Tuesday, September 30, 2008

@ কখনো লাল কখনো কালো...(সচল পেন্সিলে আঁকা-০৭)










কখনো লাল কখনো কালো...(সচল পেন্সিলে আঁকা-০৭)
রণদীপম বসু

(০১)
ঝনঝন করে মোবাইলটা বেজে ওঠলো অসময়ে। আচমকা গভীর কাচা-ঘুম ভেঙে স্থান-কাল-পাত্র সচেতন হতে হতে কয়েক মুহূর্ত কেটে গেলো। ফোনটা বেজেই চলছে।
সকাল আটটা হয় হয়। শুক্রবার। ‘অফ ডে’-তে নরমালি দেরীতেই বিছানা ছাড়ি। মফস্বলের কর্মময় শাখা-জীবনে ‘অফিস ডে’-তে ভোর ছ’টা বা তারও আগে থেকেই গোটা দিনের ঘড়ি-ধরা যান্ত্রিক রুটিনেই অভ্যস্থ আমরা। ‘ন্যাচার অব জব’টাই এমন যে, তার ব্যত্যয় হওয়ার কোন উপায় নেই, সুযোগও নেই। কিন্তু আমরা তো যন্ত্র নই। রক্ত-মাংশের এই শরীরটা যে মেশিন বা যন্ত্র নয়, তা তাকে বুঝিয়ে দিতে হয় মাঝে মাঝে। তাই ছুটির দিনগুলোকে ব্যক্তিগত জীবনাচারে অনিয়মের কারখানা বানিয়ে সেটা দেখিয়ে দিতে কখনোই কার্পন্য করি নি আমি। হয়তো আগের দিন রাত তিনটে বা চারটে পর্যন্ত পড়াশোনা লেখালেখি করলাম, ঘুম থেকে ওঠলাম সাড়ে এগারোটা বাজিয়ে, সকালের নাস্তা সারলাম দুপুর সাড়ে বারোয় (যদি তা নসিবে থাকে) ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু এই অনিয়মের সুযোগও কি সব সময় জুটে? কখনো বা পূর্বনির্ধারিত প্রোগ্রামে আষ্ঠেপৃষ্টে জড়িয়ে থাকি, আবার কখনো কখনো অনির্ধারিত প্রোগ্রাম এসে হামলে পড়ে, সব গড়বড় করে দেয়।

দূর্গোৎসবের দশমীর সরকারি ছুটিটা রোববার হওয়ায় উইক-এণ্ডে তিনটে দিন হাতে পেয়ে একেবারে মুক্তকচ্ছ। বেশ রিলাক্স মুডে ছিলাম। ইতিপূর্বে কখনোই যা বাস্তবায়নের সুযোগ হয় নি, পরিকল্পনা নিলাম, এবার সত্যি সত্যি স্ত্রী সন্তানকে কাছে কোথাও পূঁজো দেখাতে নিয়ে যাবো। অতএব রিলাক্স মুড তো বটেই। আর আমার রিলাক্স মুড মানেই অনিয়মের আখড়াটাকে চলমান করে দেয়া। নির্ঘাৎ সাড়ে এগারোর আগে চোখের পাতা ফাঁক হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তীব্র রিং-টোনের ধাক্কায় একান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও আচ্ছন্ন হাত বাড়িয়ে মোবাইলটা টেনে ঘুম-জড়িত চোখে মনিটরে তাকাতেই সচকিত হয়ে ওঠলাম। নিভা-জ্বলা আলোয় কলার আইডি ভেসে ওঠছে, ইংরেজি হরফে- ‘যোনাল অফিস নোয়াখালী’। যোনাল ম্যানেজারের নম্বরটা এভাবেই সেভ করা ছিলো। ঘুমের রেশ কেটে গেছে ততক্ষণে। খুব গুরুত্বপূর্ণ না হলে এই অফ-ডে তে একজন যোনাল ম্যানেজার এরিয়া ম্যানেজারকে বাদ দিয়ে তাঁর অধীনস্থ কোন ব্রাঞ্চ ম্যানেজারকে এভাবে সরাসরি কল করার কথা নয়। ‘ও-কে’ বাটন চেপে কানে ধরতেই আমার সালাম সম্ভাষণের মাঝেই ওপাশ থেকে উদ্বিগ্ন কণ্ঠস্বর, বাবু, আপনি কোথায় ? ‘এই তো স্যার আমি বাসায়।’ আমার জবাবের অপেক্ষা না করেই সেই উদ্বিগ্নতা নিয়েই বললেন, আপনি এক্ষুনি রাজাপুর শাখায় যান; আপনার এরিয়া ম্যানেজারকে ফোনে পাচ্ছি না; গিয়েই আমাকে ফোন করতে বলবেন। আমি ‘জ্বী স্যার’ বললাম ঠিকই; মনে হলো তার আগেই ফোনটা কেটে গেছে।

আকস্মিক অস্বাভাবিক অভিঘাতে তাৎক্ষণিক সচেতন-বোধ ঠিক থাকে না। আমার অবস্থাও খানিকটা সে রকমই। কয়েক মুহূর্ত থিতু হয়ে ভাবতে লাগলাম। কিন্তু সবকিছুই হেঁয়ালির মতো মনে হলো। ছুটির দিনের এই সাত-সকালে এরিয়া ম্যানেজারকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না; আমাকে রাজাপুর শাখায় গিয়ে এরিয়া ম্যানেজারকে কল ব্যাক করার জন্য বলতে হবে ! একেবারে এলোমেলো অবস্থা। মাথায় ততক্ষণে যুক্তিবোধের বারোটা বেজে গেছে। যাক্ কী আর করা। নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে। যোনাল ম্যানেজারের নির্দেশ; অতএব বিছানা ছেড়ে টুথব্রাশ মুখে চেপে বাথরুমে ঢুকলাম।

আমার জন্যে এই অসময়ে নাস্তা রেডি থাকার কথা নয়। হয়তো মিনিট দশেক পেরিয়েছে। নাস্তার তাড়া দিয়ে গোসলে ঢুকবো, আবার ফোন বেজে ওঠলো- যোনাল ম্যানেজার নোয়াখালী। ‘বাবু, কোথায় ?’ ‘এইতো বেরুচ্ছি স্যার।’ ‘এখনো যান নি !’ ফোন কেটে গেলো। বুঝলাম, অবস্থা গুরুতর। কীসের নাস্তা, কীসের গোসল ! ঝটপট পোশাক পাল্টে মটর সাইকেলে স্টার্ট নিলাম। পেছন থেকে রূপা, অর্থাৎ আমার নিরূপায় স্ত্রী, কী সব তেল নুন সব্জী মাছের ফর্দ আওড়ে যাচ্ছে। কে শোনে কার কথা! একশ’ সিসি হোণ্ডার স্পীডোমিটার পারলে এক মোচড়ে হান্ড্রেড-টেন’এ উঠিয়ে দিই।

(০২)
রাজাপুর শাখাটি তখনো নোয়াখালী যোনের আওতায় দাগনভূঁইয়া এরিয়ার অন্যতম শাখা। আমার কর্মস্থল জায়লস্কর শাখার পার্শ্ববর্তী। সমস্যাবহুল শাখা হিসেবে একই এরিয়াধীন পার্শ্ববর্তী শাখাসমূহের ম্যানেজারদেরকে বিশেষ প্রোগ্রামে প্রায়ই যেতে হতো ওখানে বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে। তাই ওখানকার রাস্তাঘাট এলাকার পরিবেশ আমার অত্যন্ত পরিচিত এবং শাখার সহকর্মীদের সাথে অন্তরঙ্গতাও অনেকটা ঘনিষ্ঠ। নিজস্ব বিল্ডিং শাখা। অফিসের গেটে গিয়ে হোন্ডায় ব্রেক কষেই টের পেলাম পরিবেশটা কেমন যেন থমথমে, ভারাক্রান্ত। শাখার সহকর্মী যারা কর্মস্থলে রয়েছেন তাদের সাথে কুশল সম্ভাষণের মধ্যে খবরটা শুনেই একেবারে হতবিহ্বল হয়ে পড়লাম- কী ! কী বলছে এরা ! ইউছুফ সাহেব খুন হয়েছে ! এরকম খবরের জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত নই। লম্বাচূঁড়া শক্তসমর্থ কালো শরীরের হাসিখুশি মায়াবী তরুণ মুখের তুখোড় সহকর্মী সেই ইউছুফ, খুন হয়েছে ! কোথায়, কীভাবে, কেন ? এতো সব প্রশ্নের উত্তর শাখার জীবিত সহকর্মীরাও জানে না তখনো। শুধু এটুকুই বললো- গতকাল অর্থাৎ বৃহষ্পতিবার অফিস টাইম শেষে ইউছুফ পূর্বানুমতি নিয়ে কর্মস্থল ত্যাগ করেছেন বাড়ির উদ্দেশ্যে। বাড়ি তার চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জ থানার চর আলগি ইউনিয়নে। মেঘনার প্রত্যন্ত চর এলাকা। কিন্ত ভোর বেলা বিভিন্ন মাধ্যম হয়ে শাখায় খবর এলো- নরসিংদীর কাছে কোথায় যেন তার লাশ পাওয়া গেছে। একেবারে ভিন্ন দিগন্তে ! ‘এরিয়া স্যার কই ?’ উত্তরে সহকর্মীরা জানালেন, কর্মচারি সমিতির নেতা তৈয়ব সাহেবকে নিয়ে যোনাল অফিসে গেছেন। এরই মধ্যে আবার ফোন বেজে ওঠলো; এরিয়া ম্যানেজার দাগনভূঁইয়া- ‘এই বাবু, আপনি কোথায় ?’ অবস্থান জানালাম তাঁকে। ‘শাখায় চলে আসেন; দ্রুত রেডি হন, নরসিংদী যেতে হবে। দশ মিনিটের মধ্যে রওয়ানা দিচ্ছি আমরা।’ আবার রিটার্ন ব্যাক, আমার শাখার উদ্দেশ্যে; সিলোনীয়ায়। যেখানের আমার ব্র্যাঞ্চ অফিস, জায়লস্কর শাখা।

মাথায় অস্থিরতা। হোন্ডার হ্যান্ডেল রাস্তা ছেড়ে পাশের ঢালের দিকেই নজর টানছে বেশি। সতর্ক হতে চেষ্টা করলাম। বাসায় ফিরে ঘরে হোন্ডাটা ওঠাতে না ওঠাতেই আবার এরিয়া ম্যানেজারের ফোন- ‘বাবু, আমরা আপনার অফিসে; এক্ষুনি আসেন, সময় নাই।’ যুগপৎ অস্থিরতা আর বিভ্রান্তি। রূপা’র বাড়িয়ে দেয়া নাস্তার প্লেটটা কখন কীভাবে মুখে ঢুকিয়েছি বলতে পারবো না। হুড়মুড় করে বেরিয়ে পড়ছি। তাঁর অসহায় মুখের দিকে চেয়ে খুব কষ্ট হলো। শুধু বঞ্চিতই করে গেছি তাঁকে; কথা দিয়ে কোন কথাই রাখা হয় নি আমার। তাঁর নিজের প্রিপেইড মোবাইলটা আমার দিকে বাড়িয়ে বললো- এটা নাও, অফিসেরটা রেখে যাও। তখনও মাথায় কাজ করছিলো না যে, পল্লীফোনের রোমিং-বার অনুযায়ী নরসিংদীতে অফিসের এই ফোন আদৌ কার্যকর থাকবে না । গোটা দেশে গ্রামীণের পল্লীফোনের রোমিং সুবিধা নিশ্চিৎভাবেই এই ঘটনার সন অর্থাৎ ২০০৪ সালের পরেই চালু হয়েছে। আউলা মাথায় অফিসের ফোন নিয়ে বেরুলে মাঝপথে সম্পূণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে কী যে মহা ফাপড়ে পড়তে হতো, তা ভাবতেই শরীরের লোম খাড়া হয়ে ওঠলো ! লাইফ-পার্টনার হিসেবে আবারো কৃতজ্ঞ হলাম তাঁর প্রতি।

(০৩)
অফিসে ঢোকার আগেই এরিয়া ম্যানেজার বোরহান আলী বেগ এবং কর্মচারি সমিতির সভাপতি তৈয়ব উল্লাহ বেরিয়ে এলেন। তখন প্রায় এগারোটা। সিলোনীয়া বাজার থেকে একটা চলতি গাড়িতে উঠে গেলাম তিন জন। ঢাকার অদূরে কাচপুরে নেমে ফের নরসিংদীর গাড়িতে উঠতে হবে। দীর্ঘ ভ্রমন। এই ভ্রমনকালীন সময়ে যোগাযোগের জন্য যোনাল ম্যানেজারকে নতুন কনটাক্ট নাম্বারটা জানিয়ে রাখলাম ফোনে। একে তো রমজান মাস, পথের ভোগান্তি তো আছেই; শেষ বিকেলে নরসিংদীর শিবপুর শাখার ম্যানেজার সাহেবের কনটাক্ট মোতাবেক নরসিংদী হাসপাতালে পৌঁছলাম। এমনিতেই স্নান খাওয়া বিশ্রাম নেই, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ পুলিশ এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি ব্যবস্থাপনার কথা আর না-ই বা বললাম। ওদিকটা সামলেছেন শিবপুরের ম্যানেজার সাহেব, তাঁর ব্যক্তিগত পারদর্শিতা দিয়েই বলা যায় (এ মুহূর্তে তাঁর নামটা মনে নেই)। লাশবাহী পিক-আপ ভ্যান ভাড়া ও কফিন ক্রয় করে অন্যান্য ফর্মালিটিজ সেরে হাসপাতাল মর্গে গেলাম- লাশ বুঝে নিতে হবে।

সরকারি নথিপত্রে যদিও তখনো অজ্ঞাত-পরিচয়, তবু দেখেই চিনে ফেললাম- এইতো দুরন্ত আত্মবিশ্বাসী যুবক মোঃ ইউছুফ শুয়ে আছে! কিন্তু নির্জীব। পোস্টমর্টেম-উত্তর সেলাই করা মানুষের লাশ, তাও যদি হয় অতি পরিচিত কারো, তার দিকে অভাবিত চেয়ে থাকা, এ কী চাট্টিখানি কথা! মুহূর্তেই বুঝে গেলাম, এরকম দৃশ্য আমার জন্য নয়, এতে মোটেও অভ্যস্ত নই আমি। বেরিয়ে এলাম। চোখ থেকে এমন বীভৎস লাশের ছবি তাড়াতে পারছি না কিছুতেই। দূরে গিয়ে হাসপাতাল চত্বরেই ঘাঁসের উপর মাথা গুঁজে বসে রইলাম থ হয়ে। সাদা কাফনের কাপড়ে গোটা লাশটাকে ভালোভাবে মুড়িয়ে কশে বেঁধে কফিন বন্দী করে বরফ আর চাপাতার গুড়ো দিয়ে প্যাক করে ফেলা হলো। ধারেকাছে ঘেষার অবস্থাও নেই আমার। এ দৃশ্য দেখার মতো মানসিক অপ্রস্তুত আমি, তবু দূর থেকে বারে বারে চোখ তুলে দেখছিলামও তা। এদিকে ইফতারের টাইম আসন্ন। সেই সকালের পর থেকে এক ফোঁটা পানিও মুখে পড়ে নি। সে সুযোগ, রুচি বা অবস্থাও ছিলো না। তবু লাশবাহী গাড়ির স্টার্ট নেয়া হলো। কীভাবে কত দ্রুত এ লাশ যথাযথ হস্তে গছিয়ে দেয়া যায় কেবল সে চিন্তাই মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকলো। তারপর পরবর্তী বারোটি ঘণ্টা, খাওয়া নেই ঘুম নেই বিশ্রাম নেই, এক অবিচ্ছিন্ন ঘোরের মধ্যেই কাটতে লাগলো। কাদের সাথে যেন ইফতারিতে কিঞ্চিৎ ভাগ বসিয়েছিলাম, এতটুকুই।

(০৪)
ড্রাইভারের পাশে এরিয়া ম্যানেজারকে বসিয়ে কফিন-বদ্ধ লাশ ঘিরে খোলা পিক-আপ ভ্যানে আমরা দু’জন। সন্ধ্যার বাতাস কেটে শা শা ছুটছে গাড়ি। বাতাসের কানতালি শব্দের সাথে ঠাণ্ডাও টের পাচ্ছি বেশ। কুয়াশার আর্দ্রতা আর ধূলো-বালিতে শরীরের অনাবৃত অংশে চামড়ায় একটা আঠালো ভাব চেটচেটে হয়ে ওঠছে। চারপাশের গুঞ্জন কোলাহল ইত্যাদির মধ্যেও কেমন একটা গভীর নির্জনতার উপলব্ধি সব কিছুকে ছাপিয়ে ওঠছে। এরকম পরিস্থিতিতে মানুষের ভাবনাগুলো বোধ হয় মৃত্যুচিন্তার গভীর উপলব্ধিতে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। আহা মৃত্যু, এর কাছে কত অসহায় মানুষ! কোথাকার কোন্ মানুষ কোথায় যে পড়ে থাকে!

কাঁচপুরে এসে ব্রেক কষলো গাড়ি। মোবাইল কনটাক্টের মাধ্যমেই এখানে এসে ইউছুফের ক’জন আত্মীয় এবং তাঁর বাড়ির পার্শ্ববর্তী গোবিন্দপুর শাখার ম্যানেজার সাহেব আমাদের সঙ্গী হলেন। খবর পেয়ে বাড়ি থেকে রওনা দিয়ে পথেই সন্ধ্যা পেরিয়ে গেছে। এরাই মূলত পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবেন আমাদের। সবার চোখে মুখেই এক বিপণ্নতা, বিষাদের ছায়া। আবার ছাড়লো গাড়ি। সওয়ারি আমরা ক’জন জীবিত মানুষ আর একজন মৃতের অসময়ে ফেলে যাওয়া প্রিয়তম শরীরটা। গাড়ি ছুটছে। অপেক্ষায় আছে ইউছুফের প্রিয়জনেরা। একদিন আগেও যাকে ঘিরে এদের কত চাওয়া পাওয়া মান অভিমান স্বপ্ন কষ্ট, এখন এ সবই বাহুল্য; এক চিরায়ত অতীতের গর্ভে। সব ঠিকঠাক থাকলে কুমিল্লার কচুয়ার পেট কেটে আড়াআড়ি ছুটে চাঁদপুরে ইছলি ফেরী পেরিয়ে মধ্যরাতের ভ্রমন শেষ হবে চর আলগির কোন এক নিঝুম গ্রামে। রাত দু’টোয় তাঁকে শেষবারের মতো শুইয়ে দেয়া হবে মাটির প্রিয় গভীর কোলে।

আজ যে ইউছুফকে নিয়ে গাড়িটা ছুটে যাচ্ছে তাঁর বাড়ির দিকে, গতকালও ঠিক এ সময়ে সে গাড়িতেই ছিলো। অন্য কোন গাড়িতে। অন্য কোন লক্ষ্যে। কী ছিলো লক্ষ্যটা তাঁর? আমরা কেউ কি জানি? না কেউ জানতো? হয়তো ইউছুফও জানতো না তাঁর গন্তব্য। ফেনীর মহিপালে ইফতার শেষে যে গাড়িটাতে চড়েছিলো, সেটাই নরসিংদীর শিবপুরের কাছাকাছি এসে ডাকাতের কবলে পড়ে। এ গাড়ি তো তার বাড়ি যাবার সঠিক গন্তব্যের গাড়ি ছিলো না ! এটাতে কেন উঠলো সে ! কোথায় যাচ্ছিলো ? কর্তব্যরত পেট্রোল পুলিশ রাস্তার পাশে পড়ে থাকা যে অজ্ঞাত পরিচয় লাশটি উদ্ধার করে থানায় নিয়ে যায়, দেখতে নাকি অনেকটাই ইউছুফের মতো। লাশবাহী রিক্সাভ্যান চালক, দৈবক্রমে যিনি ইউছুফকে চিনতেন, থানায় লাশ নামিয়ে রেখে তৎক্ষণাৎ ছুটে গেছেন শিবপুর শাখায়, তাঁর বাড়ি ওখানেই। তিন চার মাস আগেও ইউছুফ এ শাখায় কর্মরত ছিলো। চিৎকার চেচামেচিতে শাখার ম্যানেজার সাহেব বেরিয়ে এসে বিস্তারিত শুনেই তড়িঘড়ি থানার দিকে ছুটলেন প্রাক্তন সহকর্মীকে সনাক্ত করার জন্যে, সত্যিই ইউছুফ কি না। অতঃপর নিশ্চিৎ হওয়ার জন্য তিনিই যোগাযোগ করলেন নোয়াখালীতে। আর তাঁরই তৎপরতায় সেই অজ্ঞাত পরিচয় লাশের পরিচিতি পুনঃস্থাপন হতে হতে ছুটে চলছে প্রিয় জন্মভিটার পাশে, হয়তোবা আবাল্যের প্রিয় গাছটার নীচে।

(০৫)
পদ্মা আর মেঘনার চাঁদপুর সঙ্গম পেরিয়ে মধ্যরাতের অন্ধকার ছিঁড়ে ফেঁড়ে গাড়িটা তীব্রবেগে ছুটছে নির্ধারিত গন্তব্যের দিকে। তারই মধ্যে অন্ধকারে একটা মৃতদেহের গভীর নীরবতা ঘিরে জনা কয়েক আপাত জীবিত মানুষ অনিশ্চিৎ চেয়ে আছে নিজ নিজ কাল্পনিক দূরত্বের দিকে- অনিবার্য গন্তব্যে...
(২৯/০৯/২০০৮)

[sachalayatan]

Saturday, September 27, 2008

@ পা বাড়ালেই অথৈ পানি...(সচল পেন্সিলে আঁকা-০৬)




পা বাড়ালেই অথৈ পানি...(সচল পেন্সিলে আঁকা-০৬)
-রণদীপম বসু


(০১)
মুঠোয় ধরে না, এত্তো মোটা দড়ি বড়সড় লঞ্চ বা জাহাজের নোঙড় ছাড়া আর কোথাও কি ব্যবহার হয় ? দড়ির মাথাটাকে ঘুরিয়ে বিশেষভাবে আটকে তৈরি করা লুপ বা ফাঁসটাকে ছুঁড়ে দিলো পণ্টুনের এঙ্করটার দিকে। লক্ষ্যভ্রষ্ট শট। তীব্রস্রোতের পেছনটানে সরে আসা লঞ্চের সাথে দড়ির মাথাটাও পণ্টুন ছেড়ে ঝপ করে পানিতে পড়লো।
‘হোগার নিশানা করছস ? হালারপুতরে বউয়ে লাইচ্ছায় না ক্যা !’
খালাসির উদ্দেশ্যে ছোট্ট সাদা টুপি দিয়ে মাথার শীর্ষদেশঢাকা প্রৌঢ় সারেং এর উক্তিতে আদিরসের স্পষ্ট ইঙ্গিত। বুঝতে কারো বাকি থাকে না। লঞ্চের ডেকের সামনে এসে ভীড় করা যাত্রীদের কেউ একজন পাল্টা সরস মন্তব্য ছাড়লো, নিশানা উল্টা হইয়া গেছে যে !
সারেং এর কালো কালো দাঁত বের করা হাস্যোজ্জ্বল মুখে নদীর জলজ বাতাসে লম্বা সাদা দাড়িগুলো ফড়ফড় করে উড়ছে। ততক্ষণে পণ্টুন থেকে দশ পনেরো হাত দূরে ফসকে এসেছে লঞ্চটা। সারেং তার ডান হাত উপরে তুলে কী যেন বিশেষ ইঙ্গিত করলেন। চালকের কেবিনে গাড়ির স্টিয়ারিং এর মতো বিরাট হাতলওয়ালা হুইল ধরে দাঁড়িয়ে থাকা সহকারী পাশের ঝুলে থাকা সুতোটা ধরে টান দিলো বার কয়েক। ঠং ঠং করে কর্কশ চাপা ঘণ্টা বেজে ওঠলো। সদম্ভে গর্জে ওঠলো লঞ্চের ইঞ্জিন, কেঁপে ওঠলো লঞ্চ। একটু একটু করে আবার এগুতে লাগলো পণ্টুনের দিকে।

বিষখালী নদীর যে শাখাটা পিরোজপুরের দিকে চলে গেছে, আধাকিলোতক গিয়ে পরপর দুটো ডানেবামে মোড়। নদীর স্বভাব অনুযায়ী ওখানকার প্রশস্ততা মূল স্রোতস্বী থেকে অনেক বেশি। বর্ষার ভরযৌবনে বাড়ি খাওয়া স্রোতের উল্টাসিধা চক্করে এসে লঞ্চগুলোকে এই আমুয়া বন্দরের ঘাটে অনুকূল স্রোত ছেড়ে প্রতিকূলমুখী করেই পণ্টুনে ভেড়াতে হয়। ঢাকা থেকে বরিশাল, তারপর পটুয়াখালী বরগুনা হয়ে গোটা একদিনের বিরতিহীন নৌভ্রমন শেষে ডাঙাতে পা রাখতেই, কী আশ্চর্য, স্থলভাগটা দুলতে লাগলো ভীষণ ! দাঁড়াতেই পারছি না যেন। লঞ্চে ভাসমান থেকেও যে দুলুনিটা এক সময় আর টের পাওয়া যায় নি, সয়ে গেছে, ডাঙায় এসে এ কী হাল ! কাঁধে ঝোলানো বড় ব্যাগভর্তি বই আর প্রয়োজনীয় কাপড় চোপড়ের বোঝা বাঁ কাঁধটাকে ধ্বসিয়ে দিতে উদ্যত। আর ডান হাতে ধরে রাখা বেডিংটা যেন হাতটাকে ছিঁড়ে নেবে। তার উপরে অস্বস্তিকর দুলুনি। টাল সামলাতে না পেরে বেডিং এর উপরেই ধপ করে বসে পড়লাম।

মধ্য এপ্রিল উনিশশো’ একানব্বই। পেটের দায়ে কখনো দক্ষিণাঞ্চলের এই উপকূলীয় এলাকায় এভাবে আসতে হবে, তা কি ভেবেছিলাম ? বদলিপ্রাপ্ত নতুন এই পানিবেষ্টিত কর্মস্থল, তারুণ্যের তরতাজা চোখে পর্যবেক্ষণ করছি। ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে। আগে খেতে হবে কিছু। মান যাই হোক, বাংলাদেশের যে কোন লঞ্চঘাটেই খাবারের দোকান থাকবেই। ঝুপড়ি দোকান একটাতে ঢুকে গেলাম। মাটির সেঁতসেতে মেঝে। দু তিনটা কাঠের পলকা চেয়ার টেবিল। মন্দের ভালো একটাতে বসে পড়লাম।

টিনের প্লেটে ভাতের চেহারা দেখে সরু চালে অভ্যস্ত চোখ কপালে উঠে গেছে। মোটা চাল যে দেখিনি বা খাই না তা নয়। কিন্তু ভাত যে এতো মোটা আর প্লাস্টিক স্বভাবের হতে পারে, এ প্রথম জানলাম। শুনতে কৌতুকের মতো লাগবে, কৌতূহল বশতঃ হাত উপরে তুলে পাশের চেয়ারটাতে একটা ভাত ছেড়ে দিলাম। ঠপ করে পড়েই পিংপং বলের মতো আবার লাফ দিলো হাত খানেক উপরে। ডালের সাথে এক বাটি সব্জি আর অন্য একটা থালায় দুপাশে মাথা ও লেজ ঝুলে পড়া বিরাট সাইজের যে সামুদ্রিক মাছটা দিলো, তার নাম জানি না। আমাদের নাগরিক হোটেলের প্রচলিত পিরিচ-মাপা ভাতের সিস্টেম এখানে অচল। পেট মাপা। পরিমাণ যাই হোক, রেট একটাই। আমি অবশ্য কোন রেট টেট কিছুই জানি না। কোন বাতচিতেও নেই। আগে খেয়ে নিই, তার পরে বোঝা যাবে কী অবস্থা। এরই মধ্যে আরেক থালা ভাত চলে এলো। প্রথম দফার অর্ধেকও সামলাতে পারছি না, ভাত চিবাতে চিবাতে গালে চাপায় ব্যথা ধরে গেছে ! খট করে এক কাপ দুধ রাখা হলো টেবিলে, সাথে বেশ মোটা অচেনা জাতের সবুজ কলা একটা। আরে কী ভয়ঙ্কর ! এই ভাতের সাথে দুধ মিশিয়ে কী হবে ! আর কাঁচা কলাই বা মাখবো কী করে ! ভুল ভাঙলো পরে। কলা কাঁচা নয়, পাকাই ; ধরনটাই এ রকম। যাক্ , ভাত খাওয়াও যে রীতিমতো একটা যুদ্ধ হতে পারে, ঝালকাঠি জেলার কাঠালিয়া থানার অন্যতম ইউনিয়ন ও প্রসিদ্ধ ব্যবসা কেন্দ্র আমুয়া বন্দরে পা দিয়ে পুনঃ অভিজ্ঞতা হলো আমার।

জলবায়ু ভূপ্রকৃতি আর জোয়ার ভাটার এ অঞ্চলে বৈরি প্রকৃতির সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করে টিকে থাকা মানুষগুলোর জীবনাচারেও বুঝি এই যুদ্ধস্বভাব মিশে গেছে। অসম্ভব কায়িক পরিশ্রমী এদের পেটের মধ্যে পাথর তো আর দেয়া যাবে না। পাথরের মতো শক্ত মোটা ভাত না হলে চলবে কী করে ? পেটে তো থাকতে হবে কিছুক্ষণ। পানি মুখে দিতেই চোখ মুখ খিচরে এলো আমার। কী ব্যাপার, পানিতে লবণ দিয়েছেন কেন ? নবাগত আমার কথায় একটুও আশ্চর্য না হয়ে দোকানদার বললো, এখানকার পানি এরকমই স্যার, লোনা। আপনি নতুন তো, তাই প্রথম প্রথম এরকম লাগবে। পরে ঠিক হয়ে যাবে।

খাওয়ার বিল শুনে ফের চমকে ওঠলাম ! বলে কী ! আবার হিসাব করেন। দোকানদার অত্যন্ত বিনয় সহকারে বললো, না স্যার, একটুও বেশি ধরি নি। আমি শুধরে দিয়ে বললাম, বিল বাদ পড়েছে কিনা দেখেন ? আত্মবিশ্বাসের কোন অভাব নাই তার চোখে, জ্বী না স্যার, বিল আঠারো টাকাই !

(০২)
রাস্তা আর সাঁকো এক নয়। আমুয়া বাজারের পেটের দিকে ঢুকতে গেলে সিমেণ্টের পাকা বা ইট বিছানো রাস্তাই এর সাক্ষ্য দেয়। প্রশস্ততাও দু থেকে আড়াই হাতের বেশি হবে না। রিক্সার দুটো চাকা পাশাপাশি ধরবে না। কোন যানবাহনের প্রশ্ন তো আসেই না, রিক্সা বা সাইকেলও চোখে পড়েনি একটিও। জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অজস্র খাল নালায় ভরপুর এ অঞ্চলে আসলে এসবের চল গড়ে ওঠেনি ভূপ্রাকৃতিক অবস্থানের কারণে। যে কোন দিকে এক কিলো যেতে যেখানে সাঁকো পড়বে কমপক্ষে কুড়িটি, সেখানে আগেভাগে এমন অগ্রসর চিন্তা করাও নির্বুদ্ধিতা বৈ কি। নদীর যে পাড়ে বাজার, আমার অফিস তার অপর পাড়ে। ঘাটে খেয়াপাড়ানী পঁচিশ পয়সা দিয়ে খেয়া নৌকায় চড়ে মাঝির সামনের ছোট পাটাতনে ফেলে রাখা দশ পয়সা পাঁচ পয়সার কয়েনগুলো দেখে বিস্ময় নিয়ে চেয়ে রইলাম কতোক্ষণ। এখনো এর চল রয়েছে ! এক খিলি পানের দাম পঞ্চাশ পয়সা তখন এবং আমাদের বাজার ব্যবস্থায় ওটাকেই লেনদেনের সর্বকনিষ্ঠ মুদ্রা হিসেবে ধরে নেয়া হয়। গোলাকার ঢেউ খেলানো দশ পয়সা ও চৌকোণো পাঁচ পয়সার মুদ্রাগুলোতে খেয়ার তালে তালে আমার কৈশোরও দুলে ওঠছে যেন।

(০৩)
পাকা ভিটা নির্মাণের সময়েই প্রয়োজনীয় পয়েণ্টগুলোতে পিলার আটকানোর উপযোগী করে কতকগুলো লোহার এঙ্গেল আগে থেকেই স্থাপন করে রাখা হয়। পরে শুধু মোটা মোটা নাটবল্টু দিয়ে কাঠের পিলারগুলোকে আটকে ঘরের ফ্রেম তৈরি করে টিনের ছাউনী লাগিয়ে অথবা পিলার গুলো বসিয়ে ঘরের বাকি দেয়াল বা আড়ালগুলো আলাদা তৈরি করে পার্ট পার্ট এনে বসিয়ে দিয়ে বাড়িঘর বানানোর যে প্রক্রিয়া, এরই আধিক্য এখানে। জামাকাপড়ের মতোই, যদিও দেখিনি এমনটা, নানা রঙের নানা ঢঙের বৈচিত্র্যময় দেয়াল লাগানো আর সরিয়ে ফেলার কী চমৎকার ব্যবস্থা ! আর্থিক সঙ্গতির বিষয় বিবেচনায় নিলে এতোটা বিলাস ব্যসনের সুযোগ কি এখানকার মানুষদের আছে ? ঢাকার মুন্সিগঞ্জ এলাকায়ও এরকমের বাড়িঘর বানানোর প্রবণতা ল্ক্ষ্য করেছি। তবে মুন্সিগঞ্জের সাথে এখানকার ঘরের প্যাটার্ণে বিশেষ পার্থক্য রয়েছে। প্রথমত ওখানে টিনের দোতলা ঘর চোখে পড়েনি। দ্বিতীয়ত এখানকার ঘরগুলোতে টিনের ছাউনীর সামনের ঢালের দৈর্ঘ্য নরমাল হলেও পেছনের দিকে নামতে নামতে এতোটাই নীচে নেমে আসে যে মাথাটাকে শরীরসমেত নব্বই ডিগ্রী না নুইয়ে পেছন দরজা দিয়ে বেরুনোর উপায় থাকে না। উপকূলীয় এলাকার প্রতিকূল বাতাসের তীব্র ধাক্কা কাটানোর অন্যতম উপায় হয়তো। পাকা বাড়ি থাকলেও পরিমাণে নগন্য।

এরকমই টিনের দোতলা একটি বাড়ি আপাতত আমার ঠিকানা। নীচতলায় অফিস, উপরতলায় থাকার ব্যবস্থা। কাঠের সরু সিঁড়ি মাড়িয়ে দোতলা মানেই কাঠের পাটাতনের উপর তিন দিক বন্ধ এক দিক খোলা আধো অন্ধকার প্রকোষ্ঠ। যদিও দুপাশে দুটো ছোট্ট গরাদ বা জানালা রয়েছে, তার কার্যকারিতা যে কী, তা অবগত হওয়ার বিশেষ কোন সুযোগ খুব একটা পাওয়া হয়নি। ব্যাচেলর বা ম্যারেড ব্যাচেলরদের থাকার সুব্যবস্থা হিসেবে আমিও দোতলার এই প্রকোষ্ঠে ঠাঁই নিলাম। পোক্ত দেখে সস্তায় একটা ওয়ান টাইম খাট কিনে বিছিয়ে দেয়া হলো গণবোর্ডিং স্টাইলে। এই খাটই আবাস, খাটই সংসার আমার।

সম্পূর্ণ হাওয়াই মাধ্যম দিয়ে বিদ্যুৎ বয়ে নিয়ে আসার কোন বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি আবিষ্কৃত না হওয়ায় চারদিকের পানি সাঁতরে এলাকায় বিদ্যুতের শুভ পদার্পণ তখনো দুর্মর আকাঙ্ক্ষার পর্যায়েই রয়ে গেছে। ফলে এখানে রাত মানে হ্যারিকেনের টিমটিমে কেরোসিন আলোয় সন্ধ্যায় মধ্যরাত্রি নেমে আসা, আর দ্বিপ্রহরে রোদের খরতাপে চুল্লির মতো ফুটতে থাকা চারদিকে টিনবেষ্টিত এই দ্বিতল প্রকোষ্ঠকে দোজখের ওম বললে একটুও অত্যুক্তি হবে না। কটকটে দুপুরে মানুষ যখন ঘরের শীতল ছায়ায় শরীরটাকে বিছানায় গড়িয়ে দিয়ে দিনের দ্বিতীয়ভাগের জন্য ঝনঝনে প্রস্তুত করে তোলে, আমরা তখন ঘরপালানো এতিম নাবাল কয়েকজন পাশের সরকারি গোডাউনের দেয়ালের ছায়ায় শরীর এলিয়ে দিয়ে মধ্যদুপুরে জীবন ও জগত নিয়ে দার্শনিক আলাপে মত্ত হয়ে ওঠি। আর অভাগা দেশটার জন্য আফসোস করতে থাকি, আহা, এই বিরল প্রতিভাগুলোর ভয়ঙ্কর সব গুণাবলীর কী দুঃখজনক অপচয় ! গরীব দেশ, এ ক্ষতি পোষাবে কী দিয়ে !

(০৪)
মেসের লঙ্গর ব্যবস্থা। কাজের বুয়া, ওখানকার আঞ্চলিক ভাষায় মাতারি, মাথা গুনে তরকারি বাটি করে রেখে যায়। নতুন এলাকার সবকিছুই নতুন আমার কাছে। খাবার উপকরণ, রান্নার ভিন্নতা, স্টাইল, স্বাদ সবই। খুব আয়েশ করে শাকভাত চিবুচ্ছি। লোকমার ভেতরে আর কী কী আছে তা কি আর খুটে খুটে দেখা হয়। সবকিছুতেই কমন আইটেম নারিকেলের ব্যবহার আমার কাছে অত্যন্ত উপাদেয়। নতুন যে উপকরণটা চিবুচ্ছি, প্লাস্টিকের মতো, কিছুতেই দাঁতের ফাঁকে ভাতের সাথে মিশছে না। পাশের সহকর্মী দেখছি নিরুপদ্রবে অত্যন্ত স্বাভাবিক ভঙ্গিতে খাচ্ছে। কৌতূহলী হয়ে মুখ থেকে খাদ্যবস্তুটা হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে পরখ করছি কী এটা। কালো ইঞ্চি দেড়েক লম্বা। এটা কী ? সহকর্মীর নির্বিকার উক্তি, জোঁক, ফেলে দেন। আমি হা করে তার মুখের দিকে চেয়ে রইলাম।

আল্লা মালুম, আরো কতো কী যে ভাতের সাথে গলে গলে পেট ও শরীরের পুষ্টি বাড়িয়েছে জানি না। এই বিশেষ প্রাণীটির গঠন বৈশিষ্ট্যও কেন যে গলন্ত স্বভাব পেলো না ! তাহলে কি আর এই দুর্বিপাকে পড়তে হতো ! চাইলেই তো আর খাবার খানা ছেড়ে দেয়া যায় না। লেখাপড়ার ক্ষেত্রে এমনিতেই সর্বভুক প্রজাতির মানুষ আমি। এবার নিজেকে অনুপ্রাণিত করলাম এই ভেবে যে, যাক্ মন্দ কী, খাওয়াদাওয়ায়ও সর্বগ্রাসী চর্চার বিরল একটা সুযোগ পাওয়া গেলো ! তবে জোঁকের উৎপাত যে কেবল ভাতের প্লেট বা তরকারির কড়াইতেই সীমাবদ্ধ, তা নয়। এটা এ এলাকার সর্বত্র বিরাজিত অন্যতম প্রাণী। বাইরে এক পাক ঘুরে আসবেন আর জোঁকের আদরের ছোঁয়া পাবেন না, এটা কী করে হয় ! হ্যারিকেনের মৃদু আলোয় হুমায়ুন আজাদের ‘নারী’ ফার্স্ট এডিশনটা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছি। হঠাৎ দেখি মেরি ওল্ডস্টোনক্রাফ্ট না কি ভার্র্জিনিয়া উলফ-এর ছবিটার কপালের উপরের ভাগটা লম্বা হযে দুলে দুলে আমাকে টা টা জানাচ্ছে ! বিষয় কী ? দৃষ্টি তীক্ষ্ণ করে দেখি জোঁক। এক মাথা ছবির কপাল কামড়ে অন্য মাথায় বিজয় নিশান উড়াচ্ছে। পায়ের আঙ্গুলের ফাঁকে ভীষণ চুলকাচ্ছে। চুলকাতে গিয়ে হাতের আঙুল একটা রবারের ফাঁসের সাথে আটকে গেছে। চমকে পা টেনে মাথা কাছে নিয়ে দেখি দুদিক থেকে সজোরে কামড়ে আটকে আছে গা সিনসিন করে ওঠা জোঁকটা।

(০৫)
সহকর্মীকে সাথে নিয়ে অফিসের কাজে ফিল্ডে যাচ্ছি। ভরসা একমাত্র সচল মাধ্যম জন্মগত উত্তরাধিকার পা দুটো। সকালের মিষ্টি আলোয় দুজন হাঁটছি। প্রকৃতির কী বিচিত্র সৌন্দর্য ! এমন অকৃপণ আশির্বাদ আর কোন দেশে আছে কি ? প্রকৃতির স্নেহ-আঁচলের তলায় না এলে তা কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না। মাটির পায়ে-চলা পথ, একটা থেকে আরেকটা সৃষ্টি হয়ে অন্যদিকে চলে গেছে, কোথাও আবার আরেকটার সাথে মিশে নতুন নিশানা তৈরি করে বেঁকে গেছে আরেক দিকে। ঘন বিস্তৃত বাঁশঝাড়ের তলা দিয়ে এঁকেবেঁকে এগিয়ে বাঁশের সাঁকো পেরিয়ে ঢুকে গেছে নাম না জানা কতো গাছগাছালির সবুজের ভেতর। প্রকৃতির অকৃত্রিম সন্তান হরেক প্রজাতির পাখ-পাখালের কিচিরমিচির কলকাকলি মেখে মেখে খালের পাড়ে পাড়ে হাঁটছি। কিছুদূর গিয়ে বড় তালগাছের গুঁড়ি খালের এপাড় ওপাড় যুক্ত করে রেখেছে। ওপাশে বিস্তৃত ফসলি জমি। ধান পাট শাক সব্জি কত কী ! জমির আলে আলে হাঁটাপথ। ঝিরঝিরে বাতাস শুধু কি শরীর বুলিয়ে যাচ্ছে ? মনটাকেও শীতল ছোঁয়ায় ভরিয়ে দিচ্ছে। কোথাও পথ নেমে গেছে। আলুথালু ভাঙা। আবার বাড়িঘরের পাশ দিয়ে লাউয়ের মাচা , পুঁইএর মাচা, মরিচ খেতে ছিটিয়ে থাকা লাল লাল আগুনের ফুলকি পেরিয়ে সারি সারি তাল নারিকেলের গাছ ফেলে এগুতে থাকি। এতো ভালো লাগায় আচ্ছন্ন যে, মরে যেতে ইচ্ছে করে ! কাছে দূরে কোথাও থেকে কুলকুল জলপতনের শব্দটা ধীরে ধীরে বাড়ছে। সহকর্মী বুঝালো, জোয়ার শুরু হয়েছে তাই পানি বাড়ছে। শুকনো খাল নালাগুলোতে এরই শব্দ। পূর্ণ জোয়ারের আগেই ফিরতে হবে। নইলে সমস্যা। প্রশস্ত বিশখালী নদীটির দিকে তাকিয়ে আনমনা হয়ে গেলাম। চারদিকের এতো ঘন সবুজের বুক কেটে কেটে এতো চওড়া তীব্রস্রোতা নদী দেশের পূর্বাঞ্চল বা উত্তরাঞ্চলে কি আছে কোথাও ! নদীটির দিকে চেয়ে থাকতেই ইচ্ছে করে। বুকের ভেতরে কোথায় যেন আরেকটা উন্মনা নদীর কুলকুল আওয়াজ পাচ্ছি। ওটাতেও কি পাড় ভাঙে ? প্রিয়তম মুখটা কি ওই পাড়ে বসে আছে ? এই জীবন না কি কোনো মানুষীর জন্য বুকটা হু হু করতে লাগলো !

মানুষ ছাড়া অন্য কোন প্রাণীর বুক কি এমন হু হু করে ? হয়তো করে, হয়তো করে না। প্রকৃতির বিচিত্র অভিঘাতে উঠে আসা চাপা কষ্টটা বুকে নিয়ে পথ হাঁটছি। ধানী জমির পাশে একটা লম্বা দণ্ডের মাথায় আধহাতের চেয়ে বড় ব্যাসের রিং-এ নেটের ঝোলা আটকানো বিশেষ ধরনের সরল একটা যন্ত্র। দেখতে বড়সড় হাতার মতো। এটি হাতে নিয়ে বিপর্যস্ত দৃষ্টিতে বসে থাকা লোকটিকে দেখে মায়া হলো। ওগুলো কী ! ধান গাছগুলো পুষ্ট হয়ে উঠেছে সবে। তখনো থোড় আসে নি। কিন্তু গাঢ় সবুজ পাতাগুলোর মাঝে মাঝে অনেকগুলো কালো কালো স্পট ও ক্ষতচিহ্ণ দেখা যাচ্ছে। অনভ্যস্ত চোখে অন্তত এটুকু বুঝতে পারছি যে কোথাও একটা সমস্যা। আমার সহকর্মী বললো, পোকা, পামরি পোকা। দাঁড়িয়ে গেলাম।

শহুরে জীব হিসেবে বড় হতে হতে পিতৃসূত্রে কোথায় কতটুকু সামান্য জমিজমা রয়েছে তাও জানি না। জীবনে কখনো নিজেদের জমির আলেও হাঁটি নি। তাই পোকার উপদ্রব শুনে থাকলেও ভালো করে দেখার সুযোগ হয় নি কখনো। সহকর্মীটি বলে যাচ্ছে, এখানকার মাটিতে একে তো লবণাক্ততা, তার উপরে এক ফসলি জমিগুলোতে আমন ফসল উঠে যাবার পর জমি ফেলে না রেখে খামার করে দু’বছর যাবৎ ইরি চাষের প্রক্রিয়া চলছে। দেখা গেছে, পোকার আক্রমণ অন্য যে কোনো অঞ্চলের চেয়ে এখানে অনেক বেশি। ফলে কীটনাশকের অতিব্যবহারের কারণে ন্যাচারাল ইকো সিস্টেমে ইতোমধ্যে যে বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে সে আলোকে এবার কীটনাশক ব্যবহার নগন্য পর্যায়ে নিয়ে আসা হয়েছে। কিন্তু পরিবেশের ক্ষতিকারক নয় এমন পদ্ধতি আইপিএম বা সমন্বিত বালাই দমন কর্মসূচি এই তীব্রতায় আদৌ কি তা রুখতে পারবে ?

তার কথায় আমি যে কী ভাবলাম, আর আমার ভাবনাকে আমার সহকর্মীটিই বা কী বুঝলো সেই জানে। হঠাৎ করে পা থেকে স্যাণ্ডেল খুলে প্যাণ্ট ভাঁজ করে গুটিয়ে হাঁটুতক উঠিয়ে সোজা ওই জমির কাদায় নেমে গেলো। আকস্মিক এ ঘটনায় আমি বিব্রত ! এক জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে সে তার ছাতাটাকে মেলে চিৎ করে ধরলো। নাগালের মধ্যে ধানগাছের যে ক’টা গোছা পড়লো ওগুলোর গায়ে খোলা ছাতার কিনার দিয়ে বাড়ি মেরে ঘষটে ঘষটে কী যেন করলো। এবং কয়েক মুহূর্ত পরেই উঠে এলো। যে মুহূর্তে আমি তার মাথার সুস্থতা নিয়ে অতিশয় চিন্তিত হয়ে উঠছি, ঠিক তখনই সে কড়াইয়ের মতো চিৎ করা ছাতার ভেতরের দিকে ইঙ্গিতে কিছু দেখাতে চাইলো। মটরদানার সাইজের কালো রঙের শত শত অজস্র পোকা কিলবিল করছে। এগুলোই পামরি পোকা ? ধানের ভয়ঙ্কর বালাই ! মাত্র কয়েকটা গোছা থেকে এতগুলো পোকার দঙ্গল একসাথে স্তুপিকৃত অবস্থায় দেখে আমি হতবাক।

(০৬)
মূলত পরিবহন সুবিধাকে কেন্দ্র করেই স্থানীয় ব্যবসা বাণিজ্য নিয়ন্ত্রিত হয় বলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বাজার হাট জমে ওঠার তরিকাও ভিন্ন ভিন্ন। কোথাও দিনব্যাপি, কোথাও খুব ভোরে হাট বসে রোদ তেতে ওঠার আগেই হাট ভেঙে যায়। কোথাও বা বিকেলে বসে সন্ধ্যায় শেষ। কোথাও আবার সন্ধ্যার পর হাট শুরু হয়ে তা গভীর রাত অব্দি সরগরম থাকে। আর এখানকার বাজার হাটগুলো জোয়ারের সময় জমে ওঠে এবং ভাটার টানে ভেঙে যায়। নদীর দ্বিমুখী স্রোতের কারিশমায় জোয়ারের ভরা স্রোতে যে সব বোঝাই নৌকা হাটে এসে মালামাল উগরে দিয়ে বসে থাকে, বেচাবিক্রির পর ওগুলোই আবার অবশিষ্ট মালামাল নিয়ে ভাটার নেমে যাওয়া ওল্টোস্রোতে ফিরে যায়। এই জোয়ারভাটা নিয়ন্ত্রিত জীবন ও জীবীকা স্থানীয় অধিবাসীদের জন্য অত্যন্ত স্বাভাবিক হলেও বহিরাগত আমার অনভ্যস্ততার জন্যই তা বিব্রতকর বৈ কি।

কাজ সেরে ফেরার পথে মনে হলো পথটা কি বদলে গেছে ? পথ বদলায়নি, তবে রাস্তা বদল করা হয়েছে। যে কোণাকোণি পথ ধরে এসেছিলাম, জোয়ারের কারণে সে পথে ফিরে যাওয়ার উপায় নেই আর। আমার চে’ও সহকর্মীর তাড়া বেশি দেখছি। দুকদম গিয়েই একটা করে সাঁকো। কখনো বাঁশের, কখনো সুপারির, কখনো খেজুরের, কখনো তালের গুঁড়ি। কোনটাতে পথিকের সুবিধার্থে রেলিংয়ের মতো করে ধরার ব্যবস্থা, কোথাও নিরম্বু, দুলতে দুলতে টলতে টলতে কোনোভাবে পেরুনো গেলো এরকম। এবং যে শুকনো কটকটে রাস্তার ভাঙাটা হেঁটেই পার হয়েছি আগে, ওখানে এখন পানির গভীর স্রোত। প্যাণ্ট ভাঁজ করে উঠাতে উঠাতে শেষ পর্যন্ত কোমড়জলে সয়লাব। আশেপাশে শুকনো ময়ানগুলো জলে টইটম্বুর। মাছ ধরার কতো রকমের সরঞ্জাম হাতে নিয়ে লোকগুলো মাছ শিকার করছে। এগুলো কাটিয়ে কোথাও পা ভিজিয়ে কোথাও গা ভিজিয়ে অফিসে এসে পৌঁছলাম যখন, দড়দড় করে ঘামছি।

কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে ভাঁজ করা ভেজা প্যাণ্টের দিকে চোখ পড়তেই দেখি রক্ত ! পায়ের কয়েক জায়গা থেকে আলতো রক্তের ধারা। ব্যাপার কী ! দেখি রক্ত খেয়ে ঢোল হয়ে ওঠা জোঁকটা বহির্মুখী গজেন্দ্র চালে শরীরটাকে সোজা-বটা করতে করতে এগিয়ে যাচ্ছে।

(০৭)
পাড় থেকে নদীর ঢাল ধরে প্রায় পঁচিশ ত্রিশ হাত নেমেই তবে ফেরি নৌকাটা। গোদারা নৌকাও বলে। সদ্য পড়া পলির থকথকে কাদা মাড়িয়ে অবশ্য যেতে হয় না। পাড় থেকে কিছুটা নেমে বাঁশের তৈরি সাঁকো দিয়ে নৌকায় গিয়ে উঠতে হয়। সমস্যা হয় পানি আরেকটু নেমে গেলে। তখন ঠিকই কাদা মাড়াও। দুহাত ফেরিনৌকার পুরু ধারটাতে স্থাপন করে শরীরের গোটা ওজনটাকে ফেরিতে সঁপে দিয়ে সার্কাসের ক্লাউনের মতো পা দুটোকে নদীর পানিতে নেড়েচেড়ে কাদামুক্ত করে অতঃপর একে একে নৌকায় উঠা। দুঘণ্টা আগেও অঢেল পানি এরই মধ্যে এতোটা নীচে নেমে গেছে ! হয়তো আরো দু’তিন ঘণ্টা পর ফের উল্টো দৃশ্য দেখা যাবে। ফেরিঘাট থেকে কিছুটা দূরে বসে আমরা আরো অনেককিছুর মতো এসবও দেখছি। আর অপেক্ষা করছি ওপারের পণ্টুনে দিনের শেষ লঞ্চটা কখন এসে ভিড়বে। ওটাতে করে গুটিকয় যে দৈনিক পত্রিকাগুলো এসে পৌঁছবে, আমাদের জন্য সদ্য কড়কড়ে হলেও আদতে তা গতদিনের। কোন আপদবিপদ না ঘটলে দিনের পত্রিকা আমরা পরদিন সন্ধ্যের মধ্যেই হাতে পেয়ে যাই। ততক্ষণে পৃথিবী আরো দেড়দিন এগিয়ে গেলেও আমাদের এখানকার পৃথিবীটা খুবই ছোট এবং বড় বেশি নিস্তরঙ্গ।

অফিস শেষে আমাদের একমাত্র গন্তব্য এবং বিনোদন বলতেও দু’মিনিটের হাঁটার দূরত্বে এই নদীর পাড়টাই। কতো বিচিত্র মানুষের আসা-যাওয়া দেখা, সদ্য ধরে আনা বরফহীন রূপালি ইলিশের চকচকে ঔজ্জ্বল্যও একঘেয়ে চোখে ম্লান হতে শুরু করেছে। আমার অবস্থান দু’সপ্তাহও পূর্ণ হয় নি, এরই মধ্যে হাফিয়ে ওঠছি। পানির দরে বিক্রিত দুধের পাত্রে দুধে পানি মেশানো হয়েছে, না কি পানিতে দুধ মেশানো হয়েছে তা জানার কৌতূহল বা বিশ টাকায় বিরাট একটা কলার ছড়ি কেনার আগ্রহেও রীতিমতো ভাটা পড়েছে। চাকুরিতে ঢোকার বয়সসীমা তখনকার নিয়মে সাতাশ পেরিয়ে গেছে। আরো কিছুদিন পর বিসিএস প্রিলিমিনারী টেস্টের ইণ্টার্ভ্যু কার্ডটা বাড়ির ঠিকানা ছুঁয়ে রিডাইরেক্ট হয়ে আমার হাতে পৌঁছবে যখন, ততদিনে পরীক্ষা গত। আমার অবস্থা তখন দিবানিশি কান্দিরে নদীর কূলে বইয়া।

এই নদীর পাড়ে বসেই জোয়ার ভাটায় উথলে উঠা যৌবনের আসা আর যাওয়া ছাড়াও এ নদীর আরো কতো যে রূপ দেখা হয় ! হাটবারে সে আরেক দৃশ্য। দূর থেকে আমুয়ার দিকে ছুটে আসা লঞ্চগুলোকে তখন গতি কমিয়ে সাইরেণ বাজাতে বাজাতে সাবধানে ঢুকতে হয় ভেতরে। নদীর মোড়, যেখানে প্রায় আধা কিলো প্রশস্ত হয়ে নদীটা ঘুরে গেছে, নৌকা আর নৌকা। বিশেষ করে ধান উঠার মৌসুমে বাজারের যে দিকটাতে ধান বেচা-কেনার হাট জমে উঠে, পুরোটাই নদীর উপরে। সকালে টুথব্রাশ মুখে নিয়ে স্নান করতে নদীর চঞ্চল পাড়টাতে এলেই দেখা যায় দূরে গোটা নদীটাই ব্লক হয়ে আছে নৌকা আর নৌকায়। জোয়ার বা ভাটার জোরালো স্রোতের মধ্যেও শত শত নৌকা স্থির, দণ্ডায়মান। সবগুলোকে পাড় ছুঁয়ে দাঁড়ানোর মতো জায়গা দিতে নদীর সুদীর্ঘ চলমান পাড়ের ঘাটতি বা কার্পণ্য থাকার কথা নয়। কিন্তু বাজারের পরিসরের সীমাবদ্ধতা শেষ পর্যন্ত নদীকেই বইতে হয়। একটার পেছনে আরেকটা, তার পেছনে আরেকটা, তার পেছনে আরো, এভাবে ডানে বামে সামনে পেছনে একের পর এক হরেক পদের নৌকার সাথে নৌকার যে পারস্পরিক গুচ্ছ বন্ধনের বিশাল আয়োজন গড়ে উঠে, নদীর উপর তৈরি হয়ে যাওয়া এই বিস্তৃত ভাসমান ধানবোঝাই স্বয়ংক্রিয় পাটাতনে ঘুরে ঘুরে ক্রেতা-বিক্রেতাদের এক তুমুল শোরগোল অনেক দূর থেকেও কানে আসে। দক্ষিণাঞ্চল ছাড়া বাংলাদেশের অন্য কোন অঞ্চলে এমন দৃশ্য কি কল্পনা করা চলে ?

এর মাঝেও খুব সাধারণ কিছু ঘটনাই কেন জানি অসাধারণ হয়ে দেখা দিতে থাকে আমার কাছে। অনিবার্যভাবেই বসে আছি নদীর পাড়ে। গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে ছেড়ে আসা দিনের শেষ লঞ্চটা এসে ভিড়েছে পণ্টুনে। এখান থেকে উৎসুক দৃষ্টিতে দেখছি, ধরাধরি করে একটা রিক্সা নামানো হলো ঘাটে। তোলা হলো নৌকায়। এবং ভিড়লো এসে এপাড়ে আমাদের কাছাকাছি জায়গা দিয়ে। এমন অদ্ভুত চাকাঅলা যান দেখতে অনেক ছেলে বুড়োই ঘর থেকে বেরিয়ে এলো। এবং কী আশ্চর্য, উপরে উঠানোর পর সে এক তুলকালাম ব্যাপার ! ছেলে বুড়ো সিকি আধলি যে যেমন পারছে উঠে বসছে রিক্সাটাতে। কেউ সীটে, কেউ পাটাতনে, কেউ পাদানিতে, কেউ মাটঘাটে, কেউ স্টিয়ারিয়ে, কেউ পেছনে ঝুলে, কেউ চালকের আসনে, কেউ চাকায়, কম করে হলেও গোটা কুড়ি তো হবেই। আহা, বুকের ভেতরটায় কেমন করে ওঠলো আমার ! এদের পৃথিবীটা কতো সীমিত হয়ে আছে। এই ছোট্ট সীমানা ছেড়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়েগুলোর কথা বাদই দিলাম, অনেক বয়ষ্কাদেরও সৌভাগ্য হয় নি শহর নামক কোন লোকালয়ের চেহারাও একপাক দেখে আসার। তাদের কাছে এখানে ব্যবহার অনুপযোগী এই অদ্ভুত চাকাঅলা যানটাও বিস্ময়ের বস্তু বৈ কি। অথচ এই যানটা যে তাদের মতো সম্বলহীন অবস্থার মানুষদেরই জীবীকানির্ভর মহার্ঘ নাগরিক সম্পদ, এটাও কি এরা জানে ? রাষ্ট্রের ভৌত অবকাঠামো তথা সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার দুঃখজনক ঘাটতি একটা জনগোষ্ঠীকে কতোটা বঞ্চিত রেখে দেয় তা ভাবতে ভাবতে মনটা সত্যি বিষণ্ন হয়ে ওঠে।

আমাদেরই এক সহকর্মী কী মনে করে পাশের শাখা থেকে তার ফনিক্স সাইকেলটা নিয়ে আসছেন। হয়তো লঞ্চে বাড়ি পাঠাবেন। আসার পথে তিনি কি সাইকেলে চড়েছেন না কি সাইকেল তাকে চড়েছে এটা গুরুতর গবেষণার বিষয় হলেও এ অঞ্চলের হালচাষের অনিবার্য প্রাণীমাধ্যম মহিষগুলো যে নাগরিক প্রাণীদের মতো এতোটা শিক্ষিত হয়ে ওঠতে পারে নি, তা সম্ভবত ওই সহকর্মী ভুলেও ভাবেন নি। অথবা এটাও যে ভাবার মতো একটা বিষয় হতে পারে তাও তার মাথায় আসেনি। কারো মাথায়ই হয়তো আসার কথা না। ফলে যা হবার তাই হয়েছে। কাদায় জলে সাইকেলে মানুষে একাকার হয়ে এক অদ্ভুত মূর্তিমান রূপ ধরে তিনি অফিসে এসে পা দিতেই তাকে দেখে আমরা হাসবো না কাঁদবো তাই ভুলে গেলাম। কী ব্যাপার ! রাস্তায় চড়ে বেড়ানো মূর্খ মহিষগুলো তাদের পূর্ব অভিজ্ঞতার বাইরে এমন আচানক চলমান বস্তুকে তাদের দিকে ধেয়ে আসতে দেখে নিজেদের চিন্তাজগতে কী আলোড়ন তুললো কে জানে। আত্মরক্ষার তাগিদে না কি আক্রমণের বেয়ারা স্বভাবে এরা এমন পাগলা হয়ে ওঠলো যে, আমাদের সহকর্মী কি চতুর্মুখী তাড়া খেয়ে না কি আচমকা বোধশূন্য হয়ে নিজেই খালের দিকে তেড়ে গেলেন তা বোঝানোর মতো অবস্থা তখন তার নেই। নিষ্পাপ প্রাণী মহিষকে আর দোষ দিয়ে কী লাভ। মানুষই তো কতো জায়গায় কতো ভাবে কতো অভূতপূর্ব ঘটনার অঘটনঘটনপটিয়সী হয়ে ওঠে !

(০৮)
২৯ এপ্রিল ১৯৯১। এখানে এসেছি তিন সপ্তাও পুরো হয়নি তখনো। আগের দিন থেকেই সম্ভাব্য ঘূর্ণিঝড়ের দশ নম্বর মহাবিপদসংকেত দেখানোর ঘোষণা প্রচার হচ্ছে রেডিওতে। এখানকার বিনোদনের একমাত্র ইলেকট্রনিক্স মাধ্যম হচ্ছে রেডিও। তা আবার এক ব্যান্ডের ছোট্ট রেডিওর প্রচলই বেশি। হাতের মুঠোয় নৌকায় মাঠে ঘাটে হাটে বাজারে সহজ বহনযোগ্যতা আর তুলনামূলক সাশ্রয়ী হিসেবে আনাচে কানাচে মানুষ আছে অথচ খশখশে যান্ত্রিক আওয়াজের সাথে কথা-সুর ভেসে আসবে না তা চিন্তাও করা যায় না। বিনোদন বিলাসী বাসাবাড়িতে কারো কারো হয়তো চার পাঁচ ব্যাটারির শক্তিখেকো তিন ব্যান্ডের বড় রেডিও বা টুইন ইন ওয়ানও রয়েছে। থেকে থেকে ঘোষণা হচ্ছে, চট্টগ্রাম কক্সবাজার ফেনী নোয়াখালী ভোলা খুলনা বরিশাল পটুয়াখালী ঝালকাঠি বাগেরহাট পিরোজপুর বরগুনা জেলাসমূহ এবং তৎসহ উপকূলীয় অঞ্চলসমূহকে দশ নম্বর মহাবিপদসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হচ্ছে। সাগর প্রচণ্ড উত্তাল থাকবে এবং দশ থেকে পনের ফুট কোথাও কোথাও আরও বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসের সম্ভাবনা রয়েছে। উপকূলীয় দ্বীপ ও নিম্নাঞ্চলের অধিবাসীদের নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বলা হচ্ছে।

সকালে ঘর থেকে বেরুতেই অফিসের সামনেতক নদীর উপচে আসা সচল পানি দেখে ভড়কে গেলাম ! যথারীতি সূর্য উঠা পরিষ্কার আকাশ, মেঘের কোন চিহ্ণই নেই। ব্যাপার কী ! সহকর্মী জানালো, আজ পূর্ণিমা, ভরাজোয়ারের ফুলে ফেঁপে ওঠা পানি এগুলো। কিছুণ পরই ভাটার টান পড়লে নেমে যাবে। ওহ্, তাহলে এটাও অতিসাধারণ প্রাকৃতিক ঘটনা। কিন্তু দশ নম্বর মহাবিপদসংকেতের কী হবে ? বুকের ভেতর প্রচণ্ড ঢিপঢিপ, কোন কাজ করতেই বল পাচ্ছি না। অথচ কী আশ্চর্য, এখানকার মানুষদের মধ্যে দুশ্চিন্তার কোন বিন্দুবিসর্গও টের পাওয়া যাচ্ছে না ! সব কিছুই কী স্বাভাবিক ! বাজার হাট ব্যবসা বাণিজ্য জীবন যাপন কোথাও কোন অসঙ্গতি বা ছন্দপতনের ছিটেফোটাও না দেখে বেশ অবাক হচ্ছি আর নিজেও কেন জানি ভেতরে ভেতরে সাহস ফিরে পাচ্ছি। আমাদের অফিসের পাশের ইউনিয়ন পরিষদ অফিসের সদ্যনির্মিত দোতলা পাকা ভবনেও যথারীতি কর্মব্যস্ততা। তবে কি এই দশ নম্বর বিপদসংকেতকে আমরা দূর থেকে যেরকম ভীতিকরভাবে জানি, বাস্তবে তা এতো ভয়ঙ্কর নয় !

দুপুর বারোটাতক পরিষ্কার ঝলমলে রোদ্দুরে ঘূর্ণিঝড়ের কোন আলামতই দেখা গেলো না। এর পর রোদটা কেমন মজে আসতে লাগলো। বেলা দুটোর দিকে সবকিছু কেমন থমথমে হয়ে গেলো। রোদ সম্পূর্ণ মরে গেছে। আকাশে বাতাসে প্রকৃতিতে একটা গুমোট স্তব্ধতা। আমার বুকের ভেতর আরো বেশি। দোকানপাটগুলো দ্রুত বন্ধ হয়ে যেতে লাগলো। হাটভাঙা মানুষের বাড়িফেরার স্রোত। ইউনিয়ন পরিষদের দোতলা ভবনটাতে দলে দলে মহিলাপুরুষ এসে বাচ্চাকাচ্চাসহ আশ্রয় নিতে শুরু করেছে। কীসের অফিস আদালত ! অফিস বন্ধ করে দোতলার খোঁয়াড়ে উঠে গেলাম। সহকর্মীরা মিলে অহেতুক আড্ডায় সাহস ফিরে পাওয়ার বৃথা কসরত শুরু হলো। তিন ব্যান্ডের রেডিওটাতে নতুন ব্যাটারী লাগিয়ে অন করে দেয়া হলো। কাছাকাছি স্টেশন হচ্ছে খুলনা বেতার। ঘেরঘের আওয়াজে ঢাকা বা অন্য স্টেশনগুলোর কিছুই বুঝা যাচ্ছে না। অবশেষে খুলনাতেই মিটার ফিক্সড করে রাখা হলো। মুহুর্মূহু ঘোষণা হচ্ছে, ঘণ্টায় দুশ থেকে দুশ পঞ্চাশ কিলোমিটার বেগে ঝড়ো হাওয়া বয়ে যাবে। পনের থেকে বিশ ফুট উঁচু তীব্র জলোচ্ছ্বাসে সবকিছু ভেসে যেতে পারে। তাই চিড়া গুড় জাতীয় শুকনো প্যাকেটজাত খাবার দিয়াশলাই ও নিত্যপ্রয়োজনীয় গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্যাদি মোটা ও পুরু পলিথিনের ব্যাগে শক্ত করে বেঁধে কোন শুকনো উঁচু জায়গায় আড়াইহাত মাটির নীচে পুঁতে রাখার জন্য বারবার সতর্ক করা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের এ মুহূর্তে কিছুই করার নেই। সে সময় উত্তীর্ণ।

গুমোট স্তব্ধতা ভেঙে একটু একটু বাতাস বইতে শুরু করলো। হঠাৎ নীচে অফিসের দরজায় কে যেন জোরে জোরে কড়াঘাত করছে। সহকর্মী একজন নীচে নেমে গেলেন। সাথে নিয়ে এলেন পাশের শাখার এক সহকর্মীকে যিনি নাকি এখানকার প্রাক্তন সহকর্মীও। হাতে ব্যাগ। ছুটিতে বাড়ি রওয়ানা দিয়েছিলেন। কিন্তু দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় লঞ্চ বন্ধ। এখানেই রাতটা কাটিয়ে পরদিন যাবেন। কিন্তু আমাদের জীবনে কি পরদিন আর আদৌ আসবে ? মা বাবা ভাই বোন বন্ধু বান্ধব আত্মীয় পরিজন এবং প্রিয়তম মানুষটির জন্য বুকের ভিতর হু হু করে কান্না বইতে লাগলো। আহারে, কেন যে মরতে এই যমের রাজত্বে এসেছিলাম !

দোতলার দক্ষিণ দিকের গরাদ বা ছোট্ট জানালাটা খোলা থাকলো বাইরের পৃথিবী দেখার একমাত্র মাধ্যম হিসেবে। কিছুদূর সামনেই প্রকাণ্ড তালগাছটা মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো। তারও পরে নদীর পাড় এবং নদীর বড় একটা অংশ দেখা যায়। বিশেষ করে নদীর বড় মোড়টা এখান থেকে সরাসরি দেখা যায় এবং ওপাড়ের লঞ্চঘাটের আংশিক এখান থেকে আঁচ করা যায়। রেডিওর ঘোষণা অনুযায়ী প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড় উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে আমরা সহকর্মীরা গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাগুলো সেরে নিলাম। ঢিলেঢালা পোশাক শক্ত করে শরীরে আটকে কোমরে গামছাটাকে কষে বেঁধে অত্যাবশ্যকীয় উপকরণ টর্চলাইটটা গুঁজে নিলাম। টাকাপয়সাগুলোও পোশাকের নিরাপদ অবস্থানে রেখে দিলাম। সবাইকে একটা কথাই বলে নিলাম, জলোচ্ছ্বাসে ভেসে গেলে স্রোতের বিপরীতে সাঁতরে শক্তিক্ষয়ের দরকার নেই। স্রোত যেদিকে নেয় নিয়ে যাবে, শুধু ভেসে থাকার চেষ্টা করতে হবে। কী হাস্যকর এসব কথাবার্তা, অথচ কী গুরুত্ব দিয়ে বলছি। অনভিজ্ঞতা আর কাকে বলে !

বাতাসের বাড়ি খেয়ে তালগাছের পাতাগুলো ফড়ফড় করে কাঁপছে। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি আর বিকেলের অন্ধকার সন্ধ্যা নামিয়ে দিয়েছে। বাতাস এখন উত্তর থেকে দক্ষিণমুখী বইছে। বেগ বাড়ছে তীব্র থেকে তীব্রতর। জোয়ারের সময়। এই বাতাসই যখন ঘূর্ণির রূপ নিয়ে দক্ষিণ থেকে উত্তরে বইতে শুরু করবে, পূর্ণিমার ভরা জোয়ারের সাথে ঘূর্ণিঝড়ের প্রলয়ঙ্করী মোচড় যে আমাদেরকে তীব্রবেগে ভাসিয়ে কে জানে কোথায় নিয়ে চুরমার করে দেবে, তা কেবল সময়ের ব্যাপার। এই টিনের ঘর তো প্রথম তোড়েই দুমড়েমুচড়ে যাবে। এমন ভয়াল আগামী সামনে রেখে সত্যি সত্যি সন্ধ্যা হলো ঠিকই, কিন্তু এ কী ! একটা অপার্থিব ভুতুরে লাল হলুদে মেশানো আলোয় সব কিছু কেমন যেন আধিস্পষ্ট হয়ে ওঠতে লাগলো। এটাই ধ্বংসের পূর্ব মুহূর্ত কিনা কে জানে। এবং তখনি শুরু হলো তাণ্ডব ! চারদিকে ভৌতিক শব্দ, প্রকাণ্ড তালগাছটার শক্ত পাতাগুলো কিসে যেন খাবলে খাবলে তুলে নিয়ে যেতে লাগলো। শো শো সা সা হুম হুম ভো ভো ধুরুম ধারুম আওয়াজের সাথে সাথে আমাদের টিনের দোতলা শক্ত ঘরটা কাগজের মতো কাঁপতে লাগলো। সহকর্মীরা কাঁপতে কাঁপতে দোয়াদরুদ পড়া শুরু করলো। কেউ কেউ ঠাকুর ঠাকুর রোল তুলে দিলো। আশে পাশে কোথা থেকে যেন শঙ্খ আর উলুধ্বণি, এর পরেই কারো সর্বশক্তি দিয়ে আজানের চিৎকারও তলিয়ে যেতে থাকলো। আমি কিছুই শুনছি না আর। বোধবুদ্ধিচিন্তাশক্তি একটু একটু করে লোপ পেতে শুরু করেছে। জীবিত আছি না মরে গেছি সে ধন্ধের মধ্যে থেকেই জানলা দিয়ে বাইরে তাকাতেই ভয়াবহ দৃশ্যটা চোখে পড়লো নিমেষেই। হলুদ ভোঁতা আলোয় স্পষ্ট, সামনের বিশাল নদীটাতে একফোটা পানি নেই ! পাতালের অন্ধকার নদীর গভীরে ! এমন দানবীয় অসহ্য বীভৎস দৃশ্য দেখে চোখ বন্ধ করবো, নিজের শরীরের উপর সে নিয়ন্ত্রণ আর নেই। সম্ভবত জ্ঞান হারাতে যাচ্ছি আমি। এই মহাপ্রকৃতির কাছে পুতুল হয়ে যাওয়া সহকর্মীদের কার কী অবস্থা তখন বলতে পারবো না। বহু দূর থেকে যেন কোন যান্ত্রিক শব্দ হচ্ছে, আর এর মধ্য থেকেই মাঝে মাঝে মানুষের শব্দ, এখন একশ আশি কিলোমিটার বেগে তীব্র ঘূর্ণি হাওয়া বয়ে যাচ্ছে.. এই গতিবেগ দুশো থেকে দুশোপঁচিশ কিলোমিটারে উঠতে পারে.. ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে লন্ডভন্ড ও তলিযে যাওয়া বরগুনার সাথে সকল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে.. ঘূর্ণিঝড় শেষে প্রয়োজনীয় উদ্ধারকাজ চালানোর সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়ে আছে বলে.. জানিয়েছেন।.. বহু কষ্টে এটা স্মরণ করতে পারলাম যে এখান থেকে বরগুনার দূরত্ব খুব বেশি নয়।

হঠাৎ কারো নাক ডাকার শব্দে যেন চেতন পেলাম। আমাদের সেই বাড়ি গমনেচ্ছু সহকর্মী এই প্রলয়কান্ডের মধ্যেও বেঘোরে নাক ডাকাচ্ছেন ! আবছা আলোয় সময় দেখার চেষ্টা করলাম। দশটা বেজে কত মিনিট যেন। একটু একটু করে স্থান সচেতন হয়ে ওঠছি। সহকর্মীরা পাথরের মূর্তির মতো স্থির হয়ে আছে যে যার জায়গায়। আমিও জানলাটার পাশে সেই আগের মতোই বসে আছি। বাইরে প্রবল ঝড় বইছে। ঘরটাও কাঁপছে আগের মতোই। কিন্তু কী আশ্চর্য, ভেতরে ভয় ডর কিছুই আর টের পাচ্ছি না। বুদ্ধিবৃত্তিও মনে হয় ফিরে আসছে। কেননা তখনি বেঁচে থাকার সপক্ষে যুক্তিসিদ্ধ আলামতগুলো একে একে যাচাই করে নিতে পারছি। এই যেমন বুঝতে পারছি বাতাস এখনো উত্তর থেকে আগের মতো দক্ষিণেই বইছে। আমাদের উত্তরে দোতলা বড় ইউনিয়ন পরিষদ অফিসের ভবনটা বাতাসের থেকে থেকে আঘাত হানা ধাক্কাগুলো ঢালের মতো আটকে দেয়ায় বোধ করি আমাদের ঘরটা এখনো উড়ে যায়নি। আর উল্টো বাতাস তার দানবীয় তীব্রতায় গোটা নদীটাকেই এদিকে না এনে দক্ষিণে সাগরের দিকেই ঠেলে দিয়েছে। না জানি এই বিশাল পানির পাহাড় কতো লোকালয় ভাসিয়ে নিয়েছে ! ওটাই আবার উল্টোমুখী হয়ে ফিরে আসতে কতোক্ষণ !

কোন ভয় ডর কাজ করছে না আর। হতে পারে বেঁচে থাকার এতটুকু আশাও ভেতরে কোথাও আর অবশিষ্ট নেই বলে কিছু হারানোর আশঙ্কাও অন্তর্হিত হয়ে গেছে। সশরীরে মৃত্যু এসে সামনে দাঁড়ালেও মনে হয় এখন নির্বিকার সমর্পণ হতে পারবো তার কাছে। কেবল এক অনির্দিষ্ট কালের আপেক্ষিক সময়ের ফাঁদে আটকা পড়ে অনিশ্চিৎ অপেক্ষার প্রহর গোনা এখন। রাত দুটোর দিকে ঝড়ের তীব্রতা কমে এলো। বিরতিহীন এতো দীর্ঘ অবিচ্ছিন্ন সময়ের নার্ভাসনেসে ভোঁতা হয়ে যাওয়া নার্ভের উপর থেকে একটু একটু করে চাপ কমে আসতে শুরু করলো। এবং তখনি হঠাৎ টের পেলাম যে, বেঁচে থাকার আনন্দ মানুষের এক শাশ্বত বোধ ! বেঁচে আছি, এই দুর্বহ উচ্ছ্বাসই আনন্দে মরে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। তখনো জানি না, বাইরের পৃথিবী আদৌ তার আগের চেহারায় আছে কি না !

(০৯)
তীব্র কোলাহলে ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ খুলে আমি কোথায় কেন কীভাবে, কিছুই মনে করতে পারছি না। হ্যাবলার মতো ছাদের দিকে তাকিয়ে আছি। ধীরে ধীরে স্মৃতি ফিরে আসছে। হাঁ, মনে পড়ছে। রাতে এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ে আক্রান্ত হয়েছিলাম ! লাফ দিয়ে উঠে বসলাম। আশ্বস্ত হলাম যে আমি ঘরেই আছি। ঝট করে বাইরে বেরিয়ে এলাম। আহা, এ কী দেখছি আমি ! ধ্বংশস্তুপ ! এই প্রলয়ের বর্ণনা দেয়া কি সম্ভব !

কোথাকার কী এসে কোথায় কীভাবে পড়ে আছে দুমড়ে মুচড়ে। এগুলো বাঁচিয়ে নদীর পাড়ে এসে দাঁড়ালাম। স্মৃতি ধরে রাখার ক্ষমতা বুঝি আকাশের থাকে না। নইলে কয়েক ঘণ্টা আগের তুলকালামের পর এমন পরিষ্কার আকাশ হয় কী করে ! নদীও এমন হতো, যদি তার পাড়গুলো সুনসান হতো। কিন্তু তা তো হবার নয়। তাকে আশ্রয় করেই যে গড়ে ওঠে মানুষের লোকালয়গুলো। তাই প্রকৃতির সংহারি স্মৃতি নদীকেও বইতে হয়। আর নদী বুঝি তা ধুয়ে মুছে আবারো তার অধিবাসীদেরকে প্রস্তুত করে তোলে সব কিছু নতুন করে শুরু করতে। গতকাল বিকেলে যে বিশাল বিশাল লঞ্চ আর মাল বোঝাই কার্গোগুলো এসে ভীড়েছিলো, যেতে পারেনি আর। নিরাপদ আশ্রয় হিসেবে যে স্থানটাকে বেছে নিয়েছিলো, রাতের উল্টোঝড়ে নদীর পানি সরে যেতেই সেই যে কাত হয়ে পড়েছিলো, পানি ফিরে এলেও আর সোজা হয় নি। অর্ধেক পানির নীচে লেপ্টে আছে। চারদিকে গাছপালা একটাও অক্ষত নেই। বাড়িঘর লণ্ডভণ্ড। যেগুলো খাড়া আছে, চাল নেই। কিন্তু আশ্চর্য হয়ে যাই, মানুষগুলোর অস্বাভাবিক মনোবল দেখে ! এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেছে ফের নিজেকে সারানো আর সাজানোর পালা। এখানেই জীবন-সংগ্রামী মানুষগুলোর সাথে আমাদের মতো অথর্ব মানুষের বিরাট তফাৎ।

ফিরে এসে দেখি সহকর্মীরা রেডিওতে বিশেষ বুলেটিন শুনছে। দেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলে যে মহাপ্রলয় ঘটে গেছে তারই বিবরণ। পতেঙ্গা বন্দর থেকে তীব্র জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কায় ক্রেনবাহী জাহাজ কাগজের নৌকার মতো প্রায় উড়িয়ে নিয়ে গিয়ে কর্ণফুলি দীর্ঘ ব্রীজে যেভাবে বাড়ি মেরেছে, সাথে সাথে এতো বড়ো সেতুর মাঝামাঝি গুড়ো হয়ে দুভাগ হয়ে গেছে ! পূর্ব সতর্কতা হিসেবে নিরাপদ অবস্থানে না নেয়ায় চট্টগ্রামে বিমানবাহিনীর বেশ কতগুলো বিমান ঘূর্ণিঝড়ে চুরমার হয়ে গেছে। এজন্য রাষ্ট্রপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ কর্তৃক বিমানবাহিনী প্রধানকে তাৎক্ষণিক বরখাস্তের খবরও প্রচারিত হলো। চট্টগ্রাম কক্সবাজার ভোলা সন্দ্বীপ বিশেষ করে উড়ির চর ও আশেপাশের দ্বীপগুলোর সাথে সবধরনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতার পরও যেসব খবর আসতে শুরু করেছে, তাতেই রক্ত হীম হয়ে যাবার অবস্থা। লক্ষ লক্ষ মানুষের হতাহতের পাশাপাশি অপরিমেয় ক্ষয়ক্ষতির যে আশঙ্কা করা হচ্ছে তা সত্যি হলে পৃথিবীর ইতিহাসে অন্যতম মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হবে ! একটা গরীব রাষ্ট্র তা সামলাবে কী করে ! বস্তুত তাই হয়েছিলো। সে তুলনায় আমাদের এখানে ক্ষয়ক্ষতি কিছুই হয় নি বলা যায়। একই উপকূলীয় বেল্টে থেকেও এ কীভাবে সম্ভব ?

এটাই ঝড়ের প্রকৃতি। বিচিত্র প্রকৃতির এ ভয়াবহ ঘূর্ণির যে বিশেষ কারণে কেয়ামত হয়ে গেলো উড়ির চর সন্দ্বীপ ভোলা কক্সবাজার এবং আশেপাশের দ্বীপগুলো, সেই একই কারণে এই পটুয়াখালী ঝালকাঠি বাগেরহাট খুলনা অঞ্চলে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হলেও রক্ষা পেয়ে গেলো লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন। বিশাল এলাকা জুড়ে প্রচণ্ড এ ঘূর্ণিঝড়ের ভয়ঙ্কর ঘূর্ণি বা মোচড়টা ছিলো এণ্টিকক ওয়াইজ। ফলে দক্ষিণাঞ্চলের পশ্চিম অংশের ভয়াল বাতাস উত্তর থেকে দক্ষিণমুখী বয়ে সমস্ত নদীনালার পানি সাগরে টেনে নিলেও উন্মত্ত সাগর দক্ষিণ থেকে উত্তরমুখী ধাক্কায় ঠিকই হামলে পড়ে পূর্ব অংশে। এবং বাংলাদেশের ইতিহাসের আরেকটি বিপর্যয়ের দিন হিসেবে অমোচনীয় দাগ রেখে গেলো। যদি এ ঘূর্ণি ঠিক উল্টো মানে ক্লকওয়াইজ হতো, তাহলেও হয়তো বিপর্যয়ের কোন হেরফের ঘটতো না। তখন পশ্চিম অংশে আমরাই মিশে যেতাম চির অজানায়...।

(১০)
মানুষের প্রকৃতিও এমন যে একসময় না একসময় পরিবেশের সাথে তাকে মানিয়ে যেতেই হয়। এটাই বোধ করি টিকে থাকার অনিবার্য সূত্র। আর এক মুহূর্তও নয় ভাবতে ভাবতে আরো ছ’টি মাস কেটে গেলো ঠিকই। অভিজ্ঞতার ঝুলিতেও জমা হলো আরো কতো বিচিত্র সম্ভার। বিভিন্ন অঞ্চলের ভাষাগত আঞ্চলিক ভিন্নতার পাশাপাশি জীবনধারা রীতিনীতির পার্থক্যও অনেক বৈচিত্র্য ধারণ করে। জন্ম মৃত্যু বিয়ে উৎসব পার্বণ সবকিছুই মূলানুগত হয়েও কতো ভিন্ন সুরের কতো বিচিত্র আবেদনময়। এগুলো দেখি আর ভাবি আহা, বাধ্য হয়েই হোক, এখানে না এলে কি এসব দেখতাম জানতাম আর ভাবতাম ?

প্রতিদিনের মতোই সূর্য পাটে যেতে বসেছে। অফিসের নিয়মিত ডাকগুলো হাতে নিয়ে বাই নেমে আসা অফিসিয়াল হলুদ খামটায় চোখ আটকে গেলো। আবার কোন্ পাতলা কাগজ এলো ? অফিসিয়াল কোন ব্যাখ্যা চাওয়া বা শাস্তিমূলক চিঠির জনপ্রিয় কোড নেম হচ্ছে পাতলা কাগজ। তখনো অফিসগুলোতে কম্পিউটারের পুরো প্রচলন ঘটেনি বলে সেই আদ্যিকালের ঠকাঠক টাইপরাইটারে প্রয়োজনীয় অনুলিপিসহ চিঠিপত্রগুলো টাইপ করতে থিন পেপারই ব্যবহার হতো। সব চিঠিপত্রের ক্ষেত্রেই এই কাগজ ব্যবহার হলেও বিশেষ চিঠিগুলোকেই এরকম পাতলা কাগজ নামে ডাকার একটা রেওয়াজ সহকর্মীদের মধ্যে ছিলো এবং এখনো আছে। যদিও এখন আর কম্পিউটার নিয়ন্ত্রিত অফসেট প্রিণ্টারে পাতলা কাগজ ব্যবহার হয় না। যাক্, খামটা হাতে নিয়ে একটু দ্বিধায় থেকেই ছিঁড়লাম। তখনো কি জানতাম, আমার সোনার হরিণটা ওখানেই পোরা ছিলো !

ধড়াশ করে বুকটা লাফিয়ে ওঠলো, বদলির অর্ডার ! এই অথৈ পানির তল্লাটে আর নয়, একেবারে চট্টগ্রামের মিরসরাই। আহ, কী আনন্দ ! এভাবে নদীর কূলে নিরূপায় বসে বসে আর হাহুতাশ করতে হবে না। সেই যে এখানে এসেছি কবে ! আসতে যেতে সাড়ে পাঁচদিনের দূরত্বে আর বাড়ি যাওয়া হয় নি। প্রিয়তম মুখটা দেখি না এক যুগ হয়ে গেছে ! সে কেমন আছে ? কতোকাল তাঁর কণ্ঠ শুনি না ! বুকের ভেতরটায় কোথায় মোচড়াতে শুরু করেছে। এমন বিচ্ছিন্নতা কী করে মানুষ সহ্য করে ! ভয়ানক আশ্চর্য হয়ে ভাবছি, আমিই বা টিকে রইলাম কী করে ! নভেম্বরের পয়লা তারিখেই রিলিজ ডেট। কিন্তু এখনো তো তা আরো পনের দিন ! এতো দিন !

হঠাৎ করে দিনগুলো অস্বাভাবিক লম্বা হয়ে গেলো। সাথে সাথে চারপাশটাকেও কেমোন যেনো ভালো লাগতে শুরু করেছে ! এই জোয়ার-ভাটা, এই তালের রসে তৈরি পাটালি গুড়, বাঁশের তালের খেজুরের সাঁকো, একটা মহিষের কাঁধে অধিবৃত্তাকার ডিমের মতো বাঁকানো বিশেষ ধরনের লাঙ্গলের সূত্র, মাটির লবণাক্ততা, নৌকার ভাঙা গলুই, কাধিভরা মর্তমান কলা, নারকেলে তরকারি মাখা মোটা ভাত, লঞ্চের সাইরেণ সবকিছু। সবকিছুই কেমন যেন আবেগে মোড়ানো, ভালো লাগায় অস্থির। আহারে, ক’দিন পর আর এগুলো থাকবে না ! কী চমৎকার লোনা প্রকৃতি। আসলে তো খারাপ ছিলো না কিছুই। কী মায়া লেগে আছে সব কিছুতেই ! এ সবই ছেড়ে যেতে হবে !

(১১)
কলিগ বন্ধুর সাথে সকালে বেরিয়েছি অফিসিয়াল কাজে। বেশ দূর যেতে হবে। মাধ্যম তো সেই পায়ে হাঁটা। কিন্তু আমার মধ্যে তখন বিদায়ী বাঁশির সুরের আচ্ছন্নতা। তাই এক নতুন বিচ্ছেদি দৃষ্টি দিয়ে দেখছি সব। যেতে যেতে অনেক দূরেই চলে গেছি, প্রকৃতি যেখানে আরো অনেক গভীর। দুপুর পেরিয়ে ফিরে আসছি যখন, কটকটা রোদের তীব্র ঝাঁঝ ছাতায় মানলেও হাঁটার ক্লান্তির সাথে গরমের তীব্রতায় ঘেমে নেয়ে একশেষ দুজন। বিষখালির পাড়ে পাড়ে হাঁটছি। বিস্তির্ণ ধানি জমি। কতো রকমের নাম জানা না জানা সবুজ গাছগাছালি ঝোপঝাড় বন খাল নালা পানি বালু। প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য হিসেবে প্রচুর তাল আর নারিকেলের গাছের আধিক্য। একটু পর পর তাল গাছের সারি। কাণ্ডশীর্ষে গলায় ফাস লাগানো কলসিগুলোর খোলা মুখে বাঁশের চোঙা, যা গাথা রয়েছে তালের কাঁধির যেকোন একটা কচি তালের বিশেষভাবে কর্তিত অংশে। গাছের গায়ে ছাল তুলে নগ্ন পরিষ্কার অংশ থেকে খেজুর গাছের রস সংগ্রহ করার পদ্ধতি তালের বেলায় ভিন্ন। রস সংগ্রহের এই পদ্ধতি খেয়াল করলে মনে হবে রসবিচারে রসালো অঞ্চলের গাছ হয়েও তালগাছ মোটেও রসালো নয়। অন্যদিকে শুষ্ক মরু অঞ্চলের প্রতিনিধি হয়েও এই খেজুর গাছের অসমতল কাণ্ড বা গুড়িটা এতো রসালো বা রসদানকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলো কী করে, তা ভাবলে বেশ আশ্চর্য হতে হয় বৈ কি।

ক্লান্তির সাথে তৃষ্ণায় গলা খাঁ খাঁ করছে। ক্ষুৎপিপাসায় কাবু হয়ে একটু ছায়া দেখে একটা গাছের নীচে জিড়িয়ে নিতে বসে পড়লাম দুজনেই। কিন্তু পানি পাই কোথায় ? চোখ গেলো কাছের আরেকটি তালগাছের শীর্ষে। লোকটি বিশেষ কায়দায় গাছে চড়ে একটা দড়ি দিয়ে নিজেকে গাছের সাথে লুজ করে পেচিয়ে পেছনের দিকে শূন্যে শরীরটাকে ছেড়ে দেয়ার সাথে সাথে দড়িটা তাকে টেনে ধরলো। যেন একটা ইজি চেয়ারে হেলান দিয়ে আছে এই ভাব নিয়ে লোকটি রসে ভর্তি হয়ে ওঠা কলসিটা খুলে তাঁর কোমড়ে বাঁধা একটা গাছের ডালে তৈরি প্রাকৃতিক আংটায় বিশেষভাবে ঝুলিয়ে দিলো। আর কোমড়ের অপর পাশে ঝুলানো খালি কলসিটা গাছের সাথে যথানিয়মে বেঁধে আটকে দিয়ে ধীরে ধীরে বিশেষ কায়দায় নীচে নেমে এলো। তাকেই ডাকলাম আমরা।

জনমানবহীন নির্জন তল্লাটে গ্লাস মেপে রস বিক্রি হয় না। মূলত পাটালিগুড় তৈরি জন্যই এই রসের কারবার। এই রস থেকে প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণে পাটালিগুড় তৈরি হয়ে গোটা দেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। লাভজনক অর্থকরী ফসল। অর্থ উৎপাদনের অন্যতম প্রধান খাত হিসেবে ব্যক্তিপর্যায়ে তাল গাছ লিজ নেয়া অত্যন্ত জনপ্রিয় ব্যবসা এখানে। পিপাসা মেটাতে লোকটি এমনিতে মগে করে রস দিতে চাইলেও আমরা এই গরীব বেচারার থেকে বিনা পয়সায় রস খেতে নারাজ। অবশেষে বড় এক কলসি রস কিনে নিলাম নির্ধারিত বিশ টাকা মূল্যে। কোন মুলামুলি ছাড়া একদামে কিনে নেয়ায় লোকটি বিস্মিত হলেও আমরা বিস্মিত এতো বড়ো রসের কলসি মাত্র বিশ টাকা !

দু’মগ করে দু’জনে চার মগ রস তো গিললাম না, মনে হলো যেনো অমৃত পান করছি। ক্লান্ত তৃষ্ণার্ত বলে নয়, সদ্য নামানো তালের রস আদতেই খুব সুস্বাদু। কিন্তু দুমগেই পেট ঢোল হয়ে গেছে। টাকাসহ গোটা কলসিটাই ফেরত নিতে নিতে লোকটি বোধ করি ভাবলো, প্যাণ্ট শার্ট পড়া কেতাদুরস্ত এই ভদ্রলোক দুটোর নিশ্চয়ই মাথায় ছিট আছে। এই গরমে রসের হাড়ি পেটে যেতেই চোখে যে রঙ জমতে শুরু করেছে, তা কি আর বুঝতে পেরেছি তখন ! আহা, পৃথিবীটা কতো তৃপ্তিকর আনন্দময় ওঠছে ! একটা মধুর তন্দ্রায় পেয়ে গেছে দুজনকেই। হালকা ঝিরিঝিরি বাতাস তো নয়, স্বর্গ থেকে অন্সরীদের আঁচল দোলানো নৃত্য যেন ! রসে জমতে জমতে এই নৃত্যের মধ্যেই মজে গেলাম।

হাঁক ডাক শুনে চোখ মেললাম। সেই লোকটি। সূর্য অস্তাচলে। রসের কলসি পাল্টাতে এসে জনমানবহীন নির্জন তল্লাটে ঘাসের উপরে সেই ভদ্রলোক দুটোকে অঘোরে পড়ে থাকতে দেখে যা বুঝার বুঝে ফেলেছে। হায় হায় ! এখান থেকে অফিসে ফিরতে তো রাত হয়ে যাবে ! টর্চও সাথে আনা হয় নি। এরকম পরিস্থিতি হবে কেউ কি ভেবেছিলাম ! লোকটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে তড়িঘড়ি হাঁটা দিলাম। ভয়ানক বিপদের কথা। যেভাবে বাহ্যজ্ঞান লুপ্ত হয়ে পড়েছিলাম, মুহূর্তেই সর্বস্বান্ত হয়ে যাওয়াটা কোন বিষয়ই ছিলো না। মনে মনে লোকটির প্রতি কৃতজ্ঞতায় ভরে ওঠলো বুক।

পথেই সন্ধ্যা পেরিয়ে ঘুটঘুটে রাত নেমে এলো। একে তো জোয়ারে টইটম্বুর খাল নালা আশপাশ। তার ওপরে সবকিছু অন্ধকারে একাকার হয়ে যাচ্ছে। আতঙ্ক চেপে ধরলো দুজনকেই। হঠাৎ একটা টর্চের তীব্র আলো এসে পড়লো। জনাকয়েক লোকের সাড়া পেলাম। স্যার নি ? রাত হয়ে যাওয়ায় সহকর্মীরা আন্তরিক দায়িত্ববোধ নিয়ে খুঁজতে বেরিয়েছে। আবারো কৃতজ্ঞ হলাম।

(১২)
কী ব্যাপার , আজ লঞ্চের সাড়া পেলাম না যে ? লঞ্চ কি আসে নি ? লঞ্চডুবি হয়েছে কোথাও ? না, লঞ্চডুবি হবে কোত্থেকে ! লঞ্চই তো চলেনি আজ। মানে ! ধর্মঘট। অনির্দিষ্টকালের জন্য লঞ্চ ধর্মঘট শুরু হয়েছে দক্ষিণাঞ্চলের সব রুটে। দাবি দাওয়া নিয়ে আগে থেকেই সরকারকে হুমকী ধামকী দিয়ে আসছিলো। সরকার কোন গা করে নি বলে এবার এরা সত্যি সত্যি ধর্মঘটে নেমে গেছে।

এ অঞ্চলের একমাত্র যাতায়াত মাধ্যম নৌপথ। দূরবর্তী গন্তব্যে যাওয়ার জন্যে লঞ্চের বিকল্প নেই। দেশের বিশাল একটা অঞ্চলের মানুষ এই লঞ্চমালিক আর সরকারের দ্বৈরথে দিব্যি জিম্মি হয়ে গেলো। আমার রিলিজের ডেট আরো এগারো দিন বাকি। এর মধ্যে যে একটা সমাধান হয়ে যাবে, তাতে আমি নিশ্চিৎ। কিন্তু একদিন যায় দুদিন যায় তিনদিন যায় চারদিন পাঁচদিন এমন কি সপ্তা কেটে গেলো, কোন সাড়াশব্দ নেই। ধর্মঘট চলছেই। এবার ভেতরে ভেতরে একটু চুপসে গেলাম। তবু তীব্র আশায় আশাবাদী হলাম, দশদিনের মধ্যে একটা হেস্তনেস্ত তো হবেই। আবার অস্বস্তি, কিন্তু যদি না হয় ?

দশদিন গত হয়ে গেলো। ধর্মঘট ভাঙলো না। কঠিন দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম। রিলিজের জন্য অনিশ্চিৎকাল অপেক্ষায় থেকে শেষপর্যন্ত যদি অফিস অর্ডার ফিরে যায় ! তাহলে আবার কবে কোন কালে পুনরায় অর্ডার হবে তার কি কোনো ঠিক ঠিকানা আছে ? না, নিজেকে এভাবে অনিশ্চয়তার হাতে ছেড়ে দিতে রাজী নই আমি। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম, আগামীকাল ঠিকই রিলিজ নিয়ে নেবো। মাঝখানে পাঁচদিনের ট্রানজিট লীভ ধরে সাত দিনের দিন যোগদান করতে হবে নতুন কর্মস্থলে। এই সাত দিনেও কি যাওয়া যাবে না ? পরিহাসছলেই আমার সমস্ত জিনিস পত্র সহকর্মীদের কাছে অকশনে তুললাম। অত্যন্ত সস্তা বিধায় কাঁঠাল কাঠের কিছু ছোটকাটো ফার্নিচার বানিয়েছিলাম কয়েকজন মিলে গোটা একটা গাছ কিনে। বহু কারিশমা করে যে টি-টেবিলটা বানাতে খরচ হয়েছিলো সাড়ে পাঁচশ’ টাকা, ওটার সর্বোচ্চ দাম ওঠলো একশ’ টাকা। তাই সই। এভাবে তিনশ’ টাকার জিনিস ত্রিশ টাকা, চারশ’ টাকার জিনিস বিশ টাকা। এরকম অদ্ভুত অকশন শেষে ওয়ানটাইম খাটের কোন দরদাতা না পেয়ে এবার হাতেমতাঈ হতেও দ্বিধা রইলো না। শেষপর্যন্ত মায়ার সংসারে খালিহাতে আসা যাওয়ার মতোই যেভাবে এখানে এসেছিলাম, অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলাম যে কেবল সেগুলোই আবার ফেরৎযাত্রার সঙ্গি হতে যাচ্ছে ! কাঁধে ঝোলানো ব্যগভর্তি বই আর কাপড়-চোপড় এবং হাতে ঝোলানো বেডিংটাই।

যথাসময়ে রিলিজ নিয়ে নিলাম। এদিকে এগারো দিনেও অনির্দিষ্টকালের লঞ্চ ধর্মঘট চলতেই থাকলো। পরেরদিন সকালে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যাত্রা করার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে নৌকা ভাড়া করার খোঁজে বেরুলাম। উদ্দেশ্য কোনভাবে বরিশাল পর্যন্ত পৌঁছানো। তাহলে ওখান থেকে বাসে করে সোজা ঢাকা। কিন্তু আমুয়াবন্দর থেকে নৌপথে এতদূরের রাস্তা বৈঠানির্ভর নৌকায় অকল্পনীয় ! অতঃপর সিদ্ধান্ত নিলাম ভেঙে ভেঙে রাস্তা কমাতে থাকবো। প্রতি জায়গায় নতুনভাবে নৌকা ভাড়া করে করে যখন বা যেদিনই পৌঁছাই। পকেটে পুরো মাসের বেতন। প্রয়োজনে যাতায়াতে সব যাবে। তবুও আমি এই বদ্ধ আয়তন ভেঙে বেরুতে চাই। সেই মতোই প্রথম ভাগের নৌকা ভাড়া করে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে গেলেও ঘুম আর হলো না এক অনিশ্চিৎ অজানা অস্থিরতায়।

সকালের প্রাতঃরাশ সেরেই ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে নিলাম। সব সহকর্মীসহ যাঁদের সাথে মেলামেশা ছিলো স্থানীয় অনেকেই এসেছেন নদীর পাড়ে। যেখানটায় প্রতিদিন বিকেলের অনিবার্য গন্তব্য ছিলো এতোদিন। নৌকায় সওয়ার হতেই মাঝি বৈঠার এক ধাক্কায় নৌকাটাকে ডাঙাছোঁয়া মুক্ত করে ভাসিয়ে দিলো। সাথে সাথে বুকের কোথাও যেন এমনই এক ছিন্ন হবার টান পড়লো। দুলে ওঠলাম। মুক্ত জলে ভাসার আনন্দে, না কি এতোদিনের মায়া পড়া ছোট্ট এই ডাঙা থেকে ছিন্ন হলাম বলে, জানি না। তবে বুকের ভেতর কী যেন গুমড়ে গুমড়ে ওঠতে চাইলো। এই সেই ডাঙা, উনত্রিশে এপ্রিলের এক ভয়াবহ প্রলয়েও আমাকে আগলে রেখেছিলো গভীর যত্নে। আর আজ বেয়াড়া আমি তার কোলকে জোর করে ছিন্ন করলাম !

ধীরে ধীরে ডাঙা দূরে সরে যেতে থাকলো। সহকর্মীরা তখনো পাড়ে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছে। আমিও নাড়ছি। দূর থেকে হঠাৎ তাদের মধ্যে একটা চাঞ্চল্য দেখা যাচ্ছে। চিৎকার করে হাত ইশারায় আমাকে পেছনের দিকে কী যেন দেখাতে চাচ্ছে। পেছন ঘুরেই দেখি নদীর ঠিক মাঝখানটাতে গুটগুট করে ছোট্ট লঞ্চটা এগিয়ে আসছে ! কী ব্যাপার ! ধর্মঘট কি তাহলে... ! হাত তুলে দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। ধীরে ধীরে গতি কমে এলো লঞ্চটার। মাঝ নদীতেই নৌকা থেকে আমাকে সরাসরি লঞ্চে তুলে নিলো। বরগুনা থেকে ছেড়ে এসেছে বরিশালের উদ্দেশ্যে। আহ্ ! বেরিয়ে যাওয়া দীর্ঘশ্বাসের সাথে বুকটা খুব বেশি খালি হয়ে যেতেই বুক ভরে নদীর জলল হাওয়া টেনে নিলাম আবার।

বাঁক ঘুরেই লঞ্চটা আবার ভরাবর্ষার দু’কুলহারা বিষখালিতে পড়তেই আমুয়া বন্দরটা চোখের সামনে থেকে ধীরে ধীরে অপসৃত হয়ে গেলো। আহা, এ জীবনে আর কখনো কি আসা হবে এখানে ! তীব্র তৃষ্ণায় বুকটা ফেটে যেতে চাইলো। লঞ্চের পেছনে কেবিনে গিয়ে এক গ্লাস জল চেয়ে নিলাম। মুখে নিতেই খিচরে এলো, পানি এতো পানসে বিস্বাদ কেনো !
লোকটির চোখে কৌতুক, বিস্বাদ হইবো ক্যান ? এইডা তো মিষ্টি পানি !!!

---------------------

(স্মৃতিভ্রষ্ট নোট)
প্রায় দেড় যুগ পর আমুয়াবন্দর থেকে হঠাৎ একটা মোবাইল কল এলো ! বিস্ময় নিয়ে জানলাম, ওখানে এখন সরাসরি বাসও চলে ! হয়তো অনেক কিছুই হয়ে গেছে নতুন। এই পুরনো চোখ দুটোর গভীরে আঁকা সেই পুরাতন জীবনের দৃশ্য কেবল স্মৃতিই এখন। মিলিয়ে নেয়ার মতো সে সবের কিছু অবশিষ্ট আছে কিনা তাও জানি না। তবু মাঝে মাঝে মনে হয়, সত্যি কি নেই ? স্মৃতিরা কি দীর্ঘশ্বাস ? একবার বেরিয়ে গেলে প্রশ্বাসের সাথে একটুও কি ফিরে আসে না ? এর উত্তর আমার জানা নেই। যেভাবে জানা নেই কারা এর উত্তরটুকু সত্যিই জানেন !
(২৬/০৯/২০০৮)

[mukto-mona]
[khabor.com]
[sa7rong]
[sachalayatan]Episode[01][02][03][04][05][06][07]

Thursday, September 25, 2008

@ আমার মূর্খতা শুধরে দিতে জুবায়ের ভাই কি আসবেন ?







আমার মূর্খতা শুধরে দিতে জুবায়ের ভাই কি আসবেন ?
রণদীপম বসু


| রণদীপম বসু | সোম, ২০০৮-০৯-০১ ০২:৫৬

ইদানিং কারো কোনো অসুস্থতার খবর পেলেই ভীত হয়ে পড়ি খুব ! আমি জানি আমার এই ভীতি অমূলক। জুবায়ের ভাইয়ের সুস্থতার জন্য আমার সমস্ত শুভকামনা উন্মুক্ত রইলো। এবং তখনি স্বস্তি পাবো, যখন সচলের শীর্ষে দেখবো সেই প্রিয় বাক্যাংশটুকু-
'লিখেছেন মুহাম্মদ জুবায়ের'।
[নামের বানান ভুল করলাম কি ? তাহলেও ক্ষমা যেন পাই জুবায়ের ভাইয়ের পোস্টের মাধ্যমে]

প্রতিমুহূর্তের জন্য শুভ কামনা।


সচলের অত্যন্ত দায়িত্বশীল একজন ব্লগার তানভীর। ‘জুবায়ের ভাইয়ের অসুস্থতা (সর্বশেষ আপডেটসহ)’ শিরোনামে গত ৩১.০৮.২০০৮ তারিখ তাঁর পোস্ট করা চলমান আপডেট লেখাটি পড়েই যতদূর মনে পড়ে প্রথম অসুস্থতার খবর জানলাম। এবং একটা উৎকণ্ঠা বুকে জমা হয়ে গেলো। এ প্রেক্ষিতে আমার করা মন্তব্যটিতে জুবায়ের ভাইয়ের নামের বানান শুদ্ধ করে লিখেও হঠাৎ করে কেন সন্দেহ হলো যে বানান ভুল করলাম ? বাংলা বানানের ব্যাপারে কিছুটা খুঁতখুঁতে স্বভাব থাকা সত্ত্বেও স্ক্রল করে ওই পোস্টের উপরে গিয়ে সন্দেহমুক্ত না হয়ে কেনই বা থার্ড ব্র্যাকেটে সন্দেহযুক্ত বাড়তি মন্তব্য যোগ করেছিলাম, তার উত্তর আমার জানা নেই। অথচ মুহম্মদ লিখতে ঠিকই মুহাম্মদ লিখে বসে আছি ! তবে কি বুকের খুব গভীরে ভেতরে ভেতরে এরকম কোন অনৈতিক তৃষ্ণা লুকানো ছিলো যে, জুবায়ের ভাই সুস্থ হয়ে ওঠে এসে এক অন্যরকম ভালোবাসায় এই পোস্টে হাঁটাহাঁটি করতে করতে আমার মন্তব্যে এসে হোঁচট খাবেন ? খোদ তাঁরই নামের বানানে সন্দেহ ! ফালতু মন্তব্যের জন্য রেগেমেগে মাতৃভাষায় লেখক হিসেবে ভাষা ও বানানের সন্দেহাতীত শুদ্ধ হওয়া নিয়ে বকাঝকা মার্কা একটা বিশাল পোস্ট দিয়ে রাতারাতি আমাকে বিখ্যাত (কুখ্যাতও বিপরীতভাবেই বিখ্যাতও) করে দেবেন ? কিন্তু তিনি তো নিপাট ভদ্রলোকই ছিলেন।

পরে তানভীরের এই পোস্টের আপডেটগুলো বিভিন্ন সময় চেক করার পাশাপাশি মাঝখানে তাঁর শারীরিক উন্নতির খবরে বেশ উল্লসিতও হয়েছিলাম। ফাঁকেঝোঁকে মন্তব্য করে তা প্রকাশও করেছি। কিন্তু অবস্থা ফের ইউটার্ণ নিতেই গত ২২.০৯.২০০৮ এ যে মন্তব্য করলাম, ওখানে কোন্ বোধটা বলবান ছিলো ? আশা, না কি হতাশা ? তা আর বুঝে ওঠা হলো না।

| রণদীপম বসু | সোম, ২০০৮-০৯-২২ ১২:১৪

আমাদের দুর্ভাগ্য যে, না চাইলেও আমাদেরকে মাঝে মাঝেই খুব হতাশার খবরও শুনতে হয়।
এই হতাশার অন্ধকার কাটিয়ে এক মুঠো আলোর তৃষ্ণা বুকে ধরে রাখলাম।


আজ ব্লগে ঢুকেই যে ভয়ঙ্কর সত্যের মুখোমুখি হলাম তা কি মানতে পারলাম আদৌ ? হাহ্ , মানুষের নির্বুদ্ধিতায় সত্যের কী যায় আসে ? সত্য সত্যই। তীক্ষ্ণ, তীব্র, তিক্ত। টলানোর সাধ্যহীন অবিচল পাথরের মতো চাপা সে দেবেই। তবু গতকাল তাঁর কনিষ্ঠ সহোদর ব্লগার আনিস মাহমুদ এর মন্তব্যটা পড়েও কি মানুষের চিরায়ত দুর্মর আশাকে সত্যিই নতজানু করা গেলো ?

| আনিস মাহমুদ [অতিথি] | বুধ, ২০০৮-০৯-২৪ ২১:৪০

এইমাত্র কথা হল ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মিশিগানপ্রবাসী ডাক্তার জাকিরের সাথে। জাকির ভাইকে ধন্যবাদ; সুদূর মিশিগান থেকেও তিনি এখানকার ডাক্তারদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। এর মধ্যে অ্যালেন থেকেও ঘুরে গেছেন একবার। নিজে থেকে পয়সা খরচ করে ফোন করেছেন। যা যা তিনি জানালেন, নিচে তুলে দিচ্ছি:

- ভাইয়ের ফুসফুসে দুটো ক্ষত হয়েছে বলে নিজে থেকে শ্বাস নিতে পারছে না বললেই চলে। এই কারণে তাকে ভেন্টিলেশনে রাখা হয়েছে।

- ফুসফুসের পাশাপাশি এখন কিডনি ও লিভারের সমস্যাও দেখা গেছে। উচ্চশক্তির অ্যান্টিবায়োটিকের কারণেও অবশ্য এমনটি হতে পারে বলে ডাক্তারদের ধারণা। তবে তার শরীরে গুরুতর কোনো সংক্রমণ পাওয়া যায়নি বলে অ্যান্টিবায়োটিক আজ থেকে বন্ধ করে দিয়ে পর্যবেক্ষণে রাখা হবে, তার কিডনি আর লিভারের অবস্থার উন্নতি হয় কি না দেখার জন্য।

- ভাইয়ের ব্লাড প্রেশার হঠাত্ হঠাত্ কমে যাচ্ছে বলে আজ তার সেই পরীক্ষাও করা হবে।

- উচ্চশক্তির স্টেরয়েড প্রয়োগের কারণে ভাইয়ের রক্তে শর্করা বেড়েছে অস্বাভাবিক মাত্রায়। আগে থেকেই ছিল অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস ছিল। স্টেরয়েডের ফলে এখন তা চূড়ান্ত আকার ধারণ করেছে।

- সব মিলিয়ে বোঝা যায় যে, প্রতিরোধব্যবস্থা আস্তে আস্তে ভেঙে পড়ছে।

আমি চেষ্টা করছি প্রতিবেদকসুলভ নিস্পৃহতা বজায় রাখতে। পারছি কোথায়? বাস্তববুদ্ধি দিয়ে বুঝতে পারছি আশা নেই। মন তো সেটা মানছে না।

মন মানুক আর নাই মানুক, মনে হচ্ছে তৈরি হতেই হবে।


জুবায়ের ভাই আর নেই ! স্তম্ভিত বিস্ময়ে নতজানু হতে হতে এস এম মাহবুব মুর্শেদের একচিলতের অনিবার্য পোস্টে শেষমেশ আমি সেই নামের নিঃসন্দেহ বানানটাই ভুল লিখলাম ? এতো বেশি চর্চিত হয়েও ভুল নামের মন্তব্যে জুবায়ের ভাইয়ের প্রতি নতজানু শ্রদ্ধায় শোকার্ত হয়েছি তো ঠিক, তবু তাঁকে কি ফের অপমানই করলাম ?!

| রণদীপম বসু | বিষ্যুদ, ২০০৮-০৯-২৫ ১৯:০১

হিমুর পোস্টে মন্তব্য করেই এখানে এসেছি।
ঢাকায় এখন সন্ধ্যা সাতটা, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০০৮। ক্যালেন্ডারে যতক্ষণ না এ তারিখ পাল্টাবে, এ মন্তব্যের পর থেকে সচলে আমার সমস্ত অক্ষরগুলো নতজানু হয়ে জোবায়ের ভাইকে শোকার্ত শ্রদ্ধা জানাবে। আর আমার নতুন কোন অবাধ্য অক্ষর এসে যাতে এ নীরবতা ভাঙতে না পারে, আমি লগআউট হয়ে থাকবো।
আমার সমস্ত পোস্টগুলো নতজানু এখন। আমিও।


ক্ষমাহীন এ অপরাধ আমার। জানি না সে কি অজান্তেই হলো, না কি বোধশূন্যতার ঘোরে বিকারগ্রস্ত হয়ে এক অন্তহীন অচেনা আশায় অবচেতনেই চিরতৃষ্ণার্ত হয়ে ওঠেছিলাম ? এমন বেয়াদবি মূর্খতা সইতে না পেরে যদি সত্যি সত্যি চিরশয্যা ছেড়ে উঠে আসেন তিনি, আর বিনম্র ক্ষোভে ঝেড়ে ওঠেন, ‘আপনি কি অন্ধ ! জানেন না, আমি জোবায়ের নই ? মুহম্মদ জুবায়ের !’
অনেকের কাছে সচলায়তনের হেডমাস্টার বলে পরিচিত এই কলমবৃক্ষটিকে তখন প্রাণ ভরে দেখতাম আমি ফের !

আহা, আমার এ মূর্খতাকে শুধরে দিতে তিনি কি আসবেন আর কখনো ? কী হবে আমার ক্ষমাহীন অপরাধের ?
(২৫/০৯/২০০৮)

[sachalayatan]

Wednesday, September 24, 2008

@ মনোবিকলন না কি ছিটগ্রস্ততা...! (গদ্যপ্রলাপ)




মনোবিকলন না কি ছিটগ্রস্ততা...! (গদ্যপ্রলাপ)
রণদীপম বসু


দ্বিতীয় অংশ:

এরকম সমস্যায় একটাই উপায়। মেডিটেশন ! বিছানায় চিৎ হয়ে একনিবিষ্টে ছাদের দিকে হা করে তাকিয়ে লাশের মতো জপতে থাকলাম, আমি অমুক, বয়স এতো, সাংঘাতিক ধরনের মহাজ্ঞানী পুরুষ। স্ত্রী অমুক, কটমটিয়ে তাকানোর বাতিক থাকলেও মানুষ খারাপ না। তবে নির্বোধ রমণী। পৃথিবীর সবাই ভয়ঙ্কর ধরনের লেখক হয়ে উঠুক এটা তার ফেভারিট চাওয়া, শুধু অথর্ব স্বামীটি বাদে। একমাত্র সন্তানের নাম অমুক, বয়স এতো, নাকের দুধ না শুকালেও জলজ্যান্ত বিদ্যাসাগর, একেবারে ট্যাবলেট সংস্করণ। আর আমি ? জগতের এমন কোন বিষয় নেই যা আমার অগম্য। একেবারে নখদর্পণে। ইচ্ছে করলেই আমি যে দিকে তাকাই ভূত ভবিষ্যৎ সব বলে দিতে পারি......

মেডিটেশনে কাজ দিতে শুরু করেছে ! চোখে মুখে শীতল পরশ টের পাচ্ছি। শুধু শীতলই নয়, হিম ঠান্ডা ! আহ্, বিদ্যুৎহীন অন্ধকারেও মেডিটেশনের কী দ্রব্যগুণ ! আমার মনে পড়তে লাগলো মাসুদা ভাট্টির পোস্ট ভি এস নাইপলকে নিয়ে নোবেল বিজয়ী আত্মম্ভরী মর্ষকামী, জুলিয়ান সিদ্দিকীর তিতিক্ষা, ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরের ধর্ম নিয়ে কী ভয়ঙ্কর পোস্ট লালন কি জাত সংসারে, গৌতমের কনফেশন নিজেকে যাচাই করা হয় না অনেকদিন, আর অতন্দ্র প্রহরীর দুঃখ বিলাস বুড়ো হয়ে যাচ্ছি ! এখনো বাকি রয়ে গেছে ফারুক ওয়াসিফের গান ও কবিতা শোনা, ফারুক হাসানের ফের্মার শেষ উপপাদ্য মিলানো, এস এম মাহবুব মুর্শেদের পিটসবার্গের ধুসর পান্ডুলিপির খোঁজ করা, হাসান মোরশেদের অরুন্ধতী পাঠ এবং দেবোত্তম দাশের সূর্যাস্ত সহ আরো কতো কিছু ! এবং অন্ধকারে আমি সব দেখতে পাচ্ছি ! কে বলেছে অন্ধকার ! ঝলমলে আলো। কিন্তু সামনে দাঁড়ানো এ কে ? ফ্রিজিং ওয়াটার বোতল হাতে এমন দজ্জাল চেহারার রমণীকে আমি কি আগে দেখেছি কোথাও ? ওমা, অশিষ্টের মতো কথাও তো বলছে দেখি !
কী ব্যাপার ? হেমায়েতপুরের সিরিয়াল দিয়েছো কবে ? তোমার যা অবস্থা, ওখানেও রাখবে না ! এই জঞ্জাল শেষ পর্যন্ত আমার গলাতেই ঝুলবে ! অসুবিধা নাই, এর চিকিৎসাও আমার জানা আছে।
এ..এ..এ্যাঁ..!!! মেডিটেশন কি উল্টো হয়ে গেলো ? আবার করতে হবে !
ধপাশ করে চিৎ হয়ে পড়লাম !

প্রথম অংশ:

আজ সচলে লগইন করে যারা যারা পোস্ট দিয়েছেন এবং বিভিন্ন পোস্টে মন্তব্য করেছেন, প্রত্যেকে যার যার মোটমাট লেখা ও মন্তব্য সবগুলো একত্রে ধারাবাহিক সমাবেশ ঘটালে এগুলো দেখে কার কতটুকু মনোবিকলন ঘটেছে তা কি আদৌ যাচাই করা সম্ভব ? মনোসমীক্ষণবাদী দার্শনিক ফ্রয়েড থাকলে কী করতেন জানি না। এ থেকে নতুন কোন থিওরী বেরিয়ে আসতো কিনা তাও বলতে পারবো না। আর আজকে আমি কোন কারণে ছিটগ্রস্ত হয়ে ওঠেছি কিনা সেটা গবেষণার বিষয় হলেও হতে পারে। তবে সচলে ঢুকেই ভারি ভারি লেখাগুলোর দিকেই আজ মনোযোগ আকৃষ্ট হলো বেশি।

সব দিন এমনটা হয় না। কোনদিন হয়তো কোথায় কোথায় ফান থাকতে পারে ধারণা করে সেখানে ঢু মারি। আবার কোন দিন হয়তো কাব্যে পেয়ে বসে। কোন দিন মন্তব্য করার বাতিকে এমন জাপটে ধরে যে তা থেকে আর ছুটতেই পারি না। আবার এমনও দেখা গেছে সেদিন লগইন না করেই দু’তিন ঘণ্টা আয়েশ করে ঘুরাঘুরি করলাম এবং বহুৎ তৃপ্তি বোঝাই হয়ে হাঁসের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে বিছানায় উঠে গেলাম। কিন্তু আজ এমন সব আকর্ষণীয় লেখায় সচলের পাতাটা সমৃদ্ধ হয়ে ওঠলো যে খুঁজে খুঁজে সেগুলোতেই ডুব সাঁতার দিতে থাকলাম আর দমবন্ধ হবার আগে নিজেকে আবিষ্কার করলাম আমি হাঁপাচ্ছি। কারণ আমাদের সচলদের জন্য আমি সত্যিই গর্ববোধ করি এ জন্যেই যে চোখ একটা নয়। ফ্রান্সিস বেকনের সেই মৌমাছিদের মতো তাঁদের অনেকগুলো চোখ। এবং এ চোখগুলো দিয়ে তাঁরা যাই আহরণ করছেন কী চমৎকার মধু বানিয়ে এনে ছেড়ে দিচ্ছেন সচলের পাতাটাতে। এটা যেন পাতা নয়, জলজ্যান্ত মৌচাক একটা।

কিন্তু মধুর অনেক গুণাগুণের মতোই এটাও নিশ্চয় বিরাট গুণ যে, সাধ্যের বেশি গিললেই মাঘের শীতেও নাকি রাতভর ঠিকানা হয়ে ওঠে পাশের শীতল ডোবাটাই। আমার অবস্থাও কি তাই ? অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলাম মাত্র গুটিকয় পোস্টে ঘোরাঘুরি করেই এবং মধু একটু বেশি খেতে গিয়েই মরিমরি অবস্থা। মহামতি ফ্রয়েড থাকলে হয়তো একটা সমাধান চাওয়া যেতো। আড়চোখে ফোলা বেলুনের মতো নিজেকে বিশালভাবে দেখে মুই কি হনুরে ভাবতে ভাবতে যেভাবে আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলছিলাম, হঠাৎ এভাবে সর্বসমক্ষে ফুস করে চুপসে গেলাম ! মাথার ভেতর কোষগুলো তার সমস্ত সংবেদনশীলতা নিয়ে কিলবিল করতে লাগলো এবং এক সময় সচল ছেড়ে সোজা বিছানায় চিৎ হয়ে পড়ে রইলাম। কেন এমন হবে ? মাথার ধারণক্ষমতা কি ক্রমেই পড়ে আসছে ? এ ব্যাপারে মহাজ্ঞানীরা কে কী বলেছেন মনে করতে চেষ্টা করলাম। কী আশ্চর্য, মাথার ভেতরটা এক্কেবারে ফাঁকা ! এবং আরো আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করলাম একটু আগে কোথায় কী মন্তব্য করেছি তাও ক্রমেই ঝাপসা হয়ে আসছে ! এখন উপায় ?

তৃতীয় অংশ:

প্রযোজ্য নয়।

শেষ অংশ:

ফ্রয়েড নেই তো কী হয়েছে ? আমার মেধাবী সব সচল বন্ধুরা আছে না ! নিশ্চয়ই একটা না একটা তরিকা বেরিয়ে আসবেই। এটা কি মনোবিকলন না কি ছিটগ্রস্ততা ? তবে মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে শুনেছি কেসহিস্ট্রি না কি যেনো দিতে হয়। সে হিসেবে আমার আজকের কেসহিস্ট্রি অতি সরল।
এই যদি আমার আজকের কাহিনী হয়, তাহলে সচল বন্ধুদের কাছে আমার আরজি, বলেন তো ইহা কি মনোবিকলন, না কি সত্যিই ছিটগ্রস্ততা ? আমি কি আদৌ সুস্থ আছি ?

[sachalayatan]

Sunday, September 21, 2008

@ বিডিআর-এর ন্যায্যমূল্যের দুধ পরীক্ষা করবে কে.. ?









বিডিআর-এর ন্যায্যমূল্যের দুধ পরীক্ষা করবে কে.. ?
-রণদীপম বসু
...

বাজারে বিক্রিত সব ধরনের দুধের প্যাকেট বা কৌটায় একটা ব্রান্ড নেম থাকে। এ দুধে তা নেই। প্যাকেটের গায়ে বড় হরফে ইংরেজিতে লেখা রয়েছে ফুল ক্রিম মিল্ক পাউডার। অন্যান্য দুধের বাজার মূল্য থেকে কেজি প্রতি দু’শ টাকা কমে অর্থাৎ তিনশ’ টাকা কেজি দরে বিডিআর-এর ন্যায্যমূল্যের দোকানগুলোতে দেদারছে বিক্রি হচ্ছে। অপারেশন ডাল-ভাত ২০০৭ কর্মসূচির জন্য বিশেষভাবে প্যাকেটজাত এই দুধ বাংলাদেশ রাইফেলস কর্তৃক আমদানিকৃত বলেই কি এতে বিএসটিআই-এর দ্রব্যমান নিশ্চিৎকরণ সীল নেই ? প্যাকেটের গায়ে প্রস্তুতকারক হিসেবে সম্ভাব্য চীনা হরফে কী লেখা রয়েছে তার মর্মার্থ অভিজ্ঞ ব্যক্তিই বলতে পারবেন। কিন্তু চীন থেকে আমদানিকৃত ক্ষতিকারক মেলামাইন মিশ্রিত ভেজাল দুধ খেয়ে হাজার হাজার নিষ্পাপ শিশুর অসুস্থ হয়ে পড়া নিয়ে যখন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রীতিমতো তোলপাড় হচ্ছে, আমাদের কোমলমতি শিশুদেরকে আমরা অতিবিশ্বাস নিয়ে কী গেলাচ্ছি তা কি পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে ?

Saturday, September 20, 2008

# সবার মাথা-ই কি আউলায়, যেমন গুগল.. ?








সবার মাথা-ই কি আউলায়, যেমন গুগল.. ?
-রণদীপম বসু


কদিন ধরে ওয়েবে ঘুরাঘুরি করার সুযোগই পাচ্ছিলাম না সংসার ও জীবনের ব্যক্তিগত ব্যস্ততায়। অনলাইনে কোথাও এমন কি কোনো ব্লগেই সক্রিয়ভাবে ঢুকা হচ্ছিল না। শুধুমাত্র ই-মেইলগুলো দ্রুত চেক করে আর ফেসবুকের রিকোয়েস্টগুলো যাচাই করে ব্যবস্থা নেয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ রেখেছি নিজেকে। মাঝখানে বেশ লম্বা গ্যাপের পর সর্বশেষ দুদিন আগে গুগল ব্রাউজার ব্যবহার করেছি কতোক্ষণ। আমাদের মাস্টার আর্টিস্টদের কিছু বিখ্যাত সৃষ্টির ইমেজ খোঁজাখুজি করে ব্যক্তিগত ছবিব্লগে সংরক্ষণ করেছি এই যা।

সন্ধ্যায় অন্যদিনের মতোই যথারীতি কম্পিউটার অন করে ককরোচ বা আরশোলা সম্পর্কিত তথ্য জানার জন্য গুগল সার্চ দিয়েছি। সার্চে উইকিপিডিয়ার কেসলিঙ্কে ক্লিক করতেই একটি গুগল এরর ! ইংরেজিতে ককরোচ লিখে এবং পরে বাংলায় আরশোলা লিখে পর পর কয়েকবারই অভিন্ন চেষ্টা চালালাম। বারবারই একই গুগল এরর দেখাচ্ছে। আমি বরাবরই প্রযুক্তিকানা মানুষ। বিশেষ করে এই কম্পিউটার বা অন লাইন প্রযুক্তির অ আ ক খ-ও আমার আয়ত্তের বাইরে। ব্লগিং যেটুকু করি ঠেকতে ঠেকতে শিখে শিখে। তাই এই গুগল এরর ম্যাসেজটা আমার মধ্যে যে ভয় ঢুকিয়ে দিয়েছে তা কতোটা যুক্তিসঙ্গত তাও বুঝি না।

ততক্ষণে আরশোলা তো মাথা থেকে গেছেই, এরপর যা-ই সার্চ দেই, সংশ্লিষ্ট যে কোন লিঙ্কে ঢুকতে ক্লিক করলেই সেই একই ম্যাসেজ, গুগল এরর দেখাতে লাগলো। ভেতরের কনটেণ্টটুকু পড়ে কী বুঝলাম জানি না, এভিজি ফ্রি এণ্টিভাইরাস দিয়ে গোটা কম্পিউটার স্ক্যান করিয়ে নিলাম। কোন থ্রেডও দেখালো না। অথচ গুগল এররে বিনয়ের সাথে দুঃখ প্রকাশ করে যা বলছে তাতে কি আমার মতো কানা মানুষের মাথা খারাপ হবার জোগাড় নয় ?

এসবের কিছুই জানি না আমি। কেমনে কী করলে কীভাবে এ থেকে রেহাই পাবো তাও বুঝতে না পেরে সোজা গুগল থেকে সেই যে বেরিয়ে এসেছি আর ওমুখো হই নি। এখন শুধু একটা কাজই বাকি, ভ্যা করে কেঁদে দেয়া।

আমার কি এখন আতঙ্কিত হওয়া উচিৎ ? আপনারাই বলুন তো ঘটনাটা কী ?
(১৬/০৯/২০০৮)

[অরিজিনাল গুগল ম্যাসেজটা কপি করে যখনই ইউনিকোডেড পোস্টটা তৈরি করতে পেস্ট করেছি, তখন আর এক তুঘলকি কাণ্ড শুরু হলো। এবার আমার ব্যক্তিগত ব্লগস্পটই আউলায়ে গেল। কিছুতেই নিউ পোস্ট নিচ্ছে না। শুধু গুগল এরর ! তাই এররের কনটেণ্টটাকে বাংলা উচ্চারণে পাঠকদের জ্ঞাতার্থে তুলে দেয়া হলো। কিন্তু এখনও বুঝতে পারছিনা, শেষ পর্যন্ত আমার উপায় কী হবে!]

গুগল এরর

উই আর সরি...

... বাট ইয়োর কোয়েরি লুকস সিমিলার টু অটোমেটেড রিকোয়েস্ট ফ্রম আ্যা কমপিউটার ভাইরাস অর স্পাইওয়্যার অ্যাপ্লিকেশন। টু প্রোটেক্ট আওয়ার ইউজার, উই ক্যান’ট প্রোসেস ইয়োর রিকোয়েস্ট রাইট নাও।

উই উইল রিস্টোর ইয়োর একসেস অ্যাজ কুইকলি অ্যাজ পসিবল, সো ট্রাই এগেইন চুন। ইন দ্য মিনটাইম, ইফ ইউ সাসপেক্ট দ্যাট ইয়োর কমপিউটার অর নেটওয়ার্ক হ্যাজ বিন ইনফেকটেড, ইউ মাইট ওয়াণ্ট টু রান অ্যা ভাইরাস চেকার অর স্পাইওয়্যার রিমোভার টু মেক সিওর দ্যাট ইয়োর সিস্টেম আর ফ্রি অফ ভাইরাসেস অ্যান্ড আদার স্প্যুরিয়াস সফটওয়্যার।

ইফ য়্যু অ্যার কণ্টিন্যুয়ালি রিসিভিং দিস এরর, ইউ মে বি এবল টু রিসলভ দ্যা প্রোভলেম বাই ডিলিটিং ইয়োর গুগল কুকি অ্যান্ড রিভিজিটিং গুগল। ফর ব্রাউজার-স্প্যাসিফিক ইন্সট্রাকশনস, প্লিজ কনসাল্ট ইয়োর ব্রাউজারস অনলাইন সাপোর্ট সেণ্টার।

ইফ ইয়োর এনটায়ার নেটওয়াক ইজ এফেকটেড, মোর ইনফরমেশন ইজ অ্যাভেইলেবল ইন দ্যা গুগল ওয়েব সার্স হ্যাল্প সেণ্টার।

উই অ্যাপোলোজিজ ফর দ্যা ইনকনভেনিয়্যান্স, অ্যান্ড হোপ উই উইল সি ইউ এগেইন অন গুগল।


[sachalayatan]

@ এতো ভালো কি ভালো.. ?






এতো ভালো কি ভালো.. ?
-রণদীপম বসু


সচল প্রকাশ থেকে মেইলটা পেয়ে ভড়কে গেলাম। এমনিতেই আলকুঁড়ে মানুষ আমি। একটা নিরাপদ বালিশ আর গোটা কয় গোল্ডলীফের প্যাকেটই এখন পর্যন্ত মনে করি আমার জন্য পৃথিবীর সেরা উপহার। এর বাইরে ফরমায়েশী লেখার চাপে ব্যতিব্যস্ত আমার উপরে যখন ব্যক্তিগত ঝামেলাগুলোও মিছিল করে ছেকে ধরতে শুরু করে তখন কি আর দিশবিশ থাকে ? ফলে বেশ ক’দিন যাবৎ নেটেই ঢোকা হয় না। এরই মধ্যে মেইলে আবার রীতিমতো হুমকী ! নিয়মিতভাবে প্রাঞ্জল ভালো ভাবনা উদ্রেককারী লেখা লিখে যেতে হবে। আরে মোর জ্বালা ! আমি গাই কী, আর আমার সারিন্দা বাজায় কী !

সচলের উপর গোস্যা কি আমার কম ? অন্য অনেকের মতো আমারও যে দুরন্ত ক্ষতিটা ইতোমধ্যে করে বসে আছে তা হলো, এক সময় আরো গোটাকয় ব্লগে আমার নিয়মিত ঘুরাঘুরির সাথে লেখালেখিটাও চলতো সমানতালে। সচল সংশ্লিষ্ট হয়ে খুব আশ্চর্যের সাথে হঠাৎ আবিষ্কার করলাম ওগুলো কখন যে আমার দূরের বসত হয়ে গেছে নিজেও টের পাই নি ! খুবই দুঃখজনক কথা। নিজস্ব বরাদ্দকৃত সময় ও বাজেট অতিরিক্ত সময়গুলো এক সচলই যেভাবে দখল করে নিচ্ছে তাতে আমি সচল না হলেও যে অদৃশ্য সঙ্গি হয়ে সচলের আশেপাশেই ঘুরঘুর করতাম তা কি আর বলার বাকি রাখে ?

অতএব নিয়মিত প্রাঞ্জল ভালো ও ভাবনা উদ্রেককারী লেখা সচলে বেশি বেশি লেখা হোক বলে যে প্রত্যাশার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে, আমি এর সাথে দ্বিমত পোষণ করি। হা হা হা ! বিশ্বাস হচ্ছে না ! তাহলে আপনারাই বলুন, এই মিডিয়া বিস্তৃতির যুগে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ার বদলে যেভাবে সচলকুনো হয়ে যাচ্ছি তা কি আশঙ্কার বিষয় নয় ? এর চে’ বরং একসাথে এতো ভালো ভালো লেখা একযোগে প্রকাশ না হওয়াই তো উত্তম। এ জন্যেই কি রবি ঠাকুর তাঁর ‘শেষের কবিতা’য় বলে যান নি, ভালো যতো কম হয় ততই ভালো ?

অথচ কী আশ্চর্য, রবীন্দ্রনাথকেও অবহেলা করার দুঃসাহস দেখানো হচ্ছে ! আমি যাঁকে হৃদয়-মন দিয়ে অনেক অনেক শ্রদ্ধা করি। আর তাই যখনই দেখবো যে একসাথে অনেক অনেক ভালো লেখায় সচলের পাতাটা টইটম্বুর হয়ে আছে, চট করে একটা বাজে লেখা ছেড়ে দেবো আমি। অন্তত এর সাথে তুলনা করে ভালোগুলো যে আসলেই কতো ভালো তা যাতে সবাই বুঝতে পারে। হা হা হা ! আমি কি ঠিক বলি নি ?

সচল বন্ধুরা কী বলে, এতো ভালো কি ভালো ?
(১৯/০৯/২০০৮)

[sachalayatan]

Friday, September 12, 2008

@ মূর্খ...(গালগল্প)













মূর্খ...
-রণদীপম বসু


কম্পিউটর মনিটরে চৌকস সচলদের কেরামতিগুলো উপভোগ করছিলাম। হঠাৎ মোবাইলটা বেজে ওঠলো। সৌদি আরব থেকে কল। মোবাইলের মনিটরে ভেসে ওঠা নম্বরের শুরুতে প্লাস নয় ছয় ছয় দেখে তাই ধারণা করলাম।
স্লামালিকুম ? প্রশ্নবোধক সম্ভাষণ জানালাম।
রাকিব নি রে ? ওপাশ থেকে সরাসরি প্রশ্ল।
জ্বী না, আপনি নাম্বার ভুল করেছেন।
আমি সৌদি আরব থাইকা বলতেছি। আপনি কে ? ধমকের সুরে তার পাল্টা প্রশ্ন। যেন কোন্ ভয়াবহ অপরাধ করে ফেলেছি আমি ! সবিনয়ে বললাম, দেখুন আমি কে সেটা জরুরি নয়। আপনি কাকে খুঁজছেন সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।
এইটা কোন্ জায়গা ? আবার প্রশ্ন তার।
কিঞ্চিৎ বিরক্তই হলাম এবার। বললাম, দেখুন, ব্যক্তিগত মোবাইলের আবার কোন্ জায়গা কী ? এটা বাংলাদেশের যে কোন জায়গাই হতে পারে। আপনি যাকে চাচ্ছেন তাকে খুঁজুন।

এ মুহূর্তে হয়তো লাইনটা কেটে দেয়া উচিৎ। আমি তা করলাম না। কেননা কলটা আমি করি নি। অসৌজন্যতা দেখাই কী করে।
ওপাশ থেকে এবার নির্দেশের স্বর, আমি জানতে চাইছি এইটা কোন্ জায়গা ?
গুঁজো হয়ে বসে কম্পিউটারে ঘুরাঘুরির ঢিলেঢালা ভাবটা কেটে গেলো। টানটান হয়ে ওঠলাম। আপনি সম্ভবত ব্যক্তিসীমা লঙ্ঘন করছেন, শীতল কণ্ঠে জবাব দিলাম।
ওই মিয়া, আমি কি ডাকাইত, না ছিনতাইকারী ? এইটা কোন্ জায়গা কইলে কি আপনের মুখ খইস্যা পড়বো ? এক অর্থহীন তীব্র কটাক্ষ ঝরে পড়লো !

আমিও ততোধিক বিস্মিত ! একটা অদেখা অচেনা লোকের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয়, মিনিমাম ভদ্রতাও খুইয়ে বসে আছে ! আমারও রাগ চাপা থাকলো না।
আপনি তারচে’ও গুরুতর অপরাধ করে ফেলেছেন। কারো ব্যক্তিগত অধিকারবোধকে তোয়াক্কা না করাটা ডাকাতির চে’ও বড় ডাকাতি।
ওই মিয়া, আমারে জ্ঞান দিতে আইছো ? কী করো তুমি ?
আরে বলে কী ! এ রকম পাল্টা উত্তরে একেবারে হতবাক হয়ে গেলাম ! অপমানবোধ এতোটাই তীব্র হয়ে ওঠলো যে, এখন তো আর মোবাইল বন্ধ করে দেয়া যায় না, হেস্তনেস্ত একটা করতেই হবে ! কণ্ঠে যতোটা সম্ভব দৃঢ়তা এনে কঠিন মেজাজে উত্তর করলাম, আমি কোন মূর্খ লোককে জ্ঞান দিতে যাই না কখনো।
কী কইলা ?
আমার তখন রোখ চেপে গেছে। ওপাশের বক্তব্যে বিন্দুমাত্র তোয়াক্কা না করেই বলে চললাম, মূর্খদের সমস্যা হচ্ছে এরা জানেই না যে এরা মূর্খ। খুব জ্ঞানীর ভাব নিয়া যেসব নির্লজ্জ মূর্খামী দেখায়, যারা তা দেখে, তারাও লজ্জায় মরে যায়। অথচ এই মূর্খরা বুঝতেই পারে না যে তার কাছা খুলে মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে।
অই শালার পুত থামবি ? না পাছায় লাত্থি দিমু ?
ঠাশ করে কে যেনো চড় মারলো গালে আমার ! বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গেলাম। এমন তীব্রস্পর্শী গালির ল্ক্ষ্য ইতিপূর্বে আর কখনো হয়েছি কিনা মনে করতে পারছি না। লজ্জায় অপমানে কান দুটো ঝা ঝা করতে লাগলো। এরকম হতবুদ্ধিকর তিক্ত অভিজ্ঞতায় এক্কেবারে বাকরহিত হয়ে গেলাম। ফেলফেল করে চেয়ে রইলাম মোবাইলটার মনিটরের দিকে।

হঠাৎ বিদ্যুচ্চমক খেয়ে গেলো। আরে, তা কী করে সম্ভব ! ওটা কি আমারই নম্বর !
(১১/০৯/২০০৮)

[sachalayatan]

Friday, September 5, 2008

@ তাঁর কথা মনে এলে...(সচল পেন্সিলে আঁকা-০৫)








তাঁর কথা মনে এলে...(সচল পেন্সিলে আঁকা-০৫)
-রণদীপম বসু



বিষণ্ন পঙক্তিমালা

‘একবার উঠেছিল, তবু মাঝপথে/ যেন থেমেছে করাত,/ শুধু গুঁড়ো পড়ে আছে।/ অর্ধেক খেলার পরে সমস্ত পুতুল গেছে উঠোন পেরিয়ে;/ অর্ধেক প্রেমের পর রোদ পড়ে এসেছে শরীরে/ অর্ধেক ঘুমের পর তুমি চলে গেছ।’......
-(অসমাপ্ত/ কাব্যগ্রন্থ:সদর স্ট্রিটের বারান্দা/ প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত)


এমন বিষণ্ন অসমাপ্তিই বুঝি জড়িয়ে থাকে মানুষের প্রতিটি জীবনে; জীবনের প্রতিটি কাণায়। ভিন্নতা হয়তো আকারে, প্রকারে আর উপলব্ধির সঘন বাস্তবতায়। তবু বিষণ্নতা তো বিষণ্নতাই। যাঁকে নিয়ে বলতে চাই, রক্ত-মাংসের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্যতা নিয়ে যিনি এই আলো হাওয়া জল মাটিতে একদিন ঘুরে বেড়িয়েছেন, আজ এক আলোকিত মুখচ্ছবি! তাঁকে নিয়ে বলার কীইবা সুযোগ ও সংগতি রয়েছে আমার? খ্যাতিমান ব্যক্তিকে সবাই চেনেন, কাছে বা দূরে নিজ নিজ অবস্থান থেকে। কিন্তু আমার চেনাটা কি আদৌ চেনা? গ্রহ বা নক্ষত্রকে জয় করেন যিনি, তিনি জানেন এর নাড়ির খবর। ছোঁয়ার দূরত্ব পেরোনো হয় না যার, তার তো শুধুই চলার ইতিহাস। আমাকেও বলতে হলে সেই চলার ইতিহাসই তো বলতে হবে।
একদিন কবিতাকে প্রাণের বান্ধব করে নিয়েছি বলেই জীবনের নানান ছত্রে ছত্রে পঙক্তিতে পঙক্তিতে কতো কবিতার মুখ নাড়া দিয়ে গেছে চেতনে অবচেতনে নির্জনে কোলাহলে; ভাবতে বসলেই বুকের ভেতরে আজ নড়ে ওঠে সেই সে আদিম পাথর। তাই, তাঁর কথা মনে এলে এসে যায় কবিতার কথা। স্মৃতিময় কবোষ্ণ পালকে মোড়ানো এইসব ভাবনার ফাঁকে উঁকি দেয়া এতো কবিতার মুখ; আমি কার কথা বলবো? এমনভাবে জড়িয়ে আছে সব যে, আমি কাউকেই আলাদা করতে পারি না আজ। তাঁদের প্রতি এক বিরাট কৃতজ্ঞতায় আবিষ্ট আমি আলোকিত মুখচ্ছবি আঁকতে বসে অসম্ভব আড়ষ্টতায় থেমে যাই। ওঠে আসে আরো সেইসব অসমাপ্ত মুখ। কবিতার নীল বৃষ্টি বুকে বয়ে আকস্মিক অভিমানে একদিন জীবনকে টা টা জানিয়ে চলে যাওয়া নোয়াগাঁও নিবাসী কবি বসির আহমেদ, গল্পে গল্পে খুঁজে ফেরা জীবনের গলি ঘুচির অন্ধকারে অকস্মাৎ নিজেই হারিয়ে যাওয়া তুখোড় গল্পকার মো: সিরাজ অথবা তারুণ্যকে ডিঙাতে না দেয়া এক চিরকেলে বিষণ্ন লাশের তরুণ হয়ে রয়ে যাওয়া কালিকচ্ছের ভাস্কর প্রসাদ চৌধুরী। মহাকালের বহমান স্রোতে এ মুখগুলো কি আর বুক ভরে শ্বাস নেবে কখনো! ‘অর্ধেক ঘুমের পর’ চলে গেছে এঁরা চিরায়ত ঘুমকে সাথে নিয়ে।
স্মৃতির বিষণ্ন দরজায় কড়া নাড়ে আরো কতো মুখ, কোন্ সে চলিষ্ণুতায় আবারও দেখা হবে তাদের সাথে? আতস কাচের বিম্বে মোড়ানো প্রবীণ চোখের বিবর্ধক দৃষ্টি দিয়ে উদার আকাশকে দেখে আর দৈনন্দিকতার অনিবার্য অনুষঙ্গ হয়ে ঘুমের বড়ির বদলে একটা কবিতা লিখে এখনো কি মধ্যরাতে ঘুমোতে যান কালিকচ্ছের বয়োজ্যেষ্ঠ কবি সুধীর দাস? জীবনের দূর্বার গতিময়তাকে বুকে ধরে সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গুপ্রায় যুবক সাংবাদিক সরাইলের তরিকুল ইসলাম দুলাল এখনো কি ফের উদ্দাম হয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখে? বুনো মোষের পেছনে দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে ফেরার নিশানা হারিয়ে কখন যে সবার হয়েও ভীষণ একাকী অস্তিত্ব নিয়ে কবি ও কবিতার ছন্নছাড়া পুরুষ হয়ে গেলেন কবি জয়দুল হোসেন; একাকী নিরালায় কোনো অচেনা ব্যথায় এখনো কি খুব বিষণ্ন কাতর হয়ে ওঠেন না তিনি? মনে পড়ে সেই মৃধা কামাল, বেলাল শামস নামের তরুণ মুখগুলোকে। স্বপ্নের বিচিত্র রঙে রঞ্জিত চোখের সতেজ আকাশটাতে কতো শতো চিত্রকল্পের ডানা ঝাপটানোর প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠতো! মফস্বলের অধ্যাপকীয় চোখে সেই কবিতার পাখিরা এখনো কি খেলা করে? অসম্ভব শিল্পী-সরল মনের সেই ওঠতি যুবক খোকন সেন কি আজো তবলা বায়া দু’হাতে ঝুলিয়ে ‘ধা-কেটে ধা-কেটে’ বোলে স্মিতপ্রায় হেঁটে যায়?
আরো অনেকের কথাই মনে পড়ে। জানতে ইচ্ছে করে খুব, ‘সাহিত্য ভুবন’ নামের আত্মস্পন্দন বুকে নিয়ে সুধীর দা’র দয়াময়ী হোমিও ফার্মেসী, কালিকচ্ছের তথা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ভাবসমৃদ্ধ সর্বধর্মসমন্বয়বাদী মহাব্যক্তিত্ব শ্রী মনমোহন দত্তের স্মৃতিবিজড়িত ‘আনন্দ আশ্রম’ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী ‘সাহিত্য একাডেমী’ সেই যৌবন উচ্ছ্বাসী কলমুখরতায় এখনো কি সরগরম হয়ে ওঠে? যে অদৃশ্য নাড়ির টানে বারবার আমি ছুটে গেছি তাঁদের কাছে, সেখান থেকে ছিটকে আজ তাঁদের কথাই মনে পড়ছে খুব। নাড়ির সে টান বুঝি তীব্র থেকে তীব্রই হয়েছে আরো। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছেড়ে যাওয়ার শেষ মুহূর্তটাতে এরা কৃতজ্ঞতার যে গ্রন্থিবন্ধনে আবদ্ধ করে দিয়েছিলেন আমাকে, সেই স্মৃতিতর্পণে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করতে গিয়ে আজ সেই সেতারের নাড়িতে বুঝি মধুটংকারে উথলে ওঠছে কাতর উষ্ণতায় গলানো পুরনো বেহাগ। তবে কি আজকের আনন্দই আগামী দিনের কষ্ট? কালের স্পন্দন কষ্ট আর আনন্দকে কতো সহজেই আপেক্ষিক করে দেয়!

পাণ্ডুলিপির উজ্জ্বল অক্ষরগুলো

চাকুরেদের বুঝি স্থায়ী বসত হতে নেই। জীবনের বিচ্ছিন্ন টুকরোর মতোই খণ্ডকালীন অবস্থানের তৃপ্তিকেই বসতের উপলব্ধি দিয়ে রাঙিয়ে নিতে হয়। সময়টা সম্ভবত আগষ্ট ১৯৯৩ সাল। আগন্তুক চোখে ছোট্ট বেডিং আর একটা ব্যাগ ভর্তি বইসহ কাপড় চোপড় সম্বল নিয়ে যেদিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের কালিকচ্ছ বাজারে পা দিলাম তখনো কি জানতাম সেখানকার সঞ্চিত স্মৃতিগুলোই সেতারের আচ্ছন্ন নাড়িতে এমোন হৃদয়-ভেজা মধুটংকারের মতো এক চিরকেলে উৎস হয়ে থাকবে!
চাকুরি সূত্রে নোয়াখালীর সেনবাগের কেশারপাড় থেকে বদলি হয়ে এসেছি। একজন তরুণ ব্যাংক কর্মকর্তা হিসেবে অফিসিয়াল পরিচিতির আড়ালে যে ব্যক্তি মানুষটা বাস করে, তার এলোমেলো কবিমনের খোলা জানালা দিয়ে নিবিড় অধ্যয়ন করছি সবকিছু ; এলাকার মন মানুষ ও প্রকৃতির স্বতস্ফূর্ততাকে। বিপ্লবী উল্লাসকর দত্ত অভিরামের স্পর্শধন্য এই মাটি ও এর মানুষগুলোর দিকে প্রতিনিয়ত কৌতূহলী হচ্ছি, রোমাঞ্চিত হচ্ছি এবং আকর্ষিতও হচ্ছি। তাঁদের প্রাত্যহিক জীবন যাপন আর জীবন ধারণের মধ্যিখানে ফল্গুর মতো লোকায়ত যে সুরটি লুক্কায়িত তা খুঁজে ফেরার স্বভাবজাত প্রয়াস থেকেই একদিন আবিষ্কার করলাম, কখন যে এ মাটির স্পর্শে আর্দ্র হয়ে ওঠেছে তৃষ্ণার্ত মনের অবিচ্ছেদ্য শিকড়গুলো! চাকুরির ধরনটাই এমন যে, এলাকার তৃণমূল মানুষদের নিয়ে কাজ করতে করতে নিজের পরিচিতির পাশাপাশি এলাকাটাও চেনা হয়ে গেলো দ্রুত। অফিস শেষের ঢিলেঢালা সময়টাতে আড্ডাপ্রিয় মানুষ হিসেবে যেটুকু গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়ে গেলো, তাও বোধকরি এখানকার মানুষগুলোর উদারমনস্কতারই ফসল। মানুষ পর্যবেক্ষনের অবাধ্য স্বভাব দিয়ে মানুষের ভেতরে ডুব দিতে দিতে কতো বিচিত্র অনুভবের সামনে দিয়ে যে হেঁটে গেছি! সে সবই ব্যক্তিজীবনের একান্ত ইতিহাসের মালমশলা হয়ে রইলো।
বহিরাগত চাকুরে হিসেবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অবসরের সময়টা নিজের সাথেই নিজেকে কাটাতে হয়। সঙ্গী কেবল বই পড়া আর টেপ রেকর্ডারে গান শুনা। তারও পরে একটা টিভি এসে যোগ দিয়েছিলো আমার নি:সঙ্গতার সাথে। তবে অফিস শেষে অবসরের কিছুটা সময় বসতাম গিয়ে চা-পাতা ও কাপড় ব্যবসায়ী মো: মাজহারুল হকের গদীঘরে। কথা দিলে যে সব কিছুর বিনিময়েও কথা রাখতে হয়- এই বোধটা আমাদের সমাজ থেকে ক্রমশ লুপ্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকলেও মাজহারুল ভাইয়ের মতো লোক যতোদিন থাকবে ততোদিন লুপ্ত হবে না নিশ্চিত। এরকম একজন বিবেকবান মানুষের পাশে কিছুটা সময় কাটানো অত্যন্ত আনন্দের ছিলো আমার জন্য। এছাড়া ছন্নছাড়া মানুষ হিসেবে আমার প্রতি তাঁর আন্তরিক সহায়তার ঋণ ভুলি কী করে। এতোগুলো বছর পর শুনে খুব মর্মাহত হয়েছি, ডায়াবেটিস এবং আরো কতো জটিল রোগে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসায় ফতুরপ্রায় সেই মাজহারুল ভাই আজ রোগে শোকে আর্থিক অনটনে ধুকে ধুকে কাটাচ্ছেন তাঁর দু:সহ সময়গুলো । সৎ মানুষরা কি নিয়তির কাছে এরকম অসহায় হয়ে যায়!
টিন শেডের মলিন চেহারার যে ছোট্ট ঘরটিতে হোমিও ডাক্তার বাবুটি বসেন, সেটার নাম দয়াময়ী হোমিও ফার্মেসী। চেহারাগত দিক বিবেচনায় নিলে অন্যান্য দোকান পাটের তুলনায় তেমন কোন বিশেষত্ব নেই। বরং অন্যদের চেয়ে একটু বেশি মলিন। প্রৌঢ় বয়েসী ডাক্তার সুধীর দাস, কালো চেহারার স্থূলাঙ্গী খাটো শরীরে ধবধবে সাদা পাজামা পাঞ্জাবী। এর বাইরে অন্য কোন পোশাকে কখনোই দেখিনি তাঁকে। চশমা তো নয়, যেনো দুটো গোটা ম্যাগনিফাইং গ্লাসই বসিয়ে রেখেছেন ফ্রেমে বন্দী চোখের উপর। মুখের দিকে তাকালে শরীর ছাপিয়ে আতস কাচের বিশাল দুটো চোখই ভেসে ওঠে। নিরীহ গরীব রোগীদের আনাগোনা বেশি। ছোট্ট শিশিবোতলে পাশে রাখা ফিল্টার থেকে পানি নিয়ে হ্যনিম্যানের ষষ্ট সংস্করণ চিকিৎসা পদ্ধতির বিশেষ কায়দায় দু’হাতে শিশিবোতল ঝাকানোর চেনা দৃশ্যটা অত্যন্ত স্বাভাবিক বলে মনে হয়। অফিস থেকে বেরিয়ে আসতে যেতে পরস্পর শুভেচ্ছা বিনিময়ের কায়দাটাই বলে দিতো, অত্যন্ত সজ্জন ব্যক্তি। তবু এসব দিয়ে তাঁর সাথে এই আমার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা হবার কোন কারণ ছিলো না। কিন্তু রোগীর অবসরে তাঁর ক্রিয়াকাণ্ডের ভিন্ন এক দৃশ্যই খট্কার কারণ হলো। ছোট্ট টেবিলটাতে একটা ডায়েরী খুলে লেখার ভঙ্গীর সাথে চেহারার বিশেষ ভাব সাদৃশ্যটাতেই সন্দেহ হতে লাগলো। যে গাঙের ভাঙা বৈঠাধারী আমি, তাঁর গায়েও কি সে গাঙেরই আদিম জলের ছোঁয়া? এমনি এক বিশেষ মুহূর্তে একদিন ঠিকই ধাম করে ঢুকে গেলাম। মোহন জলের চিহ্ন আঁকা ডায়েরীর পাতাই বলে দিলো- তিনি আমাদেরই লোক! কিন্তু একজন বাতিকগ্রস্ত লিখিয়ে হিসেবে নিজের পরিচয়টাকে তখনো উন্মোচিত হতে দিইনি। সাহিত্য রসিক একজন ব্যাংক কর্মকর্তা হিসেবেই তাঁর দরবারে প্রশ্রয় পেলাম।
আনাগোনা বেড়ে গেলো সুধীর দা’র চেম্বারে। একদিন এক সৌজন্যমূলক আমন্ত্রণ জানালেন কালিকচ্ছের ঐতিহ্যবাহী আনন্দ আশ্রমে অনুষ্ঠিতব্য এক সাহিত্য সন্ধ্যায়। ডাঙার মাছের কাছে পানিতে বেড়ানোর আমন্ত্রণ! আমি যে রক্তের টানেই সেখানে হাজির, এটা বুঝার অবকাশ তাঁরা পাননি। তবে আমার উপস্থিতিকে আন্তরিক স্বাগত জানালেন। আগরতলার বিশিষ্ট কবি দিলীপ দাশকে সাথে নিয়ে এলেন কবি জয়দুল হোসেন। এসেছেন কবি মো: আশরাফ, যিনি তখন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারী মহিলা কলেজে বাংলা বিভাগের প্রধান হিসেবে কর্মরত। এসেছেন কবি ও কণ্ঠশিল্পী রত্না দে সহ কাছের ও দূরের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা আরো অনেক নবীন প্রবীণ কবি ও সাহিত্যকর্মী। আশ্রমের পরিষ্কার তকতকে মেঝেতে গোল হয়ে বসে আলোচনাপর্বের পর একটা চমৎকার আবহের মধ্যে উপভোগ করছিলাম বিভিন্ন কবির স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি। ব্যাংক ম্যানেজার হিসেবে উপস্থিতির সম্মানটুকু পাচ্ছিলাম ঠিকই। কিন্তু তারা তো তখনো জানতেন না যে আমিও তাঁদেরই লোক। সেটা সুপ্তই ছিলো। আমার সঙ্গী সহকর্মী আশেক কার কানে কানে কী যেনো বললো ফিসফিসিয়ে। একটু পরেই যখন আমার নাম ঘোষণা হলো, বুঝতে বাকী রইলো না ফিসফিসানির শা’নে-নজল কী ছিলো। খানিকটা অপ্রস্তুত এবং অবশেষে দাঁড়িয়ে আবৃত্তি করে ফেললাম বিস্ময়করভাবে মুখস্থ থাকা আরও প্রায় এক যুগ আগের লেখা আমার প্রিয় একটি কবিতা। কী আশ্চর্য! তাৎক্ষণিক অভিনন্দন প্রশংসা কিছুই বুঝি বাদ রইলো না। তবে উল্লেখযোগ্য যে বিষয়টা মনের গভীরে রেখাপাত করলো, কয়েক মুহূর্তের ব্যবধানে আমিও তাঁদেরই একজন হয়ে গেলাম। বড় বড় নাগরিক কবিদের মনোজগতের গূঢ় অনুষঙ্গের অভিজ্ঞতা আমার নেই। তবে মফস্বলের নিরিবিলিতে পড়ে থাকা আমাদের নিরীহ কবিদের বুকের দিঘিটা যে উদার বিশালতায় সাগরকেও হার মানিয়ে দিতে জানে তা উপলব্ধি করে চমৎকৃত হয়েছি। পাল্টে গেলো গোটা আবহটাই। দূরের গ্রহের মতো পাশে বসা কবি দিলীপ দাশ ঘণ্টা দুয়েকের ঘনিষ্ঠতায় কখন যে গলাগলি করা অগ্রজ বন্ধু হয়ে গেলেন, ভাবতেই অবাক লাগে! ওই বসাতেই আমার পঠিত কবিতাটা টুকে দিতে হলো তাঁকে। পরবর্তীতে আগরতলা থেকে প্রকাশিত নিয়মিত সাহিত্য পত্রিকা ‘একুশ শতক’ এর সৌজন্য সংখ্যায় ছাপা হওয়া সেই কবিতাটি দেখে কৃতজ্ঞতায় ভরে গেছে মন। সাথে পাঠানো শুভেচ্ছাপত্র সহ দিলীপ দা’র কাব্যগ্রন্থ ‘মন ছুঁয়ে আছে এপাড় ওপাড়’ এখনো মহার্ঘ স্মৃতিচিহ্ন আমার।
এরপর থেকেই নিত্যদিনের কিছু কিছু সান্ধ্যকালীন মননশীল সময় ঘাড় ধরে টেনে নিয়ে যেতো সুধীর দা’র সেই ছোট্ট চেম্বারটিতে। যাঁরা আসতেন ওখানে, সবাই কালিকচ্ছ সরাইল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনের বিশিষ্টজন। ঢাকা আগরতলা থেকেও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা আসতেন। এঁদের মধ্যে ঢাকা থেকে শ্বশুরবাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এলেই কবি আসাদ চৌধুরী, জন্ম-মাটির টানে বছরান্তে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এলে আগরতলার কবি দিলীপ দাশ, এমন কি পবিত্র সরকারের মতো ব্যক্তিত্বও ওই মলিন ছোট্ট ঘরটিতে অবলীলায় এসে ঢুকে যেতেন। এমন অনেককেই আসতে দেখেছি ওখানে। এই মলিন ছোট্ট ঘরটিই যে মনন আলোয় ওখানকার সবচেয়ে আলোকিত ঘর, নির্বোধ আমিই বুঝতে পেরেছি একটু দেরী করে। অথচ এই ঘরটির সংযোগ সুঁতো দিয়েই পরিচিতের ঘনিষ্ঠতায় এসেছি অনেক অনেক স্মৃতিময় মুখের সাথে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমীর সংগঠক সম্পাদক কবি ও ছড়াকার জয়দুল হোসেন, তাঁর সাথে পরিচয়টাও অকস্মাৎ একদিন ওখানেই হয়েছে। তাঁরই মাধ্যমে পরবর্তীতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বৃহত্তর সাহিত্য সংস্কৃতি অঙ্গনের সাথে জড়িয়ে যাওয়া। ভার্সিটি বন্ধ হলে বাড়ি ফেরা স্বপ্নালু চোখের তরুণ প্রেমিক কবি ও গদ্যকার মৃধা কামাল বা সরাইলের তরুণ সাংবাদিক ও সংস্কৃতি কর্মী তরিকুল ইসলাম দুলাল সহ স্বপ্নপ্রজন্মের কতো কতো তরতাজা মুখ। প্রগতিশীল তরুণ মেধাবী সমাজকর্মী ভাস্কর প্রসাদ চৌধুরী, যে নাকি বই বা পত্রিকার খোঁজে যখন তখন ঢুঁ মারতো আমার সোয়া তিনতলার চিলেনিবাসে, অন্যায় অবিচারের প্রতিবাদ করতে গিয়ে একদিন বীভৎস লাশ হয়ে পড়ে রইলো সবুজ সোঁদা জমিনের ভেজা কাদায়।
নোয়াগাঁও নিবাসী অবয়বে প্রবীণ কিন্তু মননে তরুণ আলাভোলা অত্যন্ত সহজ সরল এক কবিমনের অধিকারী বসির আহমেদ বা প্রিয় বসির ভাইয়ের সাথে অসম্ভব সখ্য তো সুধীর দা’র এই ছোট্ট ঘরটি থেকেই। অনুজ প্রতিম অত্যন্ত কাছের একজন মৃত আত্মীয়ের দাফন শেষ করে বাড়ি ফিরে ঘরে ঢুকেই ঢলে পড়া বসির ভাইয়ের আকস্মিক মৃত্যু-মুহূর্তে তাঁর প্রাণপ্রিয় সঙ্গিনী স্ত্রী হিসেবে কাছে থাকতে না পারার পাথর কষ্টটা বসির-ভাবী আজও বুকে বয়ে বেড়াচ্ছেন স্বপ্নের সন্তানদের মুখের দিকে চেয়ে। ওই সময়টায় তিনি তখনও মৃত আত্মীয়বাড়ি থেকে এসে পৌঁছাতে পারেন নি বলে প্রিয়তম সঙ্গীর শেষ কথাটা আর শুনা হয়নি তাঁর। সুদূর কর্মস্থল ফেনীতে বসে অকালমৃত্যুর এ দু:সংবাদ পেয়ে অনেকণ স্তব্ধ হয়ে ছিলাম। কথা ছিলো আমি যেখানেই থাকি না কেন রূপাবলীকে, অর্থাৎ বর্তমানে আমার স্ত্রী এবং তখনকার প্রেয়সী যাকে সবাই অতসি প্রতীকী নামে জানতো, তাকে নিয়ে ওখানকার সব কবি সাহিত্যিক শিল্পী বন্ধু বান্ধবের উপস্থিতিতে সবাই মিলে কোন এক বর্ষায় অন্তত একবার হলেও একটা নৌ-বিহারে যাবো ধর্মতীর্থ বা ধরন্তী- নাসিরনগরের হাওরে। আমাদের সেই নৌ বিহার কি আর হবে কখনো? নিরন্তর কাব্য-ঘোরে আবর্তিত স্বাপ্নিক মানুষ বসির ভাই আজ নেই। কখনও আসবেনও না। কালিকচ্ছের অন্তর্বাহী সাহিত্য সংস্কৃতির স্রোতটাকে দৃশ্যমান আর স্বচ্ছন্দে বইয়ে দিয়ে নতুন নতুন প্রতিভা খোঁজার প্রয়াস হিসেবে ‘সাহিত্য ভুবন’ নামে যে স্বপ্নশিশুটির জন্ম হয়েছিলো, এর আঁতুড় ঘর দয়াময়ী হোমিও ফার্মেসীকে সাহিত্য ভুবন নামে ডেকে ওঠার অন্যতম কারিগর বসির ভাই আর কখনো হৈ চৈ বাঁধাতে আসবেন না ওখানে। শ্মশ্রু-গুম্ফমণ্ডিত সেই মায়াবী মুখটি মনে এলেই এক পশলা নীল বৃষ্টি নামে বুকের ভেতরে।

বৃষ্টিতে ভিজে যায় চাঁদ

কালিকচ্ছ বাজারের উপকণ্ঠেই অপোকৃত দুর্বল তেতলা দালান ঘরটার দ্বিতীয় তলায় আমার অফিস। নীচে থেকে একটা সরু সিঁড়ি মারিয়ে উপরে ওঠতে হয়। কোন পাকা বাড়িতে এতো সংকীর্ণ ও নীচু সিঁড়ি থাকতে পারে, এটা না দেখলে কেউ কল্পনাও করতে পারবে না। পাশাপাশি দু’জন হেঁটে দোতলায় ওঠা তো দূরের কথা, বুক টানটান মাথা উঁচু স্বভার যাঁদের তাঁদেরকে ক্ষেত্রবিশেষে নতজানু হবার শিক্ষা দিতে হলে এই সিঁড়িটা নিশ্চয়ই উপযুক্ত জায়গা হতে পারে। দু’একবার দ্রুত ওঠানামা করালেই যথেষ্ট। মাথায় ফোলে ওঠা গোটাকয়েক তরতাজা টিউমারের সরব উপস্থিতি প্রশিক্ষণের সাফল্য সম্পর্কে সন্দেহমুক্তি ঘটাবে। তেতলার ছাদে একটা চিলেকোঠা, ঠাট্টা করে অনেকেই একে সোয়া তিনতলা বলতেন। ওখানেই একাকী আমার একান্ত নিবাস। ছাদের খোলা অংশটুকু আমার উঠোন। এ উঠোন থেকে প্রায় গোটা বাজারটাই দেখা যেতো এক পলকে। বাজার নিভে গেলে রাতটা যতোই গর্ভিণী হতো, ততোই হয়ে যেতো একান্ত আমার; শান্ত নীরব, একাকী। রাত-জ্যোৎস্নায় যেদিন বান ডাকতো আকাশের তারাগুলোর মতো উদ্দাম চন্দ্রঘোরে প্রথমেই ভেসে যেতাম আমি। আর প্রতিটা ঝড়ো রাতে বাতাসের তীব্রতা বাড়ার সাথে সাথে মনে হতো এটাই বুঝি এ পৃথিবীর শেষ রাত। তবু এই ছাদটাই কীভাবে কখন যেন আমার মনের রঙটাই পেয়ে গেলো, বুঝতে পারিনি। খোলা ছাদের উঠোনে দাঁড়িয়ে দৃষ্টিটা ডানে ঘুরালেই দেখা যেতো বাংলাদেশ রাইফেল্স-এর সাজানো গোছানো বিরাট ব্যাটেলিয়ান ক্যাম্পটাকে। এপাশ ওপাশ সবুজে মোড়ানো গ্রাম আর মাঝখান দিয়ে ধুসর ফিতার মতো পাকারাস্তাটা চলে গেছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের দিকে। বাঁয়ে ঘুরলে বাজারের ওপাশ থেকে সবুজ জমিন গাছপালা গ্রাম পেরিয়ে ধর্মতীর্থ বা স্থানীয় ভাষায় ধরন্তী ঘাট। ব্রাহ্মণবাড়িয়া টু নাসিরনগরের রাস্তাটা ওখানে গিয়ে হাওরটাকে স্পর্শ করেছে। ছাদ থেকে হাওরের দূরবর্তী অংশের ধবধবে উপরতল দৃশ্যমান হতো। পানিকে পানি মনে হতো না, চকচকে প্রলেপের মতো লাগতো। পরিচিতির সূত্র ধরে এই উঠোনটার ভালোলাগা উপভোগ করতে অনেকেই চলে আসতেন এখানে, বিভিন্ন সময়ে। উপলক্ষটাই শুধু আমি। কালিকচ্ছের কথা মনে এলে অবিচ্ছেদ্য স্মৃতি হিসেবে এ উঠোনের অনুভবটাকেও যেন ভেতরে ভেতরে টের পেয়ে যাই খুব গভীরে, নাড়ির ভেতর। কিন্তু এই অনুভবটুকু কি আসলে বস্তুগত উপলক্ষগুলোর জন্যে? মনে হয় না। প্রকৃতি ও প্রস্থাপনার মধ্য দিয়ে আসলে এখানকার কোমলে মধুরে মেশানো ব্যক্তিমানুষগুলোই প্রতিনিয়ত দাগ কেটে গেছে মনে। প্রিজমের মতো বিশ্লিষ্ট আলোর রঙে মূলত এই মানুষগুলোর মুখচ্ছবিই ভেতরে দানা বেঁধে আছে।
পরিচিতির পরিসর বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে ছুটির দিনগুলোতে যাতায়াত বেড়ে গেলো জয়দুল ভাই ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া সাহিত্য একাডেমীতে। সাহিত্য একাডেমী ও জয়দুল হোসেন এ দুটো নামকে আলাদাভাবে দেখার অবকাশ কখনোই আমার হয়নি; আর কারো হয় কিনা আমার জানা নেই। তবে দেশের প্রতিটা অঞ্চলে যদি নিজের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানোর মতো এরকম একজন করে জয়দুল হোসেন থাকতেন, তবে এদেশের সাহিত্য আন্দোলনের চেহারাটাই হয়তো অন্য রকম হয়ে যেতে পারতো; স্বপ্নের খুব কাছাকাছি। ইন্ড্রাস্ট্রিয়াল স্কুলের নিরিবিলি প্রাঙ্গণে সাহিত্য একাডেমীর অবস্থানটা অত্যন্ত শোভন ও যথাযোগ্য মনে হয়েছে সবসময়ই। এমন চমৎকার পরিবেশে গেলে মনটা অজান্তেই ভালো হয়ে যায়। শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সের সব অঙ্গনের তুখোড় তারুণ্যের এমন চমৎকার সমাহারে প্রতিনিয়ত মুগ্ধ হয়েছি বরাবর। একাডেমীর নিয়মিত অনিয়মিত আকর্ষণীয় বিচিত্র সব ছোট বড় অনুষ্ঠানে শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, শওকত ওসমান, মহাদেব সাহা, আসাদ চৌধুরী, শান্তনু কায়সার, নাসির আহমেদ প্রমুখের মতো দেশের প্রতিষ্ঠিত ও নেতৃস্থানীয় বহু কবি সাহিত্যিক সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বদের আন্তরিক উপস্থিতিতে বরাবরই নিজেকে সমৃদ্ধ করার সুযোগ পেয়েছি। তখনো সংসারী হইনি, এবং পিছুটান বিহীন একাকী মানুষ বলেই কতো বিকেল, কতো সন্ধ্যা বা কতো রাত যে জয়দুল ভাই সহ হেঁটে বসে রাস্তায় রাস্তায় কাটিয়েছি! উটকো যন্ত্রণা হিসেবে ভাবীকেও জ্বালাতন করেছি কতো; এখন ভাবলে কষ্টও হয়, আনন্দও পাই।
এই সাহিত্য একাডেমীর কোন এক গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকেই একদিন পরিচিত হলাম ডা:ফরিদুল হুদার সাথে। সামরিক রাষ্ট্রপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান সরকারের মন্ত্রীসভার প্রাক্তন সদস্য হিসেবে তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান ও কর্মকাণ্ড আমার আকর্ষণের বিষয় ছিলো না। আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম তাঁর সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রীতির গভীরতা উপলব্ধি করে। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধ এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের স্মৃতি সংরক্ষণে তাঁর ব্যগ্রতা দেখে কৃতজ্ঞ না হয়ে কি পারা যায়? ঐ যুদ্ধকালীন সময়ে অনেকের মতো আমিও তো মা ভাই বোনসহ একই পরিবারের পাঁচ-পাঁচজন সদস্য হারানোর ক্ষত বুকে নিয়ে জাতির সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি শ্রদ্ধায় নতজানু হই আজো, দূরবর্তী কোন স্বপ্নের দিকে তাকাই এক অমর্ত্য আকাঙ্ক্ষায়! ডা:ফরিদুল হুদার আগ্রহে ও তত্ত্বাবধানেই কুল্লাপাথার গণকবরে শুয়ে থাকা শহীদদের স্মৃতিভূমিতে সাহিত্য একাডেমীর সকল সদস্যকে নিয়ে গিয়ে পরবর্তী প্রজন্মকে মা মাটি মানুষের প্রতি রক্তের ঋণ স্মরণ করিয়ে দেয়ার অভিপ্রায় দেখেই শ্রদ্ধাবনত চিত্তে ধারণা করি কোনো অচেনা গভীরে লুকিয়ে থাকা তাঁরও কিছু কষ্টের অস্থিত্ব। ছোট্ট সাধারণ একজন মানুষ হিসেবে দূর থেকে দেখা এতো বড়ো একজন ব্যক্তির কোন গোপন কষ্টের কথা কী করে জানবো আমি? সে সুযোগ কোথায়? তবে অজান্তেই কি তাঁর স্নেহধন্য হয়ে গিয়েছিলাম আমি? তাঁর ব্যাপক কর্মকাণ্ড নিয়ে যাঁরা জানেন তাঁরাই বলতে পারেন সেসব কথা। আমি পারি কেবল আমার কৃতজ্ঞতাবোধ দিয়ে ব্যক্তিগত ঋণস্বীকারের উপলব্ধিটুকু প্রকাশ করতে।

আয় বৃষ্টি ঝেপে

আমরা অধিকাংশই পেটের দায়ে চাকুরি করি, আর মনের টানে ঘর বাঁধি কবিতার সাথে। চাকুরিতে প্রেম না থাকলেও দায়টা থেকেই যায়। কিন্তু কবিতার বন্ধনে প্রেমটাই আসল। ওটা না থাকলে যে কবিতাই থাকে না। তাই কবিতার মুখ যখন দূরে সরে যায় সেই অব্যক্ত কষ্টগুলো গোমড়াতেই পারে শুধু, সারাতে পারে না কিছুই।
১৯৯৬ সালের মাঝামাঝি সময়টাতে ভিন্ন কর্মস্থলের ডাক এলো একদিন। চাকুরিবিধি অনুযায়ী যদিও তা পদোন্নতি জনিত বদলি, মনটা হাহাকার করে ওঠলো। যেনবা শেকড়ে টান পড়েছে। বসির ভাই কী যেন বলতে এসেছিলেন, খবর শুনে ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে রইলেন এক অনিশ্চিৎ আমার দিকে। আসল কথা আর বলা হয়নি তাঁর, ভুলে গেছেন। কী আশ্চর্য! কালিকচ্ছ বাজার, সরাইল বা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়, যেখানেই যাই পরিচিত মুখগুলোতে একই অভিব্যক্তি। আমার সোয়া তিন তলার উঠোনেও চলে আসছে অনেকে। এই ছাদের উঠোনে কতোজন কতো আনন্দঘন মুহূর্ত কাটিয়ে গেছে! সবার মুখেই ছিলো হাসির উচ্ছ্বাস। কিন্তু এখোন যেন উঠোন ভর্তি শুধু কষ্ট আর কষ্ট। আবেগের আতিশয্যে চাকুরেদের জন্য খুবই সাধারণ একটা বিষয়ও বুঝি এভাবে অসাধারণ আর অনাকাঙ্ক্ষিত হয়ে গেলো! যাক্, ধীরে ধীরে মনকে মানানো হলো, এবং নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগের আশ্বাস দিয়ে সবাইকে আশ্বস্ত করা গেলো। রিলিজের তারিখ দ্রুতই ঘনিয়ে আসছে। তখনো অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতাটা বুঝি বাকিই ছিলো।
হঠাৎ করেই যেন দিনটি এসে গেলো। দূর থেকে মাইকিং-এর আওয়াজ পাচ্ছি- ‘...ব্যাংকের ম্যানেজার ..........কবি .........এর ... উপলক্ষে স্থানীয় কালিকচ্ছ প্রাইমারি স্কুল প্রাঙ্গণে এক বিদায়ী সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছে। ....... প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন বাংলাদেশ সরকারের প্রাক্তন স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী .... ডা: মো: ফরিদুল হুদা এবং ......’ ইত্যাদি ইত্যাদি। আরে, করছে কী এরা! অচেনা এক উত্তেজনায় কাজে মন দিতে পারছি না আর। দুপুরের পর থেকেই দলে দলে আসতে শুরু করলেন পরিচিত অপরিচিত কতো মুখ। শুভেচ্ছা উপহারে খেই হারিয়ে ফেলার অবস্থা! এতো শুভাশীষ আমি ধারণ করবো কী করে, বুকের উঠোন যে খুব ছোট!
বিকেলে যথারীতি অনুষ্ঠানস্থলে। বিস্ময়ে হতবাক আমি; আমার জন্যেই এতো জমকপূর্ণ একটা অনুষ্ঠান করে ফেললো এরা! আগত ব্যক্তিবর্গের কাছে নিজকে খুবই ক্ষুদ্র মনে হলো। কচি কচি কতো শিশু কিশোরও সেজে গুজে এসেছে। হাতে হাতে সবার মালা আর ফুলের সমারোহ দেখে আশঙ্কা হলো, শেষ পর্যন্ত আমাকে এরা ফুল দিয়ে চাপা দেবে না তো! আলোচনা, স্তুতি, আবৃত্তি এবং সঙ্গীতানুষ্ঠানের দীর্ঘ সূচিবদ্ধতার মধ্যে প্রধান অতিথি এলেন। ডা: ফরিদুল হুদা। বিনম্র চেহারায় তাঁকে অতিসাধারণ আমার কাছে এক অগম্য পুরুষ বলে মনে হলো। দেখলেন, এবং আশির্বাণী দিয়ে যখন তাঁর বিশাল বুকে আমাকে টেনে নিলেন, অনন্ত কৃতজ্ঞতায় মনে হচ্ছিল- আমি ভাসছি কতো লক্ষ টন মোহন শুভেচ্ছার জলে ....।

বুক তো নয়, যেন এক মায়াবী উঠোন !!
............

Wednesday, September 3, 2008

@ টান নেই আঁচড় নেই শুধুই বিষাদ - ০১ (কবিতাগুচ্ছ)







টান নেই আঁচড় নেই শুধুই বিষাদ - ০১ (কবিতাগুচ্ছ)
-রণদীপম বসু


ওহে নির্লজ্জ নগরবাসী ...

থু থু গুলো ছুঁড়ে দাও
কারো না কারোর ঘৃণায় নৈবেদ্য হবে

ডেলফির মন্দির থেকে ঘোষিত অমোঘ স্বর
আমাকে উৎপীড়ণ করে ছুঁড়ে দাও ছুঁড়ে দাও বলে
আমি তো জমাইনি তা
আজীবন গিলে ফেলা নিজের লজ্জাগুলোই
ওঠে আসে উদ্ভ্রান্ত উদ্গারে..
প্রাচীন বর্জ্যের মল
দলা পচা দুর্গন্ধ থুথুর ভারে এ প্রথম আক্রান্ত আমি

পাকস্থলি ছোট-বড় অন্ত্র সব নিরুদ্দেশ
মুখগহ্বর জুড়ে স্যুয়ারেজ পাইপ, ছুটে আসা বিষাক্ত ঘৃণার স্রোত
আমাকে নিমজ্জন করে
কোথায় ফেলবো তা ? ফুটপাথ, রাজপথ, পরিত্যক্ত নর্দমায় ?
ছেয়ে থাকা কিলবিলে কীট জোঁক পিঁপড়েও
বইবে না মানুষের আদিম লজ্জার ভার

ডেলফির মন্দিরে ঢং ঢং ঘণ্টা বাজে
আমাকে ফেলতেই হবে, আহা কতো নিরূপায়
ঘৃণার ভারে জর্জরিত পৃথিবীর আদিম সত্তা
কারো না কারোর ঘৃণায় নৈবেদ্য হবে
ওহে নির্লজ্জ নগরবাসী তোমরা কি জানো
আমার উৎক্ষিপ্ত ঘৃণাকে আমি কোথায় নৈবেদ্য দেবো ? @

[ভাড়াটে ঘাতক দিয়ে কারো মৃত্যুকে চিহ্ণিত করেও যারা নির্দোষ,
অলৌকিক এ স্বীকৃতির বৈধতা বিলায় যারা, আমার এ পঙক্তিমালা তাদের জন্য।
]
(৩১/০৮/২০০৮)
[sachalayatan]


বুকের ওড়নায় দেখো...

বোঝাতে পারি নি বলে নয়
বোঝাতে চাই নি বলেই বুঝতে পারো নি তুমি

অখণ্ড ঘৃণায় মেখে ছুঁড়ে দেবে ?
তাই দাও। এই বুক, বুকের খণ্ডিত আকাশ
বিষণ্ন জমিন এবং আমাকে দেখছো যা
তুমি তো জানো না যে এ সবই তোমার
লম্বিত সত্ত্বাই কেবল

যা কিছু ছুঁড়ো না কেন আমি যে আমি নই
ক্ষোভের ধারালো কাণায় ঘেষে ছিঁড়ে ফেলো বুক
তখনো বুঝবে কিনা অথবা বুঝবে না কিছুই
বিপণ্ন আয়নার চোখে চোখ রেখে
হয়তো জানবেও না- চেয়ে আছো আমার দিকেই

চমকে ওঠবে কি-
বুকের ওড়নায় মাখা ক্ষতনীল রক্তের চিহ্ণগুলো দেখে ?
(২৮/০৯/২০০৮)
[sachalayatan]



শীত কুড়ানো কৈশোর ফেলে

তোমাদের শহরে উত্তুরে হাওয়া নেই
বাদুড় ঝাপটানো রাতে নিঃশব্দ টিনের চালে
টুপটাপ পতনের শব্দ কোথায় পাবো ?
শিশিরহীন পথভুলো ধোঁয়াকেই অভ্রান্ত কুয়াশা ভেবে
তোমাদের সকালগুলো হারিয়ে যায় শৈশবহারা ঘুমে
বিকেলগুলো গিলে খায় ঝলমলে শপিং মল আর বুড়োদের পার্ক।
সর্ষে ক্ষেতের আলে আলে শীত কুড়ানো কৈশোর ফেলে
বড়জোর যেতে পারি সুতন্বির ঘাটে,
আমাকে খেয়া পার হতে বোলো না
নক্সীকাঁথায় মুড়ে ইচ্ছেখুশি যেতে পারা স্বপ্নের হাত ধরে
রূপকথা’র দেশে যাবার ঘুটঘুটে অন্ধকার তোমাদের শহরে নেই।

স্নানরত চাঁদটা’র সাথে প্রতিরাত কথা হয় আমার
উনুনের ওম ফেলে ছুটে আসি রোজ, একদিন আমাকে সে
সত্যিই নিয়ে যাবে হীরেমোতি কন্যার কাছে। এমন ইচ্ছের মতো
বেড়ে ওঠা ঝোপের পাশে এরকম নিরিবিলি ঘাট নিঝুম পুকুর
তোমাদের শহরে তো নেই !

চোয়ালে গেঁথে যাওয়া ইস্কুল পালানো ডাঙ্গুলির দাগ, স্বপ্নের কাছাকাছি
ভুবনের হাট আর পাখি হ’তে বাধাহীন পূর্বধলা মাঠ
তোমাদের শহরে আছে কি কোথাও...?
(২৩/০১/২০০৯)


আত্মপরিচয়

মাছুম শিশুদের দিকে বর্বর মারণ-অস্ত্রগুলো নির্বিচার তাক করার আগে
কী আশ্চর্য, একবারও ভাবলো না ওরা, অভিধান থেকে পশুরাও
মুছে না শৈশব ! বাড়ন্ত শৈশবে পৌঁছার আগে
উষার আলোয় রাঙা জীবনের কাছে নতজানু হয়ে পশুরও বৈধ মাতৃজরায়ু থাকে।
বারুদের গন্ধ ঠাশা অবৈধ ধূলোমেঘে ঢেকে যাওয়া গাজা’র আকাশ
কীভাবে ফিরিয়ে দেবে মানুষের অপসৃত বৈধ পরিচয় !

ভদ্রমহোদয়গণ, জান্তব ট্যাঙ্কের চাপায় থেতলে দেয়ার আগে মানুষের মস্তিষ্ক দিয়ে
ভাবতে পারে না যারা- শিশুদের কোনো সীমান্ত নেই, মানুষের পৃথিবীটা
শিশুদেরই অনিবার্য বৈধ অধিকার,
পবিত্র ফিলিস্তিনের দোহাই, ওদেরকে খাঁচাবদ্ধ করুন। না হয় আর দেরি নয়,
হাত পা নাক মুখ চোখ কান এবং অভিন্ন দেহের আকার ওদেরই অনুরূপ দেখে
মানুষের অভিধান থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করুন !

পশুরা পশুই হয়, তবু এরা ঘৃণ্য অমানুষ নয় !
সন্তানের চোখে চোখ রেখে, ভদ্রমহোদয়গণ, এবার আপনাদের আত্মপরিচয় দিন।
(২৩/০১/২০০৯)
[sachalayatan]



আয় বাবা বুকে আয়...

‘উঁহু, এটা নয়, ওইটা এখানে !’
‘হাঁ হাঁ, এটা ঐদিকে !’
ছিন্নভিন্ন দেহাংশগুলো সাজাতে সাজাতে
সন্ত্রস্ত ফিসফিসানিগুলো গভীর থেকে গভীরতর হতে থাকে।
পিতার বন্ধুদের সংখ্যা কমতে কমতে সামান্য ক’জনে এসে দাঁড়িয়েছে,
কী আশ্চর্য ! ‘কোলে এসো’ বলে একবারও হাত বাড়ালো না কেউ !

‘কিন্তু এই জায়গাটা খালি যে !’
এমন অদ্ভুত প্রশ্নের নিরুত্তর মর্ম খুঁজে তন্নতন্ন হয় একজোড়া শৈশব আকাশ,
‘আয় বাবা বুকে আয়’ ডাকে যেখানে ঝাঁপ দিতো অপার বিশ্বাসে, ওটা নেই !
‘ওটা নেই’
গুমোট নৈঃশব্দের চাদরে ঢেকে দেয়া দেহে ‘আয় বাবা বুকে আয়’ ডাকা ফিলিস্তিনি বুকটাকে
কোথাও পাওয়া গেলো না আর।

‘চলুন দাফন করি।’
ঘরঘর ঘরঘর দ্রিম দ্রিম... বীভৎস কোলাহলে চাপা পড়া
মৌলভী সাহেবের কান্নাতুর মোনাজাতে হাত উঠালো সবাই,
কেউ জানলো না
একটা উদ্বাস্তু শৈশব কখন যে অগোচরে ছুটে গেলো কোথায়...

ঘররঘর ঘররঘর ঘুমম্ ঘরঘর...
বিশাল দানবচাকা যান্ত্রিক বেল্টের দাঁতে খাবলে খাবলে এদিকেই আসছে !
হিংস্র ধাতব চোখে দ্রিম দ্রাম কীসের স্ফুলিঙ্গ এসব ! ধ্বসে যাওয়া বসত বাজার ফেলে
দিগবিদিক ছুটছে সবাই ! চারপাশ ছারখার করে ওটা কি সত্যিই পাহাড় !
দাউ দাউ বারুদপোড়া আকাশের তলে হঠাৎ দেখলো সবাই ভয়াল বিস্ময়ে-
মৃত্যুদানবের পথরোধ করে নির্ভীক দাঁড়িয়ে গেছে অনড় এক শিশু ! যুবা নয় তারুণ্য নয়,
মৃত্যুকে যুঝবে আজ অবুঝ শৈশব !
দুর্দান্ত চ্যালেঞ্জ তার, অতশত বোঝে না সে, অভ্রান্ত বিশ্বাসী হাতে
নিমেষেই উঠে আসে শৈশবের বৈধ হাতিয়ার। ধেয়ে আসা পৃথিবীর
ভয়ঙ্করতম মারণাস্ত্রের বিরুদ্ধে অব্যর্থ নিশানায় ছুটে যায় শিশুতোষ মানবিক ক্রোধ
একটুকরো প্রতিবাদ, অধিকার, অনাবিল মাটির ঢেলা...

ঘরঘর ঘরঘর ঘরঘর... আয় বাবা বুকে আয়... ঘরঘর ঘরঘর ঘরঘর...
আয় বাবা আয়...
(২৫/০১/২০০৯)
[sachalayatan]
[sa7rong]