. | বেদান্তদর্শন-ব্রহ্মবেদান্ত-২ : বেদান্তের উৎপত্তি ও উপনিষদীয় ক্রমবিকাশ |
রণদীপম বসু
…
১.১ : বেদান্তের উৎপত্তি ও উপনিষদীয় ক্রমবিকাশ :
.
বৈদিক চিন্তাধারার সর্বোচ্চ ও পূর্ণ বিকাশ উপনিষদে ঘটলেও, বলা হয়ে থাকে, এই পরিপূর্ণ বিকাশ লাভের বীজ নিহিত রয়েছে ঋকবেদ সংহিতা প্রভৃতি প্রাচীন গ্রন্থে। বেদের চারটি ভাগ, যথা ঋক, সাম, যজু ও অথর্ব। প্রতিটির আবার চারটি অংশ- সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ। সংহিতা অংশে বেদের মন্ত্রগুলি রয়েছে। ব্রাহ্মণ অংশে সংহিতায় উক্ত যাগযজ্ঞের বিররণ ও ব্যাখ্যা রয়েছে। আরণ্যকে আছে যজ্ঞ সম্পর্কে রূপক কল্পনা ও প্রতীক উপমার আদেশ। আর উপনিষদে আছে ব্রহ্মজ্ঞানের কথা।
রণদীপম বসু
…
১.১ : বেদান্তের উৎপত্তি ও উপনিষদীয় ক্রমবিকাশ :
.
বৈদিক চিন্তাধারার সর্বোচ্চ ও পূর্ণ বিকাশ উপনিষদে ঘটলেও, বলা হয়ে থাকে, এই পরিপূর্ণ বিকাশ লাভের বীজ নিহিত রয়েছে ঋকবেদ সংহিতা প্রভৃতি প্রাচীন গ্রন্থে। বেদের চারটি ভাগ, যথা ঋক, সাম, যজু ও অথর্ব। প্রতিটির আবার চারটি অংশ- সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ। সংহিতা অংশে বেদের মন্ত্রগুলি রয়েছে। ব্রাহ্মণ অংশে সংহিতায় উক্ত যাগযজ্ঞের বিররণ ও ব্যাখ্যা রয়েছে। আরণ্যকে আছে যজ্ঞ সম্পর্কে রূপক কল্পনা ও প্রতীক উপমার আদেশ। আর উপনিষদে আছে ব্রহ্মজ্ঞানের কথা।
দর্শন বলতে আমরা যা বুঝি তা বৈদিক যুগে দেখা যায়নি। সর্বপ্রাচীন সাহিত্য হিসেবে ঋকবেদের বিভিন্ন মন্ত্রে একাধিক দেবতার স্তুতি করা হয়েছে। এই দেবতাদের মধ্যে ইন্দ্র, অগ্নি, বায়ু ও বরুণ প্রভৃতি প্রধান। যেমন, অজস্র ঋকের মতোই ঋগ্বেদের প্রথম মণ্ডলের দ্বিতীয় সূক্তের (ঋগ্বেদ-১/২/১-৯) ঋকগুলিতেই আমরা দেখি-
‘বায়বা যাহি দর্শতেমে সোমা অরংকৃতাঃ। তেষাং পাহি শ্রুধী হবম্ ।। ১
বায় উকথের্ভিজরন্তে ত্বামচ্ছা জরিতারঃ। সুতসোমা অহর্বিদঃ।। ২
বায়ো তব প্রপৃঞ্চতী ধেনা জিগাতি দাশুষে। উরূচী সোমপীতয়ে।। ৩
ইন্দ্রবায়ূ ইমে সুতা উপ প্রয়োভিরা গতম্ । ইন্দবো বামুশন্তি হি।। ৪
বায়বিন্দ্রশ্চ চেতথঃ সুতানাং বাজিনীবসূ। তাবা যাতমুপ দ্রবৎ।। ৫
বায়বিন্দ্রশ্চ সুন্বত আ যাতমুপ নিষ্কৃতম্ । মক্ষি¦ত্থা ধিয়া নরা।। ৬
মিত্রং হুবে পূতদক্ষং বরুণং চ রিশাদসম্ । ধিয়ং ঘৃতাচীং সাধন্তা।। ৭
ঋতেন মিত্রাবরুণাবৃতাবৃধাবৃতস্পৃশা। ক্রতুং বৃহন্তমাশাথে।। ৮
কবী নো মিত্রাবরুণা তুবিজাতা উরুক্ষয়া। দক্ষং দধাতে অপসম্ ।। ৯
অর্থাৎ :
১। হে দর্শনীয় বায়ু এসো, এ সোমরস সমূহ অভিযুত হয়েছে; তা পান করো, আমাদের আহ্বান শ্রবণ করো। ২। হে বায়ু ! যজ্ঞাভিজ্ঞ স্তোতাগণ সোমরস অভিযুত করে তোমার উদ্দেশে স্তুতিবাক্য প্রয়োগ স্তব করছে। ৩। হে বায়ু ! তোমার সোমগুণপ্রকাশক বাক্য সোম পানার্থ হব্যদাতা যজমানের নিকট আসছে, অনেকের নিকট আসছে। ৪। হে ইন্দ্র ও বায়ু ! এ সোমরস অভিযুত হয়েছে, অন্ন নিয়ে এসো; সোমরস তোমাদের কামনা করছে। ৫। হে বায়ু ও ইন্দ্র ! তোমরা অভিযুত সোমরস জানো, তোমরা অন্নযুক্ত হব্যে বাস করো; শীঘ্র নিকটে এসো। ৬। হে বায়ু ও ইন্দ্র ! অভিষবকারী যজমানের অভিযুত সোমরসের নিকটে এসো; হে বীরদ্বয়! এ কাজ ত্বরায় সম্পন্ন হবে। ৭। পবিত্রবল মিত্র ও হিংসকশত্রুনাশক বরুণকে আমি আহ্বান করি; তাঁরা ঘৃতাহুতি প্রদানরূপ কর্ম সাধন করেন। ৮। হে যজ্ঞ বর্ধয়িতা যজ্ঞস্পর্শী মিত্র ও বরুণ ! তোমরা যজ্ঞফল দানার্থ এ বৃহৎ যজ্ঞে রয়েছো। ৯। ইন্দ্র ও বরুণ ঋত-সম্পন্ন, বহু লোকের হিতার্থে জাত ও বহু লোকের আশ্রয়ভূত; তাঁরা আমাদের বল ও কর্ম পোষণ করেন।
যদিও প্রাকৃতিক জগতের বিভিন্ন জড়বস্তু, বৃষ্টি, বন্যা, অগ্নি প্রভৃতির অধিষ্ঠাতারূপে এক একজন দেবতার কল্পনা করা হয়েছে, তবু ঋগ্বেদে কোনো একজন দেবতাকে সর্বোপরি মনে করা হতো না। ঋষিগণ ইন্দ্র, সোম, বরুণের স্তবকালে তন্ময়চিত্তে তাঁদের গুণ ও মহিমা কীর্তনের মাধ্যমে এই দেবতাদের পরিতুষ্ট করে এদের অনুগ্রহ লাভের প্রত্যাশী ছিলেন। কিন্তু ঋগ্বেদের সর্বশেষ দশম মণ্ডলের মন্ত্রগুলিতে বহুদেববাদ অপেক্ষা একেশ্বরবাদেরই বেশি প্রাধান্য দেখা যায়। যেমন ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের প্রজাপতি সূক্তের (ঋগ্বেদ-১০/১২১) ঋকগুলিতে বলা হয়েছে-
‘হিরণ্যগর্ভঃ সমবর্ততাগ্রে ভূবস্য জাতঃ পতিরেক আসীৎ।
স দাধার পৃথিবীং দ্যামুতেমাং কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম।। ১
য আত্মদা বলদা যস্য বিশ্ব উপাসতে প্রশিষং যস্য দেবাঃ।
যস্য ছায়ামৃতং যস্য মৃত্যুঃ কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম।। ২
যঃ প্রাণতো নিমিষতো মহিত্বৈক ইদ্রাজা জগতো বভূব।
য ঈশে অস্য দ্বিপদশ্চতুষ্পদঃ কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম।। ৩
যস্যেমাঃ প্রদিশো যস্য বাহূ কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম।। ৪
যেন দ্যৌরুগ্রা পৃথিবী চ দৃড়্হা যেন স্বঃ স্তভিতং যেন নাকঃ।
যো অন্তরিক্ষে রজসো বিমানঃ কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম।। ৫
যং ক্রন্দসী অবসা তস্তভানে অভ্যৈক্ষেতাং মনসা রেজমানে।
যত্রাধি সূর উদিতো বি ভাতি কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম।। ৬
আপো হ যদ্বৃহতীর্বিশ্বমায়ন্ গর্ভং দধানা জনয়ন্তীরগ্নিম্ ।
ততো দেবানাং সমবর্ততাসুরেকঃ কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম।। ৭
যশ্চিদাপো মহিনা পর্যপশ্যদ্দক্ষং দধানা জনয়ন্তীর্যজ্ঞম্ ।
যো দেবেষ্বধি দেব এক আসীৎ কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম।। ৮
মা নো হিংসীজ্জনিতা যঃ পৃথিব্যা যো বা দিবং সত্যধর্মা জজান।
যশ্চাপশ্চন্দ্রা বৃহতীর্জজান কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম।। ৯
প্রজাপতে ন ত্বদেতান্যন্যো বিশ্বা জাতানি পরি তা বভূব।
যৎকামাস্তে জুহুমস্তন্নো অস্তু বয়ং স্যাম পতয়ো রয়াণাম্ ।।’ ১০
অর্থাৎ :
১। সর্বপ্রথমে কেবল হিরণ্যগর্ভই বিদ্যমান ছিলেন। তিনি জাত মাত্রই সর্বভূতের অদ্বিতীয় অধীশ্বর হলেন। তিনি এ পৃথিবী ও আকাশকে স্বস্থানে স্থাপিত করলেন। কোন্ দেবতাকে হব্যদ্বারা পূজা করবো ? ২। যিনি জীবাত্মা দিয়েছেন, বল দিয়েছেন, যাঁর আজ্ঞা সকল দেবতারা মান্য করে, যাঁর ছায়া অমৃতস্বরূপ, মৃত্যু যাঁর বশ্যতাপন্ন। কোন্ দেবতাকে হব্যদ্বারা পূজা করবো ? ৩। যিনি নিজ মহিমাদ্বারা যাবতীয় দর্শনেন্দ্রিয়সম্পন্ন গতিশক্তিযুক্ত জীবদের অদ্বিতীয় রাজা হয়েছেন, যিনি এ সকল দ্বিপদ চতুষ্পদের প্রভু। কোন্ দেবতাকে হব্যদ্বারা পূজা করবো ? ৪। যাঁর মহিমাদ্বারা এ সকল হিমাচ্ছন্ন পর্বত উৎপন্ন হয়েছে, সসাগরা ধরা যাঁরই সৃষ্টি বলে উল্লেখিত হয়, এ সকল দিক বিদিক যাঁর বাহুস্বরূপ। কোন্ দেবতাকে হব্যদ্বারা পূজা করবো ? ৫। এ সমুন্নত আকাশ ও পৃথিবীকে যিনি স্বস্থানে দৃঢ়রূপে স্থাপন করেছেন, যিনি স্বর্গলোক ও নাকলোককে স্তম্ভিত করে রেখেছেন, যিনি অন্তরিক্ষলোক পরিমাণ করেছেন। কোন্ দেবকে হব্যদ্বারা পূজা করবো ? ৬। দ্যাবাপৃথিবী সশব্দে যাঁর দ্বারা স্তম্ভিত ও উল্লসিত হয়েছিলো, এবং সে দীপ্তিশীল দ্যাবাপৃথিবী যাঁকে মনে মনে মহিমান্বিত বলে বুঝতে পারলো, যাঁকে আশ্রয় করে সূর্য উদয় ও দীপ্তিযুক্ত হন। কোন্ দেবকে হব্যদ্বারা পূজা করবো ? ৭। ভূরি পরিমাণ জল সমস্ত বিশ্বভূবন আচ্ছন্ন করেছিলো, তারা গর্ভ ধারণপূর্বক অগ্নিকে উৎপন্ন করলো, তা হতে দেবতাদের একমাত্র প্রাণস্বরূপ যিনি, তিনি আবির্ভূত হলেন। কোন্ দেবতাকে হব্যদ্বারা পূজা করবো ? ৮। যখন জলগণ বল ধারণপূর্বক অগ্নিকে উৎপন্ন করলো, তখন তিনি নিজ মহিমাদ্বারা সে জলের উপরে সর্বভাগে নিরীক্ষণ করেছিলেন, যিনি দেবতাদের উপরে অদ্বিতীয় দেবতা হলেন। কোন্ দেবকে হব্যদ্বারা পূজা করবো ? ৯। যিনি পৃথিবীর জন্মদাতা, যাঁর ধারণক্ষমতা যথার্থ অর্থাৎ অপ্রতিহত, যিনি আকাশকে জন্ম দিলেন, যিনি আনন্দবর্ধনকারী ভূরি পরিমাণ জল সৃষ্টি করেছেন তিনি যেন আমাদের হিংসা না করেন। কোন্ দেবকে হব্যদ্বারা পূজা করবো ? ১০। হে প্রজাপতি ! তুমি ব্যতীত অন্য আর কেউ এ সমস্ত উৎপন্ন বস্তুকে আয়ত্ত করে রাখতে পারে নি। যে কামনাতে আমরা তোমার হোম করছি, তা যেন আমাদের সিদ্ধ হয়, আমরা যেন ধনের অধিপতি হই।
স্পষ্টতই এখানে এমন একজন সত্তাকে কল্পনা করা হচ্ছে যিনি কিনা অন্যান্য দেবতাকে নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে মনে করা হচ্ছে। আবার ঋগ্বেদের দেবতাগণ যে একই সত্তার বিভিন্ন রূপ, বিভিন্ন আকার তাও ঋগ্বেদের একটি ঋক বা মন্ত্রে উল্লেখ রয়েছে এভাবে-
‘ইন্দ্রং মিত্রং বরুমগ্নিণত্বা মাহূরথো দিবাঃ স সুপর্ণো গরুত্মান্ ।
একং সৎ বিপ্রা বহুধা বদন্তি অগ্নিং যমং মাতরিশ্বানমাহুঃ’।। (ঋগ্বেদ-১/১৬৪/৪৬)
অর্থাৎ : একই পরম তত্ত্ব এই আদিত্যকে মেধাবীগণ বা তত্ত্বদর্শী ব্রাহ্মণগণ ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ ও অগ্নি নামে অভিহিত করেন। ইনি স্বর্গীয়, পক্ষ বিশিষ্ট ও সুন্দর গমনশীল। ইনি এক হলেও একে বহু বলে বর্ণনা করে। একে অগ্নি, যম ও বায়ু বা মাতরিশ্বাও বলা হয়।
এ প্রসঙ্গে ঋগ্বেদের এই দশম মণ্ডলের আত্মা সূক্তেরও (১০/১২৫) উল্লেখ করা যায়। এই সূক্তের দেবতা ‘বাক্’। আত্মাকেও এর দেবতা বলা হয়েছে। ঋকগুলিতে এই দেবতা নিজের বিষয়ে নিজেই বলছেন (ঋগ্বেদ-১০/১২৫)-
‘অহং রুদ্রেভির্বসুভিশ্চরাম্যহমাদিত্যৈরুত বিশ্বদেবৈঃ।
অহং মিত্রাবরুণোভা বিভর্ম্যহমিন্দ্রাগ্নী অহমশ্বিন্যেভা।। ১
অহং সোমমাহনসং বিভর্ম্যহং ত্বষ্টারমুত পূষণং ভগম্ ।
অহং দধামি দ্রবিণং হবিষ্মতে সুপ্রাব্যে যজমানায় সুন্বতে।। ২
অহং রাষ্ট্রী সঙ্গমনী বসূনাং চিকিতুষী প্রথমা যজ্ঞিয়ানাম্ ।
তাং মা দেবা ব্যদধুঃ পুরুত্রা ভূরিস্থাত্রাং ভূর্যাবেশয়ন্তীম্ ।। ৩
ময়া সো অন্নমত্তি যো বিপশ্যতি যঃ প্রাণিতি য ঈং শৃণোত্যুক্তম্ ।
অমন্তবো মাং তা উপ ক্ষিয়ন্তি শ্রুধি শ্রূত শ্রদ্ধিবং তে বদামি।। ৪
অহমেব স্বয়মিদং বদামি জুষ্টং দেবেভিরুত মানুষেভিঃ।
যং কাময়ে তন্তমুগ্রং কৃণোমি তং ব্রহ্মাণং তমৃষিং তং সুমেধাম্ ।। ৫
অহং রুদ্রায় ধনুরা তনোমি ব্রহ্মদ্বিষে শরবে হন্তবা উ।
অহং জনায় সমদং কৃণোম্যহং দ্যাবাপৃথিবী আ বিবেশ।। ৬
অহং সুবে পিতরমস্য মূর্ধন্মম যোনিরপস্বন্তঃ সমুদ্রে।
ততো বি তিষ্ঠে ভুবনানু বিশ্বোতামূং দ্যাং বর্ষ্মণোপ স্পৃশামি।। ৭
অহমেব বাত ইব প্র বাম্যারভমাণা ভুবনানি বিশ্বা।
পরো দিবা পর এনা পৃথিব্যৈতাবতী মহিনা সং বভূব’।। ৮
অর্থাৎ : [বাগ্দেবীর উক্তি]
১। আমি রুদ্রগণ ও বসুগণের সঙ্গে বিচরণ করি, আমি আদিত্যদের সঙ্গে এবং সকল দেবতাদের সঙ্গে থাকি, আমি মিত্র ও বরুণ এ উভয়কে ধারণ করি, আমিই ইন্দ্র ও অগ্নি এবং দু অশ্বিদ্বয়কে অবলম্বন করি। ২। যে সোম আঘাত অর্থাৎ প্রস্তর নিষ্পীড়ন দ্বারা উৎপন্ন হন, আমিই তাঁকে ধারণ করি, আমি ত্বষ্টা ও পূষা ও ভগকে ধারণ করি, যে যজমান যজ্ঞসামগ্রী আয়োজনপূর্বক এবং সোমরস প্রস্তুত করে দেবতাদের উত্তমরূপে সন্তুষ্ট করে, আমিই তাকে ধন দান করি। ৩। আমি রাজ্যের অধীশ্বরী, ধন উপস্থিত করেছি, জ্ঞানসম্পন্ন এবং যজ্ঞোপযোগী বস্তু সকলের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। এরূপে আমাকে দেবতারা নানা স্থানে সন্নিবেশিত করেছেন, আমার আশ্রয়স্থান বিস্তর, আমি বিস্তর প্রাণীর মধ্যে আবিষ্ট আছি। ৪। যিনি দর্শন করেন, প্রাণধারণ করেন, কথা শ্রবণ করেন অথবা অন্ন ভোজন করেন, তিনি আমার সহায়তায় সে সকল কার্য করেন। আমাকে যারা মানে না, তারা ক্ষয় হয়ে যায়। হে বিদ্বান! শোন, আমি যা বলছি তা শ্রদ্ধার যোগ্য। ৫। দেবতারা এবং মনুষ্যেরা যাঁর শরণাগত হয়, তাঁর বিষয় আমিই উপদেশ দিই। যাকে ইচ্ছা আমি বলবান অথবা স্তোতা অথবা ঋষি অথবা বুদ্ধিমান করতে পারি। ৬। রুদ্র যখন স্তোত্রদ্বেষী শত্রুকে বধ করতে উদ্যত হন তখন আমিই তাঁর ধনু বিস্তার করে দিই। লোকের জন্য আমিই যুদ্ধ করি। আমি দ্যুলোকে ও ভূলোকে আবিষ্ট হয়ে আছি। ৭। আমি পিতা, আকাশকে প্রসব করেছি। সে আকাশ এ জগতের মস্তকস্বরূপ। সমুদ্রে জলের মধ্যে আমার স্থান। সে স্থান হতে সকল ভূবনে বিস্তারিত হই, আপনার উন্নত দেহদ্বারা এ দ্যুলোককে আমি স্পর্শ করি। ৮। আমিই সকল ভুবন নির্মাণ করতে করতে বায়ুর ন্যায় বহমান হই। আমার মহিমা এরূপ বৃহৎ হয়েছে যে দ্যুলোককেও অতিক্রম করেছে, পৃথিবীকেও অতিক্রম করেছে।
বাগ্দেবীকে এ সূক্তের বক্তা অর্থাৎ ঋষি বলে নির্দেশ করা হয়েছে। কিন্তু বাক্ যে এ সূক্তের বক্তা, সূক্তের ভেতর তার কোনও নিদর্শন পাওয়া যায় না। এই সূক্তে বক্তা আপনাকে সর্বনিয়ন্তা ও সর্বনির্মাতা বলে পরিচয় দিচ্ছেন। তিনি বলছেন তিনি বিস্তর প্রাণীর মধ্যে আবিষ্ট আছেন। তিনি দ্যুলোকে ও ভূলোকে আবিষ্ট আছেন, তিনি সকল ভুবনে বিস্তারিত হন। ফলে এখানে অস্পষ্টভাবে সর্বেশ্বরবাদের ধারণার বীজ পাওয়া যায়, যা পরবর্তীকালে উপনিষদে ব্রহ্মবাদে পরিণতি লাভ করেছে বলে মনে করা যায়।
এখানে বলাবাহুল্য, একেশ্বরবাদের সাথে সর্বেশ্বরবাদের ধারণার মধ্যে প্রকৃতিগত পার্থক্য হলো,- ‘একেশ্বরবাদ একজন মাত্র ঈশ্বরে বিশ্বাসী; কিন্তু তা ঠিক একবাদ নয়। তার পরিকল্পনায় ঈশ্বর ব্যক্তিত্ববিশিষ্ট এবং তিনি তাঁর সৃষ্ট বিশ্ব হতে পৃথক। তিনি সর্বশক্তিমান বটে; কিন্তু তিনি সৃষ্ট বিশ্বকে বাহির থেকে নির্মাণ করেন। সাধারণত তাঁকে বিশ্বের নিমিত্তকারণ এবং নিয়ন্তা বলে কল্পনা করা হয়। ফলে তার মধ্যে একটি দ্বৈতভাব এসে পড়ে। তার পরিকল্পনায় দুটি পৃথক শ্রেণির সত্তা নিয়ে বিশ্ব গঠিত- একদিকে ঈশ্বর এবং অন্যদিকে তাঁর সৃষ্টি।
সর্বেশ্বরবাদ বিশ্বকে ঈশ্বর হতে পৃথক করে না। তা বলে, বিশ্ব ও ঈশ্বর অভিন্ন। ঈশ্বরই বিশ্বের মধ্যে প্রচ্ছন্ন থেকে তাকে সৃষ্টি করেন এবং নিয়ন্ত্রণ করেন। সুতরাং এখানে ঈশ্বর নৈর্ব্যক্তিক সত্তা হয়ে পড়েন। সর্বেশ্বরবাদই প্রকৃত একবাদের নিদর্শন।’- (হিরণ্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়, উপনিষদের দর্শন, পৃষ্ঠা-৭১)
এবং এই অনেকটা সর্বেশ্বরবাদী প্রাথমিক চিন্তাই ঋগ্বেদের পুরুষ সূক্তে (১০/৯০) আরও স্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে। যেখানে এমন এক সর্বব্যাপী বিরাট পুরুষের কল্পনা করা হয়েছে, যাঁর সহস্র মাথা এবং সহস্র চরণ। পৃথিবীকে ব্যাপ্ত করেও তিনি তাকে অতিক্রম করেছেন, এতো বিরাট তিনি। সংক্ষেপে বলতে গেলে, তাঁর অঙ্গ বা বিভিন্ন অংশ হতে চন্দ্র, সূর্য, বায়ু, অগ্নি, আকাশ, স্বর্গ, ভূমি, ইন্দ্র, দিক ও ভুবন সবই সৃষ্টি হয়েছে। অর্থাৎ তাঁর দেহই খন্ডিত হয়ে বিশ্বের নানা বস্তু ও জীবে পরিণত হয়েছে। তিনিই বিশ্বরূপে রূপান্তরিত হয়েছেন। এই পুরুষসূক্তে বিশ্বজগতের নিয়ন্তা হিসেবে বিরাট-পুরুষের যে কল্পনা তার প্রতিফলন বিভিন্ন উপনিষদেই দেখা যায়। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের প্রসিদ্ধ এই পুরুষসূক্তটি (ঋগ্বেদ-১০/৯০) হলো-
‘সহস্রশীর্ষা পুরুষঃ সহস্রাক্ষঃ সহস্রপাৎ।
স ভূমিং বিশ্বতো বৃহাত্যতিষ্ঠদ্দশাঙ্গুলম্ ।। ১।
পুরুষ এবেদং সর্বং যদ্ভূতং যচ্চ ভব্য।
উতামৃতত্বস্যেশানো যদন্নেনাতিরোহতি।। ২।
এতাবানস্য মহিমাতো জ্যায়াংশ্চ পূরুষঃ।
পাদোহস্য বিশ্বা ভূতানি ত্রিপাদস্যামৃতং দিবি।। ৩।
ত্রিপাদূর্ধ্ব উদৈৎ পুরুষঃ পাদোহস্যেহাভবৎ পুনঃ।
ততো বিষ্বঙব্যক্রামৎ সাশনানশনে অভি।। ৪।
তস্মাদ্বিরাড়জায়ত বিরাজো অধি পূরুষঃ।
স জাতো অত্যরিচ্যত পশ্চাদ্ভূমিমথো পুরঃ।। ৫।
যৎ পুরুষেণ হবিষা দেবা যজ্ঞমতন্বত।
বসন্তো অস্যাসীদাজ্যং গ্রীষ্ম ইধ্মঃ শরদ্ধবিঃ।। ৬।
তং যজ্ঞং বর্হিষি প্রৌক্ষন্ পুরুষং জাতমগ্রতঃ।
তেন দেবা অযজন্ত সাধ্যা ঋষয়শ্চ যে।। ৭।
তস্মাদ্যজ্ঞাৎ সর্বহুতঃ সম্ভূতং পৃষদাজ্যম্ ।
পশুন্তাংশ্চক্রে বায়ব্যানারাণ্যান্ গ্রাম্যাশ্চ যে।। ৮।
তস্মাদ্যজ্ঞাৎ সর্বহুত ঋচঃ সামানি জজ্ঞিরে।
ছন্দাংসি জজ্ঞিরে তস্মাদ্যজুস্তস্মাদজায়ত।। ৯।
তস্মাদশ্বা অজায়ন্ত যে কে চোভয়াদতঃ।
গাবো হ জজ্ঞিরে তস্মাত্তস্মাজ্জাতা অজাবয়ঃ।। ১০।
যৎপুরুষং ব্যদধুঃ কতিধা ব্যকল্পয়ন্ ।
মুখং কিমস্য কৌ বাহূ কা ঊরূ পাদা উচ্যেতে।। ১১।
ব্রাহ্মণোহস্য মুখমাসীদ্বাহূ রাজন্যঃ কৃতঃ।
ঊরূ তদস্য যদ্বৈশ্যঃ পদ্ভ্যাং শূদ্রো অজায়ত।। ১২।
চন্দ্রমা মনসো জাতশ্চক্ষোঃ সূর্যো অজায়ত।
মুখাদিন্দ্রশ্চাগ্মিশ্চ প্রাণাদ্বায়ুরজায়ত।। ১৩।
নাভ্যা আসীদন্তরিক্ষং শীর্ষ্ণো দ্যৌঃ সমবর্তত।
পদ্ভ্যাং ভূমির্দিশঃ শ্রোত্রাত্তথা লোকা অকল্পয়ন্ ।। ১৪।
সপ্তাস্যাসন্ পরিধিয়স্ত্রিঃ সপ্ত সমিধঃ কৃতাঃ।
দেবা যদ্যজ্ঞং তন্বানা অবধ্নন্ পুরুষং পশুম্ ।। ১৫।
যজ্ঞেন যজ্ঞমযজন্ত দেবাস্তানি ধর্মাণি প্রথমান্যাসন্ ।
তে হ নাকং মহিমানঃ সচন্ত যত্র পূর্বে সাধ্যাঃ সন্তি দেবাঃ।। ১৬।
অর্থাৎ :
১। পুরুষের সহস্র মস্তক, সহস্র চক্ষু ও সহস্র চরণ। তিনি পৃথিবীকে সর্বত্র ব্যাপ্ত করে দশ অঙ্গুলি পরিমাণ অতিরিক্ত হয়ে অবস্থিত থাকেন। ২। যা হয়েছে অথবা যা হবে সকলই সে পুরুষ। তিনি অমরত্বলাভে অধিকারী হন, কেননা তিনি অন্নদ্বারা অতিরোহণ করেন। ৩। তাঁর এরূপ মহিমা, তিনি কিন্তু এ অপেক্ষাও বৃহত্তর। বিশ্বজীবসমূহ তাঁর একপাদ মাত্র, আকাশে অমর অংশ তাঁর তিন পাদ। ৪। পুরুষ আপনার তিন পাদ (বা অংশ) নিয়ে উপরে উঠলেন। তাঁর চতুর্থ অংশ এ স্থানে রইলো। তিনি তদনন্তর ভোজনকারী ও ভোজনরহিত ( চেতন ও অবচেতন) সকল বস্তুতে ব্যাপ্ত হলেন। ৫। তিনি হতে বিরাট জন্মিলেন এবং বিরাট হতে সে পুরুষ জন্মিলেন। তিনি জন্মগ্রহণপূর্বক পশ্চাদ্ভাগে ও পুরোভাগে পৃথিবীকে অতিক্রম করলেন। ৬। যখন পুরুষকে হব্য রূপে গ্রহণ করে দেবতারা যজ্ঞ আরম্ভ করলেন, তখন বসন্ত ঘৃত হলো, গ্রীষ্ম কাষ্ঠ হলো, শরৎ হব্য হলো। ৭। যিনি সকলের অগ্রে জন্মেছিলেন, সে পুরুষকে যজ্ঞীয় পশুস্বরূপে সে বহ্নিতে পূজা দেওয়া হলো। দেবতারা ও সাধ্যবর্গ এবং ঋষিগণ তা দ্বারা যজ্ঞ করলেন। ৮। সে সর্ব হোমযুক্ত যজ্ঞ হতে দধি ও ঘৃত উৎপন্ন হলো। তিনি সে বায়ব্য পশু নির্মাণ করলেন, তারা বন্য এবং গ্রাম্য। ৯। সে সর্ব হোম-সম্বলিত যজ্ঞ হতে ঋক ও সামসমূহ উৎপন্ন হলো, ছন্দ সকল তথা হতে আবির্ভূত হলো, যজু তা হতে জন্ম গ্রহণ করলো। ১০। ঘোটকগণ এবং অন্যান্য দন্ত পঙক্তিদ্বয়ধারী পশুগণ জন্মিল। তা হতে গাভীগণ ও ছাগ ও মেষগণ জন্মিল। ১১। পুরুষকে খণ্ড খণ্ড করা হলো, কয় খণ্ড করা হয়েছিলো ? এর মুখ কী হলো, দু হস্ত, দু উরু, দু চরণ কী হলো ? ১২। এর মুখ ব্রাহ্মণ হলো, দু বাহু রাজন্য হলো, যা উরু ছিলো তা বৈশ্য হলো, দু চরণ হতে শূদ্র হলো। ১৩। মন হতে চন্দ্র হলেন, চক্ষু হতে সূর্য, মুখ হতে ইন্দ্র ও অগ্নি, প্রাণ হতে বায়ু। ১৪। নাভি হতে আকাশ, মস্তক হতে স্বর্গ, দু চরণ হতে ভূমি, কর্ণ হতে দিক ও ভূবন সকল নির্মাণ করা হলো। ১৫। দেবতারা যজ্ঞ সম্পাদন কালে পুরুষস্বরূপ পশুকে যখন বন্ধন করলেন তখন সাতটি পরিধি অর্থাৎ বেদী নির্মাণ করা হলো এবং তিনসপ্ত সংখ্যক যজ্ঞকাষ্ঠ হলো। ১৬। দেবতারা যজ্ঞ দ্বারা যজ্ঞ সম্পাদন করলেন, তাই সর্ব প্রথম ধর্মানুষ্ঠান। যে স্বর্গলোকে প্রধান প্রধান দেবতা ও সাধ্যেরা আছেন, মহিমান্বিত দেবতাবর্গ সে স্বর্গধাম প্রতিষ্ঠা করলেন।
এই পুরুষ সূক্তটির বিশেষ উল্লেখযোগ্যতা হলো, ঋগ্বেদের অন্য কোনো অংশে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এই চার জাতির উল্লেখ নেই। এই সূক্তটিকে অপেক্ষাকৃত আধুনিক বলে বিদ্বানেরা অভিমত ব্যক্ত করেন, কেননা ঋগ্বেদ রচনাকালে আর্যদের মধ্যে জাতি বিভাগ ছিলো না। এবং বিশ্বজগতের নিয়ন্তাকে বলিস্বরূপ অর্পণ করার যে অনুভব এটিও ঋগ্বেদের সময়ের নয়, এমনকি ঋগ্বেদে আর কোথাও তা পাওয়া যায় না। তাছাড়া ব্যাকরণবিদ পন্ডিতদের সুস্পষ্ট অভিমত হলো, এই পুরুষসূক্তের ভাষা বৈদিক ভাষা নয়, অপেক্ষাকৃত আধুনিক সংস্কৃত। তাই উপনিষদীয় চিন্তাজগত থেকে উদ্ভূত ধারণাই পরবর্তীকালে ঋগ্বেদে অর্বাচীন হিসেবে সংযোজিত হয়েছে কিনা তা নিয়েও যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে।
তবে ঋগ্বেদের প্রাচীন পর্যায়ে বৈদিক ঋষিরা জড় প্রকৃতির উপাসক হলেও বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনার অন্তরালে ‘ঋত’ নামে এক সর্বব্যাপী নিয়ম ও শৃঙ্খলার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেন। বেদে ‘ঋত’ একটি সর্বব্যাপী নৈতিক নিয়ম যা জীব জগতকে পরিচালিত করে। এই ‘ঋত’ সম্পর্কিত ধারণাটি ঋগ্বেদের প্রথমকালের রচনায় বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিভিন্নভাবে দৃষ্টিগোচর হলেও পরবর্তীকালের অর্বাচীন অংশে তা পাওয়া যায় না। যেমন-
‘অপাদেতি প্রথমা পদ্বতীনং কস্তদ্বাং মিত্রাবরুণা চিকেত।
গর্ভো ভারং ভরত্যা চিদস্য ঋতং পিপর্ত্যনৃতং নি তারীৎ’।। (ঋগ্বেদ-১/১৫২/৩)।
অর্থাৎ : পদবিশিষ্ট মনুষ্যদের অগ্রে পদরহিতা ঊষা আসেন; হে মিত্রাবরুণ! এ যে তোমাদেরই কাজ তা কে জানে? তোমাদের সন্তান আদিত্য ঋতের পূরণ ও অনৃতের বিনাশ করে সমস্ত জগতের ভার বহন করেন। (সায়ণ ভাষ্যে, মিত্র ও বরুণ হলো দিবা ও রাত্রি। সূর্য ঐ দু কালের মধ্যকালে উদয় হন। এ জন্য মিত্রাবরুণের গর্ভ অর্থাৎ শিশু বলে বর্ণিত হয়েছে।)। (ঋক-১/১৫২/৩)
‘ঋতস্য হি শুরুধঃ সন্তি পূর্বীর্ঋতস্য ধীতির্বৃজিনানি হন্তি।
ঋতস্য শ্লোকো বধিরা ততর্দ কর্ণা বুধানঃ শুচমান আয়োঃ।। (ঋগ্বেদ-৪/২৩/৮)।
ঋতস্য দৃড়্হা ধরুণানি সন্তি পুরূণি চন্দ্রা বপুষে বপূংষি।
ঋতেন দীর্ঘমিষণন্ত পৃক্ষ ঋতেন গাব ঋতমা বিবেশুঃ।। (ঋগ্বেদ-৪/২৩/৯)।
ঋতং যেমান ঋতমিদ্বনোত্যৃতস্য শূষ¦স্তুরয়া উ গব্যুঃ।
ঋতায় পৃথ্বী বহুলে গভীরে ঋতায় ধেনূ পরমে দুহাতে’।। (ঋগ্বেদ-৪/২৩/১০)।
অর্থাৎ :
পুরাকাল থেকে ঋত-র অনেক জল আছে। ঋত-র স্তুতি পাপ নাশ করে। ঋত-র বোধযোগ্য ও দীপ্তিমান শ্লোকসমূহ বধির কর্ণদ্বয়ে প্রবেশ করে (ঋক-৪/২৩/৮)। ঋত-র ধারণাগুলি দৃঢ়, ঋত-র রূপগুলি মনোহর। স্তোতাগণ ঋত-র নিকট প্রভূত অন্ন কামনা করে। ঋত-র দরুন গাভীগুলি সংগৃহীত হয় এবং গাভীগুলি ঋততে (যজ্ঞে) প্রবেশ করে (ঋক-৪/২৩/৯)। ঋত-কে তুষ্ট করে স্তোতাগণ বল ও জল লাভ করে। ঋত-র জন্যই দ্যাবাপৃথিবী শ্রেষ্ঠ গাভীগুলি দান করে। ঋত-র জন্যই বিস্তীর্ণ দ্যাবাপৃথিবী দূরবগাহ (ঋক-৪/২৩/১০)।
‘ঋতাবান ঋতজাতা ঋতাবৃধো ঘোরাসো অনৃতদ্বিষঃ।
তেষাং বঃ সুম্নে সুচ্ছর্দিষ্টমে নরঃ স্যাম যে চ সূরয়ঃ’।। (ঋগ্বেদ-৭/৬৬/১৩)।
অর্থাৎ : তোমরা (মিত্র, বরুণ প্রভৃতি) ঋত-র সংরক্ষক, ঋত হতে তোমাদের জন্ম এবং তোমরা ঋত-র বর্ধক, অনৃতের তীব্র দ্বেষকারী। আমরা এবং অন্যান্য বীরেরা যেন তোমাদের আবাসস্থলে অন্নযুক্ত হয়ে সুখে থাকতে পারি। (ঋক-৭/৬৬/১৩)
‘ঋত’ নামক এই নিয়ম দ্বারা ধর্ম ও নীতি সংরক্ষিত হয় বলে প্রাচীন বেদের ঋষিদের বিশ্বাস ছিলো। তাই কারো কারো মতে, ‘ঋগ্বেদের প্রাচীন পর্যায়ে প্রকৃত দার্শনিক চেতনার কোনো আভাস যদি সত্যিই স্বীকৃত হয়- তাহলে তার মূলসূত্র এই ঋত-র মধ্যেই সন্ধান করতে হবে।’-( দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, ভারতীয় দর্শন, পৃষ্ঠা-১৮৫)।
তবে সহস্রাধিক বছরের ব্যবধানে এসে ঋষিদের এই ঋত-ধারণায় কোন পরিবর্তন এসে থাকতে পারে। তদুপরি বেদে কোনো সুবিন্যস্ত দার্শনিক চিন্তাধারা লক্ষ্য করা যায় না। তবে দেববাদ ও ধর্মে বিশ্বাসী বৈদিক ঋষি যাগ-যজ্ঞ, দান-ধ্যান প্রভৃতি পুণ্যকর্মের বিনিময়ে অনন্ত সুখের প্রত্যাশী হলেও বিশ্বের সীমার পর কী, এই অনন্ত বিশ্বের কোনো চালকশক্তি আছে কি-না, সৃষ্টির প্রারম্ভে জগৎ কিরূপ ছিলো, এ সমস্ত প্রশ্নে আলোড়িত হয়েছেন নিশ্চয়ই। এসকল প্রশ্নের বিচারের একটা ক্ষীণ ও অস্পষ্ট আভাস পাওয়া যায় ঋগ্বেদের নাসদীয় সূক্তে। তাই ঋগ্বেদের এই নাসদীয় সূক্তকেই উপনিষদীয় দার্শনিক ভাবনার প্রাথমিক ভিত্তি বা বীজ হিসেবে গণ্য করা হয়। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের এই প্রসিদ্ধ নাসদীয় সূক্তটি (ঋগ্বেদ-১০/১২৯) হলো-
‘নাসদাসীন্নো সদাসীত্তদানীং নাসীদ্রজো নো ব্যোমা পরো যৎ।
কিমাবরীবঃ কুহ কস্য শর্মন্নম্ভঃ কিমাসীদ্গহনং গভীরম্ ।। ১
ন মৃত্যুরাসীদমৃতং ন তর্হি ন রাত্র্যা অহ্ন আসীৎ প্রকেতঃ।
আনীদবাতং স্বধয়া তদেকং তস্মাদ্ধানান্ন পরঃ কিং চনাস।। ২
তম আসীত্তমসা গূড়্হমগ্রেহ প্রকেতং সলিলং সর্বমা ইদম্ ।
তুচ্ছ্যেনাভ¦পিহিতং যদাসীত্তপসস্তন্মহিনাজায়তৈকম্ ।। ৩
কামস্তদগ্রে সমবর্ততাধি মনসো রেতঃ প্রথমং যদাসীৎ।
সত্যে বন্ধুমসতি নিরবিন্দন্ হৃদি প্রতীষ্যা কবয়ো মনীষা।। ৪
তিরশ্চীনো বিততো রশ্মিরেষামধঃ স্বিদাসীদুপরি স্বিদাসীৎ।
রেতোধা আসন্মহিমান আসন্ত্ স্বধা অবস্তাৎ প্রযতিঃ পরস্তাৎ।। ৫
কো অদ্ধা বেদ ক ইহ প্র বোচৎকুত আজাতা কুত ইয়ং বিসৃষ্টিঃ।
অর্বাগ্ দেবা অস্য বিসর্জনেনাথা কো বেদ যত আবভূব।। ৬
ইয়ং বিসৃষ্টির্যত আবভূব যদি বা দধে যদি বা ন।
যো অস্যাধ্যক্ষঃ পরমে ব্যোমন্ত্ সো অঙ্গ বেদ যদি বা ন বেদ।। ৭
অর্থাৎ :
১। সেকালে যা নেই তাও ছিলো না, যা আছে তাও ছিলো না। পৃথিবীও ছিলো না, অতি দূরবিস্তার আকাশও ছিলো না। আবরণ করে এমন কী ছিলো ? কোথায় কার স্থান ছিলো ? দুর্গম ও গম্ভীর জল কি তখন ছিলো ? ২। তখন মৃত্যুও ছিলো না, অমরত্বও ছিলো না, রাত্রি ও দিনের প্রভেদ ছিলো না। কেবল সে একমাত্র বস্তু বায়ুর সহকারিতা ব্যতিরেকে আত্মা মাত্র অবলম্বনে নিশ্বাস-প্রশ্বাসযুক্ত হয়ে জীবিত ছিলেন। তিনি ব্যতীত আর কিছুই ছিলো না। ৩। সর্বপ্রথমে অন্ধকারের দ্বারা অন্ধকার আবৃত ছিলো। সমস্তই চিহ্নবর্জিত ও চতুর্দিকে জলমগ্ন ছিলো। অবিদ্যমান বস্তু দ্বারা সে সর্বব্যাপী আচ্ছন্ন ছিলেন। তপস্যার প্রভাবে সে এক বস্তু জন্মিলেন। ৪। সর্বপ্রথম মনের উপর কামের আবির্ভাব হলো, তা হতে সর্বপ্রথম উৎপত্তির কারণ নির্গত হলো। বুদ্ধিমানগণ বুদ্ধি দ্বারা আপন হৃদয়ে পর্যালোচনাপূর্বক অবিদ্যমান বস্তুতে বিদ্যমান বস্তুর উৎপত্তি স্থান নিরূপণ করলেন। ৫। রেতোধা পুরুষেরা উদ্ভব হলেন, মহিমা (পঞ্চভূত) সকল উদ্ভব হলেন। ওদের রশ্মি দু’পার্শ্বে ও নিম্নের দিকে এবং উর্ধ্ব দিকে বিস্তারিত হলো, নিম্নদিকে (নিকৃষ্ট) স্বধা (অন্ন) রইলো, প্রয়তি ( ভোক্তা পুরুষ) উর্র্ধ্বদিকে (উৎকৃষ্ট) রইলেন। ৬। কেই বা প্রকৃত জানে ? কেই বা বর্ণনা করবে ? কোথা হতে জন্মিল ? কোথা হতে এ সকল নানা সৃষ্টি হলো ? দেবতারা এ সমস্ত নানা সৃষ্টির পর হয়েছেন, কোথা হতে যে হলো, তা কেই বা জানে ? ৭। এ নানা সৃষ্টি যে কোথা হতে হলো, কার থেকে হলো, কেউ সৃষ্টি করেছেন, কি করেন নি, তা তিনিই জানেন, যিনি এর প্রভুস্বরূপ পরমধামে আছেন ! অথবা তিনিও না জানতে পারেন।
সৃষ্টির আদি কারণ ও প্রণালীর পর্যালোচনা সমৃদ্ধ এই নাসদীয় সূক্তটির ভাব দেখে এটিকেও বেদের অপেক্ষাকৃত আধুনিক বলে বিবেচনা করা হয়। সূক্তটির জ্ঞাতব্য হলো, সৃষ্টির পূর্বের অবস্থা বর্ণনা এবং পরমাত্মার অনুভব। প্রকৃতির যে কার্যসমূহ ও সৌন্দর্যকে ঋষিগণ দেবতা বলে পূজা করতেন, তাঁরা আদি দেব নহেন, তাঁরাও সৃষ্ট অর্থাৎ কার্য মাত্র, তা ঋষির মনে উদয় হয়েছে। তবে জগতের কারণ কে, আদি কে, এসব প্রশ্নের এক অব্যক্ত উত্তর যেন এই সূক্ত। কিন্তু এ প্রশ্নের উত্তর দেয়া যে মনুষ্যের সাধ্য নয়, বেদের ঋষি তাও স্বীকার করেছেন এখানে।
এই প্রশ্নসমূহ এবং তার উত্তর থেকেই বৈদান্তিক বা উপনিষদীয় দার্শনিক চিন্তার আবির্ভাব বলে ধরা হয়। বিশ্বের প্রাথমিক অবস্থা কারও মতে ছিলো সৎ বা অস্তিত্ববান, কারও মতে অসৎ। আবার কেউ বাদ-প্রতিবাদ সংবাদ দ্বারা- ‘সৎ নয়, অসৎও নয়’- বলে প্রতিষেধের প্রতিষেধ করেছেন। ঋষি কল্পনা করেছেন বিশ্বের প্রাথমিক অবস্থায় সেই মহাশূন্যে এক সত্তার অস্তিত্বকে যিনি সেই মৃত-শূন্য জগতে ছিলেন একমাত্র সজীব সত্তা। প্রথমে বিশ্ব ছিলো অনন্ত জলরাশি, ঋগ্বেদোক্ত এই তথ্য প্রাচীন বৃহদারণ্যক উপনিষদেও দেখা যায় এভাবে-
‘আপ এব ইদমগ্র আসুঃ’ অর্থাৎ, প্রথমে বিশ্ব ছিলো অনন্ত জলরাশি। – (বৃহদারণ্যক: ৫/৫/১)
এছাড়াও ঋগ্বেদের নাসদীয় সূক্তের কল্পনাকে অক্ষুণ্ন রাখার জন্যেই হয়তো বৃহদারণ্যক উপনিষদের প্রথম অধ্যায়ের দ্বিতীয় ব্রাহ্মণে বলা হয়েছিলো-
‘নৈবেহ কিংচনাগ্র আসীৎ মৃত্যুনৈব ইদম্ আবৃতমাসীৎ। অশনায়য়া অশনায়া হি মৃত্যুঃ। তৎ মনোহকুরুত আত্মন্বী স্যামিতি। সোহর্চন অচরৎ। অস্যার্চত আপোহজায়ন্ত। অর্চতে বৈ ইমে কমভূদিতি। তদেব অর্কস্য অর্কত্বম। কং হ বা অস্মৈ ভবতি। য এবমেদৎ অর্কস্য অর্কত্বং বেদ’।। (বৃহদারণ্যক: ১/২/১)।।
‘আপো বা অর্কঃ। তৎ যৎ অপাং শর আসীৎ তৎ সমহন্যত। সা পৃথিব্যভবৎ। তস্যামশ্রাম্যৎ তস্য শ্রান্তস্য তপ্তস্য তেজো রসো নিরবর্তত অগ্নি’।। (বৃহদারণ্যক: ১/২/২)।।
অর্থাৎ :
সৃষ্টির প্রথমে এসব কিছুই ছিলো না। যা ছিলো, তা আবৃত ছিলো মৃত্যুর (= জীবন শূন্যতা) দ্বারা। সেই মৃত্যু হলো ‘অশনায়া’-রূপ মৃত্যু। ‘অশনায়া’ হলো ভোগেচ্ছা-বুভুক্ষা-ক্ষুধার দাহ। এই মৃত্যু সংকল্প করলেন- ‘আমি আত্মন্বী হবো’। অর্থাৎ আমি আত্মবান বা অবয়বযুক্ত কায়াময় হবো। তিনি এই সংকল্পে স্থির থেকে নিজেই নিজের অর্চনা করতে করতে চতুর্দিক বিচরণ করে বেড়াতে লাগলেন। সেই অর্চনা বা আত্মানুশীলনের ফলে উৎপন্ন হলো জল। মৃত্যু তাই দেখে মনে মনে চিন্তা করলেন- অর্চনারত আমার জন্য কম্ অর্থাৎ জল বা সুখ উৎপন্ন হলো ! এই কারণেই অর্কের অর্কত্ব। অর্ককে যিনি এইভাবে জানেন, জলের অভাব তিনি কখনোই অনুভব করেন না- জল হয় তাঁর নিত্যসঙ্গি। (যদিও সাধারণ অর্থে অর্ক হলো তেজ বা অগ্নি, কিন্তু এখানে অর্ক-কে গৌন অর্থে জল এবং জলরূপে জানার কথা বলা হয়েছে।)। (বৃহদারণ্যক: ১/২/১)।
জলই অর্ক। জলের উপরিভাগ ক্রমশ কঠিন হলো। সংঘাতের মাধ্যমে জমতে শুরু করলো সরের মতো আস্তরণ। সেই আস্তরণ হলো পৃথিবী। অশনায়া মৃত্যু তার সৃষ্টিকার্যে বা ভোগ্যবস্তুর অভিলাষে অফুরন্ত পরিশ্রমে ক্লান্ত হলেন। ক্ষিতি-তত্ত্বের উপর শয়ান সেই স্রষ্টাপুরুষ মৃত্যুর পরিশ্রান্ত এবং উত্তপ্ত রোমবিবর থেকে নির্গত হলো তেজের সার-অংশরূপে অগ্নি, বিরাটরূপী অগ্নি। (বৃহদারণ্যক: ১/২/২)।
এই কল্পনাকে প্রলম্বিত করে উপনিষদীয় ঋষি তাঁর সৃষ্টিতত্ত্বকে আরো বিস্তৃত করলেন এভাবে-
‘স ত্রেধাত্মানং ব্যকুরুত। আদিত্যং তৃতীয়ং; বায়ৃং তৃতীয়ং। স এষ প্রাণস্ত্রেধা বিহিতঃ। তস্য প্রাচী দিক্ শিরঃ; অসৌ চাসৌ চ ঈর্মৌ। অথাস্য প্রতীচী দিক্ পুচ্ছম্; অসৌ চাসৌ চ সকথ্যৌ। দক্ষিণা চ উদীচী চ পার্শ্বে। দ্যৌঃ পৃষ্ঠং অন্তরিক্ষং উদরং, ইয়ং উরঃ স এষ অপসু প্রতিষ্ঠিতো। যত্র ক্ব চ এতি, তদেব প্রতিতিষ্ঠত্যেবং বিদ্বান্’।। (বৃহদারণ্যক: ১/২/৩)।।
অর্থাৎ :
তিনি নিজেকে তিনভাগে ভাগ করলেন। অর্থাৎ সেই বিরাট পুরুষ হলেন তিন- অগ্নি বা তেজ একভাগ; অপর দুটি হলো- আদিত্য আর বায়ু। সেই প্রাণ এইভাবে নিজেকে তিনভাগ করলেন। সেই বিরাট-পুরুষের পূর্বদিক হলো মাথা; অগ্নি আর ঈশান কোণ দুটি হলো ‘ঈর্মৌ’ অর্থাৎ দুটি বাহু; পশ্চিম দিক হলো পুচ্ছ; নৈর্ঋত আর বায়ুকোণ দুটি হলো তার দুই উরু; দক্ষিণ আর উত্তর দিক দুটি দুই পাশ; দ্যুলোক তার পিঠ; অন্তরিক্ষ হলো উদর; আর এই পৃথিবী হলো বুক। তিনি জলে প্রতিষ্ঠিত। অর্করূপী মৃত্যুকে যিনি জলে প্রতিষ্ঠিত বলে জানেন, তিনি যেখানেই যান না কেন সেখানেই তিনি প্রতিষ্ঠা লাভ করেন। (বৃহদারণ্যক: ১/২/৩)।
এই বৃহদারণ্যকেরই আরেক জায়গায় সৃষ্টির বর্ণনায় বলা হয়েছে-
‘আত্ম্যৈবেদমগ্র আসীৎ পুরুষবিধঃ। সোহনুবীক্ষ্য নান্যদাত্মনোহপশ্যৎ। সোহহমস্মীতি অগ্রে ব্যাহরৎ। ততোহহং নামাভরৎ। তস্মাদপি এতর্হি আমন্ত্রিতোহহম্ অয়মিত্যেবাগ্র উক্তবা অথান্যদ্ নাম প্রব্রুতে যদস্য ভবতি। স যৎ পূর্বোহস্মাৎ সর্বস্মাৎ সর্বান্ পাপমান ঔষৎ, তস্মাৎ পুরুষ ওষতি, হ বৈ স তং ষোহস্মাৎ পূর্বো বুভুষতি, য এবং বেদ’।। (বৃহদারণ্যক: ১/৪/১)।।
‘সোহবিভেতি; তস্মাৎ একাকী বিভেতি। স হ অয়ম্ ঈক্ষাংচক্রে-যন্মদ্ অন্যৎ নাস্তি কস্মান্নু বিভেমীতি? তত এবাস্য ভয়ং বীয়ায় কস্মাৎ হি অভেষ্যদ্ । দ্বিতীয়াৎ বৈ ভয়ং ভবতি’।। (বৃহদারণ্যক: ১/৪/২)।।
‘স বৈ নৈব রেমে। তস্মাৎ একাকী ন রমতে। স দ্বিতীয়ম্ ঐচ্ছৎ। স হৈতাবান্ আস যথা স্ত্রীপুমাংসৌ সংপরিষ্বক্তৌ, স ইমমেব আত্মানং দ্বেধা অপাতয়ৎ। ততঃ পতিশ্চ পত্নী চ অভবতাং, তস্মাৎ ইদম্ অর্ধবৃগলমিব স্ব ইতি স্মাহ যাজ্ঝবল্ক্যঃ। তস্মাৎ অয়ম্ আকাশঃ স্ত্রিয়া পূর্ষত এব। তাং সমভবৎ ততো মনুষ্যা অজয়ান্ত।। (বৃহদারণ্যক: ১/৪/৩)।।
‘সো হ ইয়ম্ ঈক্ষাংচক্রে-কথং নু মাত্মন এব জনয়িত্বা সংভবতি ! হন্ত তিরোহসানীতি। সা গৌঃ অভবৎ, ঋষভ ইতরস্তাং সমেবাভৎ। ততো গাবোহজায়ন্ত। বড়বেতরা অভবৎ, অশ্ববৃষ ইতরো, গর্দভীতরা গর্দভ ইতরবাং সমেবাভস্তৎ। তত একশফম্ অজায়ত, অজা ইতরা অভবৎ, বস্তু ইতরোহবিরিতরা মেষ ইতরস্তাং সমেবাভবৎ ততো অজাবয়োহজায়ন্ত। এবমেব যদিদং কিংচ মিথুনম্ আপিপীলিকাভ্যঃ, তৎ সর্বম্ অসৃজত।। (বৃহদারণ্যক: ১/৪/৪)।।
‘সোহবেদহং বাব সৃষ্টিরস্মি, অহম্ হি ইদং সর্বম্ অসৃক্ষীতি। ততঃ সৃষ্টিরভবৎ। সৃষ্ট্যাং হি অস্য এতস্যাং ভবতি, য এবং বেদ’।। (বৃহদারণ্যক: ১/৪/৫)।
অর্থাৎ :
‘এই সৃষ্টির পূর্বমুহূর্তে ছিলো এক পুরুষ-রূপ। তিনি হলেন ‘আত্মা’। তিনি চতুর্দিকে দৃষ্টি-বিক্ষেপ করে নিজেকে ছাড়া দ্বিতীয় আর কাউকে দেখতে না পেয়ে বলে উঠলেন- ‘সোহহমস্মি’। অর্থাৎ সেই আমি (‘সোহং’) একমাত্র ‘আমি’- আমিই ! তাঁর উচ্চারিত এই ‘অহং’ বা ‘আমি’ হলো প্রথম নাম, যা আজও আমরা নিজের নামোচ্চারণের পূর্বে ব্যবহার করি। সেই ‘আমি’র সঙ্গে দ্বিতীয় নামের পরিচয় যোগ করে জবাব দেই- ‘আমি অমুক’। তিনি ‘পুরুষ’। কারণ তিনি পূর্বেই যাবতীয় পাপ দগ্ধ করে নিষ্পাপ হয়েছিলেন। দগ্ধ করে তিনি হয়েছিলেন পাপ-বর্জিত- তাই পুরুষ। সর্বশ্রেষ্ঠ এই পুরুষকে যিনি জানেন, তিনি সেই ব্যক্তিকে নিমেষে দগ্ধ করেন, যে তাঁর চেয়েও শ্রেষ্ঠ হতে চায়।’ (বৃহদারণ্যক: ১/৪/১)।
‘হঠাৎ একসময় তিনি বেশ ভীত হয়ে পড়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে তিনি শক্ত করে নিলেন এই বলে- ‘আমি ছাড়া আর যখন কোথাও কিছু নেই, তখন আমি এতো ভয় পাবো কেন?’ মন স্থির করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর ভয়ও চলে গেলো। সেই থেকে মানুষ যখন একা থাকে, একটা ভয়-ভাব সে মনে মনে অনুভব করে। মন শক্ত করলেই সেই ভাব আর থাকে না।’ (বৃহদারণ্যক: ১/৪/২)।
‘তিনি কিন্তু আনন্দ পেলেন না। সেই থেকে আজও কেউ একা থাকার সময় মানুষ কোন আনন্দ পায় না। সঙ্গি না থাকলে আনন্দ কোথায়? তাই তিনি আনন্দ রস আস্বাদ করার জন্য চাইলেন দ্বিতীয় সত্তাকে। এক সেই আত্মার মধ্যেই একটি পুরুষ আর একটি স্ত্রী-সত্তা ছিলো সমালিঙ্গিত- একে অপরকে জড়িয়ে। যেই মুহূর্তে মনে জাগলো আনন্দ-রস আস্বাদনের ইচ্ছা, অমনি তিনি নিজের দেহকেই ভাগ করলেন দুটি ভাগে। বিভক্ত সেই দুটি সত্তা হলো- পুরুষ আর স্ত্রী- পতি এবং পত্নী। এই কারণেই যাজ্ঞবল্ক্য বলেছিলেন- প্রত্যেকে নিজ ‘অর্ধবৃগলে’র মতো (অর্থাৎ সমান দুটি ভাগ নিয়ে গোটা একটি ডালের এক এক অংশ-র নাম হলো ‘বৃগল’ বা বিদল)। দুটি বিদল নিয়ে গোটা একটি ডালের মতোই আমাদের এই স্থূল-শরীর স্ত্রী-পুরুষে সমালিঙ্গিত। স্ত্রী-অর্ধাংশ। তাই অর্ধাঙ্গিনীই পূর্ণ করে থাকে পুরুষের শূন্যস্থান। রসময় সেই আত্মা, পুরুষ এবং স্ত্রীরূপে নিজেকে অভিব্যক্ত করে সৃষ্টি লীলাবিলাসে মেতে উঠলেন। সেই পুরুষ স্ত্রীর সঙ্গে হলেন মিথুন- স্ত্রীতে উপগত হলেন। তা থেকেই মানুষের উৎপত্তি।’ (বৃহদারণ্যক: ১/৪/৩)।
‘অর্ধ অঙ্গজাত সেই নারীর মনে এলো দ্বিধা, সংকোচ। মন তাঁর হলো আলোড়িত। ভাবলেন- এ কী হলো ! নিজের অর্ধ-অঙ্গ থেকে যিনি আমাকে সৃষ্টি করলেন, তিনিই কিনা আমার সঙ্গে করলেন রতিক্রিয়া? এই নিদারুণ লজ্জায় আত্মগোপন করা ছাড়া আর কি উপায় আছে ! এই ভেবে তিনি ধরলেন গাভীর রূপ। প্রজাপতি পুরুষটির মধ্যে তখন সৃষ্টি সুখের উল্লাস। তিনিও তাই দেখে বৃষরূপ ধরে সেই গাভীতে উপগত হলেন। উৎপন্ন হলো গোজাতি। আবার আত্মগোপন করলেন নারী। ধরলেন ঘোটকীর রূপ, পুরুষটি হলেন ঘোটক, নারী হলেন গর্দভী, পুরুষ হলেন গর্দভ। উৎপন্ন হলো ‘একশফম্’ অর্থাৎ এক খুরবিশিষ্ট প্রাণী। আবার আত্মগোপন করলেন নারী। ধরলেন ‘অজা’ (ছাগলী)-র রূপ, পুরুষটি হলেন ‘অজ’ (ছাগল), নারী ধরলেন ‘অবা’ (মাদী ভেড়া)-র রূপ, পুরুষটি হলেন ‘মেষ’। এইভাবে ছোট্ট পিপীলিকা পর্যন্ত যতো-রকমের প্রাণীর রূপের মধ্যেই আত্মগোপন করুন না কেন নারী নিষ্কৃতি পেলেন না মৈথুনের হাত থেকে। সৃষ্টির আনন্দ প্রজাপতির মনে তখন লহরীর পর লহরী তুলে চলছিলো অবিরাম। মানুষ থেকে শুরু করে প্রাণী জগতের শেষ মিথুন প্রাণীটুকু পর্যন্ত এইভাবেই সৃষ্ট হলো।’ (বৃহদারণ্যক: ১/৪/৪)।
‘প্রজাপতি তাঁর সৃষ্টির দিকে তাকিয়ে খুবই আত্মপ্রসাদ লাভ করলেন। ভাবলেন- কে এই সৃষ্টির স্বরূপ? সে তো আমি। যা কিছু সৃষ্টি সবকিছু তো আমারই সৃজন। আমিই স্রষ্টা, আমিই সৃষ্টি। তাই তিনিই হলেন সৃষ্টি। সৃষ্টিতত্ত্বকে যিনি এইভাবে জানতে পারেন, সৃষ্টির মধ্যে তিনিই হতে পারেন স্রষ্টা, প্রজাপতি।’ (বৃহদারণ্যক: ১/৪/৫)।
সৃষ্টি ও স্রষ্টাকে একাত্ম করে ধীরে ধীরে এক অদ্বৈত সত্তার উপলব্ধি উপনিষদীয় ঋষিদের চিন্তাজগতে যে অনেকটাই দানা বেঁধে উঠছিলো তা উপনিষদীয়-সাহিত্যে অপ্রকাশ্য নয়। বৃহদারণ্যকেই বলা হয়েছে-
‘তদ্ধেদং তর্হি অব্যাকৃতমাসীৎ, তৎ নামরূপাভ্যামেব ব্যক্রিয়ত। অসৌ নামায়মিদং রূপ ইতি। তদিদমপি এতর্হি নামরূপাভ্যাবেম ব্যক্রিয়তে অসৌ নামায়মিদং রূপ ইতি। স এষ ইহ প্রবিষ্টঃ। আনখাগ্রেভ্যো যথা ক্ষুরঃ ক্ষুরধানেহবহিতঃ স্যাৎ বিশ্বম্ভরো বা বিশ্বম্ভরকুলায়ে, তং ন পশ্যন্তি। অকৃৎস্নো হি স প্রাণন্নেব, প্রাণো নাম ভবতি, বদন্ বাক্, পশ্যংশ্চক্ষুঃ, শৃন্বন্ শ্রোত্রম্, মন্বানো মনস্তানি, অস্যৈতানি কর্মনামানি এব। স যোহত একৈকমুপাস্তে ন স বেদ। অকৃৎস্নো হি এষঃ। অত একৈকেন ভবতি। আত্মত্যেবোপাসীত। অত্র হি এতে সর্ব একং ভবন্তি। তদেতৎ মদীনয়মস্য সর্বস্য যদয়মাত্মা। অনেন হি এতৎ সর্বং বেদ। যথা হ বৈ পদেনানুবিন্দেৎ এবম্ কীর্তিম্ শ্লোকম্ বিন্দতে, য এবং বেদ’।। (বৃহদারণ্যক: ১/৪/৭)।
অর্থাৎ :
‘প্রথমে সবই ছিলো অব্যাকৃত, অসৎ, অমূর্ত। বীজের অভ্যন্তরে ছিলো একাকার হয়ে। ছিলো না নানা নামে, নানা রূপে তার বহিঃপ্রকাশ। সৃষ্টির অভিলাষে, লীলা-বিলাসে, আনন্দের অভিসারে সেই এক তিনি হলেন ব্যাকৃত, ব্যক্ত, প্রকাশিত- হলেন নাম ও রূপ নিয়ে বহু। পৃথক পৃথক অস্তিত্ব নিয়ে তিনিই হয়েছেন বহু। হলেন ‘ইদং’- অর্থাৎ, এই। প্রত্যেকের অভ্যন্তরে তাই তাঁরই অধিষ্ঠান। নামে রূপে এই প্রকাশের ফলেই জগতের প্রতিটি বস্তুও এক-এক নাম, এক-এক রূপ। চিহ্নিত করে এই বলে- ‘এর এই নাম’, ‘এটির এই রূপ’।
ক্ষুরের খাপে যেমন ক্ষুর, কাঠে যেমন বিশ্বম্ভর অগ্নি অনুপ্রবিষ্ট হয়ে আছে, দেহের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এমনকি মাথার চুল থেকে পায়ের নখ পর্যন্ত তেমনিভাবে তিনি ( সেই লীলাভিলাষী) আত্মার মধ্যে প্রবিষ্ট হয়ে আছেন। বাইরের এই চোখ দিয়ে তাঁকে দেখা যায় না। এই চোখ যা দেখে তা সবই ‘অকৃৎস্ন’- অপূর্ণ, খণ্ডরূপ।
কর্মরত অবস্থায় আত্মা কতো কর্মই না করে চলেছেন। ভিন্ন ভিন্ন কর্মের মাঝে ভিন্ন ভিন্ন নামে তিনি নিজেকে প্রকাশ করছেন। যখন প্রাণন অর্থাৎ শ্বাস-প্রশ্বাসের কাজ করছেন, তখন তিনি প্রাণ। যখন কথা বলছেন, তখন বাক্ । যখন দেখছেন, তখন চক্ষু। যখন শুনছেন, তখন কর্ণ। যখন মনন করছেন, তখন মন। সেই এক তিনি অথচ কর্মভেদে কতোই না নাম ! এই কারণে যে আত্মাকে পৃথক ভেবে উপাসনা করে, সে প্রকৃত আত্মতত্ত্ব জানে না। যা পৃথক, তা অপূর্ণ। সবসময়ই উপাসনা করতে হবে এই ভেবে যে ‘ইনি আত্মা’। তখন পৃথক সত্তার অস্তিত্ব নিয়ে যাবে সমষ্টিতে, অপূর্ণতা পাবে পূর্ণতা, খণ্ড অখণ্ডের আনন্দে মধুর হয়ে উঠবে। কারণ, সবই আত্মার মধ্যে এক সেই আত্মাই ‘পদনীয়’ অর্থাৎ জ্ঞাতব্য বা অনুসন্ধানের একমাত্র বস্তু। নানা নামে রূপে যিনি নিজেকে প্রকাশ করে রেখে নিজে অদৃশ্য হয়ে আছেন, তাঁকে জানতে পারলে সবই জানা হয়ে যায়। আত্মতত্ত্বকে যিনি এইভাবে জানেন, তিনি অবশ্যই কীর্তিমান, যশস্বী হন।’ (বৃহদারণ্যক: ১/৪/৭)।
এই যে সমগ্র বিশ্বজগৎ একই পরম সত্তার বিভিন্ন প্রকাশ, জগতের সব কিছুর মূলে এক চৈতন্য সত্তা অস্তিত্ববান, তিনিই সেই পরম পুরুষ। উপনিষদীয় চিন্তাসূত্রে তাঁকেই ব্রহ্ম নামে অধিষ্ঠিত করা হয়েছে। তিনিই জগতের আদি, তিনিই জগতের সকল কিছুর অধিষ্ঠান, এই উপলব্ধির সাথে একাত্ম হওয়াই উপনিষদীয় দার্শনিক ভাবনার বহিঃপ্রকাশ-
‘ব্রহ্ম বা ইদমগ্র আসীৎ, তৎ আত্মানম্ এবাবেৎ- অহং ব্রহ্মাস্মি ইতি। তস্মাৎ তৎ সর্বমভবৎ। তদ্ যো যো দেবানাম্ প্রত্যবুধ্যত স এব তৎ অভবৎ। তথা ঋষীণাং তথা মনুষ্যাণাং, তদ্ধৈতৎ পশ্যন্-ঋষির্বামদেবঃ প্রতিপেদেহহং মনুরভবৎ সূর্যশ্চেতি। তৎ ইদম্নপি এতর্হি য এবং বেদাহং ব্রহ্মাস্মীতি স ইদং সর্বং ভবতি তস্য হ ন দেবাশ্চনাভূত্যা ঈশতে। আত্মা হি এষাং স ভবতি। অথ যোহন্যাং দেবতাম্ উপাস্তে অন্যঃ অসৌ অন্যোহহমস্মীতি ন স বেদ যথা পশুরেবং স দেবানাম্ । যথা হ বৈ বহবঃ পশবো মনুষ্যং ভুঞ্জুঃ এবমেকৈকঃ পুরুষো দেবান্ ভুনক্তি। একস্মিন্ এব পশৌ আদীয়মানোহপ্রিয়ং ভবতি, কিম্ উ বহুষু। তস্মাদেষাং তন্ন প্রিয়ং যদেতৎ মুনষ্যা বিদ্যুঃ’।। (বৃহদারণ্যক: ১/৪/১০)।।
অর্থাৎ :
এই জগৎ আগে ব্রহ্মরূপেই ছিলো, ছিলো ব্রহ্মময়। সর্বশক্তিমান তিনি যে মুহূর্তে নিজেকে নিজে জানালেন- ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’- অর্থাৎ ‘আমিই ব্রহ্ম’, অমনি তিনি সবকিছু হয়ে সর্বাত্মক হলেন। দেবতাদের মধ্যেও যিনি নিজেকে ব্রহ্ম সদৃশ বলে জেনে জাগ্রত হলেন, তাঁরাও সর্বাত্মক হয়েছিলেন। অতএব ঐ একইভাবে ঋষি ও মনুষ্যের মধ্যে যিনি নিজেকে ‘অহং ব্রহ্মাস্মি’ বলে জানেন তিনিই এই সব হন। ঋষি বামদেব ব্রহ্মজ্ঞানে জ্ঞানী হয়ে বলেছিলেন- ‘আমি মনু হয়েছিলাম’; ‘আমিই সূর্য হয়েছিলাম’। যিনি নিজেকে নিশ্চিত ভাবে জানেন ‘আমি ব্রহ্ম’, তিনি এইরকমই হন। কারণ তাঁর আত্মা তখন সর্বব্যাপী। তাই দেবতারও সাধ্য থাকে না তাঁর বিরুদ্ধে যাবার বা তাঁর ক্ষতি করার। আর ব্রহ্মজ্ঞানে অজ্ঞানী মানুষ যাঁরা দেবতাকে নিজেদের থেকে স্বতন্ত্র ভেবে আরাধনা করেন তাঁরা জানে না যে, তাঁরা দেবতার নিকট পশুর তুল্য। এক এক দেবতার উপাসনা করেই তারা জীবনকে ধন্য মনে করে। মানুষ যেমন পশু-গৌরবে গৌরব-বোধ করে, দেবতারাও তেমনি একই রকমের মানুষ-পশু পেয়ে খুশিই থাকেন। একটি পশু চুরি গেলে বা নষ্ট হয়ে গেলে মানুষের যেমন ক্ষতি বোধ হয়, দেবতাদের ক্ষেত্রেও ঠিক তাই। কোন সেবক মানুষ-পশু যদি নিজেকে একবার পশুত্ব-পাশ থেকে মুক্ত করে তত্ত্বজ্ঞ, আত্মজ্ঞ, ব্রহ্মজ্ঞ হয়ে ওঠে, তাহলে দেবতারা তার সেবা আর পেতে পারে না। তাই দেবতারা চান না, মানুষ ব্রহ্মজ্ঞ হোক, ব্রহ্মজ্ঞান লাভ করুক।’ (বৃহদারণ্যক: ১/৪/১০)।
এখানে দেবতাদের প্রতি উপনিষদীয় ঋষির উপরিউক্ত মনোভাব বেশ কৌতুহলোদ্দীপক হলেও তা যে অযৌক্তিক ছিলো না তা বুঝতে এখানে উল্লেখ্য যে, বেদের সুপ্রাচীন অংশের কয়েকটি সূক্তের মধ্যে, যেমন নাসদীয় সূক্ত, বৈদান্তিক ভাবনার কিঞ্চিৎ সন্ধান পেলেও, প্রাচীন আর্য ভারতীয়রা যাগযজ্ঞ এবং অনুষ্ঠানাদির উপরই বেশি গুরুত্ব দিতেন। যজ্ঞীয় কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আধ্যাত্ম ফলপ্রাপ্তির প্রতি প্রচণ্ড আস্থা ও বিশ্বাস রেখে পুরোহিত শ্রেণীর ব্রাহ্মণেরা এইসব দীর্ঘমেয়াদী ও অতি ব্যয়বহুল যাগযজ্ঞাদির খুঁটিনাটির উপর এতোটা গুরুত্ব আরোপ করতেন যে, এর প্রতিক্রিয়াস্বরূপ পরবর্তী কালের যুক্তিবাদী মননশীল ব্যক্তিরা যজ্ঞীয় ক্রিয়াকাণ্ডের ফলের উপর সন্দিহান হয়ে উঠেন এবং এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন। তাঁরা আধ্যাত্মিক সমস্যাগুলির সমাধানের জন্য গভীর চিন্তায় নিমগ্ন হন এবং পার্থিব সমস্যার ভিন্ন ভিন্ন সমাধানে উপনীত হন। বেদের সূক্তভাগে যে বেদান্ত ভাবনা বীজাকারে নিহিত ছিলো, তা-ই কালক্রমে বিবর্ধিত হয়ে উপনিষদ আকারে আত্মপ্রকাশ করে। এখানে কর্মকাণ্ডের চাইতে জ্ঞানকাণ্ডই হয়ে উঠে মুখ্য।
বেদের ক্রিয়াকাণ্ডের আচার অনুষ্ঠানের খুঁটিনাটির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের মনোভাব ব্যক্ত করার নেতৃত্বে ছিলেন ক্ষত্রিয়রাই। চিন্তা-চেতনার ক্ষেত্রে আর্য ভারতীয়রা যে খুবই বলিষ্ঠ ও সাহসিক চিন্তাবিদ ছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সত্যের তত্ত্ব নির্ণয়ে তাঁরা কোনো কিছুকেই ধর্মবিরুদ্ধ কার্য বলে মনে করতেন না। ফলে উপনিষদের প্রারম্ভ যুগেই বেদের মধ্যে বৈদিক ধর্মাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদেরও সন্ধান পাওয়া যায়। যুক্তিবাদের প্রবল বন্যার ফলেই অতি বিরুদ্ধ চার্বাক বা লোকায়ত মতবাদের মতো অনেকগুলি মতবাদের আবির্ভাব ঘটে, দার্শনিক ভাবনায় যেগুলি ছিলো অত্যন্ত বস্তুবাদী এবং ধর্ম-বিরোধী। ফলে যজ্ঞীয় পুরোহিত-বৃত্তি টিকিয়ে রেখেও সেইসব বিরোধী ভাবনাকে প্রতিহত করাটা ছিলো উপনিষদীয় চিন্তকদের জন্য প্রধান চ্যালেঞ্জ। আর এভাবেই উপনিষদে দার্শনিক ভাবনার প্রকাশ ঘটাতে গিয়েই ব্রহ্মবাদের উত্থান হয়েছে বলে মনে করা হয়। যদিও উপনিষদগুলি বিভিন্ন কালে রচিত হয়েছিলো বলে উপনিষদে আলোচিত দার্শনিক তত্ত্বের মধ্যে মূলগত ঐক্য থাকলেও কোনো কোনো বিষয়ে মতভেদও দেখা যায়।
এখানে উল্লেখ্য, প্রাচীন ত্রয়ীবিদ্যার অন্যতম যজুর্বেদের দুটি ভাগ- কৃষ্ণযজুর্বেদ ও শুক্লযজুর্বেদ। কৃষ্ণযজুর্বেদকে বলা হয় তৈত্তিরীয় সংহিতা আর শুক্লযজুর্বেদকে বলা হয় বাজসনেয়ী সংহিতা। এই দুটি ভাগে রয়েছে তিনটি শাখা এবং দুটি ব্রাহ্মণ। শাখা তিনটি হলো- তৈত্তিরীয়, মাধ্যন্দিন এবং কাণ্ব। আর ব্রাহ্মণ দুটির মধ্যে শুক্লযজুর্বেদের ব্রাহ্মণের নাম- শতপথ ব্রাহ্মণ, এবং কৃষ্ণযজুর্বেদের ব্রাহ্মণের নাম- তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ। মাধ্যন্দিন এবং কাণ্ব- এই শাখা দুটির একটিই ব্রাহ্মণ- প্রসিদ্ধ শতপথ ব্রাহ্মণ। বৃহদারণ্যক উপনিষদটি কাণ্বশাখার শতপথ ব্রাহ্মণেরই শেষ চতুর্দশ খণ্ড। যেমন বাজসনেয় সংহিতার শেষ আঠারোটি মন্ত্র নিয়ে ঈশোপনিষদ।
যাগযজ্ঞাদি কর্মে কোন্ সূক্তগুলির প্রয়োজন, কোনগুলি কিভাবে ব্যবহৃত হবে তা নির্দেশ করার জন্য সৃষ্টি করতে হয়েছে বেদের ব্রাহ্মণ ভাগ। তাই ব্রাহ্মণ হচ্ছে শ্রুতির কর্মকাণ্ড। ব্রাহ্মণ ভাগের পর আরণ্যক, তারপর উপনিষদ। ব্রাহ্মণভাগ যেমন কর্মকাণ্ড, উপনিষদ ভাগ তেমনি জ্ঞানকাণ্ড। ব্রহ্মচর্য নিয়ে বেদ সংহিতা পাঠের পর গুরুর কাছে অরণ্যাশ্রমে বেদসংক্রান্ত আলোচনা পাঠ করার রীতি ছিলো। অরণ্যে উপদিষ্ট বলে আরণ্যক। এই বৃহদারণ্যক (ন্যুনতম ৬০০ খ্রীঃপূর্ব) উপনিষদটি একদিকে যেমন শুক্ল যজুর্বেদের শতপথ ব্রাহ্মণের অন্তিম অংশ অর্থাৎ একটি আরণ্যক, অপরদিকে তা উপনিষদও। অর্থাৎ আরণ্যক-উপনিষদ। আকারেও সুবৃহৎ বলে এর নাম হয়েছে বৃহদারণ্যক উপনিষদ। ছান্দোগ্য উপনিষদের মতো প্রথমদিকের প্রাচীনতম উপনিষদের মধ্যে বৃহদারণ্যক অন্যতম। বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই উপনিষদের বক্তব্যই পরবর্তী উপনিষদগুলির উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করেছে। উপনিষদের সর্বাপেক্ষা খ্যাতনামা ঋষি বা দার্শনিক যাজ্ঞবল্ক্যের চিন্তা এই বৃহদারণ্যকে পাওয়া যায়, তাই উপনিষদ-সাহিত্যে এর স্থান অত্যন্ত উচ্চে।
বৃহদারণ্যকের ছয়টি অধ্যায়ের দ্বিতীয়, তৃতীয় এবং চতুর্থ অধ্যায়ে দার্শনিক আলোচনা রয়েছে; অবশিষ্ট অংশে শতপথ ব্রাহ্মণের কর্মকাণ্ডের ধারা চলেছে। প্রথম অধ্যায়ে যজ্ঞীয় অশ্বের সঙ্গে তুলনা করে সৃষ্টি পুরুষের বর্ণনা করা হয়েছে। তারপর রয়েছে মৃত্যু সম্পর্কে সিদ্ধান্ত। দ্বিতীয় অধ্যায়ে তত্ত্বজ্ঞানী কাশীরাজ অজাতশত্রু এবং আত্মাভিমানী ব্রাহ্মণ গার্গ্যের সংবাদ পরিবেশিত হয়েছে। এখানে দেখানো হয়েছে যে, শেষ পর্যন্ত গার্গ্যের দর্পচূর্ণ হয়েছে এবং তিনি ক্ষত্রিয় কাশীরাজের নিকট ব্রহ্মজ্ঞান শিক্ষার ইচ্ছায় তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছেন। তৃতীয় অধ্যায়ে আলোচিত হয়েছে যাজ্ঞবল্ক্যের দর্শন। চতুর্থ অধ্যায়ে আছে রাজা জনকের প্রতি যাজ্ঞবল্ক্যের উপদেশ। পঞ্চম অধ্যায়ে ধর্মাচার এবং অন্যান্য বাণীর বিষয় আছে। ষষ্ঠ অধ্যায়ে যাজ্ঞবল্ক্যের গুরুর (উদ্দালক আরুণি) গুরু প্রবাহণ জৈবলির সম্পর্কে বলা হয়েছে। এই অধ্যায়েই উত্তম সন্তান লাভের জন্য গর্ভবতী নারীগণকে ষাঁড়-বলদের মাংস ভক্ষণ করতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এতেই প্রমাণ হয় যে, সেকালে গো-মাংস ছিলো ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয় সম্প্রদায়ের প্রিয় খাদ্য। যেমন-
‘অথ য ইচ্ছেৎ পুত্র মে পন্ডিতো বিগীতঃ সমিতিংগমঃ শুশ্রূষিতাং বাচং ভাষিতা জায়েত সর্বান্ বেদান্ অনুত্রবীত সর্বমায়ুরিয়াদিতি মাংসৌদনং পাচয়িত্বা সর্পিষ্মন্তম্ অশ্মীয়াতাম্ ঈশ্বরৌ জনয়িতবৈ ঔক্ষেণ বার্ষভেণ বা’।। (বৃহদারণ্যক: ৬/৪/১৮)।।
অর্থাৎ :
‘যদি কেউ এমন কামনা করে যে আমার এমন একটি পুত্র হোক, যে পণ্ডিত, সুগায়ক, ভালো বক্তা, সুভাষী হবে তাহলে মাংসান্ন পাক করে সেই মাংসমিশ্রিত অন্ন ঘি মিশিয়ে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই খাবে। তাতে তারা তাদের মনোমতো পুত্রেরই জন্ম দিতে পারবে। তবে মাংসটি হওয়া চাই- উক্ষ অর্থাৎ বৃষ-মাংস। বৃষটি হয় তরুণ, নয়তো বৃদ্ধ হবে।’ (বৃহদারণ্যক: ৬/৪/১৮)।
অবশ্য গোটা বেদসংহিতা জুড়ে যজ্ঞের হব্য হিসেবে পশুবলি এবং তা সোমরস সহযোগে ভক্ষ্য হিসেবে গ্রহণের তৃপ্তিকর প্রকাশের নমুনা হিসেবে অজস্র সূক্ত ও ঋক রচনার বিষয়টা বিবেচনায় রাখলে সেই বৈদিক উপনিষদ যুগে ষাঁড়-বলদের মাংস আর্যগোষ্ঠির প্রিয় খাদ্যের তালিকায় থাকা মোটেও অস্বাভাবিক কিছু নয়, বরং খুবই স্বাভাবিক ও সঙ্গত বলেই মনে হয়। মোটকথা, আস্তিক হিন্দু দার্শনিকেরা যেমন নিজেদের বিচারকে সত্য তথা নির্ভুল বলে প্রমাণ করার জন্য এখনো উপনিষদের দোহাই দেন, তেমনি যজ্ঞীয় কর্মকাণ্ডে গভীর বিশ্বাস ও আস্থার সাথে কিঞ্চিৎ দার্শনিকতার মিশেলে বৃহদারণ্যক উপনিষদও বেদের জয়পতাকাকে উড্ডীয়মান রাখতে সদা তৎপর ছিলো। উপরন্তু তৎকালীন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বেদ ও ব্রাহ্মণের প্রতি স্বাধীন চিন্তা-সম্পন্ন মানুষের শ্রদ্ধা যে ক্রমশ ক্ষীণ হয়ে আসছিলো সেটা মনে রেখেই ক্ষত্রিয় শাসক শ্রেণীর শ্রেয়ত্বে যথাযথ কৃতিত্ব প্রদর্শন করেও বৃহদারণ্যক মনে করেছিলো যে, সমাজে ব্রাহ্মণদের স্থানই সর্বোচ্চ এবং সম্মানজনক। ফলে অদ্বৈত চৈতন্য-সত্তা ব্রহ্ম’র সর্বাত্মকবাদী হয়েও বৃহদারণ্যক ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণপ্রথারও অকৃত্রিম পরিপোষক ছিলো। যেমন-
‘ব্রহ্ম বা ইদমগ্র আসীৎ, একমেব; তদেকং সন্ন ব্যভবৎ। তৎ শ্রেয়ো রূপম্ অত্যসৃজত ক্ষত্রম্ । যানি এতানি দেবত্রা ক্ষত্রাণি ইন্দ্রো বরুণঃ সোমো রুদ্রঃ পর্জন্যো যমো মৃত্যুরীশান ইতি। তস্মাৎ ক্ষত্রাৎ পরং নাস্তি। তস্মাৎ ব্রাহ্মণঃ ক্ষত্রিয়ম্ অধস্তাৎ উপাস্তে রাজসূয়ে। ক্ষত্র এব তদ্যশো দধাতি। সৈষা ক্ষত্রস্য যোনির্যদ্ ব্রহ্ম তস্মাদ্ যদ্যপি রাজা পরমতাং গচ্ছতি ব্রহ্মৈব অন্তত উপনিশ্রয়তি স্বাং যোনিম্ । য উ এনং হিনস্তি স্বাং স যোনিম্ ঋচ্ছতি। স পাপীয়ান্ ভবতি, যথা শ্রেয়াংসং হিংসিত্বা’।। (বৃহদারণ্যক: ১/৪/১১)।। ‘স নৈব ব্যভবৎ বিশম অসৃজত-যানি এতানি দেবজাতানি গণশ আখ্যায়ন্তে বসবো রুদ্রা আদিত্যা বিশ্বদেবা মরুত ইতি’।। (বৃহদারণ্যক: ১/৪/১২)।। ‘স নৈব ব্যভবৎ, স শৌদ্রং বর্ণম্ অসৃজত পূষণম। ইয়ং বৈ পূষা। ইয়ং হি ইদম্ সর্বং পূষ্যতি যদিদং কিংচ।। (বৃহদারণ্যক: ১/৪/১৩)।।
অর্থাৎ :
‘এই সবকিছুর আগে ছিলেন একজন। ছিলেন ব্রহ্ম। এই জগৎ ছিলো ব্রহ্মময়। তিনি ছিলেন একা। দ্বিতীয় আর কেউ ছিলো না। জায়মান এই জগৎ-ব্যাপারকে নিয়মিত করার জন্য তিনি সক্রিয় হলেন। অব্যক্ত নিলেন ব্যক্তরূপ। ছিলেন অপ্রকট, হলেন প্রকট- প্রথমে বর্ণরূপে। শ্রেয়োরূপী ক্ষত্রিয়কে তিনি প্রথম সৃষ্টি করলেন। যেমন, দেবগণের মধ্যে ক্ষত্রিয় দেবরাজ ইন্দ্র, জলচরগণের মধ্যে ক্ষত্রিয় জলচরপতি বরুণ, ব্রাহ্মণগণের মধ্যে ক্ষত্রিয় মনুজপতি সোম, পশুগণের মধ্যে ক্ষত্রিয় পশুপতি রুদ্র, বিদ্যুৎ প্রভৃতি বস্তুর মধ্যে বস্তুপতি পর্জন্য অর্থাৎ মেঘ, পিতৃগণের মধ্যে ক্ষত্রিয় পিতৃপতি যম, রোগাদির মধ্যে ক্ষত্রিয় মৃত্যু এবং দীপ্তিশালীদের মধ্যে ক্ষত্রিয় ঈশান। ক্ষত্রিয়রাই শ্রেষ্ঠ। রাজসূয় যজ্ঞে তাই ব্রাহ্মণ ঋত্বিকের স্থান ক্ষত্রিয়ের নিচে। ব্রাহ্মণ অসংকোচে তাকে উচ্চাসনে বসিয়ে নিজের যশ দিয়ে তাকে যশস্বী করেন। ক্ষত্রিয় হয় যশ-সমৃদ্ধ। আবার ব্রহ্ম অর্থাৎ ব্রাহ্মণই হলেন ক্ষত্রিয়ের উৎপত্তির কারণ। রাজসূয় যজ্ঞে শ্রেষ্ঠত্ব লাভ করলেও যজ্ঞের শেষে কিন্তু ব্রাহ্মণকেই আশ্রয় করে থাকে। তাই যে ব্রাহ্মণকে হিংসা করে, সে নিজের উৎপত্তিস্থলকেই হিংসা করে। শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিকে হিংসা করলে যে পাপ হয়, তার চেয়েও বেশি পাপের ভাগী হয় সে, যে ব্রাহ্মণদ্বেষী।’ (বৃহদারণ্যক: ১/৪/১১)।
‘ক্ষত্রিয় সৃষ্টির পর দেখলেন তিনি, বিত্ত-ধনসম্পদ না থাকলে কেমনভাবে ক্ষত্রিয়রা করবেন যজ্ঞ, ব্রাহ্মণেরা করবেন তাঁদের কাজ ! অসম্পূর্ণ থেকে যায় যে সবকিছু ‘বিশম্’ ( বৈশ্যজাতি)-র অভাবে, যাঁরা হবেন বিত্ত-মাধ্যম। তাই তিনি ক্ষত্রিয়ের পরেই সৃষ্টি করলেন বৈশ্যদের। গণদেবতারা হলেন বৈশ্যজাতির মধ্যে গণ্য। যেমন, অষ্টবসু, একাদশ রুদ্র, দ্বাদশ আদিত্য, ত্রয়োদশ বিশ্বদেব, ঊনপঞ্চাশ মরুৎ অর্থাৎ বায়ু।’ (বৃহদারণ্যক: ১/৪/১২)।
‘এরপর ব্রহ্ম দেখলেন, ক্ষত্রিয় করলো যজ্ঞ, ব্রাহ্মণ হলো ঋত্বিক, বিত্ত-সামর্থ্য জোগালো বৈশ্য- সবই ঠিক, কিন্তু এদের পোষণ করবে কে? সেবা দিয়ে পুষ্টি সামর্থ্য জোগাবে কে? তাই তিনি সব শেষে সৃষ্টি করলেন শূদ্রকে। তার ওপর দিলেন সকলের পোষণের ভার। এই পৃথিবীই পূষা। কারণ যেখানে যা কিছু আছে, পৃথিবীই সবকিছু পোষণ করে।’ (বৃহদারণ্যক: ১/৪/১৩)।
এইভাবে চারটি বর্ণ-বিভাগ করে সেই এক এবং অদ্বিতীয় ব্রহ্ম বিশ্বে নিজেকে প্রকট করলেন। এই যে বর্ণ-বিভাজনের প্রাচীন ধারণা, তার উৎস হিসেবেও কিন্তু বেদসংহিতাকেই চিহ্নিত করা হয়। এক্ষেত্রে ঋগ্বেদের প্রসিদ্ধ ‘পুরুষসূক্ত’ (১০/৯০/১১-১২) এই ধারণার উদ্গাতা। যদিও আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, এই পুরুষ সূক্তটির বিশেষ উল্লেখযোগ্যতা হলো ঋগ্বেদের অন্য কোনো অংশে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র এই চার জাতির উল্লেখ নেই এবং এই সূক্তটিকে অপেক্ষাকৃত আধুনিক বলে বিদ্বানেরা অভিমত ব্যক্ত করেন, কেননা ঋগ্বেদ রচনাকালে আর্যদের মধ্যে জাতি বিভাগ ছিলো না। তাই উপনিষদীয় চিন্তাজগত থেকে উদ্ভূত ধারণাই পরবর্তীকালে ঋগ্বেদে অর্বাচীন হিসেবে সংযোজিত হয়েছে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে।
এই যে ব্রহ্ম বিষয়ক উপনিষদীয় ভাবনার উন্মেষ, সেই ব্রহ্মের গুণের অন্ত নেই। যেমন, বৃহদারণ্যক উপনিষদেই ব্রহ্মবিদ্ বিদুষী গার্গীকে নিজের ব্রহ্মজ্ঞানের প্রমাণ দিতে গিয়ে যাজ্ঞবল্ক্যের বয়ানে বলা হচ্ছে-
‘এতস্য বা অক্ষরস্য প্রশাসনে গার্গি সূর্যচন্দ্রমসৌ বিধৃতৌ তিষ্ঠত। এতস্য বা অক্ষরস্য প্রশাসনে গার্গি দ্যাবাপৃথিব্যৌ বিধৃতে তিষ্ঠত। এতস্য বা অক্ষরস্য প্রশাসনে গার্গি নিমেষা মুহূর্তা অহোরাত্রাণি অর্ধমাসা, মাসা ঋতবঃ সংবৎসরা ইতি বিধৃতাস্তিষ্ঠন্তি। এতস্য বা অক্ষরস্য প্রশাসনে গার্গি প্রাচ্যো অন্যা নদ্যঃ স্যন্দন্তি, শ্বেতেভ্য পর্বতেভ্যঃ প্রতীচ্যোহন্যা যাং যাং চ দিশামনু। এতস্য বা অক্ষরস্য প্রশাসনে গার্গি দদতো মনুষ্যাঃ প্রশংসন্তি যজমানং দেবা দর্বীং পিতরোহন্বায়ত্তাঃ’।। (বৃহদারণ্যক-৩/৮/৯)।।
অর্থাৎ :
গার্গী, এই সেই অসীম অনন্ত অফুরন্ত শক্তিমান অক্ষরপুরুষ। ব্রহ্মাণ্ডের প্রতিটি বস্তু নির্দ্বিধায় মেনে চলে তাঁর নির্দেশ। সূর্য-চন্দ্র, দ্যুলোক-ভূলোক, নিমেষ, মুহূর্ত, অহোরাত্র, মাসার্ধ, মাস, ঋতু, সংবৎসর তাঁরই প্রশাসন মেনে চলেছে। এই অক্ষরপুরুষের শাসনেই শ্বেতপর্বত থেকে শুরু করে অন্যান্য পর্বতে উৎপন্ন নদী পূর্বে-পশ্চিমে যে যার গতিপথে কলকল্লোলে বয়ে চলেছে। গার্গী, দানকারীরা যে প্রশংসিত হয়, দেবতারা যজমানের বা ভক্তের, পিতৃগণ দর্বী অর্থাৎ শ্রাদ্ধান্নের অনুগত হয়, তাও এই অক্ষরপুরুষের শাসনে।
অনন্ত এই অসীম গুণের আধার যে ব্রহ্ম, তাঁর স্বরূপ কী ? লক্ষ্যণীয় হলো, বৃহদারণ্যক উপনিষদে ব্রহ্মের কোন সদর্থক বর্ণনা নেই। যেমন-
‘স হোবাচ- এতদ্বৈ তদক্ষরং গার্গি। ব্রহ্মণা অভিবদন্তি অস্থূলং অনণু, অহ্রস্বমদীর্ঘম্, অলোহিতমস্নেহম্, আচ্ছায়ং, অতমোহবায়ু, অনাকাশম্ অসঙ্গমরসং, অগন্ধং অচক্ষুষ্কং, অশ্রোত্রমবাক্, অমনোহতেজস্কং, অপ্রাণং, অমুখং, অমাত্রং, অনন্তরমবাহ্যম্ । য তদ্ অশ্নাতি কিংচন, ন তদশ্নাতি কশ্চন’।। (বৃহদারণ্যক-৩/৮/৮)।।
অর্থাৎ :
যাজ্ঞবল্ক্য বললেন- গার্গী, ব্রহ্মবিদ ব্রাহ্মণেরা বলেন, ইনিই সেই অক্ষরপুরুষ, যার ক্ষয় নেই। সেই অক্ষরপুরুষের পরিচয় দিতে গিয়ে ব্রহ্মবিদেরা বলেছেন, তিনি স্থূল নন, সূক্ষ্ম নন, তিনি খর্ব নন, দীর্ঘ নন; তিনি লোহিত নন, তরল নন; ছায়া নন, অন্ধকার নন, বায়ু নন, আকাশও নন। তিনি অসঙ্গত-অরস- কোন কিছুতে আসক্ত নন, রসসিক্তও নন, গন্ধহীন- ঘ্রাণেন্দ্রিয় যার সন্ধান পায় না; চক্ষুহীন, শ্রোত্রেন্দ্রিয়হীন, মনহীন, তেজহীন, মুখহীন। তিনি অপরিমেয়, অন্তর-বাহির অর্থাৎ ভিতর-বার বলে তাঁর কিছু নেই। তিনি ভোক্তা নন আবার কারো ভোগ্যও নন।
কিন্তু সর্বব্যাপী যে অফুরন্ত সত্তা অস্তিত্ববান- সৎ বলে স্বীকার করা হয়, তাঁর বর্ণনা কেন এমন অভাবাত্মক হবে ? এর উত্তর বৃহদারণ্যকেই দেয়া হয়েছে এভাবে-
‘তস্য হৈতস্য পুরুষস্য রূপম্ । যথা মহারজনং বাসো যথা পাণ্ডাবিকং যথেন্দ্রগোপো যথাহগ্ন্যার্চিঃ যথা পুণ্ডরীকং, যথা সকৃৎ বিদ্যুত্তম্ । সকৃৎ বিদ্যুত্তেব হ বা অস্য শ্রীর্ভবতি য এবং বেদ। অথাত আদেশো নেতি নেতি ন হি এতস্মাদিতি, নেতি অন্যত্র পরমস্তি। অথ নামধেয়ং- সত্যস্য সত্যমিতি। প্রাণা বৈ সত্যম্ তেষামেষ সত্যং’।। (বৃহদারণ্যক-২/৩/৬)।।
অর্থাৎ :
‘মহারজন-বাস’- হলুদে ছোপানো বস্ত্রের মতো পীতবর্ণ। ‘পাণ্ডু-আবিকম্’- আবিকম অর্থাৎ ভেড়ার লোমে তৈরি বস্ত্রের মতো পাণ্ডুরবর্ণ। ‘ইন্দ্রগোপো’- ইন্দ্রগোপ কীটের মতো রক্তবর্ণ। ‘যথা অগ্নিঃ অর্চিঃ’- অগ্নিশিখার মতো। ‘যথা পুণ্ডরীকং’- শ্বেতপদ্মের মতো শুভ্র কান্তি। ‘যথা সকৃৎ বিদ্যুত্তম্’- একসঙ্গে অনেকগুলি বিদ্যুৎ চমকের মতো। যিনি সেই পুরুষকে এইভাবে জানেন, তিনি বিদ্যুৎ-ঝলকের মতোই শ্রী লাভ করেন।
কিন্তু এতা কথা বলার পরেও কি তাঁর রূপ প্রকাশ করা গেলো ? গেলো না। মন ভরলো না। শুরু হলো বিচার। একটা শব্দ, একটা ভাষা। পরক্ষণেই- না। আবার একটা শব্দ, একটা ভাষা। আবার- না (না+ইতি=নেতি)। বললো ‘নেতি’ ‘নেতি’ বিচার। শেষে, সিদ্ধান্তে হলো- ইনিই শ্রেষ্ঠ। এঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ কিছু নেই। কিন্তু কোন্ অভিধায় তা প্রকাশ করা যাবে। বলা হলো- ইনি ‘সত্যের সত্য’। প্রাণসমূহ সত্য। ইনি সেই সত্য প্রাণসমূহ থেকেও সত্য।
তবে এ প্রেক্ষিতে পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের উক্তিটিও প্রণিধানযোগ্য বলে মনে হয়-
‘প্রাচীন ধর্মবিশ্বাসীগণ মনে করতেন যে, কৃপা, ক্ষমা, প্রভৃতি ভাবাত্মক গুণে গুণী পুরুষগণই ঈশ্বরকে প্রাপ্ত হন কারণ ঈশ্বরও ঐরূপ গুণযুক্ত; কিন্তু মানুষ তখন শ্রদ্ধা থেকে অগ্রসর হয়ে বুদ্ধির রাজ্যে প্রবেশ করেছিল, কাজেই তাদের বোঝানোর জন্য এবং যুক্তির পথ থেকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য ব্রহ্মকে অভাবাত্মক বলে প্রচার করাই উপযোগী বলে মনে করা হলো।’- (দর্শন-দিগদর্শন-২, পৃষ্ঠা-৩৪)।
কিন্তু উপনিষদীয় ভাবনা-ধারায় এই জগত ব্রহ্ম থেকে বিচ্ছিন্ন নয় এরূপ বেদাশ্রিত চিন্তাধারার উত্তরাধিকার হিসেবে উপনিষদকে পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হয়েছে যে, ব্রহ্মময় এই দৃশ্যমান জগতেরও একটা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা রয়েছে। ফলে এক অদ্ভুত সমন্বয়-প্রচেষ্টাও উপনিষদে পরিলক্ষিত হয়। তাই বলা হচ্ছে, এই মহাবিশ্বে, এই ব্রহ্মাণ্ডে, এই দেহভাণ্ডে, যেখানে যা কিছু আছে ইন্দ্রিয়ের গোচরে, ইন্দ্রিয়ের অগোচরে; যা কিছু আছে প্রকট-অপ্রকট অবস্থায়, কোন কিছুই মিথ্যা নয়, অলীক নয়। সব সত্য। একই ব্রহ্ম দুটি রূপে বিরাজ করছেন সর্বত্র। এই দুটি রূপই সত্য। সত্যই ব্রহ্ম; ব্রহ্মই সত্য। সেই দ্বৈতরূপের মধ্যে অদ্বৈতরূপের সমন্বয়ক-চিন্তাটিই দেখা যায় বৃহদারণ্যকে-
‘দ্বে বাব ব্রহ্মণ্যে রূপ মূর্তঞ্চৈব অমূর্তঞ্চ। মর্ত্যং চামৃতং চ স্থিতম্ চ যচ্চ সচ্চ ত্যচ্চ।। (বৃহদারণ্যক-২/৩/১)।।
অর্থাৎ : ব্রহ্মের দুটি রূপ। একটি ‘মূর্ত’ অপরটি ‘অমূর্ত’। একটি ‘সৎ’ (সত্তাবান, ব্যক্ত) অপরটি ‘ত্যৎ’ (সত্তাহীন, অব্যক্ত)।
বৃহদারণ্যকের ন্যায় ছান্দোগ্য উপনিষদও (ন্যুনতম ৭০০ খ্রীষ্টপূর্ব) প্রাচীন ও যুগসন্ধিক্ষণের প্রথমকালের উপনিষদ হিসেবে তাতেও যজ্ঞীয় কর্মকাণ্ডের প্রশংসা রয়েছে। যেমন-
‘ত্রয়ো ধর্মস্কন্ধা যজ্ঞোহধ্যয়নং দানমিতি প্রথমস্তপ এব দ্বিতীয়ো ব্রহ্মচার্যাচার্যকুলবাসী, তৃতীয়োহত্যন্তম্ আত্মানম্ আচার্যকুলে অবসাদযন্ । সর্ব এতে পুণ্যলোকা ভবন্তি ব্রহ্মসংস্থোহমৃতত্বমেতি’।। (ছান্দোগ্য-২/২৩/১)।
অর্থাৎ : ধর্মের বিভাগ তিনটি। প্রথম- যজ্ঞ, বেদ-অধ্যয়ন, দান। দ্বিতীয়- তপস্যা। তৃতীয়- যতদিন দেহ ক্ষয় না হচ্ছে ততদিন অর্থাৎ যাবজ্জীবন গুরুকুলে বাস করে নিষ্ঠার সঙ্গে ব্রহ্মচর্য পালন। যারা তা করে তারা পুণ্যলোকগামী হয়, ব্রহ্মনিষ্ঠ হয়ে তারা অমৃতত্ব লাভ করে।
ছান্দোগ্য বৃহদারণ্যকেরও পূর্ববর্তী উপনিষদ। ছন্দ শব্দের অর্থ হলো বেদগান। যাঁরা বেদগানে পারদর্শী, তাঁদের বলা হয় ‘ছন্দোগ’। এই ছন্দোগদের শাস্ত্রকে বলে ‘ছান্দোগ্য’। গানের মাধ্যমে যে বেদ পাঠ করা হয়, তা হলো সামবেদ। কিন্তু সমগ্র সামবেদই ছান্দোগ্য নয়। বৈশম্পায়ন ঋষির ন’জন শিষ্যের মধ্যে একজনের নাম ছিলো তাণ্ড্য। তিনি সামবেদের একটি শাখা তাণ্ড্য শাখার প্রবর্তক। এই শাখারই অন্তর্গত একটি ব্রাহ্মণের নাম ছান্দোগ্য ব্রাহ্মণ। সেই ব্রাহ্মণে আছে দশটি প্রপাঠক বা অধ্যায়। তার শেষ আটটি অধ্যায় নিয়ে ছান্দোগ্য উপনিষদ- যার শুরু ব্রহ্মবাচী অক্ষরপুরুষ ‘ওঁ’ (ওম্)। এই প্রসঙ্গে ঋষি অরবিন্দ লিখেছেন-
‘ছান্দোগ্যের এই আরম্ভ থেকে বোঝা যায় যে, তার উদ্দেশ্য হল ব্রহ্মের জন্য সমগ্র আত্মনিয়োগ করবার যথাযথ ও সম্পূর্ণ পথনির্দেশ করা এবং তার উপযোগী সব মনোভাব ও তার সব উপায় স্পষ্ট করে বলা। বিষয়বস্তু ব্রহ্মা, কিন্তু বেদের পুণ্য অক্ষর ওঁ (ওম্) যার প্রতীক, সেই ব্রহ্ম। সুতরাং তার প্রতিপাদ্য কেবলমাত্র সর্বময় শুদ্ধসৎ নয়, আত্মার সব অংশ বা কলা- ভূর্ভুবঃ স্বঃ, জাগ্রত-স্বপ্ন-সুষুপ্তি, ব্যক্ত-অর্ধব্যক্ত-নিগূঢ়, সব বিভাবই তার বর্ণনীয়, সেসব লোক অধিকার করা, ভোগ করা এবং অতিক্রম করে যাবার ঠিক পথ নির্দেশ করাও ছান্দোগ্যের উদ্দেশ্য।’- (সূত্র: উপনিষদ সংগ্রহ, সংকলন ও ভাষান্তর চিত্তরঞ্জন ঘোষাল, পৃষ্ঠা-৩৬৭)
ছান্দোগ্য উপনিষদের শুরুটা হলো এভাবে-
‘ওম ইত্যেদক্ষরম্ উদ্গীথম্ উপাসীতোমিতি হি উদ্গায়তি তস্যোপব্যাখ্যনম।। (ছান্দোগ্য-১/১/১)।।
অর্থাৎ : ওম্ এই অক্ষরকে উদ্গীথরূপে উপাসনা করবে। কারণ প্রথমে ওম্ উচ্চারণ করে পরে উদ্-গান করা হয়। (ওঁ বা ওম্ হলো পুরুষোত্তম অক্ষর- অক্ষরপুরুষ। উপনিষদের ঋষি প্রথমেই উদ্-গীথের উপাসনা করতে বলেছেন। উদ্-গীথ হলো সামবেদের একটি অংশ বা সামগানের একটি অবয়ব। উদ্-গীথ গানে প্রথমেই উচ্চারণ করতে হয় ওঙ্কার। অর্থাৎ গানের শুরুতেই ওঙ্কারের উচ্চারণ, তার পর গীত। ওঙ্কার এই শব্দের মধ্যেই ত্রিগুণাত্মক ব্রহ্মাণ্ডের স্থিতি; ওঙ্কার এই ধ্বনির মধ্যেই ব্রহ্মাণ্ড উদ্ভাসিত। উপনিষদের ঋষিমাত্রেই এই রহস্যেও দ্বার উদ্ঘাটনে তৎপর হয়েছেন।)
ছান্দোগ্যের প্রধান দার্শনিক উদ্দালক আরুণি ( গৌতম) ছিলেন যাজ্ঞবল্ক্যের গুরু। বেশ কিছু কাহিনী এবং আখ্যায়িকায়, সেই সঙ্গে কথোপকথনের আঙ্গিকে এই উপনিষদটি সুসমৃদ্ধ। যেমন, চাক্রায়ণ-উষস্তির কাহিনী, কুকুরের সামগান, দেবকী-পুত্র কৃষ্ণকে ঘোর আঙ্গিরস ঋষির তত্ত্ব-উপদেশ, জানশ্রুতি-পৌত্রায়ণ ও শকট-চালক রৈক্কের আখ্যায়িকা, সত্যকাম-জাবালার আখ্যায়িকা, উপকোশলের কাহিনী, ইন্দ্রিয়গণের মধ্যে বিবাদ এবং প্রাণের শ্রেষ্ঠত্বের কাহিনী, শ্বেতকেতু-প্রবাহণ সংবাদ, অশ্বপতি-ষড়ব্রাহ্মণ সংবাদ, আরুণি-শ্বেতকেতুর কাহিনী, প্রজাপতি-ইন্দ্র-বিরোচন সংবাদ ইত্যাদি। তবে কোন কাহিনীই কেবলমাত্র গল্পকথা নয়, সবকটি আখ্যায়িকাই প্রতীকধর্মী। সবিশেষ বিদ্যা বা তত্ত্বকে সাধারণে বোধগম্য করার জন্যই উপনিষদের ঋষি এইসব কাহিনী বা আখ্যায়িকার মাধ্যম গ্রহণ করেছেন বলে মনে করা হয়।
প্রথম দুই অধ্যায় ব্রাহ্মণ অংশ থেকেই পুষ্ট হয়েছে। উপনিষদের সামগান এবং ‘ওম্’-এর মহিমা এতে কীর্তিত হয়েছে। তবে প্রথম অধ্যায়ের দ্বাদশ খণ্ডে, কারো কারো মতে, গ্রাসাচ্ছাদনের জন্য যে পুরোহিতগণ সামগান করেন তাঁদের সম্পর্কে একটা পরিহাস করা হয়েছে কুকুরের সামগান আখ্যায়িকার মাধ্যমে। যদিও উপনিষদের আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যায় কুকুরকে প্রাণের প্রতীক হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এখানে দেখা যায়, পণ্ডিত রাহুল সাংকৃত্যায়নের ব্যাখ্যায়-
‘ঋক দালভ্য বা গ্লাব মৈত্রেয় নামে এক ঋষি ছিলেন যিনি বেদপাঠের জন্য নির্জনে বাস করতেন। একদিন সেখানে সাদা রঙের একটি কুকুর আসে। পরে আরও কয়েকটি কুকুরের আবির্ভাব হয়। তারা সাদা কুকুরটিকে বলে, তুমি সাম্গান করো, হয়তো তাতে আমাদের ভালো আহার জুটবে। ঋষি এই কথাবার্তা শুনে তাদের সামগান শুনতে উৎসুক হন। পরের দিন তিনি দেখেন, এক কুকুর আরেক কুকুরের লাঙ্গুলে মুখ দিয়ে গাইছে- ‘হিং! খাবম্, ওম্ পানম্ করবম্; ওম্ দেবম্ মোদের খাদ্যম্ দাত্তম্!’ হে দেব আমাদের অন্ন দাও, এই দাও, ঐ দাও, হ্যান দাও, ত্যান দাও, ওম্! ইত্যাদি। এই কৌতুক নকসায় সারিবদ্ধভাবে যে পুরোহিত সকল যজ্ঞের সময় শুধু দান-দক্ষিণার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সামগান করে তাদের বিদ্রূপ করা হয়েছে, তাদের মনোযোগ দেবার্চনায় নয়, নিজ স্বার্থসিদ্ধির প্রতি।’ (দর্শন-দিগদর্শন, পৃষ্ঠা-২৬)
প্রাসঙ্গিকভাবেই এখানে উল্লেখ করা বাঞ্ছনীয় যে, প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের মধ্যে ছান্দোগ্যই সর্বপ্রথম পুনর্জন্ম বিষয়ক ধারণার অবতারণা করে। এ প্রেক্ষিতে রাহুল সাংকৃত্যায়নের মন্তব্যও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন-
‘ঐ যুগের প্রথম প্রচারক সম্ভবত ভাবেননি, যে সিদ্ধান্ত তিনি প্রচার করছেন ভবিষ্যতে তা কত বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াবে, এবং পরিস্থিতি অনুযায়ী পরিবর্তিত হওয়ার শক্তিকে রুদ্ধ করে সমাজকে স্রোতহীন এক বদ্ধ জলায় পরিণত করবে। মৃত্যুর পর স্বর্গসুখ লাভের প্রলোভন দেখানো দুঃখপীড়িত মানুষকে আশার কুহক দেখানো ছাড়া আর কিছু নয়। এর একমাত্র অভিসন্ধি হলো মানুষ যাতে তার দুরবস্থার জন্য দায়ী এই সমাজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে মুখর না হয়ে ওঠে; একে সংযত রাখার জন্যই এই পুনর্জন্মের প্রলোভন। কিন্তু পুনর্জন্ম তো কষ্ট নিপীড়িত মানুষের কাছে আরও ভয়ঙ্কর। এখানে শুধু বর্তমানের দুঃখ ভুলে যেতে উপদেশ দেওয়া হয়নি, বরঞ্চ আরও বলা হয়েছে যে, সামাজিক বৈষম্য কিছু অন্যায় নয়, কেন না তোমারই গতজন্মের কর্মফলে আজ এই অবস্থা। সামাজিক বৈষম্য না থাকলে আজ যে কষ্ট তুমি করছ, পরজন্মে তার পুরস্কার পাবে কি করে ?’- (দর্শন-দিগদর্শন-২, পৃষ্ঠা-৩০)।
ছান্দোগ্য উপনিষদে প্রচারিত পুনর্জন্ম সম্বন্ধে সেই সর্বপ্রাচীন উক্তিটি হলো-
‘তদ্য ইহ রমণীয়চরণা অভ্যাশো হ যত্তে রমণীয়াং যোনিম্ আপদ্যেরন্ । ব্রাহ্মণযোনিং বা ক্ষত্রিয়াযোনিং বা বৈশ্যযোনিং বাথ য ইহ কপূয়চরণা অভ্যাশো হ যত্তে কপূয়াং যোনিম্ আপদ্যেরন শ্বযোনিং বা সূকরযোনিং বা চন্ডালযোনিং বা।। (ছান্দোগ্য-৫/১০/৭)।।
অর্থাৎ :
তাদের মধ্যে যারা (পূর্বজন্মে) রমণীয় আচরণ বা পুণ্যকর্ম করে তারা দেহান্তরে শীঘ্রই ব্রাহ্মণযোনিতে বা ক্ষত্রিয়যোগিতে বা বৈশ্যযোনিতে জন্মলাভ করে। আবার যারা (পূর্বজন্মে) কপূয়াচরণ অর্থাৎ কুৎসিত বা অশুভ কর্ম করে তাদের শীঘ্রই কুকুরযোনিতে বা শূকরযোনিতে বা চন্ডালযোনিতে পুনর্জন্ম হয়।
বলার অপেক্ষা রাখে না, পুনর্জন্মের সাথে পুর্বজন্মের কর্মফল নামক এক অভূতপূর্ব কল্পনাকে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে যে অব্যর্থ ধারণার জন্ম দিয়েছিলেন ছান্দোগ্যের প্রখ্যাত ঋষি উদ্দালক আরুণি, তারই অব্যর্থ প্রভাব অন্যান্য উপনিষদে তো বটেই, কালক্রমে সেটাই অপ্রতিরোধ্য গতিতে পল্লবিত হতে হতে পরবর্তীকালের গড়ে ওঠা দর্শনগুলোরও অবিচ্ছেদ্য তত্ত্বীয় অংশে পরিণত হয়েছিলো।
এই ছান্দোগ্য উপনিষদেই ব্রহ্মের জ্ঞানময় চিহ্ন বা প্রতীককে উপাসনা করার কথা সব থেকে বেশি বলা হয়েছে। এই প্রতীক কখনো সূর্য, কখনো ব্যোম, কখনো অন্যকিছু। তবে সবকিছুর মূলে সেই ব্রহ্মময় ওঙ্কার ওম্ (ওঁ)। যেমন-
‘বাগেব ঋক্ প্রাণঃ সাম ওম্ ইত্যেতদক্ষরম্ উদ্গীথস্তদ্বা এতন্মিথুনং যদ্বাক্ চ প্রাণশ্চ ঋক্ চ সাম’।। (ছান্দোগ্য-১/১/৫)।। ‘আপয়িতা হ বৈ কামানাং ভবতি য এতদেবং বিদ্বানক্ষরম্ উদ্গীথমুপাস্তে’।। (ছান্দোগ্য-১/১/৭)।। ‘তেনেয়ং ত্রয়ী বিদ্যা বর্ততে ওমিতি-আশ্রাবয়তি, ওমিতি শাসতি, ওম্-ইত্যুদ্গায়তী, এতস্যৈবাক্ষরস্য অপচিত্যৈ মহিম্না রসেন’।। (ছান্দোগ্য-১/১/৯)।। ‘অথ খলু য উদ্গীথঃ সঃ প্রণবো, যঃ প্রণবঃ স উদ্গীথ ইতি, অসৌ বা আদিত্য উদ্গীথ এষ প্রণব ওমিতি হ্যেষ স্বরন্নেতি’।। (ছান্দোগ্য-১/৫/১)।। ‘সর্বাণি হ বা ইমানি ভূতানি আকাশাদেব সমুৎপদ্যন্ত, আকাশং প্রত্যস্তং যন্তি, আকাশো হি এবৈভ্যো জ্যায়ান্, আকাশঃ পরায়ণম্’।। (ছান্দোগ্য-১/৯/১)।। ‘স এষ পরোবরীয়ান্ উদ্গীথঃ। স এষোহনন্তঃ পরোবরীয়ো হাস্য ভবতি। পরোবরীয়সোহলোকান্ জয়তি। য এতদেবং বিদ্বান্ পরোবরীয়াংসম্ উদ্গীথম্ উপাস্তে’।। (ছান্দোগ্য-১/৯/২)।।
অর্থাৎ :
বাক্ হলো ঋক্ । প্রাণ হলো সাম। আর উদ্গীথ হলো ওম্ এই অক্ষর। যা বাক্ এবং প্রাণ অথবা ঋক্ এবং সাম, তা-ই যুগল বা মিথুন (ছান্দোগ্য-১/১/৫)। যুগল-সম্মিলনের (বাক্ ও প্রাণ) এই তত্ত্বকে জেনে যে (ওম্) ওঙ্কারকে উদ্গীথরূপে উপাসনা করবে, তার কোন কামনাই অচরিতার্থ থাকবে না (ছান্দোগ্য-১/১/৭)। এই অক্ষরই ত্রয়ীবিদ্যার ( বেদবিদ্যা) প্রবর্তক। ‘ওম্’ উচ্চারণ করে শ্রবণ করানো হয়, ‘ওম্’ উচ্চারণ করে মন্ত্রপাঠ করা হয়, ‘ওম্’ আগে উচ্চারণ করে পরে উদ্গান করা হয়। এই সবই মহিমা এবং রসের দ্বারা এই অক্ষরের (অক্ষরপুরুষের) পূজার জন্য (ছান্দোগ্য-১/১/৯)। যা উদ্গীথ তা-ই প্রণব। আবার যা প্রণব তা-ই উদ্গীথ। আদিত্যই (সূর্য) উদ্গীথ, আদিত্যই প্রণব। কারণ আদিত্য ‘ওম্’ উচ্চারণ করে গমন করেন (ছান্দোগ্য-১/৫/১)। এই নিখিলের যা কিছু, তা সবার উৎপত্তিস্থল আকাশ। আবার আকাশেই হয় লয়। সবার চেয়ে আকাশই শ্রেষ্ঠ। আকাশই সবার আশ্রয়, পরমা গতি (ছান্দোগ্য-১/৯/১)। শ্রেষ্ঠ হতেও শ্রেষ্ঠ অনন্ত এই আকাশই উদ্গীথ। এইভাবে জেনে যে অনন্ত আকাশে প্রতিষ্ঠিত সেই মহা-মহিমময় উদ্গীথের উপাসনা করবে, সে সর্বশ্রেষ্ঠ লোক জয় করে সর্বশ্রেষ্ঠ বরণীয় জীবন লাভ করে ধন্য হবে। (ছান্দোগ্য-১/৯/২)।
ছান্দোগ্যের ঋষি ওঙ্কারের ব্যাপ্তির কথা বলতে গিয়ে আরো বলছেন-
‘প্রজাপতিঃ লোকান্ অভ্যতপ্যৎ, তেভ্যঃ অভিতপ্তেভ্যস্ত্রয়ীবিদ্যা সংপ্রাস্রবৎ, তামভ্যতপত্তস্যা অভিতপ্তায়া এতানি অক্ষরাণি সংপ্রাস্রবন্ত, ভূর্ভুবঃ স্বরিতি।। (ছান্দোগ্য-২/২৩/২)।
তানি অভ্যতপত্তেভ্যঃ অভিতপ্তেভ্য ওঙ্কারঃ সংপ্রাস্রবৎ, তৎ যথা শঙ্কুনা সর্বাণি পর্ণানি সংতৃণ্নানি এবম্ ওঙ্কারেণ সর্বা বাক্ সংতৃণ্না, ওঙ্কার এবেদং সর্বম্, ওঙ্কার এবেদং সর্বম্’।। (ছান্দোগ্য-২/২৩/৩)।
অর্থাৎ :
প্রজাপতি (সৃষ্টিভিলাষী হয়ে) লোকসমূহকে অভিধ্যান করলেন। তার ফলে সমুদয় লোক হতে ত্রয়ী-বিদ্যা অর্থাৎ বেদবিদ্যা নিঃসৃত হলো। এরপর তিনি বেদবিদ্যার ধ্যান করলেন। ফলে সেই বেদবিদ্যা থেকে বেরিয়ে এলো তিনটি অক্ষর- ভূঃ (পৃথিবী), ভুবঃ (অন্তরিক্ষ) আর স্বঃ (দ্যুলোক)। (ছান্দোগ্য-২/২৩/২)।
এরপর প্রজাপতি ঐ তিনটি অক্ষরকে অভিধ্যান করলেন। ফলে, অক্ষরগুলো থেকে নিঃসৃত হলো ওঙ্কার। গাছের পাতা-জুড়ে যেমন পাতার শিরা, বা পাতার সব অংশই যেমন শিরার সঙ্গে যুক্ত, তেমনি সব কিছুর মধ্যে ওঙ্কার ব্যাপ্ত। সব কিছুই যুক্ত ওঙ্কারের সঙ্গে। বিশ্ব-চরাচরে যা কিছু আছে, সবই আছে ওঙ্কারে। ওঙ্কারই বিশ্বরূপ। সবই ওঙ্কার…সবই ওঙ্কার। (ছান্দোগ্য-২/২৩/৩)।
এই যে ওঙ্কারময় বিশ্বজগত এবং ওঙ্কারময়তাই যে ব্রহ্মত্ব বা ব্রহ্মময়তা, তার সমন্বয়পূর্বক বিখ্যাত প্রাচীন শাণ্ডিল্য-বিদ্যারই প্রকাশ দেখা যায় ছান্দোগ্যের তৃতীয় অধ্যায়ের চতুর্দশ খণ্ডে (ছান্দোগ্য-৩/১৪/১-৪)-
‘সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম, তজ্জলানীতি শান্ত উপাসীত। অথ খলু ক্রতুময় পুরুষো যথা ক্রতুময়রর্স্মিন্ লোকে পুরুষো ভবতি তথেতঃ প্রেত্য ভবতি, স ক্রতুং কুর্বীত।। (ছান্দোগ্য-৩/১৪/১)।। মনোময়ঃ প্রাণশরীরো ভারূপঃ সত্যসঙ্কল্প আকাশাত্মা সর্বকর্মা সর্বকামঃ সর্বগন্ধঃ সর্বরসঃ সর্বমিদম্ অভ্যত্তঃ অবাক্যনাদরঃ।। (ছান্দোগ্য-৩/১৪/২)।। এষ ম আত্মান্তর্হৃদয়েহণীয়ান্ ত্রীহের্বা যবাদ্বা সর্ষপাদ্বা শ্যামাকাদ্বা শ্যামাক-তন্ডুলাদ্বা; এষ ম আন্তর্হৃদয়ে জ্যায়ান্ পৃথিব্যা, জ্যায়ান্ অন্তরিক্ষাৎ জ্যায়ান্ দিবো জ্যায়ানেত্যো লোকেভ্যঃ।। (ছান্দোগ্য-৩/১৪/৩)।। সর্বকর্মা সর্বকামঃ সর্বগন্ধঃ সর্বরসঃ সর্বমিদম্ অভ্যাত্তঃ অবাক্যনাদও এষ ম আত্মান্তর্হৃদয় এতদ্ ব্রহ্মৈতমিতঃ প্রেত্যাভিসন্তবিতাস্মি, ইতি। যস্যা স্যাদদ্ধা ন বিচিকিৎসাস্তীতি হ স্মাহ শাণ্ডিল্যঃ শাণ্ডিল্যঃ।। (ছান্দোগ্য-৩/১৪/৪)।।
অর্থাৎ :
বিশ্ব-চরাচরে যা কিছু আছে, এই যে যা কিছু দেখছো- সব, সব কিছুই ব্রহ্ম। কারণ- তা থেকে স্থাবর-জঙ্গম সব কিছুরই সৃষ্টি, তাতেই সব কিছুর লয় আবার তাতেই সব কিছুর স্থিতি। ‘সবই ব্রহ্ম’, এইভাবে ভেবে শান্ত মনে, অচঞ্চল-চিত্তে তাঁর উপাসনা করবে। প্রতিটি জীবনই ক্রতুময় অর্থাৎ কর্মময়। (সংকল্প, কর্ম বা অধ্যবসায় ছাড়া জীবন নেই। এগুলি এক-একটি যজ্ঞ।) এখানে এই পৃথিবীতে পার্থিব জীবন নিয়ে যেমন কর্ম করবে, (যেমন অধ্যবসায় নিয়ে চলবে, যেমন সংকল্প করবে,) জীবনের অবসানে পরকালে ঠিক তেমনটিই পাবে। তাই যা কিছুই করো না কেন, এটি ভেবে করবে (ছান্দোগ্য-৩/১৪/১)। ব্রহ্ম হলেন মনোময়। [বৃহ+মন=ব্রহ্ম] মনোময় হলেও (লোকদৃষ্টিতে) তাঁর শরীর প্রাণময়। তাঁকে দেখতে কেমন? তিনি ভারূপ অর্থাৎ জ্যোতির্ময়। তিনি সত্যসঙ্কল্প- সত্যই তাঁর কর্মের প্রকাশ। তাঁর আত্মা হলো আকাশের মতো সর্বব্যাপী, অষণ্ড। সব কর্মের আধার তিনি- সর্বকর্মা; সর্ব কামনার আধার- সর্বকাম। সমুদয় গন্ধ ও রসের মূল- সর্বগন্ধ, সর্বরস। তিনি এইভাবে পরিব্যাপ্ত হয়ে আছেন সব কিছুর মধ্যে। বাক্য তাঁর কথা বলতে পারে না। অনাদর তিনি অর্থাৎ নিত্যতৃপ্ত, অনপেক্ষ (ছান্দোগ্য-৩/১৪/২)। সেই ব্রহ্মই আমার হৃদয়ের অভ্যন্তরে আত্মা। অণুরও অণু অর্থাৎ সূক্ষ্ম থেকেও সূক্ষ্মতর। যব, সর্ষে, শ্যামাক-ঘাসের তণ্ডুল- এসবের থেকেও ছোট। আবার আমার হৃদয়ের অভ্যন্তরে আত্মারূপী এই ব্রহ্ম মহৎ থেকেও মহত্তর- মহীয়ান। সুবিপুল পৃথিবী, অন্তরিক্ষ, দ্যুলোক থেকেও মহীয়ান (ছান্দোগ্য-৩/১৪/৩)। শাণ্ডিল্য এই উপদেশ বারবার দিয়েছেন- সর্বকর্মা, সর্বকাম, সর্বগন্ধ, সর্বরস, বাক্রহিত, সর্বব্যাপী সেই ব্রহ্মই আমার হৃদয়ের অভ্যন্তরে, আমার আত্মা। ইহলোক পরিত্যাগ করে আমি যখন পরলোকে যাবো, আমি তাঁকেই তখন পাবো- এতে আমার কোন সংশয় নেই। আমার স্থির বিশ্বাস- ব্রহ্মকে আমি লাভ করবোই, নিশ্চয়ই লাভ করবো (ছান্দোগ্য-৩/১৪/৪)।
এভাবে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে উপনিষদে ব্রহ্ম ও আত্মা নামক ধারণার একাকার উপলব্ধিরই প্রকাশ দেখা যায়। ছান্দোগ্য উপনিষদে একেই বলা হয়েছে বৈশ্বানর আত্মা। যেমন-
‘যস্তু এতমেবং প্রাদেশমাত্রম্- অভিবিমানং আত্মানং বৈশ্বানরম্ উপাস্তে, স সর্বেষু লোকেষু ভূতেষু সর্বেষু আত্মসু অন্নম্ অত্তি।। (ছান্দোগ্য-৫/১৮/১)।
অর্থাৎ :
তিনি একই সময়ে প্রাদেশমাত্র অর্থাৎ পরিমাপের মধ্যে নির্দিষ্ট স্থানে সসীম আবার অভিবিমান অর্থাৎ মাপজোখের বাইরে অসীম। যিনি সেই বৈশ্বানরকে এইভাবে জেনে উপাসনা করেন, তিনি সর্বলোকে, সর্বভূতে, সর্ব আত্মাতে অন্নভোজন করেন। তিনি সকলের সঙ্গে একত্ব অনুভব করেন। তখন, তাঁর ভোগ-সুখ মানে সকলের ভোগ-সুখ আবার সকলের ভোগ-সুখ মানে তাঁরই ভোগ-সুখ (ছান্দোগ্য-৫/১৮/১)।
এই যে সর্বব্যাপী ব্রহ্ম কিংবা বৈশ্বানর আত্মা, তিনি কি সবকিছুর পূর্বেও ছিলেন ? কিংবা অন্যভাবে বললে, শরীরে যেমন তথাকথিত এই আত্মার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, তেমনি বিশ্বের সৃষ্টির পশ্চাতেও নিশ্চয়ই কোনো বিস্ময়কর শক্তি কাজ করে এবং তা গুপ্তভাবে তো নয়ই বরং বিশ্বের প্রতিটি ক্রিয়াকে সেই শক্তিই দৃষ্টিগোচর করে। ফলে বস্তুর সৃষ্টি ও বিন্যাস থেকে মানব-মনেও এই জিজ্ঞাসার উদ্ভব হয়- বিশ্বসৃষ্টিরও নিশ্চয়ই কোনো উৎস আছে, এবং তারও আগে কি কিছু ছিলো ? ঋগ্বেদের নাসদীয় সূক্তকে (ঋগ্বেদ-১০/১২৯) বিবেচনায় রেখে বৃহদারণ্যক উপনিষদে সৃষ্টিতত্ত্বের একটা ব্যাখ্যা ইতঃপূর্বে আমরা দেখেছি। ছান্দোগ্য উপনিষদেও পুত্র শ্বেতকেতুকে পিতা উদ্দালক আরুণির উপদেশ বয়ানে এই প্রশ্নের দার্শনিকসুলভ উত্তর দেয়া হয়েছে ষষ্ঠ অধ্যায়ের দ্বিতীয় খণ্ডে (ছান্দোগ্য-৬/২/১-৪)। যেমন-
‘সদেব সোম্য ইদম্ অগ্র আসীৎ একমেব অদ্বিতীয়ম্ । তৎ হ এক আহুঃ অসদেবমগ্র আসীৎ একমেবাদ্বিতীয়ং; তস্মাৎ অসতঃ সজ্জায়তঃ।। (ছান্দোগ্য-৬/২/১)।। কুতস্তু খলু সৌম্যেবং স্যাদিতি হোবাচ। কথম্ অসতঃ সজ্জায়েতেতি ? সত্ত্বেব সোম্য ইদমগ্র আসীৎ একমেবাদ্বিতীয়ম্ ।। (ছান্দোগ্য-৬/২/২)।। তদৈক্ষত- বহু স্যাম্ প্রজায়েয়েতি; তৎ তেজোহসৃজত। তত্তেজ ঐক্ষত- বহু স্যাম্ প্রজায়েয়েতি; তদপোহসৃজত। তস্মাদ্ যত্র ক্ব শোচতি স্বেদতে বা পুরুষঃ তেজস এব তদধ্যাপো জায়ন্তে।। (ছান্দোগ্য-৬/২/৩)।। তা আপ ঐক্ষন্ত- বহ্ব্যঃ স্যাম্ প্রজায়েমহী ইতি; তা অন্নম্ অসৃজন্ত তস্মাদ্ যত্র ক্ব চ বর্ষতি তদেব ভূয়িষ্ঠমন্নং ভবতি। অদ্ভ্যঃ এব তৎ অধি অন্নাদ্যং জায়তে।। (ছান্দোগ্য-৬/২/৪)।।
অর্থাৎ :
হে সৌম্য! এই যে বিশ্ব-চরাচর দেখছো, সর্বপ্রথমে এটি ছিলো সৎ-স্বরূপে। সূক্ষ্ম বীজাকারে এর একটা অস্তিত্ব ছিলো। সেটি হলো সৎ বস্তু। এক এবং অদ্বিতীয় (সদ্) ভাবরূপ। তার থেকেই এই বিশ্ব-চরাচর। কেউ কেউ বলেন, সর্বপ্রথমে কিছুই ছিলো না- অসৎ। এক এবং অদ্বিতীয় (অসদ্ রূপ) অভাব থেকেই ভাবের অর্থাৎ এই বিশ্ব-চরাচর সৃষ্টি। (ছান্দোগ্য-৬/২/১)। কিন্তু সৌম্য! তা কিভাবে সম্ভব ! যা কিছুই সৃষ্টি হোক বা উৎপন্ন হোক, একটা কিছুকে তো অবলম্বন করতেই হবে। সবার আগে এক এবং অদ্বিতীয় একটি অষন্ড সত্তা- সৎবস্তু ছিলো, তা থেকেই এই জগৎ। (ছান্দোগ্য-৬/২/২)। সেই এক অদ্বিতীয় সৎ-বস্তুটি মনে মনে সঙ্কল্প করলেন- ‘আমি বহু হবো, একাধিক হয়ে জন্ম নেবো।’ সঙ্কল্প মাত্রেই তাঁর থেকে প্রথমে উৎপন্ন হলেন- তেজ। তেজের মনেও জাগলো একই সঙ্কল্প- ‘আমি বহু হবো, একাধিক হয়ে জন্ম নেবো।’ তাঁর সেই সৎ-সঙ্কল্প থেকে উৎপন্ন হলেন জল। তাই পুরুষ যখন শোকে কাতর হয়, বা ঘামে, তখন তার ভেতরের তেজই চোখের কোলে, গায়ে জল হয়ে বেরিয়ে আসে। (ছান্দোগ্য-৬/২/৩)। এবার সৎ-সঙ্কল্পজাত সেই জলও সঙ্কল্প করলেন তেজের মতোই- ‘আমি বহু হবো, আমি বহু হয়ে জন্ম নেবো।’ তাঁর সেই সঙ্কল্প থেকে উৎপন্ন হলেন অন্ন। পুত্র নিশ্চয়ই ভাবছো যে পৃথিবী নেই, অন্ন কোথা থেকে উৎপন্ন হবে। তাই বলি, জেনে রাখো, অন্নই পৃথিবী; পৃথিবীই অন্নের স্থান। তাই যেখানে যখন বৃষ্টির ধারা নেমে আসে, তখন সেখানেই উৎপন্ন হয় অন্ন। (ছান্দোগ্য-৬/২/৪)।
এই উদাহরণ থেকে এটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে যে, প্রথমত উপনিষদকার অসৎ থেকে সৎ-বস্তুর অর্থাৎ অভাব থেকে ভাবের উৎপত্তিকে মানেননি; দ্বিতীয়ত, বাস্তব উপাদানে তেজ বা অগ্নিকে মূল উপাদান বলে মানা হয়েছে। অথচ অত্যন্ত কৌতুহলের বিষয় হলো, ইতঃপূর্বে এই উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ের উনবিংশ খণ্ডেই (ছান্দোগ্য-৩/১৯/১-৩) তিনি কিন্তু উল্টোভাবে সৃষ্টির প্রথমে অভাবরূপ অসৎ-কে স্বীকার করে নিয়ে সেই অসৎ থেকে সৎ-বস্তুর উদ্ভব হয়েছে বলে আলোচনা করেছেন। যেমন-
‘আদিত্যো ব্রহ্মেতি আদেশঃ, তস্যোপব্যাখ্যানং- অসৎ এবেদমগ্র আসীৎ; তৎ সৎ আসীৎ; তৎ সমভবৎ, তৎ আন্ডং নিরবর্তত; তৎ সম্বৎসরস্য মাত্রাম্ অশয়ত; তৎ নিরভিদ্যত; তে আন্ডকপালে রজতং চ সুবর্ণং চাভবতাম্ ।। (ছান্দোগ্য-৩/১৯/১)।। তদ্ যদ্ রজতম্ সা ইয়ং পৃথিবী, যৎ সুবর্ণং সা দ্যৌঃ, যৎ জরায়ু তে পর্বতা, যৎ উল্বং স মেঘো নীহারো, যা ধমনয়স্তা নদ্যো, যৎ বাস্তেয়ম্ উদকং স সমুদ্রঃ।। (ছান্দোগ্য-৩/১৯/২)।। অথ যত্তদ্ অজায়ত সোহসৌ আদিত্যস্তং জায়মানং ঘোষা উলুলবোহনুদতিষ্ঠন্; সর্বাণি চ ভূতানি সর্বে চ কামাঃ। তস্মাৎ তস্যোদয়ং প্রতি প্রত্যায়নং প্রতি ঘোষা উলুলবঃ অনুত্তিষ্ঠন্তি, সর্বাণি চ ভূতানি, সর্বে চ কামাঃ।। (ছান্দোগ্য-৩/১৯/৩)।।
অর্থাৎ :
আদিত্য অর্থাৎ সূর্যই ব্রহ্ম- এটি আদেশ অর্থাৎ উপদেশ। কিভাবে ? তার বিস্তৃত ব্যাখ্যা এই- এই জগৎ পূর্বে অসৎ অর্থাৎ নামরূপহীন ছিলো। তা সৎ অর্থাৎ সূক্ষ্ম সত্তাবান হলো, সম্ভূত হলো এবং ডিম্বরূপে পরিণত হলো। সেই অবস্থায় এক বছর রইলো স্পন্দনহীন। তারপর সেই ডিম্ব অর্থাৎ অণ্ড দুভাগে ভাগ হলো। একভাগ হলো রজতময়। অপরভাগ হলো সুবর্ণময় (ছান্দোগ্য-৩/১৯/১)। রজতময় অংশটি হলো এই পৃথিবী আর সুবর্ণময় অংশটি হলো দ্যৌ অর্থাৎ দ্যুলোক। জরায়ু পর্বত। গর্ভবেষ্টনী হলো মেঘ এবং নীহার অর্থাৎ হিম। ধমনী হলো নদীসমূহ আর বস্তিদেশ হলো জলময় সমুদ্র (ছান্দোগ্য-৩/১৯/২)। এর পর উৎপন্ন হলো আদিত্য। উৎপন্ন হলো সমুদয় ভূত (বিষয়) এবং কাম্যবস্তু। তাঁকে ‘জায়মান’ অর্থাৎ উৎপন্ন হতে দেখে মহানন্দে উঠলো ‘উলু…উলু’ ধ্বনি। সেই থেকে সেই কারণে অর্থাৎ সমুদয় ভূত এবং কাম্যবস্তুর উৎপাদক সূর্যকে দেখে সকলে সূর্যোদয় এবং সূর্যাস্তের সময় ‘উলু…উলু’ ধ্বনি করে (ছান্দোগ্য-৩/১৯/৩)।
বেদকে আশ্রয় করে উপনিষদীয় চিন্তাজগতের বিকাশে কোনরূপ দার্শনিক শৃঙ্খলা না থাকলেও সৃষ্টিতত্ত্ব-সংশ্লিষ্ট এই সৎ-অসৎ সত্তা বিষয়ক প্রপঞ্চটি নিঃসন্দেহে খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় ছিলো, যা পরবর্তীকালের দার্শনিক-ভাবনাকে বিপুলভাবে প্রভাবিত করেছে, এর ব্যাখ্যার ভিন্নতায় তত্ত্বীয় স্বাতন্ত্র্য সৃষ্টি করেছে বিভিন্ন দার্শনিক প্রস্থানগুলির মধ্যে। তবে উপনিষদীয় চিন্তাজগতের মূল লক্ষ্যই ছিলো পরম সত্তা হিসেবে ব্রহ্মভাবনা এবং ব্রহ্মের সাথে সবকিছুকে মিলিয়ে দেয়ার অনিবার্য প্রয়াস, যা বিপুলভাবে ছড়িয়ে আছে উপনিষদগুলির পরতে পরতে, সৃষ্টি হয়েছে বিপুল উপনিষদ সাহিত্যের। এই পরম সত্তাই উপনিষদে কখনো ব্রহ্ম, কখনো আত্মা, কখনো ভগবান, কখনো কেবলমাত্র সৎ বলে অভিহিত হয়েছেন। এখানে উদাহরণ হিসেবে প্রথমকালের দুই উপনিষদের নমুনা উপস্থাপন করা হলেও অন্যান্য উপনিষদেও অন্যান্য অনেক বিষয়ের সাথে সৃষ্টি ও ব্রহ্ম বিষয়ক বর্ণনার অভাব নেই। বেদান্ত হিসেবে পরবর্তীকালের এসব উপনিষদ থেকে বিক্ষিপ্তভাবে তাদের ভাবনাধারার কিছু নমুনা দেখা যেতে পারে।
ঐতরেয় উপনিষদ (আনুমানিক ৬০০-৫০০ খ্রীষ্টপূর্ব)- এই উপনিষদ ঋগ্বেদের ঐতরেয় আরণ্যকের একটি ভাগ। ঐতরেয় ব্রাহ্মণ এবং আরণ্যকের রচয়িতা মহীদাস ঐতরেয়। এই উপনিষদের তিনটি অধ্যায়। প্রথম অধ্যায়ের তিনটি খণ্ড বা অনুচ্ছেদে ব্রহ্মের সৃষ্টিকর্মের বর্ণনা, দ্বিতীয় অধ্যায়ে তিন জন্মের বিবরণ এবং তৃতীয় অধ্যায়ে ব্রহ্মবাদ নিয়ে আলোচনা রয়েছে। এই উপনিষদের ভাবধারার নমুনা-
‘আত্মা বা ইদমেক এবাগ্র আসীৎ। নান্যৎ কিঞ্চনমিষৎ। স ঈক্ষত লোকান্ নু সৃজা ইতি।। (ঐতরেয়-১/১/১)।। স ইমান্ লোকান্ অসৃজত। অম্ভো মরীচীর্মরম্ আপোহদোহম্ভঃ পরেণ দিবং, দ্যৌঃ প্রতিষ্ঠান্তরিক্ষং মরীচয়ঃ। পৃথিবী মরো যা অধস্তাৎ তা আপঃ।। (ঐতরেয়-১/১/২)।। স ঈক্ষত, ইমে নু লোকা লোকপালান্ নু সৃজা ইতি। স অদ্ভ্যঃ এবং পুরুষং সমুদ্ধৃতা অমূর্ছয়ৎ।। (ঐতরেয়-১/১/৩)।। তম্ অভ্যতপৎ। তস্য অভিতপ্তস্য মুখং নিরভিদ্যত, যথান্ডম্ । মুখাৎ বাক্; বাচোহগ্নিঃ। নাসিকে নিরভিদ্যেতাং; নাসিকাভ্যাং প্রাণঃ, প্রাণাদ্ বায়ুঃ। অক্ষিণী নিরভিদ্যেতাম্, অক্ষিভ্যাং চক্ষুঃ, চক্ষুষ আদিত্যঃ। কর্ণো নিরভিদ্যেতাং, কর্ণাভ্যাং শ্রোত্রং, শ্রোত্রাদ্ দিশঃ। ত্বক্ নিরভিদ্যত, ত্বচো লোমানি, লোমভ্য ওষধিবনস্পতয়ঃ। হৃদয়ং নিরভিদ্যত, হৃদয়াৎ মনঃ, মনসঃ চন্দ্রমাঃ। নাভিঃ নিরভিদ্যত, নাভ্যা আপনঃ, অপানাৎ মৃত্যুঃ। শিশ্নং নিরভিদ্যত, শিশ্নাৎ রেতঃ, রেতসঃ আপঃ।। (ঐতরেয়-১/১/৪)।।
এষঃ ব্রহ্ম, এষঃ ইন্দ্রঃ, এষঃ প্রজাপতিঃ, এতে সর্বে দেবাঃ, ইমানি চ পঞ্চ মহাভূতানি- পৃথিবী বায়ুরাকাশ আপো জ্যোতীংষি ইতি এতানি, ইমানি চ ক্ষুদ্রমিশ্রাণি ইব বীজানি, ইতরাণি চেতরাণি চ- অন্ডজানি চ জারুজানি চ স্বেদজানি চ উদ্ভিজানি চ- অশ্বা গাবঃ পুরুষা হস্তিনঃ, যৎকিঞ্চ ইদং প্রাণি জঙ্গমং চ পতত্রি চ যচ্চ স্থাবরং;- সর্বং তৎ প্রজ্ঞানেত্রং প্রজ্ঞানে প্রতিষ্ঠিতং, প্রজ্ঞানেত্রো লোকঃ, প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠা, প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম।। (ঐতরেয়-৩/৩)।।
অর্থাৎ :
এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে যখন দৃশ্যমান কিছুই ছিলো না, তখন কিন্তু ছিলো এক সত্তা সকলের অগোচরে। সেই সত্তাটি ছিলো সর্বশক্তি নিয়ে শক্তিমান- আত্মা। সৃষ্টির আগে এই চৈতন্যময় আত্মা ছাড়া দ্বিতীয় আর কিছুই ছিলো না। তিনি চিন্তা করলেন- আমি লোকালোক সৃষ্টি করবো; আমি সৃষ্টি করবো জগতের পর জগৎ (ঐতরেয়-১/১/১)। তাঁর চিন্তা সঙ্গে সঙ্গে রূপায়িত হলো। সৃষ্টি হলো চারটি লোকের- জগতের। প্রথম অম্ভোলোক (যে লোকে জলভরা মেঘের আনাগোনা। দ্যুলোক বা স্বর্গলোকের উপর থেকে আরো উপর পর্যন্ত যার বিস্তার), তারপর মরীচিলোক যেখানে সাত ঘোড়ায় টানা একচক্র রথে সূর্যদেবের যাতায়াত অসংখ্য কিরণ নিয়ে), তারপর মরলোক অর্থাৎ এই পৃথিবী। তার নিচের লোক অপলোক অর্থাৎ জলময় জগৎ (ঐতরেয়-১/১/২)। তাঁর ইচ্ছায় স্থূল জগৎগুলি তো সৃষ্টি হলো। কিন্তু এগুলিকে রক্ষা করবে, পালন করবে কে ? তাই তিনি ইচ্ছা করলেন লোকপাল সৃষ্টি করতে। এবারে তিনি জল থেকে তুলে নিলেন একটি পিণ্ড। (একজন মৃৎশিল্পীর মতো) সেই পিণ্ডটিকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে দিলেন পুরুষের রূপ (ঐতরেয়-১/১/৩)। সেই পুরুষাকৃতিকে সম্পূর্ণ সপ্রাণ করে তুলতে তার দেহে কম্পন সৃষ্টি করে তাকে তপ্ত করলেন। তপ্ত করার পর তার মুখ বিকশিত হলো। মুখ থেকে নির্গত হলো বাক্, সৃষ্টি হলো অগ্নি। প্রকাশ পেলো নাসারন্ধ্র, নাসিকা থেকে নির্গত হলো নিঃশ্বাস, নিঃশ্বাস থেকে প্রাণ, প্রাণ থেকে বায়ু। প্রকাশিত হলো দুটি চক্ষুগোলক, চক্ষু থেকে সৃষ্টি হলো দৃষ্টিশক্তি, তা থেকে আদিত্য বা সূর্য। এরপর কর্ণযুগল, তা থেকে হলো শ্রবণক্ষমতা, শ্রুতি থেকে দিশা বা দিকসকল। ত্বক উৎপন্ন হলো, ত্বক থেকে রোম, রোম থেকে ওষধি বনস্পতি। হৃদয় স্ফুরিত হলো, সৃষ্টি হলো মন, মন থেকে চন্দ্রমা। নাভির উৎপত্তি হলো, তা থেকে অপান বায়ু, অপান থেকে মৃত্যু। এরপর উৎপত্তি হলো জননেন্দ্রিয়ের, তা থেকে বীর্য, বীর্য থেকে আবার সেই জল (ঐতরেয়-১/১/৪)। অতঃপর ঐ পুরুষের মধ্যে তিনি যুক্ত করে দিলেন ক্ষুধা-তৃষ্ণার অনুভূতি।
সেই প্রজ্ঞাবান আত্মাই হলেন বিরাট-স্বরাট- ব্রহ্ম। ইনিই ইন্দ্র, স্রষ্টা প্রজাপতি, ইনিই দেবরাজ্যের সব দেবতা। ইনিই জগৎ-সৃষ্টির পাঁচটি মূল উপাদান- পঞ্চমহাভূত (মাটি, বায়ু, আকাশ, জল, অগ্নি বা তেজ)। ইনিই ক্ষুদ্র কীটাণুকীট, উভচর থেকে সব কিছুর উৎপত্তিস্থল- বীজ। অণ্ডজ (পাখি ইত্যাদি), জরায়ুজ (মানুষ, পশু ইত্যাদি), স্বেদজ (মশা ইত্যাদি), উদ্ভিজ্জ (গাছপালা প্রভৃতি) থেকে শুরু করে ঘোড়া, গরু, মানুষ, হাতি- যত প্রাণী, এমনকি স্থাবর-জঙ্গমের মধ্যেও ইনিই হলেন সেই প্রাণ। প্রজ্ঞার সত্তা নিয়েই বিশ্বচরাচর সত্তাবান। প্রজ্ঞাই সব কিছু নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। এই প্রজ্ঞাই হলো সব কিছুর মূল। জীবজগৎ, জড়জগৎ, লোকালোক- সব কিছু আশ্রয় করে আছে এই প্রজ্ঞানকেই। বিরাট এই প্রজ্ঞানই ব্রহ্ম (ঐতরেয়-৩/৩)।
তৈত্তিরীয় উপনিষদ (আনুমানিক ৬০০-৫০০ খ্রীষ্টপূর্ব)- এটি কৃষ্ণ-যজুর্বেদের তৈত্তিরীয় আরণ্যকেরই একটি অংশ, যা তিনটি বল্লী বা অধ্যায়ে বিভক্ত- শিক্ষা বল্লী, ব্রহ্মানন্দ বল্লী ও ভৃগু বল্লী। প্রথম শিক্ষা বল্লীতে রয়েছে এগারোটি অনুবাক বা অনুচ্ছেদ, দ্বিতীয় ব্রহ্মানন্দ বল্লীতে নয়টি এবং তৃতীয় ভৃগু বল্লীতে দশটি অনুবাক রয়েছে। ব্রহ্ম ও সৃষ্টি সম্পর্কিত বক্তব্যে এই উপনিষদে বলা হচ্ছে-
‘অসন্নেব স ভবতি। অসদ্ ব্রহ্মেতি বেদ চেৎ। অস্তি ব্রহ্মেতি চেদ্বেদ। সন্তমেনং ততো বিদুঃ। ইতি।। (তৈত্তিরীয়-২/৬/১)।। অসদ্বা ইদমগ্র আসীৎ। ততো বৈ সদজায়ত। তদাত্মানং স্বয়মকুরুত। তস্মাৎ তৎ সুকৃতমুচ্যতে ইতি।। (তৈত্তিরীয়-২/৭/১)।। তদনুপ্রবিশ্য। সচ্চ ত্যচ্চাভবৎ নিরুক্তং চ অনিরুক্তঞ্চ। নিলয়ং চ অনিলয়ঞ্চ। বিজ্ঞানং চ অবিজ্ঞানঞ্চ। সত্যং চ অনৃতঞ্চ সত্যমভবৎ। যদিদং কিঞ্চ। তৎ সত্যমিতি আচক্ষতে (তৈত্তিরীয়-২/৬/৫)। সোহকাময়ত- বহু স্যাং প্রজায়েয়েতি। স তপোহতপ্যত। স তপস্তপ্তবা। ইদং সর্বং অসৃজত। যদিদং কিঞ্চ। ত্বৎ সৃষ্টা তদেবানুপ্রাবিশৎ।। (তৈত্তিরীয়-২/৬/৪)।। তস্মাদ্বা এতস্মাদাত্মন আকাশঃ সম্ভূত। আকাশাদ্বায়ুঃ। বায়োরগ্নিঃ। অগ্নেরাপঃ। অদ্ভ্যঃ পৃথিবী। পৃথিব্যা ওষধয়ঃ। ওষধীভ্যোহয়ম্ । অন্নাৎ রেতঃ। রেতসঃ পুরুষঃ। স বা এষ পুরুষোহন্নরসময়ঃ।। (তৈত্তিরীয়-২/১/৩)।।
অর্থাৎ :
যদি কেউ মনে করে ব্রহ্ম অসৎ অর্থাৎ অস্তিত্বহীন বা নেই, তাহলে সে নিজেও অসৎ বা অস্তিত্বহীন হয়। আর যে জানে ব্রহ্ম আছেন, ব্রহ্মবস্তু আছেন, তাহলে তাকে ব্রহ্মবিদরা ব্রহ্মস্বরূপ বলে বা সত্যস্বরূপ বলে জানেন (তৈত্তিরীয়-২/৬/১)। এই যে দৃশ্যমান জগৎ তা সর্বপ্রথমে অসৎ-ই ছিলো। সেই অসৎ থেকেই সৎ উৎপন্ন হলো। তিনি নিজেই নিজেকে এইভাবে সৃষ্টি করলেন। সেইজন্য তাঁকে বলা হয়েছে সুকৃত (তৈত্তিরীয়-২/৭/১)। সৃষ্টির ভেতরে অনুপ্রবেশ করে তিনি সৎ এবং তৎ (বহু) অর্থাৎ মূর্ত, অমূর্ত বা ব্যক্ত, অব্যক্ত- এই দুইয়ের মধ্যেই থেকে গেলেন। শুধু তাই নয়, নিরুক্ত অর্থাৎ সবিশেষ, অনিরুক্ত অর্থাৎ নির্বিশেষ, নিলয় অর্থাৎ আশ্রয়, অনিলয় অর্থাৎ নিরাশ্রয়; বিজ্ঞান-অবিজ্ঞান অর্থাৎ চেতন-অচেতন, সত্য-অনৃত অর্থাৎ ব্যবহারিক সত্য এবং মিথ্যা- এইভাবে যা কিছু আছে (তা যতো বিপরীতধর্মীই হোক না কেন) সত্যস্বরূপ ব্রহ্ম (পরমাত্মা) সবার ভেতর থেকে নিজেই সব হয়েছেন। ব্রহ্মই এইসব হয়েছেন বলে ব্রহ্মবিদরা ব্রহ্মকে বলেন সত্য (তৈত্তিরীয়-২/৬/৫)। তিনি ইচ্ছা করলেন- ‘আমি বহু হবো। আমি উৎপন্ন হবো।’ তিনি তপস্যা করলেন। এই সব কিছু তিনি সৃষ্টি করলেন- যা কিছু আছে, সব। সৃষ্টি করে আবার সব কিছুর মধ্যেই থেকে গেলেন (তৈত্তিরীয়-২/৬/৪)। সেই পরমাত্মার ইচ্ছানুসারে প্রথম হলো আকাশ। আকাশ থেকে হলো বায়ু। বায়ু থেকে অগ্নি। অগ্নি থেকে জল। জল থেকে পৃথিবী। পৃথিবী থেকে ওষধি (নানাজাতীয় গাছপালা-লতা ইত্যাদি)। ওষধি থেকে হলো অন্ন (খাদ্যবস্তু)। অন্ন থেকে রেতঃ বা বীর্য বা রক্তমস্তু। সেই রেতঃ থেকে দেহ বা শরীর (মানুষ)। এই মানুষ হলো অন্নরসময় বা অন্নরসের বিকার (তৈত্তিরীয়-২/১/৩)।
প্রশ্ন উপনিষদ (আনুমানিক ৫০০-৪০০ খ্রীষ্ঠপূর্ব)- প্রশ্ন আর উত্তরের মধ্য দিয়ে এখানে ব্রহ্মতত্ত্ব বলা হয়েছে বলে এই উপনিষদটির নাম প্রশ্নোপনিষদ। এই উপনিষদের বিষয়বস্তু হলো মহর্ষি পিপ্পলাদ-এর নিকট সুকেশা, সত্যকাম, সৌর্যায়ণী, কৌসল্য, ভার্গব, কবন্ধী নামে ছয়জন ব্রহ্মনিষ্ঠ ঋষির প্রশ্ন-উত্তর সম্বলিত ছয়টি প্রশ্ন-অধ্যায়। প্রশ্নোপনিষদের কিছু উদাহরণ-
‘তস্মৈ স হোবাচ- প্রজাকামো বৈ প্রজাপতিঃ স তপোহতপ্যত স তপস্তপত্বা স মিথুনমুৎপাদয়তে- রয়িং চ প্রাণং চেতি- এতৌ মে বহুধা প্রজাঃ করিষ্যত ইতি।। (প্রশ্নোপনিষদ-১/৪)।। আদিত্যো হ বৈ প্রাণো, রয়িরেব চন্দ্রমাঃ, রয়ির্বা এতং সর্বং যন্মূর্তং চামূর্তং চ, তস্মান্ মূর্তিরেব রয়িঃ।। (প্রশ্নোপনিষদ-১/৫)।। তস্মৈ স হোবাচ- এতদ্বৈ সত্যকাম পরং চাপরং চ ব্রহ্ম যদ্ ওঙ্কারঃ। তস্মাদ্ বিদ্বান্ এতেনৈব আয়তনেন একতরং অন্বেতি।। (প্রশ্নোপনিষদ-৫/২)।। অরা ইব রথনাভৌ কলা যস্মিন্ প্রতিষ্ঠিতাঃ। তং বেদ্যং পুরুষং বেদ যথা মা বো মৃত্যুঃ পরিব্যথা ইতি।। (প্রশ্নোপনিষদ-৬/৬)।। তান্ হোবাচ- এতবদেব অহম্ এতৎ পরং ব্রহ্ম বেদ, নাতঃ পরমস্তীতি।। (প্রশ্নোপনিষদ-৬/৭)।।
অর্থাৎ :
মহর্ষি পিপ্পলাদ বললেন- এ সবই প্রজাপতির তপস্যার ফল। প্রজাপতি ঈশ্বর সৃষ্টি-কামনায় তপস্যা করলেন, ‘এই জগৎ-সংসার সৃষ্টি করবো’- এইরকম প্রবল বাসনা দিয়ে তিনি একটি মিথুন সৃষ্টি করলেন। একটির নাম ‘রয়ি’, অন্যটির নাম ‘প্রাণ’। তাদের দেখে তিনি নিজে নিজেই বলে উঠলেন- ‘এই দুটি-ই বহু হবে, বহু হবে। অনেক, অনেক প্রজা এই মিথুন (যমজ) থেকেই উৎপন্ন হবে (প্রশ্নোপনিষদ-১/৪)। প্রাণ হলো আদিত্য অর্থাৎ সূর্য। চাঁদ হলো রয়ি। বিশ্বে মূর্ত, অমূর্ত যা কিছু আছে সবই রয়ি। মূর্ত হলো প্রত্যক্ষ, রয়ি বা জড় পদার্থ মূর্তি ছাড়া নেই। একটা না একটা অবয়ব তার আছে। তবে এতো সূক্ষ্ম যে চোখে দেখা যায় না (প্রশ্নোপনিষদ-১/৫)। পিপ্পলাদ বললেন- সত্যকাম, ওঙ্কারের উপাসনা হলো ব্রহ্মেরই উপাসনা, সে পর-ব্রহ্মই বলো, আর অপর-ব্রহ্মই বলো। ব্রহ্মর এই দুটি রূপের স্বরূপই হলো ওঙ্কার। যে তাঁকে যেভাবে ধ্যান করবে, সে তাঁকে সেইভাবেই পাবে (প্রশ্নোপনিষদ-৫/২)। রথনাভি যেমনি নিজের দেহ থেকে চারিদিকে বেরিয়ে যাওয়া শলাকা দিয়ে রথচক্রকে ধরে আছে, পরমপুরুষও তেমনি নিজের দেহ থেকে এক-একটি শক্তিকণা দিয়ে আলাদা আলাদা করে ধরে রেখেছেন বিশ্বব্যাপী এই প্রাণচক্রকে। তাঁকে জানা অর্থাৎ তাঁর স্বরূপকে জানা ছাড়া এ সংসারে জানার মতো দ্বিতীয় কিছু নেই। তাঁকে জানলে, মৃত্যুর সাধ্য কি ব্যথা দেয় (প্রশ্নোপনিষদ-৬/৬)। এই পর্যন্ত বলেই থেমে গেলেন মহর্ষি পিপ্পলাদ। বললেন- আমার জ্ঞান এই পর্যন্তই। সেই পরমব্রহ্মকে এর বেশি জানি না। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এর চেয়ে ভালোভাবে জানাও যায় না (প্রশ্নোপনিষদ-৬/৭)।
কেন উপনিষদ (আনুমানিক ৫০০-৪০০ খ্রীষ্ঠপূর্ব)- প্রশ্নময় ‘কেন’ দিয়ে শুরু হয়েছে বলে এই উপনিষদটির নাম হয়েছে কেনোপনিষদ। চার খণ্ডে বিভক্ত এ উপনিষদের প্রথম দু’খণ্ড পদ্যে রচিত, শেষ দু’খণ্ড গদ্যে। এই উপনিষদের কিছু ভাষ্য-
‘যদ্বাচানভ্যুদিতং যেন বাগভ্যুদ্যতে। তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং যদিদমুপাসতে।। (কেনোপনিষদ-১/৫)।। যন্মনসা ন মুনতে যেনাহুর্মনো মতম্ । তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং যদিদমুপাসতে।। (কেনোপনিষদ-১/৬)।। যচ্চক্ষুষা ন পশ্যতি যেন চক্ষুংষি পশ্যতি। তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং যদিদমুপাসতে।। (কেনোপনিষদ-১/৭)।। যৎ শ্রোত্রেণ ন শৃণোতি, যেন শ্রোত্রমিদং শ্রুতম্ । তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং যদিদমুপাসতে।। (কেনোপনিষদ-১/৮)।। যৎ প্রাণেন ন প্রণিতি যেন প্রাণঃ প্রণীয়তে। তদেব ব্রহ্ম ত্বং বিদ্ধি নেদং যদিদমুপাসতে।। (কেনোপনিষদ-১/৯)।। শ্রোত্রস্য শ্রোত্রং মনসো মনো যদ্ বাচো হ বাচং স উ প্রাণস্য প্রাণঃ। চক্ষুষশ্চক্ষুরতিমুচ্য ধীরাঃ প্রেত্যাস্মাল্লোকাদমৃতা ভবন্তি।। (কেনোপনিষদ-১/২)।। প্রতিবোধবিদিতং মতমমৃতত্বং হি বিন্দতে। আত্মনা বিন্দতে বীর্যং বিদ্যয়া বিন্দতে অমৃতম্।। (কেনোপনিষদ-২/৪)।।
অর্থাৎ :
বাক্য যাঁকে প্রকাশ করতে পারে না, বরং যাঁর প্রেরণায় বাক্য উচ্চারিত হয়, তিনিই ব্রহ্ম, তাঁকে জানো। জগতে যে বস্তুর স্থায়িত্ব নেই, যা শাশ্বত বা সনাতন নয়, তার উপাসনা করলে ব্রহ্মর উপাসনা করা হয় না (কেনোপনিষদ-১/৫)। যাঁকে মন দিয়ে মনন করা যায় না, অথচ যিনি প্রাণীর মন-নামক বস্তুটিকে বিলক্ষণ জানেন, তিনিই ব্রহ্ম। তাঁকে জানো। সংসারে অনিত্য বস্তুকে উপাসনা করলে ব্রহ্মর উপাসনা করা হয় না (কেনোপনিষদ-১/৬)। চোখ যাঁকে দেখতে পায় না অথচ যাঁর শক্তিতে শক্তিমান হয়ে চোখ দেখার মতো বস্তুকে দেখতে পায়, সেই শক্তিই (তিনিই) ব্রহ্ম। তাঁকে জানো। সাধারণ চোখ দিয়ে যাকে দেখে ব্রহ্ম বলে উপাসনা করছো, তিনি ব্রহ্ম নন (কেনোপনিষদ-১/৭)। যাঁকে আমরা কান দিয়ে শুনতে পাই না অথচ আমাদের এই কর্ণ নামক ইন্দ্রিয়টিকে যিনি ভালোভাবে জানেন, তিনিই ব্রহ্ম। তাঁকে জানো। জাগতিক কোন বস্তুও উপাসনা করলে তাঁর উপাসনা হয় না (কেনোপনিষদ-১/৮)। প্রাণ যাঁর সন্ধান জানে না বা নাক যার আঘ্রাণ নিজে নিতে পারে না, যিনি আঘ্রাণ-শক্তি জোগালে তবে নাক আঘ্রাণ নিতে পারে, তিনিই ব্রহ্ম। তাঁকে জানো। নশ্বর বস্তুর উপাসনা করলে তাঁকে জানা যায় না (কেনোপনিষদ-১/৯)। তিনি কানেরও কান, মনেরও মন, প্রাণেরও প্রাণ, চক্ষুরও চক্ষু। তাঁকে যিনি জেনেছেন, তিনি ধীর, জ্ঞানী। এই লোক পরিত্যাগ করে তিনি অমৃতত্ব লাভ করেন (কেনোপনিষদ-১/২)। প্রতিটি বস্তুর মধ্যেই আত্মা আছেন। তাঁরই শক্তি নিয়ে আমরা শক্তিমান- এই পরম সত্য আত্মজ্ঞানে যারা জ্ঞানী, তারাই বীর্যশালী, তারাই অমর (কেনোপনিষদ-২/৪)।
কঠ উপনিষদ (আনুমানিক ৫০০-৪০০ খ্রীষ্ঠপূর্ব)- কৃষ্ণযজুর্বেদের তৈত্তিরীয় অংশে কঠ বা কাঠক নামে একটি ব্রাহ্মণ আছে। এই উপনিষদ তার অন্তর্গত বলে এর নাম হয়েছে কঠোপনিষদ। কঠ গদ্যে রচিত। ভগবদ্গীতায় কঠ-উপনিষদ থেকে অনেক কিছুই গ্রহণ করা হয়েছে। এই উপনিষদেই মৃত্যুর অধিপতি যমের সঙ্গে বুদ্ধিমান ব্রাহ্মণ কিশোর নচিকেতার কথোপকথনকে কেন্দ্র করে প্রসিদ্ধ আখ্যায়িকার মাধ্যমে আত্মজ্ঞান শিক্ষা দেয়া হয়েছে। ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ১৩৫ সূক্তে অনুরূপ একটি উপাখ্যান আছে।
এই উপনিষদে এমন অনেক মন্ত্র রয়েছে, যা প্রায়শই প্রবাদবাক্যের মতো ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এতে দুটি অধ্যায়ের প্রতিটিতে তিনটি করে বল্লী বা অনুচ্ছেদ রয়েছে। প্রথম অধ্যায়ে একাত্তরটি মন্ত্র আর দ্বিতীয় অধ্যায়ে ছাপ্পান্নটি মন্ত্রে আখ্যায়িকার আঙ্গিকে আত্ম-তত্ত্বকথা বর্ণিত হয়েছে। যেমন-
‘ন সাম্পরায়ঃ প্রতিভাতি বালং প্রমাদ্যন্তং বিত্তমোহেন মূঢ়ম্ । অয়ং লোকো নাস্তি পর ইতি মানী পুনঃ পুনর্বশমাপদ্যতে মে।। (কঠোপনিষদ-১/২/৬)।। এতদালম্বনং শ্রেষ্ঠমেতদালম্বনং পরম্ । এতদালম্বনং জ্ঞাত্বা ব্রহ্মলোকে মহীয়তে।। (কঠোপনিষদ-১/২/১৭)।। ন জায়তে ম্রিয়তে বা বিপশ্চিন্নায়ং কুতশ্চিন্ন বভূব কশ্চিৎ। অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।। (কঠোপনিষদ-১/২/১৮)।। অণোরণীয়ান্ মহতো মহীয়ান্ আত্মাহস্য জন্তোর্নিহিতো গুহায়াম্ । তমক্রতুঃ পশ্যতি বীতশোকো ধাতুপ্রসাদান্মহিমানমাত্মনঃ।। (কঠোপনিষদ-১/২/২০)।। অশরীরং শরীরেষ¦নবস্থেষ¦বস্থিতম্ । মহান্তং বিভুমাত্মানং মত্বা ধীরো ন শোচতি।। (কঠোপনিষদ-১/২/২২)।। আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেব তু। বুদ্ধিং তু সারথিং বিদ্ধি মনঃ প্রগ্রহমেব চ।। (কঠোপনিষদ-১/৩/৩)।। ইন্দ্রিয়েভ্যঃ পরা হ্যর্থা অর্থেভ্যশ্চ পরং মনঃ। মনসন্তু পরা বুদ্ধির্বুদ্ধেরাত্মা মহান্ পরঃ।। (কঠোপনিষদ-১/৩/১০)।। মহতঃ পরমব্যক্তমব্যক্তাৎ পুরুষঃ পরঃ। পুরুষান্ন পরং কিঞ্চিৎ সা কাষ্ঠা সা পরা গতিঃ।। (কঠোপনিষদ-১/৩/১১)।। যোনিমন্যে প্রপদ্যন্তে শরীরত্বায় দেহিনঃ। স্থাণুমন্যেহনুসংযন্তি যথাকর্ম যথাশ্রুতম্ ।। (কঠোপনিষদ-২/২/৭)।।
অর্থাৎ :
(যম বলছেন), সংসারী মানুষ মাত্রই পরিবার, ধন-সম্পদে আসক্ত। সংসার তাদের মোহাচ্ছন্ন করে রাখে। তাদের বুদ্ধি অপরিণত। তারা তাদের চারপাশের দৃশ্যমান জগৎকেই সত্য মনে করে। এর বাইরেও যে একটা জগৎ আছে, সে খোঁজ তারা রাখে না। ইহলোকই আছে পরলোক বলে কিছু নেই- যে-ব্যক্তি এ কথা মনে করে সে বারবার আমার অধীন হয়। অর্থাৎ তার পুনঃ পুনঃ জন্মমৃত্যু ঘটে থাকে (কঠোপনিষদ-১/২/৬)। ব্রহ্মকে লাভ করার শ্রেষ্ঠ উপায় হলো ওঙ্কার ‘ওম্’। অপরা ব্রহ্ম (সগুণ ব্রহ্ম) এবং পরা ব্রহ্ম (নির্গুণ ব্রহ্ম) উভয়কেই এই পথে পাওয়া যায়। অপরা ব্রহ্মের সাধনার দ্বারা মানুষ ব্রহ্মলোক প্রাপ্ত হয়, ব্রহ্মের সমমর্যাদা লাভ করে। পরা ব্রহ্মের দ্বারা মানুষ ব্রহ্মের সঙ্গে এক হয়ে যায় (কঠোপনিষদ-১/২/১৭)। আত্মার জন্ম নেই, মৃত্যুও নেই। আত্মার কোন উৎপত্তি নেই, আবার আত্মা থেকেও কোন বস্তু উৎপন্ন হয় না। আত্মা জন্মরহিত, চিরন্তন, অপরিবর্তনীয় এবং সদা বিরাজমান। দেহের নাশ হয়, কিন্তু আত্মা অবিনাশী (কঠোপনিষদ-১/২/১৮)। আত্মা সূক্ষ্ম থেকেও সূক্ষ্মতর এবং বৃহতের চেয়েও বৃহত্তর। অন্তরাত্মারূপে প্রত্যেকের হৃদয়গুহাতে তিনি বিরাজ করেন। যে সব মানুষ সকল কামনা-বাসনা ত্যাগ করেছেন এবং নিজ মন ও ইন্দ্রিয় যাঁর বশে, তিনিই এই আত্মার মহিমা উপলব্ধি করতে পারেন। তখন তাঁর সকল সংশয় অতিক্রম করে যান (কঠোপনিষদ-১/২/২০)। আত্মা নিরাকার হয়েও সাকার। সকল অনিত্য বস্তুর মধ্যে তিনিই একমাত্র নিত্য; এই আত্মা বৃহৎ এবং সর্বব্যাপী। এই আত্মার সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করে প্রাজ্ঞ ব্যক্তি শোক-দুঃখকে অতিক্রম করেন (কঠোপনিষদ-১/২/২২)। জীবাত্মাকে রথের রথী এবং শরীরকে রথ বলে জেনো; বুদ্ধিকে সারথি এবং মনকে বল্লা (লাগাম) বলে জেনো (কঠোপনিষদ-১/৩/৩)। ইন্দ্রিয়ের চেয়ে শ্রেষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের বিষয় (রূপ, রস, ইত্যাদি); ইন্দ্রিয়ের বিষয়ের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মন; মনের চেয়ে শ্রেষ্ঠ বুদ্ধি; বুদ্ধির চেয়ে শ্রেষ্ঠ সেই মহান আত্মা (কঠোপনিষদ-১/৩/১০)। মহান আত্মার চেয়ে শ্রেষ্ঠ অব্যক্ত; অব্যক্তের চেয়ে শ্রেষ্ঠ পরমাত্মা। পরমাত্মার চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কিছু হতে পারে না। জীবের সমস্ত বিকাশের এখানেই চূড়ান্ত পরিণতি। পরমাত্মাই মানুষের জীবনের সর্বোচ্চ লক্ষ্য (কঠোপনিষদ-১/৩/১১)। নিজ কর্ম ও জ্ঞান অনুসারে, কোন কোন জীবাত্মা পুনর্জন্মের মধ্য দিয়ে বারবার জীবদেহ প্রাপ্ত হয়। আবার কেউ কেউ বৃক্ষ লতাদি স্থাবরদেহ প্রাপ্ত হয় (কঠোপনিষদ-২/২/৭)।
মুণ্ডক উপনিষদ (আনুমানিক ৫০০-৪০০ খ্রীষ্ঠপূর্ব)- মুণ্ডক শব্দের আক্ষরিক অর্থ যিনি মুণ্ডিত। অর্থাৎ মুণ্ডিত মস্তক গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী। ধারণা করা হয়, এই উপনিষদে নিজের এবং জগতের প্রকৃত পরিচয় সম্পর্কে অজ্ঞতা দূর করে ব্রহ্ম বিষয়ক তত্ত্বজ্ঞানের কথা বলা হয়েছে মুণ্ডিত মস্তক তথা সন্ন্যাসীদের জন্য। অজ্ঞতা দূর করাই মুণ্ডক উপনিষদের লক্ষ্য। এই উপনিষদের বক্তা ঋষি হচ্ছেন অঙ্গিরা, আর শ্রোতা ছিলেন ঘোর সংসারী শৌনক যিনি আত্মজ্ঞান প্রাপ্ত হয়ে পরে ঋষি হয়ে গিয়েছিলেন।
মুণ্ডকোপনিষদের তিনটি অধ্যায় যা মুণ্ডক নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। প্রতিটি মুণ্ডকে বা অধ্যায়ে দুটি করে খণ্ড বা অনুচ্ছেদ। মোট মন্ত্র চৌষট্টি, কিছু গদ্যে এবং কিছু পদ্যে রচিত। এই উপনিষদেই খুব স্পষ্টভাবে দৃষ্ট হয় যে, ব্রাহ্মণের যাজ্ঞিক কর্মকাণ্ড প্রধানত মুণ্ডকের বিরক্তি উৎপাদন করেছিলো। এইসব যজ্ঞরূপী কর্মকাণ্ড থেকে ব্রহ্মতত্ত্ব জ্ঞান লাভই যে শ্রেষ্ঠ এবং কাম্য তা-ই এ উপনিষদের বিবেচ্য। যেমন-
‘ইষ্টাপূর্তং মন্যমানা বরিষ্ঠং নান্যচ্ছ্রেয়ো বেদয়ন্তে প্রমূঢ়াঃ। নাকস্য পৃষ্ঠে তে সুকৃতেহনুভূত্বেমং লোকং হীনতরং বা বিশন্তি।। (মুণ্ডকোপনিষদ-১/২/১০)।। পরীক্ষ্য লোকান্ কর্মচিতান্ ব্রাহ্মণো নির্বেদমায়ান্নাস্ত্যকৃতঃ কৃতেন। তদ্বিজ্ঞানার্থং স গুরুমেবাভিগচ্ছেৎ সমিৎপাণিঃ শ্রোত্রিয়ং ব্রহ্মনিষ্ঠম্ ।। (মুণ্ডকোপনিষদ-১/২/১২)।। তপসা চীয়তে ব্রহ্ম ততোহন্নমভিজায়তে। অন্নাৎ প্রাণো মনঃ সত্যং লোকাঃ কর্মসু চামৃতম্ ।। (মুণ্ডকোপনিষদ-১/১/৮)।। যঃ সর্বজ্ঞঃ সর্ববিদ্ যস্য জ্ঞানময়ং তপঃ। তস্মাদেতদ্ ব্রহ্ম নাম রূপমন্নং চ জায়তে।। (মুণ্ডকোপনিষদ-১/১/৯)।। তদেতৎ সত্যম্-যথা সুদীপ্তাৎ পাবকাদ্ বিস্ফুলিঙ্গাঃ সহস্রশঃ প্রভবন্তে সরূপাঃ। তথাহক্ষরাদ্ বিবিধাঃ সোম্য ভাবাঃ প্রজায়ন্তে তত্র চৈবাপিযন্তি।। (মুণ্ডকোপনিষদ-২/১/১)।।
অর্থাৎ :
কিছু মানুষ আছেন যাঁরা চূড়ান্ত নির্বোধ। তাঁরা মনে করেন যাগযজ্ঞ এবং (কূপ, দীঘি খনন ইত্যাদি) জনহিতকর কর্মই সর্বোত্তম। এর চেয়ে মহত্তর কিছু থাকতে পারে তা তাঁরা জানেন না। এই সব সৎ কর্মের ফলে মৃত্যুর পর তাঁদের স্বর্গলাভ হয়, এবং নির্দিষ্ট কাল ব্যাপী তাঁরা স্বর্গসুখ ভোগ করেন। কিন্তু মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে তাঁরা আবার এই জগতে ফিরে আসেন (এবং মনুষ্যরূপে অথবা ইতর প্রাণী রূপে তাঁদের পুনর্জন্ম হয়) (মুণ্ডকোপনিষদ-১/২/১০)। আনুষ্ঠানিক উপাসনার ফল যে ক্ষণস্থায়ী একথা ব্রহ্মজিজ্ঞাসু জানেন। তাই এই জাতীয় অনুষ্ঠান তাঁকে আকর্ষণ করে না। যা নিত্য তা অনিত্য-ক্রিয়াকর্মের দ্বারা পাওয়া যায় না, একথা তিনি জানেন। এই জন্যই তিনি ব্রহ্মনিষ্ঠ বেদজ্ঞ আচার্যের অনুসন্ধান করেন। নম্রতার প্রতীক হিসেবে সমিধ কাঠ হাতে নিয়ে তিনি আচার্যের নিকট উপস্থিত হন (মুণ্ডকোপনিষদ-১/২/১২)। নিজ মনন শক্তি দ্বারা ব্রহ্ম নিজেকে প্রকাশ করেন। প্রথমে সৃষ্টির বীজ সক্রিয় হয়ে ওঠে। সেই বীজ থেকে আসে প্রাণ, প্রাণ থেকে আসে মন, সমষ্টি মন। তারপর আসে পঞ্চভূত এবং শেষে এই জগৎ। কর্ম থাকলেই তার ফল থাকবে, তাই কর্মফল অনন্ত ও অবিনাশী (মুণ্ডকোপনিষদ-১/১/৮)। যিনি সর্বজ্ঞ, যিনি সর্ববিৎ, জ্ঞানই যাঁর তপস্যা সেই পরা ব্রহ্ম থেকেই এই অপরা ব্রহ্ম (হিরণ্যগর্ভ) এবং নাম, রূপ ও অন্নাদি এসেছে (মুণ্ডকোপনিষদ-১/১/৯)। সেই অক্ষরপুরুষ ব্রহ্মই সত্য। জ্বলন্ত অগ্নি থেকে যেমন অগ্নিময় স্ফুলিঙ্গ নির্গত হয়, হে সৌম্য, সেই ভাবেই ব্রহ্ম থেকে বিবিধ বস্তুর উদ্ভব হয়, এবং সেগুলি আবার ব্রহ্মেই লোপ পায় (মুণ্ডকোপনিষদ-২/১/১)।
এভাবে আরো বিভিন্ন উপনিষদ থেকেও অজস্র নমুনা-উদাহরণ টানা যেতে পারে হয়তো। কিন্তু সত্য সন্ধানী হিসেবে উপনিষদীয় ঋষিরা যে পরম সত্তার উপলব্ধির প্রকাশ ঘটিয়েছেন সেগুলিতেও বর্ণনা বা উপস্থাপনার ভিন্নতা ছাড়া বিষয়গত ঐক্যে খুব একটা পার্থক্য পাওয়া যায় না। এই পরম সত্তাকে উপনিষদে কখনো ব্রহ্ম, কখনো আত্মা, কখনো ভগবান, কখনো বা সৎ বলে অভিহিত করা হয়েছে। তবে বিভিন্ন ঋষির চৈতন্যে উপলব্ধ সত্যকে যদি এক বলেও ধরে নেওয়া হয়, তবুও তাদের উপলব্ধির বা অনুভূতির রূপ যে সব সময় এক হবে এমন কথা নেই। বস্তুতপক্ষে পরম সত্য বা তত্ত্ব যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ঋষির কাছে বিভিন্ন প্রকারে ধরা দিয়েছে, তা প্রমাণিত হয় বিভিন্ন উপনিষদের বিভিন্ন উক্তি থেকে। মূলত, উপনিষদগুলিতে দার্শনিক তত্ত্বাবলী আলোচিত হলেও সে-আলোচনা বহুলাংশেই বিক্ষিপ্ত ও অস্পষ্ট। তাছাড়া এ-আলোচনা যুক্তিতর্কমূলক সুসংবদ্ধ দার্শনিক আলোচনা নয় এবং নানা উপনিষদে নানা রকম আলোচনার মধ্যে ঠিক কোন্ তত্ত্বকে প্রকৃত উপনিষদ-প্রতিপাদ্য তত্ত্ব বলা হবে সে-কথা নির্ণয় করাও সহজ নয়। পরমাত্মা বা পরমব্রহ্মই যদিও সাধারণভাবে উপনিষদের প্রতিপাদ্য বিষয়, তবুও বিভিন্ন উপনিষদে একধরনের সপ্রপঞ্চ ব্রহ্মবাদ, নিষ্প্রপঞ্চ ব্রহ্মবাদ, ব্রহ্মপরিণামবাদ, ব্রহ্মবিবর্তবাদ প্রভৃতি ভিন্ন ভিন্ন মতবাদের উন্মেষ ও পরিচয় পাওয়া যায় এবং ব্রহ্ম, জীব ও জগতের পারস্পরিক সম্বন্ধ, এমনকি জীবনের লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য হিসেবে মোক্ষের স্বরূপ ও উপায় নিয়েও বিভিন্ন সিদ্ধান্ত লক্ষ্য করা যায়।
কিন্তু বিভিন্ন বিষয়ে উপলব্ধ সত্য সম্পর্কে সৃষ্ট উপনিষদীয় ব্যাখ্যা ও সিদ্ধান্তের ভিন্নতার কারণে উদ্ভূত বিরোধ উপনিষদীয় সত্য সম্পর্কে সন্দেহের পাশাপাশি তৎকালীন ভারতীয়দের মনে ব্রাহ্মণের কর্মকাণ্ডই নয়, উপনিষদীয় অধ্যাত্ম-দর্শনের প্রভাবকেও স্পষ্টতই দুর্বল করে দিয়েছিলো। এসব দুর্বলতার পাশাপাশি যুক্তির উপর গড়ে ওঠা অন্যান্য ভিন্নমতবাদীদের তীক্ষ্ণ তর্কের আঘাতে উপনিষদীয় দর্শন পরাস্ত হবার উপক্রম হয়। ফলে, কালক্রমে বিভিন্ন উপনিষদে প্রকাশিত বিভিন্ন তত্ত্বের এই বিরোধ যে আপাত এবং বিভিন্ন উপনিষদের মধ্যে যে একটি মূলগত ঐক্য আছে, তা প্রতিষ্ঠা করার প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়। এরই ফলস্বরূপ কিছু যুক্তিনির্ভর অধ্যাত্ম-দর্শন সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়। ন্যায়, বৈশেষিক, যোগ এবং সাংখ্য দর্শনের মাধ্যমে তাঁরা তাঁদের সাধ্যমতো যুক্তিসম্মত সিদ্ধান্তের উত্তর দেয়ার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তাও যথেষ্ট ছিলো না। বৈদিক জ্ঞান ও কর্মকাণ্ড থেকে উত্থিত বিরোধ ও শঙ্কার উত্তর তাঁরা দিতে না পারলে যে ব্রাহ্মণ্যধর্মের অসারতাই প্রমাণ হয়ে যায়। বেদান্ত-সম্প্রদায়ের প্রধানতম প্রচেষ্টাই হলো উপনিষদ-প্রতিপাদ্য তত্ত্বেও দার্শনিক ব্যাখ্যা ও সমর্থন। স্বভাবতই, উপনিষদের অনুগামী পরবর্তী দার্শনিকেরা উপনিষদ-প্রতিপাদ্য মূল দার্শনিক তত্ত্বকে সনাক্ত করবার দায়িত্ব গ্রহণ করলেন এবং এই তত্ত্বের সুসংবদ্ধ দার্শনিক ব্যাখ্যা দিতে চাইলেন। ফলে তাঁদের স্বধর্মকে রক্ষা করার তাগিদে উপনিষদগুলির মধ্যে নিহিত চিন্তাগুলিকে সুশৃঙ্খলভাবে সংবদ্ধ করার প্রয়োজনে এগিয়ে আসেন মহর্ষি বাদরায়ণ তাঁর ব্রহ্মবাদী সূত্রগ্রন্থ ‘ব্রহ্মসূত্র’ নিয়ে। এই ব্রহ্মসূত্রই বেদান্ত দর্শনের সূত্রগ্রন্থ এবং তা বেদান্তসূত্র নামেও পরিচিত।
বেদান্তের এই ক্রমবিকাশে ব্রহ্ম-সূত্র বা বেদান্ত-সূত্রের সংকলক বাদরায়ণই যে শুধু উপনিষদের দার্শনিক চিন্তাকে সংবদ্ধ করার চেষ্টা করেছিলেন তা নয়। এই ব্রহ্মসূত্রেই দেখতে পাওয়া যায় যে, তখন বেদান্তের আরও বহু শাখা এবং সেই সব মতবাদের বহু অনুগামীও ছিলেন। ঔডুলোমি, কাশকৃৎস্ন, বাদরি, জৈমিনি, কার্ষ্ণাজিনি, আষ্মরথ্য প্রমুখ আরও বহু নামের উল্লেখ ব্রহ্মসূত্রেই পাওয়া যায়। তবে এ বিষয়ে বাদরায়ণের সূত্র সংকলনকেই সর্বশেষ এবং সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মনে করা হয়। কেননা ব্রহ্মসূত্রকে বাদ দিয়ে ব্রহ্মবাদী মতবাদ ব্রহ্মবাদ প্রতিষ্ঠার কথা অচিন্ত্যনীয়ই বলা যায়।
…
(চলবে…)
…
[আগের পর্ব : ভূমিকা] [*] [পরের পর্ব : ব্রহ্মসূত্র]
…
No comments:
Post a Comment