Friday, March 3, 2017

বেদান্তদর্শন-ব্রহ্মবেদান্ত-১৩ : বাদরায়ণের দার্শনিক মত- আত্মা কর্তা



| বেদান্তদর্শন-ব্রহ্মবেদান্ত-১৩ : বাদরায়ণের দার্শনিক মত- আত্মা কর্তা |
রণদীপম বসু
(খ) আত্মা কর্তা :
আত্মা কর্তা, শ্রুতিতে এর প্রচুর প্রমাণ আছে। কেননা, আত্মা কর্তা না হলে তাকে ভোক্তা বলে মানা ভুল। বেদশাস্ত্রে বা উপনিষদের শ্রুতিতে স্বর্গাদিলাভের উদ্দেশ্যে কিছু যাগযজ্ঞাদি অনুষ্ঠানের কথা জীবের দ্বারা করণীয় বলে ব্যবস্থাপিত হয়েছে। যদি জীবাত্মা কর্তাই না হন, তাহলে শ্রুতির এজাতীয় উপদেশগুলি নিরর্থক প্রতিপন্ন হবে। তাই সূত্রকার বাদরায়ণ বলেন-

‘কর্তা, শাস্ত্রার্থবত্ত্বাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩৩)।।
ভাবার্থ : শাস্ত্র স্বর্গাদিলাভের জন্য যে যজ্ঞাদির কথা উপদেশ করেছেন তা সার্থক হয় তখনই যখন জীবকে এইসবের কর্তা বলে মান্য করা হয় (ব্রঃ-২/৩/৩৩)।
আবার শ্রুতিবচন থেকে জানা যায়, যেমন, বৃহদারণ্যক উপনিষদের শ্রুতিতে বলা হয়েছে-
‘স যত্রৈতৎ স্বপ্নায়া চরতি, তে হাস্য লোকাঃ। তদুতেব মহারাজো ভবত্যুতেব মহাব্রাহ্মণ উতেব উচ্চাবচং নিগচ্ছতি। স যথা মহারাজো জানপদান্ গৃহীত্বা স্বে জনপদে যথাকামং পরিবর্তেতৈবম্ এবৈষ এতৎ প্রাণাম্ গৃহীত্বা স্বে শরীরে যথাকামং পরিবর্ততে’।। (বৃহদারণ্যক-২/১/১৮)।।
‘অথ যথা সুষুপ্তো ভবতি যদা ন কস্যচন বেদ…’।। (বৃহদারণ্যক-২/১/১৯)।।
অর্থাৎ :
মানুষ যখন ঘুমোতে যায়, তখনো তার দুটো অবস্থা। একটা হলো স্বপ্নাবস্থা। মানুষটি শুয়ে ঘুমোচ্ছে, সাধারণ চোখ দিয়ে যেমন দেখে সেরকম দেখছে না, সাধারণ কান দিয়ে যেমন শুনতে পাচ্ছিলো সেভাবে আর শুনতে পাচ্ছে না, ঘ্রাণেন্দ্রিয় দিয়ে শ্বাস-প্রশ্বাস যেভাবে সে অনুভব করছিলো সেভাবে করতে পাচ্ছে না, অথচ সে সবকিছুই করে চলেছে। মহারাজ, মহাব্রাহ্মণের মতো ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়াচ্ছে। বাইরে নিষ্ক্রিয়, কিন্তু ভেতরে রীতিমতো সক্রিয়। একজন মহারাজ যেমন তার অধীন প্রজাদের নিয়ে খেয়াল-খুশিমতো ঘুরে বেড়ায়। সেই বিজ্ঞানময় পুরুষ বা বলতে পারেন, স্বপ্নপুরুষ ইন্দ্রিয়দের নিজের অধীনে রেখে নিজের দেহের ভেতরে থেকেই ইচ্ছামতো ঘোরে-ফেরে, কাজ-কর্ম করে  (বৃহদারণ্যক-২/১/১৮)।
এরপর সুষুপ্তি অবস্থা। জেগে থাকার সময় সমস্ত ইন্দ্রিয় নিয়ে ঐ বিজ্ঞানময় পুরুষ যেসব বিষয় উপভোগ করে, ঘুমোতে যাবার সময় স্বপ্নের মধ্যে সে যার আস্বাদ নেয়, সুষুপ্তির মধ্যে কোন বিষয়ই সে উপভোগ করে না। ঘুমের অতল সাগরে সে তখন তলিয়ে থাকে। কোন তরঙ্গই সে সময় তাকে স্পর্শ করে না… (বৃহদারণ্যক-২/১/১৯)।
শ্রুতি অনুযায়ী, এই যে স্বপ্নাবস্থায় জীবাত্মা ইন্দ্রিয়গুলিকে সাথে নিয়ে বিচরণ করে থাকেন, এ থেকেও প্রমাণিত হয় যে, জীব কর্তা। তাই সূত্রকার বাদরায়ণ বলেন-
‘বিহারোপদেশাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩৪)।।
‘উপাদানাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩৫)।।
ভাবার্থ : বিহার বা বিচরণাদির উপদেশ থেকেও বুঝা যায় যে, জীব কর্তা (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/২৪)।  শ্রুতিতে ইন্দ্রিয়াদিকে গ্রহণরূপ কার্যের উপদেশ থাকায় জীব কর্তা-ই (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩৫)।
এখানে একটি আপত্তি উঠে যে, বুদ্ধি না হয়ে জীব বা আত্মা যদি কর্তাই হয়, তাহলে যা তার পক্ষে কল্যাণকর শুধু সেসব কর্মেরই অনুষ্ঠান করতো- শুভ-অশুভ উভয় কর্ম করতো না। এই আপত্তি খণ্ডন করে সূত্রকার বাদরায়ণ বলেন, বুদ্ধি আসলে করণ। যদি বুদ্ধিকে কর্তা বলা হয় তাহলে তা করণ হিসাবে কার্য সহায়ক হতে পারে না- ফলে আমাদের অন্য কিছুকে করণরূপে কল্পনা করতে হয়। আর জীব যেমন স্বাধীন হলেও প্রিয় ও অপ্রিয় উভয়কেই অনুভব করে, ঠিক তেমনি শুভ ও অশুভ উভয় প্রকার কার্যই করতে পারে। তাই বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-
‘উপলব্ধিবদনিয়মঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩৭)।।
‘শক্তিবিপর্যয়াৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩৮)।।
ভাবার্থ : জীব কর্তা হলেও শুভাশুভ কার্য সম্পাদনে তার কোন নিয়মিত কর্তৃত্ব বা নিয়ম নেই  (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩৭)।  বুদ্ধিকে কর্তা বললে বুদ্ধির করণত্বও লোপ হয়- তা কর্তা হয়ে যায়। আসলে জীবেরই কর্তৃত্ব (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩৮)।
তাছাড়া যদি আত্মা কর্তা না হন, তাহলে সাংখ্য-যোগ-সম্মত সমাধিরই বা কী প্রয়োজন ? এছাড়া শ্রুতিশাস্ত্রে যে আছে সমাধির দ্বারা ‘আত্মাকে জানতে হবে’ (বৃহদারণ্যক-২/৪/৫), তা অর্থহীন হয়ে যায়। সুতরাং আত্মার পক্ষে শাস্ত্রানুযায়ী ‘শ্রবণ, মনন, নিদিধ্যাসন’ ইত্যাদি সহায়ে সাধনা করে জ্ঞান উৎপাদন এবং সমাধিলাভ করাও সম্ভব হবে না। ফলে জীবাত্মার পক্ষে মোক্ষলাভ করাও হবে না। বরং আত্মাকে কর্তা বলে মেনে নিলে তাকে নিষ্ক্রিয় বসে থাকতে দেখলে দোষ হবে না। তাই বেদান্তসূত্রানুসারে-
‘সমাধ্যভাবাচ্চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩৯)।।
‘যথা চ তক্ষোভয়থা’।। (২/৩/৪০)।।
ভাবার্থ : আত্মার কর্তৃত্ব স্বীকার না করলে আত্মজ্ঞানলাভের জন্য যে সমাধির উপদেশ আছে তা বৃথা হয়ে পড়ে (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৩৯)।   সূত্রধর (কাষ্ঠশিল্পী) ইচ্ছানুসারে কর্তা এবং অকর্তা উভয়ই হতে পারে। কিন্তু অচেতন বুদ্ধি তা পারে না। সুতরাং জীবই কর্তা (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৪০)।
অর্থাৎ উপাধিযুক্ত জীবই কর্তা। কেননা, শাস্ত্রেও সকল উপদেশই হলো আত্মার বিশেষ গুণযুক্ত অবস্থা বিষয়ে। যেমন, বৃহদারণ্যক উপনিষদে বলা হয়েছে-
‘স বা অয়ং পুরুষো জায়মানঃ শরীরং অভিসম্পদ্যমানঃ পাপমভিঃ সংসৃজ্যতে। স উৎক্রামন্ ম্রিয়মাণঃ পাপমনো বিজহাতি’।। (বৃহদারণ্যক-৪/৩/৮)।।
অর্থাৎ : এই নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ অর্থাৎ বিজ্ঞানময় পুরুষ (=আত্মা) জন্মগ্রহণ করে যখন শরীর ধারণ করে তখন জাগতিক ধর্ম-অধর্মের নিয়মাধীন হয়ে পাপের সঙ্গে যুক্ত হন। আবার দেহান্তে অর্থাৎ এই শরীর ত্যাগ করার সময়, যাবতীয় পাপকেও পরিত্যাগ করে যান (বৃহদারণ্যক-৪/৩/৮)।
আত্মা স্বভাবত নিষ্ক্রিয়- যখনই মন বুদ্ধি ইত্যাদি উপাধির সঙ্গে যুক্ত হয় তখনই আত্মা সক্রিয় হয়। যদি জীবাত্মা স্বভাবতই কর্তা না হন, তাহলে শাস্ত্রের উপদেশ ব্যর্থ হয়ে যায়। কর্তার মধ্যে কর্তৃত্ব ক্ষমতা থাকেই, সে তাকে কখনো ব্যবহার করে, কখনো করে না। শ্রুতিতে সিদ্ধ করা হয়েছে যে জীবাত্মার এই কর্তৃত্বশক্তি পরমাত্মার সঙ্গে মিলিত। যেমন কৌষীতকি উপনিষদে বলা হয়েছে-
‘ন সাধুনা কর্মণ্য ভুয়ান্নো, এব অসাধুনা কনীয়ান্ । এষ হ্যেবৈনং সাধু কর্ম কারয়তি তৎ যমেভ্যো লোকেভ্য উন্নিনীষত, এষ উ এবৈনম্ অসাধু কর্ম কারয়তি তং যং অধঃ নিনীষতে। এষ লোকপালঃ। এষ লোকাধিপতিঃ। এষ সর্বেশঃ। স ম আত্মেতি বিদ্যাৎ, স ম আত্মেতি বিদ্যাৎ’।। (কৌষীতকি-৩/৮)।।
অর্থাৎ : এই যে আত্মা, শাস্ত্রবিহিত সাধু কাজ করলে যে তাঁর লাভ হলো, বৃদ্ধি হলো- তা যেমন হয় না; আবার অশাস্ত্রীয় অসাধু কাজ করলে যে ক্ষতি হলো, হীন হলো, তাও হয় না। এই মহাপ্রাণ চেতন আত্মা চলেন নিজের ইচ্ছায়। তিনি যদি মনে করেন এ জগতে কাউকে মহান করে তুলবেন, তখন তিনিই তাকে দিয়ে সাধু কাজ করিয়ে নেন। আবার যদি মনে করেন, কারো অধঃপতন ঘটাবেন, তাহলে রাজ্যের অসাধু কাজ তিনিই তাকে দিয়ে করিয়ে নেবেন। ইনি লোকপাল- জীবের প্রভু। ইনি সর্বেশ- সমস্ত গুণসম্পন্ন। জানবে- সেই আত্মাই আমার আত্মা, আমার স্বরূপ। ‘তিনিই আমার আত্মা’- তাঁকে এইভাবে জানবে। ঐ আত্মাই আমার স্বরূপ (কৌষীতকি-৩/৮)।
অতএব, বাদরায়ণও বেদান্তসূত্রে এই সিদ্ধান্ত করেন-
‘পরাত্তু তচ্ছ্রুতেঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৪১)।।
ভাবার্থ : শ্রুতি বাক্যানুসারে জীবের কর্তৃত্ব পরমাত্মা পরমেশ্বরের অধীন (ব্রঃ-২/৩/৪১)।
কিন্তু শ্রুতি অনুযায়ী জীবের ক্রিয়া পরমেশ্বরের অধীন হলে স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, যেহেতু ঈশ্বর কোন কোন ব্যক্তিকে সৎকার্যে এবং কাউকে আবার মন্দ কার্যে প্রবৃত্ত করেন সেকারণে তাঁকে নিষ্ঠুর এবং অবিবেকী মনে হতে পারে। এই আপত্তি খণ্ডন করে বাদরায়ণ বলেন-
‘কৃতপ্রযত্নাপেক্ষস্তু বিহিতপ্রতিষিদ্ধাবৈয়র্থ্যাদিভ্যঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-২/৩/৪২)।।
ভাবার্থ : জীবের ধর্ম-অধর্ম কার্যানুসারেই ঈশ্বর তাকে শুভ-অশুভ কর্মে প্রবৃত্তি দিয়ে থাকেন। অতএব শাস্ত্রোক্ত বিধি-নিষেধের সার্থকতা আছে (ব্রঃ-২/৩/৪২)।
অর্থাৎ, শাস্ত্রানুসারে, ঈশ্বর জীবের পূর্ব পূর্ব জন্মের সুকৃতি  বা দৃষ্কৃতি অনুসারেই শুভাশুভ নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। এবং সংসার যেহেতু অনাদি, নিশ্চয়ই পুনঃপুনঃ পূর্ব জন্মগুলির কর্মফল তাতে থাকবেই- এবং ঈশ্বরই এসব কর্মফলানুসারে জীবের নিয়ন্তা। সুতরাং ঈশ্বরকে নিষ্ঠুর বা স্বৈরাচারী বলে দোষারোপ করা যায় না। এভাবে বুঝলেই শাস্ত্রের কর্তব্য-অকর্তব্যের বিধিনিষেধের সার্থকতা উপলব্ধি করা যায়। তা নাহলে জীব এসব শাস্ত্র উপদেশ পালন করে কোন লাভবান হতো না। এতে কিন্তু ঈশ্বরের স্বাধীনতার কোন হানি হয় না। যদিও বলা যেতে পারে যে, তিনি তো জীবের শুভাশুভ ক্রিয়ার উপরই ফলদান ব্যাপারে নির্ভরশীল- তিনি যা খুশি তা-ই করতে পারেন না। এর উত্তরে বলা হয়, একজন রাজা যেমন তাঁর প্রজাকে তাদের কর্মানুসারে পুরস্কার বা শাস্তি দিয়ে থাকেন- কিন্তু এর দ্বারা রাজার সার্বভৌমত্বেও কোন হানি হয় না।

(চলবে…)

[আগের পর্ব : আত্মা অণু-স্বরূপ] [*] [পরের পর্ব : আত্মা ব্রহ্ম নয়, ব্রহ্মেরই অংশ]

No comments: