Thursday, September 13, 2012

| হারং-হুরং কিংবা শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত ও অন্যান্য…|

.
| হারং-হুরং কিংবা শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত ও অন্যান্য…|
রণদীপম বসু
 
বিভিন্ন কিংবদন্তী থেকে যখন ইতিহাসের উপকরণ সংগ্রহ করতে হয় এবং সেই কিংবদন্তীর মূলে যদি থাকে পৌরাণিক উপাখ্যান আর অলৌকিক আধ্যাত্মিকতার আবেগী প্রভাব, তাহলে সে ইতিহাসে বিভিন্ন স্ববিরোধিতা ও একধরনের যাদুবাস্তবতার মিশেল হয়ে যাওয়াটা হয়তো অস্বাভাবিক নয়। শ্রীহট্ট তথা সিলেটের প্রাচীন ইতিহাসের ক্ষেত্রেও এই প্রভাব অস্পষ্ট নয়। তবু তা থেকেই আমাদেরকে নিজের মতো করে প্রকৃত ধারণাটা নিতে হয়। এই ধারণা খুব স্পষ্ট বা নির্ভুল না হলেও প্রাচীন পটচিত্রের মতোই অর্থবহ তো বটেই। আর ইতিহাসের বাস্তব উপকরণ হিসেবে কোন প্রাচীন ঐতিহ্যের উপস্থিতি সেই ধারণার একটা শক্ত ভিত্তি তৈরি করে দেয় বৈকি। কিংবদন্তীর হুরং-হারং হয়তো শ্রীহট্টের ইতিহাসের জন্য তেমনই এক চমৎকার নমুনা হিসেবে সামনে এসে দাঁড়ায়।

.
(১)
ছুটির দিনে:
কথায় বলে- একে তো নাচুনে বুড়ি, তার উপর ঢোলের বাড়ি ! প্রায় আড়াই দশকের চাকুরে জীবনে এবছরের মতো ঈদ-উল-ফিতর ঘিরে কখনো আর এতোটা সুবিধাজনক দীর্ঘ ছুটি ভাগে পড়েনি বলে যানবাহনের তীব্র হুড়োহুড়ি আর ভয়ঙ্কর ভিড় ঠেলে এ সময়ে কর্মস্থল ছেড়ে কোথাও যাওয়ার খুব একটা ইচ্ছে বা সুযোগ কোনোটাই হয়নি। এবার যখন কোথাও বেরিয়ে পড়ার ইচ্ছেটা আগেভাগেই উঁকিঝুকি মারছিলো ঠিক তখনই সিলেট থেকে অনুজপ্রতীম সত্যজিৎ দেব অর্ণব ফোনে লোভনীয় উপঢৌকনটা ছুঁড়ে দিলো- দাদা, চলে আসেন, আপনাকে নিয়ে হুরং-হারং এবং আরো অনেক কিছু খুঁজতে বেরুবো। আর পায় কে ! প্রাচীন ঐতিহ্যের প্রতি আকর্ষণের অহেতুক তীব্র বেমোটার কথা সে আগে থেকে জানতো বলেই এ যাত্রায় তাঁর সূক্ষ্মরাজনীতিটাও সফল হয়ে গেলো। তাঁর বড় বোনটি, যে নাকি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ভয়ে আমাকে অরক্ষিত একা রেখে বাপের বাড়ি গিয়ে নিশ্চিন্তে খুব একটা তিষ্টাতে পারতো না, এবার একসাথে কব্জায় পেয়ে যাবার সুযোগ রূপাও কি আর হাতছাড়া করে ! হা হা হা ! আর উত্তর প্রজন্মের প্রতিনিধি প্রান্তিক তো একপায়েই খাড়া !
 .
.
আগস্টের কুড়ি তারিখ ঈদ-উল-ফিতর হবার কথা থাকলেও এবারের ছুটিটা শুরু হয়েছে বাঙালির শোকস্তব্ধ দিন পনেরো আগস্ট থেকে। আগাম নিশ্চয়তা হিসেবে এক সপ্তাহ আগেই শ্যামলী পরিবহনের টিকেট বুক করে রাখা। ঈদের ছুটি শুরুর প্রথম দিনে মিরপুরের বাসা থেকে বেরিয়ে এক ঘণ্টার মধ্যে যানজটমুক্ত অবস্থায় ঢাকার সায়দাবাদে পৌঁছে যাওয়াটা রীতিমতো আশ্চর্যের বৈকি। বাস কাউন্টারও দেখি জনশূন্য প্রায়। তারচেও আশ্চর্যের হলো ঢাকা থেকে সিলেটগামী দুপুর আড়াইটার বাস যাত্রীশূন্যতার কারণে যথাসময়ে না ছেড়ে বিলম্বিত করার সিদ্ধান্ত। কারণ ওই বাসে সাকুল্যে যাত্রী হয়েছি আমরা তিনজনই। এসময়ে সায়দাবাদ বাস টার্মিনালকে এতাটা নিরিবিলি দেখাও কোন স্বাভাবিক দৃশ্য নয়। বাঙালির ঈদ-সংস্কৃতিতে এবার এরকম বিস্ময় নিয়েই বেলা তিনটায় আমাদের বাস ছাড়লো দুটো বাসের সম্মিলিত জনা তিরিশেক যাত্রী নিয়ে। যাত্রী হিসেবে বিষয়টা বেশ সন্তোষজনক হলেও সড়ক পরিবহন ব্যবসায় ঈদ উৎসবে এই অনাকাঙ্ক্ষিত যাত্রীশূন্যতা সংশ্লিষ্টদের জন্যে সাচ্ছন্দ্যের ছিলো না নিশ্চয়ই। সিলেটে পৌঁছে দেখি ধুন্ধুমার ঈদ-কেনাকাটার ভিড় আর যানজটে দুলছে তখন পূর্বাঞ্চলীয় এ বিভাগীয় শহর। কিন্তু আমার মাথার ভেতর দুলুনি শুরু করেছে অন্যকিছু, একটি যুগ্ম-শব্দ ‘হারং-হুরং’।
 .
.
কিশোর কুমারের একটি পুরনো গান আছে- ‘যারে আমি চোখে দেখিনি তার অনেক গল্প শুনেছি, গল্প শুনে তারে আমি অল্প অল্প ভালোবেসেছি…।’ কখনো দেখার সুযোগ না হলেও হারং-হুরং সম্পর্কে টুকটাক গল্প শুনেছিলাম আগেই। যথেষ্ট সময় ও সুযোগ হাতে না পাওয়ায় যে ইচ্ছেটা চরিতার্থ করা হয়ে ওঠেনি, এবার সেটা পূর্ণ করতেই মনস্থির করে এসেছি। কিন্তু সমস্যা হলো, যাকেই জিজ্ঞেস করি কেউ লোকেশন জানেন না। তাৎক্ষণিকভাবে সিলেটের প্রাচীন ইতিহাস গ্রন্থ যেটা হাতের কাছে পেয়েছি সেটাতে হারং-হুরং শব্দটিরই কোন পাত্তা নেই। বই থেকে যেটুকু জানা গেলো, সিলেট শহর থেকে ৬/৭ মাইল পূর্বে পেঁচাগড় নামক একটি গিরিদুর্গ আছে, সেখানেই থাকতে পারে বলে বিশ্বাস। অর্থাৎ সিলেট সংলগ্ন দীর্ঘবিস্তৃত চা-বাগানের দিকে কোথাও। কোন প্রত্যক্ষদর্শীরই সাক্ষাৎ না পেয়ে শেষে সিদ্ধান্ত নেয়া হলো বিমানবন্দর রোডে মালনীছড়া চা-বাগানের ভেতরেই অভিযান চালাবো কয়েকজন মিলে। সেখান থেকেই বাগানে অবস্থানরত কারো কাছ থেকে কোন তথ্য হয়তো পেয়ে যাবো।
 .
.
অভিযানের গন্ধ পেয়ে অর্ণবের বন্ধুস্থানীয় কিন্তু আমার আইনগত ভগিনি কয়েকজন এসে উপস্থিত হলেন যথাসময়ে। অতঃপর মালনীছড়া বাগানের ফটক দিয়ে ঢুকে যাত্রা শুরু হলো আমাদের। কিন্তু বাগানের পেট কেটে মালনীছড়া পেরিয়ে তেলিহাটি হয়ে কালাগুল বাগান পর্যন্ত কটকটে রোদে ঘণ্টা তিনেক হেঁটে অভিযান দূরে থাক, দৃশ্য উপভোগই মাথায় উঠলো। কারণ ভগিনিদের সাহচর্য যতই মাধুর্যময় হোক, তাঁদের ‘ওরে গেলামরে… মরলামরে…’ ইত্যাদি আহাজারি এমন অবস্থায় পৌঁছলো যে, তাদেরকে তখন এই টিলা-টালা-উঁচু-নিচু পথ মারিয়ে কাঁধে বয়ে নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর গতি রইলো না। তাছাড়া ততক্ষণে আমরা ইচ্ছেসই  পথের টানে যেখানে এসে পৌঁছেছি সেখান থেকে যথার্থ লক্ষ্যে কিংবা ফেরৎ যেতে হলেও ফের ঘণ্টা তিনেকের সম্ভাব্য পথ হাঁটতে হবে। রোদে-ঘামে জবজবে শরীর আর পেটের মধ্যে ক্ষুধার্থ-তৃষ্ণার্ত ইঁদুরের মচ্ছবে একশেষ অবস্থা। অবশেষে স্থানীয় অধিবাসীদের কাছে এ অবস্থা থেকে অধিকতর সহজ পরিত্রাণের উপায় জেনে নিয়ে উল্টোদিকে আরো ঘণ্টাখানেক হেঁটে যখন সাহেব বাজার নামক ছোট্ট একটি বাজারে এসে ঊঠলাম, নিজের পায়ের উপরই আর ভরসা রইলো না। সেখান থেকে সিএনজি যোগে সোজা শ্বশুরালয়। লাভ হলো এটাই, ক্ষণে ক্ষণে পাল্টে যাওয়া প্রকৃতির অপরূপ দৃশ্যপট ধরে রাখা অসংখ্য ছবিশট আর বহুকাল পর আদিপ্রকৃতির একান্ত সাহচর্যে কয়েক ঘণ্টা ডুবে থাকার বিরল স্মৃতি। এছাড়া অন্যান্য অভিজ্ঞতা তো আছেই। তবে উপরি পাওনা হিসেবে হারং-হুরং যাওয়ার উপায় জানে এরকম কিছু তরুণের ঠিকানাও জানা গেলো। অর্থাৎ ঈদ সামনে রাখা অন্য প্রোগ্রাম ছেটে এই অভিযান সমাপ্ত করতে আরেকটি দিন বরাদ্দ করতেই হলো। তবে এবার আর সেই ভুল করলাম না, মোহন আবেগকে কোটরবন্দি করে এবার রমণীবিহীন অভিযান চালানোই সাব্যস্থ হলো।
 .
.
হারং-হুরং শব্দের অর্থ কোন অভিধানে থাকার কথা নয়। কেননা শব্দ দুটি নিঃসন্দেহে সিলেটী প্রাচীন আঞ্চলিক কিছু একটা হবে এটা বুঝা যায়। সিলেটবাসী যাকেই এর সম্পূর্ণ অর্থ জিজ্ঞেস করা হয়েছে, নিশ্চয় করে তা কেউ বলতে পারলেন না। হতে পারে অভিজ্ঞ কোন ব্যক্তির সাথে সাক্ষাতের সুযোগ ঘটেনি বলেই এই অস্পষ্টতা। তবে নিজস্ব অভিজ্ঞতায় বলে, হুরং হলো সুড়ঙ্গ শব্দের সিলেটী অপভ্রংশ, এক্ষেত্রে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। আর আমার নিজ জেলা সুনামগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, যতটুকু মনে পড়ে, সাঁকো অর্থেই হারং শব্দটি ব্যবহার হয়ে থাকে। সেক্ষেত্রে সাঁকো বলতে যদি প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে কোন আড়াআড়ি বা বিকল্প পথ বোঝানো হয়, তাহলে হারং-হুরং অর্থ হবে কোথাও যাবার বিকল্প সুড়ঙ্গ পথ। ইতিহাসের সাক্ষ্য মানলে অন্তত ছয়শ বছর পূর্বের তৈরি এই হারং-হুরং-এর সার্বিক প্রয়োজন পরিস্থিতি বিবেচনা করে এই অর্থটা হয়তো অমূলক হবে না। কিন্তু এই সার্বিক পরিস্থিতি উপলব্ধির জন্য সিলেটের কিংবদন্তী-প্রধান ইতিহাসের পরিক্রমা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণা থাকাটা বিষয়বস্তু বোঝার ক্ষেত্রে সহায়ক হতে পারে। সেক্ষেত্রে আমরা নাহয় ইতিহাসের মধ্য দিয়েই হারং-হুরং-এ প্রবেশের চেষ্টা করি।
(তবে পাঠকের ধৈর্য্যের বাঁধে ফাটল দেখা দিলে স্ক্রল করে একটানে নিচে যাবার সুবিধা তো রয়েছেই।)
 .
(২)

কিংবদন্তীর খোঁজে:
সিলেট নামটি নিলেই যেমন অনিবার্যভাবে এসে যায় আউলিয়া পুরুষ হযরত শাহজালাল (রাঃ) এর কথা, তেমনি ইতিহাসের সংযুক্তি হিসেবে এসে যায় রাজা গৌড়গোবিন্দের কথাও। সিলেটকে শ্রীভূমি হিসেবে আখ্যায়িত করা বেশ পুরনো রেওয়াজ। প্রকৃত অর্থেই সিলেট অঞ্চল জল-জঙ্গল-টিলা-পর্বত-হাওর-নদী-লতা-বৃক্ষ-বাগান তথা প্রকৃতির বিচিত্র লীলাভূমি বলেই যে সিলেটকে শ্রীভূমি বলা হয় তা যেমন সত্যি, তেমনি সূফি-দরবেশ-দেব-দেবী তথা প্রাচীন পৌরাণিক বিশ্বাসের অমলীন স্পর্শধোয়া ভূমির পবিত্রতার প্রতীক হিসেবেও সিলেটকে শ্রীভূমি বলা হয়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, বর্তমান সিলেটের পূর্বনাম ছিলো শ্রীহট্ট। পুরনো কাগজপত্র দলিল-দস্তাবেজে সিলেটকে শ্রীহট্ট হিসেবেই উদ্ধৃত করা আছে। এমনকি পুরনো স্থাপনাগুলোর নামফলকে এখনো শ্রীহট্ট উদ্ধৃতিই লক্ষ্য করা যায়। সিলেটের ইতিহাস বিষয়ক অন্যতম পুরনো প্রকাশনা হিসেবে ১৯১০ সালে প্রকাশিত অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি’র ‘শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত’ গ্রন্থটির ঢাউস সাইজের খণ্ড দুটোতে (পূর্বাংশ ও উত্তরাংশ) শ্রীহট্ট ছাড়া সিলেট শব্দটি চোখে পড়েনি কোথাও। এখানে নিশ্চয়ই প্রশ্ন আসে, শ্রীহট্ট থেকে এই সিলেট নামের বিবর্তনটা কীভাবে হলো ?
 .
.
এ বিষয়ে সেই ছাত্রকালে শোনা কিংবদন্তীতুল্য একটা কাহিনী হচ্ছে, হযরত শাহজালাল (রাঃ) যখন শ্রীহট্টের দিকে আগমন করেন তখন তৎকালীন হিন্দু রাজা গৌড়গোবিন্দ তাঁর আগমন থামাতে শ্রীহট্ট সীমান্তে তাঁর কথিত জাদু ক্ষমতার দ্বারা পাথরের দেয়াল বা পাহাড়ের প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন। হয়রত শাহজালালও তাঁর অলৌকিক ক্ষমতা দিয়ে ‘শিল হট্’ বলতেই সেই শিল বা পাথরের প্রতিন্ধক হটে যায় বা অপসারিত হয়। এ থেকেই এই ভূমির অন্য নাম হয়েছে শিল-হট থেকে সিলেট। তবে ব্যক্তিগতভাবে এ কাহিনী আমার কাছে যুক্তিহীন কল্পনাপ্রসূত বলেই মনে হয়। বরং বৃটিশ আমলেই এই সিলেট শব্দটির সৃষ্টি হয়েছে বলে ধারণা করি। কেননা পুরনো কাগজপত্রে বাংলায় শ্রীহট্ট হিসেবে লেখা হলেও ভারতের সরকারি নথিপত্রে যেমন আসাম গেজেটিয়ারে (Assam District Gazetteers) বা অন্যত্র শ্রীহট্টকে ইংরেজিতেই প্রথম ‘সিলহেট’ (Sylhet) হিসেবে উদ্ধৃত হতে দেখা যায়। তৎকালীন ভারতবর্ষে শাসক হিসেবে আধিপত্যকারী বৃটিশদের নিজস্ব ইংরেজি উচ্চারণে অন্য অনেক বাংলা যুক্তশব্দের বিবর্তন প্রক্রিয়ার মতোই ‘শ্রীহট্ট’ শব্দটিও যে ভিন্নমাত্রিক ‘সিলহেট’ শব্দে বিবর্তিত হয়ে বর্তমান ‘সিলেট’-এ রূপান্তরিত হয়েছে, এই ব্যাখ্যাই যুক্তিসঙ্গত মনে হয়।
 .
আর শ্রীহট্ট নামের উৎস নিয়েও রয়েছে ব্যাপক অস্পষ্টতা। এর সাথে হিন্দু পৌরাণিক মিথের প্রভাব জড়িত থাকতে পারে বলে ধারণা করা হয়। হিন্দু পুরাণ অনুযায়ী শ্রী শ্রী হাটকেশ্বর হচ্ছে মহাদেব শিবের বহু নামের অন্যতম। তৎকালীন গৌড় (শ্রীহট্ট) রাজাদের কর্তৃক পুজিত শ্রী হাটকেশ্বরই শ্রীহট্ট নামের উৎস বলে অনেকে মনে করেন। এই হাটকেশ্বর নামে প্রসিদ্ধ শিবের প্রতিষ্ঠায় গৌরবান্বিত ছিলো শ্রীহট্ট, যাঁর মহিমা প্রাচীন তন্ত্রশাস্ত্রেও কীর্তিত আছে। যেমন প্রাচীন মহালিঙ্গেশ্বর তন্ত্রে বর্ণিত আছে-

‘নকুলেশঃ কালীপীঠে শ্রীহট্টে হাটকেশ্বরঃ।’- (মহালিঙ্গেশ্বর তন্ত্র)।
 .
শ্রীহট্টে এককালে যে প্রচুর সাধু-সন্ন্যাসীর আনাগোনা ছিলো এই ধারণাও অমূলক নয়। কেননা হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী গোটা ভারতবর্ষে পবিত্র তীর্থ হিসেবে যে একান্নটি মহাপীঠস্থান রয়েছে, বর্তমান বাংলাদেশে এর সাতটির মধ্যে দুটির অবস্থানই শ্রীহট্টে। পৌরাণিক বর্ণনা অনুযায়ী-

মানব জাতির প্রথম সভ্যতার যুগে (সত্য যুগে) রাজা দক্ষ প্রজাপতি এক যজ্ঞ করেন। সেই যজ্ঞে সকল দেবতারা আহুত হন। কিন্তু দক্ষপ্রজাপতি মহাদেবকে নিমন্ত্রণ না করে তাঁর নিন্দাবাদ করেছিলেন। দক্ষতনয়া সতী পিতার মুখে পতি নিন্দা শুনে দুঃখে অপমানে দেহত্যাগ করেন। সতী দেহত্যাগ করলে মহাদেব সতীদেহ স্কন্ধে নিয়ে যজ্ঞস্থান তছনছ করে দিয়ে উন্মত্তের মতো ভারতের বিবিধ অংশে প্রলয়নৃত্যে ভ্রমণ করতে লাগলেন। মহাপ্রলয়ের অধিপতি মহাদেবের এই প্রলয়ঙ্করী অবস্থায় স্বর্গমর্ত্যের আসন্ন প্রলয় আশঙ্কায় দেবতারা জগতের স্থিতির অধিপতি ভগবান বিষ্ণুর আরাধনায় বসেন। ভগবান বিষ্ণু তখন তাঁর প্রবল ধর্মচক্র দিয়ে সতীর দেহ খণ্ড খণ্ড করে বিভিন্ন স্থানে পতিত করে মহাদেবকে শান্ত করেন। যে যে স্থানে সতীর ছেদিত অঙ্গ পতিত হয়, সেই সেই স্থান এক একটি তীর্থে পরিণত হয় যা মহাপীঠ নামে খ্যাত হয়েছে। যে স্থানে সতীর অঙ্গাংশ বা অলঙ্কার পতিত হয় তার নাম উপপীঠ। প্রত্যেক পীঠের অধিষ্ঠাত্রি এক এক ভৈরবী ও তাঁহার রক্ষক এক এক ভৈরব (শিব) আছেন।
 .
.
শ্রীহট্টে এরকম দুটি মহাপীঠ রয়েছে। একটি হলো সিলেট নগরী হতে ৩৮ মাইল উত্তরপূর্বে জয়ন্তীয়ার বাউরভাগ (বাম+উরু+ভাগ)-এর বামজঙ্ঘা পীঠ, যা সাধারণত ‘ফালজোরের কালীবাড়ী’ নামে পরিচিত। পীঠাধিষ্ঠাত্রী জয়ন্তী দেবীর নামেই সে অঞ্চল জয়ন্তীয়া বা জৈন্তা নামে খ্যাত। এখানকার ভৈরবের নাম ক্রমদীশ্বর। আর শ্রীহট্টের অন্য মহাপীঠটি হচ্ছে সিলেট শহরের নিকটস্থ দেড় মাইল দক্ষিণে বর্তমান দক্ষিণ সুরমার জৈনপুরে মহালক্ষ্মী ভৈরবী গ্রীবাপীঠ, যা গোটাটিকরের ভৈরব (শিব) বাড়ি নামে পরিচিত। পৌরাণিক বিশ্বাস অনুযায়ী এই গ্রীবাপীঠে সতীর গ্রীবা পতিত হয়েছিলো।
 .
.
এখানকার ভৈরবীর নাম মহালক্ষ্মী ও ভৈরব সর্ব্বানন্দ। প্রচলিত পঞ্জিকার তীর্থ পরিচয়ে এবং পুরনো সরকারি নথিপত্রে (Assam District Gazetteers vol.2 chap.3 p-86) এই গ্রীবাপীঠ তীর্থস্থান হিসেবে উল্লেখ রয়েছে। সিলেট অঞ্চলে এককালে এরকম প্রচুর দেবালয় ও মন্দির ছিলো বলে জানা যায়। কালের বিবর্তনে সেসব স্মৃতি এখন ম্লান হয়ে এসেছে।
 .
.
তবে সিলেটের দক্ষিণ সুরমার জৈনপুরে এই মহালক্ষ্মী গ্রীবাপীঠের পাশেই বর্তমানে এলজিইডি কর্তৃক সংস্কারকৃত একটি প্রাইমারি স্কুল রয়েছে, যার প্রতিষ্ঠাকাল উৎকীর্ণ আছে ১৭৮৬ ইং হিসেবে। স্কুলটির নাম ‘মহালক্ষ্মী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’।
 .
.
আমাদের দেশে এমন প্রাচীন বিদ্যাপীঠ বা প্রতিষ্ঠান আর কোথায় কয়টি আছে তা জানা নেই।
 .
(৩)

শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত:
এককালে শ্রীহট্ট কয়েকটি খণ্ড রাজ্য ছিলো। পার্শ্ববর্তী ত্রৈপুর রাজবংশের অধ্যুষিত অঞ্চল ছিলো ত্রিপুরা রাজ্য। এই ত্রৈপুর রাজবংশের অধিকার এক সময় বরবক্র অর্থাৎ বরাক নদীর সমস্ত বাম তীর পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত ছিলো। বরাকের অপর তীর থেকে শ্রীহট্ট গৌড়, লাউড় ও জয়ন্তীয়া নামে তিনটি প্রধান খণ্ডে বিভক্ত ছিলো এবং এই তিন ভাগ তিন পৃথক নৃপতি কর্তৃক শাসিত হতো বলে ‘Hunter’s Statistical Accounts of Assam vol.2 (Sylhet)- এ উল্লেখ রয়েছে। এই রাজ্য তিনটির অবস্থান ছিলো-
 .
গৌড় : বর্তমান সিলেট শহর সহ উত্তর সিলেট এবং পূর্ব ও দক্ষিণে অনেক দূর ব্যাপ্ত ছিলো গৌড় রাজ্যের সীমা। গৌড়ের রাজা প্রায়শই শ্রেষ্ঠ বলে গণ্য হতেন।
.
লাউড় : গৌড়ের পশ্চিমে অর্থাৎ সিলেট জেলার পশ্চিমাংশ ব্যাপ্ত লাউড় রাজ্য ছিলো। একসময় লাউড় রাজ্য ময়মনসিংহ জেলার কিয়ৎ-অংশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো। বর্তমানে হবিগঞ্জের কিছু অংশ এবং সুনামগঞ্জের প্রায় পুরোটাই এর অন্তর্ভুক্ত ছিলো।
.
জয়ন্তীয়া : সিলেটের উত্তর ও পূর্বাংশে বিস্তৃত ছিলো জয়ন্তীয়া রাজ্য। দক্ষিণে সুরমা নদী এ রাজ্যের সীমা রক্ষা করতো। আর দক্ষিণ-পূর্বাংশে ত্রিপুরা রাজ্য পর্যন্ত এর সীমা বিস্তৃত ছিলো। এই সমতল ভূমি ছাড়াও বৃটিশ আমলের প্রায় সমগ্র পার্বত্য জয়ন্তীয়া জিলা এ রাজ্যের অন্তর্গত ছিলো।
 .
এই তিনটি রাজ্য ছাড়া তরফ নামে আরেকটি অঞ্চল ছিলো যা প্রাচীনকাল থেকেই পৃথকভাবে শাসিত হতো। অধিকাংশ সময় এটি ত্রিপুরার আধিপত্য স্বীকার করলেও, গৌড় রাজ্যের অংশ বিশেষ বলে সাধারণত বিবেচিত হতো। এবং চতুর্দশ শতকে মুসলিম বিজয়ের পর তা গৌড়ের অংশরূপে গণ্য নয়। তরফের ন্যায় ইটা ও প্রতাপগড় রাজ্যও মুসলিম বিজয়ের পর থেকে গৌড়ের অংশ বলে পরিগণিত হয়েছিলো।
 .
রাজা গৌড়গোবিন্দ:
শ্রীহট্টের গৌড় রাজ্য মুসলিম বিজয়ের আগ পর্যন্ত প্রসিদ্ধনামা গোবিন্দের শাসনাধীনে ছিলো। কারো কারো মতে মধ্য ভারতের ভোজ বা বিক্রমাদিত্য নাম-পদবীতে একাধিক রাজার মতোই গোবিন্দ কোন নির্দিষ্ট রাজার নাম ছিলো না। শ্রীহট্টের গৌড় রাজ্যের রাজগণ ‘গোবিন্দ’ এই বিশেষ উপাধিতে পরিচিত হতেন। গৌড় রাজ্যের অধিপতি হিসেবে গোবিন্দ সাধারণত ‘গৌড়-গোবিন্দ’ নামে কথিত হতেন। গোবিন্দের পিতার নাম কী ছিলো তা জানা যায় না। কিংবদন্তী মতে তিনি সমুদ্রের তনয়-

‘সমুদ্র তনয় গৌড় গোবিন্দ নামেতে।
শ্রীহট্ট দেশের রাজা ছিলেন পর্ব্বতে।।’- (ভবানী প্রসাদ দত্তের লিপি)।
 .
কথিত আছে, পূর্বকালে ত্রৈপুর রাজবংশীয় কোন রাজার শত শত মহিষী ছিলেন। সমুদ্রদেব (বরুনদেব) তার মধ্যে কোন এক মহিষীর সাথে মানুষের রূপ ধরে মিলিত হন এবং তাঁর কৃপাতেই রাণী গর্ভধারণ করেন। এই গর্ভের কথা প্রকাশিত হলে রাজা সেই রাণীকে নির্বাসিত করেন। সে অবস্থায় রাণী এক সুলক্ষণান্বিত পুত্র প্রসব করেন। সমুদ্র তখন আবির্ভূত হয়ে রাণীকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, তাঁর অভিপ্রায়ে সমুদ্রের জল সরে যতদূর চড়া পড়বে, নবজাত শিশু ততদূর পর্যন্ত রাজ্যাধিকার করতে পারবে। এই নির্বাসিতা মহিষীপূত্রই গোবিন্দ।
এই কিংবদন্তী থেকে ঐতিহাসিক সূত্র হিসেবে ধারণা করা হয়, একসময় শ্রীহট্টের অনেকাংশ সমুদ্রের (হ্রদের) কুক্ষিগত ছিলো, সমুদ্র সরে গিয়ে বা ভরাট হওয়ায় অনেক স্থান প্রাচীন গৌড় রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলো। গোবিন্দ কোন নির্বাসিতা ত্রৈপুর-রাজমহিষীর সন্তান। নয়তো গোবিন্দ শ্রীহট্টের কোন হাওরের অপরপার হতে গৌড়ে এসে ভাগ্যবশে রাজ্যাধিকারী হয়েছিলেন। এর বাইরে গোবিন্দের পরিচয় সম্পর্কে আর কিছু জানা যায় না।
 .
খ্রীষ্টিয় চতুর্দশ শতকে যিনি রাজত্ব করতেন, শ্রীহট্টের সেই শেষ হিন্দু নৃপতি গৌড়গোবিন্দ বীরপুরুষ বলে খ্যাত ছিলেন। তাঁর নানাবিধ অসাধারণ ক্ষমতা ছিলো এবং তিনি দূর হতে শব্দ শুনেই অন্তরাল থেকে ল্যভেদ করতে পারতেন বলে কিংবদন্তী প্রচলিত আছে। এজন্য বিভিন্ন প্রাচীন গ্রন্থ ও পুঁথিতে তাঁকে যাদুবিদ্যা বিশারদ বলে বর্ণনা করা হয়েছে। কিন্তু তিনি কুসংস্কার বর্জিত ছিলেন না বলে রাজ্যের পক্ষে তা অশুভজনক হয়েছিলো। ‘দত্তবংশাবলী’ নামক পুঁথিতে রাজা গৌড়গোবিন্দ সম্পর্কে বিভিন্ন ঐতিহাসিক সূত্র সংবলিত কিংবদন্তী বর্ণিত রয়েছে-

‘জানিহ শ্রীহট্ট নামে আছে পূর্ব্ব দেশ।
ব্রহ্মপত্রের পূর্ব্ব স্থান আছে সবিশেষ।
গৌড় গোবিন্দ নাম তাহার নৃপতি।
শব্দভেদী বাণ যাঁর আছিল অধীতি।…ইত্যাদি’- (দত্তবংশাবলী)।
 .
ছোট-বড় পাহাড়-টিলায় আকীর্ণ সিলেট শহরের বিভিন্ন স্থানে প্রাচীন স্থাপনার চিহ্ন পাওয়া যায়, যা গৌড়গোবিন্দ রাজার বাড়ি, দেবালয় বা দূর্গ ছিলো বলে কথিত হয়ে থাকে। উচ্চ স্তম্ভকে মিনার বলা হয়। সিলেট শহরে মিনারের টিলা বলে পরিচিত, যাকে সাধারণ লোকজন মনারায়ের টিলা বলে থাকেন, এই টিলাতেও রাজার একটি বাড়ি ছিলো বলে কথিত। ১৮৯৭ সালে প্রলয়ঙ্করী ভূমিকম্পের পর এই টিলায় শ্রীহট্টের জজ সাহেবের জন্য বাংলো নির্মিত হয়। এর পার্শ্ববর্তী বর্তমান কাজিটোলা ও দরগা মহল্লায়ও গৌড়গোবিন্দ রাজার বাড়ি ও দেবালয় ছিলো বলে কথিত আছে। সিলেট শহরের উত্তরাংশে ‘গড়দুয়ার’ মহল্লা নামে একটি স্থান ছিলো যেখানে প্রাচীন স্থাপনা তথা রাজবাটিকার ভগ্নাবশেষ পাওয়া যায়। এই গড়দুয়ার মহল্লায় গৌড়গোবিন্দ রাজার ‘গড়’ অর্থাৎ দুর্গ ছিলো বলে কিংবদন্তী রয়েছে। হযরত শাহজালাল (রাঃ)-এর জীবনবৃত্ত হিসেবে প্রাচীন পারস্য গ্রন্থ ‘সুহেল-ই-এমন’-এর বঙ্গানুসৃতি গ্রন্থ ‘তোয়ারিখে জলালি’-তে বর্ণিত আছে-

‘গড় দুয়ারে গোবিন্দের ছিলো যে থাকান।
কেল্লা এক ছিল তাতে পর্ব্বত প্রমাণ।।’- (তোয়ারিখে জলালি)।
 .
তৎকালীন জয়ন্তীয়াবাসী অসভ্য পাহাড়ি জাতিদের আক্রমণ রোধার্থে সিলেট শহরের উত্তরে টীলাগড়ে আরেকটি গড় বা দুর্গ ছিলো, যা এখন ভগ্নাবশেষে পরিণত হয়েছে। টিলার উপরে দুর্গ থাকায় এই স্থান টীলাগড় নামে খ্যাত। এই টীলাগড়ে অবস্থিত বর্তমান এম.সি. অর্থাৎ মুরারী চাঁদ কলেজের পেছনভাগে উঁচু একটি টিলায় জঙ্গলাকীর্ণ অবস্থায় সম্ভাব্য এরকম একটি দুর্গের ভগ্নাবশেষ এখনো কালের সাক্ষি হয়ে আছে।
 .
.
গৌড়গোবিন্দের নৃতাত্ত্বিক উত্তর প্রজন্মের নিদর্শন হিসেবে সিলেটে তাঁর নামানুক্রমে ‘গৌড়গোবিন্দ’ বলে ক্ষুদ্র এক ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়ের কথা জানা যায়। আসামের বিভিন্ন জাতির সম্বন্ধে (এনথলজীর সুপারিটেনডেন্ট সাহেবের জন্য) শ্রীযুক্ত ত্রিপুরা চরণ মুখোপাধ্যায় একটি নোট প্রস্তুত করেন, যাতে বর্ণব্রাহ্মণ বিষয়ক প্রস্তাবে তিনি বলেন, (সূত্র: শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত পূর্বাংশ, পৃষ্ঠা-২০৮)-

‘গড়ের গোবিন্দী’ ব্রাহ্মণ রাজা গৌড়গোবিন্দের দ্বারা সৃষ্ট। ইহাঁরা সম্ভবতঃ বল্লাল-পীড়িত ব্রাহ্মণ। রাজকর্তৃক উপকৃত হওয়ায়, অনুগ্রহের নিদর্শন স্বরূপ ‘গড়ের গোবিন্দী’ বলিয়া পরিচয় দিতেন। পশ্চাদাগত রাঢ়ী প্রভৃতি হইতে বর্ত্তমানে ইহাঁদের পৃথকত্ব বাহির করা দুর্ঘট।’
আবার প্রদীপ পত্রিকার এক প্রবন্ধে (১৩১১ বাংলা কার্ত্তিক) লিখিত আছে-
‘শ্রীহট্ট সহর হইতে ৬/৭ মাইল ব্যবহিত স্থান হইতে পাতর সংজ্ঞক যে সকল ব্যক্তি সহরে পাতা, কাঠ, কয়লা প্রভৃতি বিক্রয় করে, তাহাদিগকে ‘গুরু গোবিন্দ’ বলিয়া পরিচয় দিতে শুনা যায়।’ ইহারাও গৌড়গোবিন্দ সংসৃষ্ট কোন ঘটনা হইতে এ নাম ধারণ করা বিচিত্র নহে।
 .
শিক্ষা-দীক্ষা সভ্যতা থেকে পিছিয়ে পড়া নিজেদের ‘গড়ের গোবিন্দী’ বলে পরিচয়দানকারী এই সম্পদায়ের লোকেরা নিজেদের নামের শেষে এখন ‘পাত্র’ পদবি ব্যবহার করে থাকেন। ‘পাতর’ থেকেই পাত্র পদবির উদ্ভব। শোভা প্রকাশ ঢাকা থেকে প্রকাশিত সমর পালের ‘পদবির উৎসসন্ধান’ গ্রন্থে এদের সম্পর্কে বলা হয়েছে- ‘সিলেট অঞ্চলে পাত্ররা অনগ্রসর আদিবাসী হিসেবে পরিচিত। সেখানে এদের মূল কাজ হলো কৃষিকাজ ও কয়লা বিক্রি করা।’
সিলেট সদর খাসের খাদিমনগর মৌজার দলইপাড়া নামক এলাকায় এখনো ৬০/৭০ ঘর পাত্র সম্প্রদায়ের বাস রয়েছে। সিলেটের কবি ও লেখক-ব্লগার নজমুল আলবাব অপুর কাছ থেকে লোকেশন জেনে দলইপাড়ায় গিয়ে সিলেট রামকৃষ্ণ আশ্রমের মহারাজের বরাতে পাত্র সম্প্রদায়ের নির্ভরযোগ্য বয়োজ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি একাত্তর বছর বয়ষ্ক লক্ষণ পাত্রের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিলো। কিছু সময়ের আলাপের মধ্য দিয়ে তাঁদের সংস্কৃতি ও জীবনধারা সম্পর্কে কিঞ্চিৎ জানারও সুযোগ হয়েছে।
 .
.
পাত্ররা নিজেদেরকে গৌড়গোবিন্দের বংশধর বলে দাবী করেন। সে অনুযায়ী তাঁরাই সিলেটের আদিবাসী। তাঁদের নিজস্ব একটি ভাষা রয়েছে যাকে তাঁরা ‘লালেং ভাষা’ বলেন এবং নিজেদেরকে লালেং জাতি হিসেবে উল্লেখ করেন। তাঁদের নিজেদের মধ্যে পারস্পরিক কথাবার্তায় এই ভাষা ব্যবহার করতে দেখা যায়। যদিও এই ভাষার কোন লিপি নেই বলে লক্ষণ পাত্র জানান। তাঁদের মধ্যে কয়েকটি গোত্র হচ্ছে লঙথি গোত্র, ক্যালাং গোত্র, তুক্রি গোত্র, ঠেকলা গোত্র ইত্যাদি। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক তাঁদেরকে উপজাতি হিসেবে আখ্যায়িত করায় ক্ষুব্ধ পাত্র সম্প্রদায় ১৯৭৯/৮০ সালের দিকে সিলেট রামকৃষ্ণ মিশনে একটি সম্মেলনের মাধ্যমে এর প্রতিবাদ করেন বলে জানা যায়। পরবর্তীতে তাদের ন্যায্য দাবি ও বক্তব্য তুলে ধরার প্রয়োজনে অক্সফাম বাংলাদেশের পৃষ্ঠপোষকতায় পাত্র সম্প্রদায় কল্যাণ পরিষদ ‘পাসকপ’ (PASKOP) নামে একটি সংগঠনের মাধ্যমে তাঁরা বিভিন্নভাবে সংগঠিত হবার চেষ্টা করছেন। তাঁদের সাংগঠনিক তৎপরতায় এফআইভিডিপি-এর সহায়তায় দলইপাড়ায় ‘প্রফুল্ল পাত্র প্রাথমিক বিদ্যালয়’ নামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, যার মাধ্যমে তাঁরা নিজেদের প্রজন্মের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে অনগ্রসরতা কাটিয়ে উঠার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। দলইপাড়া নামটিও লক্ষণ পাত্রের চার পুরুষ আগের পূর্বপুরুষ দলুই পাত্রের নাম থেকে হয়েছে বলে জানান তিনি। সিলেট সদর খাসের বেশ কিছু এলাকা ছাড়াও সিলেটের গোয়াইনঘাট ও জয়ন্তীয়ায়ও পাত্র সম্প্রদায়ের বাস রয়েছে। তবে জয়ন্তীয়ার আলুবাগানের অধিবাসী পাত্ররা ক্রমান্বয়ে খাসিয়াদের সংস্কৃতিতে মিশে গেছে এখন। পাত্রদের নিজস্ব সংস্কৃতি ক্ষয় হয়ে হয়ে এখন অনেকটা হিন্দু রীতিতে তাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদি পালিত হয়ে থাকে, যদিও তাঁদের নির্দিষ্ট কোন দেবালয় বা মন্দির নেই। তাঁদের নিজস্ব কিংবদন্তী অনুযায়ী সুন্দর ঠাকুর হচ্ছেন তাঁদের গোত্র দেবতা। সেই সুন্দর ঠাকুরের থানই তাঁদের হাতছাড়া হয়ে ক্রমে ক্রমে এখন সিলেটের শাহ্ সুন্দর মাজার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত বলে লক্ষণ পাত্র জানান।
 .
.
নিজস্ব সংস্কৃতির কিছু কিছু দিক এখনো টিকে থাকলেও অদূর ভবিষ্যতে সেটাও হারিয়ে যাবার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। তাঁদের আদিবাসী সম্প্রদায়ের ইতিহাস জানতে চাইলে স্বল্পশিতি লক্ষণ পাত্র যে কিংবদন্তী বর্ণনা করেন তা আসলে রাজা গৌড়গৌবিন্দের প্রচলিত কিংবদন্তীরই অপভ্রংশ। তাই এ বিষয়ে প্রচলিত শ্রীহট্টের ইতিহাস গ্রন্থকেই প্রামাণ্য হিসেবে গ্রহণ করতে পারি আমরা।
 .
(৪)

ইতিহাসের আবছা আলোয় শ্রীহট্ট:
মোহাম্মদ তোঘলক যখন দিল্লীর সিংহাসনে অধিষ্ঠিত, শামসউদ্দীন ইলিয়াস খাঁ তখন বাঙ্গালার স্বাধীন সুলতান। রাজ্য লাভের চার বৎসর পর (১৩৪৭ খ্রীষ্টাব্দে) তিনি ত্রিপুরা রাজ্যের জাজিনগর (কসবা) আক্রমণ করেন। প্রতাপমাণিক্য তখন ত্রৈপুর রাজসিংহানের রাজা। এ সময়ই সমস্ত বঙ্গদেশ মুসলিম শাসনের অধিগত হয় এবং তাঁরা সুবর্ণগ্রামে (সোনারগাঁ) রাজধানী স্থাপন করেন। এ স্থান হতে পূর্বাঞ্চল আক্রমণ করা সহজ হয়েছিলো। ফলে জাজিনগর (কসবা) আক্রমণ করে যুদ্ধে প্রতাপমাণিক্যকে পরাস্ত করে সুলতাম শামসউদ্দীন অনেক অর্থ ও হস্তী প্রাপ্ত হন। এই আক্রমণের পরই ত্রিপুরার রাজধানী জাজিনগর (কসবা) পরিত্যক্ত হয় এবং রাজধানী উদয়পুরে নীত হয় বলে কথিত আছে। শামসউদ্দীনের এই আক্রমণ ও প্রভাব এতদঞ্চলীয় তাবৎ নৃপতিদের আশঙ্কার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। রাজা গৌড়গোবিন্দ এই শামসউদ্দীনের সমসাময়িক ছিলেন।
 .
কথিত হয় যে, হযরত শাহজালাল (রাঃ) যখন শ্রীহট্টে আগমন করেন, তখন এদেশে মুসলমানের বাস ছিলো না বললেই চলে। তরফে তখন নুরউদ্দীন নামক একজন মুসলিম ব্যক্তি সপরিবারে বাস করতেন। এই নুরউদ্দীন পরিবার ব্যতীত বুরহানউদ্দীন নামক জনৈক সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি শ্রীহট্টের টুলটিকরে সপরিবারে ছিলেন বলে জানা যায়। সাধারণভাবেই হিন্দুরাজ্যে তাদের বাস খুব সাচ্ছন্দ্যের ছিলো না বলে ধারণা করা হয়। একবার বুরহানউদ্দীন নিজ পুত্রের জন্মোপলক্ষে একটি গরু জবাই করেন। দুর্ভাগ্যবশত একটা চিল এক খণ্ড মাংস নিয়ে যায় এবং মাংসখণ্ডটি জনৈক ব্রাহ্মণ গৃহে (মতান্তরে রাজগৃহে) পতিত হয়। এ বিষয় রাজার গোচরীভূত হলে রাজা ক্রুদ্ধ হয়ে বুরহানউদ্দীনের হস্ত ছেদন করেন এবং তাঁর শিশুপুত্রকে হত্যা করেন। বঙ্গে মুসলমান প্রভাবের কালে এই ঘটনা সমস্ত মুসলমান সম্প্রদায়ের জন্য অপমানসূচক হয়েছিলো। তোয়ারিখে জলালিতে লিখিত হয়েছে যে, বুরহানউদ্দীন স্বীয় অত্যাচারীর প্রতিহিংসা সাধনের উপায় চিন্তা করতে করতে মুসলিম সম্প্রদায়ের রাজধানী দিল্লী নগরীতে উপস্থিত হন। তিনি সম্রাট সদনে নিজ দুঃখ কাহিনী জ্ঞাপন করলে সম্রাট ‘আলাউদ্দীন’ নিজ ভাগিনেয় সিকান্দর শাহকে শ্রীহট্ট জয়ার্থে প্রেরণ করেন।
 .
তবে প্রথমবারেই বুরহানউদ্দীনের দিল্লীর সম্রাটের সাক্ষাতে গমন নিয়ে দ্বিমত রয়েছে। অধিকাংশেরই অভিমত, প্রতিহিংসাপরায়ণ বুরহানউদ্দীন প্রথম উদ্যমেই বোধয় দিল্লী নগরে দৌড় না দিয়ে পার্শ্ববর্তী সুবর্ণগ্রামেই গিয়েছিলেন। সুবর্ণগ্রামে তখন প্রবল প্রতাপান্বিত শামসউদ্দীন ইলিয়াস খাঁ শাসন দণ্ড পরিচালন করছিলেন। তিনিই বুরহানউদ্দীনের নির্যাতন বার্তা শুনে পার্শ্ববর্তী হিন্দুরাজ্যের এরূপ প্রভাব দমন করা আবশ্যক বোধে নিজ তনয় সুলতান সিকান্দর শাহকে গৌড়গোবিন্দের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন। এককালে নিম্নমাধ্যমিক স্কুলপাঠ্যের প্রথমভাগেও এরকমই লিখিত ছিলো বলে জানা যায়। এবং এটাই অধিকতর যুক্তিযুক্ত বিবেচিত হয়। যাহোক, সিকান্দর শাহ সসৈন্যে শ্রীহট্টে আগমন করে কিছু করতে পারলেন না, রাজা গোবিন্দের কৌশলে যুদ্ধে পরাজিত ও অপমানিত হয়ে শ্রীহট্ট পরিত্যাগ করতে বাধ্য হন।
পিতার মৃত্যুর পর ১৩৫৮ খ্রীষ্টাব্দে সুলতান সিকান্দর শাহ সিংহাসনে আরোহণ করেন, কিন্তু দিল্লীর সম্রাটের সাথে দ্বন্দ্বে লিপ্ত থাকায় তিনি শ্রীহট্টের দিকে আর মনোযোগ দিতে পারেন নি। সুচতুর গৌড়গোবিন্দ সম্ভবত ঐ সময় তাঁর সাথে কোন প্রকারের সন্ধি স্থাপন করে থাকবেন বলেও কারো কারো অভিমত।
 .
শ্রীহট্টের তরফ রাজ্যেও পুর্বোল্লিখিত ঘটনার অনুরূপ আরেকটি ঘটনার উল্লেখ পাওয়া যায় সৈয়দ আব্দুল আগফর কৃত তরফের ইতিহাস গ্রন্থে। সেখানে বলা হয়-

‘যে সময়ে রাজা গোবিন্দ শ্রীহট্টের গৌড়ভাগ শাসন করিতেছিলেন, তখন তরফে একজন হিন্দু নৃপতি ছিলেন, ইহাঁর রাজ্যাধিকার মধ্যে কাজি নুরউদ্দীন নামে এক জনৈক মোসলমান ভদ্রলোক বাস করিতেন, তিনি নিজপুত্রের বিবাহ উপলক্ষে একটি গোবধ করায়, রাজাকর্ত্তৃক স্বয়ং প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হন। এই নুরউদ্দীনের ভ্রাতা কিছুদিন দিল্লীতে ছিলেন, উক্ত ঘটনার পর তিনি পুনরায় তথা গমন করিয়া নিজ দুঃখ কাহিনী সম্রাটের গোচর করিবার চেষ্টায় ছিলেন।’
 .
ঘটনাচক্রে বঙ্গাধিপতি সুলতান সিকান্দর শাহ গৌড়গোবিন্দকে দমন করতে না পারায় ইতঃপূর্বে বর্ণিত বুরহানউদ্দীন পুত্রহত্যাকারীর প্রতিশোধ নিতে সমর্থ হননি বলে তাঁর প্রতিহিংসানল তখনও নির্বাপিত হয়নি। কাজেই উপায়ান্তর না পেয়ে শেষ চেষ্টা হিসেবে তিনি মুসলমানদের একমাত্র আশ্রয় দিল্লী নগরে উপস্থিত হন। সেখানে কিছুদিন থেকে সম্ভবত কোন আমীর-ওমরাহের সাথে তিনি পরিচিত হন এবং তাঁদের মাধ্যমে নিজ দুঃখের কাহিনী সম্রাটের গোচর করেন। বুরহানউদ্দীন ও নুরউদ্দীন ঘটিত বিররণ একইরূপ, অভিযোগ একইরূপ এবং প্রার্থনাও একইরূপ হওয়ায় সম্রাট হয়তো তাঁদের প্রার্থনায় কর্ণপাত করেছিলেন। তিনি এই অভিযোগ শুনে পূর্বাঞ্চলে মুসলিম প্রভাব প্রতিষ্ঠার জন্য আপন ভাগিনেয় সিকান্দর শাহ গাজীর অধীনে একদল সৈন্য দিয়ে তাঁকে শ্রীহট্টে প্রেরণ করেন। তোয়ারিখে জলালিতে এর বর্ণনা পাওয়া যায়-

‘আপন ভাগিনা ছিলা সিকান্দর শাহা।
ডাকিয়া বলিলা তারে শুনিলেন যাহা।।
লড়াই করিতে তারে করিল ফরমান।
তৈয়ার করিতে কহে লস্কর ও সামান।।
হাতি ঘোড়া উট আদি সমান লস্কর।
সঙ্গে লইয়া যাইতে হবে ছিলট নগর।।
গৌড় গোবিন্দ নামে এক কাফের সরদার।
মারিয়া মুল্লুক হৈতে করিবে বাহার।।’- (তোয়ারিখে জলালি)।
 .
প্রথমে বুরহানউদ্দীনের অপমানকারী গৌড়গোবিন্দকে পরাভূত করা সাব্যস্থ হলো। সে অনুসারে সিকান্দর গাজী সসৈন্যে শ্রীহট্টে উপস্থিত হলেন। তখন বর্ষা সমাগত হওয়ায় হিন্দুস্থানের সৈন্যরা রোগাক্রান্ত হয়ে পড়েছিলো। কিন্তু কুসংস্কারমনা সৈন্যরা এটাকে সেই রাজার যাদুবিদ্যার প্রভাবজনিত উপদ্রব জ্ঞান করে একান্তই ভীত ও নিরুৎসাহিত হয়ে পড়ে। এরকম ভীত ও যুদ্ধপরান্মুখ সৈন্যের দ্বারা কার্যসিদ্ধির সম্ভাবনা নেই ভেবে সিকান্দর গাজী নতুন আরেক দল সৈন্য আনালেন। কিন্তু কুসংস্কার প্রভাব আগের দল থেকে নতুন দলেও সংক্রামিত হলো। এরাও সহযোগী সৈন্যদের মুখে যাদুবিদ্যার প্রভাবের কথা শুনে দ্বিগুণ ভীত ও একেবারে হতোদ্যম হয়ে পড়লো। ফলে সম্রাটের ভাগিনেয় সিকান্দরের ভাগ্যে শ্রীহট্ট বিজয়ের যশোলাভ ঘটলো না। তিনি ব্রহ্মপুত্র তীরে শিবির স্থাপন করে সেখানেই অবস্থান করতে লাগলেন।

‘কিছুকাল পরে শাহা খাতেরজমা হইল।
উত্তম লস্কর আনি লড়িতে চাহিল।।
কোমর বান্দিয়া যবে হইল তৈয়ার।
হইল সাবেকি দশা সিকান্দর শাহার।।’- (তোয়ারিখে জলালি)।
 .
এই ঘটনায় বুরহানউদ্দীন মুষড়ে পড়লেন এবং ভগ্নমনে দেশ ত্যাগ করে মদিনায় চলে যেতে মনস্থ করলেন। মদিনার উদ্দেশ্যে যখন দিল্লীতে উপস্থিত হলেন, ঘটনাক্রমে তখন প্রসিদ্ধ দরবেশ হযরত শাহজালাল (রাঃ)-এর সাথে তাঁর দেখা হয়ে গেলো। তিনি পূর্বাঞ্চলে ইসলাম ধর্মের দুরবস্থা, নিজের দুর্দশা ও মদিনা যাওয়ার সঙ্কল্পের কথা তাঁকে জানালেন। এই বিবরণ শুনে হযরত শাহজালাল (রাঃ) এর প্রতিকার করবেন বলে তাঁকে আশান্বিত করলেন। আশ্বাস পেয়ে বুরহানউদ্দীন নতুন উদ্যমে পথ প্রদর্শক হয়ে হযরত শাহজালাল (রাঃ)-কে শ্রীহট্ট অভিমুখে নিয়ে চললেন।
 .
(৫)

হযরত শাহজালাল আউলিয়া:
শাহজালালের জীবনী থেকে যেটুকু জানা যায় (সূত্র: শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত), খ্রীষ্টিয় চতুর্দশ শতকের শুরুর দিকে আরবের এমন-এ বিখ্যাত কুরাইশ বংশে হয়রত শাহজালাল (রাঃ)-এর জন্ম। শাহজালালে পিতা হলেন ইব্রাহিমের পুত্র মাহমুদ। মাত্র তিনমাস বয়সে তিনি মাতৃহারা হন। এবং পিতা মাহমুদও কাফেরদের সাথে ধর্মযুদ্ধ করতে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দেন। মাতুল সৈয়দ আহমদ কবীর এই অনাথ শিশুর প্রতিপালনের ভার গ্রহণ করে বয়ঃপ্রাপ্তির পর তাঁকে ধর্মীয় শিক্ষদীক্ষায় বড় করে তোলেন। একই বংশের বংশ পরম্পরায় হযরত শাহজালাল (রাঃ) ছিলেন হয়রত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর আটাশতম প্রজন্ম।
 .
.
পবিত্র মক্কাতেই সাধক পীর সৈয়দ আহমদ কবীরের অবস্থান ছিলো। শিষ্য ভাগিনেয় শাহজালালও তাঁর সাথে অবস্থান করে বয়ঃপ্রাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে সাধনমার্গে অগ্রসর হতে লাগলেন। কথিত আছে, একবার একটি হরিণ দুর্দান্ত এক বাঘের আক্রমণে ভীত হয়ে সৈয়দ কবীরের দরজায় ছুটে এলে শাহজালাল আতঙ্কিত এই হরিণকে আশ্রয় দিলেন এবং প্রবল চপেটাঘাতে বাঘটিকে বিতাড়িত করে হরিণটির প্রাণরক্ষা করেন। (ছয়শ বছর পূর্বে  মরুভূমির দেশ আরবের তৎকালীন ভৌগলিক পরিবেশে কিংবদন্তীর এই বাঘ ও হরিণের অস্তিত্ব আদৌ সম্ভব ছিলো কিনা জানা নেই।) তা দেখে প্রিয় শিষ্যের আধ্যাত্মিক সিদ্ধিলাভের পরিমাণ বুঝতে পেরে খুশি হয়ে সৈয়দ কবীর শিষ্য শাহজালালকে আর এ স্থানে না থেকে হিন্দুস্থানের দিকে ধর্মপ্রচারে যাবার পরামর্শ দিলেন এবং পবিত্র মক্কা শরীফের এক মুঠো মাটি এনে তাঁর হাতে দিয়ে বললেন- ‘তোমার হাতে যে মাটি দিলাম, তা অতি যত্নে রাখবে যেন এর বর্ণ গন্ধ বা স্বাদ বিকৃত না হয়। এরূপ মাটি যে স্থানে পাবে সেখানেই সতত অবস্থান করবে। এই মাটি যে স্থানে পরিত্যাগ করবে সেই স্থানের মাহাত্ম্য অতুলনীয় হবে।
 .
.
হযরত শাহজালাল (রাঃ) পাথেয় হিসেবে এই পবিত্র মাটি সাথে নিয়ে ভারতবর্ষের অভিমুখে যাত্রা করলেন। তাঁর সঙ্গে প্রথমত বারোজন মুরিদ জুটলেন, যাঁদের একজন হলেন সেই পবিত্র মাটির তহবিলদার। তাঁর উপর এই ভার থাকলো যে, তিনি পথিমধ্যে যত জনপদ দেখতে পাবেন সেসব জায়গার মাটি পরীক্ষা করে (চেখে) দেখবেন। এই ব্যক্তির নাম হলো চাষনি পীর। যদি কখনো বর্ণ গন্ধ ও স্বাদে এই মাটির সমকক্ষ মাটি মিলে, তবে তাঁকে তৎক্ষণাৎ তা হযরত শাহজালালের নিকট জানাতে হবে।
 .
.
পথ চলতে চলতে শাহজালালের আধ্যাত্মিক ক্ষমতা ও প্রভাব দেখে আকৃষ্ট হয়ে বহুলোক তাঁর মুরিদ হতে লাগলেন এবং অনুসঙ্গিও বাড়তে লাগলো। বোগদাদ নগর হতে নিজামউদ্দীন, আরবের জাকারিয়া ও দাউদ, এরপর গজনী হতে মোখদুম জাফর ও সৈয়দ মোহাম্মদ প্রভৃতি এবং মুলতান শহর হতে আরেফ ও আজমীর হতে শরিফ প্রভৃতি বহু মুরিদ বানিয়ে দলবলসহ হযরত শাহজালাল দিল্লী নগরীতে এসে উপস্থিত হলেন। সেখানে দেখা হলো আরেক প্রসিদ্ধ কামেল পীর নিজাম উদ্দীন আউলিয়ার সাথে। হযরত শাহজালালের আধ্যাত্মিক শক্তিতে তুষ্ট হয়ে নিজাম উদ্দীন আউলিয়া তাঁকে নিজের কাছে থাকা দুই জোড়া কাজলা রঙের কবুতর উপহার দিলেন। এগুলোই বংশবিস্তার করে পরবর্তীকালে সিলেট শাহজালালের মাজার মাতিয়ে রাখা জালালী কবুতর নামে পরিচিত হয়েছে। ঘটনাক্রমে এই দিল্লী নগরীতেই হযরত শাহজালালের সাথে বুরহানউদ্দীনের সাক্ষাৎ হয় এবং তাকে আশ্বাসের প্রেক্ষিতে তিনি শ্রীহট্ট অভিমুখে রওয়ানা হন।
 .
.
এদিকে সিকান্দর গাজী বার বার পরাজিত হয়ে অতিশয় লজ্জায় সম্রাটকে মুখ দেখাতে অনিচ্ছুক হয়ে দূতমুখে নিজ পরাজয়বার্তা সম্রাটকে জ্ঞাপন করে আরো সাহায্য প্রার্থনা করলেন। সম্রাট সৈন্যদের ভীত হওয়া ও গৌড়গোবিন্দের যাদুবিদ্যার গল্প শুনে এই পরাজয়ের মূল নির্ধারণ করতে সমর্থ হলেন এবং সেসব কুসংস্কারাচ্ছন্ন সৈন্যদের প্রবোধার্থে তিনিও একজন পীর বুজুর্গ ব্যক্তিকে সেনাপতিরূপে প্রেরণের সংকল্প করলেন।
 .
.
এ সময়ে বোগদাদবাসী সৈয়দবংশীয় নাসিরউদ্দীন নামক এক বুজুর্গ ব্যক্তি দিল্লীতে কাজের খোঁজ করছিলেন। তিনি মূলত তাঁর এক আত্মীয় সৈয়দ মওসুফের অসদ্ব্যবহারে উত্যক্ত হয়ে দেশত্যাগ করে দিল্লী এসেছিলেন। দরবেশ হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিলো এবং লোকে বলতো যে, প্রবল বাতাসেও তাঁর তাঁবুর দ্বীপ নির্বাপিত হতো না। উচ্চ বংশোম্ভব এই নাসিরউদ্দীন সম্বন্ধে এধরনের প্রচারণা সম্রাটে কানে গেলে সম্রাট তাঁকেই শ্রীহট্ট প্রেরণের উপযুক্ত ব্যক্তি জ্ঞান করলেন এবং তাঁকে সিপাহসালার করে এক হাজার অশ্বারোহী ও তিন হাজার পদাতিক সৈন্য সহ শ্রীহট্ট প্রেরণ করলেন।
 .
.
দিল্লী হতে যাত্রা করে তাঁরা যখন এলাহাবাদে পৌঁছলেন, গঙ্গ-যমুনার এই সম্মিলনস্থলে সেখানে হযরত শাহজালালের সাথে তাঁদের মিলন হলো। শাহজালাল তাঁর অনুসারীদের নিয়ে সেখানে আগে থেকেই অবস্থান করছিলেন। তাঁরা পরস্পরের একই উদ্দেশ্য অবগত হয়ে পরাজিত সিকান্দর গাজী যেখানে অবস্থান করছিলেন প্রথমে সেখানে একত্রে যাওয়া স্থির করলেন। এসময়ে হযরত শাহজালালের মহিমা সম্বন্ধে অবগত হয়ে সিপাহসালার নাসিরউদ্দীন তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। যেতে যেতে বিহার প্রদেশে উপস্থিত হলে সেখানকার হিসামউদ্দীন ও মোজাফ্ফর প্রভৃতি গণ্যমান্য ব্যক্তিরাও শাহজালালের শিষ্য হয়ে তাঁর অনুগামী হলেন।
 .
.
অনুচর ও সৈন্যসহ হযরত শাহজালাল অনতিবিলম্বে সিকান্দর শাহ গাজীর শিবিরে পৌঁছলেন। সিকান্দর শাহ হযরতকে সম্মানপূর্বক নিজ দুরবস্থার কথা জ্ঞাপন করলে শাহজালাল তাঁকে আশ্বাস দিয়ে বললেন- ‘তুমি আমার সঙ্গে চলো, আমি রাজ্য সম্পত্তির লালসা রাখি না, শ্রীহট্টে ইসলাম প্রচার করবো, এটাই উদ্দেশ্য। আমার রাজ্যে প্রয়োজন নেই, সেখানকার ভূপতি তুমিই থাকবে।’ অতঃপর সিকান্দরও হযরতের শিষ্য হলেন। এভাবে শ্রীহট্ট শহরে পৌঁছার পূর্বেই হযরত শাহজালালের মুরিদ বা শিষ্য সংখ্যা ৩৬০ জনে উন্নীত হলো।
 .
(৬)

গৌড়গোবিন্দের প্রতিরোধ ও হযরত শাহজালালের শ্রীহট্ট বিজয়:
রাজা গৌড়গোবিন্দ গুপ্তচরের মাধ্যমে সর্বদাই সিকান্দরের শিবিরের সংবাদ সংগ্রহ করতেন এবং হযরত শাহজালাল সমাগম সংবাদও তিনি যথাসময়ে পেয়েছিলেন। দলবল সহ হয়রত শাহজালাল ব্রহ্মপুত্রপারে পৌঁছলে তাঁরা যাতে ব্রহ্মপুত্র পার হতে না পারেন সেজন্যে গৌড়গোবিন্দ নদীতে নৌকা চলাচল বন্ধ করে দিলেন। কথিত আছে, হযরত শাহজালালের স্বীয় আধ্যাত্মিক ক্ষমতায় তখন সবাই নিজ নিজ পবিত্র জায়নামাজ পানিতে ভাসিয়ে তার মাধ্যমে নদী পার হলেন। গৌড়গোবিন্দ বুঝতেও পারলেন না যে কী উপায়ে তাঁরা নদী পার হলেন। এরপর হযরত শাহজালাল শ্রীহট্ট সীমান্তের চৌকি নামক স্থানে (দিনারপুর পরগণায়) যেখানে গৌড় রাজ্যের সীমা শুরু সেখানে উপস্থিত হলেন।

‘চৌকি নামে ছিল যেই পরগণা জাহার।
ছিলটের হর্দ্দ ছিল সাবেক মসুর।।
সেখানে আসিয়া তিনি পৌঁছিলা যখন।
খবর পাইলা তবে গোবিন্দ তখন।।’- (তোয়ারিখে জলালি)।
 .
সীমান্ত রক্ষী দ্বারা চৌকিতে শাহজালালের আগমন সংবাদ পেয়ে গৌড়গোবিন্দ অগ্নিবাণ প্রয়োগ প্রভৃতি কৌশল অবলম্বন করে তাঁদেরকে পরাজিত করার ইচ্ছা হলেও তাঁর সব কৌশল ও প্রচেষ্টা বৃথা হলো। উপায়ান্তর না দেখে গৌড়গোবিন্দ সেস্থানের পূর্ব-উত্তরে বরাক নদীতে খেয়া নৌকাসহ সব ধরনের নৌকা চলাচল নিষেধ করে দিলেন, যাতে কোন শত্রুসৈন্য নদী পার হতে না পারে। চৌকি থেকে সসৈন্যে হযরত সতরসতী উপস্থিত হন এবং তার অন্তর্গত বাহাদুরপুরের মধ্যস্থিত ফতেপুর নামক স্থানে সেই রাত্রি অতিবাহিত করেন। সেই থেকে সেখানে একটি মোকাম বা মাজার স্থাপিত হয়। বাহাদুরপুরের পাশ দিয়ে বেগবান বরবক্র বা বরাক নদী প্রবাহিত। পার হবার জন্য কোন নৌকা না পেয়ে তাঁরা একই উপায়ে হয়রত শাহজালালের ঐশি ক্ষমতাবলে পবিত্র জায়নামাজের মাধ্যমে বরাক নদীও পার হলেন।

‘এপারে হজরত তার লস্কর সহিতে।
আসিয়া পৌঁছিলা এক নদীর পারেতে।।
বরাক নামেতে নদী ছিল যে মসুর।
যাহার নিকটে আছে জান বাহাদুরপুর।।
যখনে পৌঁছিলা তিনি নদীর কেনার।
নৌকা বিনা সে নদীও হইলেন পার।।’- (তোয়ারিখে জলালি)।
 .
কিংবদন্তী আছে যে, গোবিন্দ তখন এক ফিকির উদ্ভাবন করলেন। লৌহ দ্বারা একটি ধনু নির্মাণ করিয়ে তা শাহজালালের কাছে পাঠিয়ে জানালেন যে, এটাতে গুণ আরোপ করা হলে গোবিন্দ শ্রীহট্ট ছেড়ে চলে যাবেন। ধনুটি পৌঁছলে হযরত শাহজালাল স্বয়ং গুণ যোজনা না করে সৈন্যদের মধ্যে প্রচার করে দিলেন যে, যার আসরের নামাজ কোনদিন কাজা হয়নি, তাকে তাঁর কাছে এনে হাজির করতে হবে। সমস্ত শিবির অনুসন্ধান করে কেবল একজনকেই এই নিয়মনিষ্ঠ পাওয়া গেলো, তিনি হলেন সিপাহসালার নাসিরউদ্দীন। শাহজালাল তাঁকেই ধনুতে গুণ যোজনা করতে আদেশ করলেন। তা দেখে সবাই অবাক হলো। গুণ-যোজিত ধনু গোবিন্দের কাছে নীত হলে তিনি জয়ের আশা সম্পূর্ণ পরিত্যাগ করে পলায়ন করাই সঙ্গত বোধ করলেন।
 .
পলায়নের পূর্বে গোবিন্দের মনে হযরত শাহজালালকে এক নজর দেখার একটা কৌতুহলের উদয় হলো। এ কৌতুহল চরিতার্থের লক্ষ্যে তিনি সাপুড়ের ঝাঁপির মধ্যে লুকিয়ে থেকে শাহজালালকে দেখতে গেলেন। কিন্তু শাহজালাল তাঁর এ চাতুর্য্য ধরে ফেললেন। তাতে তিনি লজ্জিত হয়ে অবনত মস্তকে শাহজালালের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে রাজ্য ছেড়ে যেতে স্বীকৃত হন। বিমর্ষমনে প্রত্যাগমন করে পলায়নই স্থির হলেও রাজ্যপাট নিয়ে পলায়নের জন্যে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন। কিন্তু সে সময়ও নেই। শেষ উপায় হিসেবে গোবিন্দ সুরমা নদীতেও নৌকা চলাচল বন্ধ করে দিলেন। কিন্তু আউলিয়া পুরুষ শাহজালালকে এতেও রোখা গেলো না। একই পদ্ধতিতে পবিত্র জায়নামাজের মাধ্যমে সুরমা নদীও অবলীলায় পার হলেন। যে স্থান দিয়ে শাহজাদা শেখ আলী প্রমুখ পীরেরা সুরমা নদী পার হয়েছিলেন, তা সিলেটের শেখঘাট নামে পরিচিত।
 .
.
 হযরত শাহজালালের নদী পার হওয়ার সংবাদ পেয়ে গৌড়গোবিন্দ অতিমাত্রায় ভীত হয়ে পড়লেন এবং যুদ্ধ করা কিছুতেই সঙ্গত মনে করলেন না। অতঃপর অনতিবিলম্বেই গড়দুয়ারস্থিত রাজবাটি পরিত্যাগ করে পেঁচাগড় পর্বতস্থ গুপ্ত গিরিদুর্গে পালিয়ে গেলেন।

‘সিংহাসন ছাড়ি গেলা পর্ব্বত ভিতর।
এপারে কি হৈল তার না জানি খবর।।
পেঁচাগড় নামে এক ছিল যে পর্ব্বত।
বহুলোকে বলে তথা করিল বসত।।
প্রহকের তফাওত সহর হইতে।
বসত করিল গিয়া সেই পাহাড়েতে।।’- (তোয়ারিখে জলালি)।
 .
বঙ্গাধিপতি শামসউদ্দীপনপুত্র সুলতান সিকান্দর শাহের আক্রমণের পরেই শহর থেকে ৬/৭ মাইল পূর্বে এই পেঁচাগড় গিরিদুর্গটি নির্মিত হয়েছিলো বলে জানা যায়। লোকলস্কর সহ গোবিন্দ পালিয়ে গেলে রাজবাড়ি এমনই শূন্য পড়েছিলো যে, এ সংবাদ হযরত শাহজালালকে পাঠানোর মতো একজন লোকও সেখানে ছিলো না। আল্লাহর প্রতি শুক্রিয়া আদায় করে তিনদিন পর হযরত শাহজালাল সর্বপ্রথম মিনারের টিলাস্থিত রাজবাড়ি আক্রমণের আদেশ দেন। তখনই তাঁর আদেশ রক্ষিত হলে অল্পসময়ের মধ্যেই গগনস্পর্শী রাজবাড়ি বিধ্বস্ত হয়। তবে সর্বসাধারণের মধ্যে এ কথা প্রচলিত আছে যে, মিনারে টিলা সাত তাল উঁচু ছিলো, হযরত শাহজালাল ও তাঁর শিষ্য নূরের আজানের ধ্বনির প্রতিঘাতে তা ভেঙে পড়ে যায়।
 .
এভাবে বিনা রক্তপাতে শ্রীহট্ট বিজিত হলে শাহজালাল স্বয়ং রাজ্যভার গ্রহণ না করে সম্রাট ভাগিনেয় সিকান্দর গাজীর উপর এমনের রাজপুত্রের নামে শ্রীহট্টের শাসনভার অর্পণ করেন, যিনি নিজেও হয়রত শাহজালালের শিষ্য হয়ে তাঁর সাথে শ্রীহট্টে এসেছিলেন। অতঃপর চাষনি পীর শ্রীহট্টের ভূমি পরীক্ষা করে যখন দেখলেন যে হযরতের গুরু পীর আহমদ কবীর প্রদত্ত মাটির সাথে এখানকার মাটির বর্ণ, স্বাদ ও গন্ধ মিলে গেলো, হযরতকে জানানো হলে এস্থানই তাঁর কর্মক্ষেত্র বুঝতে পেরে তিনি একটি মনোরম স্থানে নিজ মাজার প্রতিষ্ঠা করেন। তা-ই বর্তমানে ‘হযরত শাহজালাল (রাঃ) দরগাহ’ নামে খ্যাত।
 .
.
.
(৭)

অতঃপর হারং-হুরং :
ইতিহাসের ভাষ্য অনুযায়ী যে পেঁচাগড় গিরিদুর্গে গৌড়গোবিন্দ লোকলস্কর নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন, সেটা যে কী পরিমাণ দুর্গম ও মনুষ্য-অগম্য ছিলো, আমাদের বর্তমান অভ্যস্থ দৃষ্টিতে তা হয়তো কল্পনা করাও অসম্ভব হবে। কেননা আজ থেকে অন্তত ছয়শ বছর পূর্বের গভীর ঘনজঙ্গলে বেষ্টিত পাহার-পর্বত আর পরিখায় আকীর্ণ সেই দুর্গম অঞ্চলটির ভূপ্রাকৃতিক অবস্থানে বহু বহু পরিবর্তন সত্ত্বেও এখনো তা মানুষের বসতির অনুপযোগী বলেই মনে হয়। সিলেটে চা-বাগনের ইতিহাস কেবল উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে শুরু। কিন্তু পেঁচাগড়ের ইতিহাস হচ্ছে চতুর্দশ শতকের কোন এক সময়ের।
 .
বর্তমান প্রেক্ষাপটে সিলেটের বড় একটা অংশ জুড়ে যে চা-বাগান, তা হচ্ছে প্রকৃতির সেই বৈচিত্র্যময় অবারিত লীলাভুমি যেখানে প্রকৃতির অপরূপ চেহারা নানান বৈচিত্র্য নিয়ে ক্ষণে ক্ষণে পাল্টাতে থাকে। কখনো উঁচু পাহাড়, কখনো নিচু ঢাল, কখনো সমতল, এসবের ফাঁকেফোঁকে বিচিত্র সব ঝরনার চিকন-সরু ধারা ইত্যাদি ভৌগোলিক আবহে সারি সারি চাবাগানের গালিচা আর ছায়াবৃক্ষের আলোছায়া পার হতে হতে নিজেকে প্রকৃতির সন্তান হয়ে যেতে হয়। এরকম অবাধ্য আকর্ষণ ঠেলে ঠেলে মালনীছড়া বাগান পেরিয়ে তেলিহাটি থেকে দক্ষিণে বাঁক নিলেই এক গভীর পাহাড়ি নির্জনতার অসহ্য ভালোলাগার উৎপাত শুরু হতে থাকে। তা পাশ কাটাতেই হয়তো পথিকেরা অজান্তেই গলা ছেড়ে ছমছমে নিরবতা ভাঙতে শুরু করেন। আমাদের দলটাও তাই করলো। গানের সুর এদিক-ওদিক পাহাড়ে ঝরনায় ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয়ে ভেঙে চুরে নিজেদের কাছেই যখন ফিরে আসে, তা বুঝি আর মানুষ সৃষ্ট থাকে না, প্রকৃতির নিজস্ব এক শব্দ তরঙ্গে পরিণত হয়ে কলকল করে ঝরতে থাকে।
 .
.
যতই গভীরে যাই, পাহাড়ের গায়ে উঁচু ঢাল কেটে তৈরি মনুষ্যসৃষ্ট কৃত্রিম আকাবাঁকা অপসৃত জনমনুষ্যহীন এ পথ যে অনভ্যস্ত একাকী পথিকের জন্য নয় তা বুঝতে অসুবিধা হয়না আমাদের। মুহূর্তে মুহূর্তে বিস্ময়। কুড়িহাত পরের পথটাও পাহাড়ের বাধায় দৃষ্টির অগম্য। এই বুঝি ভয়ঙ্কর কিছু এসে সামনে দাঁড়ায়। নিচে চা বাগান, উপরেও তাই। রহস্য আর উত্তেজনার কম্পন বুকে ধরে সাত-আট জনের একটা দল সঙ্গি না হলে কখনোই সাধারণ মানুষ হিসেবে এ অভিযানে সাহস ধরে রাখা সম্ভব হতো না বলেই মনে হয়।
 .
.
একসময় পারিপার্শ্বিক আবহ দেখেই মনে হতে শুরু করলো, এটাই কি সেই রহস্যময় পেঁচাগড় ! পেঁচারা কালো রহস্যময় জগতের প্রাণী বলেই হয়তো এ জায়গাটার নাম হয়েছে পেঁচাগড়। বুঝি একটু অন্যমনস্ক হলেই হাজার হাজার অপ্রাকৃত পেঁচার আক্রমণে ছিটকে পড়তে হবে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নিচের ঝরনার জলে। আবহের সাথে খাপ খেতে খেতে হঠাৎ আবিষ্কার করলাম আশেপাশে আর কোন চাবাগানের দৃশ্য নেই এবং আমাদের কারো কণ্ঠে কোন শব্দও নেই।
 .
.
প্রকৃতির নিজস্ব নিরব শব্দ ছাড়া আর সব কিছু স্তব্ধ। কিন্তু রহস্য উন্মোচনের সরব দৃষ্টি সবার চোখে। অচেনা পাহাড়ি লতা-গুল্ম ঝোঁপ আর গাছপালা জংলি বৃক্ষের ঘন উপস্থিতি একটা প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গপথের মতো তৈরি করে আছে সামনে। কতোসময় ধরে হাঁটছি সে জ্ঞান ছিলো না।
 .
.
ঘনছায়ার এই বনসুড়ঙ্গ পেরিয়ে কিছুদূর এগুতেই আকস্মিক একটা আলোকিত খোলা জায়গায় এসে পথটা শেষ হয়ে গেলো। জায়গাটা যেন ভোজবাজির মতো সামনে এসে উপস্থিত। বড়জোড় একটা লন টেনিসের মাঠ সমান হবে। চারদিক পাহাড়ের জঙ্গলাকীর্ণ দেয়ালে ঘেরা। যেন নুয়ে আছে। বোঝাই যাচ্ছে, কোন এককালে পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছিলো। এখন তা বন জঙ্গল আর গাছপালায় আস্তির্ণ। পাহাড়ের দেয়ালগুলো ভূমি থেকে উল্লম্ব সমতলে উঠে গেছে উপরের দিকে। কেমন থমথমে একটা পরিবেশ, অসম্ভব নিরব। নিজেদেরকে অন্য গ্রহের প্রাণী বলে ভুল হয়। সময়ও বুঝি থমকে গেছে। আর অদ্ভুত সব গাছপালা বুঝি আগন্তুক আমাদের দিকে কেমন কৌতুহলী দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।
 .
.
পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে যেটুকু সময়, তারপরই চোখে পড়লো পাহাড় ঘেরা জায়গাটার বিপরীত দুদিকে দুরবর্তী দুকোণায় লতাগুল্ম বেষ্টিত দুটি গুহামতো মুখ আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে। যেন আমাদেরকে প্রশ্ন করছে, এখানে কেন এসেছো ! পথ হারিয়েছো ! ডানদিকের গুহামুখটা তুলনামূলক প্রশস্ত। কাছে গিয়ে দেখা গেলো ওটাতে আবার দুটো সুড়ঙ্গ পথ। একটি আকারে ছোট এবং কয়েকহাত পরেই বন্ধ। অন্যটি আড়াআড়ি ঢুকে গেছে অন্ধকার ভেতরে।
 .
.
বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থেকে এরপর খোলাজায়গাটি মারিয়ে অন্য গুহাটির দিকে এগিয়ে গেলাম। এটিও আরেকটি সুড়ঙ্গ। তবে আগেরটির মধ্যে ঢুকতে হলে উবু হয়ে ঢুকতে হতো। কিন্তু এটি উপর-নিচে মানুষ সমান উঁচু।
 .
.
আসার পথে বাগানের লোকালয় থেকে বেশকিছু মোমবাতি ও ছোট্ট একটা টর্চ লাইট কিনে আনা হয়েছিলো। টর্চ মেরে দেখা গেলো সুড়ঙ্গের দেয়াল বেয়ে চোঁয়ানো পানি আর নিচে হালকা ঝরনার মতো কাদাবালির থকথকে উপস্থিতি। প্রয়োজনীয় সাহস সঞ্চয় করে দ্বিধাজড়িত পদে একটু একটু করে ভেতরে ঢুকার চেষ্টা শুরু হলো। কিন্তু দুতিন হাত ঢুকেই টর্চের আলোয় দেখা গেলো পাঁচ-ছহাত সামনে গিয়েই সুড়ঙ্গটা প্রাকৃতিক কারণেই সরু হয়ে হঠাৎ করে একটা রহস্যময় ফুটবলের আয়তন নিয়েছে। শতশত বছরের অব্যবহারই এর কারণ হয়তো। আপাত কৌতুহল নিবৃত্ত করে ওটা থেকে সরে এসে ফের আগের বড় গুহামুখটায় ফিরে এলাম। গুহার মুখে স্যাঁতস্যাঁতে শ্যাওলার আস্তরণ। শুরু হলো আড়াআড়িভাবে চলে যাওয়া বড় সুড়ঙ্গটায় ঢোকার প্রস্তুতি।
 .
গুহামুখটার সামনে কিঞ্চিৎ দূরে মাটি দিয়ে তৈরি একটা ছোট্ট তুলসী বেদীর মতো চোখে পড়লো। অজানা রহস্যময় অস্তিত্বের প্রতি একধরনের ভীতিবোধ থেকে প্রাচীন মানুষের মধ্যে লোকপূজার যে রীতি গড়ে উঠেছিলো, বাগানের অশিক্ষিত কুসংস্কারাচ্ছন্ন অনগ্রসর মানুষগুলোর বর্তমান বিশ্বাসের প্রাচীন সাক্ষি এই বেদীটি। তবে এখানে কালেভদ্রে আসেন হয়তো কেউ, খুব একটা উপস্থিতির স্বাক্ষর চোখে পড়ে না।
 .
.
মোমের আগুনে গুহায় প্রবেশ নিরাপদ হবে না বলায় অভিযানসঙ্গি বাগানের ছেলেগুলো সাথে আনা মোমগুলো জ্বালিয়ে এই বেদীতেই বসিয়ে দিলো শ্রদ্ধা ও ভক্তিভরে। এবার টর্চটাই ভরসা করে গুহায় ঢোকার প্রস্তুতি। টর্চ জ্বালতেই ভেতর থেকে সাঁ করে বাঁদুর গোত্রের ছোট্ট একটা চামচিকা বেরিয়ে এলো। হয়তো আরো আছে। ধারণা হলো সুড়ঙ্গটা হয়তো বেশ গভীর ও দীর্ঘ। টর্চ নেভালেই চোখ লেপ্টানো ভীতিকর অন্ধকার। প্রায় হামাগুড়ি দিয়ে পাঁচ-ছহাত ঢুকে আর সাহস হলো না। ক্যামেরার একটা ফ্লাশশট মেরেই বেরিয়ে এলাম। বিপদের হাতপা নেই। এরকম স্যাঁতস্যাঁতে আর জলকাদায় মেশানো সুড়ঙ্গ পথ কোনভাবেই নিরাপদ মনে হলো না।
 .
.
খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে চারদিকে চোখ বোলাতে বোলাতে দূর কোন অতীতের বুকে কান পেতে  কিছু শোনার চেষ্টা করলাম। সঙ্গি-সামন্ত বিরাট বাহিনী নিয়ে প্রবল পরাক্রান্ত কোন এক পরাজিত গৌড়গোবিন্দ রাজা একদিন এই সুড়ঙ্গপথ দিয়ে ইতিহাসের গভীরে হারিয়ে গিয়েছিলেন। আর কোন খোঁজ পাওয়া যায় নি তাঁর। সুড়ঙ্গের অন্য মুখটা কোথায় গিয়ে ঠেকেছে কে জানে। কেউ বলেন, পার্শ্ববর্তী জয়ন্তীয়া রাজ্যে পালিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু যারা যেতে পারেনি সাথে, তারাই হয়তো তাঁর উত্তর পুরুষ হয়ে একটা পাহাড়ি জাতির পরিচয়ে নিজেদেরকে গৌড়গোবিন্দ জনগোষ্ঠি বলে এখানেই থেকে গিয়েছিলো দীর্ঘ দীর্ঘকাল। সভ্যতা বিচ্ছিন্ন এরাই হয়তো হয়ে গিয়েছিলো অনগ্রসর পাতর আদিবাসী। জানি না কবে এই সুড়ঙ্গের ভেতরটার মতোই সে ইতিহাসেরও সঠিক রহস্য উন্মোচন হবে।
 .
.
সবার কৌতুহল নিবৃত্ত হয়ে আসতেই খেয়াল হলো আকাশ ঘন মেঘে অন্ধকার হয়ে এসেছে। এই বিজন পাহাড়ি জঙ্গলে ঝড়-বৃষ্টির আশঙ্কায় নাজেহাল হওয়ার চাইতেও নিরাপত্তাহীনতার বোধটাই বেশি করে বাজতে লাগলো। তাই আর দেরি করা সঙ্গত হবে না। বেলা থাকতে থাকতেই এই রহস্যভুবন থেকে বেরুতে হবে। দেখতে দেখতেই তুমুল বৃষ্টি শুরু হয়ে গেলো। আসার সময়ও সকালে হতাশার বৃষ্টি শুরু হওয়ায় যাত্রা শুরু করতে বেশ বিলম্ব হয়েছিলো। কিন্তু এবার আর অপেক্ষার উপায় নেই। সবকটা মোবাইল আর ক্যামেরা একটা পলিথিনে ব্যাগবন্দি করে প্রবল বৃষ্টি ভেঙে তারচেও প্রবল হৈচৈ করতে করতে ফিরে চললাম সবাই। শব্দের অভিঘাত সৃষ্টি করে উত্তেজনা চাপা দেয়ার অবচেতন প্রকাশ হয়তো তা। তুমুল বৃষ্টিতে এবার আর ফেরার পথ সাচ্ছন্দ্যের হলো না। সামনে ঘণ্টা তিনেকের পথ। পানির তোড়ে পাহাড়ের বালুকাদা মেশানো মাটিতে পা ডেবে যায় প্রতি পদে। কাপড়-চোপড়-জুতো-ব্যাগ ভিজে থৈথৈ। বুকের ভেতরে অদ্ভুত একটা কষ্টও বাজতে লাগলো, তুমুল বৃষ্টিতে পাহাড়ি ঢালে শোয়ানো চাবাগানের যে অমানুষিক সৌন্দর্য, তা ক্যামেরায় ধারণ করার কোন সুযোগই পেলাম না। কিন্তু প্রকৃতির এই নিবিড় আবাহন বেশ কিছুটা সময়ের জন্যে হলেও প্রাত্যহিক একঘেয়ে জীবনের ঘেরাটোপমুক্ত করে যে স্বাধীন সত্তাটাকে মেলে ধরলো, তার ক্ষমার অযোগ্য স্বল্পস্থায়ীত্বটুকুই আরেকটা আগামী একঘেয়ে জীবনকে বিস্বাদ করে দিলো নিমেষে। কারণ, তখন আর কিছুতেই মনে পড়লো না, শেষবার কবে এমন হামলে পড়া বৃষ্টিকে সঙ্গি করে সত্যি সত্যি সেই নিজস্ব শৈশবে ফিরে গিয়েছিলাম।
.
.
তথ্যসূত্র :
শ্রীহট্টের ইতিবৃত্ত, অচ্যুতচরণ চৌধুরী তত্ত্বনিধি, উৎস প্রকাশন, ঢাকা।

(১১-০৯-২০১২)
[E-mail :
ranadipam@gmail.com]

[ sachalayatan ]
...

No comments: