Saturday, December 12, 2009

| দুই-মেগাপিক্সেল | রোড-টু-সিলেট-০১ |



| দুই-মেগাপিক্সেল | রোড-টু-সিলেট-০১ |
- রণদীপম বসু




০১.
০৪-১২-২০০৯ শুক্রবার। চাইলেও সাত-তাড়াতাড়ি বের হওয়া গেলো না। সায়েদাবাদ থেকে হানিফ এন্টারপ্রাইজের গাড়িটা সিলেটের উদ্দেশ্যে টারমিনাল ছাড়লো দুপুর ১.০০ টায়। আজ গিয়ে কালই ফিরতি গাড়ি ধরতে হবে ঢাকার। কাঁধে এরকম ভুতের দাবড়ানি নিয়ে আমি ছুটলেও গাড়ির সেরকম কোন তাড়া নেই। কী আর করা ! মন ভোলাতে বাইরের দৃশ্য দেখছি প্রাণ খুলে। কাঁচপুর ব্রীজের উপর থেকে বাইরের দৃশ্যটাকে কেমন মনভোলা মনে হচ্ছে। বাস্তবেও কি তাই ? পরখ করতে পকেট থেকে দুই-মেগাপিক্সেলটা বের করে নিলাম। এবং গোটাকয় ক্লিক।



০২.
ব্রীজ থেকে নেমেই রাস্তার ঢালের বস্তিগুলোকে ছায়াবৃত করে রাখা ধুলোমাখা গাছের সবুজ পাতার ফাঁক দিয়ে পেছনের শুভ্র-দালান নয়, চোখ পড়লো জলাশয়ের দিকে। ওগুলো কি পুকুর ? ঢাকায় কি কোন পুকুর আছে ? বোঝার সুযোগ নেই। কেননা গাড়িটা আরো এগিয়ে গেছে।



০৩.
ঢাকা-চট্টগ্রাম রোড ছেড়ে গাড়ি এবার টার্ন নিলো সিলেট রোডে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল এলাকা পেরিয়ে আরো বেশ কিছুদূর। গাড়ির গতির বিপরীত বাতাসের ঠাণ্ডা ঝাপটা শীতের আগমনী জানাচ্ছে ভালোভাবেই। চোখ পড়লো খুব চিরচেনা একটা দৃশ্যে। এরকম দৃশ্যকে কেন যে এতো আপন মনে হয় ! সেই ম্লান হওয়া বিদ্যালয়, নিজের মতো করে গড়ে নেয়া ছোট্ট মায়াবি শহীদ মিনার, জীর্ণ-শীর্ণ। চলতি গাড়ি থেকেও দুই-মেগাপিক্সেলটা হতাশ করেনি।



০৪.
গাড়ি ছুটছে। শহর ছেড়ে গ্রাম্য আবহ চিরে। কী স্বস্তি ! তবু চোখে এসে বিঁধে যায় সেই নগর-পত্তনি চিহ্ণ, ইটের ভাটা। একের পর এক। সবুজ-শ্যামল গ্রামগুলো এভাবেই গ্রাস হয়ে যায় সভ্যতার কালো চিমনির ধোঁয়ায়। আমাদের গেয়ো শরীর থেকে কাদার চিহ্ণ মুছে ফেলতে কতো আয়োজন আমাদের ! সেই কাদা-মাটি পুড়িয়ে বানাচ্ছি জমাট রক্তের মতো লাল লাল ইট, অভিশপ্ত সভ্যতার ক্ষুদ্রতম স্মারক !


.

০৫.
হঠাৎ করে গাড়িটা থেমে গেলো। গাড়ি তো থামে না, থেমে যায় মানুষ। যাত্রীরা একে একে নেমে পড়ছেন। খেয়াল হলো, আজ জুম্মাবার, পাশেই মসজিদ। কারণ, ইহকাল সাময়িক, আখেরাতই দীর্ঘস্থায়ী। আমি চোখ বন্ধ করে থাকি। বর্তমানের চোখ আমাদের দেখায় না কিছুই, প্রাগৈতিহাসিক কানের প্রতিই যতো নির্ভরতা আমাদের।



০৬.
চেনা মুখগুলোও মাঝে মাঝে খুব অচেনা হয়ে যায়। কিংবা অচেনা কোন মুখও কখনো কখনো মনে হয় অতি-আপন। কিছু কিছু উষ্ণতা হিমেল বাতাসও রুখতে পারে না। পাশের সহযাত্রিনী কি একথাই ভাবছেন ?



০৭.
একটা সড়ক-দ্বীপ ডানে রেখে বাঁক নিলো গাড়িটা। তখনই চোখে পড়লো চমৎকার ভাস্কর্যটা। দুই-মেগাপিক্সেল তাক করলাম। খুব সুবিধের না হলেও হতাশ করে নি। কিন্তু জায়গাটার নাম জানি না। খুঁজতে লাগলাম। কিছু দূর এগিয়ে গুটিকয় দোকানপাট। সাইনবোর্ড খেয়াল করলাম। লেখা- বাগহাটা, শিলমান্দি, নরসিংদী।



০৮.
কিছুদূর গিয়ে আবারো একই রকম বাঁক। এবং আরেকটা পথ-ভাস্কর্য। আবার ক্লিক। অতঃপর জায়গার পরিচয় খোঁজা- শিবপুর, নরসিংদী।



০৯.
তীব্র গতিতে ছুটছে গাড়ি। রোদের তেজ কমে আসছে। জানালার বাইরে অপসৃয়মান অবিরল দৃশ্যের বন্যা। কী অপরূপ দেশ এই বাংলাদেশ ! ছোট্ট একটা সেতু উপরে এসে বিপরীত দিক থেকে আসা আরেকটা গাড়িকে সাইড দিতে গতি কমে এলো। দুই-মেগাপিক্সেল তো হাতেই তখন। আহা, মন কেড়ে নেয়া এই মধুর দৃশ্য বাংলা ছাড়া আর কোথায় আছে !



১০.
চলে এসেছি ভৈরব। গাড়ির সামনের গ্লাস ভেদ করে দৃষ্টি আটকে গেলো পথ-ভাস্কর্যটায়। সীট ছেড়ে সোজা চালকের পাশে এসে দাঁড়ালাম। হাতে দুই-মেগাপিক্সেল। ছিটগ্রস্ত মানুষকে নাকি সহজেই চেনা যায়। চালকও ভুল করে নি- ‘ওইডা তুলবেন ?’ সম্মতিসূচক মাথা নাড়তেই গাড়ির গতি কমে এলো। গ্লাসের ভেতর থেকেই সাটার টিপলাম।



১১.
আমি কোন ফটোগ্রাফি করছি না, করার উপায় নেই। সে যোগ্যতা বা ক্ষমতাও নেই আমার। কিছু স্মৃতি, কিছু প্রতিকৃতি, কিছু প্রতিচ্ছবি ইলেক্ট্রনিক মেমোরিতে গেঁথে রাখা কেবল। এখানে কোন শিল্প নেই, কলা নেই, শুধু আবেগের অন্ধ মোহ। একধরনের ছেলেমানুষি হয়তো, উদ্ভট পাগলামি। সবাই তো আর পাগলামি করে না, আমিই একটু করলাম না হয় ! ভৈরব সেতুর টোল-প্লাজায় থামতেই গাড়ির জানলা বাগিয়ে অযথাই ক্লিক করা।



আবার ছুটে চলা। সিলেট এখনো কম হলেও দু-ঘণ্টার রাস্তা।…




(চলমান…)



রোড-টু-সিলেট: [*][০২][০৩][০৪]

No comments: