Friday, November 4, 2011

| উৎবচন-শতক…| তিন | ২০১-৩০০ |

.
| উৎবচন-শতক…| তিন | ২০১-৩০০ |
- রণদীপম বসু

 …
[উৎসর্গ: হুমায়ুন আজাদ, যাঁকে আদর্শ ভাবলে প্রাণিত হই]
(২০১)
যে সত্য প্রকাশ করা যায় না, তার কোন ব্যবহারিক মূল্য নেই।
যার ব্যবহারিক মূল্য থাকে না, তা অর্থহীন অপ্রয়োজনীয়।
 .
(২০২)
যে প্রশ্নের উত্তর জানি বলে আমরা মনে করি, তা নিয়ে কেউ ভাবি না।
শেষ পর্যন্ত উত্তরটা আর জানা হয় না আমাদের;
এবং সবচেয়ে কম জানি সেটাই।
 .
(২০৩)
চিন্তারাজিকে সীমাহীন উন্মুক্ত না-করলে বিজ্ঞান-মনস্ক হওয়া যায় না;
আর মুক্তচিন্তাকে অবরুদ্ধ না করলে প্রচলিত ধার্মিক হওয়া সম্ভব নয়।
 .
(২০৪)
বিজ্ঞান-প্রদত্ত সমস্ত সুবিধা গ্রহণ করেও যখন ধর্মের ধ্বজাধারীরা
বিজ্ঞানের বিরুদ্ধেই যুদ্ধরত হন,
তখন বুঝতে হবে এদের নৈতিকতা ভণ্ডামোতে ভরা।
ভণ্ডামো দিয়ে মানবতার কোন উপকার হয় না।
 .
(২০৫)
মিল বা অমিল কোনোটাই না-থাকা হচ্ছে অলীক-অবস্থা।
চিন্তা হচ্ছে সে-রকম একটা বিষয়, যার
অলীকত্ব ঘোচাতে তাকে দৃশ্যমান করতে হয়।
 .
(২০৬)
ভাষার প্রাণ যেমন কথায় নয় দেহে,
দেহভাষার প্রয়োগ না ঘটলে কথারা হয়ে যায় অর্থহীন নিষ্প্রাণ;
লেখারও দেহভাষা থাকে,
উত্তীর্ণ লেখক সেই দেহটিকে আবিষ্কার করেন।
 .
(২০৭)
ভবিষ্যৎ সমৃদ্ধ করতে গিয়ে অতি হিসেবি যারা
বর্তমানকেই বঞ্চিত করে ফেলেন,
তাদের ভবিষ্যতও এক অধরা কাল্পনিক সত্তা হয়েই থাকে।
 .
(২০৮)
যার কাছে অর্থ নেই, তার অবস্থা শোচনীয়;
যার কাছে অর্থ ছাড়া আর কিছুই নেই, তার অবস্থা আরো শোচনীয়।
কিন্তু মানুষের চূড়ান্ত মোহ মধ্যপন্থায় চলতে অভ্যস্ত নয়।
 .
(২০৯)
কথায় বলে- ‘সব জিনিসের মূল্য আছে, মানুষের দাম নাই।’
কথাটা ভুল; কারণ দাম উঠলেই মানুষ পণ্য হয়ে যায়। এবং
নিজেকে সেরা পণ্য বানাতেই মানুষ একে অন্যের তীব্র প্রতিযোগী।
 .
(২১০)
দুই কান কাটা গেলেই যে মানুষ রাস্তার মাঝখান দিয়ে হাঁটতে পারে,
এটাই নির্লজ্জ হওয়ার সবচেয়ে বড় ক্রেডিট বা সুবিধা।
 .
(২১১)
মানুষ খোঁজে উল্লাস, পছন্দ করে বিষাদগ্রস্ততা।
 .
(২১২)
নারী যাকে অপছন্দ করে, তাকে ভুলে না কখনো।
পুরুষ যাকে পছন্দ করে, তাকে ভুলতে চায় না।
 .
(২১৩)
নারী পছন্দ করে সৃজনশীল ব্যক্তিকে,
কিন্তু জীবনসঙ্গী হিসেবে চায় গৃহী পুরুষ।
সৃজনশীল পুরুষ ভালো গৃহস্থ হয় না।
 .
(২১৪)
প্রার্থনালয়ে পড়ে থাকা নয়,
জগতের শ্রেষ্ঠতম পূণ্যের কাজ হচ্ছে
নিজেকে দেহমনে আপাদমস্তক সুস্থ রাখা।
 .
(২১৫)
মানুষ কথা বলে চোখে, মুখ তার অনুবাদ করে।
 .
(২১৬)
আনন্দ কখনো নিরপেক্ষ হয় না, তাই নির্মলও নয়।
আনন্দ পেতে না জানলে আনন্দ দেয়া যায় না।
 .
(২১৭)
পুরস্কারের নিজের কোন মূল্য বা যোগ্যতা নেই;
পুরস্কারপ্রাপ্ত ব্যক্তির যোগ্যতা দিয়েই পুরস্কারের মূল্যমান নির্ধারিত হয়।
 .
(২১৮)
না-জানার প্রশ্নে যিনি সর্বদাই উন্মুখ, তিনি দার্শনিক;
আর জানার বিজ্ঞতায় যিনি নতজানু, তিনি পণ্ডিত।
 .
(২১৯)
বিশ্বস্ততায় থাকে নির্ভরতার শক্তি ও দায়বদ্ধতা;
আনুগত্যে থাকে ক্ষমতার কাছে নতজানুতা।
অনুগতের কোন দায়বদ্ধতা নেই, তাই নির্ভরযোগ্যতাও নেই।
 .
(২২০)
হৃদয়বান হওয়ার প্রথম শর্তই হলো নিজেকে শোধরানো।
যে ভুল স্বীকার করতে জানে না, সে কখনোই হৃদয়বান হয় না।
 .
(২২১)
বাণী কালনিরপেক্ষ হয় না, তাই তা চিরন্তন নয়।
বাণীর স্থায়িত্ব তার শব্দে নয়, অনুরণনে।
 .
(২২২)
শরীরের ফটক দিয়েই মনের অন্দরে যেতে হয়;
শরীরকে যে উপেক্ষা করে, মনের নাগাল সে পায় না।
 .
(২২৩)
‘ভালোবাসি’ শব্দটি উচ্চারিত হয় বেওকুফের জিহ্বায়।
বেওকুফেরা ভালোবাসতে জানে না।
 .
(২২৪)
চিৎকার আর শীৎকারে তফাৎ হলো
একটি দূরে ঠেলে, অন্যটি কাছে টানে।
 .
(২২৫)
লেখকের ক্ষমতা গ্রহণে, সম্পাদকের ক্ষমতা বর্জনে।
 .
(২২৬)
মানুষের জীবনধারাই তার ভাবনার শৃঙ্খলা প্রকাশ করে;
যার চালচলন এলোমেলো, তার চিন্তাধারাও বিশৃঙ্খল।
 .
(২২৭)
অকারণ সৌন্দর্যসচেতনতা কর্মদক্ষতা কমিয়ে দেয়।
মানুষের সৌন্দর্য তার কর্মকুশলতায়; অথচ
কর্মনিষ্ঠ ব্যক্তি সৌন্দর্যসচেতন থাকে না।
 .
(২২৮)
ভালো হওয়ার প্রথম শর্তই হলো খারাপ হওয়া।
যে খারাপ হতে জানে না, সে ভালোও হতে পারে না।
 .
(২২৯)
সঙ্গম-সূত্র শিখে গেলে সে সঙ্গমে আর প্রাণ থাকে না;
তা হয় শুধুই যান্ত্রিক দীর্ঘায়ন।
 .
(২৩০)
ধর্ম যতক্ষণ দর্শন হিসেবে চর্চিত হয়, ততক্ষণই তা নিরপেক্ষ ও আকর্ষণীয়;
যখনই তা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়, তখনই আপত্তিকর হয়ে ওঠে।
 .
(২৩১)
কৃপণ আর স্বার্থপরে পার্থক্য সামান্যই;
স্বার্থপর অন্যকে ঠকায়, কৃপণ ঠকায় নিজেকে।
 .
(২৩২)
মানুষ যতক্ষণ প্রকৃতির সন্তান, ততক্ষণ সে মুক্ত ও স্বাধীন।
স্বাধীনতা রুদ্ধ হলেই মানুষ নাগরিক-গৃহস্থ হয়ে ওঠে।
 .
(২৩৩)
ভালোবাসার অবয়ব বাইরেই, রঙিন বেলুনের মতো;
ভেতরে তার অদৃশ্য হাওয়া।
 .
(২৩৪)
যিনি যত বড়, তিনি ততই নিঃসঙ্গ;
চূড়ান্ত নিঃসঙ্গতা মানেই মৃত্যু, যখন
নিজেও নিজেকে আর সঙ্গ দেয়া যায় না।
 .
(২৩৫)
পুরুষের কৌশলগত বিশ্লেষণে নারী অসম্পূর্ণ।
কারণ, পুরুষ তার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বেছে নিয়েছে নারীকে।
কিন্তু নারীর প্রতিদ্বন্দ্বী সে নিজেই; তাই সে খণ্ডিতই থেকে যায়।
 .
(২৩৬)
মানুষের অসহায়ত্ব তার মনে, যখন
সে তার শরীর ও মগজকে হাতিয়ার বানাতে পারে না।
 .
(২৩৭)
বিষণ্নতা এক অমূল্য সম্পদ;
বিষণ্ন হলেই মানুষ উপলব্ধির গভীরতম কুঠুরির সন্ধান পায়।
 .
(২৩৮)
অপ্রকাশিত চিন্তার গভীরতা অপরিমেয়।
প্রকাশের আওতায় এলেই চিন্তা তার গভীরতা হারিয়ে
পরিমাপযোগ্য সীমাবদ্ধতায় চলে আসে।
 .
(২৩৯)
মানুষ সেরকম চিন্তায় আনন্দ পায় বেশি
যা বাস্তবায়নযোগ্য নয়।
 .
(২৪০)
ক্ষমতার নেশা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি।
তাই অন্য সব নেশা যত ভয়ঙ্করই হোক, তা আরোপিত বলে
কোন না কোনভাবে বর্জন করা সম্ভব।
কিন্তু ব্যক্তি মন্দ হোক বা ভালোই হোক
ক্ষমতার নেশা কখনোই ছাড়তে পারে না।
 .
(২৪১)
অন্ধবিশ্বাস কোন বিশ্বাস নয়, এতে যুক্তিবোধ নেই;
অন্ধভক্তও প্রকৃতপক্ষে ভক্ত হয় না,
কারণ তাদের কোন বিবেচনাবোধ থাকে না।
 .
(২৪২)
সাধারণ মানুষ কখনো ইতিহাস বিকৃত করে না;
নির্লজ্জ ফায়দার লোভে জ্ঞানপাপীরাই ইতিহাস বিকৃতিতে নামেন।
 .
(২৪৩)
সাহিত্যে কল্পনা মূখ্য হলেও ইতিহাসে কল্পনাবিলাসের স্থান নেই;
সাহিত্য ক্ষুধা ও মোহে ইতিহাস সম্ভ্রম হারায়।
 .
(২৪৪)
চাইলেই কেউ নষ্ট হতে পারে না;
নষ্ট হতেও সুযোগের দরকার হয়।
 .
(২৪৫)
নিজেকে ত্যাগী বঞ্চিত রেখে অন্যকে সুযোগ ও সাচ্ছন্দ্য দেয়ার মধ্যে
যতই ভাববাদী মাহাত্ম্য থাক্, ট্র্যাজেডি হচ্ছে
একজীবনে বস্তুগত সুখ ও সমৃদ্ধিহীন ত্যাগীজীবনও চাপা পড়া বঞ্চনারই ইতিহাস।
যাকে মানুষ প্রশংসা করে, কিন্তু পছন্দ করে না।
 .
(২৪৬)
ক্ষমতা আর পাগলামি একে অন্যের পরিপুরক;
এতে যা-খুশি করার স্বাধীনতা পাওয়া যায়।
 .
(২৪৭)
রান্নাকে সুস্বাদু করতে কিছু কূটকৌশলের দরকার হয়; তাই
রন্ধনপটুরা কূটকৌশলী হয়।
 .
(২৪৮)
পাগলের সাথে সহাবস্থানই পাগলের চিকিৎসকদের ট্র্যাজেডি;
ক্রমে ক্রমে এরাও সুস্থ পরিবেশ থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে যান।
 .
(২৪৯)
সময়কে প্রকৃষ্টভাবে ব্যবহারের উপায় হচ্ছে সময় ভুলে যাওয়া;
মানুষ যতক্ষণ সময় সম্পর্কে সচেতন থাকে
ততক্ষণ সময় তার কাজে আসে না।
 .
(২৫০)
সমাপ্তি বলে কিছু নেই, আরেকটা শুরুর নামান্তর মাত্র।
 .
(২৫১)
নারী কোন স্ত্রৈণ পুরুষ পছন্দ করে না
কেবল নিজের স্বামীটিকে ছাড়া।
 .
(২৫২)
শরীরকে যে সন্তুষ্ট রাখতে পারে না,
নৈতিক উৎকর্ষ অর্জন তার দ্বারা অসম্ভব।
 .
(২৫৩)
জীবনে যে কষ্ট আর অভাবের মুখোমুখি হয় নি,
মানবিক অনুভূতি থেকে সে বঞ্চিত।
অনুভূতি না থাকলে গুণাবলি অর্জন সম্ভব নয়।
 .
(২৫৪)
মানুষ তার সেরা কথাটি কখনোই বলতে পারে না;
কারণ তার আয়ু অনন্ত নয়।
 .
(২৫৫)
মানুষ যখন সৃজনরহিত হয়,
পুরনো সৃষ্টির মধ্যেই নিমজ্জিত হয়ে পড়ে।
 .
(২৫৬)
মানুষের প্রথম পাপ চোখে, তারপর মনে;
সবশেষে দেহে ছড়ায়।
 .
(২৫৭)
নিঃস্ব লেখক তিনি, যার
কোন অপ্রকাশিত লেখা নেই।
 .
(২৫৮)
মানবিকতা ও সাম্প্রদায়িকতার মধ্যে প্রধান তফাৎ হচ্ছে-
প্রদর্শিত মানবিকতায় ভণ্ডামোর মিশেল থাকতে পারে; কিন্তু
সাম্প্রদায়িকতা নিজ গুণেই খাঁটি।
তাই সাম্প্রদায়িক হলে মানুষ বিশুদ্ধ পশুতে পরিণত হয়।
 .
(২৫৯)
উন্মুক্ত শৈশব কোন ধর্মীয় অনুশাসনে বন্দী থাকে না বলে
শিশুরা স্বভাবতই যুক্তিশীল ও মানবিক কৌতুহলে প্রাণময় সতেজ থাকে;
বড় হতে হতে বন্দী-প্রিয় মানুষ ক্রমান্বয়ে প্রশ্নহীন জড় পদার্থে পরিণত হয়।
 .
(২৬০)
বিশ্বস্ততার সাথে স্বাধীনতার বিরোধ নেই।
ধূর্ত ব্যক্তি স্বাধীনতাকে স্বেচ্ছাচারিতায় রূপান্তর করে;
এরা কখনো বিশ্বস্ত হয় না।
 .
(২৬১)
মানুষ তথাকথিত ঈশ্বর সম্পর্কে যা বলে
তা হচ্ছে মানুষের সৃষ্ট কল্পনা-গাঁথা; কারণ
অর্থহীন ঈশ্বর-জ্ঞান মানুষ হওয়ার জন্য অনিবার্য নয়।
 .
(২৬২)
ঈশ্বর হচ্ছেন সেই অপ্রমাণিত সত্তা
যার ক্ষমতার উৎস মানুষের অরাজক অজ্ঞতা।
 .
(২৬৩)
এবং ঈশ্বর হলো সেই অদৃশ্য পণ্য,
যে লেনদেনে পুরোটাই বিক্রেতার লাভ;
ক্রেতার ভাগে শূন্য।
 .
(২৬৪)
ধর্ম ও ধর্মগ্রন্থের মধ্যে পার্থক্যটা হলো-
ধর্মগ্রন্থ হচ্ছে মুখোশ, ধর্ম হচ্ছে বাস্তবতা।
 .
(২৬৫)
নিত্য প্রবহমান স্থির সত্যকে অনুসন্ধানই হলো দর্শনের লক্ষ্য;
বিজ্ঞানের কাজ হচ্ছে এই সত্যকে নির্ণয় এবং
তার কার্য-কারণ সত্তাকে ইন্দ্রীয়গ্রাহ্য বস্তুময় করে তোলা।
 .
(২৬৬)
ধর্মগ্রন্থ দিয়ে বিজ্ঞানের সত্যাসত্য নির্ধারণ করা যায় না,
এটা ধূর্ত-মতলববাজ আর পাগলের কাজ;
বরং বিজ্ঞানই পারে ধর্মগ্রন্থের যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করতে।
 .
(২৬৭)
প্রত্যেক মানুষই নিজের মধ্যে একধরনের মৌলবাদ লালন করে যায়।
নিজের মধ্যের এই মৌলবাদিতাকে যিনি আবিষ্কার করতে জানেন
তিনি আর মৌলবাদী থাকেন না। কারণ
সত্য হচ্ছে নিত্য-প্রবহমান স্থিরতা।
 .
(২৬৮)
দর্শনের বিমূর্ত ঘরের দরজাটাকে খুলতে হয় যুক্তির চাবি দিয়ে;
মৌলবাদে যুক্তি থাকে না বলে
সে দরজাটা ভেঙে ফেলতে চায় তার যুক্তিহীন পাশবিকতা দিয়ে।
 .
(২৬৯)
ন্যায়বোধ হচ্ছে সেই আপেক্ষিক চলক, যা
স্থান কাল পাত্র ও অবস্থা ভেদে পরিবর্তিত হয়।
 .
(২৭০)
ক্ষুধা হচ্ছে মানুষের আদি ও অকৃত্রিম অভিজ্ঞতা, যা মানুষ গোপন করতে চায় না।
আর ক্ষুধার্ততা হচ্ছে সেই আদিম প্রবৃত্তি
যা মানুষ চাইলেও গোপন করতে পারে না।
 .
(২৭১)
আত্মাহুতির পূর্বমুহূর্তে মানুষ ধীর স্থির এবং অস্বাভাবিক শান্ত হয়ে যায়;
তখন আর তাঁর মধ্যে সিদ্ধান্তহীনতার অস্থিরতা থাকে না।
 .
(২৭২)
অনন্ত প্রশ্নমালার সংহত ও সংক্ষিপ্ত রূপটির নাম ‘কেন’।
মানুষ যতক্ষণ নিষ্কলুষ শৈশবকে লালন করে,
এই প্রশ্নপ্রবাহে ততক্ষণ সে সহজাত নির্দ্বিধ হয়।
 .
(২৭৩)
সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে-
তাদের পরিচয়ে আগে গোষ্ঠি বা সম্প্রদায়, পরে মানুষ।
সাম্প্রদায়িকতায় শুরুতেই দৃষ্টি খণ্ডিত হয়ে যায় বলে
গোষ্ঠির বাইরে মানুষ পরিচয়টাই তাদের কাছে অর্থহীন।
 .
(২৭৪)
যুক্তিবোধ ও মানবিক বোধের চর্চা না থাকলে
পূর্ণাঙ্গ মানুষ সহজেই খণ্ডিত সাম্প্রদায়িক সত্তায় পরিণত হয়।
সাম্প্রদায়িক সত্তা খণ্ডিত বলে
তার পূর্ণাঙ্গ মানবিক মানুষে উত্তীর্ণ হওয়া সহজসাধ্য নয়।
 .
(২৭৫)
শেয়াল ধূর্ত, কারণ মানুষ তার ধূর্তামি দিয়ে
শেয়ালের এই বৈশিষ্ট্য আবিষ্কার করেছে।
 .
(২৭৬)
‘দ্বিধা’ এমন এক মানবসৃষ্ট প্রপঞ্চ,
সমাজ-শাসনের সুবিধার্ধে সংস্কৃতির মাধ্যমে যা
জনমানসের মধ্যে কৌশলে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে।
 .
(২৭৭)
অযোগ্য বস কখনো প্রতিভাবান সহকর্মী পছন্দ করেন না;
নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবেন।
 .
(২৭৮)
সৃজনশীল ব্যক্তির জন্যে বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের অখ্যাত পদের চেয়ে
অখ্যাত প্রতিষ্ঠানের বিখ্যাত পদ প্রতিভা বিকাশের উপযোগী।
 .
(২৭৯)
‘মাটির মানুষ’ সম্বোধনটি নিশ্চিতভাবেই অবজ্ঞাসূচক।
প্রতিপক্ষের সমীহ দেখানোর চালাকি বুঝেও
মাটির মানুষরা এর প্রতিবাদ করতে পারে না।
 .
(২৮০)
অসভ্যতা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি;
শিক্ষার মুখোশ দিয়ে তা ঢেকে রাখতে হয়।
 .
(২৮১)
যৌনতা ছাড়া মানববিশ্বে দ্বিতীয় কোন সৌন্দর্য্য নেই;
যেখানেই সৌন্দর্য্য, পেছনে যৌনতার সূত্র গ্রথিত।
 .
(২৮২)
সৌন্দর্য্যবোধ হচ্ছে মানুষের আদিম নগ্নতা,
ভোগ্য না-হওয়াতক যার পূর্ণতৃপ্তি আসে না।
 .
(২৮৩)
লেংটা হওয়ার আগ-মুহূর্তে মানুষ
ইজ্জত সম্পর্কিত সচেতনতার শীর্ষে অবস্থান করে।
 .
(২৮৪)
সময় কাটানো আর উপভোগের পার্থক্যটুকুর মাহাত্ম্য উপলব্ধি করে
দুই ধরনের লোক, নষ্ট এবং জ্ঞানীরা।
 .
(২৮৫)
দেবী আর ঈশ্বরকে সন্তুষ্ট করে অনুগ্রহ পেতে বলী হয় পাঁঠারাই;
এতে পাঁঠার কোন প্রাপ্তি নেই, কারণ পাঁঠাদের ঈশ্বর নেই।
পাঁঠারা ঈশ্বর বানাতে পারে না বলেই এরা পাঁঠা; নইলে মানুষই হতো !
 .
(২৮৬)
মানুষ ভয় পাওয়ার চেয়ে ভয়ের কথা বলতেই পছন্দ করে বেশি;
যেভাবে সাহস দেখানোর চাইতে সাহসের বড়াই করে বেশি।
 .
(২৮৭)
জাহির করতে গিয়ে মানুষ ভুলে যায় যে,
জাহির করা হলো অধরা স্বপ্নের চর্বিত চর্বণ;
যা অন্যে টের পায় সহজেই।
 .
(২৮৮)
ভালো সবসময়ই ভালো,
আগে পরে বিশেষণ লাগালে ভালো আর ভালো থাকতে পারে না।
 .
(২৮৯)
মানুষের সর্বোচ্চ সৃজনশীলতা তাঁর কল্পনায়,
যা কখনো বাস্তবায়িত হয় না।
 .
(২৯০)
প্রমাণ করা যায় না বলেই কল্পনার শক্তি প্রবল।
ইচ্ছেখুশি গড়ে নেয়া ঈশ্বর ও পরকাল হচ্ছে সেই সবিশেষ কল্পনা,
যা দিয়ে চতুর মানুষ মূর্খদের উপর আধিপত্য কায়েম করে।
 .
(২৯১)
ধর্ম নিয়ে জন্মায় না কেউ; যার যে কর্ম বা আচরণ, সেটাই তার ধর্ম।
 .
(২৯২)
চিন্তা হলো নদীর মতো, স্রোত হারালে মরে যায়।
 .
(২৯৩)
‘ইগো’ হচ্ছে মানুষের সেই প্রতিদ্বন্দ্বি সত্তা,
যার কাছে নিশ্চিত পরাজয়েও মানুষ অপমান বোধ করে না। 
 .
(২৯৪)
জগতে সঠিক পথ একটাই,
যাকে মানুষ নিজে সঠিক বলে মনে করে।
 .
(২৯৫)
মুদ্রার উভয় পিঠ কখনো এক হয় না;
মানুষের আটপৌরে ও সামাজিক সত্তা এক হয়ে যাওয়াটাও কৃত্রিম।
 .
(২৯৬)
প্রতীক্ষা যতক্ষণ না-ফুরায়, ততক্ষণই আনন্দের;
সান্নিধ্য মানেই বিচ্ছেদের শুরু।
 .
(২৯৭)
প্রতিটা পাওয়ার মধ্যেই একেকটা হারানোর দুঃখের জন্ম।
 .
(২৯৮)
নিজেরাই নির্মাতা বলে আইন হয় শাসকের পক্ষে আর
শাসিতকে মোহাবিষ্ট করতে যে সুন্দর কথামালার সৃষ্টি করা হয়
সেগুলো ভণ্ডামি।
 .
(২৯৯)
‘হও বললেই হয়ে যাওয়ার ক্ষমতাধর ঈশ্বর হচ্ছেন সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান
এবং সৃষ্ট জগত তাঁর ইচ্ছার অধীন।’- এই সারকথাটুকু
মানুষকে বোঝানোর জন্য ঈশ্বরের চেষ্টার অন্ত নেই;
যুগে যুগে কতো প্রতিনিধি পাঠাতে হচ্ছে তাঁকে !
 .
(৩০০)
স্পষ্ট কথা পছন্দ করেন না এমন স্বীকারোক্তি পাওয়া যেমন দুষ্কর,
স্পষ্ট কথা হজম করতে পারেন তেমন ব্যক্তিও বিরল। এরকম পরস্পরবিরোধী দুটো অবস্থা
একইসাথে সত্য ও স্থিত হওয়ার রসায়নেই লুকিয়ে আছে বাঙালির মানসিক জগৎ।
 …

No comments: