‘চিন্তারাজিকে লুকিয়ে রাখার মধ্যে কোন মাহাত্ম্য নেই। তা প্রকাশ করতে যদি লজ্জাবোধ হয়, তবে সে ধরনের চিন্তা না করাই বোধ হয় ভাল।’ -- প্রাচীন গ্রীক কবি ইউরিপিডিস (৪৮০-৪০৬ খ্রীঃ পূঃ)
Saturday, May 10, 2008
# রুহির সকাল
রুহির সকাল
-রণদীপম বসু
ঘড়িতে সাতটা বাজে। মানে সকাল সাতটা। রুহি জানে, এখুনি কলিং-বেলটা বেজে ওঠবে। ছুটে গেলো জানলার পাশে। সারি সারি ফ্ল্যাট বাড়িগুলোর ফাঁক দিয়ে গলিটা খুব একটা দেখা যায় না। তবু যতটুকু চোখ যায় দেখছে সে। কিন্তু কই, দেখা যাচ্ছে না তো কাউকে। আর তর সইছে না তার। আসছে না কেন, কী হলো আজ ?
কাউকে দেখছে না বললে ভুল হবে। ‘আছে.এএএ.. লাউ কলা পটল পেঁয়া..জ !’ সব্জিঅলার হাঁকে পাশের ফ্যাটের আণ্টি, প্রান্তিকের আম্মু বেলকনি থেকে ‘এই সব্জি, দাঁড়াও’ বলে ভেতরে চলে গেলেন। ‘লাগবেএএএ মাআআআছ, কেচকি মাআআআছ...!’ ভেসে আসা মাছঅলার ডাকে আশেপাশের বিল্ডিং-এর কয়েকটা কলাপসিবল গেট খোলার শব্দ ভেসে আসে। কিন্তু যার জন্য রুহি উন্মুখ হয়ে আছে, তাকে তো দেখা যাচ্ছে না। পেছনের ফ্ল্যাটের অনিক তার আম্মুর সাথে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে সব্জিঅলাকে পাশ কাটিয়ে সকালের শিফটে যাচ্ছে। শুক্রবারেও তার কোচিং খোলা। উপরে মুখ তোলে দোতলার জানলায় সহপাঠি রুহিকে দেখেই অনিক চিৎকার করে ওঠে- ‘এই রুহি..।’ হাত নাড়তে নাড়তে সে চলে যায়।
রুহির মতো অনিকেরও কোচিং একদম পছন্দ না। সারাক্ষণ পড়া আর পড়া কার ভালো লাগে ! এদিক থেকে রুহির ভাগ্যটা ভালোই। মামনিই এখনো তাকে পড়ান। ফলে কোচিং-এর ঝামেলা থেকে বেঁচে গেছে সে। কিন্তু বেচারা অনিক ! সকালে সেই যে স্কুলে যায়, কেমন বিষণ্ন হয়ে থাকে। ক্লাস শেষে রুহিরা যখন স্কুলের সামনে খোলা মাঠটায় খেলাধূলা করবে, অনিককে তখন দৌঁড়াতে হবে কোচিং এ। বিকেল গড়িয়ে বাসায় ফিরতে দেরি হলে খেলতে যাবার আনন্দটাই মাটি হয়ে যায় তখন। তবু সে মিস দিতে চায় না। আম্মু চোখ-মুখ রাঙিয়ে ‘অনিক, কিছুণ বিশ্রাম নাও, শরীর খারাপ করবে’ বলে যতোই রুখতে চান না কেন, সে আম্মুর কথা মানেই না। ঝুপঝাপ করে চলে আসে সরু গলিটাতে। যেখানে আরিফ রুহি নাফিজরা হয়তো আগে থেকেই ক্রিকেট ক্রিকেট খেলছে। অনিক এলে তাকেও রুহিরা নিয়ে নেয়। মেতে ওঠে খেলায়।
কিন্তু সেদিনের পর থেকে রুহির জন্য খেলাটাও বন্ধ হয়ে গেছে। গলির একদিক থেকে নাফিজ প্লাস্টিকের বলটা ছুঁড়ে দেয়। এপাশে আরিফ বলটা লক্ষ্য করে ছোট্ট ব্যাটটাকে সজোরে এগিয়ে দেয়। মিস। পেছনের দেয়ালে গিয়ে ঠাশ করে বাড়ি খেয়ে ফিরে আসে। পরের বারে বলটা ছুটে যায় সামনে। পাশের ফ্ল্যাটের বাউণ্ডারি ওয়ালে বাড়ি খেয়ে থেমে যায়। মাঠ তো নেই। বলের সীমানা যে এই গলিটাই। কিন্তু অমিত ব্যাট হাতে প্রথমবারেই বলটাকে সজোরে উড়িয়ে দেয়। ধাম করে সোজা নাহিদ আন্টিদের কাঁচের জানালায়। ঝন ঝন করে গ্লাস ভাঙার শব্দে হৈ হৈ করতে করতে আন্টি বেলকনিতে বেরিয়ে আসেন। তাঁর বকাবকি চেঁচামেচিতে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে গলিটা। ততক্ষণে বল রেখেই রুহিরা ভোঁ দৌঁড় যার যার ফ্ল্যাটে। দূর থেকে ভেসে আসা চেচামেচি শুনতে শুনতে হাঁফাতে থাকে ওরা। আর অপেক্ষায় থাকে, এই বুঝি শুরু হলো মা’র ধমক।
ভাড়া বাসায় থেকে এসব ঝামেলা আর মানুষের তীর্যক কথা একদম পছন্দ নয় বলে মামনি কড়া নিষেধ দিয়েছেন রুহিকে। তাই সে এখন আর খুব একটা নীচে খেলতে যায় না। কিন্তু করবে কী ? স্কুল থেকে ফিরে চলে আসে জানলাটার পাশে। হেলান দিয়ে বাইরের পৃথিবীটা দেখতে থাকে। কত কিছু যে দেখে ! কখনো কখনো চেয়ারটা টেনে নেয় কাছে। যতক্ষণ স্কুলে থাকে, সহপাঠি বন্ধুদের সাথে চমৎকার কেটে যায়। ছুটি হলে স্কুলের মাঠে তাদের সাথে হৈচৈ দৌঁড়-ঝাঁপ করতে করতে বাকি সময়টা এত দ্রুত কাটে যে, ভ্যান আঙ্কেলের নরম কণ্ঠের ‘রুহি আসো’ ডাকটাকেও অসহ্য মনে হয়। কিন্তু কিছুই করার নেই। ঘেমে নেয়ে একাকার রুহি বিষন্ন মনে ভ্যানে চড়ে বসে।
জানালাটা অত্যন্ত প্রিয় তার। মাঝে মধ্যে বেলকনিতেও বসে। কিন্তু জানলাটা সত্যি অন্যরকম। কেমন মায়া মায়া লাগে। কখনো কখনো মজার মজার গল্পের বই নিয়ে বসে। বাপি তাকে অনেকগুলো বই কিনে দিয়েছেন। বইমেলাতে বাপির সাথে বাংলা একাডেমীতে গিয়েছিলো। কী ভীড় ! কত্তো লম্বা লাইনে এক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে একটু একটু করে এগিয়ে অবশেষে মেলায় ঢুকতে পেরেছে। কত্তো মানুষ ! আর যে দিকেই তাকানো যায় বই আর বই। কতো যে দোকান আর কতো কতো বই ! কী মজার মজার বই সব ! হাতে নিলেই নিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু এতো বই কি নেয়া সম্ভব ! বাপি আবার এ দিকে খুব ভালো, বই কিনে দেন। কিন্তু কখনো কখনো কেমন যেন মনে হয় তাঁকে, যখন গম্ভীর গলায় বলেন- ‘না, এটা পড়ার বয়স এখনো হয় নি তোমার !’ বই তো বই-ই। এটার আবার পড়ার বয়স কী ? কিন্তু বাপি নাছোড়। তবে হাঁ, ছোটদের বইগুলো ঠিকই কিনে দিয়েছেন। এতোগুলো বই দু’জনে হাতে ঝুলিয়ে তারপর বাসে রিক্সায় চড়ে বাসায় ফিরতে কী কষ্টটাই না হয়েছে !
আচ্ছা, আসছে না কেনো এখনো ? ঘড়ির দিকে চোখ যায় তার। সাতটা পনের ; মানে সোয়া সাতটা ! নীল ফ্ল্যাটের কোণা দিয়ে গলির মোড়ে একটু করে রাস্তাটা দেখা যায়। কিন্তু ওখানেও তো কাউকে দেখা যাচ্ছে না। পাশের ঘরে উঁকি দিয়ে আসে, বাপি এখনো ঘুমোচ্ছে। অফিস ছুটি থাকলেই সেদিন বাপি দেরি করে ঘুম থেকে ওঠবে। আগের দিন রাত করে লেখালেখি করবে, বই পড়বে। রুহির অবশ্য রাত করার উপায় নেই। তারও মাঝে মাঝে ইচ্ছে করে বেশি রাত করে টিভি দেখবে, নয়তো গল্পের বই পড়বে। কিন্তু এগারটা বাজলেই বাপির গম্ভীর গলা- ‘রুহি, ক’টা বাজে এখন ?’ রান্নাঘর থেকে হাড়ি পাতিলের ঠুং ঠাং আওয়াজ আসছে। মামনি ঘুম থেকে উঠে গেছে। ওখানেও একটু চুপি দিয়ে আসে সে।
সাতটা পঁয়ত্রিশ। মানে সাড়ে সাতটাও পেরিয়ে গেছে ! একটু পরে আটটা বাজবে। তারপরে ন’টা ! শেষপর্যন্ত যদি না আসে ? ছটফট করছে রুহি। তার কি এখন কান্না পাবে ? যেদিন রুহির মনে খুব কষ্ট হয়, জানলার কাছে সব খুলে বলে, কথা বলে। জানলাও তাকে মজার মজার গল্প বলে। জানলাটাই যে সারাক্ষণের সঙ্গি। বাসায় আর কোন সঙ্গি নেই তার। মাঝে মাঝে জানলাটাও কেমোন যেন হয়ে যায়। কোন কথাই বলে না তখন। সেদিন কী ভেবে মামনিকে বললো- ‘আচ্ছা মামনি, তুমি একটা ডিম পাড়ো না কেন ?’ রুহির কথা শুনে মামনি বড় বড় চোখ করে তার দিকে তাকায়। তিনি কথার অর্থ ধরতে পারেন না। ‘এ কথা বলছো কেন রুহি ?’ ‘কেন, তুমি জানো না, ডিম না পাড়লে যে বাচ্চা হয় না ! বাপি যে আমাকে পাখির বইটা কিনে দিয়েছে ওটাতে পড়েছি আমি। আমার যে একটা খেলার সাথি হতো।’ রুহির জবাবে মামনি তার দিকে কেমন করে যেন তাকিয়ে থাকে। জন্ম রহস্যের এমন সরল প্রক্রিয়া জেনে রুহির বিরাট একটা রহস্যের সমাধান হয়েছে। এতো সহজ একটা বিষয়। মামনি ইচ্ছে করলেই রুহির জন্য এভাবে একটা খেলার সঙ্গি এনে দিতে পারেন। কিন্তু কেন যে করছে না !
জানলার বুক ফুঁড়ে গলির মতো আকাশটাও খানিকটা দেখা যায়। সেদিকে তাকিয়ে রুহি জিজ্ঞেস করে, আচ্ছা জানলা, দিনের বেলায় আকাশের তারাগুলো কোথায় যায় ? জানলা বলে, তুমি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে চেনো ?
তুমি কার কথা বলছো? আমাদের বইয়ে যে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের কী সুন্দর ছড়া আছে,তাঁর কথা ?
হাঁ। তিনি বলেছেন, রাতের সব তারাই থাকে দিনের আলোর গভীরে।
হুম, মনে পড়েছে, বাপি মাঝে মাঝে একটা কবিতা পড়েন। ওখানে এই কথাটা আছে। কিন্তু.. আলোর গভীরে আবার তারা থাকে কীভাবে ?
বাপির কাছে জানতে চাও নি ?
হুম, চেয়েছি।
তারারা আসলে কোথাও যায় না। তুমি কি তারা দেখো, না কি তারার আলো দেখো ?
ওটাকেই তো সবাই তারা বলে।
দিনের আলো তারার আলোর চেয়ে বেশি তীব্র ঝলমলে হওয়ায় ওই তারাগুলোকে তখন দেখা যায় না।
জানলা, তুমি কি জানো আমার যে এখন মন খারাপ ?
হাঁ জানি !
মন ভালো হওয়ার জন্য তুমি কিছু বলছো না কেন ?
তোমার যে বইটা পড়তে খুব ভালো লাগে ওটা নিয়ে বসতে পারো। মন ভালো হয়ে যাবে।
জানলার পাশে বসে প্রিয় বইটা ওল্টেপাল্টে মজার মজার ছবিগুলোর সাথে কখন যে গল্পের মায়াবী জগতে হারিয়ে যায় রুহি, টেরই পায় না। বই, জানলা, রুহি একাকার হয়ে যায়।
আচ্ছা জানলা বলো তো, ছড়াগুলো বইয়ের মধ্যে এমন নাচতে থাকে কেন ?
ছড়ার পায়ে তাল বেঁধে দেয়া আছে যে।
তাই নাকি !
এমন তালে তালে ছন্দ মিলানোর খেলাটা রুহিকে খুব আকর্ষণ করে। সেও মাঝে মাঝে এরকম চেষ্টা করে। সে দিন তো মামনি দেখেই বলে ফেললেন- বাহ্, কী সুন্দর হয়েছে রুহি ! কিন্তু বাপিটা কেমন যেন। চাপা চাপা গলায় বলেন- ‘হুম, ভালোই ; তবে তোমাকে আরো পড়তে হবে।’ বাপি কি ঠিকই বুঝে ফেলেন, ছড়ার বইয়ের কোন্ মজার ছড়াটার শব্দগুলো ওল্টে পাল্টে এটা তৈরি করা ? তিনি বলেন- ‘ঠিক আছে, এভাবেই শিখতে হয় প্রথমে। চেষ্টা করো। আস্তে আস্তে তখন নিজেই লিখতে পারবে।’
মনটা দমে আসে। কিন্তু তারই সমসাময়িক কতো ছেলেমেয়েদের কতো ছড়া যখন পত্রিকায় ‘তোমাদের ছড়া’ নাম দিয়ে ছাপানো দেখে, রুহির বুকে কোথায় যেন একটা ইচ্ছে কুড়কুড় করে বাজতে থাকে। ইশ্, তার লেখাও যদি এভাবে পত্রিকায় ছাপা হতো ! কী মজা হতো ! সবাই দেখতো রুহির ছড়া পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। বেলকনিতে দাঁড়িয়ে সবাইকে পত্রিকা দেখিয়ে বলতো- এই দেখো, পত্রিকায় আমার ছড়া ! সবাই তখন হা করে দেখতো আর চোখ উপরে তোলে বলতো, বাহ্ বাহ্ আমাদের রুহি তো দেখি সাংঘাতিক ছেলে ! ব্যাগে করে পত্রিকাটা স্কুলে নিয়ে সবাইকে দেখাতো। ক্লাশে টিচার যখন রুহিকে সবার সামনে বলতেন- ‘সাব্বাশ রুহি ! তুমি আমাদের গর্ব। চেষ্টা করো, তুমি অনেক বড় হবে।’ বুকটা গর্বে ফুলে ওঠতো তার। সবাই যখন রুহির মতো কেন হতে পারলো না বলে আফসোস করবে আর চোখ বড় বড় করে রুহিকে দেখবে, সে তখন সজলের দিকে আড়চোখে চাইবে। প্রথম আলোতে একদিন সজলের মিনি ফটোসহ তার আঁকা একটি ছবি ছাপা হলে স্কুলে এনে সবাইকে দেখিয়েছে সে। কেন জানি সজলকে তখন রুহির কাছে অনেক বড় উপরের মনে হয়েছে। সজল তার দিকে চাইলেই মনে হতো সে বুঝি চোখে চোখে রুহিকে বলছে- তোমরা এসব পারবে না। চেষ্টা করে দেখো পারো কি না। মনে মনে রুহিরও জেদ চাপে, শব্দে শব্দে ছন্দগাথার চেষ্টা করতে থাকে সে।
সেদিন যখন ছড়াটা বাপিকে দেখালো, বাপি কতোক্ষণ লেখাটার দিকে চেয়ে থাকলেন। ‘ভালোই তো। তবে এই এই জায়গাটায় একটু সমস্যা রয়েছে। দেখো ঠিক করতে পারো কি না।’ মনটা আবারো চিমসে গেলো তার। উদ্যমটা যেন ঝিমিয়ে গেলো। মুখ বেজার করে লেখাটা নিয়ে আবার টেবিলে বসলো। ধীরে ধীরে কেমন একটা ঘোরের মধ্যে চলে গেলো সে। পরেরবার বাপি দেখে বললেন- ‘হুম, আগের চাইতে ভালো হয়েছে। তবে..’ আর কিছু বলার আগেই বাপির মুখের কথা কেড়ে নিয়ে রুহিই বলে ওঠলো- ‘দেখো বাপি, এবার কিন্তু ঠিক হয় নাই বলতে পারবে না !’ হেসে দিলেন বাপি। ‘ঠিক আছে, দাও আমিই সামান্য ঠিক করে দেই।’ তাই তো ! দু’একটা শব্দ একটু এদিক ওদিক করতেই ছড়াটা কেমন ঝলমল করে ওঠলো। রুহির উজ্জ্বল চোখ মুখ দেখে বাপি তাকে সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন। কিন্তু রুহি এখন যে কথাটা বলতে চায় বাপিকে, বলবে কী করে ? পাশেই দাঁড়িয়ে থাকে। কম্পিউটর মনিটরে চোখ রেখেই বাপি বললেন, ‘কী, কিছু বলবে ?’
পত্রিকা অফিসের ঠিকানাটা খামের উপরে রুহিকে দিয়েই লিখিয়ে নিলেন বাপি। কিন্তু সমস্যা হলো বাপির কিছুই মনে থাকে না। মামনি যেমন রোজ বাপিকে অফিসে যাবার সময় মনে করিয়ে দেন ‘এই চাবি নিয়েছো ? মানিব্যাগ, মোবাইল ?’ বাপিটা যে কী ! ঠিকই ভুলে গেছে। এতো গুরুত্বপূর্ণ জিনিসও ভুলে যায় ! রুহিই বাপির হাতে খামটা তুলে দিলো। আর বারবার স্মরণ করিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলো- ‘বাপি তোমার মনে থাকবে তো পোস্টাফিসে ছাড়তে ? না কি ভুলে যাবে সেদিনের মতো ?’ সন্ধ্যায় অফিস ফিরে ঘরে ঢুকতে না ঢুকতে সবার আগে রুহির জেরা- ‘চিঠিটা ছেড়েছো তো ?’ বাপি তার আশঙ্কা দূর করে দেন মাথার চুলে আলতো হাত বুলিয়ে ‘হাঁ হাঁ, এটা কি ভুলা যায় ?’
হঠাৎ করে শুক্রবারটা কেন জানি অনেক দূরে চলে গেছে। দিনগুলো ভীষণ লম্বা হয়ে গেছে ! শেষ যেন হতেই চায় না। শুক্রবারে ছোটদের পাতায় রুহির ছড়া ছাপবে। এই সরল বিশ্বাসে বাপি বা মামনি কেউ চোট দেন না। বলেন- ‘হাঁ অপেক্ষা করো, যোগ্য মনে করলে তো ছাপবেই।’ রুহি আর অতশত বোঝে না। ছোটদের পাতায় যে লেখাগুলো ছাপে, রুহির ছড়াটা কি ওগুলো থেকে কোন অংশে খারাপ ? ওটা ছাপতেই হবে। নইলে.., আর ভাবতে পারে না সে। কান্না এসে যায়। কিন্তু শুক্রবার তো আসতেই চায় না !
রোজ ছ’টায় বিছানা ছাড়ে সে, সাতটায় স্কুলের ভ্যান নীচে চলে আসে। ঠিক ওই সময়টাতে অর্থাৎ সাতটাতে কলিংবেলটা আলতো করে ক্রিং শব্দে জানিয়ে দেয় পত্রিকা দিয়ে গেছে হকার। রুহিও সে অপেক্ষায় থাকে। মোড়াটা টেনে দরজার কাছে নিয়ে উপরের ছিটকারিটা নামিয়ে দ্রুত ধুপধাপ করে নেমে গিয়ে পত্রিকাটা নিয়ে আসে। সকালের কড়কড়ে পত্রিকাটা ওল্টেপাল্টে দেখতে অসম্ভব ভালো লাগে তার। ওল্টেপাল্টে ছবিগুলো দেখে। তারপর বানান করে করে পত্রিকার হেডলাইনগুলো পড়ে। কতো রকমের কথা আর খবর যে পেপারের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায় ছাপা। বাসায় পত্রিকার প্রথম পাঠকই রুহি। বাপি তো অফিসে বেরোবার আগে চা খেতে খেতে দ্রুত পাতা ওল্টান আর অফিস ফিরে সন্ধ্যায় চা খেতে খেতে পড়েন। মামনি সকালে রান্নাঘরে ব্যস্ত থাকেন। তাঁর পত্রিকা পড়া সেই বিকেলে ; নাওয়া খাওয়া শেষে লম্বা অবসর নিয়ে বিছানায় বসে বসে। তার আগেই বিবিসি-বাংলাদেশের সম্প্রচারে খবরের আগাম ধারণা পেয়ে যান তিনি। বিবিসি-বাংলাদেশ হচ্ছে ঠাট্টা করে রুহিকে মামনির দেয়া নাম। যতক্ষণ বাসায় থাকে সে সারাক্ষণ পত্রিকার খবর স্কুলের খবর সহপাঠিদের খবর ফেরিঅলার খবর কাকের খবর বিড়ালের খবর কালকের খবর পরশুর খবর দু’বছর আগের খবর দু’বছর পরের খবর এমন কোন খবর নেই কানের কাছে যার বিরতিহীন সম্প্রচারে মামনি নাকাল হয়ে ওঠেন না। কখনো ধমক দিয়ে থামিয়ে দিলে মুখটা কালো করে চুপচাপ চলে এসে জানলাটার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। একসময় জানলার সাথে শুরু হয় কথোপকথন পর্ব। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা ভিন্ন।
উত্তেজনায় গতরাতে ঘুমই আসছিলো না রুহির। ইশ্, চোখের পলকেই যদি রাতটা পেরিয়ে যেতো ! সকালে পত্রিকাটা উল্টেই দেখবে গুটগুট অরে ছাপানো রুহির ছড়া ! শুক্রবার অফিস ছুটি থাকায় বাপিও দেরিতে ঘুম থেকে ওঠবে। মামনিও। কিন্তু রুহি ঠিকই বাপিকে ঝাঁকিয়ে বলবে- বাপি দেখো দেখো আমার ছড়া ছেপেছে পত্রিকায় !.. এসব ভাবতে ভাবতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে জানে না সে। ঘুম ভেঙে কয়েক মুহূর্ত, হুড়মুড় করে নেমে গেলো বিছানা থেকে। ঘড়িতে পাঁচটাও বাজেনি। এঘর ওঘর করতে থাকে।
কিন্তু কী হলো আজ ? সাড়ে আটটা ! রুহির ছটফটানি দেখে মামনি জিজ্ঞেস করেন- কী রে, কী হয়েছে তোর ? ‘মামনি, এখনো পত্রিকা আসছে না কেন !’- প্রায় কেঁদে দেয়ার অবস্থা রুহির। ‘আসেনি আসবে, হয়তো কোন সমস্যা হয়েছে।’ মামনির এমন কাঠখোট্টা জবাব মনঃপূত হয়নি তার। বিষন্নভাবে কী যেন বলতে যাচ্ছিল সে, ক্রিং করে বেজে ওঠলো কলিং বেলটা। পড়িমরি করে দৌড় দিলো রুহি। দরজার উপরের ছিটকারিটা আগেই খুলে রেখেছে সে, ধুপধাপ ধুপধাপ সিঁড়ি ভেঙে বিপজ্জনকভাবে নীচে নেমে গেলো। কলাপসিবল গেটের ভেতরে ঐ তো মেঝেতে পড়ে আছে পত্রিকাটা। হার্টবিট বেড়ে গেছে তার। ছো মেরে তুলে নিলো পেপারটা। কিন্তু এ কী ! অত্যন্ত দ্রুততার সাথে ভেতরের পৃষ্ঠাগুলোও ওল্টাতে লাগলো সে। হায় হায় ! এ কী দেখছে সে ! লক করা গেটের ভেতর থেকেই ‘হকার আঙ্কেল হকার আঙ্কেল’ বলে চিৎকার করতে লাগলো।
চেচামেচি শুনে তরুণ হকার আঙ্কেল সাইকেলটা ঘুরিয়ে গেটের সামনে এলো। কিছু বলার আগেই রুহি চিৎকার করছে- এটা কী দিয়েছেন ! পেপারে তো কিছুই লেখা নাই ! সাদা ! এগিয়ে দেয়া পত্রিকাটার কপালে শুধু পত্রিকার লোগোটাই আছে, বাকি জায়গা ও পৃষ্ঠাগুলো একেবারে ফাঁকা। ধবধবে। উপরের ডান কোণায় শুধু কালো কালো বক্সে সাদা হরফে লেখা- ‘আজ কোন খবর নেই।’
উর্ধ্বশ্বাসে আরো কিছু বলার আগেই হকার আঙ্কেল তাকে থামিয়ে দিয়ে সবগুলো পত্রিকাই একে একে দেখালো। সবকটারই এক অবস্থা ! হকার আঙ্কেলের মুখটাও কেমন যেন ভারি ভারি ঠেকছিলো।
কী সাংঘাতিক কথা ! আজ কোন খবর নেই, এটা হয় নাকি ! গতরাতে এতোবড়ো ঝড় হলো, না জানি কতোগুলো গাছ উপড়ে ফেলেছে ! এটা কোন খবর না ? বিকেলে যে ওইদিকে কোন বিল্ডিংয়ে আগুন লেগে সব পুড়ে গেছে, হৈ হৈ করতে করতে কত মানুষ দৌঁড়ে গেছে ওদিকে, বেলকনি থেকে রুহি মামনি মামনি চিৎকার করেছে- দেখো আগুন ! ওটা কোন খবর না ? কাল সন্ধ্যায় যে টিভিতে বাস দুর্ঘটনার খবর শুনেছে, কতজন মারা গেছে, এটা কোন খবর না ? রুহি যে এত্তো সুন্দর একটা ছড়া পাঠিয়েছে, ওটা কি কোন.... !
হকার আঙ্কেল তার সাইকেল নিয়ে চলে গেছে কখন। হঠাৎ উদ্ভ্রান্ত আতঙ্কিত রুহি ‘মামনি মামনি‘ চিৎকার করতে করতে সিঁড়ি ভেঙে উপরে দৌঁড়তে লাগলো। মামনি মামনি.. উফ..! ধাম করে হোঁচট খেলো। ধপাশ করে পড়লো নীচে, সিঁড়ির গোঁড়ায়। দমবন্ধ হয়ে আসছে যেন। দৌঁড়ে এলো মামনি- কীরে বাবা, কী হয়েছে ? ব্যথা পেয়েছিস ? মামনির এমন অভয় দেয়া কথায় ব্যথাট্যথা সব ভুলে গেলো। ধীরে ধীরে উঠে বসলো। কিন্তু এ কী ! সিঁড়ি কোথায় ? এখানে খাট এলো কোত্থেকে ? দেয়াল ঘড়ির দিকে চোখ গেলো তার। মানে ! ঘড়িতে সাতটা বাজে ! ক্রিং করে বেজে ওঠলো কলিংবেলটা হঠাৎ !
মনে পড়ে গেলো রুহির, আজ শুক্রবার ! আচমকা ছুট লাগালো দরজার দিকে। নীচে পত্রিকা এসেছে ! //
(০৩/০৫/২০০৮)
Subscribe to:
Post Comments (Atom)
No comments:
Post a Comment