Friday, June 20, 2008

# যে ডায়েরীটা লেখা হবে না আর...(২৩)







যে ডায়েরীটা লেখা হবে না আর...(২৩)

তারিখ: নেই (অনুমান এপ্রিল,১৯৯৩)


রূপা জানো, ইদানিং কী যেন হয়ে গেছে আমার। তোমাকে কিছুই না বললেই যেন নয়। যা এমনিতে বলতে পারি না, তা হয়তো ঐ যুবককে দিয়ে বলাই। প্রতিদিনের ঘাত-প্রতিঘাত, হাসি-আনন্দ, দুঃখ-বেদনা, মানুষের প্রতিশ্রুতি ভাঙা, আস্থাহীনতা ইত্যাদি সব অনুভূতি যখন আর মনে হয় বইতে পারি না একা, তোমার অনিমেষ ভালোবাসায় সব কিছু সঁপে দিয়ে আমি সান্ত্বনা খুঁজি। তোমাকে পাশে নিয়ে আমি আমার সব উজাড় করে গলে পড়তে চাই তোমাতে রূপা। তুমি কাছে নাই। আমার এ অক্ষম কলমে ভাষাকে আর কতদূর নিতে পারি বলো। হয়তো কিছুই বোঝাতে পারি না। আমার সারাক্ষণের সাথি তুমি, অথচ কত কত দূরে আছো ! তবু সান্ত্বনা, তুমি আমার, কেবলই আমার।

সেদিন এক বিয়েতে গেলাম। আমারই এক সহকর্মীর বিয়ে। অনুষ্ঠানের আড়ম্বরতায় রাজসিক পোশাকে যখন আমার দিকে সবিনয়ে এগিয়ে এলেন হাত মেলালেন নিবিড়, আন্তরিকতায় এতটুকু খাদ না থাকলেও ঐ অবস্থায় ঐ পরিবেশে তাকে কেন জানি আমার আয়ত্তের বাইরের অনেক অনেক দূরের অন্য কোন গ্রহের মানুষ বলে মনে হচ্ছিলো ! অথবা আমিই ভিনগ্রহের কোন প্রাণী হয়ে গেলাম হয়তো। কিছুতেই মিলাতে পারছিলাম না যে তিনিই আমার নিত্যদিনের সেই সহকর্মী। সেদিনের ঐ অনুভূতিই তোমার ভালোবাসায় জারিত করে কত কিছুই না বলে ফেললাম তোমাকে। তুমি কি এতে রাগ করো রূপা ?

আজ আমার আরেক সহকর্মী হঠাৎ ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়লো। জানলাম বেশ কিছুদিন আগে থেকেই তিনি অসুস্থতার উপসর্গগুলো গোপন করে এসেছেন আমার কাছে। কর্তব্য না কি পরিবারের দায়বদ্ধতার তাগিদে অনুচিৎ এই পরিশ্রম, কে জানে ! মা বাবা স্ত্রী পুত্র গ্রামে ফেলে এই মেসের জীবনে এমন একটা অসুস্থতা ডেকে আনায় তাঁকে তিরস্কারও করলাম বটে। তার লেবেলের অন্যান্য সহকর্মীরা যাদের সাথে সার্বক্ষণিক জীবন যাপন, এরা তার দিকে খুব একটা দিকপাত না করে নির্বিকার তাদের প্রাত্যহিক খাওয়া দাওয়া গল্প গুজব চালিয়ে যাচ্ছে, এ বিষয়টা লক্ষ্য করে নিজের ভেতরে মানুষ সম্পর্কিত ধারণাগুলো খুব চোট খেয়ে ওঠলো। যেনবা নিজেই আঘাত পেলাম ! হতে পারে এ নতুন জীবনে এখনো অভ্যস্ত হয়ে উঠিনি বলেই এতোটা সংবেদনশীল হয়ে ওঠেছি আমি। অফিস প্রধান হিসেবে আমার সাথে না হয় একটা দূরত্ব থাকা স্বাভাবিক। এখানে কর্তব্য আস্তরিকতার মোড়কে উপস্থাপিত হওয়াটাই হয়তো স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। কিন্তু তার সহকর্মী বন্ধুদের থেকে সে কি পেলো ? জানি না রূপা, অর্থ ও স্বার্থ মানুষকে কী বানিয়ে তোলে।

রূপা, তোমার ভালোবাসাই আমাকে জাগিয়ে রাখে। আমি এরকম অবস্থায় ঠিক থাকতে পারি না। এ ক্ষেত্রে আমার কর্তব্যের বাইরে না গেলেও চলে। কিন্তু আমি তো কর্তব্যকে ফাঁকা আন্তরিকতার মোড়কে বাঁধতে পারি না ! আন্তরিকতাই বরং কর্তব্যের মোড়কে বাঁধতে হয় আমাকে। তাঁর ঐ কষ্ট দেখে কেন জানি মনে হলো তুমিই কষ্ট পাচ্ছো। আমি এগিয়ে যাই। তাঁর সহকর্মীরা লজ্জা পেলো কি না জানি না। অবশ্য লজ্জাবোধের মাত্রা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হয়। আমি চেয়েছিলাম তারা লজ্জিত হোক। যদিও রূপা, আন্তরিকতার সাথে কোন বিনিময় থাকতে নেই। তাইলে ওটা আন্তরিকতা থাকে না, হয় লোক দেখানো চমক। বিশ্বাস করো, আমার আন্তরিকতায় কোন ঘাটতি ছিলো না। কিন্তু এও ঠিক, আমি বাকিদের লজ্জাও দিতে চেয়েছিলাম। এ কীভাবে সম্ভব আমি জানি না। তবে সবচেয়ে বড় যেটা তা হলো আমার নিজস্ব লজ্জা ! লোকটাকে এই নগন্য সেবা করে আমি আত্মতৃপ্ত হলাম। তবে কি আমি তার অসুস্থতায় অবচেতনে খুশি হয়েছিলাম ! যাতে লোক দেখানো ঠমক দিয়ে আমি আত্মতৃপ্ত হবো ? ছি ছি, কী লজ্জা রূপা, কী লজ্জা ! মনটা এখনো ছোটই রয়ে গেলো আমার !

একটু কষ্টও হলো, লোকটার অচেনা এক অভিব্যক্তির মানবিক অনুভূতি কল্পনা করে। যেখান থেকে একটু সহমর্মিতা পাওয়ার কথা, সেখান থেকে তা পেলো না সে !

রূপা. আমি কি পারবো কখনো, তোমার কষ্টের সময়টুকুতে কাছে গিয়ে দাঁড়াতে ? যখন তুমি আমাকে একান্ত কাছে পেতে চাইবে !


চলবে.....


আগের পর্ব (২২):
পরের পর্ব (২৪):

R_d_B

No comments: