Wednesday, July 4, 2012

| ন্যায়দর্শন…০৭ : শব্দপ্রমাণ |

 .
| ন্যায়দর্শন…০৭ : শব্দপ্রমাণ |
রণদীপম বসু

৭.০ : শব্দপ্রমাণ (Testimony)
.
ন্যায়দর্শন স্বীকৃত চারটি প্রমাণের মধ্যে চতুর্থ প্রমাণ হলো শব্দপ্রমাণ। শাব্দ জ্ঞানের করণকে বলা হয় ‘শব্দ’। ভারতীয় দর্শনে শব্দপ্রমাণের গুরুত্ব উল্লেখযোগ্য। ভারতীয় সকল শাস্ত্রই গুরু পরম্পরায় শ্রবণের মাধ্যমে লালিত-পালিত হয়েছে। তাই বেদের অপর নাম শ্রুতি। ন্যায়দর্শনে প্রত্যক্ষকে প্রধান প্রমাণ বলা হলেও এই দর্শনে শব্দের বিচারও অতি সূক্ষ্ম পর্যায়ের। এ প্রেক্ষিতে জগদীশ, গদাধর প্রমুখ নব্য-নৈয়ায়িক শব্দের উপর স্বতন্ত্র গ্রন্থও রচনা করেছেন।

আধুনিক কালে পাশ্চাত্যে শাব্দবোধ ও বাক্যার্থবোধ নিয়ে যে আলোচনা দেখা যায়, ন্যায় দর্শন তথা ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়, বিশেষ করে বৌদ্ধ ও শাব্দিক সম্পদায় খ্রিস্টপূর্বযুগেই তা আলোচনা করেছেন। বস্তুতঃপক্ষে শব্দের আলোচনা ভারতবর্ষে ঋগ্বেদের যুগেই শুরু হয়েছে বলে মনে করা হয়।
 .
যথার্থ জ্ঞান লাভের জন্য শব্দ হলো একটি স্বতন্ত্র প্রমাণ। ন্যায়সূত্র-এ মহর্ষি গৌতম শব্দের লক্ষণে বলেছেন-

‘আপ্তোপদেশঃ শব্দঃ’।
অর্থাৎ : আপ্তব্যক্তির উপদেশবাক্যই শব্দ প্রমাণ।
 .
আর নব্য-নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তাঁর তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে শব্দ প্রমাণের লক্ষণ দিয়েছেন-

‘আপ্তবাক্যং শব্দঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : আপ্তবাক্যকে শব্দপ্রমাণ বলে।
 .
ন্যায়মতে, ভ্রম (একটি বস্তুকে অন্যরূপে জানা), প্রমাদ (অসাবধানতা), বিপ্রলিপ্সা (বঞ্চনা করার ইচ্ছা) ও করণাপাটব (ইন্দ্রিয়ের ত্রুটি)- এই চারটি দোষশূন্য যথার্থ বক্তাই আপ্তব্যক্তি। অন্নংভট্টে মতে-

‘আপ্তঃ তু যথার্থবক্তা’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : আপ্তব্যক্তি হলেন সেই ব্যক্তি যিনি যথার্থ বক্তা।
 .
যিনি পদার্থের যথাযথ ধর্ম-সাক্ষাৎ (তত্ত্বসাক্ষাৎ) করেছেন এবং যিনি নিজে যেরূপ সাক্ষাৎ করেছেন, অপরকে জানানোর অভিপ্রায়ে ঠিক সেইরূপ উপদেশই দেন, তাঁকে বলা হয় আপ্তব্যক্তি। এরূপ আপ্তব্যক্তির উপদেশ থেকে যথার্থ শাব্দজ্ঞান হয়। তাই এরূপ আপ্তব্যক্তির উচ্চারিত বাক্য শ্রবণ করে শ্রোতার যে জ্ঞান হয় তাই শাব্দজ্ঞান বা শাব্দবোধ এবং ঐ আপ্তবাক্যই শব্দপ্রমাণ।
 .
সাধারণভাবে শব্দ থেকে উৎপন্ন যে কোনো জ্ঞানই শাব্দজ্ঞান। তবে শাব্দজ্ঞান মাত্রই তাই যথার্থ শাব্দজ্ঞান নয়। আপ্তের ন্যায় অনাপ্তব্যক্তির উপদেশ থেকেও শাব্দজ্ঞান হতে পারে। কিন্তু সে শাব্দজ্ঞান যথার্থ নয়।  ভ্রম, প্রমাদ, বিপ্রলিপ্সা ও করণাপাটব- এই চারটি দোষের কোন একটি থাকলে কোন ব্যক্তিকে আপ্ত বলা হয় না। ঐরূপ ব্যক্তি অনাপ্ত হয়। অনাপ্ত ব্যক্তির বাক্যকে শব্দপ্রমাণ বলা হয় না।
 .
শব্দ প্রমাণের বিভাগ :
ন্যায়মতে শব্দ প্রমাণ নানা প্রকার। জ্ঞানের বিষয় অনুসারে এবং বাৎস্যায়নের মতে শব্দ প্রমাণ দুই প্রকার- দৃষ্টার্থ এবং অদৃষ্টার্থ।
 .
জাগতিক বিষয় সম্পর্কে আপ্ত ব্যক্তির যে বচন সেগুলি হলো দৃষ্টার্থ শব্দ-প্রমাণ। অর্থাৎ যে সকল বাক্যের অর্থ প্রত্যক্ষযোগ্য বা ইহলোকে দৃষ্ট হতে পারে, তাদের দৃষ্টার্থক শব্দ বলে। যেমন, আদালতে বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষীর সাক্ষ্য, বিশ্বাসযোগ্য কৃষকের বৃষ্টি অথবা ভূমি সম্পর্কে জ্ঞান, উদ্ভিদের গুণাবলি সংক্রান্ত আয়ুর্বেদের উক্তি, শাস্ত্র বা আচার অনুষ্ঠান ইত্যাদির দেয় নির্দেশ ইত্যাদি দৃষ্টার্থক শব্দের দৃষ্টান্ত।
 .
প্রত্যক্ষযোগ্য নয় এমন কোনো বিষয় বা বস্তু সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তির যে বচন তাই হলো অদৃষ্টার্থ শব্দ-প্রমাণ। অর্থাৎ যে সকল বাক্যের অর্থ ইহলোকে প্রত্যক্ষযোগ্য নয়, তাদের অদৃষ্টার্থক শব্দ বলে। যেমন, আত্মা, পরমাত্মা, পাপ, পুণ্য, পরলোক সম্বন্ধে শ্রুতিবাক্য, পরমাণু সম্বন্ধে দার্শনিকদের ও বৈজ্ঞানিকদের উক্তি অদৃষ্টার্থক শব্দের দৃষ্টান্ত।
 .
আরেকটি শ্রেণীবিভাগ অনুসারে শব্দ বৈদিকলৌকিক ভেদে দুই প্রকার। বেদোক্ত বাক্য হলো বৈদিক শব্দ। বেদে যাঁরা বিশ্বাস করেন, তাঁরা বেদকে অভ্রান্ত বলে মনে করেন, কেননা তাঁদের মতে বেদের বাক্য ঈশ্বরের বাক্য। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের বাক্য হলো লৌকিক শব্দ, এ বাক্য সত্যও হতে পারে ভ্রান্তও হতে পারে। লৌকিক শব্দের মধ্যে কেবল আপ্তব্যক্তির বাক্যই শব্দপ্রমাণ। অনাপ্তব্যক্তির বাক্য শব্দপ্রমাণ নয়।
ন্যায়মতে কি বৈদিক কি লৌকিক সকল প্রকার শব্দই পৌরুষেয়। সুতরাং আপ্ত পুরুষের বাক্য, তা লৌকিকই হোক আর বৈদিকই হোক, শব্দপ্রমাণ বলে বিবেচিত।
 .
পদ ও শব্দার্থজ্ঞান :
‘শাব্দ’ শব্দটি ন্যায় দর্শনে শুধু যে উপদেশ (আপ্ত বা অনাপ্ত) অর্থেই ব্যবহৃত হয়, তা নয়। শব্দকারণক যে কোন জ্ঞানকেই কেউ কেউ শাব্দ বলেছেন। অনেকে আবার শব্দবিষয়ক জ্ঞানকেও শাব্দ বলেছেন। জগদীশ প্রমুখ নব্য-নৈয়ায়িক আবার পদের অন্বয়বোধ বা বাক্যার্থবোধকে শাব্দবোধ বলেছেন। এ প্রেক্ষিতে শব্দের আলোচনা প্রধানত বাক্যার্থ ও শব্দার্থ কেন্দ্রিক। ন্যায়মতে ‘শব্দ’ ও ‘পদ’ সাধারণত অভিন্নার্থেই ব্যবহৃত হয়।
 .
নব্য-নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট টীকাগ্রন্থ তর্কসংগ্রহদীপিকায় বাক্যের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন-

‘বাক্যং পদসমূহঃ’।
অর্থাৎ : বাক্য হলো কতকগুলি পদের সমষ্টি।
 .
একাধিক পদ মিলে অর্থপূর্ণ উক্তি হলো বাক্য। বাক্যের অর্থ হলো বাক্যার্থ। যেমন, ‘গরুটি আন’ একটি বাক্য। এই বাক্য ‘গরু’ ও ‘আন’ এই দুটি পদের সমষ্টি। তাহলে প্রশ্ন, পদ কাকে বলে ? এর উত্তরে অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রদীপিকায় বলেছেন-

‘শক্তং পদম্’।
অর্থাৎ : যা শক্তি বিশিষ্ট তাই পদ।
 .
ন্যায়মতে, যে বর্ণ বা বর্ণসমষ্টি কোন পদার্থকে নির্দেশ করার বা সংকেত করার শক্তিসম্পন্ন, তাকে পদ বলে। পদ বা শব্দের অর্থ হলো শব্দার্থ। অর্থাৎ একটি পদ শুনলে একটি পদার্থের জ্ঞান হয়। ‘ঘট’ পদ শুনলে ঘট পদার্থের জ্ঞান হয়। ‘পট’ পদ শুনলে পট পদার্থের জ্ঞান হয়। ‘ঘট’ পদের দ্বারা পটের বা ‘পট’ পদের দ্বারা ঘটের জ্ঞান হয় না। যে কোন পদের দ্বারা যে কোন পদার্থের জ্ঞান হয় না। একটি পদের দ্বারা একটি বিশেষ পদার্থেরই জ্ঞান হয়। পদের এই জ্ঞানোৎপাদন সামর্থ্যই শক্তি। এরূপ শক্তি যার আছে তাই পদ।
ন্যায়মতে, পদের যোগ (অবয়বশক্তি) ও রূঢ়ি (সামগ্রিকশক্তি) শক্তি অনুসারে পদকে চারভাগে ভাগ করা হয়েছে- যোগরূঢ়, যৌগিক, রূঢ় ও যৌগিকরূঢ়।
 .
পদের বৃত্তি :
যার দ্বারা একটি পদ একটি পদার্থকে বোঝায় তাকে পদের বৃত্তি বলে। একটি পদের সঙ্গে একটি পদার্থের এই সম্বন্ধরূপ বৃত্তি দুই প্রকার- শক্তি ও লক্ষণা।
 .
শক্তি : একটি পদের সঙ্গে একটি পদার্থের অর্থাৎ ঐ পদের দ্বারা বোধিত বস্তুর সম্বন্ধ আছে। যে পদের সঙ্গে যে পদার্থের সম্বন্ধ আছে, সেই পদ সেই পদার্থকেই বোঝায়। পদ ও পদার্থের সম্বন্ধই শক্তি। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহদীপিকায় শক্তির লক্ষণ দিয়েছেন-

‘অর্থস্মৃত্যনুকূলঃ পদপদার্থসম্বন্ধঃ শক্তিঃ’। (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : শক্তি হলো পদ ও পদার্থের সম্বন্ধ যা পদার্থের স্মরণের সহায়ক।
 .
এর তাৎপর্য হলো, একটি পদ যে অর্থ বা বস্তুকে বোঝায় তার সঙ্গে সেই পদের একটি সম্বন্ধ আছে। কিন্তু পদ ও পদার্থের এই সম্বন্ধকেই শক্তি বলে না। একটি পদ শুনলে যখন শ্রোতা একটি বস্তুকে বোঝে, তখন তার পদ-পদার্থের সম্বন্ধের জ্ঞান থাকে এবং এই জ্ঞানের দ্বারাই সেই ব্যক্তি ঐ পদ নির্দেশিত বস্তুকে বোঝে। অর্থাৎ পদ-পদার্থের সম্বন্ধের জ্ঞান থাকার ফলেই কোন ব্যক্তি ‘ঘট’ পদটি শুনলে ঘট বস্তুকে স্মরণ করে এবং তার ঘট পদার্থের জ্ঞান হয়। একেই শাব্দবোধ বলে।
 .
লক্ষণা : শক্তির দ্বারা যেখানে পদের অর্থ নির্ধারিত হয় না সেখানে লক্ষণা করতে হয়। ন্যায়মতে শক্তির মতো লক্ষণাও শব্দ বা পদের একটি বৃত্তি। একটি পদ তার শক্তির দ্বারা যেমন একটি পদার্থের বোধক হয়, তেমনি লক্ষণার দ্বারাও একটি পদার্থের বোধক হয়ে থাকে। তবে শক্তি ও লক্ষণার মধ্যে পার্থক্য আছে। একটি পদ শক্তির দ্বারা একটি পদার্থের বোধক হয় সাক্ষাৎভাবে (directly), কিন্তু একটি পদ লক্ষণার দ্বারা একটি পদার্থের বোধক হয় পরম্পরাভাবে, অসাক্ষাৎভাবে (indirectly)।
অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহদীপিকায় বলেছেন-

‘শক্যসম্বন্ধো লক্ষণা’। (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : একটি পদের শক্তির দ্বারা যা বোধিত হয় তাই শক্য, সেই শক্যের সঙ্গে সম্বন্ধই লক্ষণা।
 .
যেমন গঙ্গা শব্দের শক্যার্থ জলপ্রবাহবিশেষ। গঙ্গার অতি নিকটে, গঙ্গার তীরে ঘোষপল্লী আছে- এটি বোঝানোর জন্য কেউ বললেন ‘গঙ্গার ঘোষেরা’। এখানে গঙ্গা পদের মূখ্যার্থ বা শক্যার্থ গ্রহণ করলে বাক্যটির অর্থের উপপত্তি হবে না। গঙ্গার পদের শক্যার্থ জলপ্রবাহবিশেষ এবং জলপ্রবাহে ঘোষপল্লী থাকতে পারে না। ‘গঙ্গার ঘোষেরা’ বাক্যটির অর্থের উপপত্তির জন্য গঙ্গা পদের শক্যার্থ বাদ দিয়ে গঙ্গা পদের লক্ষণা করে তীরকে বুঝতে হবে। গঙ্গা পদের শক্যার্থ জলপ্রবাহের অতি নিকটে তীর থাকায় গঙ্গা পদের শক্যের সঙ্গে তীরের নৈকট্য সম্বন্ধ আছে এবং এই নৈকট্য সম্বন্ধের দ্বারাই গঙ্গা পদ অসাক্ষাৎভাবে তীরকে বোঝায়। গঙ্গা পদের শক্যার্থ জলপ্রবাহবিশেষ এবং তার সঙ্গে নৈকট্য সম্বন্ধে যুক্ত তীর লক্ষণার্থ। তাই অন্নংভট্ট দীপিকায় বলেছেন- ‘শক্যসম্বন্ধো লক্ষণা’।
 .
বাক্যার্থজ্ঞান :
ন্যায়মতে আপ্তবাক্যকে শব্দপ্রমাণ বলা হয়েছে এবং আপ্তবাক্য শ্রবণের ফলে শ্রোতার যে জ্ঞান হয়, তাকে শাব্দজ্ঞান বা শাব্দবোধ বলা হয়। এই শাব্দবোধই অর্থান্তরে বাক্যার্থজ্ঞান।
 .
একাধিক পদ মিলে অর্থপূর্ণ উক্তি হলো বাক্য। বাক্যের অর্থ হলো বাক্যার্থ। বাক্য উদ্দেশ্য-বিধেয় সম্বন্ধপ্রকাশক। তাই যে কোন পদসমষ্টিই বাক্য নয়। অর্থপূর্ণ পদসমূহের উদ্দেশ্য-বিধেয় প্রকারে সন্নিবেশ হলো বাক্য। একটি বাক্য উদ্দেশ্য-বিধেয় প্রকারে সন্নিবিষ্ট হওয়ার জন্য কতকগুলি শর্তের উপর নির্ভর করে। নৈয়ায়িকেরা এ প্রেক্ষিতে বাক্যার্থ-নির্ধারক চারটি শর্তের উল্লেখ করেছেন। এই চারটি শর্ত হলো- (১) আকাঙ্ক্ষা, (২) যোগ্যতা, (৩) সন্নিধি বা আসত্তি ও (৪) তাৎপর্য।
 .
(১) আকাঙ্ক্ষা : আকাঙ্ক্ষা হলো একটি পদের সঙ্গে অন্য একটি পদের অন্বয়ের প্রয়োজন বোধ। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে আকাঙ্ক্ষার লক্ষণ দিয়েছেন-

‘পদস্য পদান্তর ব্যতিরেক প্রযুক্ত অন্বয়-অননুভাবকত্বম্ আকাঙ্ক্ষা’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : অন্য পদ ছাড়া একটি পদ যদি ঐ দুটি পদের দ্বারা বোধিত বস্তুর অন্বয় বা সম্বন্ধের জনক না হয় তাহলে বলা যায় ঐ দুটি পদ পরস্পর আকাঙ্ক্ষাযুক্ত।
 .
যেমন, ‘জল আন’ বাক্যটির অন্তর্গত পদগুলির সামগ্রিক অর্থ হলো অন্বয়। এখন ‘জল’, ‘আন’ পদ দুটির একটি অন্যটি ছাড়া বাক্যের সামগ্রিক অর্থ অর্থাৎ অন্বয়ের জনক হয় না। এই অন্বয়ের জনক না হওয়াই ‘আকাঙ্ক্ষা’ পদের অর্থ। আকাঙ্ক্ষা হলো ‘শব্দবিন্যাসগত অপেক্ষা’। ‘জল আন’ এই দুটি পদ আকাঙ্ক্ষাযুক্ত। ‘আন’ পদটি শুনলে আকাঙ্ক্ষা হয়- কী আনতে হবে ? এই আকাঙ্ক্ষার নিবৃত্তির জন্য প্রয়োজন ‘জল’ পদটি। আবার ‘জল’ এই পদটি শুনলে আকাঙ্ক্ষা হয় ‘জল নিয়ে কী করতে হবে’ ? এই আকাক্সার নিবৃত্তি হয় ‘আন’ এই পদের দ্বারা। এখন যদি বলা হয়- ‘জল অশ্ব পুরুষ হস্তী’, এই পদগুলি পরস্পর আকাঙ্ক্ষাযুক্ত না হওয়ায় এই পদগুলির দ্বারা বাক্যার্থবোধ জন্মে না।
 .
অর্থাৎ বাক্যের ভাব বা বাক্যার্থ পরিস্ফুট করার জন্য পদগুলির মধ্যে একটি অন্বয়বোধ থাকা প্রয়োজন। কতকগুলি পদ পর পর বসালেই একটি বাক্য হয় না। পদগুলি ব্যবহারের একটি নিয়ম আছে। যে পদের সঙ্গে যে পদের অন্বয় হয়, সেই পদের সঙ্গে সেই পদকেই বসাতে হবে। কর্তা অনুসারে ক্রিয়া ব্যবহৃত হয়। তেমনি বিশেষ্য অনুযায়ী বিশেষণ ব্যবহৃত হয়। সুতরাং একটি পূর্ণ বাক্যার্থবোধ উৎপন্ন করার জন্য পদগুলির মধ্যে একটি অন্বয়বোধ থাকা প্রয়োজন। এই নিয়মকে অনুসরণ করেই আমরা বক্তার ভাবকে গ্রহণ করতে পারি। ব্যাকরণ অনুযায়ী কারকপদের সঙ্গে ক্রিয়াপদের আকাঙ্ক্ষা সম্বন্ধ থাকে।
 .
(২) যোগ্যতা : যোগ্যতা হলো পদসমূহের পারস্পরিক অবিরোধ সম্বন্ধ। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহে যোগ্যতার লক্ষণ দিতে গিয়ে বলেছেন-

‘অর্থাবাধো যোগ্যতা’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : বাক্যস্থ পদগুলির অর্থের বাধ না থাকাই যোগ্যতা।
 .
একটি বাক্যের অর্থবোধের ক্ষেত্রে ঐ বাক্যস্থিত পদগুলির দ্বারা বোধিত পদার্থগুলির মধ্যে অবিরোধ সম্বন্ধ থাকা প্রয়োজন। অর্থাৎ বাক্যস্থিত পদগুলির দ্বারা বোধিত পদার্থগুলির সম্বন্ধের ক্ষেত্রে বাস্তবিক কোন বাধ থাকবে না। বাক্যস্থ পদগুলির অর্থের এই বাধ না থাকাই যোগ্যতা। যেমন, ‘জলে’র সঙ্গে ‘তাপে’র এবং ‘বহ্নি’র সঙ্গে ‘শীতলতা’র অবিরোধ সম্বন্ধ নেই। ‘বহ্নি শীতল’ একথা হাস্যকর, কেননা এস্থলে অর্থ-বাধ হয়। সুতরাং অর্থপূর্ণ বাক্যের জন্য যোগ্যতাসম্পন্ন পদসমূহই পাশাপাশি ব্যবহৃত হতে পারে।
 .
(৩) সন্নিধি বা আসত্তি : সন্নিধি বা আসত্তি হলো বাক্যে ব্যবহৃত পদসমূহের মধ্যস্থিত নৈকট্য। সন্নিধির লক্ষণ দিতে গিয়ে তর্কসংগ্রহে অন্নংভট্ট বলেন-

‘পদানাম-অবিলম্বেন উচ্চারণং সন্নিধিঃ’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : একটি বাক্যস্থিত পদসমূহের অবিলম্বে অর্থাৎ সময়ের অব্যবধানে উচ্চারণই সন্নিধি। 
 .
একটি বাক্য অর্থপূর্ণ হওয়ার জন্য পদগুলিকে দেশ ও কালের সান্নিধ্যে ব্যবহৃত হতে হয়। সকাল বেলায় ‘জল’ পদ উচ্চারণ করার পর বিকেল বেলায় যদি ‘আন’ পদ উচ্চারণ করা হয়, তাহলে এই শব্দদ্বয় কোনো বাক্যার্থবোধ উৎপন্ন করতে পারে না।
 .
(৪) তাৎপর্য : তাৎপর্য হলো কোনো পদ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বক্তার ঈপ্সিত অর্থ। অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে আকাঙ্ক্ষা, যোগ্যতা ও সন্নিধি এই তিনটিকে শাব্দবোধের হেতু হিসেবে উল্লেখ করলেও টীকাগ্রন্থ তর্কসংগ্রহদীপিকায় ‘বাক্যার্থ জ্ঞানের ক্ষেত্রে ‘তাৎপর্যজ্ঞান কারণ’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
.
যে সকল পদের একাধিক অর্থ আছে, সেই সকল পদের ক্ষেত্রে তাৎপর্য অনুধাবন করা বিশেষ প্রয়োজন। বক্তা পদটি কোন্ অর্থে ব্যবহার করেছেন তা যদি সঠিকভাবে অনুধাবন করা না হয় তাহলে সে বাক্য বক্তার মনের যথার্থ ভাব প্রকাশ করতে পারে না। যেমন, ‘সৈন্ধব’ পদের ব্যাকরণগত অর্থ দ্বিবিধ- অশ্ব এবং লবণ। এই দুই অর্থের কোন্ অর্থে বক্তা শব্দটি ব্যবহার করেছেন তা অনুধাবন না করলে বাক্য যথার্থ হবে না। পরিস্থিতি ও প্রসঙ্গ বিচার করেই বাক্যের তাৎপর্য গ্রহণ করতে হয়।

(চলবে…)

[আগের পর্ব: উপমিতি বা উপমান প্রমাণ] [*] [পরের পর্ব: ন্যায়-পরাতত্ত্ব]

No comments: