Wednesday, December 7, 2011

| জৈনদর্শন:পর্ব-০৮| ত্রিরত্ন-মোক্ষমার্গ ও পঞ্চ-মহাব্রত|

| জৈনদর্শন:পর্ব-০৮| ত্রিরত্ন-মোক্ষমার্গ ও পঞ্চ-মহাব্রত|
-রণদীপম বসু

(আগের পর্বের পর…)

৩.৫ : ত্রিরত্ন মোক্ষমার্গ (Threefold Liberation Path)
.
জৈনমত (Jainism) অনুসারে ক্রোধ, মান, লোভ ও মায়া নামক কুপ্রবৃত্তিকেই বন্ধনের মূলকারণ বলা হয়। আবার এই কুপ্রবৃত্তিগুলির কারণ হলো অজ্ঞান। এ অজ্ঞানের নাশ জ্ঞানের দ্বারাই সম্ভব। তাই জৈনদর্শনে মোক্ষের জন্য সম্যক জ্ঞানকে (right knowledge) আবশ্যক মনে করা হয়। পথপ্রদর্শকদের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস হতেই সম্যগ্জ্ঞান সিদ্ধ হয়। জৈনদর্শনে তীর্থঙ্করদের মোক্ষলাভের পথপ্রদর্শক বলা হয়েছে।


.
কৈবল্যপ্রাপ্ত জীব এই ভূতলে নিবাস করে সমাজের পরম মঙ্গল সাধন করেন। তাঁরা স্বয়ংমুক্ত হয়ে অন্য জীবের মুক্তির পথ প্রদর্শন করেন। তাঁরা কেবলী মুক্ত সিদ্ধ পুরুষ ধর্মের প্রবর্তক হন বলে ‘তীর্থঙ্কর’ নামে প্রসিদ্ধ। সেকারণে সম্যক জ্ঞানলাভের জন্য তীর্থঙ্করের প্রতি শ্রদ্ধা ও আস্থা রাখা আবশ্যক। এটি হলো মোক্ষের দ্বিতীয় সাধন যাকে সম্যক দর্শন (right faith) বলা হয়।
কিন্তু সম্যক জ্ঞান ও সম্যক দর্শন লাভ করলেও জীবের মোক্ষপ্রাপ্তি হয় না। তার জন্য মানুষকে বাসনা, ইন্দ্রিয় ও মনকে সংযত করা অত্যন্ত প্রয়োজন। একে সম্যক চরিত্র (right conduct) বলে।
.
জৈনদর্শনে মোক্ষানুভূতির জন্য সম্যক দর্শন, সম্যক জ্ঞান ও সম্যক চরিত্র এই তিনটি সাধন একত্রে ত্রিরত্ন নামে প্রসিদ্ধ। ‘অর্হম্মুনি’র কৃত প্রবচনসংগ্রহ ‘পরমাগমসার’ নামক গ্রন্থে সম্যক দর্শন, জ্ঞান ও চরিত্রকে মোক্ষের মার্গ বলা হয়েছে। কেবল সম্যক দর্শন বা সম্যক জ্ঞান বা কেবল সম্যক চরিত্র হতেই মোক্ষলাভ সম্ভব নয়। ত্রিরত্ন যুগপৎ অবলম্বন করলেই তারা মোক্ষলাভের উপায় বা সাধন হয়।
.
ভারতীয় দর্শনের অধিকাংশের ক্ষেত্রেই দেখা যায় মোক্ষের জন্য এই তিনটি সাধনের কোন একটিকে আবশ্যক মনে করা হয়েছে। কোন দর্শনে সম্যক জ্ঞানকে, কোন দর্শনে সম্যক দর্শনকে (=শ্রদ্ধাকে), আবার কোন দর্শনে সম্যক চরিত্রকে মোক্ষমার্গরূপে স্বীকার করা হয়েছে। কিন্তু জৈনদর্শনে এই তিনটি একাঙ্গী মার্গকে সমন্বয় করে ত্রিরত্ন মোক্ষমার্গরূপে আবশ্যক করা হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে জৈনদের মোক্ষমার্গকে অদ্বিতীয় বলা হয়।
.
জৈনদর্শনে ত্রিমার্গের মহত্ত্বকে প্রমাণিত করতে সাধারণত রোগগ্রস্ত ব্যক্তির উপমা দেখানো হয়। কোন রুগ্ন ব্যক্তি রোগ হতে মুক্ত হতে চাইলে তাকে চিকিৎসকের প্রতি আস্থা রাখতে হয়, তাকে উপদিষ্ট ঔষধের জ্ঞান রাখা দরকার এবং চিকিৎসকের উপদেশ অনুসারে আচরণ করা দরকার। একইভাবে আধ্যাত্ম সফলতার জন্যেও সম্যক দর্শন (=আস্থা বা শ্রদ্ধা), সম্যক জ্ঞান ও সম্যক চরিত্রের সম্মিলিত প্রয়োগ আবশ্যক বলে মনে করা হয়।
.
সম্যগ্দর্শন :
সত্যের প্রতি শ্রদ্ধাভাবনা পোষণ করা হচ্ছে সম্যগ্দর্শন, জৈনদর্শনের প্রথম রত্ন। জীব প্রভৃতি বিষয় যেরূপে অবস্থিত, অর্হৎগণ সেভাবে তাদের তত্ত্ব নিরূপণ করেছেন বলে তাতে শ্রদ্ধাযুক্ত হয়ে তত্ত্বের বিরুদ্ধ অর্থের প্রতি অভিনিবেদন পরিত্যাগ হচ্ছে সম্যগ্দর্শন। জৈনরা বলেন, কিছু ব্যক্তিতে অন্যের উপদেশের অপেক্ষা না করে জীবের এই স্বরূপ বা স্বভাবটি নিসর্গতঃ (=জন্মগত) থাকে। আবার কোন ব্যক্তিতে তা অভ্যাস ও শিক্ষার দ্বারা অধিগত হয়। তাঁরা বলেন, জৈনকথিত তত্ত্বে রুচি বা প্রীতি হচ্ছে সম্যগ্দর্শন, যা স্বভাব হতে বা গুরুর শিক্ষা বা অধিগম হতে লাভ হয়।
তবে সম্যগ্দর্শনের অর্থ অন্ধবিশ্বাস নয়। কেননা জৈনগণ অন্ধবিশ্বাসের খণ্ডন করেছেন। ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রচলিত অন্ধবিশ্বাস হতে মুক্ত হলে কোন ব্যক্তি সম্যগ্দর্শনের ভাগী হতে পারে বলে জৈনরা মনে করেন। সাধারণ লোকের যে ধারণা, নদীতে স্নান করলে এবং বৃক্ষের চারদিকে পরিক্রমা (=প্রদক্ষিণ) করলে পবিত্র হওয়া যায়, জৈনমতে একে ভ্রান্তিমূলক বলা হয়েছে। অতএব এই মতে সম্যগ্দর্শনের অর্থ বৌদ্ধিক বিশ্বাস (rational faith)।
.
সম্যগ্জ্ঞান :
দ্বিতীয় রত্ন হচ্ছে সম্যগ্জ্ঞান, যার দ্বারা জীব ও অজীবের মূল তত্ত্বের পূর্ণ জ্ঞান হয়। জৈনরা বিশ্বাস করেন, জীব ও অজীবের পার্থক্য না জানার ফলে বন্ধন প্রাদুর্ভূত হয় এবং তার প্রতিরোধের জন্য সম্যগ্জ্ঞানের দরকার। এই জ্ঞান হবে সংশয়রহিত ও দোষহীন। সম্যগ্জ্ঞানের প্রাপ্তিতে কিছু কর্ম প্রতিবন্ধক হয়। অতএব তাদের নাশ করা দরকার। কেননা কর্মের পূর্ণ বিনাশের পরই সম্যগ্জ্ঞান সম্ভব। জীব প্রভৃতি পদার্থ যে স্বরূপে অবস্থিত, সমস্ত মোহ (=মিথ্যাজ্ঞান) ও সংশয় (=অনেককোটিক জ্ঞান) হতে মুক্ত হয়ে তাদের সেরূপ যথাযথভাবে জানা হচ্ছে সম্যগ্জ্ঞান। জৈনমতে তাই বলা হয়েছে যে, সংক্ষেপে বা বিস্তৃতভাবে তত্ত্বগুলি যেরূপ অবস্থিত তাদের যে জ্ঞান তাকে পণ্ডিতগণ সম্যগ্জ্ঞান বলেন।
.
সম্যক্চরিত্র :
জৈনমতে গুরুত্বপূর্ণ তৃতীয় রত্ন হচ্ছে সম্যক্চরিত্র। যে সমস্ত কর্মের জন্য সংসারে বারংবার যাতায়াত করতে হয় সে সকল কর্মের উচ্ছেদে যত্নশীল, শ্রদ্ধাবান ও জ্ঞানবান পুরুষ পাপকর্মের নিবৃত্তির জন্য যেরূপ কর্মের অনুশীলনে রত থাকে তাকে সম্যক্চরিত্র বলে। হিতকর কার্যের আচরণ এবং অহিতকর কার্যের বর্জন হচ্ছে সম্যক্চরিত্র।
মোক্ষের জন্য তীর্থঙ্করদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সত্যজ্ঞানই পর্যাপ্ত নয়, বরং নিজের আচরণে সংযমও অত্যন্ত প্রয়োজন। সম্যক চরিত্র মানুষকে মন, বাক্য ও কর্মকে নিয়ন্ত্রণ করতে নির্দেশ দেয়। জৈনমত অনুসারে সম্যক্চরিত্র পালনের জন্য জীবকে নিজের কর্ম হতে মুক্ত হওয়া দরকার। কর্মের দরুন মানুষকে দুঃখ ও বন্ধনের সম্মুখীন হতে হয়। তাই কর্ম হতে মুক্তি পাওয়ার অর্থ বন্ধন ও দুঃখ থেকে রেহাই পাওয়া। সেকারণে মোক্ষমার্গের সবচেয়ে মহত্ত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে সম্যক্চরিত্র।
.
সম্যক্চরিত্র পালনের জন্য জৈনগণকে কতকগুলি আচরণ চর্চা করা দরকার। সেগুলি হলো-
(ক) গুপ্তি : মন, বাক্য ও শারীরিক কর্মের সংযম আবশ্যক। জৈনমতে একে গুপ্তি বলা হয়। জীবাত্মার অবয়বসমূহে কর্মপুদ্গলের অনুপ্রবেশের কারণীভূত যোগ (=আস্রব) হতে নিজেকে গোপন (=রক্ষা) করা হচ্ছে গুপ্তি। গুপ্তি তিন প্রকার।
(১) কায়গুপ্তি- শরীরের সংযম
(২) বাগগুপ্তি- বাক্যের নিয়ন্ত্রণ
(৩) মনোগুপ্তি- মানসিক সংযম।
এভাবে গুপ্তি শব্দের অর্থ হচ্ছে স্বাভাবিক প্রবৃত্তিকে প্রতিরোধ করা।
.
(খ) সমিতি : সংযমই সমিতি। প্রাণিপীড়া পরিত্যাগ করে সম্যগ্ভাবে জীবনযাপনকে সমিতি হলা হয়। জীবকে বিভিন্ন প্রকার সমিতি পালন করতে হবে। জৈনমতে সমিতি পাঁচ প্রকার-
(১) ঈর্ষাসমিতি- হিংসা পরিহার করার জন্য নিশ্চিত পথে চলা। লোকজন যে পথ দিয়ে চলে এবং যা সূর্যালোকের দ্বারা আলোকিত, সেই পথে জীবজন্তুর রক্ষার জন্য উত্তমরূপে দেখে চলা হচ্ছে ঈর্ষাসমিতি।
(২) ভাষাসমিতি- নম্র ও ভালো কথা বলা। অনিন্দ্য, সত্য, সর্বজনের হিতকর, মৌনব্রতী ব্যক্তিদের প্রিয় মিতকথনকে ভাষাসমিতি বলে।
(৩) এষণাসমিতি- উচিত ভিক্ষা গ্রহণ। বিয়াল্লিশটি ভিক্ষাদোষ হতে সর্বদা অদূষিত অন্নের জৈনমুনিকর্তৃক গ্রহণ হচ্ছে এষণাসমিতি।
(৪) আদানসমিতি- কোন বস্তুকে উঠিয়ে রাখতে সতর্কতা। ধ্যানশীল জৈনমুনি আসন-বস্ত্র-প্রভৃতিকে প্রথমে অবলোকন করে তাকে গ্রহণ করার জন্য সমুল্লঙ্ঘনের প্রয়োজনে সযত্নে প্রাণিপীড়ন পরিহার করে গ্রহণ করবেন এবং গ্রহণ করে স্থাপন করবেন। এরূপ গ্রহণকে আদানসমিতি বলে।
(৫) উৎসর্গসমিতি- শূন্য স্থানে মলমূত্র ত্যাগ করা। কফ, মল, মূত্র প্রভৃতি ত্যাজ্য পদার্থ জন্তুরহিত স্থানে সযত্নে পরিত্যাগ করা হচ্ছে উৎসর্গসমিতি।
এই পাঁচটি সমিতি হচ্ছে জৈনমুনির প্রাণিপীড়া পরিহারের উপায়।
.
(গ) ধর্ম পালন : দশ প্রকার ধর্মের পালন জৈনমতানুসারে অত্যাবশ্যক মানা হয়।
এই দশ প্রকার ধর্ম হচ্ছে- (১) সত্য (truthfulness), (২) ক্ষমা (forgiveness), (৩) শৌচ (purity), (৪) তপ (austerity), (৫) সংযম (selfrestraint), (৬) ত্যাগ (sacrifice), (৭) বিরক্তি (non-attachment), (৮) মার্দব (humility), (৯) সরলতা (simplicity) ও (১০) ব্রহ্মচর্য (celibacy)।
.
(ঘ) অনুপ্রেক্ষা : জীব ও অজীবের স্বরূপ বিচার করা প্রয়োজন। চিন্তনের জন্য জৈনগণ বারোটি ভাবের উল্লেখ করেন, তাদেরকে ‘অনুপ্রক্ষা’ বলা হয়।
.
(ঙ) পরীষহ : ঠাণ্ডা, গরম, ক্ষুধা, পিপাসা ইত্যাদি দ্বারা প্রাপ্ত দুঃখকে সহ্য করার যোগ্যতা প্রয়োজন। এই প্রকার তপকে ‘পরীষহ’ বলা হয়।
.
(চ) পঞ্চ মহাব্রত : পঞ্চ মহাব্রত পালন করাকে জৈনগণ অত্যাবশ্যক মনে করেন। এগুলো হলো- অহিংসা, সুনৃতব্রত, অস্তেয়ব্রত, ব্রহ্মচর্যব্রত ও অপরিগ্রহব্রত। কোন কোন জৈনগণ পঞ্চ মহাব্রত পালনকেই সম্যক্চরিত্রের জন্য পর্যাপ্ত মনে করেন। এই পঞ্চ মহাব্রতকেই বৌদ্ধধর্মে ‘পঞ্চশীল’ নামে পালন করা হয়।
.
৩.৫.১ : পঞ্চ মহাব্রত (five great vows)
জৈনমতে মোক্ষলাভের উপায় হিসেবে ত্রিরত্নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাধন সম্যক-চরিত্র অর্জনের জন্য পঞ্চ-মহাব্রত পালন অত্যাবশ্যক। এই পঞ্চ মহাব্রত হচ্ছে- অহিংসা, সুনৃতব্রত, অস্তেয়ব্রত, ব্রহ্মচর্যব্রত ও অপরিগ্রহব্রত।
.
(১) অহিংসা : অহিংসা মানে হিংসার পরিত্যাগ। জৈনমত অনুসারে প্রত্যেক দ্রব্যে জীবের নিবাস। তার নিবাস গতিশীলের অতিরিক্ত পৃথিবী, বায়ু, জল ইত্যাদি স্থাবর দ্রব্যেও স্বীকার করা হয়। তাই অহিংসা বলতে বুঝায় সকল প্রকার জীবের প্রতি হিংসা পরিত্যাগ করা। অর্থাৎ যেরূপ কর্মের দ্বারা চর ও অচর জীবিত পদার্থের অনিষ্ট বা জীবনহানি ঘটে তা হতে বিরত থাকা হচ্ছে অহিংসাব্রত। সন্ন্যাসী এই ব্রতের পালন অধিক তৎপরতার সাথে করে থাকে। কিন্তু সাধারণ মানুষের জন্য জৈনগণ দুই ইন্দ্রিয়যুক্ত জীবপর্যন্ত হত্যা না করার নির্দেশ করেছেন।
তবে এখানে অহিংসা নিষেধাত্মক আচরণ নয়। বরং একে ভাবাত্মক আচরণ বলা যায়। কেননা অহিংসা বলতে জীবের প্রতি কেবল হিংসা ত্যাগ করাকে বুঝায় না, পাশাপাশি জীবের প্রতি প্রেম করাকেও বুঝায়। অহিংসার পালন মন, বাক্য ও কর্মের দ্বারা করতে হয়। হিংসাত্মক কর্মের সম্বন্ধে চিন্তা করা এবং অন্যকে হিংসামূলক কার্যে প্রোৎসাহিত করা হচ্ছে অহিংসাব্রতকে উল্লঙ্ঘন করা। এ সিদ্ধান্তের দ্বারা মূলত জৈনগণ বুঝাতে চেয়েছেন, সকল জীবই সমান, তাই কোন জীবকে হিংসা করা অধর্ম।
.
(২) সুনৃতব্রত : সৃনৃত অর্থ অসত্যের পরিত্যাগ। শ্রবণকালে সুখকর এবং পরিণামে হিতকর বাক্যের প্রয়োগ হচ্ছে সুনৃতব্রত। যদি কোন বাক্য প্রয়োগ সদ্য-সুখকর অথচ পরিণামে হিতকর না হয় তবে তা সত্য হলেও সুনৃতব্রত বলে বিবেচিত হয় না। সুতরাং কোন ব্যক্তি কেবল মিথ্যা বাক্যেরই পরিত্যাগ করবে না, অধিকন্তু সে মধুর বাক্যও প্রয়োগ করবে। জৈনগণ মন, বাক্য ও কর্মের দ্বারা সুনৃতব্রত পালন করতে নির্দেশ করেছেন।
.
(৩) অস্তেয়ব্রত : এর অর্থ অন্যের সম্পদ চুরি না করা। পরের দ্রব্যাদি বস্তু দান, ক্রয় প্রভৃতির মাধ্যমে অন্যের কাছ থেকে পাওয়া গেলে গ্রহণ করা যায়, কিন্তু অন্যভাবে গ্রহণ করা হলে তা অপহরণ বা চুরি হিসেবে বিবেচিত হয়। এই অন্যভাবে গ্রহণ না করাই হচ্ছে অস্তেয়ব্রত।
জৈনমত অনুসারে জীবনের অস্তিত্ব দ্রব্য, ধনাদির উপর নির্ভর করে। প্রায়শ দেখা যায়, ধনাদি দ্রব্যের ব্যতিরেকে মানুষ জীবনকে সুচারুভাবে নির্বাহ করতে পারে না। তাই জৈনগণ ধনাদিকে মানুষের বাহ্য জীবন বলেছেন। কোন ব্যক্তির ধনাদি অপহরণ হচ্ছে তার জীবন অপহরণের সমান। অতএব চৌর্যের নিষেধকে নৈতিক অনুশাসন বলা হয়।
.
(৪) ব্রহ্মচর্যব্রত : ব্রহ্মচর্যের অর্থ হলো বাসনাত্যাগ। বিষয়ভোগের ত্যাগই হচ্ছে ‘ব্রহ্ম’ শব্দের অর্থ। তাই বিষয়ভোগ ত্যাগের মাধ্যমে বাসনারহিত অবস্থানকে ব্রহ্মচর্যব্রত বলা হয়েছে। ব্রহ্মচর্যের অর্থ সাধারণত ইন্দ্রিয়ের উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা বুঝায়। কিন্তু জৈনরা ব্রহ্মচর্যের অর্থ হিসেবে সকল প্রকার কামনার পরিত্যাগ করাকে বুঝিয়েছেন।
দিব্য (=পারলৌকিক) ও ঐহিক ভেদে বিষয়ভোগ দুই প্রকার। এই দ্বিবিধ বিষয়ভোগের প্রতিটি আবার স্বয়ংকৃত, সম্মতি প্রদানের দ্বারা অনুমত (পরকৃত) এবং কেবল অনুমোদিত ভেদে তিন প্রকার হলে এ পর্যায়ে মোট বিষয়ভোগ হয় ছয় প্রকার। এই ছয় প্রকার বিষয়ভোগের প্রতিটি আবার মন, বাক্য ও শরীর এই তিনটি কারণভেদে তিন প্রকার করে হলে মোট আঠারো প্রকার বিষয়ভোগ সিদ্ধ হয়। ফলে এই আঠারো প্রকার বিষয়ভোগের পরিত্যাগও আঠারো প্রকার হয়।
মানুষ নিজের বাসনা ও কামনার বশীভূত হয়ে পূর্ণত অনৈতিক কর্মকে প্রশ্রয় দেয়। কিন্তু মানসিক বা বাহ্য, লৌকিক বা পারলৌকিক, স্বার্থ বা পরার্থ সকল কামনার সর্বতো পরিত্যাগ করা ব্রহ্মচর্যের জন্য অতীব আবশ্যক। ব্রহ্মচর্যের পালনে জৈনগণ মন, বাক্য ও কর্মের দ্বারা অনুষ্ঠানের নির্দেশ করেছেন।
.
(৫) অপরিগ্রহব্রত : অপরিগ্রহ মানে বিষয়াসক্তির ত্যাগ। চেতন, অবচেতন, বাহ্য, আভ্যন্তর সমস্ত দ্রব্যে আসক্তি পরিত্যাগকে অপরিগ্রহব্রত বলা হয়েছে। কেননা না থাকলেও মনোরাজ্যে কেবল বস্তুতে আসক্তি চিত্তকে অস্থির করে তোলে। অতএব বন্ধনের কারণ সাংসারিক বস্তুতে নির্লিপ্ত থাকাকে আবশ্যক মনে করা হয়। সাংসারিক বিষয়ের অভ্যন্তরে রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ ও শব্দ রয়েছে। সেকারণে অপরিগ্রহ শব্দের অর্থ রূপ রসাদির গ্রাহক ইন্দ্রিয়ের বিষয়পরিত্যাগকে বুঝানো হয়েছে।

(চলবে…)
(ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

[পর্ব-০৭: জৈনমতে বন্ধন ও মোক্ষ] [*] [পর্ব-০৯: জৈনমতে অনীশ্বরবাদ ও কর্মবিচার]