Wednesday, December 7, 2011

| জৈনদর্শন: পর্ব-০৯ | জৈনমতে অনীশ্বরবাদ ও কর্মবিচার |

| জৈনদর্শন: পর্ব-০৯ | জৈনমতে অনীশ্বরবাদ ও কর্মবিচার |
-রণদীপম বসু

(আগের পর্বের পর…)

৩.৬ : জৈনমতে অনীশ্বরবাদ (Atheism in Jainism)
.
চার্বাক এবং বৌদ্ধদর্শনের মতো জৈনধর্মেও ঈশ্বরকে মানা হয়নি। এর যুক্তিসমূহও প্রায় এক রকম। বৈশেষিকরা লোক সৃষ্টির জন্য অ-দৃষ্টকে ঈশ্বরের স্থলাভিষিক্ত করেছেন, এবং জৈনরা সেই স্থান দিয়েছেন ধর্ম ও অধর্মকে।
কোন বস্তুকে করতে, না করতে বা অন্যথা করতে যে সমর্থ তাকে ঈশ্বর বলা হয়- ব্রাহ্মণ্যধর্মে এরূপ স্বতন্ত্র ও সর্বশক্তিমান ঈশ্বর স্বীকৃত। কিন্তু জৈনদর্শনে এ ধরনের ঈশ্বর স্বীকার করা হয় নি। ঈশ্বরবাদীদের আরেকটি যুক্তি হলো, ঈশ্বরের জ্ঞান প্রত্যক্ষ প্রমাণ দ্বারা সিদ্ধ না হলেও যুক্তি দ্বারা সম্ভব। ঈশ্বরের অস্তিত্ববিষয়ক এরকম যুক্তিকে জৈনরা দোষ দেখিয়ে খণ্ডন করেছেন। তাঁরা অনাদিসিদ্ধ পরমাত্মার সত্তাকে কোনভাবে স্বীকার করেন না।


.
নৈয়ায়িকরা ঈশ্বরের সিদ্ধির জন্য যুক্তি দেখান যে, প্রত্যেক কার্যের জন্য একজন কর্তা আবশ্যক, যেমন গৃহ একটি কার্য যা কোন কর্তা তৈরি করে। সেইরূপ এই বিশ্ব একটি কার্য, তার জন্য কোন কর্তা (=স্রষ্টা) অবশ্যই স্বীকার করতে হয়। এই কর্তা বা স্রষ্টা হচ্ছে ঈশ্বর।
জৈনরা এই যুক্তিকে দোষপূর্ণ মনে করেন। নৈয়ায়িক মতানুসারে এই সংসার এক কার্য বলে মানা হয়েছে। কিন্তু কেন, তার কোন সন্তোষজনক উত্তর নেই। জৈনরা নিরন্বয় বিনাশ স্বীকার করেন না। তাঁরা মীমাংসকের মতো সান্বয় বিনাশে বিশ্বাসী। তাই গৃহাদি কার্যের মতো এই বিশ্বের নিরন্বয় ধ্বংস স্বীকার না করায় বিশ্বের স্রষ্টারূপে ঈশ্বরের সত্তা স্বীকার্য নয়।
.
তর্কশাস্ত্রের নিয়মে নৈয়ায়িকের যুক্তি : পৃথিবী প্রভৃতি কার্যপরম্পরা অনাদি, তার কর্তৃরূপে অনাদি সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়। তর্কশাস্ত্রের সূত্রানুযায়ী এবিষয়ে অনুমান হচ্ছে এরকম-
প্রতিজ্ঞা : পৃথিবী প্রভৃতি সকর্তৃক।
হেতু : কেননা এগুলি কার্য বা জন্য বস্তু।
উদাহরণ : যেমন ঘটাদি কার্যদ্রব্য।
এই অনুমানে নৈয়ায়িকরা পৃথিবী প্রভৃতির কার্যত্ব সাধ্যটি সাবয়বত্ব হেতুর দ্বারা সিদ্ধ করেন। যা সাবয়ব (=অবয়বযুক্ত) তা হচ্ছে কার্য বা উৎপাদ্য। পৃথিবী প্রভৃতি দ্রব্য সাবয়ব, সুতরাং এগুলি হচ্ছে কার্য।
কিন্তু বিশ্বসংসার সাবয়ব হওয়ায় কার্য, এই বিচার জৈনদের মতে ভিত্তিহীন। কেননা নৈয়ায়িক স্বয়ং সাবয়ব আকাশকে কার্য বলে স্বীকার করেন না, নিত্য বলেন। ন্যায়মতে আকাশে অবয়ব বা অংশ কল্পনা ভ্রমমাত্র বলা হলেও সাধ্যাভাববদবৃত্তিত্ব ব্যভিচার দোষ দূর করা যায় না। আকাশে কার্য নেই, অথচ তার হেতু সাবয়বত্ব আছে।
তাছাড়া, আমরা দেখি যে, নির্মাতা বিনা-শরীরে কার্য করে না। যেমন কুম্ভকার বিনা-শরীরে ঘট বানাতে পারে না। সেরূপ ন্যায়মতে ঈশ্বরকে অবয়বহীন স্বীকার করা হয় বলে সেই ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করতে পারে না।
.
যদি ঈশ্বরকে জগতের স্রষ্টা বলা হয় তবে প্রশ্ন, কিসের প্রয়োজনে ঈশ্বর বিশ্বের নির্মাণ করে ? সাধারণত চেতন প্রাণী যা কিছু করে তা নিজের প্রয়োজনে বা অন্যের প্রতি করুণা প্রেরিত হয়ে করে থাকে। অতএব ঈশ্বরকে স্বার্থ বা করুণা প্রেরিত হতে হবে। কিন্তু ঈশ্বর পূর্ণ বলে স্বার্থপ্রেরিত হয়ে কোন কাজ করতে পারে না, কেননা ঈশ্বরের নিজের কোন প্রয়োজন থাকতে পারে না। তার কোন ইচ্ছা অতৃপ্ত নয়, অন্যের প্রতি করুণার বশবর্তী হয়ে ঈশ্বর জগতের নির্মাণ করে, একথাও বলা সঙ্গত নয়। কারণ, সৃষ্টির পূর্বে করুণার উদয় হতে পারে না। করুণার অর্থ হচ্ছে অন্যের দুঃখ দূর করার ইচ্ছা। সৃষ্টির পূর্বে দ্রব্য জীবের অভাবে তন্নিষ্ঠ বা তাতে অবস্থিত গুণের কল্পনা করা সঙ্গত নয়।
এভাবে নানা যুক্তিতে জৈনদর্শন ঈশ্বরের অস্তিত্বকে খণ্ডন করেছে।
.
ঈশ্বরের অস্তিত্বের মতো জৈনদর্শনে তার গুণেরও খণ্ডন করা হয়েছে। ন্যায়দর্শনে ঈশ্বরকে এক, সর্বশক্তিমান, নিত্য ও পূর্ণ বলা হয়েছে। এর মধ্যে সমস্ত বস্তুর মূলকারণ বলে ঈশ্বরকে যে সর্বশক্তিমান বলা হয় তা ভ্রান্তিমূলক। কেননা বিশ্বে এমন অনেক পদার্থ আছে তার নির্মাতা ঈশ্বর নয়। যেমন ঈশ্বরকে আকাশাদি নিত্য পদার্থের নির্মাতারূপে নৈয়ায়িকগণ স্বীকার করেন না। অনেক ঈশ্বর স্বীকারে তাদের উদ্দেশ্যের বিরোধের দরুন বিশ্বে সামঞ্জস্যের অভাব হবে বলে ন্যায়াদিমতে এক ঈশ্বর স্বীকার করা হয়। কিন্তু এই বিচার সমীচীন নয়। কেননা কিছু বা অনেক শিল্পীগণ মিলিতভাবে একটি রাজমহল তৈরি করে থাকে। সেরূপ একাধিক ঈশ্বরের সহযোগে এক বিশ্বের নির্মাণ কেন সম্ভব নয় ?
.
জৈনরা  সৃষ্টিস্থিতিপ্রলয়ের কর্তা বা কর্মফলের দাতারূপে ঈশ্বর মানেন না। তাঁদের মতে কর্ম স্বয়ংই ফলদানে সমর্থ। এই অংশে জৈনমত পূর্বমীমাংসার অনেকটা অনুরূপ। তাঁরা বলেন, সৃষ্টিপ্রবাহ অনাদি কাল হতে চলে আসছে। সৃষ্টিস্থিতিসংহারাদির কর্তৃরূপে ঈশ্বর স্বীকার করলে ঈশ্বরের সাবয়বত্ব, সাদিত্ব, বিনাশিত্ব ইত্যাদি বহু দোষ দৃষ্ট হয়। সুতরাং সেরূপ ঈশ্বর স্বীকার করা সমীচীন নয়।
এভাবে জৈনরা ঈশ্বরের নিষেধ করে অনীশ্বরবাদ উপপাদন করেছেন।
.

৩.৭ : জৈনধর্মে ঈশ্বর ও তীর্থঙ্কর
.
যেহেতু জৈনদর্শনে নিরীশ্বরবাদকে প্রতিপাদন করা হয়েছে, তাই প্রশ্ন আসে ঈশ্বর বিনা জৈনধর্মকে আদৌ ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করা যায় কিনা ? প্রচলিত ধারণায় ধর্ম মানেই যেখানে আধ্যাত্মবাদের সক্রিয় উপস্থিতি এবং কোন না কোনভাবে সেখানে ঈশ্বর বা তার সদৃশ কোন শক্তিমান সত্তার অস্তিত্ব স্বীকারের বিষয় জড়িত থাকে। উদয়নাচার্য ভারতীয় বিভিন্ন ধর্ম ও দর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে ঈশ্বরের কিছু স্বরূপ উল্লেখ করেছেন।
.
(১) বেদান্তীরা সকল প্রকার দ্বৈতরহিত স্বপ্রকাশ জ্ঞানস্বরূপ পরব্রহ্মরূপে, (২) সাংখ্যরা ‘আদি বিদ্বান’ অর্থাৎ স্বাভাবিক চৈতন্যযুক্ত, কূটস্থ, নিত্য, বিশেষ প্রকারের পুরুষরূপে, (৩) পাতঞ্জলরা অবিদ্যাদি পাঁচ প্রকার ক্লেশ, ধর্ম-অধর্মের সাধক রাগহিংসাদি কর্ম এবং জাতি, আয়ু, ভোগ এই তিন প্রকার বিপাক, ধর্ম-অধর্মরূপ আশয় এই সকল সম্বন্ধ হতে সর্বথা রহিত, বেদাদি নির্মাণের জন্য বিশেষ শরীর ধারণ করে বেদের প্রবর্তক, সৃষ্টির প্রারম্ভে কুলালাদির দেহ ধারণ করে ঘটাদি নির্মাণের শিক্ষা দিয়ে জীবের প্রতি অনুগ্রহকারী পুরুষ বিশেষরূপে, (৪) শৈবরা ত্রিগুণাতীত পুরুষরূপে, (৫) বৈষ্ণবরা পুরুষোত্তম (=সকল পুরুষের মধ্যে উৎকৃষ্ট পুরুষ) রূপে, (৬) পৌরাণিকরা পিতামত অর্থাৎ সংসারের উৎপাদক বিশিষ্ট পুরুষরূপে, (৭) যাজ্ঞিকরা যজ্ঞপুরুষ অর্থাৎ যার উদ্দেশ্যে যাগে অগ্নিতে আহুতি প্রদত্ত হয় সেই পুরুষরূপে, (৮) বৌদ্ধরা ক্ষণিক ও সর্বজ্ঞ পুরুষরূপে, (৯) দিগম্বর জৈনরা আবরণরহিত বিশেষ প্রকারের পুরুষরূপে, (১০) মীমাংসকরা বেদের দ্বারা স্তুত পুরুষ বা বেদে উপাস্যরূপ নির্দিষ্টমাত্র রূপে, (১১) নৈয়ায়িকরা বিশেষ যুক্তির দ্বারা উপপন্ন বিশেষগুণ (=নিত্যজ্ঞান, ইচ্ছা, যত্ন) যুক্ত পুরুষরূপে, (১২) চার্বাকরা সর্বসাধারণের মধ্যে প্রসিদ্ধ সর্বমান্য পুরুষরূপে ঈশ্বরসদৃশ সত্তার স্বীকার করেন।
.
এ ধরনের ঈশ্বর কল্পনার পেছনে রয়েছে মানুষের অপূর্ণতা ও সসীমতা। সংসারের সংঘর্ষে বিধ্বস্ত মানুষ এক পরম নির্ভরতার ভাবনায় ধর্মের মধ্য দিয়ে ঈশ্বর বা তার সমতুল্য সত্তার অন্বেষণ করে। ঈশ্বরের বিচার বা কল্পনা ছাড়া ধার্মিকতা সম্ভব নয়। ঈশ্বরই হচ্ছে সেই ধর্মের কেন্দ্রবিন্দু। সেখানে উপাসক মানব উপাস্য ঈশ্বরের করুণার পাত্র। তাই উপাস্য ও উপাসকের মধ্যকার ভেদই ধার্মিক চেতনার বিকাশ ঘটায়। ফলে উপাস্য কখনো উপাসক হয় না বা উপাসক উপাস্য হতে পারে না। সেখানে উপাসকের প্রতি উপাস্যের মা, প্রেম, করুণাধারা বহামান থাকে এবং উপাস্যের প্রতি সমাবিষ্ট থাকে উপাসকের নির্ভরতা, শ্রদ্ধা, ভয়, আত্মসমর্পণের ভাবনা।
.
এই দৃষ্টিতে জৈনধর্মের বিশ্লেষণ করলে তাকে ধর্ম হিসেবে খুব সফলই বলা যায়। কেননা সৈদ্ধান্তিকরূপে জৈনদর্শন বা ধর্মে ঈশ্বরের সত্তাকে খণ্ডন করা হলেও ব্যবহারিকভাবে জৈনরা কিন্তু ভিন্নরূপে ঈশ্বরের বিচার করেন। জৈনধর্মে তীথঙ্করকে ঈশ্বরের স্থানে স্বীকার করা হয়। ফলে অন্যান্য ধর্মমতসম্মতভাবে এক, সর্বজ্ঞ, নিত্য সর্বশক্তিমান পরমাত্মার কল্পনা করা না হলেও জৈনদর্শনে তীর্থঙ্করকে ঈশ্বরের স্থানে কল্পনা করার প্রেক্ষিতে মূলত এক নয়, বহু ঈশ্বর স্বীকৃত হয়েছে।
.
জৈনমতে বলা হয়, অনাদি কাল হতে জীব কর্মবন্ধনে আবদ্ধ। আস্রবের সংযোগের ফলে কর্মপুদ্গলের সাথে জীবের (=আত্মার) তিরোহিত স্বরূপ হচ্ছে বন্ধন। জ্ঞানাবরণীয়, অন্তরায়, বেদনীয় ও মোহনীয় এই চার প্রকার ঘাতী কর্মকে নাশ করে জীব সর্বজ্ঞ বা সিদ্ধ হয়। মৌলিকভাবে প্রত্যেক জীবে অনন্ত জ্ঞান, দর্শন, বীর্য ও সুখ এই অনন্তচতুষ্টয় স্বতঃসম্পন্ন হলেও কর্মের কারণে উক্ত গুণগুলি অন্তর্হিত থাকে। যখন সেসব ঘাতী কর্মগুলির বিনাশ করা হয় তখন জীব অনন্তচতুষ্টয়সম্পন্ন হয়। এরূপ বিশুদ্ধ জীবকে ‘অর্হন্ত’ বা ‘অরিহন্ত’ বলা হয়। কর্মরূপী শত্রুকে জয় করার ফলে তাকে ‘জিন’ বলা হয়। বিশ্বের সমস্ত বিষয়ের অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যতকে, সূক্ষ্ম স্থূল ও ব্যবহিতকে জানতে পারায় ‘সর্বজ্ঞ’ বলে অভিহিত হয়। এরূপ জীবের জ্ঞান ও দর্শন জীব হতে অতিরিক্ত অন্য কিছুর অপেক্ষা রাখে না বলে তাকে ‘কেবলী’ বলা হয়।
.
অন্য ধর্মে ঈশ্বরের যে মোহনীয় গৌরবময় পদ, জৈনধর্মে সেই পদ হচ্ছে তীথঙ্করের। সাধারণ কেবলী নিজের মুক্তিতেই তৃপ্ত থাকে। কিন্তু তীর্থঙ্কর কেবলী নিজের মুক্তি লাভে ও সংসারী সমস্ত জীবকে মুক্তির জন্য পথের উপদেশ দেন। তাই জৈনধর্মে উপদেশক মহাপুরুষ ‘তীর্থঙ্কর’ নামে উদ্ধৃত হয়েছে। তারা জীবনমুক্ত নামেও প্রসিদ্ধ। সিদ্ধ পদটি অর্হৎ বা অরিহন্ত পদের চেয়ে বড়। অরিহন্ত সর্বথা সকল কিছু থেকে মুক্ত নয়, কিন্তু সিদ্ধ জীব কর্মবন্ধ হতে সর্বথা মুক্ত। জৈনমতে তীর্থঙ্কর ঈশ্বরস্থানীয় হলেও রাগদ্বেষাদি বিনির্মুক্ত হওয়াতে সর্বদাই প্রপঞ্চপথাতীত। বীতরাগ চিত্তের চিন্তায় মানুষের কল্যাণ হয়, এ কারণে তাদের পূজার্চনাদি সম্মত।
.
জৈনধর্মে মূর্তিপূজার বিধান প্রাচীনকাল থেকেই প্রচলিত। এই ধর্মে পাঞ্চপদ প্রতিষ্ঠিত। ব্রাহ্মণ্যধর্মে রাম, কৃষ্ণ প্রভৃতি অবতার বা বৌদ্ধধর্মে গৌতম বুদ্ধের যেরূপ সমাদর, জৈনধর্মে তীর্থঙ্কর ও তাদের পদগুলি সেরকম সাদরে পূজিত হয়ে আসছে। অর্হৎ, সিদ্ধ, আচার্য, উপাধ্যায় ও সাধু এই পাঞ্চকে জৈনধর্মে পঞ্চ পরমেষ্ঠী বলা হয়। এই পাঁচ প্রকার তীর্থঙ্কর জৈনদের বন্দনা, পূজা ও অর্চনার পাত্র বলে বিবেচিত হয়। জৈনরা এই সকল তীর্থঙ্করদের মূর্তি তৈরি করে পূজাদি করেন। তবে এই পঞ্চ পরমেষ্ঠীর স্বরূপে পর্যাপ্ত পার্থক্য স্বীকার করা হয়। যেমন, জীবন্মুক্তকে ‘অর্হৎ’ বলা হয়। শরীর হতে রহিত (=বিদেহ) মুক্ত হচ্ছে ‘সিদ্ধ’। যে সাধু (মুনি) সাধুসঙ্ঘের প্রধান হয়ে স্বয়ং আচার পালন করে সঙ্ঘের অন্য অর্হম্মুনিদের দিয়ে তা পালন করায় তাকে বলা হয় ‘আচার্য’, এবং যে মুনি শাস্ত্রের স্বয়ং অভ্যাস করে অন্যান্যকে অভ্যাস করায় ও ধর্মের উপদেশ দেয় তাকে বলা হয় ‘উপাধ্যায়’। শান্ত, নিঃস্পৃহ, জিতেন্দ্রিয়, অপরিগ্রহী ব্যক্তিকে ‘সাধু’ বলা হয়।
.
জৈনমন্দিরে এই বন্দনীয় পঞ্চ পরমেষ্ঠীর মধ্যে অর্হম্মুনি বা তীর্থঙ্করের বিশেষ প্রতিমা স্থাপিত করে পূজার্চনাদি করা হয়। তাদের পূজার সাথে বৈদিক দেবতার পূজাবিধির সাদৃশ্য রয়েছে। এই পূজনের ফল হলো মোক্ষপ্রাপ্তি। দ্রব্যপূজা ও ভাবপূজা উভয় প্রকার পূজা প্রথমে বাহ্য পদার্থের দ্বারা ও পরে মানসিক ধ্যানাদির দ্বারা সম্পন্ন হয়। তারা ঈশ্বর না হলেও ঈশ্বরভাবনায় পূজিত হওয়ায় এর মধ্যে ঈশ্বরত্ব নিহিত রয়েছে। জীবকে উপাসক এবং ধ্যান, পূজা, প্রার্থনা, শ্রদ্ধাভক্তিকে উপাসনার তত্ত্বরূপে স্বীকার করা হয়েছে। জৈনরা বিশ্বাস করেন, তীর্থঙ্করের নির্দিষ্ট পথে চলে প্রত্যেক ব্যক্তি মোক্ষলাভ করতে পারে। পঞ্চ মহাব্রত, ত্রিরত্ন পালন প্রভৃতি হলো তীর্থঙ্করের উপদেশ। তীর্থঙ্করকে ঈশ্বর হিসেবে কল্পনা করে জৈনধর্ম অন্য ধর্মের মতোই কোন-না-কোনভাবে শেষপর্যন্ত ঈশ্বরেই নির্ভর করে।
.
৩.৮ : জৈনমতে কর্মবিচার
.
জৈনদর্শনে পুদ্গল, আস্রব ও কর্ম এই তিনটি হচ্ছে বন্ধনের হেতু। বন্ধনের অর্থ নিরন্তর জন্ম গ্রহণ করা অর্থাৎ জীবের দেহান্তরে গমনাগমন করা এবং ফলানুযায়ী সংসারের দুঃখকে সহ্য করা। তা থেকে মুক্তিলাভের লক্ষ্যেই জৈনধর্মে মোক্ষমার্গের সৃষ্টি। জৈনদের ‘তত্ত্বার্থসূত্রে’ (১০/২) বলা হয়েছে, কর্মের কারণেই জীব বন্ধন প্রাপ্ত হয়। সমগ্র কর্মের নাশ হলে তাকে মোক্ষ বলে।
.
জৈনরা কর্মকে একটি মূর্ত পদার্থ বলে স্বীকার করেন যা জীবের সাথে যুক্ত হয়ে বন্ধনের সৃষ্টি করে। রাগ-দ্বেষ ইত্যাদির পাশে আবদ্ধ জীব নানা প্রকার কর্ম করে। ফলতঃ সংসারী জীবের ভাব থেকে কর্মবন্ধ উৎপন্ন হয় এবং এই কর্মবন্ধ হতে রাগদ্বেষভাব উৎপন্ন হয়। এই চক্র অনাদি হলেও কখনো অনন্ত ও কখনো সান্ত (=অন্তবিশিষ্ট) হয়ে থাকে। অভব্য (=এই চক্রের অন্ত সম্পাদনে অসমর্থ) জীবের কাছে এই কর্ম অনাদি ও অনন্ত, এবং ভব্য (=এই চক্রের অন্ত করতে সমর্থ) জীবের কাছে তা অনাদি ও সান্ত। ফলে দেখা যাচ্ছে উভয়ের কাছেই কর্ম হচ্ছে অনাদি, শুধু অন্তের দিক দিয়ে তা দুই প্রকার। অর্থাৎ জীব (=আত্মা) পূর্বকর্মের ফল অনুসারেই দেহ ধারণ করে থাকে এবং জৈন অর্হম্মুনিদের প্রদর্শিত পথে কঠোর  সাধনার মাধ্যমে এই কর্মের নাশ করে জীবের জন্মচক্র রুদ্ধ হয়ে অনন্ত মুক্তি লাভ করতে পারে। এ থেকেই স্পষ্ট যে, জৈনরা কর্মফলে বিশ্বাসী।
.
কিন্তু কর্মের ফল কিভাবে উৎপন্ন হয় ? এক্ষেত্রে বেদানুসারী দর্শন থেকে জৈনদর্শন সর্বাবস্থায় ভিন্নমত পোষণ করে। ঈশ্বরবাদী বেদান্ত প্রভৃতি দর্শনে স্বীকার করা হয় যে, জীব কর্ম অনুষ্ঠানে স্বতন্ত্র হলেও ফলপ্রাপ্তিতে পরতন্ত্র, অর্থাৎ ফলপ্রাপ্তি জীবের ইচ্ছার আয়ত্বে নেই। কিন্তু ঈশ্বরের সত্তায় অস্বীকারকারী জৈনদর্শন তা স্বীকার করে না। তাদের মতে কর্ম স্বয়ং ফল প্রদান করে এবং ফলপ্রাপ্তির জন্য কোন ন্যায়াধীশ ঈশ্বরের প্রয়োজন হয় না।
.
জৈনদর্শনে প্রধানত আট প্রকার কর্ম স্বীকার করা হয়েছে। প্রত্যেক কর্মের নামকরণ তার ফলের অনুরূপ হয়। যে কর্ম জ্ঞানের বাধক হয় তাকে জ্ঞানাবরণীয় কর্ম বলে। যে কর্ম জীবের স্বাভাবিক শক্তিকে রুদ্ধ করে তাকে অন্তরায় কর্ম বলে। যে কর্ম সুখ ও দুঃখের বেদনাকে উৎপন্ন করে তা হচ্ছে বেদনীয় কর্ম। দর্শনে ও চরিত্রে মোহ উৎপন্নকারী কর্মকে মোহনীয় কর্ম বলা হয়। কৈবল্য বা মোক্ষের প্রতিবন্ধক হচ্ছে এই চার প্রকার কর্ম। এদের মধ্যে মোহনীয় কর্ম হচ্ছে প্রবল এবং তা নষ্ট হলে পর অন্যান্য কর্মের নাশ সম্ভব হয়।
এ ছাড়া অন্য চারপ্রকার কর্ম হলো, যে কর্মের দ্বারা মানুষের আয়ু নির্ধারিত হয় তাকে ‘আয়ুকর্ম’ বলে, যে কর্ম উচ্চ বা নীচ পরিবারে জন্মের নির্ধারক হয় তাকে ‘গোত্রকর্ম’ বলে, যে কর্ম বিশ্বাসের নাশ করে তাকে ‘দর্শনাবরণীয় কর্ম’ (জৈনগণ বিশ্বাস বা শ্রদ্ধার্থে ‘দর্শন’ শব্দের প্রয়োগ করেছেন) বলে এবং যে কর্ম দ্বারা বিভিন্ন অবস্থার বিভিন্ন নামকরণ হয় তাকে ‘নামকর্ম’ বলে।
.
তাছাড়া বলা হয়, জীব নিজ কর্ম অনুসারেই পুদ্গলকণাকে আকৃষ্ট করে। এই আকৃষ্ট পুদ্গলকণাকে কর্মপুদ্গল বলে। জীবের দিকে প্রবাহিত হলে কর্মপুদ্গলের যে অবস্থার সৃষ্টি হয় তাকে আস্রব বলে। আস্রব জীবের স্বরূপ নষ্ট করে বন্ধনের দিকে নিয়ে যায়। যখন এই পুদ্গলকণা জীবে প্রবিষ্ট হয় তখন সেই অবস্থাকে বন্ধন বলে।
অন্য সকল ধর্মে মোহের প্রভুত্ব স্বীকৃত হলেও মোহকে সেখানে ‘যা নয় তা ভাবা’ জনিত অবিদ্যার কারণ হিসেবে দেখানো হয়। জৈনধর্মে মোহ উৎপন্নকারী কর্মকে সবচেয়ে শক্তিশালী কর্ম হিসেবে দেখানো হয়েছে, যার নাম মোহনীয় কর্ম। তার বিনাশ না হলে অন্য কর্মের বিনাশ হয় না এবং সমগ্র কর্মের আত্যন্তিক ক্ষয় না হলে কেবল-জ্ঞানেরও উদয় হয় না। প্রাক্তন কর্মের বিনাশের সাথে সাথে নতুন কর্মে বন্ধনের শক্তি না হলে পরই মোক্ষ স্বীকার করা হয়। ফলে জৈনসম্মত কর্মসিদ্ধান্ত বহুদিক দিয়ে অন্যান্য দর্শনের বিবেচনা হতে স্বতন্ত্র।

(চলবে…)
(ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

[পর্ব-০৮: ত্রিরত্ন-মোক্ষমার্গ ও পঞ্চ-মহাব্রত] [*] [পর্ব-১০: জৈনধর্ম ও দর্শনের মূল্যায়ন]

No comments: