Sunday, November 8, 2009

| ফুটোস্কোপ দর্শন...!



| ফুটোস্কোপ দর্শন...!
   রণদীপম বসু
...
 [ উৎসর্গ: সুজঞ্চৌ ]
...
কার্টুন-চিত্রের জনক কে ? প্রশ্নটা মাথায় আসতেই ফের প্রতিবারের মতো সেই পুনর্জ্ঞানে সমৃদ্ধ হয়ে উঠলাম। কী সেই জ্ঞান ? তা হলো- আমি এটুকু জানলাম যে, আমি এর কিছুই জানি না। জ্ঞানীজনেরা বলেন, জানা মানেই জ্ঞান। অর্থাৎ এর আগে আমি নিশ্চিতভাবে এ বিষয়ে অজ্ঞান ছিলাম। কেননা, এ বিষয়ে আমি কোন কিছু জানতাম কি জানতাম না, সেটাই জানা ছিলো না আগে ! এখন তো এটা জানতে পেরেছি যে আমি জানি না ! এভাবেই নাকি মানুষ জ্ঞানী হয়ে উঠে। অতএব এই চমৎকার জ্ঞান নিয়ে কথা আর আগানো মানে যে ‘বাবা মদন, থাক, অনেক হয়েছে’ জাতীয় প্রশস্তি-বাক্য প্রাপ্তির সম্ভাব্য নিশ্চয়তা বিধান, অন্তত এটা বোঝার জ্ঞান নিয়ে কেউ কি সন্দেহ পোষণ করবেন ? মনে হয় না। সে জ্ঞানও ময়-মুরব্বির দোয়ায় অর্জন করে ফেলেছি বলা যায় ! অতএব সাহিত্য-তলানিচাপা মানুষ, যাকে কিনা শিল্প-মূর্খ বললেও খুব কম বলা হয়, তার মাথায় এমন সীমা-ছাড়া জ্ঞানী-প্রশ্ন আসবে কেন ? জ্ঞানীজনের মতে এটাকেই বলে প্রভাব।



প্রভাবিত হওয়া আর প্রভাবিত করা, এ দুয়ের মধ্যে কে বেশি সক্রিয় তা নিয়ে জ্ঞানীদের মধ্যে বিস্তর মতভেদ থাকার কথা। অন্তত এমনটাই মনে হয়। তবে এ সমস্যা আমার নয়, জ্ঞানীদের। তাহলে এ প্রসঙ্গ কেন এলো ? এর উত্তর সুজন চৌধুরী, আদর করে যাঁকে অনেকেই সুজঞ্চৌ বলে ডাকেন। তাঁর অন্য পরিচয় হচ্ছে, সম্ভাব্যতার বিচারে তিনি এমন একজন ব্যক্তি যাঁকে আমি দেখি নি কখনো। আর অন্য পরিচয় হচ্ছে তিনি একজন শিল্পী। এবং এটাই তাঁর প্রধান পরিচয় বলে আমার ধারণা। কেমোন শিল্পী তিনি ? মানুষের ভেতরের মানুষটাকে যিনি ক্যানভাসের আলোয় মূর্ত করে তোলায় দারুণ পারদর্শি। পেন্সিল, কলম, তুলি বা অন্য যাই বলি না কেন, সন্দেহাতীত মুন্সীয়ানায় তাঁর স্রষ্টা-হাতের ক্যারিকেচারে এরা কিভাবে একেকটা শিল্পের সৃজনোন্মুখ হাতিয়ার হয়ে উঠে তা না দেখলে ধারণা পাওয়া মুশকিল। কিন্তু এগুলো কোন নতুন কথা নয়, প্রশস্তিমূলক কথা, যা অন্তর্জালিক জগতের অনেকেই জানেন। নতুন ও বেদনাদায়ক কথাটা হচ্ছে, পাঠকরা যা-ই ভাবেন, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি যে, একটা জায়গায় শিল্পী সুজন চৌধুরী আসলে ব্যর্থ ! সেই ব্যর্থতাটা চিহ্ণিত করার ফাঁকে শিল্পীর প্রতি আমার সমবেদনাটা জানিয়ে রাখি।

ভালো করে বোঝার বয়স থেকে পত্র-পত্রিকা-ম্যাগাজিন বা প্রিন্ট মিডিয়ায় কার্টুন ক্যারিকেচার দেখে দেখে অভ্যস্ত চোখে দুঃখ হতো কার্টুন-চরিত্রগুলোর জন্য। ভাবতাম আহা দেখো, কেমন সুন্দর একটা মুখকে কোন্ পাজী লোকটা যে এমন বিদঘুটে করে এঁকেছে ! আরো বড়ো হতে হতে ধারণাটা আরো পোক্ত হয়েছে যে, এই কার্টুন-শিল্পীরা এমন পাজীই হয়। বিখ্যাত বিখ্যাত সব লোকদের চেহারা এমন কিম্ভুতকিমাকার বানিয়ে ফেলা পাজী লোক ছাড়া কি সম্ভব ! অথচ অনায়াস চেষ্টায় অঙ্কিত চরিত্রের পরিচয় বুঝতেও কোন কষ্ট হয় না কারো ! এবং সাথে সাথে কী ভয়ঙ্কর আশ্চর্যই না হতাম, অসম্ভব জ্ঞানী-গুণী লিখিয়ে ব্যক্তিরা বিশাল বিশাল গদ্য কলাম লিখেও আসল কথাটা বুঝাতে যেখানে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে উঠতেন, সেখানে কিনা এমন পাজী কার্টুনিস্টের কয়েকটা অদ্ভুত আঁচড় কী অবলীলায় কতো কথাই না বলে দেয় ! তা কী করে সম্ভব ? এর উত্তরও আমার জানা নেই। শুধু এটুকু বুঝতাম যে, কার্টুন-চিত্রে ব্যক্তির পরিচয় অক্ষুণ্ন রেখে তার অন্তর্নিহিত চরিত্র প্রকাশের মধ্য দিয়ে ঐ ব্যক্তির এক ভিন্নমাত্রিক চরিত্র, বক্তব্য বা ভাব প্রদর্শন, যেখানে এই শিল্পটার ক্ষমতা সাংঘাতিক !  এবং যিনি এই বিকৃতির শিল্পস্রষ্টা, তাঁর মুণ্ডুটা চিবিয়ে ছাতু করার জন্য কার্টুন-চরিত্রের অন্তরালের বাস্তব ব্যক্তিটি যে হামেশাই মুখিয়ে থাকবেন, এতে আর সন্দেহ কী ! নাকে-মুখে ফুলে-ফেঁপে উঠার মতো দুয়েকটা কিল-ঘুষি খেয়েই যেখানে মানুষ রীতিমতো খুন-পিয়াসী হয়ে উঠে, সেখানে চেহারার আদি জিওগ্রাফিটাই রীতিমতো ভেঙেচুরে একাকার !

এইসব পরোক্ষ উপলব্ধিও কী নিদারুন মার খেয়ে গেলো প্রত্যক্ষ অনুভবের কাছে ! শিল্পী সুজঞ্চৌ কোন্ বেখেয়ালে যে তাঁর শিল্প-হাতিয়ারসহ ধরা খেয়ে গেলেন চরিত্র বাছাইয়ে গড়বড় করে, তা ভাবতেই বড় তৃপ্তি পাচ্ছি ! বিষয়-বৈকল্যে শিল্পও যে তার কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, এর মস্ত প্রমাণ হচ্ছে কোন পদেই পড়ে না রণদীপম বসু নামের এমন একটা হাওয়াই চরিত্রকে শিল্পের বল্লম ছুঁড়ে অমর-বাস্তবতা দান করা। বিখ্যাত খণ্ডিত হয় শিল্পের নির্দয় আঘাতে, আর অখ্যাত পায় অমরত্ব। তাই ক্ষুব্ধ বিখ্যাতরা যখন তাঁদের অমেয় ক্ষতিপূরণে তেড়ে যায়,  অখ্যাতরা সেক্ষেত্রে অমর্ত্য আনন্দে ডুগডুগি বাজায়। আমিও সেই টইটম্বুর আনন্দে আপ্লুত।

অন্তর্জালিক লেখক কমিউনিটি ব্লগ ‘সচলায়তন’-এর শিল্প-স্রোতে শিল্পী সুজন চৌধুরীর ‘আয় তোর মুণ্ডুটা দেখি ফুটোস্কোপ দিয়ে- ২৪’-এর একটা হিরন্ময় ব্যর্থতার ঋণ আমার অনেক অনেক কৃতজ্ঞতা দিয়েও শোধ হবার নয়। মৃত্যুশীল অসংখ্য জীবনের চাইতেও এক ফোঁটা অমরত্ব যে অনেক দীর্ঘ। ভাগ্যিস তিনি এই ভুলটা করেছিলেন, এটাই আমার সৌভাগ্য ! মাই হ্যাট’স অফ টু য়্যু সুজন্দা !
...

No comments: