| বেদান্তদর্শন-ব্রহ্মবেদান্ত-১৯: বাদরায়ণের দার্শনিকমত- মুক্তির সাধন |
রণদীপম বসু
…
(ক) মুক্তির সাধন-
বিদ্যা তথা ব্রহ্মজ্ঞানকে বাদরায়ণ মুক্তির বিশেষ সাধন বলে মেনেছেন, কর্মও যার সহায়ক বলে তিনি মনে করেন।
(১) ব্রহ্মবিদ্যা :বিদ্যা তথা ব্রহ্মজ্ঞানকে বাদরায়ণ মুক্তির বিশেষ সাধন বলে মেনেছেন, কর্মও যার সহায়ক বলে তিনি মনে করেন।
এই বিদ্যা বা ব্রহ্মজ্ঞান কী ? শ্বেতাশ্বতর উপনিষদে বলা হয়েছে-
‘এতৎ জ্ঞেয়ং নিত্যমেব আত্মসংস্থং নাতঃ পরং বেদিতব্যং হি কিঞ্চিৎ।
ভোক্তা ভোগ্যং প্রেরিতারং চ মত্বা সর্বং প্রোক্তং ত্রিবিধং ব্রহ্মমেতৎ’।। (শ্বেতাশ্বতর-১/১২)।।
অর্থাৎ : ব্রহ্ম যে অন্তরতম সত্তা, সর্বদা তিনি যে ভেতরে রয়েছেন, এ সত্য জানতে হবে। এর চেয়ে উচ্চতর আর কোন জ্ঞান নেই। জীব (ভোক্তা), জগৎ (ভোগ্য), এবং অন্তর্যামী ঈশ্বর (প্রেরিতারম্)- এই তিনই যে ব্রহ্ম একথাটা জানতে হবে (শ্বেতাশ্বতর-১/১২)।
ব্রহ্মের এই স্বরূপ জানতে গিয়ে উপনিষদের বিভিন্ন ঋষিগণ ব্রহ্মকে সৎ, উদ্গীথ, প্রাণ, ভূমা, পুরুষ, দহর, বৈশ্বানর, আনন্দময়, অক্ষর, মধু প্রভৃতি বিভিন্ন নামে বর্ণনা করে জ্ঞান দ্বারা উপাসনার কথা বলেছেন। এ সকল নামকে কেন্দ্র করে এই বিষয়ে কৃত উপদেশসমূহের নাম হয়েছে সৎ-বিদ্যা, উদ্গীথ-বিদ্যা, প্রাণবিদ্যা, ভূমা-বিদ্যা ইত্যাদি। এই বিদ্যা দ্বারাই মোক্ষ তথা পুরুষার্থ প্রাপ্ত হয় বলে বাদরায়ণ মনে করেছেন। তাই বেদান্তসূত্রে তিনি বলেন-
‘সর্ববেদান্তপ্রত্যয়ম্, চোদনাদ্যবিশেষাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/৩/১)।।
‘ভেদান্নেতি চেৎ, ন একস্যামপি’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/৩/২)।।
‘দর্শয়তি চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/৩/৪)।।
ভাবার্থ :
ভিন্ন ভিন্ন বেদান্ত গ্রন্থে ভিন্ন ভিন্নরূপ উপাসনা উপদিষ্ট হলেও উপাস্য বিষয় একই (ব্রহ্ম) এবং ফল (ব্রহ্ম-উপলব্ধি) বিষয়েও এদের মধ্যে পার্থক্য নেই (ব্রহ্মসূত্র-৩/৩/১)। উপাসনার প্রকার ভেদ আছে- অতএব সর্ব বেদান্তবর্ণিত উপাসনা এক নয়- এরূপ বলা সঙ্গত হবে না- কারণ, উপাসনা এক হলেও তার প্রকার ভেদ থাকতে পারে (ব্রহ্মসূত্র-৩/৩/২)। সকল শ্রুতিও উপাসনার এই একত্বের কথাই বলেছেন (ব্রহ্মসূত্র-৩/৩/৪)।
যেমন বৃহদারণ্যক উপনিষদে মর্ত থেকে স্বর্গ পর্যন্ত বিস্তারিত বলে বর্ণিত যে বৈশ্বানররূপী সগুণ ব্রহ্মের উপাসনার কথা আছে তা-ই ছান্দোগ্য উপনিষদে উল্লেখ করে বলা হয়েছে-
‘অথ হ উবাচ উদ্দালকম্ আরুণিং গৌতম বং ত্বম্ আত্মানম্ উপাস্স ইতি পৃথিবীমেব ভগবো রাজন্নিতি হ উবাচ এষঃ বৈ প্রতিষ্ঠাত্মা বৈশ্বানরো যং ত্বস্মাত্মানম্ উপাস্স তস্মাৎ ত্বম্ প্রতিষ্ঠিতঃ অসি প্রজয়া চ পশুভিঃ চ’।। (ছান্দোগ্য-৫/১৭/১)।।
অর্থাৎ : রাজা তারপর উদ্দালক আরুণিকে বললেন- ‘হে গৌতম, তুমি কাকে আত্মারূপে উপাসনা করো ?’ উদ্দালক প্রত্যুত্তরে বললেন- ‘হে রাজা, আমি পৃথিবীকেই উপাসনা করি।’ রাজা আবার বললেন- ‘তুমি যাঁর উপাসনা করো তিনি প্রতিষ্ঠা নামে (অর্থাৎ আশ্রয়রূপে) খ্যাত বৈশ্বানর আত্মা। এই কারণেই তুমি সন্তান ও পশুসম্পদ লাভ করে প্রতিষ্ঠা পেয়েছো’ (ছান্দোগ্য-৫/১৭/১)।
আবার ছান্দোগ্যেরই অন্য একটি শ্রুতিতে বলা হয়েছে-
‘আপয়িতা হ বৈ কামানাং ভবতি য এতৎ এবম্ বিদ্বান্ অক্ষরম্ উদ্গীথম্ উপাস্তে’।। (ছান্দোগ্য-১/১/৭)।।
অর্থাৎ : ‘ওম্’ই সবকিছুর আশ্রয়- এইভাবে যিনি অক্ষর ‘ওম্’কে উদ্গীথরূপে (ব্রহ্মরূপে) উপাসনা করেন, তিনি যা যা পেতে চান (পরিণামে) তাই লাভ করেন (ছান্দোগ্য-১/১/৭)।
তাই কঠ-উপনিষদেও বলা হয়েছে-
‘সর্বে বেদা যৎ পদম্ আমনন্তি তপাংসি সর্বাণি চ যদ্ বদন্তি।
যৎ ইচ্ছন্তঃ ব্রহ্মচর্যং চরন্তি তৎ তে পদং সংগ্রহেণ ব্রবীমি- ওম্ ইত্যেতৎ’।। (কঠোপনিষদ-১/২/১৫)।।
অর্থাৎ : সকল বেদসমূহ একবাক্যে যে ঈপ্সিত বস্তুর প্রতিপাদন করেন, যাঁকে পাবার জন্য সবরকমের তপস্যা, ব্রহ্মচর্যের সাধনা, তিনিই হলেন পরমাত্মা ব্রহ্ম- সংক্ষেপে ‘ওম্’ (কঠ-১/২/১৫)।
মীমাংসক জৈমিনি পুরুষার্থে তথা স্বর্গে কর্মের (যজ্ঞের) প্রাধান্যকে মেনেছেন এবং বিদ্যাকে মেনেছেন অর্থবাদ বলে। এর জন্য তিনি অশ্বপতি কৈকয় কিংবা রাজা জনকের মতো ব্রহ্মবেত্তার উদাহরণ উদ্ধৃত করে বলেছেন যে, ব্রহ্মবেত্তাগণের যজ্ঞাচারও দেখা যায়। জৈমিনির মতের বিরুদ্ধে বাদরায়ণ বলেন যে, স্বর্গ অপেক্ষা ব্রহ্মবিদ্যাতেই অধিক মোক্ষলাভ হয়। ব্রহ্মজ্ঞানীর যজ্ঞাদিকর্ম সর্বত্র দৃষ্ট হয় না। উপনিষদের ঋষি কোথাও কোথাও বলেছেন যে গৃহস্থাদি কর্মকাণ্ডও ইচ্ছাকৃত। আবার কয়েকজন তো কর্মের ক্ষয়কেও এইভাবে ব্যাখ্যা করেছেন যে, সন্ন্যাস আশ্রমও তো রয়েছে, যাতে কর্মকাণ্ড নেই তবুও সেখানে বিদ্যা (ব্রহ্মজ্ঞান) প্রযুক্ত হয়। জৈমিনি অবশ্যই এ আশ্রমকে মেনে নিতে অস্বীকার করেছেন, কিন্তু বাদরায়ণ এই আশ্রমকেও শ্রুতিপ্রতিপাদিত হওয়ার জন্য অনুষ্ঠেয় বলে স্বীকার করেছেন। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-
‘পুরুষার্থঃ অতঃ, শব্দাৎ ইতি বাদরায়ণঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/১)।।
‘তুল্যং তু দর্শনম্’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/৯)।।
‘কামকারেণ চৈকে’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/১৫)।।
‘উপমর্দ চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/১৬)।।
‘উর্ধ্বরেতঃসু চ, শব্দে হি’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/১৭)।।
‘অতএব চ অগ্নিন্ধনাদি অনপেক্ষা’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/২৫)।।
ভাবার্থ :
ঋষি বাদরায়ণ বলেন যে, ব্রহ্মবিদ্যা থেকেই সাধকের পরম পুরুষার্থ লাভ হয়। শ্রুতিও তাই বলে (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/১)। জ্ঞানী পুরুষের পক্ষে যজ্ঞাদি কর্মানুষ্ঠান করার এবং না করার উভয় বিধানই তুল্যরূপে শাস্ত্রে দেয়া আছে (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/৯)। ব্রহ্মজ্ঞানের পর ব্রহ্মজ্ঞের কর্মানুষ্ঠান ঐচ্ছিক। জনকাদি ঋষিরা ব্রহ্মকর্ম করেছেন- আবার কেউ কেউ ব্রহ্মজ্ঞানের পর কর্ম করেননি (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/১৫)। বিদ্যা কর্মের অঙ্গ নয়। বরং জ্ঞানের দ্বারা কর্মফল ধ্বংশই হয় (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/১৬)। সন্ন্যাস আশ্রমে বিদ্যাসাধনেরই উপদেশ শাস্ত্র বিধান করেছেন- কর্মের নয়। সুতরাং বিদ্যা কর্মাঙ্গ নয় (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/১৭)। ‘জ্ঞানেই মুক্তি’ শ্রুতিতে এরূপ উল্লেখ থাকায় সন্ন্যাসীর পক্ষে যজ্ঞাদি কর্ম নিষ্প্রয়োজন (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/২৫)।
বাদরায়ণ যেহেতু শব্দ-প্রমাণক অর্থাৎ শ্রুতিবচনকেই প্রামাণ্য হিসেবে গণ্য করেন, তাই বেদান্তসূত্রে স্বভাবতই শ্রুতি-প্রামাণ্যেও উদাহরণ টেনেছেন। যেমন, শ্রুতিতে বলা হয়েছে-
‘…ভগবদ্-দৃশেভ্যঃ তরতি শোকম্ আত্মবিদ্ ইতি…’। (ছান্দোগ্য-৭/১/৩)।।
‘ব্রহ্মবিৎ আপ্নোতি পরম্ । তদেষা অভ্যুক্তা। সত্যং জ্ঞানম্ অনন্তং ব্রহ্ম’। (তৈত্তিরীয়-২/১/১)।।
‘…এতং বৈ তমাত্মানম্ বিদিত্বা ব্রাহ্মণাঃ পুত্রৈষণায়াশ্চ বিত্তৈষণায়াশ্চ লোকৈষণায়াশ্চ ব্যুত্থায়, অথ ভিক্ষাচর্যং চরন্তি…’। (বৃহদারণ্যক-৩/৫/১)।।
‘তপঃশ্রদ্ধে যে হি উপবসন্ত্যরণ্যে শান্তা বিদ্বাংসো ভৈক্ষ্যচর্যাং চরন্তঃ।
সূর্যদ্বারেণ তে বিরজাঃ প্রয়ান্তি যত্র অমৃতং স পুরুষো হ্যব্যয়াত্মা’।। (মুণ্ডক-১/২/১১)।।
অর্থাৎ :
আত্মজ্ঞানী শোক অতিক্রম করেন (ছান্দোগ্য-৭/১/৩)। যিনি ব্রহ্মকে জানেন তিনি পরব্রহ্মকে জানেন। এ বিষয়ে একটি মন্ত্র আছে- ‘ব্রহ্ম সত্য, জ্ঞান ও অনন্ত’ (তৈত্তিরীয়-২/১/১)। এই আত্মাকে জেনে ব্রাহ্মণগণ পুত্রকামনা, বিত্তকামনা ও লোককামনা একেবারে পরিত্যাগ করে ভিক্ষাটন অর্থাৎ সন্ন্যাস অবলম্বন করবেন (বৃহদারণ্যক-৩/৫/১)। কিছু সংযত-ইন্দ্রিয়, বিদ্বান ব্যক্তি আছেন যাঁরা অরণ্যে বাস করেন এবং ভিক্ষান্নে জীবন ধারণ করেন। পরম সত্য লাভ করার উদ্দেশ্যে তাঁরা কৃচ্ছ্রসাধন ও তপস্যা করেন। এভাবে তাঁদের চিত্ত শুদ্ধ হয়। মৃত্যুর পর সূর্যদ্বার পথে (উত্তরায়ণ মার্গে) তাঁরা সেই লোকে যান যেখানে অবিনাশী অক্ষয় পুরুষ হিরণ্যগর্ভ বাস করেন। একেই বলে ব্রহ্মলোক (মুণ্ডক-১/২/১১)।
ব্রহ্মবিদ্যার ক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, বেদান্ত উপনিষদের শ্রুতিগুলিই যেহেতু ব্রহ্মজ্ঞানের উৎস, তাই শ্রুতিকে অভ্রান্ত ও প্রামাণ্য বলেই মনে করা হয়। সেক্ষেত্রে, কোন কোন তত্ত্বজ্ঞানের বিষয়কে সহজবোধ্য করে উপলব্ধির সুবিধার্থে অনেক উপনিষদেই বিভিন্ন কাহিনী বা আখ্যায়িকার মাধ্যমে তত্ত্বজ্ঞান বিশ্লেষণ লক্ষ্য করা যায়। উল্লিখিত কাহিনীগুলি হলো যাজ্ঞবল্ক্য-মৈত্রেয়ী কাহিনী, প্রতর্দন কাহিনী, যম-নচিকেতা সংবাদ ইত্যাদি- যেগুলি বৃহদারণ্যক, কৌষীতকি এবং অন্যান্য উপনিষদে বর্ণিত আছে। এখান প্রশ্ন হলো, উপনিষদের এই কাহিনীগুলি শ্রুতি নির্ধারিত পারিপ্লব কিনা ? জবাবে বাদরায়ণ বলেন-
‘পারিপ্লবার্থা ইতি চেৎ, ন, বিশেষিতত্বাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/২৩)।।
‘তথা চ একবাক্যতা-উপবন্ধাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/২৪)।।
ভাবার্থ :
‘পারিপ্লব’ হলো অশ্বমেধযজ্ঞে পঠিত কাহিনী-সমষ্টি। উপনিষদের কাহিনীগুলি পারিপ্লবার্থে ব্যবহৃত হয় না- কারণ পারিপ্লবের কাহিনীগুলি শ্রুতি নির্দিষ্ট করা আছে (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/২৩)। উপনিষদ্ বর্ণিত কাহিনীগুলি ঐগুলির নিকটতম বিদ্যার বিষয়কে বিস্তারিত করার জন্য এর (বিদ্যার) সাথে এক হয়ে সন্নিবিষ্ট আছে। এরা বিদ্যার সহায়ক, পারিপ্লবের অঙ্গ নয় (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/২৪)।
নিয়মানুযায়ী অশ্বমেধযজ্ঞের অনুষ্ঠানটি একবৎসর সময়ব্যাপী হয়ে থাকে। এ সময়ের মধ্যে যজ্ঞানুষ্ঠাতা এবং তাঁর পরিবারবর্গকে কিছুদিন পর পর কতকগুলি কাহিনী শ্রবণ করতে হয়। এই কাহিনী-সমষ্টিকে বলা হয় পারিপ্লব, এবং এটি একটি যজ্ঞকর্মাঙ্গও বটে। কিন্তু উপনিষদে বর্ণিত কাহিনীগুলিও কি একই উদ্দেশ্যে গৃহীত হবে ? যদি তাই হয়, তাহলে এরাও যজ্ঞকর্মের অংশ হয়ে যায়- এবং সেক্ষেত্রে এর অর্থ এই হয় যে, জ্ঞানকাণ্ড কর্মকাণ্ডেরই অধীন। বাদরায়ণের মতে, উপনিষদের কাহিনীগুলি পারিপ্লব অনুষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত নয়- কারণ পারিপ্লবের কাহিনীগুলি শ্রুতি দ্বারা নির্ধারিত। যেকোন কাহিনী এর উদ্দেশ্য সিদ্ধ করতে পারে না। উপনিষদের কাহিনীগুলিকে এজাতীয় কাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। উপনিষদের কাহিনীগুলি বিদ্যার ব্যাখ্যানের জন্যই উল্লিখিত। এই বিদ্যা বা ব্রহ্মজ্ঞানের মাধ্যমেই মোক্ষ বা মুক্তির সাধনকে সূত্রকার বাদরায়ণ সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়েছেন। এবং ব্রহ্মবিদ্যা বিহীন অন্য কর্মকে গুরুত্বহীন বলে বাদরায়ণ মনে করেন।
ব্রহ্মজ্ঞানের
প্রাধান্যকে স্বীকার করেও বাদরায়ণ কতিপয় উপনিষদীয় ঋষির মতো যজ্ঞাদি
কর্মকাণ্ডকে তুচ্ছ করেননি, বরং কর্মে নিযুক্ত গৃহস্থাদি আশ্রমের মধ্যেও
অগ্নিহোত্র প্রভৃতি ক্রিয়াকলাপকে ব্রহ্মজ্ঞানের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় বলে মনে
করেছিলেন। বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-
‘সর্বাপেক্ষা চ যজ্ঞাদিশ্রুতেঃ অশ্ববৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/২৬)।।
‘শমদমাদি-উপেতঃ স্যাৎ তথা অপি তু, তদ্বিধেঃ তদঙ্গতয়া তেষাম্-অবশ্য-অনুষ্ঠেয়ত্বাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/২৭)।।
ভাবার্থ :
জ্ঞানলাভের সহায়ক হিসেবে সকল ক্রিয়ানুষ্ঠানের বিধানই শাস্ত্রে আছে, কিন্তু মোক্ষলাভের সঙ্গে যজ্ঞাদির সাক্ষাৎ কোন সম্পর্ক নেই। যেমন গমন কার্যের জন্য অশ্বের প্রয়োজন- কিন্তু উদ্দিষ্ট দেশ প্রাপ্ত হলে গমনের ফলের সঙ্গে অশ্বের সাক্ষাৎ কোন সম্পর্ক থাকে না (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/২৬)। যজ্ঞাদি কর্মে বিদ্যা উৎপন্ন হয়। বিদ্যার শেষ ফল মোক্ষলাভের জন্য শম, দম, তিতিক্ষা প্রভৃতি সাধন-অভ্যাস শাস্ত্রে বিহিত আছে। বিদ্যার অঙ্গীভূত রূপে শমদমাদি সাধনের বিধি থাকায় তা অবশ্যই অনুষ্ঠেয় (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/২৭)।
কারণ, এ বিষয়ে প্রামাণ্য শ্রুতিতেও বলা হয়েছে-
‘তমেতং বেদানুবচনেন ব্রাহ্মণা বিবিদিষন্তি যজ্ঞেন দানেন তপসাত্নাশকেন…’। (বৃহদারণ্যক-৪/৪/২২)।।
অর্থাৎ : ব্রাহ্মণগণ নিত্য স্বাধ্যায় যজ্ঞ, দান ইত্যাদি দ্বারা এঁকে জানতে ইচ্ছে করেন (বৃঃ-৪/৪/২২)। এজন্যই এইরূপ জ্ঞানী, শান্ত, দান্ত, উপরত… হয়ে নিজের দেহেন্দ্রিয়ের মধ্যে আত্মাকে সন্দর্শন করেন (বৃঃ-৪/৪/২৩)।
অর্থাৎ জ্ঞানলাভের সহায়ক হিসেবে এসব যজ্ঞক্রিয়ার উপযোগিতা আছে- এবং শাস্ত্রেও এসবের বিধান আছে। কিন্তু জ্ঞানের ফল মোক্ষ বা মুক্তি সাধনে এসব কর্মানুষ্ঠানের কোন ভূমিকাই নেই। কেননা, মোক্ষলাভ একমাত্র জ্ঞানের দ্বারাই সম্ভব- কর্মদ্বারা নয়। বলা হয়, শম, দম, যজ্ঞাদি ক্রিয়া মনকে শুদ্ধ করে, এবং এরূপ শুদ্ধ মনেই আত্মজ্ঞান প্রতিভাত হন। তাই জ্ঞান উৎপাদনের পরোক্ষ উপায়রূপে কর্মের উপযোগিতা আছে। শম-দমাদির সঙ্গে জ্ঞান যুক্ত হওয়া প্রয়োজন। কর্ম ঠিক, কিন্তু ব্রহ্মবিদ্যার দ্বারা তা অধিক শক্তিশালী হয়।
বাদরায়ণ কেবল যাগ-যজ্ঞাদি ইষ্ট কর্মই নয়, পানভক্ষণ সম্বন্ধীয় নিয়ম থেকেও ব্রহ্মবাদীগণকে মুক্ত করার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। তবে প্রাণনাশের আশঙ্কা থাকলে অন্য জাতির অন্ন গ্রহণের অনুমতি তিনি ঋষি উষস্তি চাক্রায়ণের মতোই দিয়েছেন। কেননা শ্রুতিভাষ্য অনুযায়ী জানা যায়, ঋষি চাক্রায়ণ খাদ্যাভাবে মৃত্যু উপস্থিত হলে এরূপ করেছিলেন। তবে সেই গ্রহণও হবে অজ্ঞাতে। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-
‘সর্বান্ন-অনুমতিশ্চ প্রাণাত্যয়ে, তদ্দর্শনাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/২৮)।।
‘অবাধাৎ চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/২৯)।।
ভাবার্থ :
প্রাণোপাসকের পক্ষে ভক্ষ্য-অভক্ষ্য বিচারের কোন প্রয়োজন নেই। অন্নাভাবে প্রাণ বিনাশের আশঙ্কা দেখা দিলে অন্ন বিষয়ে বিচারের প্রয়োজন নেই, শাস্ত্রে এইরূপ নির্দেশ আছে (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/২৮)। সর্বান্ন ভক্ষণের বিধি বিশেষ ক্ষেত্রে মাত্র দেয়া হয়েছে। তবে আহার শুদ্ধির প্রয়োজনীয়তা আছে (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/২৯)।
এক্ষেত্রে শ্রুতি প্রামাণ্য হিসেবে ছান্দোগ্য উপনিষদের শ্রুতিবচনে উল্লেখ করা হয়েছে-
‘স হোবাচ কিং মে অন্নম্ ভবিষ্যতি ইতি যৎ কিঞ্চিৎ ইদম্ আশ্বভ্যঃ আশকুনিভ্যঃ ইতি হোচুস্তদ্বা এতৎ অনস্য অন্নম্ অনঃ হ বৈ নাম প্রত্যক্ষং ন হ বা এবংবিদি কিঞ্চন ন অনন্নম্ ভবতি ইতি’।। (ছান্দোগ্য-৫/২/১)।।
অর্থাৎ : প্রাণ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আমার অন্ন কী হবে ?’ অন্য ইন্দ্রিয়েরা উত্তর দিলেন, ‘কুকুর ও শকুনি থেকে আরম্ভ করে সকল জীবের যা কিছু খাদ্য আছে (সেই সমস্তই আপনার অন্ন)।’ এইসবই অনের অন্ন। অন এই শব্দটি (প্রাণের) সাক্ষাৎ নাম। যিনি এরূপ (অর্থাৎ নিজেকে সকল অন্নের ভক্ষক প্রাণরূপে) জানেন তাঁর নিকট কিছুই অভক্ষ্য থাকে না (অর্থাৎ যে কোন প্রাণীর খাদ্যই তাঁর অন্ন হয়) (ছান্দোগ্য-৫/২/১)।
শ্রুতির এই উক্তির অপূর্বত্বহেতু এটি প্রাণোপাসকদের পক্ষে একটি বিধি বলেই মনে হতে পারে। কিন্তু বাদরায়ণ বলেন যে, এটি বিধি নয়, শুধু একটি ঘটনার বিবৃতি মাত্র, কেননা যেখানে বিধির অনুমানের কোন হেতু নেই সেখানে তার ধারণা অযৌক্তিক। নিষিদ্ধ খাদ্য তখনই ভক্ষণ করা যেতে পারে যখন জীবন বিপন্ন হয়। কারণ-
‘অপি চ স্মর্যতে’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/৩০)।।
‘শব্দশ্চ অতঃ অকামকারে’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/৩১)।।
ভাবার্থ :
মনুসংহিতাদি স্মৃতিশাস্ত্রেও প্রাণ সঙ্কটকালে নির্বিচারে খাদ্য গ্রহণের বিধি আছে (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/৩০)। শাস্ত্রসমূহ খাদ্য বিষয়ে যথেচ্ছাচারকে নিষেধই করেছেন। আপৎকাল ছাড়া খাদ্যের বিচার অবশ্যই করণীয় (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/৩১)।
উল্লেখ্য, মনুসংহিতায় এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে-
‘জীবিতাত্যয়মাপন্নো যঃ অন্নমত্তি যতস্ততঃ।
আকাশমিব পঙ্কেন ন স পাপেন লিপ্যতে’।। (মনুসংহিতা-১০/১০৪)।।
‘ক্ষুধার্তশ্চাত্তুমভ্যাগাদ্-বিশ্বামিত্রঃ শ্বজাঘনীম্ ।
চন্ডালহস্তাদাদায় ধর্মাধর্মবিচক্ষণঃ’।। (মনুসংহিতা-১০/১০৮)।।
অর্থাৎ :
যে ব্রাহ্মণ অন্নাভাবে জীবনসংশয়ে পতিত হয়েছেন তিনি যদি যেখানে-সেখানে অন্ন ভোজন করেন (এই ক্ষেত্রে অন্নস্বামীর জাতি ও কাজ বিবেচনা করা অনাবশ্যক), তাহলে আকাশ যেমন পঙ্কলিপ্ত হয় না, তিনিও সেইরকম পাপে লিপ্ত হন না (মনু-১০/১০৪)। ধর্মাধর্মবিচক্ষণ ঋষি বিশ্বামিত্র ক্ষুধায় কাতর হয়ে চণ্ডালের হাত থেকে কুকুরের জঘন মাংস (যা স্বভাবতঃ সকলরকম দোষযুক্ত) গ্রহণ করে ভোজন করতে উদ্যত হন, তবুও তিনি পাপে লিপ্ত হন নি (মনু-১০/১০৮)।
তবে সাধারণ ক্ষেত্রে ভক্ষ্য-অভক্ষ্যের শুদ্ধি বিচার প্রসঙ্গে মনুসংহিতায় বলা আছে-
‘অভোজ্যমন্নং নাত্তব্যমাত্মনঃ শুদ্ধিমিচ্ছতা।
অজ্ঞানভুক্তং তূত্তার্যং শোধ্যং বাপ্যাশু শোধনৈঃ’।। (মনুসংহিতা-১১/১৬১)।।
অর্থাৎ : নিজেকে শুদ্ধ রাখবার ইচ্ছা থাকলে অভক্ষ্য ভক্ষণ করা কখনোই উচিত নয়। যদি অজ্ঞানতাবশতঃ ঐরকম অখাদ্য খাওয়া হয়ে যায়, তাহলে তা তখনই বমি করে উগরিয়ে ফেলবে ; যদি বমি না করা যায় তাহলে তখনই (শাস্ত্রাযায়ী) প্রায়শ্চিত্ত করে শুদ্ধ হবে (মনু-১১/১৬১)।
প্রকৃতপক্ষে বাদরায়ণ কর্মানুষ্ঠানকে অপ্রয়োজনীয় মনে করেননি, তাই তিনি আশ্রমের কর্তব্য অর্থাৎ গৃহস্থাদি ধর্মকে ব্রহ্মজ্ঞানীর জন্যও ব্রহ্মবিদ্যার সাহায্যকারীর পটভূমিতে কর্তব্য বলে মেনেছেন। আপৎকালে তিনি নিয়ম-শৃঙ্খলাকে শিথিল করতে প্রস্তুত ছিলেন, এবং আশ্রমহীন অপেক্ষা আশ্রমবাসই শ্রেয় মনে করেছেন। এ প্রেক্ষিতে বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-
‘বিহিতত্বাৎ চ আশ্রম কর্মাপি’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/৩২)।।
‘সহকারিত্বেন চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/৩৩)।।
‘সর্বথাপি ত এব, উভয়লিঙ্গাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/৩৪)।।
ভাবার্থ :
আশ্রমবিহিত কর্ম সকলেরই করণীয়, কারণ, তা-ই শাস্ত্রের বিধান (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/৩২)। জ্ঞানলাভই পরম পুরুষার্থ। সুতরাং জ্ঞানলাভের সহায়ক বলেও এসকল কর্তব্য কর্ম অবশ্য পালনীয় (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/৩৩)। মুমুক্ষু এবং গৃহী উভয়ের পক্ষে যে যজ্ঞাদি কর্মের বিধান তা একই কর্ম, ভিন্ন ভিন্ন কর্ম নয় (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/৩৪)।
আশ্রমোচিত এ সকল অবশ্য করণীয় কর্মানুষ্ঠান যে জ্ঞানেরও সহায়ক, স্মৃতি ও শ্রুতিশাস্ত্রেও প্রামাণ্য আছে। যেমন স্মৃতিশাস্ত্র শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে-
‘অনাশ্রিতঃ কর্মফলং কার্যং কর্ম করোতি যঃ।
স সন্ন্যাসী চ যোগী চ ন নিরগ্নির্ন চাক্রিয়ঃ’।। (ভগবদ্গীতা-৬/১)।।
অর্থাৎ : শ্রীভগবান বললেন- কর্মফলের আশা না করে যিনি কর্তব্য (অগ্নিহোত্রাদি) নিত্যকর্ম করেন, তিনিও সন্ন্যাসী, তিনিও কর্মযোগী। অগ্নিহোত্রাদি শ্রৌত ও তপোদানাদি স্মার্ত কর্ম যিনি ত্যাগ করেছেন, কেবল তিনিই সন্ন্যাসী বা যোগী নন (গীতা-৬/১)।
আবার ছান্দোগ্য উপনিষদের শ্রুতিতে আছে-
‘অথ যৎ অনাশকায়নম্ ইতি আচক্ষতে ব্রহ্মচর্যম্ এব তৎ এষঃ হি আত্মা ন নশ্যতি যং ব্রহ্মচর্যেণ অনুবিন্দুতে অথ যৎ অরণ্যায়নম্ ইতি আচক্ষতে ব্রহ্মচর্যম্ এব তৎ তৎ অরঃ চ হ বৈ ণ্যঃ চ অর্ণবৌ ব্রহ্মলোকে তৃতীয়স্যাম্ ইতঃ দিবি তৎ ঐরস্মদীয়ং সরঃ তৎ অশ্বত্থঃ সোমসবনঃ তৎ অপরাজিতা পুঃ ব্রহ্মণঃ প্রভুবিমিতং হিরন্ময়ম্’।। (ছান্দোগ্য-৮/৫/৩)।।
অর্থাৎ : অতঃপর, যাকে ‘অনাশকায়ন’ বা অনশনব্রত বলা হয় তাও ব্রহ্মচর্য। কারণ ব্রহ্মচর্যের দ্বারা যে আত্মাকে লাভ করা যায় তার নাশ হয় না (‘অনাশক’)। আবার যাকে ‘অরণ্যায়ন’ (অরণ্যে বাস) বলা হয় তাও ব্রহ্মচর্য। কারণ এই পৃথিবী থেকে তৃতীয়-সংখ্যক দ্যুলোকে অর্থাৎ ব্রহ্মলোকে ‘অর’ ও ‘ণ্য’ নামে দুটি সমুদ্র আছে। এছাড়াও সেখানে ঐরম্মদীয় নামে একটি সরোবর (যার জল আনন্দ-বর্ধক), একটি অশ্বত্থ গাছ যার থেকে সোমরস নিঃসৃত হয়, ‘অপরাজিতা’ নামে ব্রহ্মের পুরী এবং ব্রহ্মার দ্বারা নির্মিত স্বর্ণময় একটি মণ্ডপ আছে (ছান্দোগ্য-৮/৫/৩)।
এই শ্রুতি থেকে জানা যায় যে, ব্রহ্মচর্যাদির ন্যায় সমজাতীয় কর্মানুষ্ঠান জ্ঞানের সহায়ক। ব্রহ্মচর্যাদি গুণের দ্বারা ভূষিত সাধক ক্রোধ-ঈর্ষা প্রভৃতির দ্বারা পরাভূত হন না, এজন্য তাঁর চিত্তও চঞ্চল হয় না এবং সেকারণে তিনি (জ্ঞানের) সাধনায় সক্ষম হন। আর তাই বাদরায়ণ আপৎকালে নিয়ম-শৃঙ্খলাকে শিথিল করতে প্রস্তুত হলেও আশ্রমহীন অপেক্ষা আশ্রমবাসই শ্রেয় বলে মনে করেছেন। ফলে এ প্রেক্ষিতে বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-
‘অন্তরা চ অপি তু, তদ্দৃষ্টেঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/৩৬)।।
‘অতঃ তু ইতরৎ জ্যায়ঃ লিঙ্গাৎ চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/৩৯)।।
ভাবার্থ :
আশ্রম বহির্ভূত, অন্তরাস্থিত ব্যক্তিরাও ব্রহ্মজ্ঞানের অধিকারী। যেমন শাস্ত্রে রৈক্ক বাচক্লবী প্রভৃতির দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/৩৬)। যদিও অনাশ্রমী হয়েও বিদ্যালাভ করা যায় তবুও অনাশ্রমী না হয়ে কোন আশ্রমকে অবলম্বন করাই শ্রেয়, কারণ শ্রুতি এবং স্মৃতি শাস্ত্রে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবেই আশ্রম গ্রহণের উপদেশ আছে (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/৩৯)।
তবে এখানে উল্লেখ্য যে, মুক্তির লক্ষ্যে জ্ঞানলাভের যে নানা উপায় রয়েছে, এসব সাধনোপায় থেকে উদ্ভূত জ্ঞান কি এ জন্মেই লাভ হয়, না কি জন্মান্তরে লাভ হয়, তা নিয়েও একটি প্রশ্ন উত্থাপিত হতে পারে। তাই বাদরায়ণ বেদান্তসূত্রে এই জ্ঞানোৎপত্তি বিষয়ে বলেন-
‘ঐহিকম্ অপি অপ্রস্তুতপ্রতিবন্ধে, তদ্দর্শনাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/৫১)।।
ভাবার্থ : কোন প্রতিবন্ধকতা না থাকলে এই জন্মেই ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয়। প্রতিবন্ধক থাকলে জন্মান্তরে হয়। এরূপ দৃষ্টান্ত শাস্ত্রে পাওয়া যায় (ব্রঃ-৩/৪/৫১)।
অর্থাৎ
জ্ঞান এজন্মে বা জন্মান্তরে উৎপন্ন হতে পারে- তা নির্ভর করে কোন
প্রতিবন্ধকতা আছে কি না এবং সাধকের যোগ্যতা কিংবা উপাসনার তীব্রতা কেমন তার
উপর। যেমন, কঠ-উপনিষদেই বলা হয়েছে-
‘শ্রবণায়াপি বহুভির্যো ন লভ্যঃ শৃণ¦ন্তঃ অপি বহবো যং ন বিদ্যুঃ।
আশ্চর্যো বক্তা কুশলঃ অস্য লব্ধাঃ আশ্চর্যঃ জ্ঞাতা কুশলানুশিষ্টঃ’।। (কঠোপনিষদ-১/২/৭)।।
অর্থাৎ : আত্মার বিষয়ে অনেকে শোনারও সুযোগ পান না। আবার শুনেও অনেকে এর তাৎপর্য বুঝতে পারেন না। আসলে আত্মা সম্পর্কে শিক্ষাদানের যোগ্যতা অতি অল্প সংখ্যক মানুষেরই থাকে। কাজেই এই আত্মজ্ঞান অতি নিপুণ শিক্ষার্থীই লাভ করতে পারেন। এই কারণেই নিপুণ আচার্যের কাছ থেকে শিক্ষা পেয়ে আত্মজ্ঞান লাভ করেছেন এমন মানুষের সংখ্যা সত্যিই বিরল (কঠ-১/২/৭)।
আবার শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ধ্যানযোগে বলা হয়েছে-
‘প্রযত্নাদ্ যতমানস্তু যোগী সংশুদ্ধকিল্বিষঃ।
অনেকজন্মসংসিদ্ধস্ততো যাতি পরাং গতিম্’।। (ভগবদ্গীতা-৬/৪৫)।।
অর্থাৎ : যত্নশীল যোগী বহু প্রযত্নের চর্চায় নিষ্পাপ হয়ে অনেক জন্মের সাধনসঞ্চিত সংস্কার দ্বারা সিদ্ধ মনোরথ হয়ে পরমগতি মোক্ষপ্রাপ্ত হন (গীতা-৬/৪৫)।
সাধনে প্রতিবন্ধকতা কিংবা সাধকের উপাসনার তীব্রতার বিষয় ছাড়াও এখানে আরেকটি সন্দেহ থাকতে পারে যে, হয়তো এমন কোন নিয়ম থাকতে পারে যার দ্বারা জ্ঞানের ফলশ্রুতি মোক্ষলাভ করা যায়। অথবা অন্যভাবে বললে, জ্ঞানলাভের পর মোক্ষ কি বিলম্বিত হতে পারে ? এবং সাধকের গুণানুসারে জ্ঞানের কি মাত্রাগত ভেদ আছে ? এসব সন্দেহ নিরসনকল্পে বাদরায়ণ বলেন, মোক্ষ বিষয়ে এরূপ কোন সুনির্দিষ্ট নিয়ম নাই। কারণ শ্রুতি বচনসমূহ দৃঢ়তার সঙ্গে ঘোষণা করে যে, চরম মোক্ষ অবস্থাটি একই প্রকার, এর মাত্রাগত কোন প্রভেদ নেই। কেননা চরম মুক্তির অবস্থা ব্রহ্ম ব্যতীত আর কিছুই নয়। তাই বেদান্তসূত্রে খোলাখুলি উক্তি-
(৩) উপাসনা :
‘এবং মুক্তিফলানিয়মঃ, তৎ অবস্থাবধৃতেঃ তদবস্থাবধৃতেঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৩/৪/৫২)।।
ভাবার্থ : মোক্ষলাভ কখন কিভাবে হবে- জ্ঞানের ফল কিভাবে দেখা দেবে- এই বিষয়ে কোন সুনির্দিষ্ট নিয়ম নেই। শ্রুতি এই অবস্থাকে অনির্বচনীয় বা চিরন্তন বলেই ঘোষণা করেছেন। ব্রহ্মের সাথে একত্ব লাভ করাই মোক্ষ বা মুক্তি (ব্রঃ-৩/৪/৫২)।
বিভিন্ন
জ্ঞান দ্বারা কিভাবে ব্রহ্মোপাসনা করা যায়, উপনিষদের প্রকরণেই তা বলা
হয়েছে- আত্মগতভাবে ব্রহ্মের উপাসনা করতে হয়, কোনো মূর্তি বা প্রতীকের
মাধ্যমে করা নিষিদ্ধ, কারণ ঐগুলি ব্রহ্ম নয়। যেমন-
‘…আত্মা বা অরে দ্রষ্টব্যঃ শ্রোতাব্যো মন্তব্যো নিদিধ্যাসিতব্যো মৈত্রেয়ী, আত্মনো বা অরে দর্শনেন শ্রবণেন মত্যা বিজ্ঞানেন ইদং সর্বং বিদিতম্’।। (বৃহদারণ্যক-২/৪/৫)।।
‘সর্বং হি এতৎ ব্রহ্ম অয়ম্ আত্মা ব্রহ্ম সঃ অয়ম্ আত্মা চতুষ্পাৎ’।। (মাণ্ডুক্য-২)।।
‘মনঃ ব্রহ্ম ইতি উপাসীত ইতি অধ্যাত্মম্ অথ অধিদৈবতম্ আকাশো ব্রহ্ম ইতি উভয়ম্ আদিষ্টম্ ভবতি অধ্যাত্মম্ চ অধিদৈবতম্ চ’।। (ছান্দোগ্য-৩/১৮/১)।।
অর্থাৎ :
মৈত্রেয়ী, সর্বত্রই এই আত্মা। সকলকে ব্যাপ্ত করে রয়েছেন একই আত্মা। সেই আত্মাকেই দর্শন করতে হবে, শ্রবণ করতে হবে, মনন করতে হবে, নিদিধ্যাসন বা ধ্যান করতে হবে। এই আত্মার দর্শন, শ্রবণ, মনন, নিদিধ্যাসন ঠিকমতো প্রত্যয়ের সঙ্গে করতে পারলেই তার সব জানা হয়ে যাবে (বৃঃ-২/৪/৫)। সমগ্র জগৎই ব্রহ্ম। এই জীবাত্মাও ব্রহ্ম। আপাতদৃষ্টিতে এই আত্মার চারটি অবস্থা (মাণ্ডুক্য-২)। ‘মনই ব্রহ্ম’- এইভাবে যে উপাসনা, তা হলো অধ্যাত্ম উপাসনা। আর ‘আকাশ ব্রহ্ম’- এইভাবে যে উপাসনা, তা অধিদৈবত উপাসনা। কেননা, হৃদয়াভ্যন্তরে মনই আকাশ, বাইরের আকাশই সেই বৃহৎ মন (ছান্দোগ্য-৩/১৮/১)।
এসব শ্রুতিবচন অনুসরণ করেই বাদরায়ণ বেদান্তসূত্রে ব্রহ্মোপাসনার উপায় ব্যাখ্যা করে বলেন-
‘আবৃত্তিঃ, অসকৃৎ উপদেশাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/১/১)।।
‘আত্মেতি তু উপগচ্ছন্তি গ্রাহয়ন্তি চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/১/৩)।।
‘ন প্রতীকে, ন হি সঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/১/৪)।।
‘ব্রহ্মদৃষ্টিঃ, উৎকর্ষাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/১/৫)।।
ভাবার্থ :
ব্রহ্মবিদ্যালাভের জন্য শাস্ত্রবিহিত শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনাদির পুনঃপুনঃ অভ্যাস করতে হবে, কারণ এটাই শাস্ত্রের বহুল নির্দেশ (ব্রহ্মসূত্র-৪/১/১)। কিন্তু শ্রুতিসমূহ ব্রহ্মকে উপাসকের আত্মারূপে জানেন এবং অপরকেও এরূপ ধারণা করতে উপদেশ দেন। ধ্যেয় ব্রহ্মই আমার আত্মা- এরূপ ধ্যানের উপদেশই শ্রুতিসমূহ দিয়ে থাকেন (ব্রহ্মসূত্র-৪/১/৩)। উপাসক প্রতীকের সঙ্গে নিজের একত্ব কল্পনা করে ধ্যান করবেন না, কারণ সাধক প্রতীক নন (ব্রহ্মসূত্র-৪/১/৪)। প্রতীককে ব্রহ্মরূপে দর্শন করা বিধেয়, কিন্তু ব্রহ্মকে প্রতীকরূপে ধ্যান করা বিধেয় নয় কারণ তা হলে প্রতীকটি ব্রহ্ম থেকে উৎকৃষ্ট হয়ে যায় (ব্রহ্মসূত্র-৪/১/৫)।
‘মনই ব্রহ্ম’, ‘আদিত্যই ব্রহ্ম’- ইত্যাদি প্রতীক উপাসনা প্রসঙ্গে এই প্রশ্ন জাগে যে, এখানে আমরা প্রতীককেই কি ব্রহ্ম বলে মনে করবো, না ব্রহ্মকেই প্রতীক বলবো ? বাদরায়ণ বলছেন, মন, আদিত্য ইত্যাদি প্রতীককেই ব্রহ্ম বলে গণ্য করতে হবে- কিন্তু এর বিপরীতক্রমটি নয়। যেহেতু আমাদের লক্ষ্য হলো নানাত্বেও ধারণা থেকে মুক্তি লাভ করে সর্বভূতে ব্রহ্ম দর্শন করা, সেহেতু আমাদের সেসব প্রতীককেই ব্রহ্মরূপে ধারণা করতে হবে।
আবার ধ্যান বা উপাসনার ভঙ্গি হিসেবে বাদরায়ণ বলেন, আসনে উপবিষ্ট হয়ে, স্থির দেহে, একাগ্রচিত্তে, ধ্যানের মাধ্যমে ব্রহ্মের উপাসনা করা দরকার এবং তা করতে হয় আবৃত্তি সহ, প্রত্যহ সারাজীবন। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-
‘আসীনঃ, সম্ভবাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/১/৭)।।
‘ধ্যানাৎ চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/১/৮)।।
‘অচলত্বং চাপেক্ষ্য’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/১/৯)।।
‘যত্র একাগ্রতা তত্র, অবিশেষাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/১/১১)।।
‘আপ্রায়ণাৎ, তত্রাপি হি দৃষ্টম্’।। (ব্রহ্মসূত্র-৪/১/১২)।।
ভাবার্থ :
আসনে উপবেশন করেই উপাসনা বা ধ্যান করা কর্তব্য (ব্রহ্মসূত্র-৪/১/৭)। ধ্যান এবং উপাসনা একই। আসনে না বসলে ধ্যান বা উপাসনা যথাযথ হয় না (ব্রহ্মসূত্র-৪/১/৮)। পৃথিবীর স্থিরত্বকে লক্ষ্য করেই স্থির হয়ে ধ্যানের উপদেশ আছে। আসনে স্থির হয়ে ধ্যান কর্তব্য- শায়িত বা চলিত অবস্থায় নয় (ব্রহ্মসূত্র-৪/১/৯)। ধ্যান বা উপাসনার স্থানবিশেষের কোন নির্দিষ্ট বিধি নাই। যেখানেই মনঃসংযোগ হবে সেখানেই ধ্যান করা যায় (ব্রহ্মসূত্র-৪/১/১১)। মোক্ষলাভ না হলে মৃত্যুকাল পর্যন্ত আজীবন উপাসনা করে যাবার উপদেশ শাস্ত্রে আছে (ব্রহ্মসূত্র-৪/১/১২)।
…
(চলবে…)
…
[আগের পর্ব : মুক্তি] [*] [পরের পর্ব : মুক্তিপ্রাপ্তের অন্তিমযাত্রা]
…
(চলবে…)
…
[আগের পর্ব : মুক্তি] [*] [পরের পর্ব : মুক্তিপ্রাপ্তের অন্তিমযাত্রা]
…
No comments:
Post a Comment