Monday, March 8, 2010

| শতবর্ষে নারী দিবস এবং মানবেতিহাসের এক বহমান লজ্জার গাথা |

 
| শতবর্ষে নারী দিবস এবং
মানবেতিহাসের এক বহমান লজ্জার গাথা |


-রণদীপম বসু
(০১)
মানবসভ্যতার সেই লজ্জাকর মুহূর্তে নারী যখন সর্বগ্রাসী ধর্মীয় মৌলবাদী পুরুষতন্ত্রের হাতে এক ব্যবহারযোগ্য ভোগ্যপণ্য হিসেবে শৃঙ্খলিত হলো, সেই থেকে নারীসত্ত্বা তার শৃঙ্খলভাঙার অবদমিত ইচ্ছাকে লালন করে আসছে হাজার হাজার বছর ধরে। পুরুষতন্ত্রের সেই আদিম ও আরোপিত ফাঁস থেকে নারীর আজো বেরিয়ে আসা সম্ভব হয়নি। তাকে বেরিয়ে আসতে দেয়া হয়নি। কেননা প্রচলিত সভ্যতা ও সংস্কৃতির গোটা প্রক্রিয়া ও কাঠামোটাই এই মৌলবাদী পুরুষতন্ত্র এক প্রতারণামূলক ধর্মতাত্ত্বিক বিটুমিন দিয়ে নিজের অনুকূলে ঢালাই করে নিয়েছে সুকৌশলে। প্রতিনিয়ত অসভ্য প্রহরায় রাখা সেই ঢালাই ভাঙা তো চাট্টিখানি কথা নয়।

পুরুষ নামের প্রাণীরা নিজেদেরকে মানুষ ভাবলেও ঘরে ঘরে যাদের সাথে সংসার করে আসছে শত শত বছর ধরে, সেই নারীও যে তার মতোই মানুষ এবং মানবিক অস্তিত্ব হিসেবে মানবসভ্যতায় সমসঙ্গি পুরুষের সমান সুযোগ ও মর্যাদা পাওয়ার অধিকার ধারণ করে, তা বোঝাতে এবং পাওয়ার দাবীতে এই নারীকে ঘর ছেড়ে এক অনিশ্চিত আন্দোলনের রাস্তায় নামতে হয়। এটাই মানবেতিহাসের বহমান এক লজ্জার গাথা। মায়ের অভিন্ন গর্ভে একই পিতার ঔরসে জন্মানো ছেলেটির মতোই যে মেয়েটিরও জন্ম হলো, ছেলেটি পুরুষ হয়ে ওঠে আর সেই মেয়েটিকে বানানো হয় নারী। নারীবাদী লেখিকা সিমোন দ্য বোভোয়া তার ‘দ্বিতীয় লিঙ্গ’ গ্রন্থে তাই বলেন- ‘নারী হয়ে কেউ জন্ম নেয় না, নারী হয়ে ওঠে।’ পুরুষশাসিত এই সভ্যতায় পুরুষরা স্বঘোষিত মানুষই হয়। কিন্তু নারীকে সাংস্কৃতিকভাবে এমন এক অদ্ভুত অস্তিত্ব বানিয়ে তৈরি করা হয়, শুধু সম্মানের সাথে ভোগ করার বেলায় পুরুষ তাকে আদর করে মানুষ বলে ডাকে। কিন্তু অধিকার ও মর্যাদার প্রশ্নে পুরুষ নারীকে তার সমকক্ষ হিসেবে স্বীকার তো করেই না, উপরন্তু শারীরিক, মানসিক, আধ্যাত্মিক ও বস্তুগত বৈষম্যের দৃশ্যমান ও অদৃশ্য দেয়াল তুলে তাকে বুঝিয়ে দিতেও কসুর করে না যে নারী একটি দ্বিতীয় শ্রেণীর ভোগ্যপণ্য বস্তু বা প্রাণীবাচক অস্তিত্ব কেবল। তার নিজস্ব কোন স্বপ্ন, কল্পনা, চাওয়া থাকতে পারে না। তার নিয়ন্ত্রণকারী হচ্ছে পুরুষ এবং পুরুষের চাওয়াই তার চাওয়া। কিন্তু পুরুষের পাওয়া তার পাওয়া নয়। সেভাবেই পুরুষ সৃষ্টি করেছে সংসার, সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম ও যাবতীয় তত্ত্ব। এর স্বত্ব ও বৈধতাও পুরুষ রেখেছে নিজের অধিকারেই। এই স্বয়ম্ভু স্বার্থপর পুরুষ সত্ত্বা আসলে কোনো মানবিক পুরুষ সত্ত্বা নয়, এক সর্বগ্রাসী দানবিক পুরুষতন্ত্র তা।

তাই সম-অধিকারের প্রশ্নে নারীর যে আন্দোলন সংগ্রাম, তা পুরুষের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ নারীর বিদ্রোহ নয়, বরং এক অবৈধ পৈশাচিক পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে বঞ্চিত নির্যাতিত মানবতার দীর্ঘ অসম যুদ্ধ। আর তাই অনিবার্য এ যুদ্ধে অনায়াসে সামিল হয়ে যান নারী পুরুষ নির্বিশেষে মানবতাবাদী মানবহিতৈষী সকল মানুষ।

(০২)
০৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। ২০১০ সালের এই তারিখে এসে নারী অধিকার আদায়ের সংগ্রামের বয়স আনুষ্ঠানিকভাবে একশ’ বছর পূর্ণ হলেও সংঘটিত আন্দোলনের অনানুষ্ঠানিক বয়স সম্ভবত দেড়শ’ বছরেরও বেশি। অথচ অবাক হয়ে ভাবতে হয়, পৃথিবীতে আর কোনো মানবিক আন্দোলনকে কি এমন দীর্ঘমেয়াদী ও চূড়ান্ত ফলাফলহীন অবস্থায় এভাবে অনিশ্চিত দূরগামী সক্রিয়তায় যুক্ত থাকতে হয়েছে ? নারী আন্দোলনের ইতিহাস এই প্রশ্নটাকে বিস্ময়ের সাথে এক অনিশ্চিত গন্তব্য নিয়ে ঝুলিয়ে রেখেছে আজো।

আন্দোলন যতো তাত্ত্বিক বা আধ্যাত্মিক পর্যায়েরই হোক না কেন, তার সূত্রপাত ঘটে প্রথমত বস্তুগত বঞ্চনার পুঞ্জিভূত ক্ষোভ থেকেই। নারীর অধিকার আদায়ের সংগ্রামও এর ব্যতিক্রম নয়।

আজ থেকে দেড়শ’ বছরেরও আগের কথা। আমাদের এই উপমহাদেশে তৎকালীন ব্রিটিশরাজের অধীনস্থ সিপাহী, আমাদের বিক্ষুব্ধ পূর্বপুরুষ, মঙ্গল পাণ্ডে ১৮৫৭ সালে শৃঙ্খল ভাঙার যে ঐতিহাসিক বিদ্রোহের সূচনা করেছিলেন, সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ রাজশক্তি এটাকে সিপাহী বিদ্রোহ বলে প্রচারণা চালালেও মূলত তা-ই ছিলো ভারত উপনিবেশে আমাদের জেগে ওঠা স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রথম অগ্নিস্ফুলিঙ্গ।

নিপীড়িত নির্যাতিত মানুষের যন্ত্রণা যে আসলেই একটা অভিন্ন আন্তর্জাতিক ভাষা, তার প্রমাণ পাই ঠিক সেই সময়কালেই অর্থাৎ ১৮৫৭ সালেই পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে একটি সুঁই কারখানায় যখন নারী শ্রমিকরা দৈনিক ১২ ঘণ্টা বা তারও বেশি কর্মঘণ্টা পরিশ্রম, নিম্ন-মজুরি তথা মজুরি বৈষম্য, অমানুষিক নির্যাতন ও খাদ্যের অভাবের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। ফলশ্রুতিতে তাদের উপর নেমে আসে দমন পীড়নের প্রথাগত নির্যাতন। ৮ই মার্চের সেই ঘটনাকে বিশ্বের দেশে দেশে নিপীড়িত নারীরা কখনো ভুলে যায়নি। ভুলে যাওয়া সম্ভবও ছিলো না।

১৮৬০ সালে এই নারী শ্রমিকরাই নিজেদের দাবি আদায়ের প্ল্যাটফরম হিসেবে নিজস্ব ইউনিয়ন গঠন করেন। আর তাই অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গতভাবেই ১৮৬৮ সালে শ্রমিক শ্রেণীর সেই প্রথম আন্তর্জাতিক মঞ্চ থেকে মহামতি কার্লমার্কস শ্রমিক শ্রেণীর সংগ্রামের সঙ্গে নারী অধিকার ও নারী মুক্তির বিষয়টিও তুলে ধরেন। তাদের প্রচেষ্টায় এর পর থেকেই নারী শ্রমিকদেরও ট্রেড ইউনিয়নের সদস্য করা শুরু হয়। ফলে ১৮৭১ সালে ফ্রান্সে প্যারি কমিউনের বিপ্লবী সংগ্রামে প্রবল সাহসিকতা নিয়ে শ্রমজীবী নারীরা অংশগ্রহণ করে দেখিয়ে দেয় সমকক্ষতায় পুরুষের চেয়ে কোন অংশেই এরা কম নয়। এভাবে এসব আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নারীদের একটি বড় অংশের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণা বিস্তৃতিলাভ করতে থাকে এবং ক্রমান্বয়ে রাজনৈতিক আন্দোলন দানা বাঁধতে থাকে।

উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি ঘটে ১৮৮৯ সালে। প্যারিসে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক মঞ্চ থেকে কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিন সর্বপ্রথম রাষ্ট্র ও সমাজজীবনের সর্বক্ষেত্রে পুরুষদের সাথে নারীর সমানাধিকারের দাবি তোলেন। আন্দোলন সংগ্রামের এই  ধারাবাহিকতায় ১৯০৭ সালে জার্মানীর স্টুটগার্টে এই ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বেই প্রথম আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

১৯০৯ সালে ৮ই মার্চ নিউইয়র্কের দর্জি শ্রমিক নারীরা প্রথম নারীর ভোটাধিকারের ঐতিহাসিক দাবি তুলে ধরেন। ১৯১০ সালে কোপেনহেগেনে ১৭টি দেশের ১০০ প্রতিনিধি নিয়ে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এবং এ সম্মেলনের গৃহিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯১১ সাল থেকে প্রথমবারের মতো নারীদের সমানাধিকার দিবস হিসেবে ৮ই মার্চ পালিত হওয়া শুরু হয়। এ ধারা অব্যহত থাকে এবং দেশে দেশে তা ছড়িয়ে পড়তে থাকে। যতটুকু জানা যায় অবিভক্ত ভারতে ১৯৪৩ সালে বোম্বেতে প্রথম ৮ই মার্চ পালিত হয়। আর বাংলাদেশে ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ কর্তৃক প্রথম ৮মার্চ পালিত হয়।

নারী অধিকারের এই যৌক্তিক দাবিগুলোকে মাথায় রেখে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর প্রেক্ষাপটে ১৯৪৫ সালে সানফ্রান্সিসকোতে জাতিসংঘ মানুষের মৌলিক অধিকার হিসেবে জেন্ডার ইকোয়ালিটি নামের একটি আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করে। সেই থেকে সদস্য দেশগুলো তা পালন করতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়। আর বিশ্বব্যাপি পালিত হয়ে আসা ৮ মার্চের দিনটির গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯৭৭ সালের ১৬ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে একটি বিল উত্থাপিত হয়। নিজ নিজ দেশের ঐতিহাসিক জাতীয় ঐতিহ্য ও প্রথার আলোকে মহিলাদের অধিকার ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জাতিসংঘ এই দিনটিকে দিবস হিসেবে পালনের জন্য রাষ্ট্রসমূহের প্রতি আহ্বান জানায়। আর এরই ফসল হিসেবে ১৯৮৪ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের গৃহিত প্রস্তাব অনুযায়ী ৮ই মার্চ-কে আন্তর্জাতিক নারী দিবস হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয়া হয়।

আজ ৮ মার্চের নারী দিবসের দাবি শুধু মজুরি বৈষম্য বিলোপ ও ভোটাধিকারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই। ইতোমধ্যে তা ব্যাপ্তিলাভ করেছে নারীর অর্থনৈতিক সামাজিক রাজনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে। সেই ১৮৫৭ থেকে আজতক এই যে দেড়শ’ বছরের নারী মুক্তি আন্দোলনের পরিক্রমা, এতো দীর্ঘকালব্যাপি পৃথিবীতে আর কোনো আন্দোলনকেই বোধ হয় এমন অনিশ্চিৎ অভিযাত্রায় ঘুরপাক খেতে হয় নি। এটাই বোধ করি মানবেতিহাসে মানব সভ্যতার এক চরম পরিহাস! এখানেই প্রশ্ন আসে, সভ্যতার জারিজুরি মাখা আমাদের এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজটা কি আদৌ বন্যতার আদিম সাম্য সমাজটাকেও অতিক্রম করতে পেরেছে? নইলে মানুষ পদবাচ্যে থেকে পুরুষের সমকক্ষ হয়েও একজন নারীকে কেন আজো পুরুষের সমানাধিকার প্রাপ্তির জন্য দাবি আদায়ের আন্দোলন করে যেতে হবে?

(০৩)
১৯১১ সালে প্রথমবারের মতো নারীদের সমানাধিকার দিবস হিসেবে ৮ই মার্চ পালিত হওয়া থেকে ০৮ মার্চ ২০১০ এর ব্যবধান একশ’ বছর। এই সময়কালে সারা বিশ্বে একেকবার একেকটি করে বহু থিম নিয়ে নারী দিবস পালিত হয়েছে। কিন্তু অবস্থার কতোটা উন্নতি হয়েছে তা ধারণা করা যায় এবারের নারী দিবসের শ্লোগান থেকেই। ‘সম-অধিকারের মাধ্যমে সবার অগ্রগতি’। অর্থাৎ নারী-পুরুষের সম-অধিকারের বিষয়টি এখনো প্রশ্নের পর্যায়েই রয়ে গেছে। কী সেই প্রশ্ন ?

প্রথমত অধিকার বলতে আমরা কী বুঝি ? মৌলিকভাবে এখানে দুটো বিষয়কেই প্রাধান্য দেয়া হয়। সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার অধিকার এবং ক্ষমতা-বলয়ে অংশগ্রহণের অধিকার। অর্থাৎ একজন পুরুষ স্বাভাবিকভাবে যে সুযোগ-সুবিধা পেতে পারেন, সে তুলনায় একজন নারী কতটুকু সুযোগ-সুবিধা পান। একইভাবে ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে পুরুষের তুলনায় নারীরা সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে সক্রিয়ভাবে কতটুকু অংশগ্রহণের সুযোগ পান। এই দু’পর্যায়ের অধিকারে নারী-পুরুষের তুলনামূলক প্রাপ্তি বা বঞ্চিত হওয়ার হার নির্ণয়ের মাধ্যমেই নারীর আপেক্ষিক অবস্থানকে চিহ্ণিত করা হয়ে থাকে। এটাই সারা বিশ্বে জেন্ডার সূচক হিসেবে স্বীকৃত। একটি জেন্ডার উন্নয়ন সূচক, অন্যটি জেন্ডার ক্ষমতায়ন সূচক। মূলত এই দুটো সূচক চিহ্ণিত করে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের এই সূচক দুটোর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে নারী-পুরুষের অবস্থান দেখানো হয় এবং সূচক অনুযায়ী বিভিন্ন দেশের অবস্থানও দেখানো হয়।

জেন্ডার উন্নয়ন সূচকে নারী-পুরুষের মধ্যকার অসমতা প্রতিফলিত হয়ে থাকে। জাতিসংঘের মানব উন্নয়ন রিপোর্ট-২০০৯ অনুযায়ী বাংলাদেশের জেন্ডার উন্নয়ন সূচক দেখানো হয়েছে ০.৫৩৬। এই সূচকের অর্থ হচ্ছে পুরুষের তুলনায় নারীর সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির হার প্রায় অর্ধেক। ভিন্নভাবে বললে নারীরা পুরুষের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণভাবে বঞ্চিত হচ্ছে। ওই রিপোর্টে ১৫৫ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৩তম।

অন্যদিকে জেন্ডার ক্ষমতায়ন সূচকের মাধ্যমে দেখানো হয় নারীরা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে সক্রিয়ভাবে কতটুকু অংশগ্রহণ করতে পারছে। এক্ষেত্রে যেসব বিষয়কে তথ্য-উপাত্ত হিসেবে বিবেচনা করে সূচক নির্ণয় করা হয় তা হলো, জাতীয় সংসদে পুরুষের তুলনায় শতকরা কতজন নারীর আসন রয়েছে, কতজন নারী মন্ত্রী রয়েছেন, উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও প্রশাসনিক পর্যায়ে কতভাগ নারী রয়েছে, বিভিন্ন পেশাগত এবং কারিগরি কাজে নারীর অংশগ্রহণের হার কত এবং তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ও আয়বৈষম্য কীরকম। মোটকথা এখানে কিছু নির্ধারিত ক্ষেত্রে সুযোগের বৈষম্য তুলে ধরা হয়। এইসব তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে নির্ণীত জেন্ডার ক্ষমতায়ন সূচকে বর্তমানে ১০৯ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৮। খুবই হতাশাজনক অবস্থান বলা যায়। আর বাংলাদেশের জন্য এই সূচকটি হচ্ছে ০.২৬৪। অর্থাৎ এক্ষেত্রে নারী-পুরুষের বৈষম্য আরো ব্যাপক।

নারী-পুরুষ বৈষম্যের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সূচকে যে হতাশাব্যঞ্জক চিত্র প্রতিফলিত হচ্ছে, রাষ্ট্র ও সরকার আন্তরিক হলে এর একটা সন্তোষজনক উন্নতি হয়তো সম্ভব। বিশেষ করে সামাজিক নিরাপত্তাসহ শিক্ষাগ্রহণের ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ যত বাড়ানো যাবে ততই অর্থনৈতিক জীবনে নারীর অংশগ্রহণ আশাব্যঞ্জক হয়ে ওঠবে। কিন্তু শিক্ষার সুযোগ অবারিত ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে গেলেই যে রাষ্ট্রীক অর্থনৈতিক স্থিতি ও দেশপ্রেমসুলভ উদার মানসিকতার প্রয়োজন, সেই ভিত্তিটুকুর দিকে আমরা কি কখনো দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছি বা করি ? রবার্ট ফ্রস্ট-এর সেই বিখ্যাত কবিতাংশটি মনে পড়ে যায়- ‘আই হ্যাভ মাইল্স টু গো…!’

(০৪)
কী করিলে কী হইবে- বিশেষজ্ঞদের বাঁধানো পথে অর্থতত্ত্বের জটিল পরিক্রমায় হয়তো অনেককিছুরই সমীকরণ মিলে যেতে পারে। কেউ কেউ মিলিয়ে দেবেনও হয়তো। এভাবে একদিন জেন্ডার সূচকে উন্নতির বিরাট প্রাপ্তিও অর্জিত হতে পারে। কিন্তু ‘সম-অধিকারের মাধ্যমে সবার অগ্রগতি’-এর প্রতিপাদ্য ধরে জেন্ডার সূচকে নারী-পুরুষের অধিকারের সমতা নিশ্চিত করতে হলে যে তাবিজটিকে উন্মুক্ত করা একদিন অবশ্যই জরুরি হয়ে ওঠবে, তার কথা জোরালোভাবে কাউকেই বলতে শুনি না আজো। যা না হলে সবকিছুই শেষপর্যন্ত ফাঁকা বুলি বা প্রতারণাময় ফাঁকি হিসেবেই চিহ্ণিত হয়ে থাকবে সেটা হলো- ধর্মীয় গোঁড়ামি, অন্ধতা ও কূপমণ্ডূকতা থেকে দৈহিক ও মানসিক মুক্তি। এতদঞ্চলে যতকাল এই বিষবৃক্ষের উৎপাটন না হবে, ততকাল বাকি সব অসার বকবকানিই রয়ে যাবে।

প্রচলিত ধর্মীয় ব্যবস্থা যেখানে নারীকে পুরুষের সমকক্ষ হিসেবে কখনোই বিবেচনা করে না, সেখানে একইসাথে বৃত্তাবদ্ধ ধার্মিক ও প্রগতিশীল হওয়ার দাবী কি আদতে কাঁঠালের আমসত্ত হওয়া নয় ? সমাজের ক্ষুদ্রতম প্রতিটা এককে আমরা যে মা, বোন, স্ত্রী, কন্যা নিয়ে পরম আয়েশে দিনযাপন করছি, একবারও কি ভেবে দেখেছি, নারীর সত্ত্বার মানবিক অধিকার না দিয়ে মা’কে শ্রদ্ধা, বোন’কে মমতা, স্ত্রী’কে সোহাগ বা কন্যা’কে যে বাৎসল্য দেখাচ্ছি আমরা, আসলে তা কী দেখাচ্ছি? এটা কি মর্মস্পর্শি ভণ্ডামীরই নামান্তর নয়?
প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় আজ আমরা যখন এই বিপুল মহাবিশ্বের অলিগলির খোঁজে ছড়িয়ে যেতে পারছি নিমেষেই, সেখানে পাশের একান্ত নারী-সঙ্গিটিকে চিনে নিতে সামান্য নিজের ভেতরে ডুব দিতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছি কেন আমরা? কোথায় তার সমস্যা? আদৌ কি ডুব দিতে চাচ্ছি আমরা, না কি পুরুষত্বের আদিম চামড়াটা ছিঁড়ে এখনো সত্যি সত্যি মানুষই হতে পারিনি? বাকি সবকিছুর আগে এর উত্তর পাওয়া জরুরি বৈ কি। নারী দিবসের শতবর্ষে এই চাওয়াটা বোধ করি খুব অযৌক্তিক হবে না।

পচনের উৎসটাকে রোধ না করে ধর্মতাত্ত্বিক সুগন্ধী মাখিয়ে মানবিক পচনশীলতাকে আর কতোকাল ঠেকিয়ে রাখা যাবে?

No comments: