Thursday, July 22, 2010

সামাজিক ব্যবসা : নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন (প্রফেসর ইউনূসের সাক্ষাৎকার)


সামাজিক ব্যবসা : নতুন পৃথিবীর স্বপ্ন (প্রফেসর ইউনূসের সাক্ষাৎকার)

[ বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা 'সাপ্তাহিক'-এর বর্ষ ৩ সংখ্যা ১০, ২২ জুলাই ২০১০-এ ২০০৬ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে।  অর্থনীতির জগতে এক নতুন ধারণা 'সামাজিক ব্যবসা' সম্পর্কিত বিস্তারিত আলোচনা ও বিভিন্ন কারণে এ সাক্ষাৎকারটিকে গুরুত্বপূর্ণ মনে হওয়ায় সংশ্লিষ্ট ম্যাগাজিন থেকে হুবহু সাক্ষাৎকারটির অনুলিপি এই ব্লগে সংরক্ষণ করা হলো।  আগামীতে কোন গবেষণার জন্যেও সাক্ষাৎকারটি প্রয়োজনীয় মনে হতে পারে। তাছাড়া এই সামাজিক ব্যবসার অভূতপূর্ব ধারণা এবং এর সম্ভাব্য কার্যকর প্রভাব যে আগামীতে আরেকটি নোবেল পুরস্কারের বীজ উপ্ত  করে দিচ্ছে না, তাই বা কে বলতে পারে ! সাক্ষাৎকারটি পড়ে এই সম্ভাবনাকে একেবারে উড়িয়ে দেযার  মতো মনে হয় নি। -রণদীপম বসু ]


পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূলমন্ত্র ‘ম্যাক্সিমাইজেশন অব প্রফিট’। বা তার একমাত্র লক্ষ্য ‘মুনাফা’। পুঁজিবাদের এই তাত্ত্বিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে নাড়া খেয়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। দুনিয়াজুড়ে অর্থনৈতিক মন্দার পর, পৃথিবীজুড়ে যখন চলছে হাহাকার, তখন এর মধ্য থেকে নতুন সুযোগের, নতুন সম্ভাবনার এক আবিষ্কারের কথা বলছেন বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ, নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
তিনি বলছেন, যে মানুষ স্বার্থপরতা আর আত্মপরতার সর্বক্ষণিক দৌড়ে পুঁজিবাদের রথে চড়ে কেবল ‘মুনাফা’ খুঁজছেন, সেই মানুষের অন্তরজগতে বাস করে আরেক মানুষ, যার ভাবনায় আছে পরার্থপরতা, স্বার্থহীনতা। সেই মানুষই নিজেকে বিলিয়ে দেন পরের মঙ্গলের নিবেদনে। দেশে-বিদেশে তার নজির আছে আবহমান কাল ধরেই।
এই পরার্থপর, অন্যের মঙ্গল আকাক্সক্ষী মানুষের হৃদয়কে পুঁজি ধরে নতুন এক ব্যবসার কথা বলছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তার নাম দিয়েছেন ‘সামাজিক ব্যবসা’। যে ব্যবসাতে মুনাফা হয় কিন্তু ঐ মুনাফা মালিক নেয় না। মুনাফাটা তার মধ্যেই থেকে যায়, রিসাইকেল করে বড় হয়, প্রতিষ্ঠান বড় হয়। মানুষের সমস্যার সমাধান করে।
এই সামাজিক ব্যবসার ডাক দিয়ে থেমে থাকেননি কর্মবীর ইউনূস। তা প্রতিষ্ঠিতও করেছেন। দুনিয়াজোড়া চলছে এ নিয়ে তোড়জোড়। পৃথিবীর নামি দামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চলছে ‘সোশ্যাল বিজনেস চেয়ার’, ‘ইনস্টিটিউ অব সোশ্যাল বিজনেস’ ইত্যাদি প্রতিষ্ঠা।
জার্মানি, আমেরিকা, যুক্তরাজ্য, হাইতি, কলম্বিয়া, আলবেনিয়া, মস্কো– সারা দুনিয়ায় সাড়া ফেলছে এই সোশ্যাল ড্রিভেন ব্যবসার নতুন আহ্বান।
ইতোমধ্যেই ড. ইউনূস তার নতুন এই ধারণার তাত্ত্বিক রূপ দিয়েছেন Building Social Business : The New Kind of Capitalism that Servs Humanity’s Most Pressing Needs বইটিতে।
এক সময় তিনি বলতেন মাইক্রো ক্রেডিট, তথ্যপ্রযুক্তি বদলাবে গরিব মানুষের ভাগ্য। পৃথিবীব্যাপী আলোচনা-সমালোচনার ঝড় তুলেছে তার গ্রামীণ ব্যাংক। এবার ড. ইউনূস এলেন তার সামাজিক ব্যবসা (Social Business) ধারণা নিয়ে।
সাপ্তাহিক-এর সঙ্গে দীর্ঘ এক সাক্ষাৎকারে তার এই নতুন যাত্রার আদ্যোপান্ত বলেছেন
ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন গোলাম মোর্তোজা ও শুভ কিবরিয়া
—————————————————

সাপ্তাহিক : আপনাদের মতো অল্পসংখ্যক কিছু মানুষ আছেন, যারা বলেন যে, বাংলাদেশের বিশাল সম্ভাবনা আছে। কিন্তু এর বাইরে বিশাল জনগোষ্ঠী রয়েছে যারা মনে করেন যে, দেশের আর কিছু হবে না। অনেকেই দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া কিংবা আমেরিকাতে অভিবাসন নিচ্ছেন। সামর্থ্যবান, বৈষয়িকভাবে প্রতিষ্ঠিত এসব মানুষ যখন দেশ ছাড়ছেন, তখন আপনি বলছেন বাংলাদেশ নিয়ে আশাবাদের কথা। এটা কেন বলছেন? কিসের ভিত্তিতে বলছেন?
ড. মুহাম্মদ ইউনূস : সম্ভাবনার অনেক বাস্তব ঘটনা তো ঘটেছে আমাদের। যে পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যাত্রা শুরু করেছিল তাতে তো দেশ থাকে না এমন অবস্থা হয়েছিল। যে কারণে মার্কিন রাজনীতিক হেনরী কিসিঞ্জার বাংলাদেশ নিয়ে বলতে পেরেছিলেন, ‘তলাবিহীন ঝুড়ি। এটাকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করাটাও অনর্থক চেষ্টা। এটা মরে যাবে, এমনিই মরে যাবে।’
সেখান থেকে আমাদের যাত্রা শুরু। এ সমস্ত কিছু পার হয়ে আমরা এতদূর এসেছি। আমাদের বার্ষিক মাথাপিছু আয় এখন ৭০০-৭৫০ মার্কিন ডলার। আমাদের রিজার্ভ এখন ১১ বিলিয়ন ডলার। কে চিন্তা করেছিল যে আমাদের লোক বিদেশে গিয়ে রেমিটেন্স হিসেবে এত টাকা পাঠাবে।
আমি একবার হিসেব করে দেখিয়েছিলাম, বিদেশে আমাদের দেশের যতজন যায় এবং যে বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠায় তা জনসংখ্যার পরিপ্রেক্ষিতে মাথাপিছু ভারত, পাকিস্তান থেকেও বেশি। বাংলাদেশের যে জনসংখ্যা আর ভারত, পাকিস্তানের যে জনসংখ্যা তা দিয়ে যদি হিসাব করা যায় মাথাপিছু রেমিটেন্স কত আসছে-- তাহলেও দেখা যাবে যে, আমরা বেশি আছি।
কাজেই এটাও তো একটা বিষয়। আমরা তো বিদেশে গিয়ে নিম্ন মজুরির কাজ করি। আমরা তো ওপরের কাজ করি না। আমাদের প্রফেশনাল লোক অন্য দেশের তুলনায় বিদেশে অনেক কম। তারপরও রেমিটেন্স হিসেবে এত বেশি টাকা আমাদের এখানে পাচ্ছি এইটা বিরাট ব্যাপার।
কৃষিক্ষেত্রে যে উন্নয়ন হলো সেটাও তো কম কথা নয়। আমরা আগে খাদ্য ঘাটতিতে ছিলাম, যে কারণে আমাদের খাবার নিয়ে টানাটানি হতো। আজকে আমরা খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। ইতোমধ্যে জনসংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। মানুষের খাবারের পরিমাণ বেড়েছে। যেহেতু দেশের মানুষের অবস্থা ভালো হয়েছে, তারা খাবার খাচ্ছে বেশি, তারপরও কিন্তু আমরা সামাল দিয়ে যাচ্ছি।
আবাদযোগ্য কৃষি জমির পরিমাণ কমে গেছে। কিন্তু তার পর খাদ্যে স্বনির্ভরতা এসেছে।
স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে যদি দেখেন, স্বাস্থ্য সূচকের বিবেচনায় আমরা ছিলাম দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে তলার দেশ। আজকে এই কয় বছরে আমরা আস্তে আস্তে উঠতে উঠতে, একটা দেশ পার হতে হতে এখন আমরা সর্বোচ্চ পর্যায়ে এসেছি। হেলথ কেয়ারে আমাদের এমন বিশেষ কিছু প্রস্তুতি হয় নাই। কিন্তু অন্যদের তুলনায় আমরা এখন টপে আছি। কাজেই এটাও তো একটা বিরাট ধরনের পাওয়া।
আমাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমছে। আগে প্রতি মাসে সন্তানের সংখ্যা গড়ে ছিল ৬ দশমিক ৩। এখন সেটা এসে দাঁড়িয়েছে ৩ দশমিক ২ বা ৩। অর্ধেক হয়ে গেছে। এটাও একটা বিরাট ব্যাপার। বিশেষ করে মুসলমান দেশে জনসংখ্যার প্রবৃদ্ধির হার বেশি হয়। মুসলমান দেশ হিসেবে তুলনায় নিলে আমাদের দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার তো তুলনামূলকভাবে অনেক কম। এটা আমরা অর্জন করেছি।
যদি শুধু জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার দেখি সেটা ১ দশমিক ৪-এ। ভারতেও তাই। আগে এটা ৩ শতাংশের বেশি ছিল। দক্ষিণ এশিয়ার এটাই হলো সবচাইতে কম। এটাও তো কম বড় অর্জন না।
গার্মেন্টস শিল্প নামে একটা শিল্প হবে এটা কে চিন্তা করেছিল? পাট দিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু। পাট চলে গেলে দেশ শেষ হয়ে যাবে এ রকম অবস্থা ছিল। সেখান থেকে কিভাবে কিভাবে বিরাট গার্মেন্টস শিল্প দাঁড়িয়ে গেছে। চীনের সঙ্গে, ভিয়েতনামের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। একটা বিরাট ইন্ডাস্ট্রিয়াল সেক্টর গড়ে উঠেছে। এটাও তো আমাদের একটা বড় অর্জন।
মোবাইল ফোন। ১০-১২ বছর আগে একটা ফোন করা, ফোন পাওয়ার জন্য কত জনের কাছে ধর্ণা দিতে হয়েছে, কত জনের কাছে হাতে-পায়ে ধরতে হয়েছে, কত মন্ত্রীর কাছে যেতে হয়েছে যে, একটু সুপারিশ করে দেন যদি একটা ফোন পাই। এর পর দু-তিন বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে, তারপর যদি সাংবাদিক হই তাহলে প্রায়োরিটি বেশি, আর ব্যবসায়ী হলে দ্রুত পাবার সম্ভাবনা ছিল । কিন্তু এখন দেশের ১৫০ মিলিয়ন লোকের ভেতরে প্রায় ৫৬-৫৭ মিলিয়ন লোকের হাতে মোবাইল ফোন। দশ বছরের মধ্যে এটা হয়েছে। ফলে মানুষে মানুষে যে দূরত্ব সেটা অনেক কমে গেছে। যে কোনো লোক, যে কোনো সময়, যে কোনো খবর আদান প্রদান করতে পারেন ।
কোথাও দুর্যোগ এলে, দুর্যোগের খবরটা চট করে পৌঁছানো যায়। এ রকম সব মিলিয়েই আমরা যা অর্জন করেছি তা কম নয়। তবে এর চেয়ে অনেক বেশি অর্জন করতে পারতাম। এটাই মাঝে মাঝে দুঃখ লাগে।

সাপ্তাহিক : হতাশার জায়গা কি তাহলে এটা যে, যে পরিমাণ অর্জন আমরা করতে পারতাম তা অর্জিত হয় নাই।
ড. ইউনূস : না, না। যেটা হয়েছে সেটা সম্পর্কে আমরা সচেতন না। আমাদের অর্জনটাকে আমরা দেখি না। আমরা শুধু নেতিবাচক দিকটাই দেখি। মিডিয়া বোধহয় তার একটা বড় কারণ। মিডিয়া সাধারণত নেতিবাচক দিকটাকেই সংবাদ হিসেবে বেশি গুরুত্ব দেয়। মিডিয়ার দৃষ্টিভঙ্গিটাই হয়ত তাই। ভালো কিছু দেখলে গলা উঁচিয়ে বলা হয় না মিডিয়ায়। পজিটিভ খবরটাকে গুরুত্বসহ তুলে ধরা হয় না।
তাৎক্ষণিকভাবে নেগেটিভটা তাদের চোখে পড়ে বেশি। কাজেই এটা বলা হয়।

সাপ্তাহিক : দেশ এগুচ্ছে। যদিও হয়ত উন্নয়নের গতিটা শ্লথ বা ধীর। এই ধীরগতিটাকে যদি আমরা বেগবান করতে চাই তার জন্য করণীয় কি?
ড. ইউনূস : করণীয় হলো, সমাজে এগুলোকে তুলে ধরা। যেমন বিদেশে বাংলাদেশিদের যাওয়া আরো সহজ হতে পারত। বিমানবন্দরে মানুষের হয়রানি কিংবা টাকা-পয়সা নিয়ে যে গোলমালটা করে এটা অনেক কম হতে পারত। বিদেশে যে লোক যায় তাদের পথের বাধাগুলো সরিয়ে দেয়াটা অনেক সহজ করা যেত।

সাপ্তাহিক : তার মানে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ যদি আরো জনকল্যাণমুখী হতো…
ড. ইউনূস : ব্যক্তিগত উদ্যোগেও হতে পারে। সবকিছু যে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই হতে হবে এমন তো কোনো কথা নয়। বিদেশে লোক পাঠানো তো সরকার শুরু করেনি, ব্যক্তিগত উদ্যোগেই হয়েছে। সবকিছু নিজেদের উদ্যোগে হয়েছে।
গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিও সরকার করেনি। নিজেদের উদ্যোগেই হয়েছে।
কাজেই এই উদ্যোগগুলো তো এসেছে মানুষের কাছ থেকে।
মানুষ আজ অনেক সচেতন, অনেক কিছু করতে চায়। সেখানে সরকারি যন্ত্র যদি এটাকে বাধা দেয়– যেটা আমার পুরনো কথা– পথের বাধা সরিয়ে দিন, মানুষকে এগুতে দিন, এই বাধাগুলোই হলো সমস্যা।
যত দ্রুত মানুষ এগুতে চাচ্ছে, সরকারি যন্ত্র, সরকারি নীতি অত দ্রুত তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলে না। পুরনো জিনিস দিয়ে তাকে আটকে রাখে। যত সহজে মানুষ এগিয়ে যেতে পারত, যত সহজে মানুষ কাজ করতে পারত ওটা তারা পারছে না।

সাপ্তাহিক : এই যে ‘পথের বাধা সরিয়ে দিন’ এই কথাগুলো তো আপনি অনেকদিন ধরে বলছেন। আপনার অভিজ্ঞতা কি পথের বাধা কতটুকু সরিয়ে নেয়া হচ্ছে।
ড. ইউনূস : খুব বেশি এগোয়নি। ওটা এখনো সে রকমই মনে হয়। পথের বাধা সরে গেছে বলে মনে হয় না বা কমেছে বলে মনে হয় না। কাজেই সরকার এবং মানুষের মধ্যে এই দূরত্বটা থেকে যাচ্ছে সব সময়। এই দূরত্বটা এখনো ঘোচানো যাচ্ছে না।

সাপ্তাহিক : আপনি বুয়েটের এক সমাবর্তনে এই কথাগুলো বলা শুরু করলেন ‘পথের বাধা সরিয়ে দিন’…
ড. ইউনূস : জী আমি বুয়েটের সমাবর্তনে বলেছিলাম, প্রধানমন্ত্রী এবং আমলা, শিক্ষাবিদ সবার উপস্থিতিতে বলেছিলাম।

সাপ্তাহিক : তারপর তো গত কয়েক বছরে বিশ্বের একটা পরিবর্তন হলো, একটা বড় অর্থনৈতিক মন্দা এলো এবং অনেক ওলট-পালটও হচ্ছে। এর মধ্যে দাঁড়িয়ে আপনি আবার একসময় বলেছিলেন যে, এই সঙ্কটগুলো আমাদের জন্য একটা সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। এ সুযোগ তৈরির চিন্তাটায় কি আপনি এখনো স্থির আছেন?
ড. ইউনূস : এটা সত্যি কথা তো। আমি যেটা বারে বারে বলেছি, পৃথিবীর এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ইজ রং, ইট মাস্ট চেঞ্জ।
পৃথিবীব্যাপী অর্থনৈতিক সঙ্কট যেটা এলো, আমি বললাম যে, এটা একক সঙ্কট তো না। এর সঙ্গে খাদ্য সঙ্কট আছে। ২০০৮ সালে অর্থনৈতিক সঙ্কটের আগে যেগুলো দুনিয়া কাঁপাচ্ছিল তার মধ্যে একটা হলো খাদ্য সঙ্কট। একই বছরে তিনটা সরকারের পতন হয়েছিল কয়েক মাসের ভেতরে ওই একই কারণে। বহু দেশেই রাস্তায় রাস্তায় মানুষ মিছিল করে ঘরবাড়ি পুড়িয়েছে খাদ্যের অভাবে।
যারা খাদ্য রপ্তানিকারক দেশ তারা দরজা বন্ধ করে দিয়েছিল ‘আমরা খাদ্য রপ্তানি করব না’ বলে। যারা সারা জীবন খাদ্য আমদানি করে থাকে যেমন ফিলিপাইন, তাদের দেশে হাহাকার পড়ে গেছে, কারণ তাদের কাছে কেউ খাদ্য বিক্রি করছে না। তাদের মাথায় বাজ পড়ার মতো অবস্থা হয়েছিল। সেই খাদ্য সঙ্কট তো চলে যায়নি এখন, দৃষ্টির আড়ালে আছে। যে কোনো মুহূর্তে আবার আসবে; কারণ এর সমাধান তো হয়নি। কাজেই এটা একটা সঙ্কট।
পরিবেশগত একটা সঙ্কট রয়েছে। যেখানে আমরা ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্নে’ চলে যাচ্ছি শিগগিরই। পরিবেশগতভাবে এমন সঙ্কটে আমরা চলেছি যদি সেখানে পৌঁছে আমরা সিদ্ধান্ত নিই যে, এখন ফিরে যাব, এবার ঠিক করে ফেলব, কিন্তু চাইলেই তখন আর তা ঠিক হবে না। আমরা দ্রুত সেই ‘পয়েন্ট অব নো রিটার্নে’ চলে যাচ্ছি। এই সঙ্কটগুলোকে যে ভঙ্গিতে এ্যাড্রেস করা দরকার আমরা সেই ভঙ্গিতে চিহ্নিত করছি না।
জ্বালানি সঙ্কট। এটাও ২০০৮ সালের সঙ্কট। যেখানে তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে ব্যারেল প্রতি ১৫০ মার্কিন ডলার হলো, সেটাও তো যায়নি। এখন ৭০ ডলারের ওপর নড়াচড়া করে। কিন্তু যে কোনো মুহূর্তে এটা আবার ঊর্ধ্বমুখী হয়ে যেতে পারে।
কাজেই এই যে এতগুলো সঙ্কট, সামগ্রিকভাবে এগুলোকে দেখতে হবে। এগুলো পৃথক পৃথক সঙ্কট না। আমি বলছি যে, সব সঙ্কটের গোড়া এক জায়গায়। যেভাবে আমরা পুরো সমাজকে, পুরো দুনিয়াতে অর্থনৈতিক কাঠামোটা তৈরি করেছি এই কাঠামোর ভেতরে গলদ রয়েছে। এটা নানাভাবে, নানা আঙ্গিকে দৃশ্যমান হচ্ছে। ওটার গলদটা সামাল না দেয়া পর্যন্ত এগুলো সামাল দেয়া যাবে না।
এখন এই সঙ্কটগুলো হওয়াতে আমাদের জন্য এটা একটা সুবর্ণ সুযোগ হয়ে এলো। কারণ যখন সব কিছু ঠিকমতো চলে  তখন মানুষ তাতে হাত দিতে চায় না। গা ভাসিয়ে চলতে থাকে। কিন্তু যখন সঙ্কট আসে তখন ‘কি হয়েছে’, ‘কি হয়েছে’ বলে সবাই সবকিছু খুলে দেখার সুযোগ আসে।  দেখতে হবে কোথায় গোলমাল। যখন যন্ত্র চলে তখন সাধারণত ওটা খুলে দেখা হয় না। যখন গোলমাল হয় তখন ওটা খোলা হয়। এটা টেপে, ওটা টেপে, এটা নাড়ে, ওটা নাড়ে। এটার থেকে ওটা লাগিয়ে দেখে যে, কোনোরকমে আবার চালু করা যায় কিনা?
আমি বললাম যে, এখনই হলো সেই সময়। এখন ঘোমটা খুলে দেখতে হবে যে, এর ভেতরে কি কি আছে? কোনো রকমে জোড়াতালি দিয়ে এটা লাগিয়ে দিলে হবে না। তাহলে চলবে কিছু দিন। কিন্তু ওই বড় গর্তের মধ্যে আবার আমাদের পড়তে হবে। আরো বড় ক্রাইসিসের মধ্যে পড়তে হবে। সেটা ছোটখাটো ক্রাইসিস হবে না। এখন আমরা কি তাহলে সেই বড় ক্রাইসিসের জন্য অপেক্ষা করব। যারা বলছে যে, তাড়াতাড়ি আমরা কোনোরকমে এটার থেকে উদ্ধার পেয়ে যেতে পারলে বাঁচি, আমি বলছি তারা ভুল পথে আছে।
এই সুযোগটা তারা গ্রহণ করতে দিচ্ছে না। এই সুযোগটা গ্রহণ করতে হলে সমস্যার মূলে যেতে হবে। মূলে গিয়ে সেগুলোকে সংস্কার করে আসতে হবে। যেমন আমি কথার কথা বলি, আমাকে প্রশ্ন করল যে ‘কি সংস্কার করবেন?’ আমি বললাম যে, অর্থনৈতিক সঙ্কট যখন চলছে তখন কাঠামোটাকে সংস্কার করেন। এখন এমন এক ব্যাংকিং চলছে, যেখানে একটা দেশের গুটিকয়েক লোক সারা দুনিয়ার মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলে দিতে পারে।

সাপ্তাহিক : আমেরিকার সব বড় ব্যাংকগুলো বসে গেল। সরকারের টাকা দিয়ে আবার তাদের টিকিয়ে রাখতে হলো…
ড. ইউনূস : হ্যাঁ। এটা কি কোনো ব্যাংকিং সিস্টেম হলো? এটাকেই আবার চালু করতে চান আপনি। এটা চালু করলে তো আরেকদিন এর চেয়ে বড়ভাবে আবার হবে। এমনভাবেই যাবে, যে কোনো কিছু দিয়েই আর রক্ষা করা যাবে না। তখন কি করবেন আপনি?
কাজেই এ মুহূর্তে জানা দরকার যে, সঙ্কটটা কি কি কারণে হয়েছিল এবং সেটা যাতে ভবিষ্যতে আর না হতে পারে তার জন্য কী কী করা দরকার।  সকল দেশকে কঠিন শপথ নিতে হবে যে এটা আর করতে দেব না আমরা। মাঝে মধ্যে শুনি যে, না এগুলো সংস্কার-টংস্কার করব। কিন্তু সব কিছু আগের মতোই চলছে। তার মধ্যে আরো বস্তা বস্তা টাকা ঢালো। ভাবখানা এই যেন, ‘চলো, তাড়াতাড়ি চলো।’
এটার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হলো, এটা করলে লোকে আমাকে আর মন্দ বলবে না। আমি তো চালু করে দিয়েছি অর্থনীতি। আবার আনএমপ্লয়মেন্ট রেট কমতে আরম্ভ করেছে। কাজেই চারদিকে বাহবা, বাহবা রব উঠল।
এটা তো হলো অতি সাময়িক ব্যবস্থা। কোনো রকম জোড়াতালি দেয়া। কিন্তু মূল যেটা, তার সমাধান হলো না।  কাজেই আবার বিপর্যয় আসবে।  আবার দুর্যোগ আসলে তো সবকিছুই যাবে।
পত্রপত্রিকায় সব জায়গায় বলা হয়েছিল যে, এ সঙ্কটের বড় কারণ হলো মার্কেটটাকে তারা গ্যাম্বলিং ক্যাসিনো বানিয়ে ফেলেছে। বাজারটাকে জুয়াড়িদের আড্ডাখানা বানিয়েছে। সুপার গ্রিড বা অতি লোভ বিপর্যয় এনেছে। এটা তো প্রত্যেক পত্রিকার সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে। সেই সুপার গ্রিড বা অতি লোভ কি চলে গেছে? গ্যাম্বলিং ক্যাসিনো কি শেষ হয়ে গেছে?
এটা যাতে গ্যাম্বলিং ক্যাসিনো আর কোনো দিন হতে না পারে সেটার পথ কি আমরা খুঁজে পেয়েছি? না। এগুলোকে আটকাতে হবে। এটাকে গ্যাম্বলিং (জুয়া) বানানো যাবে না। ব্যাংকিং মানেই ব্যাংকিং। জুয়া খেলা না।
আগে ব্যাংকিং ছিল যে, আমি আপনাকে টাকা দিলে আপনি টাকা দিয়ে একটা ব্যবসা করছেন। ব্যবসাটা আমি চোখে দেখছি। এখন যেটা হয়েছে, আমি ব্যাংকার, আপনি আমাকে টাকা দিয়েছেন, আপনি আমার কাগজ সই দিয়ে গেছেন, যে এত টাকা এইভাবে শোধ করবেন। আপনি আমাকে টাকাটা শোধ করার আগেই আমি কাগজটা আরেকজনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছি। সে আমাকে টাকা দিয়ে দিচ্ছে। আপনি আমাকে টাকা দেননি কিন্তু সে আমাকে টাকা দিয়ে দিয়েছে এবং আপনার লেন্ডার হলো সে। সে ওটাকে আরেকজনের কাছে বিক্রি করেছে। এই করতে করতে সব কাগজকে একত্র করা হলো।  খুচরা কাগজের দরকার কি, কাগজের এক একটা বান্ডিল বানাও। বানিয়ে বলল যে, এর মধ্যে দামি দামি জিনিস আছে, তুমি কত দিয়ে কিনতে চাও?
এখন আরেকজনের কাছে বিক্রি করলাম। বান্ডিল বিক্রি করলাম। এটাকে আবার সে টুকরা করা আরম্ভ করবে। এই প্যাকেজকে আবার টুকরা করা শুরু করবে। “ড্রাইসিং এ্যান্ড স্লাইসিং” বারবার এই শব্দগুলো দেখবেন। এক টুকরো আপনাকে দিলাম, আরেক টুকরো আরেকজনকে দিলাম।
কেউ জানে না কে কি কিনছে। এর মূল ঋণগ্রহীতা বা ঋণদাতা যারা ছিল, তাদের সঙ্গে আর কোনো সম্পর্ক নেই। মূল ঋণদাতা তার টাকা পেয়ে গেছে। এই কাগজের বান্ডিলের ভেতরে কি কি আছে এই স্পেকুলেশন করতে করতে আসমানের ওপরে সবাই মিলে এক বিরাট কাল্পনিক প্রাসাদ বানিয়ে ফেলেছে। এটার পেছনে সবাই দৌড়াচ্ছে, টাকা আনছে, রাতারাতি বড় লোক হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আসল অর্থনীতির সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই।
এটা কি চলতে থাকবে? এটার কি সমাধান নেই। এমন কি করা হবে না যে, রিয়েল ইকোনমির থেকে এটাকে বেশি দূরে যেতে দেয়া হবে না, যাতে অন্তত চোখে দেখা যায় কোথায় আছি, কে ঋণগ্রহীতা আর কে ঋণদাতা। এগুলো সংস্কার করতে হবে।
বর্তমান ব্যাংকিং সিস্টেম হলো একটা খণ্ডিত সিস্টেম। কিছু লোক এর থেকে সুবিধা পায়। দুই-তৃতীয়াংশ মানুষ দুনিয়াতে এই সুবিধা থেকে বঞ্চিত। অর্থাৎ দুই-তৃতীয়াংশ মানুষের কাছে ব্যাংকিং সিস্টেম পৌঁছে না। তাহলে এটা সংশোধন করতে হবে। আগে বলা হতো যে, এ রকম পারা যায় না। ‘গরিব মানুষ আর নট ক্রেডিট ওরথি’ আগে এই ব্যাখ্যা ব্যবহার করা হতো। কিন্তু আমরা গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে তা মিথ্যা প্রমাণ করলাম। দেখলাম যে গরিবরা বরং বেটার ক্রেডিট ওরথি। যখন বড় লোকেরা টাকা দিচ্ছে না তখনো কিন্তু এই ক্রাইসিসের মধ্যে তাদের টাকা দেয়া বন্ধ হয়নি। দুনিয়ার সব জায়গাতে একই রকমভাবে তারা টাকা পরিশোধ করে দিচ্ছে। ওদের না আছে কোনো ঘরের চাল, না আছে কোনো জমিন। কিছু নেই। কিন্তু সে টাকা পরিশোধ দিচ্ছে। তোমার এত ল-ইয়ার, এত জামানত। কিন্তু তার পরও তো টাকা আদায় করতে পারছ না।
তাহলে তোমার সিস্টেম ভালো, না এই সিস্টেম ভালো?
কাজেই এটার মোকাবিলা হতে হবে এবং ব্যাংকিংকে ইনক্লুসিভ সিস্টেম হতে হবে। যাতে করে কেউ বাদ না পড়ে। তোমরা আগেরটা ধরে বসে থাক, আমরা এটা ছাড়া করব না, এটা তো গায়ের জোরে কথা হলো।
তুমি এই নতুন ব্যাংকিং করবে না কেন? সেই প্রশ্নেরও জবাব দিতে হবে।
ব্যাংকিং শুধু কিছু লোকের জন্য করলে হবে না।
এটা একটা বিষয়। আরো অনেক বিষয়ে সংস্কার করতে হবে। এই পদক্ষেপগুলো নতুনভাবে নিতে হবে। যেহেতু আমরা নতুনভাবে শুরু করছি। এ রকম প্রত্যেকটা জায়গাতে নতুনভাবে সিদ্ধান্ত নেয়ার জায়গা আছে। আমি কনসেপচুয়াল ইস্যুর কথা বলছি, এই কনসেপচুয়াল ইস্যুর মধ্যে আমি সোশ্যাল বিজনেসের কথা বলছি।
বর্তমান অর্থনৈতিক শাস্ত্র বলে যে, ব্যবসা মানেই হলো টাকা রোজগার। পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে একটা কথাই বলা হয়, ব্যবসা করা মানেই ‘ম্যাক্সিমাইজেশন অফ প্রফিট’ অর্থাৎ লাভকে বাড়ানো– এটাই তার মিশন। আমি বললাম যে, এটা কোন ধরনের কথা?  যারা এই থিউরিটা তৈরি করেছে, তারা মানুষকে মনে করেছে এক ধরনের রোবট। যারা জীবনে খালি টাকা বানায়, টাকা বানায়, টাকা বানায়। কিন্তু প্রকৃত মানুষ তো রোবট না। থিউরিটিক্যাল মানুষ আর বাস্তবের মানুষ সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাস্তবের মানুষ মাল্টিডাইমেনশনাল। তার মন আছে। তার হৃদয় আছে। অনেকে অভুক্ত মানুষ দেখলে তাকে খাবার খাইয়ে দিতে এগিয়ে আসে। তোমার থিউরিতে তো তা বলে না।  থিউরিতে বলে শুধু নিজেরটা নিয়ে ব্যস্ত থাক। ওরটা ও করবে তোমারটা তুমি কর। এ থিউরির সঙ্গে তো বাস্তবের মানুষের মেলে না।
তার মানে বর্তমানে যে থিউরিটা দাঁড় করানো হয়েছে তার মূলভিত্তি হচ্ছে স্বার্থপরতা। থিউরিটিশিয়ানরা মনে করেছে, মানুষ মাত্রই স্বার্থপর। এটাই তার একমাত্র ডাইমেনশন। কিন্তু আসল মানুষ তো সে রকম না। আসল মানুষ মাল্টিডাইমেনশনাল। তার মধ্যে যে রকম স্বার্থপরতা আছে তার মধ্যে তেমন স্বার্থহীনতা আছে, পরার্থপরতা আছে। সে একই মানুষ। তার স্বার্থপরতা দেখে তুমি থিউরি বানালে আর তার স্বার্থহীনতার দিকে, পরার্থপরতার দিকে কোনো নজরই দিলে না, এটা কোন ধরনের থিউরি হলো।

সাপ্তাহিক : একটা দেখলাম, সেটাকে জোর দিলাম, আরেকটা দেখলামই না…
ড. ইউনূস : আমি জানতেও পারলাম না, থিউরি আমাকে বুঝতেই দিল না যে, আমার মধ্যে কি আছে?
যত ইনস্টিটিউশনাল আয়োজন হয়েছে সব একটা জিনিসের ওপর ভিত্তি করে হয়েছে যে, মানুষ স্বার্থপর, সে কেবল টাকা রোজগার করে যাবে। এটাই হলো তার জীবনের লক্ষ্য। আর এখন যত সিস্টেম সব এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে, এটাকে সমর্থন দেয়ার জন্য। তাহলে বাকিটা কি হবে?
স্বার্থহীনতার ওপর ভিত্তি করে একটা ব্যবসা হতে পারে না? তুমি তো থিউরিতে বলতে পারতে। মানুষ করে না-করে সেটা পরে দেখা যেত। তুমি তো আর বাধ্য করছ না কাউকে। কিন্তু ওই রাস্তাটা তুমি দেয়াল দিয়ে বন্ধ করে দিবে, যে না, এটা হয় না। তাত্ত্বিকরা বললেন, এটাই আমাদের পুঁজিবাদী অর্থনীতি, আমরা স্বার্থহীনতাকে স্বীকার করতে পারব না। এই অস্বীকারের কারণেই বড় গলদগুলো সৃষ্টি হয়েছে। আমি যদি স্বার্থহীনতাকে কাঠামোর ভেতর নিয়ে আসতাম তবে স্বার্থহীনতার ওপর ভিত্তি করেও একটা ব্যবসা করতাম।
প্রথম ব্যবসা যেটা স্বার্থপরতার ওপর ভিত্তি করে ব্যবসা, সেটা হলো, সবকিছু আমার জন্য, সবকিছুকে আমার কাছে নিয়ে আসতে হবে। যত বুদ্ধি আছে সবকিছু খাটাব আমার দিকে, আমার কাছে নিয়ে আসার জন্য। পরের জন্য কিছুই না। আর স্বার্থহীন ব্যবসাটা যেটা, সেটা হলো সবকিছু পরের জন্য, আমার জন্য কিছুই না। একটা হলো সবকিছু আমার জন্য, পরের জন্য কিছু না, আরেকটা হলো সবকিছু পরের জন্য, আমার জন্য কিছুই না-- আমি কি এ রকম ব্যবসা করতে পারি?
লোকে আমাকে প্রথম প্রথম বলল, এ রকম বেকুব মানুষ আছে নাকি দুনিয়াতে যে পরের জন্য করবে।
আমি বললাম, করে তো। আপনি আমাকে বেকুব মনে করছেন, আমার আপনার চেয়ে অনেক বেকুব আছে। তারা তো টাকা দানই করে দেয় । আমি তো দিয়ে দেয়ার জন্য বলছি না। আমি বলছি টাকা খাটাও, পরের জন্য খাটাও। মানুষ নিজের টাকা অন্য মানুষের হাতে দিয়ে দেয়।
যিনি দান খয়রাত করেন, ব্যক্তিগত ফাউন্ডেশন করেন, তিনি টাকা দিয়ে দেন। এটা তার নিজের টাকা কিন্তু তিনি সেটা দিয়ে দিচ্ছেন।  যখন দুর্যোগ হয় তখন মানুষ টাকা দান করছে না?
একটা জনহিতকর কাজ, হাসপাতাল বানানো, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বানানো, মানুষ করে না এসব? অনেক মানুষ এমন করেছে যে, সে তার ভিটা বাড়ি বেচে হলেও এসব প্রতিষ্ঠান করেছে। হাজী মুহাম্মদ মহসিনের নাম তো আমরা ছোটবেলায় বইতে পড়ে এসেছি। তিনি তার সবকিছু বিলিয়ে দিয়ে গেছেন। এ রকম মানুষ আছে তো। আপনি নেই বলছেন কেন? এটাকে স্বীকৃতি দেবেন না?
আমি বললাম, দিয়ে দেয়ার রাস্তাটা হলো একমুখী। কিন্তু সামাজিক ব্যবসায় টাকাটা ফেরৎ আসবে। সামাজিক ব্যবসা, অর্থাৎ আমার জন্য ব্যবসা না, সমাজের জন্য ব্যবসা। মানুষের মঙ্গলের জন্য ব্যবসা। কিন্তু টাকাটা ফেরত আসতে হবে। সে জন্য এটাকে আমি ব্যবসা বলছি। তাহলে আমিও সামাজিক ব্যবসা হিসেবে স্বাস্থ্য কর্মসূচী করতে পারি। একজনে ত্রাণ হিসেবে করল, আরেকজন করল সামাজিক ব্যবসা হিসেবে। সে এটার থেকে এমন কোনো কায়দা করল যাতে টাকাটা আদায় হয়ে আসে। তাহলে যে টাকাটা আমি দিলাম তা চক্রাকারে ঘুরতে থাকবে। এ হাসপাতাল কোনো দিন বন্ধ হবে না। চ্যারিটি হাসপাতাল বন্ধ হয়ে যাবার সম্ভাবনা আছে যদি টাকাটা শেষ হয়ে যায়। যদি আর নতুন টাকা কেউ না দেয়, তবে সেটা বন্ধ হয়ে যাবে। আর সামাজিক ব্যবসা হিসেবে হাসপাতাল যেটা বানালাম সেটা বরাবরই চলবে। কিন্তু যে মালিক, যে টাকাটা বিনিয়োগ করবে সে এখান থেকে একটা পয়সাও মুনাফা নেবে না। কারণ সে বানিয়েছেই মানুষের মঙ্গলের জন্য।

সাপ্তাহিক : আমি একশ টাকা দিলাম। দিয়ে একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বানালাম। বানিয়ে বললাম যে, এটা ব্যবসা হচ্ছে, এই একশ টাকা কি আমি নেব?
ড. ইউনূস : এই একশ টাকা আমি নেব। ওটা চলে আসবে। তখন ওটাকে আমি আবার একটা সামাজিক ব্যবসায় খাটাব। আবার একটা সামাজিক ব্যবসা দাঁড়াবে। তখন একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করেছিলাম, ওটার থেকে টাকা ফেরত নিয়ে আমি আরেকটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান করলাম। এটাও হতে পারে অথবা ওই টাকা নিয়ে আমি অন্য ব্যবসা করলাম। যেমন আমি একটা নার্সিং কলেজ করলাম সামাজিক ব্যবসা হিসেবে। এর ফলে আমার সমাজের মেয়েরা নার্স হবে, তারা চাকরি পাবে কিন্তু এখান থেকে আমার ব্যবসার টাকাটা উঠে আসবে।
অসুবিধা কী আছে?
সেটা উঠে এলে আমি উৎসাহ পাব যে, আরো বানালে আরো হবে। আমি আরো নার্সিং কলেজ বানাতে পারব। এটাই হলো সামাজিক ব্যবসা। অর্থাৎ আমি এর থেকে এক পয়সাও নেব না। আমার মূল টাকা একদিনে হোক, দশদিনে হোক উঠে আসবে। মূল টাকা যেদিন পেয়ে গেলাম সেদিন থেকে আমার টাকা নেয়া বন্ধ। নতুন বিনিয়োগ শুরু হলো। আর ওই প্রতিষ্ঠানে যা লাভ শুরু হলো তা ওই প্রতিষ্ঠানের কল্যাণেই ব্যয় হতে থাকল।
সামাজিক ব্যবসাতে মুনাফা হয় কিন্তু ওই মুনাফা মালিক নেয় না। মুনাফাটা তার মধ্যেই থেকে যায়, রিসাইকেল করে বড় হয়, মুনাফা বড় হয়, প্রতিষ্ঠান বড় হয়। এটাই হলো সামাজিক ব্যবসা। আমি কাঠামোর কথা বলছিলাম। এটা যদি একবার যোগ করে দিতে পারি ওই কাঠামোর মধ্যে তাহলে পুরো অর্থনৈতিক সিস্টেমটা বদলে যায়।
তাহলে আজকে যেটাকে পরিবেশগত সমস্যা বলছি, যেটাকে কেউ নজর দিচ্ছে না, কারণ আমি তো টাকা বানানোতে ব্যস্ত। এই টাকা বানাতে গিয়ে কার পরিবেশ কিভাবে নষ্ট করছি এটা আমি পরোয়াই করি না। আমার তো শুধু টাকা বানানোর কথা। আমি বিদ্যুৎ বানিয়ে টাকা তৈরি করব। বিদ্যুৎকে কয়লা পুড়িয়ে করলাম বা কি পুড়িয়ে করলাম তাতে আমার কিছু আসে যায় না। আমার তো টাকা বানানোর কথা, আমার তো এসব ভাবার কথা ছিল না। এগুলোকে আমি পরোয়া করি না। যার যত অনিষ্টই হোক আমি আমার টাকা বানাবো। এই হচ্ছে অবস্থা।
যদি সোশ্যাল বিজনেস থাকত তবে আরেকজন বলত, তুমি তো দুনিয়া ধ্বংস করে দিলে, এই যে কার্বন এমিশন হলো তাকে রিডিউস করার ব্যবস্থা করা যেত। রিনিউএ্যাবল এনার্জি করা যেত। সে এখান থেকে সোলার এনার্জি বা বায়োগ্যাস ইত্যাদি করে দিয়ে এটার পরিমাণ কমায়। কাজেই সে একটা পথ পায়। কিন্তু এখন পথ পাচ্ছে না। এখন কেবল চিল্লাচিল্লি করছে ‘তুমি কমাও’, ‘তুমি কমাও’। কিন্তু কেউ কমাচ্ছে না। কাজেই এই হলো ঘটনাটা।
যেমন ডোনাররা আমাদেরকে পয়সা দেয়, বিভিন্ন দেশে সাহায্য করে। আমার কথা হচ্ছে পুরো সাহায্যটা এভাবে না দিয়ে তার ১০ শতাংশও যদি সামাজিক বাণিজ্যের জন্য রেখে দিত তবে অনেক কিছু গড়ে উঠত। এই টাকা দিয়ে হাসপাতাল হোক, স্কুল হোক, রাস্তা হোক সামাজিক ব্যবসা হিসেবে ওই টাকা আবার ফেরত আসবে। এখানে জমা হবে। তাহলে এটাও চলত আবার জিনিসটার একটা স্বচ্ছতা আসত যে, হ্যাঁ সত্যি সত্যি কাজ হচ্ছে, আমি দেখতে পাচ্ছি। কারণ, ব্যবসার মধ্যে স্বচ্ছতা থাকতে হবে। গ্যারান্টি থাকতে হয়, কারণ টাকাটা ফেরত আসতে হবে।

সাপ্তাহিক : এই যে, সামাজিক ব্যবসার কথা বলছেন, শুনতে খুবই আকর্ষণীয়, খুবই ভালো উদ্যোগ বলে মনে হয় কিন্তু এর পাশাপাশি কি এই প্রশ্ন আসে যে, সব কিছুই যখন সামাজিক ব্যবসার আওতায় চলে আসে সেক্ষেত্রে অল্প পরিমাণ টাকাও যার সামর্থ্য নেই সে এর সুবিধাটা পাবে কিভাবে?
ড. ইউনূস : মুনাফামুখী ব্যবসা আছে।  আমি বলছি না যে, এই ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হবে। আমি বলছি যে, দুই ব্যবসাই চলুক। আমি সেলফিসনেসের পাশাপাশি সেলফলেসনেসটাকে (Selflessness) চালুর কথা বলছি। এটাকে তো এখন অস্বীকার করা হচ্ছে। আমি বলছি, এটার মুক্তি দাও। সে আসুক ব্যবসা করুক। কাজেই আমি এক ব্যবসার জায়গায় দুই ব্যবসার জগতের কথা বলছি।
লোকে বলে, যদি না করে? আমি বলি, যদি না করে তবে বুঝব যে, মানুষের মধ্যে সেই স্বার্থহীনতা নেই। আমি ভুল বুঝেছি। আর যদি থাকে তবে সেটাকে প্রকাশ করার একটা সুযোগ দিলাম। অসুবিধাটা কি? আমি তো কারো কাছ থেকে জোর খাটিয়ে কিছু নিয়ে আসতে চাইছি না। আমি তো বলছি না যে, ওর থেকে এটা নিয়ে দাও, এর থেকে এটা নিয়ে দাও। আমি বলছি যে, মানুষকে ব্যবসা করার সুযোগ দাও। এটার স্বীকৃতি দাও। এটার ধারণাটার স্বীকৃতি দাও। ধারণাটির স্বীকৃতি দিলে তখন ছেলেমেয়েরা স্কুল-কলেজে লেখাপড়া করার সময় জানবে যে, ব্যবসা দু’রকমের। একটি নিজের মুনাফার জন্য, আরেকটি মানুষের মঙ্গলের জন্য। সে ঠিক করবে আমি কোনটা করব? কিন্তু এখন তো সে রকম নেই। এখন আমার ছেলেমেয়েদের বলছি যে, ভালো করে লেখাপড়া কর, তাহলে ভালো একটা চাকরি পাবে। চাকরি মানে কি?
ব্যবসাতে চাকরি করতে হবে। ব্যবসাতে চাকরি করা মানে কি? মালিকের জন্য সারাদিন পরিশ্রম করো, যাতে করে তার মুনাফা হয়। এটাই তো চাকরি। কাজেই আমার তো দ্বিতীয় চিন্তা করার আর কোনো উপায় নেই। আমার সিস্টেমেই নেই। কাজেই আমাকে তৈরি হতে হচ্ছে এই কাজের জন্য। আরেকজনের এমন সেবা করার জন্য যাতে করে তার মুনাফাটা বেশি হয়।
আরেকটা হলো সরকারের চাকরি। সরকারের চাকরি তো সীমিত। কোটি কোটি মানুষ তো আর সরকারের চাকরি করতে পারে না।
চাকরি মানেই হলো যে, আরেকজনের জন্য খাটতে হবে, যেখানে তার লাভ হবে সেখানে আমি তার সেবা করব। আমার এমপ্লয়মেন্ট জেনারেট হবে। আমি বললাম, আরেক রকমের ব্যবসা সৃষ্টি করা যায় যেখানে আমি কাজ করব মানুষের মঙ্গলের জন্য। স্কুলে লেখাপড়া হচ্ছে। এটা আমাদের সামাজিক ব্যবসা। আমি রিনিউএ্যাবল এনার্জি করছি, এটা আমাদের সামাজিক ব্যবসা। আমি যেখানে কাজ করি সেটা দেশের মঙ্গলের জন্য, পৃথিবীর মঙ্গলের জন্য। আমি এ কাজ করে খুব আনন্দ পাই। আমি ওখানে এ্যাকাউনটেন্ট হিসেবে যে বেতন পাই, এখানেও একই বেতন পাই, মাঝখান থেকে আমি মানুষের, দেশের ও পৃথিবীর মঙ্গলের জন্য কাজ করছি।
আমি দুটো ব্যবসার কথাই বলছি।
আমি একটা বন্ধ করে দিয়ে আরেকটা করার কথা বলছি না এবং সবাইকে এখনি সামাজিক ব্যবসায় নেমে পড়তে হবে সেটাও বলছি না। যদি আনন্দ পাই তবে করব।
কারা করবে এটা? যারা অবসর নিয়ে নিয়েছে তারা করতে পারে।  তারা বলতে পারে, আর টাকা কত আয় করব? আমি তো এই সামাজিক ব্যবসার কথা আগে শুনিনি। আমি তো অনেক টাকা করেছি সেটা দিয়ে গ্রামের মঙ্গলের জন্য কৃষি নিয়ে সামাজিক ব্যবসা করব। আমি আর নিজের জন্য টাকা করতে চাই না।
যেমন গ্রামীণ ফাইবার গ্লাস কোম্পানি। যিনি এটা করছেন শহীদ আহমদ বাহরাইনে বিরাট ফাইবার গ্লাসের ফ্যাক্টরি চালায়। গোটা মধ্যপ্রাচ্যে তার ব্যবসা। আমি যখন তাকে বললাম আমাদের সঙ্গে সামাজিক ব্যবসা করুন, তিনি বললেন, এটা কি ধরনের ব্যবসা? আমি তাকে ব্যাখ্যা করলাম, যে, এ রকম ব্যাপার। উনি বললেন, হ্যাঁ আমি করব।
উনি যখন কাজটা শুরু করলেন, তখন তাকে একজন জিজ্ঞেস করলেন, এটা আপনি কেন করছেন? তখন উনি বললেন, দেখো আল্লাহ্ আমাকে অনেক  দিয়েছে, আমি তো কারো জন্য কিছু করিনি কোনো দিন। তো ড. ইউনূস বলছেন, এটা ভালো কাজ। আমারও মনে হয়েছে এটা ভালো হবে দেশের জন্য। আমি দেশের জন্য তেমন কিছু করার সুযোগ পাইনি কোনো দিন, কাজেই এটা আমার কাছে খুব ভালো লাগছে। আমি সে জন্য এটা করতে চাই।
এ ধরনের ব্যবসা করে কারো মনে যদি আনন্দ লাগে, সে যদি করে তবে অসুবিধা কি?

সাপ্তাহিক : তাত্ত্বিক এবং দার্শনিক জায়গা থেকে আপনি যে কথাটা বললেন এটা তো নতুন একটা জিনিস, প্রচলিত ধারণার বাইরের একটা বিষয় এবং আমরা যে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি তার জন্য এটা একটা চ্যালেঞ্জও। আপনি কি সেভাবে দেখছেন?
ড. ইউনূস : যে কোনো নতুন জিনিস আসলে লোকে হাসবে, ঠাট্টা করবে, বেকুব বলবে এটাই স্বাভাবিক। এটা অস্বীকার করার কিছু নেই। দ্বিতীয়ত বলবে যে, এটা অবাস্তব, এটা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। দু’-একজন বলবে যে, করে দেখান না দু’-একটা কেমন হয় দেখা যাক। দু’-একজন হয়ত বলবে, হ্যাঁ, এ রকম দু’-একটা হবে।  তারপর থেমে যাবে।
আমি বলি, তাতেই বা মন্দ কি দু’-একটাও যদি হয়। আমি তো বলছি না সারা দুনিয়া আজকে আমার কথা শুনে আমার পিছে পিছে আসতে হবে। যার পছন্দ হবে সে করবে। আজকে এ করবে, কালকে ও করবে। এর দেখাদেখি ও করবে। এভাবেই তো হবে। যদি জিনিসটা মানুষের মনে ধরে।
কার মনে ধরবে?
যুব সমাজের মনে ধরবে। প্রতি যুবক, প্রতি তরুণ, প্রতি কিশোর মনে করে যে, আমি দেশের জন্য, মানুষের জন্য কিছু করব। এটা তার স্বাভাবিক ইচ্ছা। আগের জামানায় যেটা হতো, সে বামপন্থী রাজনীতি করত।  সমাজ পরিবর্তন করতে হবে। এটা তারুণ্যের স্বাভাবিক অভিব্যক্তি।

সাপ্তাহিক : আপনি বলছেন যে, বামপন্থী হওয়া মানে ভালো কিছু একটা সে করতে চায়?
ড. ইউনূস : হ্যাঁ। সেই করতে চাওয়ার মধ্যে যদি দেখা যায় অনেক অপশন আছে তার মধ্যে এটা একটা অপশন। তরুণরা যখন আমার সঙ্গে কথা বলে তখন তাদেরকে আমি বলি যে, তুমি দুনিয়াতে যা যা সমস্যা দেখ সেগুলোর একটা তালিকা কর। দারিদ্র্য একটা সমস্যা, স্বাস্থ্যহীনতা একটা সমস্যা, শিশুমৃত্যু একটা সমস্যা, জলবায়ু পরিবর্তন একটা সমস্যা। এ রকম একটা তালিকা তৈরি কর। তোমার চোখে যা পড়ে। এবার তালিকাটার দিকে তাকাও। তোমার কাছে একটা জিনিস এখানে মনে হয় কি না, যে এমনভাবে একটা ব্যবসা তৈরি করতে পার যেটা এই সমস্যাগুলোর কোনো একটার সমাধান হবে। যদি করতে পার এবং সেটা যদি কাজে লাগাতে পার তাহলে কিন্তু বিরাট কাজ করে ফেলবে।
সামাজিক ব্যবসার অর্থই হলো যে, কোনো একটা সমস্যার সমাধান ব্যবসায়িক ভিত্তিতে করতে হবে। কাজেই একটা সমস্যার সমাধান যদি ব্যবসার ভিত্তিতে করে দিতে পারি যেটা আমি লাভের জন্য করিনি, ওই সমস্যা সমাধানের জন্য করেছি। আমি যদি ছোট আকারেও করি এবং এটা যখন একবার আবিষ্কার হয়ে গেল কিভাবে করতে হবে, তখন বাকি কাজ হলো রিপিট করা। তাহলেই সমস্যা থাকে না। এটা রিনিউএ্যাবল এনার্জি হতে পারে, অন্য যে কোনো বিষয়ে হতে পারে। যে কোনো জিনিস।
তুমি ১০ জনের জন্য কর। তুমি ১০ জনকে যদি সমস্যা থেকে উদ্ধার করে আনতে পার তাহলেই একটা সমাধান পেয়ে গেলাম।
এ কাজটা তো করা যায়।
ব্যবসায়িক ভিত্তিতে করার সুবিধাটা হলো যে আমার টাকা আমার কাছে ফেরত আসল, ফেরত আসলে আমি আবার বিনিয়োগ করলাম। এটা দেখে যদি আরো কেউ বলে যে, হ্যাঁ আমার টাকাও নাও, আমিও দেব। তার টাকাও নিলাম। যে কারণে আমি সোশ্যাল স্টক মার্কেটের কথা বলি। আমি তো আর পুরো ব্যবসা করতে পারছি না। ‘তুমি এটা করছ’ আমার ১০০ টাকা তুমি নাও। তখন আমি উৎসাহ পেলাম। তার কাছে একটা শেয়ার বিক্রি করলাম। আবার কোনো দিন যদি টাকার দরকার হয় শেয়ার মার্কেটে গিয়ে শেয়ার বিক্রি করে তার টাকাটা সে নিয়ে গেল। এটাই হলো সুবিধা।
আমি এগুলোর কথা বলছি। এটা একটা সুযোগ। যাতে মানুষের মনে নতুন করে একটা চিন্তা আসে। চিন্তা আসলে তখন সমাধানের কথা আসবে।
আরেকটা কথা আমি বারেবারে বলি, আমাদের দুনিয়াতে যে প্রযুক্তি ক্রমে ক্রমে আসছে তার সম্ভাবনা সীমাহীন। শক্তি সীমাহীন। যেমন মোবাইল ফোনের কথা বলি, গত বিশ বছরে যে সব প্রযুক্তি আমাদের কাছে এসেছে গত ৫শ বছরেও তো তা আসেনি।

সাপ্তাহিক : মোবাইল ফোনের কথা তো সম্ভবত আপনি ১৯৯৫ সালে শাহাদত চৌধুরীর সাপ্তাহিক বিচিত্রা’র সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন?
ড. ইউনূস : তখন লোকজন হাসাহাসি করল যে, এটা কি বলে।

সাপ্তাহিক : আপনি বলেছিলেন যে, ৩৫ হাজার ফোন ৩৫ হাজার গ্রামে দিয়ে দেয়া যায়, তখন অনেকেই হাসাহাসি করেছি। আর তখন একটা ফোন মানে যেটা বললেন যে, মন্ত্রীর কাছে যাওয়া।
ড. ইউনূস : হ্যাঁ, একটা ফোন পাওয়ার জন্য মন্ত্রীর কাছে যাওয়া। সেই অবস্থাতে বললাম যে গ্রামে ফোন দিতে হবে। তখন বলা হলো যে, গ্রামে ফোন দিয়ে কি হবে? বলল, শহরে বড়লোকেরা পাচ্ছে না ফোন অথচ আপনি গ্রামে দিতে চান। কেন? তার মধ্যে আমি আরো বলেছি যে, গ্রামের গরিব মহিলাদের দেব। আরো খারাপ কথা। আপনি তো ঠাট্টা-মশকরা করছেন! এগুলো তো ব্যবসার কথা বলছেন না। আমার কথা গ্রাহ্যই করলেন না।
ফ্যাক্স মেশিনের কথাই ধরুন। আগে ফ্যাক্স মেশিন কেনার জন্য সরকারের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হতো। সরকার বলত, না এতে আমাদের গোপন তথ্য পাচার হয়ে যাবে। নিরাপত্তা বিঘিœত হবে। কাজেই এটাতে সরকারের অনুমতি নিতে হতো, রেজিস্ট্রেশন করতে হতো।
কম্পিউটার কেনার জন্য আমার মনে আছে, কি ধরনের কম্পিউটার কেনা হবে তার বর্ণনা দিয়ে সরকারের কাছে আবেদন করে বসে থাকতে হতো অনুমতি নিতে।
আজকে কোথায় গেল সেসব? আজকে সেই কম্পিউটার, তার থেকে ল্যাপটপ, তার থেকে ব্ল্যাকবেরি, আইফোন, তার থেকে আইপ্যাড এসব এসেছে, কালকে কি আসবে কে জানে?
চিন্তা করুন, গত পঁচিশ বছরে প্রযুক্তি ক্ষেত্রে কী পরিবর্তন হয়েছে। সামনের পঁচিশ বছরে কী পরিবর্তন হবে? অভাবনীয় পরিবর্তন হবে।
সবক্ষেত্রেই প্রযুক্তির পরিবর্তন সাধিত হচ্ছে। এই প্রযুক্তিটা সারা দুনিয়া পাল্টে দেবে। কিন্তু প্রযুক্তি কার হাতে?
ব্যবসায়ীর হাতে।
ব্যবসায়ী সেটাকে কি কাজে ব্যবহার করে? মুনাফা অর্জনের কাজে।
সে তো অনুতাপ বোধ করে না। বলে, আমার তো কাজই এটা। আমাকে বলা হয়েছে এটা করার জন্য। একজনকে যখন আমি সিইও বানিয়ে দিলাম একটা কোম্পানির, সে রাতদিন চেষ্টা করে তার মুনাফা কিভাবে বাড়ে, তার স্টক মার্কেটে তার শেয়ারের দাম কিভাবে বাড়ে, তার রেভিনিউ কিভাবে বাড়ে এই চিন্তা ছাড়া আর কোনো চিন্তা তার নেই। যেহেতু এটাই তার সর্বক্ষণিক কাজ।
আমি বলি, প্রযুক্তিটা একটা গাড়ির মতো। গাড়ি নিজে স্থির করে না সে কোথায় যাবে? গাড়ি নিজের ইচ্ছায় যেখানে ইচ্ছা সেখানে যেতে পারে না। তাকে কোথায় যেতে হবে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তার চালক। আর তার ক্ষেত্রে একমাত্র ড্রাইভার হলো ব্যবসায়ী। সে কোথায় নিয়ে যায় তাকে? মুনাফার শিখরে নিয়ে যায়। এখন চালকের একমাত্র দৃষ্টি হচ্ছে মুনাফা যেদিকে। আমি বললাম যে, ওই ড্রাইভারটা যদি আমি পরিবর্তন করে দিই, একজন সামাজিক ব্যবসায়ী যদি এই ড্রাইভিং সিটে বসে তবে সে কোথায় নিয়ে যাবে গাড়িটাকে? সমস্যার পর সমস্যা সমাধান করার কাজে নিয়ে যাবে গাড়িটাকে। কারণ, তার তো মুনাফার কোন চিন্তা নেই। সে হলো সমস্যা সমাধানকারী। বর্তমান সিস্টেমে কেউ তো এই সুযোগটা পাচ্ছে না।

সাপ্তাহিক : কিন্তু সেও তো তার মুনাফা করবেই?
ড. ইউনূস : না। এটা তো সামাজিক ব্যবসা। এর তো কোনো ব্যক্তিগত মুনাফা নেই। মুনাফা কোম্পানি করবে কিন্তু ব্যক্তির কাছে সেটা যাবে না। সামাজিক ব্যবসার মূল কাজটা হলো সামাজিক সমস্যার সমাধান করা। সামাজিক ব্যবসায় এখন গাড়ির মোড় ফিরিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় না গিয়ে এখন গ্রামের দিকে যাবে। এখানেই আমার সমস্যার সমাধান করতে হবে। এটা ব্যবসায়িক ভিত্তিতে করতে হবে সৃজনশীলতা ব্যবহারের মাধ্যমে।

সাপ্তাহিক : কিন্তু গাড়ি তো সাধারণত ভালো রাস্তা দিয়েই চলতে চায়?
ড. ইউনূস : না। এটা রাস্তা ভালো খারাপের বিষয় নয়। এটা হলো যে, চালক ওই রাস্তায় যেতে চায় যেখানে মুনাফা বেশি। রাস্তাটা বিষয় নয়, গন্তব্যটা বিষয়।
বাস্তব বিষয় হলো দুটো।
একটা হলো মুনাফা আরেকটা হলো সামাজিক সমস্যার সমাধান। লোকে বলে যে, সামাজিক ব্যবসায় মজা নেই, মুনাফায় বেশি মজা, বেশি মুনাফায় বেশি মজা।
আমি বলি যে তুমি বোঝ নাই। মানুষের কল্যাণে যে কি আনন্দ এটা না করা পর্যন্ত তুমি বুঝতে পারবে না। একবার যে করেছে তার মজাটা পেয়ে যাবে। দেখবে যে সে টাকা পয়সা ভুলে গেছে। যখন মানুষ এসে তারে জড়িয়ে ধরে বলে, ভাই, কি যে কাজ করলেন আপনি আমার জন্য।
মানুষের জীবনের সার্থকতাই হলো আনন্দ পাওয়া। আনন্দই যদি পেতে চান, দুটি রাস্তা আছে ওই আনন্দ পাওয়ার জন্য। আপনি যদি মনে করেন যে, আনন্দের রাস্তা একটাই, টাকা বানানোতেই আনন্দ তাহলে ভুল করছেন।
আপনি এখনো অন্য আনন্দ উপভোগ করার সুযোগ পান নাই। আপনার থিউরি আপনাকে সে সুযোগ দেয় নাই।
সবাইকে একদিকেই যেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। আমি সামাজিক ব্যবসাই করি, আর কিছু করি না, এমনও হতে পারে। আমি দুটোই করতে পারি। এইখানে আমি ব্যবসায় মুনাফা করে টাকা করি। আবার ওই টাকা নিয়ে সামাজিক ব্যবসা করি। আমার দুটোই মজা লাগে– এমনও হতে পারে।

সাপ্তাহিক : আপনি যে সামাজিক ব্যবসার কথা বলছেন সেটা আমাদের দেশে এখনো ওইভাবে পরিচিতি পায়নি।
ড. ইউনূস : না। এ কথাগুলো তো মাত্র এলো।

সাপ্তাহিক : আপনি যখন এ কথাগুলো বলছেন বিশেষ করে দেশের বাইরে, তখন অনেক বড় বড় ব্যবসায়ীরা, অনেক বড় বড় লোকজন আপনার কথা শুনছে, ওখানে প্রতিক্রিয়াটা কি? কোনো সমালোচনা আসছে কি না?
ড. ইউনূস : খুবই ইতিবাচক। ভালো। ধারণাটা সবাইকে আকর্ষণ করছে।  বিশেষ করে তরুণদের। আমার Building Social Business বইটা পড়লে অনেক কথা জানা যাবে।

সাপ্তাহিক : সমালোচনা হচ্ছে কি না?
ড. ইউনূস : সমালোচনার দিক হচ্ছে সামাজিক ব্যবসায় টাকা আসবে কোথা থেকে। তারা বলছে, তুমি তো বলছ সামাজিক ব্যবসার কথা কিন্তু এ সামাজিক ব্যবসার জন্য পুঁজি দেবে কে? ব্যবসায়ী যেখানে টাকা উপার্জন করতে পারে সেখানে টাকা দেয় যাতে সে তার টাকা দ্বিগুণ করতে পারে। কাজেই তার একটা উৎসাহ আছে সেখানে টাকা দেয়ার। কিন্তু তোমার সামাজিক ব্যবসায় তো কোনো মুনাফা নেই তাহলে পুঁজিটা দেবে কে?
তখন আমি বললাম, প্রকৃত পরিস্থিতি খুবই আশাপ্রদ। সামাজিক ব্যবসা নিয়ে যত না লোক এগিয়ে এসেছে তার চাইতে বেশি লোক “সামাজিক ব্যবসা” তহবিল নিয়ে এগিয়ে এসেছে। এখন এত টাকা এতে আছে তা ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোক্তা এখনো পাওয়া যাচ্ছে না।  সামাজিক ব্যবসা সফল হলে পুঁজির অভাব হবে বলে মনে হয় না।  এটা যেহেতু ব্যবসা– এতে ঋণও পাওয়া যাবে।  বছরে ৬০ বিলিয়ন ডলার যে বৈদেশিক সাহায্য দেয়া হয় তার ১০ শতাংশ বিনিয়োগ হিসেবে আসলেই ৬ বিলিয়ন ডলার হবে।  তাছাড়া ফাউন্ডেশনের টাকা তো আছে।  ব্যক্তিগত সম্পদ নিয়েই বহু লোক এগিয়ে আসবে।
দ্বিতীয়ত হলো আমেরিকাতে ওয়েলফেয়ার সিস্টেম, ইউরোপেও তাই। কারো চাকরি-বাকরি না থাকলে সরকারের পক্ষ থেকে তাকে ভাতা দেয়া হয়। প্রতি মাসে তার নামে একটা চেক যায়। সেটা দিয়ে তার খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি চলে। সরকারের বাজেট থেকে এটা সব সময় দিয়ে আসতে হয়।
আমি যদি এখানে একটা সামাজিক ব্যবসা করি, দশটা এ রকম ওয়েলফেয়ার ফ্যামিলিকে আমি ওয়েলফেয়ার থেকে বের করে আনব। এটা হলো আমার সামাজিক ব্যবসা। আমি এমন একটা ব্যবসা সৃষ্টি করব ওই ব্যবসার মধ্যেই তাদের কর্মসংস্থান হবে, ভরণপোষণও হবে। এটা আমার সামাজিক ব্যবসা আমি নিজে লাভ করার জন্য করি নাই। আমি শুধু দশটা ফ্যামিলিকে ওই ওয়েলফেয়ার ভাতার আওতা থেকে বের করে আনার জন্য করছি।
আমি সরকারকে বললাম, তুমি যদি আমার এখানে বিনিয়োগ কর, আমি তোমার টাকা আবার ফেরত দেব। এদিকে আমি আরো ১০টা পরিবারকে ভাতার আওতা থেকে বের করে আনব। কাজ দেব এবং সমাজের উন্নয়নে তারা ভূমিকা পালন করবে। সরকার বলবে ভালো তো মন্দ কি। ওই ভাতার টাকা তো আমি এমনিই দেই।

সাপ্তাহিক : লোডটা কমে গেল…
ড. ইউনূস : শুধু কমা নয়, চিরস্থায়ীভাবে কমে গেল। আমি দেশের প্রতি একটা বড় কাজ করলাম। যে মানুষগুলো একেবারে অকর্মণ্য করে বসিয়ে রেখেছিলাম তারা কাজ পেল। যুক্তরাজ্যের গ্লাসগো শহরের এই সমস্যা। সেখানে আমাকে বলা হলো, তাদের শহরে কয়েক হাজার পরিবার আছে যারা চার প্রজন্ম ধরে কোনোদিন চাকরির মুখ দেখেনি। আমি তো শোনার পর অবাক হয়ে গেলাম, তোমাদের দেশে এ রকম পরিস্থিতি? তারা বলল, এটা তো সাধারণ জিনিস আমাদের এখানে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, চার প্রজন্ম ধরে তাদের কাজ হয়নি, তাদের চাকরি হয়নি, জীবিকার ব্যবস্থা হয়নি? তারা বলল, দরকার কি, সরকার থেকে টাকা পেয়েছে কাজেই চিন্তাভাবনার কিছু নেই।
শিপ বিল্ডিং যখন বন্ধ হলো গ্লাসগোতে, তখন এই বেকারত্ব সৃষ্টি হলো। তারপর বেকারদের আস্তে আস্তে এই ইন্ডাস্ট্রি, সেই ইন্ডাস্ট্রি, কিছু লোকের কর্মসংস্থান হলো। বহুসংখ্যক রয়ে গেল বেকার। ওই যে সরকার ভাতা দেয়া শুরু করল সেটা এখন চতুর্থ প্রজন্মে এসে পড়েছে। এটার কোনো প্রতিকার নেই।
আমি বললাম, তোমরা কি চেষ্টাও করে দেখনি? তারা বলল, আমরা চেষ্টা করেছি। চেষ্টা করে তাদের জন্য বিশেষত তরুণদের জন্য আমরা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছি। বলে দিয়েছি, এবার তোমরা চাকরি খোঁজ কর। ৬ মাস-৯ মাস পরে খোঁজ নিয়ে দেখি, একটাও চাকরি করেনি। কি ব্যাপার? বলে যে, আমাদের কেউ চাকরি দেয় না। আবার আসলো তারা। আবার প্রশিক্ষণ দিয়ে আমরা নিজেরাই খুঁজে খুঁজে তাদের চাকরির ব্যবস্থা করলাম। কিছু দিন পর খবর নিয়ে দেখি যে, একটাও চাকরি করে না। কি ব্যাপার? দূর! এগুলো আমাদের ভালো লাগে না।
আমি তখন বললাম, বুঝতে পারছ যে, তোমরা কি করেছ? তারা বলল, না বুঝতে পারছি না। আমি বললাম, মানুষগুলোকে শেষ করে দিয়েছ তোমরা। মানুষের যে স্পৃহা সেটা নষ্ট করে দিয়েছ। একটা পাখিকে সারাজীবন খাঁচায় বন্দি করে রেখে দরজা খুলে দিলে সে একটু ঘুরেফিরে আবার ওই খাঁচাতেই ফিরে আসবে। কারণ সে জানে না যে, কোথায় যেতে হবে। তার ওড়ার কোনো অভ্যাসই নেই। সেই রকম এদেরও কাজ করার অভ্যাস চলে গেছে। তোমরা এদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছ। তোমার দেশে আমি যদি হতাম, তবে আমি সরকারের বিরুদ্ধে কেস করে দিতাম যে, তুমি আমাদেরকে ধ্বংস করে দিয়েছ। আমার সমস্ত স্পৃহা নষ্ট করে দিয়েছে এবং সরকারকে স্বীকার করতে বাধ্য হতে হতো যে, ইয়েস উই আর রেসপনসিবল ফর দ্যাট।
এ রকম অনেক কথা বলার পর বললাম যে, এই সমস্যার সমাধান করা যায়।  নানারকম পন্থা আছে। ব্যাখ্যা করলাম কি কি হতে পারে। তার মধ্যে সামাজিক ব্যবসার একটা কথা বললাম। এই হলো শুরু। তারা এখন ‘গ্রামীণ স্কটল্যান্ড’ বলে একটা প্রতিষ্ঠান করবে যেখান থেকে আমরা সামাজিক ব্যবসা করব। দেখব যে, ১০, ২০, ৩০ জনের কাজের ব্যবস্থা করা যায় কি না? একবার যদি আমরা প্রমাণ করতে পারি যে, পারা যায় তবে তারা বলেছে, যত টাকা লাগে আমরা দেব। আমাদের এগুলো ভালো লাগে না। শহরজুড়ে এতগুলো লোক বিনা কাজে বসে আছে!
সামাজিক ব্যবসায় টাকার উৎস কোথা থেকে আসবে সেই কথা বলতে গিয়ে এগুলো বললাম।
আমি বললাম যে, তোমরা বিদেশি সাহায্য হিসেবে আমাদের টাকা দাও। তার শতকরা দশ ভাগ সামাজিক ব্যবসা হিসেবে খরচ করো। টাকা তো এমনিই দিচ্ছ। তোমাদের টাকাটা এভাবে কাজে লাগুক।
এখন জাইকা (JICA) রাজি হয়েছে। তারা বাংলাদেশের জন্য সোশ্যাল বিজনেস ফান্ড তৈরি করবে। তাদের কাছে আইডিয়াটা খুব ভালো লেগেছে। জাপানে এটা নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে। আলোচনার জন্য বহুবার বাংলাদেশে এসেছে। এখন তারা বাংলাদেশের জন্য একটা সোশ্যাল বিজনেস ফান্ড তৈরি করছে। ছোট করে শুরু করেছে। আমি বললাম, ছোট করেই শুরু কর, বড় দরকার নেই। এখন তোমরা ট্রাই করে দেখ এটা কি রকম হয়। এ রকম বিভিন্ন দেশ এ বিষয়ে আগ্রহ দেখিয়েছে।
এই বই প্রকাশ উপলক্ষে আমাকে দাওয়াত করা হলো তাদেরকে এ্যাড্রেস করার জন্য। আমি গেলাম, সবাইকে বললাম। বললাম, বিশ্বব্যাংক যে প্রতি বছর ২০ বিলিয়ন ডলার দেয়, তোমরা তার ৫ শতাংশ এই সামাজিক ব্যবসার জন্য দাও।
তুমি কি কাজ চাও? দারিদ্র্য বিমোচন চাও, শিক্ষার উন্নয়ন চাও, অবকাঠামোগত উন্নয়ন চাও, কর্মসংস্থান চাও যে কোনো কাজের জন্য দাও। এক বিলিয়ন ডলার এই কাজে দিতে যদি ভয় লাগে তবে পাঁচশ মিলিয়ন দাও। দেখ কি হয়? তুমি তো দান খয়রাতের জন্য টাকা দিয়ে রাখছো। বিশ্বব্যাপী বিদেশি সাহায্য বাবদ ৬০ থেকে ৭০ বিলিয়ন ডলার খরচ হয় প্রতি বছর। আমি বললাম, এর ১ শতাংশ  সামাজিক ব্যবসার পুঁজি হিসেবে দাও।
ফাউন্ডেশনগুলো আমাদের দেশেও আছে। প্রত্যেক কোম্পানির সিএসআর (CSR) ফান্ড আছে। কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি। সেগুলো দিয়ে তারা কি করে? ক্রিকেট ম্যাচ, রক মিউজিক ফ্যাস্টিভাল ইত্যাদি উৎসব করে। কিন্তু এই সিএসআরের উদ্দেশ্য ছিল যে, সমাজের জন্য মঙ্গলজনক কিছু করবে। মঙ্গলের কথা বলে এখন পাবলিসিটিতে চলে গেছে। গড়া হয়েছিল মঙ্গলের জন্য। যে জন্য নাম দেয়া হয়েছিল ‘কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি।’ কিন্তু এখন খরচ হচ্ছে তাদের পাবলিক রিলেশন্সে। সে ফান্ডেরও যদি ১০ শতাংশ নিয়ে আস তবে সেটাও তো একটা বড় অংক। এটা দিয়ে শুরু কর। তারপর সোশ্যাল বিজনেস ফান্ড তৈরি কর। যেটা সুনির্দিষ্টভাবে ডেডিকেটেড হতে হবে সোশ্যাল বিজনেসের জন্য।  যেমন জাইকা করছে।
নানা জায়গাতে চেষ্টা হচ্ছে, শুরু হয়েছে, তৈরি হচ্ছে সোশ্যাল বিজনেস ফান্ড। যারা সোশ্যাল বিজনেসে কাজ করতে চায় তাদের জন্য একটা বিনিয়োগের ব্যবস্থা হবে। কাজেই একবার যাত্রা শুরু হয়ে গেলে বহু রকমের পথ আছে।

সাপ্তাহিক : যাত্রা শুরু বলতে, আপনি যেমন গ্রামীণ ডানোন শুরু করলেন। সেটা কেমন চলছে?
ড. ইউনূস : খুব ভালো চলছে। আর কিছু সমস্যা হয় যেটা যে কোনো ব্যবসার জন্যই হয় সেটা হচ্ছে।
যেমন আমাদের দেশে পানি সমস্যা একটা বড় সমস্যা। দু’-একদিন আগে নিউইয়র্ক টাইমসে একটা খবর ছিল লেনসেটে একটা আর্টিকেল বেরিয়েছে, একটা গবেষণাপত্রে দেখানো হয়েছে যে, বাংলাদেশে আর্সেনিকের কারণে মানুষ মারা যাচ্ছে। মারা যাওয়ার খবরটা এতদিন এত স্পষ্ট ছিল না। মারা যাওয়াটা এটা একটা চূড়ান্ত অবস্থা। কিন্তু এতদিন ধরে যে রোগে ভূগতে হচ্ছে সেটাও একটা বড় জিনিস। কিন্তু এর সমাধান কি? আমরা তো কোনো সমাধান বের করতে পারছি না। আমরা একটা চেষ্টা করলাম সামাজিক ব্যবসা হিসেবে যে, একটা ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট বানানো হবে এবং সস্তায় মানুষকে পানি দাও, যাতে মানুষ সস্তায় পানি পায় এবং এতে মানুষ একদম পরিষ্কার, ঝক ঝকে পানি খাবে। ওটা আমরা দাউদকান্দির গোয়ালমারিতে করছি। এটা যদি সফল হয় তবে আমরা আরো করতে পারি। যেহেতু সামাজিক ব্যবসা, বিনিয়োগ করা তো কোনো সমস্যা নয়।

সাপ্তাহিক : একটা জিনিস পরিষ্কার হতে চাই সামাজিক ব্যবসা খাঁটি ব্যবসা হিসেবে চলবে?
ড. ইউনূস : শুধু তাই নয়, আমরা বলছি যে, আমরা সামাজিক ব্যবসার জন্য কোনো দিন সরকারের কাছে কোনো রেয়াত চাইব না। ফাউন্ডেশন করলে অনেকে বলে যে, আমরা গরিবের উপকার করছি আমাদেরকে ট্যাক্স থেকে অব্যাহতি দাও। আমরা তা বলব না। আমরা বলছি সামাজিক ব্যবসায়, একেবারে পাই পয়সা হিসেব করে ট্যাক্স দিতে হবে। আমরা চাই সরকারের আয় হোক, সরকার ভালোভাবে চলুক। আমাদের যে পরিবেশ দরকার সে পরিবেশ রক্ষা করুক। আমাদের শান্তি-শৃঙ্খলা চাই, আমাদের আইন চাই, আইনের শাসন চাই। আমি পয়সা না দিলে সরকার এগুলো করবে কোথা থেকে। এ জন্য ট্যাক্স দেব।
সামাজিক ব্যবসা তো সরকারের যে আইনে কোম্পানি তৈরি হয় সে আইনেই তৈরি হয়েছে। কাজেই সরকারের কাছে এটা সমান। সামাজিক ব্যবসা ট্যাক্স দেবে, অন্যরা যা যা সরকারকে দেয় এটাও তার সবকিছু দেবে। কিন্তু ব্যবসাটা হলো সমস্যার সমাধান করা। সরকারের সঙ্গে এর কোনো বিরোধ নেই।

সাপ্তাহিক : ভারতবর্ষে একসময় স্বেচ্ছাব্রতী সামাজিক আন্দোলন ছিল। মানুষ নিজেরা খেয়ে বনের মোষ তাড়াত মনের আনন্দে। এরপর যখন এনজিও সমাজ এলো তখন একটা সমালোচনা হলো যে, আমাদের ওই জিনিসটার দখল নিল বিদেশি সাহায্য। এখন আপনি বলছেন যে, সোশ্যাল বিজনেস হচ্ছে ফিউচার অব দ্য ক্যাপিটালিজম। ক্যাপিটালিজমের যে দোষত্রুটি আছে সেগুলোকে লুকিয়ে রেখেই নতুন কায়দায় সোশ্যাল বিজনেস কি এর ওপর কোনো প্রলেপ দিচ্ছে। ক্যাপিটালিজমের সুরক্ষা দিতেই কি এই নতুন আইডিয়া? এ রকম সমালোচনা কি হতে পারে না?
ড. ইউনূস : হতে পারে। এটা সাপ্রেস করবে না রিভিল করবে সেটা ভবিষ্যতের বিষয়। এটা করতে গিয়ে দেখা গেল যে, ব্যবসার ভেতরে যেসব ফন্দি ফিকির আছে সব বেরিয়ে আসছে। হতে পারে, যেহেতু ওরাই আসছে। ওদেরই মানুষ বলছে যে, আমরা ভুল কাজ করেছি। আপনি বাইরে থেকে দেখছেন যে, বিরাট প্রতিষ্ঠান, মেগা প্রতিষ্ঠান। যেমন ‘মাইক্রোসফট’। প্রতিষ্ঠান মেগা কিন্তু কাজ তো করি আমি আর আপনি। আমরা তো সেই একই লোক। চাকরি করি তার কোম্পানিতে কিন্তু তার মানে আমার মনটা তো আর বেচে দিইনি। কাজেই আমাকে যখন সামাজিক ব্যবসাতে আপনি জড়িত করবেন, আমি দেখছি যে আরে এ তো ভারি মজার জিনিস।
আমি তো নীতিনির্ধারক এই কোম্পানিতে। আমি কেন মানুষের অনিষ্ট করব? তার মনে দোলা খাবে সেটা। সেই একই লোক আগে শুধু মুনাফা অর্জনের জন্য কাজ করছিল। এখন একই সঙ্গে করছে সমাজের সমস্যা সমাধানের জন্য। এটা ছিল না বলে আমি একনিষ্ঠভাবে মুনাফা বাড়াবার কাজ করে গেছি।
যে সিইও সবচাইতে কঠোর, দক্ষ, নিষ্ঠুরভাবে কোম্পানি চালায়Ñ সে খুবই অভিজ্ঞ, ব্যবসা-বাণিজ্য চালানোর ক্ষমতা অসীম, সফল মানুষ। সে যখন একটা সিইওর আসনে বসে তখন সে একটা রোবট। তাকে আপনি মানুষ বলতে পারেন না। যেই মাত্র সে ঘরে আসে– তার ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি নিয়ে বসে তখন সে সাধারণ মানুষ। তার সঙ্গে আমার আপনার কোনোরকম পার্থক্য নেই। একটা দুঃখের খবর পত্রিকায় পড়লে সে কষ্ট পায়, একটা সুখের খবর শুনে সে খুশি হয়। দুঃখ নিয়ে ছেলেমেয়ের সঙ্গে, বউয়ের সঙ্গে সে আলাপ করে, আহারে! এ রকম করে হলো, জিনিসটা! ইস! কেউ কিছু করতে পারল না, তার জন্য! মানুষ হিসেবে তার কোনো তফাৎ নেই। কিন্তু ওই চেয়ারে বসা মাত্রই সে অন্য মানুষ, একটা রোবট।
আমি যদি তাকে আরেকটা চেয়ার বানিয়ে দিই যেখানে সে তার মন খুলে মানুষ হিসেবে কাজ করতে পারবে। একই লোক দুটো কোম্পানির সিইও। একটা সামাজিক ব্যবসার সিইও। আবার একটা নিষ্ঠুর মুনাফা অর্জনকারী প্রতিষ্ঠানের সিইও। কাজেই তার মধ্যে একটা পরিবর্তন আসবে।
যেমন আমরা ডানোন-এর সঙ্গে মিলে গ্রামীণ-ডানোন নামে একটা সামাজিক ব্যবসা করেছি। এটা খুব ছোট একটা ব্যবসা। পুষ্টিকর দইয়ের ব্যবসা।
সারা দুনিয়াতে কয়েক বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা আছে ডানোন-এর। কিন্তু তার যেখানে যত কর্মচারী কাজ করে সবাই খবর চায়, কেমন হলো, শিশুরা ঠিকমতো খাচ্ছে তো আমাদের দই।  আমাদের দেশে এটা করা যাবে না? আমরাও তো করতে পারি।
প্রত্যেক দেশে প্রশ্ন হলো তাদের কোম্পানির বড় সাহেবদের কাছে– আমাদের দেশে এটা করি না কেন? ওই দেশে করছে। ওরা বলে যে, থামো একটু। ওরা সেটল হোক। পুরো জিনিসটা আমরা বুঝে নিই, তারপর এখানেও করব। কাজেই মানুষকে অবজ্ঞা করবেন না, সে যত বড় খারাপ কোম্পানিতেই কাজ করুক না কেন? শেষ পর্যন্ত সে একটা মানুষ। যখনই মানুষের মঙ্গল হয় সে উচ্ছ্বাস বোধ করে।

সাপ্তাহিক : দর্শনটা হচ্ছে যে, মানুষের ভেতরের যে পরার্থপরতার একটা জায়গা যেটা কাজ করে…
ড. ইউনূস : এটা জাগিয়ে দাও। এটা আমরা একদম বন্ধ করে দিয়েছি। একদম টোটালি শাটডাউন করে রেখেছি। ওখানে দেয়াল আছে বা দরজা আছে, কোনো প্রশ্নই আসে না। আমি বললাম যে, এখানে দেয়ালটা ভেঙে দাও। সে যদি না করে, না করল, আমি তো তাকে জোর করছি না। সামাজিক ব্যবসা করতে হবে এ জন্য আমি তো তোমাকে জোর করছি না, তুমি আমার সমালোচনা করবে কি? আমি তোমাকে আইডিয়া দিচ্ছি। তোমার যদি ভেতরে ইচ্ছা থাকে, তবে কর। না থাকলে কর না।
আমি বললাম যে, তুমি আজকে একজন দক্ষ মুনাফামুখী ব্যবসায়ী। যেই মাত্র তুমি সামাজিক ব্যবসা শুরু করলা, এই প্রথম তোমার ডাইনিং টেবিলে তোমার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে কথা বলা শুরু হবে। তা না হলে তোমরা যার যার খাবার খেয়ে চলে যাবে। যেই মাত্র এটা হবে, মেয়ে বলবে ‘আব্বা, আমার মাথায় আরেকটা বুদ্ধি এসেছে, এটা করো না কেন?’ ছেলে বলবে, ‘আমার কাছে আরো ভালো বুদ্ধি আছে, আমি কাল সারাদিন ইন্টারনেটে চেক করেছি, এটা করলে ভালো হবে।’ তারা ইনভলবড হয়ে গেল। অথচ আগে তার ছেলেমেয়ের ব্যবসার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক ছিল না। বাপও কারো সঙ্গে কোনো কথা বলত না। কারণ সে জানে যে তার ছেলেমেয়েকে অন্যরা বলে যে, তোমার বাপ মানুষকে বোকা বানাচ্ছে কেন?’
এই যে তার পরিবর্তন– এটাই এক্সাইটিং ব্যাপার। আমার কথা হলো মানুষের মনে যদি থাকে তবেই হবে। মানুষের মনে যদি না থাকে তবে তো হবে না। তখন হবে যে, আমি চেষ্টা করেছিলাম। আমার ধারণা ছিল যে, মানুষের মনে এটা আছে। তবে আমার ধারণা, মানুষের মনে এটা শুধু আছে তাই নয়, বিপুল পরিমাণে আছে। এটাকে সুযোগ দিতে হবে।
আমরা যখন মসজিদে যাই, ওয়াজে যাই, তখন এটা জেগে ওঠে। যেইমাত্র টুপিটা খুলে ঘরে আসছি, অফিসে চলে আসছি, তখনই আবার ভুলে গেছি। যখন চার্চে যাই তখন জেগে ওঠে। যেইমাত্র ঘরে আসছি, অফিসে চলে আসছি তখন আবার ভুলে গেছি। কিন্তু বারে বারে সমাজবিদরা বুঝিয়ে গেছে যে, এই মঙ্গল কর, ওই মঙ্গল কর এটা সবাই বলছে কিন্তু কাজের বেলায় এসে সবাই ভুলে যাই। যেহেতু একাডেমিক বইপুস্তকের থিওরিতে এসে অন্যটা দেখা যায়। থিওরি বলেছে যে, তুমি মুনাফা কর এবং সবাইকে কম দাও, যাতে করে তোমার মুনাফা বাড়ে।

সাপ্তাহিক : মজুরি দেয়ার ক্ষেত্রে স্বাভাবিক ব্যবসার নিয়ম মেনেই কি সামাজিক ব্যবসায় মজুরি দেয়া হবে?
ড. ইউনূস : এখানে শ্রমিকের মর্যাদা বেশি হবে। স্বাভাবিক ব্যবসায় শ্রমিকের বেতন কমিয়ে রাখবে। সামাজিক ব্যবসায় তা করার প্রয়োজন হবে না। নিচের দিকে কর্মচারীদের ক্ষেত্রে এমনই হবে। ওপরের দিকে প্রতিযোগিতার বাজার বিবেচনা করবে। ওই বাজার থেকেই তো আনতে হবে, কাজেই ওই বেতন না দিলে সে আসবে কেন?

সাপ্তাহিক : এক সময় আপনি শুরু করলেন বিকল্প ব্যাংকিং ব্যবস্থা, মাইক্রোক্রেডিট। থিওরিটাই আপনি বদলে দিলেন। এর পর এক সময় আপনি বললেন যে, তথ্যপ্রযুুক্তিই আমাদের ভবিষ্যৎ বদলে দেবে। এখন আপনি এলেন আবার সোশ্যাল বিজনেসের দিকে– একটি নতুন ডাইমেনশন। এ তিনটার মধ্যে কি কোনো ইন্টারলিংক আছে?
ড. ইউনূস : একটার সঙ্গে আরেকটা জড়িত তো বটেই। এই যে মাইক্রোক্রেডিট বা ক্ষুদ্র ঋণ সারা দুনিয়ায় খুব জনপ্রিয় হয়ে গেল। বোধহয় পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই বর্তমানে যেখানে মাইক্রো ক্রেডিট নেই। সেটা যত বড় ধনী দেশই হোক কিংবা গরিব দেশই হোক।
আমার অভিজ্ঞতা থেকে জানি যে, যখনই একটা জিনিসের জনপ্রিয়তা আসে তখন তার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা জিনিস আসে সেটা হলো এবিউজ। আরেকটা মিসইউজ। মাইক্রোক্রেডিট নামটা যেহেতু সুন্দর, সবাই ভালোবাসে, ওই নামটা সবাই ব্যবহার করে। কেউ এবিউজ করছে, কেউ মিসইউজ করছে। সারা দুনিয়াতে এখন এটা ছড়িয়ে গেছে। তার মধ্যে বেশিরভাগ মানুষ আন্তরিকতার সঙ্গে এটা করছে।  কিন্তু অল্প কিছু লোক একে মিসইউজ করে, কেউ এবিউজ করে।
কিছু কিছু মাইক্রোক্রেডিট প্রোগ্রাম উচ্চ হারে সুদ নিয়ে ধনী মালিকদের জন্য মুনাফা করে। আমরা বলি যে, এটা কোনো মাইক্রোক্রেডিটই না। এটা হলো সনাতন মহাজনী ব্যবসা। যারা গরিব মানুষের টাকা নিয়ে নিজেরা মুনাফা করছে। বড় বড় মুনাফা করছে এবং মুনাফা নিয়ে তারা খুব বড়াই করছে যে, ‘আমরা খুব মুনাফা করছি’। মাইক্রোক্রেডিটে ব্যক্তিগত মুনাফা করাটা, বড়াই করাটা এটা কোন ধরনের কথা?
আমি সব সময় বলি, ‘আমরা তো মাইক্রোক্রেডিট সৃষ্টি করেছিলাম গরিব মানুষকে সাহায্য করার জন্য। মুনাফার বড়াই কেন কর?’ বলে যে, ‘কেন গ্রামীণ ব্যাংক মুনাফা করে না?’ বলি হ্যাঁ করে। তাহলে গ্রামীণ ব্যাংক আর আমার মধ্যে পার্থক্য কি? বলি যে, গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক হলো গ্রামীণ ব্যাংক থেকে যে ঋণ নেয় সে। কাজেই মুনাফা করা মানেই ওই টাকা তার কাছে ফেরত যাওয়া।

সাপ্তাহিক : এটা কার টাকা? এটা তো আমার টাকা না।
ড. ইউনূস : টাকাটা মালিকের। গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকরা সব ঘরের ভেতর। যারা ঋণ নেয় তারাই মালিক। ৮০ লাখ গরিব মহিলা এই ব্যাংকের মালিক। কাজেই লাভ করে আমি বাহবা নিচ্ছি এ জন্য তাদের এত লাভ হয়েছে। এখানে তো অসুবিধা নেই। আমারটা তো মঙ্গলের জন্য ব্যবসা। এই যে মঙ্গলের জন্য ব্যবসা মাথার মধ্যে ঢুকল এটা কোন ধরনের ব্যবসা? তার সঙ্গে আরেকটা জিনিস যুক্ত হয়, আমি তো অনেক কোম্পানি করেছি। এই গ্রামীণফোন থেকে শুরু করে টেলিকম, ইন্টারনেট বহু রকমের। প্রায় চল্লিশটা কোম্পানি আমাদের রয়েছে।
লোকে জিজ্ঞেস করে আপনি খুব বড়লোক নিশ্চয়। আপনার এতগুলো কোম্পানি, বহু টাকা।
আমি বলি, না, আমার তো এত টাকা নেই। আমি কি করতে পারি? আমি তো গ্রামীণ ব্যাংকের একটা চাকরি করি, বেতন পাই। ওরা বলে, ওগুলো তো কথা নয়, আপনারই তো কোম্পানি। আপনি গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক না?
আমি বলি, না আমি গ্রামীণ ব্যাংকের মালিক না।
বলে, আপনি গ্রামীণ ব্যাংক বানিয়েছেন না?
আমি বলি, হ্যাঁ, বানিয়েছি।
তো, আপনি মালিক না তো কি?
আমি তো কখনো চিন্তাও করি নাই যে গ্রামীণ ব্যাংকের একশ টাকার শেয়ারও আমি কিনব।
তাহলে এ কোম্পানি বানিয়েছেন কেন আপনি? এত বড় গ্রামীণফোনে, আপনার একটা শেয়ারও নেই। না আমার কোনো শেয়ার নাই। না, আমি তো চিন্তাও করি না। এ চিন্তা তো আমার মাথায়ই আসেনি।
তখন জিজ্ঞেস করে, এটা কেন করেন?
আমি বলি, আমি তো মানুষের মঙ্গলের জন্য করছি। আমি তো নিজের জন্য করি নাই। আমি যখন গ্রামীণ ব্যাংক করেছি তখন তো চিন্তা করিনি যে, এখান থেকে টাকা কামিয়ে আমি বড়লোক হব।
আস্তে আস্তে বুঝতে আরম্ভ করলাম যে, আমি এমন ধরনের এক ব্যবসা শুরু করেছি এটা থিউরিতে নেই। তখন মনে হলো এটা থাকা উচিত ছিল। আমি যখন করেছি, আরেকজনও তো করতে পারত? এই চিন্তাটা আসত, মাইক্রোক্রেডিট কেন? এত কোম্পানি কেন? এটা কি ধরনের কোম্পানি?
আমার যত লেখা আছে দেখবেন, একদম গোড়া থেকে একটা কথা আমি বলছি, ‘সোশ্যাল কনসাসনেস ড্রিভেন কোম্পানি।’ বুঝতে পারছিলাম না সোশ্যাল কনসাসনেস কোথা থেকে আসছে? এটা কেন হয়?  এটার বহুল প্রয়োগ সম্ভব কিনা। সোশ্যাল কনসাসনেস ড্রিভেন কোম্পানি বলতে বড় কঠিন শোনায়, বোঝা যায় না। আস্তে আস্তে একটা সহজ নাম দিলাম– সোশ্যাল বিজনেস। যখন নোবেল পুরস্কার পেলাম তখন এই কথাগুলো গুছিয়ে পরিষ্কার করে নোবেল বক্তৃতায় বললাম এই ধরনের জিনিস থিউরিতে মিসিং হওয়া উচিত না।
এরপর লোকে অনেক জায়গায় বলা শুরু করল এটা তো খুব চমৎকার কথা হলো, কিন্তু আপনাকে তো জিনিসটা আরো সবিস্তারে বলতে হবে। ২০০৬ সালে নোবেল বক্তৃতা দিলাম, ২০০৮ সালে আমার বইটা প্রকাশিত হলো। এটা হলো ‘ক্রিয়েটিং এ ওয়ার্ল্ড উইথআউট পোভার্টি, সোশ্যাল বিজনেস এ্যান্ড ফিউচার অব ক্যাপিটালিজম।’
আমি বললাম, এই ক্যাপিটালিজম চলবে না। এটা অর্ধনির্মিত ক্যাপিটালিজম। এটার সমাধান এর ভেতর থেকেই বের করতে হবে। বর্তমানে আর তো কোনো অল্টারনেটিভ দেখা যাচ্ছে না। আমি বললাম
যে, এটা করলে তাহলে এটার মধ্যে আবার মনুষ্যত্ব ফিরে আসে। মনুষ্যত্ব ফিরে আসলে এটার কিছু একটা বিবর্তন হবে। সোশ্যালিজম কমিউনিজমেরও নতুন রূপ চিন্তা করতে হবে। আগের রূপে এগুলো চলবে না।
এটা বলার পর লোকে কেবল আমাকে এই প্রশ্ন করে, ওই প্রশ্ন করে, আর আমি কেবল জবাব দিচ্ছি। মিটিং হলেই জবাব দিতে হয়, বক্তৃতা দিলেই জবাব দিতে হয়। প্রশ্ন-উত্তর সেশন থাকে লম্বা। চিঠি আসে জবাব দিতে হয়। একটা প্যাঁচানো প্রশ্ন আসে ওটার আবার একটা লম্বা জবাব দিতে হয়। এগুলো এত জবাব দিলাম যে শেষে মনে করলাম প্রত্যেকবার খালি জবাব দিচ্ছি। এগুলো লিখে ফেললে কেমন হয়? এই থেকে লেখা শুরু হলো। আমি যত জায়গায় যতবার কথা বলছি, চিন্তারও পরিশীলন হচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় যত কথা বলেছি সেগুলো কমপাইল করে একটা বই তৈরি করলাম। এই বইটা ‘বিল্ডিং সোশ্যাল বিজনেস’।
ইতোমধ্যে সামাজিক ব্যবসা নিয়ে আমাদের বাস্তব অভিজ্ঞতা হয়েছে। ২০০৮ সালে যখন বই প্রকাশ করলাম তখন গ্রামীণ-ডানোন ছাড়া আর বড় কোনো সামাজিক ব্যবসার কথা বলার সুযোগ ছিল না। এখন তো অনেকগুলো সামাজিক ব্যবসা অলরেডি হয়ে আছে এবং আরো অনেকগুলো পাইপলাইনে আছে। এভাবে বিবর্তন হয়েছে। কাজেই একটা থেকে আরেকটা আলাদা না। যেমন টেকনোলজির কথা এইমাত্র বললাম। টেকনোলজি এখন আমরা হেলথ কেয়ারে বিরাট আকারে করতে চাচ্ছি। এ জন্য যে, বর্তমানে যে হেলথ কেয়ার আছে, কেবল এ দেশে না, সারা দুনিয়াতে এমনকি আমেরিকাতেও টেকনোলজি তার ধারেকাছে নেই।
আছে কি সেটাও বলি, হাসপাতাল বেইজড খুব সফেসটিকেটেড টেকনোলজি। বিরাট বিরাট জবরজং যন্ত্রপাতি দিয়ে খুব ইমপ্রেসড করছে। আমি বলি এগুলো তো তোমরা ইমপ্রেসড করার জন্য বানিয়েছ। যাতে করে বেশি করে বিল করতে পার রোগীকে। শাসালো রোগী আসে তোমার হাসপাতালে। এগুলো দেখে-টেখে মনে করে আমার ভালো চিকিৎসা হয়।
আমি বললাম যে, ওই যন্ত্রটা যে একটা জবরজং করে বানিয়েছ এবং মেলা টাকা রোজগার করছ,  এটাকে লিটারেলি একটা জুতার বাক্সের মধ্যে নিয়ে আসা যায়। কারণ দুনিয়াতে এখন টেকনোলজির পুরো জিনিসটা হলো চিপস। এই চিপসের জন্য জায়গা লাগে না। আমি বললাম যে, আমি এই মোবাইল ফোনের মধ্যে আল্ট্রাসনো নিয়ে আসতে পারি, শুধু তার সঙ্গে একটা প্রোব লাগিয়ে দেব। সে সমস্ত জিনিস রেকর্ড করবে বাচ্চাটা পেটের ভেতরে কি রকম আছে? সে জানাবে এটা কি রিস্কি প্রেগনেন্সি না নরমাল প্রেগনেন্সি? আমি এর মধ্যে দেখতে পাব।
কিন্তু তুমি সে কাজটা করছ না। কারণ তাতে ওই পয়সা তুমি করতে পারবে না। এই যে দেখ, মুনাফা মানুষকে কোন দিকে নিয়ে যায়? মুনাফা আমাকে দিয়ে গেছে বড় বড় যন্ত্রপাতির দিকে। বেশি পয়সার দিকে। কাজেই আমি ঐ দিকে চলে গেছি। সামাজিক ব্যবসা হলে এসব লাগে না তো। এটা তো আমি আমার মোবাইল ফোনের মধ্যে করার চিন্তা করব।
আমরা এখন যেটা করছি– গ্রামে রক্ত পরীক্ষা, পায়খানা পরীক্ষা, প্রস্রাব পরীক্ষাÑ শুধু একটা মেয়েকে শিখিয়ে দিয়েছি কিভাবে স্লাইড বানাতে হয়। স্লাইডটা বানিয়ে মাইক্রোস্কোপ থেকে মোবাইল ফোনটা দিয়ে ছবি তুলে ঢাকায় পাঠাতে হয়। এখানে ডাক্তার ঐ ছবিটা দেখে সিদ্ধান্ত দেন। ঐ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের তো গ্রামে পাঠানোর দরকার নেই। তিনি যাবেনও না কোনো দিন।
কাজেই টেকনোলজি আছে কিন্তু সেটার ব্যবহার নেই।  বার বার বলছি গরিবের হাতে এই টেকনোলজি আসতে হবে। টেকনোলজিকে গরিবের হাতে আলাদীনের চেরাগ করে দিতে হবে। সে স্পর্শ করা মাত্রই যা চাইবে তা পাবে। আমি দীর্ঘদিন ধরেই আমার বক্তৃতাই বলে আসছিলাম এই আলাদীনের চেরাগ বানাতে হবে। ‘ডিজিটাল আলাদীনস ল্যাম্প’ এটা আমার বক্তব্যের বড় একটা অংশ ছিল। তাহলে কি হবে? বাংলাদেশের একটা গরিব বা বলিভিয়ার একটা মেয়ে যখন এই চেরাগটা ছোঁবে তখন সঙ্গে সঙ্গে ডিজিটাল ‘দৈত্য’ বের হয়ে বলবে ‘আমি তোমার জন্য কি করতে পারি বল।’ সে বলবে ‘ভাই, আমার হাতে তো কাজ নেই, আমাকে কাজ দাও।’ দৈত্য বলবে, ‘বলেন কি? দাঁড়ান আমি ব্যবস্থা করছি।’
ডিজিটাল দৈত্যের কাজই হবে সমস্যার সমাধান করে দেয়া।
‘আমি তো কাপড়গুলো বানিয়ে বসে আছি, কিন্তু কেউ তো কেনে না। দৈত্য বলবে, ‘আপনি চিন্তা করবেন না, আমি বিক্রির ব্যবস্থা করছি।’ সে খরিদ্দার নিয়ে আসবে। ঐখান থেকে বেচা-বিক্রি হয়ে যাবে। সব এই মোবাইল ফোনের মাধ্যমে হয়ে যাচ্ছে।
তাহলে এতদিন বলতাম যে আলাদীনের চেরাগ একদিন ‘হবে’, এখন বলব আলাদীনের চেরাগ হয়ে গেছে।
‘হয়ে গেছে, কিন্তু এটা গরিবের জন্য হয়নি।’ আমি বললাম যে, ‘আইফোন দেখুন, কি হয় এখানে, টাচ্ করেন, যা চাচ্ছেন তাই পাবেন। আইফোন দুনিয়ার সঙ্গে আপনার যোগাযোগ করে দিচ্ছে মুহূর্তের মধ্যে। আমি এখন কোন বিল্ডিংয়ে বসে আছি এই আইকনটা ছোঁয়ামাত্র স্যাটেলাইট থেকে তা বলে দিচ্ছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে বলে দিচ্ছে যে, আপনি এখন অমুক দেশের অমুক এলাকার অমুক নং বিল্ডিংয়ের এই কোনায় বসে আছেন। দুনিয়ার যেখানেই থাকি, সেটা মরুভূমিই হোক আর সাগরই হোক আমাকে সে বলে দেবে। ম্যাপসহ দেখিয়ে দেবে। তো এটা কি আলাদীনের সেই চেরাগ না? কিন্তু এ চেরাগ গরিবের জন্য বানানো হচ্ছে না। যেহেতু এর যে চালক এটা বানিয়েছেন বহু অর্থ মুনাফা করার জন্য।
এখন সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে এই টেকনোলজি যদি গরিবদের জন্য, গরিবদের হাতে হাতে দেয়া হয় তবে সে একেকটা সমস্যার জন্য এর একেকটা আইকনে চাপ দেবে আর একেকটা সমাধান আসবে। একটাতে স্বাস্থ্য পাবে, একটাতে শিক্ষা পাবে। আমি বলি যে, দুনিয়ার কোনো লোকের কি এখন দরকার আছে নিরক্ষর থাকার? খেলতে খেলতে তিনি শিখবেন। এর ভেতরে সব দেয়া আছে। ব্যবহারকারী বয়স্ক হোক, বাচ্চা হোক এর আইকনে স্পর্শ করবেন আর আলাদীনের চেরাগে একেকটা জিনিস বেরিয়ে আসবে।
অ, আ, ক, খ শেখা, চিঠি লেখা, ‘আমি ভালো আছি’, লিখে চাপ দিলাম চলে গেল এটা। ওদিক থেকে বলল, ‘বাহ্ তুমি তো বেশ ভালো লিখতে শিখেছ। বেশ বেশ’। আমাকে আবার একটা চিঠি লেখ। এভাবে খেলতে খেলতে শিখে যাবে। এর মধ্যে খেলা আছে, এর মধ্যে গল্প আছে, এর মধ্যে সবকিছু আছে। বই পড়তে চান স্পর্শ করলে বই চলে আসছে। তাহলে আলাদীনের চেরাগ তো এসে গেছে। কিন্তু আমরা শুধু চেরাগটা গরিবের জন্য তৈরি করছি না। সামাজিক ব্যবসায়ী হিসেবে যে আসবে সে বলবে যে আমি করে দেব।
আমরা সেদিন জেনারেল ইলেকট্রিকের সঙ্গে আলাপ করলাম, চুক্তি করলাম যে, আমি যেভাবে যেভাবে বলি সে রকম সিম্পল জিনিস আমাকে বানিয়ে দিতে হবে।  ভাগ্যিস জেনারেল ইলেকট্রিকের হেলথ কেয়ার ডিভিশনের যিনি সিইও তিনি বাংলাদেশি এক লোক।  ওমর ইশরাক তার নাম।  এক মিটিংয়ে তার সঙ্গে দেখা।

সাপ্তাহিক : কোথায় বসেন?
ড. ইউনূস : উনি আমেরিকাতে, যেখানে তাদের হেড কোয়ার্টার সেখানে বসেন। মধ্যপ্রাচ্যে এক মিটিংয়ে পাশে বসেছিলেন। দেখে আমি মনে করেছি ভারতীয়, ইংরেজিতে কথা বলছেন, কিছুক্ষণ পর কাছে এলেন। এসে বাংলায় বললেন, আপনাকে দেখে আমার খুব ভালো লাগছে। বহুদিন ধরে আপনার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা। আমি তখনো মনে করছি তিনি কলকাতার বাঙালি।  জিজ্ঞেস করলাম। তখন তিনি বললেন, ‘না, আমি বাংলাদেশি।’
আমি বললাম, ‘হ্যাঁ, এবার আমার মনে পড়ছে। জ্যাকওয়েলসের বইতে আপনার সম্বন্ধে আমি পড়েছি। জ্যাকওয়েলস ছিলেন জেনারেল ইলেকট্রিকের সবচেয়ে ডাকসাইটে সিইও। এখনো সারা দুনিয়া তাকে শ্রদ্ধা করে।  আত্মজীবনী লিখেছিলেন জ্যাকওয়েলস। তার আত্মজীবনীর পুরো একটা অধ্যায় হলো এই ওমর ইশরাকের ওপর।
তাকে যখন বললাম, ‘আপনার সম্পর্কে পড়েছি। তখন তিনি বললেন ‘হ্যাঁ লিখেছে।’
আমি বললাম, ‘শুধু লিখেছে না, আমরা গৌরবে ফেটে গেছি যে, জ্যাকওয়েলসের পুরো আত্মজীবনীতে একটা অধ্যায় আপনাকে নিয়ে।’ এই অধ্যায়ে জ্যাকওয়েলস বলছেন, ‘আমাদের কোম্পানিতে এক বাঙালি ছেলে আমাকে বিরক্ত করে মারছে। সে বলে যে, তোমার এই যন্ত্রপাতিগুলো স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যাবে। তুমি এটা কর। মানুষেরও উপকার হবে, তোমারও লাভ হবে।’
জেনারেল ইলেকট্রিক যে স্বাস্থ্যক্ষেত্রে প্রবেশ করবে, এই চিন্তা আমার মাথার ধারেকাছেই ছিল না। এ ছেলের প্যানপ্যানানিতে আমি তাকে বললাম, তুমি আমাকে করে দেখাও। সে আমাকে করে দেখাল। আমার ভালো লাগল। তখন আমি তাকে বললাম যে, ঠিক আছে আমি তোমাকে একটা জায়গা দিই, তুমি এটা কর। আমি মনে করলাম, এটা ছোটখাটো ব্যবসা হবে। কিন্তু দিনে দিনে এটা একটা বড় ব্যবসায় পরিণত হলো। আজ পর্যন্ত ওমর ইশরাক এটার প্রধান। পুরো জেনারেলে হেলথ কেয়ার ডিভিশন ওমর ইশরাকের কন্ট্রিবিউশন।
তাকে আমি বললাম, ‘আপনাকে বাংলাদেশে আসতে হবে একবার।’
তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ আমি তো বাংলাদেশে যাই মাঝে মাঝে। আত্মীয়স্বজন আছে।’
আমি বললাম, ‘এর পরের বার গেলে আমাকে বলবেন, আমি একটু বসব আপনার সঙ্গে। আমি হেলথ কেয়ার করতে চাচ্ছি, আপনি আমাকে একটু সাহায্য করবেন।’
তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, করব। আমি তো আসলে সুযোগই পাই না। কেউ তো জিজ্ঞেসই করে না আমাকে।’
আমি বললাম, ‘আমি তো করছি।’
এরপর পরের বছর তিনি এলেন। আমি বললাম, ‘কত বছর চাকরি করছেন?’ তিনি বললেন, ‘এত বছর।’
আমি বললাম, ‘বছর দুয়েকের জন্য ছুটি নেন।’
তিনি বললেন, ‘কেন? কি করব?’
আমি বললাম, ‘বাংলাদেশে চলে আসেন। স্বাস্থ্য ব্যবসার নতুন প্রযুক্তির প্রয়োগটা আপনি এখানে বসে করে দেন। করে দিয়ে তারপর চলে যান।’
তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, এটা তো আমার কাছে খুব আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে, এটা আমি করব।’
তিনি রাজি হয়ে গেলেন, বললেন, ‘আমি করব, দেখি আমি আমার কোম্পানির সঙ্গে আলাপ করি। দুই বছর ছুটি নিয়ে বাংলাদেশে আপনার কাছে চলে আসব।’  তিনি খুব উৎসাহ নিয়ে গেলেন। খুব এক্সাইটেড হয়ে গেলেন। যাওয়ার দুই মাস পর চিঠি লিখলেন, ‘আমি তো যাব বলেছিলাম কিন্তু আমার পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। তবে আমি এখানে থেকে আপনার যা যা লাগে করে দেব। আমি বুঝতে পারছি ওখানে থাকলে খুব ভালো হতো কিন্তু না থাকলে যা যা অসুবিধা হবে তা আমি এখান থেকেই মিটিয়ে দেব।’
পরে দেখলাম যে, কারণটা কি? তার পারিবারিক অসুবিধা হচ্ছিল। তবে আমাদের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন আন্তরিকভাবে। সেই থেকে আমাদের কমিউনিকেশন শুরু হলো। এই জিনিস তৈরি করা শুরু হলো। এখন আগামী অক্টোবরে জেনারেল ইলেকট্রিকের বিরাট ম্যানেজার সম্মেলন হবে ওয়াশিংটনে, সেখানে আমাকে বানিয়েছে কী নোট স্পিকার। যেতে হবে, কথা বলতে হবে। তাদের সমস্ত নির্বাহীকে এ্যাড্রেস করতে হবে। হেলথ কেয়ারে কি কি হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি তা বলতে হবে।
আমি তো তাদের সব সময় সমালোচনা করি। আমার অভিযোগ আপনারা ইচ্ছা করে এ জিনিসগুলো সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে এনে বড় বড় যন্ত্রপাতি বানাচ্ছেন। এই জিনিস একটা মোবাইল ফোনের মধ্যে নিয়ে আসা যায়। আপনি আমাকে বলেন, আমি আপনার সঙ্গে বসে করে দেব। আমি পারব। আমি প্রকৌশলী না কিন্তু আমি বুঝি যে এটা সম্ভব। এটা আপনি আমাকে বোঝাতে পারবেন না যে করা যায় না।
কাজেই মজা লাগে যে, আমাদের দেশের এ রকমের লোক আছে। এত বিশাল প্রতিষ্ঠানের চূড়ায় টপবস হয়ে আছে।
কাজেই টেকনোলজিকে ওই ভঙ্গিতে নিয়ে আসতে হবে। কোনো সমস্যা টিকিয়ে থাকার কথা নয় যদি আমি টেকনোলজিকে সবার কাছে পৌঁছে দিতে পারি। টেকনোলজি আজ কত উচ্চ আসনে আছে, ভেবে দেখুন আগামীকাল কি হবে তার।
এক বছর পরে কি হবে তার। দশ বছর পর কি হবে তার? দশ বছর পরে তো বর্তমান মোবাইল সেট দেখে লোকে হাসবে। মানুষ হাসবে এত বড় ভারি জিনিস দেখে, এটা কী বানিয়েছেন আপনারা ? এটাকে ভাঁজ করে পকেটের মধ্যে নিয়ে তারপর দরকার হয় টেনে টেনে সুবিধামতো বড় করে কাজ করবে। কেন এতবড় জিনিস বয়ে বেড়াতে হবে?
আপনার মনে আছে প্রথম যখন কলের গান শুরু হলো, তারপর লং প্লেয়িং রেকর্ড, তারপর ওয়াকম্যান। খুঁজে পাবেন আজকে সেই ওয়াকম্যান? হাজার ডলার দিয়ে কিনতে হবে সেই ওয়াকম্যান। এখন সেই ওয়াকম্যান একটা দুষ্প্রাপ্য বস্তু। ওয়াকম্যান এখন জাদুঘরের জিনিস।
এই যে ‘লং প্লে’ সেটা নিয়ে কি এক্সাইটমেন্ট ছিল এক সময়। একটা লং প্লে নিয়ে যদি সোভিয়েত ইউনিয়নে যাওয়া যেত তাহলে সোভিয়েত ইউনিয়নে যে কোনো জিনিস কেনা যেত। এত মূল্যবান জিনিস। কারণ তারা ঢুকতে দেয়নি, লং প্লে আসতে দেয়নি। তাদের তরুণদের কি আবেদন থাকত আবার যদি আসো আমার জন্য অমুকের একটা লং প্লে নিয়ে আসবে।’
কোথায় চলে গেল সে লং প্লে। কয়দিনের কথা? কোথায় চলে গেল সেই গ্রামোফোন? এগুলোর হদিস নেই। যে টেলিভিশন আজ আমরা ব্যবহার করছি তা দেখে আগামী দিনের লোকে হাসবে। কি এই ঢাউস সাইজের টেলিভিশন। আর এখন এই আইপডের মধ্যে পঞ্চাশ হাজার গান রাখা যায়।
তাহলে কি গতিতে এগুচ্ছে টেকনোলজি। সেই গতি আরো দ্রুততর হবে। গতি তো কমবে না।  সেটা যদি দারিদ্র্য নিরসনে হোক, স্বাস্থ্য রক্ষার্থে হোক, পরিবেশ উন্নতিতেই হোক, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতেই হোক আমি যদি প্রয়োগ করি, কোনো সমস্যা টিকে থাকতে পারে? এটাই আমার প্রশ্ন।

সাপ্তাহিক : কিন্তু পৃথিবীর সমস্যাগুলোও তো নানা আকার ধারণ করছে ?
ড. ইউনূস : গোড়া তো একটাই। যত রকমেরই সমস্যার আকার হোক গোড়া তো এক জায়গায়। ব্যক্তিগত মুনাফা। এটাই হলো মূল সমস্যা। আমি ব্যক্তিগত মুনাফা থেকে ব্যবসাকে dealing করেছি। সেটাই হলো সামাজিক ব্যবসা। আমি যত কথা বলছি ঐটা হলো ডিলিং করা। হঠাৎ করে মানুষ চমকে উঠবে বলে কি এ লোক! মুনাফা ছাড়া দুনিয়া চলে কীভাবে ?
আমি বলি অসুবিধা হলে আপনি করবেন না। আপনি যেভাবে ব্যবসা করেন সেভাবে করতে থাকুন যারা চায় তারা এটা করুক।
বলি, ‘আপনার কোম্পানির ফাউন্ডেশন আছে? সে বলে, ‘হ্যাঁ, আমাদের একটা ফাউন্ডেশন আছে।’
আমি বলি তাহলে আমি ঐ ফাউন্ডেশনের সঙ্গেই কথা বলি। কোম্পানি কিন্তু একটা ফাউন্ডেশন বানিয়ে রেখেছে। ওটায় অনেক টাকাও আছে। ওখানে কিন্তু মুনাফার কোনো বিষয় নেই। ওটা চ্যারিটি।
কিন্তু এই যে চ্যারিটিকে যে কনভার্ট করা যায় এটা কারো মনে আসছে না। তারা বলেন, ব্যবসা ব্যবসাই, এখানে টাকার কথা আসবে। এখানে অন্য কথা আসবে না। সামাজিক কথা না, ব্যক্তিগত কথা না। এখানে ব্যবসা ব্যবসাই।
আমি ছেলেও বুঝি না, বাপও বুঝি না। আমাকে মুনাফা করতে হবে।

সাপ্তাহিক : আপনি যেভাবে ‘সামাজিক ব্যবসা’কে অভিহিত করছেন, তাহলে এটা তো মানুষের    চিন্তার জায়গাকে নাড়া দেয়ার মতো একটা বিষয়। আন্তর্জাতিক মহলে এর কি প্রতিক্রিয়া পাচ্ছেন?
ড. ইউনূস : আমার বইটা (Building Social Business : The New Kind of Capitalism that Serves Humanity’s Most Pressing Needs) প্রকাশিত হলো এ বছর। এক মাস আগে আমেরিকাতে প্রকাশিত হলো হলো। আগের বইটা ২০০৮-এ। দুই বছর হয়েছে মানুষ জানল। এ পর্যন্ত যা সাড়া পেলাম, কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘চেয়ার ফর সোশ্যাল বিজনেস’ সৃষ্টি হয়েছে। ফ্রান্সের সবচেয়ে টপ বিজনেস স্কুল HSC সোশ্যাল বিজনেস চেয়ার সৃষ্টি করেছে। আজকে দু’বছর হয়ে গেল। সেখানে আবার যে দুইজন কো-চেয়ারম্যান রেখেছে ঐ পজিশনটাকে গাইড করার জন্য। তার একজন হলেন ফরাসি মন্ত্রী, আরেকজন হলাম আমি এবং তারা এ বিষয়ে বহু কোর্স দিচ্ছে, বহু উদ্যোগ নিয়েছে।
আমি গ্লাসগো যাচ্ছি। গ্লাসগো ইউনিভার্সিটি হলো যেখানে এ্যাডাম স্মিথ শিক্ষকতা করতেন। ৭০০ বছরের পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়। সেখানেও তারা সৃষ্টি করেছে ‘ইউনূস চেয়ার ফর সোশ্যাল বিজনেস’ এবং ‘সেন্টার ফর সোশ্যাল বিজনেস’। দুটো জিনিস সৃষ্টি করেছে। এবং সেটাই উদ্বোধন করার জন্য আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি আরেকটা ইউনিভার্সিটি গ্লাসগো কালিডোনিয়া ইউনিভার্সিটি। তারা আবার আরেকটা প্রতিষ্ঠান করছে ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল বিজনেস। ওরাও লঞ্চ করবে। একই ট্রিপে যাতে আমি দুটোই করে আসতে পারি সেটার জন্য।
কাজেই ইউনিভার্সিটিতে একটা চেয়ার সৃষ্টি করা, ইনস্টিটিউট সৃষ্টি করা তো সোজা কাজ না। আমাদের এখানে যেমন বহু ঘাট পেরিয়ে যেতে হয় ওখানেও একই জিনিস, একই পদ্ধতি। বহু ঘাট পার হয়ে, টাকা কোথা থেকে আসছে, এটার একাডেমিক ভ্যালু কি, সবাইকে যৌক্তিকভাবে বোঝাতে হবে, সবার সম্মতি নিতে হবে তারপর এটা করা যাবে। এবং তারা করেছে।
আমেরিকাতে একটা ইনস্টিটিউট অব সোশ্যাল বিজনেস সৃষ্টি হয়েছে, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া, লস এ্যাঞ্জেলেসের কাছে, চ্যানেল আইল্যান্ড ক্যাম্পাসে। সেটা বিরাট উৎসব করে উদ্বোধন করা হয়েছে। কাজেই অল্প সময়ের মধ্যেই ইনস্টিটিউট, চেয়ার, সেন্টার এগুলো হয়ে গেল।
ব্যাংককে এআইটিতে ইউনূস সেন্টার অব এআইটি স্থাপিত হয়েছে শুধু সোশ্যাল বিজনেসকে উদ্দেশ্য করে।

সাপ্তাহিক : অর্থাৎ একাডেমিক জগতে এক ধরনের নাড়া পড়েছে পৃথিবীর অনেক জায়গায় সোশ্যাল বিজনেসের এই চিন্তাটা নিয়ে।
ড. ইউনূস : নাড়া পড়েছে। কোর্স হচ্ছে এবং এখন ইন্টারনেটে কোর্স দেয়ার জন্য আমাদের কাছে এ্যাপ্রোচ করছে যে, আমরা ইন্টারনেটে একটা সোশ্যাল বিজনেস কোর্স করব, তোমরা আমাদেরকে সাহায্য কর।

সাপ্তাহিক : এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থাটা কি?
ড. ইউনূস : বাংলাদেশে ২৮ জুন ২০১০ তারিখে একটা অনুষ্ঠান হয়ে গেল। ‘আইসেক’ বলে একটা ছাত্র সংস্থা, আইইউবি এবং এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব উইম্যান, তারা যৌথভাবে আয়োজন করেছে। ঐ তারিখটাকে তারা সোশ্যাল বিজনেস ডে বলবে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে, এই দিনটা পালন করা হয়েছে। টোকিওতে হয়েছে, টোকিও রিককিও ইউনিভার্সিটি, কিউসো ইউনিভার্সিটি, জোহান্সবার্গে, জার্মানিতে হয়েছে, নিউইয়র্কে হয়েছে, বিভিন্ন জায়গাতে হয়েছে সোশ্যাল বিজনেস ডে পালন। এখানে বাংলাদেশে তিনটা বিশ্ববিদ্যালয় এ পর্যন্ত সোশ্যাল বিজনেসের সঙ্গে জড়িত হয়েছে। এখন এরা ওটার ফলোআপ হিসেবে ইনস্টিটিউট করতে পারে, সেন্টার করতে পারে, কোর্স অফার করতে পারে। মূল জিনিস হলো একাডেমিক্যালি কোর্স অফার করতে হবে, তা না হলে এর কোনো মূল্য নেই। কোর্স অফার করতে হবে, রিসার্স ফ্যাসিলিটি থাকতে হবে, ইত্যাদি, ইত্যাদি। তাদের হয়ত সময় লাগবে। কারণ এখানে বিনিয়োগের ব্যাপার রয়েছে। এটা এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে হচ্ছে। কাজেই অল্প সময়ের মধ্যে আমি বলব যে ভালো সাড়া পাচ্ছি।

সাপ্তাহিক : বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করছে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এর অবস্থা কি? নীতিনির্ধারক পর্যায়ের লোকজনেরা কি এ নিয়ে উৎসাহ দেখাচ্ছে?
ড. ইউনূস : এটারও বর্ণনা কিছু আছে। সংক্ষেপে আমি বলি। সর্বপ্রথম জার্মানির একটা সিটি, ওয়েজবার্ডেন বলে একটা শহর, তারা আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করল। এটা ফ্রাঙ্কফুর্টের কাছে একটা শহর। তারা ঐ শহরে নিজস্ব উদ্যোগে সোশ্যাল বিজনেস তৈরি করতে চায় কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্য নিয়ে। আমি বললাম হ্যাঁ পারা যায়। সেটা তৈরি হতে হতে এখন তারা বলছে যে, আমরা ওয়েজবার্ডেন সিটিটাকেই ‘সোশ্যাল বিজনেস সিটি’ নাম দেব। আমরা বহু রকমের সোশ্যাল বিজনেস সৃষ্টি করব এখানে। ওখানকার মেয়র খুব আগ্রহী এ বিষয়ে।
আরেকটা হলো আমি গিয়েছিলাম কলম্বিয়াতে। সেখানে মাইক্রো ক্রেডিট সামিট হচ্ছিল। রিজিওনাল সামিট, পুরো ল্যাটিন আমেরিকার জন্য। সেখানে এক গভর্নর এসে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য খুব তোড়জোড় শুরু করলেন। বলছেন আমাকে একটু সময় দিতে হবে।
আমি শুনে বললাম যে, গভর্নরের সঙ্গে আমার কি আলাপ হতে পারে ?
বলল, যে, উনি চাচ্ছেন আপনাকে ঘণ্টাখানেক সময় দিতে হবে।
আমি বললাম, ঠিক আছে গভর্নর সময় চাচ্ছে, দিলাম।
উনি এলেন। তার স্টাফ নিয়ে মোট ৭ জন লোকসহ। উনি কাগজপত্র নিয়ে বসলেন। মুখ্য বিষয় হলো তার প্রভিন্সটার নাম হলো ‘কালদাস’। বললেন ‘কলম্বিয়ান কফি’ বলতে যে জিনিসটা সারা দুনিয়া চেনে কালদাস হলো সেই জায়গা যেখানে এই বিখ্যাত কফি জন্মায়। গত কয়েক বছর যাবত এই কলম্বিয়ান কফি এখন বাজার হারিয়ে ফেলেছে। কার কাছে? ভিয়েতনামের কাছে। এশিয়ার আরো কয়েকটা দেশ আছে তাদের কাছে হেরে গেছে। বলে, আমাদের আর কিছুই নেই। কলম্বিয়ান কফি কেনে না আর কেউ। এটার কোনো বাজারই নাই। কাজেই যারা কফির ক্ষেত্রে বিনিয়োগ নিয়ে এসেছিল বেশিরভাগ ইউরোপিয়ান, আমেরিকান ব্যবসায়ী তারা সব গুটিয়ে চলে গেছে।
আমাদের পুরো অর্থনীতিটাই ছিল ওয়ান ক্রপ ইকোনমি বা এক ফসলের ওপর নির্ভরশীল অর্থনীতি। কারণ এটা রমরমা জিনিস ছিল। সবাই এটা করত। এটা চলে গেছে, সব বেকার হয়ে গেছে। আমাদের আর আমাদের পার্শ্ববর্তী দুটো মোট ৩টা প্রভিন্সের অবস্থা এখন খুব খারাপ, যারা এই কফির ওপর নির্ভরশীল ছিলাম।
এলাকার যুব সমাজ তাদের বেকারত্ব ঘোচানোর জন্য এখন ড্রাগের চাষ করছে।
মেয়েরা পতিতা বৃত্তিতে চলে গেছে।
গভর্নর হিসেবে আমার দুঃখ, এ রকম হতচ্ছাড়া অবস্থায় কি একটা প্রভিন্সের দায়িত্ব পেলাম।
আমি সব শুনে বললাম, আমার কাছে কেন এগুলো বলছেন?
উনি বললেন, আমি যার কাছেই গেছি, সেই বলেছে ড. ইউনূসের কাছে যাও। তার কাছে অনেক সমাধান পাবে। সে একটা ভালো পরামর্শ দেবে। আমি তাই আপনার কাছে এসেছি, আমার লোকজনকে নিয়ে এসেছি। আপনি যা তথ্য চান আমি দেব, এখন একটা পরামর্শ দেবেন, আমার কি করতে হবে।
আমি বললাম, আমি এ রকম চিন্তাও করিনি কোনো দিন যে, কোনো গভর্নরকে আমি পরামর্শ দেব।
তবে আপনার কথা শুনতে শুনতে আমার মনে হলো আমি একটা কাজ আপনার সঙ্গে করতে পারি।
উনি বললেন, আপনি যা করতে বলেন আমি তাতেই রাজি আছি।
বললাম, আমি আপনার প্রদেশে কিছু সোশ্যাল বিজনেস শুরু করব। আপনি এর পেছনে সাপোর্ট দেবেন, দূরে থেকে। কাছে আসার দরকার নেই।
আমি আপনার এখানে প্রাইভেট সেক্টরে যারা আছেন তাদের সঙ্গে বসব। বসে বোঝাব যে, এই জিনিস ছাড়া তোমাদেরও ভবিষ্যৎ নেই, এদেরও ভবিষ্যৎ নেই। এসব বুঝিয়ে তাদের বলব এই – এই সোশ্যাল বিজনেস কর। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থানের জন্য সোশ্যাল বিজনেস শুরু কর।
জিজ্ঞেস করলাম, আপনার এখানে জমি কেমন? উনি বললেন, আমার জমি বিশ্বের সেরা জমি। উর্বর জমি। আমরা হলাম বিষ্যুবরেখার ওপর, আমাদের আবহাওয়া হলো দুনিয়ার সবচাইতে ভালো আবহাওয়া। চমৎকার আবহাওয়া। জমি অত্যন্ত উর্বর। যা উৎপাদন করতে চান তাই হবে।
তাহলে তো আমার আর কোনো চিন্তাই নেই। প্রথমে আমরা কৃষি কাজে হাত দেব। দেখব, কিভাবে কৃষির উৎপাদন বাড়ানো যায়। এটা আমরা করব। মার্কেটিং আমরা করব সোশ্যাল বিজনেস হিসেবে। অন্য দেশ থেকে অর্ডার নিয়ে আসব।
আরেকটা জিনিস নিশ্চিত করব, খাবার জিনিস আপনাদের নিজেদেরকে উৎপাদন করতে হবে। শুধু ক্যাশ ক্রপ (পধংয পৎড়ঢ়) করবেন, আর খাদ্যের অভাবে ভুখা মরবেন এটা হবে না। জিজ্ঞেস করলাম, আপনাদের এখানে কৃষকেরা অন্য সব ফসল আবাদ করে না কেন। বললেন, করার অভ্যাস নেই। ওরা গম, ভুট্টা, ডাল আবাদ কিছু জানে না। আমি বললাম, আপনাদের এটা করাতে হবে। নিজেদের ফসল নিজেদেরকেই ফলাতে হবে। লোক তো অল্প কয়জন, কাজেই অসুবিধার কি আছে।
যা হোক, এটার ফলোআপ হিসেবে আস্তে আস্তে অনেক বৈঠক হলো তাদের সঙ্গে। এখন সেখানে সোশ্যাল বিজনেস ফান্ড তৈরি হয়েছে, সোশ্যাল বিজনেস এ্যাক্টিভিটি তৈরি হচ্ছে এবং লোকজন গেছে সেখানে কাজ করতে। নানারকম সোশ্যাল বিজনেসের প্রস্তুতি চলছে।

সাপ্তাহিক : লোকজন গেছে মানে কি– এখান থেকেই গেছে?
ড. ইউনূস : এখান থেকে এখনো যায়নি। প্রধানত যাচ্ছে জার্মানি থেকে। জার্মানির কয়েক যুবক খুব উৎসাহ দিচ্ছে। তারা বলে যে, এটা আমরা করে দেব। তারা এগুলো করবে। তারা বিনিয়োগ জোগাড় করবে ইত্যাদি ইত্যাদি। কলম্বিয়ান তরুণদের দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে ব্যবসা পরিচালনার জন্য।
কাজেই কালদাস একটা ক্ষেত্র হলো।
মাঝখানে হাইতিতে ভয়াল ভূমিকম্প হলো। এর পর পরই দাভোসে শুরু হলো ওয়ার্ল্ড ইকোনমি ফোরামের মিটিং। আমাকে তো দাওয়াত করে প্রতি বছর। যেদিকেই যাই সবার কাছে একমাত্র হাইতির কথা। হাইতি ধ্বংস হয়ে গেল, টাকা উঠাও, টাকা দাও ইত্যাদি। পত্রিকা খুললেই টাকার কথা। আর সিএনএন সে সময় ২৪ ঘণ্টা লাইভ দেখাচ্ছে। আর দর্শকদের ইমোশনাল করে ফেলেছে। তাদের দুর্ভোগ দেখে আমেরিকাজুড়ে লোকে টাকা পাঠাচ্ছে হাইতির জন্য।
আমাকে একটা মিটিংয়ে নিয়ে গেল। হাইতির ওপর মিটিং। আমি মিটিংয়ে বললাম, দেখ, এটা খুব ভালো যে, মানুষ এমন রেসপন্স করছে। তবে আমার এটা খারাপ লাগছে।
তারা বলল, কি খারাপ?
আমি বললাম, এই যে বহু টাকা, বহু সম্পদ যাচ্ছে হাইতিতে। কিন্তু এটা ব্যবহার করার ক্ষমতা এখন হাইতির নেই। কোনো স্ট্রাকচার নেই, না সরকার আছে, না কিছু আছে। কিছু নেই। কাজেই এই সাহায্যের বড় অংশটাই নষ্ট হবে। এটা পকেটে ঢুকবে অনেকের, নষ্ট হবে অনেক, রাখার জায়গা নেই। হুকুম দেয়ার মানুষ নেই, সিদ্ধান্ত নেয়ার মানুষ নেই। কিছু নেই।
আমি বললাম, একটা সমাধান আমার মাথায় আছে, আপনারা যে যা দেন না কেন তার ১০ শতাংশ একটা সোশ্যাল বিজনেস ফান্ডে জমা করুন। রিলিফ দেয়ার পর্যায় শেষ হয়ে যাবে কিছুদিনের মধ্যে। কিন্তু আসল সমস্যা আসবে যখন মানুষকে কাজে লাগাতে হবে। তখন কিন্তু কিছুই করা যাবে না। তখন আপনাদের খুঁজে পাওয়া যাবে না। সিএনএনও অন্য আরেকটা বিষয় নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাবে। হাইতির কথা সবাই ভুলে যাবে। কাজেই ভুলে যাবার আগে ফান্ডটা তৈরি করে ফেলতে হবে। যে যা দিচ্ছ তার ১০ শতাংশ দিয়ে ফান্ডটা তৈরি করতে হবে। আমি এটার নাম দিলাম ‘সোশ্যাল বিজনেস ফান্ড ফর হাইতি।’
মিটিংয়ের পর একজন এসে বললেন, আপনি কথাটা ভালো বলেছেন। কিন্তু আপনি শুরু করেন না কেন?
আমি বললাম, আপনি টাকা দিলে আমি শুরু করব। আমার তো টাকা নেই, আমি ফান্ড করতে পারি না।
বললেন, আমি টাকা দেব।
আমি বললাম, ভালো। এর পর ঘোষণা করলাম ‘আমি সোশ্যাল বিজনেস ফান্ড ফর হাইতি’ সৃষ্টি করলাম। আমরা এই এই কাজ করব। তারপর সবাই যোগাযোগ করতে শুরু করল। এখন সেই ফান্ড তৈরি হয়েছে হাইতির জন্য।

সাপ্তাহিক : টাকা কি পরিমাণ এসেছে?
ড. ইউনূস : এখনো পুরো টাকাটা পাইনি। একটি প্রতিষ্ঠান পাঁচ মিলিয়ন ইউরো প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সেটা দিয়েই আমরা শুরু করেছি। আর কিছু টাকা এসেছে বিভিন্ন জায়গা থেকে। এখনো এ্যাকাউন্টের লিগ্যাল প্রসিডিউর শেষ হয়নি বলে এ্যাকাউন্টটা খোলা যাচ্ছে না কাজেই টাকা জমা হয়নি।
আইনগত প্রক্রিয়াটা শেষ হয়ে গেলেই প্রতিশ্রুত এই টাকাটা আমরা জমা নেব।
এটা দিয়েই ছোট ছোট সোশ্যাল বিজনেস শুরু করা হবে। কিভাবে ছেলেমেয়েদের প্রক্ষিক্ষণ দেয়া যায়, কাজে নামানো যায়। যেমন একটা বিরাট গাড়ি কোম্পানিকে বললাম যে, দেখো, বিনিয়োগ হিসেবে তোমরা যদি কয়টা গাড়ি দাও তবে আমরা একটা ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি করব সোশ্যাল বিজনেস হিসেবে। চলাফেরার জন্য এবং ছেলেমেয়েদের ভালো ট্রেনিং দিয়ে দেব, চালাবে তারা। এবং এটা সোশ্যাল বিজনেস হিসেবে হবে। তারা যাতায়াতেরও ব্যবস্থা পেয়ে যাবে,  নিজেদেরও চাকরির ব্যবস্থা হবে। পরে তোমরা যদি আরেকটা প্রশিক্ষণ দাও যে এদেরকে মোটর মেকানিক করা হবে। তবে এদেরকে মোটর মেকানিক বানাব, ভেতরেও রক্ষণাবেক্ষণের কাজ হবে, বাইরে চাকরি চাইলেও তারা করতে পারবে, গাড়িগুলোর মেইনটেন্যান্সও হবে। এরপর ফুড প্রসেসিং। হাইতিতে খুব ভালো আম হয়। আমি বললাম যে, হাইতিতে আমের প্রসেসিং যদি করতে পারি তবে তাতে আমাদেরও লাভ। আমরাও শিখলাম। আমাদের দেশে আমের ক্ষেত্রে সমস্যা হয়। যখন মৌসুম আসে প্রচুর আম হয় কাজেই নষ্ট হয় অনেক। যদি প্রসেসিংটা শিখে ফেলি, ড্রাই করা, স্টোর করা, প্যাকেট করা, জুস করা, তাহলে এখান থেকে আমের জুস করা, ম্যাংগো জুস, নানা রকমের প্রজেক্ট করা যেতে পারে। তারপর একটা মিটিংয়ে আসলাম নিউইয়র্কে।
একদিন একজন যোগাযোগ করল যে, আলবেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী আমার সঙ্গে দেখা করতে চান। আমি বললাম, তার সঙ্গে তো আমার কখনো দেখা হয় নাই। তিনি কি জন্য দেখা করতে চান? বলল, আপনার সঙ্গে জরুরি কথা আছে।  তিনি তখন নিউইয়র্কে আমিও তখন নিউইয়র্কে। আমি বললাম যে, আমার তো খুব টাইট সিডিউল, উনি যদি সকাল বেলা আসতে পারেন ব্রেকফাস্টে তাহলে আমরা হোটেলে বসে আলাপ করতে পারি। বললেন যে উনার কোনো অসুবিধা নেই। পরদিন সকালে উনি আমার হোটেল রুমেই চলে আসবে এই ব্যবস্থা হলো। বললেন, বাইরে রেস্টুরেন্টের চেয়ে হোটেল রুমেই ভালো। কারণ বাইরে আশপাশের লোকেরা আপনাকে দেখলে নিয়ে যাবে। আমি তাই রুমেই আসব।
তিনি তার চার সঙ্গীকে নিয়ে আমার হোটেল রুমে এলেন। তার আবেদনও ওই কালদাসের মতো। বললেন, আমরা হলাম ইউরোপের সবচাইতে গরিব দেশ। ইউরোপ শুনলে মনে করে আমরা বোধহয় বড় লোক। কিন্তু আমাদের গরিবের অবস্থা দুনিয়ার যে কোনো গরিবের মতোই। অথচ আমরা একটা সম্পদশালী দেশ। ছোট একটা দেশ কিন্তু অসংখ্য গরিব। এর কোনো সমস্যার সমাধান আমরা করতে পারছি না। বহু বিদেশি সাহায্য আসে কিন্তু আমরা পাচ্ছি না। বললেন,  আপনি কি আমাদের কোনো পরামর্শ দিতে পারবেন?
আমি তো ইতোমধ্যে কালদাস করে এসেছি। হুবহু কালদাসে ঘটনাও তাকে বললাম। বললেন আমি রাজি, আপনি যা করতে চান। বললাম, আমি লোক পাঠাবো তারা বসে আপনাদের স্টাফদের সঙ্গে ডিজাইন করবে যে কি করতে হবে এবং আপনি যদি আমাদের অনুমতি দেন তো আমরা সোশ্যাল বিজনেস ফান্ড করব। সোশ্যাল বিজনেস ফান্ড ফর আলবেনিয়া এবং আমরা একটা সোশ্যাল বিজনেস ট্রাস্ট করব। যেটার মারফতে আমরা বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে আলাপ করে কাজ শুরু করব। উনি রাজি হয়েছেন এবং আমাদের লোকজন গেছে। গিয়ে কাজ করছে।
কয়েকটা ইনিশিয়েটিভ চিহ্নিত করা গেছে। একটা হচ্ছে আলবেনিয়ার প্রচুর হেজেল নাট হয়। ওটা তারা প্যাকিং, প্রসেসিং করে রপ্তানি করবে ইউরোপে। ইউরোপে এটার ভালো বাজার আছে। এটা একটা সোশ্যাল বিজনেস হবে। এটা সবাইকে টাচ করবে। এটা সর্বত্র হবে। এটার ভেতর দিয়ে যদি আয় হয় তবে অনেকেই আয়ের সুযোগ পাবে। দ্বিতীয়ত হলো যে, খুবই সুন্দর দেশ আলবেনিয়া। ট্যুরিজমটা ওখানকার একটা বিরাট সম্ভাবনা। ইতোমধ্যে ট্যুরিজম ব্যবসার শীর্ষে আছে এমন এক কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা সিইও-র সঙ্গে বৈঠক করলাম।
তাকে বোঝালাম, আলবেনিয়াতে আমরা একটা ট্যুরিজম ব্যবসা করতে চাই, তবে সেটা সোশ্যাল বিজনেস হবে।
তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ট্যুরিজম কিভাবে সোশ্যাল বিজনেস হবে?
বললাম, আমার একটা আইডিয়া আছে, তবে আপনার সঙ্গে আলাপ করলে হয়ত আরো পরিষ্কার হবে। উনি খুব উৎসাহী মানুষ। তার স্পেশালিটি হলো বিশ্বের সবচেয়ে ধনী লোকদের বিশ্ব ভ্রমণের আয়োজন করা। আমি বললাম, ‘আপনার ক্লায়েন্টদেরকে নিয়ে আসবে আলবেনিয়াতে। আমরা রাখব তাদের গরিবের ঘরে। তারা তো থাকে বিরাট বিরাট প্রসাদে, আমরা রাখব গরিবের ঘরে। আপনার লোকজন এসে গরিবের ঘরে কি রকম অবস্থা হলে থাকার মতো পরিবেশ হবে এটা আগে থেকে ঠিক করে রাখব। কোন কোন ফ্যামিলিতে কে কে থাকবে আগে থেকে ঠিক করে রাখব। পারিবারিকভাবে তো এদের দেখা-সাক্ষাৎ হয় নাই। এদের দেখা সাক্ষাৎ হওয়া উচিত। তারা বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে আসবে, এদেরও বাচ্চা-কাচ্চা আছে, পরস্পরের পরিচয় হবে, ভবিষ্যতে ই-মেইল এক্সচেঞ্জ হবে। নানারকম সম্পর্ক গড়ে উঠবে। এবং তারও একটা স্মরণীয় জিনিস হবে, একটা গরিব পরিবারের সঙ্গে সে এক সপ্তাহ কাটিয়ে এসেছে। আর যদি ঘর ঠিকমতো পাওয়া না যায় তবে আমরা হাউস বোট করব। এই হাউস বোটে গরিব পরিবার থাকবে ট্যুরিস্ট পরিবারও থাকবে এবং একেক জোড়া পরিবারের জন্য আমরা একেকটা হাউস বোট করে দেব।
তিনি বললেন, চমৎকার আইডিয়া। এটা তো করা যাবে। এতে গরিব-ধনী উভয় পক্ষের লাভ হবে।
আমি বললাম যে, এটা একটা ভালো ট্যুরিজম ব্যবসা হতে পারে। অসংখ্য লেক আছে। হাউস বোট তৈরি করা সমস্যা না আলবেনিয়ায়। তিনি নিশ্চিত করলেন যে, ক্লায়েন্টদের ওখানে নিয়ে যাওয়া নিয়ে তার জন্য কোনো সমস্যা নেই। কাজেই সেটাও ডেভেলপ করছে। শেষ পর্যন্ত এটা কি হয় জানি না কিন্তু উনি এটা পছন্দ করলেন। কাজেই ওই যে রাষ্ট্রীয়ভাবে যেটা বললেন, সেটা এভাবে এসেছে।
ইস্ট তিমুরের প্রেসিডেন্ট নবেল বিজয়ী ড. রামোস হোর্তা আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন তার দেশে সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে নানা সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ নেয়ার জন্য। বাংলাদেশ থেকে আমরা আগামী মাসে ৪ জনকে পাঠাচ্ছি একটা পরিকল্পনা তৈরি করার জন্য।
মস্কোর মেয়র লুসকড। আমি মস্কো গেলাম, লুসকড আমাকে খুব সমাদর করলেন। সোশ্যাল বিজনেসটা তার মাথায় খুব ঢুকেছে। লুসকডের সঙ্গে আবার রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী পুতিন আর প্রেসিডেন্ট মেদভেদেভের খুবই ঝগড়া। মেদভেদেভ তো কিছুদিন আগে ওর বিরুদ্ধে পত্রিকায় স্টেটমেন্ট দিয়েছেন। কারণ সে খুব ক্ষমতাশালী লোক। পুরো মস্কো তার নিয়ন্ত্রণে। মস্কো যার নিয়ন্ত্রণে পুরো রাশিয়া তার নিয়ন্ত্রণে এবং তার স্ত্রী হলেন দেশের সবচেয়ে ধনী মহিলা। মস্কো শহরের দুষ্ট লোকেরা বলে অর্ধেক রিয়েল এস্টেট তার স্ত্রীর। উনি সোশ্যাল বিজনেস সাংঘাতিক পছন্দ করেছেন। বললেন, আমার এখানে অসংখ্য বেকার। আমি চাকরি দিতে পারছি না। আপনি বলছেন যে, সোশ্যাল বিজনেসে কর্মসংস্থান হবে। আমি বললাম, সোশ্যাল বিজনেসে চাকরিও দেয়া যাবে। উনি বললেন, তবে আপনি আমার এখানে সোশ্যাল বিজনেস করে দিন, যা লাগে আমি দেব।
কাজেই সেদিকে আমার একটা লিংক হয়েছে এখন সেটা ডেভেলপ করতে হবে। দেখতে হবে কিভাবে কাজ করা যায়। আমি বলেছি, ছোট আকারে শুরু করব আমি যদি সফল হই তবে তার সম্প্রসারণ করা হবে। তবে সরকার থেকে আমাকে দূরে রাখবেন।
কারণ সরকারের আমলাতন্ত্রের মধ্যে পড়ে গেলে আর কিছুই হবে না। কাজেই আপনি সাপোর্ট দেবেন, ফান্ড যোগাড় করে দেবেন, আমরা ব্যবসায় তৈরি করে দেব। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি চাকরি ক্ষেত্র তৈরি করবেন কিভাবে? আমরা তো মানুষকে ফ্রি টাকা দিয়ে যাচ্ছি। কিছু হয় না তো। আমি বললাম, ফ্রি টাকা দিলে হয় না। ফ্রি টাকা দিলে ওরা খেয়ে বসে থাকে।
যা হোক আমি বললাম, আমাদের জন্য সোজা এই কাজটা এ জন্য একজন ব্যবসায়ী যখন বিনিয়োগ করে তখন তার বিনিয়োগ থেকে চাকরি তৈরি হয়। ব্যবসায়ীর লক্ষ্য হলো মুনাফা অর্জন। এই মুনাফা অর্জন করতে গিয়ে তার বাইপ্রোডাক্ট হিসেবে চাকরি আসে। জবটা তার মাথায় প্রথম আসে না। ব্যবসার কারণে কর্মসংস্থান হয়, এ্যাকাউন্ট্যান্ট কয়জন লাগবে, কেরানি কয়জন লাগবে ঐ ব্যবসার মাপে সেটা সৃষ্টি হয়। কাজেই কর্মসংস্থান তার মুখ্য বিষয় নয়। এটা হলো তার মুনাফা অর্জনের জন্য একটা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। এখান দিয়ে উঠে তিনি মুনাফাটা ধরেন।
আর সে বিনিয়োগ করার আগে তিনি যে চিন্তা করেন সেটা হলো তার বিনিয়োগের ওপর কমপক্ষে ৩০ শতাংশ রিটার্ন হতে হবে। না হলে তিনি এটার ধারে কাছে আসবেন না। কারণ তার চাইতে আরো ভালো বিনিয়োগ সুযোগ তার আছে সে ওদিকে চলে যাবে। আর সোশ্যাল বিজনেসের মজা হলো সোশ্যাল বিজনেস শুরু হয় সমস্যাটাকে সমাধান করার জন্য। ৩০% রিটার্ন অব ইনভেস্টমেন্টের কথা তিনি চিন্তাই করেন না। সাসটেইনবল হলেই হলো।

সাপ্তাহিক : যেটার মধ্যে একটা আনন্দের ব্যাপার থাকে…
ড. ইউনূস : শুধু আনন্দ নয়। প্রথম হলো সমস্যাটা কি? সমস্যাটা আনএমপ্লয়মেন্ট। আমাকে এই সমস্যাটার সমাধান করতে হবে। শুধু আনন্দ আনে বললে হবে না। ধরুন আমি চাচ্ছি সিঙ্গেল মাদার যারা আছে তাদের এমপ্লয়মেন্ট অথবা অন্ধ ও বধির তাদের কর্মসংস্থান। অর্থাৎ আমি আগে ঠিক করি কাদের জন্য এই সোশ্যাল বিজনেস হবে। অশিক্ষিত লোকের জন্য আমি কর্মসংস্থান সৃষ্টি করব। তাহলে আমাকে ব্যবসাটা করতে হবে এই অশিক্ষিত মানুষের জন্য একটা ব্যবসা তৈরি করা। তাহলে আমার মেইন পারপাস হলো খুবই নির্দিষ্ট গ্র“পের মানুষের জন্য কর্মসংস্থান। কাজেই এটা ভিন্ন। আর আমি যখন এটা করি আমি চিন্তা করি না যে, আমার ৩০ শতাংশ রিটার্ন লাগবে এটা থেকে। আমি চিন্তা করি আমার শূন্য শতাংশ রিটার্ন হলেও হোক, টাকাটা ফেরত আসুক, মুনাফা লাগবে না। জিরো পারসেন্ট হলেও খুশি। এই যে জিরো থেকে ৩০ শতাংশ জায়গা এটাতে কোনো দিন কোনো মুনাফাধারী ব্যবসায়ী আসবে না। সোশ্যাল বিজনেস খুব দ্রুত এবং সহজেই সেখানে ঢুকে যাবে। কাজেই এই যে স্পেস, এই স্পেসে বহু চাকরি অপেক্ষা করছে। সোশ্যাল বিজনেস দ্বারা ঐ জায়গাটা পূর্ণ হবে এবং স্প্যাসিফিক জব এটা।
এ প্রসঙ্গে আমাকে একজন একটা প্রশ্ন করেছিলেন আমার কাছে মজা লেগেছে, প্রশ্নটাও আবার তাৎক্ষণিক উত্তরটাও আমার কাছে মজা লেগেছে। প্রশ্নটা ছিল, যদি যে কোনো লোকের জন্য জব তৈরি করা যায়। বলেন তো তাহলে অন্ধের জন্য আপনি কি চাকরি তৈরি করবেন? অন্ধের জন্য কি সোশ্যাল বিজনেস করবেন? আমি বললাম, আমি তো চিন্তা করি নাই আগে। তবে এ রকম হতে পারে অন্ধের জন্য একটা কল সেন্টার করব যেখানে শুধু অন্ধ ব্যক্তি কাজ করবে। তার কাছে কল আসবে সে খুব সুন্দর করে, মিষ্টি করে কথা বলবে, কল সেন্টারের জন্য তার মিষ্টি গলাটা দরকার, তার তো চোখ দরকার নেই আমার।
যে টেলিফোন করছে সে তো জানে না অন্ধের সঙ্গে কথা বলছে।
আবার জিজ্ঞেস করল বোবা ও কালাদের জন্য কি করবেন? কথাও বলতে পারে না, কানেও শুনতে পায় না ওদের জন্য একটা পিৎজারিয়া (পিৎজা বানানোর দোকান) করে দেবে। পিৎজা বানাবে তারা।
আমি বললাম, ১০ জন বোবা ও বধির লোক নেব। ওদেরকে স্পেশালাইজড করে ফেলব পিৎজা বানানোর জন্য। খুব সুন্দর পিৎজা বানাবে এরা। কেননা পিৎজা বানানোর জন্য না লাগে কান, না লাগে মুখ। কিছু লাগে না। তারা কিচেনে কাজ করবে। আমার পিৎজারিয়ার পিৎজা লোকে খায় আর তারিফ করে। লোকে তো জানে না কারা বানাচ্ছে। লোকে তো কথা বলে যারা পরিবেশন করছে তাদের সঙ্গে। লোকে সুন্দর পিৎজা খাচ্ছে। কে পিৎজা বানাচ্ছে সে কানে শোনে কি না, কথা বলে কি না তা নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই।
আমি বললাম, মাথা খাটালে এর চেয়ে আরো অনেক ভালো বুদ্ধি আসবে। বুদ্ধিটা খাটাতে হবে যেহেতু সমস্যাটা আছে। সমস্যা না থাকলে আমি বুদ্ধিটা খাটাব কোত্থেকে? আমরা তো এভাবে চিন্তা করি না যখন আমি মুনাফা তৈরি করি। আমি যখন প্রফিটমেকিংয়ে যাই তখন ভাবি কি করলে ভালো হবে। জনপ্রিয় কোম্পানির ডিলারশিপ নিলে ভালো হবে, না কি এখানে চানাচুরের দোকান দিলে ভালো হবে। আমি চিন্তা করি কোনটাতে মুনাফা বেশি। আমি তো এভাবে চিন্তা করি না যাতে এই ধরনের লোকের চাকরির ক্ষেত্র তৈরি হবে, জীবিকা হবে এবং ব্যবসার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। মানুষ কিভাবে চিন্তাটা খাটায় সেটা তার ওপর নির্ভর করে ফলাফল।

সাপ্তাহিক : কাজটি সম্পন্নের জন্য দক্ষ জনশক্তি তো দরকার?
ড. ইউনূস : এটা ঘটনা থেকেই সৃষ্টি হবে। এটা তো আর আগে থেকেই কেউ করেনি। যেমন যদি এটা পাঠ্যপুস্তকে এসে যায় তবে সেখান থেকে লোক তৈরি হবে।

সাপ্তাহিক : এটা তো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।
ড. ইউনূস : সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। এটা হলো দীর্ঘমেয়াদি। এখন যেহেতু কোর্স শুরু হচ্ছে, কোর্সে এগুলো ডিসকাস হবে আপনারা যারা কিছু জিজ্ঞেস করছেন, ছাত্ররাও জিজ্ঞেস করবে এগুলো কি করে হবে? শিক্ষককে তখন জবাব দিতে হবে এটা এভাবে হবে।
না না এটা কিভাবে পারবেন?
এটা এভাবে হবে।
হ্যাঁ, হ্যাঁ। তাই তো, তাহলে এটা এভাবে হবে।
তারপর তাকে টাস্ক দেয়া হলো ক্লাসের জন্য। তোমাদের এই ত্রিশজন এটা আগামী সপ্তাহে সাবমিট করবে। প্রত্যেককে একটা সোশ্যাল বিজনেস প্ল্যান সাবমিট করতে হবে। সাবজেক্টটা হলো আমরা দশজন লোকের কর্মসংস্থান করব এবং এই দশজন লোক সবাই খাটো, লেখাপড়া জানে না এবং আগে কোনোদিন চাকরি করেনি। এই ধরনের দশটা লোকের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। এবং এমন ধরনের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে সে সুখী হয় তবে উপার্জন নিয়ে, কাজের পরিবেশ নিয়ে।
তখন ৩০ জনে ৩০টা পরিকল্পনা নিয়ে চলে আসবে। এটা একটা এক্সারসাইজ হলো। এর মধ্য থেকে হয়ত একজন খুব সুন্দর একটা জিনিস বের করল। সবাই বলল, ভারি চমৎকার! শিক্ষক বলল, হ্যাঁ তোমাকে A+ দেব। এটাকে আমরা ওয়েবসাইটে দেব। আমরা যদি চেষ্টা করি তাহলে কেউ হয়ত এটাতে বিনিয়োগ করবে। চল আমরা সোশ্যাল বিজনেস ফান্ডের সঙ্গে যোগাযোগ করি। এভাবেই হবে।
কাজেই একটা সৃষ্টিশীল প্রতিযোগিতায় লাগিয়ে দিলে বহু জিনিস বের হয়ে আসবে। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এ বিষয়ক একটা প্রতিযোগিতা লাগিয়ে দিলে এ রকম বহু জিনিস বেরিয়ে আসবে। যেটা আপনার আমার মাথায় স্বপ্নেও আসেনি কখনো।

সাপ্তাহিক : এই যে সারাক্ষণই এ কাজগুলো নিয়ে চিন্তা করছেন, অনেক সময় সমালোচনা হয় যে, অন্যান্য কাজে অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে যাওয়ার কারণে মূল প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকও ঠিকমতো চলছে না…
ড. ইউনূস : গ্রামীণ ব্যাংক খুব সুন্দরভাবে চলছে। এটা নিয়ে আমাদের কারো মনে হয়নি যে আমাদের অসুবিধা। এটা তো আজকে না, এটা বরাবরই এমন ছিল। গ্রামীণ ব্যাংকের ভেতরেও প্রতিনিয়ত নতুন নতুন জিনিস করছে। এর বাইরেও করছে। একের অভিজ্ঞতা অন্যটিতে কাজে লাগে।

সাপ্তাহিক : সবই কোম্পানির মতো করে চলছে?
ড. ইউনূস : হ্যাঁ, সবই কোম্পানির মতো চলছে। প্রত্যেকটা তো গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার।

সাপ্তাহিক : এই যে আপনি সোশ্যাল বিজনেসের ধারণাটা দিচ্ছেন এটা চমৎকার একটা জিনিস এবং এটা যখন ছড়িয়ে পড়বে তখন নিশ্চয় নতুন একটা কিছু আমরা দেখব। কিন্তু পৃথিবীতে এখন নানারকম যে সমস্যা তৈরি হচ্ছে, রাজনৈতিক সমস্যা, সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ এই সমস্যাগুলো আমরা মোকাবিলা করব কিভাবে?
ড. ইউনূস : এ নিয়ে থিওরিটিক্যাল বক্তব্য তো আগেও দিয়েছি। আমার নোবেল বক্তব্যেও কিন্তু ছিল, দারিদ্র্য সন্ত্রাসের একটি বড় কারণ। যে গরিব সে অনেক বেশি ডেসপারেট। যে কোনো লোক তার হাতে বন্দুক একটা দিয়ে যদি বলে যে, তোকে টাকা দেব তুই এই খুনটা করে আয়। সে করে। সে খুশি হয়। তার ভাতের ব্যবস্থা হয়ে গেল। এটা বড়লোকের ছেলেও করতে পারে। এ রকম যে করে না তা কিন্তু নয়। এটা প্রতিরোধ করতে হবে। যেমন আমরা গরিবের ছেলেমেয়েকে একটা উদ্দেশ্য নিয়ে খাওয়ালাম, পরালাম, এমন একটা বিশেষ কাজের উদ্দেশ্যে, মা-বাবাও বেঁচে গেল যে, খাওয়াতে, পরাতে হয় না।
এটা তো গেল একটা, আরেকটা হলো– সন্ত্রাসবাদের একটা বড় কারণ হলো অবিচার। হয় তার দারিদ্র্য, অবহেলা ইত্যাদি তাকে সন্ত্রাসবাদের দিকে ঠেলে দেয়। রাজনৈতিক অবিচার, আমার যত মানসম্মান কেড়ে নিয়েছে, আমার স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে ইত্যাদি যে কোনো একটা রাজনৈতিক কারণ। কিংবা পুরো জাতিগোষ্ঠীকে দেশ থেকে বের করে দিয়েছ। আমার দেশকে তোমরা কেড়ে নিয়েছ আমার থেকে।  সে তখন মারমুখী হয়ে পড়ে। তার যত টাকা, যত পয়সা থাক সব কিছু নিয়ে সে শক্রর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যায়।
আমার ক্ষমতা নেই, আমার যে শক্তি তা দিয়ে আমি সম্মুখ যুদ্ধ করতে পারি না, কাজেই আমি গোপন যুদ্ধ করি, যেটাকে আজকাল বলছি সন্ত্রাসী। যাদেরকে আমরা গেরিলা বলছি কিংবা বিচ্ছিন্নতাবাদী বলছি এটা একটা সামাজিক দিক।
এরপর হলো ধর্মীয় দিক। ধর্মীয় কারণে হতে পারে। আমার ধর্মে আঘাত করেছে। তোমার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পারছি না। আমার ধর্মকে অপমান করছে। এ রকম সেন্স অব ইনজাস্টিস যেটা সঠিকও হতে পারে আবার অমূলকও হতে পারে। এটা ভুল ধারণার বশবর্তী হয়েও হয়। কেউ আপনাকে আঘাত করেনি কিন্তু আপনি মনে করছেন আপনাকে আঘাত করেছে। কাজেই এটা বাস্তবও হতে পারে আবার কাল্পনিকও হতে পারে। কিন্তু তার কাছে এটা বাস্তব। তার কাছে এটা সমান। সে তখন এটার জন্য লড়ে।
এখন যদি সেটা ধর্মীয় হয় তবে আমাকে ধর্মীয়ভাবেই সেটার সমাধান করতে হবে। আমার মূল বক্তব্য হলো যুদ্ধ করে টেরোরিজম বা সন্ত্রাসবাদ শেষ করা যাবে না। যুদ্ধ করলে সন্ত্রাসবাদ আরো বাড়ে। কারণটাকে বের করে সেটাকে সমাধান করতে হবে। অবিচারটাকে সমাধান করতে হবে।

সাপ্তাহিক : ইরাক বা ফিলিস্তিনের সমস্যা যে প্রক্রিয়াতে সমাধান করা হচ্ছে আপনি কি তাকে ঠিক মনে করেন?
ড. ইউনূস : এই প্রক্রিয়াটা ঠিক নয়। যুদ্ধ করে, গায়ের জোরে এর সমাধান ঠিক নয়। গায়ের জোরে চাপা দিয়ে রাখতে পারা যায়। এদিকে চাপা দিলে ওদিকে বের হবে এবং ভয়াবহ আকারে বের হবে। কারণ সে দেখছে যে, আপনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সে পারছে না। তখন সে সন্ত্রাসবাদের মাত্রাটাকে আরো বাড়িয়ে দেবে।

সাপ্তাহিক : যে কথাগুলো এখন বলছেন পশ্চিমাদের কাছে যখন বলেন, ওরা আপনার এই কথাগুলো কিভাবে নেয়?
ড. ইউনূস : তাদের প্রতিক্রিয়া হচ্ছে আমরা চেষ্টা করি এটার সমাধান করার জন্য। কিন্তু তারা যেভাবে আমাদের ওপর আঘাত হানে আমরা তো সে চেষ্টায় সফল হতে পারি না। তারা বলে আমরা তো চেষ্টা করছি কিন্তু আয়ত্তে আনতে পারছি না। তারা তো আমাদের কথা মানছে না। আমরা তো চাচ্ছি না যে, যুদ্ধ করে তাদের দমিয়ে রাখি। কিন্তু আমাদের কথা তো তারা শুনছে না।

সাপ্তাহিক : আমাদের দেশে একক প্রচেষ্টায় অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান তৈরি হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠাতা ব্যক্তিদের অনুপস্থিতিতে এসব প্রতিষ্ঠান কিভাবে সার্ভাইভ করবে? এটার দার্শনিক কোনো ব্যাখ্যা আছে?
ড. ইউনূস : অন্য যে কোনো অর্গানাইজেশনের মতো এর ভবিষ্যৎ নির্ধারিত হবে। হয় আরো ভালো হয়, না হয় খারাপ হয়, না হয় আগের মতোই চলে। তিনটা অপশনের বাইরে যায় না। হয় ভালো, না হয় মাঝামাঝি, কিংবা খারাপ হয়।
যে কোনো একটা ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হয়ত বাবা তৈরি করে দিয়ে গেছেন, ছেলেরা এটার দায়িত্ব নেয়। ছেলেদের হাতে হয়ত খারাপ হয়, কিংবা দেখা যায় ছেলে বাপের চাইতে আরো ভালো করছে। অথবা ছেলেরা মারামারি করে জিনিসটাকে নষ্ট করে ফেলেছে। পরিবারের বেলায়ও ঠিক তাই।

সাপ্তাহিক : গ্রামীণ ব্যাংক-এর বেলায়?
ড. ইউনূস : যেহেতু এটাও একটা প্রতিষ্ঠান, কাজেই যেই মাত্রই আমার এই পদটা শূন্য হবে আরেকজনকে তা দেয়া হবে। কী পরিস্থিতিতে এবং কী প্রক্রিয়ায় এই পরিবর্তন আসে তার উপরও অনেক কিছু নির্ভর করবে। প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ নতুন ব্যক্তির গুণাগুণের ওপর নির্ভর করবে।  আর নির্ভর করবে সহকর্মীদের কি পরিমাণ আস্থা আছে তার ওপর।

সাপ্তাহিক : এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে যেটা হয় যে, বানিয়েছেন আপনি কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের ভালোবাসার মানুষের সংখ্যা অনেক। তারা এই প্রতিষ্ঠানের অবস্থা আরো ভালো দেখতে চায়। এ অবস্থায় ড. ইউনূস মাইনাস হয়ে গেলে তখন এটা আদৌ থাকবে কি-না? আদৌ চলবে কি-না?
ড. ইউনূস : এটা কল্পনার বিষয়। কেউ জবাব দিতে পারবে না। তবে এটা নির্ভর করবে যে এটার পদে, এই দায়িত্বে যিনি আসবেন তার ওপর। তার দুটো কাজ থাকবে। একটা হলো, যারা এর ভেতরে কর্মরত আছে তাদের একটা সমর্থন আদায় করা। এটা একটা বিশাল প্রতিষ্ঠান। ২৭ হাজার ছেলেমেয়ে এখানে কাজ করে। কাজেই তাদের একটা জোরালো সমর্থন যদি না থাকে তাহলে বড় রকম সমস্যা হবে। সরকারি বেতন কাঠামো অনুসারে বেতন বাড়ানোতে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যয় হঠাৎ করে বিপুল পরিমাণে বেড়ে গেছে। অথচ আয় আগের মতোই রয়ে গেছে।  আর্থিকভাবে এটার মোকাবিলা করাটাও একটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে আসবে। কাজেই আমার পরে এই পজিশনে কে আসছে এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে।

সাপ্তাহিক : এটা গুরুত্বপূর্ণ ঠিক আছে কিন্তু ‘এ’র পরে ‘বি’, ‘বি’র পরে ‘সি’– এ রকম কোনো সম্ভাব্য লোক কি তৈরি করা সম্ভব হয়েছে?
ড. ইউনূস : এই প্রশ্নের উত্তর আমরা তো বিগত ৩০ বছর ধরে দিয়ে আসছি। এভাবে বলি যে, কোনো যুবরাজ তৈরি করা ভালো না। কারণ যুবরাজ হবার কারণেই সে নিজের সর্বনাশ নিজেই ডেকে আনতে পারে। যখন সমস্যা আসবে তখন কে যোগ্য লোক সে বের হয়ে আসবে সমাধান নিয়ে। তাকে সুযোগ দিতে হবে বের হয়ে আসার । আমি যদি ৩০ বছর আগে যুবরাজ ঠিক করে রাখতাম তবে এই যুবরাজই নানা সমস্যার সৃষ্টি করত। কাজেই যুবরাজদের মধ্যে না গিয়ে সিস্টেমে যেতে হবে।
পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী কে হবেন সেটা সিস্টেমের বাইরে গিয়ে যদি এখনি ঘোষণা দিয়ে দিই যে, ‘এ হবে আগামীর প্রধানমন্ত্রী, একে আগে থেকেই স্যালুট করে রাখ’। তাহলে তো সমস্যা হবেই।
সে জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। সময়মতো গিয়ে দেখা যাবে কি হবে? একজন যাবেন, আরেকজন আসবেন, এটাই হলো সিস্টেম।
পদশূন্য হলেই তা পূরণের প্রক্রিয়াতে যেতে হবে। পদ্ধতিমাফিক হবে।

সাপ্তাহিক : এবার ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। একটা দেশের পরিবেশ কেমন থাকলে দেশ পরিচালনায় যারা থাকবেন তাদের আচার-আচরণ কেমন হলে উন্নয়ন ধারাবাহিকভাবে চলবে?
ড. ইউনূস : মূলত সব জায়গায় এক। ‘রুলস অব ল’। আইনের প্রতি আস্থা আছে সবার এবং জানে যে, আইন মতে কাজ হবে। ব্যস এটা হলেই যথেষ্ট আর কিছু দরকার নেই। সরকারের সবচাইতে বড় দায়বদ্ধতা হলো যেন আইনমতো কাজ হয়, আইনের বরখেলাপ না হয়। এটা জানতে পারার মতো শান্তি নাগরিকের জন্য আর কিছু নেই।

সাপ্তাহিক : আমরা কি সেদিকে যাচ্ছি?
ড. ইউনূস : এটা মানুষের সামগ্রিক অনুভূতির বিষয়।  মানুষ কি মনে করছে সেটা হলো বড় কথা। 

সাপ্তাহিক : সামগ্রিকভাবে সব সরকারের জন্যই কি এই চাওয়া?
ড. ইউনূস : হ্যাঁ, আমি সব সরকারের কথাই বলছি। সব সরকারের সব চাইতে বড় দায়বদ্ধতা হলো আইন অনুযায়ী চলা।
ওই আস্থা যে, আমি অপরাধ করলে পুলিশ ধরবে এটা আমি জানি। যেমন সিঙ্গাপুরে হয়। সামান্য আইন ভাঙলেই পুলিশ কোথা থেকে এসে হাজির হয়। ধরে ফেলে। ওখানকার জনগণের এসব আইন মুখস্থ। মুখ থেকে চুইংগাম ফেললেই পুলিশ এসে ধরবে। জরিমানা করবে। সে যদি আমেরিকার প্রেসিডেন্টের ছেলে হয়– তাকেও মাফ করবে না। এটাই আইন।
এটাই নাগরিকদের জন্য বড় সান্ত্বনা। অনেক সময় কষ্ট হবে মনে যে, আমার ছেলেটাকে এমন শাস্তি দিল! কিন্তু মেনে নিতে হবে। কারণ আমি জানি যে, এটাই আইন।
এটা ঠিক থাকলে বাকি সব আস্তে আস্তে শৃঙ্খলার মধ্যে এসে যাবে। শৃঙ্খলাটা আসল। আইন যদি পছন্দ না হয় তবে আইন পছন্দমতো করে নেব। আইন বদলাব। কিন্তু আইন থাকা অবস্থায় সেটাকে অমান্য করব, এটা হলে আর হবে না। আমি জানি যে, রাস্তার উল্টোদিকে যাওয়া অন্যায়, বেআইনি। তবু আমি যাব। কারণ আমি জানি যে, উল্টো দিকে গেলে, আমাকে ধরলেও কিছু টাকা দিলেই ছেড়ে দেবে। আমি যদি খুনও করি, দশজনের সামনেই খুন করি, আমি জানি আমার কিছু হবে না। কেউ আমাকে ধরতে পারবে না। এ রকম হলে কেউ আর নিরাপত্তায় থাকে না। এইটা বুঝতে হবে।

সাপ্তাহিক : সোশ্যাল বিজনেস নিয়ে বাংলাদেশের সরকারের কেউ কি আপনার সঙ্গে কথা বলেছে?
ড. ইউনূস : না, এটা নিয়ে সরকারের কারো সঙ্গে আমার আলাপ হয়নি।

সাপ্তাহিক : বাংলাদেশে তরুণদের জন্য আপনাকে যদি কিছু বলতে অনুরোধ করি…
ড. ইউনূস : সব তরুণকেই বলব, আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে একটা বিশেষ ক্ষমতা আছে। সে ক্ষমতা ব্যবহার করলে আমি একাই সারা দুনিয়া পাল্টে ফেলতে পারি। একা। এবং সে ক্ষমতার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতে হবে।  মুশকিল হলো আমরা জানিই না আমাদের সে ক্ষমতা আছে। কিন্তু আমাদের কেউ মনেও করিয়ে দেয় না। আমরা যেহেতু সে ক্ষমতা সম্বন্ধে জানি না সে জন্য আমরা কেউ সে ক্ষমতাটাকে বের করে আনারও চেষ্টা করি না।
আমার মাটির তলে যদি সোনা থাকে আর আমি যদি সেটা না জানি তবে তার ব্যবহার কোনো দিন হবে না। তোমার মধ্যে সেই ক্ষমতা আছে এখন সেটা ব্যবহার করা না করা তোমার ওপর যে, তুমি দুনিয়া বদলাবে না একটা চাকরি করে একটা গাড়ি, একটা বাড়ি করবে অথবা বিদেশ যাবে সেটা তোমার সিদ্ধান্ত। কিন্তু তোমার মধ্যে সে শক্তি আছে। তুমি মানুষ তাই তোমার মধ্যে এ শক্তি আছে।

সম্পাদনা ও গ্রন্থনা করেছেন
শুভ কিবরিয়া
ছবি তুলেছেন
মাহমুদা তুলি

No comments: