| জৈনদর্শন: পর্ব-০৫ | জৈনমতে তত্ত্ব ও দ্রব্যের স্বরূপ |
-রণদীপম বসু
…
(আগের পর্বের পর…)
…
৩.০ : জৈনমতের তত্ত্ব ভেদ
.
জৈনদর্শনে তত্ত্বের (metaphysics) দুই, পাঁচ, সাত ও নয়টি ভেদের কথা আলোচিত হয়েছে। কারো মতে জীব ও অজীব নামে দু’টি মূল তত্ত্ব। অন্য মতে জীব, আকাশ, ধর্ম, অধর্ম ও পুদ্গল এই পাঁচটি অস্তিকায় এবং অনস্তিকায় কাল মিলে- মোট ছয়টি দ্রব্য হচ্ছে মূল তত্ত্ব। কোন কোন জৈন দার্শনিক আবার জীব, অজীব, আস্রব, বন্ধ, সম্বর, নির্জর ও মোক্ষ এই সাতটি তত্ত্ব বর্ণনা করেন। কারো কারো মতে সুখ ও দুঃখের কারণ পুণ্য ও পাপকে সপ্ত তত্ত্বের সাথে যুক্ত করে নয়টি পদার্থ তত্ত্ব স্বীকার করা হয়েছে। জৈনদের সিদ্ধান্তগ্রন্থে জীব, অজীব, পুণ্য, পাপ, আস্রব, সম্বর, নির্জর, বন্ধ ও মোক্ষ এই নয়টি তত্ত্ব বর্ণিত হয়েছে।
.
তাহলে তত্ত্বগুলি দাঁড়াচ্ছে-
দুই তত্ত্ব : জীব, অজীব (আত্মা, অনাত্মা)
পাঁচ তত্ত্ব : জীব, অজীব, আকাশ, ধর্ম, পুদ্গল
সাত তত্ত্ব : জীব, অজীব, আস্রব, বন্ধন (=গ্রন্থি), সম্বর (=পুনর্সংগ্রহ), নির্জর, মোক্ষ
নয় তত্ত্ব : জীব, অজীব, আস্রব, বন্ধন, সম্বর, নির্জর, মোক্ষ, পুণ্য, অপুণ্য।
.
দুই ও পাঁচ তত্ত্বে বিভাজনে দার্শনিক পদার্থকেই রাখা হয়েছে। পরবর্তী দুটি বিভাজনে ধর্ম ও নীতিকে যুক্ত করা হয়েছে। এসব তত্ত্ব আলোচনার সুবিধার্থে আগে জৈনমতে দ্রব্যের বিবেচনা নির্ধারণ করা আবশ্যক।
.
-রণদীপম বসু
…
(আগের পর্বের পর…)
…
৩.০ : জৈনমতের তত্ত্ব ভেদ
.
জৈনদর্শনে তত্ত্বের (metaphysics) দুই, পাঁচ, সাত ও নয়টি ভেদের কথা আলোচিত হয়েছে। কারো মতে জীব ও অজীব নামে দু’টি মূল তত্ত্ব। অন্য মতে জীব, আকাশ, ধর্ম, অধর্ম ও পুদ্গল এই পাঁচটি অস্তিকায় এবং অনস্তিকায় কাল মিলে- মোট ছয়টি দ্রব্য হচ্ছে মূল তত্ত্ব। কোন কোন জৈন দার্শনিক আবার জীব, অজীব, আস্রব, বন্ধ, সম্বর, নির্জর ও মোক্ষ এই সাতটি তত্ত্ব বর্ণনা করেন। কারো কারো মতে সুখ ও দুঃখের কারণ পুণ্য ও পাপকে সপ্ত তত্ত্বের সাথে যুক্ত করে নয়টি পদার্থ তত্ত্ব স্বীকার করা হয়েছে। জৈনদের সিদ্ধান্তগ্রন্থে জীব, অজীব, পুণ্য, পাপ, আস্রব, সম্বর, নির্জর, বন্ধ ও মোক্ষ এই নয়টি তত্ত্ব বর্ণিত হয়েছে।
.
তাহলে তত্ত্বগুলি দাঁড়াচ্ছে-
দুই তত্ত্ব : জীব, অজীব (আত্মা, অনাত্মা)
পাঁচ তত্ত্ব : জীব, অজীব, আকাশ, ধর্ম, পুদ্গল
সাত তত্ত্ব : জীব, অজীব, আস্রব, বন্ধন (=গ্রন্থি), সম্বর (=পুনর্সংগ্রহ), নির্জর, মোক্ষ
নয় তত্ত্ব : জীব, অজীব, আস্রব, বন্ধন, সম্বর, নির্জর, মোক্ষ, পুণ্য, অপুণ্য।
.
দুই ও পাঁচ তত্ত্বে বিভাজনে দার্শনিক পদার্থকেই রাখা হয়েছে। পরবর্তী দুটি বিভাজনে ধর্ম ও নীতিকে যুক্ত করা হয়েছে। এসব তত্ত্ব আলোচনার সুবিধার্থে আগে জৈনমতে দ্রব্যের বিবেচনা নির্ধারণ করা আবশ্যক।
.
৩.১ : দ্রব্যের স্বরূপ ও ভেদ
জগতের যাবতীয় নিত্য ও অনিত্য সত্তাই দ্রব্যের অন্তর্ভুক্ত। তাই প্রথমে জানতে হয় সত্তা কী ?
.
জৈনমতে ‘সৎ’-এর ধারণা : সত্তার লক্ষণ কী ? সত্তার লক্ষণ প্রসঙ্গে জৈনদর্শনে বলা হয়েছে ‘উৎপাদ-ব্যয়-ধ্রৌব্যযুক্তং সৎ’। উৎপাদ অর্থ উৎপত্তি (birth), ব্যয় অর্থ ধ্বংস (death) এবং ধ্রৌব্য অর্থ স্থিরতা বা স্থিতিশীল (persistence)। অর্থাৎ যার উৎপত্তি আছে, যার ধ্বংস আছে এবং যা স্থিতিশীল, তাই সৎ (reality)। বৌদ্ধমতে অর্থক্রিয়াকারিত্বকে সতের লক্ষণ বলা হয়েছে। কিন্তু জৈনরা বলেন, প্রয়োজনভূত যে ক্রিয়া বা তৎকারিত্ব অর্থাৎ কোন কার্যকারিতাকে যদি সতের লক্ষণ বলা হয় তবে মিথ্যা সর্পদংশনেও মৃত্যুরূপ কার্য সম্পন্ন হয় মানতে হবে এবং তাতে স্বপ্নদৃষ্ট মিথ্যাসর্প সৎ হয়ে যাবে। কিন্তু মিথ্যা সর্প অস্তিত্বহীন, তা কোনভাবেই সৎ হয় না। তাই জৈনগণ সতের লক্ষণ নির্ধারণে বলেন, উৎপত্তি, ব্যয় ও ধ্রৌব্য লক্ষণযুক্ত বস্তু হচ্ছে সৎ। যাতে প্রতিক্ষণে উৎপত্তি, বিনাশ ও স্থিরতা উপলব্ধ হয় তাকে (=দ্রব্যকে) জৈনগণ সৎ বলেন।
.
উদাহরণস্বরূপ, ঘটের উৎপত্তি মৃৎপিণ্ড হতে হয়, এর বিচারে তিনটি বিষয় লক্ষ্য করা যায়। মৃৎপিণ্ড হতে ঘট নির্মাণের সময়ে মৃত্তিকার পিণ্ডরূপ পর্যায় বিনষ্ট হয়, ঘটপর্যায় উৎপন্ন হয় এবং মৃত্তিকা স্থির থাকে। এই তিনটি বিষয় একই সময়ে হয়। যে ক্ষণে ঘটপর্যায় উৎপন্ন হয় সে ক্ষণে পিণ্ডপর্যায় বিনষ্ট হয় ও মৃত্তিকার স্থিরতা বিদ্যমান থাকে। ফলে বস্তু প্রতিক্ষণে উৎপাদ, ব্যয় ও ধ্রৌব্য লক্ষণ যুক্ত হয়ে থাকে। তবে এই মতটি বহু প্রাচীন কাল হতে প্রচলিত ছিলো বলে জানা যায়। যেমন ‘মহাভাষ্যে’ বলা হয়েছে, দ্রব্য হচ্ছে নিত্য, আকৃতি অনিত্য। কেননা দেখা যায় যে সংসারে মৃৎ কোন আকৃতিতে পিণ্ড হয়, পিণ্ডাকৃতিকে মর্দন করে ছোট ঘট তৈরি করা হয়, ঘট থেকে কুণ্ডিকা করা হয়। আকৃতি ভিন্ন ভিন্ন হলেও মৃৎ কিন্তু সেরূপই থাকে। আকৃতির নাশে দ্রব্যই অবশিষ্ট থাকে। সুতরাং দ্রব্য হচ্ছে নিত্য।
.
স্যাদবাদী জৈনগণ বৌদ্ধদের মতো দ্রব্যের নিরন্বয় বিনাশ স্বীকার করেন না। কারণ জৈনমতে বিনাশ সর্বত্র সান্বয় হয়ে থাকে। ঘট বিনষ্ট হলে তার ভাঙা টুকরো দেখা যায়। তপ্ত লোহায় পতিত জলবিন্দুর বিনাশে তার অন্বয় (=যোগ) সমুদ্রে অনুমান করা যায়। সেকারণে বলা হয়েছে, জলবিন্দু ও সমুদ্রে জলের অস্তিত্বে ভেদ নেই। জলবিন্দু বিনষ্ট হলে তার অন্বয় সমুদ্রে থাকে।
জৈনমতে দ্রব্যকে অনেক ধর্মবিশিষ্ট বলায় তার পরিবর্তনশীলতা সম্ভব, কিন্তু তাতের দ্রব্যের নিত্যত্ব হারায় না। অর্থাৎ জৈনরা দ্রব্য বা পদার্থকে সর্বদা পরিবর্তনশীল বলেও মানেন নি, অপরিবর্তনীয় বলেও নয়। সত্তার বিষয়ে সাত প্রকার স্যাৎ অর্থাৎ বিদ্যমানতার কথাই জৈনদের সপ্তভঙ্গিনয়ে প্রতিফলিত হয়।
.
মূলকথা হচ্ছে, জৈনমতে জগত বিভিন্ন প্রকার দ্রব্যের সাহায্যে গঠিত। সকল দ্রব্যেরই আবার দু’প্রকার ধর্ম আছে- নিত্য এবং অনিত্য। নিত্যধর্মগুলি দ্রব্যে সর্বদা বর্তমান থাকে। কিন্তু অনিত্য ধর্মগুলি দ্রব্যে সর্বদা বর্তমান থাকে না।
.
জৈনমতে গুণ এবং পর্যায় : দ্রব্যের লণ প্রসঙ্গে জৈনদর্শনে বলা হয়েছে ‘গুণপর্যায়বৎ দ্রব্যম্’। অর্থাৎ গুণ এবং পর্যায় যাতে থাকে তাই হলো দ্রব্য। গুণ দ্রব্যে আশ্রিত এবং নির্গুণ। যেমন জ্ঞানত্ব প্রভৃতি ধর্ম হলো আত্মা বা জীবের গুণ। অর্থাৎ গুণ দ্রব্যে আশ্রিত হলেও গুণে কোন গুণ থাকে না। অপরপক্ষে দ্রব্যের বিশেষ পরিণতিকে বলা হয় পর্যায়। যেমন জীবের সাধারণ ধর্ম জ্ঞান, ঘটজ্ঞান, সুখ, দুঃখ ইত্যাদিরূপে পরিণত হয় বলে ঘটজ্ঞান প্রভৃতিকে জীবের পর্যায় বলা হয়েছে। জৈনমতে দ্রব্যের স্থিতিশীল অংশ এবং পরিবর্তনশীল অংশ আছে। আবার দ্রব্যের নিত্যধর্মও আছে, অনিত্যধর্মও আছে। নিত্য ধর্মকেই জৈনরা বলেছেন গুণ এবং অনিত্য ধর্মকে বলেছেন পর্যায়। একারণে জৈনমতে জীব নিত্য ও অপরিণামী হলেও পর্যায় বা অবস্থার দিক থেকে জীব পরিবর্তনশীল, সেহেতু অনিত্য।
.
উদাহরণস্বরূপ, মৃত্তিকাপিণ্ড নষ্ট হয়, উৎপন্ন ঘটও নষ্ট হতে পারে। কিন্তু দ্রব্য (মাটি) হিসেবে দেখলে সমস্ত অবস্থাতেই তা (মাটি) বর্তমান থাকে। এখানে মৃত্তিকা বা মাটি হচ্ছে গুণ, মৃত্তিকাপিণ্ড ঘট ইত্যাদি হচ্ছে পর্যায়। দ্রব্যের স্বভাবে গুণ ধ্রুব (=স্থায়ী) থাকে এবং পর্যায় উৎপাদব্যয়শীল হয়। অর্থাৎ জৈনমতে দ্রব্য উৎপন্ন বা বিনষ্ট হয় না, কেবল পর্যায় উৎপন্ন ও বিনষ্ট হয়। পর্যায়ের সাথে অভিন্ন হওয়ায় দ্রব্যকে উৎপাদ ও ব্যয়শীল মানা হয়।
.
আচার্য সমন্তভদ্র (ষষ্ঠ শতক) তাঁর ‘আপ্তমীমাংসা’য় এ দৃষ্টিতে তত্ত্বকে ত্রয়াত্মক বলেছেন। এ প্রসঙ্গে একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত প্রদর্শিত হয়েছে। এক রাজার কাছে একটি স্বর্ণকলস ছিলো। তা তার পুত্রের ইচ্ছায় মুকুট করে দিলে রাজকুমারী বিষণ্ন হয়, রাজপুত্র খুশি। এবং রাজার এতে শোক বা হর্ষ কিছুই হয় না, কেননা রাজা সুবর্ণের অভিলাষী থাকায় তা দুই অবস্থাতেই বিদ্যমান ছিলো। ফলতঃ দ্রব্য বা পদার্থ হচ্ছে ত্রয়াত্মক। নিষ্কর্ষ হচ্ছে জৈনদর্শনে দ্রব্যই একমাত্র তত্ত্ব। দ্রব্যের দৃষ্টিতে এই তত্ত্ব হচ্ছে নিত্য এবং পর্যায়ের দৃষ্টিতে অনিত্য।
.
জৈনমতে দ্রব্যের ধারণা : জৈনমতে যা গুণ এবং পর্যায়বিশিষ্ট তাই দ্রব্য। অর্থাৎ দ্রব্যে দুই প্রকার ধর্ম আছে- নিত্য এবং অনিত্য। দ্রব্যের নিত্য ধর্মগুলিকে বলা হয় গুণ এবং অনিত্য ধর্মগুলিকে বলা হয় পর্যায়। নিত্য ধর্মগুলির পরিবর্তন হয় না। কিন্তু পর্যায় হলো পরিবর্তনশীল ধর্ম।
.
দ্রব্যের বিভাগ :
জৈনমতে দ্রব্যকে (substance) প্রধানত দুইভাগে ভাগ করা হয়- অস্তিকায় বা বহুদেশব্যাপি (extended) এবং অনস্তিকায় বা একদেশব্যাপি (non-extended)।
‘অস্তি’ শব্দের অর্থ বিদ্যমান, ‘কায়’ শব্দের অর্থ দেহ, শরীর। ‘অস্তিকায়’ শব্দের তাৎপর্য হলো দেহ বা প্রদেশে বিদ্যমান পদার্থ। জীব, পুদ্গল, আকাশ, ধর্ম ও অধর্ম বহুপ্রদেশী। সেকারণে এই পাঁচটি তত্ত্ব হচ্ছে অস্তিকায়। ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান তিন কালের সাথে সম্মন্ধযুক্ত বলে তাদের স্থিতি বুঝাতে ‘অস্তি’ শব্দ এবং অনেক স্থান ব্যাপ্ত করে থাকে বলে কায়ের মত হওয়ায় ব্যাপ্তিবোধক ‘কায়’ শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে। কালে ব্যাপ্তি বুঝাতে ‘অস্তি’ শব্দ এবং স্থানে বা দেশে ব্যাপ্তি বুঝাতে ‘কায়’ শব্দ। ‘অস্তিকায়ে’র বিপরীত হচ্ছে ‘অনস্তিকায়’। একমাত্র কাল-ই (time) হলো অনস্তিকায় বা একদেশব্যাপি দ্রব্য।
.
কাল স্থানে ব্যাপ্ত করে থাকে না বলে অনস্তিকায় দ্রব্য। একদেশব্যাপি কালের বিস্তার দেখা যায় না। কিন্তু ভূত, ভবিষ্যৎ বা বর্তমান কালের অবস্থাযুক্তরূপে বস্তুর বিশেষ অবস্থার বর্ণনা করায় কালের গুণ হচ্ছে বর্ণনাহেতুত্ব। অনস্তিকায় কাল ভিন্ন অন্য সব অস্তিকায় দ্রব্য বহুদেশব্যাপি, তিন কাল ব্যাপে এবং অনেকস্থান ব্যাপে থাকে। বহুদেশব্যাপি অস্তিকায় দ্রব্যের বিস্তার দেখা যায়। বিস্তার ধারণের দরুন পদার্থের কায়সংজ্ঞা, অথবা অনেক প্রদেশে থাকায় শরীরের মতো তা কায়সংজ্ঞা হয়।
কাল এক ও অবিভাজ্য। কিন্তু কোন কোন জৈনমতে কাল দুই প্রকার- পারমার্থিক (real) ও ব্যবহারিক (empirical)। পারমার্থিক কাল অনন্ত, অবিভাজ্য, নিত্য, নিরবয়ব ও এক। অন্যদিকে ক্ষণ, মুহূর্ত, ঘণ্টা, দিন, মাস, বৎসর ইত্যাদি ভেদে ব্যবহারিক কালের অবয়ব কল্পিত হয়। কিন্তু পারমার্থিক কালের অবয়ব নেই, তা হচ্ছে অমূর্ত।
.
অস্তিকায় দ্রব্যকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে- জীব (self or living) এবং অজীব (non-living)।
আমরা আত্মা বলতে যা বুঝি, জৈনদর্শনে তাকেই জীব বলা হয়েছে। জৈনমতে চৈতন্য হলো জীবের গুণ। জীবের বিস্তৃতি আছে, অর্থাৎ জীব বা আত্মা স্থান বা দেশ জুড়ে থাকে। এই কারণে জীব বা আত্মা সংকোচন ও প্রসারণে সমর্থ। সুখ, দুঃখ ইত্যাদি ধর্মের দ্বারা আত্মাকে সাক্ষাৎভাবে জানা যায়। আবার অনুমানের দ্বারাও আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় বলে জৈনরা স্বীকার করেন।
অজীব হচ্ছে জীবনহীন ও জ্ঞানহীন।
.
অজীব চারপ্রকার- পুদ্গল (matter), ধর্ম (motion), অধর্ম (rest) এবং আকাশ (space)।
পুদ্গল অর্থ জড়দ্রব্য। এগুলির স্পর্শ, রস, গন্ধ এবং বর্ণ আছে। পুদ্গল দুই প্রকার- অণু বা পরমাণু (atom) এবং সঙ্ঘাত বা স্কন্ধ (compound)।
জৈনমতে ধর্ম অর্থ হলো যা গতির নিয়ামক। অর্থাৎ ধর্ম গতিকে সম্ভব করে।
অপরপক্ষে অধর্ম হলো যা জীবকে স্থির থাকতে সাহায্য করে।
আকাশ হলো অতি সূক্ষ্ম পদার্থ। এটি পার্থিব জগতকে (লোকাকাশ) এবং মুক্ত জীবের অপার্থিব জগতকে (অলোকাকাশ) ব্যাপ্ত হয়ে থাকে। জৈনমতে অতীন্দ্রিয় আকাশের প্রত্যক্ষ হয় না। অনুমানের দ্বারা আকাশের অস্তিত্ব সিদ্ধ হয়।
আকাশ দু’ধরনের- লোকাকাশ (filled space) ও অলোকাকাশ (empty space)।
.
জীবকে দুভাগে ভাগ করা হয়- মুক্ত (bound) এবং বদ্ধ বা সংসারী (liberated)।
যে সকল জীব ত্যাগ, তপস্যা ও কর্মের আবরণ সরিয়ে ফেলে কৈবল্যপদ প্রাপ্ত হয় বলে আর জন্মগ্রহণ করবে না তারা হচ্ছে মুক্ত জীব।
প্রশ্ন উঠতে পারে, যদি এইভাবে অনন্তকাল ধরে প্রাণীসকল মুক্ত হতে থাকে তবে তো দুনিয়া একদিন জীবহীন হয়ে পড়বে। এর সমাধানে জৈনমতে বলা হয়েছে, জীবের সংখ্যা কম পড়ার মতো নয়, কেননা বিশ্ব তো নিগোদ (=জীব-গ্রন্থি)-এ পরিপূর্ণ। একেকটি জীব-গ্রন্থির মধ্যে যে কতো সংখ্যক সংকোচন বিকাশশীল জীব আছে তা বোঝা যায়, জৈনমতে যখন বলা হয়, অনাদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত যত জীব মুক্ত হয়েছে তার জন্য মাত্র একটি জীব-গ্রন্থিই পর্যাপ্ত। অতএব সংসারের উচ্ছন্ন হওয়ার কোন আশঙ্কাই নেই।
অন্যদিকে জন্মমৃত্যুর ঘূর্ণিপাকে বদ্ধ বা সংসারী জীব নিয়ত ঘূর্ণায়মান। কর্মের আবরণে এই জীব (=আত্মা) আচ্ছাদিত।
.
বদ্ধ বা সংসারী জীব দুই প্রকার- সমনস্ক বা মনোযোগী ও অমনস্ক বা অমনোযোগী।
যারা সংজ্ঞাযুক্ত অর্থাৎ যে সংসারী জীবের শিক্ষা ও সামাজিকতার জ্ঞান আছে তারা মনোযোগী বা সমনস্ক জীব (=আত্মা)। সংজ্ঞা শব্দের অর্থ শিক্ষা, ক্রিয়া, আলাপের গ্রহণ ও ব্যবহার। আর যে বদ্ধ জীবের এ সংজ্ঞা নেই তারা অমনোযোগী বা অমনস্ক জীব।
.
অমনস্ক জীবকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়- ত্রস বা জঙ্গম (mobile) ও স্থাবর (static)।
কেবলমাত্র স্পর্শ ইন্দ্রিয়যুক্ত জীব যেমন পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু, বনস্পতি বা বৃক্ষ হচ্ছে গতিহীন স্থাবর জীব। আর একাধিক ইন্দ্রিয়যুক্ত জীব হচ্ছে বিচরণশীল ত্রস জীব।
.
ত্রস জীবকে ইন্দ্রিয়ভেদে চারভাগে ভাগ করা হয়-
দ্বীন্দ্রিয় যুক্ত : স্পর্শ, রস বা স্বাদ। যেমন শামুক ও কৃমি জাতীয় প্রাণী।
ত্রীন্দ্রিয় যুক্ত : স্পর্শ, রস, ঘ্রাণ। যেমন পিপীলিকা ইত্যাদি।
চতুরিন্দ্রিয় যুক্ত : স্পর্শ, রস, ঘ্রাণ, দর্শন। যেমন মাছি, ভ্রমর ইত্যাদি।
পঞ্চেন্দ্রিয় যুক্ত : স্পর্শ, রস, ঘ্রাণ, দর্শন, শব্দ। যেমন পশু, পক্ষি ইত্যাদি মেরুদণ্ডী প্রাণী।
.
আর মনোযোগী বা সমনস্ক জীব (=আত্মা) হচ্ছে ষড়েন্দ্রিয় যুক্ত নর, দেব এবং নারকীয় প্রাণী। এদের ছয়টি ইন্দ্রিয় হচ্ছে- স্পর্শ, রস, ঘ্রাণ, দর্শন, শব্দ ও মন।
…
(চলবে…)
(ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)
…
[পর্ব-০৪: জৈন প্রমাণশাস্ত্রে জ্ঞান ও তার ভেদ] [*] [পর্ব-০৬: জৈনমতে জীব ও অজীব তত্ত্বের বিচার]
জগতের যাবতীয় নিত্য ও অনিত্য সত্তাই দ্রব্যের অন্তর্ভুক্ত। তাই প্রথমে জানতে হয় সত্তা কী ?
.
জৈনমতে ‘সৎ’-এর ধারণা : সত্তার লক্ষণ কী ? সত্তার লক্ষণ প্রসঙ্গে জৈনদর্শনে বলা হয়েছে ‘উৎপাদ-ব্যয়-ধ্রৌব্যযুক্তং সৎ’। উৎপাদ অর্থ উৎপত্তি (birth), ব্যয় অর্থ ধ্বংস (death) এবং ধ্রৌব্য অর্থ স্থিরতা বা স্থিতিশীল (persistence)। অর্থাৎ যার উৎপত্তি আছে, যার ধ্বংস আছে এবং যা স্থিতিশীল, তাই সৎ (reality)। বৌদ্ধমতে অর্থক্রিয়াকারিত্বকে সতের লক্ষণ বলা হয়েছে। কিন্তু জৈনরা বলেন, প্রয়োজনভূত যে ক্রিয়া বা তৎকারিত্ব অর্থাৎ কোন কার্যকারিতাকে যদি সতের লক্ষণ বলা হয় তবে মিথ্যা সর্পদংশনেও মৃত্যুরূপ কার্য সম্পন্ন হয় মানতে হবে এবং তাতে স্বপ্নদৃষ্ট মিথ্যাসর্প সৎ হয়ে যাবে। কিন্তু মিথ্যা সর্প অস্তিত্বহীন, তা কোনভাবেই সৎ হয় না। তাই জৈনগণ সতের লক্ষণ নির্ধারণে বলেন, উৎপত্তি, ব্যয় ও ধ্রৌব্য লক্ষণযুক্ত বস্তু হচ্ছে সৎ। যাতে প্রতিক্ষণে উৎপত্তি, বিনাশ ও স্থিরতা উপলব্ধ হয় তাকে (=দ্রব্যকে) জৈনগণ সৎ বলেন।
.
উদাহরণস্বরূপ, ঘটের উৎপত্তি মৃৎপিণ্ড হতে হয়, এর বিচারে তিনটি বিষয় লক্ষ্য করা যায়। মৃৎপিণ্ড হতে ঘট নির্মাণের সময়ে মৃত্তিকার পিণ্ডরূপ পর্যায় বিনষ্ট হয়, ঘটপর্যায় উৎপন্ন হয় এবং মৃত্তিকা স্থির থাকে। এই তিনটি বিষয় একই সময়ে হয়। যে ক্ষণে ঘটপর্যায় উৎপন্ন হয় সে ক্ষণে পিণ্ডপর্যায় বিনষ্ট হয় ও মৃত্তিকার স্থিরতা বিদ্যমান থাকে। ফলে বস্তু প্রতিক্ষণে উৎপাদ, ব্যয় ও ধ্রৌব্য লক্ষণ যুক্ত হয়ে থাকে। তবে এই মতটি বহু প্রাচীন কাল হতে প্রচলিত ছিলো বলে জানা যায়। যেমন ‘মহাভাষ্যে’ বলা হয়েছে, দ্রব্য হচ্ছে নিত্য, আকৃতি অনিত্য। কেননা দেখা যায় যে সংসারে মৃৎ কোন আকৃতিতে পিণ্ড হয়, পিণ্ডাকৃতিকে মর্দন করে ছোট ঘট তৈরি করা হয়, ঘট থেকে কুণ্ডিকা করা হয়। আকৃতি ভিন্ন ভিন্ন হলেও মৃৎ কিন্তু সেরূপই থাকে। আকৃতির নাশে দ্রব্যই অবশিষ্ট থাকে। সুতরাং দ্রব্য হচ্ছে নিত্য।
.
স্যাদবাদী জৈনগণ বৌদ্ধদের মতো দ্রব্যের নিরন্বয় বিনাশ স্বীকার করেন না। কারণ জৈনমতে বিনাশ সর্বত্র সান্বয় হয়ে থাকে। ঘট বিনষ্ট হলে তার ভাঙা টুকরো দেখা যায়। তপ্ত লোহায় পতিত জলবিন্দুর বিনাশে তার অন্বয় (=যোগ) সমুদ্রে অনুমান করা যায়। সেকারণে বলা হয়েছে, জলবিন্দু ও সমুদ্রে জলের অস্তিত্বে ভেদ নেই। জলবিন্দু বিনষ্ট হলে তার অন্বয় সমুদ্রে থাকে।
জৈনমতে দ্রব্যকে অনেক ধর্মবিশিষ্ট বলায় তার পরিবর্তনশীলতা সম্ভব, কিন্তু তাতের দ্রব্যের নিত্যত্ব হারায় না। অর্থাৎ জৈনরা দ্রব্য বা পদার্থকে সর্বদা পরিবর্তনশীল বলেও মানেন নি, অপরিবর্তনীয় বলেও নয়। সত্তার বিষয়ে সাত প্রকার স্যাৎ অর্থাৎ বিদ্যমানতার কথাই জৈনদের সপ্তভঙ্গিনয়ে প্রতিফলিত হয়।
.
মূলকথা হচ্ছে, জৈনমতে জগত বিভিন্ন প্রকার দ্রব্যের সাহায্যে গঠিত। সকল দ্রব্যেরই আবার দু’প্রকার ধর্ম আছে- নিত্য এবং অনিত্য। নিত্যধর্মগুলি দ্রব্যে সর্বদা বর্তমান থাকে। কিন্তু অনিত্য ধর্মগুলি দ্রব্যে সর্বদা বর্তমান থাকে না।
.
জৈনমতে গুণ এবং পর্যায় : দ্রব্যের লণ প্রসঙ্গে জৈনদর্শনে বলা হয়েছে ‘গুণপর্যায়বৎ দ্রব্যম্’। অর্থাৎ গুণ এবং পর্যায় যাতে থাকে তাই হলো দ্রব্য। গুণ দ্রব্যে আশ্রিত এবং নির্গুণ। যেমন জ্ঞানত্ব প্রভৃতি ধর্ম হলো আত্মা বা জীবের গুণ। অর্থাৎ গুণ দ্রব্যে আশ্রিত হলেও গুণে কোন গুণ থাকে না। অপরপক্ষে দ্রব্যের বিশেষ পরিণতিকে বলা হয় পর্যায়। যেমন জীবের সাধারণ ধর্ম জ্ঞান, ঘটজ্ঞান, সুখ, দুঃখ ইত্যাদিরূপে পরিণত হয় বলে ঘটজ্ঞান প্রভৃতিকে জীবের পর্যায় বলা হয়েছে। জৈনমতে দ্রব্যের স্থিতিশীল অংশ এবং পরিবর্তনশীল অংশ আছে। আবার দ্রব্যের নিত্যধর্মও আছে, অনিত্যধর্মও আছে। নিত্য ধর্মকেই জৈনরা বলেছেন গুণ এবং অনিত্য ধর্মকে বলেছেন পর্যায়। একারণে জৈনমতে জীব নিত্য ও অপরিণামী হলেও পর্যায় বা অবস্থার দিক থেকে জীব পরিবর্তনশীল, সেহেতু অনিত্য।
.
উদাহরণস্বরূপ, মৃত্তিকাপিণ্ড নষ্ট হয়, উৎপন্ন ঘটও নষ্ট হতে পারে। কিন্তু দ্রব্য (মাটি) হিসেবে দেখলে সমস্ত অবস্থাতেই তা (মাটি) বর্তমান থাকে। এখানে মৃত্তিকা বা মাটি হচ্ছে গুণ, মৃত্তিকাপিণ্ড ঘট ইত্যাদি হচ্ছে পর্যায়। দ্রব্যের স্বভাবে গুণ ধ্রুব (=স্থায়ী) থাকে এবং পর্যায় উৎপাদব্যয়শীল হয়। অর্থাৎ জৈনমতে দ্রব্য উৎপন্ন বা বিনষ্ট হয় না, কেবল পর্যায় উৎপন্ন ও বিনষ্ট হয়। পর্যায়ের সাথে অভিন্ন হওয়ায় দ্রব্যকে উৎপাদ ও ব্যয়শীল মানা হয়।
.
আচার্য সমন্তভদ্র (ষষ্ঠ শতক) তাঁর ‘আপ্তমীমাংসা’য় এ দৃষ্টিতে তত্ত্বকে ত্রয়াত্মক বলেছেন। এ প্রসঙ্গে একটি সুন্দর দৃষ্টান্ত প্রদর্শিত হয়েছে। এক রাজার কাছে একটি স্বর্ণকলস ছিলো। তা তার পুত্রের ইচ্ছায় মুকুট করে দিলে রাজকুমারী বিষণ্ন হয়, রাজপুত্র খুশি। এবং রাজার এতে শোক বা হর্ষ কিছুই হয় না, কেননা রাজা সুবর্ণের অভিলাষী থাকায় তা দুই অবস্থাতেই বিদ্যমান ছিলো। ফলতঃ দ্রব্য বা পদার্থ হচ্ছে ত্রয়াত্মক। নিষ্কর্ষ হচ্ছে জৈনদর্শনে দ্রব্যই একমাত্র তত্ত্ব। দ্রব্যের দৃষ্টিতে এই তত্ত্ব হচ্ছে নিত্য এবং পর্যায়ের দৃষ্টিতে অনিত্য।
.
জৈনমতে দ্রব্যের ধারণা : জৈনমতে যা গুণ এবং পর্যায়বিশিষ্ট তাই দ্রব্য। অর্থাৎ দ্রব্যে দুই প্রকার ধর্ম আছে- নিত্য এবং অনিত্য। দ্রব্যের নিত্য ধর্মগুলিকে বলা হয় গুণ এবং অনিত্য ধর্মগুলিকে বলা হয় পর্যায়। নিত্য ধর্মগুলির পরিবর্তন হয় না। কিন্তু পর্যায় হলো পরিবর্তনশীল ধর্ম।
.
দ্রব্যের বিভাগ :
জৈনমতে দ্রব্যকে (substance) প্রধানত দুইভাগে ভাগ করা হয়- অস্তিকায় বা বহুদেশব্যাপি (extended) এবং অনস্তিকায় বা একদেশব্যাপি (non-extended)।
‘অস্তি’ শব্দের অর্থ বিদ্যমান, ‘কায়’ শব্দের অর্থ দেহ, শরীর। ‘অস্তিকায়’ শব্দের তাৎপর্য হলো দেহ বা প্রদেশে বিদ্যমান পদার্থ। জীব, পুদ্গল, আকাশ, ধর্ম ও অধর্ম বহুপ্রদেশী। সেকারণে এই পাঁচটি তত্ত্ব হচ্ছে অস্তিকায়। ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান তিন কালের সাথে সম্মন্ধযুক্ত বলে তাদের স্থিতি বুঝাতে ‘অস্তি’ শব্দ এবং অনেক স্থান ব্যাপ্ত করে থাকে বলে কায়ের মত হওয়ায় ব্যাপ্তিবোধক ‘কায়’ শব্দ প্রয়োগ করা হয়েছে। কালে ব্যাপ্তি বুঝাতে ‘অস্তি’ শব্দ এবং স্থানে বা দেশে ব্যাপ্তি বুঝাতে ‘কায়’ শব্দ। ‘অস্তিকায়ে’র বিপরীত হচ্ছে ‘অনস্তিকায়’। একমাত্র কাল-ই (time) হলো অনস্তিকায় বা একদেশব্যাপি দ্রব্য।
.
কাল স্থানে ব্যাপ্ত করে থাকে না বলে অনস্তিকায় দ্রব্য। একদেশব্যাপি কালের বিস্তার দেখা যায় না। কিন্তু ভূত, ভবিষ্যৎ বা বর্তমান কালের অবস্থাযুক্তরূপে বস্তুর বিশেষ অবস্থার বর্ণনা করায় কালের গুণ হচ্ছে বর্ণনাহেতুত্ব। অনস্তিকায় কাল ভিন্ন অন্য সব অস্তিকায় দ্রব্য বহুদেশব্যাপি, তিন কাল ব্যাপে এবং অনেকস্থান ব্যাপে থাকে। বহুদেশব্যাপি অস্তিকায় দ্রব্যের বিস্তার দেখা যায়। বিস্তার ধারণের দরুন পদার্থের কায়সংজ্ঞা, অথবা অনেক প্রদেশে থাকায় শরীরের মতো তা কায়সংজ্ঞা হয়।
কাল এক ও অবিভাজ্য। কিন্তু কোন কোন জৈনমতে কাল দুই প্রকার- পারমার্থিক (real) ও ব্যবহারিক (empirical)। পারমার্থিক কাল অনন্ত, অবিভাজ্য, নিত্য, নিরবয়ব ও এক। অন্যদিকে ক্ষণ, মুহূর্ত, ঘণ্টা, দিন, মাস, বৎসর ইত্যাদি ভেদে ব্যবহারিক কালের অবয়ব কল্পিত হয়। কিন্তু পারমার্থিক কালের অবয়ব নেই, তা হচ্ছে অমূর্ত।
.
অস্তিকায় দ্রব্যকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছে- জীব (self or living) এবং অজীব (non-living)।
আমরা আত্মা বলতে যা বুঝি, জৈনদর্শনে তাকেই জীব বলা হয়েছে। জৈনমতে চৈতন্য হলো জীবের গুণ। জীবের বিস্তৃতি আছে, অর্থাৎ জীব বা আত্মা স্থান বা দেশ জুড়ে থাকে। এই কারণে জীব বা আত্মা সংকোচন ও প্রসারণে সমর্থ। সুখ, দুঃখ ইত্যাদি ধর্মের দ্বারা আত্মাকে সাক্ষাৎভাবে জানা যায়। আবার অনুমানের দ্বারাও আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় বলে জৈনরা স্বীকার করেন।
অজীব হচ্ছে জীবনহীন ও জ্ঞানহীন।
.
অজীব চারপ্রকার- পুদ্গল (matter), ধর্ম (motion), অধর্ম (rest) এবং আকাশ (space)।
পুদ্গল অর্থ জড়দ্রব্য। এগুলির স্পর্শ, রস, গন্ধ এবং বর্ণ আছে। পুদ্গল দুই প্রকার- অণু বা পরমাণু (atom) এবং সঙ্ঘাত বা স্কন্ধ (compound)।
জৈনমতে ধর্ম অর্থ হলো যা গতির নিয়ামক। অর্থাৎ ধর্ম গতিকে সম্ভব করে।
অপরপক্ষে অধর্ম হলো যা জীবকে স্থির থাকতে সাহায্য করে।
আকাশ হলো অতি সূক্ষ্ম পদার্থ। এটি পার্থিব জগতকে (লোকাকাশ) এবং মুক্ত জীবের অপার্থিব জগতকে (অলোকাকাশ) ব্যাপ্ত হয়ে থাকে। জৈনমতে অতীন্দ্রিয় আকাশের প্রত্যক্ষ হয় না। অনুমানের দ্বারা আকাশের অস্তিত্ব সিদ্ধ হয়।
আকাশ দু’ধরনের- লোকাকাশ (filled space) ও অলোকাকাশ (empty space)।
.
জীবকে দুভাগে ভাগ করা হয়- মুক্ত (bound) এবং বদ্ধ বা সংসারী (liberated)।
যে সকল জীব ত্যাগ, তপস্যা ও কর্মের আবরণ সরিয়ে ফেলে কৈবল্যপদ প্রাপ্ত হয় বলে আর জন্মগ্রহণ করবে না তারা হচ্ছে মুক্ত জীব।
প্রশ্ন উঠতে পারে, যদি এইভাবে অনন্তকাল ধরে প্রাণীসকল মুক্ত হতে থাকে তবে তো দুনিয়া একদিন জীবহীন হয়ে পড়বে। এর সমাধানে জৈনমতে বলা হয়েছে, জীবের সংখ্যা কম পড়ার মতো নয়, কেননা বিশ্ব তো নিগোদ (=জীব-গ্রন্থি)-এ পরিপূর্ণ। একেকটি জীব-গ্রন্থির মধ্যে যে কতো সংখ্যক সংকোচন বিকাশশীল জীব আছে তা বোঝা যায়, জৈনমতে যখন বলা হয়, অনাদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত যত জীব মুক্ত হয়েছে তার জন্য মাত্র একটি জীব-গ্রন্থিই পর্যাপ্ত। অতএব সংসারের উচ্ছন্ন হওয়ার কোন আশঙ্কাই নেই।
অন্যদিকে জন্মমৃত্যুর ঘূর্ণিপাকে বদ্ধ বা সংসারী জীব নিয়ত ঘূর্ণায়মান। কর্মের আবরণে এই জীব (=আত্মা) আচ্ছাদিত।
.
বদ্ধ বা সংসারী জীব দুই প্রকার- সমনস্ক বা মনোযোগী ও অমনস্ক বা অমনোযোগী।
যারা সংজ্ঞাযুক্ত অর্থাৎ যে সংসারী জীবের শিক্ষা ও সামাজিকতার জ্ঞান আছে তারা মনোযোগী বা সমনস্ক জীব (=আত্মা)। সংজ্ঞা শব্দের অর্থ শিক্ষা, ক্রিয়া, আলাপের গ্রহণ ও ব্যবহার। আর যে বদ্ধ জীবের এ সংজ্ঞা নেই তারা অমনোযোগী বা অমনস্ক জীব।
.
অমনস্ক জীবকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়- ত্রস বা জঙ্গম (mobile) ও স্থাবর (static)।
কেবলমাত্র স্পর্শ ইন্দ্রিয়যুক্ত জীব যেমন পৃথিবী, জল, তেজ, বায়ু, বনস্পতি বা বৃক্ষ হচ্ছে গতিহীন স্থাবর জীব। আর একাধিক ইন্দ্রিয়যুক্ত জীব হচ্ছে বিচরণশীল ত্রস জীব।
.
ত্রস জীবকে ইন্দ্রিয়ভেদে চারভাগে ভাগ করা হয়-
দ্বীন্দ্রিয় যুক্ত : স্পর্শ, রস বা স্বাদ। যেমন শামুক ও কৃমি জাতীয় প্রাণী।
ত্রীন্দ্রিয় যুক্ত : স্পর্শ, রস, ঘ্রাণ। যেমন পিপীলিকা ইত্যাদি।
চতুরিন্দ্রিয় যুক্ত : স্পর্শ, রস, ঘ্রাণ, দর্শন। যেমন মাছি, ভ্রমর ইত্যাদি।
পঞ্চেন্দ্রিয় যুক্ত : স্পর্শ, রস, ঘ্রাণ, দর্শন, শব্দ। যেমন পশু, পক্ষি ইত্যাদি মেরুদণ্ডী প্রাণী।
.
আর মনোযোগী বা সমনস্ক জীব (=আত্মা) হচ্ছে ষড়েন্দ্রিয় যুক্ত নর, দেব এবং নারকীয় প্রাণী। এদের ছয়টি ইন্দ্রিয় হচ্ছে- স্পর্শ, রস, ঘ্রাণ, দর্শন, শব্দ ও মন।
…
(চলবে…)
(ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)
…
[পর্ব-০৪: জৈন প্রমাণশাস্ত্রে জ্ঞান ও তার ভেদ] [*] [পর্ব-০৬: জৈনমতে জীব ও অজীব তত্ত্বের বিচার]
No comments:
Post a Comment