Friday, March 3, 2017

বেদান্তদর্শন-ব্রহ্মবেদান্ত-২০: বাদরায়ণের দার্শনিকমত- মুক্তিপ্রাপ্তের অন্তিমযাত্রা



| বেদান্তদর্শন-ব্রহ্মবেদান্ত-২০: বাদরায়ণের দার্শনিকমত- মুক্তিপ্রাপ্তের অন্তিমযাত্রা |
রণদীপম বসু

(খ) মুক্তিপ্রাপ্তের অন্তিম যাত্রা-
বলা হয়, ব্রহ্মজ্ঞান প্রাপ্তির পর ভোগোন্মুখ না হলে পূর্বে ও পরে কৃত পাপ-পুণ্য বিনষ্ট হয়, তারা আর ব্রহ্মবিদকে স্পর্শ করতে পারে না। কিন্তু যে পাপ-পুণ্য ভোগোন্মুখ অর্থাৎ প্রারব্ধ হয়ে গেছে সেসব ভোগ করেই মোক্ষলাভ করতে হয়। বাদরায়ণ বলেন-

‘ভোগেন তু ইতরে ক্ষপয়িত্বা সম্পদ্যতে’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/১/১৯)।।
ভাবার্থ : ভোগের দ্বারা পাপ এবং পুণ্য উভয়প্রকার প্রারব্ধ ফল ক্ষয় করে ব্রহ্মজ্ঞ ব্রহ্মের সাথে একত্ব অনুভব করেন। ব্রহ্মবিদ্ ব্রহ্মই হয়ে যান (ব্রঃ-৪/১/১৯)।

এভাবে ভোগের মাধ্যমে সম্পূর্ণ প্রারব্ধ কর্মরাশি নষ্ট বা নিঃশেষ হলে পরই মুক্ত আত্মা ব্রহ্মের সাথে একত্ব লাভ করতে শরীর ত্যাগ করে। মুক্ত আত্মার এই শরীর ত্যাগ একটি ক্রমপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঘটে থাকে। প্রথমে বাক্ বা বাণী মনের মধ্যে লীন হয়, মন প্রাণের মধ্যে লয়প্রাপ্ত হয়, প্রাণ আত্মায় এবং আত্মা মহাভূতে। বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-


‘বাঙ্মনসি, দর্শনাৎ শব্দাৎ চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/২/১)।।
‘অত এব চ সর্বাণি অনু’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/২/২)।।
‘তৎ মনঃ প্রাণে, উত্তরাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/২/৩)।।
‘সঃ অধ্যক্ষে, তদুপগমাদিভ্যঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/২/৪)।।
‘ভূতেষু, তৎ-শ্রুতেঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/২/৫)।।
‘ন একস্মিন্, দর্শয়তো হি’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/২/৬)।।
ভাবার্থ :
মৃত্যুকালে ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের বাগিন্দ্রিয় মনে লয়প্রাপ্ত হয়। এরূপ ঘটনা দৃষ্ট হয়- এবং শ্রুতিও তা-ই বলেন (ব্রহ্মসূত্র-৪/২/১)।  মৃত্যুকালে বাক্-ইন্দ্রিয়ের ন্যায় সকল ইন্দ্রিয়ই একই কারণে মনে লয়প্রাপ্ত হয় (ব্রহ্মসূত্র-৪/২/২)।  মৃত্যুকালে মন যে প্রাণে লয়প্রাপ্ত হয় তা উদ্ধৃত শ্রুতিবচনের পরের অংশ থেকেই জানা যায় (ব্রহ্মসূত্র-৪/২/৩)।  প্রাণ জীবাত্মায় লয়প্রাপ্ত হয়। কারণ, ছান্দোগ্য বৃহদারণ্যক প্রভৃতি শ্রুতিতে এরূপ উক্তি স্পষ্টতই আছে (ব্রহ্মসূত্র-৪/২/৪)।  জীবসংযুক্ত প্রাণ শুধুমাত্র তেজের সাথেই মিলিত হয় না, বরং পৃথিব্যাদি পঞ্চভূতেই মিলিত হয়- শ্রুতিতেও এরূপ উক্তি আছে (ব্রহ্মসূত্র-৪/২/৫)।।  উৎক্রান্ত জীব শুধুমাত্র তেজের সূক্ষ্ম অবস্থাতেই লীন হয় না- শ্রুতি ও স্মৃতি উভয়ই তাকে পঞ্চভূতের সূক্ষ্মরূপে বিলীন হয়ে অবস্থান করার কথা বলেছেন (ব্রহ্মসূত্র-৪/২/৬)।

শ্রুতির সাক্ষ্য থেকে মুক্ত আত্মার এই শরীর ত্যাগের ক্রমপ্রক্রিয়াটি যাচাই করে দেখা যেতে পারে। ছান্দোগ্য উপনিষদে বর্ণিত আছে-

‘তস্য ক্ব মূলং স্যাৎ অন্যত্রাদ্ভ্যঃ অদ্ভিঃ সোম্য শুঙ্গেন তেজো মূলম্ অন্বিচ্ছ তেজসা সোম্য শুঙ্গেন সন্মূলম্ অন্বিচ্ছ সন্মূলাঃ সোম্যেমাঃ সর্বা প্রজাঃ সদায়তনাঃ সৎপ্রতিষ্ঠা যথা নু খলু সোম্য ইমাঃ তিস্রঃ দেবতাঃ পুরুষং প্রাপ্য ত্রিবৃৎ ত্রিবৃদেকৈকা ভবতি তদুক্তং পুরস্তাৎ এব ভবতি অস্য সোম্য পুরুষস্য প্রয়তো বাক্সমনসি সম্পদ্যতে মনঃ প্রাণে প্রাণঃ তেজসি তেজঃ পরস্যাং দেবতায়াম্’।। (ছান্দোগ্য-৬/৮/৬)।।
অর্থাৎ : জল ছাড়া এই দেহরূপ অঙ্কুরের মূল আবার কোথায় হতে পারে ? হে সোম্য, জলরূপ অঙ্কুর দ্বারা কারণরূপ তেজের অনুসন্ধান করো। তেজরূপ অঙ্কুর দ্বারা কারণরূপ সৎ-এর অনুসন্ধান করো। হে সোম্য, চরাচর এই সমস্তই সৎ থেকে উৎপন্ন হয়েছে, সৎ-কে আশ্রয় করে আছে এবং সৎ-এই প্রতিষ্ঠিত। এই তিন দেবতা (অর্থাৎ অগ্নি, জল ও পৃথিবী) মানুষের দেহে প্রবেশ করে প্রত্যেকে তিন ভাগে বিভক্ত হয় একথা আগেই বলা হয়েছে। হে সোম্য, মানুষ যখন মুমূর্ষু হয়, তখন তার বাক্ মনে, মন প্রাণে, প্রাণ তেজে এবং তেজ পরম দেবতায় অর্থাৎ ব্রহ্মে মিলিত হয় (ছান্দোগ্য-৬/৮/৬)।

এই শ্রুতি অনুসারে বাক্ মনে লয়প্রাপ্ত হয়, মন প্রাণে, এবং এভাবে পরপর লয় হয়। স্বভাবতই এখানে প্রশ্ন আসে, বাগিন্দ্রিয় কি ইন্দ্রিয়রূপেই মনে লয়প্রাপ্ত হয়, না কি এর ক্রিয়ামাত্র লীন হয় ? মনে হতে পারে, যেহেতু শ্রুতিতে বাক্-ক্রিয়ার লীন হওয়ার কথা স্পষ্টত উল্লেখ নেই, সেহেতু বাক্-ইন্দ্রিয়ই মনে লয়প্রাপ্ত হয়। সূত্রকার বাদরায়ণ সূত্রের সাহায্যে বলছেন যে, শুধুমাত্র বাগিন্দ্রিয়ের ক্রিয়াটিই মনে লয়প্রাপ্ত হয়। মন ইন্দ্রিয়সমূহের উপাদান কারণ নয়- এবং সেজন্যই এরা মনে লীন হতে পারে না। শুধুমাত্র উপাদানকারণেই কার্যগুলি লীন হতে পারে, এবং যেহেতু মন ইন্দ্রিয়সমূহের উপাদান কারণ নয়, সেজন্যে আমাদের বুঝতে হবে যে, এখানে ‘বাক্’ বলতে ইন্দ্রিয়কে নয়, বাক্ ক্রিয়াকেই বলা হয়েছে। যেহেতু ইন্দ্রিয়ের ক্রিয়া ইন্দ্রিয় থেকে ভিন্ন, তাই তা (বাক্ ক্রিয়া) মনে লয়প্রাপ্ত হতে পারে- যদিও মন বাক্-ক্রিয়ার কারণ নয়, যেমন অগ্নির দাহিকাশক্তির বিষয়গুলি কাঠের মধ্যে নিহিত থাকলেও অগ্নি জলেই নির্বাপিত হয়ে লীন হয়। সুতরাং শ্রুতিশাস্ত্রের উক্তিটি বাক্-ক্রিয়াকেই বুঝাচ্ছে- যেহেতু বস্তুটি এবং বস্তুর ক্রিয়াটিকে একইরূপে দেখা যাচ্ছে। বাস্তব অভিজ্ঞতায় এটা লক্ষ্য করা যায় যে, একজন মুমূর্ষু ব্যক্তি প্রথমেই তার বাক্শক্তি হারায়- যদিও তার মন তখনও পর্যন্ত ক্রিয়াশীল থাকে। অতএব বুঝতে হবে যে, বাক্ ক্রিয়াই- বাগিন্দ্রিয় নয়- মনে লয়প্রাপ্ত হয়।

আবার যখন মন প্রাণে বিলীন হয়, তখন পৃথিবীর জলে বিলীন হওয়ার মতো তাও একই ব্যাপার; কারণ, মনই হলো অন্ন বা পৃথিবী, এবং প্রাণ হলো জল। কারণ, ছান্দোগ্যেই বলা হয়েছে-

‘অন্নময়ং হি সোম্য মন আপোময়ঃ প্রাণস্তেজজোময়ী বাক্ ইতি…’।। (ছান্দোগ্য-৬/৬/৫)।।
অর্থাৎ : হে সোম্য, মন অন্নময় অর্থাৎ খাদ্যের দ্বারা পুষ্ট হয়, (অন্ন) প্রাণ জলময় অর্থাৎ জলের দ্বারা এবং বাক্ তেজের দ্বারা… (ছান্দোগ্য-৬/৬/৫)।

অতএব পূর্বোক্ত শ্রুতি অনুসারে মন যখন প্রাণে বিলীন হয়, তখনও বুঝতে হবে, মন বলতে মনের ক্রিয়াকেই বোঝানো হয়েছে। বাস্তব অভিজ্ঞতায়ও দেখা যায় যে, মুমূর্ষু ব্যক্তির মনের ক্রিয়াটি যখন রুদ্ধ হয়ে যায়, তখনও তার প্রাণশক্তি ক্রিয়াশীল থাকে। এরপর প্রাণ তেজ বা জীবাত্মায় লয়প্রাপ্ত হয়। শ্রুতিতেও বলা হয়েছে-

‘তদ্ যথা রাজানাং প্রয়িয়াসন্তং উগ্রাঃ প্রত্যেনসঃ সূত- গ্রামণ্যঃ অভিসমায়ন্তি এবমেবেমম্ আত্মানম্ অন্তকালে সর্বে প্রাণা অভিসাময়ন্তি যত্রৈতদ্ উর্ধ্বোচ্ছ্বাসী ভবতি’।। (বৃহদারণ্যক-৪/৩/৩৮)।।
অর্থাৎ : রাজা যখন ফিরে যেতে চান, তখন যেমন শান্তিরক্ষক, বিচারক, রথচালক, নেতারা সব একজায়গায় সমবেত হয়ে তাঁকে বিদায় জানায়, সেই রকম এই শারীর-আত্মাও উর্ধ্বশ্বাসী হলে, অর্থাৎ তাঁর এই দেহত্যাগের সময় এলে সমস্ত প্রাণ, যাদের আমরা ইন্দ্রিয় বলি, সবাই তার চারদিকে এসে হাজির হয় (বৃহদারণ্যক-৪/৩/৩৮)।
কিংবা, ‘প্রাণ উৎক্রমণ করলে সকল ইন্দ্রিয় উৎক্রান্ত হয়’- (বৃহদারণ্যক-৪/৪/২)।

বাদরায়ণের সূত্র (ব্রহ্মসূত্র-৪/২/৬) মতে, মৃত্যুকালে যখন জীবাত্মা একটি দেহ পরিত্যাগ করে অন্য দেহে আশ্রয় নিতে চায় তখন তা পঞ্চভূতের সূক্ষ্মরূপের মধ্যেই আশ্রয় করে অবস্থান করে, শুধুমাত্র তেজের মধ্যে নয়- কারণ ভাবী দেহ গঠনের জন্য তার পঞ্চভূতেরই প্রয়োজন হয়। এজন্যই সগুণ ব্রহ্মজ্ঞানী এবং অজ্ঞানী মানুষের মৃত্যুকালীন যাত্রাটি একই রকম হয়, যে পর্যন্ত না তারা নিজ নিজ মার্গে যাত্রা আরম্ভ করে। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-

‘সমানা চ আসৃতি-উপক্রমাৎ, অমৃতত্বং চ অনুপোষ্য’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/২/৭)।।
‘তৎ আ অপীতেঃ সংসারব্যপদেশাৎ’।। (৪/২/৮)।।
‘ন উপমর্দেন অতঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/২/১০)।।
ভাবার্থ :
মৃত্যুর পর নিজ নিজ মার্গে গমনের পূর্ব পর্যন্ত সগুণ ব্রহ্মবিদের এবং বদ্ধজীবের গতি একই প্রকার। যেহেতু সগুণ ব্রহ্মবিদের অবিদ্যা সম্পূর্ণরূপে ভস্মীভূত হয়নি, তাই তার অমৃতত্ব (ব্রহ্ম-উপলব্ধি) আপেক্ষিক মাত্র (ব্রহ্মসূত্র-৪/২/৭)।   মৃত্যুর পর ব্রহ্মজ্ঞান লাভ পর্যন্ত এই সূক্ষ্মদেহ বর্তমান থাকে। কারণ শাস্ত্রে মুক্তির পূর্ব পর্যন্ত জীবের সূক্ষ্মদেহে অবস্থানের কথা আছে (ব্রহ্মসূত্র-৪/২/৮)।  সূক্ষ্ম দেহটি স্বচ্ছ এবং স্থূল উপাদানরহিত বলেই স্থূলদেহের ধ্বংস হলেও সূক্ষ্মদেহটির বিনাশ বা পরিবর্তন হয় না (ব্রহ্মসূত্র-৪/২/১০)।

তবে সম্পূর্ণ কর্মরাশিকে বিনষ্ট করে মুক্ত আত্মা পূর্ববর্ণিত যে ক্রমপ্রক্রিয়ায় শরীর ত্যাগ করে, এই সাধারণ পথে মুক্তির গতির বৈশিষ্ট্য হলো- ব্রহ্মজ্ঞানে সমর্থ শতাধিক নাড়ী থেকে মূর্ধাযুক্ত নাড়ী দ্বারা আত্মা হৃদয়াসন ত্যাগ করে বহির্গত হয় এবং সূর্যকিরণকে অনুসরণ করে প্রস্থান করে। নিশাকাল বা দক্ষিণায়ন কোনো সময়ই মৃত্যুর পর মুক্ত পুরুষের পথের বাধা নয়। এবং মৃত্যুর পর মুক্ত পুরুষকে এক দূর দেশে যাত্রা করতে হয়। তবে এই গন্তব্য যে ব্রহ্মলোক, তা ইতঃপূর্বে উল্লিখিত ছান্দোগ্য (ছাঃ-৫/১০/১), বৃহদারণ্যক (বৃঃ-৬/২/১৫) কিংবা মুণ্ডক (মুঃ-১/২/১১) উপনিষদের শ্রুতি থেকেই জানা যায়। তাই সূত্রকার বাদরায়ণ বেদান্তসূত্রে স্পষ্ট করেই বলেছেন-

‘অর্চিরাদিনা, তৎপ্রথিতেঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/৩/১)।।
ভাবার্থ : বিদ্বান্ ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ দেহান্তে অর্চিরাদি মার্গকে অবলম্বন করে ব্রহ্মলোকে গমন করেন। শ্রুতিতে তার প্রমাণ আছে (ব্রঃ-৪/৩/১)।

কিন্তু মুক্ত আত্মার এক দীর্ঘ গমন পথ পেরিয়েই বিভিন্ন লোক হয়ে এই ব্রহ্মলোকে যেতে হয়। কিন্তু বিভিন্ন উপনিষদের মধ্যে এই গমন পথের বর্ণনায় কিছু কিছু ভিন্নতা পরিলক্ষিত হওয়ায় উপনিষদের বিক্ষিপ্ত সামগ্রিকে একত্রিত করে বাদরায়ণ সেই জ্যোতির্লোকের একটা সমন্বিত রূপ কল্পনা করেছেন। যেমন, ছান্দোগ্য উপনিষদে মুক্ত পুরুষের গমন-পথের বর্ণনায় বলা হয়েছে-

‘অথ যদু চ এব অস্মিন্ শব্যম্ কুর্বন্তি যদি চ ন অর্চিষম্ এব অভিসংভবন্তি অর্চিষঃ অহঃ অহ্নঃ আপূর্যমাণপপক্ষম্ আপূর্যমাণপক্ষাৎ যান্ ষট্ উদঙ্ এতি মাসাংস্তান্ মাসেভ্যঃ সংবৎসরং সংবৎসরাৎ আদিত্যম্ আদিত্যাৎ চন্দ্রমসং চন্দ্রমসো বিদ্যুতং তৎ পুরুষঃ অমানবঃ স এনান্ ব্রহ্ম গময়তি এষঃ দেবপথো ব্রহ্মপথঃ এতেন প্রতিপদ্যমানাঃ ইমং মানবম্ আবর্তং ন আবর্তন্তে ন আবর্তন্তে’।। (ছান্দোগ্য-৪/১৫/৫)।।
অর্থাৎ : অতঃপর যাঁরা এরূপ জানেন (অর্থাৎ অধিষ্ঠিত আত্মাকে জানেন) তাঁদের দেহত্যাগের পর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া হোক বা না হোক, তাঁরা অর্চিতে (অর্থাৎ জ্যোতিতে বা অর্চিলোকে) গমন করেন। তারপর অর্চি থেকে দিবসে, দিবস থেকে শুক্লপক্ষে, শুক্লপক্ষ থেকে উত্তরায়ণের ছয় মানে, সেই ছয়মাস থেকে সংবৎসরে, সংবৎবসর থেকে সূর্যে, সূর্য থেকে চন্দ্রে এবং চন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ-লোকে যান। সেখানে একজন অমানব (জ্যোতির্ময়) পুরুষ এসে তাঁদের ব্রহ্মলোকে (হিরণ্যগর্ভের কাছে) নিয়ে যান। এই পথই দেবযান ও ব্রহ্মযান। ঐ পথে গেলে মানুষকে আর সংসাররূপ আবর্তে ফিরে আসতে হয় না (ছান্দোগ্য-৪/১৫/৫)।

অন্যদিকে, বৃহদারণ্যক উপনিষদে মুক্ত আত্মার যাত্রাপথ সম্পর্কে বলা হয়েছে-

‘পুরুষ যখন ইহলোক থেকে প্রস্থান করেন, তখন বায়ুকে প্রাপ্ত হন। সেখানে বায়ুকে ত্যাগ করে তিনি উর্ধ্বলোকে, তথা হতে সূর্যলোকে গমন করেন’ (বৃহদারণ্যক-৫/১০/১)।

এই উভয় প্রকার মতকেই সঠিকভাবে গ্রহণ করার জন্য বাদরায়ণ সম্বৎসর থেকে বায়ুলোকে গমনের কথা বলেছেন। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-

‘বায়ুম্ অব্দাৎ, অবিশেষবিশেষাভ্যাম্’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/৩/২)।।
ভাবার্থ : সগুণ ব্রহ্মবিদের দেহ নির্গত আত্মা প্রথমে বৎসরাভিমানী দেবতার নিকট যায় এবং সেখান থেকে বায়ুদেবতার নিকট যায়- বিশেষ উল্লেখের উপস্থিতি এবং অনুপস্থিতি হেতু এরূপই বুঝতে হবে, (কারণ নানা শ্রুতিতে নানাভাবে তা বর্ণিত আছে) (ব্রঃ-৪/৩/২)।
আবার কৌষীতকি উপনিষদে এই উৎক্রান্ত মুক্ত আত্মার গমন পথের বর্ণনায় বলা হয়েছে-

‘স এতৎ দেবযানং পন্থানম্ আপদ্য অগ্নিলোকম্ আগচ্ছতি, স বায়ুলোকং, স আদিত্যলোকং, স বরুণলোকং, স ইন্দ্রলোকং, স প্রজাপতিলোকং, স ব্রহ্মলোকম্’।। (কৌষীতকি-১/৩)।।
অর্থাৎ : ব্রহ্মজ্ঞ মুক্ত আত্মা আয়ুশেষে সুষুম্নাপথে ব্রহ্মরন্ধ্র বিদীর্ণ করে, দেবযান পথে অগ্নিলোক, তারপরে বায়ুলোক, তারপরে আদিত্যলোক, তারপরে ক্রমে বরুণলোক, ইন্দ্রলোক, প্রজাপতিলোক, শেষে ব্রহ্মলোকে গিয়ে হাজির হয় (কৌষীতকি-১/৩)।

ফলে মুক্ত আত্মার গমন পথের ব্যাখ্যায়  আবার এই কৌষীতকির পাঠ সংযুক্ত করে বিদ্যুৎ-লোক থেকে উর্ধ্বে বরুণলোকে যাওয়ার কথা বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-

‘তড়িতঃ অধি বরুণঃ, সংবন্ধাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/৩/৩)।।
ভাবার্থ : বিদ্যুতের সাথে বরুণের সম্বন্ধ আছে বলে বুঝতে হবে যে, আত্মা বিদ্যুৎ-লোকের পরেই বরুণলোকে যান।

অতএব, বাদরায়ণ কর্তৃক বর্ণিত উৎক্রান্ত ব্রহ্মজ্ঞ মুক্ত আত্মার সমন্বিত গমন পথ অর্থাৎ দেবযানের অবস্থানগুলি হলো- অর্চি থেকে দিন, দিন থেকে শুক্লপক্ষ, শুক্লপক্ষ থেকে উত্তরায়ণ, উত্তরায়ণ থেকে সংবৎসর, সংবৎসর থেকে বায়ুলোক, বায়ুলোক থেকে সূর্যলোক, সূর্যলোক থেকে চন্দ্রলোক, চন্দ্রলোক থেকে বিদুৎলোক, বিদ্যুৎলোক থেকে বরুণলোক, বরুণলোক থেকে ইন্দ্রলোক, ইন্দ্রলোক থেকে প্রজাপতিলোক এবং সবশেষে ব্রহ্মলোক।

লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, রাহুল সাংকৃত্যানের উক্তিতে, ‘সম্ভবত বাদরায়ণ তাঁর থেকে সহস্র বৎসর পূর্ব-যুগের জ্যোতিষজ্ঞানকে কিছুটা অক্ষুণ্ন মেনেই জ্যোতির্লোকের মধ্যে বায়ুলোক থেকে সূর্য তার পরে চন্দ্র, বরুণ এবং ব্রহ্মলোককে মেনেছেন। ব্রহ্ম এবং ব্রহ্মলোক পর্যন্ত জ্ঞান এই ঋষিদের নিকট ছিল বাঁ হাতের খেলা, কিন্তু বাস্তব বিশ্ব-সম্পর্কিত জ্ঞানে বেচারাদের সর্বজ্ঞতা যথেষ্ট পিছিয়ে ছিল’ (দর্শন-দিগদর্শন-২, পৃষ্ঠা১৮৫)।

উল্লেখ্য যে, এখানে প্রশ্ন হতে পারে, উৎক্রান্ত আত্মার গতিপথ বর্ণনায় গতির লক্ষ্যবস্তু যে ব্রহ্মলোকের কথা বলা হয়েছে, এই ব্রহ্ম কি সগুণ ব্রহ্ম, না কি নির্গুণ বা পর ব্রহ্ম ? জবাবে বাদরায়ণ বলেন-

‘কার্যং বাদরিঃ, অস্য গতি-উপপত্তেঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/৩/৭)।।
ভাবার্থ : বাদরি মুনি মনে করেন যে, দেবযানের মধ্য দিয়ে, নানা দেবতার সাহায্যে নীত হয়ে উৎক্রান্ত আত্মা যে ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হন তিনি সম্ভাব্য ধারণায় সগুণ ব্রহ্মই। কারণ নির্গুণ ব্রহ্ম হলে, তিনি সর্বব্যাপী বলে তাঁকে প্রাপ্ত হওয়ার কোন প্রসঙ্গই উঠে না।
অর্থাৎ, বাদরির মতে, শুধুমাত্র সগুণ ব্রহ্মকে লক্ষ্য করেই এই যাত্রা বা গতি সম্ভবপর হতে পারে- কারণ, সগুণ (আপেক্ষিক) ব্রহ্ম হলেন সসীম এবং সেজন্যই তিনি একটি নির্দিষ্ট স্থান অধিকার করে অবস্থান করছেন- যে স্থানে আত্মা গিয়ে উপস্থিত হতে পারে। কিন্তু এরূপ গতি বা প্রাপ্তি নির্গুণ ব্রহ্ম সম্পর্কে প্রযোজ্য নয়- কারণ নির্গুণ ব্রহ্ম সর্বব্যাপী। তবে বিভিন্ন উপনিষদ শ্রুতিতে যেহেতু বলা আছে, মুক্ত আত্মা ব্রহ্মলোক থেকে আর প্রত্যাগমন করেন না, তাই বাদরায়ণ বলতে চেয়েছেন যে- ব্রহ্মলোকে বিলীন হওয়ার সময় আত্মাসমূহ ইতোমধ্যে জ্ঞানলাভ হেতু সগুণ ব্রহ্মের সাথে তার অপেক্ষা উচ্চতর পরব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হন। কেননা, পরব্রহ্ম ছাড়া আর কিছুতেই স্থায়িত্ব নেই। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-

‘কার্যাত্যয়ে তৎ-অধ্যক্ষেণ সহাতঃ পরম্, অভিধানাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/৩/১০)।।
‘স্মৃতেঃ চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/৩/১১)।।
‘পরং জৈমিনিঃ, মুখ্যত্বাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/৩/১২)।।
ভাবার্থ :
ব্রহ্মলোকে বিলীন হওয়ার পর উৎক্রান্ত আত্মা- ব্রহ্মলোকের অধ্যক্ষ সগুণ ব্রহ্মের সাথে পরব্রহ্মেই লীন হয়ে যান- কারণ শ্রুতিতে এরূপই আছে যে, ‘তিনি আর প্রত্যাবৃত্ত হন না।’ একমাত্র পরব্রহ্মে লীন হলেই প্রত্যাবর্তন হয় না (ব্রহ্মসূত্র-৪/৩/১০)।   স্মৃতিশাস্ত্রও ঘোষণা করেছেন যে, জীবাত্মা পরব্রহ্মেই লীন হয়ে- ব্রহ্মস্বরূপত্বলাভ করেন (ব্রহ্মসূত্র-৪/৩/১১)।   জৈমিনি মুনির মতে (ছান্দোগ্য) উপনিষদে ব্রহ্ম বলতে পরব্রহ্মকেই বুঝিয়েছে। কারণ, এটাই ‘ব্রহ্ম’ শব্দের মুখ্যার্থ। সুতরাং আত্মা পরব্রহ্মেই লীন হন- অন্যত্র নয় (ব্রহ্মসূত্র-৪/৩/১২)।

(চলবে…)

[আগের পর্ব : মুক্তির সাধন] [*] [পরের পর্ব : মুক্তের বৈভব]

No comments: