Thursday, November 5, 2009

| বার-বণিতা...[০১]



| বার-বণিতা...[০১]
 রণদীপম বসু

...
       [আশ্বস্তি : সাদৃশ্য খুঁজিবার অতি-কল্পনের মতোই সিরিজের শিরোনামটিকে শিরোধার্য ভাবিবার আপাত কোন কারণ নাই। এবং সাধু ও চলিতের মিশ্রনও এইখানে দোষণীয় গণ্য হইবে না।]

একদিন ঘুমের মধ্যে রাজা পাখি হইয়া গেলেন। ফুড়ুৎ করিয়া রাজপ্রাসাদ হইতে বাহির হইয়া উড়িয়া চলিলেন। উড়িতে উড়িতে উড়িতে উড়িতে নদী-নালা-খাল-বিল-পাহাড়-জঙ্গল পার হইয়া উড়িতেই লাগিলেন। পাখি হইয়া নিচের দৃশ্য চাহিয়া দেখিতে মন্দ লাগিতেছে না, বড়ই সৌন্দর্য বোধ হইতেছে ! পাখির চোখ দিয়া ভূ-প্রকৃতি-পরিবেশ দেখিবার মধ্যে এতো মধুর মাদকতা যে, রঙ-মহলের শরবত-ই-তহুরাও ইহার ধারেকাছে আসিতে পারিবে না ! আগে কখনোই তাহা টের পাইবার সুযোগ হয় নাই বলিয়া রাজার খুবই আফসোস হইতে লাগিলো। ইশ্, মানুষ হইতে পাখির জীবন কতো সুখের, কত্তো আনন্দময় ! আহা, আরো আগে কেন তিনি পাখি হইলেন না ! মুক্ত দুনিয়ায় উড়িয়া চলিবার বিচিত্র মজায় ডুবিয়া রাজার আর খেয়াল থাকিলো না তিনি কোথা হইতে কোথায় চলিয়া আসিয়াছেন।



নিচের দিকে ভালো করিয়া চাহিলেন। ইহাকে একটি লোকালয় বলিয়া মনে হইতেছে। ধীরে ধীরে এইবার নিচের দিকে নামিতে লাগিলেন। অস্পষ্ট নড়াচড়াগুলো স্পষ্ট হইয়া উঠিতেই দেখিলেন একটি উঠতি বয়সী বালিকা রুদ্ধশ্বাসে দৌঁড়াইতেছে। পিছন হইতে তিন-চারিটি যুবক তাহাকে তাড়া করিয়া ধরিয়া ফেলিল। চলমান লোকচক্ষুর সম্মুখেই তাহারা বালিকাটিকে জোরপূর্বক একটি যন্ত্র-শকটে তুলিয়া লইলো। শকটটি মুহূর্তকালের মধ্যে চলিতে লাগিলো। রাজাও পিছু পিছু উড়িয়া চলিলেন। ইহা কোন্ রাজ্য, রাজা বুঝিতে পারিলেন না। তবু এইটা বুঝিলেন যে তাহার নিজ রাজ্য অপেক্ষা এই রাজ্যটি অধিকতর সুসভ্যই হইবে। কারণ তাহার রাজ্যে এইরকম যন্ত্র-শকট কোথাও নাই। এমনকি রাজা নিজেও এই প্রথম ইহা দেখিলেন।

দুইপাশে জড়াজড়ি করিয়া রাজপ্রাসাদকেও হার মানাইয়া দিবার মতো বহুবর্ণিল উঁচু উঁচু নানান ভঙ্গিমার কতো-শতো দালান আর অসংখ্য পদের শকটপূর্ণ অগণিত নাগরিকে গিজগিজে লোকালয় ছাড়িয়া  শকটটি ছুটিয়া চলিলো। কোলাহল হালকা হইয়া আসিলে একটা বিবর্ণ ভগ্নপ্রায় দালানের সম্মুখে আসিয়া শকটটি থামিলো। শকট হইতে বাহির করিয়া বালিকাটিকে যুবকগুলি টানিয়া হেঁচড়াইয়া দালানের ভিতরে লইয়া চলিল। বালিকার মুখ শক্ত কাপড়ে বাঁধিয়া রাখায় চিৎকার করিবার বদলে তাহার মুখ হইতে গোঁ গোঁ শব্দ হইতে লাগিলো। ইহা যে ভয়ঙ্কর অনাচার হইতে যাইতেছে তাহা বুঝিতে পারিয়া রাজা তাঁহার রাজকীয় হুঙ্কার দিয়া উঠিলেন। কিন্তু পাখির মতো প্যাঁক প্যাঁক শব্দ শুনিয়া খেয়াল হইল তিনি আর রাজা নহেন, পাখি হইয়া গিয়াছেন। আকস্মিক এই পাখি-জীবনের অসহায়ত্ব বুঝিতে পারিয়া হঠাৎ তাহার আফসোস হইতে লাগিলো- রাজা হইয়াও একটি সামান্য বালিকার জন্য কিছুই করিতে পারিতেছেন না ! নিষ্ফল হতাশায় গাঁইগুঁই করিতে করিতে রাজার ঘুম ভাঙিয়া গেলো।

ঘামিয়া নাহিয়া একশেষ হইয়া ধড়মড় করিয়া উঠিয়া বসিলেন তিনি। হাসফাঁস নিঃশ্বাস স্বাভাবিক হইয়া আসিলে দেখিলেন রাণীসাহেবা তাহার দিকে কটমট করিয়া চাহিয়া আছেন। ‘পানি’ বলিয়া হুঙ্কার ছাড়িতেই হুড়মুড় করিয়া যুবতী বাঁদী রাজকীয় পানির পাত্র লইয়া সামনে আসিয়া দাঁড়াইলো। পরপর দুই পাত্র পানি পান করিয়া তৃষ্ণা নিবারণ হইতেই সামনে দাঁড়ানো উদ্ভিন্ন-যৌবনা সুন্দরী বাঁদীটিকে কিভাবে যেন সেই বালিকা বলিয়া বারবার ভ্রম হইতে লাগিলো।
‘আপনার কী হয়েছে জাহাপনা ?
রাণীর প্রশ্নে সম্বিৎ ফিরিয়া পাইয়া রাজা বলিলেন- একটি বালিকার প্রতি জোরপূর্বক অনাচারের কোন বিহিত করিতে পারিলাম না !
রাণী কিছুই বুঝিলেন না। চলিয়া যাইবার নির্দেশ না পাইয়া দাঁড়াইয়া থাকা সুন্দরী বাঁদীটির দিকে একবার কটাক্ষ দৃষ্টি হানিয়া পুনরায় রাজার দিকে মনোযোগী হইলেন। রাজা ইশারায় বাঁদীকে চলিয়া যাইতে বলিয়া এইবার রাণীকে আদ্যপান্ত খুলিয়া বলিলেন।

রাণী শুনিয়া বলিলেন- উহা অবশ্যই অন্যায় কার্য। কিন্তু অভয় অনুমতি পাইলে আমি কি একটা কথা বলিতে পারি জাহাপনা ?
তুমি নির্ভয়ে বলো রাণী।
আপনিও কি আপনার এই মহলে ঐরূপ সহস্রাধিক বালিকাকে বাঁদী বানাইয়া আটকাইয়া রাখেন নাই ?
রাজ-অহঙ্কারে টোকা পড়িল। রাণীর দিকে কটমট দৃষ্টি হানিয়া রাজা রাণীর নিদমহল হইতে বাহির হইয়া গেলেন।
...

আজ নকিবের কণ্ঠ বাজিয়া উঠিবার সুযোগ হইলো না। পাত্রমিত্র সভাসদগণ রাজসভায় ঢুকিয়াই চমকিয়া উঠিতে লাগিলেন। সিংহাসনের সামনে স্বয়ং রাজাহুজুর আনমনে পায়চারি করিতেছেন। আনমনা রাজাকে কুর্নিশ করিয়া করিয়া যে যার আসনের সামনে গিয়া নীরব হইয়া দুরুদুরু বক্ষে দাঁড়াইয়া রহিলো। হঠাৎ পায়চারি থামাইয়া রাজা সভার দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া সিংহাসনে আরোহণ করিলেন।
উজির সাহেব !
আদেশ করুন জাহাপনা।
এই রাজ্যে কোথায় কোন্ বালিকা কিভাবে কাহার দ্বারা কখন উত্যক্ত হয়েছে এই তালিকা সংগ্রহ করা হউক।
তাই হবে জাহাপনা...
আর শুনুন, আজই পাত্তা লাগান, কোন্ রাজ্যে অদ্ভুত সব যন্ত্রশকটের প্রচলন হয়েছে। অনতিবিলম্বে ওই মুল্লুকের বিশদ বয়ান এই সভায় অবগত করানো হোক।
জো হুকুম জাহাপনা।
সভার কার্য আজকের মতো বিরতি। বলিয়াই রাজা চিন্তিত মনে রাজসভা হইতে প্রস্থান করিলেন।

রাজসকাশে যেইসব আর্জি আর বিচারকার্য সম্পন্ন হইবার জন্য আজ নথিভুক্ত হইয়াছিলো, সেইগুলি সেইভাবে পড়িয়া রহিল। ইতোমধ্যেই সভাসদগণের মস্তিষ্কের উষ্ণতা তিরিশ ডিগ্রি বাড়িয়া গিয়াছে। হঠাৎ করিয়া রাজার এইসব কথাবার্তার মাথামুণ্ডু কেহ কিছুই বুঝিতে পারিতেছেন না। একটা অনাহুত অস্থিরতা লইয়াই তাহারা এইদিনের মতো সভাস্থল ত্যাগ করিলেন বটে, কিন্তু তাহাদের মন পড়িয়া রহিলো রাজপ্রাসাদের সভাকক্ষের মধ্যেই।
...
(চলমান...)
...
পর্ব : [*] [০২]

No comments: