Wednesday, December 7, 2011

| জৈনদর্শন: পর্ব-০৪ | জৈন প্রমাণশাস্ত্রে জ্ঞান ও তার ভেদ |

| জৈনদর্শন: পর্ব-০৪ | জৈন প্রমাণশাস্ত্রে জ্ঞান ও তার ভেদ |
-রণদীপম বসু

২.৩ : জৈন প্রমাণশাস্ত্রে জ্ঞান ও তার ভেদ
.
প্রাচীন ভারতীয় দার্শনিক তর্ক ও বিতণ্ডায় প্রমাণ ও তর্কশাস্ত্র হলো নিজ নিজ দার্শনিক বিবেচনার মোক্ষম অস্ত্র, যা দিয়ে প্রতিপক্ষের যুক্তি খণ্ডনের পাশাপাশি নিজের যুক্তি ও মত প্রতিষ্ঠিত করায় বিশেষভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। তা থেকে জৈন দার্শনিকরাও কোন অংশে পিছিয়ে ছিলেন না। বরং প্রমাণশাস্ত্র জৈনদর্শনের এক মহত্ত্বপূর্ণ শাখা। এক্ষেত্রে খ্রীষ্টিয় প্রথম শতক থেকে ষোড়শ শতক পর্যন্ত বিভিন্ন জৈন দার্শনিকদের প্রত্যক্ষ অবদানে জৈনদর্শনের যে বিশেষ বিকাশ ঘটে, তারই উজ্জ্বলতম নিদর্শন হলো জৈনদের এই প্রমাণশাস্ত্র যা মূলত ভারতীয় দর্শনকেই একাধারে মহিমান্বিত করেছে।


.
জৈনমতে জীবকে চৈতন্য বলে স্বীকার করা হয়েছে। এই চৈতন্যের উপমা দেয়া হয় সূর্যের সাথে। সূর্যের প্রকাশ থেকে অন্য বস্তুরাজির প্রকাশের (=দৃশ্যমান) সাথে সাথে যেমন সূর্য নিজেও প্রকাশ হয়, তেমনি আত্মা বা চৈতন্যের দ্বারা অন্য পদার্থ প্রকাশিত হয়, তা নিজেকেও প্রকাশিত করে। এ দর্শনে জীবকে অনন্ত জ্ঞানবিশিষ্ট বলে স্বীকার করা হয়েছে, কিন্তু কর্মের আবরণে জীবের শুদ্ধ চৈতন্যরূপ আচ্ছাদিত থাকে।
এই জ্ঞান (knowledge) দুই প্রকার- প্রত্যক্ষপরোক্ষ
প্রত্যক্ষ জ্ঞানের করণ হচ্ছে প্রত্যক্ষ প্রমাণ। আর পরোক্ষ জ্ঞানের করণ দুই প্রকার- অনুমানশব্দ। সুতরাং জৈনদর্শনে প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ ভেদে তিন প্রকার প্রমাণ স্বীকার করা হয়।
প্রত্যক্ষ হচ্ছে সকলের স্বীকৃত প্রমাণ। লোকব্যবহারের দৃষ্টিতে জৈনরা অনুমানকে প্রামাণিক বলে স্বীকার করেন এবং তীর্থঙ্করদের উপদেশবাক্যকে শব্দ প্রমাণ বলে মনে করেন। শব্দের অন্য নাম হচ্ছে আগম
.
অন্যান্য দর্শনের মতোই জৈনমতেও প্রমাণজন্য জ্ঞান দুই প্রকার- পরোক্ষ (mediate) ও অপরোক্ষ (direct, imediate)।
জ্ঞান নিজেকে ও অন্য বস্তুকে প্রকাশ করে। এই জ্ঞান বাধারহিতভাবে উৎপন্ন হলে প্রমাণ (=নিশ্চিত জ্ঞান) বলে বিবেচিত হয়। প্রমেয় বিষয় যে প্রকারে প্রকাশিত হয় সে অনুসারে কোন জ্ঞানকে অপরোক্ষ (=প্রত্যক্ষ) এবং কোন জ্ঞানকে পরোক্ষ বলা হয়।
তবে অন্যান্য দর্শনের সাথে এখানে পার্থক্য হলো, ইন্দ্রিয় ও মনের সহযোগে যে জ্ঞান উৎপন্ন হয় তাকে জৈনমতে পরোক্ষ জ্ঞান বলা হয়, প্রত্যক্ষ নয়। আর আত্মসাপেক্ষ জ্ঞান হচ্ছে অপরোক্ষ।
 .
২.৩.১ : প্রত্যক্ষ জ্ঞান
প্রত্যক্ষ জ্ঞানের উপলব্ধিতে আত্মা স্বয়ং কারণ হয় এবং তার জন্য পদার্থের প্রয়োজন হয় না। বলা হয়ে থাকে, যা কেবল আত্মার যোগ্যতাবশত উৎপন্ন হয়, তার জন্য ইন্দ্রিয় ও মনের সহায়তার প্রয়োজন হয় না। মাণিক্যনন্দীর ‘পরীক্ষামুখসূত্রে’ (২/৩) বিশদকে প্রত্যক্ষের লক্ষণ বলা হয়েছে। (সূত্র: নাস্তিক্য দর্শন পরিচয়/ ড.বিশ্বরূপ সাহা) বিশদ অর্থ বলা হচ্ছে স্পষ্ট, যার প্রকাশের জন্য অন্য কোন প্রতীতীর দরকার হয় না। অর্থাৎ স্পষ্ট যে জ্ঞান তাকে প্রত্যক্ষ বলে।
.
জৈনদর্শনে প্রত্যক্ষ জ্ঞান তিন প্রকার- অবধি, মনঃপর্যায় ও কেবল।
.
(১) অবধি জ্ঞান : অবধি হচ্ছে সীমা। এজন্যে জ্ঞান হচ্ছে অবধিজ্ঞান।  কর্মের বাধা অপসৃত হলে বিশেষ স্থান, কাল পর্যন্ত অবচ্ছিন্ন বস্তুর যে জ্ঞান উৎপন্ন হয় তাকে অবধি জ্ঞান বলে। এই জ্ঞানের দ্বারা দূরস্থ, সূক্ষ্ম ও অস্পষ্ট দ্রব্যের জ্ঞান হয়। নিজের কর্মকে অংশত নষ্ট করলে পর মানুষ এমন শক্তিলাভ করে যে সে দুরস্থ, সূক্ষ্ম বস্তুরও জ্ঞান প্রাপ্ত হতে পারে।
ভবপ্রত্যয় ও গুণপ্রত্যয় ভেদে অবধি জ্ঞান আবার দুই প্রকার। জন্মসিদ্ধ অনুরূপ জ্ঞান হচ্ছে ভবপ্রত্যয় এবং তপস্যা প্রভৃতির দ্বারা আচরণীয় কর্মের কিছু ক্ষয় হলে লব্ধ অনুরূপ জ্ঞানকে গুণপ্রত্যয় বলে। এর মধ্যে দেবতা ও নরকবাসীদের পাখির মতো আকাশে গমনের জ্ঞান হচ্ছে ভবপ্রত্যয়, আর মানুষ ও তির্যক (যারা মানুষের মতো সোজা না হেঁটে বাঁকা হাঁটে এমন বুদ্ধিহীন নিম্নজাতির জানোয়ার) প্রাণীদের গুণপ্রত্যয় হয়।
.
(২) মন-পর্যায়জ্ঞান : যখন মানুষ অন্য ব্যক্তির মনোগত বিষয় জানে তাকে মন-পর্যায় জ্ঞান বলে। মানুষ রাগদ্বেষ প্রভৃতি মানসিক বাধাকে জয় করতে পারলে অন্যের মনোগত ভূত ও ভবিষ্যৎ বিষয়ের পরিষ্কার ও স্পষ্ট জ্ঞান লাভ করতে পারে। এই জ্ঞানের সাথে নৈয়ায়িকদের অলৌকিক প্রত্যক্ষের সাদৃশ্য রয়েছে।
.
(৩) কেবল জ্ঞান : সমস্ত বাধা দূর হয়ে গেলে জীব পূর্ণ ও অনন্ত জ্ঞান লাভ করতে পারে। এই জ্ঞান কেবল মুক্ত জীবের হয়ে থাকে। যে জ্ঞানের জন্য তপস্বীরা তপস্যা প্রভৃতি ক্রিয়াবিশেষ অবলম্বন করে, অন্য সকল জ্ঞানের অসংস্পৃষ্ট অর্থাৎ স্বতন্ত্রভাবে উৎপন্ন সেই স্বয়ং প্রকাশিত নির্বাধ স্পষ্ট জ্ঞানই হচ্ছে কেবল জ্ঞান। জৈনমতে জিন বা তীর্থঙ্কররা এই জ্ঞানের অধিকারী। নিরন্তর কঠোর তপস্যা এবং সম্যগদর্শন, সম্যগজ্ঞান ও সম্যকচরিত্র এই ত্রিরত্নের উৎকর্ষ সাধনের মাধ্যমে ধ্যানের শক্তিতে জ্ঞানের আবরক ঘাতী (=ঘাতীয়) কর্মের ক্ষয় হয়ে চেতনাস্বভাব আত্মার স্বরূপের আবির্ভাবকে কেবল জ্ঞান বলে। এই জ্ঞানের অন্য নাম মুখ্য প্রত্যক্ষ এবং তাকেই মোক্ষের সাধনীভূত তত্ত্বজ্ঞান বলে।
.
আবার অন্যভাবে প্রত্যক্ষ জ্ঞান দুই প্রকার- ব্যবহারিক ও পারমার্থিক।
পারমার্থিক জ্ঞান মন বা বাহ্য ইন্দ্রিয়ের সাহায্য ব্যতীত স্বতন্ত্রভাবে প্রকাশিত হয় এবং তা কর্মজনিত ফল হতে উৎপন্ন হয়। এই জ্ঞানে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের প্রত্যক্ষ সম্বন্ধ থাকে না। কোন ব্যক্তি কর্মজনিত শৃঙ্খল হতে মুক্ত না হলে এজাতীয় জ্ঞান লাভ করতে পারে না।
.
পারমার্থিক জ্ঞান দুই প্রকার- কেবল ও বিকল।
ঘাতীয় ও অঘাতীয় কর্মের ফল হতে মুক্ত হলে নিসর্গত যে পারমার্থিক প্রত্যক্ষ উৎপন্ন হয় তা সমস্ত বিষয়ের প্রমা জ্ঞান হলে তাকে কেবল (বা সকল) জ্ঞান বলে। কেবল জ্ঞান সমস্ত প্রকার জ্ঞানের শ্রেষ্ঠ। আর কোন বিশেষ বিষয়ের সেরূপ জ্ঞান হলে তাকে বিকল জ্ঞান বলে।
এই বিকল পারমার্থিক জ্ঞান দুই প্রকার- অবধি ও মন-পর্যায়।
.
জৈনমতে ব্যবহারিক প্রত্যক্ষ জ্ঞান চার প্রকার- অবগ্রহ, ঈহা, অবায় ও ধারণা।
কোন কিছুকে পৃথক করে যে প্রত্যক্ষ জ্ঞান হয় তাকে অবগ্রহ বলে। যেমন ‘তিনি পুরুষ’, এই জ্ঞান হচ্ছে অবগ্রহ।
এরপর ‘এই ব্যক্তি কি সিলেটি না ঢাকাইয়া’ এরূপ সংশয় হলে ‘এ নিশ্চয়ই সিলেটি’ এধরনের যে জ্ঞান হয় তা হচ্ছে ঈহা। তবে এ জ্ঞান নিশ্চয় নয়, তাকে উৎপ্রেক্ষা বলা হয়।
তারপর তার ভাষা ইত্যাদি জানার ফলে ‘এ হচ্ছে সিলেটি’ এরকম যে জ্ঞান হয় তা হচ্ছে অবায়।
এরপর সেই বিষয়েরই পুনরায় যে জ্ঞান সংস্কারকে উৎপন্ন করে তা হলো ধারণা। এই ধারণার দরুন সেই বিষয়ের স্মরণ বা স্মৃতি হয়। তবে এই চার প্রকার জ্ঞানকে পরোক্ষ মতি জ্ঞানের চারটি স্তর বলা হয়।
.
২.৩.২ : পরোক্ষ জ্ঞান
প্রমেয় বিষয় যে প্রকারে জ্ঞানে প্রকাশিত হয় সে অনুসারে জ্ঞানকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বলা হয়। জৈনদার্শনিক মানিক্যনন্দীর ‘পরীক্ষামুখসূত্রে’ বিশদকে প্রত্যক্ষজ্ঞানের লক্ষণ বলে প্রত্যক্ষ ভিন্নকে পরোক্ষ জ্ঞান বলা হয়েছে। জৈনগ্রন্থ ‘প্রমাণমীমাংসা’তেও অবিশদকে পরোক্ষ বলা হয়েছে। তাতে সম্যগভাবে বিষয়ের নির্ণয় প্রমাণের লক্ষণ হলে অবিশদ অথচ সম্যগভাবে বিষয়ের নির্ণয় হলো পরোক্ষের লক্ষণ। আর এই পরোক্ষ প্রমাণের দ্বারা উৎপন্ন জ্ঞান হচ্ছে পরোক্ষ জ্ঞান। তাই বলা হয়েছে, বিজ্ঞান নিজেকে ও অন্য বস্তুকে প্রকাশ করে। তা যখন সমস্ত বাধারহিতভাবে উৎপন্ন হয় তখন তা নিশ্চিত জ্ঞান। এই নিশ্চিত জ্ঞানকেই প্রমাণ বলে। এবং প্রমেয় বিষয় যে প্রকারে জ্ঞানে প্রকাশিত হয় সে অনুসারে জ্ঞানকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ বলা হয়।
.
জৈনমতে পরোক্ষ জ্ঞান দুই প্রকার- মতি জ্ঞান ও শ্রুত জ্ঞান।
(১) মতি জ্ঞান : ইন্দ্রিয় ও মনের সহায়তায় বিষয়ের যে জ্ঞান উৎপন্ন হয় তাকে মতি জ্ঞান বলে। জ্ঞানের আবরণের ক্ষয় বা উপশম হলে ইন্দ্রিয় ও মনের সহায়তায় তাদের সাথে সংযুক্ত পদার্থের যে যথার্থ জ্ঞান বা মনন তা হচ্ছে মতি। তা হলো মননাত্মক জ্ঞান।
তবে ইন্দ্রিয় ও মনের সংযোগভিন্ন যে জ্ঞান হয় তাকে মতি বলে না। তা হলো জ্ঞানের আবরণ অর্থাৎ জ্ঞানের প্রতিবন্ধক। এই প্রতিবন্ধক তিন প্রকার- মনোগত, ইন্দ্রিয়গত ও বিষয়গত।
মাৎসর্য প্রভৃতি মনোগত প্রতিবন্ধক। কামনা, বাতিক প্রভৃতি রোগ ইন্দ্রিয়গত। বস্তুর সূক্ষ্মত্ব, অন্ধকার প্রভৃতিতে ব্যাপৃত থাকা হচ্ছে বিষয়গত প্রতিবন্ধক।
.
মতি জ্ঞান দুই প্রকার- ইন্দ্রিয়জন্য ও অনিন্দ্রিয়জন্য।
বাহ্য ইন্দ্রিয়ের দ্বারা উৎপন্ন জ্ঞানকে ইন্দ্রিয়জন্য এবং মানস জ্ঞানকে অনিন্দ্রিয়জন্য জ্ঞান বলা হয়।
জৈনমতে মতি জ্ঞানের চারটি স্তর স্বীকার করা হয়েছে। যেমন- অবগ্রহ, ঈহা, অবায় ও ধারণা।
.
অবগ্রহ : বিষয়ের সাথে ইন্দ্রিয়ের সন্নিকর্ষের দরুন উৎপন্ন জ্ঞানের প্রথম স্তর হচ্ছে অবগ্রহ। একে সমুগ্ধ, আলোচন, গ্রহণ ও অবধারণ বলা হয়। অবগ্রহ দুই প্রকার- বিজ্ঞানাবগ্রহ ও অর্থাবগ্রহ। বিজ্ঞানাবগ্রহ হচ্ছে কেবল জ্ঞেয়ের সাথে জ্ঞাতার সম্বন্ধ, আর অর্থাবগ্রহে জ্ঞাতা জ্ঞেয়কে জানা ছাড়াও অনুভব করে।
.
ঈহা : অবগ্রহের পরবর্তী ও মতি জ্ঞানের দ্বিতীয় স্তর হচ্ছে ঈহা। তা হলো বিশেষ আকাঙ্ক্ষা। এই স্তরে আত্মা দৃষ্ট বস্তুর গুণের বা ধর্মের মূল্যায়ন করতে পারে। যেমন কোন শব্দ বা গোলমাল শুনলে কেউ প্রথমে কিসের শব্দ তা বুঝতে পারে না। ‘এই শব্দটি কি শঙ্খের না শৃঙ্গের’ এরকম সংশয় হলে মাধুর্য প্রভৃতি শাঙ্খ ধর্ম উপলব্ধ হলে এবং কার্কশ্যাদি উপলব্ধ না হলে এরূপ অন্বয় ও ব্যতিরেকরূপ পর্যালোচনার মাধ্যমে মতির যে চেষ্টা তা-ই ঈহা।
এই স্তরে জ্ঞাতা শব্দের উৎস জানতে পারে, কিন্তু মতির প্রথম স্তর অবগ্রহে তা থাকে না। এই সংশয়পূর্ণ দ্বিতীয় মতিস্তরের জ্ঞানে বিষয়ের সম্যক নির্ণয় না থাকায় তাকে প্রমাণ বলা যায় না। কিন্তু অনির্ণয়াত্মক বলে অপ্রমাণও বলা যাবে না, কেননা তাতে নিজ বিষয়ের নির্ণয় হয়।
.
অবায় : ‘অব’ উপসর্গের অর্থ দৃঢ়, নিশ্চিত এবং ‘অয়’ শব্দের অর্থ জানা। মতির যে স্তরে জ্ঞাতা বিষয়টিকে নিশ্চিতভাবে জানতে পারে তাকে অবায় বলে। ঈহিত বিষয়ের নির্ণয় হয় এই স্তরে। ঈহাকে স্বীকার করে কোন বস্তুতে ‘এটি শঙ্খের শব্দ, শৃঙ্গের নয়’ এরূপ বিশেষের যে নিরূপণ হয় তা হচ্ছে অবায়। এই স্তরে উদাহৃত শব্দের উৎসস্থানকে নিশ্চিত করতে পারে।
.
ধারণা : এটি হলো মতির অস্তিম স্তর। এই স্তরে জ্ঞাতার অন্তঃকরণে বিষয়ের একটি সামগ্রিক জ্ঞান হতে সংস্কার বা স্মৃতির উৎপন্ন হয়। সুতরাং স্মৃতির হেতু হচ্ছে ধারণা। প্রত্যভিজ্ঞা, প্রত্যক্ষ ও অনুমান পুরোপুরি এই স্তরে অন্তর্গত থাকে।
.
(২) শ্রুত জ্ঞান : যা শব্দ-জ্ঞান হতে উৎপন্ন হয় তাকে শ্রুত জ্ঞান বলে। জ্ঞানের আবরণক্ষয় উপশমিত হলে মতিজনিত যে স্পষ্ট জ্ঞান উৎপন্ন হয় তা হচ্ছে শ্রুতজ্ঞান। নৈয়ায়িকমতে একে নির্বিকল্পক প্রত্যক্ষ জ্ঞান বলা হয়েছে। জৈনমতে এ জ্ঞান ইন্দ্রিয়ের দ্বারা উৎপন্ন হলেও স্বয়ং প্রত্যক্ষ বলে অতীন্দ্রিয়, তা আর ইন্দ্রিয়জন্য জ্ঞানের বিষয় হয় না। সেকারণে এই জ্ঞানকে শ্রুত বলা হয়েছে।
.
মতি জ্ঞান ও শ্রুত জ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য হলো, মতি জ্ঞানের স্থিতি কেবল বিদ্যমান পদার্থে হয়, পরেরটি ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান এই ত্রৈকালিক বিষয়ে হয়ে থাকে।
শ্রুত জ্ঞান দুই প্রকার- অঙ্গবাহ্য ও অঙ্গপ্রবিষ্ঠ।
প্রথমটিতে জৈনশাস্ত্রের জ্ঞান এবং দ্বিতীয়টিতে এ ছাড়া অন্য শ্রুত জ্ঞান অন্তর্গত হয়েছে।
.
যথার্থ জ্ঞান :
এছাড়া অন্যভাবে পরোক্ষ জ্ঞানকে পাঁচ প্রকারে ভাগ করা হয়েছে- স্মৃতি, প্রত্যভিজ্ঞা, তর্ক, অনুমান ও আগম। জৈনমতে এগুলো হচ্ছে যথার্থ জ্ঞান।
.
সংস্কার মাত্র হতে উৎপন্ন জ্ঞানকে স্মৃতি বলে।
পূর্বে দৃষ্ট বস্তুকে দেখে ‘এই সে’ এরূপ যে জ্ঞান হয় তাকে প্রত্যভিজ্ঞা বলে।
পক্ষ ও সাধ্যের ব্যাপ্তি জ্ঞানকে তর্ক বলে। ব্যাপ্তি জ্ঞান দুই প্রকার- অন্বয়ব্যাপ্তি ও ব্যতিরেকব্যাপ্তি।
যে ব্যাপ্তিতে সাধ্যে হেতুর ব্যাপকতা প্রতীত হয় তা হচ্ছে অন্বয়ব্যাপ্তি (affirmative generalization)। যেমন, ‘যেখানে ধূম সেখানে বহ্নি’। ‘পর্বতো বহ্নিমান ধূমাৎ’ এরূপ অনুমানে সাধ্য বহ্নিতে হেতু ধূমের ব্যাপকতা আছে।
আর যে যে অধিকরণে সাধ্যের অভাব থাকে সেই সকল অধিকরণে যে অভাব থাকে সেই অভাবের প্রতিযোগিতাকে ব্যতিরেকব্যাপ্তি (negative generalization) বলে। যেমন, ‘যেখানে ধূম থাকে না সেখানে বহ্নিও থাকে না’।
.
অনুমান : হেতুর দ্বারা সাধ্যের জ্ঞান হচ্ছে অনুমান। এই অনুমান স্বার্থ ও পরার্থ ভেদে দুই প্রকার- স্বার্থানুমান ও পরার্থানুমান।
হেতুদর্শন, ব্যাপ্তিস্মরণ, পরামর্শের দ্বারা যে স্থলে স্বয়ং সাধ্যকে জানে তাকে স্বার্থানুমান বলে। স্বার্থানুমানের বিষয় সাধ্যের সামনে অন্যকে বুঝাবার জন্য পরামর্শী বাক্য হতে জাত (=উৎপন্ন) জ্ঞানকে পরার্থানুমান বলে।  সুতরাং বাক্যাত্মক হচ্ছে পরার্থানুমান। ন্যায়ানুসারী জৈনদের মতে পঞ্চ অবয়বাত্মক বাক্য স্বীকার করা হয়। যেমন- ১.প্রতিজ্ঞা, ২.হেতু, ৩.দৃষ্টান্ত, ৪.উপনয় ও ৫.নিগমন।
.
তবে জৈনাচার্য ভদ্রবাহুর মতে দশ অবয়বাত্মক বাক্যের প্রয়োগ করা হয়। যেমন- ১.প্রতিজ্ঞা, ২.প্রতিজ্ঞাবিভক্তি, ৩.হেতু, ৪.হেতুবিভক্তি, ৫.বিপক্ষ, ৬.বিপক্ষপ্রতিষেধ, ৭.দৃষ্টান্ত, ৮.আশঙ্কা, ৯.আশঙ্কাপ্রতিষেধ ও ১০.নিগমন।
.
শব্দ বা আগম : ন্যায় ও মীমাংসা দর্শনের মতো জৈনদর্শনে আগম নামে শব্দ প্রমাণ স্বীকার করা হয়েছে। জৈন দার্শনিক মানিক্যনন্দীর ‘পরীক্ষামুখসূত্রে’ (৩/৯৯) বলা হয়েছে, আপ্তবাক্য হস্তসঙ্কেত প্রভৃতি হতে উৎপন্ন বিষয়ের জ্ঞান হচ্ছে আগম। জৈনরা বেদকে অপৌরুষেয় বলে স্বীকার করেন না এবং সেরূপ বেদবাক্যের প্রামাণ্যও স্বীকার করেন না। তবে তীর্থঙ্করদের উপদেশে বিশ্বাস করেন।
তাদের মতে শব্দ ও অঙ্গের মধ্যে প্রতিপাদ্যপ্রতিপাদকভাব নাম স্বাভাবিক যোগ্যতা থাকায় স্পষ্টতই শব্দ প্রভৃতি বস্তুর প্রতিপাদক হেতু। জৈনরা অন্বিতাভিধানবাদ বা অভিহিতান্বয়বাদ স্বীকার করেন। তাঁদের মতে, প্রকৃতি প্রভৃতির অন্বিতাভিধানে কিংবা অভিহিত পদগুলির অন্বয়ে পদার্থের প্রতিপত্তি (=জ্ঞান) হয়ে থাকে।
জৈনমতে আগম দুই প্রকার- লৌকিক ও অলৌকিক।
.
২.৩.৩ অযথার্থ জ্ঞান
জৈনমতে জ্ঞানকে আবার দুই ভাগে ভাগ করা হয়- যথার্থ ও অযথার্থ।
অবধি, মনঃপর্যায়, কেবল, মতি ও শ্রুত ভেদে যথার্থ জ্ঞান পাঁচ প্রকার, যা ইতঃপূর্বে আলোচিত হয়েছে।
অন্যদিকে অযথার্থ জ্ঞানের মধ্যে রয়েছে তিনটি ভেদ- সংশয়, বিপর্যয় ও অনধ্যবসায়।
সুতরাং জৈনমতে এভাবে জ্ঞান মোট আট প্রকার।
.
যাতে যা নেই তাতে তার জ্ঞান, অথবা যা যেরূপ নয় তাকে সেভাবে জানা হচ্ছে অযথার্থ জ্ঞান। এই জ্ঞানকে কেউ কেউ অপ্রমা বা মিথ্যা জ্ঞানও বলেন। জৈনমতে স্মৃতি যথার্থ হয়, কিন্তু ন্যায়ে অযথার্থ স্মৃতিও স্বীকৃত।
.
সংশয় : একই সাথে উভয় কোটিস্পর্শী প্রত্যয় হচ্ছে সংশয়। যেমন অন্ধকারে দূর থেকে উর্ধ্বাকার কোন বস্তুকে দেখে সাধক ও বাধক প্রমাণের অভাব হলে ‘এটি স্থাণু (নির্জীব বস্তু) বা পুরুষ’ এরূপ প্রত্যয় হয়। তাতে সংশয়ের নিরাকরণের জন্য জৈন স্যাদবাদের অনেকান্তিক যুক্তিতে ‘ঘট আছে ও নেই’, ‘আত্মা নিত্য ও অনিত্য’ ইত্যাদি ভঙ্গিও প্রয়োগ করা যায় না।
.
বিপর্যয় : যে বস্তুতে যা নেই তাতে তার জ্ঞান বা যে যা নয় তাকে সেরূপে জানা হচ্ছে বিপর্যয়। নামান্তরে তাকে ভ্রম বা বিপর্যাসও বলা হয়। যেমন নৌকাভ্রমণে বৃক্ষগুলি স্থির থাকলেও ছুটছে বলে জ্ঞান, দ্রুত ভ্রমণজনিত অলাত (কুমারের চক্র) প্রভৃতিতে চক্র না থাকলেও চক্রের জ্ঞান ইত্যাদি। ন্যায়মতে একে অন্যথাখ্যাতি বলা হয়।
.
অনধ্যবসায় : বিশেষের অনুল্লেখী হচ্ছে অনধ্যবসায়। দূর, অন্ধকার প্রভৃতির দরুন অসাধারণ ধর্মের প্রশ্নমূলক অনিশ্চয়াত্মক প্রত্যয় হলো অনধ্যবসায়। যেমন ‘এটি কী ?’ অন্যেরা প্রত্যক্ষ প্রমাণজন্য জ্ঞান মনে করলেও অনির্দেশ্যতার কারণে এটি অনধ্যবসায়, কেননা এখানে বিশেষের উল্লেখ হয় না। বৈশেষিক দর্শনেও এরূপ অনধ্যবসায় নাম অবিদ্যা (=অযথার্থ জ্ঞান) স্বীকৃত হয়েছে। এই জ্ঞান ঔদাসীন্যের দরুন উৎপন্ন হয়।

(চলবে…)
(ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

[পর্ব-০৩: জৈনদর্শন- স্যাদবাদ বা সপ্তভঙ্গিনয়] [*] [পর্ব-০৫: জৈনতত্ত্বে দ্রব্যের স্বরূপ]

No comments: