Tuesday, December 21, 2010

| ছবির গল্প | টিয়ে দিয়ে ভাগ্যগণনা, ভাগ্যবন্দী মানুষের অদ্ভুত সান্ত্বনা!

 
| ছবির গল্প | টিয়ে দিয়ে ভাগ্যগণনা,
ভাগ্যবন্দী মানুষের অদ্ভুত সান্ত্বনা!
-রণদীপম বসু
কেবল ভাগ্যকে সম্বল করে জীবিকার টানে দেশের নানা প্রান্ত থেকে কর্মহীন বেকার মানুষগুলো ছুটে আসে রাজধানীর দিকে। সর্বস্ব হারানো চোখে তাদের অনাগত স্বপ্ন, মনে কত কী আশা, সব কিছু সম্ভব করে দেবে এই নগরী ! অসহায় নিরিবিলি জীবন পেছনে ফেলে এই ব্যস্তবহুল নগরীর বিপুল জনস্রোতে মিশে অতঃপর খেই হারিয়ে বুঝে যায় জীবন আরো কঠিন ও কর্কশ এখানে। বন্ধুহীন স্বজনহীন এই নগরীতে কেউ কারো নয়। কিন্তু আর ফেরার উপায় নেই। নিরূপায় এরা শেষে জড়িয়ে পড়ে বাছ-বিচারহীন বৈধ অবৈধ বিচিত্র কর্মকাণ্ডে। অপরাধকর্মেও জড়িয়ে পড়ে কেউ কেউ। কেউ হয়তো আখের গড়ে। অধিকাংশই  ভাগ্যের মরীচিকায় আটকে পড়া ফাঁদে হয়ে যায় ভাগ্যসর্বস্ব, অনিশ্চিত, অসহায় ছিন্নমূল। দিনের শুরুতে জানে না এরা সামনে কী অপেক্ষা করছে নসিবে। তাদের এই আকুলতা, অশিক্ষা, অজ্ঞতা ও কুসংস্কার তাদেরকে প্ররোচিত করে কিছু মিথ্যে আশা ও অভয়বাণীর দিকে। যার নাম ভাগ্য-গণনা। শিক্ষিত ও সংস্কারমুক্ত মানুষের কাছে তা অর্থহীন হলেও ওই অসহায় লোকগুলোর কাছে এটাই হয়তো বেঁচে থাকার প্রচণ্ড আশা ও প্রাপ্তির সুর, যা তাদেরকে পুনরায় সাহসে উজ্জীবিত করে।


সাপ্তাহিক ছুটির দিনে নগরীর হালকা ভীড় ঠেলে মিরপুর এক নম্বরে রাস্তার পাশে কিছু ছোট ছোট জটলা দেখে কৌতুহলি হলাম। প্রতিটা জটলার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে একটা কাঠের খাঁচা পাশে নিয়ে বসা একেকজন ভাগ্যগণনাকারী। খাঁচার মধ্যে বন্দী টিয়ে বা তোতা জাতীয় পাখি আর ভাগ্যগণনাকারী লোকটির সামনে সুশৃঙ্খল সারিবদ্ধভাবে বিছিয়ে রাখা অনেকগুলো সুদৃশ্য খাম। ঘিরে থাকা শ্রমজীবী মানুষগুলোর যাপনকষ্ট মাখা চেহারার সাথে ভাগ্যগণনাকারী ব্যক্তিটির শ্রেণীগত অবস্থান ও বাহ্যিক চেহারায় খুব একটা পার্থক্য না থাকলেও এ মুহূর্তে যেন ভিন্ন দুই জগতের অধিবাসী এরা। একপক্ষ আনুকূল্য পেতে আর অন্যপক্ষ দিতে উৎসুক। গণক লোকটি খাঁচার কপাট খুলে একটি ছোট্ট দণ্ডের মাথা খাঁচায় ঢুকিয়ে দিতেই একটি টিয়ে উঠে বসলো দণ্ডে। টিয়ে সমেত দণ্ডের মাথা খামগুলোর আলতো উপরে ধরে একধার থেকে অন্যধারে নিয়ে যেতে যেতে দণ্ডের ইশারায় প্রশিক্ষিত টিয়েটি একটা খামে ঠোঁট ছোঁয়াতেই  ছোঁ মেরে খামটি তুলে নিলো গণক লোকটি। টিয়েটিকে খাঁচার উপরে বসিয়ে দিয়ে খামটি খুলে ভেতর থেকে একটা চিরকুট বের করে আনলো। জটলার সবক’টি কৌতুহলি চোখ তখন সেই চিরকুটের উপর, যেখানে ভাগ্য নামের অনিশ্চিত কিন্তু দোর্দণ্ড প্রতাপশালী কতকগুলো মায়াবী কালো অক্ষর মোহ ছড়ানোর অপেক্ষায়। গণকের মুখ দিয়ে দৈববাণীর মতো উচ্চারিত হলো- ‘অনাকাঙ্ক্ষিত উৎস থেকে অর্থভাগ্য সুপ্রসন্ন, তবে… পরিচিত কারোর মাধ্যমে …দুঃখজনক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে, সাবধান থাকতে হবে’…ইত্যাদি ইত্যাদি। কী অদ্ভুত নগরী ! কে কার ভাগ্য গণনা করে ! আকাশহারা বন্দী টিয়ের মতো অসহায় মানুষগুলোও ভাগ্যবন্দী হয়ে গেছে এই নগরীতে।
 
 
তবু আগাম ভাগ্যগণনায় তুষ্ট খদ্দেরের উৎফুল্ল হাত বুকপকেট থেকে খুচরা টাকা বের করে আনামাত্র ফের দণ্ডের আগায় চড়ে ভাগ্যনিরূপণকারী প্রশিক্ষিত টিয়েও জায়গামতো হাজির। খুট করে কামড়ে ধরে ইহলৌকিক নোটের কোণা। প্রকৃতির সবুজ সন্তান টিয়ে কি টাকাও চেনে…!

No comments: