| আলগা-প্যাঁচাল-০২ | হাত…|
-রণদীপম বসু
…
০১.
এক হাতে প্রিয় সন্তান বা প্রিয়জনকে আগলে রেখে অন্য হাতে সমস্ত প্রতিকূলতা সামলানোর জন্যে হলেও মানুষের দুটো হাতের দরকার হয়। প্রকৃতিও হয়তো তা জানতো যে মানুষের বেঁচে থাকার যুদ্ধে প্রধান হাতিয়ার হলো তাঁর দুটো হাতই। ওখানেই তাঁর পূর্ণ ব্যবহারিক শক্তিটুকু লুকিয়ে থাকে। এখানে যেকোন ঘাটতি আসলে তার সামর্থেরই ঘাটতি। তবুও একান্তই ঘাটতি হয়েই গেলে তা পূরণ করতে হয় অতিরিক্ত ইচ্ছা, উদ্যম আর মনোবল দিয়ে। এটা কেউ পারে, অনেকেই পারে না। কিন্তু বেঁচে থাকা এক আশ্চর্য প্রত্যয়ের নাম !
০২.
বছরের বাকি সময়গুলো অফিস নামক একটা কারাগারের প্রকোষ্ঠ থেকে ছাড়া পেতে পেতে যখন আমাদের নাগরিক বিকেলগুলো হারিয়ে যায়, রমজানের একটি মাস তা-ই ফিরে পাই চারটের অফিস শেষে অসম্ভব রোজাদার উচ্চ-পদস্থ কর্মকর্তাদের বাসায় ফেরার অদ্ভুত তাগিদের উছিলায়। (আহা, সারাটা বছর কেন যে রমজান হয় না !) সেদিনও যথারীতি অফিস শেষে মিরপুর-এক থেকে হালকা-পাতলা সওদা নিয়ে অসংখ্য রিক্সাচালকদের না-না-যামু না‘র বিরক্তিকর শব্দ ডিঙিয়ে হাল ছেড়ে হেঁটেই ফিরবো বলে মনঃস্থির করে ফেলেছি প্রায়, তখনই কোথায় যাবো ভাড়া কতো ইত্যাদির কড়ায়-গণ্ডায় নিকেশ ছাড়াই হালকা-পাতলা গড়নের চালকটি বললো- আসেন। আমি তাঁর দিকে এক পলক তাকিয়েই কোন কথা না বাড়িয়ে উঠে পড়লাম রিক্সাটায়।
স্যার কোন্ দিকে যেতে হবে বইলেন…
ঠিক তখনই বিস্ময়ের সাথে খেয়াল করলাম, শত শত রিক্সা-গাড়ি-বাস-টেম্পো আর অগুনতি অফিস ফেরতা বাজার ফেরতা মানুষের ভয়ঙ্কর ভিড় কাটিয়ে ঢাকার রাজপথের প্রতিমুহূর্তের ঝুঁকি এড়িয়ে লোকটি কেবল এক হাতে রিক্সার হ্যান্ডেল ধরে তড়তড় করে এগিয়ে যাচ্ছে ! একটা মলিন তোয়ালে জাতিয় কাপড় ঘাড় পেঁচিয়ে তার এক মাথা ডান হাতটিকে ঢেকে রেখেছে লম্বালম্বি ঝুলে পড়ে। আমি সচকিত হয়ে ওঠলাম, এই বুঝি পেছনের বিপজ্জনকভাবে এগিয়ে আসা বাসটা রিক্সাটাকে চাপা দিচ্ছে প্রায় ! এবং লক্ষ্য করলাম রিক্সাটাকে নিয়ন্ত্রণ করতে লোকটির কষ্ট হচ্ছে খুব। রিক্সা চালানো যে শারীরিকভাবে খুবই পরিশ্রমসাধ্য কাজ তা বুঝতে রিক্সা চালানোর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার দরকার হয় না। তবে এক্ষেত্রে দুটো হাত যে কী অপরিসীম গুরুত্ব বহন করে তা আর বলতে হয় না। জুত মতো প্যাডেল চাপতে হলেও দুই হাত দিয়ে শক্ত করে হ্যান্ডেল চেপে ধরেই শক্তি প্রয়োগ করতে হয়। জটিল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে তো কথাই নেই ! কিন্তু লোকটিকে তার সব কিছুই এক হাত দিয়ে করতে হচ্ছে। এ মুহূর্তে রাজপথের ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় তাঁর সাথে কোন কথা বলে মনোযোগ সরাতে চাইলাম না।
কিছুটা নিরাপদ গলি-রাস্তায় ঢুকতেই তাকে জিজ্ঞেস করলাম- আপনার ডান হাতে কি কোন সমস্যা ?
জী…।
কী হয়েছে ?
এ্যাকসিডেন্ট, হাত কেটে ফেলতে হয়েছে…।
লক্ষ্য করলাম অন্য রিক্সাচালকদের মতো তাঁর বুলিতে আঞ্চলিকতার টান প্রায় অনুপস্থিত। শুদ্ধ ভাষা ব্যবহারের একটা ঝোক খেয়াল করলাম।
কী এ্যাকসিডেন্ট হয়েছিলো ?
ছোটবেলা দুষ্টামি করতে গিয়া বিদ্যুতের তারে ঝুইল্যা গেছিলাম…। হাতটা কয়লা হইয়া গেছিলো…।
তাইলে আপনি বেঁচে গেলেন কীভাবে !
সারা শরীরের পোড়া চামড়ার দাগ এখনো কুচকাইয়া আছে…।
এদিকে আর কথা না এগিয়ে অন্যদিকে মোড় নিলাম। বাড়ি কোথায় ?
ভোলা…।
বউ-বাচ্চা আছে ?
জী…।
এরা কি ঢাকাতেই ?
জী না…। বাড়িতে।
তাইলে ঢাকায় এই ঝুঁকি নিয়ে রিক্সা চালচ্ছেন কেন ! ওখানেই তো চালাতে পারেন !
ঢাকায় মাঝে মাঝে আইসা দুই-তিন দিন রিক্সা চালাইয়া আবার বাড়ি চলে যাই। সেখানে কৃষিকাজ করি।
লোকটির কথাবার্তায় কেমন একটা সারল্যের ঘ্রাণ পাই। জিজ্ঞেস করি- ওখানে চালান না কেন ?
লজ্জা করে…।
মানে ?
আমার আব্বার অনেক জমিজমা ছিলো। কিছু নদীয়ে নিছে, আব্বা মরার পর কিছু সৎ ভাইয়েরা….
বলেই একটা দীর্ঘশ্বাস চেপে গেলো মনে হয়। বুঝলাম পেছনের কোন করুণ ইতিহাসে টোকা পড়ে গেছে। ব্রাত্য জীবনে অযথা রক্তক্ষরণ ঘটিয়ে কাজ নেই। কথা ঘুরিয়ে বললাম- এই যে এক হাতে রিক্সা চালান, তাতে কষ্ট হয় না ?
কষ্ট তো হয়ই ! জান বাইর হইয়া যায়। একদিন চালাইলে একদিন বিশ্রাম নিতে হয়…। কিন্তু বাঁচতে হইলে না-চালাইয়া উপায় নাই ! আর যখনই কেউ দেখে আমার একটা হাত নাই, রিক্সায় উঠে না…। কিন্তু আমি তো ভিক্ষা করতে পারুম না !
আবারো কথা আবেগতাড়িত হবার আগেই তাঁকে সাহস জোগাবার একটা তাড়না বোধ করতে থাকি। বলি- আপনি যা করছেন, অবশ্যই সম্মানের কাজ করছেন, পরিশ্রম করে উপার্জন করছেন, আপনার মনোবলকে আমি সম্মান জানাই।
ইতোমধ্যে গন্তব্যে পৌছে যাওয়ায় রিক্সা থেকে নেমে পড়ি। ভাড়ার নিয়মে দশ টাকা হলেও একটু সঙ্কোচ ভরেই পনের টাকা দিলাম। কিন্তু মনোযোগী শ্রোতা পেয়েই হয়তো তার আবেগ বুঝি তখনো থামে নি। আরো কিছু বলতে চাইলো। আমি তাঁর কথা শুনতে দাঁড়িয়ে গেলাম।
স্যার আমি জানি এইখানের ভাড়া কতো, দশ টাকার বেশি না। কিন্তু আপনি পাঁচ টাকা বেশি দিছেন আমারে মায়া কইরা। কিন্তু এমন যাত্রীও উঠে যারা নিয়মের ভাড়া কম দিয়া সুখ পায়। ভাড়া চাইলে গালে থাপ্পড় মাইরা বয়।
একজন যাত্রী হিসেবে তাঁর কথাগুলো যেন আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলা, আমি তাদেরই প্রতিনিধি হয়ে লজ্জায় অধোবদন হয়ে যাই। সে বলেই চলে-
গরীব দুর্বল মানুষরে হেরা মাইরা সুখ পায়। তয় আপনার মতো যাত্রীও পাই বইলাই শেষপর্যন্ত ভরসা হারাই না।
তাঁর সর্বশেষ কথাগুলোকে এড়িয়েই বলি, আমি কি আপনার একটি ছবি নেবো ? অনুরোধ করলাম তাঁর ডানহাত ঢেকে রাখা তোয়ালেটা সরিয়ে নিতে। একটু ইতস্তত করে অবশেষে সেই সারল্যমাখা হাসিটা দিয়ে বললো- কেন স্যার ?
ততক্ষণে আমি আমার দুই-মেগাপিক্সেলে ক্লিক করে দিয়েছি…। কোন দায়বোধ নেই, হয়তো হারিয়েই যাবে, তবু ব্রাত্যজীবনের এইসব ছোট ছোট ছবিগুলো নাহয় নিজের কাছেই এঁকে রাখলাম…!
(২৩-০৮-২০১০)…
[ unmochon ]
…
No comments:
Post a Comment