Wednesday, December 7, 2011

| জৈনদর্শন:পর্ব-১০| জৈন ধর্ম ও দর্শনের মূল্যায়ন |

 
| জৈনদর্শন:পর্ব-১০| জৈন ধর্ম ও দর্শনের মূল্যায়ন |
-রণদীপম বসু

(আগের পর্বের পর…)

৪.০ : জৈন ধর্ম ও দর্শনের মূল্যায়ন (Jainism: Religion and Philosophy)
.
যেকোন ধর্মের বৈশিষ্ট্য জানতে হলে তার আচারমার্গের অনুশীলনকে আবশ্যক বিবেচনা করা হয়। কেননা আচারমার্গের প্রতিপাদনেই ধর্মের ধর্মত্ব নিহিত থাকে। এখানেই সেই সেই ধর্মের স্বাতন্ত্র্য ও বৈশিষ্ট্য। ধর্ম ও তার দর্শনের ক্ষেত্রে মূল পার্থক্যটা হচ্ছে, দর্শনের মূল্য বা বৈশিষ্ট্য তার সৈদ্ধান্তিক পর্যায়ে, ধর্মের মহত্ত্ব তার ব্যবহারিক নিমিত্তে। দর্শন হচ্ছে সিদ্ধান্তের সাধক, ধর্ম হচ্ছে ব্যবহারিক তত্ত্বের প্রতিপাদক। বিশ্বাসীদের মতে, যার দ্বারা লৌকিক উন্নতি ও পারলৌকিক কল্যাণ সিদ্ধ হয় তাকে ধর্ম বলে।
.
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ্য যে, পাশ্চাত্যের ধর্ম ও দর্শনের মধ্যে যে পারস্পরিক উগ্র বিরোধ পরিলক্ষিত হয়, ভারতীয় ধর্ম ও দর্শনের ক্ষেত্রে তার বিপরীত অবস্থা দেখা যায়। এক্ষেত্রে ধর্ম ও দর্শনকে গভীর মৈত্রীর সাথে সামঞ্জস্য ও সমন্বয় করা হয়েছে। এখানে ধার্মিক আচার ব্যতীত যেমন কার্যান্বিত দর্শনের স্থিতি নিষ্ফল, অন্যদিকে দার্শনিক বিচার ছাড়া পরিপুষ্ট ধর্মের সত্তাও প্রতিষ্ঠিত হয় না। দর্শনের ভিতের উপরেই ধর্মের প্রাসাদ দাঁড় করাতে হয়। তাই উদ্ভূত ভারতীয় ধর্মগুলি আধ্যাত্মিকতার অনুপ্রাণ ধারণের সাথে সাথে তর্কহীন বিচার ও বিশ্বাস হতেও নিজেদের বাঁচানোর দার্শনিক প্রয়াস অব্যাহত রেখেছে। ভারতীয় জৈন ধর্ম ও দর্শনও এর ব্যতিক্রম হয় নি।
এ প্রেক্ষিতে আমরা জৈনধর্ম ও দর্শনকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কিছু মূল্যাংক বিবেচনায় নিতে পারি।
.
(১) . জৈনধর্মে বিশেষ সমন্বয় দৃষ্টি লক্ষ্য করা যায়। তা কোন ধর্মের সাথে বিরোধ করে না এবং কোন দার্শনিক দৃষ্টিরও অপলাপ করে না। জৈনদের স্যাদবাদের অনেকান্ত দৃষ্টিভঙ্গি সকল দার্শনিক সিদ্ধান্তে সামঞ্জস্যের পক্ষপাতী। এই মতানুসারে প্রত্যেক বস্তু অনন্ত ধর্মাত্মক এবং তা হচ্ছে বস্তুর তত্ত্ব। মানববুদ্ধি কেবল বস্তুর দু-একটি ধর্ম জানতে পারে এবং এই জানা সাপেক্ষ হওয়া ন্যায়সঙ্গত। তার ফলে জৈনরা অন্যের বিচার ও দৃষ্টিকোণের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে, যা উদার মনেবৃত্তির প্রকাশ।
.
(২) . আচারের প্রতি বিশেষ আগ্রহ জৈনধর্মের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই মতে কর্মকে একটি মূর্ত পদার্থ বিবেচনা করে একটি বিভ্রম সৃষ্টি করা হয়েছে। কোন পরমার্থিক সত্তার প্রয়োজন ছাড়াই জীবের কর্মই স্বয়ং ফল প্রদান করে এবং সঠিক আচারের মাধ্যমে কর্মের ক্ষয় দ্বারা সকল বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে মোক্ষলাভ করা যায়, এ মত যেমন জৈনধর্মকে বিশেষ ঔজ্জ্বল্য দান করেছে, অন্যদিকে দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি অভিন্ন হওয়া সত্ত্বেও কেবল বাহ্যিক আচারমার্গিক কারণে শ্বেতাম্বর ও দিগম্বর এ দুই সম্প্রদায়ে বিভক্তি জৈনধর্মের আরেকটি দুর্বলতা মনে করা হয়।
.
(৩) . জৈনমতে আত্মা সম্পূর্ণ শরীরে ব্যাপ্ত থাকে। আত্মাকে প্রাণের সমান স্বীকার করার মধ্য দিয়ে আত্মায় ভৌতিকবাদের লেশ প্রবিষ্ট হয়েছে বলে কেউ কেউ মনে করেন। আত্মাকে জীব সংজ্ঞায় অভিহিত করে জৈনরা আত্মার আধ্যাত্মিক স্বরূপকে খণ্ডিত করেছেন, যার ফলে আত্মবিষয়ক বিচারে অস্পষ্টতা লক্ষ্য করা যায়।
.
(৪) . দার্শনিক সিদ্ধান্তে ঈশ্বর নামক কোন পরম সত্তায় বিশ্বাসী না হয়েও জৈনদর্শনের অন্যতম দুর্বলতা হচ্ছে ব্যবহারিকভাবে তীর্থঙ্করকে ঈশ্বররূপে প্রতিষ্ঠা করা। তীর্থঙ্করে ঈশ্বরত্ব নিহিত হলেও তাদেরকে ঈশ্বর বলে স্বীকার করা যুক্তিসঙ্গত মনে হয় না। এতে করে জৈনদর্শনে অসঙ্গতি দৃষ্ট হয়েছে বলে মনে করা হয়।
.
(৫) জৈনদর্শনে প্রতিপাদিত অহিংসাবিষয়ক সিদ্ধান্তটি সামাজিক ও নৈতিক দৃষ্টিতে শ্রেষ্ঠ হলেও অত্যন্ত কঠোর। জৈনদের অহিংসা এতোটা কঠিন ও কঠোর যে তার নিয়ম ও আচার পালন কিছু বিরল ব্যক্তি ছাড়া সাধারণের জন্য দুষ্কর। ফলে জৈনদর্শনের অহিংসাব্রত তার অব্যবহারিকতার পরিচায়ক বললে অত্যুক্তি হবে না।
.
জৈনদের কর্মসিদ্ধান্তে কঠোর অহিংসনীতি সমাজের উৎপাদন ব্যবস্থার জন্য অনুকুল নয়। তারপরও ভিন্নমতের প্রতি শ্রদ্ধা রাখার শিক্ষা জৈনদর্শনের উল্লেখযোগ্য দিক। এছাড়াও দর্শনের ইতিহাসে প্রমাণশাস্ত্রে জৈনদের অবদান অপরিসীম। এর অন্যতম উদাহরণ হলো স্যাদবাদ।
.
৫.০ : জৈন ও বৌদ্ধদর্শনের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য
.
প্রায় সমসাময়িক দর্শন হিসেবে জৈন ও বৌদ্ধদর্শনের বিকাশ স্বতন্ত্রভাবে হলেও উভয় দর্শনের মৌলিক চরিত্রে অত্যধিক সাদৃশ্য রয়েছে। যেমন-
.
১) . জৈন ও বৌদ্ধ উভয় দর্শনই বেদবিরোধী দর্শন। তারা বেদের প্রামাণ্যকে স্বীকার করে না। একারণে জৈন ও বৌদ্ধকে নাস্তিক (heterodox) দর্শন বলা হয়।
.
২) . জৈন ও বৌদ্ধ উভয় দর্শনই ঈশ্বরে অবিশ্বাসী। তারা ঈশ্বরের সত্তাকে খণ্ডন করে অনীশ্বরবাদ (atheism) সমর্থন করে।
.
৩) . জৈন ও বৌদ্ধ উভয় দর্শনেই অহিংসার উপর অত্যধিক জোর দেয়া হয়েছে।
.
৪) . জৈনগণ অহিংসা প্রভৃতি পঞ্চ মহাব্রতের কথা সম্যক চরিত্রের জন্য গ্রহণীয় বলেন। আর বৌদ্ধগণ তাদের ধর্মে পঞ্চ মহাব্রতের পালনকে গুরুত্ব দেন। বৌদ্ধধর্মে তাকে ‘পঞ্চশীল’ বলা হয়।
.
জৈন ও বৌদ্ধদর্শনের উপরোক্ত সাদৃশ্যের মধ্যেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য বা বৈসাদৃশ্যও রয়েছে। যেমন-
.
১) . বৌদ্ধদর্শনে আত্মা অর্থে কোন নিত্য সত্তার স্বীকার করা হয় নি। কিন্তু জৈনদর্শন আত্মায় আস্থাশীল। জৈনমতে আত্মা অসংখ্য এবং তা জগতের বিভিন্ন বস্তুতে বিদ্যমান থাকে।
.
২) . জড় বিষয়ক ধারণায় জৈন ও বৌদ্ধদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। বৌদ্ধদর্শনে জড়ের অস্তিত্বে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু জৈনদর্শন জড়ের সত্তাকে সত্য বলে স্বীকার করে।
.
৩) . জৈনরা অনেকান্তবাদী। কিন্তু বৌদ্ধগণ দর্শনান্তরবৎ অনেকান্তবাদ স্বীকার করেন না।
.
৪) . জৈন ও বৌদ্ধদর্শন প্রথমে ভিন্ন ভিন্ন ভাষায় রচিত হয়েছিলো। প্রারম্ভে জৈনগণ তাঁদের দার্শনিক সাহিত্য অর্ধমাগধী প্রাকৃত ভাষায় রচনা করেন এবং পরবর্তীকালে সংস্কৃত ভাষায় তা বিকশিত হয়। অন্যদিকে বৌদ্ধগণ প্রথমে সাধারণ মানুষের মধ্যে তাঁদের ধর্মকে প্রসারিত করতে প্রচলিত পালি ভাষায় গ্রন্থ রচনা করেন, পরে দার্শনিক বিচারের সুবিধার্থে সংস্কৃত ভাষাকে অবলম্বন করে তাঁদের দার্শনিক গ্রন্থ রচিত হয়।
.
৫) . জৈনরা কেবল আচারগতভাবে দিগম্বর ও শ্বেতাম্বর সম্প্রদায়ে দ্বিধাবিভক্ত হলেও তাঁদের মধ্যে মূল ধর্মসূত্রগুলি একই রূপ। অন্যদিকে বৌদ্ধরা প্রথমে ধার্মিক দৃষ্টিতে হীনযান ও মহাযান নামে দু’টি সম্প্রদায়ে বিভক্ত হলেও দার্শনিক দৃষ্টিতে চারটি প্রধান মতে বিভক্ত। তাঁরা হচ্ছেন সর্বশূন্যত্ব, বাহ্যার্থশূন্যত্ব, বাহ্যার্থনুমেয়ত্ব ও বাহ্যার্থপ্রত্যক্ষত্ব নামে চার প্রকার মতবাদ স্বীকারকারী যথাক্রমে মাধ্যমিক, যোগাচার, সৌত্রান্তিক ও বৈভাষিক সম্প্রদায়। এদের প্রথম দু’টি মহাযানী এবং শেষ দু’টি হীনযানী।

(চলবে…)
(ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)

[পর্ব-০৯: জৈনমতে অনীশ্বরবাদ ও কর্মবিচার] [*] [পর্ব-১১: ...]

1 comment:

Panama lawyers said...

Nice looking picture with good article.