| বেদান্তদর্শন-ব্রহ্মবেদান্ত-২১: বাদরায়ণের দার্শনিকমত- মুক্তের বৈভব |
রণদীপম বসু
…
(গ) মুক্তের বৈভব-
ব্রহ্মকে প্রাপ্ত মুক্তাত্মা তাঁর স্ব-স্বরূপে অধিষ্ঠিত হয়। বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-
‘সংপদ্য আবির্ভাবঃ, স্বেনশব্দাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/৪/১)।।
ভাবার্থ : মুক্ত জীব ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হয়ে স্ব-স্বরূপেই প্রতিষ্ঠিত হয়। শ্রুতির ‘স্ব’ শব্দ থেকেই বুঝতে পারা যায় যে জীব এবং ব্রহ্ম স্বরূপত অভিন্ন। সুতরাং মুক্তি বা ব্রহ্মলাভের অর্থ হলো স্ব-স্বরূপে প্রতিষ্ঠিত হওয়া (ব্রঃ-৪/৪/১)।
কারণ, ছান্দোগ্যের শ্রুতিতে বলা আছে-
‘অথ য এষ সম্প্রসাদঃ অস্মাৎ শরীরাৎ সমুত্থায় পরম জ্যোতিঃ উপসম্পদ্য স্বেন রূপেণ অভিনিষ্পদ্যতে এষ আত্মেতি হোবাচ এতৎ অমৃতম্ অভয়ম্ এতৎ ব্রহ্ম ইতি তস্য হ বা এতস্য ব্রহ্মণো নাম সত্যম্ ইতি’।। (ছান্দোগ্য-৮/৩/৪)।।
অর্থাৎ : আচার্য বললেন,- আবার এই বিদ্বান ব্যক্তি, সুষুপ্তি হেতু যিনি আনন্দঘন মূর্তি, এই শরীর থেকে উত্থিত হয়ে, অর্থাৎ দেহাত্ম অভিমান ত্যাগ করে, পরম জ্যোতি লাভ করে স্ব-স্বরূপে বিরাজ করেন। ইনিই আত্মা। এই আত্মা অমর, নির্ভয়। ইনি ব্রহ্ম। ব্রহ্মের আরেক নাম ‘সত্য’ (ছাঃ-৮/৩/৪)।
তবে মুক্তজীব ব্রহ্মকে লাভ করলেও তাঁর সঙ্গে সংযুক্ত না হয়েই থাকে। তাহলে প্রশ্ন, ঐ সময়ে আত্মার অবস্থা কিরূপ থাকে ? শাস্ত্র অনুসারে ব্রহ্মের দুটি অবস্থা আছে, একটি হলো প্রজ্ঞাঘন শুদ্ধচৈতন্যরূপ অবস্থা, আর অন্যটি হলো ব্রহ্মের গুণাদিসম্পন্ন। যেমন, ব্রহ্মের গুণাদি সম্পর্কে ছান্দোগ্যের শ্রুতিতেই বলা হয়েছে-
‘য আত্মা অপহতপাপ্মা বিজরঃ বিমৃত্যুঃ বিশোকঃ বিজিঘৎসঃ অপিপাসঃ সত্যকামঃ সত্যসঙ্কল্পঃ সঃ অন্বেষ্টব্যঃ স বিজিজ্ঞাসিতব্যঃ স সর্বান্ চ লোকানাপ্নোতি সর্বান্ চ কামান্ যঃ তম্ আত্মানম্ অনুবিদ্য বিজানাতি ইতি হ প্রজাপতিঃ উবাচ’।। (ছান্দোগ্য-৮/৭/১)।।
অর্থাৎ : প্রজাপতি একবার বলেছিলেন,- আত্মা নিষ্পাপ, জরাহীন, মৃত্যুহীন, শোকহীন, ক্ষুধাহীন ও তৃষ্ণাহীন। আত্মাই সত্যকে জানার ও সত্যনিষ্ঠার প্রেরণাস্বরূপ। এই আত্মাকে অনুসন্ধান করতে হবে, তাঁকে বিশেষভাবে জানতে হবে। যিনি এই আত্মার অনুসন্ধান করে তাঁকে বিশেষরূপে জানতে পারেন, তিনি সমস্ত লোক ও সকল কাম্যবস্তু লাভ করেন (ছাঃ-৮/৭/১)।
অতএব, মুক্ত জীবাত্মা ব্রহ্মের গুণাদিসম্পন্ন হয়ে যে নিষ্পাপ, বিজর, বিমৃত্যু, বিশোক, ক্ষুধাহীন, তৃষ্ণাহীন, সত্যকাম ও সত্যসঙ্কল্প হয়ে উঠেন, আত্মার এই অবস্থাকে জৈমিনি বলেছেন ব্রহ্মরূপী। তাই বেদান্তসূত্রেও বলা হয়েছে-
‘ব্রাহ্মেণ জৈমিনিঃ, উপন্যাসাদিভ্যঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/৪/৫)।।
ভাবার্থ : ব্রহ্মজ্ঞান লাভের পর ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষেরা ব্রহ্মের মতোই গুণাদিসম্পন্ন হয়ে অবস্থান করেন। তা জৈমিনির মত এবং শাস্ত্রেও এই মতের সমর্থন আছে (ব্রঃ-৪/৪/৫)।
কিন্তু, ব্রহ্মকে লাভ করে মুক্ত জীবাত্মার অবস্থা সম্পর্কে ঔডুলোমি আচার্য বলেন যে তা হলো চৈতন্যস্বরূপ মাত্র-
‘চিতিতন্মাত্রেণ, তদাত্মকত্বাৎ ইতি ঔডুলোমিঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/৪/৬)।।
ভাবার্থ : ঔডুলোমি মুনি মনে করেন যে, ব্রহ্মবিদ্ বিশুদ্ধ চৈতন্যরূপেই লীন থাকেন- এটাই তাঁর যথার্থ স্বরূপ।
তবে বাদরায়ণ এই দুটি মতের অর্থাৎ জৈমিনি ও ঔডুলোমির মতের মধ্যে কোনো বিরোধ খুঁজে পাননি। কারণ-
‘এবম্ অপি উপন্যাসাৎ পূর্বভাবাৎ অবিরোধং বাদরায়ণঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/৪/৭)।।
ভাবার্থ : যদিও মুক্তাত্মা বিজ্ঞানমাত্র স্বরূপ বলে প্রতিপন্ন হয়েছেন, তবু তাঁর বিজ্ঞানরূপ স্বীয় স্বরূপ নিষ্পাপত্ব ইত্যাদি গুণবিশিষ্ট বলেও শ্রুতি সর্বত্র উল্লেখ করেছেন। সুতরাং আত্যন্তিক দৃষ্টিতে তিনি গুণাদিরহিত হলেও আপেক্ষিক দৃষ্টিতে তাঁর গুণকল্পনা অসঙ্গত নয়। বাদরায়ণ এই উভয় মতকেই (জৈমিনি ও ঔডুলোমির) সমর্থন করেছেন।
অর্থাৎ, মুক্ত জীবাত্মা কখনও নিজেকে সর্বজ্ঞ, সর্বব্যাপী ইত্যাদি বলে মনে করেন না, কিন্তু বিশুদ্ধচৈতন্যরূপেই অবস্থান করেন। আবার ব্যবহারিক দিক থেকে আমরা বলতে পারি যে, এরূপ মুক্ত আত্মা সর্বজ্ঞত্বাদি গুণসম্পন্ন হতে পারেন, কারণ বিশুদ্ধচৈতন্য আমাদের ধারণার অতীত। এই দুটি মত দুটি ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে মুক্ত আত্মার বর্ণনা করেছে- সুতরাং মূলত এদের মধ্যে কোন বিরোধ নেই। এটাই বাদরায়ণের মত।
মুক্তের বৈভবের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো, মুক্ত পুরুষের ভোগ্য-সামগ্রী তার সংকল্পমাত্রই উপস্থিত হয়। এ ক্ষেত্রে সে নিজেই নিজের প্রভু। যেমন, শ্রুতির সাক্ষ্যে বলা হয়েছে-
‘স যদি পিতৃলোককামো ভবতি সঙ্কল্পাৎ এব অস্য পিতরঃ সমুত্তিষ্ঠন্তি তেন পিতৃলোকেন সম্পন্নো মহীয়তে’। (ছান্দোগ্য-৮/২/১)।। ‘অথ যদি গন্ধমাল্যলোককামো ভবতি সঙ্কল্পাদেবাস্য গন্ধমাল্যে সমুত্তিষ্ঠতঃ তেন গন্ধমাল্যলোকেন সম্পন্নো মহীয়তে’। (ছান্দোগ্য-৮/২/৬)।। ‘অথ যদি অন্নপানলোককামঃ ভবতি সঙ্কল্পাদেবাস্য অন্নপানে সমুত্তিষ্ঠতঃ তেন অন্নপানলোকেন সম্পন্নো মহীয়তে’। (ছান্দোগ্য-৮/২/৭)।। ‘অথ যদি গীতবাদিত্রলোককামঃ ভবতি সঙ্কল্পাদেবাস্য গীতবাদিত্রে সমুত্তিষ্ঠতঃ তেন গীতবাদিত্রলোকেন সম্পন্নো মহীয়তে’। (ছান্দোগ্য-৮/২/৮)।। অথ যদি স্ত্রীলোককামো ভবতি সঙ্কল্পাৎ এব অস্য স্ত্রিয়ঃ সমুত্তিষ্ঠন্তি তেন স্ত্রীলোকেন সম্পন্নো মহীয়তে’। (ছান্দোগ্য-৮/২/৯)।। যং যমন্মম্ অভিকামো ভবতি যং কামং কাময়তে সঃ অস্য সঙ্কল্পাৎ এব সমুত্তিষ্ঠতি তেন সম্পন্নো মহীয়তে’। (ছান্দোগ্য-৮/২/১০)।।
অর্থাৎ :
আত্মজ্ঞ সেই ব্যক্তি যদি পিতৃপুরুষের সঙ্গ পেতে চান, তাহলে তাঁর ইচ্ছানুযায়ী তাঁরা তাঁর সামনে আবির্ভূত হন। সেই লোকে পিতৃপুরুষের সঙ্গে মিলিত হয়ে তিনি মহিমান্বিত হন (ছান্দোগ্য-৮/২/১)। আর তিনি যদি সুগন্ধী পুষ্পমালার জগত কামনা করেন, তবে তাঁর সঙ্কল্পমাত্রই তারা তাঁর সামনে হাজির হয়। সেই লোকে বহু সুগন্ধী মালা পেয়ে তিনি মহিমান্বিত হন (ছান্দোগ্য-৮/২/৬)। আর তিনি যদি খাদ্য ও পানীয় ভোগ করতে চান, তবে তাঁর সঙ্কল্পমাত্রই সেই সব জিনিস তাঁর সামনে এসে হাজির হয়। সেই লোকে খাদ্য ও পানীয় পেয়ে তিনি মহিমান্বিত হন (ছান্দোগ্য-৮/২/৭)। আর তিনি যদি সঙ্গীত লোক কামনা করেন, তবে তাঁর সঙ্কল্পমাত্রই সেই লোক তাঁর কাছে আবির্ভূত হয়। সেই লোকে সঙ্গীত উপভোগ করে তিনি মহিমান্বিত হন (ছান্দোগ্য-৮/২/৮)। আর যদি তিনি নারীলোক কামনা করেন, তবে তাঁর সঙ্কল্পমাত্রই নারীরা তাঁর কাছে উপস্থিত হয়। সেই নারীলোক লাভ করে তিনি মহীয়ান হন (ছান্দোগ্য-৮/২/৯)। তিনি যে যে প্রদেশ কামনা করেন, যে যে কাম্যবস্তু পেতে চান তা তাঁর সঙ্কল্পমাত্রই তাঁর কাছে উপস্থিত হয়। তা পেয়ে তিনি মহীয়ান হন (ছান্দোগ্য-৮/২/১০)।
অতএব, খুব স্বাভাবিকভাবে বেদান্তসূত্রেও বাদরায়ণ এই সিদ্ধান্তই বহাল রাখেন-
‘সংকল্পাৎ এব তু, তৎ-শ্রুতেঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/৪/৮)।।
‘অত এব চ অনন্যাধিপতিঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/৪/৯)।।
ভাবার্থ :
শ্রুতির বহু উক্তি থেকেই জানতে পারা যায় যে, ব্রহ্মজ্ঞ মুক্ত পুরুষগণ ইচ্ছামাত্র তাঁদের সঙ্কল্প সিদ্ধ করতে পারেন (ব্রহ্মসূত্র-৪/৪/৮)। মুক্ত পুরুষ ইচ্ছামাত্র সর্বময় কর্তা হতে পারেন, সুতরাং তাঁর কোন নিয়ন্তা বা কর্তা থাকতে পারেন না (ব্রহ্মসূত্র-৪/৪/৯)।
একজন মুক্ত পুরুষ যে নিজেই নিজের অধিপতি- স্বরাট্, অন্য শ্রুতিতেও তার সাক্ষ্য প্রমাণ মেলে, যেমন-
‘তৎ যথা ইহ কর্মজিতো লোকঃ ক্ষীয়ত এবম্ এব অমুত্র পুণ্যজিতো লোকঃ ক্ষীয়তে তদ্য ইহ আত্মানম্ অননুবিদ্য ব্রজন্তি তেষাম্ চ সত্যান্ কামান্ তেষাং সর্বেষু লোকেষু অকামচারঃ ভবতি অথ য ইহ আত্মানম্ অনুবিদ্য ব্রজন্তি এতান্ চ সত্যান্ কামাংস্তেষাং সর্বেষু লোকেষু কামচারো ভবতি’।। (ছান্দোগ্য-৮/১/৬)।।
অর্থাৎ : এই জগতে কঠোর পরিশ্রম করে আপনি যা অর্জন করেছেন তাও যেমন নশ্বর, তেমনি পুণ্যকর্ম করার ফলে আপনি যদি উচ্চলোকে যান সেখানকার ভোগও একদিন না একদিন শেষ হতে বাধ্য। আত্মাকে না জেনে, অথবা যে সত্য মানুষের জানা উচিত তা না জেনে যাঁরা দেহত্যাগ করেন, তাঁরা যে লোকেই যান না কেন, তাঁদের মুক্তি হয় না। কিন্তু যাঁরা আত্মজ্ঞান লাভ করে কৃতকৃত্য হয়ে দেহত্যাগ করেন তাঁরা যেখানেই থাকুন না কেন, তাঁরা মুক্ত, তাঁরা সকললোকেই স্বচ্ছন্দগতি হন (ছান্দোগ্য-৮/১/৬)।
মুক্তপুরুষের এই সঙ্কল্প এবং ভোগ্য-সামগ্রি ভোগের যে সামর্থ্য ও প্রতিপত্তি, তাতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, ব্রহ্মের নিকট অবস্থানকালে মুক্ত পুরুষ কায়াযুক্ত না কায়াহীন ? এ ব্যাপারে বাদরির বক্তব্য হলো, কায়াহীন-
‘অভাবং বাদরিঃ, আহ হি এবম্’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/৪/১০)।।
ভাবার্থ : বাদরি মুনির মতে মুক্ত জীবাত্মা শরীররহিত অবস্থাতেই বিরাজ করেন, কারণ শাস্ত্র এরূপ উক্তিই করেছেন (ব্রঃ-৪/৪/১০)।
যেমন, শাস্ত্র প্রমাণ হিসেবে ছান্দোগ্যের শ্রুতিতে আছে-
‘অথ যো বেদেদং মন্বাণি ইতি স আত্মা মনঃ অস্য দৈবং চক্ষুঃ স বা এষ এতেন দৈবেন চক্ষুষা মনসৈতান্ কামান্ পশ্যন্ রমতে য এতে ব্রহ্মলোকে’।। (ছান্দোগ্য-৮/১২/৫)।।
অর্থাৎ : আবার যিনি জানেন ‘আমি চিন্তা করছি’ তিনিই আত্মা। মন এই আত্মার দিব্য চক্ষু। এই মুক্ত আত্মা মনরূপ দিব্যচক্ষুর সাহায্যে সকল কাম্য বস্তু, যা ব্রহ্মলোকে আছে তা দেখে আনন্দিত হন (ছাঃ-৮/১২/৫)।
অন্যদিকে ব্রহ্মের নিকট অবস্থানকালে মুক্ত পুরুষকে জৈমিনি মেনেছেন সৎ-ভাব বলে-
‘ভাবং জৈমিনিঃ, বিকল্প-আমননাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/৪/১১)।।
ভাবার্থ : জৈমিনি মুনি মনে করেন যে, মুক্ত আত্মা ইচ্ছাশক্তিসম্পন্ন বলে যে-কোন রূপ ধারণ করতে পারেন, এবং শাস্ত্রেও এরূপ বিচিত্র দেহধারণের সপক্ষে উক্তি আছে (ব্রঃ-৪/৪/১১)।
যেমন, ছান্দোগ্যের শ্রুতিতেই আছে-
‘তদেষ শ্লোকঃ ন পশ্যঃ মৃত্যুং পশ্যতি ন রোগং নোত দুঃখতাম্ । সর্বং হ পশ্যঃ পশ্যতি সর্বম্ আপ্নোতি সর্বশঃ।। ইতি। স একধা ভবতি ত্রিধা ভবতি পঞ্চধা সপ্তধা নবধা চৈব পুনশ্চ একাদশঃ স্মৃতঃ শতঞ্চ দশ চৈকশ্চ সহস্রাণি চ বিংশতি…’।। (ছান্দোগ্য-৭/২৬/২)।।
অর্থাৎ : এ বিষয়ে এই শ্লোক আছে- ‘তত্ত্বদর্শী মৃত্যু দর্শন করেন না, রোগদুঃখও দর্শন করেন না। আবার তত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তি সবই দেখেন, এবং সর্বতোভাবে সবই লাভ করেন।’ তিনি সৃষ্টির পূর্বে এক। তারপরে তিন, পাঁচ, সাত, নয় প্রকার হন। আবার এগারো, একশো দশ, এবং একহাজার বিশও বলা যায়… (ছান্দোগ্য-৭/২৬/২)।
এ প্রেক্ষিতে বাদরায়ণ উভয় মতকেই গ্রহণ করে বলেছেন যে, ব্রহ্মজ্ঞ মুক্ত আত্মার কায়া থাকে না বটে, তবে সংকল্প মাত্র তা উপস্থিত হয়। শরীরের অভাবে সে স্বপ্নের ন্যায় ঈশ্বরপ্রদত্ত সম্পদকে সম্ভোগ করে, শরীর যুক্ত হলে জাগ্রত অবস্থার মতো থাকে। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-
‘দ্বাদশাহবৎ উভয়বিধং বাদরায়ণঃ অতঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/৪/১২)।।
‘তন্বভাবে সন্ধ্যবৎ, উপপত্তেঃ, ভাবে জাগ্রৎবৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/৪/১৩-১৪)।।
‘প্রদীপবৎ আবেশঃ, তথা হি দর্শয়তি’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/৪/১৫)।।
ভাবার্থ :
বাদরি এবং জৈমিনি মুনি দুজনই শাস্ত্র থেকে ভাব এবং অভাবসূচক দুই প্রকার উক্তি প্রদর্শন করে নিজ নিজ মত ব্যক্ত করেছেন। এখানে ঋষি বাদরায়ণ বলছেন যে, উভয়ই সত্য- যেমন দ্বাদশাহ যজ্ঞের দুইটি নাম (সত্ত্র এবং অহীন) একই বস্তুকে বুঝিয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-৪/৪/১২)। মুক্ত আত্মা অ-শরীর হলে স্বপ্নের ন্যায় এবং স-শরীর হলে জাগ্রৎ অবস্থায় কামনা সম্ভোগের ন্যায় ইচ্ছেমতো বাসনার পূরণ করতে পারেন (ব্রহ্মসূত্র-৪/৪/১৩-১৪)। একটি প্রদীপ যেমন নিজ দেহে বর্তমান থেকে অনুরূপ বহু প্রদীপকেই প্রজ্জ্বলিত করতে পারে, সেরূপ মুক্ত পুরুষ অন্যন্য বহু দেহকেও উদ্দীপ্ত করতে পারেন- এরূপ দৃষ্টান্ত শ্রুতিতে আছে (ব্রহ্মসূত্র-৪/৪/১৫)।
স্ব-স্বরূপ প্রাপ্ত হয় বলেই মুক্তজীবকে ব্রহ্মের নিকট থেকে আর ফিরে আসতে হয় না অর্থাৎ তার পুনর্জন্ম হয় না। তবে ব্রহ্মলোকে স্ব-স্বরূপ প্রাপ্ত হয়ে মুক্ত পুরুষ ব্রহ্মের ন্যায় গুণাদিসম্পন্ন হলেও, আমরা ইতঃপূর্বে জেনেছি যে, জগৎ সৃষ্ট্যাদি ব্যাপার ছাড়া অপর সর্ববিধ শক্তির অধিকারী হন। বেদান্তসূত্র অনুযায়ী-
‘জগৎ-ব্যাপারবর্জম্ প্রকরণাৎ, অসন্নিহিতত্বাৎ চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/৪/১৭)।।
ভাবার্থ : মুক্ত পুরুষ জগৎ সৃষ্ট্যাদি শক্তি ছাড়া অপর সর্ববিধ শক্তির অধিকারী হন। সৃষ্টি প্রকরণে ঈশ্বরের উল্লেখ আছে। ঐ প্রকরণে মুক্ত পুরুষের কোন উল্লেখই নাই। মুক্ত পুরুষের ক্ষমতা সসীম (ব্রঃ-৪/৪/১৭)।
অর্থাৎ, মুক্ত পুরুষের পক্ষে ব্রহ্মের মতো সৃষ্টিকর্ম সম্ভব নয়, শুধুমাত্র ব্রহ্মের নিকট থেকে ভোগের সমানতা প্রাপ্তিই সম্ভব।
…
(চলবে…)
…
[আগের পর্ব : মুক্তিপ্রাপ্তের অন্তিমযাত্রা] [*] [পরের পর্ব : বেদ নিত্য]
…
…
(চলবে…)
…
[আগের পর্ব : মুক্তিপ্রাপ্তের অন্তিমযাত্রা] [*] [পরের পর্ব : বেদ নিত্য]
…
No comments:
Post a Comment