Monday, July 29, 2013

| মীমাংসা দর্শন-১৮ : মীমাংসায় ভাববাদ-খণ্ডন |

.
| মীমাংসা দর্শন-১৮ : মীমাংসায় ভাববাদ-খণ্ডন |
রণদীপম বসু

৪.৫ : মীমাংসায় বাহ্যবস্তুবাদী যুক্তিতে ভাববাদ-খণ্ডন


ভারতীয় দর্শন জগতে মীমাংসাদর্শনকে আপাতদৃষ্টিতে একটি কূহেলিকাময় দর্শন বলা চলে। যজ্ঞকর্ম থেকে যজ্ঞফল হিসেবে প্রাপ্ত অপূর্বশক্তি নামের এক আদিম জাদুবিশ্বাসকে সমর্থন ও উৎসাহের মাধ্যমে সৃষ্ট এই দর্শন একদিকে যেমন প্রচণ্ড গোঁড়ামিতে পূর্ণ, অন্যদিকে ঈশ্বর দেবতা ইত্যাদি কোনো অলৌকিক সত্তায় অস্বীকার করে লৌকিক সত্তায় বিশ্বাসী বাহ্যবস্তুবাদী অবস্থানে নিজেকে প্রতিষ্ঠায় ব্রতি হয়েছে। এর পেছনে মীমাংসকদের যুক্তিগ্রাহ্যতা হলো, প্রত্যক্ষসিদ্ধ বহির্জগৎ বাস্তব বা যথার্থ না হলে যজ্ঞকর্ম, যজ্ঞফল প্রভৃতি সবই অর্থহীনতায় পর্যবসিত হবার আশঙ্কা।

তাই মীমাংসক কুমারিলভট্টের বক্তব্য হলো- ‘জ্ঞান যদি নিরালম্বন হয়- অর্থাৎ বহির্জগৎ বলে তার যদি অবলম্বন না থাকে- তাহলে মীমাংসা-দর্শনের সমস্ত আলোচনাই যুক্তিহীন হবে’ ( শ্লোকবার্তিক, নিরালম্বনবাদ, কারিকা ১-৩)।
কিংবা ‘সবই যদি স্বপ্নতুল্য হয় তাহলে যজ্ঞলব্ধ সুখও স্বপ্নসুখের অনুরূপ হবে; কিন্তু স্বপ্নসুখের আশায় বুদ্ধিমান ব্যক্তি নিদ্রাগমন করবে, আয়াসসাধ্য যজ্ঞকর্মের আয়োজন করবে কেন ? অতএব মীমাংসকের পক্ষে সুদৃঢ় যুক্তির সাহায্যে প্রমাণ করা প্রয়োজন যে বহির্জগতের বাস্তব সত্তা বর্তমান’ ( শ্লোকবার্তিক, নিরালম্বনবাদ, কারিকা ১২-১৩)। এই প্রেক্ষিতেই মীমাংসা-দর্শনে ভাববাদ-খণ্ডনের প্রয়োজনীয়তা উল্লিখিত হয়েছে।

যদিও সূত্রকার মহর্ষি জৈমিনির মীমাংসাসূত্রে ভাববাদ-খণ্ডনের কোনো সুস্পষ্ট আয়োজন চোখে পড়ে না, এক্ষেত্রে ন্যায়-দার্শনিক গঙ্গানাথ ঝা’র মন্তব্য হলো, ‘প্রাচীন যাজ্ঞিকদের পক্ষে হয়তো তার প্রয়োজনও ছিলো না। আদিম জাদুর উপযোগিতা তাঁদের কাছে স্বতঃসিদ্ধ বলেই প্রতীত হওয়া সম্ভব। কিন্তু কালক্রমে দেশে ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির উদ্ভব হয়েছে, আয়োজন হয়েছে দার্শনিক বিচারের সাহায্যে বহির্জগতের যথার্থ্য প্রত্যাখ্যান করবার। অতএব মীমাংসকদের পক্ষেও প্রয়োজন হয়েছে দার্শনিক বিচারের সাহায্যেই এই ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির খণ্ডন। তাই পরবর্তী কালের প্রায় সমস্ত মীমাংসকদের রচনায় ভাববাদ-খণ্ডনের আয়োজন দেখা যায়।’ (সূত্র: দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-২৬২)


এখানে স্মর্তব্য যে, কোনো এক আদিম বিশ্বাসের সমর্থন-উৎসাহই মীমাংসা-দর্শনে ভাববাদ-খণ্ডনের উৎস হলেও এই প্রসঙ্গে মীমাংসকদের আলোচনার স্বকীয় দার্শনিক মূল্য কোনোভাবেই উপেক্ষণীয় নয়। কেননা, সেই আদিম বিশ্বাসটির প্রতি মোহ আজকের দিনে অবশ্যই বিলুপ্ত হলেও ভাববাদের প্রভাব আজও বহুলাংশেই অপ্রতিহত। তাছাড়া সুপ্রাচীন কালেই ভারতীয় দর্শনে ভাববাদীদের পক্ষ থেকে ভাববাদ-সমর্থনের অত্যন্ত মৌলিক যুক্তিগুলিই প্রস্তাবিত হয়েছে; অতএব মীমাংসকেরাও দার্শনিক ভাববাদের মূল ভিত্তিটিকেই দার্শনিক বিচারের বিষয় করেছিলেন। সে-বিচারের দার্শনিক গুরুত্ব আজও প্রধানাংশেই অক্ষুণ্ন আছে। এ পর্যায়ে মীমাংসা-দর্শনে ভাববাদ-খন্ডনের আলোচনায় পণ্ডিত দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ‘ভারতীয় দর্শন’ গ্রন্থের ‘বৈদিক দর্শন : (১) পূর্বমীমাংসা’ পরিচ্ছেদটি যথেষ্ট গুরুত্ব বিবেচনায় তা থেকে অকুণ্ঠ সহায়তা নেয়া হয়েছে।


প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ভারতীয় দর্শনে বাহ্যবস্তুবাদী বা ভাববাদ-বিরোধী ঐতিহ্যে মীমাংসা ছাড়া আর গুরুত্বপূর্ণ অবদান বলতে ন্যায়-বৈশেষিক সম্প্রদায়ের। ন্যায়বৈশেষিকের পক্ষ থেকেও সুবিস্তৃতভাবে ভাববাদ-খণ্ডনের আয়োজন হয়েছে। এদিক থেকে দুটি সম্প্রদায়কে সমানতন্ত্র বললেও অত্যুক্তি হবে না। স্বভাবতই মীমাংসক এবং ন্যায়-বৈশেষিকের ভাববাদ-খণ্ডনের যুক্তি বহুলাংশেই সমজাতীয়। অন্যদিকে প্রাচীন ভারতীয় দর্শনের ভাববাদের গুরুত্ব সংক্রান্ত নানান অতিশয়োক্তি সত্ত্বেও ভাববাদী-দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় প্রকৃতপক্ষে মাত্র তিনটি সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ- বৌদ্ধ মাধ্যমিক, বৌদ্ধ যোগাচার এবং বেদান্ত বা অদ্বৈতবেদান্ত। উল্লেখ্য, বৌদ্ধ সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক সম্প্রদায়ের বাহ্যবস্তুবাদ এবং বৌদ্ধ যোগাচার ও মাধ্যমিক সম্প্রদায়ের ভাববাদ অবশ্যই পরস্পর-বিরুদ্ধ। তাই ভাববাদ-খণ্ডনের আলোচনা উত্থাপনের সুবিধার্থে ভাববাদের সাধারণ পরিচয় জানা আবশ্যক।

বৌদ্ধ যোগাচার-দর্শনের নাম বিজ্ঞানবাদ। ‘বিজ্ঞান’ মানে কী ? বিজ্ঞানবাদী বৌদ্ধ-সম্প্রদায়ের মতে বিজ্ঞানেরই অপর নাম চিত্ত। ‘বিংশতিকারিকা’র বৃত্তির প্রারম্ভে প্রখ্যাত বৌদ্ধ আচার্য বসুবন্ধু বলেন-
‘চিত্তং মনোবিজ্ঞানং বিজ্ঞপ্তিশ্চেতি পর্যায়াঃ।’
অর্থাৎ : চিত্ত, মন, বিজ্ঞান ও বিজ্ঞপ্তি- এই চারটি পর্যায় শব্দ, অর্থাৎ সমানার্থক।

মহামহোপাধ্যায় ফণিভূষণ তর্কবাগীশ বৌদ্ধ যোগাচার বোঝাতে বলেন, ‘যোগাচার-মতে বিজ্ঞানই একমাত্র সত্য; অতএব পরিদৃশ্যমান জগতের বহির্জগৎ হিসেবে কোনো স্বাধীন সত্তা নেই। চিত্ত বা মন বা বিজ্ঞানই জ্ঞেয়-বিষয় ( বেদ্য), জ্ঞাতা ( বেদক) এবং জ্ঞানক্রিয়া ( বেদনা)- এই তিনের কাজ করে। জ্ঞান ছাড়া কেউই কোনো বিষয়ের সত্তা সমর্থন করতে পারেন না। কারণ, জ্ঞানে আরোহণ না করলে কোনো বিষয়েরই প্রকাশ হয় না। তা-ই বস্তুত জ্ঞেয়। অন্তর্জ্ঞেয় জ্ঞানই বাহ্য আকারে প্রকাশিত হয়। বস্তুত তা বাহ্যপদার্থ নয়। কল্পিত বাহ্যপদার্থেই অন্তর্জ্ঞেয় পদার্থের ভ্রম হয়- স্বপ্নদর্শনের মতো, বা স্থানুতে পুরুষদর্শন, রজ্জুতে সর্পদর্শন, শুক্তিতে রজতদর্শনের মতোই ভ্রম হয়। তাহলে স্বপ্ন-প্রতীতির মতো জাগ্রত-প্রতীতিও ভ্রম। কোনো জ্ঞানই যথার্থ নয়, তাই প্রমাণেরও সত্তা নেই। প্রমাণ-প্রমেয় ভাব কাল্পনিক। বাস্তব নয়। কিন্তু বিজ্ঞানের সত্তা স্বীকার্য। কারণ তা স্বতঃপ্রকাশ। অনাদি সংস্কারের বৈচিত্র্যবশতই অনাদিকাল থেকে অসংখ্য বিচিত্র বিজ্ঞানের উৎপত্তি হয়। এই সমস্ত বিজ্ঞান প্রত্যেকেই ক্ষণকালমাত্র স্থায়ী। কারণ ‘সর্বং ক্ষণিকং’। পূর্বজাত বিজ্ঞান পরক্ষণেই অপর বিজ্ঞান উৎপন্ন করে বিনষ্ট হয়। অনাদিকাল থেকে এইভাবে বিজ্ঞান-প্রবাহ চলছে। তার মধ্যে ‘অহং মম’ অর্থাৎ আমি বা আমার ইত্যকার বিজ্ঞান-সন্তানের নাম আলয়বিজ্ঞান- এই হলো আত্মা। বাকি সমস্ত বিজ্ঞানের নাম প্রবৃত্তিবিজ্ঞান। যেমন, নীল, পীত, ঘট, পট, ইত্যাদি আকার বিজ্ঞান। অতএব এই আকারগুলি জ্ঞানেরই আকার, বিজ্ঞানেরই আকার; তথাকথিত কোনো বহির্বস্তুর আকার নয়। আলয়বিজ্ঞান থেকেই প্রবৃত্তিবিজ্ঞানতরঙ্গ উৎপন্ন হচ্ছে। নাম আলয়বিজ্ঞান, কেননা এই হলো সমস্ত বিজ্ঞান এবং কল্পিত সর্র্বধর্মের মূল।’ (ন্যায়দর্শন- ৫/১৭৭-৮)।

বৌদ্ধ মাধ্যমিক-দর্শনের নাম শূন্যবাদ। শূন্যবাদের ব্যাখ্যায় সাধারণত বলা হয় সবই অলীক- বহির্বস্তু তো নেইই, এমনকি জ্ঞানও নেই। অন্তর্বস্তুও নেই, বহির্বস্তুও নেই, কিছুই নেই, সবই শূন্য। কিন্তু শূন্যবাদের এই ব্যাখ্যা ঠিক কিনা সে-বিষয়ে সংশয় আছে। কেননা ‘এই মতে নাস্তিতাই শূন্যতা নয়, অর্থাৎ শূন্যের অর্থ অসৎ নয়। সৎও নয়, অসৎও নয়, সৎ ও অসৎ উভয় প্রকারও নয়, সৎ ও অসৎ ভিন্ন কোনো প্রকারও নয়- এ জাতীয় চতুষ্কোটিবিনির্মুক্ত শূন্যকেই শূন্যবাদীরা ‘তত্ত্ব’ বলেছেন। এই শূন্যই পারমার্থিক সত্য। অতএব শূন্যবাদ মানে সর্বশূন্যতাবাদ বা সর্বাসত্ত্ববাদ নয়।’ (ন্যায়দর্শন- ৫/১৭৫-৬)
কিন্তু শূন্যবাদের যে ব্যাখ্যাই গ্রহণ করা যাক না কেন, একটি বিষয়ে সন্দেহ নেই যে, এই দর্শন অনুসারেও বাহ্যবস্তু বা বহির্জগৎ বলে কিছুর প্রকৃত সত্তা নেই। অতএব লোকব্যবহার-মূলক সমস্ত জ্ঞানই ভ্রম। অতএব প্রমাণ-প্রমেয় ব্যবহার কাল্পনিক।

শূন্যবাদীদের মতে চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত শূন্যই যদি পারমার্থিক সত্য হয় তাহলে অদ্বৈতবেদান্তবাদীদের ব্রহ্মর সঙ্গে তার পার্থক্য খুব সুস্পষ্ট হয় না। যদিও মহামহোপাধ্যায় ফণিভূষণের মতে (ন্যায়দর্শন-৫/১৭৭) ‘শূন্যবাদী মাধ্যমিক-সম্প্রদায়ের স্বীকৃত তত্ত্ব শূন্যই শঙ্করের ব্যাখ্যাত ব্রহ্মতত্ত্ব, ইহাও কোনোরূপে বলা যায় না।’ অদ্বৈতবাদের মূল বক্তব্য প্রকাশ করতে গিয়ে শঙ্করাচার্য বলেছেন- ‘ব্রহ্ম সত্যং জগন্মিথ্যা জীবো ব্রহ্মৈব নাপরঃ’- অর্থাৎ, ব্রহ্ম সত্য, জগৎ মিথ্যা এবং জীব ব্রহ্মস্বরূপ।
এবং ব্রহ্মের স্বরূপ প্রকাশ করতে গিয়ে সকল ব্রাহ্মণ্যদর্শনের দিক্পাল ও অদ্বৈতমতের ভামতী সম্প্রদায়ের প্রবক্তা বাচস্পতি মিশ্র ‘ভামতি’ গ্রন্থে বলেন-
‘যদ্যপি চ কূটস্থনিত্যস্য অরিণামিন উদাসীন্যম্ অস্য বাস্তবম্, তথাপি অনাদ্যনির্বচনীয়াবিদ্যাবচ্ছিন্নস্য ব্যাপারবত্ত্বমবভাসতে ইতি কর্তৃত্বোপপত্তিঃ।… বহুভির্বচোভির্ব্রহ্মাতিরিক্তস্য প্রপঞ্চস্য প্রতিষেধাচ্চেতনঃ উপাদান-মেব জগত্, ভুজঙ্গ ইব আরোপিতো রজ্জূপাদান ইতি সিদ্ধান্তঃ। (ভামতী, পৃ-১৬৫-৮)
অর্থাৎ : যদিও কূটস্থ নিত্য অপরিণামী ব্রহ্মের ঔদাসীন্যই বাস্তব (অর্থাৎ বাস্তবে তার পক্ষে বহু হবার কথা চিন্তা করা অসম্ভব, কারণ শুদ্ধ ব্রহ্ম ক্রিয়াকারকবর্জিত। তাই চিন্তা করার কর্তৃত্ব ব্রহ্মে বর্তাতে পারে না), তথাপি অনাদি অনির্বচনীয় (মিথ্যা) অবিদ্যার দ্বারা মিথ্যাভাবে পরিসীমিত বা প্রভাবিত ব্রহ্মে মিথ্যা ক্রিয়া অবভাসিত হয়। এভাবে ব্রহ্মে চিন্তনক্রিয়ার কর্তৃত্ব উপপন্ন হতে পারে।… ব্রহ্মব্যতিরিক্ত বিশ্বপ্রপঞ্চ শাস্ত্রে প্রতিষিদ্ধ (অর্থাৎ ব্রহ্মের অতিরিক্ত কোনোকিছুর বাস্তব অস্তিত্ব নেই)। তাই একমাত্র সত্য ব্রহ্ম এই মিথ্যা জগতের উপাদান কারণ (অর্থাৎ চৈতন্যস্বরূপ এক ব্রহ্ম মিথ্যা বহু বিচিত্র বিশ্বরূপে প্রতিভাত হচ্ছে), রজ্জু যেমন মিথ্যা আরোপিত সর্পের উপাদান (অর্থাৎ মিথ্যা সর্পরূপে অবভাসিত হয়)। এই হলো অদ্বৈত সিদ্ধান্ত (একেই সংক্ষেপে বলে ‘বিবর্তবাদ’)। (সূত্র: মহামহোপাধ্যায় হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়, বৈদিকধর্ম ও মীমাংসা-দর্শন, পৃষ্ঠা-৮৫)

উল্লেখ্য, অদ্বৈতবাদে যাকে সৎ, অসৎ ও সদসৎ- কোনোরূপেই নির্দেশ করা যায় না, তাই ‘অনির্বচনীয়’। এরকম অনির্বচনীয় মায়া বা অবিদ্যার দ্বারা মিথ্যাভাবে পরিসীমিত বা প্রভাবিত ব্রহ্মে মিথ্যা জগত অবভাসিত হয়। এর সাথে শূন্যবাদীদের চতুষ্কোটি বিনির্মুক্ত শূন্যের পার্থক্য স্পষ্ট নয় বলেই কেউ কেউ অদ্বৈবাদীদেরকে প্রচ্ছন্ন বৌদ্ধ বলেও কটাক্ষ করে থাকেন। যদিও বৌদ্ধ ভাববাদ এবং বৈদান্তিক ভাববাদকে দার্শনিক ভাববাদ হিসেবে সমানতন্ত্র বিবেচনা করার একটি বড়ো বাধা হলো, স্বয়ং শঙ্করাচার্য, অনেকটা বিভ্রান্তিকর মনে হলেও, বৌদ্ধ-মত খণ্ডনকে সামগ্রিক রূপ দেবার উদ্দেশ্যে তাঁর ‘শারীরক-ভাষ্যে’ ভাববাদ-বিরোধী বা বাহ্যবস্তুবাদী সর্বাস্তিবাদের মতোই ভাববাদী বিজ্ঞানবাদ ও শূন্যবাদেরও খণ্ডন করেছেন। অথচ ‘ব্রহ্ম সত্য, জগত মিথ্যা’ অনুসারী শঙ্কর প্রকৃতই ভাববাদী।

তবে অদ্বৈতবাদী শঙ্করাচার্য বহির্জগতের পারমার্থিক সত্তা অস্বীকার করলেও অনেকটা বাধ্য হয়েই বোধকরি বহির্জগতের ব্যবহারিক সত্তা স্বীকার করেছেন। তাঁর মতে, যদিচ পারমার্থিক দৃষ্টিকোণ থেকে একমাত্র আত্মন্ বা ব্রহ্মন্ই সত্য, তবুও ব্যবহারিক দৃষ্টিকোণ থেকে জগতের- অতএব অনুভূতি-লব্ধ বস্তুর- সত্তা বর্তমান। এই বস্তু অজ্ঞানোৎপন্ন হলেও বন্ধ্যাপুত্রের মতো অলীক নয়, রজ্জুসর্পের মতো প্রাতিভাসিক নয়; যা অলীক তার কোনো অনুভূতিই হয় না, যা প্রাতিভাসিক সংসারদশাতেই তার জ্ঞান বাধিত হয়- কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞানের পূর্ব পর্যন্ত ব্যবহারিক সত্তার নিরসন হয় না।
কিন্তু এখানে স্মর্তব্য যে, মিথ্যা হিসেবে রজ্জুসর্প জাতীয় প্রাতিভাসিক সত্তা ব্যবহারিক সত্তার তুলনায় আরো বেশি মিথ্যা বলে স্বীকৃত হলেও শঙ্করমতে এই ব্যবহারিক সত্তা প্রাতিভাসিকের তুলনায় কোনো অংশে বেশি সত্য বলে স্বীকৃত হতে পারে না। পারমার্থিক সত্তাই একমাত্র সত্য; প্রাতিভাসিক সত্তার মধ্যে লেশমাত্র সত্য নেই, ব্যবহারিক সত্তার মধ্যেও নয়। কেননা, উভয়েই অবিদ্যা বা অজ্ঞান বা মায়ার পরিণাম। এই কারণেই শঙ্কর-মতের ব্যাখ্যায় আধুনিক বিদ্বানেরা সাধারণত বলে থাকেন, মিথ্যার তারতম্য আছে, কিন্তু তাকে সত্যের তারতম্য বলা যায় না।

এই ব্যবহারিক সত্তার কথা শুধুমাত্র শঙ্কর বেদান্তরই বৈশিষ্ট্য নয়। বৌদ্ধ ভাববাদীরাও নামান্তরে একই কথা উল্লেখ করেছেন। অতএব এদিক থেকেও বৌদ্ধ ভাববাদ এবং বৈদান্তিক ভাববাদের মধ্যে প্রভেদ নির্ণয় করা যায় না। বিজ্ঞানবাদী এবং শূন্যবাদী উভয়েই ‘সাংবৃত’ সত্য বা ‘সংবৃতি’ সত্য নামে এই ব্যবহারিক সত্যের কথাই স্বীকার করেছেন। এ প্রেক্ষিতে মহামহোপাধ্যায় ফণিভূষণ বলেন- ‘সৎ বলিয়া লৌকিক বুদ্ধির বিষয় পদার্থ কাল্পনিক সত্য। উহাকে ‘সাংবৃত’ সত্যও বলা হইয়াছে। বৌদ্ধগ্রন্থ ও উহার প্রতিবাদ-গ্রন্থে অনেক স্থলে ‘সংবৃতি’ ও ‘সাংবৃত’ শব্দের প্রয়োগ দেখা যায়। লৌকিক বুদ্ধিরূপ অবিদ্যা বা কল্পনাকেই ‘সংবৃতি’ বলা হইয়াছে। সুতরাং কাল্পনিক সত্যকেই ‘সাংবৃত’ সত্য বলা হইয়াছে।’ (ন্যায়দর্শন-৫/১৭৬)। এ বিষয়ে শূন্যবাদী মাধ্যমিক কারিকায় উক্ত হয়েছে-
‘দ্বে সত্যে সমুপাশ্রিত্য বুদ্ধানাং ধর্মদেশনা।
লোকসংবৃতিসত্যঞ্চ সত্যঞ্চ পরমার্থতঃ।।’- (সূত্র: ফণিভূষণ ‘ন্যায়দর্শন’-৫/১৭৭)
অর্থাৎ : বুদ্ধের ধর্মোপদেশে দুটি সত্যের উপস্থিতি রয়েছে। একটি লৌকিকবুদ্ধিরূপ সংবৃতি সত্য, অন্যটি পারমার্থিক সত্য। (মুক্ত তর্জমা)

এবং মীমাংসক কুমারিলও বৌদ্ধ ভাববাদের বা বিজ্ঞানবাদের ব্যাখ্যাকে পূর্বপক্ষ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন এভাবে-
‘যদা সংবৃতিসত্যেন সর্বমেতৎ প্রকল্প্যতে।
জ্ঞানমাত্রেহপি কস্মাদ্বো বৃথাগ্রহোহর্থকল্পনে।।’- ( শ্লোকবার্তিক, নিরালম্বনবাদ, কারিকা-৫)
অর্থাৎ : একমাত্র জ্ঞানকে সত্য বলে মানলেও এই সমস্ত কিছুকে (অর্থাৎ, সাধারণত যাকে বহির্জগৎ বলে মানা হয়, তাকে) ‘সংবৃতি সত্য’ বলে ব্যাখ্যা করা সম্ভব; অতএব তোমরা অনর্থক জ্ঞানের বিষয় হিসেবে বাহ্যবস্তুর কল্পনা কর।

বৌদ্ধ ভাববাদীর এই সংবৃতি সত্য এবং বৈদান্তিকদের ব্যবহারিক সত্যর মধ্যে বাস্তবিকই বিশেষ কোনো পার্থক্য নেই; অতএব বৈদান্তিকেরা ব্যবহারিক সত্যর উল্লেখ করেন বলেই তাঁদের ভাববাদ বৌদ্ধ ভাববাদ থেকে স্বতন্ত্র- একথাও বলা যায় না বলে পন্ডিত দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের অভিমত (ভারতীয় দর্শন, পৃ-২৬৮)। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, বাহ্যবস্তুবাদীর দৃষ্টিকোণ থেকে এই ব্যবহারিক সত্য বা সংবৃতি সত্যের পরিকল্পনাকে মীমাংসক কুমারিলভট্ট তীব্রভাবেই সমালোচনা করেছেন। তিনি ( শ্লোকবার্তিক, নিরালম্বনবাদ, কারিকা ৬-১০) বলছেন-
‘সংবৃতের্ন তু সত্যত্বং সত্যভেদঃ কুতোহন্বয়ম্ ।
সত্যং চেৎ সংবৃতিঃ কেয়ং মৃষা চেৎ সত্যতা কথম্ ।।
সত্যত্বং ন চ সামান্যং মৃষার্থপরমার্থয়োঃ।
বিরোধান্নহি বৃক্ষত্বং সামান্যং বৃক্ষসিংহয়োঃ।।
তুল্যার্থত্বেহপি তেনৈষাং মিথ্যাসংবৃতিশব্দয়োঃ।
বঞ্চনার্থ উপন্যাসের লালাবকত্রাসবাদিবৎ।।
নাস্তিক্যপরিহারর্থং সংবৃতিঃ কল্পনেতি চ।
কল্পনাপি ত্বভিন্নস্য নৈব নিবস্তুকে ভবেৎ।।
তস্মাৎ যৎ নাস্তি নাস্তি এব যৎতু অস্তি পরমার্থতঃ।
তৎ সত্যম্ অন্যাৎ মিথ্যা ইতি ন সত্যদ্বয়কল্পনা।।’
অর্থাৎ : এ-জাতীয় পরিভাষা-বিন্যাসের উদ্দেশ্য বঞ্চনামূলক প্রচেষ্টা ছাড়া আর কিছুই নয়। তোমরা বলতে চাও, প্রত্যক্ষ-সিদ্ধ বাহ্যবস্তু প্রকৃতপক্ষে মিথ্যাই; কিন্তু মিথ্যা শব্দ ব্যবহার না করে তোমরা সংবৃতি সত্য শব্দ ব্যবহার করছো;- যেমন বঞ্চনা করবার উদ্দেশ্যে ‘লালা’ শব্দ ব্যবহার না করে ‘বকত্রাসব’ শব্দ ব্যবহার করা যায়। আসলে তোমাদের সংবৃতি সত্যও যা মিথ্যাও তাই; অতএব তাকে সত্যের কোনো প্রকারভেদ বলা অর্থহীন। যদি তোমাদের মতে তা প্রকৃতপক্ষে সত্যই হয় তাহলে তাকে আবার সংবৃতি বলা কেন ? এবং যদি তা মিথ্যাই হয় তাহলে তাকে আবার কোনো এক প্রকারের সত্য বলা যায় কী করে ? সত্য এবং মিথ্যা বিরুদ্ধ বলেই উভয়ের মধ্যে সত্যতা থাকতে পারে না, যেমন বৃক্ষ এবং সিংহ উভয়ের মধ্যেই বৃক্ষত্ব থাকা সম্ভব নয়। আসলে যা মিথ্যা তাকে ‘নাস্তি’ বলেই স্বীকার কর এবং যার প্রকৃত সত্তা আছে তাকেই পরমার্থ সত্য বলে স্বীকার কর; কিন্তু সত্য দ্বিবিধ, প্রকৃত সত্য এবং মিথ্যা সত্য বা সংবৃতি সত্য- এ-জাতীয় কথা বল্পনা কোরো না। (তর্জমা- দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়)

কুমারিলের এই যুক্তিগুলি অবশ্যই অদ্বৈতবেদান্তর তথাকথিত ব্যবহারিক সত্য বা ব্যবহারিক সত্তার উপরও প্রযোজ্য হবে। একমাত্র পরম ব্রহ্মই যদি সত্য হয় এবং প্রত্যক্ষ-সিদ্ধ ও লোকব্যবহার-মূলক জগৎ যদি প্রকৃতপক্ষে মিথ্যাই হয়, তাহলে এই মিথ্যাকেও ব্যবহারিক সত্য নাম দিয়ে সত্তার কোনো প্রকারভেদ কল্পনা অযৌক্তিক হবে। অন্তত, শঙ্কর-দর্শনের এই তথাকথিত ব্যবহারিক সত্তার নজির দেখিয়ে বৌদ্ধ ভাববাদের সঙ্গে বৈদান্তিক ভাববাদের কোনো মৌলিক পার্থক্য প্রতিপন্ন করা যাবে না। অতএব শঙ্করের রচনায় বৌদ্ধ ভাববাদ খন্ডনের পরিচয় থাকলেও তার উপর প্রকৃত দার্শনিক গুরুত্ব আরোপণের প্রয়োজন নেই বলে দেবীপ্রসাদের অভিমত। তাই তাঁর মতে- ‘বিজ্ঞানবাদ ও অদ্বৈতবাদের মধ্যে অবান্তর পার্থক্য যতই থাকুক না কেন মূল দার্শনিক ভাববাদ হিসেবে উভয়ই সমানতন্ত্র। এবং বিজ্ঞানবাদ প্রসঙ্গেও আমরা দেখব, কালক্রমে বৌদ্ধ ধর্ম-বিশ্বাসীদের মধ্যেই এ-দর্শনের বিকাশ ঘটলেও প্রকৃতপক্ষে ঔপনিষদিক অর্থে বৈদান্তিক চিন্তাধারার মধ্যেই তার সূচনা অনুমেয়। এই কারণেই, বিজ্ঞানবাদের সঙ্গে শঙ্করের পরমগুরু গৌড়পাদের বেদান্ত-ব্যাখ্যায় আশ্চর্য সাদৃশ্য চোখে পড়ে। অতএব অনুমান হয়, উপনিষদের যুগেই মূল ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির সূত্রপাত হয়েছিল; কালক্রমে সেই ভাববাদ একদিকে বিজ্ঞানবাদ এবং অপরদিকে মায়াবাদরূপে বিকাশলাভ করে। অবশ্যই যুক্তি-বিন্যাস ও অন্যান্য কয়েকটি দিক থেকে ভাববাদের এই দ্বিবিধ বিকাশের মধ্যে পার্থক্য থেকেছে; তবুও ভারতীয় দর্শনে সুসম্বন্ধ ভাববাদ-খণ্ডনকে শুধুমাত্র বৌদ্ধ-মত খণ্ডন আখ্যা দেওয়া যায় না, কেননা দার্শনিক বিচারে তা একাধারে বিজ্ঞানবাদ-খণ্ডন এবং মায়াবাদ-খণ্ডন উভয়ই হতে বাধ্য। এই কথাগুলি মনে রেখে মীমাংসা-দর্শনে ভাববাদ-খণ্ডন আলোচনা করা যায়।’- (ভারতীয় দর্শন, পৃ-২৬৯)

মীমাংসা-সাহিত্যে ভাববাদ-খণ্ডনের প্রাচীনতম নিদর্শন বলতে শবরভাষ্যে (মীমাংসাসূত্র-১/১/৫, শবরভাষ্য) উদ্ধৃত জনৈক বৃত্তিকারের রচনা। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, বৃত্তিকার-খণ্ডিত এই মতকে কোন্ সম্প্রদায়ের মত বলে শনাক্ত করা হবে ? কুমারিল তাঁর ‘শ্লোকবার্তিকে’ এই রচনা-খণ্ডের ব্যাখ্যা দুটি অংশে বিভক্ত করেছেন এবং তিনি প্রথমাংশের নাম দিয়েছেন ‘নিরালম্বনবাদ’ (অর্থাৎ, বহির্বাস্তবে জ্ঞানের কোনো আলম্বন নেই, জ্ঞান বাহ্যবস্তুশূন্য) এবং দ্বিতীয়াংশের নাম দিয়েছেন ‘শূন্যবাদ’। এ-থেকে মনে হতে পারে, কুমারিল-মতে বৃত্তিকারের রচনায় বিজ্ঞানবাদ এবং শূন্যবাদ স্বতন্ত্রভাবে খণ্ডিত হয়েছে। বৃত্তিকারের রচনারও দ্বিতীয়ার্ধ ‘শূন্যস্তু’ শব্দ দিয়ে শুরু। অতএব মনে হতে পারে, এই শব্দটির আগে পর্যন্ত বিজ্ঞানবাদেরই খণ্ডন, ‘শূন্যস্তু’ শব্দের পর থেকে শূন্যবাদের খণ্ডন। কিন্তু বৃত্তিকারের সমালোচনা কোনো সম্প্রদায়-বিশেষের বিরুদ্ধে বলে শনাক্ত করার পরিবর্তে সাধারণভাবে ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে প্রযুক্ত বলে গ্রহণ করাই যুক্তিযুক্ত। এ-বিষয়ে দেবীপ্রসাদের তর্জমায় (ভারতীয় দর্শন, পৃ-২৬৯) মহামহোপাধ্যায় গঙ্গানাথ ঝা’র মন্তব্য অনুধাবনযোগ্য-
‘প্রাচীনকাল থেকেই শবরভাষ্যের সম্পাদকেরা উদ্ধৃতিটির দুটি অংশের নাম দিয়েছিলেন নিরালম্বনবাদ ও শূন্যবাদ। এবং এই দুটি অংশের সম্পর্ক নিয়ে কিছুটা মতবিভ্রান্তি আছে বলেই অনেকের ধারণা হয়েছে, (ক) ‘শূন্যস্তু’ শব্দের আগে পর্যন্ত যে অংশ তাতে ভাববাদের সমালোচনা আছে, এই ভাববাদ অনুসারে বহির্বস্তু বলে কিছু নেই, অতএব সমস্ত জ্ঞানই আলম্বন-বিহীন বা নিরালম্বন এবং (খ) ‘শূন্যস্তু’ শব্দ থেকে যে-অংশ শুরু তাতে শূন্যবাদের সমালোচনা আছে- সবই শূন্য, এমনকি জ্ঞান বা বিজ্ঞান বলেও কিছুর সত্তা নেই। কিন্তু এ ব্যাখ্যা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত। শ্লোক-বার্তিকের তথাকথিত শূন্যবাদ অংশের শেষ কারিকাটি থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, সমগ্র অংশটির মূল উদ্দেশ্য হলো, ভাববাদ-খণ্ডন করে বহির্বস্তুর যাথার্থ্য-প্রতিপাদন। শূন্যবাদ খণ্ডনের একমাত্র যুক্তি এই যে বহির্বস্তুর সত্তাই যখন অস্বীকার করা সম্ভব নয় তখন জ্ঞান বা বিজ্ঞানের সত্তা অস্বীকার করা আরও অসম্ভব। অতএব, ‘শূন্যস্তু’ শব্দ থেকে যে-অংশ শুরু তাতে শুধু মাধ্যমিক শূন্যবাদেরই সমালোচনা ও খণ্ডন আছে এ-ধারণা ঠিক নয়। বস্তুত পরবর্তী অংশটুকুতেও বহির্বস্তুর অপলাপ-খণ্ডনের রেশ দেখা যায়। সমগ্র অংশটির শেষে উপসংহার হিসেবে বৃত্তিকার মন্তব্য করেছেন, ‘অতো ন নিরালম্বনঃ প্রত্যয়ঃ’- অতএব প্রত্যয় বা জ্ঞান নিরালম্বন নয়। এ-থেকেও স্পষ্টই বোঝা যায়, রচনাটির সামগ্রিক উদ্দেশ্য হলো বহির্বস্তু প্রত্যাখ্যান খণ্ডন বা ভাববাদ-খণ্ডনই।’

অতএব, বৃত্তিকারের রচনায় বিভিন্ন ভাববাদী সম্প্রদায়ের মধ্যে অবান্তর মতবৈলক্ষ্যণ্যের সমালোচনা আবিষ্কার করার পরিবর্তে সমগ্র রচনাটিকে ভাববাদী দর্শনের সারতত্ত্ব খণ্ডন- অর্থাৎ বাহ্যবস্তুর অপলাপ খণ্ডন- বলে গ্রহণ করাই যুক্তিসঙ্গত। বস্তুত, বৃত্তিকারের কাছে সমস্যাটি ঠিক কীভাবে উঠেছে তা বিচার করলেও এই কথাই প্রতিপন্ন হয়।

সমস্যাটি উঠেছে প্রত্যক্ষের প্রামাণ্য-নিশ্চয় প্রসঙ্গে। বৃত্তিকার বলছেন, ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের যোগজনিত জ্ঞানের নাম প্রত্যক্ষ- ‘ইন্দ্রিয়ার্থসংপ্রয়োগজং জ্ঞানম্’। ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে অর্থ বা বিষয়ের যেখানেই যোগ হয় সেখানেই সৎ প্রত্যক্ষ বা প্রকৃত প্রত্যক্ষ। প্রকৃত প্রত্যক্ষ কখনোই ভ্রান্ত হতে পারে না; সৎ প্রত্যক্ষমাত্রই যথার্থ।
প্রশ্ন উঠবে, শুক্তিতে রজত-দর্শন বা স্বপ্ন-দর্শন জাতীয় দৃষ্টান্ত নিয়ে। কেননা এগুলি অবশ্যই ভ্রান্ত। উত্তরে বৃত্তিকার বলছেন, এ-জাতীয় প্রত্যক্ষ আসলে প্রত্যক্ষই নয়। কেননা এখানে ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের যোগ ঘটে না। শুক্তিতে রজত দর্শনের দৃষ্টান্তে বিষয় বলতে রজত; কিন্তু এই রজতের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের কোনো যোগ হয় না। তেমনি স্বপ্নে অট্টালিকাদি দর্শনের দৃষ্টান্তে অট্টালিকাদি বিষয়, তার সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের যোগ হয় না। অতএব ভ্রমপ্রত্যক্ষ প্রত্যক্ষই নয়।
কিন্তু প্রশ্ন উঠবে, শুক্তিতে রজত-দর্শনকালে দর্শক তো মনে করে তার চক্ষু-ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে রজতের বাস্তবিকই যোগ ঘটছে। তাহলে কী করে জানা যায় যে আসলে তা ঘটেনি ? উত্তরে বৃত্তিকার বলছেন, বাধ-প্রত্যয়ের দ্বারা তা জানা যায়। বাধ-প্রত্যয় মানে একটি পরবর্তী জ্ঞান যা কিনা প্রথম জ্ঞানটিকে বাধিত করে বা খণ্ডিত করে। যেমন, শুক্তিতে রজত-দর্শনের পর যখন শুক্তিতে শুক্তি-দর্শন ঘটে তখন দ্বিতীয় জ্ঞানটি প্রথম জ্ঞানটির বাধক হয়। তেমনি জাগ্রত-প্রত্যয় স্বপ্ন-প্রত্যয়ের বাধক জ্ঞান। অর্থাৎ, জাগ্রত-প্রত্যক্ষর সাহায্যে জানা যায় স্বপ্ন-প্রত্যক্ষ ভ্রান্ত ছিলো- স্বপ্ন-দশায় ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের বাস্তবিকই যোগ হয়নি- অর্থাৎ, স্বপ্ন-প্রত্যক্ষটি প্রত্যক্ষই নয়।
কিন্তু এ-জাতীয় অসৎ-প্রত্যক্ষের- যা কিনা প্রত্যক্ষই নয় তার- উপলব্ধি হয় কেন ? উত্তরে বৃত্তিকার বলছেন, তার কারণ ‘কারণ-দোষ’। পাণিনি-মতে ‘সাধকতম’ কারণকেই কারণ বলা হবে; কিন্তু জয়ন্ত ভট্ট দেখাচ্ছেন (ফণিভূষণ, ন্যায়দর্শন-১/৮১)- ‘কার্যের কোনো কারণ-বিশেষই কারণ নয়, কিন্তু সমগ্র কারণের সংহতিরূপ সামগ্রিই কারণ।’ এই অর্থে প্রত্যক্ষর দৃষ্টান্তে ইন্দ্রিয়, মন এবং বিষয় বা বহির্বস্তু বলে জ্ঞান-কারণ-সামগ্রিকেই কারণ বলতে হবে।
অতএব বৃত্তিকারের মতে, প্রত্যক্ষ-জ্ঞানের এই কারণ-সামগ্রির কোথাও যদি ‘দোষ’ থাকে তাহলেই অসৎ প্রত্যক্ষের উৎপত্তি হয়। যথা, চক্ষু ইন্দ্রিয় যদি অন্ধকার ‘দোষ’ দ্বারা আচ্ছন্ন হয় তাহলে রজ্জুতে সর্প দর্শন ঘটে। কিংবা মন যদি তন্দ্রাদি দোষগ্রস্ত হয় তাহলে স্বপ্ন-দর্শন ঘটে।

অর্থাৎ যা প্রকৃতপক্ষে প্রত্যক্ষ নয় অথচ যাকে প্রত্যক্ষ বলে মনে হয় তার উৎপত্তির কারণ হলো কারণ-দোষ এবং তার প্রতিপত্তির বা জ্ঞপ্তির কারণ হলো বাধ-প্রত্যয়। কিন্তু দ্রষ্টব্য হলো, বৃত্তিকারের উপরিউক্ত বক্তব্য ভাববাদী দার্শনিকদের পক্ষে কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। প্রথমত, প্রত্যক্ষ বলতে যদি ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের যোগই বোঝায় তাহলে স্বীকার করতে হয় প্রত্যক্ষ-অতিরিক্ত- অর্থাৎ জ্ঞানাতিরিক্ত বা জ্ঞানবাহ্য- বিষয়ের সত্তা বর্তমান। দ্বিতীয়ত, ভারতীয় দর্শনে ভাববাদীরা প্রধানত ভ্রম, স্বপ্ন প্রভৃতির দৃষ্টান্তকে অবলম্বন করেই অনুমান করতে চেয়েছেন যে জ্ঞান প্রকৃতপক্ষে নির্বস্তু, অর্থাৎ বাহ্যবস্তু বলে জ্ঞানের কোনো বিষয় নেই। একটা বিষয় স্পষ্ট যে, বৃত্তিকারের যুগেই ভাববাদীদের এই অনুমান খ্যাতিলাভ করেছে। কেননা, উপরিউক্ত মন্তব্যের পরই বৃত্তিকার ভাববাদীর দৃষ্টিকোণ থেকে এই অনুমানমূলক পূর্বপক্ষই অবতারণা করেছেন।

ভাববাদী বলবেন, সমস্ত প্রত্যয়ই নিরালম্বন- স্বপ্নপ্রত্যয়ের মতো। স্বপ্নপ্রত্যয়ের দৃষ্টান্তে দেখা যায়, প্রত্যয় আছে কিন্তু বহির্জগতে তার কোনো বাস্তব অবলম্বন নেই। যেমন, স্বপ্নে হস্তী দর্শন করলাম, কিন্তু এই হস্তীজ্ঞানের আলম্বন বাস্তব হস্তী কোথায় ? অতএব স্বপ্নজ্ঞান নির্বস্তু, বস্তুবিষয়ক নয়। স্তম্ভাদির জাগ্রতপ্রত্যয়ও প্রত্যয়ই। অতএব জাগ্রতপ্রত্যয়েরও কোনো অবলম্বন নেই। অর্থাৎ, জাগ্রতজ্ঞানও স্বপ্নজ্ঞানের মতোই জ্ঞান, উভয়ের মধ্যে জ্ঞানসাধর্ম্য দৃষ্ট হয়। অতএব স্বপ্নজ্ঞান যেহেতু নিরালম্বন, সেইহেতু জাগ্রতজ্ঞানও নিরালম্বন বলেই অনুমেয়। কিন্তু জাগ্রতজ্ঞানে যেহেতু কল্পনা হয় বহির্বস্তুর প্রতীতি হচ্ছে সেইহেতু এই জাগ্রতজ্ঞান মিথ্যা। বস্তুত প্রকৃত ভাববাদীমতে জ্ঞানমাত্রই স্বতঃসিদ্ধভাবে মিথ্যা।
ভাববাদীর বিরুদ্ধে আপত্তি তুলে হয়তো বলা হবে, স্তম্ভাদির জাগ্রতপ্রত্যয় ‘সুপরিনিশ্চিত’; অতএব তাও কী করে মিথ্যা হতে পারে ? উত্তরে ভাববাদী বলবেন, স্বপ্নদশায় স্বপ্নপ্রত্যয়ও সমান সুপরিনিশ্চিত বলেই প্রতীত হয়; অতএব জাগ্রত অবস্থায় জাগ্রতপ্রত্যয়ের সুপরিনিশ্চয়ত্ব থেকেই প্রমাণ হয় না যে, জাগ্রতপ্রত্যয় সত্য।
আপত্তি তুলে আবার বলা হবে, একথা স্বীকার করা যায় না। কেননা, স্বপ্নপ্রত্যয় বাধিত হয় এবং বাধিত হয় বলেই জানা যায় যে তা মিথ্যা; কিন্তু জাগ্রতপ্রত্যয় বাধিত হয় না, অতএব জাগ্রতপ্রত্যয় মিথ্যা নয়। উত্তরে ভাববাদী বলেন, প্রত্যয় হিসেবে স্বপ্নপ্রত্যয় এবং জাগ্রতপ্রত্যয় উভয়ের মধ্যে যেহেতু সাদৃশ্য আছে এবং যেহেতু স্বপ্নপ্রত্যয় বাধিত হয়, সেইহেতু অর্থাপত্তি ঘটে যে জাগ্রতপ্রত্যয়ও বাধিত হবে।

কুমারিলের ভাববাদ-খণ্ডনপ্রসঙ্গে আমরা পরে দেখবো, ভাববাদীরা বাস্তবিকই দাবি করেছেন যে, জাগ্রতপ্রত্যয়ও যোগপ্রত্যয় দ্বারা বাধিত হয়। কুমারিল এ যুক্তির উত্তর দিয়েছেন। কিন্তু বৃত্তিকার এ যুক্তির উল্লেখও করেন নি, উত্তরও দেননি। তিনি শুধু এটুকুই বলেছেন যে, ভাববাদীর মতে জাগ্রতপ্রত্যয়ও পরে বাধিত হবে।
এ জাতীয় যুক্তির উত্তরে বৃত্তিকার বলছেন, ভাববাদীর কথা স্বীকৃত হতে পারতো যদি স্বপ্নপ্রত্যয়ের মিথ্যাত্বর প্রকৃত কারণ এই হতো যে, তা প্রত্যয়। অর্থাৎ, প্রত্যয় বলেই স্বপ্নপ্রত্যয় মিথ্যা- একথা স্বীকারযোগ্য হলে মানা যেতো যে, জাগ্রতপ্রত্যয়ও মিথ্যা। কিন্তু স্বপ্নপ্রত্যয় যে মিথ্যা তার প্রকৃত কারণ এই নয় যে, তা প্রত্যয়। আসলে অন্য কারণে স্বপ্নপ্রত্যয়ের মিথ্যাত্ব প্রতিপন্ন হয়। কী কারণে ? বাধপ্রত্যয়। অর্থাৎ, জাগ্রতপ্রত্যয় স্বপ্নপ্রত্যয়কে বাধিত করে বলেই বোঝা যায় যে, তা মিথ্যা। এবং এই মিথ্যাত্বর উৎপত্তি অনুসন্ধান করলে করণদোষ আবিষ্কৃত হয়, তন্দ্রাচ্ছন্ন মন দুর্বল বা অক্ষম হয়ে পড়ে এবং এই দোষের জন্যই মিথ্যাত্বর উৎপত্তি হয়।
ভাববাদী তর্ক তুলে বলবেন, জাগ্রতপ্রত্যয়ের মূলেও কোনো করণদোষ নেই- একথাই বা জানলে কেমন করে ? উত্তরে বৃত্তিকার বলছেন, যদি করণদোষ থাকতো তাহলে তার কথা জানা যেতো। কিন্তু যেহেতু এ জাতীয় কোনো করণদোষের কথা জানা যায় না সেইহেতু তার অস্তিত্ব সম্ভাবনাও স্বীকার্য নয়।
ভাববাদী বলবেন, কিন্তু স্বপ্নপ্রত্যয়ের উৎসেও যে করণদোষ বর্তমান একথাও স্বপ্নদশায় জানা যায় না। উত্তরে বৃত্তিকার বলছেন, কিন্তু স্বপ্নভঙ্গর পর তা জানা যায়- জানা যায় স্বপ্নদশায় তন্দ্রাচ্ছন্ন মন অক্ষম হয়ে পড়েছিলো।

এইভাবে বাহ্যবস্তুবাদের বিরুদ্ধে ভাববাদীর মূল আপত্তিগুলি বিচার করার পর বৃত্তিকার ভাববাদের মূল সিদ্ধান্ত বিচার করতে অগ্রসর হয়েছেন। ভাববাদমতে জ্ঞান বা প্রত্যয় শূন্য,- অর্থাৎ বাহ্যবস্তু-শূন্য বা নির্বস্তু। অর্থাৎ, যে বিষয়ের প্রত্যক্ষ হয় বস্তু হিসেবে তার কোনো সত্তা নেই। কিন্তু যদি বস্তু না থাকে, তাহলে নীল, পীত, হ্রস্ব, দীর্ঘ প্রভৃতি আকারগুলির প্রতীতি হয় কী করে ? সাধারণত আমরা মনে করি বাহ্যবস্তুরই আকার আছে- প্রত্যক্ষর সময় এই আকারগুলিরই প্রতীতি ঘটে।
উত্তরে ভাববাদী বলেন, যে-আকারের প্রতীতি হয় তাকে বস্তুরই আকার মনে করার কোনো কারণ নেই। কেননা, জ্ঞানের আকার ও বিষয়ের আকার উভয়ের মধ্যে কোনো পার্থক্য প্রত্যক্ষসিদ্ধ নয়। অতএব স্বীকার করতে হবে জ্ঞানই সাকার, অর্থাৎ আকারবিশিষ্ট। প্রত্যক্ষর সময় জ্ঞানের এই আকার ছাড়াও তথাকথিত কোনো বিষয়ের আকার প্রতীত হয় না। অতএব এ কথাই স্বীকার্য যে প্রত্যয় বা জ্ঞানই প্রত্যক্ষের বিষয়- তদতিরিক্ত কোনো আকারবিশিষ্ট বস্তুকে জ্ঞানের বিষয় বলে কল্পনা করা যায় না।
উত্তরে বৃত্তিকার বলছেন, ‘জ্ঞানই সাকার, প্রত্যক্ষকালে যে আকারের প্রতীতি হয় তা জ্ঞানেরই আকার’- একথা কিছুতেই স্বীকৃত হতে পারে না। কেননা যদি তাইই হতো তাহলে যে কোনো সময় যে কোনো আকারের প্রতীতি সম্ভব হতে পারতো। কিন্তু তন্তুর সম্মুখে বস্ত্রকারেরই প্রতীতি হয়, ঘটাকারের প্রতীতি সম্ভব হয় না। এ থেকেইে প্রমাণ হয়, প্রতীতির বিষয় যে আকার তা বহির্বস্তুর উপরই নির্ভরশীল, অতএব তা বহির্বস্তুরই আকার- জ্ঞানের আকার নয়।

বৃত্তিকার বলছেন, ভাববাদীরা যে বলেন, প্রতীতির আকার এবং বিষয়ের আকার অভিন্ন- তাতে তো প্রতীতিরই সত্তা অপলাপের আশঙ্কা ঘটে, কেননা তাহলে তো স্বীকার করতে হয় শুধুমাত্র আকারবিশিষ্ট বিষয়ই বর্তমান, কেননা তারই প্রত্যক্ষ হয়, আকারবিশিষ্ট প্রতীতির কোনো প্রত্যক্ষ হয় না। এবং যদি তাইই হয় তাহলে আরও স্বীকার করতে হবে, প্রত্যক্ষজ্ঞানের বিষয় হলো বস্তু (বা অর্থ), জ্ঞান নয়; ‘অর্থবিষয়া হি প্রত্যক্ষবুদ্ধিঃ, ন বুদ্ধিবিষয়া।’ জ্ঞানই যে প্রত্যক্ষ-জ্ঞানের বিষয় হতে পারে না, এই কথাটি প্রতিপন্ন করবার জন্য বৃত্তিকার সুদীর্ঘ আলোচনা করেছেন।
ভাববাদী আপত্তি তুলে বলবেন, জ্ঞানই যে জ্ঞানের বিষয় হতে পারে এ কথা অস্বীকার করলে মানতে হবে যে জ্ঞান হলেও সেই জ্ঞানের কথা আমাদের কাছে অজ্ঞাত থাকে, অর্থাৎ আমরা জানতে পারি না যে জ্ঞান হয়েছে। কেননা যদি বলো যে একথা আমরা জানতে পারি, অর্থাৎ যদি স্বীকার করো যে জ্ঞান জ্ঞাত হয়, তা হলেই তো মানতে হবে যে জ্ঞানের পক্ষেই জ্ঞানের বিষয় হওয়া সম্ভব।
উত্তরে বৃত্তিকার বলছেন, প্রত্যক্ষজ্ঞানের বিষয় কখনোই জ্ঞান নয়, কিংবা জ্ঞান কখনোই প্রত্যক্ষজ্ঞানের বিষয় হতে পারে না: প্রত্যক্ষের বিষয় বলতে বস্তুই। কিন্তু বস্তু বিষয়ে জ্ঞান হবার পর অনুমানের সাহায্যে আমরা জানতে পারি যে, জ্ঞান হয়েছে। অর্থাৎ, বস্তু জ্ঞাত হয়েছে- এই ঘটনা থেকেই অনুমান হয় উক্ত বস্তুবিষয়ে জ্ঞান হয়েছে। অতএব বস্তুজ্ঞান এবং সে বিষয়ে জ্ঞান এক নয়- বস্তুজ্ঞান প্রত্যক্ষ-জন্য, সে বিষয়ে জ্ঞান অনুমান-জন্য।

অতএব বৃত্তিকার সিদ্ধান্ত করেছেন, নিরালম্বন অর্থে প্রত্যক্ষজ্ঞানকে মিথ্যা বা শূন্য বলা যায় না। পক্ষান্তরে সৎ প্রত্যক্ষ বা প্রকৃত প্রত্যক্ষমাত্রই সত্য বা যথার্থ। কেবল, কোনো একটি প্রত্যক্ষর পরে যদি বাধপ্রত্যয়ের উদ্ভব হয় তাহলে জানা যায় প্রথম প্রত্যক্ষটি মিথ্যা, অর্থাৎ প্রত্যক্ষই নয়। এবং অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই মিথ্যাত্বর মূলে করণদোষ বর্তমান; অর্থাৎ করণদোষ থেকে মিথ্যাপ্রতীতির উৎপত্তি।

মহামহোপাধ্যায় গঙ্গানাথ ঝা মন্তব্য করেছেন, ‘এইভাবে শবরভাষ্যে দ্বিবিধ ভাববাদই খণ্ডিত হয়েছে। ভাববাদের একটি অভিব্যক্তি অনুসারে বহির্বস্তু বলে কিছু নেই, জ্ঞানের বিষয় বলতে জ্ঞানই, যদিচ বৌদ্ধমতে এই জ্ঞান ক্ষণিক এবং বেদান্তমতে তা অপরিবর্তনীয়। ভাববাদের দ্বিতীয় অভিব্যক্তি অনুসারে বহির্বস্তুও নেই, জ্ঞানও নেই; সব শূন্য। এই শূন্যবাদের খণ্ডন অবশ্যই আনুষঙ্গিক। বৃত্তিকারের প্রধান উদ্দেশ্য বহির্বস্তুর স্বাধীন সত্তা প্রতিপন্ন করা। তা প্রতিপাদিত হলে শূন্যবাদ অবশ্যই খণ্ডিত হবে।’ (সূত্র: দেবীপ্রসাদ, ভারতীয় দর্শন, পৃ-২৭৩)

ভারতীয় দার্শনিক সাহিত্যে বৃত্তিকারের উপরিউক্ত রচনা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা ‘সামগ্রিকভাবে দর্শনের ইতিহাসে একটি মূল সমস্যা বলতে, ভাববাদ না বাহ্যবস্তুবাদ ? এবং ভারতীয় দর্শনে ভাববাদের সমর্থনে যে মূল যুক্তি ও দৃষ্টান্ত প্রস্তাবিত হয়েছে ও পক্ষান্তরে বাহ্যবস্তুবাদের সমর্থনে বা ভাববাদ খণ্ডনে যে মূল যুক্তি প্রস্তাবিত হয়েছে বৃত্তিকারের উপরোক্ত রচনার মধ্যেই তার পরিচয় পাওয়া যায় এবং অনুমান হয় ভারতীয় দর্শনে এ জাতীয় পরিচয়ের প্রাচীনতম নিদর্শন বলতে বৃত্তিকারের আলোচ্য রচনা-খণ্ডই। কেননা বৃত্তিকারের কাল-নিশ্চয় সুনিশ্চিত না হলেও শবরপূর্ব বলেই তাঁকে বিশেষ সুপ্রাচীনকালের দার্শনিক বলতে হবে এবং তাঁর চেয়ে প্রাচীনতর কোনো দার্শনিকের রচনায় ভাববাদ-বনাম-বাহ্যবস্তুবাদের সমস্যা এমন সুস্পষ্টভাবে ব্যাখ্যাত হয়নি। অবশ্যই এ কথা কল্পনা করবার কোনো কারণই নেই যে, বৃত্তিকার এ সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান দিয়ে গিয়েছেন; কেননা দার্শনিক ভাববাদের সমস্যা পরবর্তীকালেও বহুলাংশেই অমীমাংসিত। বস্তুত বৃত্তিকারের পরেও একদিকে যেমন বৌদ্ধ ও বৈদান্তিক ভাববাদীরা ভাববাদকে দৃঢ়প্রতিষ্ঠ করবার আয়োজন করেছেন অপরদিকে তেমনি বাহ্যবস্তুবাদী মীমাংসক ও ন্যায়-বৈশেষিকেরা এই ভাববাদখণ্ডনে অনেক সূক্ষ্ম ও গভীর বিচার উত্থাপন করেছেন। এবং ভাববাদের প্রধানতম যুক্তি যেহেতু ‘প্রমাণাশ্রিত’ (epistemological) সেইহেতু ভাববাদ-বনাম-বাহ্যবস্তুবাদের উপরোক্ত সংঘর্ষের মধ্যে দিয়েই ভারতীয় দর্শনে প্রমাণতত্ত্ব (epistemology) সবিশেষ মূল্য অর্জন করেছে এবং এই দিক থেকেই হয়তো ভারতীয় দর্শনে মীমাংসকদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান বোঝা যেতে পারে : ন্যায়বৈশেষিকদের সঙ্গে মীমাংসকরাও প্রমাণতত্ত্বে বাহ্যবস্তুবাদী ঐতিহ্যকে নানাদিক থেকে দৃঢ়প্রতিষ্ঠ করবার আয়োজন করেছেন। অবশ্যই পরবর্তী মীমাংসকদের মধ্যে ভাববাদ খণ্ডনের সবচেয়ে মূল্যবান প্রচেষ্টা বলতে কুমারিলেরই এবং যুক্তিবিন্যাসের দিক থেকে কুমারিল বহুলাংশেই ন্যায়বৈশেষিকদের সমগোত্রীয়।’ ( দেবীপ্রসাদ, ভারতীয় দর্শন, পৃ-২৭৫)
অতএব এখানে বিশেষ করে কুমারিলের ভাববাদ খণ্ডনই আলোচনা করা হবে, যদিও প্রসঙ্গক্রমে ন্যায়-বৈশেষিকদের কথাও এসে যেতে পারে।

কুমারিল ( শ্লোকবার্তিক, নিরালম্বনবাদ, কারিকা ১৭-১৮) বলছেন, ‘ভাববাদীর যুক্তি দ্বিবিধ : অর্থপরীক্ষণমূলক (ইউরোপীয় পরিভাষায় ontological) এবং প্রমাণাশ্রিত (epistemological)। অর্থাৎ একদিকে ‘অর্থ’ বা জ্ঞানের বিষয় পরীক্ষা করে  ভাববাদী প্রমাণ করতে চান যে, বাহ্যবস্তুর সত্তা অসম্ভব এবং অপরদিকে প্রমাণমূলক বিচারের ভিত্তিতে তিনি বহির্বস্তুর অপলাপ প্রয়াস করেন।’
কুমারিল-মতে দ্বিতীয় যুক্তিই বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ; অতএব তিনি বিশেষ করে এই প্রমাণাশ্রিত যু্ক্তিই বিচার করতে চেয়েছেন।

প্রমাণাশ্রিত যুক্তি আবার দ্বিবিধ ( শ্লোকবার্তিক, নিরালম্বনবাদ, কারিকা ১৮-১৯)। এক: অনুমানাশ্রিত- অনুমানের সাহায্যে বাহ্যবস্তুর প্রত্যাখ্যান। দুই: প্রত্যক্ষশক্তি পরীক্ষণাশ্রিত- প্রত্যক্ষশক্তি বিচার করে দেখানো যে প্রত্যক্ষর বিষয় বাহ্যবস্তু হতে পারে না।
এই দ্বিবিধ যুক্তিকে কুমারিল স্বতন্ত্রভাবে খণ্ডন করবার আয়োজন করেছেন- ‘নিরালম্বনবাদ’ শীর্ষক অংশে অনুমানাশ্রিত যুক্তি এবং ‘শূন্যবাদ’ শীর্ষক অংশে প্রত্যক্ষশক্তি পরীক্ষণাশ্রিত যুক্তি।

‘ভাববাদ খন্ডনে কুমারিলের উৎসাহ যে কতখানি এখানে সে বিষয়ে একটি কথা উল্লেখ করা যায় : ‘নিরালম্বনবাদ’ শীর্ষক অংশে পূর্বপক্ষ হিসেবে ভাববাদের ব্যাখ্যায় তিনি ২৭টি কারিকা রচনা করেছেন এবং সিদ্ধান্ত হিসেবে ভাববাদখণ্ডনে ১৭৫টি কারিকা রচনা করেছেন। আবার ‘শূন্যবাদ’ শীর্ষক অংশে পূর্বপক্ষ হিসেবে তিনি ৬৩টি কারিকায় ভাববাদের যুক্তি ব্যাখ্যা করেছেন এবং সিদ্ধান্ত হিসেবে আরো ২০০টি কারিকায় ভাববাদ খণ্ডন করেছেন। অতএব কুমারিলের রচনায় ভাববাদখণ্ডন অত্যন্ত সুদীর্ঘ এবং অবশ্যই অত্যন্ত জটিলও।’ ( দেবীপ্রসাদ, ভারতীয় দর্শন, পৃ-২৭৪)
আমরা কুমারিলের প্রধানতম কয়েকটি যুক্তির উপরই দৃষ্টি আবদ্ধ রাখার প্রয়াস করতে পারি।

‘নিরালম্বনবাদ’-এ কুমারিল বলছেন (ঐ, কারিকা-৩৩), ভাববাদের সমর্থনে মূল অনুমান হলো-
‘স্তম্ভাদিপ্রত্যয়ো মিথ্যা, প্রত্যয়ত্বাৎ, তথা হি যঃ।
প্রত্যয়ঃ স মৃষা দৃষ্টঃ স্বপ্নাদিপ্রত্যয়ো যথা।।
অর্থাৎ, ভারতীয় প্রমাণতত্ত্বের পরিভাষায় এ অনুমানের প্রতিজ্ঞা হলো: স্তম্ভাদিপ্রত্যয়ো মিথ্যা। হেতু: প্রত্যয়ত্বাৎ। ব্যাপ্তি: যঃ প্রত্যয়ঃ স মৃষা দৃষ্টঃ। দৃষ্টান্ত বা উদাহরণ: স্বপ্নাদিপ্রত্যয়ো যথা।
স্তম্ভাদিপ্রত্যয় মিথ্যা- মিথ্যা এই অর্থে যে, স্তম্ভাদির প্রতীতি মানে বহির্বস্তু হিসেবে স্তম্ভাদির প্রতীতি ঘটে, অথচ বহির্বস্তু নেই, অতএব অবস্তুতে বস্তুপ্রতীতি হিসেবে স্তম্ভাদির প্রতীতি মিথ্যা, সংক্ষেপে নিরালম্বন অর্থে মিথ্যা, এ অনুমানের হেতু হলো, প্রত্যয় বলেই মিথ্যা, যেহেতু প্রত্যয় সেইহেতু মিথ্যা। ব্যাপ্তি হলো,- যেখানেই প্রত্যয়ত্ব সেখানেই মিথ্যাত্ব দৃষ্ট হয়। উদাহরণ- স্বপ্নপ্রত্যয়; স্বপ্নপ্রতীতির দৃষ্টান্তে বস্তুর অভাব সত্ত্বেও বস্তুর প্রতীতি ঘটে, অর্থাৎ স্বপ্নপ্রতীতি নিরালম্বন বা মিথ্যা।

ভারতীয় প্রমাণতত্ত্বের নিয়ম অনুসারে অনুমানটি ঠিক এইভাবে প্রস্তাবিত হলে নানান দোষের আশঙ্কা থাকে। তাই কুমারিল প্রথমেই দেখাবার চেষ্টা করেছেন যে, ভাববাদীরা কী অর্থে অনুমানটিকে নির্দোষ প্রতিপন্ন করবার প্রচেষ্টা করবেন। যেমন, স্বপ্নপ্রত্যয় প্রভৃতি যে মিথ্যা একথা তো ভাববাদবিরোধীরাও স্বীকার করেন; অতএব ভাববাদী যখন প্রমাণ করতে চান যে, সমস্ত প্রত্যয়ই মিথ্যা তখন তাঁর বক্তব্য তো আংশিকভাবে বিপক্ষ-স্বীকৃতও- তাই ‘অংশে সিদ্ধসাধনভাব’ দোষ ঘটে। আবার ‘দৃষ্টান্তাভাব’ দোষও; কেননা স্বপ্ন-প্রত্যয়ও প্রত্যয়, অতএব দৃষ্টান্ত ও পক্ষ আসলে ভিন্ন নয়।
উত্তরে ভাববাদী বলবেন, ‘প্রত্যয়ো মিথ্যা’ বলতে তিনি সর্ববিধ প্রত্যয় বোঝেন না; শুধুমাত্র জাগ্রতপ্রত্যয় বা জাগ্রতবুদ্ধি বোঝেন। অতএব উপরিউক্ত দ্বিবিধ দোষের আশঙ্কা নেই।
আবার আপত্তি উঠবে, ভাববাদীর মতে প্রত্যয় মিথ্যা, কেননা প্রত্যয়ের বিষয় বা গ্রাহ্য মিথ্যা। কিন্তু তাঁর নিজের মতেই তো বুদ্ধি বা জ্ঞানই সমস্ত প্রত্যয়ের অনিবার্য বিষয় বা গ্রাহ্য। তাই প্রত্যয়ের বিষয় মিথ্যা হলে বুদ্ধি বা জ্ঞানই মিথ্যা হবে।
উত্তরে ভাববাদী বলবেন, শুধুমাত্র বাহ্যবিষয় অর্থেই আমি প্রত্যয়ের বিষয়কে মিথ্যা বলি; বুদ্ধি বা প্রত্যয় অর্থে প্রত্যয়ের বিষয় মিথ্যা নয়। ইত্যাদি ইত্যাদি।
সংক্ষেপে, ভাববাদীর মতে বাহ্যবস্তুবিষয়ক জাগ্রতপ্রতীতি মিথ্যা। ভাববাদী আরও বলবেন, ভাববাদ-খন্ডনে বৃত্তিকার বলেছেন স্তম্ভাদির জাগ্রতপ্রতীতি মিথ্যা হতে পারে না, কেননা তা সুপরিনিশ্চিত। কিন্তু আমরা বলবো, এই সুপরিনিশ্চয়ত্ব থেকে কিছুই প্রমাণ হয় না। কেননা, তা বিপরীত বুদ্ধি (অযথার্থ জ্ঞান) এবং অবিপরীত বুদ্ধি (যথার্থ জ্ঞান) উভয় ক্ষেত্রেই বর্তমান। স্বপ্নপ্রতীতিও সুপরিনিশ্চয়।

ভাববাদ-খন্ডনে কুমারিল প্রথমত বৃত্তিকারের কয়েকটি মূল যুক্তির উপরই নতুন করে গুরুত্ব আরোপণ করেছেন। যেমন, জাগ্রতপ্রত্যয়কে কিছুতেই মিথ্যা বলা যায় না, কেননা তা সুপরিনিশ্চয়। ভাববাদী বলবেন, স্বপ্নপ্রত্যয়েরও সুপরিনিশ্চয়ত্ব আছে। উত্তরে কুমারিল বলছেন, কিন্তু স্বপ্নপ্রত্যয় বাধিত হয়; অপরপক্ষে সুপরিনিশ্চিত জাগ্রতপ্রত্যক্ষর কোনো বাধপ্রত্যয় নেই এবং বাধপ্রত্যয় নেই বলেই তাকে কিছুতে মিথ্যা বা প্রমাণাভাস বলা যায় না; অন্তত বাধপ্রত্যয়-বিহীন সুপরিনিশ্চিত প্রত্যক্ষকে ভাববাদীর অনুমানের চেয়ে অনেক বেশি বলশালী বলতে হবে; কেননা প্রত্যক্ষই প্রমাণজ্যেষ্ঠ (ঐ, কারিকা-৩)।
কুমারিল আরও দেখাচ্ছেন, এমনকি ভাববাদীরাও এই জাগ্রতপ্রত্যয়কে সত্য বলে মানতে বাধ্য; কেননা, এই জাগ্রতপ্রত্যয়ের দ্বারাই স্বপ্নপ্রত্যয় বাধিত হয়; অতএব স্বপ্নপ্রত্যয়ের বাধক জাগ্রতপ্রত্যয়কে যথার্থ বলে স্বীকার না করলে স্বপ্নপ্রত্যয়কে মিথ্যা বলা যাবে না এবং তা যদি না যায় তাহলে ভাববাদীর দৃষ্টান্ত বা উদাহরণটিই (‘স্বপ্নাদিবৎ মিথ্যা’) পরিত্যক্ত হবে। অতএব ভাববাদীর  পক্ষেই স্বপ্নাদিও বাধক জাগ্রতপ্রত্যয়কে মিথ্যা বলা অসম্ভব (ঐ, কারিকা-৮০-৮১)।

উল্লেখ্য, ন্যায়-বৈশেষিকেরাও ভাববাদীর বিরুদ্ধে এই যুক্তি প্রদর্শন করেছেন- ‘স্বপ্নাবস্থায় সমস্ত জ্ঞান যে ভ্রম, ইহা পরে উহার বাধক কোনো জ্ঞান ব্যতীত প্রতিপন্ন হয় না। সুতরাং জাগ্রদবস্থার জ্ঞানকেই উহার বাধক বলিতে হইবে। তাহা হইলে সেই জ্ঞানকে যথার্থ বলিয়াও স্বীকার করিতে হইবে। কারণ, যথার্থজ্ঞান ব্যতীত ভ্রমজ্ঞানের বাধক হইতে পারে না। তাহা হইলে জাগ্রদবস্থার সেই যথার্থজ্ঞানকে দৃষ্টান্ত করিয়া প্রমাণ ও প্রমেয় বিষয়ক জ্ঞান যথার্থ, ইহাও তো বলিতে পারি। (ফণিভূষণ, ন্যায়দর্শন-৫/১৩৩)
‘যদি জাগরণ হইলে (স্বপ্নদৃষ্ট বিষয়সমূহের) উপলব্ধি না হওয়ায় স্বপ্নে বিষয়সমূহ নাই, অর্থাৎ অসৎ, ইহাই বল, তাহা হইলে প্রতিবুদ্ধ (জাগরিত) ব্যক্তি কর্তৃক এই যে সমস্ত বিষয় উপলব্ধ হইতেছে, উপলব্ধিবশত সেই সমস্ত বিষয় আছে, অর্থাৎ সৎ, ইহা স্বীকার্য। (ফণিভূষণ, ন্যায়দর্শন-৫/১৩২)
ব্যাখ্যায় মহামহোপাধ্যায় ফণিভূষণ বলছেন, ‘স্বপ্নজ্ঞান যে ভ্রম, ইহা সর্বসম্মত। কারণ, স্বপ্নদৃষ্ট বস্তুগুলি স্বপ্নকালে দ্রষ্টার সম্মুখে বিদ্যমান না থাকায় স্বপ্নজ্ঞান অসৎবিষয়ক, অর্থাৎ অবিদ্যমান-বিষয়ক। কিন্তু পূর্বোক্ত পূর্বপক্ষবাদীর (ভাববাদীর) মতে উহা সিদ্ধ হয় না। কারণ, স্বপ্নদৃষ্ট বিষয়গুলি যে অলীক, এ বিষয়ে তাঁহার মতে কোনো হেতু নাই। ভাষ্যকার (বাৎস্যায়ন) ইহা সমর্থন করিতে পরে বলিয়াছেন যে, যদি বল, স্বপ্নের পর জাগরণ হইলে তখন স্বপ্নদৃষ্ট বিষয়গুলির উপলব্ধি না হওয়ায় ঐ সমস্ত বিষয় যে অলীক ইহা সিদ্ধ হয়। তৎকালে বিষয়ের অভাব সাধনে পওে জাগ্রদবস্থায় অনুপলব্ধিই হেতু। কিন্তু ইহা বলিলে জাগ্রদবস্থায় অন্যান্য সময়ে নানা বিষয়ের উপলব্ধি হওয়ায় সেই সমস্ত বিষয়ের প্রতিষেধ বা অভাব হইতে পারে না। সেই সমস্ত বিষয়কে সৎ বলিয়াই স্বীকার করিতে হয়। কারণ, অনুপলব্ধিপ্রযুক্ত বিষয়ের অসত্তা সিদ্ধ করিতে হইলে উপলব্ধিপ্রযুক্ত বিষয়ের সত্তা অবশ্যই স্বীকার করিতে হইবে। ভাষ্যকার ইহা সমর্থন করিতে পরে বলিয়াছেন যে, যেহেতু বিপর্যয় থাকিলেই হেতুর সামর্থ্য থাকে। তাৎপর্য এই যে, পূর্বপক্ষবাদী যে অনুপলব্ধিপ্রযুক্ত অসত্তা বলিয়াছেন, উহার বিপর্যয় বা বৈপরীত্য হইতেছে উপলব্ধিপ্রযুক্ত সত্তা। উহা স্বীকার না করিলে অনুপলব্ধির দ্বারা বিষয়ের অভাব সাধন করা যায় না। কিন্তু পূর্বপক্ষবাদীর মতে স্বপ্নের পরে স্বপ্নদৃষ্ট বিষয়ের অনুপলব্ধি স্থলের ন্যায় জাগ্রদবস্থায় অন্যান্য সময়ে নানা বিষয়ের উপলব্ধিস্থলেও যখন সেই সমস্ত বিষয়ের অভাবই স্বীকৃত, তখন স্বপ্নস্থলে পরে অনুপলব্ধি হেতুর দ্বারা তিনি স্বপ্নদৃষ্ট বিষয়ের অসত্তা স্বীকার করিতে পারেন না।… যেমন অন্ধকারে প্রদীপের অভাব প্রযুক্ত রূপ দর্শন না হওয়ায় সেখানে প্রদীপের সত্তাপ্রযুক্ত রূপ দর্শনের সত্তা আছে বলিয়াই তদ্বারা সেই রূপদর্শনাভাব সিদ্ধ হয়। তাৎপর্য এই যে, উক্ত স্থলে প্রদীপ থাকিলে রূপদর্শন হইয়া থাকে, এজন্যই প্রদীপের অভাবপ্রযুক্ত যে রূপ-দর্শনাভাব, ইহা সিদ্ধ হয়। কিন্তু যদি ঐ স্থলে প্রদীপ থাকিলেও রূপদর্শন না হইত, তাহা হইলে প্রদীপের অভাব রূপ দর্শনাভাবের সাধক হেতু হইত না। বস্তুত ঐ স্থলে প্রদীপের সত্তা রূপদর্শনের হেতু বলিয়াই প্রদীপের অসত্তা রূপের অদর্শনের হেতু বলিয়া স্বীকার করা যায়। এইরূপ জাগ্রদবস্থায় নানা বিষয়ের উপলব্ধি ঐ সমস্ত বিষয়ের সত্তার সাধক হইলেই স্বপ্নের পরে স্বপ্নদৃষ্ট বিষয়ের অনুপলব্ধি ঐ সমস্ত বিষয়ের অসত্তার সাধক হইতে পারে। (ফণিভূষণ, ন্যায়দর্শন-৫/১৩৪-৫)

অতএব স্বীকার করতে হবে, ভাববাদী যদি স্বপ্নজ্ঞানকে অবিদ্যমানবিষয়ক অর্থে মিথ্যা বলে গ্রহণ করতে চান (এবং তা না চাইলে তাঁর নিজের নজিরই নস্যাৎ হবে) তাহলে তাঁকে একথা মানতে হবে যে স্তম্ভাদিও জাগ্রতপ্রত্যয় সৎবিষয়ের প্রত্যয় হিসেবে সত্য। অবশ্যই জাগ্রতপ্রত্যয়েরও যদি স্বপ্নপ্রত্যয়ের মতো কোনো বাধকপ্রত্যয় থাকতো তাহলে জাগ্রতপ্রত্যয়কেও একইভাবে মিথ্যা প্রতিপন্ন করা যেতো। কিন্তু জাগ্রতপ্রত্যয়ের বাধক প্রত্যয় নেই। এবং এই যুক্তির উপর নির্ভও করেই কুমারিল ভাববাদীদের অনুমানের বিরুদ্ধে বাহ্যবস্তুর জ্ঞানের যথার্থ প্রতিপাদনার্থে একটি বিপরীত অনুমান প্রস্তাব করেছেন ( শ্লোকবার্তিক, নিরালম্বনবাদ, কারিকা-৮০)-
‘বাহ্যার্থালম্বনা বুদ্ধিঃ ইতি সম্যক্ চ ধীঃ ইয়ম্ ।
বাধকাপেতবুদ্ধিত্বাৎ যথা স্বপ্নাদিবাধধীঃ।।
অর্থাৎ : বাহ্যবস্তুবিষয়ক বুদ্ধি বা জ্ঞান সত্য, কেননা তার বাধপ্রত্যয় নেই, স্বপ্ন প্রত্যয়ের বাধক প্রত্যয়ের মতো।

উত্তরে ভাববাদীর পক্ষে দাবি করবার প্রয়োজন হয় যে, স্তম্ভাদির জাগ্রতপ্রতীতিরও বাধজ্ঞান আছে, এবং বস্তুত ভাববাদীদের পক্ষ থেকে এই দাবি করা হয়েছে (ঐ, কারিকা-৯১-৯২)। কিন্তু জাগ্রতপ্রত্যয় কিসের দ্বারা বাধিত হতে পারে ? ভাববাদী বলবেন, যোগপ্রত্যয়ের দ্বারা। যোগসাধনার দ্বারা যোগীর অবস্থায় পৌঁছানো সম্ভব, অর্থাৎ যোগপ্রত্যক্ষ লাভ করা সম্ভব। এই যোগপ্রত্যক্ষর দ্বারাই জাগ্রতপ্রত্যক্ষ বাধিত হয়।
উত্তরে কুমারিল বিদ্রƒপ করে বলেছেন (ঐ, কারিকা-৯৩)-
‘ইহ জন্মানি কেষাঞ্চিন্ন তাবদুপলভ্যতে।’- অর্থাৎ, ইহজন্মে কারুরই এ জাতীয় উপলব্ধি- অর্থাৎ যোগপ্রত্যক্ষ হয় না।
এবং (ঐ, কারিকা-৯৪)-
‘যোগ্যবস্থাগতানাং তু না বিদমঃ কিং ভবিষ্যতি।’- অর্থাৎ, কেউ যদি যোগাবস্থায় উপনীত হয় তাহলে তার যে কী দশা ঘটবে তাও জানা নেই।
তাছাড়া (ঐ, কারিকা-৯৫)-
‘যোগিনাং চাস্মদীয়ানাং ত্বদুক্তপ্রতিযোগিনী।
ত্বদুক্তিবিপরীতা বা বাধবুদ্ধির্ভবিষ্যতি।।
অর্থাৎ : যদি বলো তোমাদের সম্প্রদায়ের যোগীদের এমন উপলব্ধি হয় যার দ্বারা তোমাদের মতই সমর্থিত হয় তাহলে আমরাও বলবো, আমাদের সম্প্রদায়ের যোগীদেরও এমন অভিজ্ঞতা হয় যা কিনা তোমাদের সিদ্ধান্তবিরুদ্ধ।

এ জাতীয় ব্যঙ্গবিদ্রƒপ থেকে স্পষ্টতই বোঝা যায়, কুমারিল-মতে যোগপ্রত্যক্ষ বলে সত্যিই কিছু থাকতে পারে না। কুমারিলের শ্লোকবার্তিকের প্রত্যক্ষসূত্র শীর্ষক ২৮-৩২ কারিকায় যোগপ্রত্যক্ষ বিষয়ে তাঁর মত উক্ত হয়েছে এভাবে-

‘ন লোকব্যতিরিক্তং হি প্রত্যক্ষং যোগিনামপি।। ২৮।।
প্রত্যক্ষত্বেন তস্যাপি বিদ্যমানোপলম্ভনম্ ।
সৎসংপ্রয়োগজত্বং বাহপ্যস্মৎপ্রত্যক্ষবৎ ভবেৎ।। ২৯।।
তোষামবর্তমানেহর্থে যা নামোৎপদ্যতে মতিঃ।
প্রত্যক্ষং সা ততস্তে¡ নাভিলাষস্মৃতাদিবৎ।। ৩০।।
লোকে চাপ্যপ্রসিদ্ধত্বাৎ প্রত্যক্ষত্বপ্রমাণতঃ।
প্রতিভাবদ্ দ্বয়াসত্ত্বং সদিত্যেতেন কথ্যতে।। ৩১।।
লৌকিকী প্রতিভা যদবৎ প্রত্যক্ষাদ্যনপেক্ষিণী।
ন নিশ্চয়ায় পর্যাপ্তা তথা স্যাৎ যোগিনামপি।। ৩২।।
অর্থাৎ : এমনকি যোগীদের প্রত্যক্ষও লোকব্যতিরিক্ত নয়, অর্থাৎ তা সাধারণ প্রত্যক্ষর মতোই। যেহেতু তা প্রত্যক্ষ সেইহেতু তারও উপলম্ভন বর্তমান এবং ‘সৎ’ বিষয়ের উপর প্রযুক্ত বলেই তা আমাদের প্রত্যক্ষর মতো হতে পারে। (কিন্তু এমন ধারণা আছে যে সৎ বিষয়ের অবর্তমানত্বের যোগীদের প্রত্যক্ষ উৎপন্ন হয়, যেমন যোগীরা অতীত বা ভবিষ্যতের প্রত্যক্ষ লাভ করতে পারেন। এ-ধারণার নিরাকরণে কুমারিল বলছেন,) সৎ বিষয়ের অবর্তমানত্বে যে মতি উৎপন্ন হয় তা সেই কারণেই প্রত্যক্ষ নয়, যেমন অভিলাষ ও স্মৃতি। অর্থাৎ অভিলাষের বিষয় হলো ভবিষ্যৎ, স্মৃতির বিষয় অতীত, অতএব যোগীদেরও যদি ভবিষ্যৎ বা অতীত বিষয়ে মতি উৎপন্ন হয় তাহলে তা অভিলাষ ও স্মৃতির সমগোত্রীয় হবে তাকে প্রত্যক্ষ বলা যাবে না। ( বৈশেষিকেরা দাবি করেন, যোগীদের এক অসাধারণ অতীন্দ্রিয় দর্শনশক্তি জন্মায়, তার নাম ‘প্রতিভা’ ! এই মত প্রত্যাখ্যানে কুমারিল বলছেন,) এই ‘প্রতিভা’ অপ্রসিদ্ধ এবং প্রত্যক্ষপ্রমাণ রহিত; এবং (শুধু যোগীদের কেন, সাধারণ লোকেরও ‘প্রতিভা’; সেই) লৌকিক ‘প্রতিভা’ প্রত্যক্ষ প্রভৃতির অপেক্ষা রাখে না বলেই সুনিশ্চিত জ্ঞানের পক্ষে পর্যাপ্ত নয়। যোগীদের প্রত্যক্ষও সেই রকম সুনিশ্চিত জ্ঞানের পক্ষে পর্যাপ্ত নয়। (তর্জমা দেবীপ্রসাদ)

আত্মপক্ষ সমর্থনে যে কোনো সম্প্রদায়ের দার্শনিকই নিজেদের অভিজ্ঞতার নজির দেখাতে পারেন। অতএব কুমারিল বলছেন, জাগ্রতপ্রত্যয়ে বাধক কোনো যোগ প্রত্যয় নেই; পক্ষান্তরে বাহ্যবস্তুবাদের সমর্থনে সাধারণ অভিজ্ঞতার নজির আছে। অতএব জাগ্রতপ্রত্যয়ও শেষ পর্যন্ত বাধিত হবে এ জাতীয় কল্পনা অসম্ভব (ঐ, কারিকা-৯৫-৯৬)।
ভাববাদী বলবেন, মরীচিকাদির ভ্রমপ্রত্যক্ষ এবং স্বপ্নপ্রত্যক্ষ জাগ্রতপ্রত্যক্ষকে বাধিত করে; উত্তরে কুমারিল বলছেন, এই ভ্রমপ্রত্যক্ষ এবং স্বপ্নপ্রত্যক্ষ তোমাদের যোগপ্রত্যক্ষরও বাধক হবে (ঐ, কারিকা-৯৭-১০১)।

ভাববাদীরা স্বপ্নপ্রত্যক্ষ দৃষ্টান্তের উপর একান্ত নির্ভরশীল। স্বপ্নপ্রত্যক্ষ মিথ্যা। ন্যায়বৈশেষিক সম্প্রদায়ের দার্শনিকদের সঙ্গে কুমারিল প্রশ্ন তুলেছেন, কিন্তু কোন্ অর্থে মিথ্যা ? ভাববাদী বলেন, নিরালম্বন অর্থে মিথ্যা। অর্থাৎ স্বপ্নপ্রত্যক্ষের বিষয় হিসেবে বহির্বস্তু নেই, অথচ স্বপ্নে বহির্বস্তুও প্রত্যক্ষ হয়, এই অর্থেই স্বপ্ন মিথ্যা। কুমারিল এবং ন্যায়বৈশেষিক উভয়েই তার তীব্র প্রতিবাদ করেছেন- স্বপ্নপ্রত্যক্ষ নিরালম্বন অর্থে মিথ্যা হতে পারে না। উভয়েই প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেনে, স্বপ্নপ্রত্যক্ষ মিথ্যা হলেও তার বিষয় মিথ্যা নয়; এই বিষয় আসলে বাহ্যবস্তুই- এই বাহ্যবস্তু দেশান্তরে ও কালান্তরে অবস্থিত এবং তা পূর্বানুভূত। সংক্ষেপে, স্বপ্নজ্ঞান পূর্বানুভূত বাহ্যপদার্থ বিষয়কই। তাই কুমারিল বলছেন (ঐ, কারিকা-১০৭-৯)-
‘স্বপ্নাদিপ্রত্যয়ে বাহ্যং সর্বথা ন হি নেষ্যতে।।
সর্বত্রালম্বনং বাহ্যং দেশকালান্যথাত্মকং।
জন্মন্যেকত্র ভিন্নে বা তথা কালান্তরেহপি বা।।
তদ্দেশো বাহন্যদেশো বা স্বপ্নজ্ঞানস্য গোচরঃ।’
অর্থাৎ : স্বপ্নজ্ঞানের কোনো বিষয় ইহজন্মে অনুভূত না হলেও পূর্বতন কোনো জন্মে তা অবশ্য অনুভূত। যে কোনো জন্মে, যে কোনো কালে, যে কোনো দেশে অনুভূত বিষয়ই স্বপ্নজ্ঞানের বিষয় হয়ে থাকে।

কিন্তু স্বপ্নে কিভাবে দেশান্তরে ও কালান্তরে অবস্থিত বাহ্যবস্তুও প্রতীতি ঘটে- বাহ্যবস্তুবাদীকে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়। কুমারিলের উত্তর অপেক্ষাকৃত সহজ। তিনি বলেছেন, স্বপ্নজ্ঞান স্মৃতিবিশেষ, প্রত্যক্ষজ্ঞান নয়। দেশান্তরে-কালান্তরে অবস্থিত পূর্বানুভূত বাহ্যবস্তুর স্মৃতি অবশ্যই হতে পারে এবং হয়ে থাকে। তাই এ নিয়ে বিশেষ সমস্যা নেই। কিন্তু ন্যায়বৈশেষিকেরা যদিও এ বিষয়ে কুমারিলের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত যে স্বপ্ন নিরালম্বন নয়,- তার বিষয় বলতে দেশান্তরে-কালান্তরে অবস্থিত পূর্বানুভূত বাহ্যবস্তুই,- তবুও তাঁরা স্বপ্নজ্ঞানকে স্মৃতি-বিশেষ বলে স্বীকার করতে সম্মত নন।
‘নৈয়ায়িক ও বৈশেষিক সম্প্রদায়ের কথা এই যে, স্বপ্নের পরে জাগরিত হইলে ‘আমি হস্তী দেখিয়াছিলাম’, ‘আমি পর্বত দেখিয়াছিলাম’, ইত্যাদিরূপেই ঐ স্বপ্নদর্শনের মানসজ্ঞান জন্মে; তদদ্বারা বুঝা যায় ঐ স্বপ্নজ্ঞান প্রত্যক্ষবিশেষ। উহা স্মৃতি হইলে ‘আমি হস্তী স্মরণ করিয়াছিলাম’ ইত্যাদিরূপেই উহার জ্ঞান হইত।’- (ফণিভূষণ, ন্যায়দর্শন-৫/১৪২)

কিন্তু স্বপ্নকে প্রত্যক্ষবিশেষ বললে ন্যায়বৈশেষিককে আরেকটি কঠিন প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়- দেশান্তরে ও কালান্তরে অবস্থিত বাহ্যবস্তুও প্রত্যক্ষ হয় কী করে ? কেননা, ন্যায়বৈশেষিকমতেও ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের সন্নিকর্ষে প্রত্যক্ষ হয়; কিন্তু দেশান্তরে ও কালান্তরে অবস্থিত বস্তুর সঙ্গে কীভাবে ইন্দ্রিয়সন্নিকর্ষ সম্ভব হবে ? উত্তরে পরবর্তীকালের নব্য-নৈয়ায়িকেরা জ্ঞানলক্ষণ সন্নিকর্ষজনিত একপ্রকার ‘অলৌকিক’ প্রত্যক্ষের কথা উল্লেখ করেন যা ভ্রমের ব্যাখ্যা হিসেবে অন্যথাখ্যাতিবাদে আলোচ্য-
‘ন্যায়াচার্যগণের মতেও স্বপ্নজ্ঞান অলৌকিক মানস প্রত্যক্ষবিশেষ।’- (ফণিভূষণ, ন্যায়দর্শন-৫/১৩৩)
তবে আপাতত লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, ন্যায়বৈশেষিকেরাও স্বপ্নের বিষয়কে বাহ্যবস্তু বলেই প্রমাণ করতে চেয়েছেন এবং এভাবেই ভারতীয় দর্শনে ভাববাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নজিরটি খন্ডন করেছেন-
‘কিন্তু স্বপ্নজ্ঞানের বিষয়গুলি পূর্বানুভূত, ইহা স্বীকার্য হইলে তদদৃষ্টান্তে প্রমাণ ও প্রমেয়কে অসৎ বা অলীক বলা যায় না। কারণ, স্বপ্নজ্ঞানের বিষয়গুলিও অলীক নহে। যাহা পূর্বানুভূত তাহা অলীক হইতে পারে না।’- (ফণিভূষণ, ন্যায়দর্শন-৫/১৪২)

স্বপ্নের বিষয় যে বাহ্যবস্তুই- ন্যায়বৈশেষিকদের এই মত মহামহোপাধ্যায় ফণিভূষণ সুদীর্ঘভাবে যে অতুলনীয় ব্যাখ্যা করেছেন বর্তমান আলোচনায় তা খুবই প্রাসঙ্গিক হিসেবে উদ্ধৃতিযোগ্য-
‘মহর্ষি  (গৌতম বা অক্ষপাদ) পূর্বোক্তমত খন্ডন করিতে পারে এই সূত্রের (ন্যায়সূত্র-৪/২/৩৪ : ‘স্মৃতি-সঙ্কল্পবচ্চ স্বপ্নবিষয়াভিমানঃ’) দ্বারা সিদ্ধান্ত প্রকাশ করিয়াছেন যে, স্বপ্নে বিষয়ভ্রম স্মৃতি ও সঙ্কল্পের তুল্য। ভাষ্যকার (বাৎস্যায়ন) সূত্রশেষে ‘পূর্বোপলব্ধ বিষয়ঃ’ এই পদের পূরণ করিয়া মহর্ষির বুদ্ধিস্থ তুল্যতা বা সাদৃশ্য প্রকাশ করিয়াছেন। যাহার বিষয় পূর্বে উপলব্ধ হইয়াছে, এই অর্থে বহুব্রীহি সমাসে ঐ পদের দ্বারা পূর্বানুভূতবিষয়ক, এই অর্থ বুঝা যায়। তাহা হইলে সূত্রশেষে ঐ পদের যোগ করিয়া সূত্রার্থ বুঝা যায় যে, যেমন স্মৃতি ও সঙ্কল্প পূর্বানুভূত পদার্থবিষয়ক, তদ্রƒপ স্বপ্নে বিষয়াভিমান অর্থাৎ স্বপ্ন-নামক ভ্রমজ্ঞানও পূর্বানুভূত পদার্থ-বিষয়ক।… যেমন স্মৃতি ও সঙ্কল্প পূর্বানুভূত পদার্থবিষয়ক হওয়ায় উহা তাহার সেই সমস্ত বিষয়ের অসত্তা সাধন করিতে পারে না, তদ্রƒপ স্বপ্নজ্ঞানও পূর্বানুভূত পদার্থবিষয়ক হওয়ায় উহা তাহার বিষয়ের অসত্তা সাধন করিতে পারে না। অর্থাৎ স্মৃতি ও সংকল্পের ন্যায় স্বপ্ন জ্ঞানের বিষয়ও অসৎ বা অলীক হইতে পারে না। কারণ, স্বপ্নজ্ঞানের পূর্বে ঐ বিষয় যথার্থজ্ঞানের বিষয় হওয়ায় উহা সৎ পদার্থ, ইহা স্বীকার্য। স্বপ্নজ্ঞান কিরূপে পূর্বানুভূত পদার্থবিষয়ক হয় ?… জাগরিতাবস্থায় যে-বিষয় দেখিয়াছে বা জানিয়াছে স্বপ্নাবস্থায় তাহাই বিষয় হওয়ায় উহা পূর্বানুভূত পদার্থ-বিষয়কই হইয়া থাকে।… যে ব্যক্তি সুপ্ত হইয়া স্বপ্ন দর্শন করে, সেই ব্যক্তিই জাগরিত হইয়া ‘আমি ইহা দেখিয়াছিলাম’ এইরূপে ঐ স্বপ্ন-দর্শন স্মরণ করে। তাৎপর্য এই যে, যে বিষয়ে স্বপ্ন-দর্শন হয় সেই বিষয়টি পূর্বানুভূত না হইলে তদ্বিষয়ে সংস্কার জন্মিতে পারে না। সংস্কার না জন্মিলেও তদ্বিষয়ে স্বপ্নদর্শন এবং ঐ স্বপ্নদর্শনের পূর্বোক্তরূপে স্মরণ হইতে পারে না। কিন্তু যখন তদ্বিষয়ে স্বপ্নদর্শনের পূর্বোক্তরূপে স্মরণ হয় এবং ঐ স্মরণে জ্ঞাতা ও জ্ঞানের ন্যায় সেই স্বপ্নদৃষ্ট পদার্থও বিষয় হয়, তখন সেই স্বপ্নদৃষ্ট বিষয়েও সংস্কার স্বীকার করিতে হইবে। তাহা হইলে তদ্বিষয়ে পূর্বানুভবও স্বীকার করিতে হইবে। কারণ, পূর্বানুভব সংস্কারের কারণ। অতএব স্বপ্নজ্ঞানের বিষয়গুলি যে জাগরিতাবস্থায় দৃষ্ট বা অনুভূত, ইহা স্বীকার্য।… মূলকথা, স্বপ্নজ্ঞান পূর্বানুভূত পদার্থ-বিষয়ক। সুতরাং জাগরিতাবস্থায় যে-বিষয় দৃষ্ট বা অনুভূত, সেই সৎপদার্থই স্বপ্নজ্ঞানের বিষয় হওয়ায় উহা অসৎ অর্থাৎ অলীক নহে।
প্রশ্ন হইতে পারে যে, স্বপ্নজ্ঞান অসদবিষয়ক হইলেই অসদবিষয়কত্ব হেতুর দ্বারা উহার ভ্রমত্ব নিশ্চয় করা যায়। কিন্তু যদি উহা সদবিষয়কই হয়, তাহা হইলে উহার ভ্রমত্ব নিশ্চয় কিরূপে হইবে ? স্বপ্নজ্ঞান যে ভ্রম ইহা তো উভয় পক্ষেরই সম্মত। ভাষ্যকার এই জন্য পরেই বলিয়াছেন যে, স্বপ্ন দর্শনের পূর্বোক্তরূপে স্মরণ হইলেই জাগ্রত ব্যক্তির বুদ্ধি-বিশেষের উৎপত্তিবশত তাহার ঐ স্বপ্নজ্ঞান মিথ্যা অর্থাৎ ভ্রম, এইরূপ নিশ্চয় জন্মে। অর্থাৎ তখন জাগ্রত ব্যক্তির এইরূপ বুদ্ধি-বিশেষের উৎপত্তি হয় যে, আমি যে-বিষয় দেখিয়াছিলাম, তাহা কিছুই এখানে নেই। এখানে অবিদ্যমান বিষয়েই আমার এই জ্ঞান হইয়াছে। তাই আমি এখানে ঐ সমস্ত বিষয়ের উপলব্ধি করিতেছি না। এইরূপ বুদ্ধি-বিশেষের উৎপত্তি হওয়ায় তাহার পূর্বজাত স্বপ্নজ্ঞান যে ভ্রম, ইহা নিশ্চয় হয়। কারণ, যে স্থানে যে বিষয় নাই, সেই স্থানে সেই বিষয়ের জ্ঞানই ভ্রম। স্বপ্নদ্রষ্টা যে স্থানে নানা বিষয়ের উপলব্ধি করে, সেই স্থানে সেই সমস্ত বিষয়ের অভাবের বোধ হইলেই তাহার সেই পূর্বজাত স্বপ্নজ্ঞানের ভ্রমত্বনিশ্চয় অবশ্যই হইবে। উহাতে স্বপ্ন দৃষ্ট বিষয়ের অলীকত্বজ্ঞান অনাবশ্যক।…
পূর্বপক্ষবাদী অবশ্যই বলিবেন যে, স্বপ্নজ্ঞান পূর্বানুভূত বিষয়ক হইলেও তাহার বিষয়ের সত্তা সিদ্ধ হয় না। কারণ, আমাদিগের মতে সমস্ত জ্ঞানই ভ্রম। সুতরাং সমস্ত বাহ্যবিষয়ই অসৎ বা অলীক। জাগ্রদবস্থায় যে সমস্ত বিষয়ের ভ্রমজ্ঞান হয়, তজ্জন্যই ঐ সমস্ত বিষয়ে সংস্কার জন্মে। সেই সমস্ত ভ্রমজ্ঞান জন্য অনাদি সংস্কারবশতই স্বপ্নজ্ঞানও তাহার স্মরণ হয়। উহার জন্য বিষয়ের সত্তা স্বীকার অনাবশ্যক। ভাষ্যকার এ জন্য পরে পূর্বপক্ষবাদীর উক্ত মতের মূলোচ্ছেদ করিতে বলিয়াছেন যে, স্বপ্নজ্ঞান ও জাগরিতজ্ঞানের বিশেষ না থাকিলে অর্থাৎ ঐ উভয় ভ্রম হইলে পূর্বপক্ষবাদীর ‘স্বপ্নবিষয়াভিমানবৎ’ এই দৃষ্টান্তবাক্য নিরর্থক হয়।… যথার্থ জ্ঞান ব্যতীত ভ্রমজ্ঞান জন্মিতে পারে না। পূর্বপক্ষবাদী যখন যথার্থ জ্ঞান একেবারে মানেন না, তখন তাঁহার মতে স্বপ্নজ্ঞান জন্মিতেই পারে না।…
পূর্বোক্ত সিদ্ধান্তে অবশ্যই আপত্তি হয় যে যাহা পূর্বে কখনও অনুভূত হয় নাই, এমন অনেক বিষয়ও স্বপ্ন হইয়া থাকে। শাস্ত্রেও নানা বিচিত্র দুঃস্বপ্ন ও সুস্বপ্নের বর্ণনা দেখা যায়- যাহার অনেক বিষয়ই পূর্বানুভূত নহে।… পরন্তু স্বপ্নে কোনো সময়ে নিজের মস্তক ভক্ষণ, মস্তক ছেদন এবং সূর্যধারণ, সূর্যভক্ষণাদি কত কত অননুভূত বিষয়েরও যে জ্ঞান জন্মে, তদ্বিষয়ে স্বপ্নদ্রষ্টা বহু প্রামাণিক ব্যক্তিই সাক্ষী আছেন। সুতরাং উহা অস্বীকার করা যাইবে না। বৃত্তিকার বিশ্বনাথ এখানে পূর্বোক্তরূপে আপত্তি প্রকাশ করিয়া তদুত্তরে বলিয়াছেন যে, স্বপ্নে নিজের শিরশচ্ছেদনাদি দর্শন স্থলেও ঐ জ্ঞানের বিষয়গুলি পৃথক পৃথক ভাবে ঐ স্বপ্নদ্রষ্টার পূর্বানুভূত। অর্থাৎ নিজের মস্তক তাহার পূর্বানুভূত এবং ছেদনাদি ক্রিয়াও তাহার পূর্বানুভূত। অন্যত্র ঐ ছেদনাদি ক্রিয়ার সম্বন্ধও তাহার পূর্বানুভূত। উহার মধ্যে কোনো পদার্থই ঐ স্বপ্নদ্রষ্টা ব্যক্তির একবারে অজ্ঞাত নহে। সেই ব্যক্তির নিজের মস্তকে ছেদনাদি ক্রিয়ার সম্বন্ধ কখনও না দেখিলেও উহা অন্যত্র দেখিয়াছে। নিজ মস্তকে ঐ সম্বন্ধবোধই তাহার ভ্রম এবং ঐ ভ্রমই তাহার স্বপ্ন। উহাতে পূর্বে নিজ মস্তকে ছেদনাদি ক্রিয়ার সম্বন্ধবোধ অনাবশ্যক। কিন্তু পৃথক পৃথক ভাবে নিজমস্তকাদি পদার্থগুলির বোধ ও তজ্জন্য সংস্কার আবশ্যক। কারণ, নিজমস্তকাদি পদার্থবিষয়ে কোনো সংস্কার না থাকিলে ঐরূপ স্বপ্ন হইতে পারে না। যে ব্যক্তি কখনও ছেদন-ক্রিয়া দেখে নাই অথবা তদ্বিষয়ে তাহার অন্য কোনোরূপ জ্ঞানও নাই, সে ব্যক্তি স্বপ্নেও ছেদন ক্রিয়াকে ছেদন বলিয়া বুঝিতে পারে না। ফল কথা, স্বপ্ন জ্ঞানের সমস্ত বিষয়ই পৃথক পৃথক রূপেও পূর্বানুভূত না হইলে তদ্বিষয়ে স্বপ্নজ্ঞান জন্মিতে পারে না। কারণ, স্বপ্নজ্ঞান সর্বত্রই সংস্কারজন্য।’- (ফণিভূষণ, ন্যায়দর্শন-৫/১৩৭-৪১)

অতএব, সংক্ষেপে, কুমারিল এবং ন্যায়-বৈশেষিক উভয়েই স্বীকার করছেন, স্বপ্নজ্ঞান অবশ্যই ভ্রমজ্ঞান। কিন্তু ভাববাদীরা যে অর্থে ভ্রমজ্ঞান বলেন সেই অর্থে নয়। ভাববাদী মতে, স্বপ্নজ্ঞান ভ্রম, কেননা তা নিরালম্বন- বাহ্যবস্তু বিষয় শূন্য। উত্তরে কুমারিল এবং ন্যায়-বৈশেষিক প্রমাণ করতে চেয়েছেন, স্বপ্নজ্ঞান ভ্রম হইলেও আসলে বাহ্য বিষয়কই- দেশান্তরে ও কালান্তরে পূর্বানুভূত বাহ্যবস্তুই স্বপ্নজ্ঞানের বিষয়, যদিও কুমারিল-মতে স্বপ্নে সেই বস্তুর স্মরণ হয় এবং ন্যায়-বৈশেষিক মতে তার প্রত্যক্ষ হয়। কিন্তু উভয় মতেই স্বপ্নজ্ঞান নির্বস্তু নয়; অতএব ভাববাদী যখন স্বপ্নজ্ঞানকে দৃষ্টান্ত করে সমস্ত জ্ঞানকে নিরালম্বন অর্থে মিথ্যা বলে অনুমান করতে চান তখন সে-অনুমান স্বীকারযোগ্য হতে পারে না।

ভাববাদীরা শুধু যে স্বপ্নের নজির দেখিয়ে সমস্ত জ্ঞানকেই নির্বস্তু অর্থে মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন তাই-ই নয়, তাঁরা একই উদ্দেশ্যে জাগ্রদবস্থার ভ্রমজ্ঞানের নজিরও উল্লেখ করেছেন।
ভাববাদী বলেন, বাহ্যবস্তুবাদীরা দাবি করেন যে স্বপ্নজ্ঞান মিথ্যা হলেও জাগ্রতজ্ঞান যথার্থ; স্বপ্নজ্ঞান বাধিত হয় বলেই তার মিথ্যাত্ব প্রতিপন্ন হয়; কিন্তু জাগ্রতজ্ঞান বাধিত হয় না, অতএব তার মিথ্যাত্বও প্রতিপন্ন হয় না। কিন্তু এ-কথা স্বীকারযোগ্য নয়, কেননা জাগ্রতজ্ঞানের ক্ষেত্রেও স্থাণুতে পুরুষ-দর্শন, রজ্জুতে সর্প-দর্শন, শুক্তিতে রজত-দর্শন, আকাশে গন্ধর্বনগর-দর্শন, মায়াবীর মায়া-দর্শন ইত্যাদি বহু ভ্রম-দর্শনের নজির রয়েছে। এগুলিকে কি নির্বস্তু-বিষয়ক জ্ঞান অর্থে মিথ্যা বলা হবে না ? স্থাণুতে পুরুষ-দর্শনকালে জ্ঞানের বিষয় হিসেবে পুরুষ বলে কোনো বাহ্য-বস্তু অবশ্যই নেই, রজ্জুতে সর্প-দর্শনকালে সর্প বলে কোনো বাহ্যবস্তু অবশ্যই নেই। তবুও এই অবস্তুই জ্ঞানের বিষয়। অতএব স্বীকার করতে হবে, এ-জাতীয় দৃষ্টান্তে বস্তুর অভাব সত্ত্বেও বস্তুর প্রতীতি ঘটে।

ভাববাদ-খন্ডনে জাগ্রদবস্থার ভ্রমজ্ঞান সংক্রান্ত ব্যাখ্যার নিমিত্তে বাহ্যবস্তুবাদীর দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতীয় দর্শনে ভ্রমজ্ঞানের প্রধানত দুটি ব্যাখ্যা প্রস্তাবিত হয়েছে। একটি হলো প্রাভাকর-মীমাংসকদের অখ্যাতিবাদ, অন্যটি ন্যায়-বৈশেষিক ও ভাট্ট-মীমাংসকদের অন্যথাখ্যাতিবাদ।
অখ্যাতিবাদ অনুসারে ভ্রমজ্ঞান বলে আসলে কিছু নেই। শুক্তি-রজতের দৃষ্টান্তে আসলে দুটি স্বতন্ত্র জ্ঞান আছে- শুক্তিকে ‘ইদং’ বলে গ্রহণাত্মক একটি জ্ঞান এবং হট্টস্থ রজতের স্মরণাত্মক আর একটি দ্বিতীয় জ্ঞান। উভয়ের মধ্যে কোনো জ্ঞানই নির্বস্তু নয়; উভয়ের বিষয়ই বাহ্যবস্তু। কিন্তু এই দ্বিবিধ জ্ঞানের মধ্যে ভেদমূলক জ্ঞানের অভাবকেই ভ্রম বলে। অর্থাৎ, ভ্রমজ্ঞান আসলে জ্ঞানই নয়, ভেদমূলক জ্ঞানের অভাব। তাই ভ্রম বলে সত্যিই কিছু নেই।
আর অন্যথাখ্যাতিবাদ অনুসারে ভ্রম আছে, কিন্তু ভ্রম নির্বস্তু নয়- ভ্রমের বিষয় হলো দেশান্তরে বা কালান্তরে পূর্বানুভূত বাহ্যবস্তুই। জ্ঞান-কারণ-দোষের নিমিত্তে সাদৃশ্যগত বিভ্রমের ফলে জাগ্রত ভ্রমজ্ঞান জন্মে। অতএব দেখা যায় বাহ্যবস্তুবাদের পক্ষে প্রস্তাবিত দ্বিবিধ ব্যাখ্যার পার্থক্য সত্ত্বেও একটি কথা উভয়সম্মত- ভ্রম নির্বস্তু নয়, বাহ্যবস্তু বিষয়কই।

কুমারিল বলছেন ( শ্লোকবার্তিক, নিরালম্বনবাদ, কারিকা-১১৬-৭), ভাববাদীর সঙ্গে আমাদের মূল বিতর্কের বিষয় হলো, বাহ্যবস্তু বলে কিছু আছে কিনা। এবং এমনকি আকাশে গন্ধর্বনগর-দর্শন বা মরীচিকায় জল-দর্শন প্রভৃতি জ্ঞানও আসলে বাহ্যবস্তু-বিহীন নয়; অর্থাৎ জাগ্রদবস্থার ভ্রমজ্ঞানের বিষয়ও বাহ্যবস্তুই। কীভাবে ?-
‘গন্ধর্বনগরেহভ্রাণি পূর্বদৃষ্টং গৃহাদি চ।
পূর্বানুভূততোয়ং চ রশ্মিতপ্তোষরং তথা।।
মৃগতোয়স্য বিজ্ঞানে কারণত্বেন কাল্প্যতে।’- (ঐ, কারিকা ১১০-১)
অর্থাৎ : আকাশে গন্ধর্বনগর-দর্শনের নিমিত্ত হলো মেঘ এবং পূর্বানুভূত গৃহাদি। মরীচিকায় জল-দর্শন স্থলে নিমিত্ত হলো পূর্বানুভূত জল। এই বাহ্যবস্তুগুলিই ভ্রমজ্ঞানের বিষয়; অতএব ভ্রমজ্ঞানও বাহ্যবস্তুশূন্য নয়।

ভ্রমজ্ঞানের বিষয় যে প্রকৃত বা যথার্থ বাহ্যবস্তুই, একথা স্বীকার করলে কুমারিলের পক্ষে অবশ্যই আরও স্বীকার করা প্রয়োজন যে, ভ্রমজ্ঞানের পর যথার্থজ্ঞানের উদ্ভব হলে শুধুমাত্র ভ্রমজ্ঞানটিরই নিরসন হয়, কিন্তু ভ্রমজ্ঞানের বিষয় যে বাহ্যবস্তু তার নিবৃত্তি বা অভাব হয় না। বস্তুত, বাহ্যবস্তুবাদের সমর্থনে ন্যায়-বৈশেষিকেরা সুস্পষ্টভাবে এই যুক্তিরই অবতারণা করেছেন। তাঁরা বলছেন, ভ্রমজ্ঞানের বাধক যে-যথার্থজ্ঞান তার সাক্ষ্য উল্লেখ করে ভাববাদী দাবি করবেন, ভ্রমজ্ঞান নির্বস্তু। ভাববাদী বলবেন-
‘ভ্রমজ্ঞানের বিপরীত যথার্থজ্ঞান স্বীকার করিলে তদ্দ¦ারাও পূর্বজাত ভ্রমজ্ঞানের বিষয়গুলির অলীকত্ব প্রতিপন্ন হইবে। কারণ, তত্ত্বজ্ঞান হইলে তখন বুঝা যাইবে যে, পূর্বজাত ভ্রমজ্ঞানের বিষয়গুলি নাই, উহা থাকিলে কখনই ভ্রমজ্ঞান হইত না; সুতরাং উহা অলীক।’- (ফণিভূষণ, ন্যায়দর্শন-৫/১৪৪)
উত্তরে ন্যায়-বৈশেষিক বলেন,- ‘তত্ত্বজ্ঞানপ্রযুক্ত ভ্রমজ্ঞানেরই নিবৃত্তি হয়; কিন্তু ভ্রমজ্ঞানের বিষয়ের অলীকত্ব প্রতিপন্ন হয় না।… স্থাণুতে পুরুষবুদ্ধি, পুরুষভিন্ন পদার্থে পুরুষবুদ্ধি, সুতরাং উহা মিথ্যা উপলব্ধি, অর্থাৎ ভ্রমজ্ঞান। এবং স্থাণুতে স্থাণুবুদ্ধি তত্ত্বজ্ঞান বা যথার্থজ্ঞান। ঐ তত্ত্বজ্ঞান জন্মিলে সেই পূর্বজাত স্থাণুতে পুুরুষবুদ্ধিরূপ ভ্রমজ্ঞানেরই নিবৃত্তি হয়, কিন্তু স্থাণু ও পুরুষরূপ পদার্থসামান্য অর্থাৎ সামান্যতঃ সমস্ত স্থাণু এবং সমস্ত পুরুষ পদার্থেও নিবৃত্তি বা অভাব হয় না। অর্থাৎ তত্ত্বজ্ঞানের দ্বারা ভ্রমজ্ঞানের বিষয়ের অলীকত্ব প্রতিপন্ন হয় না। যেমন জাগরণ হইলে তখন যে জ্ঞানোৎপত্তি হয় তজ্জন্য স্বপ্নকালীন বিষয়-ভ্রমেরই নিবৃত্তি হয়, কিন্তু ঐ স্বপ্নের বিষয়সামান্যের নিবৃত্তি হয় না। অর্থাৎ তদ্দ¦ারা স্বপ্নজ্ঞানের বিষয়ের অলীকত্ব প্রতিপন্ন হয় না।… তত্ত্বজ্ঞান ভ্রমজ্ঞানের বিরোধী, কিন্তু ভ্রমজ্ঞানের বিষয়ের বিরোধী নয়। সুতরাং উহা ভ্রমজ্ঞানেরই নিবর্তক হয়, বিষয়ের নিবর্তক হয় না।’- (ফণিভূষণ, ন্যায়দর্শন-৫/১৪৫)

ন্যায়-বৈশেষিকেরা এই প্রসঙ্গে আরও একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ যুক্তির অবতারণা করেছেন। ‘মায়া প্রভৃতি স্থলে যে মিথ্যা জ্ঞান বা ভ্রম জন্মে তাহা উপাদানবিশিষ্ট, অর্থাৎ নিমিত্ত-বিশেষজন্য।… মায়াপ্রয়োগের উপকরণবিশিষ্ট মায়িক ব্যক্তি দ্রষ্টাদিগকে যাহা দেখাইবে, তাহার সদৃশাকৃতি দ্রব্যবিশেষ গ্রহণ করিয়া অপরের ভ্রমজ্ঞান উৎপন্ন করে।… ভাষ্যকার পরে গন্ধর্বনগর-ভ্রমও যে নিমিত্তবিশেষজন্য ইহা বুঝাইতে বলিয়াছেন যে, নীহার প্রভৃতির নগররূপে সন্নিবেশ হইলেই দূর হইতে নগরবুদ্ধি জন্মে, নচেৎ ঐ নগরবুদ্ধি জন্মে না। অর্থাৎ আকাশে হিম বা মেঘ নগরাকারে সন্নিবিষ্ট হইলে দূরস্থ ব্যক্তি তাদৃশ হিমাদিকেই গন্ধর্বনগর বলিয়া ভ্রম করে। ঐ স্থলে হিমাদির নগরাকারে সন্নিবেশ ও দ্রষ্টার দূরস্থতা ঐ ভ্রমের নিমিত্ত। দ্রষ্টা আকাশস্থ ঐ হিমাদির নিকটস্থ হইলে তখন তাহার ঐ ভ্রম জন্মে না।… কোনো স্থানে কোনো কালে কোনো ব্যক্তিবিশেষেরই যখন ঐ সমস্ত ভ্রমজ্ঞান জন্মে, সর্বত্র সর্বকালে সকল ব্যক্তিরই যখন উহা জন্মে না, তখন ঐ সমস্ত ভ্রমজ্ঞান নির্নিমিত্তক নহে, ইহা স্বীকার্য। অর্থাৎ ঐ সমস্ত ভ্রমজ্ঞানে ঐ সমস্ত নিমিত্তবিশেষের কোনো অপেক্ষা না থাকিলে সর্বত্র সর্বকালে সমস্ত ব্যক্তিরই ঐ সমস্ত ভ্রমজ্ঞান হইতে পারে। কিন্তু পূর্বপক্ষবাদীও তাহা স্বীকার করেন না। অতএব ঐ সমস্ত ভ্রমজ্ঞানে ঐ সমস্ত নিমিত্তবিশেষের কারণত্ব স্বীকার করিতে তিনিও বাধ্য। তাহা হইলে নিমিত্তের অভাবে সর্বকালে সকল ব্যক্তির ঐ সমস্ত ভ্রম জন্মে না, ইহা তিনিও বলিতে পারেন। কিন্তু ঐ সমস্ত নিমিত্তের সত্তা অস্বীকার করিয়া সর্বত্র সমস্ত বিষয়ের অসত্তা বা অলীকত্ববশত সকল জ্ঞানেরই ভ্রমত্ব সমর্থন করিতে গেলে সর্বকালে সকল ব্যক্তিরই মায়াদি স্থলীয় সেই সমস্ত ভ্রমজ্ঞান কেন জন্মে না, ইহা তিনি বলিতে পারেন না। অতএব ঐ সমস্ত ভ্রমজ্ঞান স্থলে পূর্বোক্ত ঐ সমস্ত নিমিত্তের সত্তা স্বীকার্য। তাহা হইলে মায়াদি দৃষ্টান্তের দ্বারা পূর্বপক্ষবাদী প্রমাণ ও প্রমেয়-বিষয়ক সমস্ত জ্ঞানকেই ভ্রম বলিয়া প্রমাণ ও প্রমেয়ের অসত্তা বা অলীকত্ব প্রতিপন্ন করিতে পারেন না। কারণ মায়াদি স্থলের ন্যায় সর্বত্র সমস্ত ভ্রমেরই নিমিত্তবিশেষ তাঁহারও অবশ্য স্বীকার্য। তাহা হইলে সমস্ত পদার্থই অসৎ বা অলীক, ইহা বলা যায় না। সুতরাং সমস্ত জ্ঞানকেই ভ্রমও বলা যায় না। অতএব পূর্বপক্ষবাদীর ঐ মত তাঁহার ঐ দৃষ্টান্তের দ্বারা সিদ্ধ হয় না। ভাষ্যকার ইহা সমর্থন করিতে শেষে তাঁহার চরম যুক্তি বলিয়াছেন যে, মায়াপ্রয়োগকারী এবং মায়ানভিজ্ঞ দর্শক ব্যক্তির বুদ্ধির ভেদ দেখাও যায়। অর্থাৎ মায়াপ্রয়োগকারী ঐন্দ্রজালিক বা বাজিকর মায়াপ্রভাবে যে সমস্ত দ্রব্য দেখাইয়া থাকে, ঐ সমস্ত দ্রব্য অসত্য বলিয়ই তাহার জ্ঞান হয়। কিন্তু মায়ানভিজ্ঞ দর্শক উহা সত্য বলিয়াই তখন বুঝে। অর্থাৎ ঐ স্থলে ঐন্দ্রজালিকের নিদেও দর্শন তৎকালেই বাধজ্ঞানবিশিষ্ট, দর্শকদিগের দর্শন তৎকালে বাধজ্ঞানশূন্য। সুতরাং ঐ স্থলে ঐ উভয়ের বুদ্ধি বা জ্ঞান একরূপ নহে। এইরূপ দূরস্থ ব্যক্তির আকাশে যে গন্ধর্বনগর ভ্রম হয়, এবং মরীচিকায় জলভ্রম হয়, তাহা নিকটস্থ ব্যক্তির হয় না।… সুতরাং ঐ স্থলে দূরস্থ ও নিকটস্থ ব্যক্তির বুদ্ধি বা জ্ঞানও একরূপ নহে।… সকল পদার্থের অভাব হইলে অর্থাৎ সকল পদার্থই নিরূপাখ্য বা নিঃস্বরূপ হইলে পূর্বোক্ত বুদ্ধিভেদের উৎপত্তি হয় না।… কারণ যাহা অলীক তাহা সকলের পক্ষেই অলীক। তাহা কোনো কালে কোনো স্থানে কোনো ব্যক্তি সত্য বলিয়া বুঝিবে এবং কোনো ব্যক্তি তাহা অসৎ বলিয়া বুঝিবে, ইহার কোনো হেতু নাই।’- (ফণিভূষণ, ন্যায়দর্শন-৫/১৪৬-৯)

বস্তুত ভারতীয় দর্শনে বৌদ্ধ বিজ্ঞানবাদী ও শূন্যবাদী এবং বৈদান্তিক গৌড়পাদপ্রমুখ সমস্ত ভাববাদীই স্বপ্ন, ভ্রম প্রভৃতিকে দৃষ্টান্ত করেই ভাববাদের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় অনুমান করতে চেয়েছেন। অতএব, বাহ্যবস্তুবাদীর দৃষ্টিকোণ থেকে কুমারিল এবং ন্যায়-বৈশেষিকের উপরিউক্ত বিচার কোনো এক সম্প্রদায়বিশেষের বিরুদ্ধে উদ্দিষ্ট বলে গ্রহণ না করে সাধারণভাবে ভাববাদ খন্ডনেই প্রযুক্ত বলে গ্রহণ করা উচিৎ। এবার ভাববাদ-খন্ডনে বাহ্যবস্তুবাদীদের অন্যান্য বিচার দেখা যেতে পারে।

কুমারিলের বিচার অনুসারে, আমরা আগেই দেখেছি, ভাববাদীর প্রমাণাশ্রিত যুক্তি দ্বিবিধ- অনুমানাশ্রিত এবং প্রত্যক্ষশক্তিপরীক্ষণাশ্রিত। শ্লোকবার্তিকে ‘নিরালম্বনবাদ’ শীর্ষক অংশে কুমারিল প্রথমটি খন্ডন করার পর ‘শূন্যবাদ’ শীর্ষক অংশে দ্বিতীয়টি খন্ডন করতে অগ্রসর হয়েছেন। ভারতীয় দার্শনিক আলোচনার প্রথা অনুসারে কুমারিল এখানেও প্রথমেই সুদীর্ঘভাবে ভাববাদ ব্যাখ্যায় পূর্বপক্ষ বর্ণন করেছেন। তিনি বলছেন-
‘ভাববাদী বলবেন, মূল প্রশ্ন এই যে, স্তম্ভাদি বাহ্যবস্তুর সত্তা স্বীকার করলে পরই কি জ্ঞানের- বিশেষত প্রত্যক্ষজ্ঞানের বা প্রত্যক্ষবুদ্ধির- ব্যাখ্যা পাওয়া সম্ভব, না কি প্রত্যক্ষবুদ্ধি বিষয় হিসেবে বাহ্যবস্তুর পরিবর্তে নিজের উপর নির্ভরশীল ? যদি দেখা যায়, প্রত্যক্ষবুদ্ধির বিষয় বাহ্যবস্তুই তাহলে ইতঃপূর্বে ভাববাদের বিরুদ্ধে যে সব যুক্তি প্রযুক্ত হয়েছে তা স্বীকৃত হবে; কিন্তু প্রত্যক্ষবুদ্ধির পক্ষে স্বগ্রহণ প্রমাণিত হলে- অর্থাৎ, যদি দেখা যায় প্রত্যক্ষবুদ্ধির বিষয় বলতে বুদ্ধিই- তাহলে উক্ত যুক্তির একটিও স্বীকৃত হবে না।’- ( শ্লোকবার্তিক, শূন্যবাদ, কারিকা ৩-৪)

স্বভাবতই ভাববাদী দেখাতে চাইবেন, প্রত্যক্ষশক্তিকে পরীক্ষা করলে শুধুমাত্র দ্বিতীয় সম্ভাবনাটিই প্রমাণিত হয়। কীভাবে ?
‘ভাববাদী বলছেন, প্রত্যক্ষবুদ্ধি স্থলে ঠিক কী উপলব্ধ হয় ? ঠিক কিসের উপলব্ধি ঘটে ? একথা সর্বস্বীকৃত যে, নীল, পীত, হ্রস্ব, দীর্ঘ প্রভৃতি আকারই উপলব্ধ হয়। কিন্তু জ্ঞেয় বিষয় হিসেবে এই আকারগুলির কোনো স্বতন্ত্র বা পৃথক উপলব্ধি হয় না। এগুলি উপলব্ধি হিসেবেই উপলব্ধ হয়। এবং জ্ঞেয় বিষয়ের কোনো পৃথক উপলব্ধি হয় না বলেই জ্ঞেয় বিষয়ের পৃথক সত্তা স্বীকার্য নয়। অতএব, জ্ঞান ও জ্ঞেয় বিষয় বস্তুত অভিন্ন।’- (ঐ, কারিকা ৫-৬)
তাহলে নীল, পীত, হ্রস্ব, দীর্ঘ প্রভৃতির অর্থ কী ? ভাববাদী বলবেন, নীলাকার জ্ঞানবিশেষই নীল; কেননা এই নীলাকার জ্ঞানবিশেষ ছাড়া নীলের কোনো স্বতন্ত্র উপলব্ধি নেই। পীতাকার জ্ঞানবিশেষই পীত; কেননা এই পীতাকার জ্ঞানবিশেষ ছাড়া পীতের কোনো স্বতন্ত্র উপলব্ধি নেই। অতএব, নীল, পীত, প্রভৃতিকে বাহ্যবস্তু বা বাহ্যবস্তুর আকার বলা যায় না। কারণ, ভাববাদী বলেন, যা জ্ঞাত হয় বা অনুভূত হয়, শুধুমাত্র তারই সত্তা স্বীকার্য; অজ্ঞাত বা অননুভূত বিষয়ের সত্তা স্বীকার্য নয়। এবং যা জ্ঞাত তা জ্ঞাততালক্ষণযুক্ত, অতএব জ্ঞান-নিরপেক্ষ বাহ্যবস্তুর সত্তা অসম্ভব। তাহলে পূর্বোক্ত দ্বিবিধ সম্ভাবনার মধ্যে কোনটি স্বীকার্য ? জ্ঞানই জ্ঞানের বিষয়, না, জ্ঞানাতিরিক্ত বাহ্যবস্তু জ্ঞানের বিষয় ? জ্ঞানাতিরিক্ত বাহ্যবস্তুর জ্ঞান সম্ভব নয়, অতএব তার সত্তাও সম্ভব নয়; অতএব স্বীকার করতে হবে জ্ঞানই জ্ঞানের বিষয়, যে আকারের অনুভূতি হয় তা জ্ঞানেরই আকার, অর্থাৎ জ্ঞানই সাকার, জ্ঞানাতিরিক্ত আকারবিশিষ্ট কোনো বাহ্যবস্তু নেই।- (ঐ, কারিকা ৭-১০)
ভারতীয় দর্শনে বিশেষত বৌদ্ধভাববাদী অর্থাৎ বিজ্ঞানবাদীরাই এই যুক্তির ব্যাখ্যা করেছেন; স্বভাবতই এ যুক্তিকে বিজ্ঞানবাদের মূল ভিত্তি বলে গ্রহণ করা হয়। বিজ্ঞানবাদীদের পরিভাষায় এর নাম সহোপলম্ভনিয়ম। ‘সহোপলম্ভ’ অর্থে জ্ঞান ও জ্ঞেয়ের এক বা অভিন্ন উপলব্ধিই বিবক্ষিত হয়। মহামহোপাধ্যায় ফণিভূষণ তর্কবাগীশের ব্যাখ্যায়-
“সহোপলম্ভনিয়মাৎ’ ইত্যাদি কারিকার দ্বারা কথিত হইয়াছে যে, নীল জ্ঞান স্থলে নীল ও তদ্বিষয়ক যে জ্ঞান, তাহার ভেদ নাই। নীলাকার জ্ঞানবিশেষই নীল। এইরূপ সর্বত্রই জ্ঞানের বিষয় হিসেবে যাহা কথিত হয়, তাহা সমস্তই সেই জ্ঞানেরই আকারবিশেষ। জ্ঞান হইতে বিষয়ের পৃথক সত্তা নাই। জ্ঞান ব্যতিরেকে জ্ঞেয় অসৎ। ইহার হেতু বলা হইয়াছে ‘সহোপলম্ভনিয়মাৎ’।… সর্বত্রই জ্ঞানের উপলব্ধিই বিষয়ের উপলব্ধি। জ্ঞানের উপলব্ধি ভিন্ন বিষয়ের পৃথক উপলব্ধি নাই, ইহাই ‘সহোপলম্ভ নিয়ম’। উহার দ্বারা জ্ঞান ও জ্ঞেয়ের যে ভেদ নাই, ইহা সিদ্ধ হয়। কিন্তু ভ্রান্তিবশত যেমন একই চন্দ্রকে দ্বিচন্দ্র বলিয়া দর্শন করে, অর্থাৎ ঐ স্থলে যেমন চন্দ্র এক হইলেও তাহাতে ভেদ দর্শন হয়, তদ্রƒপ জ্ঞান ও জ্ঞেয় বিষয়ের ভেদ না থাকিলেও ভেদ দর্শন হয়। ফলকথা, পূর্বোক্ত ‘সহোপলম্ভনিয়ম’ শব্দে ‘সহ’ শব্দের অর্থ এক বা অভিন্ন- উহার অর্থ সাহিত্য নহে। ‘তত্ত্বসংগ্রহপঞ্জিকা’য় কমলশীল… পূর্বোক্ত ‘সহোপলম্ভ’র উক্তরূপ ব্যাখ্যা স্পষ্ট করিয়াই বলিয়াছেন।’- (ফণিভূষণ, ন্যায়দর্শন-৫/১৬৩)

ভারতীয় দর্শনে ভাববাদ সমর্থনে সুদূর অতীতেই মূলত জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় সম্পর্কিত এই যুক্তি প্রস্তাবিত হয়েছিলো এবং বাহ্যবস্তুবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে মীমাংসক ও ন্যায়-বৈশেষিক তা বিচারপূর্বক প্রত্যাখ্যান করেছেন। শ্লোকবার্তিকের ‘শূন্যবাদ’ শীর্ষক অংশে পূর্বপক্ষ ব্যাখ্যায় কুমারিল ভাববাদীদের অন্যান্য যুক্তিও উল্লেখ করেছেন। যেমন-
ভাববাদী বলেন, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় অভিন্ন বলেই বাহ্যত্বর প্রশ্নই অবান্তর ( শ্লোকবার্তিক, শূন্যবাদ, কারিকা-১৪)। অতএব জ্ঞেয় বিষয়ের আকার জ্ঞানেরই আকার ছাড়া আর কিছুই নয়। তার একটি সুস্পষ্ট দৃষ্টান্ত হলো স্মৃতি : স্মরণমূলক প্রতীতি অবশ্যই সাকার বা আকারবিশিষ্ট, কিন্তু এই আকার বাহ্যবস্তুর আকার হতে পারে না, কেননা স্মৃতিস্থলে বাহ্যবস্তু বলে কিছু নেই। অতীতের জ্ঞানই স্মৃতির বিষয়। অতএব উক্ত আকার স্পষ্টতই সেই জ্ঞানের আকার (ঐ, কারিকা ২৮-৯)। বর্তমান প্রত্যক্ষর দৃষ্টান্তেও দেখা যায়, আকার ব্যতীত প্রতীতি হয় না, অতএব আকারকে প্রতীতিরই আকার বলতে হবে (ঐ, কারিকা-৩৮)। অপরপক্ষে, বাহ্যবস্তুবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে প্রত্যক্ষ জ্ঞানের সম্ভাবনাই নেই; কেননা তার জন্য জ্ঞান ও বিষয়ের মধ্যে যোগ স্থাপন হওয়া প্রয়োজন, কিন্তু বিষয় যদি বাহ্য হয় ও জ্ঞান আন্তঃ হয় এবং বিষয় যদি জড়বস্তু হয় এবং জ্ঞান চেতনবস্তু হয়- তাহলে উভয়ের মধ্যে যোগ স্থাপন অসম্ভব (ঐ, কারিকা ৪২-৪)। দ্বিচন্দ্রাদির প্রত্যক্ষর দৃষ্টান্তে স্পষ্টই দেখা যায় জ্ঞানের আকার বাহ্য-বস্তুর আকার-জন্য হতে পারে না (ঐ, কারিকা-৫৭)। তাছাড়া, একই সুন্দরী রমণীর শবদেহ সাধু কুকুর এবং লম্পটের মধ্যে ত্রিবিধ ধারণা উদ্রেক করে- ধারণা যদি বাহ্যবস্তু নিয়ন্ত্রিত হয় তাহলে এক পদার্থর পক্ষে একই ধারণার উদ্রেক সম্ভব হবে; কিন্তু ত্রিবিধ ধারণার উদ্রেক থেকেই বোঝা যায়, ধারণা জ্ঞাতার উপরই নির্ভরশীল, বাহ্যবস্তুর উপর নয় (ঐ, কারিকা ৫৮-৯)। তেমনি একই পদার্থের কখনো দীর্ঘ কখনো হ্রস্ব প্রতীতি ঘটে, একই ঘট কখনো ঘট হিসেবে কখনো মৃন্ময় হিসেবে, ইত্যাদি নানাভাবে প্রতীত হয়; অতএব প্রমাণ হয় প্রতীতিগুলি জ্ঞাতার উপরই নির্ভরশীল, তথাকথিত কোনো বাহ্যবস্তুর উপর নয় (ঐ, কারিকা-৬০)। অতএব, সংক্ষেপে, কোনোদিক থেকেই বাহ্যবস্তুর সত্তা স্বীকার্য নয়।

ভাববাদীর এই যুক্তিগুলি কুমারিল সুদীর্ঘভাবে খন্ডন করেছেন। তাঁর বক্তব্য হলো (পন্ডিত দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ে ‘ভারতীয় দর্শন’ পৃ-২৮৭ এ উদ্ধত)-
জ্ঞান ও জ্ঞেয় যে বস্তুত অভিন্ন এ বিষয়ে কোনো প্রমাণ নেই; কোনো একটি দৃষ্টান্তেই দেখা যায় না যে, গ্রাহকভাব ও গ্রাহ্যভাব একই পদার্থে বর্তমান ( শ্লোকবার্তিক, শূন্যবাদ, কারিকা-৬৪ ও ১২০)। জ্ঞেয়র উপলব্ধি অবধারিতভাবে বিষয়ের উপলব্ধি, তা কখনোই জ্ঞানের উপলব্ধি নয়। নীলাদি আকার যখন উপলব্ধ হয় তখন কখনোই এ উপলব্ধি হয় না যে, আকারগুলি জ্ঞানেরই আকার; পক্ষান্তরে আকারগুলি বিষয়ের আকার বলেই উপলব্ধ হয় (ঐ, কারিকা-৭৪)। অর্থাৎ, নীল পীতাদির প্রত্যক্ষস্থলে প্রত্যক্ষই যে নীল বা পীত এ জাতীয় কোনো উপলব্ধি ঘটে না; বস্তুত নীল পীতাদি প্রত্যক্ষর বিষয় হিসেবেই অনুভূত হয়; অতএব, ভাববাদীর দাবি প্রত্যক্ষবিরুদ্ধ। জ্ঞান ও জ্ঞেয় অভিন্ন হলে জ্ঞেয় বিষয়ের বিচ্ছিন্ন উপলব্ধি অসম্ভব হতো; কিন্তু জ্ঞানের ধারণা ব্যতিরেকেও জ্ঞেয় বিষয়ের বিচ্ছিন্ন উপলব্ধ হয় (ঐ, কারিকা-৭৯)। পক্ষান্তরে, জ্ঞেয় বিষয় ব্যতিরেকেও জ্ঞানের উপলব্ধি হয়; যথা, “অমুক সময়ে আমি কোনো বিষয় অবগত হয়েছি বলে স্মরণ হয় না,”- এ জাতীয় অভিজ্ঞতার দৃষ্টান্তে দেখা যায় জ্ঞেয় বিষয় ব্যতীতই জ্ঞানের স্মরণ ঘটে; কিন্তু জ্ঞান ও জ্ঞেয় অভিন্ন হলে জ্ঞানের স্মরণে অবশ্যই বিষয়েরও স্মরণ হতো (ঐ, কারিকা ৮৩-৪)।
কুমারিল সুদীর্ঘ যুক্তির অবতারণা করে প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন যে, জ্ঞাতা এবং জ্ঞেয় যদি অভিন্ন হয় তাহলে এই দ্বিবিধভাবে তার উল্লেখ অর্থহীন আর যদি ভিন্নভাবে উল্লেখের কারণ থাকে তাহলে উভয়ের অভিন্নত্ব প্রতিপাদন অসম্ভব (ঐ, কারিকা ১২১-৯)। ভাববাদীরা বলেন সবই জ্ঞান- কোনো জ্ঞান জ্ঞাতা হিসেবে প্রতীত হয়, কোনো জ্ঞান জ্ঞেয় হিসেবে প্রতীত হয়; কিন্তু জ্ঞান যদি জ্ঞেয় এবং জ্ঞাতা থেকে পৃথক না হয় তাহলে এ জাতীয় উক্তি অর্থহীন ( কোনো পার্থক্যই যদি না থাকে তাহলে একটি জ্ঞানকে জ্ঞাতা এবং অপর একটিকে জ্ঞেয় বলার এবং জ্ঞান শব্দ ছাড়াও জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় শব্দ ব্যবহারের তাৎপর্য কী?); অপরপক্ষে যদি স্বীকার কর যে জ্ঞান, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় কোনো অর্থে পৃথক তাহলে এগুলির মধ্যে অভিন্নত্ব প্রতিপাদনে চেষ্টা কেন? (ঐ, কারিকা ১৩০-৩)।
ভাববাদীরা স্মৃতির দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে প্রমাণ করতে চান জ্ঞানই সাকার- যে আকারের প্রতীতি হয় তা বাহ্যবস্তুর আকার নয়। উত্তরে কুমারিল বলছেন, স্মৃতির দৃষ্টান্তে যে আকার প্রতীত হয় তাও অবশ্যই বাহ্যবস্তুরই আকার, কেবল এই বাহ্যবস্তু কালান্তরগত (ঐ, কারিকা ১৫৯-৬১)। আমরা ইতঃপূর্বেই দেখেছি, বাহ্যবস্তুবাদের সমর্থনে কুমারিল এবং ন্যায়-বৈশেষিক উভয়েই দাবি করেছেন যে, স্বপ্ন নির্বস্তু নয়; দেশান্তর ও কালান্তরে অবস্থিত বাহ্যবস্তুই প্রকৃতপক্ষে স্বপ্নের বিষয় হয়। স্মৃতির ব্যাখ্যাতেও কুমারিল এই কথাই বলেছেন- স্মরণের বিষয় পূর্বানুভূত বস্তুই, পূর্বের কোনো জ্ঞান নয়; এই বস্তুরই স্মরণ হয় এবং এই বস্তু-স্মরণের উপর নির্ভর করেই পূর্বজ্ঞানের স্মৃতি হয় (ঐ, কারিকা-১৯২ ও ১৯৯)।

প্রতীত আকার যে জ্ঞানেরই আকার- বস্তুর আকার নয়- তার নজির হিসেবে ভাববাদীরা ভ্রমজ্ঞান উল্লেখ করেন; কিন্তু কুমারিল বলছেন, ইতঃপূর্বে ‘নিরালম্বনবাদের আলোচনা প্রসঙ্গেই প্রদর্শিত হয়েছে যে, বহু দৃষ্টান্তেই দেখা যায় ভ্রমজ্ঞানের কারণ বস্তুর অভাব নয়, আসলে দেশ ও কালমূলক ভ্রান্তিই (ঐ, কারিকা-২০১)। অর্থাৎ ভ্রমজ্ঞান নির্বস্তু নয়; দেশান্তরে ও কালান্তরে অবস্থিত বস্তুরই প্রতীতি। এমন কি প্রত্যক্ষজ্ঞান ছাড়া অন্যান্য প্রমাণের দৃষ্টান্তে দেখা যায় ভূত ও ভবিষ্যৎ বস্তু জ্ঞানের বিষয় হতে পারে (ঐ, কারিকা-২০২)। বিজ্ঞানবাদী বলেন, অনাদি সংস্কারের বৈচিত্রবশতই অনাদিকাল থেকে অনন্ত বিজ্ঞানের উৎপত্তি হয়; এই বিজ্ঞানই জ্ঞাতা, জ্ঞেয় এবং জ্ঞান। কিন্তু কুমারিল বলছেন, বস্তুরই যদি কোনো সত্তা না থাকে তাহলে সংস্কারের উদ্ভবই সম্ভব নয়; অতএব জ্ঞানই সম্ভব নয়। উত্তরে ভাববাদী যদি বলেন, সংস্কারের অভাব সত্ত্বেও জ্ঞান সম্ভব হতে পারে তাহলে তাঁর মূল কথাটি পরিত্যাগ করতে হবে, অর্থাৎ স্বীকার করতে হবে সংস্কারই জ্ঞানের কারণ নয় (ঐ, কারিকা ২০৩-৪)। আর যদি সংস্কার স্বীকার করা হয় তাহলে স্বীকার করতে হবে সংস্কারের পূর্বে জ্ঞান হয়েছিলো এবং তাহলে আরও স্বীকার করতে হবে যে, কোনো-না-কোনো স্থানে বস্তু অবগত হয়েছিলো; অর্থাৎ বস্তু অবগত হলেই জ্ঞান সম্ভব এবং জ্ঞান হলে পরই সংস্কার সম্ভব (ঐ, কারিকা-২০৫)।
ভাববাদী বলেন, স্বপ্নাদি দৃষ্টান্তে দেখা যায় জ্ঞানের আকারই জ্ঞেয়র আকার; কিন্তু যদি তাই হয় তাহলে তাঁদের মতে স্বপ্নজ্ঞানের বৈশিষ্ট্য কী হবে ? অর্থাৎ, ভাববাদ মতে সর্বত্রই জ্ঞানের আকারই জ্ঞেয় বিষয়ের আকার; যদি তাই হয় তাহলে ভাববাদী স্বপ্নজ্ঞানের সঙ্গে জাগ্রতজ্ঞানের পার্থক্য নির্ণয় করবেন কেমন করে? কিন্তু স্বীকার করতেই হবে স্বপ্নজ্ঞান মিথ্যা এবং এই মিথ্যাত্বের কারণ হলো বস্তু যেভাবে (অর্থাৎ যে দেশে ও যে-কালে) বর্তমান স্বপ্নস্থলে তার ঠিক সেইভাবে প্রতীতি হয় না, অন্যভাবে প্রতীতি হয় (ঐ, কারিকা-২১০)।

ভাববাদীরা স্বপ্নাদি ভ্রমজ্ঞানকে নির্বস্তু বলে প্রমাণ করতে চান; কিন্তু বাহ্যবস্তুবাদীদের মূল বক্তব্য হলো স্বপ্নজ্ঞান এবং যথার্থ জ্ঞান উভয়ই ভাববাদ-মতে নির্বস্তু বলে ভাববাদীরা স্বপ্নাদি ভ্রমজ্ঞানের বৈশিষ্ট্যের কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেন না; পক্ষান্তরে বাহ্যবস্তুবাদ মতে স্বপ্নাদি ভ্রমজ্ঞান এবং স্তম্ভাদির যথার্থ জ্ঞান উভয়েরই বিষয় বাহ্যবস্তুই, কেবল ভ্রমজ্ঞানের দৃষ্টান্তে দেশকালগত বিকৃতি এই বাহ্যবস্তুকেই বিকৃত বা ভ্রান্তভাবে উপস্থিত করে এবং এই দেশ-কাল-গত বিকৃতির মূলে কোনো দোষ বর্তমান (ঐ, কারিকা-২১১)। দ্বিচন্দ্রাদি ভ্রমজ্ঞানের মূল কারণও দোষ, কিন্তু ভ্রমজ্ঞানের বিষয় যে চন্দ্র বাহ্যবস্তু হিসেবে তার অলীকত্ব নয় (ঐ, কারিকা ২১২-৩)।
ভাববাদীরা বলেন, সুন্দরী রমণীর শবদেহ সাধু কুকুর লম্পটের মধ্যে ত্রিবিধ ধারণার উদ্রেক করে; কুমারিল বলছেন, তা করে, কিন্তু তার আসল কারণ এই নয় যে, এই ত্রিবিধ ধারণা বস্তু নিরপেক্ষ; প্রকৃতপক্ষে আলোচ্য বাহ্যবস্তুটির মধ্যে ত্রিবিধ ধারণার বিষয়ই বর্তমান, ত্রিবিধ দর্শকের ত্রিবিধ প্রবৃত্তি অনুসারে এই ত্রিবিধ বিষয় গৃহীত হয় (ঐ, কারিকা-২১৫)। আসলে একই বাহ্যবস্তুর মধ্যে বিবিধ আকারের সমাবেশ থাকে; এক একটি আকার গ্রহণ করার সময় জ্ঞাতা বাকি আকারগুলি সাময়িকভাবে প্রত্যাহার করেন (ঐ, কারিকা-২১৬)।
ভাববাদী বলেন, একই বস্তু কখনো দীর্ঘ কখনো হ্রস্ব আকারে প্রতীত হয়, একই ঘটের প্রতীতি কখনো ঘটত্বের প্রতীতি আবার কখনো বা পার্থিবত্বর প্রতীতি। কুমারিল বলছেন, এর মধ্যে কোনো বিরোধ নেই (এবং অবশ্যই এই বিবিধভাবে প্রতীতি-উৎপাদন থেকে নির্বস্তুত্ব প্রতিপন্ন হয় না); কারণ একই বস্তু অন্যান্য নানা বস্তুর সঙ্গে তুলনামূলকভাবে কখনো হ্রস্ব কখনো দীর্ঘ বলে প্রতীতি হয়, একই ঘটের মধ্যে পার্থিবত্ব, ঘটত্ব প্রভৃতি আকারের সমাবেশ আছে- তুলনামূলক কারণে, অর্থাৎ অন্যান্য বস্তুর তুলনায় কখনো তার ঘটত্ব প্রতীতি হয় কখনও বা প্রতীতি হয় তার পার্থিবত্ব (ঐ, কারিকা-২১৭)। বিদ্রƒপ করে কুমারিল বলছেন, ভগবান এমন কোনো নিয়ম বেঁধে দেননি যে এক বস্তুর মধ্যে মাত্র একটি আকারই বর্তমান থাকতে বাধ্য; আসলে একই বস্তুর বিভিন্ন আকার বর্তমান এবং বিভিন্ন কারণে এই বিভিন্ন আকারেরই প্রতীতি হয় (ঐ, কারিকা-২১৯)। যেমন একই ঘটে রূপ গন্ধ প্রভৃতি বিভিন্ন আকার বর্তমান, কিন্তু এগুলির স্বতন্ত্রভাবে প্রতীতি নির্ভর করছে চক্ষু, নাসিকা প্রভৃতি বিভিন্ন ইন্দ্রিয়ের সক্রিয়তার উপর (ঐ, কারিকা-২২৩)। তেমনি প্রত্যেক জ্ঞাতার পক্ষেই ঘটে ঘটত্ব পার্থিবত্ব প্রভৃতি বর্তমান; কিন্তু জ্ঞানকালে জ্ঞাতার যদি ঘট শব্দ মনে আসে তাহলে ঘটত্বর প্রতীতি হয়, যদি পৃথিবী শব্দ মনে আছে তাহলে পার্থিবত্বর প্রতীতি হয় (ঐ, কারিকা-২২৪)।
কুমারিল আরও বলছেন, দার্শনিকের দায়িত্ব হলো সাধারণ অভিজ্ঞতার ব্যাখ্যা দেওয়া এবং সাধারণ অভিজ্ঞতা বলতে এই নয় যে, জ্ঞানেরই আকার আছে এবং প্রতীতিকালে এই আকারেরই প্রতীতি হয় (ঐ,কারিকা-২২৫)। সাধারণ লোকে অবশ্যই বলবে, ‘প্রতীতিকালে যে আকার জ্ঞাত হয় বস্তুতে সেই আকারই বর্তমান, অর্থাৎ বস্তু সেই আকার বিশিষ্টই’; কিন্তু তার কারণ এই নয় যে, সাধারণ লোকে মনে করে প্রতীতিরই আকার অবগত হয়ে সেই আকার অনুসারেই বিষয়ের আকার নির্দিষ্ট করা হয় (ঐ, কারিকা-২২৬)। আসলে প্রতীতি বিষয়ের আকার অবগতির কারণ, আকারের কারণ নয় (ঐ, কারিকা-২২৭)।

এইভাবে সুদীর্ঘ যুক্তির অবতারণা করে কুমারিল প্রতিপন্ন করতে চেয়েছেন, জ্ঞাতা এবং জ্ঞেয় অভিন্ন নয়; জ্ঞান মানে জ্ঞানেরই জ্ঞান নয়, বস্তুর জ্ঞান; যে আকারের প্রতীতি হয় তা জ্ঞানের আকার নয়, বস্তুর আকার; এমনকি স্মৃতি, স্বপ্ন ও অন্যান্য ভ্রমজ্ঞানও নির্বস্তু নয়, এগুলির বিষয়ও বাহ্যবস্তুই, যদিও তা দেশান্তরে ও কালান্তরে অবস্থিত। অতএব কুমারিল সিদ্ধান্ত করছেন, প্রত্যক্ষশক্তি পরীক্ষণাশ্রিত যুক্তির সাহায্যেও ভাববাদ প্রতিষ্ঠিত হয় না; বস্তুত প্রত্যক্ষশক্তি পরীক্ষণের সাহায্যে বাহ্যবস্তুবাদই প্রমাণিত হয়।

কুমারিলের এই ভাববাদ খন্ডন এবং বাহ্যবস্তুবাদ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে ন্যায়-বৈশেষিকদের প্রচেষ্টার নিকট সাদৃশ্য রয়েছে। এই প্রসঙ্গে, কৌতুহলি পাঠকের আগ্রহ বিবেচনায় অতিরিক্ত সংযুক্তি হিসেবে, ন্যায়-বৈশেষিকদের এ আলোচনার কিছু নমুনা উপস্থাপন করা যেতে পারে।
কুমারিল তাঁর ‘শ্লোকবার্তিক’-এ ভাববাদীদের প্রমাণাশ্রিত যুক্তিকে দুই অংশে ভাগ করে খন্ডন করেছেন। প্রথম অংশে, ভাববাদীরা স্বপ্নপ্রত্যয়কে দৃষ্টান্ত করে যে অনুমানের সাহায্যে নিরালম্বন অর্থে স্তম্ভাদির জাগ্রতপ্রত্যয়কেও মিথ্যা প্রতিপন্ন করতে চান, ‘নিরালম্বনবাদ’ শীর্ষক অংশ সেই অনুমানের খন্ডন। এবং দ্বিতীয় অংশে, প্রত্যক্ষশক্তি পরীক্ষা করে ভাববাদীরা যেভাবে প্রমাণ করতে চান যে, জ্ঞানই জ্ঞানের বিষয়, ‘শূন্যবাদ’ শীর্ষক অংশ তারই খন্ডন। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, ন্যায়-বৈশেষিকেরাও ভাববাদীর উক্ত অনুমানমূলক এবং প্রত্যক্ষশক্তিপরীক্ষণমূলক দ্বিবিধ দাবিই খন্ডন করেছেন যদিও কুমারিলের মতো আলোচনাকে অমন সুস্পষ্ট দু’ভাগে ভাগ করেননি।

এ পর্যায়ে ন্যায়সূত্রের বাৎস্যায়নভাষ্যের উপর রচিত মহামহোপাধ্যায় ফণিভূষণ তর্কবাগীশের ‘ন্যায়দর্শন’ গ্রন্থ থেকে তাঁর সুদীর্ঘ বক্তব্য উদ্ধৃত করাই যথার্থ হবে। তিনি বলছেন-
‘উদ্দ্যেতকর পূর্বোক্ত ‘স্বপ্নবিষয়াভিমানাৎ’ ইত্যাদি সূত্রের দ্বারা বিজ্ঞানবাদীর মতানুসারে পূর্বপক্ষ ব্যাখ্যা করিয়াছেন যে, যেমন স্বপ্নাবস্থায় যে সমস্ত বিষয়ের জ্ঞান হয়, উহা ‘চিত্ত’ হইতে অর্থাৎ জ্ঞান হইতে ভিন্ন পদার্থ নহে, তদ্রƒপ জাগ্রদবস্থায় উপলব্ধ বিষয়সমূহও জ্ঞান হইতে ভিন্ন পদার্থ নহে। অর্থাৎ জ্ঞান হইতে ভিন্ন জ্ঞেয়ের সত্তা নাই। তাৎপর্যটীকাকার বলিয়াছেন যে, বিজ্ঞানবাদীর মতে প্রমাণ ও প্রমেয় বিষয়ক জ্ঞান যে ভ্রম, এ বিষয়ে জ্ঞানত্বই হেতু, স্বপ্নজ্ঞান দৃষ্টান্ত। উদ্দ্যোতকর পূর্বোক্ত ‘হেত্বভাবসিদ্ধিঃ’ এই সূত্রোক্ত যুক্তির দ্বারা বিজ্ঞানবাদীর দৃষ্টান্ত ও তন্মূলক উক্ত মতের খন্ডনপূর্বক শেষে বিশেষ বিচারের জন্য বিজ্ঞানবাদীর স্বপক্ষসাধক অনুমানের উল্লেখ করিয়াছেন যে, বিষয়সমূহ চিত্ত হইতে ভিন্ন পদার্থ নহে, যে হেতু উহা গ্রাহ্য অর্থাৎ জ্ঞেয়,- যেমন বেদনাদি। ‘বেদনা’ শব্দের অর্থ সুখ ও দুঃখ। ‘চিত্ত’ শব্দের অর্থ বিজ্ঞান। যেমন সুখদুঃখাদি জ্ঞেয় পদার্থ বিজ্ঞান হইতে পরমার্থতঃ ভিন্ন পদার্থ নহে তদ্রƒপ অন্যান্য বিষয়সমূহও জ্ঞান হইতে ভিন্ন পদার্থ নহে। বিজ্ঞান ব্যতিরেকে জ্ঞেয়র সত্তা নাই।
উক্ত অনুমানের খন্ডন করিতে উদ্দ্যোতকর বলিয়াছেন যে, সুখ ও দুঃখ হইতে জ্ঞান ভিন্ন পদার্থ। কারণ, সুখ ও দুঃখ গ্রাহ্য পদার্থ, জ্ঞান উহার গ্রহণ। সুতরাং গ্রাহ্য-গ্রহন-ভাববশত সুখ-দুঃখ এবং উহার জ্ঞান অভিন্ন পদার্থ হইতে পারে না। গ্রাহ্য ও গ্রহন যে অভিন্ন পদার্থ, ইহার কোনো দৃষ্টান্ত নাই। কারণ, কর্ম ও ক্রিয়া একই পদার্থ হইতে পারে না। অর্থাৎ সুখ ও দুঃখের যে গ্রহণরূপ ক্রিয়া, উহার কর্মকারক সুখ ও দুঃখ, এজন্য উহাকে গ্রাহ্য বলা হয়। কিন্তু কোনো ক্রিয়া ও উহার কর্মকারক অভিন্ন পদার্থ হয় না। কুত্রাপি ইহার সর্বসম্মত দৃষ্টান্ত নাই। পরন্তু চতুষ্কন্ধ ও পঞ্চস্কন্ধাদিবাদ পরিত্যাগ করিয়া একমাত্র বিজ্ঞানকেই সৎ বলিয়া স্বীকার করিলে ঐ বিজ্ঞানের ভেদ কিরূপে হয়, ইহা জিজ্ঞাসা। কারণ বিজ্ঞানমাত্রই পদার্থ হইলে অর্থাৎ বিজ্ঞান হইতে ভিন্ন বাহ্য ও আধ্যাত্মিক আর কোনো পদার্থের সত্তা না থাকিলে বিজ্ঞানভেদের বাহ্য ও আধ্যাত্মিক কোনো হেতু না থাকায় বিজ্ঞানভেদ কিরূপে হইবে ? যদি বল, স্বপ্নের ভেদের ন্যায় ভাবনার ভেদবশতই বিজ্ঞানের ভেদ হয়, তাহা হইলে ঐ ভাবনার বিষয় ভাব্যপদার্থ ও উহার ভাবক পদার্থের স্বীকার করিতে হইবে। কারণ, ভাব্য ও ভাবক অভিন্ন পদার্থ হয় না। পরন্তু স্বপ্নাদি জ্ঞানের ন্যায় সমস্ত জ্ঞানই ভ্রম বলিলে প্রধান জ্ঞান অর্থাৎ উহার বিপরীত যথার্থ জ্ঞান স্বীকার্য। কারণ, যে বিষয়ে প্রধান জ্ঞান একেবারেই অলীক, তদ্বিষয়ে ভ্রমজ্ঞান হইতে পারে না। ঐরূপ জ্ঞানকে ভ্রম বলা যায় না। উহার সর্বসম্মত কোনো দৃষ্টান্ত নাই। পরন্তু যিনি ‘চিত্ত’ অর্থাৎ জ্ঞান হইতে ভিন্ন বিষয়ের সত্তা মানেন না, তাঁহার স্বপক্ষসাধন ও পরপক্ষখন্ডন সম্ভব নহে। কারণ তিনি তাঁহার ‘চিত্তর’ দ্বারা অপরকে কিছু বুঝাইতে পারেন না। তাঁহার ‘চিত্ত’ অর্থাৎ সেই জ্ঞানবিশেষ অপরে বুঝিতে পারে না- যেমন অপরের স্বপ্ন সেই ব্যক্তি না বলিলে অপরে জানিতে পারে না। যদি বল, স্বপক্ষসাধন ও পরপক্ষখন্ডনকালে যে সমস্ত শব্দ প্রয়োগ করা হয়, তখন সেই সমস্ত শব্দাকার চিত্তের দ্বারাই অপরকে বোঝানো হয়। শব্দাকার চিত্ত অপরের অজ্ঞেয় নহে। কিন্তু তাহা বলিলে ‘শব্দাকার চিত্ত’ এই বাক্যে ‘আকার’ পদার্থ কি তা বক্তব্য। কোনো প্রধান বস্তু অর্থাৎ সত্য পদার্থের সাদৃশ্যবশত তদ্ভিন্ন পদার্থে তাহার যে জ্ঞান, উহাই আকার বলা যায়। কিন্তু বিজ্ঞানবাদীর মতে শব্দ নামক বাহ্য বিষয়ের সত্তা না থাকায় তিনি ‘শব্দাকার চিত্ত’ এই কথা বলিতে পারেন না। শব্দ সত্য পদার্থ হইলে এবং কোনো বিজ্ঞানে উহার সাদৃশ্য থাকিলে তৎপ্রযুক্ত ঐ বিজ্ঞানবিশেষকে ‘শব্দাকার চিত্ত’ বলা যায়। কিন্তু বিজ্ঞানবাদী তাহা বলিতে পারেন না। পরন্তু বিজ্ঞান হইতে ভিন্ন বিষয়ের সত্তাই না থাকিলে স্বপ্নবস্থা ও জাগ্রদবস্থার ভেদ হইতে পারে না। কারণ, বিজ্ঞানবাদীর মতে যেমন স্বপ্নাবস্থায় বিষয়ের সত্তা নাই, তদ্রƒপ জাগ্রদবস্থাতেও বিষয়ের সত্তা নাই। সুতরাং ইহা স্বপ্নাবস্থা, ইহা জাগ্রদবস্থা ইহা কিরূপে বুঝা যাইবে ও বলা যাইবে ? উহা বুঝিবার কোনো হেতু নাই। ঐ অবস্থাদ্বয়ের বৈলক্ষণ্যপ্রতিপাদক কোনো হেতু বলিতে গেলেই বিজ্ঞান হইতে ভিন্ন বিষয়ের সত্তা স্বীকার করিতেই হইবে।
উদ্দ্যোতকর পরে ইহাও বলিয়াছেন যে, স্বপ্নাবস্থা ও জাগ্রদবস্থার কোনো ভেদ না থাকিলে ধর্মাধর্ম ব্যবস্থাও থাকে না। যেমন স্বপ্নাবস্থায় অগম্যাগমনে অধর্ম জন্মে না, তদ্রƒপ জাগ্রদবস্থায় অগম্যাগমনে অধর্মের উৎপত্তি না হউক ? কারণ জাগ্রদবস্থাও স্বপ্নাবস্থার ন্যায় বিষয়শূন্য। বিজ্ঞানবাদীর মতে তখনও তো বস্তুত অগম্যাগমন বলিয়া কোনো বাহ্য পদার্থ নাই। যদি বল, স্বপ্নাবস্থায় নিদ্রার উপঘত এবং জাগ্রদবস্থায় নিদ্রার অনুপঘাতপ্রযুক্ত ঐ অবস্থাদ্বয়ে ভেদ আছে এবং ঐ অবস্থাদ্বয়ে জ্ঞানের অস্পষ্টতা ও স্পষ্টতাবশত উহার ভেদ বুঝা যায়। কিন্তু ইহাও বলা যায় না। কারণ, নিদ্রোপঘাত যে চিত্তের বিকৃতির হেতু, ইহা কিরূপে বুঝা যাইবে ? এবং জ্ঞানের বিষয় ব্যতীত উহার স্পষ্টতা ও অস্পষ্টতাই বা কিরূপে সম্ভব হইবে, ইহা বলা আবশ্যক। যদি বল, বিষয় না থাকিলেও তো বিজ্ঞানের ভেদ দেখা যায়। যেমন তুল্য কর্মবিপাকে উৎপন্ন প্রেতগণ পূয়পূর্ণ নদী দর্শন করে। কিন্তু সেখানে বস্তুত নদীও নাই, পূয়ও নাই। এইরূপ কোনো কোনো প্রেত সেই স্থলে সেই নদীকেই জলপূর্ণ দর্শন করে। কোনো কোনো প্রেত তাহাকেই রুধিরপূর্ণ দর্শন করে। অতএব বুঝা যায় যে, বাহ্য পদার্থ না থাকিলেও বিজ্ঞানই ঐরূপ বিভিন্নাকার হইয়া উৎপন্ন হয়। বিজ্ঞানের ভেদে বাহ্য পদার্থর সত্তা অনাবশ্যক।
উদ্দ্যোতকর উক্ত কথার উত্তরে বলিয়াছেন যে, বাহ্য পদার্থ অলীক হইলে পূর্বোক্ত কথাও বলাই যায় না। কারণ, বিজ্ঞানই সেইরূপ উৎপন্ন হয়, ইহা বলিলে ‘সেইরূপ কি?’ এবং কেনই বা ‘সেইরূপ?’ ইহা জিজ্ঞাস্য। যদি বল, রুধিরপূর্ণ নদী দর্শনকালে রুধিরাকারে বিজ্ঞান জন্মে, তাহা হইলে ‘ঐ রুধির কি?’ তাহা বক্তব্য এবং জলাকার ও নদ্যাকার বিজ্ঞান জন্মে, ইহা বলিলে ‘ঐ জল ও নদী কি?’ তাহা বক্তব্য। রুধিরাদি বাহ্যবিষয়ের একেবারেই সত্তা না থাকিলে রুধিরাকার ও জলাকার ইত্যাদি বাক্যই বলা যায় না। পরন্তু তাহা হইলে দেশাদি নিয়মও থাকে না। অর্থাৎ প্রেতগণ কোনো স্থানবিশেষেই পূয়পূর্ণ নদী দর্শন করে, স্থানান্তরে দর্শন করে না, এইরূপ নিয়মের কোনো হেতু না থাকায় ঐরূপ নিয়ম হইতে পারে না। কারণ, সর্বস্থানেই পূয়পূর্ণ নদী দর্শন এবং তদাকার বিজ্ঞান জন্মিতে পারে।’- (ফণিভূষণ, ন্যায়দর্শন-৫/১৫৯-৬০)

অবশ্যই বিজ্ঞানবাদের মূল ভিত্তি বলতে ‘সহোপলম্ভনিয়ম’, অর্থাৎ জ্ঞানের উপলব্ধিই বিষয়ের উপলব্ধি- প্রকাশ্য, প্রকাশক ও প্রকাশ-ক্রিয়া অভিন্ন পদার্থ। ফণিভূষণ বলেন, ‘উক্ত সিদ্ধান্তের উপরই বিজ্ঞানবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়। উহা স্বীকার না করিলে বিজ্ঞানবাদ স্থাপনই করা যায় না’ (ঐ, ন্যায়দর্শন-৫/১৬২)। সুতরাং উদ্দ্যোতকর বিশেষ করে এই সহোপলম্ভনিয়ম খন্ডন করেছেন। তাই ফণিভূষণের বক্তব্য-
‘নহি কর্ম চ ক্রিয়া চ একং ভবতি’- অর্থাৎ কর্ম ক্রিয়া একই পদার্থ হয় না। সুতরাং গ্রহণ ক্রিয়া ও উহার কর্মকারক গ্রাহ্য বিষয় অভিন্ন পদার্থ হইতেই পারে না। তাৎপর্যটীকাকার বাচস্পতি মিশ্র উদ্দ্যোতকরের তাৎপর্য ব্যক্ত করিয়া এখানে পরে ইহাও লিখিয়াছেন যে, উদ্দ্যোতকরের ঐ কথার দ্বারা ‘সহোপলম্ভনিয়মাৎ’ ইত্যাদি কারিকার জ্ঞান ও জ্ঞেয় বিষয়ের অভেদ সাধনে যে হেতু কথিত হইয়াছে, তাহাও পরাস্ত হইয়াছে বুঝিতে হইবে। কারণ, কর্ম ও ক্রিয়া যখন একই পদার্থ হইতেই পারে না, তখন বিজ্ঞান ও উহার কর্মকারক জ্ঞেয় বিষয়ের ভেদ স্বীকার্য হওয়ায় বিজ্ঞানের উপলব্ধি হইতে জ্ঞেয় বিষয়ের উপলব্ধিকে ভিন্ন বলিয়াই স্বীকার করিতে হইবে। সুতরাং ‘সহোপলম্ভ’ বলিতে জ্ঞান ও জ্ঞেয়ের এক বা অভিন্ন উপলব্ধিই বিবক্ষিত হইলে ঐ হেতুই অসিদ্ধ। তার যদি জ্ঞেয় বিষয়ের সহিত জ্ঞানের উপলব্ধিই ‘সহোপলম্ভ’ এই যথাশ্রুত অর্থ গ্রহণ করা যায়, তাহা হইলে ঐ হেতু বিরুদ্ধ হয়। সুতরাং উক্ত হেতু দ্বারা জ্ঞান ও জ্ঞেয় বিষয়ের অভেদ সিদ্ধ হইতে পারে না।’- (ঐ, ন্যায়দর্শন-৫/১৬২)

ন্যায়-বৈশেষিকের পক্ষ থেকে বিজ্ঞানবাদের বিরুদ্ধে আরও যেসব গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি প্রস্তাবিত হয়েছে তার মধ্যে মহামহোপাধ্যায় ফণিভূষণের বয়ানে উল্লেখযোগ্য প্রধানতম যুক্তিগুলি হলো-
‘জ্ঞেয় বিষয়ের সত্তা ব্যতীত জ্ঞানেরও সত্তা থাকে না। কারণ, নির্বিষয়ক জ্ঞান জন্মে না। জ্ঞেয় বিষয়গুলি বস্তুত জ্ঞানেরই আকারবিশেষ, সুতরাং জ্ঞানস্বরূপে উহার সত্তা আছে, ইহা বলিলে বাহ্যস্বরূপ উহার সত্তা নাই, অর্থাৎ বাহ্যপদার্থ নাই, উহা অলীক, ইহাই বলা হয়। কিন্তু তাহা হইলে জ্ঞানাকার পদার্থ অর্থাৎ অন্তর্জ্ঞেয় বস্তু বাহ্যবৎ প্রকাশিত হয় এই কথা বলা যায় না। কারণ, বাহ্যপদার্থ বন্ধ্যাপুত্রের ন্যায় অলীক হইলে উহা উপমান হইতে পারে না।’- (ঐ, ন্যায়দর্শন-৫/১৬৭)
আবার ‘জ্ঞেয় বিষয়ের সত্তা ব্যতীত তাহার বৈচিত্র্য হইতে পারে না। বিষয়ের বৈচিত্র্য ব্যতীতও জ্ঞানের বৈচিত্র্য হইতে পারে না। বিজ্ঞানবাদী অনাদি সংস্কারের বৈচিত্র্যবশতই জ্ঞানের বৈচিত্র্য বলিয়াছেন। কিন্তু বিষয়ের বৈচিত্র্য ব্যতীত সেই বিষয় সংস্কারের বৈচিত্র্যও হইতে পারে না।’- (ঐ, ন্যায়দর্শন-৫/১৬৭)
তাছাড়া, ‘জ্ঞান হইতে ভিন্ন বিষয়ের সত্তাই না থাকিলে সর্বত্র জ্ঞানেরই জ্ঞান জন্মিতেছে, ইহাই বলিতে হয়। কিন্তু তাহা হইলে জ্ঞানের পরে ‘আমি জ্ঞানকে জানিলাম’ এইরূপ জ্ঞান কেন জন্মে না? ইহা বলিতে হইবে।’- (ঐ, ন্যায়দর্শন-৫/১৬৭)
বিজ্ঞানবাদী বলবেন, “সবত্রই কল্পিত বাহ্য পদার্থে জ্ঞানাকার ও অন্তর্জ্ঞেয় বস্তুই বাহ্যবৎ প্রকাশিত হয়।” ইহা বলিলে সেই সমস্ত বাহ্য পদার্থের কাল্পনিক ও ব্যবহারিক সত্তাও স্বীকার করিতে হইবে। কিন্তু তাহা হইলে সেই সমস্ত বাহ্য পদার্থকে পারমার্থিক বিজ্ঞান হইতে অভিন্ন বলা যায় না। কাল্পনিক ও পারমার্থিক পদার্থের অভেদ সম্ভব নয়।’- (ঐ, ন্যায়দর্শন-৫/১৬৭)
অতএব ফণিভূষণ বলেন, ‘বিজ্ঞানবাদী স্বপ্নাদিজ্ঞানকে দৃষ্টান্ত করিয়া জ্ঞানত্বহেতুর দ্বারা জাগ্রদবস্থার সমস্ত জ্ঞানকেও ভ্রম বলিয়া সিদ্ধ করিতে পারেন না। কারণ, জাগ্রদবস্থার সমস্ত জ্ঞান স্বপ্নাদিজ্ঞানের তুল্য নহে। পরন্তু স্বপ্নাদি জ্ঞান ভ্রম হইলেও উহাও একেবারে অসদবিষয়কও নহে। সুতরাং তদ্দৃষ্টান্তে জাগ্রদবস্থার সমস্ত জ্ঞানকে অসদবিষয়ক বলিয়া প্রতিপন্ন করা যায় না। পরন্তু সর্বাবস্থায় সমস্ত জ্ঞানই ভ্রম হইলে জগতে যথার্থজ্ঞান থাকে না। উহা না থাকিলেও ভ্রমজ্ঞান বলা যায় না। কারণ, যথার্থজ্ঞান ও তত্ত্বজ্ঞান জন্মিলেই পূর্বজাত ভ্রমজ্ঞানের ভ্রমত্ব নিশ্চয় করা যায় নচেৎ সমস্ত জ্ঞানই ভ্রম, ইহা মুখে বলিলে কেহ তাহা গ্রহণ করে না। যথার্থজ্ঞান একেবারেই না থাকিলে প্রমাণেরও সত্তা থাকে না। কারণ, যথার্থ অনুভূতির সাধনকেই প্রমাণ বলে। সেই প্রমাণ ব্যতীত কোনো সিদ্ধান্ত স্থাপন করিতে গেলে বিনা প্রমাণে বিপরীত পক্ষও স্থাপন করা যায়। বিজ্ঞানবাদী অপরের সম্মত প্রমাণ-পদার্থ গ্রহণ করিয়া যে সমস্ত অনুমানের দ্বারা তাঁহার সিদ্ধান্ত স্থাপন করিয়াছেন, উহার প্রামাণ্য নাই। কারণ, প্রত্যক্ষবিরুদ্ধ অনুমানের প্রামাণ্য কেহই স্বীকার করেন না। বাহ্য পদার্থের যখন জ্ঞান হইতে পৃথকরূপেই প্রত্যক্ষ হইতেছে, তখন কোনো অনুমানের দ্বারাই তাহার অসত্তা সিদ্ধ করা যায় না।’- (ঐ, ন্যায়দর্শন-৫/১৬৮)
ভাববাদ-খন্ডনে ন্যায়-বৈশেষিকের পক্ষ থেকে এরকম অনেক অনেক যুক্তিই প্রস্তাবিত হয়েছে। বলাবাহুল্য, কুমারিলও এই যুক্তিগুলির মধ্যে প্রায় প্রত্যেকটিই ভাববাদের বিরুদ্ধে উত্থাপন করেছেন। তাই ভাববাদ খন্ডনের দিক থেকে মীমাংসা ও ন্যায়-বৈশেষিককে সমানতন্ত্র বলা যায়।

প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতীয় দর্শনে ভাববাদ-বনাম-বাহ্যবস্তুবাদ সমস্যার চরম মীমাংসা হয়েছে- এ জাতীয় কোনো দাবি অতিশয়োক্তি হলেও, পন্ডিত দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের ভাষায়- ‘এই প্রসঙ্গে যে কথা বিশেষভাবে মনে রাখা প্রয়োজন তা এই যে, সুপ্রাচীন কাল থেকেই ভারতীয় দর্শনে ভাববাদ এবং বাহ্যবস্তুবাদ নামের দুটি মূল দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে বিরোধ ও সংঘাত সুস্পষ্ট হয়েছে এবং এই সংঘাতের মধ্যে দিয়েই ভারতীয় দর্শন সবিশেষ গুরুত্ব অর্জন করেছে। এবং মীমাংসাপ্রসঙ্গে যে কথা বিশেষ উল্লেখযোগ্য তা এই যে, একদিক থেকে চরম সংরক্ষণশীলতার পরিচায় হয়েও ভাববাদবিরোধী বা বাহ্যবস্তুবাদী দৃষ্টিকোণ অবলম্বন করে তা ন্যায়বৈশেষিকাদি বাহ্যবস্তুবাদী সম্প্রদায়ের সঙ্গে ভারতীয় দর্শনে প্রকৃত বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে।

(চলবে…)

[আগের পর্ব : বৈদিক দেবতা প্রসঙ্গে মীমাংসামত] [*] [পরের পর্ব : মীমাংসামতে স্বর্গ ও মোক্ষ]

No comments: