Friday, March 3, 2017

বেদান্তদর্শন-ব্রহ্মবেদান্ত-২৩: বাদরায়ণের দার্শনিকমত- বর্ণাশ্রম ও জাতিভেদ



| বেদান্তদর্শন-ব্রহ্মবেদান্ত-২৩: বাদরায়ণের দার্শনিকমত- বর্ণাশ্রম ও জাতিভেদ |
রণদীপম বসু

২.২.০৮. বর্ণাশ্রম ও জাতিভেদ :
ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণাশ্রম ধর্ম ও জাতিভেদ প্রথার প্রতি বাদরায়ণের ছিলো প্রচণ্ড পক্ষপাতিত্ব। ফলে বাদরায়ণের ব্রহ্মবিদ্যায় যে শূদ্রের প্রতি কোনো রকম সহানুভূতি বা উদারতা আশা করা শেষপর্যন্ত নিষ্ফল তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেননা, ব্রহ্মবিদ্যায় শূদ্রদের অধিকার নিষিদ্ধ করে বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-

‘সংস্কার-পরামর্শাৎ তৎ অভাব-অভিলাপাৎ চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/৩৬)।।
ভাবার্থ : দ্বিজাতির ক্ষেত্রে সংস্কারের উল্লেখ আছে এবং শূদ্রের পক্ষে এই ক্রিয়াদির নিষেধ আছে বলে শূদ্রদের ব্রহ্মবিদ্যার অধিকার নাই (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/৩৬)।

উপনয়নাদি সংস্কার ক্রিয়া যে-কোন জ্ঞান বা বিদ্যা অর্জনের জন্যই আবশ্যিক প্রয়োজন বলে শাস্ত্রে উল্লেখ আছে। কিন্তু এসব বিধান শুধু উচ্চবর্ণের লোকদের জন্যই বিহিত। শূদ্রদের ক্ষেত্রে এইসব সংস্কার প্রযোজ্য নয়- এমন কথা শাস্ত্রে পুনঃ পুনঃ উল্লেখ আছে। মনুসংহিতাতেই এর ভুরিভুরি প্রমাণ মেলে, যেমন-


‘ব্রাহ্মণঃ ক্ষত্রিয়ো বৈশ্যস্ত্রয়ো বর্ণ দ্বিজাতয়ঃ।
চতুর্থ একজাতিস্তু শূদ্রো নাস্তি তু পঞ্চমঃ’।। (মনুসংহিতা-১০/৪)।।
অর্থাৎ : ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় ও বৈশ্য এই তিন ধর্মের পক্ষে উপনয়ন সংস্কারের বিধান থাকায় এরা ‘দ্বিজাতি’ নামে অভিহিত হয়। আর চতুর্থ বর্ণ শূদ্র উপনয়ন-সংস্কার বিহীন হওয়ায় দ্বিজাতি নয়, তারা হলো ‘একজাতি’। এছাড়া পঞ্চম কোনও বর্ণ নেই অর্থাৎ ঐ চারটি বর্ণের অতিরিক্ত যারা আছে তারা সকলেই সঙ্করজাতি (মনু-১০/৪)।

এই সঙ্করজাতিরা ব্রহ্মাসৃষ্ট চতুবর্ণেরও বাইরে। অর্থাৎ এদের থেকেই অস্পৃশ্য বা অচ্ছুৎ সম্প্রদায়ের সৃষ্টি। উত্তর-ভারতীয় ভাষায় যাকে বলে দলিত সম্প্রদায়। এরাই বৈদিক সমাজের ব্রাত্য জনগোষ্ঠী।
প্রাসঙ্গিকভাবেই বিষয়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্রাহ্মণ থেকে শূদ্র পর্যন্ত চারজাতীয় মানুষই হলো চারটি বর্ণ। এ ছাড়া বর্বর, কৈবর্ত প্রভৃতি অন্যান্য যে সব মানুষ আছে তারা সঙ্কীর্ণযোনি বা বর্ণসঙ্কর। চারটি বর্ণের মধ্যে তিনটি বর্ণ ‘দ্বিজাতি’ অর্থাৎ এদের দুবার জন্ম হয়; কারণ দ্বিতীয়-জন্ম উৎপাদক উপনয়ন-সংস্কার কেবল ঐ তিনটি বর্ণের পক্ষেই শাস্ত্রমধ্যে বিহিত আছে। শূদ্র হলো একজাতি অর্থাৎ ওদের একবার মাত্র জাতি বা জন্ম হয়, কারণ শূদ্রের পক্ষে উপনয়ন-সংস্কারের বিধান নেই। অতএব অনিবার্যভাবে শূদ্ররা হলো নিম্নবর্ণ। ফলে এরা ব্রত যজ্ঞ অনুষ্ঠানাদি পালনের যোগ্য হতে পারে না।  তাই মনুর বক্তব্য হলো-

‘ন শূদ্রায় মতিং দদ্যান্নোচ্ছিষ্টং ন হবি®কৃতম্।
ন চাস্যোপদিশেদ্ ধর্মং ন চাস্য ব্রতমাদিশেৎ’।। (মনুসংহিতা-৪/৮০)
অর্থাৎ : শূদ্রকে কোন মন্ত্রণা-পরামর্শ দেবে না। শূদ্রকে উচ্ছিষ্ট দান করবে না। যজ্ঞের হবির জন্য যা ‘কৃত’ অর্থাৎ সঙ্কল্পিত এমন দ্রব্য শূদ্রকে দেবে না; শূদ্রকে কোনও ধর্মোপদেশ করবে না এবং কোনও ব্রত বা প্রায়শ্চিত্ত করতেও উপদেশ দেবে না (মনু-৪/৮০)।

কারণ, শূদ্রজন্ম যে প্রকৃত অর্থেই দাসজন্ম, এ বিষয়টা যাতে কারো কাছে অস্পষ্ট না থাকে সেজন্যে মনুশাস্ত্রে স্পষ্ট করে দেয়া হয়েছে-

‘শূদ্রং তু কারয়েদ্ দাস্যং ক্রীতমক্রীতমেব বা।
দাস্যায়ৈব হি সৃষ্টোহসৌ ব্রাহ্মণস্য স্বয়ম্ভুবা’।। (মনুসংহিতা-৮/৪১৩)।।
‘ন স্বামিনা নিসৃষ্টোহপি শূদ্রো দাস্যাদ্বিমুচ্যতে।
নিসর্গজং হি তত্তস্য কস্তস্মাত্তদপোহতি’।। (মনুসংহিতা-৮/৪১৪)
অর্থাৎ :
ক্রীত অর্থাৎ অন্নাদির দ্বারা প্রতিপালিত হোক্ বা অক্রীতই হোক্ শূদ্রের দ্বারা ব্রাহ্মণ দাসত্বের কাজ করিয়ে নেবেন। যেহেতু, বিধাতা শূদ্রকে ব্রাহ্মণের দাসত্বের জন্যই সৃষ্টি করেছেন (মনু-৮/৪১৩)।  প্রভু শূদ্রকে দাসত্ব থেকে অব্যাহতি দিলেও শূদ্র দাসত্ব কর্ম থেকে অব্যাহতি পেতে পারে না। দাসত্বকর্ম তার স্বভাবসিদ্ধ কর্ম (অর্থাৎ জন্মের সাথে আগত)। তাই ঐ শূদ্রের কাছ থেকে কে দাসত্ব কর্ম সরিয়ে নিতে পারে (মনু-৮/৪১৪)?

আবার অন্য স্মৃতিতেও দেখা যায়, শূদ্রের পক্ষে বেদপাঠ কিংবা শ্রবণ সম্বন্ধে নিষেধাজ্ঞা জারি করে বলা হচ্ছে-

‘অথ হাস্য বেদমু শৃংণ্যতস্ত্রপূজতুভ্যাং শ্রোত্রপ্রতিপুরণমুদাহরণে জিহ্বাচ্ছেদো ধারণে শরীরভেদঃ’। (গৌতম-ধর্মসূত্র-২/১২/৩)।।
অর্থাৎ : শূদ্রকে বেদপাঠ বা শ্রবণ করতে দেখলে তার জিহ্বা কর্তন করে কানে গরম সীসা ঢেলে দেওয়া উচিত এবং বেদ ধারণ করতে দেখলে দৈহিকভাবেই হত্যা করা প্রয়োজন (গৌতম-ধর্মসূত্র-২/১২/৩)।

এছাড়া বিভিন্ন শ্রুতিতেও শূদ্রের বেদ শ্রবণ-পঠনে নিষেধ করে বলা আছে- ‘শূদ্র শ্মশানতুল্য, তার বেদপাঠ অনুচিত।’  কিংবা, ‘শূদ্র যদি প্রভূত ধন-সম্পদের মালিকও হয় তবুও যজ্ঞের অধিকার তার নেই।’ এবং যেহেতু মনুর বক্তব্য হলো-

‘চাতুর্বর্ণ্যং ত্রয়ো লোকাশ্চত্বারশ্চশ্রমাঃ পৃথক্ ।
ভূতং ভব্-দ্ভবিষ্যঞ্চ সর্বং বেদাৎ প্রসিদ্ধ্যতি’।। (মনুসংহিতা-১২/৯৭)।।
অর্থাৎ : চারটি বর্ণ, তিন লোক, পৃথক পৃথক চারটি আশ্রম এবং ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান- এগুলি সব একমাত্র বেদ থেকেই প্রচারিত হয় (মনু-১২/৯৭)।

অতএব এ বিধান অন্যথা হবার নয়, কিংবা তা কারো অমান্য করারও উপায় নেই। কেননা শ্রুতি ও স্মৃতিশাস্ত্রের বক্তব্যের বিষয়ে শাস্ত্রীয়ভাবেই কোন সন্দেহ বা প্রশ্ন করার অধিকারও সীমিত করে মনুসংহিতায় বলা হয়েছে-

‘শ্রুতিস্তু বেদো বিজ্ঞেয়ো ধর্মশাস্ত্রস্তু বৈ স্মৃতিঃ।
তে সর্বার্থেষ্বমীমাংস্যে তাভ্যাং ধর্মো হি নির্বভৌ’।। (মনুসংহিতা-২/১০)।।
অর্থাৎ : ‘বেদ’ বলতে ‘শ্রুতি’ বোঝায় এবং ‘ধর্মশাস্ত্রের’ নাম ‘স্মৃতি’। সকল বিষয়েই (অর্থাৎ সকল রকম বিধি-নিষেধের স্থানে) এই দুই শাস্ত্র বিরুদ্ধতর্কের দ্বারা মীমাংসার অতীত, কারণ, শ্রুতি ও স্মৃতি থেকেই ধর্ম স্বয়ং প্রকাশিত হয়েছে (মনু-২/১০)।

আর তাই খুব সঙ্গত কারণেই ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রাতঃস্মরণীয় প্রতিভূ ও শব্দ-প্রমাণক হিসেবে বাদরায়ণও শূদ্রের ব্রহ্মবিদ্যার অধিকার প্রসঙ্গে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত টেনে বেদান্তসূত্রে বলেন-

‘শ্রবণাধ্যয়নার্থ প্রতিষেধাৎ স্মৃতেঃ চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/৩৮)।।
ভাবার্থ : যেহেতু স্মৃতি শাস্ত্রেও শূদ্রদের বেদের শ্রবণ, অধ্যয়ন এবং তদর্থজ্ঞান নিষিদ্ধ, তাই শূদ্রদের ব্রহ্মজ্ঞানলাভেরও অধিকার নাই (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/৩৮)।

মূলত এর মাধ্যমেই সূত্রকার বাদরায়ণ তাঁর সমকালীন সামাজিকতায় বর্ণবাদী ব্রাহ্মণ্যবাদ তথা অমানবিক জাতিভেদ প্রথাকে সংরক্ষণের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়াশীল শ্রেণীর কট্টর সমর্থক হিসেবেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন।

(চলবে…)

[আগের পর্ব : বেদ নিত্য] [*] [পরের পর্ব : অন্যান্য ঋষিপ্রোক্ত দর্শন-মত খণ্ডন]

No comments: