Saturday, May 10, 2008

# যে ডায়েরীটা লেখা হবে না আর...(০৯)






যে ডায়েরীটা লেখা হবে না আর...(০৯)

তারিখ: নেই (অনুমান এপ্রিল,১৯৯৩)


‘পয়সা রোজগার করতে হলে মাথানীচু করতেই হয়। সত্যি সত্যিই হোক কি অভিনয় করেই হোক, যে যত বেশী রোজগার করে তার মাথা তত বেশী নোয়াতে হয়- যা বাইরে থেকে দেখা যায় না।
আমাদের মাথা কারো পায়ে শারীরিকভাবে নোয়াতে হয় না, নিজের আদর্শ ও আত্মাভিমানকে ছোট করে নিজেকে নীচু করতে হয়। সেটা একটা দারুণ কষ্টকর অভিজ্ঞতা। যার আত্মাভিমান যত বেশী, তাকে এই কষ্টটা তত বেশী করে বাজে। অভিনয়ের ছলে মাথা নোয়াতেও বাজে। অথচ মাথা না নুইয়ে এ দুনিয়ায় বাঁচাই মুস্কিল।’

- বুদ্ধদেব গুহ (একটু উষ্ণতার জন্যে)।

জীবিকার উপায় না থাকলেও প্রেম হয়তো আসে, কিন্তু প্রেমাস্পদ কাছে আসে কি না এর উত্তর যুবকের জানা নেই। এই অর্থহীন মূল্যবান জীবিকার খোঁজেই একদিন যুবকটি বেরিয়ে পড়লো। সে বেশ আগের কথা। প্রেমাস্পদ মেয়েটি রয়ে গেলো সেই পুরাতন বৃত্তে। এই বৃত্ত ভাঙার সাধ্য মেয়েটির আছে কি ? অথবা ঐ যুবকের ? তারা জানে না। হয়তো জানতে চায়ও না। প্রেমাস্পদকে খুব কাছে পাওয়ার জন্যে যুবক চলে গেলো অ-নে-ক দূরে। তারপর অ-নে-ক অ-নে-ক কথা রূপা। সে কি তোমার ভালো লাগবে ?
জীবিকার নতুন বৃত্তে জড়িয়ে পড়া অসহায় যুবকের মাথায় উপরের কথাগুলো এমোন তীব্র সত্য হয়ে ঝরতে লাগলো যে, সে বিদ্রোহী হয়ে ওঠতে চাইলো। কিন্তু এ যে অভিমন্যুর সপ্তবুহ্যের মরন-ফাঁদ ! উপায় না জেনে ঢুকলে আর বেরনো যায় না। উপায় যে তার জানা নেই ! ভেসে ওঠলো একটি মেয়ের মুখ। কী ভীষণ পবিত্রতায় মাখানো একটি মুখ ! পৃথিবী থেকে কত মনোরম দিন রাত্রি চলে যাচ্ছে, ক্ষয়ে যাচ্ছে তাকে ফাঁকি দিয়ে। মনে হলো সমস্ত পৃথিবীটাই তাকে প্রতারিত করলো, প্রতারণা করলো। ক্ষোভে দুঃখে বিদ্রোহী আত্মা ফেটে পড়তে চাইলো, সুতীব্র অভিমানে চিৎকার করে কাঁদতে চাইলো। কিন্তু এখানে কান্নার কোন স্থান নেই- কান্নাকে নির্দয় হাসির মুখোশ এটে ঢেকে রাখতে হয় !

‘এক মহরূম চলে মীর হম-হী আলম সে,
বরনহ্ আলমকো জমানহ্ নে দিয়া কেয়া কেয়া কুছ।’


(এক আমিই বঞ্চিত হয়ে চললাম, দুনিয়া থেকে ;
নয়তো কালপ্রবাহ দুনিয়াকে কতই না দিয়েছে ।) - মীর-তকী মীর।

থাক রূপা, এই যুবকের আবেগী কান্না শুনে তোমার কোন কাজ নেই। তার কান্নাকে ভাবাবেগ বলে তাচ্ছিল্যে উড়িয়ে দিলে সে আরো কষ্ট পাবে। সত্যিই তো মেয়েটিকে কাছে পাওয়ার জন্যে তার মনটা কেমোন যেনো হয়ে যায়। খোলা আকাশের নীচে দাঁড়িয়ে যুবকটি বিড়বিড় করে পাঠ করে-

‘ তুমি কি কখনও শুনতে পাও তোমাকে আমি কত ডাকি, কতবার ডাকি। তুমি কি কখনও মাঝরাতে ঘুম ভেঙে উঠে জানালায় এসে দাঁড়াও, জানালায় দাঁড়িয়ে তারাভরা আকাশের দিকে চেয়ে তুমি কি একবারও জানতে পাও যে একজন হতভাগা লোক তার গোলমেলে রুক্ষ জীবনের মধ্যে এই রাতের জানালায় দাঁড়িয়ে তোমার দিকে, তোমার ধ্রুবতারার মত নীল ও শান্ত সহজ সত্তার দিকে চেয়ে আছে। সে তোমাকে তার জীবনে অনুক্ষণ যেমনভাবে উপলব্ধি করে, তোমার অস্তিত্ব তার সমস্ত মনকে যেমন করে প্রতি মুহূর্তে আচ্ছন্ন করে রাখে, তুমি কি তাকেও তেমনি করে উপলব্ধি কর ? না কি কখনও করো না... ? কখনও বোঝ না, সে তোমাকে এ জীবনে কি দিয়েছিল !’
-বুদ্ধদেব গুহ (একটু উষ্ণতার জন্যে)।

রূপা, ‘ জীবনে এমন অনেক থাকা থাকে যা থাকাকালীন তাদের অস্তিত্ব বা দাম আমরা বুঝতে পারি না। হয়ত কেউই পারে না। যখন তা আর আমাদের থাকে না, তখনই টুকরো টুকরো কথা, বাসি ফুলের গন্ধের মত চাপা স্মৃতি ফিরে ফিরে মনে আসে। মনে না আসলে, যে-কোনো বিচ্ছেদই অনেক সুখকর হত। কিন্তু আমরা যতই কঠোর স্বার্থপর বা আধুনিক হই না কেন, তবুও তা আসে। স্মৃতির ফেউ কিছুতেই দ্রুত ধাবমান অনিশ্চয় বর্তমানের পিছন ছাড়ে না।’
-ঐ।


চলবে...

আগের পর্ব (০৮):
পরের পর্ব (১০):
R_d_B

No comments: