‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই। তা প্রকাশ করতে যদি লজ্জাবোধ হয়, তবে সে ধরনের চিন্তা না করাই বোধ হয় ভাল।’ -- প্রাচীন গ্রীক কবি ইউরিপিডিস (৪৮০-৪০৬ খ্রীঃ পূঃ)
Saturday, May 10, 2008
# ‘ছড়া পত্রিকা’ ত্রয়োদশ সংখ্যা- ‘উল্টা বুঝলি রাম’!
‘ছড়া পত্রিকা’ ত্রয়োদশ সংখ্যা-
‘উল্টা বুঝলি রাম’!
- রণদীপম বসু
প্রথম ছোঁয়া
মননশীল কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের একটি বিখ্যাত বই আছে, নাম- ‘অপ্রকাশের ভার’। কিন্তু আমার প্রসঙ্গ ওই বই বা এর নামকরণ নিয়ে নয়। সদ্য প্রকাশিত ছড়া বিষয়ক জনপ্রিয় লিটল ম্যাগাজিন ‘ছড়াপত্রিকা’ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ ত্রয়োদশ সংখ্যাটি হাতে পেয়ে এবং এর সুলুক-সন্ধান শেষে প্রথমেই যে অন্তর্গত-বোধে আক্রান্ত হলাম আমি তা প্রকাশের উপযুক্ত শব্দভাষা খুঁজতে গিয়ে ওই শব্দ-যুগলের কথা মনে এলো, অপ্রকাশের ভার।
মনের ভাবকে কিছুতেই প্রকাশ করতে না পারার কষ্ট নাকি দুর্বহ হয়। কিন্তু যে ভাবটাকে স্বতস্ফূর্ত অন্তঃকরণে প্রকাশ করতে চাওয়া হলো, তা যদি অকারণে ভিন্নার্থ নিয়ে বিপরীত উচ্চারণবাহী হয়ে ওঠে, এ ভার লাঘব হবে কী করে? ছড়াপত্রিকা’র এই ত্রয়োদশ সংখ্যায় প্রকাশের জন্য বাংলা কিশোরকবিতার গতি-প্রকৃতি, অতীত ও বর্তমান প্রবণতা এবং বিবিধ প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে ‘চারুপাঠের মগ্নকিশোর ও আমাদের কিশোর কবিতা’ শিরোনামে যৎকিঞ্চিৎ গবেষণা-প্রয়াস হিসেবে একটি সমালোচনামূলক প্রবন্ধ প্রেরণ করা হয়েছিলো। এটা নিশ্চয় শ্লাঘার বিষয়, এবং সম্পাদক মাহবুবুল হাসান ভাইয়ের কাছেও, যদিও তাঁর সাথে মুখোমুখি পরিচয়ের সৌভাগ্য হয় নি, রচনাকার হিসেবে আমার কৃতজ্ঞতা যে, প্রবন্ধটি প্রধান রচনা হিসেবে ছড়াপত্রিকায় প্রকাশ করা হয়েছে সুন্দরভাবেই। কিন্তু রচনায় প্রবেশ করে পাঠক কী বুঝলেন জানি না; তবে সাথে সাথে আমার সেই পুরনো গল্পটিই মনে হয়ে গেলো, যার তর্জমা অনেকটা এরকম-
এক সময় রেওয়াজ ছিলো, যে-অঞ্চলে কোন নদী নেই বা গ্রামের মধ্যে নির্ধারিত কোন ভাগাড়ও নেই, মরে যাওয়া পরিত্যক্ত পশুগুলোকে লোকালয়ের বাইরে বেশ দূরের কোন উন্মুক্ত প্রান্তরে ফেলে দিয়ে আসা হতো। আর হীন-দরিদ্র মুচিরা সেই বিস্তির্ণ এলাকা ঘুরে ঘুরে ওগুলো থেকে প্রয়োজনীয় চামড়া সংগ্রহ করতো। সদ্যমৃত অবস্থায় খুঁজে না পেলে যে মৃতদেহগুলো শেয়াল-কুকুর-শকুনের খাদ্য হয়ে অবশিষ্ট কিছুই থাকবে না; তাই তাড়ারও অন্ত ছিলো না। সে সময়কারই কথা। দরিদ্র সেই মুচি, যাকে সবাই মুচিরাম বলেই ডাকতো, প্রতিদিনের মতোই যথারীতি বেরুলো সেরকমই মৃত পশুর খোঁজে। প্রখর গ্রীষ্ম আর খটখটে উষর অঞ্চল, পায়ে হেঁটে ঘুরে ঘুরে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় শ্রান্ত ক্লান্ত ব্যর্থ মুচিরাম ধপ করে মাটিতেই বসে পড়লো শেষে। খরখরে ঝাপসা আকাশটার দিকে মুখ তুলে তাকিয়ে হয়তোবা প্রচলিত বিশ্বাসে ওখানেই সম্ভাব্য অবস্থান কল্পনা করে তার আরাধ্য ঈশ্বর রামের কাছে কাতর নিবেদন করলো- আহা রাম, আমার যদি একটা ঘোড়া হতো! দেবতা রাম এ কাতর ডাক শুনলেন কি না বুঝা গেলো না। তবে সত্যি সত্যি ঘোড়ার তীব্র ডাক শুনে মুচিরাম চমকে উঠলো; ফিরে দেখে সে-আমলের প্রতাপশালী হাফপ্যান্ট পরা দারোগার বাহন মাদি ঘোড়াটা সদ্য প্রসবোত্তর অস্থিরতায় চিৎকার করছে। জনমানবহীন শুষ্ক প্রান্তরে অনাকাঙ্ক্ষিত এই আকস্মিক ঘটনায় ঘোড়ার নবজাত বাচ্চাটি নিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দারোগা। হঠাৎ মুচিরামকে দেখেই হাতে চাঁদ পেয়ে গেলেন যেন। সদম্ভে হাঁক ছাড়লেন- এই মুচিরাম এদিকে আয়! মর্ত্যের মুচিরামদের সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের অধিকর্তা দারোগার হাঁক শুনে কি আর ঠিক থাকা যায়!... অতঃপর, ঘোড়ার পিঠে দারোগা, আর পেছনে নবজাত ঘোড়াটিকে পিঠে নিয়ে ন্যুব্জ মুচিরাম হাঁটছে আর আগের মতোই অবিচল ভক্তিসহকারে তার নমস্য ঈশ্বরের কাছে আক্ষেপ করছে- হা হা রাম, উল্টা বুঝলি রাম!
আমার অবস্থাও অনেকটা তা-ই। স্ব-হস্তলিখিত অক্ষরে প্রেরিত রচনাটি যখন ছড়াপত্রিকার সুদৃশ্য কড়কড়ে মলাটের ভেতরে ঠাই পেয়ে ছাপার অক্ষরের রূপ ধরে ফিরে এলো, নিজেই নিজের অভূতপূর্ব মহাপুরুষসুলভ উদারতা দেখে চম্কে ওঠলাম! এতো ভালো আমি হলাম কী করে! কার এতো বিগলিত করুণা এই অভাজনের ওপর যে এমন অকাতরে বর্ষিত হলো! হয়তো আমি বলতে চেয়েছিলাম- দীপম বাবুর চেহারাটা চমৎকার, প্রশংসা করতেই হয়। তবে তাঁর শরীরের দুষ্টতগুলো প্রকটভাবে দৃশ্যমান; ক্ষতগুলো হচ্ছে এই এই, এবং এই এই কারণে তাঁর ক্ষতগুলো সৃষ্টি হয়েছে। হয়তো ঔদার্যহীন সীমাবদ্ধ-মানষের মিঠেকড়া সংলাপ হিসেবে নিশ্চয়ই তা তুরীয়জ্ঞানে অনুত্তীর্ণ হয়েছে। নইলে তা থেকে উল্লেখযোগ্য অংশবিশেষ মুণ্ডিত হয়ে যখন সংশোধিত ও খণ্ডিত আকারে কেবল ‘দীপম বাবুর চেহারাটা চমৎকার, প্রশংসা করতেই হয়’ জাতিয় সংলাপ বর্ষিত হলো, এতে হয়তো ব্রহ্মচারিসুলভ বদান্যতার উন্নত প্রকাশ ঘটলো ঠিকই, কিন্তু মানবীয় দোষের উর্ধ্বে উঠে সত্য-প্রকাশের বিশ্বস্ততা কি অক্ষুণ্ন থাকলো? আমি তো দোষে-গুণে মিলিয়েই একজন সামান্য মানুষ। দোষের পাল্লাটা না হয় একটু বেশি ভারীই ছিলো। তাই বলে কি এতোটা উদারহস্তে নির্দোষ এই অলৌকিক গুণের দুর্বহ বোঝা চাপিয়ে আমাকে মহাপুরুষ সাজাতে হবে! সদয় পাঠক হয়তো নিজ গুণে আমাকে উৎড়ে দেবেন, কিন্তু সেই অপ্রকাশের ভার আমি লাঘব করবো কী করে? যা-ই হোক, আমি তো এখনো একজন লজ্জাশীল মানুষই।
লজ্জাকে ভাঙে কোন্ মোহন আঘাত
লজ্জা না কি ভাঙে না, লজ্জাকে ভাঙতে হয়। তাই পাঠক আসুন আমরা লজ্জা ভাঙার কাজটা না হয় শুরু করে দিই।
‘চারুপাঠের মগ্নকিশোর ও আমাদের কিশোর কবিতা’ নামের রচনাটিকে গবেষণামূলক বললে নির্লজ্জ ঢোল পেটানো হয়ে যাবে। তার চে’ বরং এটাকে একটা সমালোচনামূলক প্রবন্ধ বলাটাই যুক্তিযুক্ত হতো, যদি তা অঙ্গহানি ঘটার ভাগ্যলিপি বরণ না করতো। আমাদের দেশে প্রচলিত বর্তমানে কতগুলো প্রশস্তিমূলক কৌশলি বাক্যবন্ধ’র সাথে কিছু হাইপোথিটিক্যাল অস্পষ্টতা যোগ করে তৈরি বিশেষ ধরনের গদ্যকে সমালোচনামূলক প্রবন্ধ নাম দিয়ে চালিয়ে দেয়ার রেওয়াজ ইদানিং জোরেশোরেই ল্ক্ষ্য করা যাচ্ছে। এর বাইরে কেউ সত্যিকারের ত্রুটিগুলো চোখে আঙুল দিয়ে স্পষ্ট করে দেখিয়ে সমস্যাটা কোথায় তা চিহ্নিত করতে গেলে তো আর কথাই নেই; হন্যে হয়ে তেড়ে আসছেন অন্যেরা একযোগে। পারলে পেশির আয়তনটাও দেখিয়ে দিতে কার্পণ্য করছেন না। এসব দেখে শুনে নির্ঝঞ্ঝাট ভদ্র বিনয়ি মেধাবী সম্পাদকরা তাঁদের কাগজে সত্যিকারের সমালোচনা সাহিত্য চর্চার সাহসটাকে নিরোপদ্রব রাখতে পারছেন কি? যাঁরা একান্তই নির্বিরোধি, শেষ পর্যন্ত তাঁরা হয়তো শুদ্ধচর্চটাই বাদ রাখছেন; কেউ কেউ ছেড়েই দিয়েছেন। এতে করে সাহিত্য-পরিশুদ্ধির যে শুভ-সুযোগটা তৈরি হতে পারতো, তা না হয়ে চোখের সামনে আমাদের সাহিত্যের নন্দনকানন গুলো আগাছা-আক্রান্ত শিল্পবর্জিত জঙ্গলে পরিণত হচ্ছে। এর দায় কি আমাদের কারো নেই?
‘I am only one, but still I am one. I cannot do everything, but still I can do something;
and because I cannot do everything I will not refuse to do the something that I can do.’
-Edward Everett Hale
দায়বোধ এমনি এমনি আসে না, তাকে আনতে হয়। তাই ইচ্ছাটাকে জাগ্রত করে প্রথমে আমরা আমাদের নিজ নিজ অবস্থানটাকে যদি চিহ্নিত করে নিতে পারি যে শুদ্ধচর্চার ক্ষেত্রে আমার দ্বারা কী করা সম্ভব এবং আমি তা করতে চাই কি না, উদ্দেশ্যই বলে দেবে তখন আমার পরবর্তী কাজটা কী হবে। উপরোক্ত প্রবন্ধে একজন রচনাকার হিসেবে আমার দায়বদ্ধতা ছিলো এটাই যে, পাণ্ডিত্য না থাকতে পারে কিন্তু নিজস্ব চিন্তাসূত্রের সততা অক্ষুণ্ন রেখে বক্তব্য প্রকাশে যেন কুণ্ঠিত না হই। সে ক্ষেত্রে কিশোর কবিতা প্রসঙ্গে যাবার আগে অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত কারণে কবিতার বৈশিষ্ট্যগুলো চিহ্নিত করার একটা প্রয়াস নিয়েছিলাম। কবিতা যে কিছু শিল্পব্যাকরণ মেনে চলে এবং তা যে গৎবাঁধা কতগুলো শব্দকে জোড়াতালি দিয়ে কেবল একটা লক্করঝক্কর মালগাড়ি বানানোর কৌশলমাত্র নয় তা-ই বলার চেষ্টা করা হয়েছে। কবিতা মানেই সেরা শব্দের বিন্যাসে নির্মিত একটা বিস্ময়কর মায়াজাল। শব্দের দ্যোতনায় বুনা চিত্রকল্পময়তার মায়াবী আকর্ষণ সবাইকে কাছে টানবে কিন্তু বন্ধনে জড়াবে না। তা এমনই এক শিল্প-রসায়ন যেখানে রস আস্বাদনে উন্মুখ পাঠকের আশ্রয়ি কল্পনাও এর আবশ্যিক উপাদান হয়ে ওঠবে। বিবৃতি বা বর্ণনাধর্মীতার সুনির্দিষ্ট আক্ষরিক অর্থবোধকতার বাইরে যদি আর কোন ভাব বা দ্যোতনাময় নতুন কোন ভিন্নমাত্রিক অর্থের প্রকাশ ঘটাতে ব্যর্থ হয় তবে তা আর কবিতা হয়ে ওঠে না। ওটা তখন কেবলই পদ্য।
কিশোরকবিতার গতি-প্রকৃতি ও বর্তমান প্রবণতা নির্ধারণ করার সুবিধার্থে এ সময়ে এ অঙ্গনে যারা অগ্রণী ভূমিকায় আছেন বা পরিচিত বলে ধরা হয়, নমূনা হিসেবে তাদের ক’জনের রচনাকে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে যথাযুক্ত ব্যবচ্ছেদের জন্য; বিশেষ করে যাদের রচনাগুলো বিভিন্ন ধরনের সমগ্র হিসেবে নাম নিয়ে ইতোমধ্যে বাজারে এসে গেছে। এদের মধ্যে কবি ফারুক নওয়াজ, রহীম শাহ, সুজন বড়ুয়া ও রাশেদ রউফ অন্যতম। তাদের মধ্যে আবার কবি ফারুক নওয়াজের বিচিত্রমুখি সৃষ্টিশীল মেধা বাকীদের চেয়ে অনেক বেশি বিবেচনাবোধের স্বাক্ষর রেখেছে বলে মনে হয়। তিনি অন্তত অন্যদের মতো একগাদা পদ্য ও বর্জ্য বোঝাই করে দু’মলাট বন্দি রচনাভাণ্ডকে নির্বাচিত বা সেরা কিশোরকবিতা সমগ্র নাম দিয়ে পাঠককে প্রতারণা করার অভিযোগে অভিযুক্ত হন নি। তাঁর বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল পাঠককে আশ্বস্ত করে এ জন্যে যে, অনুত্তির্ণ ছড়া বা পদ্যকে তিনি কবিতা বলে চালিয়ে দেয়ার মানসিকতা দেখান নি। বরং তাঁর ছড়াসমগ্র হাতে নিলে পাঠক স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে উজ্জ্বল অনেকগুলো চমৎকার ছড়া তো পাবেনই, বোনাস হিসেবে আস্বাদনযোগ্য কিছু কবিতাও পেয়ে যেতে পারেন। অবশ্য উত্তীর্ণ পদ্যও রয়েছে অনেক। তবে কবিতা, পদ্য ও ছড়া’কে একই পঙক্তিভোজে সারিবদ্ধ করে কবি ফারুক নওয়াজ সাধারণ পাঠককে ধাঁ-ধা’র মধ্যে রেখে দিলেন।
অন্যদিকে বাকী ক’জনের কিশোরকবিতা সমগ্র হাতে নিয়েই আগ্রহী পাঠক যখন কবিতার রস আস্বাদনে উন্মুখ হয়ে ওঠবে, পাঠকের উত্তুঙ্গ চাওয়া কি তৃপ্ত হবে? মেড়মেড়ে পদ্যের ডোবায় ঝাপ দিয়ে পাঠক কি কবিতার নির্মল হ্রদে অবগাহনের অভূতপূর্ব আস্বাদ পেতে পারেন? ক্ষুব্ধ পাঠকের ত্যক্ত মানসিকতায় হয়তো তখন ওখানে গুটিকয় কবিতার উপস্থিতির বিষয়েও এক ধরনের অনাগ্রহ চলে আসতে পারে।
এ তো গেলো শিল্প-শিক্ষিত পাঠকের অনুভূতি। কিন্তু একেবারেই সাধারণ পাঠক ও সাবালক না হয়ে ওঠা কিশোর পাঠকরা কী শিখবেন ওখান থেকে? ক্রমহ্রাসমান কাব্যপাঠকের মধ্যে আমরা কি ‘ইহাই কবিতা’ বলে একগাদা শিল্পান্ধ প্রজন্ম তৈরি করবো?
এসব কথাই আমি ছড়াপত্রিকায় প্রবন্ধটির মাধ্যমে বলতে চেষ্টা করেছি উদাহরণ সহযোগে। কিন্তু কী সেই অদৃশ্য ভয়, যা সুযোগ্য সম্পাদক মহোদয়ের শ্যন-চক্ষুকেও ভারাক্রান্ত করে তুললো? আলোচ্য বিষয়ের প্রয়োজনেই আমাকে কবিতা কী, কেন, কীভাবে হয়, তার কীর্তি উদাহরণ টেনে বিস্তৃত ব্যাখ্যায় যেতে হয়েছে শ্রমলব্ধ বিবেচনাবোধ দিয়ে। শিল্প-বিবর্তনের অনিবার্য পরিক্রমা হিসেবে আমাদের এযাবৎ কালের প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদের দোহাকারদের লৌকিক সৃষ্টির লোকায়ত ধারাটা কীভাবে শ্রুতিনির্ভর একটা ছড়াশিল্প হয়ে লৌকিক বাংলার জীবনে যাপনে গার্হস্থ্যে পার্বণে ছড়িয়ে ছিটিয়ে কিছু কালগর্ভে হারিয়ে এবং কিছু লেখ্যরূপ পেয়ে আমাদের সাহিত্যভাষা তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে তা আলোচনায় এসেছে। এবং এভাবেই রবীন্দ্রনাথ, সুকুমার, যোগীন্দ্রনাথ প্রমুখের হাত ধরে শিশুসাহিত্যের জন্মযন্ত্রণার রূপরেখাটাও কিছু কিছু নমূনা উপস্থাপন করে দেখানোর চেষ্টা করা হয়েছে। সেই ধারাটা যে তখনো ছড়া, পদ্য, কবিতা ইত্যাদিতে বিভক্ত না হয়ে বরং একটা সমন্বিতরূপেই থাকতে চেয়েছে, তাই ল্ক্ষ্য করি আমরা। আধুনিক বাংলা সাহিত্যে ওই সময়টাকেই পণ্ডিতজনেরা রেনেসাস কাল বলে থাকেন। সেই সময়কার মেধাবী কলমচাষীরাই সাহিত্যের মূলধারাটাকে সৃষ্টিশীলতায় বেগবান রেখেছেন। এবং উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো তাঁদের রচিত সিংহভাগ সাহিত্যই ছিলো সাধারণ পাঠক তথা সবার পাঠ্য, যা তখন এবং পরবর্তিকালেও নিম্ন থেকে উচ্চ শ্রেণীর সাধারণ পাঠ্যসূচির অন্তর্ভূক্ত হয়েছে এবং এখনো আছে।
এই রবীন্দ্রনাথ বা যোগীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাপূর্ব কালপর্বে আলোচ্য কাব্যসাহিত্যের মূল পটভূমি এবং স্বাধীনতা উত্তর আধুনিক কিশোরকবিতাভাবনার দানা বেধে ওঠার প্রক্রিয়া নিয়ে ছড়াপত্রিকায় প্রয়োজনীয় আলোচনাটুকু পাঠকের গোচরে আনা হয়েছে বিধায় এখানে তা পুনরোল্লেখে না গিয়ে বরং স্বাধীনতা উত্তর কিশোরকবিতায় আধুনিকতার সংযোগসূত্রগুলো সম্পর্কে দু’য়েকটা কথা বলা নিতে চাই, যদিও তাও পুনরোল্লেখের মতোই মনে হবে।
স্বাধীনতা-উত্তর কালে এসে যখন সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটের জটিল আবর্তে পড়ে জনমানুষের মানসিকতার প্যাটার্নটাই পাল্টে যেতে থাকলো, সাথে এই কাব্যসাহিত্যেও শুরু হলো অস্থিরতা। ততদিনে অবশ্য ছড়া বা শিশুসাহিত্য আলগা হয়ে নিজস্ব আকৃতি নিয়ে বাড়তে শুরু করেছে। এই অস্থির সময়টাতেই বাংলাদেশের ছড়া ও শিশুসাহিত্যেও শিশুতোষ ও ‘সবতোষ’ বা ম্যাচির্ওড ছড়া হিসেবে পৃথকভাবে দু’টো ধারায় এগিয়ে যেতে থাকলো। এবং ছড়া থেকে শিশুতোষ কবিতাও ভিন্ন হয়ে যেতে লাগলো। এ সময়কালেই কবি আহসান হাবীব এবং এর পরেই আল মাহমুদের অবদানে এই শাখা রাতারাতি সমৃদ্ধ হয়ে ওঠলো, যদিও এ প্রক্রিয়াটা এঁরা আরো আগে থেকেই শুরু করেছিলেন নিজ নিজ মানসভূমিতে। ফলে তখনকার কিশোরকবিতায় আধুনিকতার একটা সংহত রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করি সাগ্রহ বিস্ময় নিয়ে। পরবর্তিতে এ স্রোতটা আরো সম্ভাবনা নিয়ে এগিয়ে গেলেও হুমায়ুন আজাদ ছাড়া তেমন কাউকে আর এখানে বাঁক তৈরিতে সক্রিয় প্রয়াস নিয়ে এগিয়ে আসতে দেখা যায় না। ‘চারুপাঠের মগ্নকিশোর...’ প্রবন্ধে তা তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
নদী মরলে সিকস্তি থেকে যায়
সাহিত্যে স্বেচ্ছাচার-সংশ্লিষ্ট বিষয়ে প্রবন্ধের যে অংশটা সম্মানিত সম্পাদকের খড়্গ-হস্তে খণ্ডিত ও উপড়ে ফেলা হয়েছে, তা সমালোনা-সাহিত্যের জন্য কতোটা অপ্রয়োজনীয় কিংবা জরুরি ছিলো তা সহৃদয় পাঠকের পুনর্বিবেচনার জন্যে এখানে উপস্থাপন করতে চাই। এতে প্রবেশের আগে একটা বিষয় আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাওয়া জরুরি যে, এই কিশোরকবিতার সম্ভাবনাময় উর্বরা ভূমিটাতে যা কিছু নতুন ফলন নতুন ফসল, সবটুকুই মূলধারার কবিরা এসেই মাঝে মাঝে ফলিয়ে গেছেন তাঁদের কবিসুলভ সক্ষমতার বলে। নতুন নতুন যতগুলো বাঁক বা ধারা তৈরি হয়েছে তাও ওই কবিদেরই অবদান। তাই পূর্বজ কবিদের এই অবদান স্বীকার করেই পরবর্তিতে যারা এ অঙ্গনে সার্বক্ষণিক চর্চাকারী হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন তাদের কাছ থেকে পাঠকের নতুন কিছু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষাটা অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিলো। কিন্তু হতাশাজনকভাবে এই সার্বক্ষণিক সাহিত্যকর্মীরা নতুন কিছু দেয়া তো দূরের কথা, মূলধারার মধ্যে থেকেও মূল স্রোতের সঙ্গী হতে ব্যর্থ হয়েছেন অনেকেই।
তবে এই কিশোরকবিতার মূলস্রোতের মধ্য থেকে যাদেরকে আমরা মাঝেমধ্যে উজ্জ্বল হয়ে ওঠতে দেখেছি, এখানেও রয়েছেন সেই মূল সাহিত্যধারার কবি সৈয়দ শামসুল হক, মহাদেব সাহা, নির্মলেন্দু গুণ, আবু হাসান শাহরিয়ার, খালেদ হোসাইন, টোকন ঠাকুর প্রমুখের পাশাপাশি শিশু-কিশোরসাহিত্যের আক্তার হুসেন, ফারুক নওয়াজ, আবু কায়সার, আলী ইমাম, সিকদার নাজমুল হক, হুমায়ুন সাদেক চৌধুরী, মাসুদ আনোয়ার, এমরান চৌধুরী, অরুন শীল, ইকবাল বাবুল, ফারুক হোসেন, সুজন বড়ুয়া প্রমুখ। এরকম আরো কিছু নাম হয়তো আসতে পারে। কেউ কেউ আবার নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে রাশেদ রউফ ও রহীম শাহ-এর নামও উচ্চারণ করেন, যদিও তাদের কৃতি কতোটা উজ্জ্বল তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
আর যাদের ভাণ্ডে যৎকিঞ্চিৎ উজ্জ্বল অহংকার থাকা সত্ত্বেও শুধু আদর্শিক দায়বদ্ধতা না থাকার কারণে পরবর্তিতে শিল্প-ব্যাকরণ হারিয়ে অথৈ অন্ধকারের টানে হারিয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়ে যায়, তার ট্রাজিক উদাহরণ বোধ করি সুজন বড়ুয়া। যিনি ‘বাড়ির সাথে আড়ি’র মতো কাব্যগ্রন্থে- ‘কৃষ্ণচূড়া তোমার এ নাম কে দিয়েছে, কে/ মিশকালো না হয়ে যদি লাল হয়ে ফুটবে/ আলতা রঙে এমন যদি সাজবেই বারবার/ তোমার কেন কৃষ্ণচূড়া নাম হয়েছে আর?/... (কৃষ্ণচূড়ার কাছে) -এর মতো পঙক্তি উপহার দিতে পারেন, প্রায় দু‘যুগের ব্যবধানে এসে সেই তিনিই কিনা হাতে ধরে আমাদের শিশু-কিশোর পাঠকদের সামনে কী তুলে দিচ্ছেন-
‘দু’দিনের ছুটি হাতে পেয়ে ছুটি গোপালগঞ্জ বেড়াতে/ বন্ধু আলম তালুকদারের দাওয়াত পারিনি এড়াতে/ সঙ্গী ছিলাম আমরা দু’জন, আমার সঙ্গে বিপ্রদা/ বৃষ্টির দিন মেঘের দাপটে গাড়ির নেই সে ক্ষিপ্রতা/ আকাশের মেঘ মাঠে নেমে যেন গরুদের মতো চরছে/ বাতাসে বাদলে জেলে খালে-বিলে কী মাছ ভেসালে ধরছে/... (গোপালগঞ্জ/ পতাকা আমার আয়না)।
এটা কি লেখকের আদর্শিক ট্রাজেডী, না কি পাঠক হিসেবে আমাদের অতি আকাঙ্ক্ষার ট্রাজেডী, ঠিক বুঝে ওঠতে পারি না।
ছড়াপত্রিকা ত্রয়োদশ সংখ্যার তৃতীয় পৃষ্ঠায় লেখকদের জন্য সম্পাদক কর্তৃক জ্ঞাতব্য বিষয়ের এক জায়গায় উল্লেখ রয়েছে- ‘ছড়াপত্রিকায় প্রকাশিত লেখার মতামত ও দায়দায়িত্ব সম্পূর্ণভাবে সংশ্লিষ্ট লেখকের নিজস্ব।’ তাই তো। লেখক হিসেবে এই স্বতসিদ্ধতা মেনেই তো সবাই লেখালেখি করেন। কিন্তু ঘোষণাটা কি সম্পাদক মহোদয় নিজে সত্যি সত্যি মানেন? না কি লোকদেখানো আনুষ্ঠানিকতা? বোঝা যায় না। দেখতে যত কুশ্রীই হোক পেছনে ছিদ্র না থাকলে সুঁই-এর কাজ কি আর আলপিন দিয়ে চলে? সমালোচনা-সাহিত্য মানেই তো সুঁই ফোড়ার কাজ। ছিদ্র না থাকলে সংস্কারের সুতোটা পরাবে কে? এতো যত্নে যে প্রবন্ধের সুঁইটা বানানো হলো, সম্পাদকীয় প্রকৌশলে ছিদ্রটা সযত্নে বুজে দিয়ে সৌন্দর্য বৃদ্ধি করা হলো ঠিকই, কিন্তু সে আর কার্যকর কোন সুঁই থাকলো কি? কী ছিলো সেই ছিদ্রটা, যা নাকি পুরোপুরি বুজে দেয়া হলো? এ ছিদ্রের নাম ছিলো- হাতির বর্জ্যের নীচে চাপা পড়ে চিত্রল হরিণ। কৌতূহলী পাঠকের জ্ঞাতার্থে এবার সেই ছিদ্রটা আবিষ্কার করা যাক।
হাতির বর্জ্যের নীচে চাপা পড়ে চিত্রল হরিণ
আব্রাহাম লিঙ্কনের বিখ্যাত সেই উক্তিটি আমরা সবাই জানি, আবার জানিও না- “সব মানুষকে তুমি কিছু সময়ের জন্য বোকা বানাতে পারো; আবার, কিছু মানুষকে তুমি সব সময়ের জন্যেও বোকা বানাতে পারো; কিন্তু সব মানুষকে তুমি সব সময়ের জন্য বোকা বানাতে পারো না।” পাঠককে বুদ্ধু ভাবা যে গ্রন্থকারের কতো বড় নির্বুদ্ধিতা তা যিনি না বুঝেন তাকে কি বলা যায়? এই একবিংশ শতাব্দির তুমুল সময়ে এসেও নির্বাচিত কিশোর কবিতা বা কিশোর কবিতা সমগ্র নাম দিয়ে যদি কতকগুলো পদ্যবোঝাই কাগজের মলাটবন্দি ভাণ্ড পাঠকের হাতে ধরিয়ে দেয়ার তুঘলকীকাণ্ড ঘটিয়ে কেউ বাহবা নেয়ার পায়তারি করেন, তাঁরা পাঠককে অবমূল্যায়নই করলেন! নির্বাচিত পদ্য সংকলন নাম দিলে বরং পাঠক সেখানে পদ্যের মধ্যে কোথাও কোথাও কবিতার ঝিলিক ও আস্বাদ পেয়ে গেলে গ্রন্থকারকে তাঁর সাফল্যে হাত খুলে অভিনন্দন জানানোর মওকা পেয়ে যেতেন।
ফেব্রুয়ারি ২০০৪-এ শৈলী প্রকাশন চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত রাশেদ রউফ-এর নির্বাচিত কিশোর কবিতা নামের গ্রন্থটি তেমন একটি উদাহরণ। গোটা গ্রন্থে দু-একটা লেখা কবিতা হয়ে ওঠার খুব কাছাকাছি চলে এলেও বাকিগুলো নিরেট পদ্য মাত্র। কবিতার অনিবার্য বৈশিষ্ট্য চিত্রকল্প নির্মাণ যে শুধুই কিছু শব্দসমষ্টি দিয়ে তৈরি কল্পচিত্র নয়- শ্রমনিষ্ঠ এই বোধটাকে আয়ত্বে না এনেই শব্দের ব্যবহারে আনাড়িপনার কারণে, অন্তত গুটিকয় যে লেখাগুলো বিষয়-বৈচিত্র মেনে কবিতা হয়ে ওঠতে পারতো, তা হয় নি; বিকলাংগ হয়ে গেছে।
‘যখন আকাশে গোলাপের মতো সোনালি সূর্য ওঠে/ ডিমের হলুদ কুসুমের মতো ঘোলাটে বিকেল আসে/ শিশির মাখানো চাঁদের আলোতে রজনীগন্ধা ফোটে/ তখন কেবল আব্বুর ছবি আমার দু-চোখে ভাসে/... (আব্বুকে মনে পড়ে/ নির্বাচিত কিশোর কবিতা/ রাশেদ রউফ)।
‘আব্বুকে মনে পড়ে’ শিরোনামের বেয়াল্লিশ চরণের দীর্ঘ রচনাটি পড়তে গিয়ে আবারো ‘ম্যাকলিশের’ সেই বিখ্যাত পঙক্তিটি পাঠককে স্মরণে আনতে বলি- ‘কবিতা কিছু বোঝায় না/ কবিতা হয়ে উঠে।’ বোঝাতে যাওয়ার বাহুল্যদোষে আক্রান্ত হয়ে পড়া রচনাটিতে লেখক শব্দে শব্দে অক্ষরে অক্ষরে বর্ণনাধর্মী কাহিনীচিত্র এঁকে এটাকে একটা পদ্যই বানিয়েছেন। চিত্রকল্পের প্রতীকী ব্যঞ্জনা দিয়ে গোটা লেখাটিকে কবিতায় উত্তীর্ণ করতে আরাধ্য আবেগের যে সংহতি ও পাঠককে কল্পনা বিস্তারের সুযোগ করে দিতে হয়, লেখকের বর্ণনাপ্রবণ মেড়মেড়ে মোহের কবলে পড়ে পুরোটাই ফানুস হয়ে গেছে। পাঠককে উক্ত রচনাটি একবার পড়ে দেখার অনুরোধ করি। লেখকের আক্ষরিক বর্ণনার বাইরে মায়াবী দ্যোতনার কোন সফল প্রয়াস কি চোখে পড়ে?
চিত্রকল্পের আনাড়ি ব্যবহার বা প্রয়োগে কবিতা কীভাবে মার খেয়ে যায় তার একটা নমূনা উদাহরণ-
‘শ্বেত কপোতের ডিমের মতো মিষ্টি চাঁদের আলো-/ ঝরছিল যেই, এই মনে হয়- বিশ্বটা জমকালো,/ আকাশ তখন আকাশ তো নয়, ফুটফুটে নীল শাড়ি/ চোখ জুড়ানো মন জুড়ানো মোহন মনোহারী।’... (চাঁদের হাসি ফুলের হাসি/ নির্বাচিত কিশোর কবিতা/ রাশেদ রউফ)।
‘শ্বেত কপোতের ডিমের মতো মিষ্টি চাঁদের আলো’- চাঁদনি রাতের কী অদ্ভুত সুন্দর এক চিত্রকল্পময় ব্যঞ্জনা! সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। কিন্তু কবি যখন রাতের আকাশটাকে ‘ফুটফুটে নীল শাড়ির’ হটকারী রূপক দিয়ে পাঠকের চোখ ফুটো করে দিলেন, তখন সত্যিই প্রশ্ন জাগে, হতে গিয়েও কবিতা হয়ে না ওঠার আক্ষেপটা কি পাঠককে এভাবে ভারাক্রান্ত করতো, যদি লেখক অন্তত একটিবার কবির দৃষ্টি দিয়ে রাতের আকাশটাকে আগ্রহভরে দেখতেন! রাতের আকাশ কি নীল হয়?
শব্দের ব্যবহারও যে কী ভয়াবহ হতে পারে রাশেদ রউফের লেখা থেকে আরেকটি নমূনা না টানলে শেষপর্যন্ত পাঠককেই বঞ্চিত করা হবে। ‘কোথাও যাবো না আমি’- একটি ভালো লেখা হতে পারতো। রচনাটিতে প্রচলিত কিশোরকাব্য প্রকরণের ভাঙচুরকে অবশ্যই সাধুবাদ জানাই। এখানে তিনি বৈচিত্র সৃষ্টির প্রয়াস করেছেন। কিন্তু একটি সম্ভাবনার মাথায় বজ্রপাত ঘটে রচনাটির সর্বশেষ পঙক্তিতে এসে-
‘কোথাও যাবো না আমি, এ ঘরে নীরবে/ শুধু ঘুমাবো,/ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সব লাল-শাদা-নীল/ স্বপ্ন খাবো।’
যেখানে শেষ করলেন তিনি, সেই ভয়ঙ্কর ‘খাবো’ শব্দটি খেয়াল করুন। তাঁর শিল্পক্ষুধা বুঝি এতোই প্রবল হলো যে, ঘাড় ধরে অন্ত্যমিল করতে গিয়ে তিনি ‘স্বপ্ন’ তো খেলেনই, একই সাথে কবিতাটাকেই খেয়ে ফেললেন!
আরো খারাপ অবস্থা বইপড়া প্রকাশনী থেকে বইমেলা ২০০৪-এ প্রকাশিত রহীম শাহ’র ‘নির্বাচিত কিশোর কবিতা’ নামের গ্রন্থটির ক্ষেত্রে। কবিতা হয়ে ওঠার মতো একটি লেখাও চোখে পড়ে নি।
‘শীতের পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে আসছে/ শীতের পাখিরা হাওড়ের জলে ভাসছে/ সরালি লেন্জা লালশির নীলশির/ চখাচখি ভূতি দীঘরেরা করে ভিড়/ ’... (শীতের অতিথি/ নির্বাচিত কিশোর কবিতা/ রহীম শাহ)।
এ জাতীয় পদ্য লেখা দোষের কিছু নয়; ওটাও একটা সাহিত্য মাধ্যম বৈ কী। তবে পাঠককে প্রতারণা করে নয় নিশ্চয়ই। ইদানিং বুঝে না বুঝে অনেকেই এই স্থূল প্রবণতায় যে আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছেন, তাও কিন্তু পাঠকের চোখ এড়ায় না।
ভুল করতেও ভুল হয়
যতটুকু জেনেছি ছড়া বিষয়ক জনপ্রিয় লিটল ম্যাগাজিন ছড়াপত্রিকার প্রথিতযশা মেধাবী সম্পাদক ছড়াকার মাহবুবুল হাসান অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। অবশ্যই তিনি আমার শ্রদ্ধাভাজন। তাঁকে বা কাউকে ছোট করার জন্য এ লেখা নয়। কিন্তু সময় বড় নির্মম। মহাকাল কাউকে না কাউকে দিয়ে উদ্দিষ্ট কাজটি ঠিকই করিয়ে নেয়। সাহিত্যের ক্ষেত্রে মহাকালের তিলক হচ্ছে পাঠকের শতদ্রু চোখ। কাল সাক্ষী, কখনো না কখনো সবাইকেই এ টেবিলে এসে ব্যবচ্ছেদ হতেই হবে। টিকে থাকার শর্তই এটা।
সবাই সব সময় ভুল না করলেও কেউ কিন্তু ভুলের উর্ধ্বে ওঠতে পারেন না। তাই ছড়াপত্রিকার প্রধান রচনাটির জন্য সংশ্লিষ্ট সম্পাদকীয় দৃষ্টিভঙ্গী অনযায়ী ভুলক্রমে যে ভুল করতে আমি ভুল করি নি, তার শল্যচিকিৎসা করতে গিয়ে মাননীয় সম্পাদক কিন্তু অজ্ঞাতে সেই ভুলটিই করলেন। প্রবন্ধের উপ্ড়ে ফেলা কর্তিত অংশের লিঙ্ক হিসেবে ছড়াপত্রিকার উনষাট পৃষ্ঠায় গ্রন্থসূত্রের ৭ ক্রমিকে ‘পতাকা আমার আয়না/ সুজন বড়ুয়া/ বাংলাদেশ শিশু একাডেমী/ ফেব্রু ২০০১/ ঢাকা’ এবং ১৬ ক্রমিকে ‘নির্বাচিত কিশোর কবিতা/ রহীম শাহ/ বই পড়া/ বইমেলা ২০০৪/ ঢাকা’ এই প্রদর্শিত সূত্রদু’টো মুছতে ভুলেই গেলেন। বুদ্ধিমান মেধাবী পাঠক কিন্তু এই রয়ে যাওয়া সূত্রের লিঙ্ক ধরে ভেতরে ঘটে যাওয়া কোন ভৌতিক ঘটনা আঁচ করে নিতেই পারেন।
তবে রসিক পাঠকের প্রতি অনুরোধ, ব্ক্ষ্যমান নিবন্ধটি পূর্বোল্লিখিত ছড়াপত্রিকা ত্রয়োদশ সংখ্যা ফেব্রুয়ারি ২০০৮ এর সংশ্লিষ্ট ‘চারুপাঠের মগ্নকিশোর ও আমাদের কিশোরকবিতা’ শিরোনামের প্রবন্ধটির সাথে মিলিয়ে পড়লে বরং আমার অপ্রকাশের ভার কিছুটা লাঘব হবে বলে মনে করি। ##
[একফর্মা ছড়াপত্র, পঞ্চম সংখ্যা, বৈশাখ ১৪১৫]
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment