Wednesday, March 21, 2012

| চাণক্যজন কহেন : ০৬ | নীতিকথা-০৩ |

.
| চাণক্যজন কহেন : ০৬ | নীতিকথা-০৩ |
-রণদীপম বসু

মাতৃবৎ পরদারেষু পরদ্রব্যেষু লোষ্টবৎ।
আত্মবৎ সর্বভূতেষু যঃ পশ্যতি স পণ্ডিতঃ।। ০৩।। (চাণক্য নীতিশাস্ত্র)।
অর্থাৎ : যে ব্যক্তি পরের স্ত্রীকে মাতৃজ্ঞানে দেখেন, পরের দ্রব্যকে মাটির ঢেলার মতো জ্ঞান করেন (অর্থাৎ নির্লোভ থাকেন) এবং সকল জীবে আত্মজ্ঞান পোষণ করেন- তিনিই যথার্থ পণ্ডিত বা জ্ঞানী।

চমৎকার এই মোহনীয় নীতিবাক্যটি মুগ্ধ হয়ে শুনতে ভালোই লাগে। কিন্তু একটু ভাবতে বসলেই ভিরমি খেতে হয়- পরের স্ত্রীকে মাতৃজ্ঞানে দেখার সাথে যথার্থ পাণ্ডিত্যের বা জ্ঞানের সম্পর্কটা কোথায় ! কেউ কেউ অবশ্য এই নীতিবাক্যের মনোমুগ্ধকর ব্যাখ্যাও দিয়েছেন এভাবে-
‘সমাজে বাস করতে গেলে কতগুলি সামাজিক নিয়মকানুন মেনে চলতে হয়। পরস্ত্রীর প্রতি আকর্ষণ সামাজিক গর্হিত অপরাধ। স্বাভাবিক কামনাবশতঃ সৃষ্ট এইসব প্রবৃত্তিকে প্রশ্রয় দিলে ব্যভিচার হয়, সামাজিক বন্ধন নষ্ট হয়। পরস্ত্রীর প্রতি আকর্ষণ পরিহারের শ্রেষ্ঠ পন্থা হ’ল তাঁকে নিজের মা বলে ভাবা। নিজের মা যেমন ভক্তি শ্রদ্ধার পাত্র- পরস্ত্রীও সেরকমই। এই জ্ঞান এলে সমস্ত অসৎবুদ্ধি দূর হয়- ব্যবহারে কালিমা আসে না। পরের জিনিষের প্রতিও কোন লোভ পোষণ করা উচিত নয়। লোভ মানুষকে অনেক সময় অমানুষ করে তোলে। মাটির ঢেলাকে আমরা যে দৃষ্টিতে দেখি সেই দৃষ্টিতে যদি পরের জিনিষ দেখা যায় তবে আর কোন মোহ আসে না। ফলে তা পাওয়ার বাসনাও লুপ্ত হয়। সকল প্রাণীতে আত্মজ্ঞান যথার্থ পণ্ডিতের লক্ষণ। সকল জীবের সুখ-দুঃখের সঙ্গে নিজের সুখ-দুঃখের অনুভূতির সাম্যজ্ঞান আসলে কখন দুঃখে শোকে অভিভূত হওয়ার প্রশ্ন ওঠে না।’
.
খুবই সুন্দর ব্যাখ্যা নিঃসন্দেহে। তবে এটা একালের ব্যাখ্যা। শ্লোকটি রচিত হওয়ার কালে কি এরকম কোন ব্যাখ্যা রচয়িতার ভাবনায় সক্রিয় ছিলো ? আমরা না-হয় পরে আবার এ ব্যাখ্যায় ফিরে আসবো। কিন্তু সামাজিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় চাণক্য হঠাৎ মানুষের চারিত্রিক কিছু মৌলিক ঝোঁককে যথার্থ পাণ্ডিত্যের সাথে যেভাবে সূত্রাবদ্ধ করে দিলেন, তাতে করে এই সম্পর্কসূত্রটা খোঁজার একটা কৌতুহল জেগে ওঠে বৈকি। সেক্ষেত্রে শ্লোক রচনার সময়টাতে একটু ঘুরে আসা যাক।  এবং এক্ষেত্রে আমাদেরকে অনিবার্যভাবে শাস্ত্রীয় জটিল বিধানের জগতেই ঢু মারতে হবে ফের।
.
প্রশ্নটা যেহেতু পণ্ডিত বা জ্ঞানী বিষয়ক, তাই আমাদের ইতঃপূর্বের (নীতিকথা-০২) আলোচনার সূত্রে এটা অন্তত বুঝা যায় যে, বিতর্কটা একান্তই বিদ্যার জাহাজি ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। যাদের নারী বিষয়ক মনোরঞ্জনের সুযোগ-সুবিধায় পবিত্র শাস্ত্রগ্রন্থে কোন সীমা বেঁধে দেয়া হয় নি বলেই প্রতীয়মান হয়-
সবর্ণাহগ্রে দ্বিজাতীনাং প্রশস্তা দারকর্মণি।
কামতস্তু প্রবৃত্তানামিমাঃ স্যুঃ ক্রমশো বরাঃ।। ৩/১২।। (মনুসংহিতা)।
অর্থাৎ : ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য- এই দ্বিজাতিগণের দারপরিগ্রহ ব্যাপারে সর্বপ্রথমে (অর্থাৎ অন্য নারীকে বিবাহ করার আগে) সমানজাতীয়া কন্যাকেই বিবাহ করা প্রশস্ত। কিন্তু কামনাপরায়ণ হয়ে পুনরায় বিবাহে প্রবৃত্ত হলে (অর্থাৎ সবর্ণাকে বিবাহ করা হয়ে গেলে তার উপর যদি কোনও কারণে প্রীতি না জন্মে অথবা পুত্রের উৎপাদনের জন্য ব্যাপার নিষ্পন্ন না হলে যদি কাম-প্রযুক্ত অন্যস্ত্রী-অভিলাষ জন্মায় তাহলে) দ্বিজাতির পক্ষে ব্ক্ষ্যমাণ নারীরা প্রশস্ত হবে। (পরবর্তী শ্লোকে তা বর্ণিত হয়েছে)
.
শূদ্রৈব ভার্যা শূদ্রস্য সা চ স্বা চ বিশঃ স্মৃতে।
তে চ স্বা চৈব রাজ্ঞশ্চ তাশ্চ স্বা চাগ্রজম্মনঃ।। ৩/১৩।। (মনুসংহিতা)।
অর্থাৎ : একমাত্র শূদ্রকন্যাই শূদ্রের ভার্যা হবে; বৈশ্য সজাতীয়া বৈশ্যকন্যা ও শূদ্রাকে বিবাহ করতে পারে; ক্ষত্রিয়ের পক্ষে সবর্ণা ক্ষত্রিয়কন্যা এবং বৈশ্যা ও শূদ্রা ভার্যা হতে পারে; আর ব্রাহ্মণের পক্ষে সবর্ণা ব্রাহ্মণকন্যা এবং ক্ষত্রিয়া, বৈশ্যা ও শূদ্রা ভার্যা হতে পারে।
একে তৃপ্ত না হয়ে কামনাপরায়ণ হলে যেকোন বর্ণ থেকে পুনঃ পুনঃ নারী গ্রহণের বৈধ উপায় উন্মুক্ত থাকলেও পরস্ত্রীর প্রতি এই বর্ণশ্রেষ্ঠদের কামদৃষ্টি নিক্ষেপ বা পরস্ত্রী-গমন নিশ্চয়ই সম্ভ্রান্ত দোষ হিসেবেই গণ্য হয়ে থাকবে, অপরাধ নয়। অপরাধের জন্য দণ্ডের বিধান থাকে। আর দোষ থেকে পাপ হয়, যা মোচনের জন্য প্রায়শ্চিত্তের প্রয়োজন হয়। 

অকামতঃ কৃতং পাপং বেদাভ্যাসেন শুধ্যতি।
কামতস্তু কৃতং মোহাৎ প্রায়শ্চিত্তৈঃ পৃথগ্বিধৈঃ।। ১১/৪৬।। (মনুসংহিতা)।
অর্থাৎ : অনিচ্ছাপূর্বক যে পাপ করা হয়, তা পুনঃপুনঃ বেদপাঠ দ্বারা ক্ষয় হয়, কিন্তু মূঢ়তাবশতঃ ইচ্ছাপূর্বক যে পাপ করা হয় তা বিশিষ্ট প্রায়শ্চিত্তসমূহের দ্বারাই শুদ্ধ হয়ে থাকে।
 
তবে পরস্ত্রীগমন বিষয়ক পাপগুলো যে পণ্ডিত প্রবরদের জন্য কোন গুরু পাপ নয়, লঘু পাপ, শাস্ত্রীয় বিধানই তা আশ্বস্ত করে-
গোবধোহযাজ্যসংযাজ্য-পারদার্যাত্মবিক্রয়াঃ।
গুরুমাতৃপিতৃত্যাগঃ স্বাধ্যায়াগ্ন্যোঃ সুতস্য চ।। ১১/৬০।। (মনুসংহিতা)।
অর্থাৎ : গোহত্যা, অযাজ্যসংযাজ্য [অযাজ্য অর্থাৎ অবিরুদ্ধ অপাতকী শূদ্র প্রভৃতি, তাদের সংযাজ্য অর্থাৎ যাজন অর্থাৎ পূজা প্রভৃতি ধর্মকর্ম করে দেওয়া], পরস্ত্রী-গমন, আত্মবিক্রয় [অর্থাৎ গবাদি পশুর মতো নিজেকেও পরের দাসত্বে বিলিয়ে দেওয়া], গুরুত্যাগ [অধ্যাপনা করতে সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও নিজের অধ্যাপক-গুরুকে ত্যাগ করে অন্য অধ্যাপকের আশ্রয়-নেওয়া], পতিত না হওয়া সত্ত্বেও মাতাকে ও পিতাকে পরিত্যাগ [তাঁরা যদি পতিত হন তাহলে তাদের ত্যাগ করা শাস্ত্র সম্মত], স্বাধ্যায় অর্থাৎ বেদাধ্যয়ন পরিত্যাগ, অগ্নিত্যাগ অর্থাৎ গৃহ্য বা স্মার্তাগ্নিত্যাগ এবং পতিত নয় এমন গুণবান প্রাপ্তবয়স্ক পুত্রকে ত্যাগ- এগুলি সব উপপাতক।
আর সাথে এটাও জেনে রাখা অনুচিত হবে না যে, ধর্মশাস্ত্রে ব্রাহ্মণের জন্য গুরুতর পাপ বা মহাপাতক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে পাঁচটি বিষয়কে-
ব্রহ্মহত্যা সুরাপানং স্তেয়াং গুর্বঙ্গনাগমঃ।
মহান্তি পাতকান্যাহুঃ সংসর্গশ্চাপি তৈঃ সহ।। ১১/৫৫।। (মনুসংহিতা)।
অর্থাৎ : ব্রহ্মহত্য, নিষিদ্ধ সুরাপান, ব্রাহ্মণের সোনা অপহরণ ও গুরুপত্নীগমন- এইগুলিকে ঋষিগণ মহাপাতক বলেছেন; ঐসব মহাপাতকগ্রস্ত ব্যক্তির সাথে ক্রমিক একবৎসর সংসর্গ করাও মহাপাতক অতএব এই পাঁচটিকে মহাপাতক বলা হয়।
তবে এর চাইতে অধিকতর লঘু পাপ হলো নিচেরগুলো-
রেতঃসেকঃ স্বযোনীষু কুমারীষ্বন্ত্যজাসু চ।
সখ্যুঃ পুত্রস্য চ স্ত্রীষু গুরুতল্পসমং বিদুঃ।। ১১/৫৯।। (মনুসংহিতা)।
অর্থাৎ : সহোদরা ভগিনী, কুমারী অর্থাৎ অবিবাহিত নারী, অন্ত্যজনারী অর্থাৎ চণ্ডালজাতীয়া নারী, সখা এবং পুত্রের স্ত্রী- এদের যোনিতে রেতঃপাত করলে তা গুরুপত্নীগমনতুল্য পাতক বলে বুঝতে হবে। [তবে এগুলো অনুপাতক। মহাপাতকের তুলনায় কম প্রায়শ্চিত্ত হবে।]
যুবক শিষ্যকর্তৃক গুরুপত্নীগমনকে কেন এমন প্রণিধানযোগ্য মহাপাপ হিসেবে বিবেচনা করা হলো সে ব্যাখ্যায় না যাই। বরং বয়োবৃদ্ধ শাস্ত্রগুরুরা এসব পাতকের জন্য উপযুক্ত দণ্ডবিধান না-করে প্রয়োজনীয় প্রায়শ্চিত্তের যে বিস্তৃত বিধান শাস্ত্রগ্রন্থের পাতার পর পাতা জুড়ে রচনা করেছেন, তাতে করে প্রতীয়মান হয়, যে-পাপ পরস্পর সম্মতি সাপেক্ষে নির্বিচার ঘটে চলেছে সম্ভ্রান্ত সমাজদেহের অন্তরালে, তাকে প্রমাণযোগ্য করা যতোটা না জটিল, তার চেয়ে জটিলতর ছিলো হয়তো সমাজপতিদের আত্মগ্লানির মুখোমুখি হওয়ার ভয়াবহ পরিস্থিতি। তাই পাপ আর প্রায়শ্চিত্তের ভীতি আরোপের শাস্ত্রীয় বিধির পাশাপাশি নীতিশাস্ত্রের মাধ্যমে উদ্বুদ্ধকরণই অধিকতর বিজ্ঞ কৌশল হিসেবে গণ্য হয়েছে। পরের স্ত্রীকে মাতৃজ্ঞানে দেখার সাথে পণ্ডিত ব্যক্তির যথার্থ পাণ্ডিত্যের সম্মন্ধসূত্রটা এখানেই হয়তো।
.
কিন্তু যথার্থ পণ্ডিত বা জানীর লক্ষণে পরের দ্রব্যকে মাটির ঢেলার রূপে দেখার আগে আমাদেরকে বোধয় কিছু শাস্ত্রীয় বিভ্রম চেখে আসতে হবে। যেমন-
সর্বং স্বং ব্রাহ্মণস্যেদং যৎ কিঞ্চিজ্জগতীগতম্।
শ্রৈষ্ঠ্যেনাভিজনেনেদং সর্বং বৈ ব্রাহ্মণোহর্হতি।। ১/১০০।। (মনুসংহিতা)।
অর্থাৎ : জগতে যা কিছু ধনসম্পত্তি সে সমস্তই ব্রাহ্মণের নিজ ধনের তুল্য; অতএব সকল বর্ণের মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে ব্রাহ্মণই সমুদয় সম্পত্তিরই প্রাপ্তির যোগ্য হয়েছেন।
.
স্বমেব ব্রাহ্মণো ভুঙ্ক্তে স্বং বস্তে স্বং দদাতি চ।
আনৃশংস্যাদ্ ব্রাহ্মণস্য ভুঞ্জতে হীতরে জনাঃ।। ১/১০১। (মনুসংহিতা)।
অর্থাৎ : ব্রাহ্মণ যে পরের অন্ন ভোজন করেন, পরকীয় বসন পরিধান করেন, পরের ধন গ্রহণ করে অন্যকে প্রদান করেন, সে সবকিছু ব্রাহ্মণের নিজেরই। কারণ, ব্রাহ্মণেরই আনৃশংস্য অর্থাৎ দয়া বা করুণাতেই অন্যান্য যাবতীয় লোক ভোজন-পরিধানাদি করতে পারছে।
এরপরেও পরিতৃপ্তিহীন পোড়াচক্ষে যখন পরের দ্রব্য কিছুতেই মাটির ঢেলায় পরিণত না-হয়ে অপহরণের বস্তু হয়ে যায়, তখন উপায়ান্তর না-পেয়ে হয়তো উপরে উদ্ধৃত শ্লোকে (মনুসংহিতা ১১/৫৫) ব্রাহ্মণের সোনা অপহরণকে মহাপাতক হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। পণ্ডিতেরা তো আর চুরি করেন না, করেন অপহরণ।
.
অন্যদিকে সকল জীবে আত্মজ্ঞান পোষণ কেবল পণ্ডিত কেন, সবার জন্যেই একটা শ্রেষ্ঠ মহৎ গুণ হিসেবে বিবেচিত হওয়া উচিত। শাস্ত্র মানেই তো অতি পবিত্র মহৎ জীবন বিধান। একজন শাস্ত্রবেত্তা গুণী ব্যক্তি  যেসব শাস্ত্রীয় বিধান অধ্যয়ন উপলব্ধির মাধ্যমে আত্মজ্ঞানী পণ্ডিত হয়ে ওঠেন এবং তা তাঁদের জীবনাচরণে কঠোরভাবে মান্য করে থাকেন, মনুশাস্ত্র থেকে তার আর ব্যাখ্যা না-করে কেবল কিছু উদ্ধৃতিই তুলে ধরি। তাহলেই আমাদেরও সম্যক উপলব্ধি হবে চাণক্য কথিত যথার্থ পণ্ডিত ব্যক্তির সকল জীবে আত্মজ্ঞান পোষণের মাহাত্ম্য প্রকৃতই কোন্ পর্যায়ে ছিলো।
এতমেব তু শূদ্রস্য প্রভুঃ কর্ম সমাদিশৎ।
এতেষামেব বর্ণানাং শুশ্রƒষামনসূয়য়া।। ১/৯১।। (মনুসংহিতা)।
অর্থাৎ : প্রভু ব্রহ্মা শূদ্রের জন্য একটি কাজই নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন,- তা হলো কোনও অসূয়া অর্থাৎ নিন্দা না করে (অর্থাৎ অকপটভাবে) এই তিন বর্ণের অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের শুশ্রূষা করা।
.
মঙ্গল্যং ব্রাহ্মণস্য স্যাৎ ক্ষত্রিয়স্য বলান্বিতম্।
বৈশ্যস্য ধনসংযুক্তং শূদ্রস্য তু জুগুপ্সিতম্।। ২/৩১।। (মনুসংহিতা)।
অর্থাৎ : ব্রাহ্মণের নাম হবে মঙ্গলবাচক শব্দ (‘মঙ্গল’ শব্দের অর্থ ‘ধর্ম’; সেই ধর্মের সাধক ‘মঙ্গল্য’; ইন্দ্র, বায়ু প্রভৃতি দেবতাবাচক শব্দ বা ঋষিবাচক শব্দ মঙ্গলের সাধন, তাই ‘মঙ্গল্য’; যেমন- ইন্দ্র, বায়ু, বসিষ্ঠ, বিশ্বামিত্র প্রভৃতি); ক্ষত্রিয়ের নাম হবে বলসূচক শব্দ (যেমন, প্রজাপাল, দুর্যোধন, নৃসিংহ প্রভৃতি); বৈশ্যের নাম হবে ধনবাচক অর্থাৎ পুষ্টিবৃদ্ধিসমন্বিত (যেমন ধনকর্মা, গোমান, ধনপতি প্রভৃতি) এবং শূদ্রের নাম হবে জুগুপ্সিত (নিন্দা বা হীনতাবোধক, যেমন- কৃপণক, দীন, শবরক ইত্যাদি)।
.
ন শূদ্রায় মতিং দদ্যান্নোচ্ছিষ্টং ন হবিষ্কৃতম্।
ন চাস্যোপদিশেদ্ ধর্মং ন চাস্য ব্রতমাদিশেৎ।। ৪/৮০।। (মনুসংহিতা)।
অর্থাৎ : (ব্রাহ্মণ) শূদ্রকে কোন মন্ত্রণা-পরামর্শ দেবে না। শূদ্রকে উচ্ছিষ্ট দান করবে না। যজ্ঞের হবির জন্য যা ‘কৃত’ অর্থাৎ সঙ্কল্পিত এমন দ্রব্য শূদ্রকে দেবে না; শূদ্রকে কোনও ধর্মোপদেশ করবে না এবং কোনও ব্রত বা প্রায়শ্চিত্ত করতেও উপদেশ দেবে না।
.
শূদ্রং তু কারয়েদ্ দাস্যং ক্রীতমক্রীতমেব বা।
দাস্যায়ৈব হি সৃষ্টোহসৌ ব্রাহ্মণস্য স্বয়ম্ভুবা।। ৮/৪১৩।। (মনুসংহিতা)।
অর্থাৎ : ক্রীত অর্থাৎ অন্নাদির দ্বারা প্রতিপালিত হোক্ বা অক্রীতই হোক্ শূদ্রের দ্বারা ব্রাহ্মণ দাসত্বের কাজ করিয়ে নেবেন। যেহেতু, বিধাতা শূদ্রকে ব্রাহ্মণের দাসত্বের জন্যই সৃষ্টি করেছেন।
.
ভার্যা পুত্রশ্চ দাসশ্চ ত্রয় এবাধনাঃ স্মৃতাঃ।
যত্তে সমধিগচ্ছন্তি যস্য তে তস্য তদ্ ধনম্।। ৮/৪১৬।। (মনুসংহিতা)।
অর্থাৎ : স্মৃতিকারদের মতে ভার্যা, পুত্র ও দাস- এরা তিনজনই অধম (বিকল্পে অধন); এরা তিনজনেই যা কিছু অর্থ উপার্জন করবে তাতে এদের কোনও স্বাতন্ত্র্য থাকবে না, পরন্তু এরা যার অধীন ঐ ধন তারই হবে।
.
উচ্ছিষ্টমন্নং দাতব্যং জীর্ণানি বসনানি চ।
পুলাকাশ্চৈব ধান্যানাং জীর্ণাশ্চৈব পরিচ্ছদাঃ।। ১০/১২৫।। (মনুসংহিতা)।
অর্থাৎ : ব্রাহ্মণ উচ্ছিষ্ট অন্ন, জীর্ণ-পরিত্যক্ত বস্ত্র, ধানের পুলাক অর্থাৎ আগড়া (অসার ধান) এবং জীর্ণ পুরাতন ‘পরিচ্ছদ’ অর্থাৎ শয্যা-আসন প্রভৃতি আশ্রিত শূদ্রকে দেবেন।
.
শক্তেনাপি হি শূদ্রেণ ন কার্যো ধনসঞ্চয়ঃ।
শূদ্রো হি ধনমাসাদ্য ব্রাহ্মণানেব বাধতে।। ১০/১২৯।। (মনুসংহিতা)।
অর্থাৎ : ‘ধন অর্জনে সমর্থ হলেও শূদ্রকে কিছুতেই ধন সঞ্চয় করতে দেওয়া চলবে না, কেননা ধন সঞ্চয় করলে ব্রাহ্মণদের কষ্ট হয়৷ শাস্ত্রজ্ঞানহীন শূদ্র ধনমদে মত্ত হয়ে ব্রাহ্মণদের পরিচর্যা না করে অবমাননা করতে পারে৷’
বৈদিক সংস্কৃতির অনিবার্য জীবনবিধান হিসেবে অবশ্যপালনীয় শাস্ত্রগ্রন্থ মনুসংহিতায় এরকম শাস্ত্রবিধানের অভাব নেই। ভূরিভূরি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। একইভাবে সংঘটিত কোন অপরাধের দণ্ড আরোপের ক্ষেত্রেও মনুশাস্ত্রে তীব্র বৈষম্য আমাদের চোখ এড়িয়ে যায় না। যেমন-
পঞ্চাশদ্ ব্রাহ্মণো দণ্ড্যঃ ক্ষত্রিয়স্যাভিশংসনে।
বৈশ্যে স্যাদর্দ্ধপঞ্চাশৎ শূদ্রে দ্বাদশকো দমঃ।। ৮/২৬৮।। (মনুসংহিতা)।
অর্থাৎ : (উত্তমর্ণ) ব্রাহ্মণ যদি (অধমর্ণ অনুসারে) ক্ষত্রিয়ের প্রতি আক্রোশন বা গালিগালাজ করে তা হলে তার পঞ্চাশ দণ্ড হবে, বৈশ্যের প্রতি করলে পঁচিশ পণ এবং শূদ্রের প্রতি করলে বারো পণ দণ্ড হবে।
অন্যদিকে-
যেন কেনচিদঙ্গেন হিংস্যাচ্চেৎ শ্রেষ্ঠমন্ত্যজঃ।
ছেত্তব্যং তত্তদেবাস্য তন্মনোরনুশাসনম্।। ৮/২৭৯।। (মনুসংহিতা)।
অর্থাৎ : শূদ্র কিংবা অন্ত্যজ ব্যক্তি (শূদ্র থেকে চণ্ডাল পর্যন্ত নিকৃষ্ট জাতি) দ্বিজাতিগণকে (ব্রাহ্মণ, ক্সত্রিয়, বৈশ্য) যে অঙ্গের দ্বারা পীড়ন করবে তার সেই অঙ্গ ছেদন করে দেবে, এটি মনুর নির্দেশ।
স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, কোন অপরাধের জন্য ব্রাহ্মণের ক্ষেত্রে খুবই অল্পমাত্রায় অর্থদণ্ডের বিধান থাকলেও সেই একই অপরাধে বর্ণদাস শূদ্রের অপরাধী অঙ্গ বা প্রত্যঙ্গ কর্তনের কঠোর নির্দেশ রয়েছে। এভাবে জীবনের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বিষয়গুলোতেও শাস্ত্রের অনিবার্য বিধানের বাইরে গিয়ে প্রচলিত সামাজিক শৃঙ্খলা ও স্থিতির স্বার্থে চাণক্য তার নীতিশ্লোকের কোথাও শাস্ত্রবিধানের পরিপন্থি কোন উপদেশ দান করেছেন কিনা তা কৌতুহলি গবেষকদের আগ্রহের বিষয় হতে পারে।  ব্রাহ্মণ্যশাসনাধীন তৎকালীন সমাজ-ব্যবস্থায় মনুশাস্ত্রের উপরিউক্ত অবশ্যপালনীয় শ্লোকগুলোর খুব দৃঢ় উপস্থিতির পরও আবার তৎকালীন হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্য আরেক অবশ্যমান্য পবিত্র ধর্মপুস্তক শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় অমর ললিত বাণী দেখা যায়-
বিদ্যাবিনয়সম্পন্নে ব্রাহ্মণে গবি হস্তিনি।
শুনি চৈব শ্বপাকে চ পণ্ডিতাঃ সমদর্শিনঃ।। ৫/১৮।। (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা)।
অর্থাৎ : বিদ্বান ও বিনয়ী ব্রাহ্মণ, গরু, হস্তী, কুকুর ও চণ্ডালে ব্রহ্মজ্ঞানীগণ সমদর্শী হন (অর্থাৎ ব্রহ্মদর্শন করেন)।
কিংবা-
আত্মৌপম্যেন সর্বত্র সমং পশ্যতি যোহর্জুন।
সুখং বা যদি বা দুঃখং স যোগী পরমো মতঃ।। ৬/৩২।। (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা)।
অর্থাৎ : হে অর্জুন, যিনি সকল ভূতের সুখ ও দুঃখকে নিজের সুখ ও দুঃখ বলিয়া অনুভব করেন, আমার মতে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী।

.
এখানে ভুলে গেলে চলবে না যে, মনুশাস্ত্র হলো তৎকালীন সমাজ-শাসনের ব্যবহারিক বিধান, যা থেকে বর্তমানে প্রচলিত হিন্দু ধর্মীয় আইনও এখনো আওতামুক্ত হতে পারে নি কোনভাবেই। আর শ্রী শ্রী গীতা হলো সেইসব ভাগ্যবানদের কোন আয়েশী অলস মুহূর্তের পূণ্য কামানোর গদগদ মাহাত্ম্য নিয়ে পরম তৃপ্তির সাথে পঠিত ও নিজের মতো করে বিশ্লেষিত হবার এক ভাবুক ধর্মগ্রন্থ। ইতিহাসই বলে দেয় আমাদের চাণক্য পণ্ডিতের কর্মযজ্ঞ ঘিরে ছিলো মনুরই বিধান। কিন্তু তাঁর নীতিশাস্ত্রে দেখি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার ভাবুক মুহূর্তেরই ছায়া। তাই কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আরোপ না করেও সকল জীবে আত্মজ্ঞান পোষণের এই নৈতিক উপদেশ তাত্ত্বিক আলোচনায় কতোটা গ্রহণযোগ্য কে জানে, কিন্তু ব্যবহারিক প্রপঞ্চে তা কেবলই এক বিভ্রম বলেই মনে হয়।
অবস্থা বৈগুন্যে আদিবাসী গারোদের একটা প্রবাদের কথা মনে পড়ে-
‘আনথাং নাদে ছিজং পিদ্দক
গিব্বিন নাদে বগা পিদ্দক।’
(নিজের বেলায় কাছিম গলা, পরের বেলায় বগের গলা)।
আর তৎকালীন সাধারণ জনগোষ্ঠি তথা শূদ্রদের অবস্থা তো কুড়িগ্রাম অঞ্চলের প্রচলিত সেই প্রবাদটির মতোই- ‘গরম ভাতোত নুন জোটে না, পান্তা ভাতোত ঘি !’ 
.
নির্মোহ সামাজিক ও ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির বিশ্লেষণে চাণক্যের এই নীতিশ্লোকটি পরবর্তীকালের নীতিসাহিত্যে যথেষ্ট ছায়া ফেললেও তৎকালীন প্রায় সমসাময়িক সামাজিক পরিস্থিতিতে বিপ্রতীপ দৃষ্টিকোণ থেকে রচিত নীতিসাহিত্য হিসেবে ভর্তৃহরির নিম্নোক্ত নীতিশ্লোকটিকেই গ্রহণযোগ্যতায় অধিকতর মোহনীয় মনে হতে পারে। কেননা  বর্তমান ভাবনা-কাঠামোর আলোকে সমকালীন ব্যাখ্যা আরোপ করে এটাকে যুগোপযোগী নীতিকথায় রূপান্তর করা সহজতর মনে হয়-  
অকরুণত্বমকারণবিগ্রঃ
পরধনে পরযোষিতি চ স্পৃহা।
সুজনবন্ধুজনেষ্বসহিষ্ণুতা
প্রকৃতিসিদ্ধমিদং হি দুরাত্মনাম্ ।। ৫২।। (ভর্তৃহরির নীতিশতক)।
অর্থাৎ : নির্দয়তা, বিনাকারণে কলহ, পরধন ও পরস্ত্রীতে আসক্তি, সজ্জন ও সুহৃজ্জনে ঈর্ষা- এগুলো (হচ্ছে) দুর্জনদের স্বভাবসিদ্ধ (প্রবৃত্তি)। 


(চলবে…)

[ নীতিকথা-০২ ] [ * ] [ নীতিকথা-০৪ ]

[ sachalayatan ]
...

No comments: