Sunday, August 29, 2010

| আলগা-প্যাঁচাল…|০১|


| আলগা-প্যাঁচাল…|০১|
রণদীপম বসু

শাহবাগ আজিজ সুপার মার্কেটের দ্বিতীয় তলা পর্যন্ত উঠতে না উঠতেই জিন্সের বাঁ পকেটে মন উতলা করা বাঁশির সুরটা বেজে উঠলোবুঝলাম কেউ আমাকে স্মরণ করছেকবি আহমেদুর রশীদ টুটুল, শুদ্ধস্বর প্রকাশনার স্বত্ত্বাধিকারী- দাদা আপনি কোথায় ?
এইতো তৃতীয় তলার পথে, আপনার কাছাকাছি !

গতকাল মেইলে জানিয়েছিলাম আজ শনিবার আসতে পারিউদ্দেশ্য প্রকাশিতব্য প্রবন্ধের বইটা ছাপার মেশিনে ঢুকার আগে চূড়ান্ত অবস্থাটা শেষবার দেখে নেয়াপ্রচ্ছদও নাকি এসে গেছে সংশ্লিষ্ট শিল্পীর কাছ থেকেতা দেখে চক্ষু-কর্ণের বিবাদ-ভঞ্জনটাও সেরে নেবো

শুদ্ধস্বরে ঢুকেই দেখি আমাদের আবু মুস্তাফিজ ভাই ওরফে সবুজ বাঘ টুটুল ভাইর সাথে খুনশুটি করছে পাতলা খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি আর চমৎকার প্রাণবন্ততায় তাঁকে বেশ রোমান্টিক লাগছে ! এ অবস্থায় তাঁকে দেখলে যে কোন মেয়েই প্রেমে পড়ে যেতে বাধ্য ! ফিনিশিংলেস চেহারাসমৃদ্ধ আমি তাঁকে এই রোমান্টিক চেহারায় দেখে তখন হিংসায় জ্বলে যাচ্ছি। আমাকে দেখেই হৈ হৈ করে করে উঠলেন তিনি। আমি যে আজ আসবো এটা তিনি জানতেন। অনেকদিন কোন আড্ডা হচ্ছে না বলে আরো কাউকে কাউকে নাকি বলে রেখেছেন চলে আসতে। এরই মধ্যে চলে এলো শিমুল সালাহউদ্দিন। উদীয়মান ও ডাকসাইটে তরুণ কবি। কিছুক্ষণ পর দল বেঁধে আরো কয়েকজন, যাঁদের সাথে প্রত্যক্ষ পরিচয় আজই প্রথম, মরণ ভাই, খালিদ ভাই, দাদা শশাঙ্ক বরণ রায় সহ আরো কয়েকজন। সবাই অন্তর্জালের জগতে নিজ নিজ মেধা ও যোগ্যতায় পরিচিত। পরিচয়পর্ব সেরেই আড্ডাস্থল হিসেবে চিহ্নিত হলো ছবির হাট। তাঁরা চলে গেলেন সেখানে, আর আমি প্রকাশনা বিষয়ক সামান্য কাজটুকু সেরে ইপ্তার-টাইমের পরে যোগ দিলাম তাঁদের সাথে। একটু পর সেখানে এলো আরো তিন খ্যাতনামা ব্লগার জ্যোতির্ময় বণিক ওরফে সবজান্তা ও রাইয়ান কামাল ওরফে এনকিদু, যারা প্রযুক্তি ও লেখালেখি দুদিকেই সিদ্ধহস্ত। আর তৃতীয়জন হলেন অন্তর্জালিক কবি তারেক রহিম, যিনি ইদানিং অক্ষরে গাঁথা ভার্চুয়াল কবিতার চাইতে জলজ্যান্ত কবিতা-শরীরীর দিকেই অধিকতর আগ্রহী হয়েছেন। 

আড্ডার কোন নির্দিষ্ট বিষয় থাকে না। আড্ডাই বিষয় তৈরি করে নেয়। ছবির হাটে সন্ধ্যার গাছ-গাছালির মায়াবী ছায়া আর চমৎকার জ্যোৎস্নার আলো-আঁধারিতে চায়ের সাথে ধুম্র উদ্গীরণ আর আড্ডার অসংখ্য মুখ-বিস্তারণ। ইদানিং ব্লগস্ফিয়ারের গতিবিধি থেকে শুরু করে রাজনীতি সমাজনীতি প্রযুক্তিদুনিয়া হেনতেন বিষয় যখন পেঁচিয়ে উঠছে তখনি জানা গেলো শিমুলের মাথায় নাকি কবিতা ভর করেছে। কী ভয়ঙ্কর কথা ! তারেক রহিমকে কবি বলে সম্বোধন করায় ক্ষেপে গেলো সে, তাঁকে নাকি অশ্লীল শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে, কী সাংঘাতিক ! এদিকে নিজের মধ্যে একটু কবি কবি ভাব টের পেয়ে ভাবছিলাম যে নিজেকে কবি হিসেবে প্রচার করবো কিনা; ওমা, শিমুল তো রীতিমতো চ্যালেঞ্জ করে বসলো- আপনি যে কবি তা প্রমাণ করেন ! মহা ফাপড়ের কথা ! কিভাবে কবি প্রমাণ করে ? কার অনুমোদন, প্রত্যয়ন জোগার করতে হয় ? শেষপর্যন্ত রণে ভঙ্গ দিলাম, থাক বাবা, কবি হতে গিয়েই এই ফাঁপড়, হয়ে গেলে না জানি আরো কতো কী পেশ করতে হবে ! শেষে ভাই (যাঁর নামটা আবারো ভুলে গেলাম) সবুজ বাঘকে সাক্ষী রেখে আলোচনায় সিদ্ধান্ত টানলেন- কবিতা হচ্ছে একটা ভ্রান্ত ধারণা। সবাই সমস্বরে মেনে নিলো তা। কী আর করা, আমার আর কবি হওয়া হলো না !

অনেকক্ষণই হয়তো চলে গেছে। ভাদ্রের চিহ্ন- যেখানে মেঘ সেখানে বৃষ্টি। গায়ে কয়েক ফোটা আঁছড়ে পড়তেই বুঝলাম আড্ডায় ভাটার টান। নিজ নিজ ফেরার ঠিকানার দূরত্ব অনুপাতে একে একে আড্ডা থেকে লোক কমতে শুরু করেছে। সর্বশেষ আমরা যখন ছবির হাট থেকে বেরিয়ে এলাম তখনো কি জানতাম মিরপুরগামী শেষ বাসটাও ছেড়ে গেছে। সবজান্তা, এনকিদু আর তারেক চলে গেলো টিএসসির দিকে। গল্পহাঁটায় যাচ্ছি আবারো আজিজের দিকে। বাচ্চাকাচ্চা সমেত উন্মুক্ত ফুটপাথে শুয়ে থাকা পরিবারটির দিকে চোখ আটকে গেলো। আহা, পৃথিবীতে কার ঠিকানা যে কোথায় তা কি আমরা কেউ জানি ? তবু একটা আপাত ঠিকানাকে সম্বল করেই আমরা ছুটছি। শঙ্খ ঘোষের সেই বিখ্যাত পঙক্তিটা মনে এলো- যাইতাছি যাইতাছি, কই যাইতাছি জানি না ! ঢাকায় বেড়াতে এসে একটা ট্রাকের পেছনে এই লেখাটা দেখেই নাকি তাঁর এই কবিতাটার জন্ম। এরই মধ্যে শাপলু ভাই মানে সবুজ বাঘ শাহবাগ থেকে রিক্সায় ইন্দিরা রোড। আরো কে কিভাবে কোন দিকে যেন চলে গেলো। শশাঙ্ক দা উঠে গেলো মোহাম্মদপুরের বাসে। অবশিষ্ট আমি আর খালিদ ভাই মিরপুর একের বাস ফেল করে কাটাবন থেকে রিক্সায় নীলক্ষেত। সেখান থেকেও ফেল করলে হাঁটা ছাড়া আর গতি নেই। মনে মনে আড্ডার পিণ্ডি চটকাতে চটকাতে শেষে বাস পেয়ে গেলাম।

চেহারা যতই ভারিক্কি হোক, খালিদ ভাই যে নিপাট শুদ্ধ একটা মানুষ তা বুঝতে বাকি রইলো না যখন দেখলাম সিদ্ধগরমে বাসের অপরিসর ঘিঞ্জির মধ্যেও প্রযুক্তিকানা আমার প্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট অসংখ্য বোকা বোকা প্রশ্নের উত্তর একটুও ক্ষুব্ধ না হয়ে অসীম ধৈর্য্যের সাথে দিয়ে গেলেন। এরকম অবস্থায় আমি হলে নিশ্চিতভাবে বলে ফেলতাম- ভাই, যা বুঝেন না তা নিয়ে পণ্ডিতি না করলে হয় না ! কিন্তু খালিদ ভাই তো আর আমার মতো অসহিষ্ণু না ! এরই মধ্যে আবার মোবাইলে সেই বাঁশির সুর। মানুষ কি বুঝে না এখন আমি গাড়িতে হাসফাঁস অবস্থায় আছি ! গাড়ির চিপসে সীটের ত্রিভঙ্গ চিপায় বসে পকেট থেকে মোবাইল বের করা কি চাট্টিখানি কথা ! হাতে নিয়ে দেখি আমার নাইয়োরস্থ লাইফ পার্টনার, সিলেট থেকে- তুমি কোথায় ?
গাড়িতে, জ্যামে আটকা।
হুমম, আমি না থাকলে রাতবিরেতে বাইরে থাকো তাহলে ! বাসায় পৌছে আমাকে কল দিও।
কী ব্যাপার, কোন সমস্যা !
বললাম তো, বাসায় পৌছে….
ঝট করে লাইনটা কেটে গেলো। এর পরেও কাউকে বোঝাতে পারি না যে, বিয়ে হলো সংশোধনের অযোগ্য সেই ভুল, যা করে গবেটরা বীরত্ব দেখায়, আর বীরেরা বুদ্ধু সাজে।

আমাকে বাসের ভিড়ের মধ্যে একা করে খালিদ ভাই নেমে গেলেন। কিছুক্ষণ পর আমিও নেমে গেলাম। বাসায় ফিরেই কল ব্যাক করলাম সিলেট। ওপাশ থেকে তখন গুঙানোর শব্দ পাচ্ছি ! কী হয়েছে ? মার্কেটিং করতে বেরিয়েছিলো। সফলভাবে শেষও করেছে। বিপত্তি হলো বাসায় এসে। কাপড় পাল্টাতে গিয়ে হঠাৎ কে যেনো কাঁধের কাছে আগুনে পোড়া গোটা সুঁই ঢুকিয়ে দিয়েছে। চিৎকার চেচামেচিতে লঙ্কাকাণ্ড! তাঁর মা ভাই বোন বৌদি সবাই ছুটে এসে খোঁজাখুজি করে আবিষ্কার করলো দুটো ভীমরুল! একটা রীতিমতো হুল ফুটিয়ে দিয়েছে, বাকিটা সম্পন্ন করার প্রক্রিয়ায়। একদিক নাকি ততক্ষণে অবশ হয়ে গেছে প্রায়। প্রচণ্ড ব্যথা আর আগুনের মতো জ্বালা। জীবনে বহু ভীমরুল দেখেছে, হুল খেয়েছে এই প্রথম। জ্বর আসি আসি করছে। বুঝলাম, এজন্যেই মেজাজ খাপ্পা !

গতকাল ফোন করে বলছিলো, কিচ্ছু ভালো লাগছে না। আমি যে আগ বাড়িয়ে ফোন করি না তাতেই সে বুঝে গেছে চোখের আড়াল হলে মনেরও আড়াল হয়। দীর্ঘদিন পর নাইওর গিয়ে বুঝতে পেরেছে আমার আসল চেহারা। আমি যে কেবল সামনে থাকলেই পুতু পুতু করি, আড়ালে গেলে মনে অন্য কোন অভিসন্ধি, তা আর বুঝতে বাকি নেই। এজন্যেই তার জীবন সম্বন্ধে ব্যাপক উপলব্ধিতে সব কিছু খালি খালি লাগছে ! কিচ্ছু ভালো লাগছে না। কেবল মরে যেতে ইচ্ছে করে ! আমি আর কী বলবো বা বুঝাবো ! ভাবতাম নাইওর গেলে রমণীরা বিরক্ত হয় বেশি বেশি ফোন করলে। প্রথম প্রথম সে তা-ই হতো। সে অভিজ্ঞতায় আমি আর আগ বাড়িয়ে ফোন করতে যাই না। কিন্তু রাম যে উল্টো বুঝে বসেছে ! তাই আজকে তাঁর হুল খাওয়া ফুল টেম্পারের মধ্যেই প্রশ্ন করলাম- তুমি কি আজ ভালো আছো, না কি কাল ভালো ছিলে ?
কী ! খটাশ করে ফোনটা রেখে দিলো সে।

ভীমরুল যে এতো উপকারী প্রাণী আগে তা জানা ছিলো না !
(২৮-০৮-২০১০)

[unmochon]

No comments: