Sunday, January 30, 2011

| ছবির গল্প | ঢাকার নৌকা : নগর-সভ্যতায় নদীমাতৃক ঐতিহ্যের বিলীয়মান প্রতিনিধি |

 
| ছবির গল্প | ঢাকার নৌকা : নগর-সভ্যতায় নদীমাতৃক ঐতিহ্যের বিলীয়মান প্রতিনিধি |
-রণদীপম বসু

পড়ন্ত বিকেলে এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া কুলকুল নদীর স্বচ্ছ বুকে সূর্যের আলোয় চকচকে বাদাম তোলা নৌকার চিরায়ত ছবি আর বুকের গভীরে অজান্তিকে বেজে ওঠা ‘ ভাটির দেশে কে যাও তুমি উজান গাঙের নাইয়া’র মতো ভাটিয়ালি সুর বাঙালির একান্তই নিজস্ব ও চিরন্তন আবেগের পটভূমি। তা থেকে বাঙালির নাড়িকে বিচ্ছিন্ন করা কিছুতেই সম্ভব নয়। কারণ নৌকা আর বাঙালি অবিচ্ছেদ্য। তার ধমনীতে বয়ে যাওয়া রক্তের নদীটাতে এখনো প্রাচীন নৌকা ভাসে, আর ওখানে হাল ধরে আছে তার পূর্বপুরুষের গ্রন্থিল পেশী। তাই নৌকাহীন বাঙালি এখনো অকল্পনীয়।

শুধু বাঙালির কেন, মানব-সভ্যতার অন্যতম আদিম যানবাহন নৌকা। সভ্যতার কোন এক ঊষালগ্নে আদিম মানুষ কাঠের গুঁড়ি কুঁদে কুঁদে খোল তৈরি করে জলে ভাসিয়ে একদিন ওটাতেই চড়ে বসেছিলো। সেই থেকে শুরু। এরপর কাঠ, গাছের বাকল, চামড়া, বেত ইত্যাদি নানান বস্তু নানাভাবে ব্যবহার করে পৃথিবীর নানা অঞ্চলে তৈরি হয়েছে নৌকা। এখন কাঠ ছাড়াও ফেরোসিমেন্ট ও ফাইবার গ্লাসের মতো আধুনিক বস্তু দিয়েও নির্মিত হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের নৌকা। তবে এগুলো আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে ততটা ব্যবহারযোগ্যতা না পেলেও উন্নত দেশগুলোতে তা প্রমোদ ও ক্রীড়ার কাজে আদৃত হচ্ছে।
.
 .
খাল-বিল-নদী-নালায় জড়ানো আমাদের এই নদীমাতৃক দেশে নৌকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যানবাহন। আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে নৌকা এমন ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে যে বাঙালি মানসে এই নৌকা এখনো একটি অনিবার্য অনুষঙ্গ। নদী আছে নৌকা নেই এমন অভাবনীয় অসম্ভব দৃশ্য বাঙালির কল্পনারও অগম্য। নদীকেন্দ্রিক সভ্যতার গোড়াপত্তনের মধ্য দিয়ে আমাদের আজকের এই যে নগর সভ্যতা, তার মূলেও রয়েছে নৌকা। কিন্তু তা কি আমরা মনে রাখতে পারছি ? যন্ত্রসভ্যতার অপ্রতিরোধ্য অনুষঙ্গ কার্গো-লঞ্চ-স্টীমার-ট্রলারের ভীড়ে এক বা একাধিক বাদাম উড়ানো দাঁড়টানা মালবাহী কোন বাজিতপুরি নৌকা বা বাচারি বা ঘাসি বা রপ্তানি বা গয়নাজাতীয় বড়সড় নৌকা কি এই বুড়িগঙ্গায় আদৌ দেখা যায় এখন ? বজরায় চড়ে এখন আর কেউ নৌবিহারে বেরোয় না। চট্ট্রগ্রামের ঐতিহ্যবাহী সাম্পান বুড়িগঙ্গায় কখনো না ভাসলেও নাইওরগামী পানসিও এখন আর বাঙালি বঁধুকে নিয়ে কোন ঘাট থেকে ছেড়ে যায় না। সড়ক যোগাযোগ কোনভাবে ব্যহত হলে সেই বঁধুরা এখন ‘ইস্টিমারে বাপের বাড়ি যায়’। ফলে ‘খোল’ ‘পাটা’ ‘ছই’ ‘হাল’ ‘দাঁড়’ ‘পাল’ ‘মাস্তুল’ ‘গলুই’ ‘বৈঠা’ ‘লগি’ ‘গুণ’ নামের এইসব নৌকা সংশ্লিষ্ট অবিচ্ছেদ্য বাঙলা শব্দগুলোও নাগরিক অভিধান থেকে দ্রুতই আবেদন হারিয়ে ফেলছে। এখনো লুপ্ত না হলেও এগুলো এখন নাগরিকদের বিস্মৃত শব্দ।
.
 .
তবে নগর-বর্জ্যে ভয়াবহ বিষাক্ত ও জরাগ্রস্ত নদী বুড়িগঙ্গায় ভয়ঙ্কর দুর্গন্ধ ঠেলে নাকমুখ চেপে হলেও নাগরিকদের অনিবার্য পারাপারের প্রয়োজনেই হয়তো নৌকার ঐতিহ্যবাহী ছোট সংস্করণ ডিঙ্গি নৌকা এখনো টিকে আছে নগরের নদীমাতৃক ঐতিহ্যের শেষ চিহ্ন হিসেবে। ঢাকা সদরঘাট টার্মিনালের আশেপাশে এর উপস্থিতি একটু বেশি। বুড়িগঙ্গার কালো হয়ে যাওয়া তৈলাক্ত ভারি পানিতে ভাসমান এই ঐতিহ্যবাহী নৌকাগুলোকে ঢাকার আর কোথাও দেখা যায় না। বিচিত্র অর্থনৈতিক জীবনধারার সাথে সঙ্গতি রেখে গুটিকয় ডিঙ্গি নৌকা মাঝেমধ্যে চোখে পড়ে ছোট্ট নদী তুরাগেও। তাও গাবতলি হাটের আশেপাশে। দেখা যায় শ্যালো ইঞ্জিন লাগানো কিছু শ্যালো নৌকাও। তবে সেখানে দু-তিনজন লোকের ভার বহনক্ষম নৌকার একেবারে ছোট্ট সংস্করণ কোষা নৌকারই আধিক্য। সমতল তলাবিশিষ্ট এই কোষা নৌকা আরো কিছু দেখা যায় ঢাকার আমিন বাজারগামী বেরিবাধের বাইরের দিকে। নগর সভ্যতা প্রায় সব জলাশয় গিলে খেলেও নগরীর বাইরে বেরিবাধের তুরাগঘেষা বিস্তৃত জলাভূমিকে এখনো গ্রাস করেনি বলে ওদিকটাতে জলাভূমির উপরে ইদানিং ছোট ছোট বেশ কিছু অদ্ভুত ধরনের স্বল্পমানের রিসোর্ট তৈরির হিড়িক পড়েছে। গড়ে ওঠছে দুর্বল স্থাপনার শিশু-বিনোদন পার্কও। আর আবদ্ধ নগরীর হাঁসফাঁস থেকে নাগরিকদের একটু মুক্ত পরিবেশে ঘুরে আসার বৈকালিক আগ্রহের ক্রমবর্ধমান চাহিদার সাথে সঙ্গতি রেখে সেখানেও ভাড়ায় ছোট্ট ট্রিপ দেয়ার মতো বেশ কিছু ছইঅলা কোষা-নৌকা চোখে পড়ে। কিন্তু নগরীর কোলাহলের বাইরে হলে কী হবে, কর্পোরেট থাবার নাগালের বাইরে যেতে পারে নি এগুলো কোনভাবেই। নৌকার ছইগুলো কর্পোরেট বিজ্ঞাপনের লাল লাল বিকল্প হয়ে ওঠার সৃজনশীল উদ্যোগে চমক আছে অবশ্যই। কিন্তু হারিয়ে গেছে বাঙালি মানসে লালন করা নৌকার সেই মোহময়ী আবেদন। এছাড়াও সেখানে চোখে পড়ে গ্রাম্য আবহ নিয়ে জাল ফেলে প্রতীক্ষারত দুয়েকটা ছোট ছোট মাছ ধরার কোষা নৌকা, গ্রামবাংলার হঠাৎ ঝলকে ওঠা বিস্মৃত কোন জলছবির নাগরিক সংস্করণ হয়ে।
.
.
নৌকার চিরায়ত রূপ এই নগরী আর কখনোই হয়তো ফিরে পাবে না। তবে নগরীর স্যুয়ারেজ ব্যবস্থা ও নালা-নর্দমা গ্রাস হয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত জলাবদ্ধতা তৈরির আলামত দেখে মনে হয় এই নগরী থেকে ছোট ছোট কোষা নৌকাগুলো হারাবে না কখনোই। একটু বৃষ্টি হলেই ঢাকার রাস্তাঘাট যেভাবে অথৈ পানিতে টইটম্বুর হয়ে যায়, তাতে যন্ত্র বা মনুষ্যচালিত চক্রযানের বদলে এই কোষা নৌকাগুলোই হয়ে ওঠতে পারে যথাযথ বিকল্প বাহন।

No comments: