Friday, March 3, 2017

বেদান্তদর্শন-ব্রহ্মবেদান্ত-২২: বাদরায়ণের দার্শনিকমত- বেদ নিত্য



| বেদান্তদর্শন-ব্রহ্মবেদান্ত-২২: বাদরায়ণের দার্শনিকমত- বেদ নিত্য |
রণদীপম বসু

২.২.০৭. বেদ নিত্য :
মীমাংসা সূত্রকার মহর্ষি জৈমিনি বেদকে অপৌরুষেয় বলে মানলেও ব্রহ্মসূত্রকার বাদরায়ণ বেদকে অপৌরুষেয় মানেননি, কিন্তু বেদের নিত্যতা সম্বন্ধে একমত ছিলেন। কেননা বেদও যদি অন্যান্য শাস্ত্রের মতো অনিত্য বলে প্রমাণিত হয়ে যায়, তাহলে প্রামাণ্যের অভাবে যুক্তিতর্কের ভিত্তিতে সাংখ্য, ন্যায়, বৈশেষিক, বৌদ্ধ প্রভৃতির মতো তার্কিকগণের সম্মুখে আত্মপক্ষ সমর্থনে সক্ষম হতে পারবে না। তাই সূত্রকার বাদরায়ণ বেদান্তসূত্রে বেদের নিত্যতা প্রসঙ্গে বলেন-

‘অত এব চ নিত্যত্বম্’।। (ব্রহ্সূত্র-১/৩/২৯)।।
ভাবার্থ : সৃষ্টি শব্দ-পূর্বিকা, অতএব বৈদিক শব্দ ও তার অর্থ উভয়ই নিত্য।
কারণ, ঋগ্বেদ-সংহিতাতেই উদ্ধৃত আছে যে-


‘যজ্ঞেন বাচঃ পদবীয়মায়ন্তামন্ববিন্দন্নৃষিষু প্রবিষ্টাম্ ।
তামাভৃত্যা ব্যদধুঃ পুরুত্রা তাং সপ্ত রেভা অভি সং নবন্তে’।। (ঋগ্বেদ-১০/৭১/৩)।।
অর্থাৎ : বুদ্ধিমানগণ যজ্ঞদ্বারা ভাষার পথ প্রাপ্ত হন। ঋষিদের অন্তকরণ মধ্যে যে ভাষা সংস্থাপিত ছিলো তা তাঁরা তাঁদের পূর্বকৃত সুকৃতির জন্য প্রাপ্ত হলেন। সে ভাষা আহরণপূর্বক তাঁরা নানাস্থানে বিস্তার করলেন। সপ্তছন্দ সে ভাষাতেই স্তব করে (ঋক-১০/৭১/৩)।

বলা হয়, ঋষিগণ বেদের দ্রষ্টা মাত্র, বেদের কর্তা বা রচয়িতা নন। তাই পূর্ব থেকেই সংস্থাপিত বা অবস্থিত বেদের শব্দরাশির উল্লেখ থেকেই প্রমাণ হয় যে, বেদ নিত্য। আবার স্মৃতিশাস্ত্র হিসেবে মনুসংহিতায় বলা আছে-

‘সর্বেষাং তু স নামানি কর্মাণি চ পৃথক্ পৃথক্ ।
বেদশব্দেভ্য এবাদৌ পৃথক্-সংস্থাশ্চ নির্মমে’।। (মনুসংহিতা-১/২১)।।
অর্থাৎ : সৃষ্টির প্রারম্ভে হিরণ্যগর্ভরূপে অবস্থিত এই পরমাত্মা বেদ থেকে (পূর্ব-পূর্ব কল্পের যার যেমন নামাদি ছিলো তা) অবগত হয়ে সকলের নাম (যেমন, গোজাতির অন্তর্গত গো, অশ্ব-জাতির অশ্ব প্রভৃতি), কর্ম (যেমন ব্রাহ্মণের অধ্যয়নাদি, ক্ষত্রিয়ের প্রজারক্ষণাদি), এবং নানারকম লৌকিকী ক্রিয়া (যেমন, ব্রাহ্মণের যাজনাদি, কুলালের ঘটনির্মাণ, তন্তুবায়ের পটনির্মাণ প্রভৃতি) পৃথক পৃথক ভাবে (অর্থাৎ পূর্বকল্পের যার যেমন ছিলো সেইভাবে) নির্দেশ করলেন (মনুসংহিতা-১/২১)।

এখানে বোঝানো হয়েছে যে, প্রলয়কালেও পরমাত্মার মধ্যে বেদরাশি সূক্ষ্মরূপে বিদ্যমান থাকে, এটাই শাস্ত্রসিদ্ধান্ত। অতএব, বেদ নিত্য।

তাছাড়া আমরা ইতঃপূর্বে দেখেছি যে, ব্রহ্মের উপাসনা করার সুবিধার জন্য উপনিষদে (কঠ-২/১/১২) মনুষ্যের হৃদয়ে অঙ্গুষ্ঠ প্রমাণ ব্রহ্মের কথা স্বীকার করে বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-

‘শব্দদেব প্রমিতঃ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/২৪)।।
‘হৃদি-অপেক্ষয়া তু মনুষ্য-অধিকারত্বাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/২৫)।।
ভাবার্থ :
শ্রুতিশাস্ত্রের শব্দ থেকেই জানা যায় যে, তিনি ‘অঙ্গুষ্ঠমাত্র’- পরিমিত পুরুষ (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/২৪)।  শাস্ত্রপাঠে এবং উপাসনায় একমাত্র মানুষেরই অধিকার, তাই সকল মানুষের হৃদয়ের পরিমাণ অনুসারে উপাসনার নিমিত্ত তাঁকে অঙ্গুষ্ঠ পরিমাণ বলা হয়েছে (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/২৫)।

কিন্তু এ প্রেক্ষিতে যে সন্দেহটির উদ্রেক হতে পারে তা হলো, যেহেতু বলা হয়েছে একমাত্র মানুষই শাস্ত্রপাঠ অর্থাৎ বেদাধ্যয়নের অধিকারী, তাহলে কি বেদপাঠে দেবতাদের কোন অধিকার নেই ? এ প্রেক্ষিতে বেদান্তসূত্র বলছে-

‘তদুপরি অপি বাদরায়ণঃ সম্ভবাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/২৬)।।
ভাবার্থ : বাদরায়ণ বলেন যে, মনুষ্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ দেবতাগণেরও এই অধিকার আছে ; কারণ তাঁদের পক্ষেও মোক্ষলাভেচ্ছু হওয়া সম্ভব (ব্রঃ-১/৩/২৬)।
অর্থাৎ, বাদরায়ণের মতে দেবতারাও বেদপাঠের অধিকারী। কিন্তু তাঁদের পক্ষে কিভাবে তা সম্ভব ? তা সম্ভব এজন্যেই যে, দেবতারাও দেহধারী, তাঁদেরও ব্রহ্মলোক অথবা পরাজ্ঞানের আকাঙ্ক্ষা আছে- এবং এই জ্ঞানলাভের জন্য সাধনচতুষ্টয়সম্পন্ন হবার যথাযোগ্য গুণ আছে। কেননা, শ্রুতিতেও দেখতে পাওয়া যায় যে, ইন্দ্রাদি দেবগণ ব্রহ্মজ্ঞান লাভের জন্য ব্রহ্মচর্য-জীবন যাপন করছেন। দৃষ্টান্তস্বরূপ-

‘তদ্ধোভয়ে দেবাসুরা অনুবুবুধিরে তে হোচুর্হন্ত তম্ আত্মনম্ অন্বিচ্ছামো যম্ আত্মানম্ অন্বিষ্য সর্বাংশ্চ লোকানাপ্নোতি সর্বাংশ্চ কামানিতীন্দ্রো হৈব দেবানামভিপ্রবব্রাজ বিরোচনঃ অসুরাণাং তৌ হ অসংবিদানৌ এব সমিৎপাণী প্রজাপতিসকাশম্ আজগ্মতুঃ’। (ছান্দোগ্য-৮/৭/২)।।  ‘তৌ হ দ্বাত্রিংশতং বর্ষাণি ব্রহ্মচর্যম্ ঊষতুঃ…’। (ছান্দোগ্য-৮/৭/৩)।।
অর্থাৎ : দেবতা ও অসুরগণ উভয়েই লোকমুখে প্রজাপতির এই উপদেশের কথা শুনেছিলেন। তাঁরা বললেন, ‘যে আত্মাকে অনুসন্ধান করলে সমস্ত লোক ও সকল কাম্যবস্তু লাভ করা যায়, আমরা তার অনুসন্ধান করবো।’ এই উদ্দেশ্যে দেবতাদের মধ্যে ইন্দ্র ও অসুরদের মধ্যে বিরোচন প্রজাপতির কাছে গেলেন। তাঁরা পরস্পরের অজ্ঞাতসারেই যজ্ঞের কাঠ হাতে প্রজাপতির নিকট উপস্থিত হলেন (ছান্দোগ্য-৮/৭/২)।  তাঁরা দুজনে কঠোর ব্রহ্মচর্য অবলম্বন করে বত্রিশবছর সেখানে বাস করলেন… (ছান্দোগ্য-৮/৭/৩)।

এ পর্যায়ে এখানে আরেকটি প্রশ্ন উত্থাপিত হয় যে, যদি দেবতারা সাকার বা দেহধারী হন, তাহলে এই ইন্দ্রাদি দেবতাদের পক্ষে একই সময়ে বিভিন্ন স্থানে একাধিক যজ্ঞে উপস্থিত থাকা কী করে সম্ভব ? উত্তরে বলা হয়েছে-

‘বিরোধঃ কর্মণি ইতি চেৎ, ন, অনেকপ্রতিপত্তেঃ দর্শনাৎ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/২৭)।।
ভাবার্থ : দেবতারা দেহধারী হলেও একই দেবতার যজ্ঞাদিতে একই সময়ে বহু স্থানে উপস্থিতি কিভাবে সম্ভব হতে পারে ? হা, তা সম্ভব। কারণ শাস্ত্রপাঠে জানা যায় যে, তাঁরা একই সময়ে বহু দেহ ধারণ করতে পারেন (ব্রঃ-১/৩/২৭)।

কিন্তু এবারও দেবতাদের শরীরধারণত্ব বিষয়ে আপত্তি দেখা দেয়। বলা হয়, যদি দেবতারা দেহধারী হন তাহলে তাঁরাও মনুষ্যের ন্যায় জন্ম মৃত্যুর অধীন হবেন। সেক্ষেত্রে যেহেতু নাম ও নামীর সম্পর্ক নিত্য, তাই অনিত্য দেবতার নাম বেদে উক্ত হওয়ায় বেদও অনিত্য হবে। এই আপত্তি খণ্ডন করে বেদান্তসূত্রে বলা হয়েছে-

‘শব্দ ইতি চেৎ, ন, অতঃ প্রভবাৎ প্রত্যক্ষানুমানাভ্যাম্’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/২৮)।।
‘সমাননামরূপত্বাৎ চ আবৃত্তৌ অপি অবিরোধঃ দর্শনাৎ স্মৃতেশ্চ’।। (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/৩০)।।
ভাবার্থ :
দেবতারা শরীরবিশিষ্ট হলে বৈদিক শব্দের নিত্যতা কী করে সম্ভব ?- হাঁ, সম্ভব। কারণ শ্রুতি-স্মৃতি প্রমাণে ‘সৃষ্টি শব্দপূর্বিকা’- তা জানা যায় (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/২৮)।  পূর্বকল্পে সৃষ্টি যেমন নামরূপবিশিষ্ট ছিলো পরকল্পেও তা সেইরূপ নামরূপবিশিষ্ট হয়েই প্রকাশিত হয়- তা শ্রুতি স্মৃতি পাঠে জানা যায় (ব্রহ্মসূত্র-১/৩/৩০)।
অর্থাৎ, এখানে বলা হচ্ছে, অনিত্য দেবতার নাম বেদে উক্ত হওয়ায় বেদও অনিত্য হবে এরূপ আশঙ্কার কোনো কারণ নেই, কারণ বেদ ইন্দ্র থেকে এই শব্দ গ্রহণ করেনি, বরং বেদের শব্দ থেকেই ইন্দ্র নামটি পাওয়া গেছে। বস্তুত দেবতাদের দ্যোতক শব্দের বাচ্য বস্তুগুলি কোন ব্যক্তি-বিশেষ নয়- এটি একটি সাধারণধর্মী জাতি। যেমন রাজা বলতে কোন ব্যক্তি বিশেষকে বুঝায় না; রাজত্বধারী যে-কোন ব্যক্তিকেই বুঝায়, তেমনি ইন্দ্র বলতে যে-কোন ব্যক্তিকেই বুঝায়- যিনি সেই পদে উন্নীত হতে পারেন। সুতরাং বৈদিক শব্দের মধ্যে কোন স্ববিরোধিতা নেই। অতএব, বেদ নিত্য। ইন্দ্রাদির একই নাম ও একই রূপ হওয়াতে, বারংবারতার আবৃত্তি হতে থাকলেও বেদের নিত্যতার কোনো হানি হয় না।

(চলবে…)

[আগের পর্ব : মুক্তের বৈভব] [*] [পরের পর্ব : বর্ণাশ্রম ও জাতিভেদ]

No comments: