.
| ন্যায়দর্শন…০১ : ভূমিকা |
রণদীপম বসু
…
রণদীপম বসু
…
১.০ : ভূমিকা
.
ন্যায় দর্শনের উদ্ভব
ভারতীয় আস্তিক ষড়দর্শনের মধ্যে ন্যায়দর্শনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ন্যায় দর্শনের দুটি শাখা- প্রাচীন ন্যায় ও নব্য ন্যায়। প্রাচীন ন্যায়দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মহর্ষি গোতম। কেউ কেউ বলেন গৌতম। মহর্ষি রচিত ‘ন্যায়সূত্র’ হলো ন্যায়দর্শনের মূল গ্রন্থ। গৌতমের অপর নাম অক্ষপাদ (২৫০ খ্রীঃ)। তাঁর এই নাম অনুসারে ন্যায় দর্শনকে অক্ষপাদ-দর্শনও বলা হয়ে থাকে। অক্ষপাদ গৌতমের ন্যায়শাস্ত্র বুদ্ধিবাদী বা যুক্তিবাদী।
.
ন্যায় দর্শনের উদ্ভব
ভারতীয় আস্তিক ষড়দর্শনের মধ্যে ন্যায়দর্শনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ন্যায় দর্শনের দুটি শাখা- প্রাচীন ন্যায় ও নব্য ন্যায়। প্রাচীন ন্যায়দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হলেন মহর্ষি গোতম। কেউ কেউ বলেন গৌতম। মহর্ষি রচিত ‘ন্যায়সূত্র’ হলো ন্যায়দর্শনের মূল গ্রন্থ। গৌতমের অপর নাম অক্ষপাদ (২৫০ খ্রীঃ)। তাঁর এই নাম অনুসারে ন্যায় দর্শনকে অক্ষপাদ-দর্শনও বলা হয়ে থাকে। অক্ষপাদ গৌতমের ন্যায়শাস্ত্র বুদ্ধিবাদী বা যুক্তিবাদী।
.
অক্ষপাদের
জীবনী সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা যায় না। পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের ভাষ্য
অনুযায়ী (দর্শন-দিগদর্শন) ডক্টর সতীশচন্দ্র বিদ্যাভূষণ মেধাতিথি গৌতমকে
আন্বীক্ষিকী (= ন্যায়) শাস্ত্রের আচার্য বলেছেন, এবং প্রমাণ করতে চেয়েছেন
যে, তিনি ৫৫০ খ্রীস্টপূর্বে জন্মেছিলেন ও তাঁর জন্মভূমি দারভাঙ্গার
গৌতমস্থানে। ঋগ্বেদের ঋষি মেধাতিথি গৌতম এবং উপনিষদের ঋষি নচিকেতা গৌতমকে
মিশ্রিত করে তিনি ন্যায়শাস্ত্রের মূল আচার্য মেধাতিথি গৌতমকে সৃষ্টি করেছেন
বলে রাহুল সাংকৃত্যায়নের অভিমত। বস্তুত যে ন্যায়সূত্রকে অক্ষপাদের
ন্যায়সূত্র রূপে পাওয়া যায়, তার আগে এমন কোনো সুব্যবস্থিত শাস্ত্র ছিলো বলে
জানা যায় না। উদ্যোতকর (৫৫০ খ্রীঃ)-এর ‘ন্যায়বার্তিক’ এবং বাৎস্যায়ন (৩০০
খ্রীঃ)-এর ‘ন্যায়ভাষ্যে’ অক্ষপাদকেই ন্যায়সূত্রের কর্তা হিসেবে অভিহিত করা
হয়েছে। তবে এটা নিশ্চিত যে, অক্ষপাদ শূন্যবাদী বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুনের
(১৭৫ খ্রীঃ) উত্তরসূরী ছিলেন। কেননা, নাগার্জুন তাঁর ‘বিগ্রহব্যবর্তণী’
গ্রন্থে প্রমাণকে চূড়ান্ত বা পরম বলে না মানার যে যুক্তি দেখিয়েছেন,
অক্ষপাদ ন্যায়সূত্রে তা খণ্ডন করে চূড়ান্ত প্রমাণকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা
করেছেন। অর্থাৎ ন্যায়সূত্র নাগার্জুনের পরে লেখা হয়েছিলো।
.
ন্যায়
দর্শনের ইতিহাস অতি প্রাচীন ও বিস্তৃত। এ দর্শনের উপর একাধিক গ্রন্থ রচিত
হয়েছে। তবে মহর্ষি গৌতমের ‘ন্যায়সূত্র’ প্রাচীন ন্যায়দর্শনের মূল গ্রন্থ।
এ গ্রন্থে পাঁচটি অধ্যায় রয়েছে এবং প্রতিটি অধ্যায় দুটি করে আহ্নিক বা
খণ্ডে বিভক্ত। ন্যায়সূত্রের বিখ্যাত ভাষ্যগ্রন্থ হচ্ছে ভাষ্যকার
বাৎস্যায়নের ‘ন্যায়ভাষ্য’। এছাড়া উদ্দ্যোতকরের ‘ন্যায়বার্ত্তিক’, বাচস্পতি
মিশ্রের (নবম শতক) ‘ন্যায়বার্তিক-তাৎপর্য টীকা’, উদয়নাচার্যের (দশম শতক)
‘ন্যায়বার্তিক-তাৎপর্যপরিশুদ্ধি’ এবং ‘ন্যায়-কুসুমাঞ্জলি’, জয়ন্ত ভট্টের
(নবম-দশম শতক) ন্যায়মঞ্জরী ইত্যাদি গ্রন্থে ন্যায়সূত্রের তাৎপর্য ব্যাখ্যা ও
বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
.
উদয়নাচার্যের
পরবর্তীকালে দ্বাদশ শতকে মহানৈয়ায়িক গঙ্গেশ উপাধ্যায় সূক্ষ্ম থেকে
সূক্ষ্মতর বিশ্লেষণাত্মক পদ্ধতিতে ন্যায় দর্শনের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা
করেন। এই নতুন অধ্যায় নব্যন্যায় নামে পরিচিত। গঙ্গেশের যুগান্তকারী গ্রন্থ
‘তত্ত্বচিন্তামণি’ এই অধ্যায়ের ভিত্তিস্তম্ভ। প্রথমে মিথিলায় এবং পরে
নবদ্বীপে এর প্রসার ঘটে। ন্যায়-সম্প্রদায়ের ইতিহাসে এই নব্য-ন্যায় মতের
গ্রন্থটি এমনই যুগান্তর সৃষ্টি করে যে, এর ফলে দীর্ঘদিন ধরে অন্যান্য
প্রাচীন গ্রন্থগুলি এমনকি ন্যায়সূত্র এবং বৈশেষিকসূত্রও অবহেলিত ছিলো বলে
জানা যায়। সাম্প্রতিককালে এগুলির চর্চা পুনরুজ্জীবিত হয়েছে।
.
ন্যায়সম্প্রদায়ে
তর্কবিদ্যার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপিত হয়েছে। তবে প্রাচীন ন্যায়ে যে সকল
দার্শনিক তত্ত্ব পরিলক্ষিত হয়, নব্যন্যায়ে তা বহুলাংশেই অনুপস্তিত। এখানে
তর্কবিদ্যার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটেছে এবং দার্শনিক তত্ত্বের তুলনায় যৌক্তিক
শুদ্ধতা ও যৌক্তিক বিশ্লেষণের উপরই অধিক গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তারপর থেকে
সম্প্রদায়টিতে কোনো নির্দিষ্ট দার্শনিক মত চর্চা করবার উৎসাহ প্রায় বিলুপ্ত
হয়েছে বলে বিদ্বানদের অভিমত। নব্যন্যায়ের এক ও অদ্বিতীয় উৎসাহ কেবল
তর্কেই। এই নব্যন্যায় মতকে ঘিরেও বেশ কিছু সাহিত্য রচিত হয়েছে। তার মধ্যে
বাসুদেব সার্বভৌম (পঞ্চদশ শতক), রঘুনাথ শিরোমণি, জগদীশ তর্কালঙ্কার, গদাধর
ভট্টাচার্য প্রমুখের রচনা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এছাড়া বিশ্বনাথের
‘ভাষাপরিচ্ছেদ’ এবং অন্নংভট্টের ‘তর্কসংগ্রহ’ ন্যায়-প্রস্থানের বিশেষ করে
নব্যন্যায়ের মূল সিদ্ধান্তগুলিকে সংক্ষেপে ও সহজবোধ্যভাবে উপস্থাপন করার
প্রয়াস।
.
ন্যায় দর্শনের প্রাথমিক পরিচয়
‘নীয়তে অনেন ইতি ন্যায়ঃ।’ অর্থাৎ এই শাস্ত্রের দ্বারা পরিচালিত হয়ে মানুষের বুদ্ধি স্থির মীমাংসায় উপনীত হয় বলে এই শাস্ত্রকে বলা হয় ন্যায়। ফলে যথাযথ জ্ঞান লাভ করতে হলে কী কী উপায় অবলম্বন করে শুদ্ধ চিন্তায় উপনীত হতে পারা যায়- তা-ই হলো ন্যায় দর্শনের মূল উদ্দেশ্য। তাই যথার্থ জ্ঞান লাভের প্রণালী হিসেবেই ন্যায় দর্শনকে আখ্যায়িত করা হয়।
‘নীয়তে অনেন ইতি ন্যায়ঃ।’ অর্থাৎ এই শাস্ত্রের দ্বারা পরিচালিত হয়ে মানুষের বুদ্ধি স্থির মীমাংসায় উপনীত হয় বলে এই শাস্ত্রকে বলা হয় ন্যায়। ফলে যথাযথ জ্ঞান লাভ করতে হলে কী কী উপায় অবলম্বন করে শুদ্ধ চিন্তায় উপনীত হতে পারা যায়- তা-ই হলো ন্যায় দর্শনের মূল উদ্দেশ্য। তাই যথার্থ জ্ঞান লাভের প্রণালী হিসেবেই ন্যায় দর্শনকে আখ্যায়িত করা হয়।
.
ন্যায়
দর্শন যুক্তিমূলক বস্তুবাদী দর্শন। জ্ঞানের বিষয়ের যে জ্ঞান-ভিন্ন
স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে তা এই দর্শনে স্বীকৃত। অর্থাৎ বিভিন্ন বস্তুর জ্ঞান
নিরপেক্ষ অস্তিত্ব আছে। কারণ বস্তুর অস্তিত্ব আমাদের জানা বা না-জানার উপর
নির্ভর করে না। শুধুমাত্র যুক্তি তর্ক বিচারের মাধ্যমে নৈয়ায়িকরা বস্তুর
জ্ঞান নিরপেক্ষ অস্তিত্ব স্বীকার করে নেন বলে নৈয়ায়িকদের বস্তুবাদ
যুক্তিমূলক বস্তুবাদ।
.
যেহেতু
ন্যায় দর্শন বেদকে প্রামাণ্য বলে গ্রহণ করে, তাই ন্যায় দর্শন আস্তিক
দর্শন। তবে বেদকে প্রামাণ্য বলে গ্রহণ করলেও এ মতবাদ স্বাধীন চিন্তা ও
বিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত। আমাদের চিন্তাধারাকে ফলপ্রসূ করার জন্য নির্দেশ
দেয় বলে ন্যায় দর্শনকে ‘ন্যায়বিদ্যা’ বলা হয়। এই মতে ‘প্রমা’ বা
যথার্থজ্ঞান লাভের প্রণালীকে ‘প্রমাণ’ বলা হয়। প্রমা এবং প্রমাণ নিয়ে
বিস্তারিত আলোচনা করে বলে ন্যায় দর্শনকে প্রমাণশাস্ত্র নামেও অভিহিত করা
হয়। জীবনের সকল ক্ষেত্রে আমাদেরকে অনুমান, শব্দ প্রভৃতি প্রমাণের উপর
নির্ভর করতে হয়। এই প্রমাণগুলির তত্ত্ব একমাত্র ন্যায়শাস্ত্রেই
বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এছাড়া ন্যায় দর্শন সব শাস্ত্রকে
নির্ভুলভাবে প্রতিভাত করে বলে ন্যায়সূত্রের ভাষ্যকার বাৎসায়ন ন্যায়দর্শনকে
‘সর্বশাস্ত্রপ্রদীপ’ বা ‘সকল বিদ্যার প্রদীপ’ নামে অভিহিত করেছেন। আবার
যুক্তির দ্বারা বিষয়ের বিশ্লেষণকে ‘ঈক্ষা’ বা মনন বলে। এই অর্থে অনুমান হলো
অন্বীক্ষা (অনু + ঈক্ষা)। ন্যায় দর্শন এই অন্বীক্ষার সমাধা করে অর্থাৎ
অনুমান বা ন্যায়ের সাহায্যে বস্তুর জ্ঞানলাভের পথ উন্মুক্ত করে বলে তাকে
আন্বীক্ষিকীও বলা হয়ে থাকে।
.
ন্যায়
দর্শনে যুক্তি-তর্ক এবং জ্ঞানতত্ত্বের আলোচনার প্রাধান্য থাকলেও
যুক্তি-তর্ক করাই কিন্তু ন্যায় শাস্ত্রের চরম উদ্দেশ্য নয়। ভারতীয় অন্যান্য
দর্শনের মতোই ন্যায় দর্শনের চরম উদ্দেশ্য বা পুরুষার্থ হলো মুক্তি বা
মোক্ষ। যুক্তিসিদ্ধ চিন্তা এই পরম পুরুষার্থ লাভের সহায়ক মাত্র। কী করে এই
পুরুষার্থ বা মোক্ষকে লাভ করা যায়, ন্যায়দর্শন সে সম্পর্কে আলোচনা করে বলে
তাকে মোক্ষশাস্ত্রও বলা হয়। ন্যায়দর্শন মানুষের পার্থিব জীবনকে দুঃখময় রূপে
এবং মোক্ষপ্রাপ্তিকেই মানব জীবনের পরমলক্ষ্য হিসেবে স্বীকার করে নিয়েছে।
এই মতে অবিদ্যা হলো দুঃখের কারণ এবং তত্ত্বজ্ঞান বা যথার্থজ্ঞানের দ্বারাই
অবিদ্যা দূর করে মোক্ষ লাভ করা সম্ভব। ন্যায় মতে জীবের মোক্ষলাভের জন্য
ষোলটি পদার্থের তত্ত্বজ্ঞান প্রয়োজন। তাই ন্যায়দর্শনে এই ষোড়শ পদার্থের
বিস্তৃত আলোচনা করা হয়। কিন্তু তত্ত্বজ্ঞান লাভ করা সম্ভব কিনা তা নির্ধারণ
করার জন্য যথার্থজ্ঞানের প্রণালী কী হতে পারে তা ঠিক করার নিমিত্তে
ন্যায়শাস্ত্রে জ্ঞানতত্ত্বের প্রয়োজন স্বীকার করা হয়। ন্যায় দর্শনের প্রধান
তত্ত্বগুলি হলো- জ্ঞানতত্ত্ব, জগৎতত্ত্ব, আত্মতত্ত্ব এবং ঈশ্বরতত্ত্ব।
…
(চলবে…)
…
[*] [পরের পর্ব: ন্যায়মতে ষোড়শ পদার্থ]
…
…
(চলবে…)
…
[*] [পরের পর্ব: ন্যায়মতে ষোড়শ পদার্থ]
…
No comments:
Post a Comment