Wednesday, November 2, 2011

| যে ডায়েরীটা…| ৩৮ |

. | যে ডায়েরীটা লেখা হবে না আর…| ৩৮ |
 -রণদীপম বসু

তারিখ: নেই (১৯৯৩)

রূপা, এমোন যে খবরহীন হয়ে গেলে হঠাৎ ! তুমি কারো কথা না ভাবতে পারো, কিন্তু কেউ তো তোমার কথা ভাবে সারাক্ষণ, এটা কি বুঝতে পাও ? অবশ্য যদি তোমার ভালোবাসার উদার আকাশে কোন দীপ্ত নক্ষত্রের খোঁজ পেয়ে থাকো, সেটা ভিন্ন কথা। আমি তো নিভু নিভু মাটির প্রদীপ মাত্র ! টিমটিমে নিজকেই প্রকাশ করতে, আলোকিত করতে পারি না, সেখানে নক্ষত্রের সাথে পাল্লা দেবো কোন্ সাহসে ! যে নক্ষত্রের উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত, প্রদীপের আলো তো সেখানে পরিহাস মাত্র ! শুধু পুড়ে যাওয়াই সার !
 .
বেশ ক’টা দিন অনন্ত আশা নিয়ে বসে ছিলাম, ব্যাকুল প্রতীক্ষা ছিলো, এই ভীষণ ব্যস্ত সময়টাতে তোমার অন্তত একটা চিঠি পাবো। ব্যস্ততার ক্লান্তিটুকু আদরে আদরে মুছিয়ে দেবে ওটা, শক্তি দেবে। বুঝি এটাই আমার দুরাশা ! তোমাকে কাছে চাওয়া, ভালোবাসতে পাওয়া যদি আমার অনধিকার চর্চা হয়, এমন দুরাশা হয়, তাইলে জানিয়ে দিলেই তো পারো ! সময় তো কারো জন্য বসে থাকে না, জীবন কারো জন্যে থেমেও থাকে না। তুমি চাইলেই পৃথিবীর সব সুখ তোমার পায়ে লুটিয়ে পড়তে প্রস্তুত, ভাগ্যবিধাতা এমোন অমূল্য সম্পদ তোমাকে দিয়েছেন। আমি তো কেবলই সম্ভাবনাহীন এক ছন্নছাড়া মাত্র, আমার কীইবা সামর্থ্য আছে তোমাকে সুখী করার ? একটা নিরাপত্তাহীন জীবন দেয়া ছাড়া ! তোমার জীবনে আমি না থাকলেই বোধকরি তুমি সুখী হতে বেশী, অনেক সুখী ! জীবন তো কারো থেমে থাকে না, আমারও থাকবে না। হয়তো তোমাকে নিয়ে গড়া স্বপ্নময় আলোর পথটা আমার একাকী অন্ধকার গলিতে মোড় নেবে। জীবন ঠিকই এগিয়ে যাবে।
 .
যখন দুজনের মধ্যে কোন লেখা বিনিময় ছিলো না, তখন ওটাই ছিলো স্বাভাবিক। পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেন, যত যুগের ব্যবধানই থাকুক, মনে হতো তুমি কেবলই আমার, চিরকালের আমারই থাকবে। বুকের ভেতরে খুব কষ্ট হলেও পরম আশ্বাসে স্থির ছিলাম, পৃথিবীতে আর যা-ই ঘটুক, আমার রূপা আমারই থাকবে। আর কারো অধিকারে যেতে পারে না, কেননা আমি যে শুধুই রূপার। কিন্তু পত্র বিনিময়ের অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে পড়ার পর তোমার এমন হঠাৎ আত্মগোপন আমাকে ভীষণ ভাবিয়ে তুলেছে। এটা কি তোমার নির্লিপ্ততা ? তবে কি তুমি বদলে যাচ্ছো ভীষণ ? অবশ্য এটা যেকোন মনের যেকোন মানুষের একেবারে নিজস্ব অধিকার। এতে অন্য কারো হাত দেয়ার উপায় নেই। নিজে নিজে কষ্ট পেলেও ধরে রাখার যোগ্যতা যদি নাই থাকলো, আমি দুঃখ পেলে তাতে তোমার কী ? তুমি তোমার সম্ভাবনাময় সুখকে জলাঞ্জলি দেবে কেন ?
 .
নিঃসঙ্গ মানুষেরা বুঝি একটু বেশী আবেগপ্রবণ হয়। আমার বুকের একেবারে গহীন থেকে বেরিয়ে আসা কথাগুলোকে তুমি ক্ষণিক ভাবাবেগ বলে উড়িয়ে দিতে পারো, সে অধিকার তোমার আছে। কিন্তু আত্মপক্ষ সমর্থন করেও তো বলতে পারি, জগতে এমন কোন ভালোবাসার অস্তিত্ব কখনো ছিলো কিনা অথবা আছে কিনা আমার জানা নেই যেখানে আবেগের ছোঁয়া নেই। তবু এটাও স্বতসিদ্ধ যে, যুক্তি দিয়ে আর যাই হোক ভালোবাসা চলে না। তাই আমার উপর থেকে যদি তোমার ভালোবাসা নিতান্তই হ্রাস পেয়ে থাকে বা উঠে যায়, তাতে তোমাকে দোষ দিতে পারি না। সে আমারই অক্ষমতা, অপূর্ণতা এবং অযোগ্যতাই হবে। যে তোমাকে পাবার যোগ্য, তাকেই তো তুমি গ্রহণ করবে, কে কী ভাবলো এর খোঁজ রেখে তোমার দরকার কিসের ?
 .
পৃথিবীটা ছোট হয়ে আসলেও নিঃসঙ্গ একাকী মানুষদের জন্যে পৃথিবীটা আসলেই অনেক বড়। ঘুরতে ঘুরতে একটা যাযাবর জীবন কাটিয়ে দেবার মতোই বড়।

(চলবে…)

পর্ব:[৩৭] [*] [৩৯]
 …

No comments: