|বেদান্তদর্শন-বিশিষ্টাদ্বৈতবেদান্ত-০৩ : রামানুজের মতে জগৎ|
রণদীপম বসু
…
৩.০ : রামানুজের মতে জগৎ
রণদীপম বসু
…
৩.০ : রামানুজের মতে জগৎ
বেদান্তসূত্রের
ভাষ্য গ্রন্থ হিসেবে রচিত শ্রীভাষ্যে আচার্য রামানুজ তাঁর বিশিষ্টাদ্বৈত
মতবাদে তিনটি তত্ত্ব স্বীকার করেছেন- ব্রহ্ম বা ঈশ্বর, চিৎ বা আত্মা এবং
অচিৎ বা জড়। তাঁর মতে ঈশ্বরই সর্বোচ্চ তত্ত্ব। কিন্তু ঈশ্বর একমাত্র
তত্ত্ব নন। ঈশ্বরের দুটি অংশ- চিৎ এবং অচিৎ। অর্থাৎ ভেদের দিক থেকে তত্ত্ব
তিনটি- চিৎ, অচিৎ ও ব্রহ্ম। কিন্তু অভেদের দিক থেকে তত্ত্ব কেবলমাত্র একটি
এবং তা হলো চিৎ-অচিৎ বিশিষ্ট ব্রহ্ম। ব্রহ্ম বা ঈশ্বরই পরম সত্তা এবং চিৎ ও
অচিৎ হলো ব্রহ্মের দুটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
রামানুজের মতে ব্রহ্মের চিৎ অংশ থেকে জীব এবং অচিৎ অংশ থেকে জড় বস্তুর সৃষ্টি। সুতরাং ব্রহ্ম অংশী বা বিশেষ্য এবং চিৎ ও অচিৎ ব্রহ্মের অংশ বা বিশেষণ। অংশ ও অংশী সম্পূর্ণভাবে অভিন্ন নয়, আবার সম্পূর্ণভাবে ভিন্নও নয়। তাদের মধ্যে যে অভেদ, তা হলো বিশিষ্ট অভেদ, আত্যন্তিক অভেদ নয়। এ কারণেই রামানুজের মতবাদকে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ বলা হয়।
রামানুজের মতে ব্রহ্ম বা ঈশ্বর যেহেতু যথার্থই জগৎ-স্রষ্টা, তাই সৃষ্ট-জগৎ যথার্থই সত্য। তাঁর মতে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর তাঁর মঙ্গলময় ইচ্ছাশক্তির দ্বারা তাঁর নিজের মধ্য থেকে জীব ও জড় সমন্বিত এই জগৎ সৃষ্টি করেন। মাকড়সা যেমন তার অভ্যন্তর থেকে তন্তু বের করে জাল বোনে, ঈশ্বরও তেমনি তাঁর চিৎ অংশ থেকে জীবজগৎ এবং অচিৎ অংশ থেকে জড়জগৎ সৃষ্টি করেন। জড় অচিৎ এবং চেতন জীবাত্মাগুলি ঈশ্বরেই বিধৃত। ঈশ্বর জগতের উপাদান ও নিমিত্তকারণ। ঈশ্বরের চিৎ অংশ জীবের এবং অচিৎ অংশ জগতের উপাদান কারণ। আবার ঈশ্বর জীব ও জগতের নিমিত্তকারণ। কারণ তিনিই জীব ও জগতের আবির্ভাব নিয়ন্ত্রণ করেন। সৃষ্টির পূর্বে জীব ঈশ্বরের চিৎ অংশে এবং জড়জগৎ ঈশ্বরের অচিৎ অংশে অব্যক্ত রূপে বর্তমান থাকে।
রামানুজের মতে ব্রহ্মের চিৎ অংশ থেকে জীব এবং অচিৎ অংশ থেকে জড় বস্তুর সৃষ্টি। সুতরাং ব্রহ্ম অংশী বা বিশেষ্য এবং চিৎ ও অচিৎ ব্রহ্মের অংশ বা বিশেষণ। অংশ ও অংশী সম্পূর্ণভাবে অভিন্ন নয়, আবার সম্পূর্ণভাবে ভিন্নও নয়। তাদের মধ্যে যে অভেদ, তা হলো বিশিষ্ট অভেদ, আত্যন্তিক অভেদ নয়। এ কারণেই রামানুজের মতবাদকে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ বলা হয়।
রামানুজের মতে ব্রহ্ম বা ঈশ্বর যেহেতু যথার্থই জগৎ-স্রষ্টা, তাই সৃষ্ট-জগৎ যথার্থই সত্য। তাঁর মতে সর্বশক্তিমান ঈশ্বর তাঁর মঙ্গলময় ইচ্ছাশক্তির দ্বারা তাঁর নিজের মধ্য থেকে জীব ও জড় সমন্বিত এই জগৎ সৃষ্টি করেন। মাকড়সা যেমন তার অভ্যন্তর থেকে তন্তু বের করে জাল বোনে, ঈশ্বরও তেমনি তাঁর চিৎ অংশ থেকে জীবজগৎ এবং অচিৎ অংশ থেকে জড়জগৎ সৃষ্টি করেন। জড় অচিৎ এবং চেতন জীবাত্মাগুলি ঈশ্বরেই বিধৃত। ঈশ্বর জগতের উপাদান ও নিমিত্তকারণ। ঈশ্বরের চিৎ অংশ জীবের এবং অচিৎ অংশ জগতের উপাদান কারণ। আবার ঈশ্বর জীব ও জগতের নিমিত্তকারণ। কারণ তিনিই জীব ও জগতের আবির্ভাব নিয়ন্ত্রণ করেন। সৃষ্টির পূর্বে জীব ঈশ্বরের চিৎ অংশে এবং জড়জগৎ ঈশ্বরের অচিৎ অংশে অব্যক্ত রূপে বর্তমান থাকে।
জগৎ সৃষ্টির ব্যাখ্যায় রামানুজ পরিণামবাদের সমর্থক। তাঁর মতে এই জগতের যাবতীয় জড় বস্তুর মূল উৎস হলো অচিৎ। এই অচিৎকেই ‘প্রকৃতি’ বলা হয়। এই ধরনের চিন্তা যে বিভিন্ন উপনিষদে স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হয়েছে, তা প্রদর্শন করে রামানুজ তাঁর পরিণামবাদী তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। যেমন, শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বলা হয়েছে-
‘অজামেকাং লোহিতশুক্লকৃষ্ণাং বহ্বীঃ প্রজাঃ সৃজমানাং সরূপাঃ।
অজো হ্যেকো জুষমাণঃ অনুশেতে জহাত্যেনাং ভুক্তভোগাম্ অৎঃ অন্যঃ’।। (শ্বেতাশ্বতর-৪/৫)
‘মায়াং তু প্রকৃতিঃ বিদ্যাৎ মায়িনং চ মহেশ্বরম্ ।
তস্য অবয়বভূতৈঃ তু ব্যাপ্তং সর্বমিদং জগৎ’।। (শ্বেতাশ্বতর-৪/১০)
অর্থাৎ :
প্রকৃতি (ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ) নিজের মতোই অনেক জীব সৃষ্টি করে। তারা কেউ বা লাল (রজঃ গুণাত্মক), কেউ বা সাদা (সত্ত্ব গুণাত্মক) আবার কেউ কালো (তমঃ গুণাত্মক) (অর্থাৎ, তারা আগুন, জল আর মাটি দিয়ে তৈরি)। একজন অজ্ঞান জীব এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতের প্রতি আকৃষ্ট হয় এবং তা ভোগ করে। কিন্তু আরেকজন বুদ্ধিমান এবং বিচারশীল ব্যক্তি পূর্ব পূর্ব অভিজ্ঞতার দরুন তিনি বুঝেছেন যে এই স্থূল জগৎ ক্ষণস্থায়ী; সেই কারণেই তিনি এই জগৎকে ত্যাগ করেন (শ্বেতাশ্বতর-৪/৫)।
প্রকৃতি হলো সেই উপাদান যা দিয়ে জগৎ নির্মিত। প্রকৃতিকে মায়া বলে এবং মহেশ্বর (তথা ব্রহ্মকে) মায়াধীশ বলে জানবে। এই বিশ্বচরাচর মহেশ্বরের দেহ। অর্থাৎ ব্রহ্ম সর্বত্র এবং সর্বজীবে বিরাজিত (শ্বেতাশ্বতর-৪/১০)।
শ্রুতির মতো পুরাণ ও স্মৃতিশাস্ত্রগুলিতেও প্রকৃতিকে জড়জগতের উৎসরূপে গণ্য করা হয়েছে। আবার সাংখ্যদার্শনিকরাও প্রকৃতিকে অজা অর্থাৎ যার জন্ম নেই বলেছেন এবং প্রকৃতিকেই জগতের কারণরূপে অভিহিত করেছেন। কিন্তু সাংখ্যদর্শন প্রকৃতিকে ঈশ্বরের অংশরূপে স্বীকার করেনি। সাংখ্যমতে প্রকৃতি স্বনির্ভর, নিত্য এবং সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ গুণের সমন্বয়ে গঠিত একটি স্বতন্ত্র সত্তা। আর রামানুজের মতে প্রকৃতি নিত্য ও ত্রিগুণাত্মক, কিন্তু স্বনির্ভর সত্তা নয়। তাঁর মতে প্রকৃতি ব্রহ্ম বা ঈশ্বরের অংশ এবং ঈশ্বর কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। বিভিন্ন আকৃতির স্বর্ণালঙ্কার যেমন স্বর্ণ-নির্ভর, তেমনি এই বিচিত্র প্রকৃতি ব্রহ্ম-নির্ভর। মানুষের শরীরকে যেমন তার আত্মা নিয়ন্ত্রণ করে, তেমনি ঈশ্বরও প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণ করেন। ঈশ্বরের কোন অভাব নেই। তাই তিনি কোন অভাব পূরণের জন্য জগৎ সৃষ্টি করেননি। জগৎ সৃষ্টি তাঁর লীলা।
রামানুজ সৎকার্যবাদী ও পরিণামবাদী। তাঁর মতে উৎপত্তির পূর্বে কার্য তার উপাদানকারণের মধ্যে অব্যক্ত অবস্থায় বর্তমান থাকে। সৃষ্টির পূর্বে অচেতন প্রকৃতি ঈশ্বরে লীন হয়ে থাকে এবং সুপ্ত ও অবিভক্ত অবস্থায় অবস্থান করে। ঈশ্বর জীবের পূর্বজন্মের কর্মফল অনুসারে বিচিত্র বস্তু সমন্বিত জগৎ সৃষ্টি করেন। ঈশ্বরের ইচ্ছাতেই সূক্ষ্ম ও অবিভক্ত অচিৎ তিনটি সূক্ষ্ম জড় পদার্থে পরিণত হয়। যথা অগ্নি, জল ও ক্ষিতি বা পৃথিবী। তিনটি সূক্ষ্ম জড় পদার্থ থেকে তিনটি গুণ প্রকাশ পায়- সত্ত্ব, রজো এবং তমো। এই তিনটি সূক্ষ্ম উপাদান ক্রমশ মিলিত হয়ে এই জগতের বিভিন্ন জড় বস্তু উৎপন্ন করে থাকে। এই প্রক্রিয়ার নাম ‘ত্রিবৃৎ-করণ’। জগতের প্রতিটি জড় বস্তুতে এই তিনটি উপাদান বর্তমান থাকে। তাই জগতের প্রতিটি বস্তুই হলো ঐ তিনটি সূক্ষ্ম উপাদানের সংমিশ্রণের ফল।
আবার উপনিষদে বলা হয়েছে- ‘মায়ি নং তু মহেশ্বরম্’ অর্থাৎ ঈশ্বরকে মায়া সৃষ্টির অধিকারী বলা হয়েছে। এই উক্তিটির ভাষ্যে রামানুজ বলেছেন যে, ঈশ্বরের জগৎ সৃষ্টি আমাদের বুদ্ধির অগম্য। ঈশ্বরের সৃষ্ট জগতের মতো তাঁর মায়াশক্তিও সত্য। যাদুকরের যাদু সৃষ্টির কৌশল যেমন আমরা বুঝতে পারি না, তেমনি ঈশ্বরের জগৎ সৃষ্টির কৌশল ও শক্তিকে আমরা বুঝতে পারি না। তাছাড়া ঈশ্বর যে বহু বিচিত্র বস্তু সমন্বিত জগৎ সৃষ্টি করেছেন, সেই জগৎও ইন্দ্রজালের মতোই বিস্ময়কর। তাই উপনিষদে প্রকৃতিকে মায়া এবং ঈশ্বরকে মায়াধীশ বলা হয়েছে।
অদ্বৈতবাদীর ন্যায় রামানুজের বিশিষ্টাদ্বৈতবাদ মায়াকে মিথ্যা বলে না। বিশিষ্টাদ্বৈতমতে মায়া ব্রহ্মের প্রকৃত শক্তি। ব্রহ্ম যেমন সত্য, তেমনি তাঁর জগৎ-সৃষ্টিকারী মায়াশক্তিও সত্য, আবার সৃষ্ট জগৎও সত্য। এই মতে কার্য হলো কারণশক্তির বিকাশ। এই বিকাশকেই বলা হয় পরিণাম। সৃষ্টির পূর্বে চিৎ ও অচিৎ সংকুচিত অব্যক্ত অবস্থায় ব্রহ্মে নিহিত ছিলো। এই অবস্থায় ব্রহ্মকে কারণ-ব্রহ্ম বলা হয়। এই কারণ-ব্রহ্মই জীব ও জগৎরূপে কার্যে পরিণত হয়। জীব ও জগৎ তাই কার্য-ব্রহ্ম। সৃষ্টির আদিতে প্রথম আবির্ভূত হয় মহৎ। তারপর ক্রমশ মহৎ থেকে অহংকার এবং অহংকার থেকে পর্যায়ক্রমে সূক্ষ্মভূত, স্থূলভূত প্রভৃতির সৃষ্টি হয়।
৩.১ : শঙ্করাচার্যের মায়াবাদের বিরুদ্ধে রামানুজের আপত্তি
অদ্বৈতবেদান্তে মায়াশক্তি অনির্বচনীয় ঐশ্বরিক শক্তি। অদ্বৈতবাদী শঙ্করাচার্য মায়াকে মিথ্যা, অবিদ্যা বা অজ্ঞান বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে সগুণ ঈশ্বর কল্পিত এবং মায়া। মায়া সৎও নয়, অসৎও নয়; অনির্বচনীয়। কিন্তু বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজের নিকট মায়া যথার্থই ঐশ্বরিক শক্তি। এই শক্তি মিথ্যা, অজ্ঞান বা অনির্বচনীয় নয়। রামানুজের মতে ব্রহ্ম সগুণ ও সবিশেষ। বিচিত্রার্থ-সৃষ্টিকারী মায়াশক্তির সাহায্যে ঈশ্বর জগৎ সৃষ্টি করেছেন। এভাবে অদ্বৈতবাদীর ‘নিষ্প্রপঞ্চ ব্রহ্মবাদ’ বিশিষ্টাদ্বৈতবাদীর নিকট ‘সপ্রপঞ্চ ব্রহ্মবাদে’ পর্যবসিত হয়েছে।
সপ্তধা অনুপপত্তি :
আচার্য রামানুজ তাঁর ‘শ্রীভাষ্যে’ শঙ্করাচার্যের মায়াবাদের বিরুদ্ধে সাতটি গুরুত্বপূর্ণ আপত্তি উত্তাপিত করেছেন। এই সাতটি আপত্তি ‘সপ্তধা অনুপপত্তি’ নামে পরিচিত। তবে অদ্বৈত বেদান্তীরা ঐসব আপত্তির উত্তরও দিয়েছেন। এই আপত্তি ও উত্তরগুলো নিম্নরূপ-
(১) আশ্রয়ানুপপত্তি : রামানুজের প্রথম অনুপপত্তিটি হলো আশয়ানুপপত্তি। অর্থাৎ, রামানুজের মতে শঙ্করাচার্যসম্মত মিথ্যা মায়া বা অবিদ্যার আশ্রয় উপপন্ন করা যায় না। মায়া শক্তিরূপা বলে এই শক্তির একটি আশ্রয় স্বীকার করা প্রয়োজন। রামানুজের মতে যদি সত্যই মায়া বা অবিদ্যার অস্তিত্ব থাকে, তাহলে প্রশ্ন হলো, মায়া বা অবিদ্যা কোথায় থাকে? কারণ আশ্রয় বা অধিষ্ঠান ছাড়া কোন বিষয়ের অস্তিত্ব থাকতে পারে না। এখন মায়া ব্রহ্মে থাকলে নির্গুণ অদ্বয় ব্রহ্ম স্বগত ভেদসম্পন্ন হয়ে যাবে। অথচ শঙ্করাচার্যের মতে একমাত্র ব্রহ্মই সত্য এবং ব্রহ্ম স্বজাতীয়, বিজাতীয় এবং স্বগত-ভেদ বর্জিত। দ্বিতীয়ত, জ্ঞানবিরোধী অবিদ্যারূপ মায়া ব্রহ্মে অবস্থান করলে ব্রহ্মকে জ্ঞানস্বরূপ ইত্যাদি বলা যাবে না। অথচ শঙ্করাচার্যের মতে ব্রহ্ম জ্ঞানস্বরূপ ও স্বপ্রকাশ। সুতরাং, ব্রহ্ম মায়ার আশ্রয় হলে অদ্বৈতবাদ মিথ্যা মতবাদে পরিণত হবে।
আবার জীবকেও অবিদ্যার আশ্রয়রূপে গণ্য করা যাবে না। কারণ জীব স্বয়ং অবিদ্যার সৃষ্টি বা কার্য। যেহেতু কারণ কখনও নিজের অস্তিত্বের জন্য কার্যের উপর নির্ভর করে না, সুতরাং, ব্রহ্ম বা জীব কেউই অবিদ্যার আশ্রয়রূপে গণ্য হতে না পারায় শঙ্করাচার্যসম্মত মায়া বা অবিদ্যার কোন অস্তিত্ব নেই।
উক্ত আপত্তির উত্তরে অদ্বৈতবেদান্তীরা বলেন যে, জীব এবং ব্রহ্ম উভয়েই অবিদ্যার আশ্রয় হতে পারে। জীবকে অবিদ্যার আশ্রয়রূপে স্বীকার করলে অসুবিধা দেখা দেয় তখনই যখন আমরা একটিকে অন্যটির পূর্ববর্তী ভাবি। কিন্তু জীব ও অবিদ্যাকে যদি আমরা একই জিনিসের দুটি পরস্পর নির্ভরশীল দিক রূপে গণ্য করি, তবে ঐ অসুবিধার সৃষ্টি হয় না। যেমন একটা বৃত্তের পরিধি ও কেন্দ্র বৃত্তেরই দুটি দিক, একটা অন্যটার পূর্ববর্তী নয়। আবার ব্রহ্মকেও অবিদ্যার অধিষ্ঠানরূপে গণ্য করা যায়। মায়া বা অবিদ্যা ব্রহ্মেই অধিষ্ঠিত। ব্রহ্ম মায়ার দ্বারা জগতের সত্যতার ভ্রম উৎপাদন করেন। কিন্তু তিনি জগৎপ্রপঞ্চ সৃষ্টি করে তার দ্বারা প্রভাবিত হন না।
(২) তিরোধানানুপপত্তি : শঙ্করাচার্যের মায়াবাদের বিরুদ্ধে রামানুজের দ্বিতীয় আপত্তিটি হলো তিরোধানানুপপত্তি। তিরোধান শব্দের অর্থ হলো নাশ। শঙ্করাচার্যের মতে স্বয়ং-প্রকাশ ব্রহ্ম মায়াশক্তির দ্বারা আবৃত হন। রামানুজের আপত্তি হলো, এই অদ্বৈতমত স্বীকার করলে ব্রহ্মের স্বরূপ নাশপ্রাপ্ত হবে। কারণ, প্রথমত, স্বয়ং-প্রকাশ ব্রহ্ম মায়ার দ্বারা আবৃত হতে পারেন না। দ্বিতীয়ত, যদি ধরে নেয়া হয় যে, ব্রহ্ম মায়ার দ্বারা আবৃত হন, তাহলে ব্রহ্মকে আর স্বয়ং-প্রকাশ বলা যায় না। অবিদ্যা তাঁর স্বরূপ আবৃত করে বললে ব্রহ্মের স্বরূপ তিরোহিত হবে। কিন্তু স্বপ্রকাশ ব্রহ্মের তিরোধান বা নাশ সম্ভব নয়। সুতরাং, অদ্বৈতমতসম্মত মায়াবাদ গ্রহণযোগ্য নয়। শ্রীভাষ্যে বলা হয়েছে-
‘নিত্যমুক্ত-স্বপ্রকাশজ্ঞানস্বরূপস্যাবিদ্যোপাধি তিরোধানাসম্ভবাৎ। তিরোধানং নাম বস্তুস্বরূপে বিদ্যমানে তৎপ্রকাশনিবৃত্তিঃ। প্রকাশ এব বস্তুস্বরূপম্ ইত্যঙ্গীকারে তিরোধানাভাবঃ স্বরূপনাশো বা স্যাৎ।’- (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/৪/২২)।
অর্থাৎ :
নিত্যমুক্ত ও নিত্যপ্রকাশময় জ্ঞানস্বভাব ব্রহ্মের অবিদ্যা-জনিত আবরণের অপগম সম্ভব হয় না। কেননা, তিরোধান অর্থ- বস্তুর স্বরূপ বিদ্যমান সত্ত্বেও তার প্রকাশ বা প্রতীতিযোগ্যতা নিবৃত্তি, (উচ্ছেদ নয়); অতএব, ‘প্রকাশই ব্রহ্মের স্বরূপ’ একথা স্বীকার করলে হয় আবরণের অভাব, না হয়, ব্রহ্মেরই স্বরূপোচ্ছেদ হয়ে যেতে পারে (শ্রীভাষ্য-ব্রহ্মসূত্র-১/৪/২২)।
এই আপত্তির উত্তরে অদ্বৈতবেদান্তীরা বলেন যে, জীব অবিদ্যার বশীভূত হলে ব্রহ্মকে জানতে পারে না। কিন্তু অবিদ্যার ঐ আবরণের জন্য ব্রহ্মের স্বরূপ নাশ হয় না। কারণ ব্রহ্ম সর্বদাই স্বপ্রকাশ ও স্বয়ং-জ্যোতি। যেমন, মেঘ সূর্যকে আচ্ছন্ন করলে মানুষ সূর্যকে দেখতে পায় না। কিন্তু মেঘের দ্বারা প্রকৃতপক্ষে সূর্য প্রভাবিত হয় না।
(৩) স্বরূপানুপপত্তি : শঙ্করাচার্যের মায়াবাদের বিরুদ্ধে রামানুজের তৃতীয় আপত্তিটি স্বরূপানুপপত্তি নামে পরিচিত। অর্থাৎ, অদ্বৈতমত অনুসারে মায়ার স্বরূপ উপপন্ন করা যায় না। শঙ্করাচার্যের মতে মায়া অজ্ঞান। এখন প্রশ্ন হলো- এই অজ্ঞান জ্ঞানরূপ, না জ্ঞাতারূপ, না জ্ঞেয়রূপ ? মায়া জ্ঞানরূপ হতে পারে না, কারণ মায়াকে জ্ঞান বলা হলে জ্ঞান নিজেই দোষদুষ্ট হয়ে পড়ে। তাছাড়া অদ্বৈতমতে একমাত্র ব্রহ্মই জ্ঞানরূপ, মায়া জ্ঞানরূপ হতে পারে না। জ্ঞানকে দোষদুষ্ট বলা হলে তার মূলে অপর একটি জ্ঞান এবং সেই জ্ঞানের মূলে অপর একটি জ্ঞান স্বীকারে অনবস্থা দোষ দেখা দেয়। মায়া জ্ঞাতা হতে পারে না, কারণ মায়া চেতন নয়। আবার মায়া জ্ঞেয়ও হতে পারে না, কারণ অজ্ঞানরূপ মায়াকে জ্ঞেয় বলা হলে জ্ঞান ও জ্ঞেয় সমানাধিকরণ হয়ে পড়ে। কিন্তু জ্ঞান ও জ্ঞেয় বিরুদ্ধস্বভাব হওয়ায় এদের মধ্যে সামানাধিকরণ্য সম্ভব নয়, অর্থাৎ একই অধিকরণ বা অধিষ্ঠানে পরস্পরবিরোধী দুয়ের অবস্থান থাকতে পারে না। যেহেতু জ্ঞান, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় বিলক্ষণ কোন বস্তু থাকতে পারে না, অতএব মায়া স্বরূপতই অসিদ্ধ।
আবার অন্যভাবে বললে, শঙ্করাচার্যের অদ্বৈত মতানুসারে স্বপ্রকাশ চৈতন্য জ্ঞাতাও নয়, আবার জ্ঞেয়ও নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও ঐ স্বপ্রকাশ চৈতন্য নিজের অভ্যন্তরস্থিত দোষের জন্য নিজেকে জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়রূপে দেখে। রামানুজের প্রশ্ন হলো, ঐ দোষ সত্য, না মিথ্যা? ঐ দোষ সত্য নয় কেননা দোষের সত্যতা স্বীকার করা হয়নি। আবার ঐ দোষ মিথ্যাও নয়। কারণ যদি ঐ দোষ মিথ্যা হয়, তাহলে ঐ দোষটি জ্ঞাতা বা দ্রষ্টা, জ্ঞেয় বা দৃশ্য, কিংবা জ্ঞান বা দৃষ্টিরূপে গণ্য হবে। কিন্তু ঐ দোষ দ্রষ্টা, দৃশ্য ও দৃষ্টির কোনটিই নয়। আবার দ্রষ্টা, দৃশ্য ও দৃষ্টিকে যদি মিথ্যারূপে গণ্য করা হয়, তাহলে তাদের মিথ্যাত্বের ব্যাখ্যার জন্য আরও একটি দোষ স্বীকার করতে হবে। এইভাবে অনবস্থা দোষের সৃষ্টি হবে। সুতরাং, মায়ার স্বরূপ উপপন্ন করা যায় না।
এই আপত্তির উত্তরে অদ্বৈতবেদান্তীরা বলেন যে, উক্ত দোষ জ্ঞানেরই বিষয়। বস্তুত অদ্বৈতবেদান্তমতে মায়া বা অবিদ্যা (জীবরূপ) সাক্ষী-চৈতন্যের বিষয়। কিন্তু অবিদ্যা জ্ঞাতাও নয়, জ্ঞানও নয়। যদিও মায়া বা অবিদ্যা ভ্রমাত্মক, তবুও অনাদি স্বনির্বাহকরূপে মায়া নিজেই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করে। নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য মায়া অন্য কোন দোষের অপেক্ষা করে না। সুতরাং, মায়া অনাদি বলে অনবস্থা দোষের আশঙ্কা নেই।
(৪) অনির্বচনীয়ত্বানুপপত্তি : শঙ্করের মায়াবাদের বিরুদ্ধে রামানুজের চতুর্থ আপত্তিটিকে বলা হয় অনির্বচনীয়ত্বানুপপত্তি। অর্থাৎ, মায়াকে যে অদ্বৈতবাদীরা অনির্বচনীয় বলেছেন, তা উপপন্ন করা যায় না। অদ্বৈতমতে মায়া সৎ নয়, যেহেতু মায়ার পারমার্থিক সত্তা নেই। আবার মায়া আকাশ-কুসুমের মতো একেবারে অসৎ বা অলীক নয়। কেননা আমাদের কিছু একটার জ্ঞান হয়। আবার মায়া সদসৎও বলা যায় না, যেহেতু সেটি পরস্পরবিরোধী ধর্ম। এইজন্য অদ্বৈতমতে মায়া সদসৎ ভিন্ন অনির্বচনীয়। কিন্তু রামানুজ বলেন, জাগতিক বস্তু হয় সৎ হবে কিংবা অসৎ হবে। ঐ দুটি ছাড়া তৃতীয় কোন বিকল্প থাকতে পারে না। সুতরাং, মায়া আছে এবং নেই- একথা বলা স্ববিরোধী। তাই সদসৎ-বিলক্ষণ অনির্বচনীয় বস্তুর ধারণা নিছক কল্পনামাত্র।
কিন্তু এই আপত্তির উত্তরে অদ্বৈতবেদান্তীরা বলেন যে, ‘মায়া সৎ নয় এবং অসৎ নয়’- এরূপ উক্তি স্ববিরোধী নয়। কারণ সৎ অর্থ হলো যা অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ এই কালত্রয়ে বাধিত হয় না। আবার অসৎ অর্থ হলো যা সর্বকালে মিথ্যা।
(৫) প্রমাণানুপপত্তি : অদ্বৈত মায়াবাদের বিরুদ্ধে রামানুজের পঞ্চম আপত্তিটি হলো প্রমাণানুপপত্তি। অর্থাৎ, অবিদ্যা বা মায়ার সমর্থনে প্রমাণ অনুপপন্ন। অদ্বৈতবাদী শঙ্করাচার্যের মতে মায়া ভাবরূপ এবং ‘আমি অজ্ঞ’ প্রভৃতি প্রত্যক্ষ-প্রতীতি ভাবরূপ মায়ার অস্তিত্বের পক্ষে প্রমাণ। রামানুজ এই মতের বিরুদ্ধে আপত্তি উত্থাপন করে বলেছেন, অজ্ঞানরূপ মায়া কখনোই ভাববস্তু হতে পারে না। ‘আমি অজ্ঞ’ এরূপ প্রত্যক্ষ-প্রতীতি অদ্বৈতবাদীর প্রমাণাভাস ছাড়া আর কিছুই নয়। প্রত্যক্ষের দ্বারা কেবলমাত্র কোন বস্তুর অস্তিত্ব বা অভাবকে জানা যায়। ‘অজ্ঞ’ শব্দ অভাববোধক। অভাবরূপ বস্তু প্রত্যক্ষপ্রমাণলভ্য হতে পারে না। দ্বিতীয়ত, অবিদ্যা যেহেতু সৎও নয় আবার অসৎও নয়, তাই অবিদ্যাকে অনুমানের দ্বারা জানা যাবে না। কারণ যে কোন অনুমানে হেতু থাকা অবশ্য প্রয়োজন। কিন্তু ঐ অনুমানে কোন হেতু নেই। তৃতীয়ত, শব্দ প্রমাণের দ্বারাও মায়াকে জানা যায় না। কারণ শ্রুতিতে মায়ার অর্থ হলো ঈশ্বরের সৃজনীশক্তি। এই শক্তিকে শ্রুতি মিথ্যা অনির্বচনীয়রূপে ঘোষণা করেনি। সুতরাং, প্রত্যক্ষ, অনুমান ও শব্দ- কোন প্রমাণের দ্বারাই মায়ার অস্তিত্ব প্রমাণিত হয় না বলে মায়া অসিদ্ধ।
এই আপত্তির উত্তরে অদ্বৈতবাদীরা বলেন যে, অনুমানের দ্বারা মায়া বা অবিদ্যা প্রতিষ্ঠা করা যায় না। অনুমানের দ্বারা অবিদ্যার কেবল ভাবরূপত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। অপরোক্ষ সজ্ঞার দ্বারা সাক্ষী চৈতন্য অনাদি অবিদ্যাকে জানে। সুতরাং, মায়া বা অবিদ্যার বিষয়ে কোন প্রমাণ নেই একথা বলা যায় না।
(৬) নিবর্তকানুপপত্তি : মায়াবাদের বিরুদ্ধে রামানুজের ষষ্ঠ আপত্তিটি নিবর্তকানুপপত্তি নামে পরিচিত। অর্থাৎ, অবিদ্যার নিবর্তক বা নাশক কে, তা উপপন্ন করা যায় না। অদ্বৈতবাদী শঙ্করাচার্যের মতে ব্রহ্মজ্ঞান মিথ্যা মায়ার নিবর্তক। নির্গুণ ব্রহ্মের উপলব্ধির সঙ্গে সঙ্গে অবিদ্যা দূর হয়। কিন্তু রামানুজের আপত্তি হলো, ব্রহ্ম ও মায়া উভয়ই সৎ হওয়ায় ব্রহ্মজ্ঞান মায়ার নিবর্তক হতে পারে না। একটি সৎ বস্তু অপর একটি সৎ বস্তুর নিবর্তক হয় না। উপরন্তু সকল সৎ বস্তুই যেখানে সবিশেষ, সেখানে নির্বিশেষ ব্রহ্মের জ্ঞান কিভাবে মায়ার নিবর্তক হতে পারে? জীবের জ্ঞানও মায়ার নিবর্তক হতে পারে না। জীবের জ্ঞানমাত্রই যখন মায়াপ্রসূত, তখন জীবের জ্ঞানকে মায়ার নিবর্তক বলার প্রশ্নই ওঠে না।
রামানুজ বলেন, জ্ঞান হবার জন্য জ্ঞাতা ও জ্ঞেয়ের মধ্যে পার্থক্য অবশ্য প্রয়োজনীয়। তাছাড়া অবিভক্ত, বৈশিষ্ট্যহীন কোন বিষয়ের জ্ঞান সম্ভব নয়। অতএব অদ্বৈতবেদান্তীদের নির্গুণ ব্রহ্ম বিষয়বিযুক্ত হবার জন্য ব্রহ্মজ্ঞান অসম্ভব। যেহেতু ব্রহ্মজ্ঞান অসম্ভব, সেহেতু অবিদ্যার বিনাশও সম্ভব নয়।
এই আপত্তির উত্তরে অদ্বৈতবেদান্তীরা বলেন যে, শ্রুতিতে নির্গুণ ব্রহ্মের উপলব্ধিকেই অবিদ্যা দূর করার উপায় রূপে ঘোষণা করা হয়েছে। সগুণ ব্রহ্মের উপাসনা ও উপলব্ধি নির্গুণ ব্রহ্মের উপলব্ধির সোপানমাত্র।
(৭) নিবৃত্তানুপপত্তি : শঙ্করাচার্যের মায়াবাদের বিরুদ্ধে বিশিষ্টাদ্বৈতবাদী রামানুজের সর্বশেষ আপত্তিটি হলো নিবৃত্তানুপপত্তি। নিবৃত্তি অর্থ নাশ। রামানুজের মতে অবিদ্যাকে দূর করা অসম্ভব। অদ্বৈতবাদী শঙ্করাচার্যের মতে নির্বিশেষ জ্ঞানের দ্বারা অর্থাৎ, ‘জীব ও ব্রহ্ম এক এবং অভিন্ন’- এই ব্রহ্মজ্ঞানের দ্বারা মায়া বা অবিদ্যা নিবৃত্ত বা দূর হয়। কিন্তু রামানুজ আপত্তি করে বলেন, মায়ার নিবর্তকই যখন অসিদ্ধ, তখন মায়ার নিবৃত্তিরও কোন সম্ভাবনা নেই। রামানুজের মতে ঐরূপ জ্ঞান অসম্ভব। সুতরাং, অবিদ্যার নিবৃত্তি সম্ভব নয়। আর মায়ার নিবৃত্তি সম্ভব না হওয়ায় মায়াকে সৎ বলেই গ্রহণ করতে হবে।
এই আপত্তির উত্তরে অদ্বৈতবেদান্তীদের বক্তব্য হলো, রামানুজের মতে জীবাত্মার বন্ধনের কারণ কর্ম, অবিদ্যা নয়। কিন্তু শ্রুতি ও স্মৃতিতে স্পষ্টই বলা হয়েছে যে মায়ার জন্যই জীবের বন্ধন হয় এবং জ্ঞান কর্মকে বিনষ্ট করে। ব্রহ্মোপলব্ধিরূপ জ্ঞান অবিদ্যাকে নিবৃত্ত করে। অর্থাৎ, ব্রহ্মজ্ঞান হলে কর্ম ক্ষয় হয় এবং অবিদ্যাও নিবৃত্ত হয়। সুতরাং, মায়াবাদের বিরুদ্ধে রামানুজের আপত্তিগুলি যুক্তিযুক্ত নয়।
…
(চলবে…)
…
[আগের পর্ব : রামানুজের মতে ব্রহ্মের ধারণা] [*] [পরের পর্ব : রামানুজের মতে জীবের ধারণা]
…
No comments:
Post a Comment