Thursday, March 29, 2012

| ছোটদের গল্প…| চিণ্টু মামা |

 .
| ছোটদের গল্প…| চিণ্টু মামা |
-রণদীপম বসু


‘বুঝলি, মামা ছিলেন খুবই মজার মানুষ। আর সবচে মজার বিষয় হলো, তিনি কোন মজাই করতে পারতেন না !’ বলেই একটু থামলেন। এরপর দীপ্ত’র দিকে চেয়ে বলে উঠলেন- ‘কিরে, এমন হ্যাবলার মতো তাকিয়ে আছিস কেন ?’
.
এমন জট পাকানো কথা শুনলে হ্যাবলা না হয়ে উপায় আছে ! চিণ্টু মামার কথা শুনে দীপ্ত’র অবস্থাও তাই। কিন্তু ফাজিল টুম্পি’টার সামনে তাকে হ্যাবলা বলাটা মামার কিছুতেই ঠিক হয় নি। এতে সে অপমান বোধ করেছে। সে যে হ্যাবলা না, বরং মামার বক্তব্যটাই জট পাকানো সেটা বোঝাতে দীপ্ত বলে ওঠলো- ‘তুমি কী বললে মামা ? আবার বলো তো ?’
.
মামা কিছু বলার আগেই টুম্পিটা ফিক ফিক করে ওঠলো- ‘আমি বুঝেছি মামা !’
দীপ্ত’র ইচ্ছা হলো এক্ষুনি টুম্পিটার গালে ঠাশ করে একটা চড় বসিয়ে দেয়। আদব-কায়দা কিছু তো জানেই না, বড়দের কথার উপর ফট ফট করে কথা বলার অভ্যাস ! কিন্তু চড় কশলে হৈ হৈ করে কেঁদে কেটে সারা বাড়িটা এমন মাথায় তুলবে যে, আম্মু বা বড় আপাকে কিছুতেই বোঝানো যাবে না এখানে দীপ্ত’র কোন দোষই নেই।
.
‘তোমার মামা যে একটুও মজা করতে পারতেন না, এইটা তোমার কাছে খুব মজার ছিলো, তাই না মামা ?’
টুম্পির কথা শেষ হতে না হতেই মামা তাঁর গোল গোল চোখ দুটোতে আশ্চর্য চমক এনে বলে ওঠলেন- ‘দেখেছিস দেখেছিস, কেমোন পাকনা মেয়ে !’
দীপ্ত বেশ গম্ভীর হয়ে বসে আছে। কারণ সে এসব পাকামি পছন্দ করে না। কিন্তু মামা সেদিকেই গেলেন না। মামার এই বিষয়টাকে দীপ্ত একদমই পছন্দ করে না। খুব রাগ হয় তার। মামা বলে চলেছেন- ‘ওই যে তোদের কিছু শিশু অধিকার আছে না ? ওগুলোতে মামা একদমই বিশ্বাস করতেন না।’
‘কেন ?’ সমস্বরে চেঁচিয়ে ওঠলো দুজনেই। দীপ্ত’র মনেই ছিলো না যে সে খুব গম্ভীর হয়ে ছিলো। সে আর কিছু বলার আগে টুম্পিই ফের বললো- ‘তোমার মামাটা খুব পচা ছিলেন ?’
.
এতোক্ষণে টুম্পি একটা ভালো কথা বলেছে। এই সুবাদে তার আগের সব অপরাধ মাফ করে দিলো দীপ্ত। কিন্তু সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না, চিণ্টু মামা তাহলে তাঁর ওই মামাটাকে এতো পছন্দ করতেন কেন ? আবারো জট পাকিয়ে যাচ্ছে সব। তাই প্রশ্ন না করেও থাকতে পারলো না- ‘তোমার ওই পচা মামাটা কেন এগুলো পছন্দ করতো না ?’
প্রথমে টুম্পি এরপর দীপ্ত’র চোখের দিকে চেয়ে মামা-ই প্রশ্ন করলেন এবার- ‘তোরা কি বলতে পারবি শিশু অধিকারগুলা কী ?’
.
দীপ্ত’র চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠলো। এবার তার শ্রেষ্ঠত্ব ও জ্যেষ্ঠত্ব দেখানোর একটা মোক্ষম সুযোগ এসেছে। কেননা ইস্কুলের পাঠ্য হিসেবে পরীক্ষার জন্য তাকে সবগুলো শিশু অধিকার মুখস্ত করতে হয়েছে। টুম্পির এগুলো সেইভাবে জানার কথা নয়। তাই আর মুহূর্ত দেরি না করেই সে তার শ্রেষ্ঠত্ব দেখাতে পটাপট বলা শুরু করলো-
শিশু অধিকারগুলো হচ্ছে এক নম্বরে স্নেহ ও ভালোবাসা পাওয়ার অধিকার, দুই নম্বরে একটি নাম ও জাতীয়তার অধিকার, তিন নম্বরে পুষ্টি ও চিকিৎসার অধিকার, চার নম্বরে খেলাধূলা ও বিনোদনের অধিকার, পাঁচ নম্বরে শিক্ষার অধিকার, ছয় নম্বরে ছেলে ও মেয়ে শিশুর সমান অধিকার, সাত নম্বরে আদব কায়দা, ভদ্রতা, চরিত্র গঠন ইত্যাদি নৈতিক শিক্ষা লাভের অধিকার…
‘হয়েছে হয়েছে।’
.
মামার কথায় বলা থামিয়ে বেশ তৃপ্ত ভঙ্গিতে মামার দিকে চেয়ে রইলো সে। মামা বললেন- ‘এই যে এতগুলো অধিকারের কথা বললি, এগুলো কে দেবে তোদেরকে ?’
তাই তো ! হঠাৎ করে বিষয়গুলো তাদের বোঝার সাধ্যের চাইতেও জটিল মনে হলো। মামার দিকে নিরুত্তর চেয়ে রইলো ওরা।
.
‘মামা বলতেন- শিশুরা ওগুলো কেন চাইবে ! কেন চাইতে হবে তাদেরকে ? তাদের মাথায়ই বা কেন এগুলো আসতে হবে ?’
দীপ্ত ও টুম্পি খুব মনোযোগ দিয়ে মামার কথা শুনছে। কিন্তু নিরুত্তর। কথার মুডে উঠে গেলে চিণ্টু মামাটা কিরকম যেন হয়ে যান। তখন আর তাঁর কথাগুলো সহজে বুঝা যায় না। কথায় কোন ছেদ না টেনে মামা বলে যাচ্ছেন- ‘ মামা বলতেন, এগুলো চাওয়ার জিনিস নারে, এগুলো দেয়ার জিনিস। যাদের দেয়ার দায়িত্ব, এগুলো তো তাদের মুখস্ত করার কথা, তোদের না ! এজন্যেই মামা তা বিশ্বাস করতেন না।’
.
বড় অদ্ভুত কথা ! এর আগে তো এভাবে কেউ বলেনি এদের। কোথাও শুনেও নি এরা। মামা’র মামাটাকেও মামা’র মতোই বড় অদ্ভুত মানুষ বলে মনে হতে লাগলো তাদের। এক্ষেত্রে কৌতুহল কি আর দমিয়ে রাখা যায় ! স্বভাব অনুযায়ী টুম্পিটা তার মুরব্বিসুলভ প্রশ্নটা করেই বসলো- ‘আচ্ছা মামা, তোমার মামার ছেলেরা কি এগুলো তোমার মামাকে বলেছে ?’
‘ছেলে আসবে কোত্থেকে রে ? মামা তো বিয়েই করেন নি !’
‘কেন ?’
‘তোরা তো ওসব বুঝবি না, যারা অন্যরকমভাবে চিন্তা করে, অন্যরকম ভাবে, তাদের সহজে বিয়ে হয় না রে।’ বলেই মামা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। তাঁর হাসিখুশি মুখটা কেমন নিরিবিলি গম্ভীর হয়ে গেছে।
.
‘তুমি বিয়ে করো না কেন মামা ?’ আচমকা টুম্পির এমন ইঁচড়েপাকা প্রশ্নে মামা চমকে উঠলেন। এরপর হো হো করে হাসতে লাগলেন।
‘এখনি মামী নিয়ে এলে এই মামা তোদের সাথে গল্প করবে কখন রে !’ বলেই উঠে পড়লেন হঠাৎ। এবং হনহন করে হাঁটা শুরু করলেন। কোথায় যেন যেতে হবে তাঁকে। মামা’র হাঁটাপথের দিকে তাকিয়ে দীপ্ত বা টুম্পির কিরকম কষ্ট হতে লাগলো।  যেদিন মামা এরকমভাবে কখনো বেরিয়ে যান, এরপর কয়েকদিন তাঁর আর কোন পাত্তাই থাকে না। আম্মুটাও কেন জানি তখন তাদের উপর শুধু শুধু বকাঝকা শুরু করে দেয়।

No comments: