Friday, August 12, 2011

| মনু’র বৈদিক চোখ : নারীরা মানুষ নয় আদৌ…| পর্ব-০২/৩ |


| মনু’র বৈদিক চোখ : নারীরা মানুষ নয় আদৌ…| পর্ব-০২/৩ |
-রণদীপম বসু

[ অখণ্ড পোস্ট এখানে পিডিএফ : নারী ও প্রগতি, জুলাই-ডিসেম্বর ২০১০ দ্বাদশ সংখ্যা ]
[ প্রথম পর্বের পর...]

মনুসংহিতায় নারী
এক কথায় বলতে হলে, মনুশাস্ত্রে নারী হচ্ছে পুরুষের ইচ্ছাধীন কর্ষণযোগ্য ক্ষেত্র বা জৈবযন্ত্র, যাতে পুরুষপ্রভু তার বীর্যরূপ বীজ বপন করে পুত্ররূপ শস্য হিসেবে যোগ্য উত্তরাধিকারী উৎপাদনের মাধ্যমে ধর্মরূপ পুরুষতন্ত্রের বহমান ধারাটিকে সচল রাখতে সচেষ্ট রয়েছে। এখানে নারী কেবলই এক পুরুষোপভোগ্য জৈবসত্তা। নারীর মনস্তত্ত্ব বা কোনরূপ মানসিক সত্তাকে মনুশান্ত্রে স্বীকারই করা হয়নি। নারীর দেহসত্তাটিরই প্রাধান্য এখানে, যার মালিকানাও নারীর নিজের নয় অবশ্যই। এর মালিকানা শুধুই আধিপত্যকামী পুরুষ প্রভুর। পুরুষতন্ত্র তার ইচ্ছানুরূপ শারীরিক-মানসিক ভোগ-লিপ্সা চরিতার্থ করতে, সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি ও সত্ত্বাধিকার প্রতিষ্ঠিত রাখতে এবং তার নিরঙ্কুশ আধিপত্যবাদ কায়েম রাখতে যখন যা করার প্রয়োজন মনে করেছে, ধর্মশাস্ত্রের নাম দিয়ে মনুশাস্ত্রে তার সবই প্রয়োগ করা হয়েছে। কোন কিছুরই বাদ রাখা হয়নি। সর্বক্ষেত্রেই নিজেদের অনুকূলে প্রয়োজনীয় আইন ও অনুশাসন সৃষ্টির মাধ্যমে নারীকে বাধ্য করেছে সম্পূর্ণ পদানত রাখতে। এমনকি নারীভোগকে আরো উপভোগ্য করে নিংড়ে নেয়ার প্রয়োজনে নারীর মনস্তাত্ত্বিক যে বিমূর্ত জগত যেখানে আইনের শাসনও পৌঁছাতে পারে না, সেখানেও আধিপত্য অর্জনের লক্ষ্যে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও ফাঁপা প্রশংসা বা কল্পিত গুণ-গান করে তাকে সুযোগমতো প্রতারণা করতেও দ্বিধা করা হয় নি।

 .
তাই পুনরুক্তি হলেও এখানে যে বিষয়টা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাওয়া দরকার, মনুশাস্ত্রের বর্ণভিত্তিক সমাজে দ্বিজ না হওয়ার কারণে বর্ণদাস শূদ্রের যেমন নিজের মালিকানাও নিজের থাকে না, প্রভুর অধীন সে, তেমনি নারীও স্পষ্টভাবে পুরুষপ্রভুরই অধীন। সাধারণ শূদ্রের ক্ষেত্রে সে হয়তো জন্মসূত্রে শ্রমদাস হয়ে জন্মানোর কারণে বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণের সেবাদাস হয়ে আমৃত্যু শ্রমসেবা দিয়ে যেতে বাধ্য। কিন্তু মনুশাস্ত্রের নারীর অবস্থা আরো শোচনীয়। জন্মসূত্রে শূদ্রতুল্য হওয়ায় ভিন্নভাবে একই নিয়তি তার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হলেও জন্মসূত্রে প্রাপ্ত নারীদেহটির কারণে তাকে শ্রমসেবার পাশাপাশি ইচ্ছেরহিত এক ভয়ঙ্কর দেহমূল্যও দিয়ে যেতে হয়। এক্ষেত্রে নারী শূদ্রের চেয়েও অধমই বলা যায়। আরেকটু এগুলেই আমাদের কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে যাবে, সর্বজ্ঞ মনুশাস্ত্রে নারীকে কিভাবে বিশেষিত করা হয়েছে।
 .
পুরুষের কর্ষণযোগ্য শস্যক্ষেত্র নারী
নারী হচ্ছে পুরুষের মালিকানাধীন ও ইচ্ছাধীন কর্ষণযোগ্য শস্যক্ষেত্র, এটাই নারীর প্রতি ধর্মশাস্ত্র মনুসংহিতার মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং সিদ্ধান্তও। এই সিদ্ধান্ত নিরাপদে অটল রাখার প্রয়োজনেই গোটা মনুসংহিতায় নারী বিষয়ক যাবতীয় অনুশাসন একই দৃষ্টিভঙ্গিরই অনুগামী হয়েছে বলা যায়।

‘ক্ষেত্রভূতা স্মৃতা নারী বীজভূতঃ স্মৃতঃ পুমান্।
ক্ষেত্রবীজসমাযোগাৎ সম্ভবঃ সর্বদেহিনাম্।।’
নারী শস্যেক্ষেত্রের মতো, আর পুরুষ শস্যের বীজস্বরূপ। এই ক্ষেত্র ও বীজের সংযোগে সকল প্রাণীর উৎপত্তি। (৯/৩৩)।
‘বীজস্য চৈব যোন্যাশ্চ বীজমুৎকৃষ্টমুচ্যতে।
সর্বভূত প্রসূতির্হি বীজলক্ষণলক্ষিতা।।’
বীজ এবং যোনি এই দুটির মধ্যে বীজই শ্রেষ্ঠ বলে কথিত হয়। কারণ, সর্বত্র সন্তান বীজের লক্ষণ যুক্ত হয়ে থাকে। (৯/৩৪)।
এখানে পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের দম্ভ স্পষ্টভাবেই প্রকাশিত। যেহেতু আদিম কৃষিভিত্তিক সমাজকৃষ্টিতে নারীকে পুরুষের শস্যক্ষেত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, তাই পুরুষ তার নিজস্ব শস্যেক্ষেত্রে ইচ্ছে-স্বাধীন কর্ষণ করে প্রয়োজনীয় বীজ বপন করে পছন্দসই ফসল তুলে নেবে এটাই স্বাভাবিক। এবং ক্ষেত্রের মালিক যেহেতু পুরুষই, তাই ফসলের মালিকও পুরুষ প্রভুই হবে এটাও শিরোধার্য। তবে বিশেষ ধরনের সম্পদের মোহনীয় উপস্থিতি যেখানে স্পষ্ট, সেখানে মালিকানা দ্বন্দ্বেরও যে ক্রমবিকাশ ঘটে তার ইঙ্গিতও মনুসংহিতায় অস্পষ্ট নয়-
‘নশ্যতীষুর্যথা বিদ্ধঃ খে বিদ্ধমনুবিধ্যতঃ।
তথা নশ্যতি বৈ ক্ষিপ্রং বীজং পরপরিগ্রহে।।’
যেমন অন্যের শরে বিদ্ধ কৃষ্ণশারাদি প্রাণীর শরীরে ঐ বেধজনিত ছিদ্রে অন্য কোনও ব্যক্তির দ্বারা নিক্ষিপ্ত বাণ নিষ্ফল হয়, এবং ঐ মৃগ প্রথম বাণনিক্ষেপকারী পুরুষেরই প্রাপ্য হয়; সেইরকম পরস্ত্রীতে নিক্ষিপ্ত বীজও বীজী পুরুষটির নষ্ট হয়ে যায়, যেহেতু তা থেকে উৎপন্ন সন্তানটি হয় ক্ষেত্রস্বামীর। (৯/৪৩)।
অর্থাৎ ব্যভিচারী প্রভাবশালী পুরুষদের মধ্যে নারীরূপ ক্ষেত্র দখল ও ভোগের যে স্বেচ্ছাচারিতা পুরুষতান্ত্রিক সমাজদেহে প্রচল ছিলো এবং তার ফসল হিসেবে সন্তান সৃষ্টি ও তার মালিকানাজনিত জটিলতায় সামাজিক শৃঙ্খলা বিনষ্টের উপর্যপুরি সম্ভাবনাও যে প্রকট হয়ে ওঠছিলো তা বুঝাই যায়। এই উদ্ভুত বিশৃঙ্খলা নিরসন করার প্রয়োজনেই সন্তানের মালিক চিহ্নিত করা জরুরি হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে নারী যার মালিকানায়ই থাকুক না কেন তা যে লোভনীয় ও ভোগ্য এবং তা ভোগ করার ক্ষেত্রে চিরায়ত পুরুষশ্রেষ্ঠের জন্য কোথাও কিঞ্চিত অনৈতকতাদোষ থাকলেও তা যে অবৈধ নয় তা-ই আসলে পরোক্ষভাবে অনুমোদন করা হয়েছে। অর্থাৎ নারীমাত্রেই পুরুষভোগ্যা। এখানে দ্বন্দ্ব নারীর নয়, কেননা পুরুষ ভিন্ন তার স্বকীয় কোন অস্তিত্ব থাকার কথাও নয়। যেহেতু এই দ্বন্দ্ব পুরুষের সাথে পুরুষের, একজন পুরুষের বৈধ মালিকানার নারীতে যাতে অন্য কেউ পুরুষশ্রেষ্ঠতার প্রভাব নিয়ে ভোগের দ্বন্দ্বে জড়িয়ে না পড়ে সে লক্ষ্যে মনুশাস্ত্রে প্রভাবশালী পুরুষগণকে অতি উদার ও নমনীয়ভাবে কাল্পনিক অতীত গাথার প্রসঙ্গ টেনে নিরুৎসাহিত করার চেষ্টা লক্ষ্য করা যায়-

‘অত্র গাথা বায়ুগীতাঃ কীর্ত্তয়ন্তি পুরাবিদঃ।
যথা বীজং ন বপ্তব্যং পুংসা পরপরিগ্রহে।।’
পরস্ত্রীতে বীজ বপন করা পুরুষের যে উচিত নয় সে সম্বন্ধে অতীতকালজ্ঞ পণ্ডিতেরা বায়ুকথিত কতকগুলি গাথা অর্থাৎ ছন্দোবিশেষযুক্ত বাক্য বলে গিয়েছেন। (৯/৪২)।

‘অন্যদুপ্তং জাতমন্যদিত্যেতন্নোপপদ্যতে।
উপ্যতে যদ্ধি যদ্বীজং তত্তদেব প্ররোহতি।।’
একরকম বীজ বপন করা হল আর অন্য রকম শষ্য জন্মালো, এরকমটি হতে পারে না; কিন্তু যেমন বীজ বপন করা হয় সেইরকমই ফসল তা থেকে জন্মায়। (৯/৪০)।

‘তৎ প্রাজ্ঞেন বিনীতেন জ্ঞানবিজ্ঞানবেদিনা।
আয়ুষ্কামেণ বপ্তব্যং না জাতু পরযোষিতি।।’
অতএব বীজ যখন ঐ রকম প্রভাবসম্পন্ন, তখন প্রাজ্ঞ (যিনি স্বাভাবিক প্রজ্ঞার দ্বারা যুক্ত), বিনীত অর্থাৎ শিক্ষিত, জ্ঞানে (অর্থাৎ বেদাঙ্গশাস্ত্রে) এবং বিজ্ঞানে (অর্থাৎ তর্ক-কলা প্রভৃতি-বিষয়ক শাস্ত্রে) অভিজ্ঞ এবং আয়ুষ্কামী ব্যক্তি নিজশরীরস্থিত ঐ বীজ কখনো যেন পরক্ষেত্রে অর্থাৎ পরস্ত্রীতে বপন না করেন। (৯/৪১)।

‘যাদৃশং তূপ্যতে বীজং ক্ষেত্রে কালোপপাদিতে।
তাদৃগ্ রোহতি তত্তস্মিন্ বীজং স্বৈর্ব্যঞ্জিতং গুণৈঃ।।’
বপনের উপযুক্ত বর্ষাকাল প্রভৃতি সময়ে উত্তমরূপে কর্ষণ-সমীকরণ প্রভৃতি পদ্ধতির দ্বারা সংস্কৃত ক্ষেত্রে যেরকম বীজ বপন করা হয়, সেই প্রকার ক্ষেত্রে সেই বীজ বর্ণ-অবয়বসন্নিবেশ রস-বীর্য প্রভৃতি নিজগুণের দ্বারা বিশিষ্ট হয়ে শস্যরূপে উৎপন্ন হয়। (৯/৩৬)।
অতএব এই ভয়ঙ্কর সত্যটা স্পষ্টতই প্রতীয়মান হয় যে, মনুর ধর্মীয় দৃষ্টিতে ক্ষেত্রস্বরূপা নারী প্রকৃত অর্থেই জড়স্বভাবী পরাধীন সত্তা। কে কখন কিভাবে কোথায় তার উপভোগ্য নারীদেহটিকে নানারূপে নানাভাবে কর্ষণ বা ভোগ করলো কি না-করলো তা ওই নারীর দেখার বিষয় নয়, এ অধিকারও তার নেই। কারণ-
‘প্রজনার্থং স্ত্রিয়ঃ সৃষ্টাঃ সন্তানার্থঞ্চ মানবাঃ।’
গর্ভধারণের জন্য নারী এবং গর্ভাধানের জন্য পুরুষ সৃষ্টি হয়েছে। (১০/৯৬)।

নারীদেহ যতই ভোগ্যপণ্য হোক, তবু পুরুষের মোক্ষলাভ তথা জন্মান্তরবাদী দৃষ্টিতে ইহলৌকিক-পারলৌকিক মুক্তি ও আধিপত্য অর্জনের লক্ষ্যে ধর্মীয় বিধি অনুযায়ী এই নারীদেহে পুত্র উৎপাদনই যেহেতু পুরুষের চূড়ান্ত লক্ষ্য, তাই পছন্দসই পুত্র উৎপাদনার্থে তার একান্ত মালিকানাধীন স্ত্রী হিসেবে ভোগ্য ও যোগ্য নারীটি বাছাইয়ের দায়িত্বও পুরুষের উপরই বর্তায়। এক্ষেত্রেও পুরুষতন্ত্রের চাপানো অনুশাসনে নারীকে সম্পূর্ণ পরাধীন ও বাসনারহিত চেতনবস্তু হিসেবেই দেখানো হয়েছে।
 .
পুরুষের স্ত্রী-সংগ্রহে নারীর যোগ্যতা
মনুশাস্ত্রের ভোগবাদী দৃষ্টিতে নারী যেহেতু শস্যক্ষেত্রস্বরূপ, তাই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে পুরুষেচ্ছায় সন্তোষ প্রদানক্ষম দেহের যোগ্যতা দিয়েই নারীর যোগ্যতা নির্ণিত হয়। এর সাথে ক্ষমতার উত্তরাধিকারের মূর্ত প্রতীক পুত্র উৎপাদন সক্ষমতা জড়িত থাকার বিষয় তো রয়েছেই। তাই পুরুষদেরকে পুত্র উৎপাদনে সক্ষম জননোপযোগী কন্যা নির্বাচনের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তবে প্রাথমিকভাবে অবশ্যই তা ধর্মীয় ও সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্য হতে হবে-

‘অসপিণ্ডা চ যা মাতুরসগোত্রা চ যা পিতুঃ।
সা প্রশস্তা দ্বিজাতীনাং দারকর্মণি মৈথুনে।।
যে নারী মাতার সপিণ্ড না হয় (অর্থাৎ সাতপুরুষ পর্যন্ত মাতামহবংশজাত না হয় এবং মাতামহের চতুর্দশ পুরুষ পর্যন্ত সগোত্রা না হয়) এবং পিতার সগোত্রা বা সপিণ্ডা না হয় (অর্থাৎ পিতৃস্বসাদিব সন্তান সম্ভব সম্বন্ধ না হয়) এমন স্ত্রী-ই  দ্বিজাতিদের (ব্রাহ্মণ-ত্রিয়-বৈশ্য) পক্ষে ভার্যাত্বসম্পাদক বিবাহব্যাপারে এবং মৈথুন বা জনন কাজে বিধেয়। (৩/৫)।
মাতামহ বা পিতামহের বংশজাত হলেই কি নারীর সাথে মৈথুন জনিত শারীরিক ক্রিয়ায় কোন সমস্যা হবার কথা ? মোটেও তা নয়। তবু মৈথুন কাজটিকে গুরুত্ব দেয়ার কারণ নিশ্চয়ই মৈথুনকর্মে সৃষ্ট সন্তান জন্মদানের প্রসঙ্গেই বিবেচিত হয়েছে। স্ত্রী হিসেবে গ্রহণের লক্ষ্যে এই কন্যা নির্বাচন জনন উপযোগী হলেও যাতে উত্তরাধিকার মনোনয়নে সন্তানের বংশগতির ধারাটি নিরুপদ্রব থাকে তারই গুরুত্ব প্রকাশ পেয়েছে এখানে। আবার কোন অর্থনৈতিক সুবিধা অস্বীকার করে হলেও এই বংশধারা সুস্থ-সাবলিল রাখার তাগিদেই হয়তো ঘোষিত হয়েছে-
‘মহান্ত্যপি সমৃদ্ধানি গোহজাবিধনধান্যতঃ।
স্ত্রীসম্বন্ধে দশৈতানি কুলানি পরিবর্জয়েৎ।।’
ব্ক্ষ্যমান দশটি কুল (বংশ বা পরিবার) গরু, ছাগল, ভেড়া প্রভৃতি পশু এবং ধন ও ধান্যে বিশেষ সমৃদ্ধিশালী হলেও স্ত্রীসম্বন্ধ-ব্যাপারে সেগুলি বর্জনীয়। (৩/৬)।

এই দশটি কুল কী ?-

‘হীনক্রিয়ং নিষ্পুরুষং নিশ্ছন্দো রোমশার্শসম্।
ক্ষয্যাময়াব্যপস্মারিশ্চিত্রিকুষ্ঠিকুলানি চ।।’
(এই কুলগুলি হল-) যে বংশ ক্রিয়াহীন (অর্থাৎ যে বংশের লোকেরা জাতকর্মাদি সংস্কার এবং পঞ্চমহাযজ্ঞাদি নিত্যক্রিয়াসমূহের অনুষ্ঠান করে না), যে বংশে পুরুষ সন্তান জন্মায় না (অর্থাৎ কেবল স্ত্রীসন্তানই প্রসূত হয়), যে বংশ নিশ্ছন্দ অর্থাৎ বেদাধ্যয়নরহিত, যে বংশের লোকেরা লোমশ (অর্থাৎ যাদের হাত-পা প্রভৃতি অঙ্গে বড় বড় লোম দেখা যায়), যে বংশের লোকেরা অর্শ অর্থাৎ মলদ্বারাশ্রিত রোগ বিশেষের দ্বারা আক্রান্ত, যে বংশের লোকেরা ক্ষয়রোগগ্রস্ত, যে বংশের লোকেরা আময়াবী (আমাশয়রোগাক্রান্ত বা মন্দাগ্নি অর্থাৎ ভুক্ত দ্রব্য যাদের ঠিকমতো পরিপাক হয় না), যে বংশের লোকেদের অপস্মার রোগ (যে রোগ স্মৃতিভ্রংশ প্রভৃতি ইন্দ্রিয়বৈকল্য ঘটায়) আছে, যে বংশের লোকদের শ্বেতরোগ আছে এবং যারা কুষ্ঠরোগদ্বারা আক্রান্ত। এই দশটি বংশের কন্যাকে বিবাহ করা চলবে না। (৩/৭)।
অর্থাৎ এই সব বংশে বিবাহ করলে বিবাহোত্তরকালে উৎপন্ন সন্তানও সেই সেই রোগাক্রান্ত হতে পারে বলে বংশগতি ক্ষুণ্ন হওয়ার আশংকা থেকে ঐসব পরিবারে বা বংশে বিবাহে নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়েছে। কিন্তু যে বংশে কেবল কন্যাসন্তানই জন্মে সে বংশে বিবাহে নিষেধাজ্ঞা আরোপের অর্থ কি কেবলই কন্যাসন্তান জন্মানোটা একটা ভয়ঙ্কর রোগ হিসেবে চিহ্নিত ? না কি সামাজিক অপরাধ ? তবে এই নিষেধাজ্ঞা থেকে নারীর সামাজিক অবস্থান সম্পর্কে খুব স্পষ্টভাবেই একটা নির্দেশনা পাওয়া যায় বৈ কি।
 .
কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুরুষের স্ত্রী নির্বাচনে নারীর যোগ্যতাকে রীতিমতো ব্যক্তিগত বা শারীরিকভাবেই আক্রমণ করা হয়েছে-
‘নোদ্বহেৎ কপিলাং কন্যাং নাধিকাঙ্গীং ন রোগিণীম্।
নালোমিকাং নাতিলোমাং ন বাচাটাং ন পিঙ্গলাম্।।’
কপিলা কন্যাকে (যার কেশসমূহ তামাটে, কিংবা কনকবর্ণ) বিবাহ করবে না; যে কন্যার অঙ্গুলি প্রভৃতি অধিক অঙ্গ আছে (যেমন, হাতে বা পায়ে ছয়টি আঙ্গুল আছে), যে নারী নানা রোগগ্রস্তা বা চিররোগিণী বা দুষ্প্রতিকার্য ব্যাধির দ্বারা আক্রান্ত, যে কেশশূন্যা (অথবা যে নারীর বাহুমূলে ও জঙ্ঘামূলে মোটেই লোম নেই, সে অলোমিকা), যার শরীরে লোমের আধিক্য দেখা যায়, যে নারী বাচাল (অর্থাৎ অতিপ্রগল্ভা) এবং যে নারীর চোখ পিঙ্গলবর্ণের- এই সমস্ত নারীকে বিবাহ করবে না। (৩/৮)।

‘নর্ক্ষবৃক্ষনদীনাম্নীং নান্ত্যপর্বতনামিকাম্।
ই পক্ষ্যহিপ্রেষ্যনাম্নীং না চ ভীষণনামিকাম্।।’
ঋক্ষ অর্থাৎ নক্ষত্রবাচক নামযুক্তা (যেমন, আর্দ্রা, জ্যেষ্টা প্রভৃতি), বৃক্ষবাচক নামযুক্তা (যেমন, শিংশপা, আমলকী প্রভৃতি), নদীবাচক শব্দ যার নাম (যেমন, গঙ্গা, যমুনা প্রভৃতি), অন্ত্যনামিকা অর্থাৎ অন্ত্যজজাতিবোধক নামযুক্তা (যেমন, বর্বরী, শর্বরী প্রভৃতি), পর্বতবাচক নামযুক্তা (যেমন, বিন্ধ্যা, মলয়া প্রভৃতি), পক্ষিবাচক নামযুক্তা (যেমন, শুকী, সারিকা প্রভৃতি), সাপবোধক নামযুক্তা (যেমন, ব্যালী, ভুজঙ্গী প্রভৃতি), ভৃত্যবাচক নামযুক্তা (যেমন, দাসী, চেটী প্রভৃতি) কন্যাকে এবং (ডাকিনী, রাক্ষসী প্রভৃতি) ভয়বোধক যাদের নাম এমন কন্যাকে বিবাহ করবে না। (৩/৯)।
অর্থাৎ নারীর নামের মধ্যেও পুরুষের মনোরঞ্জনের উপাদান থাকা বাধ্যতামূলক। যেহেতু নারীর গোটা সত্তাই পুরুষের ভোগের নিমিত্তে ব্রহ্মাকর্তৃক মর্ত্যলোকে পাঠানো হয়েছে, অতএব পুরুষকে সন্তোষ প্রদানই নারীর একমাত্র কাজ। তাই পুরুষের ভোগ্যসামগ্রি হিসেবে স্ত্রীলোকের একটি সুন্দর নাম যে তাকে ভোগের ক্ষেত্রেও মানসিক পরিতৃপ্তিজনক পরিস্থিতি বা আবহ তৈরি করে, সে বিবেচনাতেই হয়তো স্ত্রী-জাতির নামকরণে মনুর নির্দেশনা-
‘স্ত্রীণাং সুখোদ্যমক্রূরং বিস্পষ্টার্থং মনোহরম্।
মঙ্গল্যং দীর্ঘবর্ণান্তমাশীর্বাদাভিধানবৎ।।’
স্ত্রীলোকদের পক্ষে এমন নাম রাখতে হবে- যে নাম সুখে উচ্চারণ করতে পারা যায় অর্থাৎ স্ত্রীলোক ও বালকেরাও যে নাম অনায়াসে উচ্চারণ করতে পারে (যেমন যশোদাদেবী; এই নাম দুরুশ্চারণাক্ষরহীন হবে, যেমন ‘সুশ্লিষ্টাঙ্গী’ এই রকম নাম হবে না), সে নাম যেন ক্রূরার্থের প্রকাশক না হয় (অর্থাৎ ডাকিনী, পরুষা প্রভৃতি নাম হবে না), যে নাম বিস্পষ্টার্থ হবে (অর্থাৎ অনায়াসে যে নামের অর্থবোধ হয়; ‘কামনিধা’, ‘কারীষগন্ধী’ প্রভৃতি যে সব নামের অর্থ স্পষ্ট নয় এমন নাম হবে না), যে নাম হবে মনোহর অর্থাৎ চিত্তের আহ্লাদজনক (যেমন শ্রেয়সী; কিন্তু ‘কালাক্ষী’ জাতীয় নাম মনের সুখ উৎপাদন করে না), যে নাম মঙ্গলের বাচক হয় (যেমন চারুমতী, শর্মমতী; বিপরীত নাম যেমন ‘অভাগা’, ‘মন্দভাগ্যা’ প্রভৃতি হবে না), যে নামের শেষে দীর্ঘ স্বর থাকে (যেমন ‘ঈ’কার, আ-কার যুক্ত নাম), যে নামের উচ্চারণে আশীর্বাদ বোঝায় (যেমন ‘সপুত্রা’, ‘বহুপুত্রা’ প্রভৃতি)। (২/৩৩)।
মনুশাস্ত্রে নারীর সৌন্দর্য্যের ধারণা সম্পূর্ণই দৈহিক এবং তা নির্বাচনের ক্ষমতা একমাত্র পুরুষেরই একচ্ছত্র বলেই সম্পূর্ণ পুরুষ-মনস্তত্ত্বজাত সৌন্দর্যবোধকেই নারীর উপর সবলে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এ প্রেক্ষিতে সর্বশাস্ত্রজ্ঞ মনু পুরুষের ভোগের নৈবেদ্য হিসেবে বিবাহযোগ্য নারী নির্বাচনের লক্ষণ নির্ধারণ করে দিয়েছেন-
‘অব্যঙ্গাঙ্গীং সৌম্যনাম্নীং হংসবারণগামিনীম্।
তনুলোমকেশদশনাং মৃদ্বঙ্গীমুদ্বহেৎ স্ত্রিয়ম্।।’
যে নারীর কোন অঙ্গ বৈকল্য নেই (অর্থাৎ অবয়বসংস্থানের পরিপূর্ণতা বর্তমান), যার নামটি সৌম্য অর্থাৎ মধুর, যার গতি-ভঙ্গি হংস বা হস্তীর মতো (অর্থাৎ বিলাসযুক্ত ও মন্থরগমনযুক্তা), যার লোম, কেশ ও দন্ত নাতিদীর্ঘ, এবং যার অঙ্গসমূহ মৃদু অর্থাৎ সুখস্পর্শ (অর্থাৎ যে নারী কোমলাঙ্গী), এইরকম নারীকেই বিবাহ করবে। (৩/১০)।

আর এই আদর্শ লক্ষণযুক্তা নারীই যেহেতু ভোগোদ্যত পুরুষের পছন্দশীর্ষে অবস্থান করে, তাই এরূপ সুরূপা দেহযুক্তা নারীরত্ন সংগ্রহের সুবিধার্থে ব্রাহ্মণ্যবাদী তীব্র বর্ণপ্রথাকেও এই বিশেষ ক্ষেত্রে শিথিল করে মনু বলছেন-
‘শ্রদ্দধানঃ শুভাং বিদ্যামাদদীতাবরাদপি।
অন্ত্যাদপি পরং ধর্মং স্ত্রীরত্নং দুষ্কুলাদপি।।’
শ্রদ্ধাযুক্ত ব্যক্তি শূদ্রাদিজাতীয় লোকের কাছ থেকেও গারুড়াদি বিদ্যা অর্থাৎ সর্পমন্ত্র প্রভৃতি শ্রেয়স্করী বিদ্যা গ্রহণ করবে; অন্ত্যজ চণ্ডালাদি জাতির (যারা পূর্বজন্মে যোগাভ্যাসযুক্ত ছিল) কাছ থেকেও শ্রেষ্ঠ ধর্ম (অর্থাৎ মোক্ষের উপায় আত্মজ্ঞানাদি) গ্রহণ করবে; এবং দুষ্কুলজাত অর্থাৎ নিজের থেকে নিকৃষ্ট কুল থেকেও উত্তমা স্ত্রীরত্ন গ্রহণ করবে। (২/২৩৮)।

‘স্ত্রিয়ো রত্নান্যথো বিদ্যা ধর্মঃ শৌচং সুভাষিতম্।
বিবিধানি চ শিল্পানি সমাদেয়ানি সর্বতঃ।।’
স্ত্রী, রত্ন (মণি-মাণিক্য), বিদ্যা, ধর্ম, শৌচ, হিতবাক্য এবং বিবিধ শিল্পকার্য সকলের কাছ থেকে সকলেই গ্রহণ করতে পারে। (২/২৪০)।
চূড়ান্ত বিচারে নারী যে আসলে মানুষ নয়, অন্যান্য ভোগ্যবস্তুর মতোই পুরুষের ব্যবহারযোগ্য উপভোগের সামগ্রী মাত্র উপরিউক্ত শ্লোক থেকে বুঝতে কোন সমস্যা হবার কথা নয়। তবে একটি ক্ষেত্রে বিবাহ-সম্বন্ধ করার ব্যাপারে মনুশাস্ত্রে স্পষ্টতই সতর্ক করে দেয়া হয়েছে এই বলে যে-
‘যস্যাস্তু ন ভবেদ্ভ্রাতা ন বিজ্ঞায়েত বা (বৈ) পিতা।
নোপযচ্ছেত তাং প্রাজ্ঞঃ পুত্রিকাধর্মশঙ্কয়া।।’
যে কন্যার কোনও ভ্রাতা নেই, প্রাজ্ঞ ব্যক্তি সেই কন্যাকে ‘পুত্রিকা’ হওয়ার আশঙ্কায় [ভ্রাতৃহীনা কন্যাকে পিতা ইচ্ছা করলে পুত্রের মত বিবেচনা করতে পারতেন, এইরকম কন্যাকে পুত্রিকা বলা হত। আবার ভ্রাতৃহীনা কন্যার কোনও পুত্র হলে সে নিজে পুত্রস্থানীয় হয়ে সপিণ্ডনাদি কাজ সম্পন্ন করবে- অপুত্রক পিতার এইরকম অভিসন্ধি থাকলে সেই কন্যাকে পুত্রিকা বলা হত।] অথবা যে কন্যার পিতা সম্বন্ধে কিছু জানা যায় না তাকে জারজ বা মদ্যপব্যক্তির দ্বারা জাত সম্ভাবনায় অধর্ম হওয়ার ভয়ে বিবাহ করবে না।  [অতএব, পুত্রিকাশঙ্কায় ভ্রাতৃহীনা কন্যা অবিবাহ্যা এবং যার পিতৃসম্বন্ধ অজ্ঞাত-জারজত্ব সম্ভাবনায় এইরকম কন্যা অধর্মাশঙ্কায় অবিহাহ্যা]। (৩/১১)।

পিতৃসম্পদের উত্তরাধিকার নির্বাচনের ধর্মীয় দায়ভাগ বিধানমতে পুত্রের অনুপস্থিতিতে ‘পুত্রিকা’ বিশেষ অবস্থায় অর্থনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে- এটা একান্ত নিরূপায় বিধান হলেও পুরুষতন্ত্রের জন্য নিশ্চয়ই বিব্রতকর বিষয়। কেননা পুরুষতন্ত্র কখনোই চায় না নারী অর্থনৈতিক ক্ষমতা পাক। এর প্রতিবিধানকল্পে পুত্র উৎপাদনার্থে পুরুষের পুনর্বিবাহের সুযোগ রয়েছে, কিংবা অপুত্রক স্বামী মারা গেলে অনুমোদনকৃত বিশেষ নিয়োগপ্রথার মাধ্যমে বিধবাকে পুত্রবতী করার ব্যবস্থা থাকার পরও এসব ব্যবস্থা গ্রহণ না-করার খেসারত হিসেবেই হয়তো পুত্রিকাকে বিয়ের প্রসঙ্গে এসে সংকটে পড়তে হচ্ছে।  অর্থাৎ নারীর ক্ষমতায়ন পুরুষতন্ত্রের জন্য অসহ্য গাত্রদাহের বিষয়। এছাড়াও নারী যে তার দেহের বাইরে পিতৃপরিচয়েই অস্তিত্বমান এবং পিতৃপরিচয়ের নিশ্চয়তাবিধান যে পিতৃতন্ত্র বা পুরুষতন্ত্রের প্রধান হাতিয়ার, তা অক্ষুণ্ন ও নিরাপদ রাখার গুরুত্ব অনুধাবন করেই কন্যার বংশপরিচয়ের সুস্পষ্টতা থাকা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অর্থাৎ নারীর জন্য পিতৃপরিচয় সম্পত্তির ধারণার চেয়ে বড় এবং পুরুষতন্ত্রের এই হাতিয়ারকে মনুশাস্ত্র কিছুতেই বিফল হতে দিতে রাজী নয়।
 .
মনুশাস্ত্রে বিয়ে ও নারীর স্থান
বৈদিক শাস্ত্রে বিয়ে হচ্ছে সুনির্দিষ্ট উপভোগ্য নারীকে প্রয়োজনীয় ভোগের নিমিত্তে পুরুষের ব্যক্তি-মালিকানায় শর্তহীন হস্তান্তরের ধর্মসিদ্ধ প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়া যাতে কিছুতেই ব্যহত না হয় সে লক্ষ্যে ‘বিবাহ-সংস্কারকেই স্ত্রীলোকদের সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ উপনয়নস্থানীয় বৈদিক সংস্কার’ (২/৬৭) হিসেবে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ‘এই সংস্কার সম্পন্ন না হলে স্ত্রীলোকদের দেহশুদ্ধি হয় না’ (২/৬৬)। যেহেতু ‘গর্ভধারণের জন্য নারী এবং গর্ভাধানের জন্য পুরুষ সৃষ্টি হয়েছে’ (১০/৯৬), তাই গর্ভধারণ করাই নারীর প্রধান কাজ হিসেবে বিবেচিত। আর পুত্রোৎপাদনের নিমিত্তে নারীদেহে গর্ভাধানের কাজটি ইচ্ছানুযায়ী সম্পাদন করবে তার পুরুষ প্রভু বা স্বামী, যিনি বিবাহ নামক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঐ নারীদেহের সম্পূর্ণ কর্তৃত্বের অধিকারী হন-
‘মঙ্গলার্থং স্বস্ত্যয়নং যজ্ঞশ্চাসাং প্রজাপতেঃ।
প্রযুজ্যতে বিবাহেষু প্রদানং স্বাম্যকারণম্।।’
স্ত্রীলোকদের বিবাহকর্মে যা কিছু স্বস্ত্যয়ন বা প্রজাপতিযাগ অর্থাৎ বিবাহের দেবতা প্রজাপতির উদ্দেশ্যে যে হোম করা হয়, তা কেবল উভয়ের মঙ্গলার্থ মাত্র। স্ত্রীলোকগণকে প্রথমে যে বাগদান করা হয়, তার দ্বারাই স্ত্রীলোকের উপর পতির স্বামিত্ব জন্মায়; অতএব বাগদান থেকে আরম্ভ করেই স্ত্রীলোকদের স্বামীর সেবা করা কর্তব্য। (৫/১৫২)।
আর এজন্যেই বয়োসন্ধিকালে প্রজননক্ষম হওয়ামাত্রই কন্যাকে পাত্রস্থ করে দিতে মনুর উপদেশ-
‘কালেহদাতা পিতা বাচ্যো বাচ্যশ্চানুপযন্ পতিঃ।
মৃতে ভর্তরি পুত্রস্তু বাচ্যো মাতুররক্ষিতা।।’
বিবাহ-যোগ্য সময়ে অর্থাৎ ঋতুদর্শনের আগে পিতা যদি কন্যাকে পাত্রস্থ না করেন, তাহলে তিনি লোকমধ্যে নিন্দনীয় হন; স্বামী যদি ঋতুকালে পত্নীর সাথে সঙ্গম না করেন, তবে তিনি লোকসমাজে নিন্দার ভাজন হন। এবং স্বামী মারা গেলে পুত্রেরা যদি তাদের মাতার রক্ষণাবেক্ষণ না করে, তাহলে তারাও অত্যন্ত নিন্দাভাজন হয়। (৯/৪)।

অর্থাৎ একটি কুমারী কন্যা প্রজননযোগ্যা ঋতুমতী হয়েও প্রজননকার্যে ব্যবহৃত না-হওয়া মনুশাস্ত্রেরই উল্লঙ্ঘন। সেক্ষেত্রে যথাসময়ে পাত্রস্থ না-করার কারণে কন্যার উপর পিতার অধিকারও খর্ব হয়ে যায়। ফলে-
‘পিত্রে ন দদ্যাচ্ছুল্কন্তু কন্যামৃতুমতীং হরন্।
স হি স্বাম্যাদতিক্রামেদৃতূনাং প্রতিরোধনাৎ।।’
ঋতুমতী কন্যাকে যে বিবাহ করবে সেই ব্যক্তি কন্যার পিতাকে কোন শুল্ক দেবে না। কারণ, সেই পিতা কন্যার ঋতু নষ্ট করছেন বলে কন্যার উপর তার যে অধিকার তা থেকে তিনি বঞ্চিত হয়েছেন। (৯/৯৩)।
এখানে দেখা যাচ্ছে যে, বিয়ের বাজারে কন্যার একটা বিনিময়মূল্য রয়েছে, যা অধিকার হিসেবে পিতাই প্রাপ্ত হতেন। কিন্তু কন্যার ঋতু নষ্ট না-করার স্বার্থেই তা সম্পর্কিত। অতএব, ঋতু নষ্ট না-করা অর্থাৎ যথাসময়ে পাত্রস্থ করাটা খুবই গুরুত্ববহ। তবে যোগ্য পাত্র নির্বাচন করাও গুরুত্বপূর্ণ। তাই গুণহীন পাত্রে কন্যাদান যেমন নিরুৎসাহিত করা হয়, তেমনি যোগ্য পাত্র পাওয়া গেলে ঋতুমতী হবার আগেই কন্যাকে সম্প্রদান করারও নির্দেশ করা হয়েছে-
‘উৎকৃষ্টায়াভিরূপায় বরায় সদৃশায় চ।
অপ্রাপ্তামপি তাং তস্মৈ কন্যাং দদ্যাদ্ যথাবিধি।।’
উৎকৃষ্ট অভিরূপ এবং সজাতীয় বর পাওয়া গেলে কন্যা বিবাহের বয়স প্রাপ্ত না হলেও তাকে যথাবিধি সম্প্রদান করবে। (৯/৮৮)।
নইলে-
‘অদীয়মানা ভর্তারমধিগচ্ছেদ্ যদি স্বয়ম্।
নৈনঃ কিঞ্চিদবাপ্লোতি ন চ যং সাহধিগচ্ছতি।।’
ঋতুমতী হওয়ার তিন বৎসর পরেও যদি ঐ কন্যাকে পাত্রস্থ করা না হয়, তাহলে সে যদি নিজেই পতি বরণ করে নেয়, তার জন্য সে কোনও পাপের ভাগী হবে না। কিংবা যাকে সে বরণ করে, তারও কোনও পাপ বা দোষ হবে না। (৯/৯১)।

এটাকে নারী বা কন্যার অধিকার হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। বরং পিতার ব্যর্থতায় প্রজননযোগ্য কন্যার এই স্বপ্রণোদিত পুরুষানুগমন ধর্মীয় পিতৃতন্ত্রের বাধ্যবাধকতাই নির্দেশ করে। উল্লেখ্য, একই প্রেক্ষিতে সামাজিকভাবে নারীর বিয়ের বয়সটিও মনুশাস্ত্রে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে-
‘ত্রিংশদ্বর্ষোদ্বহেৎ কন্যাং হৃদ্যাং দ্বাদশবার্ষিকীম্।
ত্র্যষ্টবর্ষোহষ্টবর্ষাং বা ধর্মে সীদতি সত্বরঃ।।’
ত্রিশ বৎসর বয়সের পুরুষ বারো বৎসর বয়সের মনোমত কন্যাকে বিবাহ করবে, অথবা, চব্বিশ বছর বয়সের পুরুষ আট বছরের কন্যাকে বিবাহ করবে। এর দ্বারা বিবাহযোগ্য কাল প্রদর্শিত হলো মাত্র। তিনগুণের বেশি বয়সের পুরুষ একগুণ বয়স্কা কন্যাকে বিবাহ করবে, এর কমবেশি বয়সে বিবাহ করলে ধর্ম নষ্ট হয়। (৯/৯৪)।
তবে যে দৃষ্টিতেই দেখা হোক না কেন, ধর্মভিত্তিক পুরুষতন্ত্রে বিয়ে মানেই হচ্ছে পুরুষ কর্তৃক পছন্দসই নারী সংগ্রহ ও তার উপর ব্যক্তি-মালিকানা প্রতিষ্ঠাকরণের সামাজিক বৈধতা আরোপ প্রক্রিয়া মাত্র। এই প্রক্রিয়ার স্বরূপ অনুযায়ী বৈদিক শাস্ত্রের আট রকমের বিবাহের উল্লেখ রয়েছে-
‘ব্রাহ্মো দৈবস্তথৈবার্যঃ প্রাজাপত্যস্তথাসুরঃ।
গান্ধর্বো রাক্ষসশ্চৈব পৈশাচশ্চাষ্টমোহধমঃ।।’
ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য, আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস ও সর্বাপেক্ষা নিকৃষ্ট (নিন্দিত) পৈশাচ- বিবাহ এই আটরকমের। (৩/২১)।

‘ষড়ানুপূর্ব্যা বিপ্রস্য ক্ষত্রস্য চতুরোহবরান্।
বিট্শূদ্রয়োস্তু তানেব বিদ্যাদ্ধর্ম্যানরাক্ষসান্।।’
(প্রথম থেকে) ক্রমানুসারে ছয়-প্রকার বিবাহ (ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য, আসুর, গান্ধর্ব) ব্রাহ্মণের পক্ষে ধর্মজনক (অতএব বিহিত); শেষ দিকের চারটি বিবাহ (আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস ও পৈশাচ) ক্ষত্রিয়ের পক্ষে বিহিত; এবং রাক্ষস ভিন্ন শেষের বাকী তিনটি বিবাহ (আসুর, গান্ধর্ব ও পৈশাচ) বৈশ্য ও শূদ্রের পক্ষে বিহিত বলে জানবে। (৩/২৩)।

এবং এই আটপ্রকার বিবাহের স্বরূপ থেকেই বিবাহ-সংস্কৃতিতে নারীর অবস্থান বা ভূমিকা কী তার পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায়।
(ব্রাহ্মবিবাহের স্বরূপ:)
‘আচ্ছাদ্য চার্চয়িত্বা চ শ্র“তিশীলবতে স্বয়ম্।
আহূয় দানং কন্যায়া ব্রাহ্মো ধর্মঃ প্রকীর্তিতঃ।।’
শাস্ত্রজ্ঞান ও সদাচার সম্পন্ন পাত্রকে (কন্যার পিতা) স্বয়ং আহ্বান করে (অর্থাৎ বরের দ্বারা ঐ পিতা প্রার্থিত না হয়ে) নিজের কাছে আনিয়ে বর ও কন্যাকে (দেশ অনুসারে যথাসম্ভব যথাযোগ্য) বস্ত্রদ্বারা আচ্ছাদিত করে এবং অলঙ্কারাদির দ্বারা অর্চনা করে (অর্থাৎ বিশেষ প্রীতি ও বিশেষ সমাদর দেখিয়ে) ঐ বরের হাতে কন্যাকে যে সম্প্রদান করা হয়, তাকে ব্রাহ্মবিবাহরূপ ধর্মব্যবস্থা বলা হয়। [ব্রাহ্মবিবাহ সর্বোৎকৃষ্ট; এই বিবাহে যে কন্যাদান করা হয়, তাতে কোনও শর্ত বা স্বার্থ থাকে না]। (৩/২৭)।
(দৈববিবাহের স্বরূপ:)
‘যজ্ঞে তু বিততে সম্যগৃত্বিজে কর্ম কুর্বতে।
অলংকৃত্য সুতাদানং দৈবং ধর্মং প্রচক্ষতে।।’
জ্যোতিষ্টোমাদি বিস্তৃত যজ্ঞ আরম্ভ হলে সেই যজ্ঞে পুরোহিতরূপে যজ্ঞকার্যনিষ্পাদনকারী ঋত্বিক-কে যদি সালঙ্কারা কন্যা দান করা হয়, তাহলে এইরকম বিবাহকে মুনিগণ দৈব নামক শাস্ত্রবিহিত বিবাহ বলে থাকেন। [ব্রাহ্মবিবাহে নিঃশর্তভাবে কন্যাদান করা হয়। দৈববিবাহে কন্যাদান করা হয় বটে, কিন্তু যজ্ঞকর্মে নিযুক্ত ঋত্বিকের কাছ থেকে পূণ্যফল লাভের সম্ভাবনা থাকায় এই কন্যাদানটিকে একেবারে শুদ্ধদানের পর্যায়ে ফেলা যায় না]। (৩/২৮)।
(আর্য-বিবাহের স্বরূপ:)
‘একং গোমিথুনং দ্বে বা বরাদাদায় ধর্মতঃ।
কন্যাপ্রদানং বিধিবদার্ষো ধর্মঃ স উচ্যতে।।’
ধর্মশাস্ত্রের বিধান-অনুসারে বরের কাছ থেকে এক জোড়া, বা দুই জোড়া গোমিথুন (অর্থাৎ একটি গাভী ও একটি বলদ) গ্রহণ করে ঐ বরকে যথাবিধি কন্যাসম্প্রদান ধর্মানুসারে আর্য-বিবাহ নামে অভিহিত হয়। [এখানে বরের কাছ থেকে গোমিথুন-দানগ্রহণ একটি ধর্মীয় ব্যাপার। তাই এটি কন্যার শুল্ক বা বিনিময় মূল্যস্বরূপ নয়। কাজেই এখানে কন্যা-বিক্রয় করা হচ্ছে এমন মনে করা উচিত নয়। টিকাকার মেধাতিথির মতে, এখানে অল্পই হোক, বা বেশিই হোক, কোনও ঋণপরিশোধের ব্যাপার নেই]। (৩/২৯)।
(প্রাজাপত্য-বিবাহের স্বরূপ:)
‘সহোভৌ চরতাং ধর্মমিতি বাচানুভাষ্য চ।
কন্যাপ্রদানমভ্যর্চ্য প্রাজাপত্যো বিধিঃ স্মৃতঃ।।’
‘তোমরা দুইজনে মিলে একসঙ্গে গার্হস্থ্যধর্মের অনুষ্ঠান কর’- বরের সাথে এইরকম চুক্তি করে এবং তার কাছ থেকে প্রতিশ্রুতিরূপে স্বীকৃতি আদায় করে, অলঙ্কারাদির দ্বারা বরকে অর্চনাপূর্বক কন্যাসম্প্রদান প্রাজাপত্যবিবাহ নামে স্মৃতিমধ্যে অভিহিত হয়েছে। [সম্ভবতঃ এই বিবাহে বর নিজে থেকে প্রার্থী হয়ে উপস্থিত হন। প্রাজাপত্যবিবাহে যে কন্যাদান করা হয়, সে দান শুদ্ধ নয়, কারণ এখানে দানের শর্ত আরোপ করা হয়]। (৩/৩০)।
(আসুরবিবাহের স্বরূপ:)
‘জ্ঞাতিভ্যো দ্রবিণং দত্ত্বা কন্যায়ৈ চৈব শক্তিতঃ।
কন্যাপ্রদানং স্বাচ্ছন্দ্যাদাসুরো ধর্ম উচ্যতে।।’
কন্যার পিতা প্রভৃতি আত্মীয়স্বজনকে নিজের ইচ্ছা অনুযায়ী (কিন্তু শাস্ত্র-নির্দেশ অনুসারে নয়) এবং যথাশক্তি অর্থ দিয়ে এবং কন্যাটিকেও স্ত্রীধন দিয়ে যে কন্যর ‘আ-প্রদান’ অর্থাৎ কন্যাগ্রহণ করা হয়, তা আসুরবিবাহ নামে অভিহিত হয়ে থাকে। [আসুর-বিবাহের ক্ষেত্রে লক্ষ্যণীয় যে, এই বিবাহে স্বেচ্ছানুসারে ধন দিয়ে অর্থের জোরে কন্যা গ্রহণ বা ক্রয় করা হয়, কিন্তু শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে নয়। এখানেই আর্য-বিবাহ থেকে আসুর-বিবাহের পার্থক্য। আর্যবিবাহে যেমন গোমিথুন নির্দিষ্ট করা হয়, আসুর বিবাহে তেমন হয় না। এখানে বর কন্যার রূপ ও গুণে আকৃষ্ট হয়ে এবং স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে তার সামর্থ অনুযায়ী কন্যার মূল্যস্বরূপ অনির্দিষ্ট পরিমাণ শুল্ক বা অর্থের বিনিময়ে কন্যা গ্রহণ বা সংগ্রহ করা হয়]। (৩/৩১)।
(গান্ধর্ব-বিবাহের স্বরূপ:)
‘ইচ্ছয়ান্যোন্যসংযোগঃ কন্যায়াশ্চ বরস্য চ।
গান্ধর্বঃ স তু বিজ্ঞেয়ো মৈথুন্যঃ কামসম্ভবঃ।।’
কন্যা ও বর উভয়ের ইচ্ছাবশতঃ (অর্থাৎ প্রেম বা অনুরাগবশতঃ) যে পরস্পর সংযোগ (কোনও একটি জায়গায় সঙ্গমন বা মিলন) তা গান্ধর্ব-বিবাহ; এই বিবাহ মৈথুনার্থক অর্থাৎ পরস্পরের মিলন বাসনা থেকে সম্ভূত এবং কামই তার প্রযোজক বা কারণস্বরূপ। (৩/৩২)।
(রাক্ষস-বিবাহের স্বরূপ :)
‘হত্বা চ্ছিত্ত্বা চ ভিত্ত্বা চ ক্রোশন্তীং রুদতীং গৃহাৎ।
প্রসহ্য কন্যাহরণং রাক্ষসো বিধিরুচ্যতে।।’
বাধাপ্রদানকারী কন্যাপক্ষীয়গণকে (আহত) নিহত করে, (অঙ্গ) প্রত্যঙ্গ ছেদন করে এবং গৃহ প্রাচীর প্রভৃতি ভেদ করে যদি কেউ চীৎকারপরায়ণা ও ক্রন্দনরতা কন্যাকে গৃহ থেকে বলপূর্বক অপহরণ করে, তবে একে রাক্ষস-বিবাহ বলা হয়। (৩/৩৩)।
(পৈশাচ-বিবাহের স্বরূপ:)
‘সুপ্তাং মত্তাং প্রমত্তাং বা রহো যত্রোপগচ্ছতি।
স পাপিষ্ঠো বিবাহানাং পৈশাচশ্চাষ্টমোহধমঃ।।’
নিদ্রাভিভূতা, মদ্যপানের ফলে বিহ্বলা, বা রোগাদির দ্বারা উন্মত্তা কন্যার সাথে যদি গোপনে (বা প্রকাশ্যে) সম্ভোগ করা হয়, তাহলে তা পৈশাচ-বিবাহ নামে অভিহিত হবে; আটরকমের বিবাহের মধ্যে এই অষ্টম বিবাহটি পাপজনক ও সকল বিবাহ থেকে নিকৃষ্ট (এই বিবাহ থেকে ধর্মাপত্য অর্থাৎ ধর্মজ-পুত্র জন্মে না)। [পৈশাচবিবাহে মিথ্যা বা ছল আশ্রয় করে গোপনে কন্যা সংগ্রহ করা হয় বলে এ বিবাহ খুবই নিন্দিত। তবে টিকাকারদের অভিমত এই যে, পরে হোমসংস্কারের দ্বারা ঐ নিন্দনীয় সকল বিবাহেরই স্বীকৃতি দেয়া হয়]। (৩/৩৪)।
এই আটপ্রকার বিয়ের স্বরূপ দেখে এটা মনে করা বাহুল্য হবে না যে, বৈদিক শাস্ত্রে বিয়ে মানে পুরুষের নারী সংগ্রহের সামাজিক অভিযান কেবল। প্রাথমিক দৃষ্টিতে এই সংগ্রহ অভিযান শোভন বা অশোভন বা নিন্দনীয় যা-ই দেখাক না কেন, পুরুষতন্ত্র নিজের প্রয়োজনেই তার স্বীকৃতির ব্যবস্থা রেখেছে। তবে নারী যে পূর্ণমাত্রায় কেবল সম্পত্তিই, এর প্রমাণ হচ্ছে নারী দানযোগ্য, ক্রয়-বিক্রয়যোগ্য কিংবা বলপূর্বক হরণযোগ্য। অর্থাৎ যেভাবেই হোক, তার মালিকানার হস্তান্তর ঘটে মাত্র। তাই বস্তুগত ক্রয়-বিক্রয় বা হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় যেমন ভেজাল দেয়া অনৈতিক বলে গণ্য হয়, তেমনি প্রয়োজনীয় নারী সংগ্রহের হস্তান্তর প্রক্রিয়ায়ও কোনরূপ ব্যতিক্রম সহ্য করা হয় না-
‘অন্যাং চেদ্ দর্শয়িত্বান্যা বোঢ়ুঃ কন্যা প্রদীয়ক্তে।
উভে তে একশুল্কেন বহেদিত্যব্রবীন্মনুঃ।।’
বরের নিকট থেকে পণ নেওয়ার সময়ে একটি কন্যাকে দেখিয়ে বিবাহের সময়ে যদি তাকে (বরকে) অন্য একটি মেয়েকে দেওয়া হয়, তা হলে সেই বরটি ঐ একই শুল্কে দুইটি কন্যাকেই পাবে, মনু নিজেই একথা বলেছেন। (৮/২০৪)।

‘নোন্মত্তায়া ন কুষ্ঠিন্যা ন চ যা স্পৃষ্ঠমৈথুনা।
পূর্বং দোষানভিখ্যাপ্য প্রদাতা দণ্ডমর্হতি।।’
মেয়েটি উন্মত্তা কিংবা কুষ্ঠরোগগ্রস্তা কিংবা অন্যপুরুষের দ্বারা উপভুক্তা,- কন্যার এসব দোষ বিবাহের আগেই বলে দিলে অর্থাৎ শুল্ক নেবার আগেই তা কথায় প্রকাশ করে দিলে আর সেই কন্যাদানকারী দণ্ডনীয় হবে না। (৮/২০৫)।

নইলে এক্ষেত্রে রাজার বিচারে অপরাধের মাত্রাবিচারে বিভিন্ন দণ্ডের বিধান মনুসংহিতায় উদ্ধৃত রয়েছে। তবুও-
‘বিধিবৎপ্রতিগৃহ্যাপি ত্যজেৎ কন্যাং বিগর্হিতাম্।
ব্যাধিতাং বিপ্রদুষ্টাং বা ছদ্মনা চোপপ্যাদিতাম্।।’
বর যথাবিধি কন্যাকে গ্রহণ করেও যদি দেখে যে মেয়েটি বিগর্হিতা, ব্যাধিতা, বিপ্রদুষ্টা কিংবা তাহার স্বরূপ গোপন করে তাকে সম্প্রদান করা হয়েছে, তা হলে তাকে পরিত্যাগ করবে। (৯/৭২)।
আবার-
‘ন দত্ত্বা কস্যচিৎ কন্যাং পুনর্দদ্যাদ্বিচক্ষণঃ।
দত্ত্বা পুনঃ প্রযচ্ছন্ হি প্রাপ্লোতি পুরুষানৃতাম্।।’
যার উদ্দেশ্যে কন্যা বাগদত্তা হবে, তার মৃত্যুর পরও বিচক্ষণ ব্যক্তি নিজের ঐ বাগদত্তা কন্যাকে আবার অন্য পুরুষকে সমর্পণ করবে না। কারণ ঐ ভাবে একজনের উদ্দেশ্যে দত্তা কন্যাকে আবার অন্যকে দান করলে পুরুষানৃত প্রাপ্ত হবে অর্থাৎ যে ব্যক্তি ঐরকম করে তাহলে সমগ্র মানবজাতিকে প্রতারণা করার যে পাপ হয়, সে তার ভাগী হয়। (৯/৭১)।

অর্থাৎ এক্ষেত্রে নারীটির জৈব-মানসিক চাহিদাকেই সম্পূর্ণ অস্বীকার করা হলো।
 আমরা আগেই দেখেছি যে, নারী বা স্ত্রী সকলের কাছ থেকে সকলেই গ্রহণ করতে পারে (২/২৪০)। তবু ব্রাহ্মণ্যবাদের রক্ষকেরা কিন্তু তাদের মৌলিক বর্ণবাদী নীতিকে ভুলে যায় নি একটুও। তাই নারী শূদ্র-সমতুল্য হলেও (৯/১৮), নারীর প্রাথমিক রক্ষকের (অর্থাৎ পিতৃবংশের) বর্ণ-অবস্থান বা আভিজাত্যের নিরীখেই তারও স্তর বা জাতিভেদ আরোপ করে আরও নিগ্রহের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ফলে নারী নির্বাচন ও সংগ্রহের মনুশাস্ত্রীয় প্রক্রিয়ায় পুরুষের প্রতি মনুর পরামর্শ-
‘সর্ববর্ণেষু তুল্যাসু পত্নীষবক্ষতযোনিষু।
আনুলোম্যেন সম্ভূতা জাত্যা জ্ঞেয়াস্ত এব তে।।’
সকল বর্ণের পক্ষেই স্বপরিণীতা ও অক্ষতযোনি (অর্থাৎ প্রথমবিবাহিতা এবং যার সাথে আগে কোনও পুরুষের দৈহিক সম্পর্ক হয় নি) সবর্ণ বা সমান জাতির নারীর গর্ভে সবর্ণ পতিকর্তৃক উৎপাদিত সন্তান পিতামাতার জাতি থেকে অভিন্ন। অর্থাৎ ব্রাহ্মণীতে ব্রাহ্মণকর্তৃক উৎপাদিত সন্তান ‘ব্রাহ্মণ’হবে; ক্ষত্রিয়কর্তৃক এই রকম ক্ষত্রিয়া পত্নীর গর্ভে উৎপাদিত সন্তান ‘ক্ষত্রিয়’ হবে; বৈশ্যকর্তৃক স্বপরিণীতা ও অক্ষতযোনি বৈশ্যার গর্ভে উৎপাদিত সন্তান ‘বৈশ্য’ এবং শূদ্রকর্তৃক ঐ রকম শূদ্রার গর্ভে উৎপাদিত সন্তান ‘শূদ্র’ হবে। এসব ছাড়া অসবর্ণা স্ত্রীর গর্ভে উৎপন্ন সন্তান জনকের সাথে সবর্ণ হয় না, নিশ্চয়ই জাত্যন্তর হবে। (১০/৫)।
তাই-
‘সবর্ণাহগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকর্মণি।
কামতস্তু প্রবৃত্তানামিমাঃ স্যুঃ ক্রমশো বরাঃ।।’
ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য- এই দ্বিজাতিগণের দারপরিগ্রহব্যাপারে সর্বপ্রথমে (অর্থাৎ অন্য নারীকে বিবাহ করার আগে) সমানজাতীয়া কন্যাকেই বিবাহ করা প্রশস্ত। কিন্তু কামনাপরায়ণ হয়ে পুনরায় বিবাহে প্রবৃত্ত হলে [অর্থাৎ সবর্ণাকে বিবাহ করা হয়ে গেলে তার উপর যদি কোনও কারণে প্রীতি না জন্মে অথবা পুত্রের উৎপাদনের জন্য ব্যাপার নিষ্পন্ন না হলে যদি কাম-প্রযুক্ত অন্যস্ত্রী-অভিলাষ জন্মায় তাহলে] দ্বিজাতির পক্ষে ব্ক্ষ্যমাণ নারীরা প্রশস্ত হবে। (৩/১২)।
 ‘শূদ্রৈব ভার্যা শূদ্রস্য সা চ স্বা চ বিশঃ স্মৃতে।
তে চ স্বা চৈব রাজ্ঞশ্চ তাশ্চ স্বা চাগ্রজন্মনঃ।।’
একমাত্র শূদ্রকন্যাই শূদ্রের ভার্যা হবে; বৈশ্য সজাতীয়া বৈশ্যকন্যা ও শূদ্রাকে বিবাহ করতে পারে; ক্ষত্রিয়ের পক্ষে সবর্ণা ক্ষত্রিয়কন্যা এবং বৈশ্যা ও শূদ্রা ভার্যা হতে পারে; আর ব্রাহ্মণের পক্ষে সবর্ণা ব্রাহ্মণকন্যা এবং ক্ষত্রিয়া, বৈশ্যা ও শূদ্রা ভার্যা হতে পারে। [এটা ‘অনুলোম’ বিবাহের প্রসঙ্গ। উচ্চবর্ণের পুরুষের সাথে নীচবর্ণের কন্যার বিবাহকে অনুলোম বিবাহ বলে। এর বিপরীত বিবাহ অর্থাৎ তুলনামূলক উচ্চবর্ণের কন্যাকে নিম্নবর্ণের পুরুষ কর্তৃক বিবাহের নাম প্রতিলোম বিবাহ। প্রতিলোম বিবাহ সকল স্মৃতিকারদের দ্বারাই নিন্দিত। মনু মনে করেন, প্রথমে সজাতীয়া কন্যার সাথে বিবাহই প্রশস্ত। পুনর্বিবাহের ইচ্ছা হলে অনুলোম-বিবাহের সমর্থন দেয়া হয়েছে]। (৩/১৩)।
এখানে একটু খেয়াল করলেই উচ্চবর্ণীয় প্রভাবশালী ক্ষমতাধর পুরুষকর্তৃক হীনবর্ণীয়া একাধিক নারীভোগ করার শাস্ত্রীয় অনুমোদনের সূক্ষ্ম রাজনীতিটা স্পষ্ট হয়ে যায়। প্রথম বিয়েটা সবর্ণা নারীর সাথে হওয়া বাঞ্ছনীয় এজন্যেই যে, তার থেকে জাত-পুত্র পিতার বংশরাক্ষা ও উত্তরাধিকারের সহায়ক হয়, যা হীনবর্ণা স্ত্রী-জাত বর্ণ-সঙ্কর সন্তানে শাস্ত্রীয় সংকট তৈরি করে। কেননা-

‘জ্যেষ্ঠেন জাতমাত্রেণ পুত্রীভবতি মানবঃ।
পিতৃণামনৃণশ্চৈব স তস্মাৎ সর্বমর্হতি।।’
উৎপত্তির সঙ্গে সঙ্গেই জ্যেষ্ঠ পুত্র অসংস্কৃত থাকলেও তার দ্বারাই মানুষ পুত্রবিশিষ্ট হয় এবং ঐ পুত্র তার পিতৃপুরুষগণকে পুন্-নামক নরক থেকে নিষ্কৃতি দেয়ার জন্য সে পিতৃঋণ থেকে মুক্ত হয়; জ্যেষ্ঠই প্রকৃত অর্থে পুত্রপদবাচ্য। এইরকম বিচার করলে, জ্যেষ্ঠই সমস্ত পিতৃধন লাভ করার যোগ্য। (৯/১০৬)।

‘পুন্নাম্নো নরকাদ্ যস্মাৎ ত্রায়তে পিতরং সুতঃ।
তস্মাৎ পুত্র ইতি প্রোক্তঃ স্বয়মেব স্বয়ম্ভুবা।।’
যে হেতু পুত্র ‘পুৎ’ নামক নরক থেকে পিতাকে উদ্ধার করে এই কারণে স্বয়ং ব্রহ্মা তাকে ‘পুত্র’ এই নামে অভিহিত করেছেন। [পৃথিবীতে যে সব প্রাণীর উৎপত্তি হয় তাদের সেই উৎপত্তিটাকেই পুৎ নামক নরক বলা হয়। পুত্র জন্মালে পিতাকে তা থেকে পরিত্রাণ করে অর্থাৎ পিতা তখন পৃথিবীতে পুনর্জন্ম গ্রহণ না করে দেবলোকে জন্মপ্রাপ্ত হয়। সেই কারণে তাকে ‘পুত্র’ বলা হয়]। (৯/১৩৮)।

‘যস্মিনৃনং সন্নয়তি যেন চানন্ত্যমশ্নুতে।
স এব ধর্মজঃ পুত্রঃ কামজানিতরান্ বিদুঃ।।’
যে জ্যেষ্ঠপুত্রের উৎপত্তিমাত্র পিতা পিতৃঋণ পরিশোধ করেন, এবং যার দ্বারা পিতা মোক্ষ লাভ করেন, সেই জ্যেষ্ঠ পুত্রকে যথার্থ ধর্মজ-সন্তান বলা যায়; অবশিষ্ট পুত্রগুলি সব কামজ, জ্ঞানীরা এইরকম বিবেচনা করেন। (৯/১০৭)।
তাই পারলৌকিক মুক্তি বা ইহলৌকিক ক্ষমতাকেন্দ্রিক বর্ণ-প্রাধান্যের কারণেই দ্বিজদের জন্যে সবর্ণা কন্যার সাথে প্রথম বিয়ের গুরুত্ব অপরিসীম। এটা ঠিক থাকলে বর্ণ-শ্রেষ্ঠদের জন্য পরবর্তী অনুলোম বিবাহের মাধ্যমে অতিরিক্ত কামনা চরিতার্থের সুযোগ শাস্ত্রই অবারিত রেখেছে। তবে যেহেতু বর্ণ-সংকর সন্তান সৃষ্টি ক্ষমতাকেন্দ্রিক সামাজিক শৃঙ্খলা নষ্টের কারণ হতে পারে, তাই হীনবর্ণা নারীকে সর্বস্তরের পুরুষের ইচ্ছানুরুপ সম্ভোগের সবরকম সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়ে শুধু তাদের মাধ্যমে সন্তান উৎপাদনকে কৌশলে নিরুৎসাহিত করা হয়েছে-
‘হীনজাতিস্ত্রিয়ং মোহাদুদ্বহন্তো দ্বিজাতয়ঃ।
কুলান্যেব নয়ন্ত্যাশু সসন্তানানি শূদ্রতাম্।।’
ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই দ্বিজাতিরা যদি মোহবশতঃ (ধনলাভজনিত অবিবেকবশতই হোক অথবা কামপ্রেরিত হয়েই হোক) হীনজাতীয়া স্ত্রী বিবাহ করেন, তাহলে তাদের সেই স্ত্রীতে সমুৎপন্ন পুত্রপৌত্রাদির সাথে নিজ নিজ বংশ শীঘ্রই শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়। (৩/১৫)।

‘শূদ্রাবেদী পতত্যত্রেরুতথ্যতনয়স্য চ।
শৌনকস্য সুতোৎপত্ত্যা তদপত্যতয়া ভৃগোঃ।।’
শূদ্রা স্ত্রী বিবাহ করলেই ব্রাহ্মণাদি পতিত হন,- এটি অত্রি এবং উতথ্যতনয় গৌতম মুনির মত। শৌনকের মতে, শূদ্রা নারীকে বিবাহ করে তাতে সন্তানোৎপাদন করলে ব্রাহ্মণাদি পতিত হয়। ভৃগু বলেন, শূদ্রা স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তানের সন্তান হলে ব্রাহ্মণাদি দ্বিজাতি পতিত হয়। [মেধাতিথি ও গোবিন্দরাজের মতে, কেবলমাত্র ব্রাহ্মণের শূদ্রা স্ত্রীর ক্ষেত্রেই এই পাতিত্য বুঝতে হবে। কুল্লুক ভট্টের মতে, ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য- এই তিনজাতির শূদ্রা স্ত্রী সম্বন্ধেই এই পাতিত্য হবে]। (৩/১৬)।

‘শূদ্রাং শয়নমারোপ্য ব্রাহ্মণো যাত্যধোগতিম্।
জনয়িত্বা সুতং তস্যাং ব্রাহ্মণ্যাদেব হীয়তে।।’
সবর্ণা স্ত্রী বিবাহ না করে শূদ্রা নারীকে প্রথমে বিবাহ করে নিজ শয্যায় গ্রহণ করলে ব্রাহ্মণ অধোগতি (নরক) প্রাপ্ত হন; আবার সেই স্ত্রীতে সন্তানোৎপাদন করলে তিনি ব্রাহ্মণত্ব থেকে ভ্রষ্ট হয়ে পড়েন [অতএব সমানজাতীয়া নারী বিবাহ না করে দৈবাৎ শূদ্রা বিবাহ করলেও তাতে সন্তান উৎপাদন করা ব্রাহ্মণের উচিত নয়]। (৩/১৭)।

ইত্যাদি অর্থাৎ বংশ পতনের কারণ সৃষ্টি হয় কেবল হীনজাতীয়া স্ত্রীতে সমুৎপন্ন পুত্রপৌত্রাদি দিয়েই। তা না হলে আর কোন সমস্যা নেই। তারপরও-
‘দৈবপিত্যাতিথেয়ানি তৎপ্রধানানি যস্য তু।
নাশ্লন্তি পিতৃদেবাস্তং ন চ স্বর্গং স গচ্ছতি।।’
শূদ্রা ভার্যা গ্রহণের পর যদি ব্রাহ্মণের দৈবকর্ম (যথা, দর্শপূর্ণমাস যজ্ঞ প্রভৃতি এবং দেবতার উদ্দেশ্যে যে ব্রাহ্মণভোজনাদি হয়, তা), পিত্র্যকর্ম (পিতৃপুরুষের প্রতি করণীয় কর্ম, যথা, শ্রাদ্ধ, উদক-তর্পণ প্রভৃতি) এবং আতিথেয় কর্ম (যেমন, অতিথির পরিচর্যা, অতিথিকে ভোজন দান প্রভৃতি) প্রভৃতিতে শূদ্রা ভার্যার প্রাধান্য থাকে অর্থাৎ ঐ কর্মগুলি যদি শূদ্রা স্ত্রীকর্তৃক বিশেষরূপে সম্পন্ন হয়, তাহলে সেই দ্রব্য পিতৃপুরুষগণ এবং দেবতাগণ ভক্ষণ করেন না এবং সেই গৃহস্থ ঐ সব দেবকর্মাদির ফলে স্বর্গেও যান না (অর্থাৎ সেই সব কর্মানুষ্ঠান নিষ্ফল হয়)। (৩/১৮)।
অর্থাৎ শূদ্রা নারী ব্রাহ্মণের ভার্যা হয়ে ব্রহ্মভোগের বস্তু হলো ঠিকই, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে স্ত্রীর কোন মর্যাদাই তার প্রাপ্য হয় না।
 .
অন্যদিকে হীনবর্ণীয় পুরুষ কর্তৃক উচ্চবর্ণা নারী সম্ভোগকারী প্রতিলোম-বিবাহকে তীব্রভাবে নিন্দিত বা নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এর কারণ কিন্তু নারীকে বা নারীর কোন আভিজাত্যকে সমুন্নত করা নয় কিছুতেই। মূলত ব্রাহ্মণ্যশান্ত্রের সামাজিক ক্ষমতা-কাঠামোয় বর্ণশ্রেষ্ঠের প্রভাব ও আভিজাত্যকে রক্ষা ও নিষ্কণ্টক রাখার নিরাপোষ খবরদারি তা। এক্ষেত্রে শূদ্রসমতুল্য নারী তার সহজাত দেহটি নিয়ে রক্ষকের বর্ণস্তরের আপাত প্রতীক হিসেবেই চিহ্নিত শুধু। তাই হীনজাতীয় পুরুষ কর্তৃক উচ্চবর্ণের নারীসম্ভোগ সরাসরি দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবেই গণ্য হয়-
‘উত্তমাং সেবমানস্তু জঘন্যো বধমর্হতি।
শুল্কং দদ্যাৎ সেবমানঃ সমামিচ্ছেৎ পিতা যদি।।’
কোনও হীনজাতীয় পুরুষ যদি কোনও উচ্চবর্ণের কন্যাকে তার ইচ্ছা অনুসারেও সম্ভোগ করতে থাকে, তাহলে সেই পুরুষের বধদণ্ড হবে। কিন্তু নিজের সমানজাতীয়া কন্যার সাথে ঐরকম করলে সে ঐ কন্যার পিতাকে শুল্ক দেবে, যদি তার পিতা ঐ শুল্ক নিতে ইচ্ছুক হয়। (৮/৩৬৩)।

‘শূদ্রো গুপ্তমগুপ্তং বা দ্বৈজাতং বর্ণমাবসন্।
অগুপ্তমঙ্গসর্বস্বৈর্গুপ্তং সর্বেণ হীয়তে।।’
কোনও দ্বিজাতি-নারী স্বামীর দ্বারা রতি হোক্ বা না-ই হোক, কোনও শূদ্র যদি তার সাথে মৈথুন ক্রিয়ার দ্বারা উপগত হয়, তাহলে অরতিা নারীর সাথে সঙ্গমের শাস্তিস্বরূপ তার সর্বস্ব হরণ এবং লিঙ্গচ্ছেদনরূপ দণ্ড হবে; আর যদি স্বামীর দ্বারা অরক্ষিতা নারীর সাথে সম্ভোগ করে তাহলে ঐ শূদ্রের সর্বস্বহরণ এবং মারণদণ্ড হবে। (৮/৩৭৪)।

এভাবে অন্যান্য দ্বিজাতি পুরুষও যদি তার চেয়ে তুলনামূলক উচ্চবর্ণের রক্ষিতা বা অরক্ষিতা নারীসম্ভোগ করে, তাহলে শূদ্রের মতো তীব্রদণ্ড না হলেও বিভিন্ন দণ্ডের বিধান মনুশাস্ত্রে বর্ণিত আছে। এছাড়াও পুরুষতান্ত্রিক ব্যবস্থায়  বিবাহকার্যে একেবারে আনকোরা অত নারী সরবরাহের ব্যবস্থা অক্ষুণ্ন রাখতে নারী সংরক্ষণের নিমিত্তে মনুসংহিতায় ব্যভিচার রোধকল্পে বর্ণস্তর অনুযায়ী বিভিন্নমাত্রার দণ্ডবিধান রাখা হয়েছে। যা অবশ্যই বর্ণ নিরপেক্ষ নয়। এক্ষেত্রে দণ্ডবিধান উচ্চবর্ণীয়দের অনুকুলই বলা যায়।
 .
তবে প্রতিলোম-প্রক্রিয়ায় স্ত্রী-ভোগের ফলাফল শুধু এই দণ্ডদানেই থেমে থাকে না। উচ্চবর্ণের স্ত্রীভোগ গুরুতর সামাজিক অপরাধ বা দূষণ হিসেবেও চিহ্নিত। তাই এ প্রক্রিয়ায় দ্বিজাতি পুরুষসৃষ্ট সন্তান উত্তরাধিকার ব্যবস্থায় বর্ণ-সংকট তৈরি করে বর্ণ-অবনমন ঘটালেও, শূদ্রবর্ণের পুরুষের উৎপাদিত বর্ণসঙ্কর সন্তান তাদের পুত্র-অধিকার হারিয়ে নরাধম হয়ে যায়। এখানে বর্ণবৈষম্য খুবই স্পষ্ট। আর এ অপরাধের মাত্রা বা দূষণপ্রক্রিয়া তীব্রতম হলে অর্থাৎ শূদ্রপুরুষ কর্তৃক ব্রাহ্মণা স্ত্রী দূষিত হলে উৎপাদিত বর্ণসঙ্কর অস্পৃশ্য চণ্ডাল হয়ে যায়-
‘আয়োগবশ্চ ক্ষত্তা চ চাণ্ডালশ্চাধমো নৃণাম্।
প্রাতিলোম্যেন জায়ন্তে শূদ্রাদপসদাস্ত্রয়ঃ।।’
শূদ্র পুরুষ থেকে প্রতিলোমক্রমে জাত অর্থাৎ শূদ্র পুরুষের ঔরসে বৈশ্যা স্ত্রীতে জাত আয়োগব, ক্ষত্রিয়া স্ত্রীতে জাত ক্ষত্তা এবং ব্রাহ্মণী স্ত্রীতে জাত চণ্ডাল- এই তিন জাতি পুত্রকাজ করার অযোগ্য। এই জন্য এরা অপসদ অর্থাৎ নরাধম বলে পরিগণিত হয়। এদের মধ্যে চণ্ডাল হলো অস্পৃশ্য। (১০/১৬)।
‘চণ্ডালশ্বপচানাং তু বহির্গ্রামাৎ প্রতিশ্রয়ঃ।
অপপাত্রাশ্চ কর্তব্যা ধনমেষাং শ্বগর্দভম্।।’
চণ্ডাল, শ্বপচ প্রভৃতি জাতির বাসস্থান হবে গ্রামের বাইরে। এইসব জাতিকে ‘অপপাত্র’ করে দিতে হয়; কুকুর এবং গাধা হবে তাদের ধনস্বরূপ। (অপপাত্র হলো যে পাত্রে ভোজন করলে তা আর সংস্কার দ্বারা শুদ্ধ করা চলবে না, তা পরিত্যাগই করতে হবে। অথবা তারা যে পাত্র স্পর্শ করে থাকবে তাতে অন্ন-শক্তু প্রভৃতি দেয়া চলবে না; কিন্তু পাত্রটি মাটির উপর রেখে দিলে কিংবা অন্য কোনও লোক তা হাতে করে ধরে থাকলে তার উপর ভাত-ছাতু প্রভৃতি দিয়ে মাটির উপর রেখে দিলে তারা ঐ খাদ্য গ্রহণ করবে। অন্য অর্থে ভাঙা পাত্রকে অপপাত্র বলে)। (১০/৫১)।
অতএব, সারমর্ম দাঁড়ালো এই, পুরুষতান্ত্রিক বৈদিক ধর্মব্যবস্থায় নারীর নিজের কোন বর্ণ নেই বলে সাধারণ দৃষ্টিতে নারী শূদ্রসমতুল্য। ফলে নারী হচ্ছে পুরুষের ইচ্ছানুরূপ ভোগের নৈবেদ্য। তাকে যথেচ্ছ ভোগ করার পুরুষকেন্দ্রিক বৈধতা রয়েছে। তবে সহজাত পিতৃবর্ণের স্তরভেদ অনুযায়ী নারীর যে আপেক্ষিক বর্ণপরিচয় দাঁড় করানো হয়, তা মূলত আধিপত্যকামী পুরুষতন্ত্রের নিজস্ব আভিজাত্যের আন্তবৈষম্য নির্ণায়ক সামাজিক প্রতীকী মাত্র। তাই তাকে ইচ্ছেখুশি ভোগ করা গেলেও উপজাত হিসেবে সৃষ্ট সন্তানের দ্বারা সমাজে প্রচলিত সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষমতা কেন্দ্রিক উচ্চ-নিচ বর্ণ-ভারসাম্য নষ্ট করা চলবে না কিছুতেই। কেননা পুরুষতন্ত্রে নারীই হচ্ছে সেই একমাত্র উপাদান, যাকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সমাজ-নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়ায় ধর্মীয় সমাজ-শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থাটিকে প্রয়োজনমতো পরিচালিত করা হয়।
 .
মনুর দৃষ্টিতে নারীর প্রকৃতি ও সম্পত্তি বিচার
প্রাকৃতিকভাবেই নারী যে পুরুষের মতোই প্রাণীজ আবেগসম্পন্ন জৈব-মানসিক সত্তা, তা পিতৃতান্ত্রিক কূটবুদ্ধিতে অজানা থাকার কথা নয়। তাই নারীকে ক্ষমতা ও অধিকারশূণ্য করে পিতৃতন্ত্রের পূর্ণ-কব্জায় নিতে গিয়ে পুরুষের মধ্যে যে মনস্তাত্ত্বিক সংকট ও জটিলতা তৈরি হয়েছিলো, শেষপর্যন্ত তা হয়তো গোপন রাখা যায় নি। আর এই সংকট ও নিজেদের ব্যভিচার ঢেকে রাখার আপ্রাণ অপচেষ্টা হিসেবে নারীকে হীনস্বভাবী আখ্যায়িত করে তার উপর খুব সচেতনভাবেই কতকগুলো আপত্তিকর অপবাদ কৌশলে চাপিয়ে দিয়েছে পুরুষ-
‘স্বভাব এষ নারীণাং নরাণামিহ্ দূষণম্।
অতোহর্থান্ন প্রমাদ্যন্তি প্রমদাসু বিপশ্চিতঃ।।’
ইহলোকে (শৃঙ্গার চেষ্টার দ্বারা মোহিত করে) পুরুষদের দূষিত করাই নারীদের স্বভাব; এই কারণে পণ্ডিতেরা স্ত্রীলোকসম্বন্ধে কখনোই অনবধান হন না। (২/২১৩)।

‘অবিদ্বাংসমলং লোকে বিদ্বাংসমপি বা পুনঃ।
প্রমদা হ্যুৎপথং নেতুং কামক্রোধবশানুগম্।।’
ইহলোকে কোনও পুরুষ ‘আমি বিদ্বান্ জিতেন্দ্রিয়’ মনে করে স্ত্রীলোকের সন্নিধানে বাস করবেন না; কারণ, বিদ্বানই হোন বা অবিদ্বানই হোন, দেহধর্মবশতঃ কামক্রোধের বশীভূত পুরুষকে কামিনীরা অনায়াসে বিপথে নিয়ে যেতে সমর্থ হয়। (২/২১৪)

‘মাত্রা স্বস্রা দুহিত্রা বা না বিবিক্তাসনো ভবেৎ।
বলবানিন্দ্রিয়গ্রামো বিদ্বাংসমপি কর্ষতি।।’
মাতা, ভগিনী বা কন্যার সাথে কোনও পুরুষ নির্জন গৃহাদিতে বাস করবে না, কারণ ইন্দ্রিয়সমূহ এতই বলবান্ (চঞ্চল) যে, এরা (শাস্ত্রালোচনার দ্বারা আত্মসংযম অভ্যাস করতে পেরেছেন এমন) বিদ্বান্ ব্যক্তিকেও আকর্ষণ করে (অর্থাৎ কামক্রোধাদির বশবর্তী করে তোলে)। (২/২১৫)।

‘নৈতা রূপং পরীক্ষন্তে নাসাং বয়সি সংস্থিতিঃ।
গুরূপং বা বিরূপং বা পুমানিত্যেব ভুঞ্জতে।।’
বস্তুতঃপক্ষে স্ত্রীলোকেরা যে সৌন্দর্যে আসক্ত হয় তা নয় কিংবা পুরুষের বিশেষ বয়সের উপর নির্ভর করে তা-ও নয়। কিন্তু যার প্রতি আকৃষ্ট হয় সে লোকটি সুরূপই হোক বা কুরূপই হোক তাতে কিছু যায় আসে না, যেহেতু ব্যক্তিটি পুরুষ এইজন্যেই তার প্রতি আসক্ত হয় (এবং তার সাথে সম্ভোগে লিপ্ত হয়)। (৯/১৪)।

‘শয্যাসনমলঙ্কারং কামং ক্রোধমনার্জবম্।
দ্রোহভাবং কুচর্যাঞ্চ স্ত্রীভ্যো মনুরকল্পয়ৎ।।’
বেশি নিদ্রা যাওয়া, কেবল বসে থাকার ইচ্ছা, শরীরকে অলংকৃত করা, কাম অর্থাৎ পুরুষকে ভোগ করার আকাঙ্ক্ষা, অন্যের প্রতি বিদ্বেষ, নীচহৃদয়তা, অন্যের বিরুদ্ধাচরণ করা এবং কুচর্যা অর্থাৎ নীচ পুরুষকে ভজনা করা- স্ত্রীলোকদের এই সব স্বভাব মনু এদের সৃষ্টি-কালেই করে গিয়েছেন। (৯/১৭)।
অর্থাৎ পুরুষের নিজস্ব দুরাচারকে সুকৌশলে ব্রহ্মবাক্য দিয়ে শেষপর্যন্ত নারীর উপরই চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ তথাকথিত শাস্ত্রজ্ঞ হয়েও আসলে পুরুষই যে অভব্য হয়, সেই নিচত্ব ঢাকতে গিয়ে নারীকে একটা নিকৃষ্ট কামজ সত্তা প্রমাণেই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে হীনম্মণ্য পুরুষ। এ কারণে মনুশাস্ত্রে নারীর স্বাধীনতাকে পুরোপুরি অস্বীকার করে বলা হচ্ছে- নারী স্বাধীনাবস্থায় অবস্থানের যোগ্য নয়-
‘বালয়া বা যুবত্যা বা বৃদ্ধয়া বাপি যোষিতা।
ন স্বাতস্ত্র্যেণ কর্তব্যং কিঞ্চিৎ কার্যং গৃহেষবপি।।’
স্ত্রীলোক বালিকাই হোক, যুবতীই হোক কিংবা বৃদ্ধাই হোক, সে গৃহমধ্যে থেকে কোনও কাজই স্বামী প্রভৃতির অনুমতি ছাড়া করতে পারবে না। (৫/১৪৭)।

‘বাল্যে পিতুর্বশে তিষ্ঠেৎ পানিগ্রাহস্য যৌবনে।
পুত্রাণাং ভর্তরি প্রেতে ন ভজেৎ স্ত্রী স্বতন্ত্রতাম্।।’
স্ত্রীলোক বাল্যাবস্থায় পিতার অধীনে থাকবে, যৌবনকালে পাণিগ্রহীতার অর্থাৎ স্বামীর অধীনে থাকবে এবং স্বামীর মৃত্যু হলে পুত্রদের অধীনে থাকবে। (পুত্র না থাকলে স্বামীর সপিণ্ড, স্বামীর সপিণ্ড না থাকলে পিতার সপিণ্ড এবং পিতার সপিণ্ড না থাকলে রাজার বশে থাকবে), কিন্তু কোনও অবস্থাতেই স্ত্রীলোক স্বাধীনতা লাভ করতে পারবে না। (৫/১৪৮)।

উল্লেখ্য যে, সপিণ্ড মানে যিনি মৃতব্যক্তির শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে পিণ্ড দানের যোগ্য। হিন্দুশাস্ত্রে পিণ্ডদানের ক্রমাধিকারের সাথে সম্পত্তির অধিকার অর্জনের বিষয়ও জড়িত।
এবং মনুর পুরুষ-দৃষ্টি এতোটাই একচক্ষু যে, নারীকে কখনও বিশ্বাসও করা যাবে না। তাই-
‘পিত্রা ভর্ত্রা সুতৈর্বাপি নেচ্ছেদ্বিরহমাত্মনঃ।
এষাং হি বিরহেণ স্ত্রী গর্হ্যে কুর্যাদুভে কুলে।।’
স্ত্রীলোক কখনো পিতা, স্বামী কিংবা পুত্রের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হবে না; কারণ, স্ত্রীলোক এদের থেকে বিচ্ছিন্ন থাকলে পিতৃকুল ও পতিকুল- উভয় কুলকেই কলঙ্কিত করে তোলে। (৫/১৪৯)।

অর্থাৎ নারীর জীবন পিতা বা স্বামীর কুলেই সীমাবদ্ধ। নিজের কোন কুল নেই বলে এই কুলহীনতা নারীকে একধরনের সামাজিক সম্পত্তিতে পরিণত করে। ফলে চূড়ান্ত বিচারে নারী পুরুষের অধীনতাই স্বীকার করতে বাধ্য।
 .
পুরুষ-কেন্দ্রিকতায় নারীর প্রতি এই সম্পত্তি-ধারণা থেকেই হয়তো পুরুষের নারীসংরক্ষণের দৃষ্টিভঙ্গি উদ্ভূত। অসতর্ক হলেই এ সম্পত্তি নষ্ট বা হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে। তাই মনুশাস্ত্রে উক্ত হয়-

‘অস্বতন্ত্রাঃ স্ত্রিয়ঃ কার্যাঃ পুরুষৈ স্বৈর্দিবানিশম্।
বিষয়েষু চ সজ্জন্তঃ সংস্থাপ্যা আত্মনো বশে।।’
স্ত্রীলোকদের আত্মীয় পুরুষগণের [অর্থাৎ পিতা, স্বামী, পুত্র প্রভৃতি যে সব পুরুষ স্ত্রীলোককে রাক্ষা করবার অধিকারী, তাদের] উচিত হবে না, দিন ও রাত্রির মধ্যে কোনও সময়ে স্ত্রীলোককে স্বাতন্ত্র্য অবলম্বন করতে দেওয়া [অর্থাৎ স্ত্রীলোকেরা যে নিজেদের ইচ্ছামতো ধর্ম, অর্থ ও কামে প্রবৃত্ত হবে তা হতে দেবে না]। স্ত্রীলোকেরা গান-বাজনা প্রভৃতি বিষয়ে আসক্ত হতে থাকলে তা থেকে তাদের নিবৃত্ত করে নিজের বশে রাখতে হবে। (৯/২)।

‘ইমং হি সর্ববর্ণানাং পশ্যন্তো ধর্মমুত্তমম্।
যতন্তে রক্ষিতুং ভার্যাং ভর্তারো দুর্বলা অপি।।’
স্ত্রীলোককে রক্ষণরূপ-ধর্ম সকল বর্ণের পক্ষে শ্রেষ্ঠ ধর্ম- অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ কর্তব্য। এই ব্যাপার বুঝে অন্ধ, পঙ্গু প্রভৃতি দুর্বল স্বামীরাও নিজ নিজ স্ত্রীকে রক্ষা করবার জন্য যত্ন করবে। (৯/৬)।

শাস্ত্রে উপদিষ্ট হয়েছে বলেই যে কেবল ভার্যাকে রক্ষা করা কর্তব্য, এমন নয়; স্ত্রীর দ্বারা নানারকম প্রয়োজন সাধিত হয় বলেও ঐ রক্ষণরূপ কাজ করা কর্তব্য-
‘স্বাং প্রসূতিং চরিত্রঞ্চ কুলমাত্মানমেব চ।
স্বঞ্চ ধর্মং প্রযত্নেন জায়াং রক্ষন্ হি রক্ষতি।।’
যে লোক যত্নের সাথে নিজের স্ত্রীকে রক্ষা করে, তার দ্বারা নিজ সন্তান রক্ষিত হয়। কারণ, সাঙ্কর্যাদি দোষ না থাকলে বিশুদ্ধ সন্তান-সন্ততি জন্মে। স্ত্রীকে রক্ষার দ্বারা শিষ্টাচার রক্ষিত হয় এবং নিজের কুলমর্যাদা রক্ষিত হয়। স্ত্রীকে রক্ষা করলে নিজেকেও রক্ষা করা হয় এবং স্ত্রীকে রক্ষা করলে স্বামী তার নিজের ধর্মকেও রক্ষা করতে পারে। (৯/৭)।
তাই, কিভাবে স্ত্রীকে রক্ষা করতে হবে তার উপায়ও মনু বাতলে দিয়েছেন-
‘ন কশ্চিদ্যোষিতঃ শক্তঃ প্রসহ্য পরিরক্ষিতুম্।
এতৈরুপায়যোগৈস্তু শক্যাস্তাঃ পরিরক্ষিতুম্।।’
স্ত্রীলোকসমূহকে কেউ বলপূর্বক বা সংরোধ বা তাড়নাদির দ্বারা রক্ষা করতে পারে না। কিন্তু বক্ষ্যমাণ উপায়গুলি অবলম্বন করলে তাদের রক্ষ করা যায়। (৯/১০)।
কী উপায় ?
‘অর্থস্য সংগ্রেহে চৈনাং ব্যয়ে চৈব নিযোজয়েৎ।
শৌচে ধর্মেহন্নপক্ত্যাঞ্চ পারিণাহ্যস্য বেক্ষণে।।’
টাকাকড়ি ঠিকমত হিসাব করে জমা রাখা এবং খরচ করা, গৃহ ও গৃহস্থালী শুদ্ধ রাখা, ধর্ম-কর্ম সমূহের আয়োজন করা, অন্নপাক করা এবং শয্যাসনাদির তত্ত্বাবধান করা- এই সব কাজে স্ত্রীলোকদের নিযুক্ত করে অন্যমনস্ক রাখবে। (৯/১১)।
তারপরও রক্ষক পুরুষ এই স্বভাবদুষ্ট নারীকে নিয়ে নিশ্চিন্ত হতে পারে নি। কেননা নারীকে কখনো বিশ্বস্ত ভাবা হয় না। তাই স্বভাব অনুযায়ী নারীর অবিশ্বস্ত বা দূষিত হওয়ার আরো কিছু কল্পিত কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়েছে, যা থেকে নারীকে নিরস্ত করার ব্যবস্থা নিতে হয়-
‘পানং দুর্জনসংসর্গঃ পত্যা চ বিরহোহটনম্।
স্বপ্নোহন্যগেহবাসশ্চ নারীসংদূষণানি ষট্।।’
মদ্যপান, দুষ্ট লোকের সাথে মেলামেশা করা, স্বামীর সাথে বিচ্ছেদ, যেখানে সেখানে ঘুরে বেড়ানো, অসময়ে ঘুমানো এবং পরের বাড়িতে বাস করা- এই ছয়টি বিষয় স্ত্রীলোককে দূষিত করে। (৯/১৩)।

‘অরক্ষিতা গৃহে রুদ্ধাঃ পুরুষৈরাপ্তকারিভিঃ।
আত্মানমাত্মনা যাস্তু রক্ষেয়ুস্তাঃ সুরক্ষিতাঃ।।’
যে স্ত্রী দুঃশীলতাহেতু নিজে আত্মরক্ষায় যত্নবতী না হয়, তাকে আপ্তপুরুষেরা গৃহমধ্যে অবরুদ্ধ করে রাখলেও সে অরক্ষিতা হয়; কিন্তু যারা সর্বদা আপনা-আপনি আত্মরক্ষায় তৎপর, কেউ তাদের রক্ষা না করলেও তারা সুরক্ষিতা হয়ে থাকে। (৯/১২)।

অতএব-
‘যাদৃশং ভজতে হি স্ত্রী সুতং সূতে তথাবিধম্।
তস্মাৎ প্রজাবিশুদ্ধ্যর্থং স্ত্রিয়ং রক্ষেৎ প্রযত্নতঃ।।’
যে পুরুষ শাস্ত্রবিহিত উপায়ে নিজের পতি হয়েছে এমন পুরুষকে যে স্ত্রীলোক সেবা করে, সে উৎকৃষ্ট সন্তান প্রসব করে; আর শাস্ত্রনিষিদ্ধ পরপুরুষ-সেবায় নিকৃষ্ট সন্তান লাভ হয়। সেই কারণে সন্তানের বিশুদ্ধতা রক্ষার জন্য, সর্বপ্রযত্নে যাতে স্ত্রীর পরপুরুষ-সম্পর্ক না হয়, তার জন্য স্ত্রীকে সকল সময় রক্ষা করা কর্তব্য। (৯/৯)।

যাবতীয় দুষ্কর্মের ক্ষেত্রেই দেখা যায় যে পুরুষই সব অঘটনের মূল ও সক্রিয়বাদী। তবু একপেশে পুরুষবাদে নারীকেই এর সমস্ত দায়ভাগ অন্যায়ভাবেই বহন করতে হয়। এক্ষেত্রে মনুশান্ত্র অন্ধ নয় অবশ্যই, দারুণরকম পক্ষপাতদুষ্ট ও আধিপত্যবাদী। ফলে সম্পত্তিসূচক স্ত্রীসংরক্ষণে প্রভুত্ববাদী মনুশাস্ত্র কখনোই হাল ছেড়ে দেয়নি তো বটেই, এবং একই কারণে স্ত্রীকে কোনরূপ প্রশ্ন উত্তাপনের সুযোগরহিত করে কেবল ভোগ্য থাকার নিমিত্তে নারীর কর্তব্যবিধান নির্দেশেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে।

(চলবে…)

[পর্ব-০১][×][পর্ব-০৩]

No comments: