| আমি তো মিন্টু হইলাম, কিন্তু…!
-রণদীপম বসু
…
(০১)
‘আপনি রণদীপম দাদা না !‘
প্লাস্টিকের ওয়ান-টাইম পেয়ালায় চায়ে চুমুক দিতে দিতে দারুণ জলি-টাইপ হাস্যোজ্জ্বল প্রশ্নকারী দোহারা গড়নের যুবকটির দিকে তাকালাম। আমার সম্মতিসূচক জবাব ও প্রশ্নময় চাউনিতে তিনি বলে যাচ্ছেন- ‘আপনি উইকিমিডিয়ায় প্রচুর ছবি দিয়েছেন দাদা, ব্লগে আপনার ছবিও দেখেছি তো..!‘
এবার মনে হয় চিনতে পেরেছি তাঁকে। বাংলা উইকিতে বেলায়েত ভাই‘র হালকা নিক ছবির সাথে অনেক মিল চেহারায়, তিনিই হবেন। ‘আপনি বেলায়েত ভাই ?‘
‘না-না, আমি বেলায়েত না। বেলায়েত যখন আপনার ছবিগুলোর কাজ করছিলো, আমি দেখেছি তখন। আমার নাম মাহে আলম খান। সংক্ষেপে সবাই ম্যাক বলে চিনে।‘ বলেই তিনি যে ভুবন-ভুলানো হাসিটা দিলেন, তাতেই বুঝে গেলাম, এ লোকের পৃথিবীতে কোন শত্রু থাকতে পারে না। বর্তমানে অনলাইন জগতে বাংলাকে ব্যবহার-বান্ধব করে তুলতে অঙ্কুর-আইসিটি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের সাথে উজার হয়ে কাজ করছেন জানা গেলো।
‘দাদা আসেন, আপনাকে আরেকজনের সাথে পরিচয় করিয়ে দেই। তিনি আপনাকে দেখতে চেয়েছেন।‘ ম্যাক ভাই যাঁর সাথে পরিচয় করাতে নিলেন, এই চা-বিরতির কিছুক্ষণ আগেই বন্টু-মিন্টুর আড্ডামঞ্চে উনি দুর্দান্ত এক অভিজ্ঞতাসমৃদ্ধ নীতিনির্ধারণীমূলক বক্তব্য রেখে এসেছেন হাস্যরসিকতার মধ্য দিয়ে। তাঁর বক্তব্য শুনেই মনে মনে সমীহ করা শুরু করে দিয়েছি। প্রযুক্তিক্ষেত্রে বেশ কেষ্টুবিষ্টু ধরনের বহুমাত্রিক ব্যক্তি বলে মনে হলো। নাম মুনির হাসান। বাংলাদেশ ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক (বিডিওএসএন) এর সাধারণ সম্পাদক। মাথাভর্তি কাঁচাপাকা চুলে হাসিখুশি মানুষ মুনির ভাই বর্তমানে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কর্মরত। এর আগে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ছিলেন ক‘বছর। ওপেন সোর্স কার্যক্রমে তাঁর উদ্যম ও প্রয়াস যথেষ্ট গুরুত্ববহ বলে ধারণা করছি। প্রযুক্তিক্ষেত্রে ডেভেলাপার গোছের তুখোড় তরুণ-যুবক অনেকেই তাঁকে স্যার বলে সম্বোধন করছিলো। আমাকে চেনা এবং কথাবার্তার মাধ্যমে ধারণা হলো খুব স্বাভাবিকভাবেই তিনি উইকিপিডিয়ার সাথেও জড়িত আছেন। প্রযুক্তি আর ওপেন সোর্স অপারেটিং সিস্টেম ও ফোরামের কর্মকাণ্ড নিয়ে বেশ মজার আলোচনা করলেন। ইতোমধ্যে চা-বিরতির সময় শেষ। পরের পর্বে অংশগ্রহণের জন্য ফের মিলনায়তনে ঢুকলাম।
ঢাকা ও ঢাকার বাইরে থেকে আগত তিনশতাধিক উজ্জ্বল তারুণ্যের কাছে একমাত্র আমাকেই সাধারণ লিনাক্স ব্যবহারকারী হিসেবে যে অত্যন্ত বেমানান ঠেকলো, তা বয়েসের কারণে নয়। এই তরুণরা প্রযুক্তি-দুনিয়া চষে বেড়ানো তুখোড় মেধাবী সব, আমাদের আগামীর স্বপ্নকে যারা প্রযুক্তির নিত্য-নতুন রঙে রূপ দেবে মনের মাধুরি মিশিয়ে। এদের সাপেক্ষে আমি হলাম এক প্রযুক্তিকানা নাদান মানুষ। প্রযুক্তির প-ও বুঝি না বা এর কিছুই জানি না আমি। কেবল জানি প্রযুক্তির সুবিধাটা ভোগ করতে। তাহলে আমি এখানে এই এদের মাঝে কেন এলাম ? ওপেন সোর্স নেটওয়ার্ক বা লিনাক্স আন্দোলনের অগ্রযোদ্ধা বন্টু-মিন্টুদের এই আড্ডায় আমার উপস্থিতি আসলে হঠাৎ করেই। কিন্তু এর পেছনে রয়ে গেছে নিজেকে উদ্ধার এবং ক্ষয়ে যাওয়া মানবিক বোধটাকে পুনরুদ্ধার করার একান্ত ইচ্ছার প্রকাশ ও প্রয়াস। আমার মতো এমন আরো বহু সাধারণ ব্যবহারকারী আছেন যারা কম্পিউটারে অপারেটিং সিস্টেম উইন্ডোজ ব্যবহার করেন কিংবা নবীন লিনাক্স ইউজার হচ্ছেন বা হয়েছেন। তাদের সাথেই আমি আমার অনুভব ও উপলব্ধি মেশানো পরের কথাগুলো শেয়ার করছি। (হয়তো বোদ্ধাদের কাছে এটাকে খুবই বোকা বোকা পোস্ট বলে মনে হবে।)
(০২)
যখন কম্পিউটারে উইন্ডোজে হাতেখড়ি হয় তখন কাকতালীয়ভাবে, না কি যথানিয়মেই, লিনাক্সের কথা শুনেছিলাম এ মুহূর্তে নিশ্চয় করে বলতে পারছি না। তারপর আবার যথারীতি ভুলেও গেলাম সেই লিনাক্সের কথা। এর বহুদিন পর আবার একটা উদ্ভট নাম মাথার ভিতর গেঁথে গেলো- উবুন্টু। উদ্ভট বলছি এজন্যেই যে, বাংলা ভাষার সাপেক্ষে নামটাকে উদ্ভটই বলতে হয়। সে যাক, যথানিয়মে তাও স্মৃতির ভেতরে চাপা পড়ে গেলো। ওমা ! আরো কিছুদিন পর দেখি পরিচিত কেউ কেউ উবুন্টু নিয়ে বেশ লাফালাফি করছে। আরে, এ নিয়ে লাফালাফির কী হলো ! যেহেতু কলমপেষা মানুষ, তাই জিজ্ঞেস করি, বাংলা লেখার কী অবস্থা ? মুখ চিমসে করে জবাব আসে- বাংলায় অবশ্য একটু সমস্যা আছে, তবে বাকি সব….। বেশ আতেলিয় স্টাইলে বাঁকা একটা হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দেই- হাহ্, তা নিয়ে এতো লাফালাফি ! আগে বাংলার ব্যবস্থা হোক, তখন না হয় দেখা যাবে !
ক‘দিন পরই এর জবাব এলো- এখন লিনাক্সেও বাংলা লেখা কোন বিষয়ই নয় ! অভ্র ফোনেটিক নামিয়ে নিলেই হয়। তাছাড়া উবুন্টুর পরবর্তী ভার্সনগুলোতে বাংলার কিছু লেআউট সাথেই দেয়া আছে। বলে কী ! আমার মুখই বুঝি চিমসে হবার জোগাড় ! এবার সত্যি সত্যি কৌতুহলি হয়ে ওঠলাম। শুরু হলো বাংলায় লিনাক্স বা উবুন্টু বিষয়ক কোথায় কী লেখা আছে তার খোঁজাখুঁজি। অজ্ঞতার কারণে বিরুদ্ধ মতামতও রয়েছে দেখে ভেতরে একটা আশঙ্কা তো ছিলোই। বেকুব হয়ে গেলাম লিনাক্স নিয়ে বিভিন্ন ফোরামে লেখালেখির এতো সমাহার দেখে ! মুই কী হনুরে আমি যে আসলে একটা মূর্খ এবং এর কিছুই জানতাম না, তা বেশ ভালোভাবেই টের পেলাম এবার। মনে মনে লজ্জিতও হলাম। তবে বুকটা অহঙ্কারে ভরে গেলো বাঙালি ছেলেদের কাণ্ডকীর্তি দেখে ! নিজের খেয়ে বনের মোষ দৌড়ানোর এমন স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যম যারা ধারণ করে তারাই তো সমাজকে জাতিকে কিছু দিতে পারে। এই চিরায়ত বাঙালি ঐতিহ্য আমরা ব্যাকডেটেডরা নই, ওরাই ধরে রেখেছে। কতোটা আত্মসম্মানবোধসম্পন্ন হলে তাদের তারুণ্য উইন্ডোজ ব্যবহার সংশ্লিষ্ট দুই নম্বরি চুরি-চামারি পাইরেসি বাদ দিয়ে একটা অপরিচিত ওপেন সোর্স অপারেটিং সিস্টেমকে আঁকড়ে ধরে বন্ধনহীন উন্মুক্তির ডাক দিতে পারে, তা ভাবতেই মনটা ভালো হয়ে যায়। অতঃপর আস্থা ও বিশ্বাস অনড় হতে দেরি হয় না যে আমার মায়ের ভাষা প্রিয়তম বাংলাকে এই অক্ষয় প্রজন্মরাই একদিন বিশ্বের বুকে মাথা উঁচু করে ধরবেই ধরবে।
(০৩)
শুরু হলো লিনাক্স অধ্যয়ন আমার। এই অধ্যয়নের সুলুকসন্ধান না হয় আরেকদিন করা যাবে। তবে এজন্যে বাংলা উবুন্টু-বিডি, আমাদের প্রযুক্তি ও অভ্রনীলের আবাস নামের দুটো ফোরাম ও ব্লগ আমার অধ্যয়নে প্রচুর অবদান রেখেছে। তাদের প্রতি আমার বিশেষ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে রাখি। তো একদিন জানলাম যে আমার মতো কম্পুকানা ও নবীন ব্যবহারকারীদের জন্য লিনাক্স নাকি নতুন একটা ডিস্ট্রো রিলিজ করেছে, ‘লিনাক্স মিন্ট ৯ ইসাডোরা‘ নামে, যা উইন্ডোজ ইউজার-বান্ধব। যেহেতু কম্প্যুটারে এখনো আমাদের হাতেখড়ি হচ্ছে উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেমের হাত ধরে, তাই স্বাচ্ছন্দ্যবোধের বিষয়টিকে এড়িয়ে যাবার বা অবহেলা করার কোন উপায় নেই। কিন্তু ফকির প্রজন্মের অক্ষমতা ও অসহায়ত্বের দায় ঘাড়ে নিয়ে উইন্ডোজের পাইরেটেড দুই-নম্বরী টুলস ও ভিক্ষালব্ধ সফটঅয়ার ব্যবহার করে করে যখন হীনম্মণ্য গিনিপিগের মতো মানবিক আত্মসম্মানবোধ তলানিগত প্রায়, ঠিক সে সময়ে এরকম একটা খবর নিজেকে অনিবার্যভাবে পুনরুদ্ধারের সুযোগ করে দিলো। আফসোস হলো, যে মানবিক বোধ নিয়ে লেখালেখির চর্চা করি, সেই মানবিকতা ধারণ করতে পারিনি কেবল একটি কুক্ষিগত অপারেটিং সিস্টেমের (উইন্ডোজ) পণ্যদাস হয়ে ! আর নয়, এই দাসত্ব থেকে মুক্ত হবার সময় এসেছে। এবার আমিও মিন্টু হবো ! ওপেন-সোর্সের উন্মুক্ত স্বাধীনতা আমিও ভোগ করতে চাই !
স্বাধীনতার ডাক বড় ভয়ঙ্কর ! তা কোন বন্ধন মানে না। ক্রীতদাসের যেমন কোন স্বাধীন বন্ধু হয় না, যে হয় সেও ক্রীতদাস, তেমনি ক্রীতদাসের কোন স্বাধীন ইচ্ছা নেই। কারণ তার ইচ্ছা পরাধীন। প্রভুর ইচ্ছাই তার ইচ্ছা। উইন্ডোজ তার নিজস্ব ইচ্ছাকে চারিত করেছে তার পণ্যদাস পরিচালনায়। উইন্ডোজ যা ইচ্ছা করেছে, আমিও তা-ই করেছি এতোদিন। যা ইচ্ছা করেনি, আমিও তা করতে পারি নি। কারণ আমি তার পণ্যদাস। আসলে আমি বা আমরা কখনোই উইন্ডোজ উপভোগ করিনি, উইন্ডোজই ভোগ করেছে আমাদের, এখনো করছে, আগামীতেও করবে। তার ভোগের ইচ্ছার বাইরে যাওয়ার সাধ্য পণ্যদাস আমাদের নেই। এবং সে যে কষ্ট করে আমাদেরকে ভোগ করছে, তার বিনিময়মূল্যও আদায় করে নিচ্ছে আমাদের কাজ থেকে। তা করবেই তো ! তারাই তো আমাদেরকে কম্প্যুটার ব্যবহার শিখিয়েছে, মজা দিয়েছে, তৃপ্তি দিয়েছে ! যেভাবে আমাদের দেশে এই উইন্ডোজকে আঁকড়ে ধরে বাংলা লেখালেখির ক্ষেত্রে বিজয় নামের একটা প্রোগ্রামও তা-ই করছে। বড়ো মজার ভোগ্যপণ্য আমরা। কিন্তু এই দাসত্ব থেকেই মুক্তির ডাক দিয়েছে ওপেন সোর্স অপারেটিং সিস্টেম। লিনাক্স হচ্ছে সেই মুক্তির কান্ডারি। আমি আমার মতো ভোগ করবো, জিনিসপত্র সবই আছে, আমি আমার প্রয়োজন ও ইচ্ছেমতো খাবার তৈরি করে নেবো, উপভোগ করবো, চাই করবো না। কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের সেই বিখ্যাত পঙক্তিটা মনে পড়ে যায়- ‘ইচ্ছে করলেই যেতে পারি, কিন্তু কেন যাবো …? ‘ লিনাক্স আমাদেরকে সেই ইচ্ছের স্বাধীনতাই দেখিয়ে দিয়েছে। প্রয়োজন অনুযায়ী অপারেটিং সিস্টেম আমি চাইলেই আমার মতো তৈরি করে নিতে পারি। আমার ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতা বা অজ্ঞতার কারণে নিজে না পারলেও অভিজ্ঞ কারো মাধ্যমে লিনাক্সের সমৃদ্ধ ও উন্মুক্ত উৎস থেকে বেছে বেছে নিয়ে তা করিয়ে নিতে পারি। নিজের রাস্তা পছন্দ করার কিংবা পছন্দমতো রাস্তা তৈরি করে নেয়ার উন্মুক্ত স্বাধীনতা, এ বড়ো ভয়ঙ্কর স্বাধীনতা, অনেকটা ঈশ্বরের মতো। ডিকোডিং এর উৎসগুলো সিলগালা করে রাখা বনেদি বিশ্ব-বণিক উইন্ডোজ কি দিতে পারবে কখনো ?
আগ্রহ তুঙ্গে তখন। কোথায় লিনাক্স সিডি পাই ! কিন্তু লিনাক্স তো আর উইন্ডোজের মতো একনায়কতান্ত্রিক ও বন্ধুহীন নয় ! এর প্রতিটা ইউজারই তো একেকটা স্বাধীন মানবিক সত্তা। এই অসংখ্য বহমান ধারার সম্মিলিত স্রোতই তো লিনাক্স। অতএব আমারও বন্ধুর অভাব হয় না। এতো বন্ধু যে খেই হারিয়ে ফেলতে হয়। যারা বিশ্বাস করে- শেয়ার অব নলেজ ইজ পাওয়ার এন্ড দ্য ফ্রিডম। কী আশ্চর্য, নিজেকে শেয়ার করতেই মুখিয়ে আছে এরা ! এটাই তাঁদের শক্তি, এটাই তাঁদের দর্শন। শেষমেশ প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির সুযোগ্য শিক্ষক আমাদের বন্ধু শামীম ভাই (মিয়া মো: হুসেইনুজ্জামান) সেই কোথা থেকে একেবারে মিরপুরে আমার অফিসেই সশরীরে চলে এলেন আমাকে সহায়তায় ! চেয়েছিলাম একটা, তিনি নিয়ে এলেন এক বাণ্ডিল লাইভ-সিডি ! যদি কাউকে দিতে হয়, আমার যাতে অতিরিক্ত কষ্ট করতে না হয়।
লাইভ-সিডি‘র সুবিধা হচ্ছে কোন ধরনের ইনস্টল না করেই সিডি দিয়ে গোটা অপারেটিং সিস্টেম চালানো। উইন্ডোজ বা লিনাক্স দিয়ে কম্প্যুটারে যত ধরনের কাজ করা হয় তার সবই এই সিডি দিয়ে আলগা থেকে সেরে ফেলা যায় ! এডিটিং, ক্রিয়েটিং, এমিউজম্যান্ট ইত্যাদি সবই ! অথচ উইন্ডোজে কি লিনাক্সের মতো এরকম লাইভ-সিডি কল্পনাও করা যায় ! বেশ ফুরফুরে মেজাজে অফিসে এলাম। লিনাক্স কী তা ভালো করে বোঝার আগেই লিনাক্সের উপর বিশাল এক বক্তব্য দিয়ে অফিসের দু‘জন উইন্ডোজ ইউজারকে মহাসমারোহে দুটো সিডি দিয়ে দিলাম। সন্ধ্যের পর বাসায় ফিরেই আমার ল্যাপির জায়গামতো লাগিয়ে দিলাম সিডি। ওমা, আমার মিন্টু তো চলে না ! মনিটর গড়ের মাঠ ! বসে রইলাম পাঁচ মিনিট, দশ মিনিট, পনের মিনিট, বিশ মিনিট…। কিন্তু… ! রিস্টার্ট করলাম ল্যাপি। আবারো সেই… ! এবার সিডিটা পাল্টে অন্যটা লাগালাম। সেই একই অবস্থা ! লাগালাম ফোন শামীম ভাইকে। ওপাশ থেকে জবাব এলো- আপনি কি হার্ডঅয়ার ও সিডি কোনটা থেকে আগে বুট হবে তা বায়োসে ঠিক করে দিয়েছেন ? আরে বলে কী ! বায়োস নামটা জীবনে দুয়েকবার শুনেছি বটে, কিন্তু কিভাবে ওটাকে কানে ধরে টানতে হয় তা-ই তো জানি না ! শামীম ভাই‘র কাছে আমার তো কেঁদে ফেলার অবস্থা ! ওপাশ থেকে আশ্বস্ত করলেন তিনি- চিন্তা নেই, আপনাকে সহায়তা দিতে প্রয়োজনে আপনার বাসায় লোক চলে যাবে। কিছুক্ষণ পর আরেকটা ফোন, দাদা কেমন আছেন ? আমি শাবাব মুস্তাফা, উন্মাতাল তারুণ্য, কাল কখন কোথায় আসবো বলেন…।
অনেক ভাঙাচুরা রাস্তা আর গলি-গালা পেরিয়ে পরদিন সন্ধ্যায় একেবারে বাসায় চলে এলেন শাবাব ভাই। তিনি যখন এলেনই, তখন আমার চাওয়া আরো বাড়ন্ত। এবার আর লাইভ-সিডি কেন ! একেবারে ডুয়েল-বুটই করিয়ে নেবো। হলোও তা-ই। এবার সত্যি সত্যি আমি মিন্টু হলাম ! কিন্তু এতো কষ্ট করে নিজের খেয়ে বনের মোষ দৌড়াতে যিনি এলেন, সেই শাবাব ভাইকে ভালো একটু নাস্তাও করাতে পারি নি। বন্টু-মিন্টুরা কি এমন বেরসিক হয় ! না কি আমারই সীমাবদ্ধতা !
এটা কী জিনিসরে ভাই, ভেতরে ঢুকবো কী, ডেস্কটপের নিচের বাঁ কোণা থেকে বিচ্ছুরিত নতুন হালকা-সবুজ আলোকরশ্মির ছড়িয়ে যাওয়া অদ্ভুত সুন্দর চেহারাটার দিকে চেয়ে থাকতেই ইচ্ছে করে ! আর এভাবেই শুরু হলো আমার মিন্টু-যাত্রা। সত্যিকারের যাত্রা ! শুরুতেই কৌতুহল হলো উইন্ডোজের সাথে লিনাক্স মিন্ট ইসাডোরা‘র মিল বা অমিলটা কোথায় তা খুঁজে দেখতে।
ডেস্কটপের বাঁ দিকে উপর থেকে পর পর দুটো আইকন। কম্পিউটার ও হোম। ডেস্কটপের নিচে একটা টাস্ক-বার। এই বারের বাঁ পার্শ্বে মেনু আইকন, ডান পাশে পাশাপাশি ছ‘টি আইকন এবং সপ্তাহের বার, মাস, তারিখ ও সময় চিহ্নিত করা। ছ‘টি আইকনের প্রথমটির চেহারা একটা সাদা শীল্ড-এর মতো। ছোটবেলায় ফুটবল খেলে কালো রঙের এরকম শীল্ড জিতে পাড়ায় হৈ হুল্লোড় করে চাঁদা তুলতাম। আইকনটা দেখে পুরনো স্মৃতিটা মনে পড়ে গেলো। ওটাতে ক্লিক করতেই একটা ছোট্ট উইন্ডো (উইন্ডোজের ভাষায় এটাকে উইন্ডো বলে, লিনাক্সের ভাষায় কী বলে জানি না) হাজির হয়ে লিনাক্স মিন্ট-এর আপডেটের জন্য পাসওয়ার্ড চাইলো। বাহ ! ইন্টারনেট কানেকশান থাকলে এই শীল্ডের উপর কার্সর রাখলেই লেখা দেখায় অনুমোদিত কতগুলো আপডেট অপেক্ষায় আছে। এর পরের আইকনটা গলাগলি করে থাকা দুটো ডেস্কটপ মনিটরের ছবি। কার্সরটা উপরে রাখতেই নেটওয়ার্ক কানেকশান আছে কি নেই সে তথ্য ভেসে উঠে। কম্পুতে ইন্টারনেট মডেম সংযুক্ত করতেই জোড়া কম্প্যুটারের ছবিটা ছোট্ট দুটো আলোর বলের রূপ নিয়ে নেয় এবং একটা আলোর রেখা এদেরকে ঘিরে ক্লক-ওয়াইজ ঘুরতে থাকে এবং কিয়ৎক্ষণ পরেই মনিটরে ইন্টারনেট কানেকশনের তথ্য নিশ্চিত করে। এর পরের আইকনটা একটা ঠেলাগাড়ি বা টানাগাড়ির মতো ছবি। ওটাতে ক্লিক করলেই কতকগুলো অপশন দেখায়। কুইট, রিস্টার্ট, বাংলা-ইউনিকোড, ইংরেজি-আইস্পেল ইত্যাদি দেখেই বুঝে ফেলা যায় এর কাজ কী হবে। এর পরেরটাই একটা ব্লুট্রুথের পরিচিত আইকন। ক্লিক করলে ব্লুট্রুথ সম্পর্কিত বিভিন্ন প্রয়োজনীয় অপশন ভেসে উঠে। ল্যাপটপ হওয়ায় হয়তো এর পরের আইকনটা ব্যাটারির। এবং তার পরেরটা সাউন্ড বাড়ানো-কমানোর আইকন।
এবার ডেস্কটপের উপরে বাঁ দিকের কম্প্যুটার আইকনে ক্লিক করতেই যে উইন্ডোটা ওপেন হয়, এটাকে উইন্ডোজের মাই-কম্পিউটার উইন্ডো থেকে একটুও ব্যতিক্রম মনে হয় নি। সবগুলো ড্রাইভের আইকন পূর্বকৃত নাম ও তথ্যসহ প্রদর্শিত হয়ে আছে। প্রয়োজনীয় ড্রাইভ ফোল্ডারে ক্লিক করতেই উইন্ডোজে আগের তৈরি সবগুলো ফোল্ডারই দেখা গেলো অরিজিনাল নামসহ। একে একে সব যাচাই করে দেখলাম, সবগুলো ফাইল ও ফোল্ডার ঠিক সেরকমই আছে, যেভাবে আগে করা ছিলো। আর উইন্ডোর বাঁ দিকের একটা অংশে কম্প্যুটারের ভেতরে থাকা সবগুলো মেইন-ফোল্ডারের একটা উপর-নিচ তালিকাও প্রদর্শন করছে, সবার উপরে লিনাক্সের হোম ফোল্ডারসহ। উইন্ডোজ থেকে এটা একটা বেশতি সুবিধা বলে মনে হলো যে, ব্যাক করে করে এসে অন্য ড্রাইভে ঢুকার কষ্ট না করে ওখান থেকেই প্রয়োজনীয় ফোল্ডারটিতে সরাসরি ঢুকা যাচ্ছে। এমনকি টেক্সট ফাইলগুলো সেই সুতন্নিএমজে ফন্টে তৈরি লেখাসহ অক্ষত ও অবিকৃত অবস্থাতেই দেখা যাচ্ছে ! কী মজা ! তবে এই ফোল্ডার তালিকার নিচে আরেকটা ভাগে পাঁচটি নতুন ফোল্ডার আইকন দেখায়- ডকুমেন্ট, মিউজিক, পিকচার, ভিডিও ও ডাউনলোড নামে। ওগুলোতে ক্লিক করলে ভেতর ফাঁকা দেখায়। হয়তো লিনাক্সের নিজস্ব এই ফোল্ডারগুলোতে কোন ডকুমেন্ট বা অন্যকিছু এখনো সেভ করা হয়নি বলে। আরো ব্যবহারের পর এগুলো কার্যকারিতা বুঝা যাবে।
পুনরায় ডেস্কটপে ফিরে হোম আইকনে ক্লিক করতেই সরাসরি ফাইল সিস্টেমে ঢুকে গেলাম, যা উপরে উল্লেখ করা হয়েছে। এবার উইন্ডোজের নিয়মেই পুরনো একটা ফোল্ডারে ঢুকে নতুন একটা ওয়ার্ড ফাইল খুলে কিছু লিখে টেস্ট করা দরকার। উইন্ডোজে দেখাতো এমএস ওয়ার্ড, আর এখানে দেখালো ওপেনঅফিস-অর্গ রাইটার। লিনাক্স মিন্ট ইসাডোরায় বাংলা লেখার সুবিধা ডিফল্ট করে দেয়া। এখানকার ফন্টগুলো সব ইউনিকোডেড, যা আমরা অন-লাইনে ব্যবহার করে থাকি। আলাদাভাবে অভ্র ডাউনলোডেরই প্রয়োজন নেই ! কিংবা অনলাইনে লিখতে ইউনিকোড কনভার্টারেরও প্রয়োজন নেই ! কেবল ‘কন্ট্রোল + স্পেস‘ কী চাপলেই ইংরেজি থেকে বাংলা, আবার একই কী চেপে বাংলা থেকে ইংরেজিতে রূপান্তর। উপরের ফন্ট ট্যাব থেকে সোলাইমানিলিপি সিলেক্ট করেই লেখা শুরু করে দিলাম। অবিশ্বাস্য চমৎকারিত্বে আমি অভিভূত ! আর উইন্ডোজের চাইতেও বুঝি প্রয়োজনীয় টুলস অনেক বেশি দেয়া রয়েছে টুলস-বারে ! ফাইলটিকে কারেন্ট ফরমেটে সেভ করে ফিরে এলাম আবার ডেস্কটপে। ওমা, দেখি কিছুক্ষণ আগের কাজ করা ফাইলের মূল ফোল্ডারটা একটা আইকন ডেস্কটপে এসে বসে আছে অস্থায়ীভাবে ! বাহ্, চাইলে এখান থেকেই ফের সরাসরি ঢুকে যাওয়া যাবে।
ডেস্কটপের নিচের বাঁ কোণায় মেনু বারে ক্লিক করতেই কী চমৎকার একটা ছোট্ট পর্দা বেরিয়ে এলো ! তিনটি কলামে সাজানো সব প্রোগ্রামগুলো আইকনসহ শোভা পাচ্ছে। প্রথম কলামে প্লেসেস মেনুর অধীনে রয়েছে কম্পিউটার, হোম-ফোল্ডার, নেটওয়ার্ক, ডেস্কটপ ও ট্রাশ। এর নিচে সিস্টেম মেনুর অধীনে রয়েছে সফটঅয়ার-ম্যানেজার, প্যাকেজ-ম্যানেজার, কন্ট্রোল-সেন্টার, টার্মিনাল, লক-স্ক্রীন, লগ-আউট ও কুইট। মাঝের কলামে অ্যাপ্লিকেশান মেনুর অধীনে সমস্ত অ্যাপ্লিকেশানের মূল মেনু তালিকা- অল, একসেসরিজ, গ্রাফিকস, ইন্টারনেট, অফিস, সাউন্ড এন্ড ভিডিউ, সিস্টেম-টুলস, এ্যাডমিনিস্ট্রেশানস, ও প্রেফারেন্সেস। এই তালিকার যে কোন অ্যাপ্লিকেশনে কার্সর রাখার সাথে সাথে ডান দিনের কলামে এর অধীনস্ত যাবতীয় প্রোগ্রামগুলোর তালিকা ফেভারিটস-এর নিচে ভেসে ওঠে। যেমন অফিস অ্যাপ্লিকেশনে কার্সর নেয়ার সাথে সাথে ডান দিকে ভেসে ওঠে পাঁচটি প্রোগ্রাম- ডিকশনারী (অনলাইন স্পেল-চেকার), ওপেনঅফিসঅর্গ-ডাটাবেজ (উইন্ডোজে যা একসিস প্রোগ্রাম), ওপেনঅফিসঅর্গ-প্রেজেন্টেশান (উইন্ডোজের স্লাইড-শো ইত্যাদি), ওপেনঅফিসঅর্গ-স্প্রেডশীট (উইন্ডোজে যা এক্সেল প্রোগ্রাম) এবং ওপেনঅফিসঅর্গ-ওয়ার্ডপ্রসেসর (উইন্ডোজে যা এমএসওয়ার্ড বা লেখালেখির খাতা)। এসবের যে কোনো একটিতে ক্লিক করলেই সেই প্রোগ্রাম ওপেন হয়ে যায় প্রয়োজনীয় কাজ করার প্রস্তুতি নিয়ে। একইভাবে মাঝের কলামের ইন্টারনেট অ্যাপ্লিকেশানে কার্সর রাখার সাথে সাথে ডানদিকের কলামে ফেভারিটসের নিচে মজিলাফায়ারফক্স সহ মোট আটটি ব্রাউজারের প্রোগ্রাম ভেসে ওঠে। লিনাক্স মিন্ট ইসাডোরায় মজিলা-ফায়ারফক্স ডিফল্ট থাকায় কম্পুতে ইন্টারনেট কানেকশান দিয়ে ওখানে ক্লিক করলেই ফায়ারফক্সের ব্রাউজার ওপেন হয়ে যায়। আর এর সাথে সাথে নিচের মেনুবারের ডানদিকের ইন্টারনেট আইকনটি একটি টাওয়ারের চেহারা নিয়ে নেয়।
এরপর কদিন ধরে লিনাক্স-মিন্ট অপারেটিং সিস্টেম থেকে ইন্টারনেটে ব্রাউজিং করলাম অন্য যে কোনো সময়ের চাইতে একটু বেশিই। সাবালক-নাবালক কোন ওয়েবসাইটই বাদ রাখিনি ব্রাউজিং করতে। বিস্ময়ের সাথে খেয়াল করলাম, উইন্ডোজের চাইতেও লিনাক্সে কি বিভিন্ন সাইটের ছবিগুলো আরো বেশি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে ! প্রয়োজনীয় লগ-ইন করে ই-মেইল চেক করে রিপ্লাই দেয়া, ফেসবুকে ছবি আপলোড করা, বিভিন্ন ব্লগে কমেন্ট করা, মশলাদার ভিডিওক্লিপ চালিয়ে দেখা সবই হলো। কিন্তু কই, কোথাও তো কোন সমস্যা হলো না ! আমি কম্পুকানা মানুষ, অত্যন্ত সাধারণ ইউজার হিসেবে উইন্ডোজের প্রাথমিক জ্ঞান দিয়েই তো লিনাক্স চালাচ্ছি। তাহলে অসুবিধা হচ্ছে না কেন ? অসাধারণ ইউজারদের জন্যেই হয়তো সমস্যা-অসমস্যার কাহিনী। যা আদৌ আমার জানা নেই। তাহলে আমরা সাধারণ ব্যবহারকারীরা কি আসলে কম্পিউটারকে প্রকৃতই কম্পিউটার হিসেবে ব্যবহার করি না ? হয়তো তা-ই। আর এ জন্যেই আমাদের জন্য লিনাক্সে কোন সমস্যাই নেই, বাড়তি কিছু সুবিধা ছাড়া। এদিকে বন্টু-মিন্টু বন্ধুরা খোজ-খবর নিচ্ছে- দাদা, লিনাক্স কেমন চলছে, কোন সমস্যা হচ্ছে না তো ? আমি কী করে বলি যে কোন সমস্যা নেই ! তারচেয়ে বরং জবাব দেই- আরো ব্যবহার করি, দেখি সমস্যা কোথায় কোথায় হয় ?
হঠাৎ খবর পেলাম ২৩ জুলাই ২০১০ তারিখ বিকেল ৩.৩০ এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আর সি মজুমদার মিলনায়তনে বন্টু-মিন্টুদের এক বড়সড় আড্ডা হতে যাচ্ছে। আড্ডা মানে মিলনমেলা। যেহেতু এটা বন্টু-মিন্টুদের মিলনমেলা, তাহলে নিশ্চয়ই সেখানে লিনাক্স ব্যবহারে উদ্ভুত সমস্যা সমাধান এবং পরবর্তি গতি-প্রকৃতি নিয়ে তুলকালাম কাণ্ড ঘটবে। অতএব আমি তো যাবোই, তবে তার আগে লিনাক্সের কিছু সমস্যা বের করে নিয়ে যেতে হবে। কিন্তু নাদান ইউজার আমি যে কোনো সমস্যাই খুঁজে পাচ্ছি না ! ততদিনে আমার মিন্টু হবার বয়েস দু-সপ্তাও পুরেনি। দেখতে দেখতে ২৩ তারিখও এসে গেলো। এখন কী করা ! সমস্যা নেই মানেই তো আরেকটা সমস্যা ! সিদ্ধান্ত নিলাম, আমি যখন কোন সমস্যাই খুঁজে পাইনি, যাবো তো বটেই, সেখানে গিয়ে না হয় অন্যদের কাছ থেকে সমস্যা কোথায় আছে তা-ই জানবো।
ঢাকা ভার্সিটির ছাত্র ছিলাম না বলে আর সি মজুমদার মিলনায়তনের সুনির্দিষ্ট অবস্থানটা না জানলেও এটা জানা গেছে যে মধুর কেন্টিনের ধারেকাছে কোথাও আছে। ভার্সিটির গ্রন্থাগারের সামনের টং-দোকানিরাও কি এই মিলনায়তন চেনে না ! পরে একজন বললো মধুর কেন্টিনের দিকে যেতে। মধুর কেন্টিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ানো এক যুবকের কাছে ঠিকানা জানতে চাইলাম। উল্টো তিনি আমাকে বললেন- একটু অপেক্ষা করেন, আমিও সেখানে যাবো, একজন আমাকে রিসিভ করতে আসছেন। বুঝলাম তিনিও আমার মতোই। কয়েক মুহূর্ত পর কেন্টিনের ভেতর থেকে বেরিয়ে আসা দু‘জন যুবকের একজন আমাকে দেখেই প্রশ্ন করলেন- আপনি রণদীপম বসু না ? অপরিচিত যুবকের প্রশ্নে সায় দিয়ে প্রশ্নবোধক দৃষ্টি তাঁর দিকে ছুঁড়ার আগেই শ্যামলা বর্ণের চমৎকার প্রাণপ্রাচুর্যময় সুদর্শন যুবকটি বললেন- আপনার ছবি দেখেছি তো, তাই চিনতে পেরেছি; আমি প্রযুক্তি ফোরামের মানচুমাহারা। বুঝা গেলো, মাথায় আটকানো ক্রীম-কালার টুপিটা বুঝি নিকের মর্যাদা পেয়ে গেছে। আসলে আমি তো নই, পরিচিতির দাবিদার এই টুপিটাই। বেশ, তাঁর সাথে হাঁটতে হাঁটতে খুব কাছেই অবস্থিত আর সি মিলনায়তনে পৌছে গেলাম।
গেটে ভলান্টিয়ার দায়িত্ব পালন করছেন কয়েকজন বন্টু-মিন্টু। কে বন্টু কে মিন্টু তা পরিধানের লোগো-মার্কা গেঞ্জি দেখেই চেনা যাচ্ছে। পরিবেশটা নিরব নিরব মনে হওয়ায় ভাবলাম বুঝি এখনো খুব একটা কেউ আসে নি। কিন্তু কম্পাউন্ডে ঢুকে তো চোখ উল্টে গেলো ! ভাগে ভাগে বসানো টেবিলে কোথাও উবুন্টু ও লিনাক্স মিন্টের লোগোসহ গেঞ্জি বা টি-শার্ট, কোন টেবিলে লিনাক্স ও মিন্টের অতিরিক্ত সফটঅয়ার ও আপডেটসহ উবুন্টু বাংলাদেশ সংকলিত সিডি-ডিভিডির বিপুল সমাহার, কোথাও চায়ের সরঞ্জাম গোছগাছ হচ্ছে। হলরুমের প্রবেশপথে এন্ট্রি টেবিল। চারদিক ভলান্টিয়ার আর বন্টু-মিন্টুদের উচ্ছ্বাসে মুখর। আমাকে দেখেই শামীম ভাই‘র উজ্জ্বল হাসি আরো প্রসারিত হলো। আমিও আশ্বস্ত হলাম। এন্ট্রি শেষে হাতে ধরিয়ে দেয়া হলো বিডিওএসএন মুক্ত সফটঅয়ার ও এর প্রয়োজনীয়তার বিবরণ সংবলিত লিফলেট এবং আউট সোর্সিংয়ের উপর বিনামূল্যে বিতরণকৃত বুকলেট। কিন্তু হলরুমে ঢুকেই ভ্যাবচেকা খেয়ে গেলাম। তিনশ আসন বিশিষ্ট মিলনায়তন ভর্তি হয়ে কেউ কেউ দাঁড়িয়ে আছে। জাতীয় সঙ্গীতে সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে ততক্ষণে আনুষ্ঠানিক আড্ডা শুরু হয়ে গেছে। হলের এক কোণায় পাতা টেবিলে যাবতীয় সরঞ্জাম নিয়ে আমাদের বিশিষ্ট বন্টু ও ব্লগার গৌতম সচলায়তন, প্রযুক্তি ও উবুন্টু ফোরামে একযোগে আড্ডার লাইভ-স্ট্রিমিং শুরু করে দিয়ে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। ঢাকা ও ঢাকার বাইরের তিন শতাধিক বন্টু-মিন্টুর তারুণ্যের উচ্ছ্বাস আর উষ্ণতা আমার ভেতরেও তখন বইতে শুরু করেছে।
(০৮)
আড্ডা আর আনুষ্ঠানিকতার মিশেলে আয়োজিত অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনার দায়িত্ব পালন করছেন শাবাব মুস্তfফা ও অয়ন খান। চেহারা দেখে বুঝা যায় না তাঁদের কথার মধ্যে এতো রস ! শাবাব মুস্তফা আমার পূর্ব-পরিচিত। উইকিমিডিয়ায় ছবি প্রেরণ সম্পর্কিত কারণে মোবাইল-আলাপের সূত্রে নাম-পরিচিত ছিলেন তিনি। আর সেদিন আমার ল্যাপটপে মিন্টু বুট করতে গিয়ে বাকি পরিচয়। প্রজন্ম-ফোরামে উন্মাতাল তারুণ্য নামে ব্লগিং করেন। এছাড়া ব্লগারদের মধ্যে শামীম ভাই, গৌতম আর পেছনে তরুণী-সংসর্গে বসা রায়হান আবীরকে পরিচিতের মধ্যে পেলাম। তবে অনুষ্ঠানস্থলের শৃঙ্খলার মধ্যে অন্য কাউকে খুঁজে দেখার সুযেগ হয়নি তখনো।
মঞ্চের পেছনে সাঁটানো বন্টু-ব্লগার অভ্রনীলের ডিজাইন করা ব্যানারটার দিকে তাকালেই বুকের ভেতরে একটা আড্ডা আড্ডা ভাব চলে আসে। ব্যানারের নিচের দিকে ডানে আজকের অনুষ্ঠান আয়োজনের তথ্যে প্রাতিষ্ঠানিক লোগোসহ চমৎকারভাবে উল্লেখ করা দেখলাম- প্রচার সহায়তায়: আমাদের প্রযুক্তি, প্রজন্ম ফোরাম, সচলায়তন ও লিনাক্স মিন্ট বাংলাদেশ। কারিগরি সহায়তায়: অঙ্কুর আইসিটি ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন এবং আয়োজনে: উবুন্টু বাংলাদেশ।
প্রথম সেশনে একটা ডকুমেন্টরি দেখানো হলো প্রজেকটরে। জে টি এস ম্যুরের মুক্তসোর্স ভিত্তিক ডকুমেন্টরি ‘রেভল্যুশন ওএস’। দীর্ঘ ডকুমেন্টরিটি দেখতে দেখতে অন্য কেউ বোরড হলো কি না জানি না, তবে আমার জন্যে ছিলো অত্যন্ত আগ্রহোদ্দীপক। কারণ আমার কাছে সবই নতুন। তাছাড়া ঐ ডকুমেন্টরি থেকেই ওপেন সোর্স বা ফ্রি সোর্স আন্দোলনের যাত্রা, এর স্রষ্টাদের কর্মকাণ্ড, স্বাধীন মানবিক দর্শনের প্রাযুক্তিক ব্যবহার, সম্ভাবনা ও অগ্রযাত্রা, বিস্তার, বিশ্বব্যাপি প্রভাব এবং আগামী দিনের কাণ্ডারি হবার অনিবার্যতার বিষয়গুলো ধাপে ধাপে সচল চিত্র ও সংলাপের মধ্য দিয়ে খুব চমৎকারভাবে উঠে এসেছে। এবং আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলাম, ডকুমেন্টরিটি দেখার পর আগের আমি ও পরের আমিতে বিরাট একটা পার্থক্য সূচিত হয়ে গেছে ! এখনকার আমি আর আগের আমি নই ! তবে কি সত্যি পাল্টে যাচ্ছি ! হতে পারে পাল্টানোর জন্যে প্রস্তুত হয়েই ছিলাম। তাই বলে এখন কেউ যদি ওই ডকুমেন্টরির তথ্যগত বিষয়ে কোন প্রশ্ন করেন, কোন উত্তরই দিতে পারবো না আমি। কেননা এটা আমার উপলব্ধির দার্শনিক বোধে নাড়া দিয়ে গেছে ঠিকই, কিন্তু কোন সুনির্দিষ্ট নাম বা তথ্য আমার ব্যক্তিগত সীমাবদ্ধতার কারণেই স্মৃতিসংরক্ষণাগারে সাথে সাথে সংরক্ষিত হয় নি।
এরপরই শুরু হলো মূল আড্ডা। মিলনায়তনের ইতস্তত অবস্থান থেকে মঞ্চে উঠে এসে একে একে নিজেদের অভিজ্ঞতা বয়ান করছেন একেকজন। সমস্যার মুখোমুখি হওয়ার গল্প, যার কোডিং-ডিকোডিং সম্পর্কিত বিষয়গুলোর মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না আমি। তবে উপলব্ধি করছি, এ হচ্ছে পাক্কা সাঁতারুদের উল্টোস্রোতকে বশে আনার গল্প। এদের উজ্জ্বল মুখের দিকে চেয়ে থাকতেই ভালো লাগছে। কেউ আবার কারো মারমুখী আত্মীয়ার প্রিন্টার ভেঙে ফেলার গল্প বলছেন, যে প্রিন্টার লিনাক্সে চলে না সেটা রাখবোই না জাতীয় প্রতিজ্ঞাবদ্ধতার। কেউ বলছেন লিনাক্স প্রচারণা করতে গিয়ে নাদান পাবলিকের দৌড়ানি খাওয়ার গল্প। প্রেমিকাকে লেখা চিঠি স্ত্রীর কাছে চলে যাবার প্রতীকী গল্প শুনলাম মুনির ভাই‘র মুখে। তিনি অবশ্য মুক্তসোর্সের মাধ্যমে কিভাবে আমাদের প্রতিভার বিকাশ হতে পারে তা বুঝাতে গিয়ে গল্পের হাস্যরস তৈরি করেন। ইত্যাদি নানান রঙ্গ, অভিজ্ঞতা। নবীন ইউজার কেউ কাজ করতে গিয়ে সমস্যায় পড়েছেন, তা থেকে উত্তরণের উপায় জানতে চাচ্ছেন। তার সমাধান জানাতে অভিজ্ঞ আরেকজন কেউ উঠে আসছেন। শেয়ার অব নলেজের এক আজব আড্ডা। অভিজ্ঞতা বিনিময়ের এক চমৎকার কার্যকর ব্যবস্থা ! বুঝা গেলো বিষয়ের বৈচিত্র্য আর সমাহারের বিবেচনায় বিকেল ৩.৩০ থেকে রাত ৮.০০টা পর্যন্ত সময়ও অতি সংকীর্ণ হয়ে গেছে।এদিকে ম্যাক ভাই তো রীতিমতো শ্রীপুরে বড়ি বেঁচার কায়দা নিয়ে মঞ্চে উঠে অঙ্কুরের বাংলায় লোকালাইজেশন করা ভিএলসি প্লেয়ায়, মজিলা ফায়ারফক্স ও ওপেন অফিসের যাবতীয় প্রোগ্রামের এক সিডি ও মজিলা ফায়ারফক্সের লোগোসংবলিত ব্যাজ উপস্থিত অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে বিনামূল্যে বিতরণ করতে গিয়ে আড্ডায় রীতিমতো হাউকাউ বাঁধিয়ে দিলেন। কারণ এতো বন্টু-মিন্টুর সমাগম হবে তা ভাবতে পারেন নি বলেই হয়তো বিতরণসামগ্রি পরিমাণে কিছু কম এনেছিলেন। হা হা হা !
কাজ করা মানে কোন না কোন সমস্যার মুখোমুখি হওয়া, সমস্যা মানে কিছু প্রশ্ন উত্থিত হওয়া, সঠিক প্রশ্ন আসা মানে সমস্যার অর্ধেক সমাধান হয়ে যাওয়া, এবং কেউ না কেউ বাকিটুকুর সমাধান জানবেনই বা ওপেন সোর্সে এর সমাধান তৈরি হবেই। এভাবেই এগুচ্ছে সব। এদিকে আমার সমস্যা হলো এতো অল্প সময়ের ব্যবহারে কিংবা আমার ব্যবহারিক সীমাবদ্ধতার কারণে লিনাক্স মিন্ট ইসাডোরায় কোন সমস্যাই পাচ্ছি না। এর অর্থ কি তাহলে আমি অকর্মা !
অনুষ্ঠানে এমনভাবে মজে ছিলাম যে, দুই-মেগাপিক্সেলে ছবি উঠানোর কথাই ভুলে ছিলাম। সময় পেরিয়ে হঠাৎ খেয়াল হলে রাতকানা মোবাইল তাক করে এক-দু‘টা ক্লিক করতেই সমস্যা একটা মাথায় এসে গেলো। আরে, উইন্ডোজে তো নকিয়ার ছবি ও ডাটা কম্পিউটারে ট্রান্সফারের জন্যে ‘নকিয়া পিসিসুট‘ নামের আলগা একটা সফটঅয়ার ইনস্টল করতে হয়েছিলো। এখন লিনাক্সে কী হবে ! লিনাক্স ব্যবহার করে উইকিতে ছবি পাঠানো বা আমার দুই-মেগাপিক্সেল সিরিজ কি চলবে না তবে ! সমস্যার কথা শুনে ক‘জন দুয়েকটা সফটঅয়ার ইনস্টল করার পরামর্শ দিলেন। তবে তারা এই বাদাইম্যা গোছের মোবাইল-ক্যাম ব্যবহার করেন না বলে এর কার্যকারিতা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন না। মনির ভাই জানতে চাইলেন- ‘আপনি কি মোবাইল ডিভাইস কম্পিউটারে সংযুক্ত করে দেখেছেন ?‘ আমি বললাম- ‘না, তা করিনি।‘
‘তাহলে সমস্যা জানলেন কী করে ?‘
আমি বললাম- ‘ সমস্যার আগাম ধারণা করছি।‘
তিনি আমাকে কী ভাবলেন জানি না। শুধু বললেন- ‘আপনি যথানিয়মে মোবাইল ডিভাইসটা কম্পিউটারে সংযোগ দিয়ে দেখেন কী হয়।‘
অনুষ্ঠান শেষে বাসায় এসেই ডাটাঅয়ার দিয়ে মোবাইলটাকে আগের নিয়মেই কম্পিউটারের ইউএসবি পোর্টে সংযুক্ত করার সাথে সাথে আমি হা হয়ে গেলাম ! লিনাক্স মিন্টে কি তাহলে এই প্রোগ্রামও ডিফল্ট করে দেয়া ! শুধু নকিয়াই নয়, অন্য অনেক মোবাইলের জন্যেও প্রোগ্রামটি সেবা দিতে প্রস্তুত হয়েই আছে। বেসিক্যালি আমি লোকটা বোকা বলেই হয়তো এবার কত নম্বরবার বেবাটের মতো বোকা বনলাম তা জানার সুযোগ রইলো না।
একজনকে প্রশ্ন করেছিলাম, আচ্ছা, মাউসে রাইট ক্লিক করলে যে কোন রিফ্রেশ অপশন পাই না ! মোক্ষম জবাবটা দিলেন তিনি। ফ্রেশ না থাকলেই তো রিফ্রেশের বিষয় আসবে ! ওপেন সোর্স হিসেবে ভাইরাসমুক্ত লিনাক্স অপারেটিং সিস্টেম নিজেই সবসময় রিফ্রেশ থাকে। তাই তাকে আলাদা করে রিফ্রেশের নির্দেশ দিতে হয় না বলে রিফ্রেশ অপশনেরই প্রয়োজন নেই। প্রযুক্তি জগতে আমি কতো বড়ো নাদান বোকা, আমার কথাবার্তা শুনেই এই সব কম্পুবিদ তরুণ বন্ধুরা হয়তো ঠিকই বুঝে ফেললেও কেউ তা কথায় বা আচরণে প্রকাশ তো করেই নি, বরং এতো আন্তরিকতা দিয়ে আমাকে নিজেদের একজন করে নিয়েছে যে, তাঁদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। এ কথা জানাতেই এক বন্ধু বললো- দাদা, প্রযুক্তির জগতে বোকা প্রশ্নের প্রাধান্য বেশি। এখানে বোকা না হলে কিছু শেখা যায় না।
আমি তাঁর কথা বুঝলাম কি বুঝলাম না, সেটাই বুঝলাম না !
আড্ডানুষ্ঠান শেষে দরজা দিয়ে বেরুতেই বেশ লম্বা সৌম্য চেহারার ফুটফুটে এক তরুণ এগিয়ে এসে বললো- ‘আপনি রণদীপম দা‘ না ?‘ গৌড়বর্ণের অল্পবয়েসী চেহারায় তাঁর একটা সহজ-সরল বালক বালক ভাব। ‘আমি শাফায়েৎ, মুক্তমনা ব্লগ ডেভেলাপার…।‘
আরে বলে কী ! শাফায়েৎ তো হবার কথা একটা দুঁদে টাইপের রুক্ষসুক্ষ লোক ! এই চমৎকার ছেলেটি বলে কিনা সেই শাফায়েৎ ! হা হা হা !
চা-নাস্তা সেরে বন্টু-ব্লগার গৌতমকে মধুর কেন্টিনে রেখেই বাসার উদ্দেশ্যে বিদায় নিলাম। টাউন বাস ধরতে হবে। এরকম আড্ডায় এলে কতো নতুন নতুন বন্ধুদের সাথে পরিচয় হয় ! আবার যাকে দেখিনি কখনো, নামে চিনি, সেই বন্ধুদেরকে পেতে এরকম আড্ডার জুড়ি আছে কি ? পুরনো বন্ধুরা তো আছেই। ছোট্ট একটা জীবনে সে-ই তো সর্বহারা ফকির যার কোন বন্ধু নেই। হাঁটছি আর ভাবছি- শেষপর্যন্ত আমি তো মিন্টু হলাম, কিন্তু….. ! হয়তো এই কিন্তুটাকেই খুঁজে ফিরতে হবে আগামী দিনগুলোতে…।
…ছবি-কৃতজ্ঞতা: বন্টু-মিন্টুর আড্ডা
Mahay Alam Khan’s Facebook-Album
Ranadipam Basu’s Facebook-Album
…
প্রকাশ:
[ sachalayatan ]
…
No comments:
Post a Comment