Wednesday, July 21, 2010

অদৃশ্য বাতিঘর--১১ (কবিতাগুচ্ছ)

অদৃশ্য বাতিঘর--১১ (কবিতাগুচ্ছ)
-রণদীপম বসু
...
| ক্ষরণ |
পিঞ্জল বুকের চৈতী হাওয়ায় মেখে
তোমার জন্যে সাজিয়ে রেখেছি মন–সুবর্ণ প্রাসাদ,
তুমি তো আসো নি কাল।
নীলার মূল্যে আঁকা রূপোর পাত্রখানি
এখনো অচ্ছুৎ তেমনি আছে–
গায়ে গায়ে তোমারই বিস্মৃতি গাঁথা।

যে বসন্ত সায়াহ্নে ডোবায় গা
তার কাছে থাকে বাকি বৃষ্টি কিছু- কিছু জলের ফোঁটা
কিছু কিছু দীর্ঘ নিঃশ্বাস আর
হিরন্ময় প্রতীক্ষার প্রহর কিছু।
পারাবত স্বপ্নগুলো তখনো দেয়নি উড়াল
পড়েনি বিমূঢ় খসে তৃষ্ণার পালক আশা,
অথচ আসোনি তুমি;
হাতে নিয়ে একগুচ্ছ জোনাকির ভাষা
কতোনা প্রতীক্ষা ছিলো–
কী ভীষণ প্রতীক্ষা আমার !

শরীরে শুকনো ক্ষত খুঁটে খুঁটে রক্তাক্ত হলেই
আকাঙ্ক্ষা ফেরেনা পিছু,
দৃষ্টির লাবণ্য ছেনে না পেলে স্পর্শের ঘ্রাণ
সুরের আল্পনা আঁকা রয়ে যায় সবটুকু বাকি।
কাল তুমি আসোনি বলে
আমার পিয়ালের ডালে ফোটেনি আঁজলা চাঁদ,
হাজারো নক্ষত্রে ঢাকা মেটমেটে অন্ধকারে
কতোনা পথ কেটে
বর্ণহীন অর্থহীন ঘুরে কতো ফিরেছে রাত।
তুমি আসোনি বলে
এতো যে পরিচিত নিজস্ব শরীর আমার
কী ভীষণ অপরিচিতের ফলক এঁটে
ক্লান্তিহীন পড়েছিলো কাল;
প্রিয়তম শব্দগুলো জুড়েনি বাক্য কোনো
বুকে জড়া শিল্পীত কথার।

তোমাকে বলেছি যা-
ওটুকু আমার হৃদয়,
যা কিছু হয়নি বলা– ওটাই কবিতা।
তুমি কি হৃদয় হবে, নাকি কবিতা
এখনো জানার বাকি রয়েই গেলো–
তুমি তো আসোনি কাল।

(০৯-০১-১৯৯৬)


| ভাঙার গান |
ওই ফুল ভাঙে ফল ভাঙে
পাতালের জল ভাঙে
ভাঙনের শব্দে ভাঙে গোমতির কুল,
ডাল ভাঙে পাতা ভাঙে
তুষারে পাহাড় ভাঙে
রমণী-আদরে ভাঙে পাথরের ফুল।

পাখি উড়ে ভেঙে ভেঙে বাঁকিয়ে আকাশ
কুমারী বিকেল ভাঙে কুয়াশী বাতাস।

ঋতু ভাঙে সেতু ভাঙে
পরাণে স্বপ্ন ভাঙে
তলে তলে মন ভাঙে জীবন বিমুখ,
সুর ভাঙে স্বর ভাঙে
চাঁদেরা রাত্রি ভাঙে
অক্ষরে অক্ষরে ভাঙে কবিতার বুক।

ভাঙার যা ভেঙে যায় নিতুই বিপুল
ভেঙে ভেঙেই শুদ্ধ হয়
যতো সব হিরন্ময় ভুল।

(০৪-১২-১৯৯৫)

| শ্রেষ্ঠতম শপথ |
শব্দের দাসত্ব ছিঁড়ে
এবার আশ্চর্য পঙক্তি হবো-
তোমাকে ভুলে থাকার
শ্রেষ্ঠতম শপথ আমার…।

(১৪-১০-১৯৯৬)

| গন্তব্য |
মল্লিকপুর নতুন বাসস্ট্যান্ড থেকে রিক্সায়
হাছন নগর হয়ে সদর হাসপাতাল
খুব একটা দূরে তো নয়–
বৃদ্ধ ক্লান্ত পিতা শুয়ে আছেন রোগ শয্যায়
চার নম্বর কেবিনের বেডে অবসণ্ন একা।
হয়তো পরিজন বেষ্ঠিত
তবু জীবনের খাতায় নিঃসঙ্গ একাই;
অনিবার্য বার্ধক্য মানুষকে এমন একা করে দেয়।

কৈশোরের পুরনো রাস্তা
রিক্সায় সওয়ারী আমি ছুটে চলি দিগবিদিক
পুরানো বাসস্ট্যান্ড ফেলে ট্রাফিক পয়েন্ট ঘুরে
সোজা পথ চলে গেছে পাবলিক লাইব্রেরি হয়ে
ভীষণ ব্যস্ত শহর তবু
মনে হয় শীতের সুরমার নিস্তরঙ্গ বুকের মতোই
কী যেন হারিয়ে গেছে
সুউচ্চ দালান আর মার্কেটের ভীড়ে।

হারিয়েছে এ শহর মায়াময় শৈশব আর
দুরন্ত কৈশোর তার–
শহীদ মিনার আগের মতোই শুধু
স্মৃতিময় কদম আর কৃষ্ণচূড়া নেই–
পাশে পুরনো বালুর মাঠ এখন
ঝলমলে বিশাল পৌর বিপণী বিতান।
অতীতের চেনা চেনা মুখ বড়োই অচেনা ঠেকে আজ,
তুখোড় যে যুবকেরা একদিন হৈ হৈ মাতাতো শহর
এদিক ওদিক দেখি
কেমোন ন্যুব্জ আর ঘোলাটে দৃষ্টিতে খুঁজে
পুরনো স্বাক্ষর যতো
হয়তো বা যা কিছুই অন্যের দখলে সবি;
আহা, দিন বদলের কষ্ট খণ্ডাতে পারে না কেউ।

বদলে গেছে কত কিছুই, রাস্তা-ঘাট-পুকুর-মাঠ
ছোট্ট শহরে এতো পরস্পর পরিচিত মুখ
সুখে দুখে হয়ে যেতো সবাই সবার
সে সবই বদলে গেছে
বদলে গেছে সময়েরা প্রজন্মের প্রজন্মের পর
বদলে গেছে প্রিয়তম শহর আমার।

রুগ্ন পিতা শুয়ে আছেন হাসপাতালের বেডে
উকিল পাড়া বাঁয়ে রেখে তাড়াহুড়ো গন্তব্য আমার
চমকে উঠি তীব্রতায় আকস্মিক ব্রেকের শব্দ
হৈ হৈ করে ছুটে আসে পুরনো বন্ধু জমির
স্কুলের সহপাঠি এককালের তুখোড় প্লেয়ার
স্বভাবটা তেমনি আছে এতোকাল পর।
হুড়হাড় কথার ফাঁকে চেয়ে থাকি অপলক
দু’দিনের না-কামানো দাঁড়ি ধবধবে সাদা আর
বয়েসটা ঝুলে আছে চামড়ার ভাঁজে;
ওটা কি আমারই বিম্ব তবে ! হায়,
আর যারা সহপাঠি কে কোথায় আজ ?
বিপণ্ন প্রশ্নগুলো নিরুত্তর কথা হয়ে
জীবন্ত আয়নায় খোঁজে আপন আপন মুখ।

হাসপাতালে শুয়ে আছেন বৃদ্ধ পিতা
অবসণ্ন একা
আপাতত ওটাই গন্তব্য আমার,
এবং একদিন আমাদের সবার…।

(২৯-০৯-২০০৫)

| ওখানে তোমার ছোঁয়া |

[‘শঙ্খে সমুদ্র্রের স্বর’-এর কবি সুধীর দাস-কে]

দীঘিটা বিজন ছিলো
গাছেরা মিতালি করে
নুয়ে পড়ে ঢেকে দিতো দীঘল ছায়ায়
দুলিয়ে শ্যামল ডানা পাড়াতো চিড়ল ঘুম
কাজল আদর দিতো চোখের নরোম পাতায়;
দীঘিটা বিজন ছিলো।
শব্দের বর্গিরা মাঝে মাঝে দিয়ে যেতো হানা
নিয়ে যেতো রত্নরাজি
বুকের গভীরে যা পড়তো জমা নিবিড় ব্যথায়
রেখে যেতো ক্ষতচিহ্ন
গেঁথে যাওয়া ক্লান্তিহীন বিষণ্ন অক্ষরে।

সোনালী আলোয় নেয়ে অচেনা পাখিরা এসে
কখনো বা রেখে যেতো আপন আদরে বোনা মুখর ছোঁয়া
এমন তরল বুকে মাছেরা লাফিয়ে পড়ে
মাঝে মাঝে বলে যেতো
নৈঃশব্দের কত কী না বলা কথা
তবু সজল দীঘিটা আমার বিজনই ছিলো
বেভুল পথিক এক জিরিয়ে নেয়ার ফাঁকে
ছুঁয়ে দিলো বুক–
ভেঙে দিলো বয়ে যাওয়া নিত্য-নীরবতা।

আকাশের নীল শুষে ওই বুকে
ভেতরে দুঃখ ছিলো ছোট ছোট কষ্ট ছিলো
ছিলো বিপণ্ন বিষাদ
এভাবে বুঝিনি আর মগ্নতার গভীরে এমোন
তোমার কাঁপন ছোঁয়ায় আবেশে স্বপন এলো
ছড়িয়ে গেলাম আমি
অবোধ্য ব্যথায়…

বুকের ভেতরে দীঘি থিরিথিরি বুক
ওখানে তোমার ছোঁয়া…।

(১৯-১০-১৯৯৫)

| নীল বৃষ্টি |

[প্রয়াত সুহৃদ বসির আহমেদ-কে]
আমি কি চলেই যাবো, না কি যাবো না–
কিছু তো বললে না তুমি।

অসম্ভব নীল বৃষ্টি দূরে কোথাও
এখানে ঝলমলে আকাশ
এই নির্বোধ লোকালয় ছেড়ে
আমার যাবার কথা কোন এক মুখর বৃক্ষের কাছে
অনন্তের হাত ধরে যে নাকি দাঁড়িয়ে আছে
সবুজের মোহে
আমি কি বৃক্ষই হবো, না কি অন্তরালবাসী–
কিছু তো বললে না তুমি।

যেখানে নারীরা আসে প্রচ্ছন্ন রমণী হয়ে
নিশ্চয়ই ফুটবে ফুল বনে বনে
অথবা অরণ্য উজার হবে;
পাহাড়ে সাগরে যতো মিল বা অমিল আসুক
খেয়ালি প্রকৃতির কাছে আমি কি পুরুষ হবো
না কি আদিম মানব–
কিছু তো বললে না তুমি।

লোকে বলে স্বপ্নেরা অবুঝ নাকি শিশুর মতোই;
অথচ শৈশবের স্বপ্নের সীমা
পারে না ছাড়িয়ে যেতে অবাধ্য মানুষ
কূহক স্বপ্নের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আমাকে
কিছুই তো বললে না তুমি
আমি কি আত্মঘাতিই হবো
না কি মোহন ঘাতক।
তুমি তো বললে না কিছুই…।

(৩০-০৯-২০০৫)

No comments: