Friday, August 12, 2011

| মনু’র বৈদিক চোখ : নারীরা মানুষ নয় আদৌ… | পর্ব-০১/৩ |

| মনু’র বৈদিক চোখ : নারীরা মানুষ নয় আদৌ… | পর্ব-০১/৩ |
-রণদীপম বসু

[ অখণ্ড পোস্ট এখানে পিডিএফ : নারী ও প্রগতি, জুলাই-ডিসেম্বর ২০১০ দ্বাদশ সংখ্যা ]
...
এটা কোন কথার কথা নয়
মানব সভ্যতার ইতিহাস আসলে ধর্মেরই ইতিহাস। সম্ভবত কথাটা বলেছিলেন দার্শনিক ম্যাক্স মুলার, যিনি প্রাচীন ভারতীয় দর্শন (Indian Philosophy) তথা বৈদিক সাহিত্য বা সংস্কৃতিরও একজন অনুসন্ধিৎসু বিদ্বান হিসেবে খ্যাতিমান। তবে যে-ই বলে থাকুন না কেন, সভ্যতার এক দুর্দান্ত বিন্দুতে দাঁড়িয়েও উক্তিটির রেশ এখনো যেভাবে আমাদের সমাজ সংস্কৃতি ও জীবনাচরণের রন্ধ্রে রন্ধ্রে খুব দৃশ্যমানভাবেই বহমান, তাতে করে এর সত্যতা একবিন্দুও হ্রাস পায় নি। বরং কোন কোন ক্ষেত্রে তা অনেক বেশিই প্রকট। কেননা বর্তমান বিশ্বে এমন কোন সভ্যতার উন্মেষ এখনো ঘটেনি যেখানে মানুষের জন্ম মৃত্যু বিবাহ উৎসব উদযাপন তথা প্রাত্যহিক জীবনাচরণের একান্ত খণ্ড খণ্ড মুহূর্তগুলো কোন না কোন ধর্মীয় কাঠামো বা অনুশাসনের বাইরে সংঘটিত হবার নিরপেক্ষ কোন সুযোগ পেয়েছে আদৌ। ব্যক্তির সাথে ব্যক্তির, গোষ্ঠির সাথে গোষ্ঠির, সমাজের সাথে সমাজের ইত্যাদি পারস্পরিক সম্পর্কের প্রেক্ষিতগুলো এখনো ধর্মকেন্দ্রিকতার বাইরে একচুলও ভূমিকা রাখতে পারে নি বলেই মনে হয়। এমন কি মানুষ হিসেবে আমাদের ব্যক্তি বা সামাজিক পরিচয়ের অন্তঃস্থ চলকগুলোও নিরেট ধর্মীয় পরিচয়েই মোড়ানো।

.
একেবারে বহিরঙ্গের পরিচ্ছদে যে যেই রঙের আঁচড়ই লাগাই না কেন, এই আলগা পোশাকের ভেতরের নিজস্ব যত্নশীল শরীরটা যে আসলেই কোন না কোন ধর্মীয় ছকের একান্তই অনুগত বাধক হয়ে আছে তা কি আর স্বীকার না করার কোন কারণ সৃষ্টি করতে পেরেছে ? অন্তত এখন পর্যন্ত যে পারে নি তা বলা যায়। আর পারে নি বলেই আরো অসংখ্য না-পারার ক্ষত আর খতিয়ানে বোঝাই হতে হতে আমরা ব্যক্তিক সামাজিক ও জাতিগতভাবেও একটা ঘূর্ণায়মাণ বৃত্তে আবদ্ধ হয়ে পড়ছি কেবল, বাইরের সীমাহীন সম্ভাবনায় পা রাখতে পারছি না সহজে। এবং একই কারণে আমাদের সমাজ-সংগঠন-চিন্তা বা দর্শনের জগতটাও অসহায়ভাবে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে একটা স্থবিঢ় বা অনতিক্রম্য বিন্দুতে। বাড়ছে না আমাদের বৃত্তাবদ্ধতার আয়তন বা সংগঠিত করা যাচ্ছে না কোন সংস্কারমূলক কর্মকাণ্ডও। কিন্তু কেন তা ভাঙা সম্ভব হচ্ছে না ?
 .
প্রশ্নের আকার যতো শীর্ণই হোক না কেন, ভাবগত অর্থে এতো বিশাল একটা প্রশ্নকে সামনে রেখে কোন একরৈখিক আলোচনা যে আদৌ কোন মীমাংসা বা সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্যে একান্তই অকার্যকর তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে আলোচনার কান ধরে টান দিলে হয়তো এমন অনেক প্রাসঙ্গিক প্রশ্নও সামনে চলে আসার সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেয়া যাবে না যেগুলোর যথাযথ উত্তর অনুসন্ধানের মধ্যেই কোন না কোন সমাধানের বীজ লুকিয়ে থাকতে পারে। সে বিবেচনায় একেবারে নিশ্চুপ থাকার চেয়ে কিঞ্চিৎ হল্লাচিল্লা করায় সম্ভাব্য সুবিধা রয়েছে বৈ কি। তাই সমাজ সভ্যতা সংস্কৃতির বহুমাত্রিক স্রোতে অত্যাবশ্যকীয় উপাদান হিসেবে মানুষের লিঙ্গীয় (Gender) অবস্থান বা আরও খোলাশা করে বললে সামগ্রিক জনগোষ্ঠির অর্ধাংশ জুড়ে যে নারী তাঁর ভূমিকা, কার্যকর প্রভাব ও অবস্থান চিহ্নিত করতে গেলে অনিবার্যভাবেই প্রচলিত ধর্ম ও অনিরপেক্ষ ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির প্রসঙ্গটি অনায়াসে সামনে চলে আসে। অনিরপেক্ষ বলা হচ্ছে এজন্যেই যে, আমাদের ধর্মীয় চেতনদৃষ্টি যে প্রকৃতপক্ষেই লিঙ্গ-বৈষম্যমূলক ও সুস্পষ্টভাবেই পুরুষতান্ত্রিক পরম্পরায় গড়ে ওঠা তা বোধ করি অস্বীকার করার উপায় নেই। এ ক্ষেত্রে আলোচনার সূত্র ধরে আমরা নাহয় একটু খোঁজার চেষ্টা করে দেখি, কী আছে এই ধর্মতত্ত্বের পেছনে ?
 .
ধর্মীয় অমানবিকতার আদিম ধারাটির নাম বৈদিক সংস্কৃতি
জগত জুড়ে ধর্মীয় সংস্কৃতির যে ক’টি প্রধান ধারার অস্তিত্ব এখনো বহাল রয়েছে তার মধ্যে সম্ভবত বৈদিক সংস্কৃতিই প্রাচীনতম। তার উৎস হচ্ছে বেদ (Veda), যা বর্তমান হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বিশ্বাস করা হয়। অথচ বহিরাগত একদল লিপিহীন বর্বর আক্রমণকারী শিকারি আর্য গোষ্ঠির দ্বারা এককালের আদিনিবাসী জনগোষ্ঠির মাধ্যমে গড়ে ওঠা সমৃদ্ধ প্রাচীন হরপ্পা বা সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংস হওয়া এবং এই ধ্বংসাবশেষের উপর ক্রমে ক্রমে গড়ে ওঠা আর্য সংস্কৃতির বিকাশের আর্যাবর্ত ধারাক্রমই মূলত এই বৈদিক সংস্কৃতি। যেখানে আর্যরা (Aryan) হয়ে ওঠে মহান শাসক আর আদিনিবাসী জনগোষ্ঠিটাই হয়ে যায় তাদের কাছে অনার্য বা শাসিত অধম, নামান্তরে দাস বা শূদ্র (Sudra)। তাই এই বৈদিক সংস্কৃতির ঐতিহাসিক ক্রমবিকাশের মধ্যেই একটি সভ্যতার উন্মেষ ও পর্যায়ক্রমে তার মাধ্যমে ধর্ম নামের একটি শাসনতান্ত্রিক ধারণার জন্ম ও আধিপত্য কায়েমের মধ্য দিয়ে এ ব্যবস্থার পরিণতি পর্যবেক্ষণ করলেই ধর্ম কী ও কেন- এ সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যায় বলে বিদ্বানেরা মনে করেন। আর প্রতিটা ধর্মেরই যেহেতু অন্যতম প্রধান শিকার হচ্ছে নারী, তাই আধিপত্যবাদী পুরুষতন্ত্রের ধারক ও বাহক এই ধর্মের প্রত্যক্ষ আক্রমণে কিভাবে সামাজিক নারী তার পূর্ণ মানব সত্তা থেকে সমূলে বিতাড়িত হয়ে কেবলই এক ভোগ্যপণ্য চেতনবস্তুতে পরিণত হয়ে যায় তারও উৎকৃষ্ট নমুনা-দলিল এই প্রাচীন বৈদিক শাস্ত্রই। বয়সে প্রবীণ এই শাস্ত্রের ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা ও সাফল্য থেকেই সম্ভবত পরবর্তী নবীন ধর্মশাস্ত্রগুলো তাদের পুরুষতান্ত্রিক শোষণের হাতিয়ারটাকে আরেকটু আধুনিক ও বৈচিত্র্যময় করে তার শাসন-দক্ষতাকেই সুচারু করেছে কেবল, খুব স্বাভাবিকভাবেই কোন মৌলিক মানবিক উন্নতি ঘটেনি একটুও। তাই সম্যক পর্যালোচনার খাতিরে আমরা এই বৈদিক শাস্ত্রের বিষয়-সংশ্লিষ্ট প্রসংগগুলো চয়ন করে এতদবিষয়ক কিছু প্রয়োজনীয় অভিজ্ঞতা নেয়ার কিঞ্চিৎ চেষ্টা করে দেখতে পারি।
 .
বৈদিক শব্দটি এসেছে ‘বেদ’ থেকে। ‘বেদ’ মানে হচ্ছে পবিত্র ও পরম জ্ঞান। ‘বেদ’ নামে সাধারণ্যে কোন একটি গ্রন্থবিশেষ বোঝালেও মূলত এটি প্রায় শতাধিক গ্রন্থের সমষ্টিই বোঝায়। যদিও বেদকে অপৌরুষেয় বলা হয়ে থাকে, অর্থাৎ বেদ মনুষ্যসৃষ্ট নয় বলে দাবী করা হয়, তবু সামগ্রিকভাবে এই শতাধিক গ্রন্থের সমষ্টিকেই ‘বৈদিক সাহিত্য’ বলা হয়। ভারতবর্ষীয় তথা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষার সর্বপ্রাচীন সাহিত্য এটি। এখানে স্মর্তব্য যে প্রাচীন ভারতীয় সংস্কৃতির ক্ষেত্রে দুটো মূল ধারা রয়েছে- বৈদিক ও অবৈদিক। বেদ বহির্ভূত যা কিছু নিকৃষ্ট ও আদিম- ওই অবৈদিক জড়বাদী (চার্বাক) উপাদান সম্বলিত লোকায়ত ধারাটির গুরুত্ব সেকালে পারতপক্ষে স্বীকার করা হতো না। শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর অনুকূল ভাববাদী বৈদিক ধারাটিরই জয়জয়কার ছিলো। বৈদিক ধারার ধারক ও বাহক ছিলো ‘বৈদিক সাহিত্য’ নামের এক বিশাল শাস্ত্র-ভাণ্ডার।  তাই বিষয় অনুসঙ্গ হিসেবে এ মুহূর্তে আমাদের লক্ষ্য হতে পারে এই বৈদিক সাহিত্যের কিছুটা সুলুক-সন্ধান করা, যেখানে সুকৌশলে এক আধ্যাত্মিক ভণ্ডামো আরোপ করে খুব সদম্ভেই নারী জাতিকে কেবলই ভোগ্যপণ্য ক্রিতদাসীতে পরিণত করে ফেলা হয়েছে ।
 .
রচনাকালের পরম্পরা ও প্রকৃতি অনুযায়ী ‘বেদ’ চারটি- ১) ঋগ্বেদ, ২) সামবেদ, ৩) যজুর্বেদ, ৪) অথর্ববেদ।
এই প্রতিটি বেদের চারটি অংশ:
ক) ‘সংহিতা’ বা সংগ্রহ- গান, স্তোত্র, মন্ত্র প্রভৃতির সংকলন।
খ) ‘ব্রাহ্মণ’-  গদ্যে রচিত একজাতীয় যাগযজ্ঞ-বিষয়ক সুবিশাল সাহিত্য।
গ) ‘আরণ্যক’- অরণ্যে রচিত একজাতীয় সাহিত্য, বিশ্ব-রহস্যের সমাধান অন্বেষণই তার প্রধান উদ্দেশ্য।
ঘ) ‘উপনিষদ’- আক্ষরিক অর্থে গুহ্য-জ্ঞান, দার্শনিক তত্ত্বের বিচারই এর প্রধান বিষয়বস্তু। এই উপনিষদকে ‘বেদান্ত’ সাহিত্যও বলা হয়।
.
বেদের সংহিতা ও ব্রাহ্মণ অংশকে কর্মকাণ্ড, আরণ্যককে উপাসনাকাণ্ড এবং উপনিষদকে জ্ঞানকাণ্ড বলা হয়। রচনাকাল ও বিষয়বস্তুর দিক থেকে প্রত্যেকটি অংশের মধ্যে একটা ধারাবাহিকতা রয়েছে বলে স্বীকৃত। বৈদিক সাহিত্যের বহু প্রাচীন অংশই বিলুপ্ত হয়েছে। তবুও যা টিকে আছে তাও আকারে সুবিশাল।
 .
বেদের কাল
বেদের সুক্ত বা সংহিতাগুলো অতি প্রাচীনকালে দীর্ঘ সময় নিয়ে রচিত হয়েছে। অর্থাৎ তা কোন একক ব্যক্তির রচিত নয়। বংশ পরম্পরাক্রমে তা মুখে মুখে রচিত হয়েছে এবং শ্রুতির মাধ্যমে তা সংরক্ষিত হয়েছে। তাই বেদকে শ্রুতি গ্রন্থ্ও বলা হয়। বেদের রচনাকাল নিয়ে মতভেদ থাকলেও ধারণা করা হয় খিস্টপূর্ব ২০০০ বা ২৫০০-তে এর রচনাকাল শুরু এবং রচনা সম্পন্ন হয়েছে খ্রিস্টপূর্ব ৭৫০ থেকে ৫০০-এর মধ্যে। সুনির্দিষ্ট কোন সন-তারিখের হিসাব করা সম্ভব না হলেও গবেষকদের স্থির সিদ্ধান্ত এটুকু যে, গৌতম বুদ্ধের পূর্বেই এ-সাহিত্যের রচনা ও সংকলন সমাপ্ত হয়েছিলো। এই দীর্ঘ সময়ের পরিক্রমায় বহু শতাব্দির ব্যবধানের কারণেই বেদের প্রথম দিকের রচনাগুলোর সাথে শেষের দিকের রচনাগুলোর উদ্দেশ্য, ভাব ও দৃষ্টিভঙ্গিতে বিস্তর পার্থক্য তৈরি হয়ে গেছে। প্রথম দিকের রচনা সুক্তগুলোর মাধ্যমে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক সত্তা যেমন অগ্নি, নদী, বাতাস, সোম (এক জাতীয় লতা)-কে দেবতা জ্ঞান করে লিপিহীন আদিম পশুপালক জনগোষ্ঠির চাওয়া-পাওয়ার লক্ষ্য নিবদ্ধ ছিলো। এবং তা নিবিষ্ট ছিলো কোন যজ্ঞরূপ আয়োজনের মধ্য দিয়ে দৈনন্দিন ইহলৌকিক জীবনযাত্রার সাধারণ ধনসম্পদ ভোগের কামনার মধ্যে। বা কোন গোত্র-প্রধান ইন্দ্রের প্রতি নিজেদেরকে রক্ষার আবেদনে। ফলে তাকে অনেকটাই আদিম টোটেম উপজাত বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। যেমন-

‘উপঃ নঃ সবনা গহি সোমস্য সোমপাঃ পিব। নোদা ইদ্রেবতো মদঃ।।’
হে সোমপায়ী ইন্দ্র! আমাদের অভিষবের নিকট এস, সোমপান কর; তুমি ধনবান তুমি হৃষ্ট হলে গাভী দান কর। (মণ্ডল ১। সুক্ত ৪। ঋক ২)।
‘স নো দূরাচ্চাসাচ্চ নি মর্ত্যাদঘায়োঃ। পাহি সদমিদ্বিষবায়ুঃ।।’
হে সর্বত্রগামী অগ্নি! তুমি দূরে ও আসন্ন দেশে পাপাচারী মানুষ হতে আমাদের সর্বদা রক্ষা করো। (মণ্ডল ১ সুক্ত ২৭ ঋক ৩)।
‘আ নো ভজ পরমেষবা বাজেষু মধ্যমেষু। শিক্ষা বষ্বো অন্তমষ্য।।’
পরম অন্ন ও মধ্যম অন্ন আমাদের প্রদান কর, অন্তিকস্থ ধন প্রদান কর। (মণ্ডল ১ সুক্ত ২৭ ঋক ৫) ইত্যাদি।
আর শেষের দিকের এসে রচিত সুক্তগুলোয় একধরনের পারলৌকিক ধারণার উপস্থিতি দেখা যায়। অর্থাৎ তাদের আদিম অগভীর বিশৃঙ্খল চিন্তাসূত্রের মধ্যে ততদিনে আরো উন্নত কল্পনার একটা শৃঙ্খলা তৈরি হয়ে গেছে। যেমন-

‘যত্রে যমং বৈবস্বতং মনো জগাম দূবকম্। তত্ত আ বর্তয়ামসীহ ক্ষয়ায় জীবসে।।’
তোমার যে মন অতি দূরে বিবস্বানের পুত্র যমের নিকট গিয়েছে, তাকে আমরা ফিরিয়ে আনছি, তুমি জীবিত হয়ে ইহলোকে এসে বাস কর। (মণ্ডল ১০। সুক্ত ৫৮। ঋক ১)।

উল্লেখ্য, এই কাল্পনিক পারলৌকিক ধারণাই যে ধর্ম ব্যবস্থার প্রধানতম হাতিয়ার হয়ে পরবর্তীকালের মানবসংস্কৃতিকে বিভিন্নভাবে নিয়ন্ত্রণ করেছে এবং এখনও করে যাচ্ছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিংবা তুলনামূলক আরেকটু উন্নত চিন্তার উপস্থিতি দেখতে পাই, যখন বলা হয়-

‘কিয়তী যোষা মর্যতো বধূয়োঃ পরিপ্রীতা পন্যসা বার্ষেণ। ভদ্রা বধূর্ভবতি যৎসুপেশাঃ স্বরং সা মিত্রং বনুতে জনে চিৎ।।’
কত স্ত্রীলোক আছে, যে কেবল অর্থেই প্রীত হয়ে নারীসহবাসে অভিলাষী মনুষ্যের প্রতি অনুরক্ত হয়? যে স্ত্রীলোক ভদ্র, যার শরীর সুগঠন, সে অনেক লোকের মধ্য হতে আপনার মনোমত প্রিয় পাত্রকে পতিত্বে বরণ করে। (মণ্ডল ১০ সুক্ত ২৭ ঋক ১২)।

অর্থাৎ তখন একটা সুস্পষ্ট সামাজিক কাঠামো দাঁড়িয়ে গেছে যেখানে অর্থের বিনিময়ে ভোগ-উপভোগ বা অন্যদিকে নিরাপদ পরিবার গঠনের নীতিবোধ বিরাজ করতে শুরু করেছে সামাজিক আবহে। এই তুলনামূলক পার্থক্যগুলো উপলব্ধি করতে এখানে স্মর্তব্য যে, বেদজ্ঞ পণ্ডিতদের মতে প্রাচীন ঋগ্বেদের মোট দশটি মণ্ডলের মধ্যে সর্বশেষ দশম মণ্ডলের সুক্তগুলো বেদের পূর্ববর্তী নয়টি মণ্ডলের সার্বিক আবহের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। অর্থাৎ ধারণা করা হয় আরো বহুকাল পরে হয়তো উপনিষদ যুগে এই দশম মণ্ডলটি ঋগ্বেদে সংযোজিত হয়েছে। এছাড়াও অন্যান্য বেদসংহিতা গ্রন্থেও ঋগ্বেদের বহু শ্লোকের পুনরুক্তি রয়েছে। সম্ভবত পরবর্তীকালের ধর্মীয় উপজগুলো এভাবেই কথিত বেদাশ্রিত হয়ে আগ্রাসী ধর্মরথকে তার উদ্দেশ্যমূলক গতিপথে বেগবান করতে সহায়তা করেছে। তাৎক্ষনিক অবস্থায় হাতের সামনে যা চোখে পড়লো উদাহরণ হিসেবে তা-ই উদ্ধৃত করা হলো। বেদে এ ধরনের উদাহরণ ভুরি ভুরি রয়েছে।
 .
মনুসংহিতার উন্মেষ ও ব্রাহ্মণ্যবাদ
বেদ ও উপনিষদের পরে ভারতবর্ষে ছয়টি আস্তিক দর্শনের আবির্ভাব ও পর্যায়ক্রমে স্তরে স্তরে এগুলোর ক্রমবিকাশ ঘটে। অর্থাৎ বেদের সংহিতাকে আশ্রয় করে পরবর্তীতে পর্যাক্রমে রচিত অন্য সাহিত্য বা স্মৃতিগ্রন্থগুলো যেমন ব্রাহ্মণ, আরণ্যক হয়ে উপনিষদের যুগে এসে পুরোপুরি ভাববাদে প্রবেশ করেছে। ততদিনে ভারতীয় সমাজে হিন্দুইজম (Hinduism) বা বৈদিক দর্শন রীতিমতো শেকড় গেড়ে বসেছে। এবং সেগুলোকে আশ্রয় করে পরবর্তীকালে রচিত বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থের মাধ্যমে ধর্মীয় শাসনতন্ত্র তার শেকড়-বাকড় ছড়িয়ে সমাজদেহে পূর্ণ থাবা বিস্তার করে ফেলেছে। তারই ঐতিহাসিক উৎকৃষ্ট নিদর্শন হচ্ছে মনুস্মৃতি (Manu smriti) বা মনুসংহিতা (Manu samhita), যাকে বৈদিক সংস্কৃতি বা ব্রাহ্মণ শাসনের সংবিধান বললেও বাহুল্য হবে না। সামাজিক বিশ্বাস এমন যে- এর মধ্যেই নিহিত আছে সমস্ত বেদার্থ। অথচ এই মনুসংহিতাই হলো পৃথিবীর অন্যতম বর্বর, নীতিহীন, শঠতা আর অমানবিক প্রতারণায় পরিপূণ বর্ণবাদী ব্রাহ্মণ্যবাদের আকর গ্রন্থ। ভারতীয় শ্রুতি ও স্মৃতির পরম্পরায় বৈদিক পরিমণ্ডলের ধর্মীয় দুরুহতা অতিক্রমের জন্যেই উপনিষদগুলোর পরবর্তী ধাপে মনুসংহিতার মতো ধর্মশাস্ত্র সৃষ্ট হয় বলে দাবী করা হয়। এটিকে বেদের নির্যাস স্মৃতিগ্রন্থ হিসেবে দাবি করা হলেও মূলতঃ তা উপরিউক্ত সবগুলো গ্রন্থেরই নির্যাস নিয়ে রচিত ব্রাহ্মণ্য শাসনতন্ত্রের নীতিসূত্রগ্রন্থ বলে মনে করা হয়। তার আলোকেই হিন্দু ধর্মের যাবতীয় রীতিনীতি জীবনযাপন পূজাশাসন আচারবিচার সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হয়েছে এবং এখনো তার ভিত্তিতেই ধর্মীয় অনুশাসনের মাধ্যমে যাবতীয় ক্রিয়াকাণ্ড বাস্তবায়ন করা হয়ে থাকে। এমন কি বর্তমানেও হিন্দু ধর্মানুসারীদের জন্য প্রয়োগযোগ্য রাষ্ট্রীয় যে বিশেষ আইন যেখানে ‘হিন্দু আইন অনুযায়ী’ শব্দ-সমষ্টি দ্বারা ট্যাগ করা হয়ে থাকে তার অন্যতম উৎস হিসেবেও মনুসংহিতাই প্রধান। অর্থাৎ এটি সমাজ-উদ্ভূত বিশেষ আইনশাস্ত্র হিসেবেও প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। অথচ মজার ব্যাপার হলো, চা থেকে যেমন পেয়ালা গরম হয়ে থাকে তেমনি বেদের সহনীয় নিরপেক্ষতার চাইতেও কথিত বেদাশ্রিত মনুসংহিতার আরোপিত অনুশাসনগুলো শতগুণ কট্টর বর্ণবাদী, বৈষম্যমূলক ও তীব্র অমানবিকই শুধু নয়, অদ্ভুত বর্ণাশ্রম প্রচলনকারী এই শাস্ত্রগ্রন্থে বস্তুত মানবিক সত্তাময় মানুষের উপস্থিতি নাই বললেই চলে। আর নারী তো সেখানে মানুষই নয়, হয়তো অন্যকিছু।
 .
প্রায় দুহাজার সাতশত শ্লোক সংবলিত দ্বাদশ অধ্যায়ে বিভক্ত বর্তমানে প্রচলিত ‘মনুসংহিতা’ ভারতীয় সমাজ ও সাহিত্যের ইতিহাসে একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ও বহুল আলোচিত গ্রন্থ নিঃসন্দেহে। এটিকে একাধারে স্মৃতিশাস্ত্র ও ধর্মশাস্ত্র হিসেবে অত্যন্ত মান্য করা হয়। এটাকে তৎকালীন বৈদিক আর্য সমাজ ও প্রচলিত হিন্দু সমাজের অবশ্য পালনীয় পবিত্র সংবিধান বা সামগ্রিক ও সম্পূর্ণ জীবনাচরণবিধি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। মনুসংহিতাকে পরিপূর্ণ একটি ধর্ম ও শাস্ত্র গ্রন্থ হিসেবে বিবেচনা করা হয় এজন্যে যে, এই গ্রন্থে বিশ্বজগৎ বা বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ডের যাবতীয় বস্তুনিচয়, গোটা প্রাণীকূল, উদ্ভিদ, গ্রহ-নক্ষত্র-পৃথিবী, আলো-জল-হাওয়া, দিন-রাত্রি-সময়-কাল-যুগ, জীব-জগতের উৎস, স্বভাব-চরিত্র-জীবনযাপন, গুণ ও দোষবাচক সমস্ত অনুভব-অনুভূতি, স্বর্গ-মর্ত্য-নরক, জীবলোক-মৃতলোক, সাক্ষি-বিচার-শাসন, আচার-অনুষ্ঠান, জন্ম-মৃত্যু-বিবাহ, খাবার-খাদ্য, ভক্ষ্য-অভক্ষ্য, শূচি-অশূচি ইত্যাদি যাবতীয় বস্তুগত ও ভাবগত বিষয়ের সৃষ্টিরহস্য ব্যবহার-বিবেচনা বর্ণিত হয়েছে কল্পনার সমৃদ্ধ শিখরে অবস্থান করে অত্যন্ত আকর্ষণীয় নিজস্ব ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে। মোটকথা মনুসংহিতা হচ্ছে বিশ্বাসীদের কাছে একটি ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সমগ্র জীবন বিধান। কারণ এগুলো স্বয়ং মনুর বচন। যদিও শাস্ত্রগ্রন্থটির নাম থেকেই বুঝা যায় এটি মনুর রচিত সুক্ত বা শ্লোক বা স্মৃতিশান্ত্র, তবু এই মনুর পরিচয় নিয়েও যথেষ্ট বিভ্রান্তি রয়ে গেছে স্মৃতিশাস্ত্রেই। তাহলে এই মনু কে ?
.
কে এই মনু ?
সুপ্রাচীন বৈদিকযুগ থেকেই বিভিন্নভাবে এই মনু’র উল্লেখ পাওয়া যায় এবং তা থেকে মনুর প্রাচীনত্বই প্রমাণিত হয়। ঋগ্বেদের ২ মণ্ডল ৩৩ সুক্ত ১৩ ঋক-এ ঋষিগণ মরুদগণের উদ্দেশ্যে স্তুতি নিবেদনের সময় পিতা মনুর সুখপ্রদ ঔষধ মনোনীত করার কথা উল্লেখ করেছেন এভাবে-

“যা বো ভেষজা মরুতঃ শুচীনি যা শন্তমা বৃষণো যা ময়োভু।
যানি মনুরবৃণীতা পিতা নস্তা শঞ্চ যোশ্চ রুদ্রস্য রশ্মি।।”
হে মরুৎগণ ! তোমাদের যে নির্মল ঔষধ আছে, হে অভীষ্টবর্ষিগণ, তোমাদের যে ঔষধ অত্যন্ত সুখকর ও সুখপ্রদ, যে ঔষধ আমাদের পিতা মনু মনোনীত করেছিলেন, রুদ্রের সে সুখকর ভয়হারী ঔষধ আমরা কামনা করছি। (২.৩৩.১৩)।
আবার অষ্টম মণ্ডলের ৩০ সুক্তের ৩ ঋকে দেবতাদের কাছে ঋষিরা প্রার্থনা জানাচ্ছেন, তাঁরা যেন পিতা মনু থেকে আগত পথ হতে ভ্রষ্ট না হন। দেবতাদের উদ্দেশ্যে মনুর যজ্ঞনিবেদনের কথাও ঋগ্বেদে বহুবার (৮.৩০.২, ১০.৩৬.১০ ও ১০.৬৫.১৪ প্রভৃতি) পাওয়া যায়। ঋগ্বেদে মনু’র এরকম বহু উল্লেখ থেকে তাকে একজন প্রভাবশালী স্বতন্ত্র মানুষ বলে মনে হয় এবং প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যে নানা প্রসঙ্গে মনুকে মনুষ্যজাতির জনক আদিপিতা, পুরাতন ঋষি, অগ্নিদেবের সংস্থাপক, অর্থশাস্ত্রের প্রণেতা, কৃতযুগের রাজা প্রভৃতিরূপে উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ঋগ্বেদের সর্বানুক্রমণীতে মনুকে পাঁচটি সুক্তের ঋষি বলা হয়েছে এবং বেদের নিরুক্ত ভাষ্যকার সায়ণ এইসব সুক্তের ভাষ্যে মনু-অর্থে বৈবস্বত মনুর উল্লেখ করেছেন।
 .
তৈত্তিরীয় সংহিতায় মনু’র নির্দেশকে ‘ভেষজ’ বলা হয়েছে- “যদ্বৈ কিং চ মনুরবদৎ তদ্ ভেষজম্।” ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণে “সর্বজ্ঞানময়ো বেদঃ সর্ববেদময়ো মনুঃ” উক্তিটির মাধ্যমে মনুর মধ্যে সমস্ত বেদের জ্ঞান নিহিত আছে বলে প্রশংসা করা হয়েছে। ছান্দোগ্য উপনিষদে ঋষি বলছেন- “প্রজাপতি (ব্রহ্মা) মনুকে উপদেশ দিয়েছিলেন এবং মনুই প্রজাদের মধ্যে তা প্রচার করেন।”- “প্রজাপতি র্মনবে মনুঃ প্রজাভ্যঃ” (৩.১১.৪)। তৈত্তিরিয় সংহিতায় মনু থেকেই প্রজা সৃষ্টি হওয়ার কথা বলা হয়েছে। মহাভারতেও অসংখ্যবার মনু’র উল্লেখ পাওয়া যায়। সেখানে কখনো ‘স্বায়ংভুব মনু’ এবং কখনো বা ‘প্রাচেতস মনু’র উক্তি উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে। মহাভারতের শান্তিপর্বে (৩৩৬.৩৮-৪৬) বর্ণিত হয়েছে-

পুরুষোত্তম ভগবান ধর্মবিষয়ক লক্ষ শ্লোক রচনা করেছিলেন, যার দ্বারা সমগ্র লোকসমাজের পালনীয় ধর্মের প্রবর্তন হয়েছিলো (লোকতন্ত্রস্য কৃৎস্নস্য যস্মাদ্ ধর্মঃ প্রবর্ততে)। স্বায়ংভুব মনু নিজে ঐ ধর্মগুলি প্রচার করেছিলেন এবং পরবর্তীকালে উশনাঃ ও বৃহস্পতি মনু-স্বায়ংভুবের গ্রন্থ আশ্রয় করে নিজ নিজ শাস্ত্র রচনা করেছিলেন।–
স্বায়ংভুবেষু ধর্মেষু শাস্ত্রে চৌশনসে কৃতে।
বৃহস্পতিমতে চৈব লোকেষু প্রতিচারিতে।।
আবার মহাভারতের অন্তর্গত ভগবদ্গীতায় বৈবস্বত মনুরও উল্লেখ দেখা যায়। ভগবদ্গীতায় ভগবান্ শ্রীকৃষ্ণ নিজের উপদিষ্ট যোগের প্রাচীনত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে অর্জুনকে বলছেন-

“ইমং বিবস্বতে যোগং প্রোক্তবান্ অহমব্যয়ম্।
বিবস্বান্ মনবে প্রাহ মনুরিক্ষাকবেহব্রবীৎ।।” (৪.১)
ভগবান ঐ যোগ পুরাকালে বিবস্বানকে বলেছিলেন এবং বিবস্বান নিজপুত্র বৈবস্বত মনুকে বলেছিলেন। পরে বৈবস্বত মনু ঐ যোগ ইক্ষাকুকে উপদেশ দিয়েছিলেন।
তবে খোদ মনুসংহিতার মধ্যেই মনুস্মৃতির উদ্ভব কাহিনী বর্ণিত রয়েছে ভিন্নভাবে। স্বয়ম্ভু ভগবান কর্তৃক পূর্বে অপ্রকাশিত এই বিশ্বসংসার সৃষ্টি ও সংহারের পর্যায়ক্রমিক বিশদ বর্ণনার এক পর্যায়ে এসে মনুসংহিতায় বলা হচ্ছে-

এবং স জাগ্রৎস্বপ্নাভ্যামিদং সর্বং চরাচরম্।
সঞ্জীবয়তি চাজস্রং প্রমাপয়তি চাব্যয়ঃ।। (১/৫৭)
এইরূপে সেই অব্যয় পুরুষ ব্রহ্মা স্বীয় জাগ্রৎ ও স্বপ্ন অবস্থার দ্বারা এই চরাচর বিশ্বের সতত সৃষ্টি ও সংহার করছেন।
এরপরই আমরা পেয়ে যাই এই শাস্ত্র প্রস্তুতির উল্লেখ-

ইদং শাস্ত্রং তু কৃত্বাসৌ মামেব স্বয়মাদিতঃ।
বিধিবদ্ গ্রাহয়ামাস মরীচ্যাদীংস্ত¡হং মুনীন্।। (১/৫৮)
ব্রহ্মা সৃষ্টির প্রথমে এই শাস্ত্র প্রস্তুত করে আমাকে যথাবিধি অধ্যয়ন করিয়েছিলেন এবং আমি (মনু) মরীচি প্রভৃতি মুনিগণকে অধ্যয়ন করিয়েছি।

প্রখ্যাত শাস্ত্রভাষ্যকার মেধাতিথি মনুসংহিতার প্রথম অধ্যায়ের এই ৫৮ সংখ্যক শ্লোকের ভাষ্যে বলেন-
নারদশ্চ স্মরতি। শতসাহস্রো গ্রন্থঃ প্রজাপতিনা কৃতঃ স মন্বাদিভিঃ ক্রমেণ সংক্ষিপ্ত ইতি।” অর্থাৎ এখানে নারদ বলছেন- “এই গ্রন্থ শতসাহস্র বা লক্ষ সন্দর্ভাত্মক; প্রজাপতি (ব্রহ্মা) এটি রচনা করেছেন। তারপর ঐ লক্ষ সন্দর্ভটিকে ক্রমে ক্রমে মনু প্রভৃতি মহর্ষিগণ সংক্ষিপ্ত করেছেন।
এই একই শ্লোকের টিকায় কুল্লুকভট্ট নারদের উক্তি উল্লেখ করে বলেন-
ব্রহ্মা প্রথমে স্মৃতিগ্রন্থটি প্রণয়ন করেন; তারপর মনু নিজ ভাষায় তার সারসংক্ষেপ করেন এবং সেই সংক্ষিপ্ত গ্রন্থটিই তাঁর শিষ্যদের মধ্যে প্রচার করেন।
 .
পুরাণে পৃথিবীকে সপ্তদ্বীপা কল্পনা করে সেই সেই দ্বীপে সাতটি জাতির পর্যায়ক্রমে বসতি স্থাপনের উল্লেখ দেখা যায়। এই সাতটি ছিল মূল জাতি। প্রত্যেক মূল জাতির আদি পিতা মনু; ফলে মোট সাতজন মনুর অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। এঁরা হলেন- স্বায়ংভুব, স্বারোচিষ, ঔত্তমি, তামস, রৈবত, চাক্ষুষ ও বৈবস্বত। এঁদের মধ্যে বৈবস্বত মনুকে আর্যজাতির আদি পিতারূপে কল্পনা করা হয়েছে। মনুসংহিতায় এই মনুর কথাই বলা হয়েছে ১/৬১-৬৩ শ্লোকে। শ্রী হীরেন্দ্রনাথ দত্তের মতে- “এইসব মনু ব্যক্তিবিশেষের নাম নয়। প্রত্যেক মূল জাতির আদি পিতা এক এক জন মনু এবং তাঁদের নামানুসারেই সেই জাতির জীবিতকালকে ‘মন্বন্তর’ বলা হয়।” মনুসংহিতার প্রথম অধ্যায়ে (শ্লোক ৩২-৩৫) দেখা যায়, প্রজাপতি ব্রহ্মা থেকে বিরাট্ পুরুষের উৎপত্তি হয়েছিল এবং সেই বিরাট্ পুরুষ তপস্যার দ্বারা মনু-কে সৃষ্টি করেছিলেন। মনু আবার প্রজাসৃষ্টির অভিলাষে ক্লেশকর তপস্যা করে যে দশজন প্রজাপতি (এঁরা সকলেই মহর্ষি) সৃষ্টি করলেন তাঁরা হলেন- মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু, প্রচেতা, বশিষ্ঠ, ভৃগু এবং নারদ। প্রথম অধ্যায়ের শ্লোক ৫৮-৫৯ অনুযায়ী বলা হচ্ছে, ব্রহ্মা মনুসংহিতায় আলোচনীয় শাস্ত্র অর্থাৎ বিধিনিষেধসমূহ প্রস্তুত করে প্রথমে মনু-কে অধ্যয়ন করিয়েছিলেন এবং তারপর মনু তা মরীচি প্রভৃতি মুনিগণকে পড়িয়েছিলেন। ভৃগুমুনি এই সম্পূর্ণশাস্ত্র মনুর কাছে অধ্যয়ন করলেন। চারটি বর্ণের ও সঙ্কর জাতিগণের ধর্মসমূহ জানার উদ্দেশ্যে মনু-সমীপে আগত মহর্ষিদের মনু জানালেন যে, তিনি এইসব শাস্ত্র ভৃগুকে শিক্ষা দিয়েছেন এবং এই ভৃগুই ঐ শাস্ত্র আদ্যোপান্ত সকলকে শোনাবেন। মনুকর্তৃক এইভাবে আদিষ্ট হয়ে মহর্ষি ভৃগু খুশি হয়ে সকল ঋষিকে তাঁদের জিজ্ঞাস্যের উত্তর দিতে লাগলেন- এভাবেই মনুসংহিতা ভৃগু কর্তৃক সংস্কার ও সংকলিত হয়ে প্রচারিত হলো। এ প্রসঙ্গে মনুসংহিতার সর্বশেষ অর্থাৎ দ্বাদশ অধ্যায়ের অন্তিম শ্লোকটি লক্ষ্যণীয়-

ইত্যেতন্মানবং শাস্ত্রং ভৃগুপ্রোক্তং পঠন্ দ্বিজঃ।
ভবত্যাচারবান্ নিত্যং যথেষ্টাং প্রাপ্লুয়াদ্ গতিম্।। (১২/১২৬)
ভৃগুর দ্বারা কথিত এই মনু-সৃষ্ট-শাস্ত্র নিয়মিত পাঠ করতে থাকলে দ্বিজগণ সতত আচারনিষ্ঠ হন এবং যথাভিলষিত উৎকৃষ্ট গতি অর্থাৎ স্বর্গ লাভ করেন।
এইসব শাস্ত্রীয় বিভ্রম বা অহেতুক বিভ্রান্তিকর তথ্য উল্লেখ করার কারণ হচ্ছে সংশ্লিষ্ট ধর্ম ও সামাজিক ব্যাপ্তিতে এই মনু ও মনুসংহিতার অসাধারণ শাস্ত্রীয় গুরুত্ব এবং তার সমকালীন প্রভাব ও প্রাধান্যটুকু সম্যক ধারণা নেয়ার জন্যে। ভারতীয় সমাজ শাস্ত্র ও সংস্কৃতিতে নারীদেরকে মানুষ থেকে এক ঝটকায় ভোগ্যপণ্য সামাজিক সত্তা বানিয়ে হাজার হাজার বছর ধরে পুরুষতান্ত্রিক ভোগের মহোৎসবে পরিণত করার মূল হোতা এই মনু গং যে এতোটা সর্বগ্রাসী প্রভাব বিস্তার করেছিলো, মনু-শাসনের নারী-নিবর্তনমূলক অঙ্গনে প্রবেশের আগে তার ব্যাপক আয়োজনের প্রেক্ষিতটাও জানা জরুরি বৈ কি। এ ব্যাপারে ভারতীয় শাস্ত্রগুলোতে একটু সতর্ক মনোনিবেশ করলেই এর গূঢ় অভিসন্ধিটুকু আঁচ করা যায়।  
 .
মনুর কাল ও আধিপত্য
প্রাচীনকাল থেকেই যে এই মনুসংহিতাকে স্মৃতিশাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে, বহু প্রাচীন শাস্ত্রগ্রন্থেই এর উল্লেখ রয়েছে।
যেমন রামায়ণের কিস্কিন্ধ্যাকাণ্ডে দেখা যায়, রামচন্দ্রকর্তৃক আহত বানররাজ বালি রামচন্দ্রকে ভর্ৎসনা করলে রামচন্দ্র মনুসংহিতা থেকে দুটো শ্লোক উদ্ধৃত করে নিজ দোষ ক্ষালনে উদ্যোগী হয়েছিলেন-

“রাজভিঃ ধৃতদণ্ডাশ্চ কৃত্বা পাপানি মানবাঃ।
নির্মলাঃ স্বর্গমায়ান্তি সন্তঃ সুকৃতিনো যথা।।
শাননাদ্ বাপি মোক্ষাদ্ বা স্তেনঃ পাপাৎ প্রমুচ্যতে।
রাজা ত্বশাসন্ পাপস্য তদবাপ্নোতি কিল্বিষম্ ।।”
মানুষ পাপ করলে যদি রাজা তাকে দণ্ড দেন, তবে সে পাপমুক্ত হয়ে পুণ্যবান ব্যক্তির ন্যায় স্বর্গে যায়; রাজার দ্বারা শাসিত হলে, অথবা বিচারের পর বিমুক্ত হলে, চোর চৌর্যপাপ থেকে মুক্তি লাভ করে। কিন্তু রাজা চোরকে শাসন না করলে তিনি নিজেই ঐ চৌর্যপাপের দ্বারা লিপ্ত হন।

রামায়ণে উদ্ধৃত এই শ্লোক দুটি মনুসংহিতার অষ্টম অধ্যায়ের ৩১৬ ও ৩১৮ সংখ্যক শ্লোকে প্রায় একইভাবে পাওয়া যায়। এ থেকে মনে করা যায়, রামায়ণের সময়েও শ্লোকাকারে মনুসংহিতা আংশিকভাবে হলেও প্রচলিত ছিলো।
 .
৮০০ থেকে ৮২৫ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আবির্ভূত টীকাকার বিশ্বরূপ তাঁর যাজ্ঞবল্ক্যসংহিতার টীকায় মনুসংহিতা থেকে দুশটিরও বেশি শ্লোকের পূর্ণাঙ্গ বা আংশিক উদ্ধৃতি দিয়েছেন বলে P.V. Kane দেখিয়েছেন। সপ্তম শতকে আবির্ভূত বিখ্যাত অদ্বৈতবাদী বা মায়াবাদের জনক শঙ্করাচার্য তাঁর বেদান্তসূত্রভাষ্যে প্রায়ই মনুসংহিতা থেকে শ্লোক উদ্ধৃতি দিয়েছেন (উল্লেখ্য, বর্তমানকালের প্রচলিত হিন্দু দর্শন শঙ্কারাচার্যের এই মায়াবাদের উপরই আশ্রিত বলা যায়)। মোটামুটিভাবে চতুর্থ-পঞ্চম শতকের লোক মহাকবি কালিদাস তাঁর রচিত রঘুবংশের প্রথম সর্গে ১৭ সংখ্যক শ্লোকে দিলীপের বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছেন-

এই রাজার শাসনপ্রভাবে মনুর সময় থেকে প্রচলিত চিরাচরিত আচার-পদ্ধতি থেকে তাঁর প্রজারা বিচলিত হননি-
“রেখামাত্রমপি ক্ষুণ্নাদা মনো র্বত্মনঃ পরম্।
ন ব্যতীয়ুঃ প্রজাস্তস্য নিয়ন্তু র্নেমিবৃত্তয়ঃ।।”

আবার চতুর্দশ সর্গে ৬৭ সংখ্যক শ্লোকে কালিদাস বলেছেন-

রাজা যাতে বর্ণ ও আশ্রম সুরক্ষিত করতে পারেন, তার জন্য মনু কিছু ধর্ম নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন-
“নৃপস্য বর্ণাশ্রমপালনং যৎস এব ধর্মো মনুনা প্রণীতঃ।”
২০০ থেকে ৩০০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে রচিত শূদ্রকের মৃচ্ছকটিক নাটকের নবম অঙ্কে মনুর একটি অনুশাসনের উল্লেখ রয়েছে এভাবে-

“অয়ং হি পাতকী বিপ্রো ন বধ্যো মনুরব্রবীৎ।
রাষ্ট্রাদস্মাত্তু নির্বাস্যো বিভবৈরক্ষতৈঃ সহ।।”
মনুর মতানুসারে পাপাচারী ব্রাহ্মণ বধ্য হবেন না, বরং এঁকে এঁর সমস্ত ধন-সম্পদের সাথে রাজ্য থেকে বহিষ্কৃত করাই বিধি।
৫০০ খ্রিস্টাব্দের বেশ কিছুকাল আগেই আবির্ভূত জৈমিনি-সূত্রের ভাষ্যকার শবরস্বামী তাঁর ভাষ্যে মনু ও অন্য কয়েকজনকে উপদেশদাতা রূপে চিহ্নিত করেছেন এবং মনুসংহিতার অষ্টম অধ্যায় থেকে একটি স্মৃতিবিষয়ক শ্লোক (৪১৬ সংখ্যক) স্মরণ করেছেন এভাবে-

“এবং চ স্মরতি। ভার্যা দাসশ্চ পুত্রশ্চ নির্ধনা সর্ব এব তে।
যত্তে সমধিগচ্ছন্তি যস্য তে তস্য তদ্ধনম্।।”
স্মৃতিকারগণের মতে, ভার্যা, পুত্র ও দাস- এরা তিনজনই অধম; এরা তিনজনেই যা কিছু অর্থ উপার্জন করবে, তাতে এদের কোনও স্বাতন্ত্র্য থাকবে না, পরন্তু এরা যার অধীন ঐ ধন তারই হবে।
এসব উদাহরণ থেকে অনুমান করা ভুল হবে না যে আনুমানিক দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দ থেকেই এই মনুসংহিতাকে স্মৃতিশাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে স্বীকার করা হয়েছে। ফলে এটাও স্পষ্ট যে এই সময়কালের আগেই অর্থাৎ দ্বিতীয় খ্রিস্টাব্দের মধ্যেই মনুসংহিতা রচনা সম্পন্ন হয়েছে। পণ্ডিতেরা অনুমান করেন, খ্রিস্টপূর্ব ২য় শতক থেকে খ্রিস্টাব্দ ২য় শতকের মধ্যে মনুসংহিতা রচিত হয়েছিলো।
 .
আবার কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রেও কয়েকবার মনুর উল্লেখ পাওয়া যায়। কৌটিল্য বা চাণক্য মৌর্য চন্দ্রগুপ্তের সময় (৩২০-৩১৫ খ্রিঃ পূর্বাব্দ) আবির্ভুত হয়েছিলেন। অতএব এ থেকে প্রতীয়মান হয় যে, মনুর নামে প্রচলিত কিছু শ্লোক ৩২০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের আগেই প্রচলিত ছিলো। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের কয়েকটি উক্তির সাথে মনুসংহিতার বর্ণনার সামঞ্জস্য দেখা যায়। যেমন, “কন্যাদানং কন্যামলংকৃত্য ব্রাহ্মো বিবাহঃ। সধর্মচর্যা প্রাজাপত্যঃ। গোমিথুনাদানাদার্ষঃ। অন্তর্বেদ্যামৃত্বিজে দানাৎ দৈবঃ।” ইত্যাদির সাথে মনুসংহিতার তৃতীয় অধ্যায়ের বিভিন্ন ধরনের বিবাহের প্রকৃতি ও স্বরূপ বর্ণনা সংবলিত ২৪, ২৭-৩৪ শ্লোকগুলোর সাদৃশ্য লক্ষ্যণীয়। আবার কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে এবং কামন্দকীয় নীতিসারে ‘ইতি মানবাঃ’ বলে যে অভিব্যক্তি আছে, টীকাকারেরা ‘মানবাঃ’ শব্দটির ব্যাখ্যা করেছেন ‘মানবাঃ মনোঃ শিষ্যাঃ’ এভাবে। এ থেকে ধারণা করা হয় ‘মানবাঃ’ শব্দটি মনুর দ্বারা প্রচারিত শ্লোকগুলোকে আশ্রয় করে পরবর্তীকালে রচিত ধর্মশাস্ত্রগুলোর রচয়িতাদের বোঝানো হয়েছে; এদের মধ্যে অবশ্য ভৃগুই ছিলেন প্রধান। অতএব ‘ইতি মানবাঃ’ নামে কৌটিল্য সম্ভবত ভৃগুরচিত বর্তমানে প্রাপ্ত মনুসংহিতার কথাই বলতে চেয়েছেন।
 .
আরেক স্মৃতিশাস্ত্রকার বৃহষ্পতির আবির্ভাবকাল ৫০০ খ্রিস্টাব্দের আগে। তিনিও প্রয়োজনবোধে বহুস্থানে মনুবচন উদ্ধৃত করেছেন। আবার অপরার্ক, কুল্লুক ভট্ট প্রভৃতি ভাষ্যকারগণও নিজ নিজ মন্তব্যের সমর্থনে বৃহষ্পতির ঐ উদ্ধৃতিগুলো উল্লেখ করেছেন। যেমন, কুল্লুক ভট্ট মনুসংহিতার প্রথম শ্লোকের টীকায় মনুবচনের প্রশংসাসূচক বৃহষ্পতির দুটি উদ্ধৃতি দিয়েছেন এভাবে-

“বেদার্থোপনিবন্ধৃত্বাৎ প্রাধান্যং তু মনুস্মৃতৌ।
মন্বর্থবিপরীতা যা স্মৃতিঃ সা ন প্রশস্যতে।।”
বেদের অর্থ ঠিক ঠিক ভাবে উপস্থাপিত করার জন্যই মনুস্মৃতির প্রাধান্য। যে স্মৃতি মনুবচনের বিরুদ্ধ তা নিন্দনীয়।
আবার-

“তাবচ্ছাস্ত্রাণি শোভন্তে তর্কব্যাকরণানি চ।
ধর্মার্থমোক্ষোপদেষ্টা মনুর্যাবন্ন দৃশ্যতে।।”
তর্ক, ব্যাকরণ প্রভৃতি শাস্ত্র ততক্ষণ পর্যন্তই শোভা পায়, যতক্ষণ মনুস্মৃতি আমাদের দৃষ্টির অগোচরে থাকে। মনু হলেন ধর্ম, অর্থ ও মোক্ষের উপদেষ্টা।
 বোঝা যাচ্ছে, মনুবচনই বেদবাক্য হিসেবে শিরোধার্য্য হয়ে আছে। এমনকি এই মনুসংহিতায় আলোচনীয় বিষয়বস্তু সম্বন্ধে প্রথম অধ্যায়ের একটি শ্লোকে ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে এভাবে-

“অস্মিন্ ধর্মোহখিলেনোক্তো গুণদোষৌ চ কর্মণাম্।
চতুর্ণামপি বর্ণানামাচারশ্চৈব শাশ্বতঃ।।
এই শাস্ত্রের প্রতিপাদ্য বিষয় হল- ধর্ম বা স্মার্তধর্ম; এখানে এই বিষয়টি বিস্তৃতভাবে বলা হয়েছে; যা কিছু ধর্ম নামে অভিহিত হতে পারে তা-ই এই শাস্ত্রে সমগ্রভাবে বলা আছে। বিহিত ও নিষিদ্ধ কর্মের গুণ ও দোষ বর্ণিত হয়েছে, এবং চার বর্ণেরই শ্বাশ্বত আচার-ব্যবহারও কথিত হয়েছে। অতএব ধর্ম-বিষয়ক জ্ঞানলাভের জন্য এই শাস্ত্রই যথেষ্ট, অন্য কোন শাস্ত্রের উপর নির্ভরশীল হতে হয় না,- এ-ই হলো এই শ্লোকের অভিপ্রেতার্থ। (১/১০৭)।
অর্থাৎ পরবর্তীকালের বৈদিক ধর্মে মানবসমাজের সর্বক্ষেত্রে মনুসংহিতার অনুশাসনই চূড়ান্ত, এর অন্যথা হবার উপায় ছিলো না। বস্তুত সভ্যতার নানান চড়াই-উৎড়াই পেরিয়ে এই বর্তমান যুগে এসেও সেই প্রাচীন মনুযুগের অনুশাসন থেকে এখনো যে মুক্ত হতে পারছি না আমরা, এটাই তিক্ত সত্য ও পরিতাপের বিষয়। এবং মানবতার কলঙ্কও।
 .
মনুসংহিতার বিষয়বস্তু নানা ধারায় বিস্তারিত। বৈদিক ভাবপরম্পরাকে আশ্রয় করে মনুসংহিতা রচিত হয়েছে বলে প্রচার করা হলেও যে সময়ে এই গ্রন্থের জন্ম, সে সময়ের সমাজের দিকে দৃষ্টি রেখেও অনেক নতুন কথা এখানে বলা হয়েছে। ফলে মনুসংহিতায় বর্ণিত ব্রাহ্মণ প্রাধান্য, বর্ণভেদপ্রথা, বিবাহসম্পর্কীয় আলোচনা, নারীর স্বাতন্ত্র্য অননুমোদন, বর্ণ ও আশ্রম ব্যবস্থা প্রভৃতি প্রসঙ্গগুলো বেদসংহিতার কোথাও সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ না থাকার কারণে বর্তমানযুগে এগুলোর নতুনভাবে ব্যাখ্যা করার প্রয়াস অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে। নইলে সুদীর্ঘকাল যাবৎ মনুবচনকেই বেদবাক্য শিরোধার্য্য করে ব্রাহ্মণ্যবাদ নামের যে অনৈতিক শাসন ব্যবস্থা এখনো নানারূপে চালু রয়েছে তা থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব হবে না এবং সেক্ষেত্রে নারীকেও পুরুষের ভোগ্যবস্তুর অপমানকর অবস্থান থেকে মানব সত্তায় উন্নীত করা যাবে না আদৌ। তাই বর্তমান বিজ্ঞান-চেতনা ও জ্ঞানস্তরের সাপেক্ষে মনুশাস্ত্রের অমানবিক আবহে ভাগ্যহত নারীর মানবেতর অবস্থান চিহ্নিত করার লক্ষ্যে মনুসংহিতার প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলোর উপর মুক্তদৃষ্টি নিক্ষেপ জরুরি। কেননা, এর মাধ্যমেই পরবর্তীতে সৃষ্ট ও প্রচলিত ধর্মতত্ত্বগুলোরও প্রকৃত গন্তব্য ও মৌলিক প্রবণতাটা কী এবং নারী কেন্দ্রিক চিন্তা-চেতনাটা কী তারও ধারণা পেতে সহায়ক হবে।
 .
জগতসৃষ্টির শাস্ত্রতত্ত্ব
পুরুষতন্ত্রের সন্দেহাতীত ধারক ও বাহক হিসেবে প্রাচীন ধর্মশাস্ত্র মনুসংহিতায় প্রায় শুরুতেই অনিবার্যভাবেই জগতসৃষ্টির হেতু পুরুষরূপী ব্রহ্মার অব্যক্ত স্বরূপের খোঁজ পেয়ে যাই আমরা-
‘আসীদিদং তমোভূতমপ্রজ্ঞাতমলক্ষণম্।
অপ্রতর্ক্যমবিজ্ঞেয়ং প্রসুপ্তমিব সর্বতঃ।।’
এই পরিদৃশ্যমান বিশ্বসংসার এককালে (সৃষ্টির পূর্বে) গাঢ় তমসাচ্ছন্ন ছিল; তখনকার অবস্থা প্রত্যক্ষের গোচরীভূত নয়; কোনও লক্ষণার দ্বারা অনুমেয় নয়; তখন ইহা তর্ক ও জ্ঞানের অতীত ছিল। এই চতুর্বিধ প্রমাণের অগোচর থাকায় এই জগৎ সর্বতোভাবে যেন প্রগাঢ় নিদ্রায় নিদ্রিত ছিল। (১/৫)।
‘ততঃ স্বয়ম্ভূর্ভগবানব্যক্তো ব্যঞ্জয়ন্নিদম্।
এহাভূতাদিবৃত্তৌজাঃ প্রাদুরাসীৎ তমোনুদঃ।।’
তারপর (প্রলয়ের অবসানে) অব্যক্ত (বাহ্য ইন্দ্রিয়ের অগোচর অর্থাৎ যোগলভ্য) বৃত্তৌজাঃ (অপ্রতিহত সৃষ্টিসামর্থ্যশালী) ষড়ৈশ্বর্যশালী ভগবান স্বয়ম্ভূ (স্বেচ্ছায় লীলাবিগ্রহকারী পরমাত্মা) তমোনুদ হয়ে অর্থাৎ প্রলয়াবস্থার ধ্বংসক, মতান্তরে প্রকৃতিপ্রেরক হয়ে, এই স্থূল আকাশাদি মহাভূত- যা পূর্বে অপ্রকাশ ছিল- সেই বিশ্বসংসারকে ক্রমে ক্রমে প্রকটিত করে আবির্ভূত হলেন। (১/৬)।
‘যোহসাবতীন্দ্রিয়গ্রাহ্যঃ সূক্ষ্মোহব্যক্তঃ সনাতনঃ।
সর্বভূতময়োহচিন্ত্যঃ স এব স্বয়মুদ্বভৌ।।’
যিনি মনোমাত্রাগ্রাহ্য, সূক্ষতম, অপ্রকাশ, সনাতন (চিরস্থায়ী), সকল ভূতের আত্মাস্বরূপ অর্থাৎ সর্বভূতে বিরাজমান এবং যিনি চিন্তার বহির্ভূত সেই অচিন্ত্য পুরুষ স্বয়ংই প্রথমে শরীরাকারে (মহৎ প্রভৃতিরূপে) প্রাদুর্ভূত হয়েছিলেন। (১/৭)।
‘সোহভিধ্যায় শরীরাৎ স্বাৎ সিসৃক্ষুর্বিবিধাঃ প্রজাঃ।
অপ এব সসর্জাদৌ তাসু বীজমবাসৃজৎ।।’
সেই পরমাত্মা স্বকীয় অব্যাকৃত (unmanifested) শরীর হতে বিবিধ প্রজা সৃষ্টির ইচ্ছা করে চিন্তামাত্র প্রথম জলের সৃষ্টি করলেন এবং তাতে আপন শক্তিবীজ অর্পণ করলেন। (১/৮)।
‘তদণ্ডমভবদ্ধৈমং সহস্রাংশুসমপ্রভম্।
তস্মিন্ জজ্ঞে স্বয়ং ব্রহ্মা সর্বলোকপিতমহঃ।।’
জলনিক্ষিপ্ত সেই বীজ সূর্যের ন্যায় প্রভাবিশিষ্ট একটি অণ্ডে পরিণত হল আর সেই অণ্ডে তিনি স্বয়ংই সর্বলোকপিতামহ ব্রহ্মারূপে জন্ম পরিগ্রহ করলেন। (১/৯)।
 এরপর পিতামহ ব্রহ্মা জগতের তাবত কিছু সৃষ্টি করতে লাগলেন। স্বর্গলোক, মর্ত্যলোক, আকাশ, অষ্টদিক, সমুদ্রাখ্য, দোষ, গুণ, মহত্ত, ইন্দ্রিয়, পঞ্চভূত, বেদ, যজ্ঞ, শাস্ত্র, দেবাদি, অগ্নি, বায়ু, সূর্য, কাল, ক্ষণ, তপস্যা, বাক্য, রতি, কামনা, ক্রোধ, সুখ, দুঃখ, ধর্ম, অধর্ম, ফলাফল, সত্য, মিথ্যা ইত্যাদি লৌকিক-অলৌকিক যাবতীয় ভাব ও বস্তুনিচয় তৈরি করলেন। উল্লেখ্য, একক স্রষ্টায় বিশ্বাসী পৃথিবীর সবগুলো ধর্মতত্ত্বেই জগতস্রষ্টার স্বরূপ ও সৃষ্টি সম্পর্কিত মৌলিক ধারণার মধ্যে সম্ভবত খুব একটা তফাৎ নেই। স্রষ্টার সর্বব্যাপ্ততা আর হও বললেই হয়ে যাওয়ার অকল্পনীয় ক্ষমতা না থাকলে তিনি স্রষ্টা হবেনই বা কী করে ! অতএব দৃশ্যমান অদৃশ্যমান প্রয়োজনীয় কোন কিছুই সৃষ্টির বাকি থাকার কথা নয়। যেহেতু তিনি জগতের স্রষ্টা বা প্রভু বা পতি, তাই প্রজা সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত তিনি প্রজাপতি ব্রহ্মা হবেন কী করে। অতএব এবার তিনি জীবজগতের সৃষ্টিতে মনোযোগী হলেন-

‘দ্বিধা কৃত্বাত্মনো দেহমর্দ্ধেন পুরুষোহভবৎ।
অর্দ্ধেন নারী তস্যাং স বিরাজমসৃজৎ প্রভু।।’
সেই প্রভু প্রজাপতি আপনার দেহকে দ্বিধা করে অর্ধেক অংশে পুরুষ ও অর্ধেক অংশে নারী সৃষ্টি করলেন এবং তারপর সেই নারীর গর্ভে বিরাটকে উৎপাদন করলেন। (১/৩২)।
‘তপস্তপ্তাসৃজৎ যং তু স স্বয়ং পুরুষো বিরাট্।
তং মাং বিত্তাস্য সর্বস্য স্রষ্টারং দ্বিজসত্তমাঃ।।’
হে দ্বিজসত্তমগণ! সেই বিরাট পুরুষ তপস্যা করে স্বয়ং যাকে সৃষ্টি করলেন, আমি সেই মনু- আমাকে এই সমুদয়ের দ্বিতীয় সৃষ্টিকর্তা বলে জেনো। (১/৩৩)।
 অর্থাৎ  ব্রহ্মা হচ্ছেন সর্বলোকপিতামহ, আর মনু হচ্ছেন জীবজগতের আদিপিতা। এবং তা যে নিশ্চিতভাবেই পুরুষবাচক তা বোধ করি বলার অপেক্ষা রাখে না। প্রজাসৃষ্টির মানসে আদিপিতা মনু তপস্যা করে প্রথমতঃ দশজন মহর্ষি প্রজাপতি সৃষ্টি করলেন (১/৩৪)। (এরাও কিন্তু পুরুষই।) এই মহাতেজস্বী দশজন মহর্ষির মাধ্যমে বিস্তর ধাপে ধাপে জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যক্ষ, রক্ষ, পিশাচ, গন্ধর্ব, অপ্সরা, অসুর, নাগ, সর্প, সুপর্ণ এবং দেবলোক পিতৃলোক সবই সৃষ্টি হতে লাগলো। এভাবেই মানুষ এবং যাবতীয় পশু পক্ষী কীট পতঙ্গ ইতরপ্রাণী সব সৃষ্টি হতে লাগলো। আর এসবের জন্মসৃষ্টির পেছনের কারণ হিসেবে জন্মান্তরবাদ নামের এক অদ্ভুত তত্ত্ব সৃষ্টি করে তারই যুক্তি দাঁড় করিয়ে দেয়া হলো- যাকে বলে ‘পূর্বজন্মের কর্মফল’। পূর্বজন্মের নিজ নিজ কৃতকর্মের ফলস্বরূপ অবিনাশি আত্মার পরজন্মে বিভিন্ন যোনিদেহপ্রাপ্তির এই সুচতুর ধারণা তথা জন্মান্তরবাদের অদৃশ্য নিগড়ে পরবর্তীকালের বৈদিক তথা ভারতীয় সমাজদেহ যে ভয়ঙ্কর পাঁকচক্রে বাঁধা পড়ে গেলো, তা থেকে আর মুক্ত হওয়া সম্ভব হয়নি আজো। কেননা পরমাত্মা ব্রহ্মার সৃষ্ট নিয়মেই এসব জন্ম-জন্মান্তরের অনিবার্য ধারাক্রম আবর্তিত হচ্ছে বলে বিশ্বাস করানো হয়। অবিনাশি আত্মার এই আবর্তন এমনই চিরায়ত ভয়াবহ আবর্তন যে জগতের প্রলয় বা ধ্বংস হলেও এ আবর্তন চূড়ান্তভাবে শেষ হয়ে যায় না। পরমেশ্বরের ইচ্ছারূপ কিছুকাল বিরতিমাত্র-
‘এবং সর্বং স সৃষ্ট্রেদং মাং চাচিন্ত্যপরাক্রমঃ।
আত্মনান্তর্দধে ভূয়ঃ কালং কালেন পীড়য়ন্।।’
মহর্ষিগণ, সেই অচিন্ত্যপরাক্রম ভগবান এইভাবে স্থাবর-জঙ্গম সমুদয় জগৎকে ও আমাকে সৃষ্টি করে প্রলয়কাল দ্বারা সৃষ্টিকালের বিনাশসাধন করত প্রলয়কালে পুনর্বার আপনাতেই আপনি অন্তর্হিত হন। (১/৫১)।
‘তস্মিন স্বপতি তু স্বস্থে কর্মাত্মানঃ শরীরিণঃ।
স্বকর্মভ্যো নিবর্তন্তে মনশ্চ গ্লানিমৃচ্ছতি।।’
ভগবান প্রজাপতি যখন (জগতের প্রলয়কালে) আপনাতে আপনি অবস্থিত থেকে বিরাম উপভোগ করেন, অর্থাৎ দেহ-মনের ব্যাপার রহিত হন, তখন কার্যানুযায়ী-লব্ধদেহ শরীরিগণও স্ব স্ব কর্ম থেকে নিবৃত্ত হয় এবং তাদের মনও সকল ইন্দ্রিয়ের সাথে লীনভাবে অবস্থান করে অর্থাৎ কার্যরহিত হয়। (১/৫৩)।
 ‘যখন মহাপ্রলয়কালে সেই পরমাত্মাতে এককালে নিখিল সংসার লয় পেয়ে থাকে, তখন সেই সর্বভূতাত্মা নিশ্চিন্তভাবে যে পরম সুখে নিদ্রা যান।’ (১/৫৪)।
‘মহাপ্রলয়কালে জীবাত্মা তমঃ অর্থাৎ অজ্ঞান প্রাপ্ত হয়ে বহুকাল ইন্দ্রিয়সমূহের সাথে অবস্থান করে। নিজের শ্বাস-প্রশ্বাসাদি কোনও কর্মই করে না এবং তখন সে নিজের পাঞ্চভৌতিকাদি শরীর থেকে উৎক্রমণ করে অর্থাৎ দেহ ত্যাগ করে সূক্ষ্মদেহ ধারণ করে।’ (১/৫৫)।
‘জীবাত্মা যখন পুর্যষ্টকরূপ অণুমাত্রিক হয়ে অর্থাৎ সূক্ষ্ম পঞ্চ মহাভূত, জ্ঞানেন্দ্রিয়, মন, বুদ্ধি, বাসনা, বায়ু, কর্ম ও অজ্ঞান- এই সব লিঙ্গশরীরযুক্ত হয়ে বৃক্ষাদিস্থাবরসৃষ্টির এবং মনুষ্যাদি জঙ্গম সৃষ্টির হেতুভূত স্থাবর ও জঙ্গমবীজকে সমাশ্রয় করে, তখন প্রাণাদির সাথে সংসৃষ্ট অর্থাৎ যুক্ত হয়ে সে বৃক্ষাদির রূপ বা মনুষ্যাদির রূপ ধারণ করে (এই সময় তার সৃষ্টি-অবস্থা এবং সেই অবস্থাতে সে স্থূল মূর্তি ধারণ করে)। (১/৫৬)।

‘এবং স জাগ্রৎস্বপ্নাভ্যাদিমং সর্বং চরাচরম্।
সঞ্জীবয়তি চাজস্রং প্রমাপয়তি চাব্যয়ঃ।।’
এইরূপে সেই অব্যয় পুরুষ ব্রহ্মা স্বীয় জাগ্রত ও স্বপ্ন অবস্থার দ্বারা এই চরাচর বিশ্বের সতত সৃষ্টি ও সংহার করছেন। (১/৫৭)।
বর্ণাশ্রম, মানবতা হননের প্রথম ধর্মীয় আগ্রাসন
ভারতীয় বৈদিক ধর্মে কর্মফল অনুবর্তী এই পরমার্থিক জন্মান্তরবাদের ধারণা বা দর্শন যে মূলত কুচক্রী ব্রাহ্মণ্যবাদী শাসকচক্রের সমাজ শাসনের এক ভয়াবহ সুচতুর শাসনতাত্ত্বিক ধর্মদর্শন তা মনুসংহিতার পরতে পরতে উৎকটভাবেই পরিদৃষ্ট হয়। কেননা কর্মফল অনুযায়ীই কেউ শাসক, কেউ শাসিত, কেউ ব্রাহ্মণ, কেউ শূদ্র হয়ে জন্মেছে। এবং নারীজন্মও তার পূর্বজন্মের কর্মেরই ফল। এই কর্মফল এমনই অবিচ্ছেদ্য অপরিবর্তনীয় যে, এজন্মে কর্মনির্দিষ্ট কার্যাদি সুষ্ঠু ও যথাযথ সম্পাদনের মাধ্যমেই শুধু পরবর্তী জন্মে উত্তম ফল পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি করে। তাই এজন্মের দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণাভোগ পূর্বজন্মের কোন দুষ্কর্মের ফল হওয়ায় এর জন্য নিজেই দায়ী এবং তা ভোগ করতেই হবে, অন্য কাউকে দোষী করার উপায় নেই। অন্য কেউ এজন্যে দায়ীও নয়। অন্যদিকে এ জন্মে যাবতীয় সুখ ভোগকারীর উপভোগ্য সকল সুবিধাও তার পূর্বজন্মের কোন সুকৃতিরই পুরস্কার। সমাজের ধর্মীয় শাসনতন্ত্রকে এমন নিরাপদ সর্বগ্রাসী উপভোগ্য করে তোলার এই যে প্রক্রিয়া, তা যেন কোনভাবেই বাধাগ্রস্ত বা শাসিতদের দিক থেকে কোনরূপ হুমকীর সম্মুখীন হতে না হয়, সেজন্যে ব্রহ্মার নামে সুকৌশলে প্রচারিত জন্মান্তরবাদের এই ধারাক্রমে মানবজীবনটাকেও বেঁধে ফেলা হয়েছে এক ভয়ঙ্কর অমানবিক বর্ণাশ্রম প্রথায়-
‘লোকানাং তু বিবৃদ্ধ্যর্থং মুখবাহূরুপাদতঃ।
ব্রাহ্মণং ক্ষত্রিয়ং বৈশ্যং শূদ্রঞ্চ নিরবর্তয়ৎ।।’
পৃথিব্যাদির লোকসকলের সমৃদ্ধি কামনায় পরমেশ্বর নিজের মুখ, বাহু, উরু ও পাদ থেকে যথাক্রমে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র- এই চারিটি বর্ণ সৃষ্টি করলেন। (১/৩১)।
 এই বর্ণ সৃষ্টি করেই থেমে যান নি। কেননা এমনি এমনি তা সৃষ্টি হয়নি। পূর্বজন্মের কর্ম অনুযায়ী এজন্মে তার ফল ভোগ করার নিমিত্তেই ব্রহ্মা কর্তৃক এই বর্ণসৃষ্টি। তাই শ্রম বিভাজনের মাধ্যমে তাদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন সুনির্দিষ্ট কার্যেরও ঘোষণা করা হলো-

‘সর্বস্যাস্য তু সর্গস্য গুপ্ত্যর্থং স মহাদ্যুতিঃ।
মুখবাহুরুপজ্জানাং পৃথক্ কর্মাণ্যকল্পয়ৎ।।’
এই সকল সৃষ্টির অর্থাৎ ত্রিভুবনের রক্ষার জন্য মহাতেজযুক্ত প্রজাপতি ব্রহ্মা নিজের মুখ, বাহু, উরু এবং পাদ- এই চারটি অঙ্গ থেকে জাত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের পৃথক পৃথক কার্যের ব্যবস্থা করে দিলেন। (১/৮৭)।
‘অধ্যাপনমধ্যয়নং যজনং যাজনং তথা।
দানং প্রতিগ্রহঞ্চৈব ব্রাহ্মণানামকল্পয়ৎ।।’
অধ্যাপন, স্বয়ং অধ্যয়ন, যজন, যাজন, দান ও প্রতিগ্রহ (উপহার বা দান-সামগ্রি গ্রহণ)- এই ছয়টি কাজ ব্রহ্মা ব্রাহ্মণদের জন্য নির্দেশ করে দিলেন। (১/৮৮)।
‘প্রজানাং রক্ষণং দানমিজ্যাধ্যয়নমেব চ।
বিষয়েম্বপ্রসক্তিশ্চ ক্ষত্রিয়স্য সমাসতঃ।।’
প্রজারক্ষণ, দান, যজ্ঞ, অধ্যয়ন, নৃত্যগীতবনিতাদি-বিষয়ভোগে অনাসক্তি, এই কয়েকটি কাজ ব্রহ্মা ক্ষত্রিয়গণের জন্য সংক্ষেপে নিরূপিত করলেন। (১/৮৯)।
‘পশূনাং রক্ষণং দানমিজ্যাধ্যয়নমেব চ।
বণিক্পথং কুসীদঞ্চ বৈশ্যস্য কৃষিমেব চ।।’
পশুদের রক্ষা, দান, যজ্ঞ, অধ্যয়ন, বাণিজ্য (স্থলপথ ও জলপথ প্রভৃতির মাধ্যমে বস্তু আদান-প্রদান করে ধন উপার্জন), কুসীদ (বৃত্তিজীবিকা- টাকা সুদে খাটানো) এবং কৃষিকাজ- ব্রহ্মা কর্তৃক বৈশ্যদের জন্য নিরূপিত হল। (১/৯০)।
‘অধীয়ীরংস্ত্রয়ো বর্ণাঃ স্বকর্মস্থা দ্বিজাতয়ঃ।
প্রব্রূয়াদ্ ব্রাহ্মণস্ত্বেষাং নেতরাবিতি নিশ্চয়ঃ।।’
ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য- এই তিনবর্ণের লোকেরা দ্বিজাতি; এঁরা নিজনিজ কর্তব্য কর্মে নিরত থেকে বেদ অধ্যয়ন করবেন। কিন্তু এঁদের মধ্যে কেবল ব্রাহ্মণেরাই অধ্যাপনা করবেন, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই দুই বর্ণের পক্ষে অধ্যাপনা করা উচিত নয়। -এটাই শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত। (১০/১)।
‘এতমেব তু শূদ্রস্য প্রভুঃ কর্ম সমাদিশৎ।
এতেষামেব বর্ণানাং শুশ্রƒষামনসূয়য়া।।’
প্রভু ব্রহ্মা শূদ্রের জন্য একটি কাজই নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন,- তা হলো কোনও অসূয়া অর্থাৎ নিন্দা না করে (অর্থাৎ অকপটভাবে) এই তিন বর্ণের অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের শুশ্রূষা করা। (১/৯১)।
 উপরোক্ত শ্লোকগুলো থেকে আমরা এটা বুঝে যাই যে, স্বয়ম্ভু ব্রহ্মা গোটা বিশ্ব-জগৎ সৃষ্টি করেছেন তো বটেই। তবে এই বিশ্ব-জগৎ সুষ্ঠুভাবে রক্ষাকল্পে তিনি আসলে কোন মানুষ সৃষ্টি করেন নি। চারটি বর্ণ সৃষ্টি করলেন- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। এদের আবার দুটো ভাগ- প্রথম তিনটি উচ্চ বর্ণ, আর চতুর্থটি অর্থাৎ শূদ্র হচ্ছে নিম্নবর্ণ, যে কিনা উচ্চবর্ণীয়দের সেবাদাস। আবার ব্রাহ্মণ, যে কিনা কোন শারীরিক শ্রমের সাথে কোনভাবেই জড়িত নয়, সকল বর্ণের শীর্ষে। শুধু শীর্ষেই নয়, ক্ষমতার এতোটাই কল্পনাতীত উচ্চ অবস্থানে অবস্থিত যে, জগতের সবকিছুর মালিক বা প্রভুও হচ্ছে ব্রাহ্মণ-
‘উত্তমাঙ্গোদ্ভবাজ্জৈষ্ঠ্যাদ্ ব্রহ্মণশ্চৈব ধারণাৎ।
সর্বস্যৈবাস্য সর্গস্য ধর্মতো ব্রাহ্মণঃ প্রভুঃ।।’
ব্রহ্মার পবিত্রতম মুখ থেকে উৎপন্ন বলে, সকল বর্ণের আগে ব্রাহ্মণের উৎপত্তি হওয়ায়, এবং বেদসমূহ ব্রাহ্মণকর্তৃক রক্ষিত হওয়ার জন্য (বা বেদসমূহ ব্রাহ্মণেরাই পঠন-পাঠন করেন বলে)- ব্রাহ্মণই ধর্মের অনুশাসন অনুসারে এই সৃষ্ট জগতের একমাত্র প্রভু। (১/৯৩)।
‘ব্রাহ্মণো জায়মানো হি পৃথিব্যামধিজায়তে।
ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং ধর্মকোষস্য গুপ্তয়ে।।’
ব্রাহ্মণ জন্মগ্রহণ করা মাত্রই পৃথিবীর সকল লোকের উপরিবর্তী হন অর্থাৎ সমস্ত লোকের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হন। কারণ, ব্রাহ্মণই সকলের ধর্মকোষ অর্থাৎ ধর্মসমূহ রক্ষার জন্য প্রভুসম্পন্ন হয়ে থাকেন। (১/৯৯)।
‘সর্বং স্বং ব্রাহ্মণস্যেদং যৎ কিঞ্চিজ্জগতীগতম্।
শ্রৈষ্ঠ্যেনাভিজনেনেদং সর্বং বৈ ব্রাহ্মণোহর্হতি।।’
জগতে যা কিছু ধনসম্পত্তি সে সমস্তই ব্রাহ্মণের নিজ ধনের তুল্য; অতএব সকল বর্ণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে ব্রাহ্মণই সমুদয় সম্পত্তিরই প্রাপ্তির যোগ্য হয়েছেন। (১/১০০)।
‘স্বমেব ব্রাহ্মণো ভুঙ্ক্তে স্বং বস্তে স্বং দদাতি চ।
আনৃশংস্যাদ্ ব্রাহ্মণস্য ভুঞ্জতে হীতরে জনাঃ।।’
ব্রাহ্মণ যে পরের অন্ন ভোজন করেন, পরকীয় বসন পরিধান করেন, পরের ধন গ্রহণ করে অন্যকে প্রদান করেন, সে সবকিছু ব্রাহ্মণের নিজেরই। কারণ, ব্রাহ্মণেরই আনৃশংস্য অর্থাৎ দয়া বা করুণাতেই অন্যান্য যাবতীয় লোক ভোজন-পরিধানাদি করতে পারছে। (১/১০১)।
অন্যদিকে শূদ্রজন্ম যে প্রকৃত অর্থেই দাসজন্ম, এ বিষয়টা যাতে কারো কাছে অস্পষ্ট না থাকে সেজন্যে মনুশাস্ত্রে স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে-

‘শূদ্রং তু কারয়েদ্ দাস্যং ক্রীতমক্রীতমেব বা।
দাস্যায়ৈব হি সৃষ্টোহসৌ ব্রাহ্মণস্য স্বয়ম্ভুবা।।’
ক্রীত অর্থাৎ অন্নাদির দ্বারা প্রতিপালিত হোক্ বা অক্রীতই হোক্ শূদ্রের দ্বারা ব্রাহ্মণ দাসত্বের কাজ করিয়ে নেবেন। যেহেতু, বিধাতা শূদ্রকে ব্রাহ্মণের দাসত্বের জন্যই সৃষ্টি করেছেন। (৮/৪১৩)।
এখানেই শেষ নয়। কেউ সন্তুষ্ট বা দয়াপরবশ হয়ে যদি শূদ্রকে দাসত্ব থেকে মুক্তি দিতে চায়, এটাও খুবই গর্হিতকর্ম হবে। তাই এ কাজ সুস্পষ্টভাবে নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে শাস্ত্রে–

‘ন স্বামিনা নিসৃষ্টোহপি শূদ্রো দাস্যাদ্বিমুচ্যতে।
নিসর্গজং হি তত্তস্য কস্তস্মাত্তদপোহতি।।’
প্রভু শূদ্রকে দাসত্ব থেকে অব্যাহতি দিলেও শূদ্র দাসত্ব কর্ম থেকে অব্যাহতি পেতে পারে না। দাসত্বকর্ম তার স্বভাবসিদ্ধ কর্ম (অর্থাৎ জন্মের সাথে আগত)। তাই ঐ শূদ্রের কাছ থেকে কে দাসত্ব কর্ম সরিয়ে নিতে পারে ? (৮/৪১৪)।
তাই–
‘বৈশ্যশূদ্রৌ প্রযত্নেন স্বানি কর্মাণি কারয়েৎ।
তৌ হি চ্যুতৌ স্বকর্মভ্যঃ ক্ষোভয়েতামিদং জগৎ।।’
রাজা বিশেষ যত্ন সহকারে বৈশ্য এবং শূদ্রকে দিয়ে তাদের কাজ অর্থাৎ কৃষিবাণিজ্যাদি করিয়ে নেবেন। কারণ, তারা নিজ নিজ কাজ ত্যাগ করলে এই পৃথিবীকে বিক্ষুব্ধ করে তুলবে। (৮/৪১৮)।
উচ্চবর্ণিয়দের জন্য প্রতিকুল সময়ে ভিন্ন জীবিকা গ্রহণের পর্যাপ্ত সুযোগ এই মনুসংহিতায় বিশদভাবেই দেয়া হলেও শূদ্রকে তার নিজ কর্মের বাইরে বিকল্প জীবিকা গ্রহণের কোন সুযোগও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। এমনকি মনুশাস্ত্রে শূদ্রের কোনরূপ সম্পদ অর্জনকেও নিষিদ্ধ করে দেয়া হয়েছে-
‘শক্তেনাপি হি শূদ্রেণ ন কার্যো ধনসঞ্চয়ঃ।
শূদ্রো হি ধনমাসাদ্য ব্রাহ্মণানেব বাধতে।।’
‘ধন অর্জনে সমর্থ হলেও শূদ্রকে কিছুতেই ধন সঞ্চয় করতে দেওয়া চলবে না, কেননা ধন সঞ্চয় করলে ব্রাহ্মণদের কষ্ট হয়৷ শাস্ত্রজ্ঞানহীন শূদ্র ধনমদে মত্ত হয়ে ব্রাহ্মণদের পরিচর্যা না করে অবমাননা করতে পারে৷’(১০/১২৯)।
তারপরও কোন শূদ্র যদি কদাচিৎ ধন আহরণ করে ফেলে ? সেক্ষেত্রেও ধর্মের শ্যেনদৃষ্টি এড়ানোর কোন উপায় নেই তার। কেননা-
‘বিস্রব্ধং ব্রাহ্মণঃ শূদ্রাদ্ দ্রব্যো দাদানমাচরেৎ।
ন হি তস্যাস্তি কিঞ্চিৎ স্বং ভর্তৃহার্যধনো হি সঃ।।’
ব্রাহ্মণ নিঃসঙ্কোচে শূদ্রের জিনিস গ্রহণ করবেন; কারণ তার অর্থাৎ শূদ্রের নিজের বলতে কোন ধনও নেই, সেও প্রভুরই জন্য দ্রব্য আহরণ করে; সে স্বয়ং ধনহীন। (৮/৪১৭)।
শূদ্রের এই ভয়াবহ শূদ্রত্বের কারণ কী ? সেই পূর্বজন্মেরই কর্মফল এটা। এই কর্মফলের কারণেই এই মানবেতর অবস্থা উত্তরণে এ জন্মে তার মুক্ত জীবনধারী অর্থাৎ দ্বিজ হওয়া সম্ভব নয়। দ্বিজত্ব হচ্ছে ব্রাহ্মণ্যবাদের সেই বর্ণবাদী প্রতারণা যার মাধ্যমে সমাজকে স্পষ্টতই বহু বিভাজনে টুকরো টুকরো করে দেয়া হয়েছে। দ্বিজ অর্থ হচ্ছে দ্বিতীয়বার জন্মগ্রহণ করেন যিনি। এই দ্বিতীয় জন্ম একটি আনুষ্ঠানিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান হলেও বর্ণবিভাজিত সমাজে এর প্রভাব ও গুরুত্ব অপরিসীম। কেননা এই দ্বিজ হয়ে ওঠাই বৈদিক বর্ণপ্রথার গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট। এর মাধ্যমেই অবধারিতভাবে সমাজের জনগোষ্ঠির মধ্যে প্রভূ ও ভৃত্য বা দাসের বাধ্যতামূলক বিভক্তিকরণ বর্ণ বা বংশ পরম্পরা চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। ব্রহ্মা কর্তৃক নির্ধারিত চারটি বর্ণের মধ্যে প্রথম তিনটি বর্ণে অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যেরই এই অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দ্বিজ হয়ে ওঠার সুযোগ ও অধিকার রয়েছে। অর্থাৎ এরা প্রভূ বা প্রভূসম্পর্কিত জাতি-
‘নাভিব্যাহারয়েদ্ব্রহ্ম স্বধানিনয়নাদৃতে।
শূদ্রেণ হি সমস্তাবদ্ যাবদ্বেদে ন জায়তে।।’
মৌজ্ঞীবন্ধন অর্থাৎ উপনয়নের পূর্ব পর্যন্ত (অর্থাৎ যতক্ষণ না বেদজন্মরূপ উপনয়ন প্রাপ্ত হয় ততক্ষণ) স্বধা অর্থাৎ শ্রাদ্ধসম্বন্ধীয় বেদমন্ত্র ছাড়া অন্য বেদবাক্য উচ্চারণ করাবে না (এটি পিতার প্রতি উপদেশ)। যতক্ষণ না উপনীত হয়ে বেদাধ্যয়নদ্বারা দ্বিতীয় জন্ম গ্রহণ করবে, ততক্ষণ (ব্রাহ্মণাদি তিন বর্ণ) শূদ্রেরই সমান। (২/১৭২)।
‘ব্রাহ্মণঃ ক্ষত্রিয়ো বৈশ্যস্ত্রয়ো বর্ণা দ্বিজাতয়ঃ।
চতুর্থ একজাতিস্তু শূদ্রো নাস্তি তু পঞ্চমঃ।।’
ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই তিন বর্ণের পক্ষে উপনয়ন সংস্কারের বিধান থাকায় এরা ‘দ্বিজাতি’ নামে অভিহিত হয়। আর চতুর্থ বর্ণ শূদ্র উপনয়নসংস্কার বিহীন হওয়ায় দ্বিজাতি নয়, তারা হলো ‘একজাতি’। এছাড়া পঞ্চম কোনও বর্ণ নেই অর্থাৎ ঐ চারটি বর্ণের অতিরিক্ত যারা আছে তারা সকলেই সঙ্করজাতি। (১০/৪)।

এই সঙ্করজাতিরা ব্রহ্মাসৃষ্ট চতুবর্ণেরও বাইরে। অর্থাৎ এদের থেকেই অস্পৃশ্য বা অচ্ছুৎ সম্প্রদায়ের সৃষ্টি। উত্তর-ভারতীয় ভাষায় যাকে বলে দলিত সম্প্রদায়। এরাই বৈদিক সমাজের ব্রাত্য জনগোষ্ঠী।
 .
শাস্ত্রীয় প্রবঞ্চনার প্রধান শিকার নারী
বৈদিক শাস্ত্রে নারীর অবস্থান নির্ণয়ে প্রাসঙ্গিকভাবেই এই দ্বিজত্বপ্রাপ্তির বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্রাহ্মণ থেকে শূদ্র পর্যন্ত চারজাতীয় মানুষই হলো চারটি বর্ণ। (এদের মধ্যে বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণই শীর্ষে অবস্থান করে সর্বাপেক্ষা বেশি গুরুত্ব পাবে। আর শূদ্র হচ্ছে সর্বনিম্ন অবস্থানে, যার প্রত্যক্ষ যোগ হচ্ছে দাসত্ব।)  এ ছাড়া বর্বর, কৈবর্ত প্রভৃতি অন্যান্য যে সব মানুষ আছে তারা সঙ্কীর্ণযোনি বা বর্ণসঙ্কর (১০/৬-২৭)। চারটি বর্ণের মধ্যে উর্ধ্বতন তিনটি বর্ণ ‘দ্বিজাতি’ অর্থাৎ এদের দুবার জন্ম হয়; কারণ দ্বিতীয়-জন্ম উৎপাদক উপনয়ন-সংস্কার কেবল ঐ তিনটি বর্ণের পক্ষেই শাস্ত্রমধ্যে বিহিত আছে। শূদ্র হলো একজাতি অর্থাৎ ওদের একবার মাত্র জাতি বা জন্ম হয়, কারণ শূদ্রের পক্ষে উপনয়ন-সংস্কারের বিধান নেই। অতএব অনিবার্যভাবে শূদ্ররা হলো নিম্নবর্ণীয় দাস। ফলে এরা ব্রত যজ্ঞ অনুষ্ঠানাদি পালনের যোগ্য হতে পারে না। কারণ এই জাত-কর্মাদির অধিকার কেবল দ্বিজদেরই আয়ত্তে। একইভাবে যেহেতু এই শাস্ত্রসূত্রানুসারেই নারীর জন্যেও দ্বিজ হবার কোন অধিকার রাখা হয়নি, তাই নারীও শূদ্রসমতুল্য বা শূদ্রই-
‘অমন্ত্রিকা তু কার্যেয়ং স্ত্রীণামাবৃদশেষতঃ।
সংস্কারার্থং শরীরস্য যথাকালং যথাক্রমম্।।’
পুরুষের মতো স্ত্রীলোকদেরও শরীরসংস্কার বা দেহশুদ্ধির জন্য এই সমস্ত আবৃৎ (অর্থাৎ জাতকর্ম থেকে আরম্ভ করে সংস্কারগুলির আনুষ্ঠানিক কর্মসমূহ) যথা-নির্দিষ্ট কালে এবং যথানির্দিষ্ট ক্রমে সম্পন্ন করতে হয়; কিন্তু তাদের পক্ষে ঐ সমস্ত অনুষ্ঠানে কোনও মন্ত্রের প্রয়োগ থাকবে না। (২/৬৬)।
সংস্কার মানে হচ্ছে শুদ্ধ হওয়া। এর জন্যে অবশ্যই মন্ত্র প্রয়োগের প্রয়োজন রয়েছে। ধর্মশাস্ত্রানুযায়ী মন্ত্রহীন সংস্কার অর্থহীন, ফলহীন। নারীর জন্য মন্ত্রের প্রয়োগ না থাকার অর্থ হলো কিছু অর্থহীন ফালতু সংস্কার আরোপ করা হলেও মূলত নারীর উপনয়ন-সংস্কার হয় না। কেননা ওই সংস্কারকর্ম কোন ধর্মানুষ্ঠানই নয়। এর অর্থ দাঁড়ায়, দ্বিজ হওয়া নারীর পক্ষে কখনোই সম্ভব নয়। ফলে মূলত মনুশাস্ত্রে কোথাও নারীকে শূদ্রের চেয়ে বেশি মর্যাদা দেয়া হয়েছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। স্মৃতি বা বেদাদি ধর্মশাস্ত্রে বা কোন ধর্মানুষ্ঠানে শূদ্রকে যেমন কোন অধিকার দেয়া হয়নি, নারীকেও তেমনি স্বভাবজাত দাসী বানিয়েই রাখা হয়েছে। এ ব্যাপারে যাতে কোনরূপ সন্দেহের অবকাশ না থাকে সেজন্যে মনুশাস্ত্রে সুস্পষ্ট বিধান জুড়ে দেয়া হয়েছে-
‘নাস্তি স্ত্রীণাং ক্রিয়া মন্ত্রৈরিতি ধর্মে ব্যবস্থিতিঃ।
নিরিন্দ্রিয়া হ্যমন্ত্রাশ্চ স্ত্রিয়োহনৃতমিতি স্থিতিঃ।।’
স্ত্রীলোকদের মন্ত্রপাঠপূর্বক জাতকর্মাদি কোনও ক্রিয়া করার অধিকার নেই- এ-ই হলো ধর্মব্যবস্থা। অর্থাৎ স্মৃতি বা বেদাদি ধর্মশাস্ত্রে এবং কোনও মন্ত্রেও এদের অধিকার নেই- এজন্য এরা মিথ্যা বা অপদার্থ, – এই হলো শাস্ত্রস্থিতি। (৯/১৮)।
তবে যত মিথ্যা-অপদার্থই হোক না কেন, পুরুষের অনিবার্য প্রয়োজনেই গোটা মনুশাস্ত্রে নারীর জন্য একটি সংস্কারকে সবার উপরে স্থান দিয়ে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ও অবধারিত করে দেয়া হয়েছে- তা হলো বিবাহ-সংস্কার। এ ব্যাপারে মনুসংহিতার স্পষ্টোক্তি-
‘বৈবাহিকো বিধিঃ স্ত্রীণাং সংস্কারো বৈদিকঃ স্মৃতঃ।
পতিসেবা গুরৌ বাসো গৃহার্থোহগ্নিপরিষ্ক্রিয়া।।’
বিবাহ-সংস্কারই স্ত্রীলোকদের উপনয়নস্থানীয় বৈদিক সংস্কার (অর্থাৎ বিবাহের দ্বারাই স্ত্রীলোকদের উপনয়ন সংস্কার সিদ্ধ হয়); বিবাহের পর স্ত্রীলোকেরা যে তাদের পতিদের সেবা করে (শুশ্রূষা বা সন্তোষ বিধান করে), তা-ই তাদের গুরুগৃহে বাসস্বরূপ (গুরুগৃহে বাস করা অবস্থায় বেদাধ্যয়ন কর্তব্য, কিন্তু স্ত্রীলোক তো সত্য-সত্য গুরুগৃহে বাস করে না, তাই তাদের বেদাধ্যয়নের প্রসঙ্গ আসে না); স্বামীর গৃহস্থালীর কাজই হলো (যেমন, অন্নরন্ধন, পোষাকাদি সাজিয়ে রাখা, টাকাকড়ি গুণে ঠিকমতো রাখা ইত্যাদি) স্ত্রীলোকেদের পক্ষে গুরুগৃহে (সায়ং ও প্রাতঃকালীন হোমরূপ) অগ্নিপরিচর্যা [ব্রহ্মচারী গুরুগৃহে থেকে সায়ং-প্রাতঃকালীন যে সমিৎ সংগ্রহ করে, তা স্ত্রীলোকদের পক্ষে গৃহস্থালীর কাজের দ্বারা সম্পন্ন হয়। আর স্ত্রীলোকেরা গৃহস্থালীর কাজকর্ম অর্থাৎ অগ্নির দ্বারা নিষ্পাদনীয় রন্ধনাদি যে সব কাজ করে, তার দ্বারা ব্রহ্মচারীর করণীয় যতকিছু যম-নিয়ম প্রভৃতি সেগুলিও পদের দ্বারা অনুষ্ঠিত হয়ে যায়। অতএব, এখানে স্ত্রীলোকদের অগ্নিপরিষ্ক্রিয়াটি পুরুষদের যম-নিয়মাদি কর্তব্যগুলির উপলক্ষণ]। (২/৬৭)।
অর্থাৎ এক কথায় এটা এমনই এক শাস্ত্রীয় প্রবঞ্চনা, যার মাধ্যমে খুব সচেতনভাবে নারীকে সমস্ত বৈদিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করে পুরুষের অনুগামী অধীনস্থ হওয়াই নিয়তি-নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে।
 .
অনুগত ক্রিতদাসের প্রতিও ন্যূনতম যেটুকু মানবিক সহানুভূতি অন্তত মানুষের স্বাভাবিক মনোবৃত্তিতে থাকা উচিত বলে মনে হয়, গোটা মনুশাস্ত্রে শূদ্রদের জন্য এর ছিটেফোটাও কোথাও দেখা যায় না। এবং নারীর ক্ষেত্রে এই মনেবৃত্তি এতোটাই আপত্তিকর পর্যায়ে নেমে গেছে যে, মনুশাস্ত্রে নারী যে বস্তুত কোন মানুষ বা মানবিক সত্তাধারী কোন প্রাণী তাও স্বীকার করতে কুণ্ঠিত বলেই মনে হয়। মনুসংহিতা তো আর যে সে গ্রন্থ বা শাস্ত্র নয়, খোদ বেদাশ্রিত ধর্মশাস্ত্র-
‘যঃ কশ্চিৎ কস্যচিদ্ধর্মো মনুনা পরিকীর্তিতঃ।
গ সর্বোহভিহিতো বেদে সর্বজ্ঞানময়ো হি সঃ।।’
ভগবান মনু যে কোনও ব্যক্তির যে কোনও (যেমন, বর্ণধর্ম, আশ্রমধর্ম, সংস্কারধর্ম প্রভৃতি এবং ব্রাহ্মণাদি বিশেষ বিশেষ বর্ণের জন্য বিহিত বিশেষ বিশেষ ধর্ম) উপদেশ দিয়েছেন, সে সবগুলিই বেদে প্রতিপাদিত হয়েছে। কারণ, সেই বেদ হলো সকল প্রকার জ্ঞানের আকর (অর্থাৎ জ্ঞাপক কারণ)। (২/৭)।

তাই মনুর শাস্ত্র মনুসংহিতা অনিবার্য ও অবশ্যপালনীয় জীবনবিধান, যার ব্যতিক্রম হওয়ার কোন উপায় বৈদিক সমাজধর্মে কোথাও রাখা হয়নি। ফলে মনুসংহিতায় নারীর জন্যে আরোপিত বিধান বা অনুশাসনগুলিও যে আচরিত সমাজ ব্যবস্থায় বাধ্যতামূলক ছিলো তা আর নতুন করে বলা বাহুল্য। অতএব প্রশ্ন আসে, মনুশাস্ত্রে নারী আসলে কী বস্তু ?

(চলবে…)

No comments: