.
| চাণক্যজন কহেন : ০৭ | নীতিকথা-০৪ |
-রণদীপম বসু
-রণদীপম বসু
.
প্রথম
পাঠেই নীতিবাক্যটিতে কোন জটিলতার কারণ খুঁজে পাওয়া দুরুহ বৈকি। কেননা
আমাদের সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান থেকেই এর একটা সহজ সরল ব্যাখ্যা মনের মধ্যে এমনিই
হাজির হয়ে যায়। কী সেই ব্যাখ্যা ? তা হলো, কেবলমাত্র উচ্চবংশে জন্মগ্রহণ
করলেই কেউ সম্মান বা শ্রদ্ধাভাজন হয়ে যায় না। মানুষকে সে সম্মান যোগ্যতার
মাধ্যমেই অর্জন করতে হয়। আর সেই যোগ্যতা অর্জন করতে হয় শাস্ত্রজ্ঞান
অর্জনের মাধ্যমে। ফলে উচ্চবংশে জন্মগ্রহণ না-করেও যিনি শাস্ত্রজ্ঞ হন, লোকে
তাঁকে সম্মান করে, এমনকি দেবতারাও তাঁর সমাদর করেন। অতএব উচ্চবংশে
জন্মগ্রহণ করলে সেই বংশের যোগ্য হওয়ার জন্য নিশ্চয়ই তাঁকে প্রয়োজনীয় চর্চার
মধ্য দিয়ে গুণাবলী অর্জন করতে হবে।
.
কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় সেসব অনুভূতিপ্রবণ পাঠকের জন্যে। যাঁদের সংবেদনশীল মনে এ নীতিবাক্যটির অন্তত তিনটি বিষয় কিঞ্চিৎ কড়া নাড়তে থাকে। কেননা চাণক্য তাঁর এ নীতিশ্লোকটিতে কুল বা উচ্চবংশ কথাটা গুরুত্বের সাথে আরোপ করার মাধ্যমে তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষিতে মূলত বংশমর্যাদার বিষয়টিকে গুরুত্ববহ করে তুলেছেন। অর্থাৎ সামাজিক আবহে বংশমর্যাদা একটি উল্লেখযোগ্য প্রপঞ্চ। আর এই ধারণা বা প্রপঞ্চটিকে একালে এসেও আমাদের বর্তমান সমাজ-ব্যবস্থায় পূর্ণ শক্তিতে বহাল থাকতে দেখছি আমরা। আমাদের শ্রুতিবাহুল্যে উচ্চবংশ বা উঁচু জাত ও নিম্নবংশ বা নিচু জাত শব্দ দুটো এতোটাই বহুল প্রচলিত হয়ে গেছে যে, মধ্যবংশ বা মধ্য জাত বলে কোন শব্দের ব্যবহারিক অস্তিত্ব আদৌ রয়েছে কিনা আমাদের জানা নেই। এ থেকে এটাই প্রতীয়মান হয়, বংশ পরম্পরায় আমাদের সমাজটা আসলে দুটো ভাগে বিভাজিত সেই প্রাচীনকাল থেকেই। পরবর্তীকালে আমাদের এই জনবসতিতে বহু ধর্মাধর্মের আগমন-নির্গমন ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু সেই বিভাজনটা রয়েই গেছে। তাই প্রাসঙ্গিক কারণেই এর উৎস খোঁজাটা নিশ্চয়ই অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
.
এছাড়া আর যে দুটো বিষয় এ নীতিশ্লোকে স্থান পেয়েছে, তা হলো ব্যক্তির গুণের প্রসঙ্গ এবং শাস্ত্রজ্ঞ হওয়া না-হওয়ার বিষয়টি। তবে এখানে গুণের সাথে শাস্ত্রের একটা চমৎকার একরৈখিক সম্পর্ক দেখতে পাই আমরা। অর্থাৎ যিনি শাস্ত্রজ্ঞ তিনিই গুণবান হবেন, আর এর বিপরীতে শাস্ত্রে অজ্ঞ বা শ্রদ্ধাহীন ব্যক্তি অবশ্যই গুণহীন এবং তিনি পরমার্থের অযোগ্য। এজন্যেই হয়তো সেই প্রাচীনকাল হতেই বৈদিক সমাজ-সংস্কৃতিতে ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বহুল পূজিত গ্রন্থ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে এভাবে-
.
কিন্তু সমস্যা দেখা দেয় সেসব অনুভূতিপ্রবণ পাঠকের জন্যে। যাঁদের সংবেদনশীল মনে এ নীতিবাক্যটির অন্তত তিনটি বিষয় কিঞ্চিৎ কড়া নাড়তে থাকে। কেননা চাণক্য তাঁর এ নীতিশ্লোকটিতে কুল বা উচ্চবংশ কথাটা গুরুত্বের সাথে আরোপ করার মাধ্যমে তৎকালীন সামাজিক প্রেক্ষিতে মূলত বংশমর্যাদার বিষয়টিকে গুরুত্ববহ করে তুলেছেন। অর্থাৎ সামাজিক আবহে বংশমর্যাদা একটি উল্লেখযোগ্য প্রপঞ্চ। আর এই ধারণা বা প্রপঞ্চটিকে একালে এসেও আমাদের বর্তমান সমাজ-ব্যবস্থায় পূর্ণ শক্তিতে বহাল থাকতে দেখছি আমরা। আমাদের শ্রুতিবাহুল্যে উচ্চবংশ বা উঁচু জাত ও নিম্নবংশ বা নিচু জাত শব্দ দুটো এতোটাই বহুল প্রচলিত হয়ে গেছে যে, মধ্যবংশ বা মধ্য জাত বলে কোন শব্দের ব্যবহারিক অস্তিত্ব আদৌ রয়েছে কিনা আমাদের জানা নেই। এ থেকে এটাই প্রতীয়মান হয়, বংশ পরম্পরায় আমাদের সমাজটা আসলে দুটো ভাগে বিভাজিত সেই প্রাচীনকাল থেকেই। পরবর্তীকালে আমাদের এই জনবসতিতে বহু ধর্মাধর্মের আগমন-নির্গমন ঘটেছে ঠিকই, কিন্তু সেই বিভাজনটা রয়েই গেছে। তাই প্রাসঙ্গিক কারণেই এর উৎস খোঁজাটা নিশ্চয়ই অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
.
এছাড়া আর যে দুটো বিষয় এ নীতিশ্লোকে স্থান পেয়েছে, তা হলো ব্যক্তির গুণের প্রসঙ্গ এবং শাস্ত্রজ্ঞ হওয়া না-হওয়ার বিষয়টি। তবে এখানে গুণের সাথে শাস্ত্রের একটা চমৎকার একরৈখিক সম্পর্ক দেখতে পাই আমরা। অর্থাৎ যিনি শাস্ত্রজ্ঞ তিনিই গুণবান হবেন, আর এর বিপরীতে শাস্ত্রে অজ্ঞ বা শ্রদ্ধাহীন ব্যক্তি অবশ্যই গুণহীন এবং তিনি পরমার্থের অযোগ্য। এজন্যেই হয়তো সেই প্রাচীনকাল হতেই বৈদিক সমাজ-সংস্কৃতিতে ধর্মগ্রন্থ হিসেবে বহুল পূজিত গ্রন্থ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে এভাবে-
অজ্ঞশ্চাশ্রদ্দধানশ্চ সংশয়াত্মা বিনশ্যতি।
নায়ং লোকোহস্তি ন পরো ন সুখং সংশয়াত্মনঃ।। ৪/৪০।। (শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা)।
অর্থাৎ : অজ্ঞ, শাস্ত্রে শ্রদ্ধাহীন, (জ্ঞান ও কর্মের অনুষ্ঠানবিষয়ে) সন্দিগ্ধচিত্ত ব্যক্তি পরমার্থের অযোগ্য হয়। সন্দিগ্ধচিত্ত ব্যক্তির ইহলোকও নাই, পরলোকও নাই এবং ঐহিক সুখও নাই।
.
আর শাস্ত্রজ্ঞ বা বিদ্বান ব্যক্তি যে তিনিই যিনি বেদের প্রামাণ্য স্বীকার করে নিজ ধর্মে নিবিষ্ট হবার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় বিদ্যা অর্জন করবেন (মনুসংহিতা : ২/৮) তা ইতঃপূর্বে (নীতিবাক্য-০১-এ) বিস্তৃত আলোচনা করা হয়েছে। তাই সে প্রেক্ষিত এখানে পুনরায় ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না। তবে এই প্রয়োজনীয় বিদ্যা অর্জনের লক্ষ্যে ধর্মের নিশ্চিত সিদ্ধান্ত অবগত হওয়ার উপায়টাও যে শাস্ত্রে বলে দেয়া হয়েছে তা আলোচনার সুবিধার্থে উল্লেখ করা যেতে পারে। এ ব্যাপারে মনুশাস্ত্রে বলা হচ্ছে-
প্রত্যঞ্চানুমানঞ্চ শাস্ত্রঞ্চ বিবিধাগমম্ ।
ত্রয়ং সুবিদিতং কার্যং ধর্মশুদ্ধিমভীপ্সতা।। ১২/১০৫।। (মনুসংহিতা)।
অর্থাৎ : যে ব্যক্তি ধর্মশুদ্ধি অর্থাৎ ধর্মের নিশ্চিত সিদ্ধান্ত অবগত হতে ইচ্ছুক তাঁর পক্ষে প্রত্যক্ষ, অনুমান এবং নানাপ্রকার বিধিনিষেধযুক্ত স্মৃতি প্রভৃতি-শাস্ত্র- এই তিনটি প্রমাণ সম্যকরূপে বিদিত হওয়া আবশ্যক।
এবং আরো বলা হচ্ছে-
আর্ষং ধর্মোপদেশঞ্চ বেদশাস্ত্রাহবিরোধিনা।
যস্তর্কেণানুসন্ধত্তে স ধর্মং বেদ নেতরঃ।। ১২/১০৬।। (মনুসংহিতা)।
অর্থাৎ : যে ব্যক্তি বেদোক্ত-ধর্মোপদেশসমূহ বেদশাস্ত্রের অবিরোধী অর্থাৎ অনুকূল তর্কের সাহায্যে অনুসন্ধান করেন অর্থাৎ নিরূপণ করতে চেষ্টা করেন, তিনিই বেদের ধর্ম অর্থাৎ বেদের অর্থ অবগত হন; এর বিপরীত স্বভাব ব্যক্তি বেদার্থধর্ম বোঝে না।
.
উল্লেখ্য, এখানে ধর্ম শব্দটির অর্থ হলো বেদার্থ অর্থাৎ বেদবাক্যের তাৎপর্যবিষয়ীভূত অর্থ। অতএব আমাদের বুঝতে বাকি থাকে না যে, ধর্ম অর্থাৎ বেদের প্রামাণ্য স্বীকার করার যে শাস্ত্রবিহিত জ্ঞান, সেটুকু যিনি আয়ত্ত করবেন তিনিই শাস্ত্রজ্ঞ। এবং তিনিই হবেন গুণবান। ধর্মভিত্তিক গোঁড়ামিপূর্ণ বৃত্তাবদ্ধ একটা সমাজে মানুষের মানবিক ও নৈতিক গুণাবলী গৌন হয়ে যুক্তিহীনভাবে কেবলমাত্র ধর্মের প্রতি অবিচল আস্থা ও নিষ্ঠা থাকাই যে মহৎ গুণের পরিচায়ক হয়ে ওঠা, এটাই তাৎপর্যপূর্ণ এবং অনুধাবনেরও বিষয়। নীতিপ্রবক্তা পণ্ডিত চাণক্য যে আসলে এ বৃত্তের বাইরের কেউ নন, এটা বোধ করি বোঝার বাকি রাখে না। এবং আড়াই হাজার বছর পেরিয়ে একালের এই আমরা এখনো এ গণ্ডিটা কতোটা মুক্ত হতে পেরেছি তা নিজেদের জন্যেও বোঝাপড়ার বিষয়।
.
এখানে বুদ্ধিমান পাঠকের জ্ঞাতার্থে এটাও জানিয়ে রাখা আবশ্যক যে, প্রতিটা বিষয়ের উৎস সন্ধানে আমাদেরকে যেহেতু বারে বারে শাস্ত্রীয়-বিধানের আকরগ্রন্থ মনুসংহিতার দ্বারস্থ হতে হচ্ছে, তাই বেদবিহিত এই মনুশাস্ত্রের যথার্থতা নিয়ে যাতে কারো কোন সন্দেহের অবকাশ না-থাকে সে লক্ষ্যে মনুশাস্ত্রেই নির্দেশিত হয়েছে-
যঃ কশ্চিৎ কস্যচিদ্ধর্মো মনুনা পরিকীর্তিতঃ।
স সর্বোহভিহিতো বেদে সর্বজ্ঞানময়ো হি সঃ।। ১/৭।। (মনুসংহিতা)।
অর্থাৎ : (যেহেতু মনু সকল বেদই সম্যকরূপে অবগত আছেন) সর্বজ্ঞানময় মনু যে কোনও ব্যক্তির যে কোনও ধর্মের (যেমন, বর্ণধর্ম, আশ্রমধর্ম, সংস্কারধর্ম প্রভৃতি এবং ব্রাহ্মণাদি বিশেষ বিশেষ বর্ণের জন্য বিহিত বিশেষ বিশেষ ধর্ম) উপদেশ দিয়েছেন, সে সবগুলিই বেদে প্রতিপাদিত হয়েছে। কারণ, সেই বেদ হলো সকল প্রকার (এমনকি যে সব বিষয় লৌকিক প্রমাণের দ্বারা অবগত হওয়া যায় না সে সবেরও) জ্ঞানের আকর।
.
তাই এই মনুশাস্ত্রের প্রতি আস্থা অগাধ হলে নিশ্চয়ই আমাদের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিপাদ্য বিষয় চাণক্য-কথিত কুল বা বংশমর্যাদার প্রাচীন উৎসটাও খুঁজে পেতে সহায়ক হবে। আর তা খুঁজতে হলে প্রথমত আমাদেরকে এ ব্যাপারে সন্দেহমুক্ত হতে হবে যে বংশের সাথে জন্মের সম্পর্কটা অবিচ্ছেদ্য। সে সন্দেহ থাকার কথাও নয়, কেননা বংশ মানে হচ্ছে জন্ম-পরম্পরায় উত্তরাধিকার বহন। একবার জন্ম নিয়ে বংশের যে তিলকটা কপালে সেঁটে গেছে তা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যেমন অসম্ভব, তেমনি জন্মপ্রক্রিয়ার বাইরে অন্য কোন উপায়ে আরেকটি বংশে অনুপ্রবেশও কোনোভাবে সম্ভব নয়। প্রকৃতির একটা উল্লেখযোগ্য প্রধান জাতিগোষ্ঠি এই মানুষের মধ্যে জন্মগ্রহণ করেও বংশ নামের আরেকটি অদ্ভুত খাঁচায় নিজেকে আবিষ্কারের এই বিস্ময়টা আমাদেরকে আসলে তথাকথিত পবিত্র শাস্ত্রগ্রন্থ নামের কিছু ধর্মীয় ধারণার মুখোমুখি করে দেয়। আর এই শাস্ত্রের মাহাত্ম্যই বলি কি রহস্যই বলি তা নিয়ন্ত্রণের সূত্রটা সুকৌশলে রাখা হয়েছে এক অদৃশ্য স্রষ্টা ব্রহ্মার রহস্যময় লীলার মধ্যে। আপাতত সেই রহস্য বাদ রেখে বরং বংশ লীলাটাই খোঁজা যাক। এ বিষয়ে প্রথমেই মনু বলছেন-
লোকানাং তু বিবৃদ্ধ্যর্থং মুখবাহূরুপাদতঃ।
ব্রাহ্মণং ক্ষত্রিয়ং বৈশ্যং শূদ্রঞ্চ নিরবর্তয়ৎ।। ১/৩১।। (মনুসংহিতা)।
অর্থাৎ : পৃথিব্যাদির লোকসকলের সমৃদ্ধি কামনায় পরমেশ্বর নিজের মুখ, বাহু, উরু ও পাদ থেকে যথাক্রমে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র- এই চারিটি বর্ণ সৃষ্টি করলেন।
.
কিন্তু ব্রহ্মা কর্তৃক এই বর্ণ সৃষ্টি তো আর এমনি এমনি হয়নি। পূর্বজন্মের কর্ম অনুযায়ী এজন্মে তার ফল ভোগ করার নিমিত্তেই ব্রহ্মা কর্তৃক মানবকুলে এই বর্ণসৃষ্টি। তাই শ্রম বিভাজনের মাধ্যমে তাদের জন্য ভিন্ন ভিন্ন সুনির্দিষ্ট কার্যেরও ঘোষণা করা হলো-
সর্বস্যাস্য তু সর্গস্য গুপ্ত্যর্থং স মহাদ্যুতিঃ।
মুখবাহুরুপজ্জানাং পৃথক্ কর্মাণ্যকল্পয়ৎ।। ১/৮৭।। (মনুসংহিতা)।
অর্থাৎ : এই সকল সৃষ্টির অর্থাৎ ত্রিভুবনের রক্ষার জন্য মহাতেজযুক্ত প্রজাপতি ব্রহ্মা নিজের মুখ, বাহু, উরু এবং পাদ- এই চারটি অঙ্গ থেকে জাত ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্রদের পৃথক পৃথক কার্যের ব্যবস্থা করে দিলেন।
.
অধ্যাপনমধ্যয়নং যজনং যাজনং তথা।
দানং প্রতিগ্রহঞ্চৈব ব্রাহ্মণানামকল্পয়ৎ।। ১/৮৮।। (মনুসংহিতা)।
অর্থাৎ : অধ্যাপন, স্বয়ং অধ্যয়ন, যজন, যাজন, দান ও প্রতিগ্রহ (উপহার বা দান-সামগ্রি গ্রহণ)- এই ছয়টি কাজ ব্রহ্মা ব্রাহ্মণদের জন্য নির্দেশ করে দিলেন।
.
প্রজানাং রক্ষণং দানমিজ্যাধ্যয়নমেব চ।
বিষয়েম্বপ্রসক্তিশ্চ ক্ষত্রিয়স্য সমাসতঃ।। ১/৮৯।। (মনুসংহিতা)।
অর্থাৎ : প্রজারক্ষণ, দান, যজ্ঞ, অধ্যয়ন, নৃত্যগীতবনিতাদি-বিষয়ভোগে অনাসক্তি, এই কয়েকটি কাজ ব্রহ্মা ক্ষত্রিয়গণের জন্য সংক্ষেপে নিরূপিত করলেন।
.
পশূনাং রক্ষণং দানমিজ্যাধ্যয়নমেব চ।
বণিক্পথং কুসীদঞ্চ বৈশ্যস্য কৃষিমেব চ।। ১/৯০।। (মনুসংহিতা)।
অর্থাৎ : পশুদের রক্ষা, দান, যজ্ঞ, অধ্যয়ন, বাণিজ্য (স্থলপথ ও জলপথ প্রভৃতির মাধ্যমে বস্তু আদান-প্রদান করে ধন উপার্জন), কুসীদ (বৃত্তিজীবিকা- টাকা সুদে খাটানো) এবং কৃষিকাজ- ব্রহ্মা কর্তৃক বৈশ্যদের জন্য নিরূপিত হল।
.
এতমেব তু শূদ্রস্য প্রভুঃ কর্ম সমাদিশৎ।
এতেষামেব বর্ণানাং শুশ্রƒষামনসূয়য়া।। ১/৯১।। (মনুসংহিতা)।
অর্থাৎ : প্রভু ব্রহ্মা শূদ্রের জন্য একটি কাজই নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন,- তা হলো কোনও অসূয়া অর্থাৎ নিন্দা না করে (অর্থাৎ অকপটভাবে) এই তিন বর্ণের অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্যের শুশ্রূষা করা।
.
অর্থাৎ উপরিউক্ত শ্লোকগুলো থেকে আমরা এটা বুঝে যাই যে, স্বয়ম্ভু ব্রহ্মা গোটা বিশ্ব-জগৎ সৃষ্টি করে তা সুষ্ঠুভাবে রক্ষাকল্পে চারটি বর্ণ সৃষ্টি করলেন- ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র। এদের আবার দুটো ভাগ- এক ভাগে প্রথম তিনটি যথাক্রমে উচ্চতম, উচ্চতর ও উচ্চ বর্ণ, আর দ্বিতীয় ভাগে চতুর্থটি অর্থাৎ শূদ্র হচ্ছে নিম্নবর্ণ, যে কিনা উচ্চবর্ণীয়দের সেবাদাস। আবার ব্রাহ্মণ, যে কিনা কোন শারীরিক শ্রমের সাথে কোনভাবেই জড়িত নয়, সকল বর্ণের শীর্ষে। শুধু শীর্ষেই নয়, ক্ষমতার এতোটাই কল্পনাতীত উচ্চ অবস্থানে অবস্থিত যে, জগতের সবকিছুর মালিক বা প্রভুও হচ্ছে ব্রাহ্মণ-
উত্তমাঙ্গোদ্ভবাজ্জৈষ্ঠ্যাদ্ ব্রহ্মণশ্চৈব ধারণাৎ।
সর্বস্যৈবাস্য সর্গস্য ধর্মতো ব্রাহ্মণঃ প্রভুঃ।। ১/৯৩।। (মনুসংহিতা)।
অর্থাৎ : ব্রহ্মার উত্তমাঙ্গ মানে পবিত্রতম মুখ থেকে উৎপন্ন বলে, সকল বর্ণের আগে ব্রাহ্মণের উৎপত্তি হওয়ায়, এবং বেদসমূহ ব্রাহ্মণকর্তৃক রক্ষিত হওয়ার জন্য (বা বেদসমূহ ব্রাহ্মণেরাই পঠন-পাঠন করেন বলে)- ব্রাহ্মণই ধর্মের অনুশাসন অনুসারে এই সৃষ্ট জগতের একমাত্র প্রভু।
তাই-
ব্রাহ্মণো জায়মানো হি পৃথিব্যামধিজায়তে।
ঈশ্বরঃ সর্বভূতানাং ধর্মকোষস্য গুপ্তয়ে।। ১/৯৯।। (মনুসংহিতা)।
অর্থাৎ : ব্রাহ্মণ জন্মগ্রহণ করা মাত্রই পৃথিবীর সকল লোকের উপরিবর্তী হন অর্থাৎ সমস্ত লোকের অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ হন। কারণ, ব্রাহ্মণই সকলের ধর্মকোষ অর্থাৎ ধর্মসমূহ রক্ষার জন্য প্রভুসম্পন্ন হয়ে থাকেন।
.
উদ্ধৃত পবিত্র শ্লোকগুলো থেকে নিশ্চয়ই কুল অর্থাৎ বংশ বা বর্ণের ক্রমিক শ্রেষ্ঠত্বের বিষয়ে একটা ধারণা তৈরি হয়ে যায় আমাদের। তবু অজ্ঞানী বা মূর্খ-দৃষ্টিতে শরীরের অবস্থান অনুযায়ী মুখ, বাহু, উরু ও পায়ের পবিত্রতার রকমফের নিয়ে যাতে সন্দেহের কোনরূপ অবকাশই না-থাকে, সে লক্ষ্যে মনুশাস্ত্র সবার মঙ্গলার্থে তা স্পষ্ট করে দিয়েছে এভাবে-
ঊর্ধ্বং নাভের্মেধ্যতরঃ পুরুষঃ পরিকীর্তিতঃ।
তস্মান্মেধ্যতমং ত্বস্য মুখমুক্তং স্বয়ম্ভুবা।। ১/৯২।। (মনুসংহিতা)।
অর্থাৎ : (পুরুষ ব্রহ্মা আপাদ-মস্তক সর্বতোভাবে পবিত্র)। (তবুও) পুরুষের নাভি থেকে উর্ধ্বপ্রদেশ পবিত্রতর বলে কথিত। তা অপেক্ষাও আবার পুরুষের মুখ আরও পবিত্র- একথা স্বয়ম্ভু ব্রহ্মা বলেছেন।
.
উল্লেখ্য, এখানে পুরুষ বলতে কিন্তু স্বয়ম্ভু ব্রহ্মাকেই বোঝানো হয়েছে। দেখা যাচ্ছে নাভির উর্ধ্বপ্রদেশ পবিত্রতর অংশ। তাহলে নাভির নিম্নপ্রদেশ ? পাদ বা পায়ের অবস্থান তো নিম্নেই। সবখানে সবকিছু ব্যাখ্যা করতে হয় না, কারণ শাস্ত্রগ্রন্থ তো নিম্নবর্ণীয় মূর্খদের জন্যে নয়। পুরুষ ব্রহ্মা আপাদ-মস্তক সর্বতোভাবে পবিত্র হলেও তাঁর পা থেকে উৎপন্ন শূদ্রের বংশ বা বর্ণের নিচত্বে যে কোন সন্দেহ থাকা চলবে না, সেটাও শাস্ত্র-বিধানে পরিষ্কার করে দেয়া হয়েছে-
ন স্বামিনা নিসৃষ্টোহপি শূদ্রো দাস্যাদ্বিমুচ্যতে।
নিসর্গজং হি তত্তস্য কস্তস্মাত্তদপোহতি।। ৮/৪১৪।। (মনুসংহিতা)।
অর্থাৎ : প্রভু তাঁর অধীনস্থ শূদ্রকে দাসত্ব থেকে অব্যাহতি দিলেও শূদ্র দাসত্ব কর্ম থেকে অব্যাহতি পেতে পারে না। দাসত্বকর্ম তার স্বভাবসিদ্ধ কর্ম (অর্থাৎ জন্মের সাথে আগত)। তাই ঐ শূদ্রের কাছ থেকে কে দাসত্ব কর্ম সরিয়ে নিতে পারে ?
.
বড় ভয়ঙ্কর কথা ! অতএব আশা করা যায় এতোসব শাস্ত্র-উদ্ধৃতির ভারে ভারাক্রান্ত হতে হতে নিশ্চয়ই আমরা মানবকুলে বংশমর্যাদা নামের সৃষ্ট প্রপঞ্চ বা রহস্যের উৎস-সূত্রটা একটু হলেও অনুধাবন করতে সক্ষম হচ্ছি। আমাদের আপাত প্রয়োজন এটুকুই। আর তা সম্বল করেই আরেকটু ভালোভাবে অনুধাবনের উদ্দেশ্যে প্রায় আড়াই হাজার বছর আগের রচিত চাণক্যের উদ্ধৃত নীতিবাক্যটির কাছে আবার ফিরে যেতে পারি আমরা।
নীতিবাক্যে বলা হচ্ছে- যে ব্যক্তি গুণহীন, তার উচ্চবংশে জন্মগ্রহণেও সার্থকতা কোথায় ? বিপরীতপক্ষে, যিনি শাস্ত্রজ্ঞ, তিনি উচ্চবংশে জন্মগ্রহণ না করলেও দেবতাদের দ্বারা পূজিত (সমাদৃত) হন।
.
অর্থাৎ কোন ব্যক্তির উচ্চবংশে জন্ম নিয়ে বংশ-নির্দেশিত প্রক্রিয়ায় বেদবিহিত শাস্ত্র অধ্যয়ন ও বুৎপত্তি অর্জন করার মাধ্যমে গুণবান হওয়ার যে কর্তব্যকাজ নির্দিষ্ট করা আছে, তা যথাযথ না-হলে ওই গুণহীন ব্যক্তির উচ্চবংশে জন্মগ্রহণের কোন সার্থকতা থাকে না। এ ব্যাখ্যা অনুযায়ী চাণক্যের প্রথমাংশের সাথে আমাদের মতানৈক্য হওয়ার সুযোগ নেই বলতে হবে। কিন্তু অন্যদিকে উচ্চবর্ণীয় ব্রাহ্মণ বংশে জন্ম না-হয়ে শূদ্রজাত নীচ-বংশে জন্ম নিয়ে কোন ব্যক্তির শাস্ত্রজ্ঞ হওয়ার সুযোগ আদৌ কি শাস্ত্রগ্রন্থে রাখা হয়েছে ? শাস্ত্রবাক্য শোনাও তো তার জন্যে অপরাধের পর্যায়ে পড়ে। কিভাবে সে গুণবান শাস্ত্রজ্ঞ হবে ? সেক্ষেত্রে চাণক্যের দ্বিতীয়াংশের এই বিভ্রমের উত্তর হতে পারে এরকম যে, ব্রাহ্মণ না-হয়ে হয়তোবা শাস্ত্র অধ্যয়নের অনুমোদপ্রাপ্ত অন্য কোন দ্বিজ যেমন ক্ষত্রিয় বংশে জন্মগ্রহণ করেও শাস্ত্রজ্ঞ হওয়ার সুযোগ রয়েছে। মোটকথা ব্রহ্মার উর্ধ্বাঙ্গের যেকোন অঙ্গ থেকে উৎপন্ন উচ্চবর্ণীয় দ্বিজদের নিজেদের মধ্যেই এই সুবিধা ভাগাভাগির একটা কৌশলই এই নীতিবাক্যে প্রতিবিম্বিত হতে দেখি আমরা। এখানে আসলে নিচ-জাত নিম্নবংশীয় শূদ্র ও অন্যান্য অন্ত্যজদের গুণবান হওয়ার উপায় বা স্বীকৃতির কোন সুযোগই রাখা হয়নি। এটাকেই যদি এ নীতিবাক্যের গোপন মর্মার্থ হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তাতে কি খুব অন্যায় হবে ?
.
খুব সুস্পষ্ট না-হলেও সুপ্তভাবে এই ইঙ্গিতই পরিলক্ষিত হয় কাছাকাছি সময়কালের একই আবহের অন্য নীতিকাব্য স্রষ্টা ভর্তৃহরির নীতিশতকেও-
পরিবর্তিনি সংসারে মৃতঃ কো বা ন জায়তে !
স জাতো যেন জাতেন যাতি বংশঃ সমুন্নতিম্ ।। ৩২।। (ভর্তৃহরির নীতিশতক)।
অর্থাৎ : পরিবর্তনশীল (এই জগৎ) সংসারে মৃত কে-ই বা না জন্মগ্রহণ করে (অর্থাৎ কে-ই বা না মরে আর কে-ই বা না জন্মে, কিন্তু একমাত্র) সে(-ই) জন্মেছে (অর্থাৎ তার জন্মই সার্থক) যার জন্মের দ্বারা (তার) বংশ (প্রভূত) উন্নতি লাভ করেছে।
.
এই বংশবত্তার জয়গান কেবল যে চাণক্য বা ভর্তৃহরির ক্ষেত্রেই দেখা যায় তা নয়, পরবর্তীকালের ধর্মের পট্টি বাঁধা চোখের অন্যান্য নীতিকথকদের মধ্যেও সমভাবে দৃষ্ট হয় তা। যেমন ‘উদ্ভট শ্লোক সংগ্রহে’র একটি শ্লোকেও এই প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
গুণাঃ সর্বত্র পূজ্যন্তে পিতৃবংশো নিরর্থকঃ।
বসুদেবং পরিত্যজ্য বাসুদেব উপাস্যতে।। (উদ্ভট-সাগর)।।
অর্থাৎ : মানুষের গুণই সর্বত্র বিচার্য বা পূজিত- পিতৃবংশ নয়। ভগবান বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণের কথা সর্বলোকমুখে; সবার উপাস্য। বসুদেবের কথা ক’জন জানে ?
.
আসলে এই ভূখণ্ডের পুরনো জনগোষ্ঠির প্রাচীন জনসংস্কৃতিতে পরবর্তীকালে বহু ধর্ম ও সংস্কৃতির মিশেল ঘটলেও আশরাফ-আতরাফ বা উচ্চ-নীচ বংশ-মর্যাদা বা মর্যাদাহীনতার বহু কল্পকাহিনী ও প্রচলিত সমাজ-মনস্কতায় এই সামাজিক বিভেদটা বিলুপ্ত না হয়ে বরং আরো জোরালো হয়েই জেঁকে বসেছে বিভিন্ন চেহারায় বিভিন্ন মোড়কে। তাই হয়তো চাণক্যের এই ধর্মীয় সামাজিক বৈষম্যদায়ী নীতিশ্লোকটা বর্তমান জনমানসের কাছে আগ্রহ হারায় নি এখনো। এর প্রধান কারণ হয়তো এটাই যে, ধর্মীয় আধিপত্যবাদী মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণার আগল থেকে আমরা মুক্ত হতে পারিনি আজো।
.
কিন্তু বর্তমানকালের অগ্রবর্তী জ্ঞান ও সামাজিক সাম্যতার ধর্ম নিরপেক্ষ বিজ্ঞানমনস্ক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে এই নীতিশ্লোকটিতে কোনোভাবে সমকালীন ব্যাখ্যা আরোপ করা আদৌ কি সম্ভব ? নিশ্চয়ই তা ভাবনার বিষয়। কেননা, বংশমর্যাদার মতো একটা পশ্চাৎপদ হীন দৃষ্টিসম্পন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত বিষয় অন্তর্ভুক্ত হয়ে থাকায় চাণক্যের এই নীতিশ্লোকটিকে আসলে মুক্ত মানবিক চিন্তা কাঠামোয় এখন আর কোনভাবেই যুগোপযোগী হবার উপায় নেই বলেই প্রতীয়মান হয়।
…
(চলবে…)
…
[ নীতিকথা-০৩ ] [ * ] [ নীতিকথা-০৫ ]
…
No comments:
Post a Comment