Saturday, July 7, 2012

| ন্যায়দর্শন…০৮ : ন্যায় পরাতত্ত্ব |

 .
| ন্যায়দর্শন…০৮ : ন্যায় পরাতত্ত্ব |
রণদীপম বসু

৮.০ : ন্যায় পরাতত্ত্ব
.
৮.১ : জগৎ
ন্যায়মতে জগতের স্বতন্ত্র সত্তা আছে। তাই জাগতিক বস্তুরও স্বতন্ত্র সত্তা আছে, সেগুলো নিছক মনের ধারণা নয়। ফলে এদের অস্তিত্ব জ্ঞানের উপর নির্ভরশীল নয়।

 .
ন্যায়সূত্রানুযায়ী, যোলটি পদার্থের তত্ত্বজ্ঞান থেকে নিঃশ্রেয়স বা মুক্তি হয়। এই যোড়শ পদার্থ হচ্ছে- প্রমাণ, প্রমেয়, সংশয়, দৃষ্টান্ত, সিদ্ধান্ত, অবয়ব, তর্ক, নির্ণয়, বাদ, জল্প, বিতণ্ডা, হেত্বাভাস, ছল, জাতি, নিগ্রহস্থান। আবার নৈয়ায়িকেরা বৈশেষিক মতের সাতটিই পদার্থ যেমন দ্রব্য, গুণ, কর্ম, সামান্য, বিশেষ, সমবায় এবং অভাব- এর অস্তিত্বও স্বীকার করেন। অতএব ন্যায়সূত্রের ষোড়শ পদার্থের সিদ্ধান্তের সাপেক্ষে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, তাহলে কিভাবে বলা যায় যে পদার্থ কেবলমাত্র সাতটিই। এ প্রেক্ষিতে নব্য নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তাঁর তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে বলেন-

‘সর্বেষাং পদার্থানাং যথাযথমুক্তেষবন্তর্ভাবাৎ সপ্তৈব পদার্থা ইতি সিদ্ধম’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : সকল পদার্থ উল্লিখিত সাতটি পদার্থের যে কোন একটির অন্তর্ভুক্ত বলে পদার্থ সাতটি এবং কেবলমাত্র সাতটি।
 .
নৈয়ায়িকদের মতে জ্ঞানের বিষয় বা প্রমেয় বারোটি, যথা- আত্মা, শরীর, ইন্দ্রিয়, অর্থ, বুদ্ধি, মন, প্রবৃত্তি, দোষ, প্রেত্যভাব, ফল, দুঃখ ও অপবর্গ।
এখানে প্রবৃত্তি বলতে ধর্ম ও অধর্ম (শুভ-অশুভ কর্ম) বোঝায়। দোষ বলতে রাগ, দ্বেষ ও মোহকে বোঝায়। রাগ বলতে ইচ্ছাকে, দ্বেষ বলতে ক্রোধকে, মোহ বলতে শরীরাদিতে আত্মভ্রমকে বোঝায়। প্রেত্যভাব বলতে মরণের পর পুনরুৎপত্তি বা পুনর্জন্মকে বোঝায়। ফল বলতে সুখদুঃখের ভোগকে বোঝায়। অপবর্গ বলতে নিঃশ্রেয়স বা মোক্ষকে বোঝায়। আত্মার অপবর্গ বা মুক্তি বলতে বোঝায় এমন এক অবস্থা যখন সকল দুঃখ ধ্বংস হয় এবং যখন দুঃখ ফিরে আসার আর কোন সম্ভাবনাই থাকে না। অর্থাৎ মুক্তি দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তিকে বোঝায়।
 .
এইসব জ্ঞানের বিষয় ভৌতিক জগতে দেখা যায় না। যেসব বিষয় বা পদার্থ ভৌতিক দ্বারা গঠিত সেগুলি দেখা যায়। আত্মা ও মন যেহেতু ভৌতিক নয়, সেহেতু জাগতিক নয়। নৈয়ায়িকগণ বস্তুবাদী দার্শনিক। তাঁদের মতে আত্মা হলো একটি অভৌতিক দ্রব্য। দেশ ও কালের দ্বারা আত্মা সীমিত হয় না। দেশ ও কালের বস্তুগত সত্তা আছে। কাল অনন্ত ও অখণ্ড, দেশও অনন্ত অখণ্ড।
 .
পৃথিবী ও যাবতীয় বস্তুসকল চারটি উপাদান দ্বারা গঠিত হয়েছে। এই উপাদান হলো- ক্ষিতি (মাটি), অপ (জল), তেজ (অগ্নি) ও মরুৎ (বাতাস)। এই উপাদানগুলির অন্তিম অংশ হলো চার প্রকারের পরমাণু। এই পরমাণুগুলি নিত্য, অবিভাজ্য ও অপরিবর্তনীয়। পরমাণুগুলি ও ঈশ্বর সহাবস্থানকারী। ঈশ্বর এই পরমাণুগুলি সৃষ্টি করেননি। তিনি এই পরমাণুর সাহায্যে জগৎ সৃষ্টি করেছেন। তাই ঈশ্বর এই জগতের নিমিত্ত কারণ মাত্র। জগতের সকল বস্তু যৌগিক এবং পরমাণু দ্বারা গঠিত। যৌগিক বস্তু, ইন্দ্রিয়, জীবদেহ এবং ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য গুণ সবই এই যৌগিক পদার্থের অন্তর্ভুক্ত।
 .
নৈয়ায়িকরা দ্বৈতবাদী। তারা জড়জগৎ ও আত্মা উভয়েরই স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্বীকার করেন।
 .
.
৮.২ : আত্মা ও অপবর্গ
ন্যায়দর্শনে মুখ্যত জ্ঞানতত্ত্ব ও যুক্তিবিদ্যার আলোচনা গুরুত্ব পেলেও আত্মা বা আত্মার অপবর্গের আলোচনা এই দর্শনে কখনোই উপেক্ষিত হয় নি। মহর্ষি গৌতমের ‘ন্যায়সূত্র’, বাৎস্যায়নের ভাষ্যগ্রস্থ ‘ন্যায়ভাষ্য’ ও তাদের টীকা-টিপ্পনী ছাড়াও আত্মা বিষয়ে নৈয়ায়িক উদয়নাচার্যের ‘আত্মতত্ত্ববিবেক’ স্বতন্ত্র গ্রন্থ হিসেবে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
 .
আত্মার স্বরূপ :
আত্মা বলতে জীবাত্মা এবং পরমাত্মা উভয়কেই বোঝায়। ন্যায়মতে ঈশ্বরই পরমাত্মা, তাই সাধারণভাবে আত্মা বলতে জীবাত্মাকেই বোঝানো হয়। নৈয়ায়িকদের মতে আত্মা একটি অভৌতিক, নিত্য ও সর্বব্যাপী দ্রব্য। দেশ ও কাল আত্মাকে সীমিত করতে পারে না। তাঁদের মতে এক একটি দেহে এক একটি আত্মা বিদ্যমান।
 .
মহর্ষি গৌতম তাঁর ন্যায়দর্শনে জ্ঞানের বিষয় হিসেবে বারোটি প্রমেয়-পদার্থের আলোচনায় আত্মা ও অপবর্গ বিষয়ে তাঁর নিজস্ব মত প্রকাশ করেছেন। বৈশেষিক দর্শনে আত্মা নবদ্রব্যের অন্যতম দ্রব্য পদার্থরূপে স্বীকৃত। ‘আত্মন’ শব্দ গমনার্থক ‘অত্’ ধাতুর সঙ্গে ‘মন্’ প্রত্যয়ের মাধ্যমে নিষ্পন্ন। ‘অত্’ ধাতুর অর্থ গমন। তাই আত্মার অর্থ হলো গমনকারী। দেহ থেকে দেহান্তরে গমন করে বলেই আত্মাকে গমনকারী বলা হয়। আবার গমনার্থক ধাতুমাত্রই জ্ঞানার্থক। সুতরাং ‘আত্মন্’ শব্দের অপর অর্থ হলো জ্ঞাতা বা জ্ঞানের আশ্রয়। নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহ গ্রন্থে আত্মার লক্ষণ দিয়েছেন-

‘জ্ঞানাধিকরণমাত্মা’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : আত্মা জ্ঞানের অধিকরণ বা আশ্রয়।
 .
আত্মা জ্ঞান বা চৈতন্যস্বরূপ নয়। জ্ঞানাধিকরণত্ব আত্মার লক্ষণ। জ্ঞান বা চৈতন্য আত্মার একটি গুণ। ন্যায় ও বৈশেষিক উভয় সম্প্রদায়মতেই আত্মা জ্ঞান ও ইচ্ছাদি (ইচ্ছা, দ্বেষ, বুদ্ধি বা প্রযত্ন, সুখ, দুঃখ প্রভৃতি) গুণের আশ্রয়। এ বিষয়ে অন্নংভট্ট তাঁর টীকাগ্রন্থ তর্কসংগ্রহদীপিকায় বলেন-

‘সুখাদৌ আশ্রয়ত্বং জীব লক্ষণম্’। (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : সুখ, দুঃখ, দ্বেষাদির আশ্রয় হলো জীব (জীবাত্মা)।
 .
তবে জ্ঞান আত্মার নিত্য গুণ নয়, আগন্তুক গুণ। আত্মাতে জ্ঞান সর্বদা থাকে না। আত্মাতে জ্ঞান উৎপন্ন হয়। এই জ্ঞান বা চৈতন্য ও ইচ্ছা প্রভৃতি গুণ আত্মা বা আত্মদ্রব্যের বিশেষ গুণ। এই গুণগুলি অভৌতিক। এর ফলে কোন ভৌতিক দ্রব্যে এই গুণগুলি থাকতে পারে না। গুণের আলাদা অস্তিত্ব থাকে না, গুণ হয় দ্রব্যাশ্রিত। অর্থাৎ যে কোনো গুণ কোনো না কোনো দ্রব্যকে আশ্রয় করে অবস্থান করে। রাগ, দ্বেষ ইত্যাদি গুণগুলি যেহেতু ভৌতিক নয়, তাই এই গুণগুলি কোনো অভৌতিক দ্রব্যকে আশ্রয় করেই অবস্থান করতে হয়। এই অভৌতিক গুণগুলির আশ্রয়রূপে যে অভৌতিক দ্রব্য স্বীকৃত, তাই আত্মা। ন্যায়-বৈশেষিক মতে এই আত্মদ্রব্য বা আত্মা নিত্য অর্থাৎ উৎপত্তি ও বিনাশরহিত, মূর্ত, বিভু ও সংখ্যায় বহু। প্রতি শরীরে জীবাত্মা ভিন্ন ভিন্ন। বিভু অর্থ পরমমহৎপরিমাণবিশিষ্ট। শরীরের দ্বারা অবচ্ছিন্ন বলে জীবাত্মাকে সীমিত বলে মনে হয়।
 .
ভারতীয় বিভিন্ন দার্শনিক সম্প্রদায়ের মধ্যে জীবাত্মার স্বরূপ সম্পর্কে বিভিন্ন মতবাদ দেখা যায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য চারটি মতবাদ হলো- জড়বাদী, অভিজ্ঞতাবাদী, ভাববাদী ও বস্তুস্বাতস্ত্র্যবাদী মতবাদ। জড়বাদী দার্শনিক সম্প্রদায় চার্বাকদের মতে, চৈতন্যবিশিষ্ট দেহই আত্মা, দেহ ছাড়া আত্মার ভিন্ন কোনো সত্তা নেই এবং অভৌতিক আত্মা বলে কিছু নেই, অর্থাৎ আত্মা এবং দেহ অভিন্ন। চার্বাকমতে দেহ বিনষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আত্মাও বিনষ্ট হয়, তাই আত্মা অমর নয়। অভিজ্ঞতাবাদী বৌদ্ধ দার্শনিকদের মতে আত্মা (পুৎগল) হলো পরিবর্তনশীল মানসিক অবস্থা। ভাববাদী অদ্বৈত বেদান্তমতে  আত্মা বিশুদ্ধ চৈতন্যস্বরূপ ও নিত্য। এই মতে আত্মা জ্ঞাতাও নয়, জ্ঞেয়ও নয়। আর রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈত মতে আত্মা চৈতন্যস্বরূপ নয়, আত্মা হলো সক্রিয় ও সগুণ সচেতন দ্রব্য।
 .
নৈয়ায়িকরা আত্মাকে একটি চৈতন্যবিশিষ্ট দ্রব্য বলে মনে করেন। তাঁদের মতে আত্মা জ্ঞাতা, ভোক্তা ও কর্তারূপে সব কিছু জানে। সকল কর্ম সম্পাদন করে এবং সকল কিছু ভোগ করে। তবে ন্যায়মতে চৈতন্য বা জ্ঞান আত্মার বিশেষ গুণ হলেও তা আত্মার স্বাভাবিক বা অবিচ্ছেদ্য গুণ নয়। জ্ঞান বা চৈতন্য আত্মার আগন্তুক গুণ, যা কিছু সম্বন্ধের মাধ্যমে আত্মায় আশ্রিত হয়। আত্মা স্বরূপত অচেতন, নিষ্ক্রিয়। আত্মা যখন মনের সঙ্গে, মন ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে এবং ইন্দ্রিয় বাহ্যবস্তুর সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হয়, তখন আত্মার চেতনা বা বুদ্ধির আবির্ভাব হয়। এই সম্বন্ধগুলির অভাবে জ্ঞান উৎপন্ন হয় না। আবার আত্মা যখন দেহ বিযুক্ত হয় তখন তাতে আর চৈতন্যরূপ থাকে না। মোক্ষাবস্থায় আত্ম-মন-সংযোগ না থাকায় আত্মায় জ্ঞান উৎপন্ন হতে পারে না এবং আত্মা জ্ঞানহীন শুদ্ধ সত্তারূপে বিরাজ করে। কিন্তু এই জ্ঞানহীন শুদ্ধ সত্তা বদ্ধ আত্মারই অবস্থান্তর। বদ্ধাবস্থায় আত্মা জ্ঞানের অধিকারী হয়। এজন্য মুক্ত আত্মাকে জ্ঞানহীন বলা যায়, কিন্তু জ্ঞানাযোগ্য বলা যায় না।
 .
আত্মার অস্তিত্বের প্রমাণ :
ন্যায়সূত্রকার মহর্ষি গৌতম এবং অন্যান্য নৈয়ায়িকেরা বিভিন্ন যুক্তির সাহায্যে আত্মা যে ইন্দ্রিয়াদি, শরীর, প্রাণ প্রভৃতি থেকে ভিন্ন, তা নিরূপনের মাধ্যমে আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণের চেষ্টা করেছেন।
শরীর ও ইন্দ্রিয় যে আত্মা হতে ভিন্ন তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে নৈয়ায়িকদের বক্তব্য হচ্ছে, শরীর কিংবা ইন্দ্রিয় আত্মা হতে পারে না। আত্মা শরীর ও ইন্দ্রিয় হতে ভিন্ন।
 .
শরীর আত্মা হলে, অর্থাৎ শরীর ও আত্মা অভিন্ন হলে শরীরের কোন অঙ্গের নাশে শরীরের নাশ হলে আত্মারও নাশ হয়- একথা বলতে হয়। কিন্তু একথা স্বীকার করলে স্মৃতি ব্যাখ্যা করা যায় না। শরীরের কোন অঙ্গের নাশে আত্মার নাশ স্বীকার করলে শরীরের ঐ অঙ্গের নাশের পূর্বে অনুভূত বিষয়ের স্মরণ করা সম্ভব হবে না। স্মৃতির ব্যাখ্যার জন্য শরীরাতিরিক্ত এক অভিন্ন সত্তা অবশ্য স্বীকার্য। ক্ষণে ক্ষণে পরিবর্তনশীল শরীর আত্মা হতে পারে না।
 .
আবার ইন্দ্রিয় ও আত্মা অভিন্ন হলে অনুসন্ধান বা প্রত্যভিজ্ঞা ব্যাখ্যা করা যাবে না। ‘যে আমি ঘটকে দেখেছিলাম সেই আমি এখন ঘটকে স্পর্শ করছি’ এরূপ প্রত্যভিজ্ঞা আমাদের হয়। এরূপ প্রত্যভিজ্ঞাস্থলে প্রত্যক্ষ কর্তা ও স্পর্শকর্তা অভিন্নরূপে প্রতীত হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে স্পর্শ স্থলে যে ইন্দ্রিয় কাজ করে ও প্রত্যক্ষ স্থলে যে ইন্দ্রিয় কাজ করে তা ভিন্ন। ইন্দ্রিয় ও আত্মা অভিন্ন হলে স্বীকার করতে হয় যে, অনুভব হয়েছে একজনের আর স্মরণ হচ্ছে অন্যজনের। কিন্তু অনুভবকর্তা ও স্মরণকর্তা অভিন্ন না হলে স্মরণ সম্ভব হয় না। অভিন্ন আত্মা স্বীকার না করলে অনুভব হবে একজনের আর স্মরণ হবে অন্যের। সুতরাং শরীর ও ইন্দ্রিয় হতে ভিন্ন এক নিত্য আত্মার অস্তিত্ব অবশ্য স্বীকার্য।
 .
মহর্ষি গৌতম ও বাৎস্যায়ন আত্মাকে অনুমেয় বলেছেন। এই প্রাচীন নৈয়ায়িকদের মতে আত্মার অস্তিত্ব সাক্ষাৎভাবে জানা যায় না। অনুমানের সাহায্যে আত্মার অস্তিত্বের কথা জানা যায়। তাঁদের মতে ইচ্ছা, দ্বেষ, প্রযত্ন, সুখ, দুঃখ প্রভৃতির অস্তিত্ব থেকে আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণ করা যেতে পারে। এছাড়া আত্মার অস্তিত্ব সম্পর্কে শ্রুতিতে উল্লেখ আছে। যেহেতু শ্রুতি শব্দপ্রামাণ্য গ্রন্থ, তাই আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার্য।
 .
ইচ্ছা, দ্বেষ, সুখ, দুঃখ প্রভৃতির অস্তিত্ব আমরা স্বীকার না করে পারি না। কিন্তু কোনো স্থায়ী আত্মার অস্তিত্ব যদি স্বীকার করা না হয় তাহলে ইচ্ছা, দ্বেষ প্রভৃতির ক্রিয়াকে আমরা কিভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি। কোনো একটি বস্তু সুখদায়ক বলে সেই বস্তুটি লাভ করার ইচ্ছা করি। কোনো দুঃখজনক অবস্থার উদ্ভব হলে আমরা মনে করি যে পূর্বের মতো আমরা দুঃখ পাবো। এই সুখ দুঃখের অনুভূতি অতীত অভিজ্ঞতার উপর নির্ভর করে। এই অতীত অভিজ্ঞতার স্মৃতিই প্রমাণ করে যে স্থায়ী আত্মার অস্তিত্ব আছে। জ্ঞান ও আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণ করে কোনো বিষয়ে প্রথমে জানার ইচ্ছা করে পরে সেই সম্বন্ধে চিন্তা করলে তার জ্ঞান লাভ করা যায়। এই কারণেও আত্মার অস্তিত্ব স্বীকার করতে হয়।
 .
তবে উদ্দ্যোতকর, আচার্য উদয়ন প্রভৃতি নব্য নৈয়ায়িকদের মতে অহং-প্রত্যয়ের বিষয়রূপে স্ব স্ব আত্মার মানস-প্রত্যক্ষের সাহায্যে আত্মাকে জানা যায়। তাঁদের মতে, আমাদের মনের সঙ্গে যখন শুদ্ধ আত্মার সংযোগ ঘটে তখন আত্মা সম্পর্কে আমাদের সাক্ষাৎ জ্ঞান জন্মে। এই আত্মসচেতনতাই মানস-প্রত্যক্ষ। কোনো কোনো নৈয়ায়িকের মতে শুদ্ধ আত্মা প্রত্যক্ষের বস্তু নয়। বুদ্ধি, অনুভূতি, প্রযত্ন প্রভৃতি গুণের মাধ্যমে আত্মাকে সাক্ষাৎভাবে প্রত্যক্ষ করা যায়। আমরা যখন বলি ‘আমি আছি’, ‘আমি সুখী’, ‘আমি দুঃখী’ তখন আমাদের আত্মা সম্পর্কে জ্ঞান প্রকাশিত হয়।
 .
নৈয়ায়িকদের মতে চৈতন্যের অস্তিত্বও আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণ করে। আত্মার সঙ্গে চৈতন্যের সমবায় সম্বন্ধ। চৈতন্য আত্মারূপ দ্রব্যকেই আশ্রয় করে বিরাজ করে। অতএব আত্মার অস্তিত্ব আছে।
আবার ন্যায়মতে অলৌকিক প্রত্যক্ষের সাহায্যেও আত্মার অস্তিত্ব জানা যায়। তাঁদের মতে, যোগীরা ধ্যানের মাধ্যমে আত্মাকে প্রত্যক্ষ করতে পারেন।
 .
আত্মার মুক্তি বা অপবর্গ :
আত্মার মোক্ষলাভকে ন্যায়ের পরিভাষায় বলা হয় অপবর্গ। চার্বাক ব্যতীত প্রায় সকল ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়েরই মূল লক্ষ্য হলো আত্মার মুক্তি। বৌদ্ধ মতে যদিও স্থায়ী আত্মা স্বীকার করা হয়নি, তবুও তাঁদেরও মূল লক্ষ্য চৈতন্য প্রবাহের নির্বাণ।
ন্যায়মতে আত্মা স্বভাবতই নিষ্ক্রিয়, নির্গুণ ও চৈতন্যহীন দ্রব্য। আত্মা মনের সঙ্গে যুক্ত হলে এবং মন, ইন্দ্রিয় ও বাহ্যবস্তুর সঙ্গে সংযুক্ত হলেই বুদ্ধি, ইচ্ছা, দ্বেষ, সুখ, দুঃখ, প্রযত্ন প্রভৃতি গুণ আত্মার মধ্যে আবির্ভুত হয়। মন ও দেহের সঙ্গে আত্মার এই সংযোগ ঘটলে আত্মার বদ্ধাবস্থা সূচনা করে। এর ফলে এই বদ্ধ-আত্মারূপ দেহ সুখ-দুঃখাদি ভোগ করে। ন্যায়মতে এই সুখ-দুঃখাদি ভোগের আত্যন্তিক মুক্তি বা নিবৃত্তিই হলো মোক্ষ বা অপবর্গ। মূলত মুক্তি বলতে নৈয়ায়িকেরা দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তিকেই বোঝান। দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি হলে তার আর পুনরাবৃত্তি হয় না।
 .
প্রশ্ন হলো, কী কারণে দুঃখ হয় ? মিথ্যাজ্ঞান বা অবিদ্যা হেতু দুঃখ হয়। তাহলে অবিদ্যা কী ? অনিত্যবস্তুকে নিত্য মনে করাই অবিদ্যা। যেমন আমরা মন, ইন্দ্রিয়, শরীর প্রভৃতিকেই আত্মারূপে মনে করি। কিন্তু আত্মা মন, শরীর ও ইন্দ্রিয়- এই কোনোটির সঙ্গেই অভিন্ন নয়। এই ভ্রান্ত জ্ঞানই মিথ্যাজ্ঞান। অজ্ঞানতাবশত মানুষ নিজেকে কর্তা, জ্ঞাতা এবং ভোক্তা মনে করে। আত্মাকে সুখ, দুঃখ, ইচ্ছা, দ্বেষ প্রভৃতির অধীন মনে করে মোহগ্রস্ত হয়। আত্মাকে এরূপ মনে করাই অবিদ্যা। এই অবিদ্যা বা মিথ্যজ্ঞান থেকে তিন প্রকার দোষ জন্মে, যেমন- রাগ, দ্বেষ ও মোহ। এই দোষের তাড়নায় জীব ভালো মন্দ কাজে লিপ্ত হয়। এর ফলে ধর্ম ও অধর্মের উৎপত্তি হয়। এই প্রবৃত্তির জন্য মানুষের আবার জন্ম হয় এবং এই জন্ম হেতু দুঃখ হয়। ভারতীয় কর্মফলবাদ তথা জন্মান্তরবাদ অনুযায়ী জীবের ধর্মাচরণের ফলস্বরূপ সুখ ভোগ করার জন্য এবং অধর্মাচরণের ফলস্বরূপ দুঃখ ভোগের জন্যই জীবকে বারবার জন্মগ্রহণ করতে হয়। জীবের জন্য এই জন্মগ্রহণই মূলত সকল দুঃখের কারণ। ন্যায়মতে, সকল দুঃখের মূল যে মিথ্যাজ্ঞান, সেই মিথ্যাজ্ঞান যথার্থ জ্ঞান দ্বারা বিনষ্ট হলে জীবকে আর জন্মগ্রহণ করতে হবে না।
 .
দেহ ও ইন্দ্রিয় হতে আত্মার সম্পূর্ণ বিচ্যুতি না হওয়া পর্যন্ত তার দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি সম্ভব নয়। দেহ ও ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে আত্মার সংযোগই আত্মার বদ্ধাবস্থা এবং আত্মা যখন দেহ ও ইন্দ্রিয় হতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে তখন আত্মার মুক্তাবস্থার সূচনা হয়। এই মুক্তাবস্থার পূর্ব পর্যন্ত আত্মা তার স্বরূপে অবস্থান করে না এবং পুনঃ পুনঃ জীবের জন্মচক্র সংঘটিত হতে থাকে। মুক্তাবস্থায় আত্মা তার স্বরূপে অবস্থান করলে আর কখনো সুখ-দুঃখাদির অনুভব হয় না এবং এই অবস্থাকেই বলা হয় আত্যন্তিক নিবৃত্তি বা মোক্ষ বা অপবর্গ।
 .
মোক্ষ অবস্থায় সুখ অনুভূতি থাকে কিনা এই নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। মহর্ষি গৌতম সুখানুভূতির অস্তিত্বের কথা স্পষ্ট প্রকাশ করেননি। তবে ভাষ্যকার বাৎস্যায়নের মতে মোক্ষতে সুখের অনুভূতি থাকে না। এই অপবর্গ বা আত্মার মুক্তিলাভের উপায় কী ? নৈয়ায়িকদের মতে যথার্থ তত্ত্বজ্ঞানই মুক্তি লাভের উপায়। আত্মা দেহ, মন ও ইন্দ্রিয় হতে যে ভিন্ন এই জ্ঞানই তত্ত্বজ্ঞান। অপবর্গ লাভই যে ন্যায় দর্শনের লক্ষ্য, তা ন্যায়সূত্রে মহর্ষি গৌতমের প্রথম সূত্রেই উক্ত হয়েছে। ন্যায়মতে প্রমাণাদি ষোড়শ পদার্থের তত্ত্বজ্ঞান অপবর্গ লাভের সহায়ক মাত্র। তবে অন্যান্য বৈদিক সম্প্রদায়ের মতো নৈয়ায়িকগণও অপবর্গের উপায়রূপে তত্ত্বজ্ঞান লাভের জন্য শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের উল্লেখ করেছেন। আত্মার যথার্থ স্বরূপ সম্পর্কে শ্রুতিবাক্য বা শাস্ত্রবাক্যের শ্রবণ ও অনুধাবন হলো শ্রবণ। মনন হলো ঐ সকল বাক্যাদির যুক্তিপূর্ণ বিচার, সঠিক অর্থগ্রহণ এবং ঐ অর্থের উপর দৃঢ় বিশ্বাস স্থাপন। নিদিধ্যাসন হলো যোগ ও সাধনার মাধ্যমে আত্মার স্বরূপকে সতত ধ্যান করা। এই ত্রিবিধ স্তরের মাধ্যমে দেহ, মন ও ইন্দ্রিয়াদির অতিরিক্ত এক শুদ্ধ আত্মার উপলব্ধি ঘটে। জীব তখন আর মন, শরীর বা ইন্দ্রিয়কে আমিরূপে উপলব্ধি করে না। আত্মোপলব্ধির ফলে মিথ্যাজ্ঞান, বিভিন্ন প্রকার দোষ ও প্রবৃত্তির চির-বিলুপ্তি ঘটে।
 .
শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের ফলে একদিকে যেমন পূর্বে সঞ্চিত কর্মফল ভোগের মাধ্যমে সমাপ্ত হয়, তেমনি অপরদিকে প্রবৃত্তির বিনাশে নতুন কর্মফল আর উৎপন্ন হয় না। স্বাভাবিকভাবেই জীবের অদৃষ্টভোগ সমাপ্ত হয়। অদৃষ্টভোগের সমাপ্তিতে এবং নতুন কর্মফলের অনুৎপত্তিতে জীবাত্মার পুনর্জন্ম রোধ হয় এবং দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি ঘটে। এরই নাম মোক্ষলাভ বা অপবর্গলাভ।
নৈয়ায়িকদের মতে তত্ত্বজ্ঞানী ব্যক্তি মাত্রই, সেই ব্যক্তি সন্ন্যাসীই হোন বা গৃহস্থই হোন, তিনি মোক্ষ লাভের অধিকারী।
 .
.
৮.৩ : ঈশ্বর
ন্যায়মতে ঈশ্বরই পরমাত্মা। এই পরমাত্মা জগতের সৃষ্টি, স্থিতি ও লয়ের কারণ। বেদান্তমতে জগৎ ব্রহ্মের বিবর্ত (নিমিত্ত ও উপাদান উভয়ই)। সাংখ্যমতে জগৎ প্রকৃতির পরিণাম। কিন্তু ন্যায়মতে জগৎ পরমাণুর সাহায্যে ঈশ্বরের দ্বারা সৃষ্ট। জগতের উপাদান কারণ পরমাণু এবং নিমিত্ত কারণ ঈশ্বর। দেশ, কাল, আকাশ প্রভৃতি জগৎ সৃষ্টির সহকারি কারণ। দেশ, কাল, আকাশ প্রভৃতি এবং জগতের আদি উপাদান নিত্যপরমাণু ঈশ্বরের দ্বারা সৃষ্ট নয়। ঈশ্বর তাই জগৎ-স্রষ্টা হলেও জগতের আদি উপাদানের স্রষ্টা নন। কুম্ভকার যেমন প্রাপ্ত মৃত্তিকার সাহায্যে ঘট নির্মাণ করে, ঈশ্বর তেমনি নিত্য স্থিত পরমাণুর সাহায্যে এই বৈচিত্র্যময় জগৎ সৃষ্টি করেছেন।
 .
ন্যায়দর্শনে মহর্ষি গৌতম যে ষোলটি পদার্থে কথা উল্লেখ করেন তাতে ঈশ্বরের কোন উল্লেখ নেই। তিনি ঈশ্বর সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা না করলেও ‘ন্যায়সূত্র’-এর চতুর্থ অধ্যায়ের প্রথম আহ্নিকে তিনটি সূত্রে ঈশ্বরের কথা উল্লেখ করেছেন। সিদ্ধান্তসূত্রতে মহর্ষি গৌতম দৃঢ়ভাবে বলেছেন যে ঈশ্বরই জীবের কর্ম ও কর্মফল নিয়ন্ত্রণ করেন।
পরবর্তী নৈয়ায়িকেরা ঈশ্বর সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন এবং অভিমত দেন যে, ঈশ্বরের করুণা লাভ করলেই মোক্ষ লাভ সম্ভব হয়। ঈশ্বরের করুণা ছাড়া জীবাত্মার মুক্তি সম্ভব নয়। ঈশ্বর সর্বজ্ঞ। তিনি শুধু জগতের সৃষ্টিকর্তা নন, তিনি জগতের রক্ষাকর্তা এবং ধ্বংসকর্তাও বটে।
 .
ঈশ্বরের স্বরূপ :
ন্যায়মতে প্রমেয় পদার্থের অন্যতম পদার্থ হলো আত্মা। আত্মা দু’প্রকার- জীবাত্মা ও পরমাত্মা। এই পরমাত্মাই ঈশ্বর। জীবাত্মার জ্ঞান অনিত্য, কিন্তু পরমাত্মা বা ঈশ্বর নিত্য জ্ঞানবান। ঈশ্বরের লক্ষণ বর্ণনা করে নব্য-নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহদীপিকায় বলেন-

‘নিত্যজ্ঞানাধিকরণত্বং ঈশ্বরত্বম’। (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : পরমাত্মা বা ঈশ্বর নিত্যজ্ঞানের অধিকরণ বা আশ্রয়।
 .
নিত্যজ্ঞান পরমাত্মার গুণ। সুতরাং ঈশ্বর সগুণ। সর্বজ্ঞ পরমাত্মা সর্ববিষয়ক নিত্যজ্ঞানের আশ্রয়, কিন্তু নিত্যজ্ঞানস্বরূপ নন। তিনি জ্ঞানাদি গুণবিশিষ্ট, নিত্য, সর্বজ্ঞ। তাই ঈশ্বর অতীন্দ্রিয়দর্শী, অনাদী, অসীম, সর্বশক্তিমান।
.
ন্যায়মতে ঈশ্বর আত্মদ্রব্য হলেও জীবাত্মার ন্যায় ঈশ্বর সুখ-দুঃখাদি ভোগ করেন না। মুক্ত আত্মাতে নৈয়ায়িকেরা যেমন জ্ঞানের স্বরূপযোগ্যকারণতা স্বীকার করেন, কিন্তু ফলোপধায়ককারণতা স্বীকার করেন না তেমনি ঈশ্বর বা পরমাত্মাতে তাঁরা সুখ-দুঃখাদির স্বরূপযোগ্যকারণতা স্বীকার করেন, কিন্তু ফলোপধায়ককারণতা স্বীকার করেন না। ফলোপধায়ককারণ বাস্তবিক পক্ষে কার্য উৎপন্ন করে, কিন্তু স্বরূপযোগ্যকারণ কার্য উৎপন্ন করার ক্ষমতাসম্পন্ন হলেও বাস্তবিক পক্ষে কার্য উৎপন্ন করে না। শরীর, অদৃষ্ট প্রভৃতি সহকারি কারণের অনুপস্থিতিতে ঈশ্বর বা পরমাত্মায় সুখ-দুঃখাদি উৎপন্ন হতে পারে না।
 .
পরমাণু, দেশ, কাল, আকাশ, মন ও আত্মা- এগুলি হলো নিত্য দ্রব্য। ন্যায়মতে ঈশ্বর এই নিত্য দ্রব্যগুলি সৃষ্টি করেননি। জগৎ সৃষ্টির পূর্বে এই নিত্য দ্রব্যগুলির ঈশ্বরের ন্যায় অস্তিত্ব ছিলো এবং এদের অস্তিত্ব জগৎ ধ্বংসের পরেও থাকবে। কুম্ভকার যেমন মৃত্তিকারূপ উপাদানের সাহায্যে ঘট নির্মাণ করে, তেমনি ঈশ্বরও পরমাণু, দেশ, কাল, আকাশ, মন এবং আত্মার সাহায্যে এই জগৎ সৃষ্টি করেন। ঈশ্বরই জগতের স্রষ্টা। জগৎ সৃষ্টির পর তিনি জগতকে রক্ষা করেন, আবার প্রয়োজনবোধে তিনি এই জগতকে ধ্বংস করেন। তিনি পরমাণুর সংযোগ সাধান করে জগৎ সৃষ্টি করেন এবং পরমাণুর বিচ্ছেদ সাধান করে জগতের ধ্বংস সাধন করেন।
 .
ঈশ্বর অদৃষ্ট শক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করেন। জীব নিজের ইচ্ছায় কর্ম করে এবং কর্মের গুণাগুণ বিচার করে কর্মের গুণানুসারে ঈশ্বর তার ফল প্রাপ্তির ব্যবস্থা করেন। কর্ম অনুযায়ী জীব ফল ভোগ করে। কর্ম অনুযায়ী জীব যে পাপ-পুণ্যের অধিকারী হয়, এই পাপ-পুণ্য যার মধ্যে সঞ্চিত হয় তাকে বলে অদৃষ্ট। ঈশ্বর এই অদৃষ্টকে নিয়ন্ত্রণ করেন। জীবের কর্মফল প্রাপ্তির ব্যবস্থা করার জন্য ঈশ্বরকে জীবের অদৃষ্ট শক্তির উপর নির্ভর করতে হলেও ঈশ্বর সর্বশক্তিমান। তিনি সর্বজ্ঞ, সব কিছুর যথাযথ স্বরূপ সম্পর্কে তিনি জ্ঞাত। ঈশ্বরের এই অনন্ত জ্ঞান তার অবিচ্ছেদ্য গুণ।
 .
ঈশ্বর এক ও শাশ্বত পরম সত্তা। ঈশ্বর সকল জীবের কর্মকে নিয়ন্ত্রণ করেন। জীবের ইচ্ছার স্বাধীনতা থাকলেও ঈশ্বরের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। ঈশ্বরই কর্মফল প্রদান করেন। তিনিই আমাদের নৈতিক জীবনের সুখ দুঃখের নিয়ন্ত্রণ কর্তা। তাই-

‘তত্র ঈশ্বরঃ সর্বজ্ঞঃ পরমাত্মা এক এব’। (তর্কসংগ্রহ)।
অর্থাৎ : নিত্য পরমাত্মা বা ঈশ্বর এক ও সর্বজ্ঞ।
 .
ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ে প্রমাণ :
বলা হয়ে থাকে, ধর্মপরায়ণ ব্যক্তির নিকট ঈশ্বরের অস্তিত্ব স্বতঃই প্রমাণিত। ঈশ্বরের অস্তিত্ব-বিষয়ক প্রমাণ তাই তাঁর কাছে নিরর্থক। কিন্তু দার্শনিকদের কাছে, বিশেষ করে যুক্তিবাদী দার্শনিকদের কাছে প্রমাণের গুরুত্ব অবশ্যস্বীকার্য। বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের মন অন্ধভাবে কোন কিছু স্বীকার করতে চায় না। তাই ঈশ্বরের অস্তিত্ব-বিষয়ক প্রমাণ পর্যাপ্ত হোক বা না হোক, ঈশ্বরোপলব্ধির পদক্ষেপ হিসেবে এই প্রমাণগুলির গুরুত্ব অস্বীকার করা যায় না।
 .
ঈশ্বরবিশ্বাসী অন্যান্য দার্শনিকদের ন্যায় নৈয়ায়িকেরাও ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে নানা যুক্তির অবতারণা করেছেন। এই যুক্তিগুলি ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে ‘প্রমাণ’ বলে পরিচিত। তাঁদের প্রদত্ত প্রমাণগুলির কোনো না কোনোটার সাথে পাশ্চাত্য দার্শনিকদের ঈশ্বরের অস্তিত্বের যুক্তির সাদৃশ্য দেখা যায়। অর্থাৎ বিশ্বের অন্যান্য দার্শনিকদের উপস্থাপিত প্রায় সব প্রমাণই নৈয়ায়িকদের প্রদত্ত প্রমাণগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা যায়।
.
নৈয়ায়িকদের সুপ্রসিদ্ধ ও সমধিক প্রচলিত প্রমাণ-চতুষ্টয় হলো- (ক) কার্যকারণ বিষয়ক প্রমাণ (The Causal Argument), (খ) অদৃষ্টভিত্তিক প্রমাণ (Argument from Adrista), (গ) বেদ-কর্তারূপে ঈশ্বর প্রমাণ (The Argument from the Authoractiveness of the Vedas), (ঘ) ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ে বেদ বা শ্র“তি প্রমাণ (The Testimony of Sruti)।
 .
(ক) কার্যকারণ বিষয়ক প্রমাণ : কার্য-কারণ নিয়ম অনুযায়ী প্রতিটি কার্য-পদার্থেরই একটি কারণ আছে। নৈয়ায়িকেরা আরম্ভবাদী। তাঁদের মতে কার্য সৃষ্টির পূর্বে অসৎ থাকে। কারণসামগ্রিই কার্যকে উৎপন্ন করে। বিচিত্র বস্তু সমন্বিত এই জগৎ একটি কার্য। অতএব এই জগতেরও একটি কারণ আছে। জগতের এই কারণই ঈশ্বর।
 .
প্রশ্ন উঠতে পারে যে, প্রতিটি কার্যেরই কারণ আছে এ সত্য নৈয়ায়িকেরা আবিষ্কার করলেন কী করে ? আবার প্রতিটি কার্যেরই একটি কারণ আছে এরূপ সার্বিক নিয়ম স্বীকার করে নিলেও জগৎ যে একটি কার্য তাতেই বা প্রমাণ কী ? এক্ষেত্রে নৈয়ায়িকেরা বিভিন্ন দৃষ্টান্তের সাহায্যে অন্বয় প্রক্রিয়ার দ্বারা কার্য-কারণ বিষয়ক একটি সার্বিক নীতিকে এবং ভিন্ন যুক্তির সাহায্যে জগৎ যে একটি কার্য তা প্রতিষ্ঠা করেছেন।
 .
কোন কার্য উৎপন্ন হওয়ার পেছনে দু’প্রকার কারণ থাকে- উপাদান কারণ ও নিমিত্ত কারণ। যেমন, ঘট হলো একটি কার্য। এই কার্যের উপাদান কারণ হলো মৃত্তিকা। আর নিমিত্ত কারণ হলো কুম্ভকার। এখানে কুম্ভকার চেতন কর্তা। অর্থাৎ কোন কার্য কোনও চেতন কর্তা ব্যতীত উৎপন্ন হয় না। যখনই কোন কার্য উৎপন্ন হয় কার্যের পেছনে তখনই তার নিমিত্ত কারণরূপে কোন একটি চেতন সত্তা থাকে। ন্যায়মতে একই ক্ষণে কার্য ও কারণ উভয়ই উৎপন্ন হতে পারে না। তাই কারণ কার্যের সমকালীন না হয়ে পূর্ববর্তীই হয়। কার্যের চেতন কারণ ন্যায়মতে নিমিত্ত কারণের অন্তর্গত।
 .
জগৎ যে কার্য এ সত্য প্রতিষ্ঠা করতে নৈয়ায়িকেরা সাবয়বত্ব ও অবান্তরমহত্ত্ব নামক দুটি হেতুর সাহায্য নিয়েছেন। সাবয়ব মানে অবয়ববিশিষ্ট এবং অবান্তরমহৎ মানে মধ্যমপরিমাণবিশিষ্ট। ন্যায়মতে নিরবয়ব পরমাণু ও অতিমহৎ দেশকালাদি (দেশ, কাল, আকাশ, মন, আত্মা) নিত্য। তাই এরা কার্যরূপ নয়। কিন্তু ঘট, পট, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ, নক্ষত্র, পাহাড়-পর্বত ইত্যাদি পার্থিব বস্তু দেশকালাদির ন্যায় অতিমহৎও নয় আবার পরমাণুর ন্যায় অনুপরিমাণও নয়। পার্থিব সকল বস্তুই সাবয়ব এবং অবান্তরমহৎ বা মধ্যমপরিমাণবিশিষ্ট। সাবয়ব এবং অবান্তরমহৎ পদার্থ মাত্রই কার্যরূপ- যেহেতু এগুলি অংশের সমষ্টি এবং সীমিত পরিসর যুক্ত। সুতরাং জাগতিক সকল বস্তুই কার্য। এই কার্যরূপ জগতের নিমিত্তকারণরূপে একটি চেতন সত্তা প্রয়োজন।
কার্যের নিমিত্ত কারণরূপ চেতন সত্তা অবশ্যই কার্যের সূক্ষ্ম উপাদানের সুস্পষ্ট জ্ঞান, কার্য উৎপন্ন করার ইচ্ছা এবং কার্য উৎপন্ন করার ক্ষমতা সম্পন্ন হবেন। অন্যথা জড় উপাদান ও চেতন কর্তার মধ্যে পার্থক্য থাকে না। জগতের উপাদান সূক্ষ্মপরমাণুর এবং সহকারি কারণ দেশ-কালাদির সার্বিক জ্ঞান কোন সীমিত জ্ঞানের অধিকারী চেতন কর্তার পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। সুতরাং জগতের যিনি নিমিত্ত কারণ তাঁকে অসীম জ্ঞানের অধিকারী বা সর্বজ্ঞ হতে হবে। জগতের মতো বিরাট কার্য উৎপন্ন করার ইচ্ছা ও ক্ষমতা এক সর্বশক্তিমান সত্তার পক্ষেই থাকা সম্ভব। তাই একমাত্র সর্বজ্ঞ ও সর্বশক্তিমান সত্তা যে ঈশ্বর তিনিই এ নিখিল জগতের সৃষ্টিকর্তা ও নিমিত্তকারণ।
 .
(খ) অদৃষ্টভিত্তিক প্রমাণ : অদৃষ্ট হলো জীবের নিজ নিজ কর্ম অনুযায়ী সঞ্চিত পাপ-পুণ্যের সমষ্টি বা ভাণ্ডার। অদৃষ্টে সঞ্চিত কর্ম অনুযায়ী জীব তার কর্মফল ভোগ করে। এটাকে কর্মবাদ বলা হয়।
এ জগতে দেখা যায় যে, সকল জীবের জীবন একরূপ নয়। জগতে কেউ সুখী, আবার কেউ দুঃখী। শুধু তাই নয়, কেউ হয়তো সৎ উপায়ে জীবনযাপন করা সত্ত্বেও দুঃখভোগ করে। আবার কেউ অসৎ উপায়ে জীবনযাপন করেও দুঃখভোগ করে না। জীবের সুখ-দুঃখের এই তারতম্য ও আপাত-অসংগতি দূর করার জন্য ভারতীয় দর্শনে একটি সার্বিক নৈতিক নিয়ম স্বীকার করা হয়, যা কর্মবাদ নামে পরিচিত।
 .
কর্মবাদ অনুযায়ী জীবের প্রতিটি সকাম কর্মেরই ফল আছে এবং প্রতিটি জীবকেই তার নিজের কর্মফল ভোগ করতে হয়। কর্মের সুফলকে বলা হয় পুণ্য এবং কুফলকে বলা হয় পাপ। প্রতিটি জীবের জীবনেই সুকর্ম থেকে সুখভোগ এবং কুকর্ম থেকে দুঃখভোগ হয়। কর্মফল সবসময় কর্মানুযায়ী হয়। তারপরও, কোন কোন ব্যক্তির জীবনে কর্মের এই নিয়মের আপাত-ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু আপাত-ব্যতিক্রমের জন্য সার্বিক নৈতিক নিয়মকে অস্বীকার করা যায় না। কেননা সার্বিক নৈতিক নিয়মকে অস্বীকার করা হলে মানবজীবন যথেচ্ছাচারের দাস হয়ে পড়ে। এজন্যে এই ব্যতিক্রমের হেতু অনুসন্ধান  করে কর্মবাদের ব্যাখ্যায় বলা হয়, জীব একটি মাত্র জন্মে তার সকল কৃতকর্মের ফল-ভোগ সমাপ্ত করতে সক্ষম হবে এমন কোন কথা নেই। জীব তার কৃতকর্মের ফলের পরিমাণ অনুযায়ী জন্ম-জন্মান্তরে তা ভোগ করে থাকে। এই জন্মান্তরবাদের উপর ভিত্তি করেই কর্মবাদ প্রতিষ্ঠিত। যে ব্যক্তি ইহজীবনে সৎকর্ম করেও দুঃখভোগ করে সে আসলে এই ইহজীবনের কর্মফল ভোগ করে না। পূর্বজন্মের কৃত কুকর্মের পাপ তার পূর্বজন্মেই শেষ হয়ে যায় নি বলেই সেই সঞ্চিত পূর্বজন্মের পাপ সে এই জীবনে ভোগ করে চলেছে। এজন্যেই ইহজীবনে তার কর্ম ও ফলভোগের মধ্যে অসংগতি দেখা দেয়। প্রকৃতপক্ষে প্রতিটি জীবের কর্মফলভোগ তার নিজস্ব পাপপুণ্যের সমষ্টি বা ভাণ্ডার অনুযায়ীই হয়ে থাকে। এই কর্মফল-ভাণ্ডার বা সঞ্চিত পাপপুণ্যের সমষ্টি ন্যায়দর্শনে জীবের অদৃষ্ট বলে পরিচিত।
 .
এই অদৃষ্ট হলো অচেতন বা জড় পদার্থ। সে নিজে নিজে পরিচালিত হতে পারে না। প্রতিটি জীবের অদৃষ্ট সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ এবং জন্মান্তরে জীবকে নিজ নিজ অদৃষ্ট অনুযায়ী যথাযোগ্য ফল অর্পণ আকস্মিকভাবে বা কোন সসীম জীবের দ্বারা সম্ভব হতে পারে না। জীব কোন্ কর্মের কী ফল তা জানে না। তাছাড়া জীব নিজেই অদৃষ্টের দাস। অদৃষ্টের সঠিক পরিচালনার জন্য অদৃষ্টের বহির্ভুত অর্থাৎ যিনি নিজে অদৃষ্টের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত নন এরূপ নিরপেক্ষ, সর্বশক্তিমান একটি সত্তা স্বীকার করা প্রয়োজন, যাঁর দক্ষ ও সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণে প্রতিটি জীব তার নিজ নিজ অদৃষ্টের অধিকারী হয়ে জন্ম-জন্মান্তরে নিজ নিজ কর্মফল ভোগ করতে পারে। এই সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান, অদৃষ্ট-নিয়ন্ত্রক সত্তাই হলেন ঈশ্বর।
নিজের কর্ম জীব নিজেই করে এবং সেই কর্মের ফল সে নিজেই ভোগ করে। ঈশ্বর জীবের অদৃষ্টের রক্ষক ও পরিচালক মাত্র। ঈশ্বর কখনো অদৃষ্টের পরিবর্তন করেন না।
 .
(গ) বেদ-কর্তারূপে ঈশ্বর প্রমাণ : সকল আস্তিক সম্প্রদায়ই বেদকে অভ্রান্ত ও সর্বপ্রকার জ্ঞানের আকর বলে মনে করেন। আস্তিক সম্প্রদায়গুলির কাছে বেদ প্রামাণিক শাস্ত্র। দৃষ্টার্থ বেদবাক্য থেকে বেদের প্রামাণ্য সুস্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়। যেমন আয়ুর্বেদ রোগ নিরাময়ের যে সকল বিধান দেয় সেই সকল বিধান পালন করে রোগগ্রস্ত মানুষ স্বচ্ছন্দে রোগমুক্ত হতে পারে। এরূপ দৃষ্টার্থ বেদবাক্যের ন্যায় অদৃষ্টার্থ বেদবাক্যও অভ্রান্ত মানতে হবে। সসীম মানুষের পক্ষে বেদের সকল বাক্যের ব্যবহারিক প্রামাণ্য প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়।
 .
ন্যায়মতে, আসলে বেদের প্রামাণ্য বেদের রচয়িতার প্রামাণ্য থেকে নিঃসৃত। বেদের বহু উপদেশ সাধারণ মানুষের জ্ঞানগম্যই নয়। এমন অতিসূক্ষ্ম ও অতীন্দ্রিয় পদার্থ বিষয়ক বেদবাক্য রচনা কোন সর্বজ্ঞ পুরুষের দ্বারাই সম্ভব, সসীম মানুষের দ্বারা সম্ভব নয়। বস্তুতঃপক্ষে বেদ সর্ব জ্ঞানের অধিষ্ঠান বা আকর। এরূপ অধিষ্ঠান বা আকরের রচয়িতা সর্বজ্ঞ ঈশ্বর ছাড়া আর কেউ হতে পারেন না।
অতএব, ন্যায়মতে বেদ সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের বাক্য যার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যৎ এবং যাবতীয় বিষয়ের প্রত্যক্ষ জ্ঞান আছে। এভাবে বেদের কর্তারূপে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণিত হয়।
 .
(ঘ) ঈশ্বরের অস্তিত্ব বিষয়ে বেদ বা শ্রুতি প্রমাণ : বেদ ও উপনিষদ বিভিন্ন স্থানে ঈশ্বরের স্বরূপ ও প্রকৃতি সম্বন্ধে স্পষ্টভাবে বিভিন্ন উক্তি প্রকাশ করেছে। প্রায় সকল উপনিষদেই কোন না কোন ভাবে সৃষ্টিকর্তারূপে এক সর্বজ্ঞ সত্তার ইঙ্গিত আছে। এসব শ্রুতির প্রামাণ্য স্বীকার করে নৈয়ায়িক অন্নংভট্ট তর্কসংগ্রহদীপিকায় বলেন-

‘যঃ সর্বজ্ঞঃ স সর্ববিৎ’ ইতি আগমোহপি তত্র প্রমাণম্ । (তর্কসংগ্রহদীপিকা)।
অর্থাৎ : ‘যঃ সর্বজ্ঞ স সর্ববিৎ’- এরূপ আগম বা শ্রুতিবাক্যের দ্বারাও ঈশ্বরের অস্তিত্ব সিদ্ধ হয়।
 .
অন্নংভট্ট শ্রুতি হিসেবে যে ‘যঃ সর্বজ্ঞঃ স সর্ববিৎ’- বেদবাক্যটি (মুণ্ডক উপনিষদ-১/১/৯) উল্লেখ করেছেন, এতে যাঁকে ‘সর্বজ্ঞ’ (‘যিনি সামান্যত সবকিছুতে জানেন’) ও ‘সর্ববিৎ’ (‘যিনি সবকিছুকে বিশদভাবে জানেন’) বলা হয়েছে, তিনিই ঈশ্বর। উল্লেখ্য, মুণ্ডকোপনিষদের মূল শ্লোকটি হচ্ছে-

যঃ সর্বজ্ঞঃ সর্ববিদ্ যস্য জ্ঞানময়ং তপঃ।
তস্মাদেতৎ ব্রহ্ম নাম রূপম্ অন্নম্ চ জায়তে।। (মুণ্ডক উপনিষদ : ১/১/৯)।
অর্থাৎ : যিনি সর্বজ্ঞ, যিনি সর্ববিৎ, জ্ঞানই যাঁর তপস্যা সেই পরা ব্রহ্ম থেকেই এই অপরা ব্রহ্ম (হিরণ্যগর্ভ বা ঈশ্বর) এবং নাম, রূপ ও অন্নাদি এসেছে। (অর্থাৎ ব্রহ্ম থেকেই সবকিছুর প্রকাশ, বিকাশ।)
 .
যদিও আস্তিক দর্শন সম্প্রদায়ের অন্তর্গত হয়েও সাংখ্য ও মীমাংসা সম্প্রদায় ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না, কিন্তু বৃহদারণ্যক, শ্বেতাশ্বতর প্রভৃতি উপনিষদে ও ভগবদ্গীতায় যে ঈশ্বরের অস্তিত্বের কথা বলা হয়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই বলে নৈয়ায়িকদের অভিমত।
গীতায় সুস্পষ্টভাবে শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন যে, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালনের জন্য তিনি বারংবার আবির্ভূত হন। ঈশ্বর সর্বজীবের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত। তিনিই জগতের পিতা, মাতা, ভর্তা ও প্রভু। বৃহদারণ্যক উপনিষদে আছে- ‘তিনি সকলের প্রভু, সকলের নিয়ামক, সকলের শাসনকর্তা এবং সকল জীবের স্বামী।’ শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বলা হয়েছে যে, ঈশ্বরই পরম পুরুষ, তিনি সর্বব্যাপী, সর্বজ্ঞ এবং সর্বভূতের আশ্রয়স্থল। মোটকথা বিভিন্ন উপনিষদে ঈশ্বরকে কখনো সৃষ্টিকর্তা, রক্ষাকর্তা, পালনকর্তারূপে, কখনো সকল ভূতের আশ্রয়রূপে, কখনো ন্যায় ও কল্যাণের প্রতিষ্ঠাতারূপে, আবার কখনো জীবের মোক্ষের উপায়রূপে উল্লেখ করা হয়েছে। শ্রুতি যদি অভ্রান্ত হয় তাহলে এ সকল উক্তি থেকেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব সন্দেহাতীতরূপে প্রতিষ্ঠিত হয়।
 .
এখানে প্রশ্ন হতে পারে যে, শাস্ত্র বাক্যকে আমরা ঈশ্বরের অস্তিত্বের প্রমাণ বলে মেনে নেবো কেন ? সাধারণ ধর্মবিশ্বাসী মানুষ ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করলেও দার্শনিকরা শাস্ত্রবাক্যকে প্রামাণ্য বলে স্বীকার করে নিয়ে ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করবেন কী করে। একথার খণ্ডন করে বলা হয়, কোন কিছুর অস্তিত্ব প্রত্যক্ষ দ্বারা প্রমাণিত হয়। ঈশ্বরের অস্তিত্বও প্রত্যক্ষ উপলব্ধির বিষয়। যুক্তির দ্বারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায় না। ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য যেসব যুক্তি দেয়া হয়েছে সেগুলি ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারে না, কারণ সব যুক্তিই ঈশ্বরের অস্তিত্বকে পূর্বে স্বীকার করে নিয়ে তারপর ঈশ্বরে অস্তিত্বের বিষয়টি প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে।
.
প্রত্যক্ষই ঈশ্বরের অস্তিত্বের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রমাণ। কিন্তু যারা ঈশ্বরকে প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করতে পারেননি, তাদের সত্যদ্রষ্টা ঋষিদের আপ্তবাক্যের উপর নির্ভর করা শ্রেয়। বেদ ও উপনিষদে ঈশ্বরের যে অস্তিত্বের কথা আছে সেগুলি বিশ্বাসযোগ্য। ঋষিদেরও শ্রুতিবাক্য আপ্তবাক্য-প্রামাণ্য বলে স্বীকার করা উচিত।
এভাবেই নৈয়ায়িকেরা শ্রুতির সাহায্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করেন।
 .
ঈশ্বরের অস্তিত্বের পক্ষে নৈয়ায়িকদের যুক্তির বিরুদ্ধে আপত্তি :
নৈয়ায়িকেরা ঈশ্বরের অস্তিত্বকে প্রমাণ করার জন্য যেসব যুক্তি উপস্থাপন করেছেন সেসব যুক্তির বিরুদ্ধে সাংখ্য, মীমাংসা ও জৈন দার্শনিকেরা কতকগুলি আপত্তি এনেছেন। এবং নৈয়ায়িকেরাও এই অভিযোগগুলি খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন।
 .
নৈয়ায়িকদের ঈশ্বর সম্পর্কিত যুক্তিগুলির মধ্যে কার্য-কারণ বিষয়ক প্রমাণের বিরুদ্ধে অপর দার্শনিকদের আপত্তি হলো, ঈশ্বর যদি এই জগতের সৃষ্টিকর্তা হন তবে তার অবশ্যই দেহ থাকতে হবে। আর যদি ঈশ্বরের দেহ থাকে তাহলে তিনি অসীম নন। কুম্ভকার শারীরিক ক্রিয়ার দ্বারা মৃত্তিকারূপ উপাদানের সাহায্যে ঘট নির্মাণ করেন। ঈশ্বরও নিত্য দ্রব্যগুলির সাহায্যে জগৎ সৃষ্টি করেন। ঈশ্বর যদি এই জগতের সৃষ্টিকর্তা হন তবে ঈশ্বরের অবশ্যই দেহ থাকা প্রয়োজন।
নৈয়ায়িকেরা এই আপত্তি খণ্ডন করে বলেন, কর্ম করার জন্য জীবের দেহের প্রয়োজন, কিন্তু ঈশ্বরের জন্য দেহের কোনো প্রয়োজন নেই। যেসব পরমাণুর দ্বারা ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেন সেই পরমাণুগুলি ঈশ্বরের ইচ্ছায় সংযুক্ত হয় এবং সেই পরমাণুগুলিই ঈশ্বরের দেহের কাজ করতে পারে। ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই পরমাণুগুলি গতিশীল হয়ে ওঠে।
 .
নৈয়ায়িকদের বিরুদ্ধে অপর আপত্তি হলো, ঈশ্বর যদি জগতের সৃষ্টিকর্তা হন তাহলে জগৎ সৃষ্টির পেছনে ঈশ্বরের কোনো উদ্দেশ্য রয়েছে। কিন্তু ঈশ্বরের কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে না। বিরোধীপক্ষ বলেন, যেহেতু ঈশ্বরের কোনো উদ্দেশ্য থাকতে পারে না সেহেতু ঈশ্বর জগতের সৃষ্টিকর্তা নন। আরো বলা হয়ে থাকে যে, ঈশ্বর করুণাবশত এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু ঈশ্বর যদি করুণাবশত জগৎ সৃষ্টি করে থাকেন তাহলে তিনি সকল জীবকে সুখী করতেন। কিন্তু জগতে অনেক দুঃখ-কষ্ট রয়েছে। মানুষ অনেক দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে। সুতরাং ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেননি।
এই আপত্তির উত্তরে নৈয়ায়িকেরা বলেন, ঈশ্বর করুণাবশত এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন। জীবকে তার নিজের কর্মফল ভোগ করতে হয়। ঈশ্বর জীবের পাপ-পুণ্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে জগৎ সৃষ্টি করেছেন। জীবকে স্বাধীনভাবে কর্ম করার সুযোগ দিয়েছেন। জীবই স্বাধীন ইচ্ছার দ্বারা নিজের সুখ ও দুঃখের সৃষ্টি করে। মানুষের কর্মফলের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ঈশ্বর কোন মানুষকে সুখী, কোন মানুষকে দুঃখী করেন।
 .
শেষের দুটি অর্থাৎ তৃতীয় ও চতুর্থ প্রমাণে নৈয়ায়িকেরা বেদের ও শ্রুতির সাহায্যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করেছেন। নৈয়ায়িকদের এ দুটি প্রমাণ সম্বন্ধে পরস্পরাশ্রয় বা অন্যোন্যাশ্রয় বা চক্রক দোষের আপত্তি উঠেছে। দুটি তত্ত্ব বা বস্তু যদি পরস্পর পরস্পরের উপর নির্ভরশীল হয়ে পরস্পরকে প্রতিষ্ঠা করে, তাহলে অন্যোন্যাশ্রয় বা পরস্পরাশ্রয় বা চক্রক দোষ ঘটে। তৃতীয় যুক্তিতে নৈয়ায়িকেরা বেদের প্রামাণ্য প্রতিষ্ঠার জন্য বেদকে ঈশ্বর-নির্ভর বলেছেন। আবার চতুর্থ প্রমাণে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য তাঁরা ঈশ্বরকে বেদ বা শ্রুতি-নির্ভর বলেছেন। অর্থাৎ নৈয়ায়িকেরা বেদের প্রামাণ্য প্রতিষ্ঠা করার জন্য ঈশ্বরের এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য বেদের সাহায্য নিয়েছেন। বেদ ও ঈশ্বর পরস্পর পরস্পরের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় প্রকৃতপক্ষে কেউই কাউকে প্রতিষ্ঠা করতে পারে না। এরূপ দোষের নামই পরস্পরাশ্রয় দোষ।
নৈয়ায়িকেরা উপরিউক্ত আপত্তি খণ্ডন করতে বলেন, পরস্পরাশ্রয় সব সময় দোষের নয়। দুটি বস্তু যদি একই বিষয়ে পরস্পরের উপর নির্ভর করে, তাহলেই পরস্পরাশ্রয় দোষ হয়। অর্থাৎ যে জন্য বেদ ঈশ্বর-নির্ভর, সেজন্যই যদি ঈশ্বর বেদ-নির্ভর হতেন, তাহলে সেখানে অন্যোন্যাশ্রয় দোষ ঘটতো। কিন্তু ঈশ্বরের অস্তিত্ব-বিষয়ক তৃতীয় ও চতুর্থ প্রমাণে এরূপ নির্ভরশীলতার কথা বলা হয়নি। তৃতীয় প্রমাণে বেদ রচনা-বিষয়ে ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল বলা হয়েছে। অর্থাৎ ঈশ্বর যেহেতু বেদের সৃষ্টিকর্তা, সেহেতু সৃষ্টির জন্য বেদ ঈশ্বরের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু ঈশ্বর জ্ঞপ্তি বিষয়ে বেদের উপর নির্ভরশীল, অস্তিত্ব বিষয়ে নন। অর্থাৎ ঈশ্বরতত্ত্ব উপলব্ধির জন্য আমাদের বেদের উপর নির্ভর করতে হয়, ঈশ্বরের উৎপত্তির জন্য নয়। নিত্য ঈশ্বরের উৎপত্তির প্রশ্নই উঠে না। নির্ভরতার বিষয় সম্পূর্ণ ভিন্ন হওয়ায় ঈশ্বর ও বেদের অন্যোন্যাশ্রয় দোষের আশঙ্কা অর্থহীন।

(শেষ)

[আগের পর্ব: শব্দ প্রমাণ] [*]

No comments: