|বেদান্তদর্শন-ব্রহ্মবেদান্ত-২৫: অ-ঋষিপ্রোক্ত ঈশ্বরবাদী দর্শন-মত খণ্ডন|
রণদীপম বসু
…
৩.২ : অ-ঋষিপ্রোক্ত দর্শন খণ্ডন-
আর্য-সম্মানহীন
দর্শনগুলিই মূলত অ-ঋষিপ্রোক্ত দর্শন। এসব দর্শনের প্রতিস্থাপক
ঋষি-শ্রেণীভুক্ত নন। অ-ঋষিপ্রোক্ত দর্শনেও দুটি ভাগ রয়েছে- ঈশ্বরবাদী ও
নিরীশ্বরবাদী।
(ক) ঈশ্বরবাদী দর্শন খণ্ডন :
আগেই বলা হয়েছে যে, সম্ভবত আর্যদের ভারতে আসার আগেই এতদঞ্চলে পাশুপত ও পাঞ্চরাত্র দর্শনের উদ্ভব। কিন্তু এ দর্শনগুলি ঈশ্বরবাদী হওয়া সত্ত্বেও অ-ঋষিপ্রোক্ত হওয়ায় সেগুলিকে বৈদিক আর্যক্ষেত্রে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখা হয়নি। কেননা, এগুলি অনার্য দর্শন। কিন্তু বাদরায়ণের সমকালীন ও লোকপরম্পরায় বহুল চর্চিত ও প্রচলিত দর্শন হিসেবে সেগুলিকে খণ্ডনের প্রয়োজন হয়েছিলো।
(ক) ঈশ্বরবাদী দর্শন খণ্ডন :
আগেই বলা হয়েছে যে, সম্ভবত আর্যদের ভারতে আসার আগেই এতদঞ্চলে পাশুপত ও পাঞ্চরাত্র দর্শনের উদ্ভব। কিন্তু এ দর্শনগুলি ঈশ্বরবাদী হওয়া সত্ত্বেও অ-ঋষিপ্রোক্ত হওয়ায় সেগুলিকে বৈদিক আর্যক্ষেত্রে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখা হয়নি। কেননা, এগুলি অনার্য দর্শন। কিন্তু বাদরায়ণের সমকালীন ও লোকপরম্পরায় বহুল চর্চিত ও প্রচলিত দর্শন হিসেবে সেগুলিকে খণ্ডনের প্রয়োজন হয়েছিলো।
(১) পাশুপত মত খণ্ডন : শিবের আরেক নাম পশুপতি। পাশুপতরা শিব ও শিবলিঙ্গকেই ইষ্টদেবতা বলে মানতেন। শিব শব্দটি যদিও বৈদিক, কিন্তু যে লিঙ্গ চিহ্নকে (অর্থাৎ পুরুষ জননেন্দ্রিয়) সামনে রেখে শিবপূজা করা হয়, রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে- ‘তা মহেঞ্জোদড়ো যুগের (এখন থেকে ৫০০০ বছর পূর্বেকার) অনার্যকাল থেকে চলে আসছে; এবং এমন একটা সময়ও ছিল যখন লিঙ্গপূজা করার জন্য অনার্যদের ‘শিশ্নদেব’ বলে অপমানও করা হতো। কিন্তু যুগের হাওয়ায় যা এক সময় অপমানকর তা পরে সম্মানজনক বলে অভিহিত হতেও দেখা যায়। এই লিঙ্গ-পূজা-ধর্ম কালান্তরে পাশুপত (= শৈব) মতের রূপে বিকশিত হয়েছিল, এবং এর দার্শনিক সিদ্ধান্তও প্রস্তুত হয়েছিল। আজ যদিও শৈবগণ পাশুপতের অধিকারী, তথাপি দর্শনক্ষেত্রে তাঁরা শঙ্করের মায়াবাদী অদ্বৈতবাদেরই অনুসরণ করেছেন।’- (দর্শন-দিগদর্শন-২, পৃষ্ঠা-১৯০)।
বাদরায়ণের যুগে পাশুপতদের নিজস্ব এক দর্শন ছিলো, যার খণ্ডন করতে গিয়ে বাদরায়ণকে কয়েকটি সূত্র রচনা করতে হয়েছিলো। বর্তমানের আর্য-সমাজীদের মতো পাশুপতও ত্রৈতবাদ- জীব (মানে পশু), জগৎ ও ঈশ্বর (মানে পশুপতি)-কে মানতেন। বাদরায়ণের বেদান্ত মতে ব্রহ্ম (ঈশ্বর) হলেন জগতের নিমিত্ত ও উপাদান উভয় কারণ। কিন্তু পাশুপত মতে, পশুপতি (ঈশ্বর) হলেন জগতের নিমিত্ত কারণ এবং তিনিই প্রধান ও জীবাত্মাগুলির নিয়ন্তা, যাঁরা তাঁর থেকে ভিন্ন। তাই পাশুপত দর্শনের বিরুদ্ধে বাদরায়ণের প্রথম আপত্তি হলো যে তা বেদ বা শ্রুতি বিরুদ্ধ। এই মতবাদ গ্রহণীয় নয়। ফলে বেদান্তসূত্রে বাদরায়ণ বলেন-
‘পত্যুঃ, অসামঞ্জস্যাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৩৭)।।
ভাবার্থ : (পাশুপত দর্শন মতে) ঈশ্বর জগতের নিমিত্তকারণ মাত্র, উপাদানকারণ নন- শ্রুতিবিরুদ্ধ এই মতবাদ গ্রহণীয় নয় (ব্রঃ-২/২/৩৭)।
কেননা,
পাশুপতদের এই মত গ্রহণ করলে অসঙ্গতির সম্মুখীন হতে হয়। কিভাবে ? এই মত
গ্রহণ করলে ঈশ্বরের উপর পক্ষপাতিত্বদোষ আরোপ করা হয়; কারণ তিনি তাহলে এই
জগতে কারো প্রতি সদয় হয়ে সুখী করেছেন এবং অন্যের প্রতি নিষ্ঠুর হয়ে তাদেরকে
অসুখী করেছেন, ধরে নিতে হয়। বেদান্তবাদী বাদরায়ণের মতে, ঈশ্বর নিরপেক্ষ,
সমদর্শী- কিন্তু তিনি জীবগণকে তাদের পূর্বকৃত কর্মের শুভাশুভ ফলানুসারে
নিয়ন্ত্রণ করেন (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩৪-৩৫)। কারণ এটাই শাস্ত্রসম্মত, এবং যদি এ
বিষয়ে শাস্ত্রের প্রামাণ্যকে মান্য করা হয়, তাহলে ‘বহু স্যাং প্রজায়েয়
ইতি’ অর্থাৎ ‘আমি বহু হবো’- (তৈত্তিরীয়-২/৬) এই উপনিষদীয় শ্রুতিবচনকে সত্য
বলে গ্রহণ করতে হবে। এই শ্রুতি থেকেই প্রমাণিত হয় যে, ঈশ্বর জগতের
অভিন্ন-নিমিত্তোপাদান।
আবার, ঈশ্বর যেহেতু অংশরহিত, এবং প্রধান ও জীবাত্মাগুলিও সেইরূপ, সেজন্য ঈশ্বর এবং তাদের মধ্যে কোন সম্বন্ধস্থাপন সম্ভব নয়। কার্যত সেকারণেই এরা ঈশ্বরকর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। অথবা ঈশ্বর ও জীবের মধ্যে পরম্পরাগত অবিচ্ছেদ্য অংশ-অংশী ভাব, দ্রব্য এবং তার অবিচ্ছেদ্য গুণগত ভাব ইত্যাদি সম্পর্কও স্থাপন করা সম্ভব হয় না। বেদান্ত-মত গ্রহণ করলে কিন্তু এজাতীয় আপত্তি উঠতে পারে না। কারণ বেদান্ত মতে এই সম্বন্ধ হলো অনির্বচনীয়-তাদাত্ম্য, এবং প্রামাণ্য বিষয়ে বেদান্তীরা শ্রুতি-নির্ভর। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-
আবার, ঈশ্বর যেহেতু অংশরহিত, এবং প্রধান ও জীবাত্মাগুলিও সেইরূপ, সেজন্য ঈশ্বর এবং তাদের মধ্যে কোন সম্বন্ধস্থাপন সম্ভব নয়। কার্যত সেকারণেই এরা ঈশ্বরকর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। অথবা ঈশ্বর ও জীবের মধ্যে পরম্পরাগত অবিচ্ছেদ্য অংশ-অংশী ভাব, দ্রব্য এবং তার অবিচ্ছেদ্য গুণগত ভাব ইত্যাদি সম্পর্কও স্থাপন করা সম্ভব হয় না। বেদান্ত-মত গ্রহণ করলে কিন্তু এজাতীয় আপত্তি উঠতে পারে না। কারণ বেদান্ত মতে এই সম্বন্ধ হলো অনির্বচনীয়-তাদাত্ম্য, এবং প্রামাণ্য বিষয়ে বেদান্তীরা শ্রুতি-নির্ভর। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-
‘সম্বন্ধানুপপত্তেশ্চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৩৮)।।
ভাবার্থ : ঈশ্বর এবং জীবের মধ্যে কোন সম্বন্ধ সম্ভবপর না হওয়ায় (পাশুপতদের) এই মত গ্রহণীয় নয় (ব্রঃ-২/২/৩৮)।
পাশুপতগণ ঘড়া বা গৃহরূপী কার্যের অধিষ্ঠাতা হিসেবে কুম্ভকার ইত্যাদির মতো জগতেরও কোন অধিষ্ঠাতা আছেন, এভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অনুমান করেন। কিন্তু বাদরায়ণের মতে এরকম অনুমানের দ্বারা ঈশ্বরের সত্তাকে সিদ্ধ করা যায় না। কেননা, নিরাকার ঈশ্বরকে অধিষ্ঠাতা বলে সিদ্ধ করা যায় না। এবং প্রধান ইত্যাদি মৃৎপিণ্ডের ন্যায় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য পদার্থ নয়, সুতরাং ঈশ্বর তাদেরকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন না। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-
‘অধিষ্ঠানানুপপত্তেশ্চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৩৯)।।
ভাবার্থ : (পাশুপত মতে) ঈশ্বর অধিষ্ঠান (উপাদান-কারণ) না হওয়ার জন্য (তার পক্ষে) নিয়ন্ত্রিত্ব অসম্ভব (ব্রঃ-২/২/৩৯)।
এ প্রেক্ষিতে পাশুপতরা বলেন, নিরাকর জীব (আত্মা) যেমন ইন্দ্রিয়, শরীর ইত্যাদির অধিষ্ঠাতা, এগুলিকে পরিচালনা করেন- পশুপতি ঈশ্বরও তেমনি প্রধান প্রভৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করেন বলে অনুমান করি। এই যুক্তি খণ্ডনে বাদরায়ণ বলেন, উপমাটি যথার্থ নয়, কারণ জীবের ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, জীব সুখ-দুঃখাদির ভোক্তা, ফল-ভোগাদির কারণে জীবকে অধিষ্ঠাতা হতে হয়। কর্ম-বন্ধন-মুক্ত পশুপতিকে ফল ভোগ করতে হয় না, তার শরীর ধারণ করারও প্রয়োজন নেই। আর যদি পশুপতির ভোগ ইত্যাদি আছে বলে মানা হয় তবে তাঁকে সান্ত বা সসীম এবং অ-সর্বজ্ঞ বলে মানতে হবে। তাই বেদান্তসূত্রে বাদরায়ণ বলেন-
‘করণবৎ চেৎ, ন, ভোগাদিভ্যঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৪০)।।
‘অন্তবত্ত্বম্ অসর্বজ্ঞতা বা’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৪১)।।
ভাবার্থ :
জীব অশরীরী হয়েও ইন্দ্রিয়সমূহের অধিষ্ঠাতারূপে যেমন ভোগ করে, ঈশ্বরও সেইরূপ প্রকৃতিতে অধিষ্ঠান করেন- যদি এরূপ বলা হয়- তা ঠিক নয়, কারণ জীব ভোক্তা নয় (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৪০)। তা হলে ঈশ্বরও জীবের ন্যায় জন্ম-মৃত্যুর অধীন এবং অসর্বজ্ঞ হয়ে পড়েন। অতএব পাশুপতমত অগ্রাহ্য (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৪১)।
(২) পাঞ্চরাত্র মত খণ্ডন : পাশুপত মতের ন্যায় পাঞ্চরাত্র মতও প্রাচীন অনার্য ভারতেরই সৃষ্টি। পাশুপতগণ যেমন শিব ও শিবলিঙ্গকেই ইষ্টদেবতা বলে মানতেন, পাঞ্চরাত্রগণ বিষ্ণু-ভগবান-বাসুদেবকে ইষ্টদেবতারূপে আরাধনা করতেন। তাই এঁদেরকে বৈষ্ণব ও ভাগবত নামেও অভিহিত করা হয়। ভাগবত ধর্মের মূল গ্রন্থকেই পাঞ্চরাত্র বলে, তবে তা শুধু একটিমাত্র পুস্তক নয়, গ্রন্থ-সংগ্রহ। এর মধ্যে অহির্বুধন্য, পৌষ্কর, সাত্বত, পরমসংহিতা প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য দুর্লভ গ্রন্থ।
যেভাবে পাশুপতগণের পূজা ও ধর্ম আর শৈবদের পূজা ও ধর্মের রূপে পরিণত হয়েছে (যদিও তার দর্শন সম্পূর্ণ নতুন)- তেমনি পাঞ্চরাত্র ভাগবত ধর্ম বর্তমানের বিষ্ণু-পূজক বৈষ্ণব ধর্মের রূপে পরিণত হয়েছে, রাহুল সাংকৃত্যায়নের মতে- ‘যদিও তা নিজস্ব বৈভবের সময়ে গুপ্তযুগে যতটা পরিবর্তিত হয়েছিল, আজ তা থেকেও তাতে অনেক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে। তবুও বর্তমানের অনেক বৈষ্ণবমতের মধ্যে রামানুজের বৈষ্ণবমত পাঞ্চরাত্র আগমকে শ্রদ্ধার দৃষ্টিতে দেখে এবং একদিক থেকে তার উত্তরাধিকারীও বটে। এ কেমন বিড়ম্বনা? এ সম্প্রদায়ের এক প্রধান প্রবক্তা রামানুজ, বাদরায়ণ কর্তৃক পাঞ্চরাত্র মতের বিরুদ্ধে কঠোর সমালোচনাকে সমর্থন করেছেন, এবং পাঞ্চরাত্র দর্শনের পরিবর্তে বাদরায়ণের দর্শনকে স্বীকার করেছেন !’- (দর্শন-দিগদর্শন-২, পৃষ্ঠা-১৯১)।
পাঞ্চরাত্র বা ভাগবত মতবাদ ঈশ্বরের নিমিত্ত এবং উপাদান উভয় কারণত্বকেই স্বীকার করে। এই মতে বাসুদেবই পরমেশ্বর, এবং জগতের নিমিত্ত ও উপাদান কারণ। বাসুদেবের পূজা করে, তাঁর ধ্যান করে এবং তাঁকে জেনেই জীবের মুক্তি হয়। বাসুদেব থেকেই সঙ্কর্ষণ জীব, জীব থেকে প্রদ্যুম্ন মন, এবং মন থেকে অনিরুদ্ধ অহঙ্কারের জন্ম হয়েছে। এই হলো পরমেশ্বর বাসুদেবের চতুর্ব্যূহচারি বিগ্রহ। এ সম্বন্ধে পরমসংহিতায় বলা হয়েছে-
‘পরমকারণাত্ পরব্রহ্মভূতাত্ বাসুদেবাত্ সংকর্ষণী নাম জীবো জায়তে, সংকর্ষণাত্ প্রদ্যুম্নসংজ্ঞা মনো জায়তেং তস্মাদ্ অনিরুদ্ধসজ্ঞোৎহং কারো জায়তে’।- (পরমসংহিতা)।।
অর্থাৎ : বাসুদেব, সংকর্ষণ, প্রদ্যুম্ন, অনিরুদ্ধ ক্রমান্বয়ে ব্রহ্ম, জীব, মন ও অহঙ্কারেরই নামান্তর। ব্রহ্ম কর্তৃক জীব (সংকর্ষণ) উৎপন্ন হয়, তা থেকে মন ও মন থেকে অহঙ্কার (-পরমসংহিতা)।
পাঞ্চরাত্রের চারটি বিগ্রহের মধ্যে বাসুদেবই যে পরমেশ্বর এবং তাঁকেই পূজা-অর্চনাদি করতে হবে- এসব মতবাদকে বেদান্তবাদীরা স্বীকার করতে পারেন, কারণ তা শ্রুতিবিরুদ্ধ হয় না। কিন্তু বাদরায়ণ জীবের সৃষ্টি ইত্যাদি ব্যাপারকে প্রত্যাখ্যান করেন- কারণ, শ্রুতিতে জীবকে নিত্য বলা হয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/১৭), তার উৎপত্তি সম্ভব নয়। তাই পাঞ্চরাত্রের মত প্রত্যাখ্যান করে বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-
‘উৎপত্তি-অসম্ভবাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৪২)।।
ভাবার্থ : (পুরুষ সংযোগ বিনা শুধু শক্তির দ্বারা) উৎপত্তি অসম্ভব বলে (পাঞ্চরাত্র মতবাদ অগ্রাহ্য) (ব্রঃ-২/২/৪২)।
আবার পাঞ্চরাত্র মতবাদে জীব থেকে অন্তরেন্দ্রিয় বা মনের উৎপত্তি এবং মন থেকে অহং-এর উৎপত্তির কথা বলা হয়েছে। এই মতও প্রত্যাখ্যান করে বাদরায়ণ বলেন, মন হলো কর্তা জীবের (আত্মার) কারণ বা উপায়, এবং কর্তা থেকে কারণ জন্মে না। অতএব জীব (সংকর্ষণ) থেকে মনের উৎপত্তির কথা বলা ভুল এবং এ বিষয়ে কোন শ্রুতি-প্রমাণও নেই। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-
‘ন চ কর্তুঃ করণম্’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৪৩)।।
ভাবার্থ : পুরুষ ইন্দ্রিয়াদি করণবিহীন। এরূপ কোথাও দৃষ্ট হয় না যে, কর্তা থেকে করণের সৃষ্টি হয়েছে (ব্রঃ-২/২/৪৩)।
অবশ্য একইসাথে বাদরায়ণ তাও বলেন যে, যদি বাসুদেবকে আদি চৈতন্য বলে গ্রহণ করা হয় তাহলে পাঞ্চরাত্রের মত নিষিদ্ধ নয়। কিন্তু পরস্পর-বিরোধী কথার জন্যেও পাঞ্চরাত্র দর্শন ত্যাজ্য। কেননা, ভাগবতগণ বলতে পারেন যে, বিশ্বের সব কিছুই বাসুদেব ভগবানের মূর্তি এবং সব কিছুই সমানভাবেই ঈশ্বরের জ্ঞান, কর্তৃত্ব, শক্তি, সাহস ইত্যাদি সম্পন্ন এবং দোষ ও অপূর্ণতা থেকে মুক্ত। কিন্তু এরূপ মনে করলে একাধিক ঈশ্বরকে স্বীকার করতে হয়; যা বাহুল্য-সমন্বিত এবং স্বসিদ্ধান্ত-বিরোধী। কেননা তার সব কিছুই মেনে নিলেও একটি থেকে আরেকটির উৎপত্তি ব্যাপারটি অচিন্তনীয় হয়ে দাঁড়ায়। সর্বতোভাবে সমান বলে এদের কোনোটাই অপর কিছুর কারণ হতে পারবে না; যেহেতু কার্যের মধ্যে এমন কতকগুলি গুণ পাওয়া দরকার যা কারণে অনুপস্থিত। তাছাড়া বাসুদেবের মূর্তি শুধুমাত্র চারটি আকারেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারে না, যেহেতু ‘আব্রহ্মস্তম্ব পর্যন্ত’ সমগ্র জগৎ-ই পরমেশ্বরের বিরাট মূর্তি। অতএব, বেদান্তসূত্রে বাদরায়ণের সিদ্ধান্ত হলো-
‘বিজ্ঞানাদিভাবে বা তদপ্রতিষেধঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৪৪)।।
‘বিপ্রতিষেধাৎ চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৪৫)।।
ভাবার্থ :
যদি স্বীকার করা হয় যে, পুরুষ বিজ্ঞানাদি গুণসম্পন্ন, তা হলেও পূর্বের আপত্তির প্রতিবিধান হয় না (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৪৪)। ভাগবত (শক্তি কারণাদি বাদ) বেদাদি শাস্ত্রসম্মত নয় বলে গ্রহণীয় নয় (ব্র্হ্মসূত্র-২/২/৪৫)।
…
(চলবে…)
…
[আগের পর্ব : অন্যান্য ঋষিপ্রোক্ত দর্শনমত খণ্ডন] [*] [পরের পর্ব : অ-ঋষিপ্রোক্ত নিরীশ্বরবাদী দর্শন-মত খণ্ডন]
…
(চলবে…)
…
[আগের পর্ব : অন্যান্য ঋষিপ্রোক্ত দর্শনমত খণ্ডন] [*] [পরের পর্ব : অ-ঋষিপ্রোক্ত নিরীশ্বরবাদী দর্শন-মত খণ্ডন]
…
No comments:
Post a Comment