Monday, February 18, 2013

| আহমেদ রাজীব হায়দার, ভাই আমার, তোমার স্মৃতির ভার বইতে পারছি না আমি…!

.
| আহমেদ রাজীব হায়দার, ভাই আমার, তোমার স্মৃতির ভার বইতে পারছি না আমি…!
রণদীপম বসু

(১)
০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৩, বিকেলের দিকে মোবাইলটা বেজে উঠতেই মনিটরে ভেসে উঠলো একটা সহজ-সরল যুবকের মুখ, থাবা বাবা। বেশ আগে কোন একদিন আড্ডা দিতে দিতে ছবিটা তুলে নম্বরের সাথে যুক্ত করে রেখেছিলাম।
দাদা আপনি কোথায়, অফিসে ?
হাঁ, অফিসেই।
সন্ধ্যায় আসবো দাদা ? গত দু’দিন শাহবাগে ছিলাম। হঠাৎ শরীরটা ভালো না থাকায় চলে এসেছি বাসায়। কিন্তু ভালো লাগছে না। ভাবছি আপনার সাথে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আসবো। মনে হচ্ছে কতোদিন দেখি না আপনাকে !
অথচ মাত্র এক সপ্তাহ আগেই আমার ঘরেই কয়েক ঘণ্টা কাটিয়ে গেছে সে।

 .
আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন (থাবা বাবা), বিরামহীন সাইবার যুদ্ধে... ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩, শাহবাগ, ঢাকা।
আহমেদ রাজীব হায়দার শোভন (থাবা বাবা), বিরামহীন সাইবার যুদ্ধে… ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৩, শাহবাগ, ঢাকা।
.
০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ তারিখে ট্রাইবুনালে একাত্তরের অন্যতম মানবতা বিরোধী যুদ্ধাপরাধী কসাই কাদের মোল্লার বিচারের রায় হিসেবে খুব কাঙ্ক্ষিত ফাঁসির বদলে সাধারণ কারাদণ্ডের সাজা ঘোষিত হওয়ায় যখন আকস্মিক হতাশায় মুহ্যমান হয়ে পড়েছিলাম, ওদিকে তখন তরুণ প্রজন্মের ব্লগার এক্টিভিস্টরা এই রায়ের বদলে ফাঁসির দাবিতে তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ ও বিক্ষোভে ফেঁটে পড়েছে রাস্তায়। চিরায়ত তারুণ্যের ক্ষোভে আর দ্রোহের আগুনে উত্তাল হয়ে কিছু সময়ের মধ্যেই শাহবাগ প্রজন্ম-চত্বর রূপ নিয়েছে বিক্ষুব্ধ জনসমুদ্রের উপচে পড়া জাগরণ মঞ্চে। এতোকালের চাপা পড়া বাঙালি সত্তার সুপ্ত আগ্নেয়গিরিটা উন্মুক্ত হয়ে গেছে।  মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উৎসারিত হাতগুলো মুষ্ঠিবদ্ধ হয়ে ঘাতক নরপিশাচ জামাত-শিবিরের যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে মুহুর্মূহু শ্লোগানের স্ফুলিঙ্গ আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলতে লাগলো। এর পরপরই সকল অনিশ্চয়তা আর হতাশা কাটিয়ে শাহবাগের এই আগুন ছড়িয়ে পড়লো গোটা বাংলাদেশে। এবং দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে এই আগুন ছিটকে পড়লো সারা বিশ্বের যেখানে যেখানে বাঙালি সন্তানেরা রয়েছে সেখানেও। প্রজন্মের চেতনার এই অস্তিত্বের সংগ্রামের অন্যতম এক অকুতোভয় সৈনিক আহমেদ রাজীব হায়দার (Ahmed Rajib Haider), পেশায় স্থপতি, ব্লগার ও ফেসবুকার হিসেবে যে থাবা বাবা (Thaba Baba) নামে পরিচিত। তাঁর ব্লগিং এক্টিভিজমের মূল বিষয়টাই ছিলো যুদ্ধাপরাধীদের সঠিক বিচার এবং এদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণে তরুণ প্রজন্মকে সচেতন ও সক্রিয় করে তোলার প্রেক্ষিত।
 .
তাঁকে বললাম, ঠিক আছে চলে আসেন। সন্ধ্যে সাতটা’র দিকে আসলো সে। চেহারায় ক্লান্তি ও অপরিপাট্যের ছাপ। তাঁর পূর্ব-পরিচিত রুমটিতে ঢুকেই সহজাত ভঙ্গিতে বললো- আহ্ , এই রূমটাতে ঢুকলেই মনটা ভালো হয়ে যায় !
এই ভালোলাগা যে মোটেও রুমটির গোছগাছহীন সৌন্দর্যের জন্য নয় তা বুঝতে পারি আমি। তাঁর আকর্ষণ মূলত রুম জুড়ে নির্বিচারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছন্নছাড়া বইগুলোর প্রতি। এর আগেও বেশ কয়েকবার সে এসেছে এখানে। এটা-ওটা নেড়েচেড়ে পাতা উল্টে প্রাসঙ্গিক বিষয়ে একটা-দুটা আলাপ থেকে ডাল-পালা ছড়িয়ে কতো কী-যে আলোচনায় চলে আসতো ! অদ্ভূত বিস্ময়ে খেয়াল করতাম, হেন বিষয় নেই যার উপর তাঁর আপাত স্পষ্ট ধারণা নেই ! সাহিত্য সংস্কৃতি শাস্ত্রীয়-সংগীত চিত্রকলা রাজনীতি ধর্মনীতি দর্শন ইতিহাস ঐতিহ্য দেশিয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে তাঁর টুকটাক আলোচনা প্রচুর অধ্যয়ন স্পষ্ট পর্যবেক্ষণ আর স্বচ্ছ চিন্তা-শৈলির সাক্ষ্য দেয়। স্থাপত্যকলায় যে অঙ্ক-জ্যামিতি বা এর সংশ্লিষ্ট বিষয় প্রতিপাদ্যের বাইরেও এর চমৎকার গভীর একটি আন্ত-দর্শন রয়েছে তা রাজীবের কাছ থেকেই প্রথম উপলব্ধি করি আমি। মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সের জীবনে যে-কোন বিষয়ের উপর কারো এতোটা সৃজনশীল বৈদগ্ধ্য অর্জন সম্ভব, রাজীবের সংস্পর্শে না এলে হয়তো কখনোই তা বিশ্বাস করতাম না আমি। অথচ ব্যক্তি জীবনে তাঁর অসম্ভব বিনয় এবং আচারে-ব্যবহারে চূড়ান্ত নম্র-ভদ্রতায় কখনো কোথাও ব্যত্যয় হয়েছে এরকম নজির তাঁর সংস্পর্শে কেউ পেয়েছেন কিনা আমার জানা নেই। ব্যক্তিমানুষের উন্নত রুচি ও হিউমারবোধ এবং যেকোনো বিষয়ে জানার অদম্য আগ্রহ কাকে বলে তা প্রতি মুহূর্তে তাঁর কাছে শিখতে হয়েছে আমাকেও, অন্তত যেটুকু সময় তাঁর সংস্পর্শে ছিলাম দেখে দেখে। তাই তাঁকে যেটুকু কাছে থেকে দেখেছি সেই বিচারে একজন ব্যক্তি রাজীবের কোন শত্রু থাকতে পারে এটা বিশ্বাস করার আগে পৃথিবী থেকে শত্রুতা নামক বিষয়টির সংজ্ঞাই পাল্টে নেয়ার প্রয়োজন হবে বলে আমার সুস্পষ্ট অভিমত। তবে হাঁ, আদর্শের বিচারে একটি বর্বর সমাজে তাঁর শত্রুর অভাব থাকার কথা নয়, যেখানে তাঁর মানবিক আদর্শের বিরুদ্ধবাদী গোষ্ঠিগুলো রাজীবের জন্মকাল থেকেই এই দেশটাকে তাদের বর্বর চারণক্ষেত্র বানিয়ে চলেছে।
 .
রাজীব বয়সে আমার অনেক নবীন ছিলো। তারপরও সে আমার কাছে মাঝেমধ্যে কেন আসতো ?  ইতিহাসবোধ ও প্রয়োজনীয় পাঠ থেকে তাঁর কাছে মুক্তিযুদ্ধের সামগ্রিক চেতনা খুবই স্পষ্ট ছিলো। মুক্তিযুদ্ধকালে আমার শৈশব কেটেছে বলে আমি বেশি জানবো তার কোন যৌক্তিকতা নেই। বরং মুক্তিযুদ্ধ না দেখার আক্ষেপ তাঁকে এ বিষয়ে অনেক বেশি অধ্যয়নে উৎসাহী করেছে এবং এই চেতনায় তার অবস্থানকে অনেক জোরালো করেছে। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী শক্তিকে সে চরমভাবে ঘৃণা করতো। মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতো, বাঙালির চিরায়ত বৈশিষ্ট্য তার ধর্মনিরপেক্ষ প্রকৃতি। কপট ধর্মব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে বাঙালির এই ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে সুপরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করার মরিয়া চেষ্টা করছে। এর বিরুদ্ধে সে যে খুব সোচ্চার ছিলো তা তাঁর ব্লগপোস্টগুলোই সাক্ষ্য দেয়। এক্ষেত্রে তাঁর আবেগ কোন বাধবিচারের তোয়াক্কা করতো না বলেই হয়তো তাঁর নিজস্ব ব্যক্তিচরিত্রের বাইরে গিয়ে তাঁর ব্লগগুলো তাঁর ফেসবুক স্ট্যাটাসগুলো হয়েছে অনেক বেশি দুর্বিনীত, অদম্য। এটা তাঁর ভার্চুয়াল রূপ, ব্যক্তিমনের গোপন আক্ষেপ নিঃসন্দেহে। ব্যক্তি হিসেবে সে এক অকৃত্রিম বাঙালি, কোন খাদ নেই, অন্তত আমার চোখে পড়েনি কখনো। বাঙালির উৎসব ঐতিহ্যে তাঁর আগ্রহ অপরিমেয়। তাঁর স্পষ্ট উচ্চারণ- আমি প্রথমে মানুষ, তারপর বাঙালি এবং এরপর প্রয়োজন হলে অন্য পরিচয়।
 .
তাঁর একটা প্রচণ্ড আক্ষেপ ছিলো। সে মনে করতো, যাঁরা মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, দেখেছেন বা ওই সময়ে অবস্থান করেছেন তাঁরা বাঙালি হিসেবে প্রচণ্ড ভাগ্যবান। আমি বলতাম, ভাগ্যবান তো বটেই, তবে ওই প্রজন্মের অনেক দুঃখ, বেদনা, কষ্টও আছে। তাও উপলব্ধি করতো সে খুব ভালোভাবেই। আমার কাছে আসতো হয়তো ওই কষ্টটুকু অনুভব করার জন্যেই। হয়তো সেই কষ্টের তাপটুকু অনুভব করার জন্য যে, একাত্তরে একই পরিবার থেকে মা ভাই বোন হারানো একজন বিধ্বস্ত স্বজন কিভাবে জীবন-যাপন করে, কিভাবে তার কষ্টগুলো ঢেকে রাখে কিংবা উগড়ে দেয় তা কাছে থেকে উপলব্ধি করতে। তবে তাঁর সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ ঘটেছিলো প্রায় বছরখানেক হবে।
 .
কয়েক হাজার বছর পূর্বের তৎকালীন প্রেক্ষাপটে প্রাচীন ভারতবর্ষে বৈদিক যুগ বা তারও আগে থেকে বিশ্বের প্রাচীনতম জড়বাদী দর্শন লোকায়ত বা চার্বাক দর্শনের যে উত্থান ঘটেছিলো, তা খুঁজতে গিয়ে গোটা ভারতীয় দর্শন নাড়াচাড়া করতে করতে ‘চার্বাকের খোঁজে’ শিরোনামে গবেষণাধর্মী একটি ধারাবাহিক লেখা প্রকাশ করতে থাকি ‘মুক্তমনা’ ব্লগে। তারও আগে অস্পৃশ্য ও ব্রাহ্মণ্যবাদে নারীকে কিভাবে দেখা হতো সেই বৈদিক কালে, তা নিয়েও ধারাবাহিক লিখেছিলাম ওখানেই। প্রচণ্ড কৌতুহলি রাজীবের সেগুলো চোখে পড়েছিলো ঠিকই। একদিন একটি ফোন পেলাম, ‘আপনি কি রণদীপম দা ? এদিক থেকে অনুকূল জবাব পেয়ে বললো, দাদা আমি রাজীব হায়দার, তবে আমাকে হয়তো আপনি থাবা বাবা নামে চিনবেন। আমি আপনার ফেসবুকের ফ্রেন্ডলিস্টে আছি। আপনার আপত্তি না থাকলে একদিন আপনার সাথে দেখা করার খুব ইচ্ছে আমার। অমুকের কাছ থেকে আপনার নম্বর পেয়েছি। তাঁকে সাথে নিয়েই একদিন দেখা করতে আসবো।’ পূর্বপরিচিত অন্য ব্লগার-বন্ধুর রেফারেন্স থাকায় নিঃসন্দেহ হয়ে সম্মতি জানালাম। তারপর একদিন ফোন করে সেই পরিচিত ব্লগারসহ চলে আসলো আমার অফিসে। প্রথম সাক্ষাতেই তাঁকে এতো ভালো লেগে গেলো যে, এরপর বন্ধুত্বে অনেকটা ঘনিষ্ট হয়ে গেলাম আমরা। সহজ সরল মায়া মাখানো মুখটা দেখলেই এক অন্যরকম ভালোলাগায় আচ্ছন্ন হতে হয়। কূটিলতামুক্ত এমন নির্ভেজাল সারল্যমাখা চোখ খুব কমই দেখেছি আমি। সেই থেকেই রাজীব হায়দার আমার ছোট ভায়ের আসনটি গেঁড়ে বসলো। আমাকে যতোই তাঁকে ‘তুমি’ করে সম্বোধন করতে বলুক, আমি তাঁকে সামনাসামনি ‘আপনি’ করেই সম্বোধন করে গেছি। 
 .
Ahmed Rajib Haider, Shahbagh, Dhaka, 08-02-2013
Ahmed Rajib Haider, Shahbagh, Dhaka, 08-02-2013
.
(২)
সাত তারিখ সন্ধ্যায় এসে অন্যদিনের মতো এতোটা সময় থাকলো না সে। তবে যেটুকু সময় ছিলো, চেহারায় ক্লান্তি ও অপরিপাট্য থাকলেও স্বভাব-প্রাচুর্য্যে সেই রাজীবই, মাতিয়ে রাখলো স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে। শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরে তারুণ্যের দ্রোহ আর আন্দোলনের তিন-তিনটি দিন প্রায় পেরিয়ে যাচ্ছে তখন, অথচ আমার চাকুরিগত অসুবিধা ও পারিবারিক সীমাবদ্ধতার কারণে আমি আন্দোলনে সশরীরে অংশগ্রহণ করতে পারছি না, ভেতরগত এই আক্ষেপটাও আমাকে কুরে কুরে খাচ্ছিলো। তাঁর কাছ থেকে শাহবাগের যতোটা সম্ভব তথ্য নেয়ার চেষ্টা করলাম। পরের দিন ০৮ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার ছুটির দিন থাকায় শাহবাগে ঘোষিত মহাসমাবেশে অংশগ্রহণ করবো এটা পূর্বনির্ধারিত। তাঁকে এগিয়ে দিতে গিয়ে যথারীতি বাসার কাছের চা-দোকানটাতে আদা সহযোগে দুধ-চায়ের অর্ডার দিয়ে আরো কিছুক্ষণ এটা-ওটা আলোচনা। অতঃপর চলে যাওয়ার সময় বললো- দাদা, কাল আপনি রওয়ানা দেয়ার আগে একটা রিং দিয়েন। আমি চলে আসবো আপনার বাসায়, একসাথে শাহবাগ যাবো। সাথে আপনার মডেমটাও নিতে হবে। এ মুহূর্তে ওটার সার্ভিস দরকার আমার।
 .
দুজনেই মিরপুরের বাসিন্দা হলেও এটুকু জানি যে, আমার ভাড়া বাসা থেকে রাজীবের নিজের বাসা অনেক দূর, মিরপুরের এপার-ওপার বলা চলে। কখনো যাই নি আমি সেদিকটাতে। রাজীবের খুব ইচ্ছে ছিলো একদিন আমাকে তাঁর বাসায় নিয়ে যাবে। ওখানকার পরিবেশটা নাকি ঢাকা নগরীর সাপেক্ষে একেবারে অন্যরকম, নাগরিক বদ্ধতার অভিশাপগুলো আষ্টেপৃষ্ঠে চেপে ধরেনি এখনো। কিন্তু দু’জনেরই ব্যস্ততায় তা আর হয়ে ওঠেনি। সেদিনও যাবার আগে কথা ক’টা বলেছিলো আবার। আমিও বলেছি, যাবো যাবো। আমার কি আর যাওয়া হবে কখনো ! কার কাছে যাবো !
 .
পরদিন আট ফেব্রুয়ারি বাসা থেকে শাহবাগের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেবার আগে রাজীবকে রিং দিলাম। জানলাম সে বেরোচ্ছে। বললাম, আপনি মিরপুর দশে আসেন, আমিও আসছি। তখনো পৌঁছেনি দেখে রাজীবকে রিং করলাম। এইতো দাদা, দু’মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছি। মিরপুর থেকে একই বাসে চাপলাম দুজন। আমি সাথে নিয়েছি ছোট্ট ক্যামেরাটা ইতিহাসের কিছু আলোক-স্বাক্ষর রাখার উদ্দেশ্যে। রাজীব ক্যামেরার সাথে নিয়েছে সঙ্গি ছোট ল্যাপটপটাও। সীটে বসেই বললো, দাদা মডেমটা ? আমরা নামবো হোটেল রূপসী বাংলার মোড়ে। গাড়ি ছুটছে, আর এর মধ্যে রাজীবও তাঁর ল্যাপিটাকে সংযুক্ত করে নিয়েছে অনলাইনের মুক্ত দুনিয়ায়।
 .
দুপুর বারোটা পেরিয়েছে হয়তো। যথাস্থানে নেমে আমরা ছুটছি শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের দিকে। ওটা এখন আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ, নতুন একাত্তর। ওখান থেকে থেকে-থেকে শ্লোগানের স্ফুলিঙ্গ উড়ছে। কটকটে রোদ শরীরে ছ্যাঁকা দিচ্ছে প্রায়, কিন্তু আমরা তখন গোটা এলাকা চষে চষে ক্যামেরায় ক্লিক করে চলেছি। নতুন নতুন বিষয় পেলেই রাজীব বলছে, দাদা ওই যে ! যতই সময় গড়াচ্ছে মানুষের ঢল বাড়ছে। অনেক পরিচিত-অপরিচিত কতো ব্লগার-এক্টিভিস্টিদের সাথে পরিচয় কুশল বিনিময় ইত্যাদি ইত্যাদিও সমানে চলছে। রাজীব যে ওর বন্ধুদের কাছে এতো জনপ্রিয় ও এতোটা প্রিয়মুখ তা না দেখলে এই দিকটা জানা হতো না আমার। কতোক্ষণ গড়িয়েছে জানি না, হঠাৎ রাজীব বললো, দাদা চলেন একটা ট্রাই করি !
আমি না-বুঝে জিজ্ঞেস করলাম, কী ?
তর্জনি নির্দেশে পিজি হাসপাতাল অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই উঁচু ছাদটা দেখালো। খুব ছোট্ট করে ওখানে বেশ ক’টি মানুষের মাথা আর টিভি-ক্যামেরা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু কিভাবে যাবো ওখানে ! কখনো ভেতরে ঢুকি নাই যে ! রাজীব বললো, আসেন, দেখা যাক। আরো কয়েকজন ব্লগারও আমাদের সঙ্গি হলো।
 .
গেট দিয়ে ভেতরে ঢুকে বিভিন্ন জিজ্ঞাসাবাদ পেরিয়ে অবশেষে ছাদে উঠতে পারলাম। কয়েকটি টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা সংশ্লিষ্ট সংবাদ-কর্মী ও বেশ কয়েকজন নিরাপত্তা কর্মী রয়েছেন সেখানে। দূরবীণ দিয়ে গোটা এলাকাটা নজরে রাখা হচ্ছে। আমরা গলা উঁচু রেলিংয়ে ঠেক লাগিয়ে উপর থেকে বেশ কিছু স্বাভাবিক ও জুমশট নিলাম নিচের গোটা এলাকার। খেয়াল করলাম সাদা-পোশাকের নিরাপত্তাকর্মী আমাদেরকে নজরে রাখছেন ভালোকরেই।  ততক্ষণে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে গেছি প্রত্যেকে। নিচে নেমে আসার আগে ছাদের বিশাল পানির ট্যাঙ্কিটার একপাশে কলের ট্যাপ খুলে দিয়ে যে যার মতো হাত-মুখ ধুয়ে ঠাণ্ডা হয়ে নিচ্ছি। হঠাৎ দেখি রাজীব ক্লান্তির ধকল সইতে না পেরে তাঁর মাথাটাই ট্যাপের নিচে ঠেলে দিয়েছে !
 .
যখন নিচে নেমে এসেছি ততক্ষণে মানুষের ঢল ওদিকে চারুকলা ছাড়িয়ে ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই অবস্থা। কোনভাবে আমরা কয়েকজন জাতীয় জাদুঘরের সামনের ফুটপাথের প্রান্তে বসার একটা সুযোগ করে নিলাম। ঠিক আমাদের পাশেই আরেকটা গণস্বাক্ষরের ব্যবস্থা। স্বতঃস্ফূর্ত মন্তব্যসহ স্বাক্ষর প্রদান চলছে তো চলছেই। চারটা বাজতে চললো। মহাসমাবেশের কর্মসূচি শুরু হবে। আমাদের সামনে ডানে বামে আর কোন খালি জায়গা অবশিষ্ট নেই। একমাত্র পেছন ঘেষে ফুটপাথ দিয়ে এখন মানুষের নিরেট স্রোত। আমার গা ঘেষে বসে রাজীব তখন ফেসবুকে সদ্য তোলা বিভিন্ন ছবি আপলোড আর ক্যাম্পেইনে ব্যস্ত। তারুণ্যের এই ঐতিহাসিক জোয়ারে অভিভূত আমি কোন্ ভাবনায় ডুবে ছিলাম জানি না, হঠাৎ দেখি রাজীব পাশের বন্ধু ব্লগারের কোলে ল্যাপিটা রেখেই দৌঁড়ে গেলো সামনে। বিশাল জাতীয় পতাকাটা মাথায় নিয়ে বিরাট একটা মিছিল এদিক থেকে ওদিকে বয়ে যাচ্ছে। রাজীবের অ্যাঙ্গেলটা বুঝতে বুঝতে সময় লেগে গেলো আমার। ততক্ষণে আমিও ছুট লাগালাম। মিছিলের ভেতরে ঢুকে নিচ থেকে উপরমুখো করে ক্যামেরাটা বাগিয়ে ক্লিক করলাম। কিন্তু আকাশের মতো পতাকার শেষ অংশটাই ধরতে পারলাম ক্যামেরায়। রাজীব ফিরে এসে দেখালো তাঁর নেয়া অসাধারণ শটটা। আমি যে এরকম একটা শট নিতে পারলাম না এই আফসোস বেরিয়ে এলো আমার মুখ থেকে। সে কেবল একটু করে তাঁর সেই মোহন হাসিটা দিলো। ওখানে বসেই মনে হয় ছবিটা ফেসবুকে আপলোড করে দিয়েছে সে। পরদিন বাসায় বসে ফেসবুকে তাঁর জাতীয় পতাকার এই ছবি স্ট্যাটাসটা চোখে পড়ায় মন্তব্য করেছিলাম- দুর্দান্ত ! রাজীব অর্থাৎ থাবা বাবা প্রতি-মন্তব্যে লিখেছিলো, আপনার আক্ষেপটা বুঝি দাদা।
 .
একসময় ফুটপাথ ছেড়ে রাজীব সহ আমরা কয়েকজন জাগরণ মঞ্চের কাছাকাছি যাওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। অঢেল ভিড়ের ঠেলায় দাঁড়িয়ে স্থির থাকাও সম্ভব হচ্ছিলো না বলে আমরা গোল হয়ে বসে গেলাম রাস্তায়। মাঝখানে বিভিন্ন শ্লোগান লেখা বুকখোলা একটা আর্টপেপার। এরকম অগুনতি বৃত্তাকার জটলা গোটা এলাকা জুড়েই ছড়িয়ে ছিলো। এ আন্দোলন শুরুর আগের কতো কতো মিডিয়া-বিখ্যাত মুখ এদিক ওদিক দেখছি, কিন্তু তাদেরকে আজ এই চেতনার স্ফুলিঙ্গবিন্দুতে এসে আলাদাভাবে বিখ্যাত বা গুরুত্বপূর্ণ কোন কিছু মনে হচ্ছে না আর। কেননা বাঙালির ইতিহাসে আজ এ মুহূর্তে তারুণ্যই নিয়ন্ত্রক নায়কের আসনে আসীন, অন্যরা কেবলই সহ-চরিত্র এখানে। কৌতুহলি ক্যামেরাগুলি এদিক-ওদিক কতোভাবে মুখ বাড়িয়ে দেখে নিচ্ছে তারুণ্যের মুখগুলিকে, যেখানে বয়স আর বিবেচ্য নেই, বিবেচ্য কেবল তারুণ্যের দ্রোহ আর অঙ্গিকার। অন্য অনেকের মতোই ছোট্ট একটি ক্যামেরা হাতে এটিএন-এর জই মামুনকেও দেখলাম আমাদের জটলাটাকেও ক্যামেরায় ধরে নিতে। আমরা কি জানতাম তখনো এই ছোট্ট বৃত্তটির মাঝে কোলে খোলা ল্যাপটপ নিয়ে মগ্ন হয়ে আছে যে, সেই হতে যাচ্ছে ইতিহাসের অক্ষয় আলোকবিন্দু হয়ে প্রজন্মের প্রথম শহীদ সন্তানটি ! জই মামুন এখনো জানেন কি যে তার ক্যামেরার কোন গোপন কন্দরে আলোক উদ্ভাস ছড়িয়ে যাচ্ছে রাজীব হায়দারের উজ্জ্বল মুখটি ? 
 .
শাহবাগের মুহূর্মুহু শ্লোগান আর ইতিহাসের অন্যতম বৃহত্তম মহাসমাবেশে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা শেষ হয়েছে তখন। তবে তারুণ্যের এই লাগাতার আন্দোলন যে বিপুল জন-সম্পৃক্ত হয়ে অবিচ্ছিন্নভাবেই চলার সামর্থ অর্জন করে ফেলেছে তা আর বুঝতে বাকি নেই আমাদের। ভাবছিলাম ভিড় কমলে আলো-আঁধারির কিছু ছবি নেবো। কিন্তু সন্ধ্যার পর ভিড় কমবে কী ! তা আরো ভীষণভাবে বাড়তে লাগলো। শ্রেণী-পেশা-বয়সের ভেদাভেদ ভুলে হাজার হাজার লোক তারুণ্যের শ্লোগানে শ্লোগানে রাত কাটিয়ে দেবে এখানেই। আমাদের গোটা দিনটা এখানেই কেটেছে। একা এসেছি বলে বাসায় ফিরতে হবে। রাজীবকেও নাকি তাঁর কিছু পেশাগত কাজ সম্পন্ন করার জন্যে বাসায় যেতে হবে। ফেরার পথে ভাবছিলাম একটু বইমেলার দিকেও ঢুঁ মারতে হবে। প্রতি বছরের মতো এবারও আমার একটা বই বেরোবে। গ্রন্থকার হিসেবে এটাকে অবহেলার করার উপায় নেই। যদিও বিগত বছরগুলোতে এ সময়টা অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি মাসটা বইমেলা নিয়ে মেতে থেকেছি। কিন্তু এবার সবকিছু ছাড়িয়ে বাঙালির ঠিকানা যেনো এই শাহবাগের বিশাল চত্বরটাই। তবু রাজীবকে ইচ্ছেটা জানাতেই সে বললো, চলেন ঘুরে আসি। অসম্ভব ভিড় ঠেলতে ঠেলতে আরো কয়েকজন বন্ধু ব্লগারসহ বাংলা একাডেমীর দিকে হাঁটতে লাগলাম আমরা।
 .
সবাই মিলে হালকা চা-নাস্তা সেরে বইমেলায় ঢুকলাম। ইচ্ছে ছিলো প্রকাশিতব্য আমার কিশোর গল্পের বইটা বেরোলে মেলাতেই রাজীবকে উপহার দেবো। ফেসবুকে ছড়াকারে ওর মজার মজার স্ট্যাটাস ছাড়াও  শিশুসাহিত্য নিয়েও ওর অদম্য আগ্রহ টের পেয়েছি আগেই। কিন্তু শুদ্ধস্বরে গিয়ে যখনই জানলাম যে ‘টিপলু’ এখনো মেলায় আসেনি, মনটা দমে গেলো। এবং তখনই টের পেলাম যে ধীরে ধীরে ক্লান্তি এসে ভর করছে। এবার বাসায় ফিরতে হবে, যা আরো কমসে-কম ঘণ্টা দুয়েকের মামলা। এরই মধ্যে মেলায় আগত আমার পরিচিত বন্ধু লেখকদের আগমন ঘটতে শুরু করেছে। থাবা বাবা হিসেবে রাজীবের সাথে নতুন করে প্রত্যক্ষ পরিচয় হলো লেখক আহমাদ মোস্তফা কামাল, ফারসিম মান্নান মোহাম্মদী সহ আরো বেশ কয়েকজনের সাথে। স্বকৃত নোমানের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলাম শাহবাগেই। তাড়া থাকায় বেশিক্ষণ অপেক্ষা না করে ফিরে চললাম আমরা। গেট দিয়ে বেরোতে গিয়েই রাজীবের সাথে মুখোমুখি পরিচয় হলো ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন ভাইয়ের সাথে, তাও থাবা বাবা হিসেবেই। কিছুক্ষণ কথাও হলো ওদের মধ্যে। পাশে দাঁড়িয়ে আমি। অতঃপর ফিরে চললাম। এরই মধ্যে রাজীব একটা কাজ করে বসলো। পকেট থেকে বার্মিজ সিগারেটের একটা চকচকে প্যাকেট বের করে আমার দিকে বাড়িয়ে বললো- জুনিয়র কিছু পোলাপান সেন্টমার্টিন গিয়েছিলো, এটা নিয়ে এসেছে আপনার জন্যে। রাজীব নিজে অধূমপায়ী। আমিও পারতপক্ষে অধূমপায়ী ও জুনিয়র কারো দেয়া সিগারেট নেই না সেটা সে জানতো ঠিকই। রাজীবের নিটোল চোখ কী যেনো বলতে চাইলো, আমিও নিয়ে নিলাম।  বইমেলা প্রাঙ্গন থেকে হেঁটে হেঁটে টিএসসি চত্বর হয়ে নীলেক্ষেত গিয়ে ফের একই বাসে চড়লাম। ইতোমধ্যে অন্যান্য ব্লগাররা যে যার দিকে চলে গেছেন। কেউ ফিরে গেছে শাহবাগে।
 .
সীটে বসেই ফের রাজীব ল্যাপিতে অনলাইনে। মিরপুর দশে এসে গাড়ি থেকে নামলামও একসাথে। এবার দুজনের পথ দুদিকে। আমার হাতে মডেমটা ফিরিয়ে দিয়ে নিষ্পাপ হাস্যোজ্জ্বল রাজীবের সেই চিরায়ত সংলাপ, দাদা আবার দেখা হবে, আসি তাহলে ?
তখনো কি জানতাম, রাজীবের সাথে সংলাপমুখর আমার এটাই শেষ দেখা !
আমার ড্রয়ারের মধ্যে বার্মিজ সিগারেটের সেই অক্ষত প্যাকেটটা রয়ে গেছে তেমনিই, রাজীবের স্মৃতি হয়ে। ওই প্যাকেট আর কখনোই ভাঙা হবে না আমার। নিজের নিয়মে যতোকাল টিকে থাকে…!
 .
My Only Photo With Ahmed Rajib Haider (Thaba Baba) By Parveen Rahman.
My Only Photo With Ahmed Rajib Haider (Thaba Baba) By Parveen Rahman.
.
(৩)
রূপা, অগৃহস্থ স্বভাবী আমার সাথে সুখেদুখে পনেরোটি বছর পার করেছে সবে। বিশ্ব কাঁপিয়ে দেয়া শাহবাগ আন্দোলনের দশটি দিন শারীরিক অসুস্থতা নিয়েও সে খাওয়া-দাওয়া-ঘুম এলোমেলো করে টিভির পেছনমুখ হয়নি বলা যায়। কিন্তু ঢাকায় অবস্থান করেও এই ইতিহাসের প্রত্যক্ষ সাক্ষি হতে পারবে না এটা কী করে হয়! একই কথা উত্তরপুরুষ প্রান্তিকেরও। অতঃপর ইতিহাসের সাক্ষি হয়ে থাকতে আন্দোলনের একাদশতম দিন ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ শুক্রবার বেরিয়ে পড়লাম আমরা দুপুরের বেশ আগেই। গাড়িতে উঠার আগেই রূপার দুর্বল শরীর টলছে, কোনো শক্তি পাচ্ছে না। তবুও মনোবলের উপর ভরসা করে গাড়িতে চড়লাম। ভাবলাম প্রজন্ম চত্বরের তারুণ্যের উচ্ছ্বাসে তার এই দুর্বলতা কেটে যাবে। হলোও তাই। গোটা এলাকাটা ঘুরেফিরে বাঙালির চেতনার ঔজ্জ্বল্য মেখে কটকটে রোদের মধ্যেই জাগরণ মঞ্চের মোটামুটি কাছাকাছি এসে বসে গেলাম তিনজন। ক্রমশই বসার মিছিল পেছনে দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হতে লাগলো। গোটা এলাকা প্রকম্পিত লাখো মানুষের শ্লোগানে শ্লোগানে। সামনেই মঞ্চে অন্য অনেকের সাথে লাকীকে দেখেই প্রান্তিক উচ্ছ্বসিত। জয় বাংলা, তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা, ঘাতক দালাল রাজাকার এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়, জামায়াতে ইসলাম মেইড বাই পাকিস্তান, ক-তে কাদের মোল্লা তুই রাজাকার তুই রাজাকার, গ-তে গোলাম আজম তুই রাজাকার তুই রাজাকার, একটাই দাবী ফাঁসি ফাঁসি, জামাত-শিবিরের রাজনীতি আইন করে বন্ধ করো, এরকম অগুনতি শ্লোগানে শ্লোগানে সেও হাত উঁচিয়ে লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে। আর আমি দেখছি আমাদের আগামী প্রজন্মের বুক থেকে বেরিয়ে আসা বাঙালির চিরায়ত চেতনার উদ্ভাস। এরাই একদিন আগামীর বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেবে, সেই স্বপ্নের হাইওয়ের নির্মাণ কাজই বুঝি চলছে এই শাহবাগের মোহনায় তারুণ্যের প্রকৌশলে।
 .
বেলা গড়িয়ে গোধূলি তার ছায়ার আঁচল বিছাতে শুরু করেছে। যদিও এই মহানগরী ঢাকার যান্ত্রিক জীবনে গোধূলি বলে আসলে কিছু নেই। তবু ক্যামেরার সাটারে চাপ পড়লে এই যন্ত্রই আলোর স্বল্পতাটুকু জানিয়ে দিতে শুরু করে। বিভিন্ন ছাত্র নেতৃবৃন্দের জ্বালাময়ী বক্তব্য-বিবৃতি চলছে জাগরণ মঞ্চে। ফাঁকে ফাঁকে আকাশ কাঁপানো শ্লোগান। চারদিকে জনসমুদ্রের ঠাঁইহীন উত্থাল শ্লোগানের মধ্যেই হঠাৎ চোখে পড়লো আমাদের কয়েক হাত দূরেই আমাদের মতোই রাস্তায় বসে আমাদের সাথেই শ্লোগানে তাল মিলাচ্ছেন মাননীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমণি ! তিনি কখন কিভাবে এখানে সংহতি জানাতে এসেছেন বুঝতেই পারিনি। আবার এই উদ্দামতার মাঝখানে কখন যে চলে গেছেন তাও টের পাইনি। একনাগাড়ে কয়েক ঘণ্টা বসে থেকে রূপার পায়ে খিল ধরে গেলে নড়ে চড়ে বসার চেষ্টা করছে। ভাবলাম এখান থেকে উঠিয়ে নিয়ে তাকে একটু হাঁটাহাঁটির মধ্যে রাখলে হয়তো ভালো লাগবে। কিন্তু সে এখান থেকে নড়তে রাজি নয়। প্রান্তিকও না। তবু তার অসুস্থতার কথা বিবেচনা করে আমার চাপাচাপিতে একটু উঠে দাঁড়াতে গিয়েই দেখা গেলো রূপা টলে পড়ে যাচ্ছে ! তার চোখ-মুখ সাদা হয়ে যাচ্ছে ! তাঁকে জাপটে ধরে একহাতে শরীরের সাথে বেঁধে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসলাম।
 .
সে আসলে হাঁটছে না, যন্ত্রের মতো টলে টলে পা ফেলছে। বস্তুত তাকে পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে হাঁটছি আমিই। অন্যদিকে প্রান্তিককে ধরে রেখেছি। এই ভীড়ের মধ্যে একবার হারিয়ে গেলে খড়ের গাদায় সুঁই খোঁজার চাইতেও কঠিন হবে। প্রায় অজ্ঞান অবস্থার একজন রোগীকে এভাবে জনসমুদ্রের ঠাশা ভিড়ের মধ্য দিয়ে নিয়ে যাওয়া অসম্ভব একটা কাজ মনে হলেও খেয়াল করলাম আগত মানুষেরা অভূতপূর্ব সহায়তা নিয়ে যাবার পথ তৈরি করে দিচ্ছেন ! এমন সুশৃঙ্খল জনসমুদ্রের মধ্যেও অন্যরকম একটা মানবিক বৈশিষ্ট্য অবলোকন করে নিজেকে একজন বাঙালি হিসেবে ভাবতে অসম্ভব গর্ব হলো। চারুকলার কাছাকাছি গিয়ে রূপাকে কোথাও বসানোর দরকার হলো। নির্দ্বিধায় একটা চেয়ার ছেড়ে দিয়ে একজন বৃদ্ধ পিতার মতো সহায়তায় এগিয়ে এলেন। পাতলা একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললেন, এটা দিয়ে বাতাস করেন।
 .
বাতাস করতে করতে দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে উঠেছি, প্রেশারটা সম্ভবত খুব নেমে গেছে ওর। এমনিতেই অ্যাজমার রোগী, রক্তে অক্সিজেন-স্বল্পতা থাকাটা খুব স্বাভাবিক। তার উপরে পরিশ্রম আর ক্লান্তির কারণে হয়তো ডিহাইড্রেশনও দেখা দিয়েছে। তাকে দ্রুত স্যালাইনের ব্যবস্থা করতে পারলে ভালো হতো। কী করি কী করি ভাবতে ভাবতেই মনে হয়ে গেলো রাজীবের কথা। মোবাইলটা বের করেই ফোন লাগালাম। তখনও সন্ধ্যা হয়নি। ওপাশ থেকে ফোন ধরেছে সে, কিন্তু প্রচণ্ড কোলাহল-মুখরতার কারণে রাজীবের মায়াবী কণ্ঠের কোন কথাই বুঝতে পারলাম না। আমার কথাও সে বুঝলো কিনা কে জানে ! লাইন কেটে দিলাম। হঠাৎ একটা উপায় মনে এলো, যেকোনভাবে তাকে বইমেলায় ঢুকিয়ে শুদ্ধস্বর প্রকাশনার স্টলে নিতে পারলে পরিচিত লোকজনের কিছু একটা সহায়তা পেয়ে যাবো। আবারো ধরে ধরে সাহস দিতে দিতে বইমেলার সারিবদ্ধতার শৃঙ্খলা ভেঙেই ঢুকে গেলাম বাংলা একাডেমীর চত্বরে। শুদ্ধস্বরের সামনে যেতেই অন্যরা এগিয়ে এলো। 
 .
একটু পরেই প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল ভাই সুখবর দিলেন, ‘টিপলু’ আজই মেলায় এসেছে। বইটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে রূপার হাতে দিলাম। মনে হলো ওর নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেয়েছে। এবার বাসায় ফিরতে হবে। বইমেলা চলাকালীন প্রকাশকের পক্ষ থেকে লেখককে কোন সৌজন্য কপি দেয়া হয় না। তাই লেখক-কমিশনের সুযোগ নিয়ে গোটা চারেক কপি কিনে নিলাম, যার মধ্যে একটা রাজীবের জন্যে বরাদ্দ ছিলো। এরপরই বাসার দিকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে রওয়ানা দিলাম। রাস্তার ধকল কাটিয়ে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত প্রায় দশটা। ফ্রেশ হয়ে সাড়ে দশটার দিকে অনলাইনে ঢুকলাম কেবল। ভাবলাম মেইল আর ফেসবুকটা চেক করে আজকের তোলা ছবিগুলো আপলোড শুরু করবো ফেসবুক এলবামে। কিন্তু ঢুকতে-না-ঢুকতেই ফেসবুকের চ্যাট বক্সে একইসাথে কয়েকজন ভার্চুয়াল বন্ধুর টোকা। একজন ল্যাটিন হরফে বলছে, থাবা বাবা নাকি নেই !
 .
মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝলাম না। তখনও ঘূণাক্ষরেও মাথায় কাজ করেনি যে, ওরা ভয়ঙ্কর একটা দুঃসংবাদ আমাকে দিচ্ছে বা জানতে চাইছে ! আমিও প্রত্যুত্তর লিখলাম, কী বলছেন বুঝতে পারছি না। আরেকজনের চ্যাটবক্স ওপেন করতেই মাথা এলোমেলো হয়ে গেলো, ব্লগার রাজীব হায়দার খুন হয়েছেন ! কী বলছে এরা ! চিন্তাশক্তি লোপ পেয়ে যাচ্ছে আমার ! দ্রুত ফেসবুকের মূল পেজে ঢুকলাম, কখন যে চিৎকার বেরিয়ে এলো মুখ দিয়ে- রূপা !
 .
আমার অস্বাভাবিক আর্তচিৎকারে উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এলো রূপা। পেছন পেছন প্রান্তিকও। শুধু এটুকুই বলতে পারলাম, রাজীব নাকি খুন হয়েছে ! হতবিহ্বল শরীরে কোন নিয়ন্ত্রণ নেই আমার, থরথর করে কাঁপছে। কোন কথা বলতে পারছি না আর ! আমার চোখ আটকে আছে ফেসবুকের একটা ছবি স্ট্যাটাসে। রাজীবের ছবি ! কতক্ষণ গেছে জানি না। চেতন ফিরে এলে বুঝলাম, হাউমাউ করে রূপা কাঁদছে। জগতের প্রতিটা নারীই বুঝি একেকজন মায়ের প্রতিনিধিত্ব করে। ঠিক আটদিন আগে তরুণ প্রজন্মের প্রতি নির্মল কৃতজ্ঞতা মিশিয়ে মিষ্টি খাইয়েছিলো যাকে, তাঁকে নিয়ে এতোবড়ো দুঃসংবাদ শুনতে প্রস্তুত নয় সে। আর রাজীবের প্রচণ্ড ফ্যান প্রান্তিক, যে আঙ্কেল বাসায় এলে পড়াশুনা বাদ দিয়ে মজার মজার গল্প শুনতে চলে আসে চুপি চুপি, এরকম মজার আঙ্কেলকে কারা খুন করবে কেন খুন করবে তা হতবাক ওর কৈশোরিক হিসাবে মিলছে না কোনমতেই ! ওই চমৎকার আঙ্কেলটি আর কোনদিন এ বাসায় আসবে না এটা কী করে হয় ! নিয়ন্ত্রণহীন আবেগের উদ্গীরণে এটা খেয়াল করার অবস্থা রইলো না যে, একটা স্বপ্নময় কিশোরের মনোজগতটা কী দুর্মর অপঘাতে ভেঙে খানখান হয়ে গেলো !
 .
Mirror Image of Ahmed Rajib Haider. Shahbagh 08-02-2013বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের লিফটে।
Mirror Image of Ahmed Rajib Haider. Shahbagh 08-02-2013
বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের লিফটে।
.
(৪)
বুকের ভেতরে আমার অসম্ভব একটা পাথর জমে বসে গেছে। সেই একাত্তরে মায়ের মরদেহের পাশে দাঁড়িয়ে শৈশবের চোখে বুঝে উঠতে পারিনি আমার বাবা এমন পাগলের মতো কাঁদছিলেন কেন ! তাঁকে তো আমার ছোট্ট জীবনে আর কখনো এরকম কাঁদতে দেখিনি ! মৃত্যু কী সেটা বুঝতে পারিনি বলেই হয়তো তখন কান্না আসেনি, শুধু অন্য যেকোন দিনের চেয়ে অন্যরকম একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে কেবল ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থেকেছি। কে যেন আমাকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো। তারপর বড় হতে হতে টের পেতে শুরু করেছি যে বুকের ভেতরে ছোট্ট জমাট একটা পাথর দিনে দিনে বড় হচ্ছে। বড় হতে হতে সেটা আমার অস্তিত্বকেই গ্রাস করে বসে আছে। ওই পাথরটাই বুঝি এবার ফের গলাতে শুরু করেছিলো এই প্রজন্মের সন্তানেরা তাদের শব্দভেদী শ্লোকের দুর্বিনীত উচ্চারণ দিয়ে। কিন্তু আচমকা হঠাৎ এই বড়োসড়ো ধাক্কাটা এসে গোটা বুকটাকে বুঝি আবার অনড় পাথর বানিয়ে দিলো ! রাজীবের মায়ামাখা মুখটা থেকে থেকে মনে আসতেই কী এক দুর্বহ কষ্টে শ্বাস-প্রশ্বাস থেমে যাচ্ছে বারেবারে ! যদি একটু কাঁদতে পারতাম, ভালো হতো খুব। কিন্তু তা তো হচ্ছে না !  প্রিয় রাজীব, ভাই আমার, এ ভার আমি বইতে পারছি না ! আমাকে বলে দাও ভাই, এখন আমি কী করবো !
 .
ঘোরের বশেই কখন যে অনলাইন থেকে বেরিয়ে গেছি জানি না ! একটা অস্থির যন্ত্রণা নিয়ে বিছানায় গেছি, ঘুমের মধ্য দিয়েই নাহয় এ যন্ত্রণা ভুলে থাকবো। কিন্তু বিছানায় গা এলাতেই বুকের পাথরটা আরো বেশি করে চেপে বসে। দমবন্ধ হয়ে আসে। পাশ ফিরে চেষ্টা করি। নাহ্, উঠে বসি, আবার এলিয়ে পড়ি। জানিনা কখন তন্দ্রায় গেছি, চমকে আবার চোখ খুলি। কয়েক বছরের নিয়ম ভেঙে খুব সকালেই ঘুম ভেঙে গেলো আমার ! সত্যিই ঘুমিয়েছিলাম কি ! জানি না। আবার চেষ্টা করলাম ঘুমোতে। অর্থহীন ! বহুকাল পর এই প্রথম আমার ঘুম ভাঙার পরে সকালের পত্রিকা এলো। বিশাল হেডিংয়ে রাজীব হায়দারের খবর, ওর সেই সহজ-সরল মুখটা ! খবরের ভেতর আর পড়া হয় না, ওর মুখের দিকে চেয়ে থাকি। যেন আমার পাশেই বিছানাটায় হেলান দিয়ে সে বসে আছে ! এখনি কথা বলে উঠবে তাঁর চিরাচরিত কোমল কণ্ঠে ! কিন্তু কোন কথা বলে না সে। কয়েক বছরের মধ্যে এই প্রথম নিজে থেকেই টিভির সামনে গিয়ে বসে পড়ি।
 .
ভালো লাগছে না কিছুই। কত ঘণ্টা কেটেছে জানি না। সান্ত্বনাহীন বুকের ভার চেপে বসে আছে। টিভিতে পত্রিকায় ওর ছবিটা ভেসে উঠে বারবারই। আর সাথে সাথে পাথরটাও ভেতরে নড়াচড়া শুরু করে দেয়। এভাবে অনড় হয়ে বসে থাকাও সম্ভব হচ্ছে না আর। কোন একটা কাজে ঠেলে দিতে হবে। কিন্তু কী করবো ? আয়নায় নিজের ভয়ঙ্কর বিধ্বস্ত চেহারা দেখে আঁতকে ওঠলাম নিজেই ! হঠাৎই সিদ্ধান্ত নিলাম চুল কাটাবো। হনহন করে বেরিয়ে গেলাম, সেলুনে সিরিয়াল দিয়ে বসে পড়লাম। মাথার মধ্যে একটা উল্টাপাল্টা কিছু ডলা দেয়া উচিৎ। একসময় চুল কাটানো শেষ করে বাসায় ফিরে শার্ট-প্যান্ট খুঁজছি, ধোলাই করতে হবে। জামাত-শিবিরের খুনিদের হাতে নির্মমভাবে নিহত ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারের জানাজা হবে শাহবাগের চত্বরে। তাঁর মরদেহ সামনে রেখে শপথ নেবে তরুণ প্রজন্ম। থেকে থেকে টিভি নিউজ কানে আসছে। শপথ, কঠিন শপথ নিতে হবে !
 .
অনলাইনে নাকি রাজীবের নামে কুৎসা রটাচ্ছে জামাত-শিবিরের খুনি ও দোসররা। ধর্ম কি কাউকে এতোটাই পশু বানাতে পারে যারা একজন মুক্তমনা মানবিক মানুষকে খুন করে আবার তাঁর মৃত্যুতে পৈশাচিক উল্লাস করে ! তখনই মনে হলো একজন রাজীব সম্পর্কে কে কী জানে জানি না, কার কাছে কী স্মৃতি আছে তাও জানি না। কিন্তু এটা জানি, রাজীবের স্মৃতি আমাকে সমৃদ্ধ করেছে, ঋণী করেছে। এ ঋণ অপরিশোধযোগ্য। তবু এ ঋণের কথাটাই আমাকে বলতে হবে। নইলে অকৃতজ্ঞ আমি এ দায় থেকে মুক্ত হতে পারবো না কখনোই। ক্ষমাহীন অপরাধবোধ আমাকে তাড়িয়ে বেড়াবে চিরকাল। হাঁ, সিদ্ধান্ত নিলাম, আমাকে কিছু একটা লিখতে হবে এই বুকের ভার নামাতে। অমনি ভেতরে পাথরটা আবারো নড়েচড়ে উঠছে। টের পাচ্ছি, কিরকম একটা ভয়াল নিম্নচাপ তৈরি হচ্ছে বুকের ভেতর। ধীর পায়ে এসে বসে গেলাম টেবিলে। আজ অন্য সব কাজ স্থগিত, এখন একটাই কাজ আমার। আহমেদ রাজীব হায়দার, ভাই আমার, তোমার স্মৃতির ভার বইতে পারছি না আমি ! বইতে পারছি না কোনভাবেই ! হঠাৎ চারদিক কাঁপিয়ে গুমরে গুমরে উঠলো শরীর ! বিকট শব্দে একটা বাধ ভেঙে গেলো যেন ! প্রবল বন্যার তোড়ে ফেঁটে চৌচির হয়ে গেলো স্তব্ধ হয়ে থাকা দুই চোখ। কী লিখবো আর, কিছুই ভেবে পাচ্ছি না। অথচ রাজীবের সাথে আমার অনেক অনেক স্মৃতি ! লিখতে পারছি না কিছুই। কেবল কীবোর্ডটা ভেসে যাচ্ছে গলে যাওয়া পাথরে পাথরে… !
 .
Rajib Haider with his Laptop, Shahbagh Chattar, 08-02-2013.
Rajib Haider with his Laptop, Shahbagh Chattar, 08-02-2013.
.
(৫)
নিজের যোগ্যতার প্রতি মোটেও সুবিবেচনা করে নি রাজীব। বহু বহু বিষয়ে বৈদগ্ধ্য থাকলেও তাঁকে অনেকবার বলেছি সেগুলো নিয়ে লিখতে। সবিনয়ে এড়িয়ে গেছে সে। বলেছে, দাদা, যে কাজটা সম্পন্ন না হলে শেষপর্যন্ত সবকিছুই অর্থহীন, সে কথা ভাবলে আর কিছু ভালো লাগে না। ওসব লিখার জন্যে তো আপনারাই আছেন।
চার্বাক নিয়ে বড়সড় কাজ শুরু  করেছি বলে প্রতিনিয়ত আমাকে উৎসাহ দিয়ে গেছে সে। মূলত এই কাজের সুবাদেই তাঁর সাথে আমার পরিচয়ের সূত্রপাত। মাঝে মাঝে বলতাম তাঁকে, এই চাপ মনে হয় নিতে পারছি না আমি। আমাকে সাহস দিয়ে বলতো, কাউকে না কাউকে তো দায়িত্ব নিতেই হয় দাদা। আপনি ধীরে ধীরে করেন, তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। আমরা সেযাবৎ অপেক্ষা করবো। তাঁকে বলেছিলাম, সংস্কৃতে বার্হস্পত্য-সূত্র শতকের বাংলা তর্জমা নিয়ে আটকে আছি। কিছু কিছু সম্ভব হয়েছে, কিন্তু বাকিগুলো তর্জমা না হলে কাজটা অপূর্ণ থেকে যাবে। আমাকে কথা দিয়েছিলো, কলকাতায় তাঁর পরিচিত যোগ্য লোক আছেন, যোগাযোগ করে একটা ব্যবস্থা করা যাবে। নির্ভার হয়ে আমি অন্য কাজে মনোনিবেশ করেছি। কিন্তু এখন কে আমাকে ফের রাজীবের মতো নির্ভার করবে আরেকটি কাজে ডুব দেয়ার জন্যে !
 .
আত্মপ্রচার বিমুখ রাজীব পথ চলতে চলতে কতশত বিচিত্র বিষয় সামনে পেলেই মোবাইল-ক্যামেরায় ধারণ করে নিতো অদ্ভূত অদ্ভূত সব ছবি। ফেসবুকে ‘থাবাগফুর কম্পোজিশন’ নামে সেগুলোর একটা অসাধারণ সিরিজ পোস্ট করতো। বলতো সে, এগুলোতে স্থপতির দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব আছে, তাই অন্য কারো সাথে তাঁর ফটোগ্রাফিক দৃষ্টি মিলবে না। অথচ নিজের কোন ছবি তুলতে খুব উৎসাহী ছিলো না কখনোই। ফলে তার খুব একটা ছবিও তোলা হয়নি আমার। তবু রাজীবের সাথে সর্বশেষ ০৮ ফেব্রুয়ারি গোটা যে দিনটি কাটালাম, শাহবাগ আন্দোলনের বিভিন্ন বৈচিত্র্যের ছবি তুলতে তুলতে তাঁরও কয়েকটা ছবি এসে গিয়েছিলো আমার বিভিন্ন শটে। সেগুলোই আজ অমূল্য স্মৃতি হয়ে গেছে আমার কাছে।
 .
আমি জানি না, রাজীবের মৃত্যু আমাদেরকে অপরাধী করে দিয়ে গেলো কিনা। তবে আমাদেরকে সে এক কঠিন শপথের শিসায় বেঁধে দিয়ে গেছে ঠিকই। শাহবাগের মহান চত্বরে ইতিহাসের বৃহত্তম জানাজায় উপস্থিত হয়ে প্রজন্ম আন্দোলনের প্রথম শহীদ হিসেবে অমর অক্ষরে লেখা হয়ে গেলো আহমেদ রাজীব হায়দার শোভনের নাম। খুব কাছে থেকে নিবিড়ভাবে তাঁকে দেখেছি বলে সে আজ নেই একথার কোন সান্ত্বনা পাচ্ছি না এখনো। তবুও নিজেকে সান্ত্বনার ভাষায় প্রবোধ দেই, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের আঁচলের নিচেই ইতিহাসের যোগ্য এক প্রজন্ম সন্তান হিসেবে রাজীব হায়দারের নাম অক্ষয় অমর হয়ে থাকবে। যোগ্য মায়ের সুযোগ্য সন্তান তো সে-ই ! তারুণ্যের চিরায়ত প্রেরণার উৎস হয়ে বাঙালির আন্দোলন-সংগ্রামে বেঁচে থাকবে রাজীব হায়দার। সে হবে আমাদের আরেকটি শপথের নাম।
 .
মৃত্যু সবারই হয়, হবে। কিন্তু জাতীয় শহীদের অক্ষয় মর্যাদা নিয়ে ক’জন অমর হতে পারে ! বাঙালির দ্রোহের সুরে আহমেদ রাজীব হায়দার তাঁর যোগ্যতা দিয়েই সেই অমরত্ব অর্জন করে আমাদেরকে আরো সাহসী করে দিয়ে গেলো। শাহবাগ আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনের মধ্য দিয়ে একদিন এই শাহবাগ চত্বর রাজীব হায়দারের স্মৃতি মেখে পরিচিতি পাবে ইতিহাসের অমোচনীয় পৃষ্ঠায়। তাই বেদনা ভারাক্রান্ত বুকে আমি আজ গর্বিত যে, রাজীবের মতো এমন একটি ভাই ও বন্ধু পেয়েছিলাম। এ আমার নিজস্ব অহঙ্কার !
(১৬-০২-২০১৩)

No comments: