.
| মীমাংসা দর্শন-১৯ : মীমাংসা-মতে স্বর্গ ও মোক্ষ |
রণদীপম বসু
…
৪.৬ : মীমাংসা-মতে স্বর্গ ও মোক্ষ
…
মীমাংসা-শাস্ত্রে যজ্ঞকর্মকেই যজ্ঞফলের অদ্বিতীয় কারণ বলে স্বীকার করা হয়। কিন্তু যজ্ঞকর্ম যেহেতু ক্ষণিক এবং এর ফল ক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎপন্ন হয় না, তাই প্রশ্ন আসে, যজ্ঞক্রিয়াকে কীভাবে ফল-উৎপাদক বলা যায় ? যেমন, বেদের বিধিতে বলা হয়- ‘দর্শপূর্ণমাসাভ্যাং স্বর্গকামো যজেত’- অর্থাৎ, স্বর্গকামী ব্যক্তি দর্শপূর্ণমাস নামের যজ্ঞ করবেন। এই স্বর্গফল প্রাপ্তি কীভাবে সম্ভব হতে পারে ? যজ্ঞের এই ফল-উৎপাদক শক্তিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মীমাংসকরা ‘অপূর্ব’ নামের একটি অদৃষ্ট-শক্তির ধারণা আনয়ন করেন। এই ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে, যজ্ঞক্রিয়া বিনষ্ট হলেও তার মাধ্যমে সৃষ্ট অপূর্ব-শক্তিটি কার্যকরি থাকে এবং এই শক্তিই শেষ পর্যন্ত ফল সৃষ্টি করে। বেদ যেহেতু ভ্রান্ত হতে পারে না, এবং বেদ অনুসারে যাগ থেকে স্বর্গাদি ফল উৎপন্ন হয় উল্লেখ আছে, অতএব মানতেই হবে যাগ এবং স্বর্গাদি-ফল উভয়ের মধ্যে শক্তিবিশেষ উৎপন্ন হয়।
রণদীপম বসু
…
৪.৬ : মীমাংসা-মতে স্বর্গ ও মোক্ষ
…
মীমাংসা-শাস্ত্রে যজ্ঞকর্মকেই যজ্ঞফলের অদ্বিতীয় কারণ বলে স্বীকার করা হয়। কিন্তু যজ্ঞকর্ম যেহেতু ক্ষণিক এবং এর ফল ক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে উৎপন্ন হয় না, তাই প্রশ্ন আসে, যজ্ঞক্রিয়াকে কীভাবে ফল-উৎপাদক বলা যায় ? যেমন, বেদের বিধিতে বলা হয়- ‘দর্শপূর্ণমাসাভ্যাং স্বর্গকামো যজেত’- অর্থাৎ, স্বর্গকামী ব্যক্তি দর্শপূর্ণমাস নামের যজ্ঞ করবেন। এই স্বর্গফল প্রাপ্তি কীভাবে সম্ভব হতে পারে ? যজ্ঞের এই ফল-উৎপাদক শক্তিকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মীমাংসকরা ‘অপূর্ব’ নামের একটি অদৃষ্ট-শক্তির ধারণা আনয়ন করেন। এই ব্যাখ্যায় বলা হচ্ছে, যজ্ঞক্রিয়া বিনষ্ট হলেও তার মাধ্যমে সৃষ্ট অপূর্ব-শক্তিটি কার্যকরি থাকে এবং এই শক্তিই শেষ পর্যন্ত ফল সৃষ্টি করে। বেদ যেহেতু ভ্রান্ত হতে পারে না, এবং বেদ অনুসারে যাগ থেকে স্বর্গাদি ফল উৎপন্ন হয় উল্লেখ আছে, অতএব মানতেই হবে যাগ এবং স্বর্গাদি-ফল উভয়ের মধ্যে শক্তিবিশেষ উৎপন্ন হয়।
যেহেতু মীমাংসকরা কোনো লোকোত্তর ঈশ্বরে বিশ্বাসী নন, তাই যজ্ঞকর্ম থেকে উৎপন্ন কাষ্ঠলোষ্ট্রের সমান অচেতন অপূর্ব থেকে ফলপ্রাপ্তি জাতীয় কথা আসলে আদিম জাদুবিশ্বাসের দার্শনিক সমর্থন বলা যায়। এখন প্রশ্ন হলো মীমাংসা-মতে স্বর্গ বলতে কী বোঝায় ? এই মতে স্বর্গ মানে সুখ বা প্রীতি। এখানে আবার প্রশ্ন ওঠে, স্বর্গ মানে যদি শুধু সুখই হয় এবং যেহেতু সুখ ইহকালেই সম্ভব তাহলে স্বর্গ বলে লোকোত্তর কিছু কি নেই ? এ বিষয়ে ভূতনাথ সপ্ততীর্থ শাবরভাষ্য (৬/১/২)-এর তর্জমায় মন্তব্য করেন-
‘মীমাংসকগণের এ বিষয়ে যথাযথ মত কী তাহা নিরূপণ করা দুরূহ। ভাষ্যের আপাতলভ্য অর্থে বুঝা যায়, স্বর্গ বা নরকভোগের জন্য স্বতন্ত্র স্থান বিশেষ অনাবশ্যক।’ (সূত্র: ভারতীয় দর্শন, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা-২৫৬)।
এই তথাকথিত আপাতলভ্য অর্থটিই যে প্রকৃত অর্থ হবে তার নজির হলো, মীমাংসা-মত খন্ডনে বৈদান্তিকদের উত্থাপিত যুক্তির পূর্বপক্ষ হিসেবে মীমাংসা-মতকে এই অর্থেই উপস্থাপন করা। যেমন, বেদান্তর বিবরণ প্রস্থানের ‘তত্ত্বদীপন’ টীকায় পূর্বপক্ষ হিসেবে মীমাংসা-মত উপস্থাপিত হয়েছে এভাবে-
‘কিং লোকবিশেষঃ স্বর্গঃ, উত সুখমাত্রম্ ? নান্যঃ, তত্র মানাভাবাৎ।’- অর্থাৎ, লোকবিশেষকে স্বর্গ বলা যায় না, তাহাতে কোনো প্রমাণ নাই।
একইভাবে ‘বিররণপ্রমেয়সংগ্রহ’-তেও পূর্বপক্ষ হিসেবে মীমাংসা-মত উদ্ধৃত হয়েছে এভাবে-
‘অত্রৈব নরক-স্বর্গাবিতি মাতঃ প্রচক্ষতে। মনঃপ্রীতিকরঃ স্বর্গো নরকস্তাদ্বিপর্যয়ঃ’- অর্থাৎ, স্বর্গ ও নরক ইহলোকেই ভোগ্য, আর নিরতিশয় যে প্রীতি তাহাই স্বর্গ এবং তদ্বিরুদ্ধ যে-দুঃখ তাহাই নরক।
এক্ষেত্রে, মীমাংসাসূত্র ৬/১/৩ শাবরভাষ্যের মূল প্রতিপাদ-বিষয়, স্বর্গাদি ফলই সাধ্য বা প্রধান, যাগাদি কর্ম তার কারণ বা গুণস্বরূপ। যুক্তি হলো, নিষ্ফল কর্মে পুরুষের প্রবৃত্তি উৎপাদন করতে পারে না। পক্ষান্তরে কর্ম ক্লেশাত্মক হওয়ায় পুরুষের প্রবৃত্তিকে প্রতিহত করে, অতএব, বিধিশক্তিকে কুণ্ঠিত করে। তাই, যজ্ঞকর্মের ফল যে স্বর্গ বা নিরতিশয় সুখ- অর্থাৎ, নিরতিশয় সুখই উদ্দেশ্য, যজ্ঞকর্ম তার উপায়মাত্র- এই বোধ সুদৃঢ় না হলে যজ্ঞকর্মমূলক বিধি শক্তিশালী হতে পারে না। (সূত্র: ভারতীয় দর্শন, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা-৩২৮)।
মীমাংসকদের এই অর্থবাদ ব্যাখ্যা অনুসারে মানতেই হয় যে, বেদোক্ত ‘স্বর্গকামো যজেত’ বিধিবাক্যটিকে মীমাংসকেরা ‘সুখকামো যজেত’ অর্থেই গ্রহণ করেছিলেন। শবরস্বামীর সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা অনুযায়ী মীমাংসা-দর্শনে এই বিধিবাক্যের উপর অপরিসীম গুরুত্ব আরোপ করায় সহজেই অনুমান হয়, মীমাংসা-মতে বস্তুত সুখলাভই মানুষের চরম উদ্দেশ্য- যজ্ঞ এই সুখলাভের উপায়মাত্র।
স্বর্গ নামের উৎকৃষ্ট সুখ যদি ইহলোকেই ভোগ্য হয়, তাহলে এ পর্যায়ে এসে প্রশ্ন ওঠে, মীমাংসা-মতে ইহলৌকিক সুখই কি পুরুষার্থ বা মোক্ষ বলে বিবেচিত হবে ? এখানে উল্লেখ্য, লোকায়ত চার্বাক-মতেও কিন্তু বলা হয়, সুখই পুরুষার্থ। যদিও লোকায়তিকরা যাগ-যজ্ঞ ইত্যাদিকে পুরোহিত-শ্রেণীর প্রবঞ্চনামূলক উদ্ভাবন বলে বিদ্রƒপ করেন। তাহলে আস্তিক-নিন্দিত লোকায়তিকদের সঙ্গে আস্তিক-অগ্রণী মীমাংসকদের পুরুষার্থ বিষয়ে মতপার্থক্য কোথায় ? পূর্ব-মীমাংসার নামান্তর কর্মমীমাংসা। বেদের ব্রাহ্মণভাগ বা কর্মকান্ডকে আশ্রয় করেই এই দর্শনের উদ্ভব। অতএব কর্মই মীমাংসার মূল আলোচ্য বিষয়। এবং কর্মের ফল স্বর্গ বা সুখ, মোক্ষ নয়। অতএব মীমাংসা-দর্শনে যুক্তিযুক্তভাবে মোক্ষের আদর্শ থাকা সম্ভব নয়। কিংবা কোনো মীমাংসক যদি মোক্ষকেই পুরুষার্থ বলে গ্রহণ করতে চান তাহলে তাঁকে মীমাংসা-দর্শনের মূল দৃষ্টিভঙ্গি পরিত্যাগ করতে হবে। এজন্যেই কি সূত্রকার মহর্ষি জৈমিনি মীমাংসাসূত্রে মোক্ষের কোনো আলোচনা করেননি ? এমনকি ভাষ্যকার শবরস্বামীর শাবরভাষ্যেও মোক্ষ সম্বন্ধে কোনো আলোচনা বা উল্লেখ নেই। তাই মহামহোপাধ্যায় যোগেন্দ্রনাথ তর্কসাংখ্যবেদান্ততীর্থ তাঁর ‘ভারতীয় দর্শন সমগ্র’-এ বলেন-
‘পূর্ব-মীমাংসা দর্শনের সূত্রকার জৈমিনি মোক্ষর কোনো আলোচনা করেন নাই। ধর্মের সাধন, স্বরূপ প্রভৃতির আলোচনাতেই জৈমিনি-সূত্র পর্যবসিত হইয়াছে।’ (সূত্র: ভারতীয় দর্শন, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, পৃষ্ঠা-২৫৮)।
প্রাচীন মীমাংসার আদিরূপটিতে যুক্তিযুক্তভাবেই মোক্ষের কোনো স্থান না থাকলেও কালক্রমে পরবর্তীকালের মীমাংসকদের মধ্যে মোক্ষই পুরুষার্থ বলে স্বীকার করার ঝোঁক পরিলক্ষিত হয়। মীমাংসক প্রভাকর মিশ্র ও কুমারিল ভট্ট মোক্ষ বিষয়ে আলোচনাকে খুব একটা গুরুত্ব না দিলেও তাঁদের অনুগামীরা ক্রমশই এ আলোচনাকে গুরুত্ব দিয়েছেন। এতে লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, তারই ফলে তাঁরা ক্রমশই সুপ্রাচীন মীমাংসা-মতকে বেদান্ত বা প্রচ্ছন্ন-বেদান্তে পরিণত করেছেন। ‘প্রকরণপঞ্চিকায়’ শালিকনাথ মিশ্র বলছেন, কর্মপ্রসূত সমস্ত ধর্মাধর্মের ঐকান্তিক বিলোপই মোক্ষ।
মজার বিষয় হলো, মোক্ষকে পরম পুরুষার্থ বলে স্বীকার করা হলে কর্ম এবং ধর্মকর্ম সবকিছুই পরম পুরুষার্থেও অন্তরায় বলে বিবেচিত হতে বাধ্য এবং যদি তাই হয় তাহলে মীমাংসকদের কাছে মীমাংসা-দর্শনের মূল আলোচ্য-বিষয়ই বর্জনীয় হতে বাধ্য। তারপরও এই স্ববিরোধিতাই পরবর্তীকালের মীমাংসকদের মধ্যে প্রকট হতে দেখা যায়। অর্থাৎ নামে মীমাংসক হলেও পরবর্তীকালের মীমাংসকেরা মীমাংসাকে বেদান্তনুগামী বা বেদান্তনুসারী করবারই প্রয়াস করেছেন। বস্তুত প্রাভাকর-সম্প্রদায়ের পরবর্তী দার্শনিকদের মধ্যে এ-জাতীয় প্রয়াসের প্রকট পরিচয় পাওয়া যায়। সেজন্যেই গৌড় ব্রহ্মানন্দ তাঁর ‘সিদ্ধান্তবিন্দু’ গ্রন্থে বলেন-
‘প্রভাকরভাট্টয়োস্তু বেদান্তদর্শনে বিদ্বেষাভাবঃ।’- অর্থাৎ, বেদান্ত-দর্শনে প্রভাকরের (ও ভাট্টর) বিদ্বেষ নেই।
পরবর্তী প্রাভাকর-সম্প্রদায়ের মতে সকল প্রকার দুঃখের আত্যন্তিক লয়ে ভূমানন্দের যে অনুভূতি হয় তাই মুক্তি। শরীরের সঙ্গে সম্বন্ধযুক্ত হওয়াই জন্ম এবং এই সম্বন্ধের বিনাশই মৃত্যু। কর্মফল ভোগের জন্য জীবকে বারবার জন্মগ্রহণ করতে হয়। কিন্তু নিত্য, নৈমিত্তিক ও নিষ্কাম কর্মের মাধ্যমে সুখ-দুঃখের আত্যন্তিক বিনাশ হয়। এইরূপ বিনাশই মুক্তি।
মোক্ষের স্বরূপ সম্পর্কে অবশ্য ভাট্ট-সম্প্রদায় ও প্রাভাকর-সম্প্রদায়ের মধ্যে মতপার্থক্য বর্তমান। প্রাভাকর-মতে সকল দুঃখের আত্যন্তিক বিনাশই মোক্ষ। মোক্ষলাভে ধর্ম ও অধর্ম দুই-এরই বিনাশ হয়। ধর্ম ও অধর্মের জন্যই জীবের সংসারগতি লাভ হয়। ধর্ম ও অধর্ম সম্পূর্ণভাবে ক্ষয়প্রাপ্ত হলে দেহের যে আত্যন্তিক বিনাশ হয়, তাই মোক্ষ। ধর্ম ও অধর্মের বশীভূত হয়েই জীব ভিন্ন ভিন্ন যোনিতে আবর্তিত হয়। সংসারে আত্যন্তিক সুখ নেই। সংসার-সুখ অস্থির। কর্মের কর্তা-রূপ আত্মায় শুভ বা অশুভ রূপ অদৃষ্ট বা অপূর্ব সমবেত থাকে এবং এই অদৃষ্ট বা অপূর্বেও দ্বারাই শুভ ও অশুভ ফল লাভ হয়। এই অপূর্ব লৌকিক প্রমাণের অগম্য, একমাত্র বৈদিক শব্দ প্রমাণের দ্বারাই তার কথা জানা যায়।
বৈদিক কর্মসমূহও যে মরণোত্তর বা জন্মান্তরীয় ফল উৎপাদন করে, সে ক্ষেত্রেও ঐ অদৃষ্ট বা অপূর্ব অলৌকিক শক্তি হিসেবে কাজ করে। কর্ম ইহজীবনে সাময়িককালে অনুষ্ঠিত হলেও তার ফল ভোগ করতে হয় জন্ম-জন্মান্তরে। নিষিদ্ধ কর্মের ফলে যে অশুভ অদৃষ্ট উৎপন্ন হয়, তাকে বলা হয় পাপ। পাপের ফলে আত্মাকে নরক ভোগ করতে হয়। আর বিহিত কাম্য-কর্মের অনুষ্ঠানের দ্বারা যে পুণ্য সঞ্চয় হয়, তার দ্বারা স্বর্গাদি লাভ হয়।
প্রাভাকর-মতে এই স্বর্গাদিলাভ শুভকর্মের প্রাসঙ্গিক ফলমাত্র। কর্তব্যবোধেই কর্ম অনুষ্ঠেয় এবং তার ফলে চিত্তশুদ্ধি হয়, আর শুদ্ধচিত্তেই মোক্ষপ্রাপ্তির প্রত্যক্ষ কারণস্বরূপ জ্ঞান লাভ হয়। তাই বলা হয়, ধর্মজিজ্ঞাসা বা ধর্মানুষ্ঠান ব্রহ্মজিজ্ঞাসার পূর্ববর্তী ধাপ। উল্লেখ্য, এই ব্রহ্মজিজ্ঞাসা হলো মূলত বেদান্ত-সিদ্ধান্ত।
লৌকিক শুভকর্মের অনুষ্ঠান এবং নিত্য ও নৈমিত্তিক কর্ম চিত্তশুদ্ধির সহায়ক। ভাট্ট-মতে নিত্যকর্ম প্রত্যক্ষভাবে ফলদায়ক নয়। দূরিতক্ষয়ই তার ফল। প্রাভাকর-মতে ফল-নিরপেক্ষভাবেই নিত্যকর্ম অনুষ্ঠেয়। এই কর্মই পুরুষার্থ। কাম্য, নিত্য ও নৈমিত্তিক এই ত্রিবিধ কর্মের অনুষ্ঠানই ধর্ম। ধর্মমাত্রই দুঃখমিশ্রিত। সেজন্যেই জীবের মোক্ষাভিলাষ জাগে। ইহলোকে বা পরলোকে সুখ বা দুঃখ উৎপাদনকারী সমস্ত প্রকার কর্ম থেকে বিরতিই মোক্ষ। দূরিতক্ষয়কারী প্রয়োজনীয় প্রায়শ্চিত্ত কর্মের দ্বারা সঞ্চিত কর্মের ফলনাশ হয় এবং শম, দম, ব্রহ্মচর্য, সন্তোষ প্রভৃতি দ্বারা শরীরী সত্তা থেকে ক্রমশ মুক্তি হয়। কিন্তু শুধুমাত্র তত্ত্বজ্ঞানের দ্বারা বন্ধন-মুক্তি হয় না। তার জন্য বেদবিহিত নিত্য ও নৈমিত্তিক কর্মের অনুষ্ঠান প্রয়োজন। তবে কাম্য কর্ম পুনর্জন্মের প্রযোজক, মোক্ষলাভের ঘটক নয়। তত্ত্বজ্ঞানের দ্বারা পাপ-পুণ্যের ভবিষ্যৎ-বৃদ্ধি বিরত হয়। নিত্য, নৈমিত্তিক ও প্রায়শ্চিত্তাদি কর্ম সাধন করে চিত্ত শুদ্ধ হয়। পরে শমদমাদিসাধন সম্পত্তির দ্বারা তত্ত্বজ্ঞান লাভ হলেই মোক্ষ লাভ হয়।
প্রাভাকর-মতে জীবের এই মুক্তাবস্থা কিন্তু আনন্দদায়ক অবস্থা নয়। মুক্ত আত্মা নির্গুণ বলে তার আনন্দানুভব সম্ভব নয়। নির্গুণ আত্মার স্বাভাবিক রূপের স্ফুরণই মোক্ষ। মোক্ষ সুখ এবং দুঃখ এই দুই-এরই অতীত। কিন্তু ভাট্ট-মতে মোক্ষ আনন্দস্বরূপ। সকল দুঃখের আত্যন্তিক বিনাশে উৎপন্ন ভূমানন্দ লাভই মোক্ষ। সংসারে জন্মগ্রহণ করে জীবকে সুখ-দুঃখ ভোগ করতেই হয়, আর সুখ-দুঃখের ভোগের দ্বারাই সঞ্চিত ও প্রারব্ধ কর্মের ক্ষয় হয়। কিন্তু নিষিদ্ধ ও কাম্য বর্ম বর্জন না করলে নব নব ভোগ্যবস্তুও দিকে চিত্ত আকৃষ্ট হয় এবং মোক্ষলাভে বাধা সৃষ্টি হয়।
এই ভূমানন্দস্বরূপ মোক্ষ দুঃখের আত্যন্তিক অভাবস্বরূপ। তাই এই অবস্থা নিত্য। ভাট্টমতে বলা হয়, সূত্রকার জৈমিনি স্বর্গরূপ যে পুরুষার্থেও কথা বলেছেন, তার দ্বারা আসলে মোক্ষই সূচিত হয়। কারণ স্বর্গ বলে কোন স্থান নেই। দুঃখলেশশূন্য পূর্ণানন্দই মোক্ষস্বরূপ। এই মোক্ষরূপ স্বর্গই নিত্য, আর কাম্যকর্মজন্য অপূর্ব থেকে লব্ধ যে স্বর্গের কথা বলা হয়েছে, তা অনিত্য। অর্থাৎ পুণ্যেও দ্বারা যে স্বর্গলাভ হয়, পুণ্য ক্ষয়প্রাপ্ত হলে সেখান থেকে আবার মর্ত্যে ফিরে আসতে হয়। কিন্তু ভূমানন্দস্বরূপ মোক্ষ নিত্য, তাকে আর হারাতে হয় না। মোক্ষ তাই নিত্য আনন্দস্বরূপ।
…
[আগের পর্ব : মীমাংসায় ভাববাদ-খণ্ডন] [*] [শেষ]
…
No comments:
Post a Comment