Thursday, May 13, 2010

| এক জীবনে বাবা সাহেব ড. ভীমরাও আম্বেদকর এবং…|

 
| এক জীবনে বাবা সাহেব ড. ভীমরাও আম্বেদকর এবং…|
- রণদীপম বসু
...
অছ্যুৎ পরিবারে পিতা রামজী মালোজী শকপাল ও মাতা ভীমাবাঈ-এর ১৪ সন্তানের সর্বকনিষ্ঠ সন্তান ছিলেন আম্বেদকর। পারিবারিক নাম ভীমরাও। যদিও চৌদ্দজন ভাই বোনের মধ্যে ৫ জন বেঁচে ছিলেন, ৩ ভাই ২ বোন। বলরাম, আনন্দরাও, মঞ্জুলা, তুলসী ও সর্বশেষ ভীমরাও। পৈতৃক বাড়ী ছিল  তৎকালীন বোম্বাই প্রদেশের রত্নগিরি জেলার আম্বেদাবাদ গ্রামে। পিতা রামজী শকলাল মধ্যপ্রদেশের ‘মোউ’ সেনানিবাসে চাকুরিকালীন সময়ে ১৮৯১ সালের ১৪ এপ্রিল আম্বেদকরের জন্ম। পুত্রের নাম রাখা হলো ভীমরাও শকপাল। আম্বেদকর হলো পার্শ্ববর্তী এক গাঁয়ের নাম। স্কুলজীবনে প্রবেশের পর এক ব্রাহ্মণ শিক কৌতুহলবশত শকপালের স্থলে ভীমরাও এর সাথে জুড়ে দেন আম্বেদকর শব্দটি। সেই থেকে ভীমরাও শকপাল হয়ে গেলো ভীমরাও আম্বেদকর। তাঁর পূর্বপুরুষদের অনেকেই ব্রিটিশ ভারতীয় সেনাবাহিনীর সৈনিক ছিলেন। তাঁর পিতামহ মালোজী শকপালও সৈনিক ছিলেন। থানা জেলার অন্তর্গত মুরবাদ গ্রামের মুরবাদকর পরিবারের তাঁর মাতামহরাও ছিলেন সামরিক বাহিনীর সুবেদার-মেজর।

পিতা রামজী শকলাল মারাঠি ও ইংরেজিতে সাধারণ শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলেন বলে শিক্ষানুরাগ ও ধর্মপরায়নতা তাঁর চরিত্রের অংশ হয়ে উঠেছিলো। ফলে সন্তানদেরকে শিক্ষাগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতেন তিনি। সাথে সাথে উৎসাহিত করতেন হিন্দু ধর্মের ক্লাসিকগুলো অধ্যয়নের জন্য। সেনাবাহিনীর সুবেদার হিসেবে সামরিক বাহিনীর চাকুরি থেকে রামজী শকলাল ১৮৯৪ সালে যখন অবসর নেন তখন আম্বেদকরের বয়স সবে দুই বছর পেরিয়েছে। এর দু’বছর পরে রামজী বোম্বাই প্রদেশের সাতারার সেনাবানিবাসের একটি স্কুলে চাকুরি জোগাড় করে সেখানে পরিবার নিয়ে বসবাস শুরু করেন। এরই মধ্যে আম্বেদকরের মাতা ভীমাবাঈ মারা গেলেন। ভীমাবাঈয়ের অকাল মৃত্যুতে শোকাভিভুত রামজী তাঁর একমাত্র বোন মীরাবাঈকে সংসার দেখাশুনার জন্য শ্বশুরবাড়ি থেকে নিয়ে এলেন। তিনি সাংসারিক কাজে খুব অভিজ্ঞ ও কর্মঠ ছিলেন। ইতোমধ্যে ১৮৯৮ সালে আম্বেদকরের বাবা রামজী শকপাল পুনরায় বিয়ে করেন। আম্বেদকরের বয়স তখন ৫/৬ বৎসর। পিতার এই দ্বিতীয় বিয়েকে আম্বেদকরের শিশুমন কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি। ফলে অধিকাংশ সময় পিসীর সাহচর্যেই কাটাতেন। মাতৃহারা আম্বেদকরকে তিনি মাতৃস্নেহে বেঁধে রাখতেন।

ছেলের স্কুলে পড়ার বয়স হলে সেনাবাহিনীর চাকুরির সুবাদে বহু অনুনয় বিনয় করে রামজী শকলাল তার পুত্রকে সরকারি স্কুলে ভর্তির সুযোগ পেলেন। আম্বেদকরের প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষাজীবন শুরু হলো সাতারাতে। আর স্কুলজীবনের শুরুতেই হিন্দু সমাজের বর্ণবাদী জাতিভেদ প্রথা তথা অস্পৃশ্যতার অভিশাপের বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা শুরু হলো তাঁর।

বাল্যকাল বা স্কুল জীবন থেকে প্রতি পদেক্ষেপে যেভাবে তিনি সামাজিক বঞ্চনা, নির্যাতন ও অবহেলার শিকার হয়েছিলেন তখন থেকে তাঁর মধ্যে জীবনে প্রতিষ্ঠা পাবার স্বপ্ন জাগ্রত হয়েছিলো। তাঁর জীবনের সঞ্চিত অভিজ্ঞতাগুলো তাঁকে অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছাতে শক্তি যুগিয়েছে। একসময় স্কুলে লাঞ্ছনা-গঞ্জনার কারণে স্কুল এবং পড়াশুনার প্রতি ঘোর বিতৃষ্ণা জন্মে যায় এবং প্রায়শই স্কুল পালাতে থাকেন তিনি। তবু লক্ষ্যকে তাঁর দৃষ্টি থেকে কখনো ফিরিয়ে নেননি। এদিকে বিমাতাকে মোটেই সহ্য করতে পারছিলেন না। ফলে কচি আবেগের বশবর্তী হয়ে তিনি এ পরিস্থিতিতে স্বাধীন জীবিকার্জনের কথা চিন্তা করে বোম্বাইতে চলে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু সেখানে যেতে অনেক টাকা পয়সার প্রয়োজন। তাঁর কাছে কোন টাকা পয়সা নেই। অগত্যা পিসীমার কোমরে বাঁধা থলিটির দিকে ভীমের নজর পড়লে একদিন তা ভাগিয়ে নিয়ে থলিটিতে প্রত্যাশিত পয়সা না পেয়ে অতিশয় হতাশ হয়ে পড়েন। আর এই সময়টাতেই তাঁর জীবনের আমূল পরিবর্তন দেখা দেয়। তাঁর কথা থেকেই জানতে পারা যায় যে, এই পরিবর্তনের কারণেই তিনি পরবর্তীতে নিজেকে ড. আম্বেদকর হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন-

‘ঠিক করলাম যে আমি স্কুল পালানোর অভ্যাস ত্যাগ করবো এবং পড়াশুনার প্রতি গভীরভাবে মনোনিবেশ করবো, যাতে যত শীঘ্র সম্ভব স্কুলের পাঠ সেরে স্বাধীনভাবে জীবন যাপন শুরু করতে পারি।’
এরই মধ্যে চাকুরির কারণে রামজী শকপাল সপরিবারে বোম্বাই চলে এলেন। ছোট্ট একটি ঘর ভাড়া নিলেন যা ৬/৭ জন সদস্যের পক্ষে কোনক্রমেই মাথাগোজা সম্ভব নয়। আম্বেদকরকে মারাঠা হাইস্কুলে ভর্তি করানো হলো এবং স্কুলের অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ পিতার সযত্ন শিক্ষাদানে তাঁর পড়াশুনায় প্রভূত উন্নতি দেখা দিলো। অন্য ভাইদের পড়াশুনা আর না হলেও পিতা রামজী ভীমের পাঠস্পৃহা দেখে চরম অর্থনৈতিক প্রতিকূলতার মধ্যেও তাঁর জন্য বিভিন্ন বইপত্র সংগ্রহ করে আনতেন। পড়াশুনায় উত্তরোত্তর মনোযোগ ও উন্নতি লক্ষ্য করে তাঁকে বোম্বাইর বিখ্যাত স্কুল এলফিনস্টোন হাইস্কুলে ভর্তি করানো হলো। আম্বেদকরই হলেন এলফিনস্টোন রোডের আশেপাশের এলাকায় এখানকার প্রথম ও একমাত্র অস্পৃশ্য ছাত্র।

এই নামকরা স্কুলে ভর্তি হয়ে শত অবহেলা অপমানের মধ্যেও পড়াশুনার প্রতি তাঁর মনোযোগ আরো বেড়ে গেলো। কিন্তু যে পরিবেশের মধ্যে তাঁকে পড়াশুনা করতে হয়েছে তা ভাবলে সত্যিই অবাক হতে হয়। সবার জন্য একটিমাত্র ঘর। সেখানে রান্নাবান্না, থাকা-খাওয়া, জ্বালানি কাঠের স্তুপ, ঘরের এক কোণে থাকতো একটি ছাগলও। থাকার জায়গার অভাবে পিতা রামজী একটি কৌশল বের করলেন। সন্ধ্যার পর আম্বেদকর ঘুমোতে যেত এবং পিতা রামজী জেগে থেকে তাঁর পাঠ তৈরি করে দিতেন। রাত দুটো বাজলে তিনি আম্বেদকরকে জাগিয়ে তার জায়গায় শুয়ে পড়তেন। আম্বেদকর সারারাত ধরে নিরিবিলিতে পড়াশুনা করতেন। একদিকে পারিবারিক অসুবিধা অন্যদিকে এলফিনস্টোন হাইস্কুলের মতো ঐতিহ্যবাহী স্কুলেও বর্ণহিন্দু সহপাঠি ও শিকদের কাছ থেকে লাঞ্ছনা ও বিষোদ্গার সত্ত্বেও ১৯০৭ সালে এলফিনস্টোন হাইস্কুল থেকে কৃতিত্বের সাথে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।

সে সময়কালে একজন অস্পৃশ্য মাহার সম্প্রদায়ের ছেলের প্রবেশিকা বা ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করা ছিলো  অকল্পনীয় ব্যাপার। বোম্বাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এলফিনস্টোন কলেজে আইএ ক্লাশে আম্বেদকরই হলেন ভারতবর্ষের প্রথম কোন অস্পৃশ্য ছাত্র। এই কৃতিত্বের জন্য তাঁর সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে একটি সংবর্ধনা সভার আয়োজন করা হয়, যার পৌরোহিত্য করেন বিশিষ্ট সমাজ সংস্কারক এস.কে বোলে এবং সমাজসেবী শিক্ষক অর্জুন কেলুশকার, যিনি দাদা কেলুশকার নামে পরিচিত। কৃতিত্বের জন্য উচ্ছ্বসিত প্রশংসা ও উচ্চশিক্ষার জন্য উৎসাহিত করে অর্জুন কেলুশকার প্রীতি উপহার হিসেবে ‘গৌতম বুদ্ধের’ একটি জীবনী গ্রন্থ আম্বেদকরের হাতে তুলে দেন। এই বইটিই পরবর্তীকালে আম্বেদকরের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ পট পরিবর্তনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলো।

সে আমলে অল্প বয়সে বিয়ের রেওয়াজ থাকায় প্রবেশিকা পাশ করার পর আম্বেদকরের আপত্তি সত্ত্বেও তাঁর বিয়ের আয়োজন করা হলো। দাপোলীর সগোত্রীয় সম্প্রদায়ের ভিখু ওয়ালঙ্করের নয় বছর বয়েসী কন্যা রমাবাঈয়ের সাথে ভীমরাও আম্বেদকর ১৯০৮ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। এই রমণীর গর্ভে তাঁর তিন পুত্র ও এক কন্যার জন্ম হয়। কন্যা ইন্দু শৈশবেই মারা যায় এবং এক পুত্র রাজরত্ন ১৯৩৪ সালের জুলাই মাসে মারা যায়।

১৯১০ সালে এলফিনস্টোন কলেজ থেকে আই.এ পাশ করার পর অর্থাভাবে তাঁর লেখাপড়া বন্ধ হবার খবর পেয়ে শুভানুধ্যায়ী শিক্ষক অর্জুন কেলুশকার আম্বেদকরকে নিয়ে বরোদার মহারাজা সয়াজিরাও গাইকোয়াড়ের সঙ্গে দেখা করেন। সব শুনে মহারাজা তাঁর উচ্চশিক্ষা গ্রহণার্থে যাবতীয় সাহায্য প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন এবং তাঁকে একই কলেজে বি.এ পড়ার খরচ জোগান। ১৯১২ সালে সেখান থেকে বি.এ পাশ করেন এবং ঠিক তার পরের বছর ১৯১৩ সালের ২রা ফেব্রুয়ারি তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। তাঁর জীবনের অন্যতম সহায়ক শক্তির উৎস পিতার মৃত্যুতে তিনি অত্যন্ত শোকাভিভূত হয়ে পড়লেও বর্ণবাদের শিকার হয়ে শৈশবের অপমান, নির্যাতন, অবজ্ঞা, অত্যাচার ইত্যাদির বিরুদ্ধে অধিকার অর্জনের সংগ্রাম তাঁকে সর্বদাই তাড়িত করছিলো। আর এ শুধু তাঁর নিজের অধিকার আদায়ের লড়াই নয়, শত সহস্র বছরকাল ধরে নির্যাতিত, শোষিত, লাঞ্ছিত কোটি কোটি অস্পৃশ্য মানব সন্তানদের মানুষ হিসেবে অধিকার প্রতিষ্ঠা ও বাঁচার লড়াই। তা করতে হবে সেই কায়েমী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠিটার সাথে যারা বিদ্যা, বুদ্ধি, ক্ষমতা, অর্থ, কূটনীতি, ধূর্ততায়, শঠতায়, হিংস্রতায়, ধর্মান্ধতায় বহুগুণ শক্তিশালী। এদের সাথে লড়তে হলে প্রথমে নিজেকে সেভাবেই যথোপযুক্তভাবে প্রস্তুত করে তুলতে হবে। এই প্রস্তুতির জন্য চাই যতো বেশি সম্ভব জ্ঞানবলে বলীয়ান হওয়া। জীবনের এ পর্যায়ে এসে আম্বেদকর যে আর দমবার পাত্র নন। তিনি দমে যাননি।

ইতোমধ্যে বরোদার মহারাজা গাইকোয়াড়ের অর্থায়নে অস্পৃশ্য মেধাবী ছাত্র হিসেবে আমেরিকার কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার সুযোগ মিলে গেলো। শর্ত হলো আমেরিকা থেকে ফিরে বরোদার মহারাজার অধীনে ১০ বছর চাকরি করবেন আম্বেদকর। আমেরিকায় পা দিয়ে এই প্রথম যেন তিনি মুক্তির স্বাদ পেলেন। স্বদেশের মতো এখানে নেই প্রতিনিয়ত জাত, পাত, বর্ণ ও অস্পৃশ্যতার ভণ্ডামি। সবার সাথে একত্রে খেতে পারা, বসতে পারা, প্রাণ খুলে কথা বলতে পারা, যেন নতুন এক স্বপ্নলোক। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, সমাজবিজ্ঞান, মানববিজ্ঞান, নীতিবিজ্ঞান ও অর্থনীতিকে পাঠের বিষয় করে তিনি কঠোরভাবে পড়াশুনায় নিমগ্ন হলেন। ১৯১৫ সালে ‘Ancient Indian Commerce’ বিষয়ে অর্থনীতিতে এম.এ ডিগ্রী অর্জন করেন এবং ১৯১৬ সালের জুন মাসে ‘National Dividend of India- a Historic and Analytical Study’ বিষয়ে তাঁর লিখিত থিসিসের জন্য ডক্টরেট উপাধি লাভ করেন। ১৯১৭ সালে ১ম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। শিক্ষাশেষে এর মধ্যেই তিনি জাহাজযোগে স্বদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন এবং ১৯১৭ সালের ২৪ আগস্ট বোম্বাইতে পৌঁছে কর্মজীবনে প্রবেশ করেন।

তাঁর কর্মজীবনের বহুমুখী কর্মকাণ্ডের মধ্যেও তিনি পুনরায় ১৯২০ সালের জুলাই মাসে উচ্চ শিক্ষার্থে বিলেত যান। সেখানে ‘London School of Economics and Political Science’ কলেজে ভর্তি হন এবং তাঁর গবেষণামূলক প্রবন্ধ ‘Provincial Decentralisation of Imperial Finance in British India’ বিষয়ের উপর M.Sc ডিগ্রী লাভ করেন। ১৯২২ সালে ভারতীয় ভাষা ও সংস্কৃতি বিষয়ে গবেষণার উদ্দেশ্যে জার্মানির বন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেও অর্থাভাবে সেবারের গবেষণা শেষ করতে পারেন নি। ১৯২৩ সালে পুনরায় লন্ডনে ফিরে এসে ‘The Problem of the Rupee’ নামক প্রবন্ধের উপর গবেষণা কাজ চালিয়ে D.Sc উপাধি লাভ করেন। এরপর লন্ডনে ওকালতি শুরু করেন এবং সেখান থেকে Bar-at-Law ডিগ্রী লাভ করেন।

স্বদেশে ফিরেই ১০ বছর চাকুরি করার অংগীকার অনুযায়ী ড. আম্বেদকর বরোদা স্টেট-এ যোগদান করলেন। মহারাজা তাঁকে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব ন্যস্ত করার সিদ্ধান্ত নিলেন। তবে তার আগে অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য প্রথমে সামরিক সচিব হিসেবে নিয়োগ দিলেন। প্রথম কর্মজীবনে প্রবেশ করেও এতোবড়ো পদবীধারী বিদ্বান ব্যক্তিকে ফের অস্পৃশ্যের সেই পুরনো ঘৃণ্য আগুনে পড়তে হলো। অফিসের শিক্ষিত কর্মকর্তা থেকে শুরু করে পিওন পর্যন্ত কেউ তাঁর সাথে কথা বলতো না, তাঁর ফাইল-পত্র টেবিলের উপর ছুঁড়ে মারা হতো, এমনকি অফিসে রক্ষিত পানীয় জল খেতে পারতেন না। এ সময়ে থাকার কোন সুব্যবস্থা না থাকায় তিনি বংশ পরিচয় গোপন রেখে এক পার্সী হোটেলে অবস্থান করছিলেন। ক’দিন পর পার্সীদের কিছু লোক জানতে পারলো যে, তাদের হোটেলে অবস্থানকারী লোকটি একজন অস্পৃশ্য শ্রেণীভুক্ত, সে হিন্দু নয়। তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠলো তারা। দলবদ্ধ হয়ে লাঠি-সোটা নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। আম্বেদকর কর্মদিবস শেষে হোটেলে প্রবেশের পূর্বেই বিক্ষুব্ধ পার্সী লোকজন কর্তৃক বাধাগ্রস্ত ও লাঞ্ছিত হলেন। এরপর তারা জোর করে তাঁকে সে স্থান ত্যাগ করতে বললো এবং তাঁর ব্যবহৃত জিনিসপত্র ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্রাদি ছুঁড়ে ফেলে দিলো। পাশ্চাত্যের সুধীমহলে বিপুলভাবে অভিনন্দিত কীর্তিমান এই ছাত্রটিকে শেষপর্যন্ত স্বদেশের অশিতি, মুর্খ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন লোকদের তাড়া খেয়ে নিরাশ্রিত হয়ে সারাদিন গাছতলায় বসে বড় বিষণ্ন মন নিয়ে ভাবতে হয়েছিলো, অস্পৃশ্যরা কি হিন্দু নয় ?

আম্বেদকর এই ঘটনার বিস্তারিত জানিয়ে মহারাজাকে চিঠি লিখলেন। মহারাজা তাঁর দেওয়ানকে এর বিহিত ব্যবস্থা করতে বললে দেওয়ান তার অক্ষমতার কথা মহারাজাকে জানিয়ে দিলেন। এর অল্প ক’দিন পরেই এক বুক কষ্ট নিয়ে আম্বেদকর বোম্বাই ফিরে এলেন। এ ঘটনায় হিন্দু সমাজের জঘন্যতম রূপটিও তাঁর কাছে স্পষ্ট হয়ে গেলো। এর উৎসটাকে চিহ্নিত করতেও তাঁর কষ্ট হলো না।

অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে আন্দোলন…
বরোদা থেকে আম্বেদকর যখন বোম্বাই ফিরে এলেন এবং সিডেনহ্যাম কলেজ অব কমার্স এ্যান্ড ইকনমিক্স কলেজে আইনের অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন, এখানেও অস্পৃশ্যতার ন্যাক্কারজনক থাবা থেকে তিনি মুক্ত ছিলেন না। বর্ণহিন্দু ছাত্ররা প্রথমে তাঁর ক্লাশ বর্জন করলো, সহকর্মী শিক্ষকরা তাঁর সাথে এক টেবিলে বসে চা-পান ও গল্প-গুজব করতেন না এবং স্টাফরুমের কলসী থেকে জল পানের ক্ষেত্রেও তাদের আপত্তি ছিলো। এ সময়ে চলমান রাজনীতিতে ভারতে স্বায়ত্বশাসনের দাবী জোরদার হয়ে উঠেছে। তখন ভারত সচিব মন্টেগু সাম্প্রতিক অবস্থা সরাসরি জানার জন্য ভারতে আসেন। বিভিন্ন সংগঠন ও জাতিগোষ্ঠি তার কাছে বিভিন্ন দাবী-দাওয়া পেশ করতে লাগলো। এরই মধ্যে ১৯১৮ সালের ২৩ ও ২৪ মার্চ বোম্বাইতে ডিপ্রেসড ক্লাশেস মিশনের পক্ষে বরোদার মহারাজা সয়াজিয়া গাইকোয়ারের পৌরহিত্যে ভারতের অনেক নেতৃবর্গের উপস্থিতিতে যে মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, সেখানে বালগঙ্গাধর তিলক বলেন যে- অস্পৃশ্যতা হিন্দু সমাজের একটি মস্তবড় ব্যাধি এবং একে অবশ্যই দূর করতে হবে। স্বয়ং ভগবান অস্পৃশ্যতাকে সমর্থন করলেও তিনি করবেন না। অথচ সম্মেলনের ইশতেহারে যখন বলা হলো, কোন নেতা তাদের দৈনন্দিন জীবনে অস্পৃশ্যতা মানবেন না, তখন তিলকই সেই ইশতেহারে সই করলেন না।

রাজনীতির প্রাথমিক অভিজ্ঞতাতেই এমন জ্বালাময়ী বক্তব্য দানকারীদের স্বরূপটাকে ভালোভাবে বুঝে নিতে ভুল করলেন না তিনি। কথায় ও নিজের জীবনাচারে প্রচণ্ড স্ববিরোধী এসব চরিত্রের সাথে কখনোই আপোষকামী না হবার দৃঢ়তাটা আম্বেদকর তখনই নিজের মধ্যে ধারণ করে নিলেন। ফলে নেতৃস্থানীয় ইন্ডিয়ান স্কলার হিসেবে ড. আম্বেদকরকে মন্টেগু চেম্বসফোর্ড রিফর্মস এর ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পর্কে সাউথবোরো কমিটিতে আমন্ত্রণ জানালে তিনি নির্যাতিত শ্রেণীর জন্য পৃথক নির্বাচন ও সংখ্যানুপাতে আসন সংরক্ষণের কথা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন। ফলে ১৯১৯ সালের নতুন আইনে (Government of India Act 1919) নির্যাতিত শ্রেণীর রাজনৈতিক অধিকার প্রথম স্বীকৃত হয়। এ আইনে কেন্দ্রীয় আইন সভায় নির্যাতিত শ্রেণীর বেশ কিছু সংখ্যক সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

এ সময়ে অস্পৃশ্যদের শিক্ষার প্রসার ও জাতিগত বিধিনিষেধের অবসানকল্পে কোলাপুরের মহারাজা শাহু মহারাজ আন্তরিক উৎসাহ নিয়ে এগিয়ে এলে তাঁরই অর্থায়নে ১৯২০ সালে ড. আম্বেদকর ‘মুকনায়ক’ নামক একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। প্রথম সংখ্যাতেই ড. আম্বেদকর হিন্দুধর্মীয় বৈষম্যনীতির কঠোর সমালোচনা করেন। এ বছরের মে মাসে নাগপুরে শাহু মহারাজের সভাপতিত্বে একটি সর্বভারতীয় অস্পৃশ্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। অস্পৃশ্যদের জন্য এটাই প্রথম সর্বভারতীয় সম্মেলন। এই সম্মেলনে ড. আম্বেদকরের চেষ্টায় অস্পৃশ্য মাহারদের আঠারটি সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্মিলিতভাবে ভোজোৎসবের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ মাহার সম্প্রদায় গড়ে তোলা হয়। এরপরই ড. আম্বেদকর বিদেশী বন্ধু মিঃ নাভাল ভাথেনার আর্থিক সহযোগিতায় ব্যারিস্টারি সনদপ্রাপ্ত হওয়ার পর স্বাধীনভাবে আইন ব্যবসায় নেমে পড়েন এবং নিজ যোগ্যতায় এতে সাফল্য অর্জন করেন।

ইতোমধ্যে নির্যাতিত শ্রেণীর প্রতিনিধি হিসেবে এস.কে. বোলে কেন্দ্রীয় আইন সভায় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব পাশ করান। তা হলো পুকুর, জলাশয়, বিদ্যালয়, হাসপাতাল, সরকারি অফিস, কোর্ট কাচারিতে নির্যাতিতদের সমানাধিকার থাকবে। আইনগতভাবে পাশ হলেও বাস্তবে তা কার্যকরি হলো না। এদিকে গান্ধীজী খেলাফত আন্দোলনে যোগ দিয়ে রাজনীতিতে মার খাওয়ার পর ১৯২৪ সালে ‘হরিজন’ সম্প্রদায়ের কল্যাণে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেন। এর পেছনে অস্পৃশ্যদের কল্যাণের চেয়ে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটাই যে প্রধান ছিলো ড. আম্বেদকর তা বুঝতে পেরেছিলেন ঠিকই। একই বছর ১৯২৪ সালে ড. আম্বেদকর অস্পৃশ্যদের উপর চাপিয়ে দেয়া বাধা নিষেধ দূর করার প্রয়াসে কেন্দ্রীয় সংগঠনের গোড়াপত্তন করার উদ্দেশ্যে একটি সম্মেলন আহ্বান করেন। এই সম্মেলন থেকেই স্যার চিমনলাল শীতলবাদকে সভাপতি করে ২৯ জুলাই ‘বহিষ্কৃত হিতকারিণী সভা’ নামে একটি সমিতি গঠিত হয়। এই সমিতির মাধ্যমে ১৯২৫ সালের গোড়া থেকেই দলিত সম্প্রদায়ের সহায়তামূলক কিছু শিক্ষা ও আর্থ-সামাজিক উদ্যোগ যেমন ছাত্রাবাস নির্মাণ, পত্রিকা প্রকাশ, ফ্রি রিডিং রুম স্থাপন, মাহার হকি কাব গঠন ইত্যাদি বাস্তবায়ন করা শুরু হয়। ড. আম্বেদকরের এই উদ্যোগ দক্ষিণ ভারত তোলপাড়সহ ভারতের অন্যান্য প্রান্তেও আছড়ে পড়ে নতুন এক আন্দোলনের ঢেউ তুলতে লাগলো।

এরই মধ্যে ১৯২৬ সালের মার্চ মাসে মাদ্রাজে সংঘটিত আর একটি ঘটনার খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশব্যাপি উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। মুর্গেসন নামক একজন অস্পৃশ্য যুবক ঝড়-বৃষ্টিতে বিপণ্ন হয়ে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে তাদের জন্য নিষিদ্ধ একটি মন্দিরে ঢুকে পড়লে মন্দির অপবিত্র করার দায়ে দণ্ডিত হয়ে উচ্চবর্ণ লোকদের হাতে তাকে প্রাণ দিতে হয়। আম্বেদকর এ ঘটনাবলী গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে তাঁর ‘মুক-নায়ক’ পত্রিকার সম্পাদকীয়তে ফলাও করে ছাপতে থাকলে আন্দোলনের তীব্রতা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এরপর তিনি সাধারণ মানুষের কাতারে গিয়ে জ্বালাময়ী ও উদ্দীপনামূলক বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে অস্পৃশ্যদের মনে এক অভূতপূর্ব আত্মপ্রত্যয়ের সৃষ্টি করতে লাগলেন। আত্ম নির্ভরতা, আত্ম উন্নয়ন ও আত্মসম্মান, এই তিনটি মূলমন্ত্রকে সামনে রেখে অত্যন্ত প্রাঞ্জলভাবে তাঁর বক্তব্য প্রকাশ করতে লাগলেন-
‘আমাদেরও জন্মভূমির উপর অন্যান্যদের মতো সমান অধিকার রয়েছে, যে অধিকার থেকে আমাদেরকে শত সহস্র বছর ধরে বঞ্চিত রাখা হয়েছে। আজ মরনপণ সংগ্রাম করেও সে অধিকার আমাদের আদায় করে নিতে হবে।’
তিনি আরো বলতেন-
‘আগে নিজেকে জাগ্রত করতে হবে। যারা মানুষ হয়েও সমাজে পশুর চেয়ে অধম, যুগ যুগান্তরে সমাজের প্রাণপণ সেবা করেও হিন্দু সমাজের যে সব ধূর্ত ও প্রবঞ্চকের দল তাদের শত সহস্র বছরকাল অস্পৃশ্যতার মালা পড়িয়ে কুকুর বিড়ালের চেয়েও বেশি ঘৃণ্য করে এসেছে সেই সমস্ত মানুষদের প্রথম প্রয়োজন মানুষের অধিকার লাভ। অন্যথায় তাদের জীবনে রাজনৈতিক স্বাধীনতার কোন ভিত্তি নেই।’

চৌদার পুকুর অভিযান ও 'বাবা সাহেব' খ্যাতি অর্জন
১৯২৩ সালের কেন্দ্রীয় আইন সভায় গৃহীত ‘বোলে প্রস্তাব’ অনুযায়ী মাহাদ মিউনিসিপালিটি ১৯২৪ সালে চৌদার পুকুর অস্পৃশ্যদের জন্য মুক্ত করা হবে বলে ঘোষণা প্রকাশ করেছিলো। কিন্তু মুসলমান ও খ্রীস্টানরা এই পুকুরের জল অবাধে ব্যবহার করলেও অস্পৃশ্যদের ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাধা-নিষেধ ঠিকই বলবৎ রইলো। এমন কাগুজে ঘোষণার মধ্যে অস্পৃশ্যদের অধিকার সীমাবদ্ধ থাকার প্রেক্ষিতে ১৯২৭ সালে ড. আম্বেদকর এবার সরাসরি কার্যকর আন্দোলনে নামার সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি এ বছরের ১৯ ও ২০ মার্চ মাহাদে একটি সম্মেলন আহ্বান করলেন। এ সম্মেলনে বিভিন্ন জেলা থেকে প্রায় দশ হাজার প্রতিনিধি ও কিছু উদারমনা বর্ণহিন্দু ব্যক্তির উপস্থিতিতে ড. আম্বেদকর এক জ্বালাময়ী বক্তৃতায় বলেন-
‘আমরা যদি নিজেদের মর্যাদা নিজেরা সৃষ্টি করতে না পারি কেউই আমাদের মর্যাদা দেবে না এবং পদে পদে অপমান ও ঘৃণা করবে। আমাদের প্রত্যেককে শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে। ভবিষ্যৎ বংশধরদের যদি আমাদের চেয়ে উন্নতস্তরে পৌঁছে দেয়ার চেষ্টা না করি তবে আমাদের সঙ্গে পশুদের পার্থক্য কোথায় ?’
এ সম্মেলনে প্রথম দিনে ১৯২৪ সালে গৃহীত বোলে প্রস্তাবসমূহ অবিলম্বে বাস্তবায়নে সরকারী দৃষ্টি আকর্ষণের প্রস্তাব রাখা হয়। এবং দ্বিতীয় দিনের সম্মেলন শেষে প্রতিনিধিগণ এক বিরাট শোভাযাত্রা নিয়ে চৌদার পুকুর অভিমুখে যান। ড. আম্বেদকর প্রথম পুকুরের জল স্পর্শ ও পান করে অস্পৃশ্যদের হাজার বছরের অনধিকার ভেঙ্গে দেন। সাথে সাথে সহস্র মানুষের জয়ধ্বনিতে পুকুর প্রাঙ্গণ মুখরিত হয়ে ওঠে এবং নির্যাতিত শ্রেণীর হাজার হাজার জনতা সমস্বরে ড. আম্বেদকরকে ‘বাবা সাহেব’ বলে আখ্যায়িত করলেন। এরপর জনতা আনন্দ মিছিল নিয়ে নিকটবর্তী বীরেশ্বর প্যান্ডেলে ফিরে আসেন।

এদিকে কুচক্রী বর্ণ হিন্দুরা অপপ্রচার করতে লাগলো যে, অস্পৃশ্যরা শুধু পুকুরের জলই অপবিত্র করে নাই, তার বীরেশ্বরের মন্দিরও অপবিত্র করতে আসছে। ফলে একদল হামলাবাজ অতর্কিতে প্যান্ডেল আক্রমণ করে। এ হামলার খবর ডাক বাংলোতে অবস্থানরত ড. আম্বেদকরের কানে পৌঁছলে তিনি দ্রুত পুলিশ কর্তৃপক্ষকে প্রতিহত করার আহ্বান জানিয়ে কয়েকজন সহচর নিয়ে দ্রুত প্যান্ডেল অভিমুখে ছুটে এসে হামলাকারীদের উদ্দেশ্যে জানালেন যে মন্দির অভিযানের কোন পরিকল্পনা তাদের নেই। এমন সময় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা নেতৃবর্গ ও অস্পৃশ্য সাধারণ জনগণ তাদের প্রিয় নেতার সামনে এসে পাল্টা হামলা চালাবার নির্দেশ দানের জন্য আবেদন জানালে তিনি তাদেরকে আইনানুগ ব্যবস্থায় বিহিত ব্যবস্থা করবেন বলে আশ্বস্ত করেন।

আন্দোলনের তীব্রতা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। দেশের সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়লো। কেউ মধ্যপন্থা অবলম্বন করলেন, কেউ আম্বেদকরের পাশে এস দাঁড়ালেন। এদের একজন বীর সাভারকর। যিনি স্পষ্ট ভাষায় উচ্চারণ করলেন-
‘অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ শুধু যুগোপযোগী নীতি বা কর্তব্য হিসেবেই নয়, মনুষ্যত্বের ন্যায়বিচার ও হিন্দু ধর্মের বৃহত্তর স্বার্থের জন্যেও অবিলম্বে এ ব্যাধি অপসারণ করা দরকার। গোবর ও গোমূত্র নামক পশুমল দ্বারা পবিত্রকরণের হিন্দু ব্যবস্থার ঘৃণ্য ও হাস্যকর বিধান থেকে হিন্দু ধর্মকে মুক্ত করা প্রয়োজন।
উত্তেজনা তীব্র হতে থাকলে ১৯২৭ সালের ৪ঠা আগস্ট হঠাৎ করে মাহাদ মিউনিসিপালিটি এক অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে চৌদারপুকুরটিকে অস্পৃশ্যদের কাছে উন্মুক্ত রাখার ১৯২৪ সালের প্রস্তাবটি প্রত্যাহার করে নেয়।  এ ঘটনা ড. আম্বেদকরের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিলো। এর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ তিনি ১৯২৭ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর বোম্বাইয়ের দামোদর হলে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করেন। এতে মাহাদ মিউনিসিপালিটির অবৈধ প্রস্তাবের তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করা হয় এবং সর্বসম্মতিক্রমে এই অন্যায় আদেশের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এখান থেকেই ২৫ ও ২৬শে ডিসেম্বর চৌদার পুকুরে সত্যাগ্রহ পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। চরম উত্তেজনার মধ্য দিয়ে ২৫শে ডিসেম্বর পনের হাজার সত্যাগ্রহীর উপস্থিতিতে সম্মেলন শুরু হলো। ইতোমধ্যে কয়েকজন ব্যক্তি পুকুরটিকে তাদের ব্যক্তিগত দাবী করে কোর্টে কাগজপত্র দাখিল করেছিলো। তাই কোর্ট কর্তৃক পুকুরটি সর্বসাধারণের সম্পত্তি হিসেবে প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত সেখানে সত্যাগ্রহ মূলতবী রাখার জন্য জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের অনুরোধের প্রেক্ষিতে সত্যাগ্রহ স্থগিত রাখার প্রস্তাব গৃহিত হয়। এই সম্মেলনেই ড. আম্বেদকর হিন্দুধর্মের পবিত্র গ্রন্থ ‘মনুসংহিতা’র তীব্র সমালোচনা করে বলেন-
‘মনুসংহিতাকে হিন্দু ধর্মের আচরণবিধির পবিত্র গ্রন্থরূপে গণ্য করা হয়। মনুস্মৃতিকে ব্রাহ্মণ জগদীশ্বর বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, শূদ্রের সম্পদ অর্জনকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং ব্রাহ্মণেরা শূদ্রের সম্পত্তির ন্যায়সঙ্গত অধিকারী বলে স্বীকৃত হয়েছে। যে কোন বর্ণের নারী ব্রাহ্মণদের উপভোগের বস্তু। গ্রন্থটি ব্রাহ্মণ্যবাদের কালাকানুন এবং সভ্যসমাজের কলঙ্ক। কাজেই গ্রন্থটিকে অবিলম্বে ভষ্মীভূত করা প্রয়োজন।’
তাঁর এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে সম্মেলনের উত্তেজনা বৃদ্ধি পেলো। ফলে এই সম্মেলন থেকেই প্রথম মানবাধিকারের এক সনদপত্র পাশ করানো সহ হিন্দুধর্মের পবিত্র গ্রন্থ মনুস্মৃতির প্রজ্জ্বলন সংক্রান্ত প্রস্তাব গৃহীত হলো এবং সর্বসম্মতিক্রমে ২৫ ডিসেম্বর রাত ৯টায় সোচ্চার ধিক্কার ও বিপুল আনন্দধ্বনির মধ্য দিয়ে সর্বসমক্ষে ‘মনুস্মৃতি’র বহ্ন্যুৎসব করা হয়।
এদিকে পরবর্তী তিন বছর ধরে চলা চৌদার পুকুরের মামলায় শেষপর্যন্ত অস্পৃশ্যরাই জয়লাভ করলো। আর এই মাহাদ আন্দোলনের ফলশ্রুতিতেই অল্প সময়ের মধ্যে ড. আম্বেদকরের পক্ষ সারা ভারতে তফসীলি বা দলিত আন্দোলনও গড়ে তোলা সম্ভব হলো।

সাইমন কমিশন রিপোর্ট
১৯২৮ সালের প্রথম সপ্তাহে ভারতের সমস্যাবলী সমীা করার জন্য স্যার জন সাইমনের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি বৃটিশ প্রতিনিধি দল বোম্বাই আসে যা ‘সাইমন কমিশন’ (Simon Commission) নামে পরিচিত। এখানে কোন ভারতীয়কে অন্তর্ভুক্ত না করায় ভারতীয় কোন রাজনৈতিক দলই এই কমিশনকে স্বাগত জানায়নি। এই সময় কংগ্রেস কর্তৃক হিন্দু, মুসলমান, পার্সী, শিখ, দ্রাবিড় ও এ্যাংলো ইন্ডিয়ান প্রভৃতি প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সর্বভারতীয় সম্মেলন আহূত হলেও এই সম্মেলনে নির্যাতিত শ্রেণীর কোন প্রতিনিধিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। তবে সাইমন কমিশনের কাজে সহায়তা করার জন্য আইন সভার সদস্যদের নিয়ে প্রত্যেক প্রদেশের গঠিত কমিটিতে বোম্বাই থেকে আম্বেদকর মনোনীত হন। নির্যাতিত শ্রেণীর ১৬টি সংস্থা সাইমন কমিশনের কাছে পৃথক নির্বাচনের দাবী জানায়। ড. আম্বেদকর তাঁর ‘বহিষ্কৃত হিতকারিনী সভা’র পক্ষ থেকে সংরক্ষিত আসনে যুক্ত নির্বাচন ব্যবস্থা এবং নির্যাতিত শ্রেণীর জন্য পৃথক আসন দাবী করেন। শেষাবধি কমিশনের সাথে ঐকমত্যে আসতে না পেরে তিনি দেশ ও জাতির বৃহত্তর কল্যাণ ও ঐক্যের প্রতি অধিকতর গুরুত্ব আরোপ করে আলাদাভাবে রিপোর্ট পেশ করেন। এই রিপোর্ট প্রকাশিত হবার পর ড. আম্বেদকর সত্যিকার দেশপ্রেমিক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিতি পান।

১৯৩০ সালের আগস্ট মাসে আম্বেদকরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সর্বভারতীয় নির্যাতিতদের নিয়ে নাগপুরে এক সম্মেলন সভায় তিনি বলেন-
‘জাতিধর্ম নির্বিশেষে অখণ্ড জাতীয়তাবোধের মাধ্যমে ভারতীয়দের পক্ষে স্বাধীন সরকার গঠন সম্ভব। তবে সংবিধান তৈরিকালীন সময়ে বিভিন্ন জাতির সুবিধা অসুবিধার দিকসমূহ বিবেচনার দাবী রাখে। … এক দেশের উপর অন্য দেশের শাসন যেমন বরদাস্ত করা যায় না, তেমনি কোন জাতি বা শ্রেণীর শাসনকে ভাল বলে মেনে নেওয়া যায় না।’
মন্দির প্রবেশ অভিযান
আম্বেদকরের উস্কে দেয়া দলিত আন্দোলন ভারতব্যাপী ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্নস্থানে এই আন্দোলন নির্যাতিতদের শত শত বছরের নিষিদ্ধ থাকা মন্দিরে প্রবেশের অধিকার আন্দোলনেও একাত্ম হয়ে পড়ে। এসব আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন স্থানে মন্দির ও পূজা কমিটি অস্পৃশ্যদের পূজামণ্ডপে প্রবেশের অনুমতি দিতে বাধ্য হয়। কোথাও কোথাও সংঘর্ষের রূপ নেয়। ইতোমধ্যে বর্ণবাদী হিন্দু প্রতিনিধি গান্ধিজী মন্দির প্রবেশের এসব আন্দোলনকে বানচাল করার জন্য বিভিন্ন কূট কৌশল প্রয়োগ করতে লাগলেন। আম্বেদকর বুঝতে পারছিলেন যে গান্ধিজীও আসলে হরিজনদের মন্দির প্রবেশের অনশন আন্দোলনের নামে এক কূট-রাজনীতি শুরু করে দিয়েছেন। তাই তার অনুগামী সবাইকে সতর্ক করে দিয়ে বলে দিলেন যে, কোন মানুষের মধ্যে অত্যুজ্জ্বল সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটাতে দেখলে তাকে সাধারণ মানুষ থেকে আলাদা ভেবে অবতারে পরিণত করাই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রচলিত রেওয়াজ। তারা অস্পৃশ্যরা যেন কখনও তাঁর (আম্বেদকর) উপর দেবত্ব আরোপ না করেন। একমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতাই তাদের পার্থিব দুঃখ দুর্দশার হাত থেকে রা করতে পারে। তিনি আরো বলেন-
‘ভগবানের প্রতি ভক্তি, কোন মহাত্মার পেছনে ছোটা, তীর্থ গমন, অনশন বা উপবাসে মুক্তি মিলবেনা, মুক্তি মিলবে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে।’

লন্ডনে গোলটেবিল বৈঠক
ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে লন্ডনে অনুষ্ঠিত ১৯৩০ ও ১৯৩১ সালের প্রথম ও দ্বিতীয় গোলটেবিল বৈঠক (Round Table Confarence) যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ ছিলো। এখানে মহাত্মা গান্ধী, মহম্মদ আলী জিন্নাহ, এ কে ফজলুল হক, শিখ নেতা উজ্জল সিং প্রমুখ ভারতের সব রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি ও বিভিন্ন রাজ্যের ভারতীয় রাজন্যবর্গের সাথে ভারতের বড়লাট কর্তৃক এই প্রথম দলিত প্রতিনিধি হিসেবে ড. আম্বেদকরও আমন্ত্রিত হন। সেখানে মহাত্মা গান্ধী নির্যাতিত শ্রেণীর জনগণের সমস্যাকে মামুলি ব্যাপার বলে উপেক্ষা করতে চাইলেও আম্বেদকর দলিত সম্প্রদায়ের পক্ষে বাস্তব অবস্থা বিশ্লেষণ করে কড়া যুক্তিসহকারে বিভিন্ন দাবী দাওয়া উত্থাপন করেন। শেষপর্যন্ত এই গোলটেবিল বৈঠক কোন সিদ্ধান্ত ছাড়াই মূলতবি হয়ে গেলো।

ঐতিহাসিক পুনা চুক্তি
১৯৩২ সালের জানুয়ারিতে ‘ফ্রান্সাইজ কমিটি’র আহ্বানে কমিটির সদস্যদের সাথে আম্বেদকর ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ পরিভ্রমণকালে সর্বত্রই তাঁর উদ্যোগে নির্যাতিত শ্রেণীর লোকেরা কমিটির কাছে তাদের পৃথক নির্বাচনের দাবী জানিয়েছেন।
তখন কেন্দ্রীয় আইন সভায় নির্যাতিত শ্রেণীর প্রতিনিধি ছিলেন এম.সি রাজা। তিনি প্রথমে ড. আম্বেদকরের পৃথক নির্বাচনের সক্রিয় সমর্থক হলেও পরবর্তীতে ড. মুঞ্জের সাথে একত্রে সংরক্ষিত আসনের ভিত্তিতে যুক্ত নির্বাচনের দাবী জানিয়ে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্মারকলিপি প্রেরণ করে আম্বেদকরকে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলে দিলেন।

ড. আম্বেদকর পূর্বে সংরক্ষিত আসনে যুক্ত নির্বাচনের পক্ষপাতী ছিলেন এবং সাইমন কমিশনে উক্ত দাবী করেছিলেন। কিন্তু আম্বেদকরের এই দাবী গান্ধিজী মেনে নিতে অপরাগতা প্রকাশ করায় নির্যাতিত জনসাধারণ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং ড. আম্বেদকরও পৃথক নির্বাচনের জোরালো দাবী তোলেন। এই দাবীর সমর্থনে সারা ভারতে প্রচণ্ড উত্তেজনা দেখা দেয় এবং নির্যাতিত শ্রেণীর অনেক সংগঠন এই দাবীর সমর্থনে এগিয়ে আসে।

১৯৩২ সালের ১লা মে ‘ফ্রান্সাইজ কমিটি’র অধিবেশন শেষ হয়। এই কমিটি কর্তৃক নির্যাতিত শ্রেণী বলতে কাদেরকে বুঝাবে তার একটি সুস্পষ্ট সংজ্ঞা তৈরি করা হয়। তা অনুসারে হিন্দু সমাজের যে সমস্ত শ্রেণীর মানুষকে অস্পৃশ্য হিসেবে গণ্য করা হয় তারাই ‘নির্যাতিত শ্রেণী’ (Depressed Classes) নামে চিহ্নিত হবে।

এ প্রেক্ষিতে ৭ মে নাগপুরে ১৫/২০ হাজার লোকের সমাবেশের মধ্য দিয়ে সর্বভারতীয় দলিত বা নির্যাতিত শ্রেণীর মহা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে ড. আম্বেদকরের দাবীকে সমর্থন করে নির্যাতিতদের পৃথক নির্বাচনের দাবী সমর্থিত হয় এবং রাজা-মুঞ্জে ফ্যাক্টকে নির্যাতিত শ্রেণীর স্বার্থ বিরোধী বলে ঘোষণা করা হয়।

এদিকে এম.সি রাজার ডিগবাজীর কারণে বিচলিত আম্বেদকর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সাথে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন এবং শীঘ্রই লন্ডনের পথে যাত্রা করেন। ১৯৩২ সালের ৭ জুন লন্ডনে পৌঁছে দাবী সম্বলিত ২২ পৃষ্ঠার এক স্মারকলিপি ব্রিটিশ কেবিনেটে পেশ করেন এবং উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করে নির্যাতিত শ্রেণীর অনেক বিষয়াদি সম্পর্কে তাদের অবহিত করান।

১৯৩২ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক সাম্প্রদায়িক বন্টনের রায় ঘোষিত হয়। এতে পশ্চাৎপদ শ্রেণীর জন্য প্রাদেশিক আইন সভায় পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা এবং দ্বৈত ভোটাধিকারের ব্যবস্থাও স্বীকৃত হয়। এই দ্বৈত ভোট পদ্ধতি হলো- একটি ভোট নিজেদের প্রার্থীকে এবং অন্যটি সাধারণ প্রার্থীকে প্রয়োগ করতে পারবে। এছাড়া ভারতের অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্যেও পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থা স্বীকৃত হয়। ফলে পার্লামেন্টে হিন্দুরা সংখ্যালঘিষ্ট হয়ে পড়ার আশঙ্কায় হিন্দু স্বার্থ সংশ্লিষ্ট পত্র-পত্রিকাগুলো সাম্প্রদায়িক বন্টনের বিরুদ্ধে তীব্র আক্রমণাত্মক খবর ছাপতে থাকে। এতে সবচেয়ে বেশি আঘাতপ্রাপ্ত হলেন পুনার যারবেদা জেলে অবস্থানরত বর্ণ হিন্দুদের প্রধান স্বার্থরাকারী প্রতিভূ মহাত্মা গান্ধী। এই সাম্প্রদায়িক বন্টনের ফলে তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সমস্ত প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে চলেছে এই ধারণার বশবর্তী হয়ে নির্যাতিত শ্রেণীর বহু প্রত্যাশিত ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক অনুমোদিত পৃথক নির্বাচন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে এই প্রথম গান্ধিজী আমরণ অনশনের শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করলেন।

গান্ধিজীর আমরণ অনশনের সিদ্ধান্ত কংগ্রেস নেতাকর্মীদের মধ্যে বেশ উত্তেজনার সৃষ্টি করলো। গান্ধিজীর জীবন রক্ষার জন্য কেউ কেউ ড. আম্বেদকরের ঐকান্তিক সহযোগিতা কামনা করলেন। অসংখ্য টেলিগ্রাম ও পত্র মারফত কেউ সাম্প্রদায়িক বন্টনের দাবী ত্যাগের অনুরোধ করতে লাগলেন, কেউ বা ড. আম্বেদকরের জীবননাশের হুমকি দিতে লাগলেন, আবার কেউ সাম্প্রদায়িক বন্টনের সিদ্ধান্তে অটল থাকার অনুরোধ জানালেন। আম্বেদকর তাঁর সিদ্ধান্তে অবিচল রইলেন। নির্যাতিত জনগণের অধিকারকে ক্ষুণ্ন করতে তিনি নারাজ। লন্ডনে অনুষ্ঠিত গোল টেবিল বৈঠকে নির্যাতিত শ্রেণীর জনগণের সমস্যাকে যে গান্ধিজী মামুলি ব্যাপার বলে উপেক্ষা করেছিলেন, অথচ আজ তিনি সেই মামুলি সমস্যার জন্য কেন আমরণ অনশন পালনের সিদ্ধান্ত নিলেন ?

ড. আম্বেদকর প্রশ্ন তোলেন-
গান্ধিজী তো ইংরেজদের দেশ ছাড়তে, মুসলমান বা অন্যান্য সংলঘুদের পৃথক নির্বাচনের বিরুদ্ধে বা সমাজ থেকে চিরতরে অস্পৃশ্যতার মূলোৎপাটন করতে কোনদিন আমরণ অনশনে যাননি। আসলেই তিনি শক্ত মাটিতে পদাঘাত করার মত মুর্খ নন। অন্যান্য সংখ্যালঘুদের পৃথক নির্বাচনে যদি ভারতের জাতীয়তা নষ্ট না হয় তাহলে অস্পৃশ্যদের পৃথক নির্বাচনে ভারতের জাতীয়তা নষ্ট হবে কেন ?
পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গান্ধিজীর আমরণ অনশন শুরু হয়ে গেলে ১৯৩২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর বোম্বাইয়ের ‘ইন্ডিয়ান মার্চেন্টস চেম্বার হলে’ পণ্ডিত মদনমোহন মালব্যের সভাপতিত্বে বর্ণবাদী হিন্দুদের একটি সম্মেলন আহুত হয়। এই প্রথম এরকম একটি সম্মেলনে ড. আম্বেদকর আমন্ত্রিত হলেন। এ সভায় অন্যান্যদের মধ্যে যাঁরা উপস্থিত ছিলেন ড. মুঞ্জে, ড. সোলাংকি, চিমন লাল শীতলবাদ, ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ, ড. দেশমুখ, ড. সাভারকর, মানু সুবেদার, কমলা নেহেরু, তেজ বাহাদুর সপ্রু, চৈত রাম, অ্যানি বেসান্ত, ঠক্কর, কে নটরাজন ও পি.ও গিদওয়ানী প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।

সভাপতির অনুরোধক্রমে প্রথমে ড. আম্বেদকর তাঁর নাতিদীর্ঘ বক্তৃতায় বলেন-
‘…এটা দুঃখের বিষয় যে, গান্ধিজী নির্যাতিত শ্রেণীর জনগণের স্বার্থের বিরুদ্ধে আমরণ অনশন শুরু করেছেন। সকলে যে তাঁর মূল্যবান জীবন রক্ষার জন্য ব্যাকুল হবেন এটাই স্বাভাবিক। আপনারা হয়তো আমাকে নিকটতম ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে গুলি করে মারতে পারেন, কিন্তু আমি যে পবিত্র দায়িত্ব ও কর্তব্যভার গ্রহণ করেছি তা থেকে আমি বিচ্যুত হতে পারবো না। গান্ধিজী কোন বিকল্প প্রস্তাব না রাখায় আমি এই সমস্যার সমাধান খুঁজে পাচ্ছি না। আপনারা বরং গান্ধিজীকে এক সপ্তাহের জন্য অনশন বন্ধ রাখতে অনুরোধ জানান এবং এই সময়ের মধ্যে কোন না কোন একটা সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে।’
প্রস্তাব চালাচালি শুরু হলো। কিন্তু দুপক্ষের কারো প্রস্তাব কেউ গ্রহণ করতে পারছেন না।
এদিকে গান্ধিজীর শারীরিক অবস্থা ক্রমেই খারাপের দিকে যাচেছ। বিষয়টি ড. আম্বেদকরকে চিন্তিত করে তুললো। কেননা কোন দুর্ঘটনা ঘটে গেলে গান্ধিজীর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ভারতে অস্পৃশ্য নির্যাতিত শ্রেণীর উপর  সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও ব্যাপক হতাহত হবার তীব্র সম্ভাবনা দেখা দিতে লাগলো। উপায়ান্তর না দেখে ড. আম্বেদকর ২৪ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত বৈঠকে একটা আপোষ রফায় চলে আসার সিদ্ধান্ত নিলেন। এই আপোষ চুক্তিতে গান্ধিজী যে ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন তা অভিনব। কার্যোদ্ধারের জন্য পরম শত্রুর কাছেও পরম মিত্রের অভিনয় করার দক্ষতা। ফলে বৃটিশরাজ কর্তৃক সাম্প্রদায়িক বন্টনের ভোট পদ্ধতিতে বন্টিত ৭৮ টি আসনের পরিবর্তে নির্যাতিত শ্রেণীর জন্য এখন ১৪৮ টি আসনে বৃদ্ধি করা হলো বটে, কিন্তু সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো তাদের কাছ থেকে দ্বিতীয় ভোটাধিকার হরণ করে নেয়া হলো। যার মাধ্যমে অস্পৃশ্যরা সহজেই সাধারণ নির্বাচনকে প্রভাবান্বিত করতে পারতো, সেই পথ পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়া হলো। এই চুক্তি ভারতের ইতিহাসে ‘কুখ্যাত পুনা চুক্তি’ (Poona Pact) নামে চিহ্নিত হয়ে আছে।

স্ত্রীবিয়োগ
১৯৩৫ সালে বোম্বাই সরকারি আইন কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন। দু’বছর তিনি এ পদে অধিষ্ঠিত থাকেন। এদিকে ছোটকাল থেকে লালন করে আসা সুপ্ত স্বপ্নটিকে এবার বাস্তবায়ন ঘটাতে লাগলেন। বোম্বাইর দাদারের হিন্দু কলোনীতে নিজের মতো করে একটি সুন্দর বাড়ি তৈরি করলেন যার উপর তলায় হলো ৫০ হাজারেরও অধিক পুস্তক পরিপূর্ণ একটি ব্যক্তিগত লাইব্রেরী। বাড়ির নাম রাখলেন ‘রাজগৃহ’। যে নামটির সাথে বৌদ্ধধর্মের প্রাচীন ইতিহাস জড়িত। কিন্তু এ সুখও সইলো না তাঁর। এ বছরেই ১৯৩৫ সালের ২৭শে মে দীর্ঘ রোগভোগের পর তাঁর স্ত্রীবিয়োগ হলো। তাঁর জীবনের সাফল্যের নেপথ্যে যে ধর্মপরায়ণা, পতিপরায়ণা ও সাংসারিক কাজে কর্মনিষ্ঠ ত্যাগী মহিলার অবদান পরতে পরতে জড়িত, জীবনের অধিকাংশ সময় পড়াশুনা, সামাজিক, সাংগঠনিক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকায় যে পরিবারের প্রতি তেমন নজর দেয়ার সুযোগ হয়নি, তাঁর মৃত্যুতে আম্বেদকর বড় নিঃসঙ্গ ও অসহায় হয়ে পড়লেন। ফলে দিন দিন আরো বেশি করে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে সচেষ্ট হতে লাগলেন।

স্ত্রীর অনেকদিনের স্বপ্ন ছিলো একবার পান্ধারপুর তীর্থভ্রমণে যাওয়ার। আম্বেদকর বারবার এড়িয়ে গিয়ে বলেছিলেন ব্রাহ্মণ্যবাদের অস্পৃশ্যতা মুক্ত হয়ে যেদিন এক নতুন পান্ধারপুর বানাতে পারবেন সেদিনই তাকে নিয়ে তীর্থে যাবেন তিনি। কিন্তু সেই স্বপ্ন বুকে নিয়েই স্ত্রীর মৃত্যু হলো। বর্ণবাদের কঠিন নিগড় থেকে এখনো হিন্দু সমাজ মুক্ত হতে পারেনি। এবার তিনি বর্ণবাদী হিন্দু সমাজের কূপমণ্ডুকতা, অসহিষ্ণুতা, গোঁড়ামি, ভণ্ডামির বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনায় মুখর হয়ে ওঠলেন। ফলে বর্ণহিন্দুরাও অত্যন্ত নির্দয় ও কটুভাবে অস্পৃশ্য তাঁর বিরুদ্ধে বিদ্বেষের বিষ ছড়াতে লাগলো। এর প্রেক্ষিতে এবার তিনি ইয়োলা সম্মেলনের ডাক দিলেন।

ইয়োলা সম্মেলন
১৯৩৫ সালের ১৩ অক্টোবর ইয়োলা সম্মেলনের দিন ধার্য হয়। আসন্ন ইয়োলা সম্মেলনে ড. আম্বেদকর ধর্ম পরিবর্তনের সিদ্ধান্ত নেবেন বলে গুঞ্জন শোনা যেতে লাগলো। নির্দিষ্ট দিনে অনুষ্ঠান শুরু হলো। অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি স্বাগত ভাষণে বলেন-
“ভারতে হিন্দু ধর্মের নামে চলছে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম, সমস্ত প্রকার সুযোগ সুবিধার পাকাপাকি ব্যবস্থা করাই ব্রাহ্মণ্যবাদের মূল কথা, ‘ভাগ কর ও শাসন কর’ এই নীতি ব্রাহ্মণ্যবাদের মৌলিক কৌশল। এই নীতিকে ধর্মের সংগে যুক্ত করে এবং তা চিরস্থায়ী করার জন্য বর্ণাশ্রমের প্রতিষ্ঠাপূর্বক ব্রাহ্মণদের বর্ণশ্রেষ্ঠ বলে ঘোষণা করা হয়। তাদের আর একটি কৌশল দেব-দেবীর সৃষ্টি, দেব-দেবীর উদ্দেশ্যে ভক্তদের দানীয় বস্তু দেব-দেবীর পক্ষে গ্রহণ করে ব্রাহ্মণ পুরোহিত কর্তৃক আত্মসাৎকরণ।”
এই অনুষ্ঠানে ড. আম্বেদকর তাঁর দীর্ঘ ভাষণে বলেন-
“…নির্যাতিত শ্রেণীর মানুষদের হিন্দু হয়েও যদি সম অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়, বিগত ১৫ বছর ধরে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা, রাজনৈতিক শোষণ, বঞ্চনার বিরুদ্ধে আন্দোলন বা সংগ্রাম করেও তাদের কাছ থেকে বিন্দুমাত্র ন্যায়বোধের পরিচয় পাওয়া না যায় তাহলে নির্যাতিত সমাজকে ভাল করে ভেবে দেখতে হবে। তাই দীর্ঘ বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদেরকে আত্মসম্মান ও মানবিক অধিকার লাভ করতে হলে হিন্দু ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হবে। … আমার চরম দুর্ভাগ্য যে, অস্পৃশ্য সমাজে জন্মেছি বলে আমাকে আত্মসম্মানহীন অপমানজনক সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে।”
তিনি দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেন-
“আমি অস্পৃশ্য হয়ে জন্মগ্রহণ করলেও অস্পৃশ্য হয়ে মরবো না।”
এই সম্মেলনে গৃহীত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হলো-
১) অস্পৃশ্যদের সামাজিক সমতা লাভের আন্দোলনের প্রতি উচ্চবর্ণের হিন্দুদের উদাসীনতা অথবা বিরোধিতাকে এই সম্মেলনে কঠোর ভাষায় নিন্দা জানায়।
২) হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী করার জন্য বিগত ১৫ বছর ধরে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের সঙ্গে নির্যাতিত শ্রেণীর হিন্দুদের সমান সামাজিক অধিকার লাভের নিমিত্ত যে আন্দোলন ও সংগ্রাম তারা চালিয়ে আসছে তা এখন থেকে বন্ধ করা হবে।
৩) অতঃপর তারা সমাজে সম্মানজনক ও সমানাধিকার লাভের জন্য ভারতের অন্য যে কোন ধর্ম গ্রহণ করবে।

ইয়োলা সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলো প্রকাশিত হওয়া মাত্র মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, শিখ প্রভৃতি বিভিন্ন ধর্মের নেতৃবর্গের কাছ থেকে এদের স্ব-স্ব ধর্ম গ্রহণের জন্য আহ্বান পত্র আসতে লাগলো এবং ড. আম্বেদকরের ধর্ম পরিবর্তনের সিদ্ধান্তে সারা ভারতে প্রচণ্ড আলোড়ন সৃষ্টি করলো। এর প্রতিক্রিয়ায় নানা জনের নানা মত ব্যক্ত হতে লাগলো। গান্ধিজী ও সমমনা নেতৃবৃন্দ চিন্তা করলেন অস্পৃশ্যরা যদি হিন্দু সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তাহলে হিন্দুর সংখ্যা কমে যাবে এবং এই অনুপাতে কংগ্রেসের শক্তি হ্রাস পাবে। অনেকে আশংকা করলেন ড. আম্বেদকর যদি তার অনুগামীদের নিয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তাহলে ভারতে মুসলমানদের শক্তি বেড়ে গেলে হিন্দুদের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াবে। ফলে হিন্দু মিশনারী নেতারা আম্বেদকরের সাক্ষাত প্রত্যাশা করলেন। আম্বেদকর স্পষ্ট ভাষায় জানালেন- ‘একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে যদি উচ্চবর্ণের হিন্দুরা হিন্দুধর্ম থেকে অস্পৃশ্যতা তুলে নেয় তবে তারা হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করবেন না।’ কিন্তু বর্ণ হিন্দুদের কাছে এ প্রস্তাব কোন গুরুত্ব পেলো না।

পরবর্তীতে অধ্যাপক এন. শিবরাজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে শিবরাজ আম্বেদকরের সিদ্ধান্তকে সমর্থন জানিয়ে বলেন-
‘হিন্দু ধর্ম আজ প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের কায়েমী স্বার্থের ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। অতএব এই ধর্ম পরিত্যাগ করা ছাড়া নির্যাতিতদের আর কোন উপায় নেই।’
একই সম্মেলনে ড. আম্বেদকর বলেন-
‘হিন্দু ধর্মের পুনর্জীবনের আর কোন সম্ভাবনা নেই, তাই অতীব দুঃখের সাথে আমাদেরকে হিন্দু ধর্ম থেকে সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে।’

রাজনৈতিক ব্যাপ্তি
১৯৩৬ সালে ড. আম্বেদকর ‘ইনডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টি’ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে এই পার্টি কেন্দ্রীয় আইন সভায় ১৫ টি আসন লাভ করে। এ সময় আম্বেদকর The Annihilation of Caste নামে একটি বই প্রকাশ করেন। এ বইয়ে হিন্দু ধর্মের বর্ণপ্রথা ও সংশ্লিষ্ট নেতৃবৃন্দের তীব্র সমালোচনা করেন। এতে তিনি অস্পৃশ্য সম্প্রদায়কে গান্ধী কর্তৃক ‘হরিজন’ (ঈশ্বরের সন্তান) নামে অভিহিত করার কংগ্রেসীয় সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ করেন।

১৯৩৯ সালের প্রথম দিকে ভাইসরয় তাঁর সরকারের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দেন। এই পদ্ধতিতে রাজ্যের প্রতিনিধিরা যোগদান করবে, কিন্তু রাজ্যে কোন দায়িত্বশীল সরকার থাকবে না। মনোনয়নের ভিত্তিতে প্রতিনিধি করা হবে। এই প্রস্তাবকে প্রত্যাখ্যান করে বিবৃতি দেন কংগ্রেস সভাপতি নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, মুসলিম লীগ এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টির পক্ষে ড. আম্বেদকর। হিন্দু মহাসভা এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানায়। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের এই প্রস্তাব নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা সমালোচনা চলতে লাগলো।
এ সময় কংগ্রেসের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব ও গান্ধিজীর সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রে সুভাষ চন্দ্র বসু সভাপতির পদ ও কংগ্রেস ত্যাগ করেন। ইতোমধ্যে ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে ভাইসরয় ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা আপাতত স্থগিত রাখেন।

তৎকালীন ভারতীয় ভাইসরয় লর্ড লিন লিথগো অক্টোবর মাসে ভারতীয় নেতৃবর্গের সাথে সাক্ষাতে মিলিত হন। এদের মধ্যে গান্ধিজী, নেহরু, ড. আম্বেদকর, জিন্নাহ, সাভারকর, বল্লভ ভাই প্যাটেল, রাজেন্দ্র প্রসাদ, সুভাস বসু বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ সাক্ষাতে ড. আম্বেদকর বলেন- পুনা চুক্তির ফলাফলে তারা খুবই ক্ষুব্ধ এবং ভবিষ্যতে ভারতীয় সংবিধান সংক্রান্ত আলোচনা হলে তাদের আরো বক্তব্য আছে।

কিছুদিন পর ভাইসরয়ের বিবৃতি প্রকাশিত হলে কংগ্রেস অসন্তুষ্টি প্রকাশ করে এবং সমস্ত প্রদেশ থেকে তাদের মন্ত্রীসভা প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা জানিয়ে দেয়। এ ঘটনার পর ড. আম্বেদকর বিবৃতি দিলেন যে,
গান্ধিজীর একনায়কত্বের মনোভাবই ভারতে সংখ্যালঘু সমস্যা সমাধানে সবচেয়ে বড় অন্তরায়।
১৯৩৯ সালের নভেম্বরে কংগ্রেসের প্রাদেশিক মন্ত্রীসভা সমূহকে পদত্যাগের নির্দেশ দেয়। এ দিনটিকে জিন্নাহ সাহেব ‘মুক্তি দিবস’ হিসেবে পালন করে। ১৯৪০ সালে মার্চ মাসে লাহোরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে মুসলিম লীগ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ট অঞ্চল নিয়ে স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দেয়। এপ্রিল মাসে রামগড়ে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের সম্মেলনে ভারত বিভাগকে কোনক্রমেই বরদাস্ত করা হবে না বলে ঘোষণা করে। হিন্দু-মুসলমানের দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগের এ প্রস্তাবকে ঘিরে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের মধ্যে মতদ্বৈধতা বাড়তে লাগলো। ১৯৪০ সালে ড. আম্বেদকরের Thoughts on Pakistan বইটি প্রকাশিত হলে ভারতীয় রাজনীতিতে বইটির প্রতিপাদ্য বিষয়কে কেন্দ্র করে মারাত্মক ঝড়ো হাওয়ার সৃষ্টি হয়। এ গ্রন্থের সারকথা হলো,
সম্পূর্ণ লোক বিনিময় পূর্বক মুসলমানদের দাবীর প্রেক্ষিতে তাদের জন্য পাকিস্তান সৃষ্টিই ভারতের সাম্প্রদায়িক সমস্যার একমাত্র বাস্তব ও স্থায়ী সমাধান। দুটি ভিন্ন শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মানসিকতা সম্পন্ন জাতিকে নিয়ে একটি দেশ গড়ে উঠতে পারে না। যে হিন্দুরা নিজেদের একটি অংশকে হাজার হাজার বছরব্যাপী ঘৃণিত ও বঞ্চিত করে রেখেছে তাদের কাছে কোন্ ভরসায় মুসলমানরা উদারতা ও সমমর্যাদা আশা করবে ?
আম্বেদকরের প্রস্তাবে জিন্নাহ সাহেব ঐকমত্য পোষণ করেন। কিন্তু গান্ধিজীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস লোক বিনিময়ের এ প্রস্তাবকে অবাস্তব বলে উড়িয়ে দেয়।

রাজনৈতিক অচলাবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে আম্বেদকর গণভোট সংক্রান্ত একটি ফর্মূলা সরকারের কাছে পেশ করেন। মুসলমান প্রধান অঞ্চলে দু’টি গণভোটের ব্যবস্থা করাই এই ফর্মূলার বিষয়। প্রথম গণভোটে মুসলমানরা ঠিক করবে তারা পাকিস্তান চায় কিনা। যদি মুসলিমরা পাকিস্তান চায় তবে প্রস্তাবিত পাকিস্তানে অমুসলিমদের গণভোট হবে যে তারা পাকিস্তানে থাকতে চায় কিনা। যদি না চায় তাহলে উক্ত প্রদেশ চায় কিনা। যদি না চায় তাহলে উক্ত প্রদেশ সমূহে সীমানা কমিশন গঠন করে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ও অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাসমূহ নির্ধারণ করা হবে এবং মুসলমানরা রাজী থাকলে মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাসমূহ নিয়ে পাকিস্তান করা যেতে পারে। পরবর্তীকালে পশ্চিম বঙ্গ ও পূর্ব পাঞ্জাব ভারতভুক্তিও ড. আম্বেদকরের উক্ত ফর্মূলার বাস্তবায়ন।

যদিও ১৯৪৫ সালে Thoughts on Pakistan এর দ্বিতীয় সংস্করণ Pakistan or Partition of India গ্রন্থে কিছু নতুন অধ্যায় সংযোজিত হয়। সংযোজিত নতুন অধ্যায়ে বলা হয়-
পৃথিবীতে এমন কিছু কিছু দেশ আছে যেখানে একাধিক জাতি একই রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পূর্ণ স্বাধীন সত্ত্বা নিয়ে বসবাস করছে। উদাহরণস্বরূপ দক্ষিণ আফ্রিকা, কানাডা, সুইজারল্যান্ড ইত্যাদি। সুতরাং পাকিস্তান সৃষ্টি না করেও মুসলমানরা একটা আলাদা জাতি হিসেবে স্বাধীন ভারতে সম্পূর্ণ পৃথক সত্তা নিয়ে বসবাস করতে পারবে। সংবিধান রচনাকালে তাদের পৃথক সত্তা সম্পর্কে সংবিধানসম্মত নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখতে হবে।
কিন্তু এ প্রস্তাব আর তৎকালীন নেতৃবৃন্দের কাছে গৃহীত হয়নি।

১৯৪১ সালের জুলাইয়ে ভাইসরয় কয়েকজন ভারতীয়কে নিয়ে একটি প্রতিরক্ষা পরামর্শদাতা কমিটি এবং এক্সিকিউটিভ কাউন্সিল গঠনের সিদ্ধান্ত নেন। প্রতিরক্ষা পরামর্শদাতা কমিটিতে ড. আম্বেদকরকে অন্তর্ভুক্ত করলেও এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে নির্যাতিত শ্রেণীর ও শিখদের মধ্য থেকে কোন প্রতিনিধি না নেওয়ায় আম্বেদকর ব্রিটিশ সরকারের কাছে অসন্তোষ প্রকাশ করেন।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আমল থেকে শুরু করে উনবিংশ শতাব্দির শেষ ভাগ পর্যন্ত নির্যাতিত শ্রেণীর যুবকদের নিয়ে গঠিত ‘মাহার ব্যাটেলিয়ান’ ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে দক্ষতা ও সাহসিকতার সাথে কাজ করে আসলেও বর্ণহিন্দুদের প্ররোচনায় অস্পৃশ্যতার ধূয়া তুলে ১৮৯২ সালে ইংরেজ সরকারের এক আদেশ বলে অস্পৃশ্যদের সামরিক বাহিনীতে নিয়োগ বন্ধ করে দেয়া হয। ড. আম্বেদকরের আপ্রাণ চেষ্টায় বৃটিশ সেনাবাহিনীতে পুনরায় মাহারদের (অস্পৃশ্য) নিয়োগদান চালু করা হয়।

১৯৪২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্টাফোর্ড ক্রিপস ভারতের রাজনৈতিক অচলবস্থা নিরসনকল্পে ভারতে আসেন। ৩০ মার্চে এক সাক্ষাতকারে ক্রিপস ড. আম্বেদকরকে ইনডিপেন্ডেন্ট লেবার পার্টির নেতা, না নির্যাতিত শ্রেণীর নেতা হিসেবে তাঁর সাথে আলোচনা করছেন এই প্রশ্ন করলে আম্বেদকরকে সমস্যায় ফেলে দেন। সেদিনই তিনি তার অনুগামী ও অফসিলী নেতাদের নিয়ে দিল্লীতে এক বৈঠকে বসলেন। সারা ভারতে তফসিলীদের নিয়ে একটি রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলার উপর গুরুত্বারোপ করা হয় এবং ১৮ ও ১৯ জুলাই সারা ভারত তফসিলী সম্মেলনের দিন ধার্য করা হয়।

২রা জুলাই ভাইসরয় তার এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলে আরো ৫ জন সদস্য  অন্তর্ভুক্ত করলে নির্যাতিত শ্রেণীর পক্ষে এই প্রথম ড. আম্বেদকর ভারত সরকারে অন্তর্ভুক্ত হয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের শ্রম দপ্তরের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্বে আসীন হন।

১৮ ও ১৯ জুলাই পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী নাগপুরে আয়োজিত সারাভারত তফসিলী সম্মেলনে ৭০ হাজারের অধিক তফসিলী প্রতিনিধির সামনে আম্বেদকর তাঁর ভাষণে বলেন, তফসিলীরা হিন্দুধর্মের অন্তর্ভুক্ত হলেও জাতীয় ও রাজনৈতিক জীবনে তাদের একটা পৃথক সত্তা আছে যা হিন্দুদের ধর্মগ্রন্থেও স্বীকৃত। গান্ধিজীর মতো বর্ণহিন্দু স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠিরা তফসিলীদের পৃথক সত্তাকে অস্বীকার করে আত্মসাৎ করার চক্রান্তে লিপ্ত। তফসিলীদের পৃথক জাতিসত্তার ভিত্তিতে এই সম্মেলনে তাদের রাজনৈতিক সংগঠন All India scheduled castes Federation গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়।

১৯৪২ সালের আগস্ট মাসে ‘ভারত ছাড়’ ধ্বনি তুলে কংগ্রেস ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনের ডাক দেয় এবং পরে দেশবাসীর মনোযোগ আকর্ষণের উদ্দেশ্যে গান্ধিজী পুনার আগা খাঁ প্রাসাদে ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২১ দিনের অনশন শুরু করেন। ড. আম্বেদকর তখন এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য হিসেবে কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত থাকায় তার উপর কংগ্রেসী নেতাদের প্রবল চাপ সৃষ্টি হয়। এতে তিনি বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয়ে শ্রমিকদের জীবনের মানোন্নয়নের কথা চিন্তা করে কতকগুলো  কমিশন গঠন করে কিছু উদ্যোগ নিতে থাকেন।

১৯৪৫ সালের জুন মাসে আম্বেদকরের What Congress and Gandhi have done to the untouchables? নামক একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হলে তা ভারতীয় রাজনীতিতে এক অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়। এ বছর জুলাই মাসে ইংল্যান্ডের সাধারণ নির্বাচনে টোরীদের ভরাডুবি হলে লেবার পার্টি ক্ষমতাসীন হয়। ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল ১৯৪৬ সালে ভারতেও সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ঘোষণা করেন। এর পর পরই ভারতের রাজনৈতিক আবহাওয়া উত্তপ্ত হতে লাগলো। নির্বাচনে কুখ্যাত পুনাচুক্তির কুফল তফসিলীরা হাড়ে হাড়ে টের পেয়ে গেলো। আম্বেদকরের তফসিলী ফেডারেশন কংগ্রেসের কাছে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত হলো।

এর আগ পর্যন্ত ড. আম্বেদকর ৪ বৎসর শ্রমমন্ত্রী থাকাকালীন নারী, শিশু শ্রমিকসহ জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সমগ্র শ্রমিক সমাজের কল্যাণে কিছু অধিকার বাস্তবায়ন করে গেছেন-

১) শ্রমিকদের বিষয়ে যে কোন আলোচনায় আগে শুধু সরকার পক্ষ এবং মালিকপক্ষ বসতেন। ড. আম্বেদকর শ্রমমন্ত্রী থাকাকালীন ঘোষণা করলেন শ্রমিক সম্পর্কিত যে কোন আলোচনায় শ্রমিক প্রতিনিধিও যোগদান করতে পারবেন। এই পদ্ধতির নাম ‘ত্রি-পাক্ষিক’ শ্রম আলোচনা।
২) আমেরিকা ও ইংল্যান্ডের ন্যায় ভারতেও ‘Joint Labour Management Committee’ বা যৌথ শ্রম পরিচালনা কমিটি গঠন করেন।
৩) বিভিন্ন অফিস, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানায় প্রতিষ্ঠিত শ্রমিক সমিতিকে অধিকার দানের উদ্দেশ্যে ‘Trade Union’ এর স্বীকৃতি দানের আইন পাশ করেন।
৪) শ্রমিকদের কাজের সময় ১০ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে ৮ ঘণ্টা ধার্য করা হয় এবং ৮ ঘণ্টার বেশি কাজ করলে ‘Over time salary’ প্রদানের আইন পাশ করা হয়।
৫) শ্রমিকদের বেতন, বাসস্থান, খাদ্য, শিক্ষা, পোশাক আশাক ও প্রশিক্ষণ প্রভৃতি বিষয়ে খোঁজ খবর রাখার জন্য ‘শ্রম অনুসন্ধান সমিতি’ গঠন পূর্বক তাদের উন্নয়নের অনেকগুলো আইন পাশ করা হয়।
৬) ‘কারখানা সংশোধনী বিল’ পাশের মাধ্যমে শিল্প ও কারখানা শ্রমিকদের সবেতন ছুটির ব্যবস্থা চালু করেন। এতে প্রাপ্ত বয়স্ক শ্রমিক কর্মচারীরা বছরে ১০ দিন এবং অপ্রাপ্ত বয়স্ক শ্রমিক কর্মচারীরা বছরে ১৪ দিন সবেতন ছুটি ভোগ করতে পারবেন। এর আগে সাপ্তাহিক ছুট ছাড়া অন্যান্য দিন ছুটি ভোগ করলে মালিক কর্তৃক বেতন কর্তন করে নেয় হতো।
৭) নারী শ্রমিক কর্মচারীদের সাথে পুরুষ শ্রমিক কর্মচারীদের বেতন বৈষম্যের বিলোপ সাধন। এই কাজের জন্য নারী পুরুষ সমহারে বেতন পাবেন।
৮) কয়লা শ্রমিকদের আর্থিক উন্নয়নকল্পে ‘কয়লা খনি শ্রমিক উন্নয়ন তহবিল’ গঠনের আইন পাশ।
৯) প্রসবকালীন ‘Maternity Leave’ ছুটির আইন বিধিবদ্ধ করেন।



সংবিধানের স্থপতি ড. আম্বেদকর
১৯৪৭ সালের ১৫ জুলাই বৃটিশ পার্লামেন্ট কর্তৃক ‘স্বাধীন ভারত’ হিসেবে আইন পাশ করা হলে গণপরিষদ সার্বভৌম ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। দেশ বিভাজনের ফলে গণপরিষদও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। ড. আম্বেদকর পূর্ব পাকিস্তানের ভোটার কর্তৃক জয়লাভ করে গণ পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন বলে দেশ বিভাজনের ফলে তার সদস্যপদও খারিজ হয়ে যায়। এ সময় ড. এম.আর জয়াকর গণপরিষদ থেকে পদত্যাগ করায় ড. আম্বেদকর কংগ্রেসের সমর্থনে পুনরায় মহারাষ্ট্র থেকে গণ পরিষদে সদস্য নির্বাচিত হন। তাঁকে কেন্দ্রীয় সরকারের আইন মন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত করা হয়।

এদিকে ভারতের জাতীয় পতাকা তৈরির দায়িত্ব ড. আম্বেদকরের উপর ন্যস্ত হবার সুযোগে তিনি রাজর্ষি সম্রাট অশোকের রাজকীয় স্মারক ‘অশোক চক্র’ জাতীয় পতাকায় অন্তর্ভুক্ত করেন।

২৯ আগস্ট গণপরিষদ কর্তৃক সর্বশ্রী কৃষ্ণস্বামী আয়ার, এন ধাবরাও, স্যার বি.এন.রাও, যুগল কিশোর খান্না, সৈয়দ সাদুল্লা, এস.এন.মুখার্জী ও কেবলকৃষ্ণকে সদস্য এবং ড. আম্বেদকরকে চেয়ারম্যান নির্বাচিত করে একটি খসড়া সংবিধান কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে তিনি খসড়া সংবিধান সম্পূর্ণ করে গণপরিষদের সভাপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদের কাছে হস্তান্তর করেন। অতঃপর সংবিধানটি জনমত যাচাইয়ের জন্য ৬ মাস সময় নেয়ার পর ১৯৪৮ সালের ৪ঠা নভেম্বর ড. আম্বেদকর খসড়া সংবিধানটি গণপরিষদে পেশ করেন।

এই সংবিধান রচনা করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক নীতিবিরোধী কিছু কিছু ধারা পার্টির হাই কমান্ডের চাপের মুখে সংযোজন করতে হয়েছে। বিশেষ করে কংগ্রেসের প্রভাবশালী নেতাদের পরামর্শও শুনতে হয়েছে। ফলে অনেক সময় নিজেদের অভিরুচি ও স্বাধীন বিবেচনা মাফিক কাজ করতে পারেননি বলে সংবিধান কমিটির সদস্য এম.সাদুল্লা ও অনেকেই স্বীকার করেন। তবু এই সংবিধান ভারতের সকল শ্রেণীর মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষে তৈরির জন্য যত বেশি সম্ভব চেষ্টা করা হয়েছে।

১৯৪৯ সালের ২৬শে নভেম্বর গণপরিষদ কর্তৃক খসড়া সংবিধানকে স্বাধীন ভারতের সংবিধান হিসেবে গ্রহণ করে সভাপতির ভাষণে ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ ড. আম্বেদকরকে খসড়া সংবিধান কমিটির সদস্য ও চেয়ারম্যান নির্বাচন করাকে একটি নির্ভুল সিদ্ধান্ত বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। তিনি বলেন-
‘আমি সভাপতি হিসেবে বলতে চাই, আমরা ভারতের সবচেয়ে যোগ্যতম ব্যক্তির হাতেই আমাদের ভবিষ্যৎ সংবিধান রচনার ভার অর্পন করেছিলাম।’

দ্বিতীয় বিয়ে
১৯৩৫ সালে স্ত্রী রমাবাঈয়ের মৃত্যুর পর দীর্ঘকাল তিনি নিঃসঙ্গ জীবন কাটিয়েছেন আম্বেদকর। ফলে বেশি করে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে নিজেকে সচেষ্ট করতে গিয়ে সীমার অতিরিক্ত যে শারীরিক ও মানসিক চাপে পড়েছেন, প্রাকৃতিক নিয়মেই তা তাঁর শরীর মন বইতে পারছিলো না। ফলে একসময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বোম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে গিয়ে নিয়মিত চিকিৎসা করাতে হতো তাঁকে। কিন্তু হাসপাতালে পড়ে থাকার ব্যক্তিও তিনি নন। আর এ অনিয়মের কারণে বারবারই তাঁকে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যেতেই হয়। সে হাসপাতালের ডাঃ শ্রীমতি সারদা কবির চিকিৎসা করতেন। তিনি ড. আম্বেদকরের চিকিৎসা ও সেবা সুশ্রূষার প্রতি বিশেষ মনোযোগী ছিলেন। এভাবে দীর্ঘ চিকিৎসা জীবনে রোগী ও চিকিৎসকের মধ্যে গড়ে ওঠা সখ্যতা একটু একটু করে হৃদয়ঘটিত সম্পর্কে মোড় নেয়।

রমাবাঈয়ের মৃত্যুর পর তিনি দ্বিতীয় কোন রমণীর দারপরিগ্রহ না করার সংকল্পবদ্ধ হয়ে দীর্ঘ নিঃসঙ্গ জীবন অতিবাহিত করলেও ক্রমবর্ধমান শারীরিক ও মানসিক চাপ এবং জীবন-যাপনে বিশ্রামহীন অনিয়ম ও নৈকট্যসঙ্গের অভাবে যখন দৈহিক অবস্থা দ্রুত ভেঙে পড়ছিলো, সেই সময় ডাঃ সারদার সাহচর্যে সেই অভাব অনেকটা লাঘব হতে চলছিলো। ব্যক্তি জীবনে এরকম একজন দরদী ও সহানুভূতিশীল সঙ্গির প্রয়োজনীয়তা অপরিহার্য হয়ে পড়লো। অবশেষে ১৯৪৮ সালের ১৫ এপ্রিল ৫৭ বছর বয়সে নয়াদিল্লীর ১নং হার্ডিঞ্জ এভিনিউস্থ স্বীয় বাসভবনে ড. আম্বেদকর ও ডাঃ শ্রীমতি সারদা কবির রেজিস্ট্রির মাধ্যমে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। শেষপর্যন্ত সারদা কবির নিঃসন্তান ছিলেন। আম্বেদকরের এই বিয়ের সিদ্ধান্তে সর্বত্র অনেক বিতর্কের ঝড় বয়ে গেলো।

হিন্দু কোড বিল ও মন্ত্রীত্ব থেকে পদত্যাগ
হিন্দু আইনের সংস্কারের নিমিত্তে ১৯৪১ সালের দিকে গঠনকৃত একটি কমিটি ‘হিন্দু কোড বিল’ নামে একটি খসড়া বিল তৈরি করে। ‘হিন্দু কোড বিল’ মূলত হিন্দু নারী সমাজের কল্যাণের উদ্দেশ্যে প্রচলিত ধর্মীয় বিধানের সংস্কার। ১৯৪৭ সালে ড. আম্বেদকর কেন্দ্রীয় সরকারের আইন মন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত থাকাকালীন সময়ে হিন্দু কোড বিল তাঁর হস্তগত হলে তিনি এই বিলকে আরো ঢেলে সাজালেন। বিশেষ করে যৌথ পরিবারের ক্ষতিকর প্রভাব, মেয়েদের সম্পত্তির অধিকার ও বিবাহ বিচ্ছেদ প্রভৃতি বিষয়ে তিনি নতুনত্ব আনতে চাইলেন। এতে হিন্দু গোঁড়াপন্থীরা তাঁর উপর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন এবং প্রগতিবাদীরা তাঁকে স্বাগত জানালেন।

১৯৫১ সালের গোড়ার দিকে পার্লামেন্টের অধিবেশন বসার পূর্ব পর্যন্ত ‘হিন্দু কোড বিল’ নিয়ে তীব্র সমালোচনার ঝড় বইতে লাগলো। পার্লামেন্টে হিন্দু কোড বিল পাশ না হলে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু তাঁর পদ থেকে পদত্যাগ করবেন বলেও ঘোষণা দেন। অন্যদিকে সরদার প্যাটেল ও ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ বিলটির বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ১৯৫১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ড. আম্বেদকর বিলটি পার্লামেন্টে পেশ করলেন। তিন দিন পর্যন্ত এই বিলটির উপর প্রচণ্ড বিতর্ক চলার পর অবশেষে বিলটি মূলতবী রাখা হয়।

এপ্রিল মাসে দিল্লীতে আম্বেদকর ভবনের ভিত্তি প্রস্তর অনুষ্ঠানে ড. আম্বেদকর তফসিলীদের প্রতি সরকারের বিরূপ মনোভাবের অভিযোগ তুলে বক্তব্য রাখলে মন্ত্রী সভায় তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়। প্রধানমন্ত্রী নেহেরু আম্বেদকরকে তাঁর অসন্তোষের কথা জ্ঞাপন করেন এবং মন্ত্রী সভা পুনর্গঠনের নিমিত্তে পদত্যাগ করার কথাও ব্যক্ত করেন। এ পরিস্থিতিতে আম্বেদকর তাঁর অনুগামীদের সাথে আলোচনার জন্য বোম্বাই যান এবং তাদের সাথে আলোচনা করে পার্লামেন্টের পরবর্তী অধিবেশনে ‘হিন্দু কোড বিল’ পাশ না পর্যন্ত পদত্যাগ না করার সিদ্ধান্ত হয়।

কংগ্রেসের পার্লামেন্টারি বোর্ডেও অধিকাংশ সদস্য বিলটির বিরোধিতা করলে নেহেরু বাধ্য হয়ে বিলটি সম্পর্কে পার্লামেন্টে স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের অনুমতি দিতে হলো। শেষ পর্যন্ত বিলটি দু অংশে বিভক্ত করে এক অংশকে বিবাহ ও বিবাহ বিচ্ছেদ বিধি নামে পার্লামেন্টে পেশ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ড. আম্বেদকর এতে সম্মতি দিলেন, তবে এই অংশের আলোচনার জন্য ১৭ সেপ্টেম্বর পার্লামেন্টে উত্থাপন করা হলে অনেকেই বিলটির তীব্র বিরোধিতা করেন। পার্লামেন্টের ভিতরে বাইরে এত তীব্র অসন্তোষের কারণে প্রধানমন্ত্রী নেহেরু ড. আম্বেদকরকে বিলটি তুলে নেয়ার জন্য অনুরোধ জানালে বিলটি আর পাশ করানো সম্ভব হলো না। আত্মমর্যাদাসম্পন্ন ড. আম্বেদকর এ ঘটনায় খুবই আঘাত পেলেন এবং ২৭ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর পদত্যাগের কথা জানিয়ে দেন। কয়েকটি সরকারি বিলে তাঁর বক্তব্য রাখার বিষয় পূর্ব নির্ধারিত থাকায় তিনি সৌজন্যের খাতিরে সে বিলগুলোর উপর আলোচনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত সরকারকে সহযোগিতা করার প্রতিশ্রুতি দেন।

১৯৫১ সালের ১১ অক্টোবর পার্লামেন্টে বক্তব্য পেশ করতে এলে লোকসভার ডেপুটি স্পীকার আম্বেদকরের বক্তব্যের একটি কপি তাঁর কাছে জমা দিতে বলায় আত্মসম্মানে প্রচণ্ড ঘা লাগে এবং বক্তব্য না রেখেই তিনি লোকসভা ত্যাগ করে চলে যান। পরের দিন সংবাদ পত্রে ৫টি বিশেষ কারণ উল্লেখপূর্বক তাঁর পদত্যাগের পূর্ণ বিবরণ প্রকাশিত হয়।

ধর্মান্তর পর্ব
ড. আম্বেদকর অস্পৃশ্যদের ধর্মীয় ও সামাজিক অধিকার প্রতিষ্ঠাকল্পে দীর্ঘকাল ধরে ব্যাপক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে পারলেন যে, ব্রাহ্মণ্যবাদী গোষ্ঠি অস্পৃশ্য জনগণকে একদিকে যেমন হিন্দু ধর্মীয় অধিকার দিতে নারাজ অন্যদিকে তাদেরকে হিন্দু বলে স্বীকৃত দিতেও অনিচ্ছুক। তাই ১৯৩৬ সালে অনুষ্ঠিত ইয়োলা সম্মেলনে অস্পৃশ্যদের সামাজিক মর্যাদা আদায়ের ব্যাপারে সর্বসম্মতিক্রমে কংগ্রেস তথা বর্ণবাদী হিন্দু সংগঠনগুলোর কাছে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত উপস্থাপন করা হয়েছিলো এবং নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়িত না হলে হিন্দু ধর্ম ত্যাগের হুমকিও দিয়েছিলেন। তার ধারাবাহিকতায় ১৯৩৬ সালে ১৯ এপ্রিল এক সভায় ‘হিন্দু ধর্ম ত্যাগ কমিটি’ও গঠিত হয়েছিলো। এরপর সামাজিক রাজনৈতিক বহু ডামাডোলের মধ্য দিয়ে আরো অনেক সময় পেরিয়ে গেলেও হিন্দু ধর্ম তাঁর কূপমণ্ডুকতা থেকে বের হতে তো পারেই নি, অস্পৃশ্যদের ব্যাপারেও তাদের দৃষ্টিভঙ্গির এতটুকু উন্নতি হয়নি। এ নিয়ে হিন্দু সমাজের ধর্মগ্রন্থ ও অন্ধকার দিকগুলো নিয়ে তীব্র সমালোচনামূলক প্রচুর লেখালেখিও করে গেছেন তিনি। কিন্তু এতেও তাদের একটুও উন্নতি হয়নি এবং হবার সম্ভাবনাও দেখা গেলো না।  আম্বেদকর তাই এতকাল ভেতরে লালন করে রাখা বৌদ্ধদর্শনের মানবিক সমৃদ্ধির বিষয়গুলো সামনে তুলে ধরতে লাগলেন। তা যে বহুকাল ধরে তিনি ভেতরে লালন করে আসছেন, তাঁর কর্মকাণ্ডে তা তাঁকে এক অভূতপূর্ব মানবিক শক্তি যুগিয়ে গেছে, তাঁর বক্তব্য থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায়। ১৯৫৪ সালের অক্টোবরে অল ইন্ডিয়া রেডিওতে ড. আম্বেদকরের ‘আমার জীবন দর্শন’ নামক এক বক্তৃতা প্রচারিত হয়। সেখানে তিনি বলেন-
‘তিনটি শব্দের মধ্যে আমার জীবন দর্শন খুঁজে পাই। স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব। যদিও আমরা ভারতীয় সংবিধানে রাজনৈতিক কারণে স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নীতিকে গ্রহণ করেছি বস্তুত আমাদের সমাজ জীবনে এগুলোর কোন অস্তিত্ব নেই। এগুলো আমি বুদ্ধের বাণী থেকে গ্রহণ করেছি। হিন্দু ধর্মে স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের কোন স্থান নেই, তাই বুদ্ধের আদর্শ গ্রহণ করলে ভারতীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক আদর্শ পরস্পরের পরিপূরক হবে।’
সে বছরই ডিসেম্বর মাসে ড. আম্বেদকর সস্ত্রীক তাঁর একান্ত সচিব মিঃএস.ভি সবদকরকে নিয়ে রেঙ্গুনে তৃতীয় বৌদ্ধ সম্মেলনে যোগদান করেন। সেখানে তিনি বলেন-
‘…বিশ্ব বৌদ্ধ সংস্থা যদি সহায়তা করে তাহলে আমি বুদ্ধের জন্মস্থান ভারতে বুদ্ধের করুণা ও সাম্যের বাণী প্রচারে আত্মনিয়োগ করবো।’
ভারতীয় জাতীয় পতাকায় অশোক চক্র, জাতীয় প্রতীক হিসেবে অশোক স্তম্ভের প্রতিষ্ঠা এবং তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় বৈশাখী পূর্ণিমা দিবসকে সর্বভারতে সাধারণ ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা থেকেই বুঝা যায় যে, অনেক আগে থেকেই তিনি বুদ্ধকে হৃদয়ে ধারণ করে নিয়েছিলেন। রেঙ্গুন থেকে প্রত্যাবর্তনের অল্পদিন পরেই লুনার নিকটবর্তী দেহু রোডে তিনি এক বৌদ্ধ বিহার নির্মাণ করেন এবং সেখানে রেঙ্গুন থেকে আনীত একটি বৌদ্ধ মূর্তি প্রতিস্থাপন করেন। মন্দির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ২০ হাজার জনতার উপস্থিতিতে তিনি জানিয়ে দেন অচিরেই তিনি তাঁর গবেষণামূলক গ্রন্থ ‘বুদ্ধ ও তাঁর বাণী’ প্রকাশ করবেন।

আম্বেদকরের বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে দেশ বিদেশের বহু বৌদ্ধ সোসাইটি থেকে অভিনন্দন আসতে লাগলো। এদিকে আম্বেদকরের স্বাস্থ্যের ক্রমাবনতি ঘটতে লাগলো, শ্বাসকষ্ট জনিত কারণে তাঁকে প্রায়ই অক্সিজেন ব্যবহার করতে হচ্ছে। তার পরও তাঁর কলম থেমে থাকলো না। Revolution and Counter Revolution in India, Buddha or Karl Marx, The Riddless in Hinduism নামে কয়েকটি গ্রন্থ রচনায় প্রচুর ব্যস্ত তিনি। ১৯৫৬ সালের প্রথম দিকেই তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ The Buddha and his Gospel বা বুদ্ধ ও তাঁর বাণীর কিছু অংশ প্রকাশিত হয়। ২৪ মে বোম্বাইয়ের নারে পার্কে অনুষ্ঠিত বুদ্ধ জয়ন্তী অনুষ্ঠানে আগামী অক্টোবর মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণের কথা ঘোষণা করলেন। এই অনুষ্ঠানে তিনি হিন্দুধর্মের সাথে বৌদ্ধধর্মের পার্থক্য পরিষ্কারভাবে ব্যক্ত করেন। সে বছর মে মাসেই বি.বি.সি (ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং করপোরেশান)-এ দেয়া ‘কেন আমি বৌদ্ধধর্ম পছন্দ করি’ শীর্ষক প্রচারিত এক বক্তৃতায় বলেন-
‘আমি তিনটি নীতির জন্য বৌদ্ধধর্ম পছন্দ করি। প্রথমটি হলো প্রজ্ঞা (অলৌকিক ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুক্তিসংগত জ্ঞান), দ্বিতীয়টি হলো করুণা (প্রেম অর্থাৎ সমস্ত প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা) এবং তৃতীয়টি হলো সাম্য (সমতা অর্থাৎ সমস্ত মানুষকে সমান মনে করা)।
জুন মাসের দিকে ড. আম্বেদকরের শারীরিক অবস্থার দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকে। ২৩ সেপ্টেম্বর এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রচার করা হলো যে, আগামী ১৪ অক্টোবর বিজয়া দশমীর দিনে বেলা ৯টা থেকে ১১টার মধ্যে প্রাচীন কালের বৌদ্ধ শাস্ত্রের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পণ্ডিত নাগার্জুনের জন্মস্থান নাগপুরে ড. আম্বেদকার বৌদ্ধধর্মে দীক্ষা পর্ব সম্পন্ন করবেন। দীক্ষাদানের জন্য গোরপুরের কুশীনারাতে অবস্থানরত অশীতিপর বৃদ্ধ বৌদ্ধ ভিক্ষু চন্দ্রমণিকে ঐ অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতে আমন্ত্রণ জানালেন। কলকাতা মহাবোধি সোসাইটির সম্পাদক ডি. ঊলিসিনহাকেও দীক্ষানুষ্ঠানে উপস্থিত থাকার জন্য অনুরোধ জানালেন। তাছাড়া তাঁর অসংখ্য গুণগ্রাহী, অনুগামী যারা তাঁর সঙ্গে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করতে ইচ্ছুক তারাও যেন উক্ত দিবসে পরিচ্ছন্ন শ্বেতবস্ত্র পরিধান করে নাগপুরে উপস্থিত হন সেজন্য তাদের প্রতি আবেদন জানালেন।

দীক্ষা দিবসের তিনদিন পূর্বে আম্বেদকর সস্ত্রীক নাগপুরে চলে গেলেন। তাঁকে ঘিরে লক্ষ লক্ষ মানুষের আগমনে নাগপুর মুখরিত হয়ে ওঠলো। নাগপুরের শ্রদ্ধানন্দ পার্কে ১৪ একর জায়গা নিয়ে তৈরি করা হলো ঐতিহাসিক দীক্ষাভূমি। ১৩ অক্টোবর আহূত এক প্রেস কনফারেন্সে ড. আম্বেদকর জানালেন-
‘আমি যে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করতে যাচ্ছি তা হবে আধুনিক সমাজ জীবনের ভিত্তিতে বৌদ্ধধর্মের এক নবতর রূপ, যার নাম হবে নবযান। আমি বিগত ৩০ বছর ধরে হিন্দুধর্মকে গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে গড়ে তোলার আন্দোলন করে আসছি। কায়েমী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠি হিন্দুধর্মের স্তরে স্তরে অসাম্য বজায় রেখে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির মতলব ত্যাগ না করাতে বাধ্য হয়ে অনুগামীদের নিয়ে আমাকে হিন্দু ধর্ম ত্যাগ করতে হচ্ছে এবং অন্য কোন ধর্মের চেয়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করলে ভারতীয় সংস্কৃতিই অটুট থাকবে বলে আমি মনে করি।’
১৪ অক্টোবর সকাল ন’টায় শ্বেতবস্ত্রে সুসজ্জিত আম্বেদকর, তাঁর স্ত্রী ও একান্ত সচিব দীক্ষাভূমির ডায়াসে উঠে একান্ত সচিবের কাঁধে হাত রেখে অন্য হাতে তাঁর লাঠিটি উঁচু করে ধরতেই লক্ষ কণ্ঠের আনন্দ ধ্বনিতে সারা নাগপুর শহর প্রকম্পিত হয়ে উঠে। মারাঠি ভাষায় রচিত এক প্রশস্তি সংগীতের মাধ্যমে অন্যুষ্ঠানের সূচনা হয়। ৮৩ বছর বয়স্ক ভিক্ষু চন্দ্রমণি মহাস্থবির তাঁদের দীক্ষাকার্য সম্পন্ন করেন।

স্বয়ং দীক্ষাগ্রহণের পর আম্বেডকর তাঁর প্রায় ৪ লক্ষ অনুগামীকে দীক্ষাপ্রদান করেন। পরের দিন একই দীক্ষাভূমিতে এক লাধিক জনতা দীক্ষা গ্রহণ করেন। ত্রিরত্ন এবং পঞ্চশীল গ্রহণের পর তাঁরা সম্মিলিতভাবে ২২টি শপথ গ্রহণ করেন। এরপর ১৬ অক্টোবর ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে আম্বেডকর অপর একটি গণদীক্ষার আয়োজন করেন এবং সেখানেও নবদীতি বৌদ্ধগণকে নিম্নোল্লিখিত ২২টি শপথ প্রদান করেন।

১. আমি ব্রহ্মা, বিষ্ণু, মহেশ্বরের প্রতি কোন বিশ্বাস রাখব না এবং তাদের উপাসনা করব না।
২. আমি রাম এবং কৃষ্ণ, যারা ঈশ্বরের অবতার রূপে পরিচিত, তাদের প্রতি কোন বিশ্বাস রাখব না এবং তাদের উপাসনা থেকে বিরত থাকব।
৩. আমি গৌরী, গণপতি সহ অন্যান্য হিন্দু দেবদেবীগণের প্রতি কোন বিশ্বাস রাখব না এবং তাদের আরাধনা করব না।
৪. আমি ঈশ্বরের অবতারে বিশ্বাস করি না।
৫. আমি ভগবান বুদ্ধকে বিষ্ণুর অবতার হিসেবে স্বীকার করি না এবং ভবিষ্যতেও করব না। আমি মনে করি এই তত্ত্বটি একটি মিথ্যা প্রচারমাত্র।
৬. আমি শ্রাদ্ধানুষ্ঠান এবং মৃতের উদ্দেশে পিণ্ডদান করা থেকে বিরত থাকব।
৭. আমি সেই সমস্ত কার্যাবলি থেকে বিরত থাকব যার দ্বারা ভগবান বুদ্ধের শিক্ষার অবমাননা হয়।
৮. আমি ব্রাহ্মণগণকে কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে হিন্দু শাস্ত্রীয় বিধি অনুসারে ধর্মীয় ক্রিয়াদি সম্পাদন করতে দেব না।
৯. আমি মানুষের মধ্যে সাম্যে এবং ঐক্যে বিশ্বাস করব।
১০. আমি মানবসমাজে সাম্য এবং ঐক্য প্রতিষ্ঠার্থে আপ্রাণ প্রয়াস করে যাব।
১১. আমি ভগবান বুদ্ধ কর্তৃক প্রচারিত অষ্টাঙ্গ মার্গ অনুসরণ করে চলব।
১২. আমি ভগবান বুদ্ধ কর্তৃক প্রচারিত দশ পারমিতা মান্য করে চলব।
১৩. আমি জগতের সকল জীবের প্রতি দয়া এবং করুণা প্রদর্শন করব এবং তাদের রক্ষা করব।
১৪. আমি চৌর্যবৃত্তি অবলম্বন করব না।
১৫. আমি মিথ্যা বাক্য উচ্চারণ করব না এবং কখনও মিথ্যাচার করব না।
১৬. আমি ইন্দ্রিয়কাম চরিতার্থ করার জন্য কোন অসাধু কার্যে লিপ্ত হব না।
১৭. আমি মদ্যাদি মাদকদ্রব্য সেবন করব না।
১৮. আমি জীবনে প্রতিনিয়ত অষ্টাঙ্গ মার্গ অনুশীলনের প্রয়াস করব এবং সকলের প্রতি করুণা অভ্যাস করব।
১৯. আমি হিন্দুধর্ম ত্যাগ করছি কারণ হিন্দুধর্ম মনুষ্যত্বের পক্ষে ক্ষতিকর। হিন্দুধর্ম বর্ণাশ্রমভিত্তিক সমাজব্যবস্থার মাধ্যমে মানবসমাজে বিভেদের প্রাচীর সৃষ্টি করেছে এবং সাম্য প্রতিষ্ঠাকে প্রতিহত করেছে। তাই আমি বৌদ্ধ ধর্মকে আনুষ্ঠানিকভাবে আমার ধর্ম হিসেবে অবলম্বন করলাম।
২০. আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে ভগবান বুদ্ধ কর্তৃক প্রচারিত ধর্মই একমাত্র সত্য ধর্ম।
২১. আমি বিশ্বাস করি যে আমি জন্মান্তরিত হয়েছি।
২২. আমি এতদ্বারা ঘোষণা করছি যে আমি ভবিষ্যতে ভগবান বুদ্ধ কর্তৃক প্রচারিত ধর্ম দর্শন এবং শিক্ষানুসারে জীবনযাপন করব।

১৬ অক্টোবর চান্দাতে বিশাল জনতাকে বৌদ্ধধর্মে দীক্ষিত করে আম্বেদকর দিল্লী অভিমুখে রওনা হন। ধর্মান্তরের কারণে ভারতের কোন নেতৃবর্গ তাঁকে অভিনন্দন না জানালেও বিশ্বের অনেক দেশ ও নেতৃবর্গের কাছ থেকে অভিনন্দিত হন।

এরপর সারা ভারতব্যাপী ধর্মদীক্ষা অনুষ্ঠান পরিচালনা করার এক ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেন তিনি। এদিকে তাঁর স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি ঘটতে থাকলে সেই কর্মসূচি পরিচালনা করা তাঁর পক্ষে অসম্ভব হয়ে পড়ে। তবু ৩০ নভেম্বর নেপালে অনুষ্ঠিতব্য চতুর্থ বিশ্ব বৌদ্ধ সম্মেলনে তিনি সস্ত্রীক গমন করেন। সেখানে বৌদ্ধধর্ম ও কার্ল মার্কসের উপর গবেষণামূলক ভাষণে বৌদ্ধ ধর্মের শ্রেয়তর পথগুলো সুক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করেন। এটাই তাঁর জীবনের শেষ বৌদ্ধধর্ম প্রচার।

বৌদ্ধধর্মের মূলনীতিগুলো হচ্ছে
ক) চতুরার্য সত্য-
১) যথা দুঃখ
২) দুঃখ সমুদয়: দুঃখের কারণ
৩) দুঃখ নিরোধ: দুঃখ নিরোধের সত্য
৪) দুঃখ নিরোধ মার্গ: দুঃখ নিরোধের পথ

খ) অষ্টাঙ্গিক মার্গ- (তিনটি মৌলিক শ্রেণীতে আটটি উপাদান)
প্রজ্ঞা
১) সম্যক ধারণা বা দৃষ্টি
২) সম্যক সংকল্প
শীল
৩) সম্যক বাক্য
৪) সম্যক আচরণ বা কর্ম
৫) সম্যক জীবনধারণ বা জীবিকা
সমাধি
৬) সম্যক চেষ্টা
৬) সম্যক মনন বা স্মৃতি
৭) সম্যক ধ্যান বা সমাধি

গ) ত্রিশরণ মন্ত্র-
আর্যসত্য এবং অষ্টবিধ উপায় অবলম্বনের পূর্বে ত্রিশরণ মন্ত্র গ্রহণ করতে হয়। এই মন্ত্রের তাৎপর্য:
১) বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি – আমি বুদ্ধের শরণ নিলাম। বোধি লাভ জীবনের মূখ্য উদ্দেশ্য। বুদ্ধত্ব মানে পূর্ণ সত্য, পবিত্রতা, চরম আধাত্মিক জ্ঞান।
২) ধম্মং শরণং গচ্ছামি – আমি ধর্মের শরণ নিলাম। যে সাধনা অভ্যাস দ্বারা সত্য লাভ হয়, আধ্যাত্মিকতার পূর্ণ বিকাশ হয় তাই ধর্ম।
৩) সঙ্ঘং শরণং গচ্ছামি – আমি সঙ্ঘের শরণ নিলাম। যেখানে পূর্ণ জ্ঞান লাভের জন্য ধর্মের সাধনা সম্যক্ ভাবে করা যায় তাই সঙ্ঘ।

জীবনাবসান
নেপাল থেকে ফিরে আম্বেদকরের স্বাস্থ্যের আরো অবনতি ঘটলো। কিছুটা সুস্থ বোধ করলে ২রা ডিসেম্বর অশোক পার্ক বিহারে তিনি নির্বাসিত তিব্বতীয় ভিক্ষু দালাইলামার সাথে একান্ত সাক্ষাতকারে মিলিত হন। পরদিন ‘বুদ্ধ ও তাঁর ধর্ম’ গ্রন্থটির শেষ অধ্যায়ের লেখা সম্পন্ন করে কার্ল মার্কসের ‘দাস ক্যাপিট্যাল’-এ চোখ বুলালেন। কার্ল মার্কস সবসময়ই তাঁর আগ্রহের বিষয় ছিলো। যা তাঁর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে প্রতিভাত হয়েছে। ৪ঠা ডিসেম্বর তিনি রাজ্যসভার অধিবেশনে যোগদান করলেন। ১৯৫২ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে ভারতের প্রথম সাধারণ নির্বাচনে তফসিলী ফেডারেশনের প্রার্থী হিসেবে আম্বেদর কেন্দ্রীয় লোকসভায় কংগ্রেস প্রার্থীর কাছে খুব অল্প ভোটে পরাজিত হয়েছিলেন। পরে ১৯৫২ সালের মে মাসে রাজ্যসভার নির্বাচনে জয়ী হয়ে বিরোধীদলীয় এমপি হন। ৪ঠা ডিসেম্বরের পর যে আম্বেদকরের মতো একজন প্রতিভাবান সাংসদকে আর লোকসভায় দেখা যাবে না সেটা হয়তো কেউ ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি। বাসায় ফিরে সিদ্ধান্ত নিলেন আগামী ১৬ ডিসেম্বর বোম্বাইতে অনুষ্টিতব্য দীক্ষা সমারোহে যোগদানের উদ্দেশ্যে ১৪ ডিসেম্বর বোম্বাই রওনা দেবেন। ৫ ডিসেম্বর রাত ৮টায় সাক্ষাতপ্রার্থী কয়েকজন জৈন নেতার সাথে নিজ বাসভবনেই বৌদ্ধধর্ম ও জৈনধর্ম সম্পর্কে কিছুক্ষণ আলোচনা হলো। রাত ১১টার পর গুনগুন করে ‘বুদ্ধং শরনং গচ্ছামী’ গাইতে গাইতে ড. আম্বেদকর নিদ্রামগ্ন হলেন। সবার অগোচরে এটাই তাঁর শেষ নিদ্রা। পরদিন ১৯৫৬ সালের ৬ ডিসেম্বর ভোর বেলা আম্বেদকর যথারীতি আর জাগলেন না।

তাঁর মৃত্যু সংবাদ দাবানলের মতো দ্রুত সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়লো। তাঁর বাড়িতে ছুটে এলেন প্রধানমন্ত্রী নেহেরু, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী পণ্ডিত গোবিন্দ বল্লভ পন্থ, যোগাযোগ মন্ত্রী জগজীবন রামসহ অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতৃবর্গ। সেদিন রাতেই তাঁর মরদেহ বোম্বাই নিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত হলো। যোগাযোগ মন্ত্রী স্পেশাল প্ল্যানের ব্যবস্থা করলেন। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া সুসম্পন্ন করার সমস্ত দায়িত্ব নিলেন। মাথার উপর বুদ্ধের করুণা বিগলিত মূর্তি সম্বলিত ড. আম্বেদকরের মরদেহ ৪ লক্ষ জনতার বিশাল শোভাযাত্রা দাদার শ্বশানক্ষেত্রে গিয়ে পৌঁছলে সন্ধ্যা ৭.৩০ মিনিটে তাঁর একমাত্র সন্তান যশোবস্তরাও মুখাগ্নি করলেন।

ড. আম্বেদকরের আত্মার সৎগতি কামনা করে প্রধানমন্ত্রী নেহেরুর প্রস্তাবে লোকসভা ও রাজ্যসভা একদিন বন্ধ ঘোষণা করা হয়। পরে মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী ড. আম্বেদকরের জন্মদিনকে সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন।

আম্বেদকরের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে এক বিশাল যুগের অবসান ঘটলো। বেঁচে থাকতে যে রাষ্ট্র তাঁকে যথাযথ সম্মান জানাতে পারেনি, তাঁর মৃত্যুর পরও যে জাতি এখনো অস্পৃশ্য বর্ণবাদ মুক্ত হতে পারেনি, সেই ভারত তাঁর মৃত্যুর ৪৪ বছর পর ১৯৯০ সালে তাঁকে মরণোত্তর ভারত রত্ন উপাধিতে ভূষিত করে হয়তো পাপস্খালনের কিছুটা প্রয়াস নিয়েছে। তবে এর আগেই বিশ্বব্যাপী দলিত অস্পৃশ্য জাতিগোষ্ঠির মুক্তির আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান জানাতে ড. আম্বেদকরের মৃত্যু দিবসটিকে স্মরণীয় করে রাখতে ৬ ডিসেম্বর-এর আগের দিনটিকে জাতিসংঘ বিশ্ব মর্যাদা দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা করে।

কৃতজ্ঞতা: তথ্য সূত্র-
১) অবহেলিত জনগোষ্ঠীর মুক্তির প্রবক্তা ডঃ আম্বেদকর / সুভাষ কান্তি বড়ুয়া / ১৯৯৮ প্রথম সংস্করণ।
২) ইংরেজিবাংলা ‘উইকিপিডিয়া’, অনলাইন মুক্তবিশ্বকোষ (Wikipedia, the free encyclopedia)।
৩) বিশ্ব মর্যাদা দিবসের ভাবনা ড. আম্বেদকর ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা / ‘সন্তবন্ধু’ মাস্টার কানাই লাল রবিদাস, সহসভাপতি, বাংলাদেশ দলিত ও বঞ্চিত অধিকার আন্দোলন এবং আহবায়ক, বাংলাদেশ দলিত ফোরাম। (BPERM)।



 [mukto-mona] 'অস্পৃশ্য ও ব্রাহ্মণ্যবাদ' পর্ব: [০৭][০৮]
[ বৌদ্ধধর্মীয়ব্লগ : প্রজ্ঞাদর্শন ]
...

No comments: