Thursday, March 29, 2012

| ছোটদের গল্প… | হাওয়াই মিঠাই |

 .
| ছোটদের গল্প… | হাওয়াই মিঠাই |
-রণদীপম বসু
সপাং করে পিঠের ওপর জালিবেতের তীব্র বাড়িটা পড়তেই শার্টের নিচে চামড়াটা যেন ঝলসে উঠলো অপুর ! অবিশ্বাস্য চোখে রহমান স্যারের এমন ভয়ঙ্কর মূর্তি দেখে শিউড়ে ওঠলো সে। বড় বড় চোখ দুটো ডিমের মতো ঠেলে বেরিয়ে আসছে তার ! চতুর্থ শ্রেণীর কাস টিচার রহমান স্যারের এমন উগ্র রূপ আগে কি কখনো দেখেছে সে ! কিছুতেই মনে করতে পারলো না।
.
অপু’র মনটা আজ এমনিতেই ভীষণ খারাপ। ঠিক দু’দিন আগেই তার বাবা বিয়ে করে বাসায় একজন নতুন মা এনেছেন। নতুন মা’র মুখটা একবার দেখেই এক অজানা বিস্ময় নিয়ে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়েছিলো সে। বাবা বলছিলেন- ইনি তোমার মা, এখন থেকে তাঁকে মা বলে ডাকবে। সে কোন জবাব দিয়েছিলো কিনা মনে নেই। কিন্তু এবছর কলেজে ভর্তি হওয়া জেদি ভাইয়াটা চোখমুখ লাল করে কোন জবাব না-দিয়ে সামনে থেকে সরে গিয়েছিলো, আর বাবাও ওর চলে যাওয়ার দিকে কিরকম করে যেন তাকাচ্ছিলেন। গতকাল অনেক আলোকসজ্জা করে বাসায় যে অনুষ্ঠানটা হলো, সেখানে কতো লোকজন এলো, খাবার দাবার চলছিলো। সবাই কীরকম হাসি-ঠাট্টা করছিলো, কিন্তু অপু’র শুধুই কান্না পাচ্ছিলো। আর বড় ভাইয়াকেও কোথাও দেখলো না সে।
.
এই উজ্জ্বল আলোয় শুধু শুধু কাঁদতে কি লজ্জা হয় না ! কিন্তু কান্না চেপে রাখলে বুকের ভিতর কোথায় যেন অন্যরকম একটা ভারী ভারী কষ্ট হয়, চোখ দিয়ে শুধু শুধু পানি বেরিয়ে আসে, এরকম কষ্ট আগে সে পায়নি কখনো। এটা কেন হয় তা কাকে যে জিজ্ঞেস করবে তাও বুঝে উঠতে পারলো না। উঠোনে একটা সাজানো উঁচু মঞ্চে নতুন মাকে কিরকম সাজিয়ে যেন বসানো হয়েছে। অনেকগুলো লম্বা লম্বা টেবিল আর চেয়ার বিছিয়ে তাতে সাদা কাপড় পেতে ওখানে যারা খাওয়া দাওয়া করছিলেন, বাবা ঘুরে ঘুরে তা দেখছিলেন, আবার মঞ্চে গিয়ে নতুন মা’র পাশে বসছিলেন। এরকম সাজে বাবাকেও আগে সে কখনো দেখেনি। ভীষণ অচেনা বাবা মনে হচ্ছিলো, আর ভয় ভয় করছিলো তার।
.
গত বছর মায়ের নিথর শরীরটা ঘর থেকে উঠোনে এনে কারা যেন শুইয়ে দিয়েছিলো। তাঁর বুকের উপর আছড়ে পড়ে বড় ভাইয়াটা কী বলে যেন চিৎকার করছিলো। আশ্চর্য ! যে মা একটু উফ শুনলেই কী হয়েছে রে বলে দৌড়ে চলে আসতেন, সেই মা একটু নড়লোও না !  আর পাশেই একটা চেয়ারে বসে লুঙ্গি পরিহিত উদোম বাবা এমন উন্মাদের মতো হাউমাউ করে কাঁদছিলো, জীবনে বাবাকে সেই একবারই কাঁদতে দেখেছে সে। এরা এমন পাগলের মতো এরকম করছিলো কেন অপু এর কিছুই বুঝে ওঠতে পারে নি। কেবল ভয়ঙ্কর অজানা এক আতঙ্কে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। কে যেন ‘এদিকে এসো বাবা’ বলে অপুকে কোলে তোলে পাশের বাড়িতে নিয়ে গেলো। আর কখনোই মাকে দেখেনি সে। বাড়িটা কিরকম ফাঁকা হয়ে গেলো। এরপর কতো কান্নাকাটি করেছে সে। সবাই বলেছে মা বেড়াতে গেছে, শীগ্গিরই ফিরে আসবে। তাকে না-নিয়ে মা বেড়াতে গেছে শুনে তীব্র অভিমান ভর করেছে তার, কতোদিন ভাত পর্যন্ত খায়নি।  কিন্তু মা আর আসে নি। এরপর কিভাবে যেন জেনেছে সে, মা নাকি মারা গেছে। মারা গেলে কেউ ফিরে আসে না, এটাও জেনে গেছে অপু। মা-ও আর আসবে না কখনো।
.
মা’র সাথে অপু যেরকম নেওটা ছিলো, পুলিশের চাকুরে বাবার সাথে তার সেরকম ঘনিষ্ঠতা ছিলো না কখনোই। অধিকাংশ দিনেই বাবাকে সারাদিনই দেখেনি সে। তার ঘুম থেকে ওঠার আগেই বাবা নাকি চলে গেছেন কোথায় অফিসের কাজে, ডিউটিতে। আবার ঘুমোবার আগ পর্যন্তও বাবা অফিস থেকে ফিরেন নি। এটাই ছিলো অপু’র স্বাভাবিক জীবন। মা মারা গিয়েই হঠাৎ সব এলোমেলো হয়ে গেলো। বড় ভাইয়াটাও কীরকম হয়ে গেলো। তার মেজাজেরও কোন আগামাথা রইলো না। এমনিতেই ভাইয়াটা নাকি মেধাবী ও মেজাজি ছিলো। বয়েসে অনেকটা বড় হওয়ায় কথায় কথায় অপু’কে শাসন আর মাস্টারি করার সব দায়িত্ব তাঁর ছিলো। এজন্যে ভাইয়াটাকে একদমই পছন্দ করতো না সে। কিন্তু ভাইয়াটা হঠাৎ কেমন হয়ে যাওয়ায় ওর জন্যেও অপু’র কিরকম একটা কষ্ট হচ্ছে যেন। এ অনুষ্ঠানে ভাইয়াটাকে না-দেখে অপু’র হঠাৎ খুব অভিমানও হতে লাগলো। এদিক ওদিক খুঁজেও তাকে সে কোথাও দেখতে পেলো না। কাকে জিজ্ঞেস করবে সে ?
.
ইচ্ছে হলো বাবাকে জিজ্ঞেস করে। কিন্তু আজকের বাবা যে অন্যরকম বাবা ! তবু এগিয়ে যায় সে। কিন্তু বাবার পাশে ওই নতুন মা-টাকে দেখেই ওর অন্যরকম কষ্টটা বাড়তে থাকে। কারা যেন বলছে- আগের জনের চেয়ে এবারের জন অনেক সুন্দর। শুনেই অপুর মাথায় কী যেন একটা কিলবিল করে উঠে। তার মায়ের মতো এতো সুন্দর মুখ আর একটিও দেখেনি সে। নাকের ডান পাশে ঠোঁটের উপরে কত্তো বড়ো একটা তিল ছিলো মায়ের, ওটার দিকে সে কতোদিন আশ্চর্য হয়ে তাকিয়ে থেকেছে ! এতো সুন্দর তিলও সে দেখেনি আর কারো। রাতের বেলা বারান্দায় চাঁদের আলোতে তাকে কোলে বসিয়ে মা যখন গুনগুন করে রাজকুমার আর রাজকুমারীর গল্প বলতো, কি সুন্দর হয়ে ওঠতো মা’র মুখটা ! মনে হতো কতো দূর থেকে একটা মনকাড়া সুর এসে অপুর চারদিকে ঘুরতে থাকতো আর কেমন একটা ঝিম ধরা ঘুমের মতো তন্দ্রা নেমে আসতো চোখে। মা’র মুখের তিলটাও তখন খিলখিল করে হাসতে থাকতো। ওই চাঁদটাও তার কাছে কী বিচ্ছিরি লাগতো ! আর ওরা বলে কিনা মা সুন্দর ছিলো না ! বুকের ভেতরের ভারী কষ্টটা কিলবিল করে মাথার ভেতরে তার আগুন ধরিয়ে দিলো। আর সহ্য করতে পারলো না সে। হাউমাউ করে কেঁদে উঠেই চিৎকার করতে লাগলো- ওটা পচা ওটা পচা ! পায়ের কাছে পড়ে থাকা ছোট্ট ইটের টুকরোটায় চোখ পড়লো তার, মুহূর্তেই তুলে নিলো হাতে। কিন্তু কিছু বুঝে ওঠার আগেই কে যেন তাকে জড়িয়ে ধরে আড়কোলা করে শূন্যে তুলে ‘বাবার বিয়ে দেখতে নেই বাবু’ বলতে বলতে পাশের বাড়ির দিকে নিয়ে যেতে থাকলো। অপু তখন তার সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করছে- আমাকে ছেড়ে দাও, আমাকে ছেড়ে দাও।
.
পাশের বাড়ির রিনি আপুটা খুব ভালো। একেবারে মা’র মতো আদর করছিলো তাকে। অপু’র কান্না তখন থেমে থেমে গোঙানিতে পরিণত হয়েছে। ভেতর থেকে ভারি কষ্টটা দমকে দমকে বেরিয়ে আসতে চাইছিলো। এবং কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো সে বলতে পারে না। সকালে ঘুম ভেঙে অপু বুঝতে পারলো না সে কোথায়। কয়েক মুহূর্ত পর আবিষ্কার করলো রিনি আপু ঠিক মা’র মতোই অপুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে আছে। খুব ভালো লাগছিলো তার। কী সুন্দর মিষ্টি একটা ঘ্রাণ পাচ্ছে সে। চোখ বড় বড় করে রিনি আপুর ঘুমন্ত মুখের দিকে অপলক চেয়ে থাকলো। এবং হঠাৎ করে তার আবার কষ্ট হতে লাগলো। কাঁদতে ইচ্ছে করছে খুব। ধড়ফড় করে উঠে পড়লো সে, বাসায় যাবে। ততক্ষণে রিনি আপুর ঘুম ভেঙে গেছে।
.
বাসাটাকে একটা ছাড়াবাড়ির মতো লাগছে। গতরাতের অনুষ্ঠানের মালপত্র এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। টুকটুক করে ভেজানো দরজা ঠেলে ঘরে ঢুকলো। দু’ভাই একসাথে এ ঘরে থাকে।  বড় ভাইয়া ঘুমিয়ে আছে এখনো। ডন-বৈঠক করা ভাইয়াটার এ সময়ে ঘুমানোর কথা নয়। ওপাশের রান্নাঘর থেকে কাজের বুয়ার রান্নার ঠুকঠাক শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। পড়ার টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো অপু। বই খাতা কলম পেন্সিল গুছিয়ে নিয়ে কাউকে কিছু না-বলেই স্কুলের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো।
.
বাসা থেকে খুব দূরে নয় স্কুল। কালিবাড়ি থেকে হাছননগরের দিকে চলে যাওয়া সড়কটার পাশ ঘেষেই স্কুল। গত কয়েকদিন স্কুলে আসেনি অপু। স্কুল শুরুর সময় হয়নি, কোন ছাত্রছাত্রীও আসেনি তখনো। একটু আগেভাগেই চলে এসেছে সে। স্কুলের সাইনবোর্ডটার দিকে চেয়ে রইলো কিছুক্ষণ। কালিবাড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সুনামগঞ্জ। স্থাপিত ১৯… ইং। মনে হলো এর আগে গোটা সাইনবোর্ডটা কখনোই পড়া হয় নি তার। ক্লাশরুমগুলো তালাবদ্ধ থাকায় উঁচু বারান্দার একপাশটাতে পা ঝুলিয়ে বসে পড়লো। নিচে মাটিতে একটা বাঁশের পাতলা চ্যাপ্টা কঞ্চির মতো কী যেন পড়ে আছে। এটা দিয়ে অনেককেই খেলতে দেখেছে অপু। কিছু কাঁকড় আর ছোট ছোট পাথরের টুকরোসহ ওটা কুড়িয়ে নিলো। এরপর বারান্দায় বসে এক হাতে বাঁশের কঞ্চির গোড়ায় ধরে অন্যহাতের দু’আঙুলে কঞ্চিটার উপরভাগে কাঁকর বা পাথর টুকরো চেপে ধরে পেছনদিকে কঞ্চিটাকে টেনে বাঁকিয়ে হঠাৎ ছেড়ে দিলো সামান্য দূরের কোন নিশানা লক্ষ্য করে। গুলতি ছোঁড়ার মতোই পাথরটুকরোটা সজোরে ছুটে গেলো সেদিকে। স্কুলের দুষ্টু ছেলেদেরকে এভাবে খেলতে দেখেছে সে।  আজ অপুও তা দিয়ে নিশানা করতে লাগলো। সবকটা নিশানা লক্ষ্যভ্রষ্ট হলেও আনমনে করে যেতে থাকলো। হঠাৎ দূর থেকে টুংটাং ঘণ্টার মৃদু শব্দে সচকিত হলো।
.
অপুর বয়সী মলিন চেহারার ছেলেটা হাওয়াই মিঠাই ভর্তি একটা বড় টিনের বাক্স ঝুলিয়ে এদিকে আসছে। বাক্সটার সামনের চওড়া দিকটায় একটা স্বচ্ছ গ্লাস লাগানো।  ওখান দিয়ে অনেকগুলো গোল গোল ক্রিকেট বলের সাইজের লাল টুকটুকে হাওয়াই মিঠাই থরে থরে সাজানো দেখা যাচ্ছে। কিছুদিন আগেও এক বুড়ো চাচা স্কুলের আঙিনাটার ওই পাশে একটা বড়ো মতো গোলাকার অদ্ভুত বাক্স নিয়ে বসতো। ওটা ছিলো হাওয়াই মিঠাই বানানোর যন্ত্র। বাক্সটার মধ্যে একটা প্লেটের মতো চাকতির মাঝখানে ছোট্ট বাটির মতো একটা পাত্র ছিলো। আর চাকতিটার নিচে একটা জ্বলন্ত বাতি ছিলো। বাতির আগুন চাকতিটাকে গরম করতো আর ছোট্ট পাত্রটাতে লালরঙের চিনি দিতেই ওগুলো গলতে শুরু করতো। বাক্সটার এক পাশে একটা বাঁকানো হ্যান্ডেল ছিলো। হ্যান্ডেলটা ঘুরালেই চাকতিটা ঘুরতে থাকতো আর চাকতি থেকে লাল লাল রস ছিটকে বাক্সটার গোলাকার দেয়ালে মাকড়সার জালের মতো জাল তৈরি হতে থাকতো। এরপর লোকটি ওই জালটাকে হাত দিয়ে তুলে কিভাবে দুএক প্যাঁচ দিয়েই হাওয়াই মিঠাইয়ের একেকটা বল বানিয়ে ফেলতো। গরম গরম ওই মিঠাই খেতে লোকটির চারপাশে ভীড় জমে যেতো। এই ছেলেটি অবশ্য বানানো হাওয়াই মিঠাই নিয়েই এসছে।  ইতোমধ্যে স্কুলে বেশ কিছু ছাত্র-ছাত্রী এসে গেছে এবং এদিক ওদিক দৌড়াদৌড়ি করছে। অন্যদিন হলে অপুও হয়তো তাই করতো। মিঠাই বিক্রেতা ছেলেটিকে দেখে কেউ কেউ এগিয়ে গেলো। হঠাৎ খেয়াল হলো অপুর খুব খিদে পেয়েছে।
.
অপুও এগিয়ে গেলো। কিন্তু তার পকেটে যে কোন টাকা নেই। সে ছেলেটিকে বললো- এই আমাকে দুইটা হাওয়াই মিঠাই দাও, তোমাকে পরে টাকা দেবো। বাকী নাই !- ছেলেটির এমন তাৎক্ষণিক উত্তরে সে থতমত খেয়ে গেলো। আশেপাশের অন্যান্য ছাত্রছাত্রীদের সামনে এভাবে আচানক অপদস্ত হয়ে অপুরও জিদ চেপে বসলো- আমাকে দে বলছি, তোকে পরে টাকা দিয়ে দেবো ! না,- ছেলেটির স্পষ্ট উত্তর। এরপর কী করবে অপু জানে না। ঠাশ করে শব্দ হলো একটা ! ঝনঝন শব্দে গ্লাসটা টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়লো মাটিতে। স্তব্ধ হয়ে গেলো সবাই, অপু নিজেও। কখন যে অপু হাওয়াই মিঠাই বাক্সের ওই গ্লাসটাকে তার বাঁশের কঞ্চি ছোঁড়া পাথরের নিশানা বানিয়ে ফেলেছে সে নিজেই জানে না ! ছেলেটিও উবু হয়ে দেখতে গিয়ে কাত হয়ে পড়া বাক্স থেকে সবকটা হাওয়াই মিঠাই গড়িয়ে নিচের ধূলোমাটিতে পড়ে গেলো। হাউমাউ করে চিৎকার করে ওঠলো ছেলেটি। ভয় পেয়ে অন্য ছাত্র-ছাত্রীরা দৌড়ে ক্লাশরুমে ঢুকে পড়লো। অপুও তাই করলো। ক্লাশরুমের দরজা দিয়ে দেখলো কেবল, ছেলেটি মাটিতে পড়ে যাওয়া কাচের টুকরো আর মিঠাইগুলো কুড়িয়ে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে যেদিক থেকে সে এসেছিলো সেদিকেই চলে গেলো।
.
মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো তার। যা সে পছন্দ করে না সেসবই একে একে ঘটে যাচ্ছে। খুব ভয় হতে লাগলো অপু’র। এবং টের পেলো তার শরীরটা থর থর করে কাঁপছে। ক্লাশ শুরুর ঘণ্টা পড়ে গেছে এবং কাশ টিচার রহমান স্যার ক্লাশে ঢুকে যথারীতি রোল কলও শুরু করেছেন। কিন্তু অপুর কাঁপুনি থামছে না। এর মধ্যেই ক্লাশের বাইরে নারী কণ্ঠের চেচামেচি শুনা গেলো। হেডস্যারের বাজখাই গলার আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছে। একটু পরেই অপুদের ক্লাশরুমের দরজায় হেডস্যার এবং তাঁর পেছনে একজন লিকলিকে দুর্বল মহিলা ও সেই ছেলেটিকে দেখা গেলো। ছেলেটি এই রুমটাকেই আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে। হেডস্যারের ইশারায় রহমান স্যারও বেরিয়ে গেলেন। এবং কিছুক্ষণ পর একাই ফিরে এলেন। কিন্তু তাঁর চেহারাটা থমথমে।
.
প্রত্যেক দিন রহমান স্যার ক্লাশে ঢুকে রোল কল সেরে প্রথমেই একটা কৌতুক বলতেন, আর ক্লাশ জুড়ে যখন হাসির রোল পড়ে যেতো তখনই ‘চুপ করো সবাই’ বলে একটা ধমক দিয়ে হট্টগোল থামিয়ে দিতেন। ক্লাশের সবাই বুঝতো ওটা আসলে স্যারের আসল ধমক নয়। তাই কেউ ওই ধমকটাতে ভয় পেতো না, বরং মজাই পেতো। কিন্তু কালচে লকলকে একটা বেত হাতে আজকের থমথমে রহমান স্যারকে কেউ দেখেনি আগে। স্যারের গমগমে কণ্ঠেও কেউ সেই আদরের রেশ খুঁজে পেলো না- ছিঃ ছিঃ ! কে এই কাজ করেছিস বলে ফেল্ ! নইলে আজ সবক’টার চামড়া তুলে ফেলবো ! সারা ক্লাশ জুড়ে পিনপতন নিস্তব্ধতা। সবার চোখে ভয়ার্ত চাউনি। অপু’র শরীরটা বুঝি পাথর হয়ে গেছে ! সেই কাঁপুনিটা নেই, কিন্তু শরীরটা বুঝি একটুও নড়ানোর সাধ্য নেই তার। গলাটা শুকিয়ে কেমন ফাঁকা হয়ে গেছে, কোন শব্দ করার শক্তিও নেই ওতে। চোখের সামনে সবকিছু সাদা হয়ে যাচ্ছে, কতকগুলো জোনাকির ঝিলমিল দেখছে শুধু। কানটা ঝাঁ ঝাঁ করছে, তবুও রহমান স্যারের ভারী গলা শুনা যাচ্ছে- আমি এক থেকে পাঁচ পর্যন্ত গুণবো। কে করেছিস এর মধ্যে যদি না বলিস তাহলে একপাশ থেকে শুরু করবো বেতানো, দেখি না-বলে কিভাবে থাকিস ! বলেই তিনি ডায়াস থেকে নেমে ডানদিকের সামনের বেঞ্চের দিকে আগাতে আগাতে শুরু করলেন গোণা- এ…ক, দু…ই…!
.
স্যারের বলা সংখ্যাগুলো তখন ক্লাশরুমের দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হয়ে ভয়ঙ্কর শব্দে গোটা কক্ষে ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। তি…ন ! ততক্ষণে ডানদিকের বেঞ্চ থেকে হাউমাউ কান্না আর চিৎকার শুরু হয়ে গেছে- আমি না স্যার… আমি করি নাই স্যার… আমি জানি না স্যার…। গোটা ক্লাশে তখন ভয়ার্ত কান্নার রোল। স্যারের চোখ রাগে কটমট করছে। বাজ পড়ার মতো শব্দ হলো- চা…র ! ততক্ষণে স্যার ডানদিকের বেঞ্চটার কাছে পৌঁছে গেছেন। চিৎকারের শব্দ আরো বেড়ে গেছে তখন। এবং হঠাৎ করে সমস্ত শব্দ থেমে গেলো একসাথে। সারা ক্লাশের ভয়ার্ত চোখ রুমের প্রায় মাঝামাঝি বেঞ্চটাতে আটকে গেছে। উদ্ভ্রান্তের মতো ডান হাতটা উপরে তোলে দাঁড়িয়ে আছে অপু। কিন্তু মুখ দিয়ে তার কোন শব্দ বেরোচ্ছে না।
.
সপাং করে পিঠের ওপর জালিবেতের তীব্র বাড়িটা পড়তেই শার্টের নিচে চামড়াটা যেন ঝলসে উঠলো অপুর ! উহ্… হিইইই… করে আশপাশ থেকে কয়েকটা তীক্ষ্ণ কান্নার শব্দ করলো কারা যেন। কিন্তু অপু’র মুখ দিয়ে কোন শব্দই বেরুলো না। বড় বড় স্থির চোখ দুটো ডিমের মতো ঠেলে বেরিয়ে আসছে। প্রচণ্ড ব্যথা করছে চোখে। তার সামনে এখন আর রহমান স্যার নেই, কোত্থেকে যেন মা’র মুখটা এগিয়ে আসছে তার দিকে। ওইতো তিলটা দেখা যাচ্ছে মা’র। কিন্তু ওটা হাসছে না কেন আজ ! বুকের ভেতরে একটা পাথর গড়িয়ে যাচ্ছে বুঝি। ভেতরের সেই অন্যরকম কষ্টটা লিকলিক করে বাড়তে লাগলো। সপাং করে আরেকটা বাড়ি পড়লো। এবারেরটা পড়লো ঠিক কষ্টগুলোর উপর। মুহূর্তেই একটা বিদ্যুৎ ছড়িয়ে গেলো অপুর সারা শরীরে। এবং চোখ দুটো হঠাৎ করে হালকা হয়ে এলো। জল থৈথৈ চোখে মা’র মুখটা কীকরে যেন রহমান স্যারের মুখ হয়ে গেলো ! কী অদ্ভুত চোখে তাকিয়ে আছেন রহমান স্যার। হঠাৎ করেই স্যার ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। এবং বলতে লাগলেন- জানিস কী করেছিস তুই ! ওই ছেলেটা তোরই বয়েসী। তোর মতো তারও তো স্কুলে পড়ার কথা ছিলো। কিন্তু পিতৃহীন ছেলেটাকে দুই গ্রাস ভাতের জন্যে, রুগ্ন মা’টার চিকিৎসার জন্যে সারাটাদিন না-খেয়ে না-দেয়ে ওই ক’টা হাওয়াই মিঠাই বিক্রি করে পয়সা জুটাতে হয়। বিক্রি হলে তবে সামান্য চাল আর ঔষধ নিয়ে ওকে ওর ভাঙা বস্তিঘরটায় ফিরতে হয়। বল তো এখন কী করে খাবে ও, কী করে তার মায়ের ঔষধ কিনবে ? সবই তো নষ্ট করে দিয়েছিস তুই ! তোর তো কতো কিছু আছে, ওর কী আছে বল্ ! …কথাগুলো ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে তীরের ফলার মতো একে একে বিঁধতে লাগলো অপুর বুকে।
.
কথারা এমন তীব্র আর কষ্টের হতে পারে, অপু কি জানতো আগে ! স্যারের বেতের আঘাতে তো এরকম কষ্ট পায়নি সে ! কিন্তু স্যারের কথাগুলো সে সহ্য করতে পারছে না কেন ! তার বুকের ভেতর থেকে কী যেন দলা পাকিয়ে গলা দিয়ে বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে। গোঙানির মতো গো গো শব্দ বেরোতে লাগলো। কিছু বলতে চাচ্ছে সে, কিন্তু বলতে পারছে না। এবং অকস্মাৎ আমার ভুল হয়ে গেছে স্যার… আর কখনো এমন করবো না স্যার … বলতে বলতেই গোটা শরীর ঝাঁকুনি দিয়ে হু হু করে তীব্র এক বাধভাঙা বন্যা নেমে এলো অপুর চোখে-মুখে। শরীরটা তার অস্বাভাবিক রকমে কাঁপছে। স্যার আরো কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রাখলেন তাকে। এদিকে ক্লাশ জুড়ে তখন এদিক-ওদিক নাক টানার ফুৎ-ফাৎ শব্দ। অপুর কান্নার বেগ কমে এলে স্যার তাকে ছেড়ে দাঁড়ালেন এবং ক্লাশের সবগুলো মুখের দিকে বার কয়েক তাকিয়েই হুঙ্কার ছাড়লেন- কিরে, সব ক’টার কি সর্দি হলো নাকি ! চুপ, কোন শব্দ নাই ! রহমান স্যারের সেই পুরনো ধমক। এরপরই ‘আয় আমার সাথে’ বলেই অপুকে হাতে ধরে ক্লাশ থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন।
.
বারান্দায় পা দিয়েই অপুর চোখে পড়লো হেডস্যারের পাশে বড় ভাইয়া দাঁড়িয়ে। স্কুলের আঙিনা পেরিয়ে ওদিকে সেই ছেলেটি তার মায়ের হাত ধরে ফিরে যাচ্ছে। একদৃষ্টিতে সে তাকিয়ে রইলো সেদিকেই। বুকের ভেতর আবারো কষ্ট হতে লাগলো। ‘কিরে, কাউকে না বলে-কয়ে বাসা থেকে এভাবে চলে এলি যে !’ বড় ভাইয়ার প্রশ্নে সম্বিৎ ফিরে পেলো অপু। উশকোখুশকো চেহারায় ভাইয়াটা কেমন আশ্চর্য চোখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। অপুর হঠাৎ কী যেন হয়ে গেলো, ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে এক করুণ আর্তি বেরিয়ে এলো- ‘আমি রিনি আপুর কাছে যাবো !’ অপুর কথায় চমকে ওঠে ভাইয়ার চোখ দুটো কেমন ছলছল করতে থাকলো।

(২৬ মার্চ ২০১২)

[ sachalayatan
...

No comments: