|বেদান্তদর্শন-ব্রহ্মবেদান্ত-২৪: অন্যান্য ঋষিপ্রোক্ত দর্শন-মত খণ্ডন|
রণদীপম বসু
…
৩.০ : অন্যান্য দর্শন-মত খণ্ডন :
বাদরায়ণ
তাঁর বেদান্তসূত্রে উপনিষদ সিদ্ধান্তের সমন্বয় ও বিরোধ নিষ্পত্তির
পাশাপাশি একইসঙ্গে অন্যান্য দর্শনের সিদ্ধান্তগত দুর্বলতার দিকেও অঙ্গুলি
নির্দেশের চেষ্টা করেছেন। এই দর্শনগুলির মধ্যে সাংখ্য ও যোগ এমনই দর্শন,
যার মূল কর্তা কপিলকে সেই যুগ পর্যন্ত ঋষি বলেই মানা হতো। কেননা,
ঋষিপ্রোক্ত হওয়ায় কপিলের মতকে স্মৃতিশাস্ত্রের পর্যায়ভুক্ত করা হয়েছিলো। আর
ধারণা করা হয়, পাশুপত ও পাঞ্চরাত্র মত আর্যদের ভারতে আসার আগেই প্রাচীন
সিন্ধুসভ্যতায় সৃষ্ট, তাই ঈশ্বরবাদী হওয়া সত্ত্বেও অ-ঋষিপ্রোক্ত হওয়ায়
সেগুলিকে বৈদিক আর্যক্ষেত্রে সশ্রদ্ধ দৃষ্টিতে দেখা হয়নি। অন্যদিকে
বৈশেষিক, বৌদ্ধ ও জৈন মত অ-ঋষিপ্রোক্ত তথা নিরীশ্বরবাদী দর্শন হওয়ায়
বাদরায়ণের মতো আস্তিকের নিকট সেগুলি আরো ঘৃণার বিষয় হয়েছিলো বলে পণ্ডিত
রাহুল সাংকৃত্যায়নের অভিমত।
৩.১ : ঋষিপ্রোক্ত বিরোধী দর্শনের খণ্ডন-
যে দর্শনের প্রতিস্থাপকরা ঋষির মর্যাদা পেয়েছিলেন এবং তাঁদের মতকে স্মৃতিশাস্ত্রের পর্যায়ভুক্ত করা হয়েছিলো, সেগুলিই ঋষিপ্রোক্ত দর্শন নামে পরিচিত। কিন্তু তাঁদের মত যেক্ষেত্রে ব্রহ্মবাদী উপনিষদীয় দর্শন বা শ্রুতিবাক্যের সাথে সাংঘর্ষিক হয়েছে তথা বেদবিরোধী মনে হয়েছে, বাদরায়ণ সেক্ষেত্রে আগ বাড়িয়ে তা খণ্ডনে উদ্যোগী হয়েছিলেন। ঋষিপ্রোক্ত সাংখ্য ও যোগদর্শনে এই বিরোধ প্রত্যক্ষ হওয়ায় বাদরায়ণ তা খণ্ডনে আগ্রহ দেখিয়েছেন। এখানে সাংখ্যকে নিরীশ্বরবাদী এবং যোগকে ঈশ্বরবাদী দর্শন হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
৩.১ : ঋষিপ্রোক্ত বিরোধী দর্শনের খণ্ডন-
যে দর্শনের প্রতিস্থাপকরা ঋষির মর্যাদা পেয়েছিলেন এবং তাঁদের মতকে স্মৃতিশাস্ত্রের পর্যায়ভুক্ত করা হয়েছিলো, সেগুলিই ঋষিপ্রোক্ত দর্শন নামে পরিচিত। কিন্তু তাঁদের মত যেক্ষেত্রে ব্রহ্মবাদী উপনিষদীয় দর্শন বা শ্রুতিবাক্যের সাথে সাংঘর্ষিক হয়েছে তথা বেদবিরোধী মনে হয়েছে, বাদরায়ণ সেক্ষেত্রে আগ বাড়িয়ে তা খণ্ডনে উদ্যোগী হয়েছিলেন। ঋষিপ্রোক্ত সাংখ্য ও যোগদর্শনে এই বিরোধ প্রত্যক্ষ হওয়ায় বাদরায়ণ তা খণ্ডনে আগ্রহ দেখিয়েছেন। এখানে সাংখ্যকে নিরীশ্বরবাদী এবং যোগকে ঈশ্বরবাদী দর্শন হিসেবে চিহ্নিত করা যায়।
(১) সাংখ্যদর্শন খণ্ডন : কপিলের সাংখ্যদর্শনে বলা হয়েছে সৃষ্টির উপাদান কারণ প্রকৃতি বা প্রধান, এবং পুরুষ বা ঈশ্বর হলেন নিমিত্ত কারণ। ফলে উপনিষদের ব্রহ্মকারণবাদের সঙ্গে সাংখ্যের প্রধানকারণবাদের কয়েকটি ক্ষেত্রে মতবিরোধ ছিলো। উপনিষদ বা বেদান্তবাদী বাদরায়ণ কারণ থেকে কার্যকে বিলক্ষণ বা ভিন্ন বলে গণ্য করেছেন, অন্যদিকে সৎ-কার্যবাদী সাংখ্যমতে কার্য-কারণ সংলক্ষণ বা অভিন্ন বলে মানা হয়েছে। সাংখ্যের পুরুষ নিষ্ক্রিয়, কিন্তু বেদান্তের পুরুষ সক্রিয়।
উপনিষদ আবির্ভাবের ক্রমপঞ্জিতে প্রাচীনতম ঈশ-উপনিষদ থেকে শুরু করে প্রথম কালের (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৭০০-৬০০) ছান্দোগ্য, বৃহদারণ্যক, দ্বিতীয় কালের (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৬০০-৫০০) ঐতরেয়, তৈত্তিরীয়, তৃতীয় যুগের (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ৫০০-৪০০) প্রশ্ন, কেন, কঠ, মুণ্ডক, মাণ্ডুক্য এবং চতুর্থ কালের (আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২০০-১০০) কৌষীতকি, মৈত্রী ও শ্বেতাশ্বতর পর্যন্ত এই তেরটি প্রাচীন উপনিষদ সাংখ্য-সংস্থাপক কপিলকে ঋষি বলে মেনে নিয়েছে। তাই উপনিষদের প্রামাণ্য বা শব্দ-প্রমাণকে অভ্রান্ত না বলে ধাঁধা বলে মানা বাদরায়ণের মতো দার্শনিকের নিকট খুবই অসুবিধাজনক ছিলো। তাছাড়া প্রাচীন সাংখ্যবাদীরা বেদবাদী না হলেও পরবর্তীকালের কেউ কেউ নিজেদের বেদবাদী বলেছেন এবং উপনিষদের মতকে পুষ্ট করার কাজে তৎপর হতে দেখা গিয়েছিলো। ফলে বাদরায়ণ বলার চেষ্টা করেছেন যে, উপনিষদ না সাংখ্যের প্রধানকে মেনেছে, না মেনেছে তাঁর নিষ্ক্রিয় পুরুষকে। অর্থাৎ সাংখ্যমতের শ্রুতিপ্রামাণ্য নেই।
এক্ষেত্রে সমস্যাটি হলো, বিরুদ্ধবাদীদের মতে, যদি সাংখ্যের প্রধানের কারণত্বের মতবাদকে অস্বীকার করা হয়, তাহলে মহামুনি কপিল প্রচারিত এবং অপর বহু বিদগ্ধ ঋষি স্বীকৃত সাংখ্য দর্শনটিই অপ্রামাণ্য হয়ে যায়। সুতরাং এটাই যুক্তিসঙ্গত যে, বেদান্ত শ্রুতিগুলিকে এমনভাবেই ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন যাতে স্মৃতির প্রামাণ্যও রক্ষিত হয় এবং তাকে সম্পূর্ণরূপে বিরুদ্ধ বলেও মনে না হয়। বিরুদ্ধপক্ষের এই অভিমতের উত্তরে বাদরায়ণের বক্তব্য হলো, যদি বেদবিরুদ্ধ সাংখ্য শ্রুতিকে মান্য করার জন্য ব্রহ্মকে সৃষ্টির আদি-কারণরূপে গ্রহণ করার মতবাদকে পরিহার করতে হয়, তাহলে এই মতবাদ পরিহারের দ্বারা মনুসংহিতা, গীতা ইত্যাদি বহু স্মৃতিকেই গ্রহণ করা সম্ভব হবে না, অথচ এ সকল স্মৃতি শ্রুতিভিত্তিক হওয়ায় অধিকতর প্রামাণ্য এবং এদের সকলেই বিজ্ঞানময় ব্রহ্মকেই জগতের আদি-কারণ হিসেবে গ্রহণ করার মতবাদকে অনুসরণ করেন। সুতরাং এই উভয়ের মধ্যে শ্রুতিবিরুদ্ধ অর্থাৎ বেদরিরোধী স্মৃতিগুলিকে পরিহার করাই বাঞ্ছনীয়। তাই বেদান্তসূত্রে বাদরায়ণ বলেন-
‘স্মৃত্যনবকাশদোষপ্রসঙ্গ ইতি চেৎ, ন, অন্যস্মৃত্যনবকাশ-দোষপ্রসঙ্গাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/১)।।
ভাবার্থ : যদি সাংখ্যসম্মত নয় বলে ব্রহ্মের জগৎ-কারণত্বকে অস্বীকার করা হয়, তাহলে বেদের অনুকূল মনু ইত্যাদি স্মৃতির উল্লেখের সম্ভাবনাও থাকে না; সেক্ষেত্রে স্মৃতিগুলির পরস্পরের মধ্যেই একটা বিরোধ সৃষ্টি হয় (ব্রহ্মসূত্র-২/১/১)।
এ প্রেক্ষিতে সাংখ্যবাদীরা একটি আপত্তি উত্থাপন করে বলেন যে, প্রধানও শাস্ত্রপ্রমাণের উপর প্রতিষ্ঠিত, কারণ কোন কোন বেদের শাখা যেমন কঠ-শাখা এমন কতকগুলি শ্রুতিবচন উল্লেখ করেছেন যেখানে প্রধানকেই লক্ষ্য করে হয়েছে বলে মনে হয়, যেমন-
‘মহতঃ পরমব্যক্তমব্যক্তাৎ পুরুষঃ পরঃ।
পুরুষান্ন পরং কিঞ্চিৎ সা কাষ্ঠা সা পরা গতিঃ’।। (কঠোপনিষদ-১/৩/১১)।।
অর্থাৎ : মহৎ থেকে অব্যক্ত শ্রেষ্ঠ, অব্যক্তের চেয়ে পুরুষ শ্রেষ্ঠ। পুরুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কিছু হতে পারে না। তিনিই পরাকাষ্ঠা, চূড়ান্ত পরিণতি। তিনিই শ্রেষ্ঠ গতি বা গন্তব্যস্থান (কঠ-১/৩/১১)।
সাংখ্যবাদীরা বলেন যে, এই শ্রুতিতে অব্যক্ত শব্দটি প্রধানকেই লক্ষ্য করা হয়েছে- কারণ, মহৎ, অব্যক্ত এবং পুরুষ শব্দগুলিকে যে ক্রমানুক্রমিকভাবে সাংখ্যদর্শনে উল্লেখ করা হয়েছে, ঠিক সেভাবেই শ্রুতিতেও উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং শ্রুতি ব্যবহৃত এই শব্দগুলিকে সাংখ্যে ব্যবহৃত শব্দগুলির একই পর্যায়ভুক্ত বলে গণ্য করা হয়। কিন্তু সাংখ্যবাদীর এ যুক্তি বাদরায়ণ মানতে নারাজ। তিনি তা খণ্ডন করে বলেন, কঠোপনিষদের মহৎ এবং অব্যক্ত সাংখ্যের ধারণার অন্তর্গত নয়-
‘আনুমানিকম্ অপি একষাম্ ইতি চেৎ, ন, শরীররূপকবিন্যস্তগৃহীতেঃ, দর্শয়তি চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/৪/১)।।
ভাবার্থ : যদি বলা হয় যে, কাঠক শ্রুতি অনুসারে অনুমানগম্য সাংখ্যোক্ত প্রধানও শ্রুতিসিদ্ধ বলে মনে হয়, তার উত্তরে আমরা বলবো, ‘না, তা হতে পারে না। কারণ, রূপকের সাহায্যে অব্যক্ত শব্দদ্বারা শরীরকেই এখানে লক্ষ্য করা হয়েছে, সাংখ্যের প্রকৃতি বা প্রধানকে নয়’ (ব্রহ্মসূত্র-১/৪/১)।
বাদরায়ণের বক্তব্য হলো, শ্রুতিতে ‘অব্যক্ত’ শব্দটি শরীরসংক্রান্ত উপমা প্রদর্শনের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয়েছে, তার লক্ষ্য প্রধান নন। কেননা, কঠোপনিষদের উল্লিখিত এই শ্রুতিটির (কঠ-১/৩/১১) পূর্ববর্তী শ্রুতি (কঠ-১/৩/১০) এর সাথে তুলনা করলেই বুঝা যায় যে, পূর্ববর্তী শ্রুতির আত্মা-কেই পরবর্তী শ্রুতিতে পুরুষ বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট পূর্ববর্তী শ্রুতিটি হলো-
‘ইন্দ্রিয়েভ্যঃ পরা হ্যর্থা অর্থেভ্যশ্চ পরং মনঃ।
এনসস্তু পরা বুদ্ধির্বুদ্ধেরাত্মা মহান্ পরঃ’।। (কঠোপনিষদ-১/৩/১০)।।
অর্থাৎ : ইন্দ্রিয়ের চেয়ে ইন্দ্রিয়ের বিষয় (রূপ, রস, ইত্যাদি) শ্রেষ্ঠ, বিষয়ের চেয়ে মন শ্রেষ্ঠ, মনের চেয়ে বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ, বুদ্ধি থেকে শ্রেষ্ঠ সেই মহান আত্মা (যিনি বুদ্ধির সমষ্টিরূপ) (কঠ-১/৩/১০)।
কঠোপনিষদের সংশ্লিষ্ট এই দুটি শ্রুতিকে যথানিয়মে পর্যাক্রমিকভাবে স্থাপন করলেই দেখা যায় যে, ইন্দ্রিয়, মন এবং বুদ্ধি পূর্ববর্তী শ্রুতিতে যাদের উল্লেখ করা হয়েছে তা-ই পরবর্তী শ্রুতিতেও পাওয়া যাচ্ছে। পূর্ববর্তী শ্রুতির আত্মাকেই পরবর্তী শ্রুতিতে পুরুষ বলা হয়েছে। পরবর্তী শ্রুতির মহৎ বলতে মহাবিশ্বের সামগ্রিক বুদ্ধিকেই বুঝিয়েছে এবং তা পূর্ববর্তী শ্রুতিতে উল্লিখিত বুদ্ধিরই অন্তর্ভুক্ত। এখানে তা ব্যষ্টি এবং সমষ্টিগত বুদ্ধির সামগ্রিক অর্থেই ব্যবহৃত হয়েছে। এখন শুধু অবশিষ্ট আছে পূর্বশ্রুতির শরীর এবং পরবর্তী শ্রুতির অব্যক্ত; এবং সেজন্যই এখানে অব্যক্ত বলতে শরীরকে বুঝিয়েছে, প্রধানকে নয়। কেননা, এই শ্রুতিদ্বয়কে পাশাপাশি রেখে একসাথে ব্যাখ্যা করলে এরকমই হয়- ‘ইন্দ্রিয়ের চেয়ে ইন্দ্রিয়ের বিষয়সমূহ শ্রেষ্ঠ, বিষয়ের চেয়ে মন শ্রেষ্ঠ, মনের চেয়ে বুদ্ধি শ্রেষ্ঠ, বুদ্ধির চেয়ে মহৎ বা সেই মহান আত্মা শ্রেষ্ট। মহতের চেয়ে অব্যক্ত শ্রেষ্ঠ, অব্যক্তের চেয়ে পুরুষ শ্রেষ্ঠ। পুরুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ আর কিছু নেই।’
বাদরায়ণের মতে, কোন শ্রুতিবাক্যকে বুঝার জন্য স্মৃতির বচনের সাথে তুলনা করা সমীচিন নয়, দৃষ্টান্ত অনুযায়ী কোন সমজাতীয় শ্রুতির তুলনা করাই যুক্তিযুক্ত। তাই তিনি বলেন-
‘মহদ্বৎ চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/৪/৭)।।
ভাবার্থ : সাংখ্যোক্ত মহৎ এবং শ্রুতিতে উপদিষ্ট মহৎ একার্থ-বাচক নয় (ব্রঃ-১/৪/৭)।
এখানে আবার আপত্তি উঠে যে, শরীর হলো স্থূল এবং পরিবর্ধিত। তাকে কিভাবে অব্যক্ত (অপরিবর্ধিত) বলা যেতে পারে ? এর উত্তরে বাদরায়ণ বলেন, এখানে স্থূল শরীরকে বুঝানো হয়নি, যে পঞ্চ উপাদানে শরীরটি গঠিত সেই কারণ-বস্তুগুলিকে বুঝানো হয়েছে। এই উপাদানগুলি সূক্ষ্ম এবং সম্পূর্ণরূপে ব্যক্ত নয় এবং যেহেতু এরা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয় সেজন্য এদেরকে যথার্থভাবেই ‘অব্যক্ত’ শব্দ দ্বারা অভিহিত করা যেতে পারে। তাই বেদান্তসূত্রে বাদরায়ণ বলেন-
‘সূক্ষ্মং তু তদর্হত্বাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/৪/২)।।
ভাবার্থ : ‘অব্যক্ত’ শব্দ সূক্ষ্ম পদার্থবাচক। স্থূল শরীরও সূক্ষ্মেরই স্থূলাবস্থা মাত্র। কাজেই শ্রুতিতে অব্যক্ত অর্থ শরীরই (ব্রহ্মসূত্র-১/৪/২)।
আবার, সাংখ্যমতে মানুষ তখনই মুক্তিলাভ করে, যখন সে পুরুষ এবং অব্যক্তের (প্রকৃতির) মধ্যে পার্থক্যকে জানতে পারে। সুতরাং অব্যক্ত তাঁদের নিকট জ্ঞেয়। এ প্রেক্ষিতে তাঁরা শ্রুতির যে দৃষ্টান্তটি তুলে ধরেন-
‘অশব্দম্ অস্পর্শম্ অরূপম্ অব্যয়ং তথা অরসং নিত্যম্ অগন্ধবৎ চ যৎ।
অনাদি অনন্তং মহতঃ পরং ধ্রুবং নিচায্য তন্মৃত্যুমুখাৎ প্রমুচ্যতে’।। (কঠোপনিষদ-১/৩/১৫)।।
অর্থাৎ : যিনি শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধ-বিহীন, যিনি অক্ষয় শাশ্বত অনাদি ও অনন্ত, যিনি মহত্তত্বের চেয়েও শ্রেষ্ঠ ও কূটস্থ নিত্য- তাঁকে অবগত হলেই সাধক মৃত্যুমুখ থেকে বিমুক্ত হন (কঠ-১/৩/১৫)।
সাংখ্যবাদীদের মতে, এই শ্রুতিতে প্রধানকে জ্ঞাত হয়েই মুক্তিলাভ করার কথা উপদিষ্ট হয়েছে, তার সাথে প্রধানের সাদৃশ্য আছে এবং প্রধানও মহৎ থেকে উর্ধ্বে। সাংখ্যের এই মত খণ্ডন করে বাদরায়ণ বলতে চেয়েছেন যে, ‘মহতঃ পরং’ বলতে এখানে বিজ্ঞানময় পরমাত্মাকেই বুঝিয়েছে- এবং পরমাত্মাই কঠোপনিষদের এই অধিকরণের আলোচ্য বিষয়। তাই বেদান্ত সূত্রে বলা হয়েছে-
‘বদতীতি চেৎ, ন, প্রাজ্ঞো হি প্রকরণাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/৪/৫)।।
‘ত্রয়াণামেব চৈবমুপন্যাসঃ প্রশ্নশ্চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/৪/৬)।।
ভাবার্থ :
যদি বলা হয় যে, শ্রুতিতে অব্যক্তের জ্ঞেয়ত্ব উল্লিখিত আছে, তার উত্তরে বলা যায় যে, প্রকরণ হতে পরমাত্মাকেই জ্ঞেয় বলে বুঝতে পারা যায় (ব্রহ্মসূত্র-১/৪/৫)। এই প্রকরণে মাত্র তিনটি প্রশ্ন এবং তিনটি প্রাসঙ্গিক উত্তর। এখানে প্রধানের কোন প্রাসঙ্গিকতা নেই (ব্রহ্মসূত্র-১/৪/৬)।
অর্থাৎ কঠোপনিষদের সংশ্লিষ্ট এই অধিকরণে নচিকেতা যমকে মাত্র তিনটি প্রশ্ন করেন- অগ্নি সম্পর্কে, জীবাত্মা সম্পর্কে এবং পরমাত্মা সম্পর্কে। এখানে প্রধানের কোন উল্লেখই নেই। সুতরাং নিশ্চয়ই আশা করা যায় না যে, যম তাঁর মূল বক্তব্যকে অতিক্রম করে যে-প্রধান সম্পর্কে কোন প্রশ্নই করা হয়নি সে সম্পর্কে উপদেশ দেবেন।
সাংখ্যকার জৈমিনির সাথে বাদরায়ণের অন্য মতবিরোধটি হলো, সাংখ্যকার জৈমিনি তাঁর দর্শনকে কেবলমাত্র শব্দ-প্রমাণের ওপরেই প্রতিষ্ঠিত বলে মানেননি অর্থাৎ বেদকেই একমাত্র প্রমাণ বলে মানেননি, তার জন্য যুক্তিতর্কও উপস্থিত করেছেন। এর উত্তর দিতে গিয়ে বাদরায়ণ বলেন যে, অনুমান সিদ্ধ প্রধানকে মানা যুক্তিসঙ্গত নয়, কারণ প্রধান জড় হলে তার পক্ষে বিশ্বের বিচিত্র বস্তুসমূহ সৃষ্টি করা সম্ভব নয়, এবং এরূপ সৃষ্টিতে প্রবৃত্তিও হতে পারে না-
‘রচনানুপপত্তেশ্চ নানুমানম্’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/১)।।
‘প্রবৃত্তেশ্চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/২)।।
ভাবার্থ :
জগৎ-সৃষ্টির পরিকল্পনায় জ্ঞান ও কৌশল প্রয়োজন। প্রধান অচেতন। সুতরাং অচেতন প্রধানের পক্ষে জগৎ রচনার কল্পনা অনুমান করা চলে না (ব্রহ্মসূত্র-২/২/১)। অচেতন প্রধানের পক্ষে কোন কার্যে রত হবার প্রবৃত্তি (ইচ্ছা) থাকা সম্ভব নয় (ব্রহ্মসূত্র-২/২/২)।
এক্ষেত্রে সাংখ্যবাদীরা দুধ এবং জলের দৃষ্টান্ত গ্রহণ করে প্রধানের জগৎকারণত্বকে প্রমাণ করার চেষ্টায় বলেন, জল যেমন নদীতে এবং দুগ্ধ যেমন গাভীর স্তন হতে নিজে নিজেই বাছুরের মুখে প্রবাহিত হয়, কিংবা গাভীভুক্ত তৃণ যেভাবে স্বতই দুধে পরিণত হয়, তেমনিভাবে অচেতন প্রধান স্বতই রূপান্তরিত হয়ে অন্যের কর্তৃত্ব ছাড়াই বুদ্ধি অহঙ্কার প্রভৃতিতে পরিণত হতে পারে। সাংখ্যবাদীদের এই যুক্তি খণ্ডন করে বাদরায়ণ বলেন যে, এই জল এবং দুগ্ধের প্রবহমানতা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত-
‘পয়ঃ অম্বুবৎ চেৎ তত্রাপি’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৩)।।
‘ব্যতিরেকানবস্থিতেঃ চ অনপেক্ষত্বাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৪)।।
‘অন্যত্র অভাবাচ্চ ন তৃণাদিবৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৫)।।
ভাবার্থ :
যদি এরূপ বলা হয় যে, দুগ্ধ যেমন আপনা থেকে বৎসমুখে এবং মেঘজল যেমন স্বতই পৃথিবীবক্ষে পতিত হয় সেরূপ প্রধান স্বতই পরিবর্তিত হয়ে সৃষ্টি করেন- না তা হতে পারে না- সেক্ষেত্রেও অন্যের কর্তৃত্ব প্রয়োজন (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৩)। সাংখ্যমতে প্রধানের নিজ বহির্ভূত কোন কর্তা নাই এবং বহির্ভূত কোন কিছুর উপর তা নির্ভরশীলও নন। সেক্ষেত্রে অচেতন প্রধানের কর্তৃত্ব বা অকর্তৃত্ব কিছুই নাই। অতএব প্রধান আদিকারণ নন (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৪)। তৃণ যেমন গাভীর উদরে স্বতই দুগ্ধে পরিণত হয়, সেরূপ প্রধানও স্বয়ংই জগতে পরিণত হন- যদি এরূপ বলা হয় ? তার উত্তরে বলা যায় যে, এখানে অন্য কারণ আছে, তা না হলে ষাঁড় যে তৃণ ভক্ষণ করে তা তো দুগ্ধে পরিণত হয় না (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৫)।
সাংখ্যবাদীরা হয়তো যুক্তি দেখাতে পারেন যে, অন্ধ ও পঙ্গু ব্যক্তিদ্বয় যেমন একে অন্যের সাহায্যে দেখতে ও চলতে পারে, অথবা লৌহ ও চুম্বক পৃথক বস্তু হয়েও যেমন পরস্পরকে আকৃষ্ট করতে পারে সেরকম প্রকৃতি ও পুরুষও স্বতন্ত্র রূপে নিষ্ক্রিয় থাকলেও একটি অপরটির সঙ্গে মিলিত হয়ে বিশ্ববৈচিত্র্য সৃষ্টিতে সক্ষম। এর উত্তরে বাদরায়ণ বলেন, তবুও গতি সম্ভব নয়, কারণ প্রকৃতি-পুরুষের সঙ্গম আকস্মিক নয়, নিত্য ঘটনা; আবার গতি অবিরাম, কিন্তু বস্তু-সৃষ্টির জন্য গতি এবং গতি রোধ দুইয়েরই প্রয়োজন। সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ এই তিন গুণের আধিক্য বা স্বল্পতা মেনে নিলেও কার্যসিদ্ধি হবে না। কেননা, নিষ্ক্রিয় পুরুষের বদলে কোন নিয়ন্ত্রণকারী সক্রিয় সত্তা স্বীকার করা না হলে, সর্বদা পুরুষের সমীপস্থ প্রকৃতির মধ্যে এই ত্রিগুণের মাত্রা ভেদ সুশৃঙ্খল থাকে না, যার ফলে কোথাও বা সত্ত্বগুণের আধিক্যে কোমলতা আরো প্রকট হবে, রজঃগুণের আধিক্যে গতি ও স্থিতি অনিয়ন্ত্রিত হবে, আবার তমঃগুণের আধিক্যে কাঠিন্য ও নিষ্ক্রিয়তা ভারসাম্যহীন হবে। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-
‘অভ্যুপগমে অপি অর্থাভাবাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৬)।।
‘পুরুষাশ্মবৎ ইতি চেৎ, তথাপি’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৭)।।
‘অঙ্গিত্বানুপপত্তেশ্চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৮)।।
ভাবার্থ :
সাংখ্যমতে জগৎসৃষ্টির মূলে একটা উদ্দেশ্য আছে; তা হলো- ভোগ এবং মোক্ষসাধন। কিন্তু অচেতন প্রধানের কোন উদ্দেশ্য থাকতে পারে না। সেজন্য প্রধান আদিকারণ হতে পারেন না (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৬)। পঙ্গু ও অন্ধ পুরুষের অথবা লৌহ ও চুম্বকের দৃষ্টান্ত অনুযায়ী যদি প্রধানের কর্মপ্রবৃত্তি থাকা সম্ভব ধরেও নেয়া হয়- তা হলেও প্রধানের পক্ষে জগৎ-কর্তৃত্ব সিদ্ধ হয় না (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৭)। সাংখ্যমতে গুণ সকলের ‘অঙ্গ-অঙ্গী’ ভাব ধরে নিয়ে প্রধানের জগৎরূপে পরিণত হওয়ার ব্যাখ্যা দেয়া হয়। কিন্তু তাও যুক্তিসিদ্ধ নয়। কারণ প্রলয়ে সকল গুণই সাম্যভাবে অবস্থান করে (ব্রহ্মসূত্র-২/২/৮)।
সাংখ্যমতে প্রধান সত্ত্ব, রজঃ এবং তমঃ- এই তিন গুণসম্পন্ন। এই তিনটি গুণই পরস্পর স্বতন্ত্র এবং সৃষ্টির পূর্বে সাম্যাবস্থায় অবস্থান করে। সৃষ্টিকার্য তখনই আরম্ভ হয়, যখন এই সাম্যাবস্থার মধ্যে একটা বিপর্যয় ঘটে; যখন একটি গুণ অপর দুইটি গুণকে অতিক্রম করে ক্রিয়াশীল হয়। বাইরের কোন শক্তি ছাড়া এই সাম্যাবস্থার বিপর্যয় হতে পারে না।
আবার যদি প্রধানকে মেনে নেয়া যায় তবুও তাতে কোনো লাভ হবে না, কারণ, পুরুষ (জীব) তো স্বতঃনিষ্ক্রিয়, নির্বিকার-চেতন, প্রধানের কার্যের জন্য তার বিশেষ কোনো ইচ্ছা থাকতে পারে না। এছাড়াও বাদরায়ণের মতে সাংখ্যদর্শনে বহুবিধ বিরুদ্ধভাব আছে বলে সাংখ্যের প্রধান গ্রহণযোগ্য নয়-
‘বিপ্রতিষেধাৎ চ অসমঞ্জসম্’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/২/১০)।।
ভাবার্থ : শ্রুতি-স্মৃতির সাথে সাংখ্যের বহু বিরোধ আছে এবং সাংখ্যদর্শনের নিজের চিন্তার মধ্যেও স্ববিরুদ্ধভাব আছে। সুতরাং সাংখ্যের প্রধান গ্রহণযোগ্য নন।
মোটকথা, সাংখ্যদর্শনে বহু বিরুদ্ধভাব আছে, যেমন সাংখ্যে কখনও ইন্দ্রিয়ের সংখ্যা বলা হয়েছে একাদশ, কোথাও বলা হয়েছে সাত। আবার একজায়গায় বলা হয়েছে যে, মহৎ থেকে তন্মাত্রের সৃষ্টি হয়েছে- অন্যত্র বলা হয়েছে যে, এগুলি অহঙ্কার থেকে জাত- এ ধরনের বহু অসঙ্গতি ছাড়াও শ্রুতি ও স্মৃতির সাথে তার বিরোধ সুপ্রসিদ্ধ। সুতরাং সাংখ্যবাদীদের প্রধানের জগৎকারণত্ব মতবাদ গ্রহণযোগ্য নয়।
(২) যোগদর্শন খণ্ডন : সাংখ্যের প্রকৃতি-পুরুষের সঙ্গে পুরুষ-বিশেষ ঈশ্বরকে সংযুক্ত করায় তা ঈশ্বরবাদী সাংখ্যদর্শনে পরিণত হয়েছে। তাই যোগদর্শনকে সেশ্বর-সাংখ্যও বলা হয়। ফলে যোগদর্শনকে খণ্ডন করার জন্য বাদরায়ণের অধিক পরিশ্রম করার প্রয়োজন হয়নি, কারণ, সাংখ্য-সম্মত প্রধান তথা পুরুষের বিরুদ্ধে একই যুক্তিই এখানে প্রযোজ্য। তাই যোগদর্শনকে খণ্ডন করতে গিয়ে বেদান্তসূত্রে বাদরায়ণ বলেন-
‘এতেন যোগঃ প্রত্যুক্তঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/১/৩)।।
ভাবার্থ : একই যুক্তিতে সাংখ্য মতানুসারী যোগ স্মৃতি-শাস্ত্রের প্রামাণ্যকেও খণ্ডন করা হলো (ব্রঃ-২/১/৩)।
যোগ ঈশ্বরকে বিশ্বের উপাদান কারণ বলে মানেননি। কিন্তু বাদরায়ণ উপনিষদের শ্রুতি-প্রমাণ দ্বারা তাকে (ব্রহ্মকে) নিমিত্ত ও উপাদান-কারণ বলে সিদ্ধ করেছেন। বাদরায়ণের মতে, ঈশ্বর (ব্রহ্ম) জাগতিক রূপে পরিণত হন, এতেই তাঁর বৈচিত্র্যময় শক্তির কথা জানা যায়, এবং তিনি যোগসম্মত নির্বিকার ঈশ্বর নন।
…
(চলবে…)
…
[আগের পর্ব : বর্ণাশ্রম ও জাতিভেদ] [*] [পরের পর্ব : অ-ঋষিপ্রোক্ত ঈশ্বরবাদী দর্শন-মত খণ্ডন]
…
No comments:
Post a Comment