Saturday, May 26, 2012

| প্রসঙ্গ : সমকালীন ছড়া !

 .
| প্রসঙ্গ : সমকালীন ছড়া !
রণদীপম বসু
(০১)
আলোচনার যা বিষয়, তাতে শুরুতেই একটু গৌড়চন্দ্রিকা সেরে নেই। স্থান ও কাল উল্লেখ না করেই বলি, কোন এক কাজে ফুটপাথ ধরে হাঁটছিলাম। হঠাৎ একটা আকর্ষণীয় সাইনবোর্ড চোখে পড়লো, ওটার এক জায়গায় খুব সুন্দর করে লেখা- ‘এখানে যত্ন সহকারে বৈজ্ঞানিক উপায়ে চিকিৎসা করা হয়।’ হতভাগা আমার ভাষাজ্ঞান ও হিউমার-বোধ কম থাকায় ছড়াকার হতে পারি নি কখনো। কিন্তু বৈজ্ঞানিক উপায়ে চিকিৎসার হিউমার-সমৃদ্ধ কথাটা পড়ে ওই চিকিৎসক ব্যক্তিটি ছড়াকার কিনা জানতে ভীষণ কৌতুহল হলো।
.
এতোকাল জানতাম যে, রোগ নিরাময়ের বিজ্ঞানসম্মত প্রক্রিয়াকেই চিকিৎসা বলে। চিকিৎসা শব্দটার আগে আলাদাভাবে ‘বৈজ্ঞানিক উপায়ে’ ক্রিয়া-বিশেষণ তাও আবার যত্ন সহকারে যুক্ত করার মানে দাঁড়াচ্ছে যে, বিপরীত অর্থে নিশ্চয়ই অবৈজ্ঞানিক উপায়ে যত্ন ছাড়াও কোন চিকিৎসা পদ্ধতি রয়েছে। অনেকটা ‘মিষ্ট-রসগোল্লা’র মতো। রসগোল্লা তে মিষ্টিই হয়। যদি ঝাল-রসগোল্লা, টক-রসগোল্লা বা তিতে-রসগোল্লা জাতীয় কিছুর অস্তিত্ব থাকতো, তাহলে যেমন মিষ্ট-রসগোল্লার মাহাত্ম্য বোঝা যেতো, বৈজ্ঞানিক উপায়ে চিকিৎসাও সেরকমই। তবে কথাটাকে একেবারে সত্যের অপলাপ বলে উড়িয়ে দেবারও উপায় নেই মনে হয়। কেননা ঝাঁড়-ফুঁক, পানি পড়া, তাবিজ-তাগা ইত্যকার অবৈজ্ঞানিক উৎস-উদ্ভূত হাতুড়ে চিকিৎসার কথাও আমরা কম-বেশি সবাই জানি। কিন্তু এগুলোকে আদৌ চিকিৎসা বলে কিনা তা ডাক্তার সাহেবরাই ভালো বলতে পারবেন। আমি বরং সমকালীন ছড়া বিষয়ে এই গৌড়চন্দ্রিকার কারণটাতেই সরাসরি প্রবেশ করি। কেননা, সমকালীন ছড়ার অভিধাটা কেন যেন ওই বৈজ্ঞানিক উপায়ে চিকিৎসার মতোই অদ্ভূতুড়ে মনে হয়। কিভাবে ?
.
‘সমকালীন ছড়া’ বলতে আমরা আসলে কী বুঝবো ? এই শব্দ-যুগল উচ্চারণের সাথে সাথে আমরা চাই বা না-চাই, আমাদের সক্রিয় মানব-মস্তিস্কের বিস্ময়কর যুক্তি-শৃঙ্খলায় প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে কতকগুলো ভিন্ন ভিন্ন ক্রাইটেরিয়া বা শ্রেণীবৈশিষ্ট্য স্বয়ংক্রিয়ভাবেই তৈরি হয়ে যাবে। এবং সেগুলো আমাদের অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞানে কিছু কিছু বিমূর্ত ছায়াপাতও ঘটাবে। আর যেগুলো পূর্ব অভিজ্ঞতার আয়ত্তে থাকবে না, সেগুলো হয়তো কিছু কিছু প্রশ্নাকার জিজ্ঞাসার জন্ম দেবে। সবই যে সচেতনভাবে ঘটবে এমন কথা নেই, অবচেতনেও এসব কাল্পনিক প্রশ্নকল্প তৈরি হতে পারে। সব মিলিয়ে আমাদের ভাবনাজগতে যে স্পষ্ট-অস্পষ্ট প্রশ্নের আলোড়ন তৈরি হবে, সেই জটের মধ্যেই আসলে আমাদের উদ্দিষ্ট উত্তরগুলো নিহিত। সেগুলো কী ? আসলে প্রশ্ন করতে জানলে উত্তর নাকি এমনিতেই এসে ধরা দেয় ! আমরা কি তাহলে সেরকম কিছু একটু চেষ্টা করে দেখবো ? তবে আগেভাগেই বলে নেয়া ভালো, যাঁরা সব প্রশ্নের উত্তর জেনে বুদ্ধিমান ও জ্ঞানী হয়ে বসে আছেন তাঁদের জন্যে এ লেখা নয়। আমার মতো হাবাগোবা যাঁরা এক পা আগাতেই একটা প্রশ্নের পিঠে আরেকটা বেয়াড়া প্রশ্ন এসে খাড়া হয়ে যায়, হয়তো তাঁরাই এখানে সঙ্গি হতে সাচ্ছন্দ্য বোধ করতে পারেন।
.
সে যাক্, প্রথমেই, সমকালীন বলতে আমরা কী বুঝি ? যেহেতু বলা হচ্ছে সমকালীন ছড়া, তাহলে সমকালীনের বাইরে নিশ্চয়ই ছড়ার আরো নানান প্রকারভেদ রয়েছে ? সেগুলো কী ? এবং নিতান্ত নির্বোধের মতোই প্রসঙ্গক্রমে এটাও মনে এসে যায়, প্রকৃতপক্ষে ছড়া-ই বা কী ? অর্থাৎ কাকে আমরা ছড়া বলি ? বড়ই মৌলিক প্রশ্ন। এভাবে প্রশ্নের পর প্রশ্ন আসতেই থাকবে। তারচে আমরা বরং একটু একটু জট খুলে এগিয়ে দেখি কোথায় কী অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
.
(০২)
বাংলা একাডেমীর ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’-এ ‘সমকালীন’ শব্দটির দুটো অর্থ দেয়া আছে- একই কালের ও সমসাময়িক। এবং এটি একটি বিশেষণবাচক শব্দ। অতএব শব্দটির বুৎপত্তিগত দিক বিবেচনায় নিলে আমরা এটুকু বুঝতে পারি যে, রচয়িতার সমসাময়িক প্রসঙ্গ নিয়ে রচিত ছড়াই সমকালীন ছড়া। সাথে সাথে প্রশ্ন আসে, সমকালীন প্রসঙ্গের বাইরেরগুলোকে কী বলে তাহলে ? প্রশ্নটা যে অতি নির্বোধের মতোই হয়ে গেছে তা বুঝতে পারি যখন খুব দুর্ভাগ্যজনকভাবেই সেরকম কোন নমুনার হদিস পাওয়া যায় না কোথাও। এটা আমারই সীমাবদ্ধতা হতে পারে। কিন্তু যিনি যখনই লিখে থাকেন না কেন, রচয়িতার সমকালীন অনুসঙ্গ বা আবহের বাইরে কেউ কি যেতে পারেন না ? একালের ছড়াকারদের রচনা থেকে শুরু করে একটু একটু পেছনের দিকে হঠতে হঠতে লোকছড়া ছাড়িয়ে শেষপর্যন্ত সেই চর্যার কালে আনুমানিক দশম থেকে দ্বাদশ শতকে গিয়ে ঠেকলাম। সেখানেও তথৈবচঃ !
উঞ্চা উঞ্চা পাবত তহিঁ বসই সবরী বালী।
মোরাঙ্গ পীচ্ছ পরিহাণ সবরী গীবত গুঞ্জরী মালী।।
উমত সবরো পাগল সবরো মা কর গুলী গুহারী।
তোহোরী ণিঅ ঘরিণী ণামে সহজ স্ন্দুরী।।… -(চর্যাগীতিকা-২৮ : শবরপাদানাম্)।
অর্থাৎ : উঁচু উঁচু পর্বত, সেখানে বাস করে শবরী বালিকা। ময়ূরের পুচ্ছ পরিধান করে শবরী, গলায় গুঞ্জার মালা। (ওগো) উন্মত্ত শবর, পাগল শবর, গোলমাল (কিংবা) অভিযোগ কোরোনা। সহজ সুন্দরী নামে (ঐ শবরীই) তোমার নিজ গৃহিনী।
.
প্রাচীন বৌদ্ধ চর্যাকারদের এই দোহা’য় সাহিত্যরূপের আড়ালে যত গূঢ় সাধনতত্ত্বই থাকুক না কেন, এর উপাস্থপিত সাহিত্যরূপের চিত্রণে সমকালীন চিত্রকল্প বা আবহকে অস্বীকার করা যায় নি কিছুতেই। কিংবা কৃষিজীবী সমাজের জনভাষ্যে মিশে থাকা আমাদের লোকভাষ্যকারদের লোকায়ত বচনগুলোও যদি খেয়াল করা যায়, এর ব্যত্যয় ঘটে না-
 ‘ষোল চাষে মুলা/ তার অর্ধেক তুলা/ তার অর্ধেক ধান/ বিনা চাষে পান’।।
‘বেঙ ডাকে ঘন ঘন,/ শীঘ্র হবে বৃষ্টি জান’।।
‘বামুন বাদল বান,/ দক্ষিণা পেলেই যান’।। -(খনার বচন)।
.
অথবা, ধারণামতে নবাব আলীবর্দী খাঁ’র আমলের দুঃসহ সময়কে ধরে রাখা সেই বুকে ইতিহাস উৎকীর্ণ করা লোক ছড়াটি যদি বিবেচনা করি?-

‘ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এল দেশে/ বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেবো কিসে?/ ধান ফুরুল, পান ফুরুল খাজনার উপায় কি?/ আর কটা দিন সবুর কর, রসুন বুনেছি।’ -(লোকছড়া)।
.
কিংবা-

‘আমরা দুটি ভাই, শিবের গাজন গাই/ মা গিয়াছেন গয়াকাশী, ডুগডুগি বাজাই।’ -(লোকায়ত ছড়া)।
.
স্থান, কাল, পাত্র, পরিবেশ, পরিস্থিতির ইঙ্গিতবহ এরকম সাহিত্য-নমুনার তালিকা টেনে টেনে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর করা যেতে পারে, এবং চাইলে একালেরও অগুনতি নমুনা হাজির করা যেতে পারে। কিন্তু সমকালীনতার বাইরে রচিত ছড়া-সাহিত্যের নমুনা বিরলই বলা যায়। তবে কি সমকালীনতার বাইরে গিয়ে ছড়া-সাহিত্য রচনা অসম্ভব ? সেটা সম্ভব কি অসম্ভব এ সিদ্ধান্ত জানানোর মুরোদ বা যোগ্যতা এ অর্বাচীন লেখকের আয়ত্তের বাইরে। কিন্তু সমকালীনতার বাইরে গিয়ে ছড়া রচনা যে অপ্রাসঙ্গিক, তা নিয়ে কারোর দ্বিমত আছে বলে জানা নেই। এক্ষেত্রে ‘উড়কী ধানের মুড়কী’ গ্রন্থের তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকায় অন্নদাশঙ্কর রায়ের উক্তিটি খুবই প্রণিধানযোগ্য মনে হয়, যেখানে তিনি বলছেন- ‘…ছড়া লেখার উপকরণ আসে সমসাময়িক ঘটনা বা পরিস্থিতি থেকে।…’ আধুনিক ছড়ায় সমসাময়িক ঘটনা কিভাবে সার্থক উপকরণ হয়ে ওঠতে পারে তার নমুনা অন্নদাশঙ্কর নিজেই-
তেলের শিশি ভাঙল বলে/ খুকুর ’পরে রাগ করো,/ তোমরা যে সব বুড়ো খোকা/ ভারত ভেঙে ভাগ করো !/ তার বেলা ?
ভাঙছ প্রদেশ ভাঙছ জেলা/ জমিজমা ঘরবাড়ী/ পাটের আড়ৎ ধানের গোলা/ কারখানা আর রেলগাড়ী !/ তার বেলা ?
চায়ের বাগান কয়লাখনি/ কলেজ থানা আপিস-ঘর/ চেয়ার টেবিল দেয়ালঘড়ি/ পিয়ন পুলিশ প্রোফেসর !/ তার বেলা ?
যুদ্ধ-জাহাজ জঙ্গী মোটর/ কামান বিমান অশ্ব উট/ ভাগাভাগির ভাঙাভাঙির/ চলছে যেন হরির-লুট !/ তার বেলা ?
তেলের শিশি ভাঙল বলে/ খুকুর পরে রাগ করো/ তোমরা যে সব ধেড়ে খোকা/ বাঙলা ভেঙে ভাগ করো !/ তার বেলা ?
-(খুকু ও খোকা / অন্নদাশঙ্কর রায়)
.
জনমানুষের চেতনাকে নাড়া দেবার মতো ছড়া দিয়ে উত্থাপিত সমস্যার সমাধান হোক বা না-হোক, ভারত বা বাঙলা ভেঙে ভাগ করার রাজনৈতিক চালিয়াতির বিরুদ্ধে তৎকালীন রাষ্ট্রনৈতিক পরিস্থিতিতে রচিত এ ছড়ায় সংশ্লিষ্ট আত্মকেন্দ্রিক নেতৃত্বকে কটাক্ষ আর ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ সুস্পষ্ট। এটা রচয়িতার সমকালীন পরিস্থিতিতে আলোচিত বিষয় ছিলো নিঃসন্দেহে। এবং বিষয়ের অনুষঙ্গ হয়ে আসায় তা থেকে মানবেতিহাসের কোন একটা অঞ্চলের কোন একটা সময়ের সাহিত্য-দলিল হিসেবে ছড়াটি চিহ্নিত হয়ে থাকে। এরকম আরেকটি নমুনা-
ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ / দুপুর বেলার অক্ত/ বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায় ?/ বরকতের রক্ত।
হাজার যুগের সূর্যতাপে/ জ্বলবে এমন লাল যে,/ সেই লোহিতেই লাল হয়েছে/ কৃষ্ণচূড়ার ডাল যে !
প্রভাতফেরীর মিছিল যাবে/ ছড়াও ফুলের বন্যা/ বিষাদগীতি গাইছে পথে/ তিতুমীরের কন্যা।
চিনতে না কি সোনার ছেলে/ ক্ষুদিরামকে চিনতে ?/ রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিলো যে/ মুক্ত বাতাস কিনতে ?
পাহাড়তলীর মরণ চূড়ায়/ ঝাঁপ দিল যে অগ্নি,/ ফেব্রুয়ারির শোকের বসন/ পরলো তারই ভগ্নী।
প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী/ আমায় নেবে সঙ্গে,/ বাংলা আমার বচন, আমি/ জন্মেছি এই বঙ্গে।
-(একুশের কবিতা / আল মাহমুদ)।
.
কেউ কেউ এই উদ্ধৃত ছড়াগুলিকে রাজনৈতিক ছড়া হিসেবেও আখ্যায়িত করেন। অনুষঙ্গ বিবেচনায় রেখে চাইলে এরকম আরো অনেক নামকরণই করা যেতে পারে, যেমন- প্রেমের ছড়া, হাসির ছড়া, বিয়ের ছড়া, বিপ্লবের ছড়া, বিদ্রোহের ছড়া, বয়স্ক ছড়া, শিশুতোষ ছড়া, ননসেন্স ছড়া ইত্যাদি ইত্যাদি। সে বিবেচনায় উপরিউক্ত ছড়াগুলি রাজনৈতিক ছড়া হতেই পারে। অনুষঙ্গের বিচারে ছড়ার এই বিশেষিত রূপকে আমরা হয়তো অস্বীকার করতে পারি না। কেননা অনুষঙ্গ দিয়ে নির্দিষ্ট কোন ছড়ার বহিঃরঙ্গের স্থিতিশীল চেহারাটাকে হয়তো বা চিহ্নিত করা চলে। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন অন্যত্র। ইতিহাসের ক্ষণ বিচারে এই ছড়াগুলির সমকালীনতা সংশ্লিষ্ট ক্ষণের সাথে খুবই নিবিড় বাঁধনে জড়ানো। একটা সময়ে এগুলি তখনকার সমকালীন ছড়া হিসেবে নিশ্চয়ই আলোচিতও হয়েছে। তদুপরি এখন কি আমরা সেই কালোত্তীর্ণ ছড়াগুলিকে বর্তমানের সাপেক্ষে সমকালীন ছড়া বলতে পারি ? অর্থাৎ সমকালীনতা কি ছড়ার কোন স্থায়ী পরিচিতি হতে পারে ? প্রশ্নটাকে হেলাফেলা করার সুযোগ আছে কিনা জানি না। কেননা, যদি এগুলিকে এখনো সমকালীন ছড়া বলা না যায় তাহলে কোন ছড়াকে সমকালীন হিসেবে বিশেষিত করার আগে আমাদেরকে ফের আরো কিছু পুনঃবিবেচনার দ্বারস্থ হতে হবে। সেই বিবেচনাগুলি কী ? ছড়ার প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য।
.
(০৩)
ধান ভানতে শিবের গীত’ প্রবাদটা যত কটাক্ষপূর্ণ হোক না কেন, আমাদের লোকায়ত জনগোষ্ঠিতে ধান ভানতে গিয়ে কখনো কখনো শিবের গীত যে প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ ছিলো তা জনশ্রুতিতে এই লোকপ্রবাদের অক্ষুণ্ন বহমানতা থেকেই টের পাওয়া যায়। ছড়া প্রসঙ্গেও যে-কোন বিষয়ে আলোচনা করতে গেলেই যে শেষপর্যন্ত ছড়ার প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যের শিবের গীতে অনিবার্যভাবেই ফিরে আসতে হয়, তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে ! কেননা, ছড়ার প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যের মধ্যেই আসলে ছড়া সম্পর্কিত প্রশ্নগুলোর উত্তর মিশে থাকে। তাছাড়া আরেকটা ব্যাপার ল্ক্ষ্যণীয় যে, আমাদের ছড়া-সাহিত্য নিয়ে যাঁরা বর্তমানে নিয়মিত চর্চা করছেন তাঁদের মধ্যে অনাবশ্যকভাবেই ছড়ার প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনায় খুবই নির্লিপ্ত একটা ভাব ইদানিং খুব উৎকটভাবেই পরিলক্ষিত হচ্ছে। তাঁদের এই নির্লিপ্তির উৎসটাও চিহ্নিত হওয়া জরুরি। তাই কখনো কখনো চর্বিত চর্বণ হলেও বারবার এই শিবের গীত গাওয়া ছাড়া উপায় কী ! এরা পিঠে কুলো বেঁধেছেন কি বাঁধেন নি তা গুরুত্বপূর্ণ নয়, জরুরি হচ্ছে কানের তুলোটা খুলে ফেলার সময় যে গত হচ্ছে সেটা অনুধাবন করছেন কিনা।
.
ছড়া নিয়ে আলোচনায় হ্যাঁপাও কম নয়। কেননা, আলোচনার শুরুতেই যে বিষয়গুলোর জট খোলার প্রয়োজন হয়ে পড়ে, তা হলো-
প্রথমতঃ সাহিত্য বিচারে বাংলা ছড়ার বিশাল ভাণ্ডারকে দুটি অংশে ভাগ করা হয়ে থাকে। লোকছড়া এবং আধুনিক ছড়া। ছড়ার যে অংশ অজ্ঞাত রচয়িতার মৌখিক সৃষ্টি, তা-ই লোকছড়া। আর আধুনিক যুগে লেখকদের রচিত ছড়াই আধুনিক ছড়া। এ সংজ্ঞা খুব মোটাদাগে আংশিক সত্য হতে পারে, কিন্তু তা কোনভাবেই পরিপূর্ণ সংজ্ঞা নয়। কেননা এতে সুনির্দিষ্টভাবে রচনার কোন কালনির্দেশনা নেই। আর আধুনিক যুগেও অজ্ঞাত রচয়িতা থাকতে পারে। তাছাড়া আধুনিক যুগ কথাটিতেও যথেষ্ট অস্পষ্টতা রয়েছে। বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ, বিশ্বসাহিত্যের আধুনিক যুগ, ইতিহাসের আধুনিক যুগ কিংবা সভ্যতার আধুনিক যুগের মধ্যে বিস্তর ফারাক। তাই আধুনিক যুগের লেখক বলতে কাদেরকে বোঝানো হয় তা চিহ্নিত করাটাও জরুরি।
দ্বিতীয়তঃ লোকছড়ার বৈশিষ্ট্যগুলি চিহ্নিত করে তার সাথে আধুনিক ছড়ার বৈশিষ্ট্য ও পার্থক্য নিরূপন করা।
তৃতীয়তঃ ছড়ার সাথে একই ধাঁচের অন্যান্য সাহিত্যকর্ম যেমন কবিতা ও পদ্যের পার্থক্য চিহ্নিত করা।
অতঃপর ছড়া বিষয়ক প্রাসঙ্গিক আলোচনার সূত্র ধরে একটা সমন্বিত মতামত প্রয়োগ বা আপাত কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া।
.
এ প্রেক্ষিতে এই দীর্ঘ পরিক্রমায় যাওয়ার সুযোগ নেই বলে খুব মোটা দাগে বিষয়গুলো চিহ্নিত করে আমাদের প্রাসঙ্গিক আলোচনায় আপাত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর চেষ্টা করা হবে। সে অনুযায়ী প্রথমেই লোকছড়ার সাথে আধুনিক ছড়ার কালবিভাজনটা চিহ্নিত করে নেয়া যেতে পারে।
.
লোকছড়া কেন অজ্ঞাত রচয়িতার মৌখিক সৃষ্টি হবে ? কারণ লিখে রাখার অবারিত সুযোগ ও সম্ভাবনা তখনো সৃষ্টি হয়নি বলে। কেননা তখনো ভাষার সুনির্দিষ্ট কোন লিখিত রূপ ও কাঠামো তৈরি হয়নি, শাসন কাঠামো থেকে সামন্ততন্ত্রের উৎখাত হয়নি এবং সমাজ গঠনে তখনো নগর ও নগরকেন্দ্রিকতার বিকাশ ঘটে নি, যা সম্পন্ন হলেই আধুনিক যুগের উন্মেষ হয় বলে সমাজবিজ্ঞানীদের অভিমত। আর যুগ-সাহিত্যে আধুনিকতার উন্মেষে মুদ্রণযন্ত্রের প্রচলন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও প্রধান বৈশিষ্ট্য সন্দেহ নেই। তাই তৎকালীন বঙ্গ সমাজ ও জীবনে আধুনিক যুগের সূচনা বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ তাঁর গবেষণা গ্রন্থ ‘ছড়ায় বাঙালী সমাজ ও সংস্কৃতি’-এ উল্লেখ করেন-
‘বিশ্বপর্যায়ে সামন্তবাদী শাসনের সর্বশেষ শক্ত ঘাঁটির বিলোপ ঘটে কনস্টান্টিনোপলের পতনের (১৪৫৩) মধ্য দিয়ে। পরবর্তী সময়ে ইউরোপীয় রেঁনেসা, মুদ্রণযন্ত্রসহ কতিপয় যুগান্তকারী উদ্ভাবন, বিজ্ঞানসহ জ্ঞানের তুলনাহীন বিকাশ আধুনিক যুগের ভিত্তি স্থাপন করে। সমাজবিকাশের ধারায় মধ্যযুগে সামন্তবাদের সঙ্গে এবং আধুনিক যুগ ধনবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত। অন্যদিকে আধুনিক যুগের আর একটি বৈশিষ্ট্য হিসেবে বিকশিত হয় নগর ও নগরকেন্দ্রিকতা।
ইউরোপে পঞ্চদশ শতকে সামন্তবাদের অবসান ঘটলেও বঙ্গে তা আরও তিনশত বছর অব্যাহত ছিল। ভারতীয় উপমহাদেশের মধ্যে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা অঞ্চল নিয়ে গঠিত তৎকালীন সুবায় সামন্তবাদী নবাবী শাসনের অবসান ঘটে পলাশীর যুদ্ধে (১৭৫৭) তাদের পরাজয়ের ফলে। সিরাজ-পরবর্তী সময়ে মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে মীর জাফর, মীর কাশিম প্রমুখ আসীন হলেও রাজদণ্ডের প্রকৃত মতা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর করতলগত ছিল। সমাজ বিচারে উক্ত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী ছিল ধনতন্ত্রের প্রথম পর্যায় বণিক ধনতন্ত্র (Mercantile Capitalism)-এর প্রতিনিধি। ধনতন্ত্রের সঙ্গে আধুনিকতার অচ্ছেদ্য বন্ধন, তাই বঙ্গেও সূচিত হয় আধুনিক যুগ ও জীবনের।’
.
আরো অনেক পর এই বৃটিশ-ইন্ডিয়ায় মুদ্রণযন্ত্রের প্রচলন হলে আমরা জানি যে উনিশ শতকের শেষভাগে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও যোগীন্দ্রনাথ সরকার বাংলা লোকছড়ার সংগ্রহ এবং তা সাহিত্য পত্রিকার মাধ্যমে ও পুস্তকাকারে জনসমে প্রথম প্রকাশের উদ্যোগ নেন। অতএব মুখে মুখে লোকছড়া রচনাকালের সাথে আধুনিক ছড়া রচনার একটা কালক্রমের আভাস আমরা এ থেকে পেয়ে যাই। আর মুখে মুখে রচিত লোকছড়ার রচয়িতারা যেহেতু সরাসরি কৃষিভিত্তিক সমাজের প্রতিনিধি ছিলেন, তাই লোকছড়ার প্রাণ ও রূপটিও সেই কৃষি-সংশ্লিষ্ট উপাদান, উপকরণ, উপাচার ও জীবনযাত্রাকেই প্রতিফলিত করে। অন্যদিকে আধুনিক ছড়া তার কালকে কোনভাবেই উপেক্ষা করতে পারে না। তাই লোকায়ত শ্রুতি ও স্মৃতিনির্ভর জীবনধারার বাহুল্যবর্জিত সারল্য, তত্ত্ব-উপদেশমুক্ত লঘু চিন্তা, ভাব ও প্রাকৃত ছন্দ লোকছড়ায় প্রতিফলিত হলেও আধুনিক জীবনধারায় স্বভাবতই তা অধিকতর জটিলরূপে উদ্ভাসিত। 
.
এ হচ্ছে ছড়ার প্রকৃতিগত দিক। তবে সমকালীন ছড়ার বিশিষ্টতা বুঝতে গেলে আমাদেরকে আগে আধুনিক ছড়ার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হতে হয়। কিন্তু আধুনিক ছড়ার বৈশিষ্ট্য কী হবে, তা কি নির্ধারণ করা হয়েছে ? আমাদের প্রথাগত সাহিত্যে কবিতা বা পদ্যের রূপ বা বৈশিষ্ট্য কী হবে তার একটা ধারণা বা মাপকাঠি হয়তো দাঁড়িয়ে গেছে। কী সেই মাপকাঠি ? রবীন্দ্রনাথের কথাকে ধার করেই বলতে হয়- ‘রূপের মধ্যে অরূপের সন্ধানই কবিতা’। অর্থাৎ প্রয়োজনীয় শব্দের পর শব্দ সাজিয়ে যে অপরূপ শব্দচিত্র বা দৃশ্য আঁকা হয় তার মধ্যে অরূপের সন্ধান অর্থাৎ অন্তর্গত অনুভূতির রসে ভিন্ন কোন অর্থের আবহ তৈরি করাকে কবিতা বলা যায়। আক্ষরিক ব্যাখ্যাযোগ্যতার গভীরে ক্রিয়াশীল অন্য এক উপলব্ধির অর্থময় অনুভব। পাঠকমনের সৃজনশীল কল্পনা যেখানে ক্রিয়াশীল হবার বিষয়নিষ্ঠ সুযোগ পেয়ে  যায়। এ প্রেক্ষিতে সহজ সাবলীল একটি যথার্থ কবিতার নমুনা উদাহরণ দেখা যেতে পারে-
‘অমলকান্তি আমার বন্ধু,
ইস্কুলে আমরা একসঙ্গে পড়তাম।
রোজ দেরি করে কাসে আসত, পড়া পারত না,
শব্দরূপ জিজ্ঞেস করলে
এমন অবাক হয়ে জানলার দিকে তাকিয়ে থাকত যে,
দেখে ভারি কষ্ট হত আমাদের।
আমরা কেউ মাস্টার হতে চেয়েছিলাম, কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল।
অমলকান্তি সে-সব কিছু হতে চায়নি।
সে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।
ক্ষান্তবর্ষণ কাক-ডাকা বিকেলের সেই লাজুক রোদ্দুর,
জাম আর জামরুলের পাতায়
যা নাকি অল্প একটু হাসির মতন লেগে থাকে।
আমরা কেউ মাস্টার হয়েছি। কেউ ডাক্তার, কেউ উকিল
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারেনি।
সে এখন অন্ধকার একটা ছাপাখানায় কাজ করে।
মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে।
চা খায়, এটা-ওটা গল্প করে, তারপর বলে “উঠি তাহলে।”
আমি ওকে দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসি।
আমাদের মধ্যে যে এখন মাস্টারি করে,
অনায়াসে সে ডাক্তার হতে পারত ;
যে ডাক্তার হতে চেয়েছিল,
উকিল হলে তার এমন-কিছু ক্ষতি হত না।
অথচ, সকলেরই ইচ্ছে পূরণ হল, এক অমলকান্তি ছাড়া।
অমলকান্তি রোদ্দুর হতে পারে নি।
সেই অমলকান্তি- রোদ্দুরের কথা ভাবতে ভাবতে
যে একদিন রোদ্দুর হতে চেয়েছিল।
-(অমলকান্তি / নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী)
.
 অন্যদিকে ভাষাগত শব্দ ও অক্ষরে সৃষ্ট চেনা দৃশ্যের গভীরে যদি আর কোন দ্যোতনাময় অনুভব ও রসময় উপলব্ধির ছোঁয়া না থাকে বা ভিন্ন কোন অর্থদ্যোতনা তৈরি করতে না পারে এবং পাঠককে তাঁর নিজস্ব কল্পনার কোন অবকাশ না দিয়ে বর্ণিত অর্থটাই যদি একমাত্র আক্ষরিক ব্যাখ্যা হয়ে ওঠে, তবে সেটাকে নিশ্চিতভাবে পদ্য বলে ধরে নিতে পারি আমরা। এবং এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, পদ্যও একটা সাহিত্য মাধ্যম। এক্ষেত্রে একটা সার্থক বিখ্যাত পদ্যের উদাহরণ-
আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে,
বৈশাখ মাসে তার হাঁটু জল থাকে।
পার হয়ে যায় গরু পার হয় গাড়ি,
দুই ধার উঁচু তার ঢালু তার পাড়ি।
.
চিকচিক করে বালি, কোথা নাই কাদা,
এক ধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা।
কিচিমিচি করে সেথা শালিকের ঝাঁক,
রাতে ওঠে থেকে থেকে শেয়ালের হাঁক।
.
তীরে তীরে ছেলে মেয়ে নাহিবার কালে,
গামছায় জল ভরি গায়ে তারা ঢালে।
সকালে বিকালে কভু নাওয়া হলে পরে
আঁচলে ছাঁকিয়া তারা ছোটো মাছ ধরে।
.
আষাঢ়ে বাদল নামে নদী ভর ভর
মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর ।
দুই কূলে বনে বনে প’ড়ে যায় সাড়া,
বরষার উৎসবে জেগে ওঠে পাড়া।
[অংশ]
-(আমাদের ছোট নদী / রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
.
পদ্য ও কবিতার এই ভাবগত বৈশিষ্ট্যের বাইরেও আরো কিছু প্রকরণগত বৈশিষ্ট্য হয়তো বলার বাকি রয়ে গেছে। কিন্তু সেগুলো কোন গুরুতর বিষয় নয় কিংবা বর্তমান আলোচনার জন্যে গুরুত্বপূর্ণ নয়। তবে পদ্য ও কবিতার মতো সাহিত্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ও সর্বপ্রাচীন মাধ্যম ছড়ার বৈশিষ্ট্য চিহ্নিত করা না-গেলে মূলত ছড়া বিষয়ক সকল আলোচনাই যে অর্থহীন হয়ে যায়, এটা আমাদের বর্তমানকালের অনেক আঁতেল ছড়াকারই বুঝতে চান না। কেন বুঝতে চান না, তাও এক রহস্যপূর্ণ বিষয় বৈ কি। হয়তো তাঁদের ভাবটা এরকম যে, তাঁদের কাজ হলো লিখে যাওয়া, আর এসব লেখা থেকে যাঁদের প্রয়োজন তাঁরা এসে বৈশিষ্ট্য নির্ধারণ করবে। অন্ধ হলেই কি আর প্রলয় বন্ধ থাকে ! হয়তো তাঁরা ভুলে যান বা আদৌ অবগত নন যে, সেই উনিশ শতকের শেষভাগ থেকেই রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে বাঙলা সাহিত্যের সব বাঘা বাঘা মহাজন ব্যক্তিরাই ছড়া সম্পর্কিত তাত্ত্বিক ও তথ্যমূলক আলোচনার সূত্রপাত ঘটিয়ে গত এক শতাব্দিকাল যাবৎ বিশেষজ্ঞ মত ও প্রতিমত চালাচালির মাধ্যমে রীতিমতো ঝড় বইয়ে দিয়েছেন। যদিও লোকছড়া প্রসঙ্গে তাঁদের সেসব মতামত থেকে আধুনিক ছড়ার কোন সংজ্ঞা নির্ধারিত হয়নি, তবু তা থেকে ছড়ার বৈশিষ্ট্য বিচার্য্য একটা রূপরেখা দাঁড় করানো অসম্ভব কিছু নয়। সে বিবেচনায় ছড়া প্রসঙ্গে সেসব মতামতের কিছু মহাজন উক্তি উদ্ধৃত করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
.
(০৪)
এক্ষেত্রে আরো অনেক বিষয়ের মতোই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই আমাদের অগ্রণী পুরুষ। তাঁর হাত দিয়েই বাংলা লোকছড়ার সংগ্রহ শুরু হয় এবং তিনিই এই লোকছড়াকে সাহিত্য পত্রিকার মাধ্যমে জনসমক্ষে প্রথম প্রকাশের উদ্যোগ নেন। পাশাপাশি এগুলোকে ছেলে-ভুলানো ছড়া বা মেয়েলি ছড়া নামে অভিহিত করে এ সম্পর্কিত আলোচনারও সূত্রপাত ঘটান তিনি। ‘ছিন্নপত্রাবলীতে’ ৫ সেপ্টেম্বর ১৮৯৪ এর একটি পত্র-বিচিত্রায় উল্লেখ করেন-

‘…ছড়ার একটা স্বতন্ত্র রাজ্য আছে, সেখানে কোনো আইন কানুন নেই- মেঘরাজ্যের মতো।…’
.
১৩০১ বঙ্গাব্দে তাঁর ‘লোকসাহিত্য’ রচনায় ‘ছেলেভুলানো ছড়া-১’ পর্বে রবীন্দ্রনাথ বলেন-

‘আমি ছড়াকে মেঘের সহিত তুলনা করিয়াছি। উভয়েই পরিবর্তনশীল, বিবিধ বর্ণে রঞ্জিত, বায়ুস্রোতে যদৃচ্ছ ভাসমান। দেখিয়া মনে হয় নিরর্থক। ছড়াও কলাবিচারে শাস্ত্রের বাহির, মেঘবিজ্ঞানও শাস্ত্র নিয়মের মধ্যে ভাল করিয়া ধরা দেয় নাই। অথচ জড় জগতে এবং মানব জগতে এই দুই উচ্ছৃঙ্খল অদ্ভুত পদার্থ চিরকাল মহৎ উদ্দেশ্য সাধন করিয়া আসিতেছে।’
.
অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথ বলতে চাচ্ছেন যে ছড়া কোন নির্দিষ্ট নিয়ম-শৃঙ্খলে আবদ্ধ নয়। সত্যি কি তাই ? এবং একই রচনায় রবীন্দ্রনাথ আরো বলেন-

‘…তাহারা মানবমনে আপনি জন্মিয়াছে।…ইহার মধ্যে ভাবের পরস্পর সম্বন্ধ নাই, …কতকগুলি অসংলগ্ন ছবি নিতান্ত সামান্য প্রসঙ্গসূত্র অবলম্বন করিয়া উপস্থিত হইয়াছে।… গাম্ভীর্য নয়, অর্থের মারপ্যাঁচ নয়, সুরময় ধ্বনিই ছড়ার প্রাণ।…’
.
আবার আশ্বিন ১৩৪৪ বঙ্গাব্দে ‘ছড়ার ছবি’ রচনায় রবীন্দ্রনাথ বলেন-

‘…ছড়ার ছন্দ প্রাকৃত ভাষার ঘরাও ছন্দ।…এর ভঙ্গীতে এর সজ্জায় কাব্যসৌন্দর্য সহজে প্রবেশ করে, কিন্তু সে অজ্ঞাতসারে। এই ছড়ায় গভীর কথা হালকা চালে পায়ে নূপুর বাজিয়ে চলে, গাম্ভীর্যের গুমোর রাখে না।… ছড়ার ছন্দকে চেহারা দিয়েছে প্রাকৃত বাংলা শব্দের চেহারা।… বাংলা প্রাকৃত ভাষায় হসন্ত-প্রধান ধ্বনিতে ফাঁক বুজিয়ে শব্দগুলিকে নিবিড় করে দেয়।’
.
অন্যদিকে ১৩৪৮ বঙ্গাব্দে মোহিতলাল মজুমদার তাঁর ‘বাংলা কবিতার ছন্দ’ গ্রন্থে ছড়ার ছন্দ নিয়ে বৈশিষ্ট্যময় মন্তব্য করেন-

‘এই ছন্দের সাধারণ রূপটির প্রধান উপাদান দুইটি-
১. ইহার ধ্বনিস্থানের সংখ্যা সর্বদাই চার, এবং
২. আদ্য বর্ণের ঝোঁকটিকে সমৃদ্ধ করিবার জন্য ধ্বনিস্থানের উপযুক্ত অবকাশে হসন্তের সন্নিবেশ।’
.
ছড়ায় হসন্ত নিয়ে এতো যে তোলপাড়, যোগীন্দ্রনাথ সরকার কর্তৃক সংগৃহীত ও ১৩০৬ বঙ্গাব্দে লোকছড়ার প্রথম সংকলিত গ্রন্থ ‘খুকুমণির ছড়া’ থেকে তার একটি নমুনা যাচাই করে নিতে পারি আমরা-
চৌধরী বাড়ির মৌধরি পিঠা,
গয়লা বাড়ির দই;
সকল চৌধরী খেইতে বৈছে,
বুড়া চৌধরী কই?
বুড়া চৌধরী গাই দুয়ায়,
গাইয়ে দিল লাথ;
সকল চৌধরী মইরা গেল
শনিবারের রাইত্ !
-(চৌধরী / খুকুমণির ছড়া)
.
উল্লেখ্য, আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, লোকায়ত সাহিত্য বিশেষ করে লোকায়ত ছড়া সাহিত্য থেকেই পরবর্তী সাহিত্য-কলাশাস্ত্রের উদ্ভব। সাহিত্য যখনো তার লেখ্যরূপ পায়নি, মুখে মুখে রচিত শ্লোক, গান বা ছড়াই যখন সকল সামাজিক কর্মকাণ্ডের শ্রুতিমাধ্যম হয়ে বহমান, আধুনিক শাস্ত্রবিচারিক পণ্ডিতদের আবির্ভাব নিশ্চয়ই এর পূর্বে ঘটে নি। এ কথাটা মনে রেখেই আবারো আমরা মহাজন উক্তিতে ফিরে যাই। ‘লোকসাহিত্য’ বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে সুকুমার সেন তাঁর ‘বিচিত্র সাহিত্য’ গ্রন্থে বলেন-

‘…লোকসাহিত্যের যে শাখাটি অন্তপুরের আঙিনায় স্নিগ্ধ ছায়া বিস্তার করেছে তা ঘুমপাড়ানি ও ছেলেভুলানো ছড়া। এই ছড়ার মধ্যেই লুকিয়ে আছে সর্বদেশের সর্বকালের আদিম কবিতার বীজ, বাণীর প্রথম অঙ্কুর। আদি মানবজননীর কণ্ঠের অর্থহীন ছড়ার টানা সুর ছন্দের জন্ম দিয়েছে।… ছেলেভুলানো ছড়া কবিতাই। তবে তার নির্মাণরীতি সাধারণ কবিতার থেকে আলাদা। সাধারণ কবিতা লেখবার সময় কবির কল্পনা বিচরণ করে ভাব থেকে রূপে, রস থেকে ভাষায়। ছড়া কবিতায় লেখকের কল্পনা যায় রূপ থেকে ভাবে, ভাষা থেকে রসে, এবং তাতে রূপের ও ভাবের মধ্যে, ভাষা ও রসের সঙ্গে কোন রীতিসিদ্ধ যোগাযোগ বা সঙ্গতি আবশ্যিক নয়।…’
.
তবে লোকসাহিত্য তথা ছড়া নিয়ে দীর্ঘসময়ব্যাপী তাৎপর্যপূর্ণ গবেষণা করেছেন আশুতোষ ভট্টাচার্য। ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘বাংলার লোক-সাহিত্য’ গ্রন্থে ছড়া নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা রয়েছে। আমরা কেবল খুব সামান্য পরিসরে তাঁর চুম্বক অংশটা উদ্ধৃত করবো-

‘…যাহা মৌখিক আবৃত্তি করা হয়, তাহাই ছড়া, যাহা তাল ও সুরসহ গান করা যায়, তাহাই সঙ্গীত।… ছড়ার সুর বৈচিত্র্যহীন, সঙ্গীতের সুর বৈচিত্র্যময়।…
…ছড়ায় কোন কাহিনীও থাকে না; ইহার মধ্যে যাহা থাকে, তাহাকে চিত্র বলিতে পারা যায়; কিন্তু সেই চিত্রও স্বয়ংসম্পূর্ণ নহে,…
…ছড়ার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য এই যে, ইহার একটির অংশের সঙ্গে আর একটির অংশ অতি সহজেই জুড়িয়া যায়, তাহার ফলেই একই ছড়ার মধ্যে ভাব ও চিত্রগত বিভিন্নতা দেখিতে পাওয়া যায়। ছড়ার পদগুলি পরস্পর সুদৃঢ়ভাবে সংবদ্ধ নহে, বরং নিতান্ত অসংলগ্ন;…
…ছড়ার ছন্দের বিশিষ্ট লক্ষণ এই যে, ইহা শ্বাসাঘাত-প্রধান।… প্রতি পর্বের স্বর সংখ্যা গণনা করিয়া মাত্রার হিসাব পাওয়া যায় বলিয়া অনেকে ইহাকে স্বরমাত্রিক বা স্বরবৃত্ত ছন্দ বলেন। ইহার প্রত্যেক পর্বের আদিতে ঝোঁক পড়ে বলিয়া ইহাকে প্রাস্বরিক ছন্দ বা বল-প্রধান ছন্দও বলে; এতদ্ব্যতীত ইহা ছড়ার ছন্দ, লৌকিক ছন্দ, প্রাকৃত ছন্দ ইত্যাদি নামেও পরিচিত, তবে স্বরবৃত্ত নামটিই ইহার বহুল প্রচলিত।’
.
একই গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে আশুতোষ ভট্টাচার্য আরো বলেন-

‘…ছড়ার মধ্যে শব্দ অপেক্ষা সুরের প্রয়োজন অধিক।…
…ছড়ায় অপরিচিত বিদেশী শব্দ কদাচ ব্যবহৃত হয় না। ছড়া শিশুর ভাষা, বিজ্ঞের ভাষা নহে;…
…শব্দের উচ্চারণ বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করিয়াই ছড়া প্রধানতঃ রচিত হয়, শব্দই ছড়ার প্রাণ-স্বরূপ, অর্থ ইহার গৌণ মাত্র।…
…বাস্তবে এবং কল্পনায় মিলিয়াই ছড়ার জগৎ গড়িয়া উঠে, কেবলমাত্র অবিমিশ্র বাস্তবও যেমন ইহাতে থাকে না, তেমনই অবিমিশ্র কল্পনার উপাদানেও ইহা সৃষ্টি হয় না। সাহিত্য মাত্রেরই ইহা স্বাভাবিক ধর্ম।…
…ছড়ার মধ্যে যেমন চিত্রের অসংলগ্নতা দেখা যায়, ইহার আনুপূর্বিক বর্ণনার মধ্যেও তাহাই অনুভব করা যায়। কিন্তু চিত্রগুলি পরস্পর অসংলগ্ন হইলেও একটি অখণ্ড সুর ইহাদের মধ্য দিয়া প্রবহমান; ছড়ার ইহাই বৈশিষ্ট্য।…’
.
আর ১৯৮০ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত ধীমান দাশগুপ্ত সম্পাদিত ‘একশো ছড়া’ সংকলন গ্রন্থে ছড়া বিষয়ে অন্নদাশঙ্কর রায়ের স্পষ্টোক্তি-

‘…কবিতার মতো ছড়ার নির্দিষ্ট নিয়ম নেই, ছড়া বানাবার। ছড়া হয় আকস্মিক, ইররেগুলার। সেখানে আর্ট আছে, আরটিফিসিয়ালিটির স্থান নেই।
ছড়া হবে ইররেগুলার, হয়তো একটু আন্ ইভেন। বাকপটুতা, কারিকুরি নয়। কবিতা থেকে ছড়া আলাদা। ছড়াকে কবিতার মধ্যে ঢোকাতে গেলে কবিতাকে ব্যপ্ত করে নিতে হয়। কবিতা তো যে কোনো ভাবেই হয়, যে কোনো ছন্দে, এমনকি গদ্যেও। ছড়ার কিন্তু একটাই ছন্দ, রবীন্দ্রনাথ যাকে বলেছেন ছড়ার ছন্দ, একটু দুলকি চালে চলে, শাস্ত্রসম্মত নামও একটা আছে তার। ছড়া ঐ ছন্দেই লেখা যায় শুধুই।… আর ছড়ার মিল। দু সিলেবল হবেই, তিন সিলেবল হলে আরও ভালো হয়। আর শেষে কোন যুক্তাক্ষর থাকবে না।…
ভাব ও ছন্দ তো থাকবেই, এ ছাড়াও ছড়ায় থাকবে ইমেজ ও মিল। ছড়ার ইমেজ মিল রেখে আসে না, পারম্পর্য কম।… ছড়া হলেই হালকা, সরস হবে তা কেন? সব কিছু নিয়েই ছড়া হয়েছে, বীভৎস রস নিয়েও হয়েছে।…
আধুনিক ছড়ায় লোকছড়ার কালেকটিভ সেন্সটা নেই।… আজ সীরিয়াস লোকেরাও ছড়া লিখছেন। ছড়ার মধ্যে সত্যি কিছু না থাকলে এটা হত না। তবে সব ছড়াই তো আর ছড়া নয়, বেশীর ভাগই পদ্য।’
.
অন্নদাশঙ্করের বক্তব্যের সর্বশেষ বাক্যটা কিন্তু বিশেষ মনোযোগের দাবি রাখে- ‘সব ছড়াই তো আর ছড়া নয়, বেশীর ভাগই পদ্য।
এরকম প্রচুর মহাজন উক্তি এবং বিভিন্ন মতামত জারিত করে গবেষক সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ তাঁর গবেষণা সন্দর্ভ ‘ছড়ায় বাঙালি সমাজ ও সংস্কৃতি’ গ্রন্থে লোকায়ত বাংলা ছড়ার  বৈশিষ্ট্যগুলিকে সংক্ষেপে উপস্থাপন করেছেন এভাবে-
১. ছড়ায় যুক্তিসঙ্গত বা বিশিষ্ট ভাব কিংবা ভাবের পারম্পর্য নেই।
২. ছড়ায় ঘটনার ধারাবাহিকতা বা আনুপূর্বিক কাহিনী থাকে না।
৩. ছড়া ধ্বনি প্রধান, সুরাশ্রয়ী।
৪. ছড়ায় রস ও চিত্র আছে, তত্ত্ব ও উপদেশ নেই।
৫. ছড়ার ছন্দ শ্বাসাঘাত প্রধান প্রাকৃত বাংলা ছন্দ।
৬. ছড়া বাহুল্যবর্জিত, দৃঢ়বদ্ধ ও সংক্ষিপ্ত।
৭. ছড়ার ভাষা লঘু ও চপল।
৮. ছড়ার রস তীব্র ও গাঢ় নয়, স্নিগ্ধ ও সরস।
এছাড়াও আলোচিত মতামতগুলোর ভিত্তিতে আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তও গ্রহণযোগ্যতা পেয়ে যায়। যেমন:
.
ক) ছড়া ও সঙ্গীতের পার্থক্য:
১. ছড়া আবৃত্তি বা ধ্বনিনির্ভর। অন্যদিকে সঙ্গীত তাল ও সুর নির্ভর।
২. ছড়ার সুর একটানা বৈচিত্র্যহীন। অন্যদিকে সঙ্গীতের সুর বিচিত্র বা বৈচিত্র্যময়।
.
খ) ছড়া ও শিশু-কবিতার পার্থক্য:
১. ছড়ার বিষয়বস্তু উদ্ভট, অসঙ্গত। শিশু-কবিতার বিষয়বস্তু সাধারণত সুসঙ্গত হয়ে থাকে।
২. ছড়ার আকার হ্রস্ব। শিশু-কবিতার আকার দীর্ঘও হয়ে থাকে।
৩. ছড়ার ছন্দ শ্বাসাঘাত প্রধান প্রাকৃত বাংলা ছন্দ অর্থাৎ স্বরবৃত্ত। কিন্তু শিশু-কবিতার যে কোন ছন্দ হতে পারে।
৪. ছড়ার পরিণতি আকস্মিক। অন্যদিকে শিশু-কবিতার পরিণতি সুষ্ঠু ও পরিকল্পিত।
.
লোকায়ত ছড়ার উপরিউক্ত বৈশিষ্ট্যগুলি নিয়ে দ্বিমত করার অবকাশ খুব একটা নেই বলেই মনে হয়। ফলে এগুলির সাথে পরবর্তীকালের সাহিত্য পরম্পরায় সৃষ্ট বাংলা আধুনিক ছড়ার কিছু স্বীকৃত সার্থক সৃষ্টির তুলনামূলক বিশ্লেষণ ও সম্যক পর্যালোচনার মাধ্যমে আধুনিক ছড়ার বৈশিষ্ট্য নির্ধারণী রূপকাঠামো নির্মাণ নিশ্চয়ই অসম্ভব নয়। কিভাবে ?
.
(০৫)

ইদানিংকালের ছড়া নিয়ে যত হতাশাই থাকুক না কেন, আধুনিক সাহিত্যে বাংলা ছড়ায় আমাদের সমৃদ্ধি মোটেও হতাশাব্যঞ্জক নয়। তবে লোকছড়ার সাথে আধুনিক বাংলা ছড়ার প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্যে কিছু পার্থক্য রয়েছে এবং এটাই স্বাভাবিক। অন্যভাবে বললে, এই পার্থক্য সৃষ্টিকারী বৈশিষ্ট্য না-থাকাটাই অস্বাভাবিক ছিলো। কেননা, তা আগেই উল্লেখ করেছি, ‘মুখে মুখে রচিত লোকছড়ার রচয়িতারা যেহেতু সরাসরি কৃষিভিত্তিক সমাজের প্রতিনিধি ছিলেন, তাই লোকছড়ার প্রাণ ও রূপটিও সেই কৃষি-সংশ্লিষ্ট উপাদান, উপকরণ, উপাচার ও জীবনযাত্রাকেই প্রতিফলিত করে। অন্যদিকে আধুনিক ছড়া তার কালকে কোনভাবেই উপেক্ষা করতে পারে না। তাই লোকায়ত শ্রুতি ও স্মৃতিনির্ভর জীবনধারার বাহুল্যবর্জিত সারল্য, তত্ত্ব-উপদেশমুক্ত লঘু চিন্তা, ভাব ও প্রাকৃত ছন্দ লোকছড়ায় প্রতিফলিত হলেও আধুনিক জীবনধারায় স্বভাবতই তা অধিকতর জটিলরূপে উদ্ভাসিত।’
.
লোকায়ত ছড়ার সাথে সৃষ্ট পার্থক্যগুলো বোঝার সুবিধার্থে আমরা কিছু আধুনিক বাংলা ছড়ার সার্থক নমুনা যাচাই করে নিতে পারি-
(ক)
মুচকে হাসে অতুল খুড়ো,
কানে কলম গোঁজা।
চোখ টিপে সে বললে হঠাৎ,
‘পরতে হবে মোজা।’
.
হাসল ভজা, হাসল নবাই-
‘ভারি মজা’ ভাবল সবাই-
ঘরসুদ্ধ উঠল হেসে,
কারণ যায় না বোঝা।
-(খাপছাড়া/ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)
.
(খ)
এক রত্তি ছিল যখন, ডিমের মতো ছাঁদ
পেটটি ছিল ঢাকাই জালা ষাঁড়ের মত নাদ;
বয়স বেড়ে ক্রমে এখন হল বেজায় বুড়ো,
ডাকতে হলে বলে সবাই ‘গঙ্গারামের খুড়ো’।
-(গঙ্গারামের খুড়ো/ হিজিবিজি/ যোগীন্দ্রনাথ সরকার)
.
(গ)
হেড আফিসের বড়বাবু লোকটি বড় শান্ত,
তার যে এমন মাথার ব্যামো কেউ কখনো জানত ?
দিব্যি ছিলেন খোসমেজাজে চেয়ারখানি চেপে,
একলা বসে ঝিমঝিমিয়ে হটাৎ গেলেন ক্ষেপে!
আঁৎকে উঠে হাত-পা ছুঁড়ে চোখটি ক’রে গোল!
হঠাৎ বলে “গেলুম গেলুম, আমায় ধরে তোল!”
.
তাই শুনে কেউ বদ্যি ডাকে, কেউ-বা হাঁকে পুলিশ,
কেউ-বা বলে, “কামড়ে দেবে সাবধানেতে তুলিস।”
ব্যস্ত সবাই এদিক-ওদিক করছে ঘোরাঘুরি-
বাবু হাঁকেন, “ওরে আমার গোঁফ গিয়েছে চুরি!”
গোঁফ হারানো ! আজব কথা ! তাও কি হয় সত্যি ?
গোঁফ জোড়া তো তেমনি আছে, কমে নি এক রত্তি।
সবাই তাঁরে বুঝিয়ে বলে, সামনে ধরে আয়না,
মোটেও গোঁফ হয় নি চুরি, কক্ষনো তা হয় না।
.
রেগে আগুন তেলে বেগুন, তেড়ে বলেন তিনি,
“কারো কথার ধার ধারিনে, সব ব্যাটাকেই চিনি।
নোংরা ছাঁটা খ্যাংরা ঝাঁটা বিচ্ছিরি আর ময়লা,
এমন গোঁফ তো রাখত জানি শ্যামবাবুদের গয়লা।
এ গোঁফ যদি আমার বলিস করব তোদের জবাই”-
এই না বলে জরিমানা কল্লেন তিনি সবায়।
.
ভীষণ রেগে বিষম খেয়ে দিলেন লিখে খাতায়-
“কাউকে বেশি লাই দিতে নেই, সবাই চড়ে মাথায়।
আফিসের এই বাঁদরগুলো, মাথায় খালি গোবর
গোঁফ জোড়া যে কোথায় গেল কেউ রাখে না খবর।
ইচ্ছে করে এই ব্যাটাদের গোঁফ ধরে খুব নাচি,
মুখ্যুগুলোর মুণ্ডু ধরে কোদাল দিয়ে চাঁচি।
গোঁফকে বলে তোমার আমার- গোঁফ কি কারো কেনা ?
গোঁফের আমি গোঁফের তুমি, তাই দিয়ে যায় চেনা।”
-(গোঁফ চুরি/ আবোল তাবোল/ সুকুমার রায়)
.
(ঘ)
আয় ভাই, ভাগ ক’রে
নিই জমিদারী,-
আমি রাখি জমিটুকু,
তুই রাখ্ দাড়ি।
.
আমি নেব হাতিশালে
যত হাতি, আর
তুই নিস্ ছুরি কাঁচি
যত হাতিয়ার।
.
তারপরে ভাগ করি
এই ঘোড়াশাল,–
আমি নেব ঘোড়াগুলো
তোকে দেব শাল !
.
ভিটেমাটি সব কিছু
ভাগ করে নেব,–
আমি যদি ভিটে পাই
তোকে মাটি দেব !
-(ভাগাভাগি / রঙদার / আবদার রশীদ)
.
(ঙ)
অসময়ে মেহমান
ঘরে ঢুকে বসে যান
বোঝালাম ঝামেলার
যতগুলো দিক আছে
তিনি হেসে বললেন
ঠিক আছে ঠিক আছে।
.
রেশনের পচা চাল
টলটলে বাসি ডাল
থালাটাও ভাঙা-চোরা
বাটিটাও লিক আছে
খেতে বসে জানালেন
ঠিক আছে ঠিক আছে।
.
মেঘ দেখে মেহমান
চাইলেন ছাতাখান
দেখালাম ছাতাটার
শুধু কটা শিক আছে
তবু তিনি বললেন
ঠিক আছে ঠিক আছে।
-(ঠিক আছে / সুকুমার বড়ুয়া)
.
আধুনিক বাংলা ছড়ার স্বার্থক উদাহরণ আরো টানা যেতে পারে। তবে বিভিন্ন রসের, ভাবের, ছন্দের ও প্রকরণের এ ক’টি নমুনা নেয়া হলো মূলত লোকায়ত ছড়ার সাথে আধুনিক ছড়ার পার্থক্য সৃষ্টিকারী মৌলিক বৈশিষ্ট্য নির্ধারণের নিমিত্তে। একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে যে, লোকছড়ার কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের সাথে আধুনিক ছড়ার বৈশিষ্ট্যে কিছু অমিল পরিলক্ষিত হয়। যেমন- উল্লেখিত ‘ছড়ায় ঘটনার ধারাবাহিকতা বা আনুপূর্বিক কাহিনী থাকে না’ লোকছড়ার এই দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্যটি আধুনিক ছড়ায় প্রযোজ্য না হলেও ছড়ার আমেজ ও আবেদন কোনভাবেই ক্ষুণ্ন হয় না। একই ভাবে পঞ্চম বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ‘ছড়ার ছন্দ শ্বাসাঘাত প্রধান প্রাকৃত বাংলা ছন্দ’ আধুনিক ছড়ায় থাকতেই হবে এমন কথা নেই। বরং ছড়ার বক্তব্য ও আবেদন ক্ষুণ্ন না হলে যে কোন আকর্ষণীয় ছন্দই ছড়ায় প্রযোজ্য হতে পারে। আর উল্লেখকৃত ষষ্ঠ বৈশিষ্ট্যের আংশিক যেমন ‘ছড়া বাহুল্যবর্জিত, দৃঢ়বদ্ধ’ আধুনিক ছড়ার জন্য অবশ্য-প্রযোজ্য হলেও এ বৈশিষ্ট্যের শেষ নির্দেশনা ‘সংক্ষিপ্ত’ না হলেও যে আধুনিক ছড়া শিল্পোত্তীর্ণ হতে পারে তা উদ্ধৃত নমুনা উদাহরণেই দেখা যায়।  তবে আধুনিক ছড়ার যে অনিবার্য বৈশিষ্ট্যটি সাধারণত লোকছড়ায় থাকে না তা হলো, স্যাটায়ারধর্মিতা বা হিউমার প্রবণতা। মূলত এটিই আধুনিক ছড়ার প্রাণ, ছড়ার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও তাই; যা না-থাকলে ছড়া আর পদ্যে বিশেষ পার্থক্য থাকে না। হয়তো এ কারণেই অন্নদাশঙ্করের পূর্বোল্লিখিত উক্তি- ‘সব ছড়াই তো আর ছড়া নয়, বেশীর ভাগই পদ্য।
.
অতএব, এ পর্যালোচনার আলোকে আমরা যদি আধুনিক বাংলা ছড়ার অনিবার্য বৈশিষ্ট্যগুলোকে পুনর্বিন্যস্ত করে সাজিয়ে নেই, তাহলে শর্তগুলো দাঁড়ায় এরকম-

১. ছড়ায় যুক্তিসঙ্গত বা বিশিষ্ট ভাব কিংবা ভাবের পারম্পর্য নেই।
২. ছড়ায় ঘটনার ধারাবাহিকতা বা আনুপূর্বিক কাহিনী থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে।
৩. ছড়া ধ্বনি প্রধান, সুরাশ্রয়ী।
৪. ছড়ায় রস ও চিত্র আছে, তত্ত্ব ও উপদেশ নেই।
৫. ছড়ার ছন্দ হবে আকর্ষণীয়।
৬. ছড়া বাহুল্যবর্জিত ও দৃঢ়বদ্ধ। সংক্ষিপ্ত হবেই এমন কথা নেই।
৭. ছড়ার ভাষা লঘু ও চপল।
৮. ছড়ার রস তীব্র ও গাঢ় নয়, স্নিগ্ধ ও সরস।
৯. ছড়া স্যাটায়ারধর্মী বা হিউমার প্রধান।
.
অর্থাৎ এই বৈশিষ্ট্যগুলিই আধুনিক বাংলা ছড়াকে তার নিজস্ব ঔজ্জ্বল্য ও স্বকীয়তায় সাহিত্যের অন্য যে-কোন মাধ্যম থেকে পৃথক ও চিহ্নিত করে দেয়। ছড়া মানেই উপরের বৈশিষ্ট্যগুলো যা নিজের মধ্যে ধারণ করে। ছড়ার শেকড় আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যের গভীরে প্রোথিত, সাহিত্যের আদি মাতা সে, আমাদের আত্মপরিচয়ের উৎস। তাই আমাদের ভুলে যাওয়া ঠিক নয় যে, ছড়া মানে পদ্য নয়, কবিতা নয়, বা অন্য কোন সাহিত্য মাধ্যম নয়। ছড়া মানেই ছড়া।
.
(০৬)

এবারে আমরা যেখান থেকে শুরু করেছিলাম, মানে সমকালীন-ছড়া প্রসঙ্গ, সেখানেই ফিরে আসি। প্রারম্ভেই গৌরচন্দ্রিকায় যে ভণিতা ফেঁদেছিলাম তা এমনি এমনি নয়। আসলে বলতে চেয়েছিলাম যে,  সমকালীন-ছড়া নিয়ে আলোচনার কিছু নেই। ওটা বাস্তবিকই আলোচনার বিষয় হয় না। কেন হয় না ? সেটা জানতেই ছড়ার প্রকৃতি ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে ইতঃপূর্বের সংক্ষিপ্ত পরিক্রমাটা করতে হলো। কেননা, আমাদের একটা সিদ্ধান্তে আসার দরকার ছিলো যে, ছড়া তখনই ছড়া হবে যখন তার গঠন-কাঠামোর মধ্যে উপরের নির্ণায়ক বৈশিষ্ট্যগুলি থাকবে। আর সমকালীনতা ছড়ার কোন বৈশিষ্ট্য নয়, এটা তার প্রকৃতি বা স্বভাব, তার ভিত্তিভূমি। সমকালীন ঘটনা, পরিবেশ, পরিস্থিতি ইত্যাদি অনুষঙ্গ দিয়ে গড়া হয় তার শরীর। যে শরীরে ছড়ার বৈশিষ্ট্যগুলি উপস্থিত থাকবে। সমকালীনতার বাইরে ছড়ার জন্ম অপ্রাসঙ্গিক, উদ্দেশ্যহীন এবং অর্থহীনও। কারণ প্রচলিত অসংগতি, অন্যায়, অনিয়ম, অসারতাকে কটাক্ষ, বিদ্রূপ, শ্লেষ, ঘৃণা ইত্যাদির মাধ্যমে আঘাত করে ন্যায্য প্রতিকারের লক্ষ্যেই ছড়ার আত্মপ্রকাশ ঘটে। আলীবর্দী খাঁ’র নাতি নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার বিয়ের কাহিনী একালের ছড়ার অনুষঙ্গ হতে পারে না। নবাব সিরাজের নিজে নিজে এখানে আসার সুযোগ নেই। তবে তিনি আসতে পারেন অন্যের আশ্রয়ে। একালের কোন অসংগতিময় বৈসাদৃশ্যপূর্ণ পরিস্থিতি সৃষ্টিকারী বিয়ে জাতীয় ঘটনার প্রেক্ষিতে বা অনুষঙ্গে রচিতব্য ছড়ায় বিদ্রূপের উপমায় আশ্রিত হয়ে সিরাজ আসতে পারেন বৈ কি। তাই শ্রেণীগতভাবে সমকালীন-ছড়া নামকরণটাই বৈসাদৃশ্যের ইঙ্গিতবহ।
.
তবে ছড়ার অনুষঙ্গ-নির্ভর নামকরণ হতেই পারে। আজ যাকে প্রেমের ছড়া বলছি, আগামীকালও তাকে প্রেমের ছড়াই বলা হবে। এক বছর পর বা এক শতাব্দি পরও তা প্রেমের ছড়া হিসেবেই পরিচিত থাকতে পারে। অর্থাৎ এই অনুষঙ্গ-নির্ভর নামকরণটা আসলে ছড়ার উদ্দেশ্য বা প্রবণতানির্ভরও। এই লক্ষ্যনির্ভরতা ছড়ার বিশিষ্ট রূপ, যা সময়ের ব্যবধানে নষ্ট হয় না। কিন্তু সমকালীন-ছড়া নামকরণে সেরকম কোন বিশিষ্টতা অনুপস্থিত। আজ যাকে সমকালীন-ছড়া বলবো, কাল তা সমকালীন নাও থাকতে পারে। এক বছর পর তাকে সমকালীন বলাটা হতে পারে অস্বাভাবিক। আর এক শতাব্দি পর তাকে সমকালীন বলাটা হবে নিছক পাগলামি। তাহলে প্রশ্ন, ইদানিং কেন এই সমকালীন-ছড়া নামের শব্দবন্ধটা উচ্চারিত হতে শোনা যাচ্ছে ?
.
ইদানিং যাঁরা এটা বলছেন, ধারণা করা যায়, অধিকাংশই ছড়াকে না-বুঝেই সমকালীন-ছড়া হিসেবে আখ্যায়িত করছেন। আর কেউ কেউ হয়তো উদ্দেশ্যমূলক এই বিকৃতি ছড়াচ্ছেন। এরা মিডিয়াকার। যাঁদের কাছে জগতের তাবৎ কিছুই সংবাদ-মূল্যের অতিরিক্ত কোন আবেদন তৈরি করে না। মানবিক-অমানবিক ঘটনা বোধ উপলব্ধি সবকিছুই তাঁদের কাছে সংবাদ পণ্য বৈ আর কিছু নয়। আজকের কোন আলোচিত ঘটনার সংবাদ-মূল্য তাঁদের কাছে অসীম হলেও আগামী পরশু এটাই তাঁদের কাছে একেবারেই মূল্যহীন বকেয়া বর্জ্য। এই সমকালীন সংবাদ-মূল্যের সাপেক্ষেই যাঁরা ছড়ারও সমকালীনতা যাচাই বা মূল্যায়ন করেন তাঁদের ছড়া-মনস্কতা নিয়ে কোন মন্তব্যই যথেষ্ট নয়। কিন্তু যাঁরা একই সমান্তরালে খুব সমকালীন ঘটনার বিবরণ নিয়ে দায়সারাভাবে ফরমায়েশি ছড়া রচনা ও প্রকাশে লিপ্ত হন, তাঁরা কি আদৌ ছড়া লিখেন না-কি নকিবের মুখস্থ ঘোষণা পাঠ করেন বোঝা দায়। ছড়ার অন্তর্গত শক্তিটা যে চিরায়ত মানবিক বোধ ও স্পৃহার স্ফূরণ, সেই দায়বদ্ধতা না-থাকলে কেউ কি আদৌ ছড়াকার হবার যোগ্যতা রাখেন !
.
ছড়ায় সমকালীনতা কোন বদ্ধ বা স্থবির বিষয় নয়, এবং যত্র লিখে তত্র দিয়ে অন্ত্যমিল সাজালেই যে ছড়া হয়ে যায় না, এই বোধটুকুর উজ্জ্বল উপস্থিতি অন্ততঃ ইদানিংকার পত্র-পত্রিকার পাতা উল্টালে খুব একটা চোখে পড়ে না। অথচ আমাদের দেশে সেরকম স্বঘোষিত দশাসই ছড়াকারও কম নেই। কেউ কেউ আবার খুব জুতসই একটা উত্তরের চিরকালীন রেকর্ড টেপ করে রেখেছেন, কিছু বললেই সাথে সাথে বাজতে থাকে- ‘নিজে একটা লিখে দেখান !’ হা হা হা ! তাঁদের কাছে অবশ্য ছড়া লিখাটা সহজতম একটা কর্ম নিঃসন্দেহে। ছড়া লিখা তো সহজই, যেহেতু এর কথা সহজ, ভাব সহজ, ভঙ্গি সহজ, এবং যেহেতু এর ভাষা লঘু ও চপল এবং ছন্দও সরল। কঠিন ভাবা ঠিক নয় অবশ্যই, এমন আত্মবিশ্বাস না-থাকলে কি হয় ! আমরাও তেমন ছড়াকারই চাই বটে। শুধু একটুকু অনুনয়, ছড়া লিখার আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই উক্তিটা যদি অন্তত কিঞ্চিৎ মনে রাখার চেষ্টা করেন, ‘খাপছড়া’ গ্রন্থের নামপৃষ্ঠার ভণিতায় কবি যা বলেছিলেন-

‘সহজ কথায় লিখতে আমায় কহ যে,
সহজ কথা যায় না লেখা সহজে।…’

(২৬-০৫-২০১২)
তথ্যসূত্র:

০১) ছড়ায় বাঙালী সমাজ ও সংস্কৃতি : সৈয়দ মোহাম্মদ শাহেদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পৌষ ১৩৯৫, ঢাকা।
০২) বাংলা লোকসাহিত্যের ধারা : ওয়াকিল আহমদ, বইপত্র, এপ্রিল ২০০৭, ঢাকা।
০৩) নির্বাচিত প্রবন্ধ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : সম্পাদনা রবিশংকর মৈত্রী, শুভ প্রকাশন, বইমেলা ২০০৫, ঢাকা।
০৪) খুকুমণির ছড়া : যোগীন্দ্রনাথ সরকার, ন্যাশনাল বুক এজেন্সি প্রাইভেট লিমিটেড, বইমেলা ২০০৬, কলকাতা।
০৫) সুকুমার রচনা সমগ্র : সংকলন ও সম্পাদনা তপন রুদ্র, সালমা বুক ডিপো, জুন ২০০২, ঢাকা।
০৬) শিশু কিশোর কবিতার হাজার বছর : সম্পাদনা কামরুন নাহার শিমুল ও কাজী ইমদাদ, অনিকেত, ফেব্রুয়ারি ২০০৭, ঢাকা।
০৭) রঙদার : আবাদর রশীদ, রূপ প্রকাশন, বইমেলা ২০০০, ঢাকা।
০৮) অবমুক্ত গদ্যরেখা : রণদীপম বসু, শুদ্ধস্বর, ফেব্রুয়ারি ২০১১, ঢাকা।
০৯) চর্যাগীতিকা : সম্পাদনা মুহম্মদ আবদুল হাই ও আনোয়ার পাশা, বর্ণমিছিল, ডিসেম্বর ১৯৭৩, ঢাকা।

No comments: