Saturday, June 22, 2013

| চতুষ্পদী কষ্টগুলো… |৬১-৬৫|

.
| চতুষ্পদী কষ্টগুলো… |৬১-৬৫|
-রণদীপম বসু


(৬১)
একতারা সেতার নয়,
বন্দিশ চেয়ো না মেয়ে, দিতে পারি টংকার কিছু।
কে চায় বিনিময় বলো,
দিয়েছো কেটেই যদি সুর তাল লয় !
.
(৬২)
ঝিনুক কুড়ানি মেয়ে
বেঁধে নাও ভালো করে বিস্রস্ত আঁচল,
তোমার ঝিনুক-বুক কীভাবে এড়াবে চোখ !
বুঝো না অপেক্ষায় কারা ? মুক্তো খোঁজার দল।
.

| সমতলে বক্ররেখা-০৬ : আমাদের সব আবেগই কি যুক্তিহীন !


| সমতলে বক্ররেখা-০৬ :                           
আমাদের সব আবেগই কি যুক্তিহীন !
-রণদীপম বসু
(১)
ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে মিরপুর হার্ট ফাউণ্ডেশনের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলাম। এখানে যারা আসেন, সখ করে তো নয়, দায়ে পড়েই আসেন। একটু একটু করে হৃদয়হীন হয়ে যাওয়া এই দেশটাতে হৃদয়গত সমস্যা যে কী প্রবল তা টের পাওয়া যায় রমনা পার্ক বা এ জাতীয় উদ্যানগুলোর অন্তর্হিত নিরালা স্পটগুলোতে গেলে অথবা নগরীর বিভিন্ন হার্ট ক্লিনিকগুলোতে ঢু মারলে। যদিও দুটো জায়গার পরিবেশ পরিস্থিতি এবং প্রেক্ষিত ভিন্ন, দুই দল দুই ভুবনের পাত্রপাত্রী, তবু অভিন্নতা একটাই ; উভয়েই হৃদয়গত সমস্যায় তটস্থ, কখনো কখনো বিধ্বস্ত।

| সমতলে বক্ররেখা-০৫ : নাস্তিক্য বনাম আস্তিক্য, শুধুই কি সত্যাসত্য দ্বন্দ্ব ?

. 
 | সমতলে বক্ররেখা-০৫ :
নাস্তিক্য বনাম আস্তিক্য, শুধুই কি সত্যাসত্য দ্বন্দ্ব ?
-রণদীপম বসু


(১)
 
 ইদানিংকালে আস্তিক্য-নাস্তিক্য নামক একটা বিভ্রান্তিমূলক বিষয়কে কেন্দ্র করে যে তুলকালাম ঘটনাপ্রবাহ বয়ে গেলো আমাদের জাতীয় জীবনে তা কতোটা যৌক্তিক বা জরুরি ছিলো তা নিয়ে বিজ্ঞজনেরা বিস্তর আলাপ-আলোচনা বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন তাঁদের নিজ নিজ অবস্থান ও দায়িত্ববোধ থেকেই। তবে সচেতন নাগরিকমাত্রেই আমাদের স্ব-স্ব চিন্তাজগতে অনাকাঙ্ক্ষিত এসব ঘটনা যে অনেকগুলো কপাল-ভাঁজ করা প্রশ্নবোধক চিহ্নেরও জন্ম দিয়েছে তা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাওয়ার সাথে আস্তিক্য-নাস্তিক্যবাদের কী সম্পর্ক, কিংবা জাতীয় নির্বাচন-প্রক্রিয়ায় আস্তিক্য-নাস্তিক্য চিন্তাধারা কোন্ অনুঘটকের দায়িত্ব পালন করে, অথবা আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালন-দক্ষতা ও সততার সাথে ব্যক্তিগত আধ্যাত্ম বিশ্বাস-অবিশ্বাস কী প্রক্রিয়ায় জড়িত এসব বিষয়-আশয় রাজনীতি-অপরাজনীতির অবলম্বন হতে পারে হয়তো। কিন্তু দর্শন-তাত্ত্বিক বিচারে আমাদের সমাজ-রাজনৈতিক পরিমন্ডলে তা কতোটা অনিবার্য, এ বিষয়টা নিয়ে আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র নেতৃত্বের দৃষ্টিভঙ্গি বিচারটাও সমকালীন প্রেক্ষাপটে জরুরি হয়ে উঠেছে। কিন্তু যিনি বা যারা এই বিচার করবেন তাদের দৃষ্টিভঙ্গিই বা কতোটা প্রভাবমুক্ত সেটাও বিবেচ্য নয় কি ?

Saturday, June 1, 2013

| মীমাংসা দর্শন-১৭ : বৈদিক দেবতা প্রসঙ্গে মীমাংসা-মত |

.

| মীমাংসা দর্শন-১৭ : বৈদিক দেবতা প্রসঙ্গে মীমাংসা-মত |
-রণদীপম বসু

৪.৪ : বৈদিক দেবতা প্রসঙ্গে মীমাংসা-মত


বেদে প্রচুর সংখ্যক দেব-দেবীর প্রতি স্তুতিপূর্ণ মন্ত্র-পূজাদির উপস্থিতি থেকে স্বাভাবিকভাবেই ধারণা করা যেতে পারে যে, মীমাংসকরা ঐকান্তিক অর্থে বেদপন্থী বলেই সর্বজ্ঞ সর্বশক্তিমান কোনো ঈশ্বর অস্বীকার করলেও তাঁরা অন্তত বৈদিক দেবতাদের কর্তৃত্বে বিশ্বাসী হবেন, এবং এই অর্থে তাদের মতবাদ বহু-দেববাদী হওয়াই সম্ভব। কিন্তু, আপাত-বিস্ময়কর মনে হলেও এটাই ঠিক যে, মীমাংসকরা বৈদিক দেবতাদের কর্তৃত্ব- এমনকি তাঁদের সত্তাও- সম্পূর্ণভাবেই অস্বীকার করেছেন। 

| মীমাংসা দর্শন-১৬ : মীমাংসা-মতে ঈশ্বর |

.

| মীমাংসা দর্শন-১৬ : মীমাংসা-মতে ঈশ্বর |
-রণদীপম বসু

৪.৩ : মীমাংসা-মতে ঈশ্বর


মীমাংসার মূল আলোচ্য-বিষয় অবশ্যই বৈদিক যাগযজ্ঞ বা ক্রিয়াকর্ম- আধুনিক অর্থে যা দার্শনিক আলোচনা নয়। অর্থাৎ, মীমাংসকরা তত্ত্ব-লাভের উদ্দেশ্যে দর্শন-চর্চা করেননি। তবুও তাঁরা যে অনিবার্যভাবেই দার্শনিক সমস্যা উত্থাপন ও আলোচনা করতে বাধ্য হয়েছিলেন তার কারণ এই যাগযজ্ঞে চরম বিশ্বাস স্থাপন করতে হলে বিশ্বপ্রকৃতি এবং মানবিক প্রচেষ্টাদি সংক্রান্ত একটি নির্দিষ্ট দৃষ্টিভঙ্গিও অবলম্বন করা প্রয়োজন। অনুমান হয়, সুপ্রাচীন কালে যাজ্ঞিকদের মধ্যে যজ্ঞকর্মের নানা খুঁটিনাটি নিয়ে বিভেদ ও বিতর্ক থাকলেও যে-মূল বিশ্বাসের ভিত্তিতে যজ্ঞের চরম গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত সে-সম্পর্কে সংশয়ের অবকাশ ছিলো না; সে-বিশ্বাস তাঁদের কাছে স্বতঃসিদ্ধ অতএব প্রমাণ-সাপেক্ষ না হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু কালক্রমে এই পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটে অন্যান্য দার্শনিক সম্প্রদায় গড়ে উঠার প্রেক্ষিতে সেগুলির দিক থেকে বিশ্বপ্রকৃতি ও মানবপ্রচেষ্টাদি প্রসঙ্গে যে-সব মত প্রস্তাবিত হয়েছে তার সঙ্গে যাজ্ঞিকদের মূল বিশ্বাসের অনিবার্য সংঘাতও সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিলো। ফলে প্রয়োজন হয়েছে সেই মূল বিশ্বাসের যুক্তিতর্কমূলক সমর্থন ও সংরক্ষণ এবং তার সঙ্গে অন্যান্য সম্প্রদায়ের মত খন্ডন- অন্তত অন্যান্য সম্প্রদায়ের সেই দাবিগুলি খন্ডন করবার প্রয়োজন হয়েছে যার সঙ্গে যাজ্ঞিকদের মূল বিশ্বাস ও দৃষ্টিভঙ্গির সংহতি সম্ভব নয়। এভাবেই দার্শনিকতত্ত্ব মীমাংসার মূখ্য বিষয়বস্তু না হলেও মীমাংসকরা ক্রমশই দার্শনিক আলোচনায় প্রবৃত্ত হতে বাধ্য হয়েছিলেন।  

| মীমাংসা দর্শন-১৫ : অপূর্ব-বাদ |

.

| মীমাংসা দর্শন-১৫ : অপূর্ব-বাদ |
-রণদীপম বসু

৪.২ : অপূর্ববাদ 


মীমাংসার একটি মৌলিক সিদ্ধান্ত হলো- ‘আম্লায়স্য ক্রিয়ার্থত্বম্’- অর্থাৎ, বেদের তাৎপর্য হলো ক্রিয়া।
এখানে ক্রিয়া বলতে যাজ্ঞিক ক্রিয়াকলাপ বোঝাচ্ছে। কিন্তু কেন যজ্ঞকর্ম করতে হবে ? যেহেতু বেদে যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠানের নির্দেশ রয়েছে তাই যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠান বেদ নির্দেশিত বলে তা করতে হবে। মীমাংসকরা বৈদিক যাগযজ্ঞ অনুষ্ঠানকে অনুমোদন করলেও এই সব যাগযজ্ঞ দেবতাদের তুষ্ট করার জন্য করতে হবে তা সমর্থন করেন না। তবে কোনো কর্তব্য সম্পাদন করলে কর্তব্য সম্পাদনে যে ফল লাভ হয় এ কথা মীমাংসকরা বিশ্বাস করেন। তাই লৌকিক শুভকর্ম এবং বেদ-বিহিত কর্মের অনুষ্ঠানের দ্বারা মানুষ ঐহিক ও পারলৌকিক শুভফল লাভ করতে পারে। এই ফল কোন ঈশ্বর প্রদান করে না, কেননা মীমাংসা-মতে কর্তব্য কোনো বেদ নিহিত ঈশ্বরের আদেশ নয়। মীমাংসকরা ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন না এবং তাঁরা ‘ঈশ্বর’ নামের কোনো অতি-প্রাকৃত সত্তার প্রয়োজন আছে বলে মনে করেন না। তাঁদের মতে কর্তব্য-কর্মের ফললাভ হয় কর্ম নিয়ম অনুসারে। কিন্তু এই কর্ম নিয়ম কী ?  

| মীমাংসা দর্শন-১৪ : বিধি ও অর্থবাদ |

.
| মীমাংসা দর্শন-১৪ : বিধি ও অর্থবাদ |
রণদীপম বসু

বিধি ও অর্থবাদ :
মীমাংসা-মতে যজ্ঞকথাই বৈদিক সাহিত্যের প্রাণবস্তু; অথএব বৈদিক সাহিত্যে এমন কিছুই থাকতে পারে না যা-কিনা যজ্ঞের দৃষ্টিকোণ থেকে অবান্তর। বেদের সংহিতা (মন্ত্র), ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ এসব মিলিয়ে বেদের অনেক ভাগ বলা হলেও প্রধানত বেদের দুই ভাগ- মন্ত্র এবং ব্রাহ্মণ। প্রাচীন মীমাংসকরা মন্ত্র শব্দের সঠিক সংজ্ঞা দেননি; কিন্তু সাধারণভাবে তাঁদের মতে বেদের যে-অংশ বিধির নির্দেশক নয় তবুও বৈদিক দেবতাদির নাম প্রভৃতি নির্দেশ করে যে-বাক্যগুলি যজ্ঞকর্মের সহায়ক সেগুলিকেই মন্ত্র বলে। বিভিন্ন যাগযজ্ঞে প্রযোজ্য মন্ত্রের সমাবেশ সংহিতায়। মন্ত্র ছাড়া বেদের বাকি সব অংশই ব্রাহ্মণ এবং ব্রাহ্মণ-অংশ বিধিমূলক বৈদিক ক্রিয়াকর্মের নির্দেশক। বিবিধ যজ্ঞের বিধান রয়েছে বিত্বায়কবাক্যবহুল ব্রাহ্মণে। কোন্ যজ্ঞবিশেষে কোন্ মন্ত্রবিশেষের ‘বিনিয়োগ’ হবে তার বিধান দেয়া হয়েছে। কিন্তু বেদের এই ব্রাহ্মণ-অংশে এমন অনেক বাক্য আছে যার মধ্যে কোন বিধির নির্দেশ নেই; ব্রাহ্মণ-অংশের এ-জাতীয় বাক্যকে মীমাংসকরা দু-ভাগে ভাগ করেন- অর্থবাদ এবং নাম-ধেয়।  তাই মীমাংসাশাস্ত্রে বিচার্য বিষয়ের দিক থেকে বেদের ভাগগুলি হলো- মন্ত্র, বিধি, নামধেয় এবং অর্থবাদ। আবার মন্ত্রকে বাদ দিয়ে বেদের বিধি, নিষেধ, নামধেয় ও অর্থবাদ এই চতুর্বিভাগও প্রচলিত আছে। কেউ কেউ বিচার্যের দিক থেকে বেদকে সরাসরি দুটি ভাগে ভাগ করেন- বিধি এবং (বাদবাকি সব) অর্থবাদ। 

| মীমাংসা দর্শন-১৩ : মীমাংসা তত্ত্ববিদ্যা- নীতি ও ধর্মতত্ত্ব |

.

| মীমাংসা দর্শন-১৩ : মীমাংসা তত্ত্ববিদ্যা- নীতি ও ধর্মতত্ত্ব |
রণদীপম বসু

৪.০ : মীমাংসা তত্ত্ববিদ্যা

৪.১ : মীমাংসাদর্শনে নীতি ও ধর্মতত্ত্ব


মীমাংসাশাস্ত্রে কর্মের অনুষ্ঠানকে সর্বাপেক্ষা প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। মীমাংসকদের মতে যে কর্ম বেদ নির্দেশিত অর্থাৎ বেদ যে কর্মকে ইষ্টের সাধক বলে তাই-ই ধর্ম, এবং বেদ নিষিদ্ধ কর্ম অর্থাৎ বেদ যাকে অনিষ্টের সাধক বলে তা অধর্ম। এই মতে, স্মৃতি (অর্থাৎ ঋষিদের রচিত ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থ) ও সদাচারও ধর্মে প্রমাণ বলে গৃহীত হতে পারে যদি বেদে তার বিরুদ্ধতা না পাওয়া যায়। কিন্তু তাকে বেদ থেকে পৃথক মনে করে ধর্ম বলে মানা যায় না, এইভাবেই শুধু মানা যেতে পারে যে এ রকম কোনো উক্তি পূর্বেই ছিলো যা থেকে স্মৃতি ও সদাচার তাকে গ্রহণ করেছে। বেদের বেশ কয়েকটি শব্দ লুপ্ত হওয়ায় এখন সেগুলি অপ্রাপ্য। এখানে ‘অপ্রাপ্য’ শব্দের এই অর্থ করতে হবে যে সেগুলির অভিব্যক্তি নেই, অন্যথায় নিত্য হওয়ার জন্য বেদের শব্দরাজি তো কোথাও না কোথাও সংরক্ষিত থাকবেই।

| মীমাংসা দর্শন-১২ : প্রমেয় পদার্থ |

.

| মীমাংসা দর্শন-১২ : প্রমেয় পদার্থ |
রণদীপম বসু

৩.৫ : প্রমেয় 


মীমাংসা দর্শন মতে, সমস্ত বস্তুই হয় প্রমাণ অথবা প্রমেয়ের অন্তর্গত। এই মতে, প্রমাণ হলো প্রমা বা যথার্থ জ্ঞানের করণ বা উপায়, আর প্রমেয় হলো যথার্থ জ্ঞানের বিষয়। আর প্রমেয়ভূত মূল বিষয়কে বলা হয় পদার্থ।

| মীমাংসা দর্শন-১১ : ভ্রম জ্ঞান |

.

| মীমাংসা দর্শন-১১ : ভ্রম জ্ঞান |
রণদীপম বসু

৩.৪ : ভ্রম-জ্ঞান


ভ্রম হলো ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণ অর্থাৎ একটি বস্তুকে আর একটি বস্তুরূপে প্রত্যক্ষ করা। যেমন শুক্তিতে রজত দর্শন, রজ্জুতে সর্প দর্শন ইত্যাদি। কিন্তু কেন এই ভ্রান্ত প্রত্যক্ষ ঘটে তা নিয়ে ভারতীয় দর্শনে বিভিন্ন ভ্রম-বিচার হয়েছে। উল্লেখ্য, ভারতীয় দর্শনের ইতিহাসে ভ্রম-বিচারের গুরুত্ব অত্যন্ত মৌলিক। প্রায় প্রতিটি সম্প্রদায়েরই মূল তত্ত্ব অন্তত বহুলাংশে এই ভ্রম-ব্যাখ্যার উপর প্রতিষ্ঠিত। এর সাথে ভাববাদ বনাম বাহ্যবস্তুবাদ দ্বন্দ্ব তো রয়েছেই। তাই মহামহোপাধ্যায় ফণিভূষণ তর্কবাগীশ ন্যায়সূত্রের বাৎসায়ণভাষ্যের ব্যাখ্যামূলক গ্রন্থ ‘ন্যায়দর্শন’-এ বলেছেন-
‘এই ভ্রমজ্ঞান সম্বন্ধে প্রাচীন কাল হইতেই ভারতীয় দার্শনিক সমাজে নানারূপ সূক্ষ্ম বিচারের ফলে সম্প্রদায়ভেদে নানা মতবাদ হইয়াছিল এবং এই সমস্ত মতভেদই সম্প্রদায়ভেদে বিভিন্ন মত স্থাপনের মূল ভিত্তি হইয়াছিল।’- (ন্যায়দর্শন-৫/১৭১)

| মীমাংসা দর্শন-১০ : জ্ঞানের প্রামাণ্য |

.

| মীমাংসা দর্শন-১০ : জ্ঞানের প্রামাণ্য |
রণদীপম বসু

৩.৩ : জ্ঞানের প্রামাণ্য


ভারতীয় দর্শনে ‘প্রমা’ মানে যথার্থজ্ঞান। আর পারিভাষিক অর্থে ‘প্রমাণ’ মানে প্রমার করণ। যে-অসাধারণ কারণের সক্রিয়তার ফলে একটি নির্দিষ্ট কার্যের উৎপত্তি তাকে করণ বলা হয়। এই অর্থে ‘প্রমার করণ’ বা ‘প্রমাণ’ মানে প্রত্যক্ষ অনুমানাদি যথার্থজ্ঞানের উৎস। প্রত্যক্ষই প্রত্যক্ষ-প্রমার কারণ, অনুমানই অনুমানমূলক প্রমার কারণ, ইত্যাদি। কিন্তু ‘প্রমাণ’ শব্দটি সবসময় শুধুমাত্র এই নির্দিষ্ট পারিভাষিক অর্থে ব্যবহৃত হয়নি। অনেক সময় প্রমা বা যথার্থজ্ঞান অর্থেও তা ব্যবহৃত হয়েছে। এভাবে প্রমার যে-যথার্থত্ব বা সত্যতা, তাকে বলা হয়েছে প্রামাণ্য বা প্রমাত্ব। একইভাবে অযথার্থত্ব বা মিথ্যাত্বকে বলা হয়েছে অপ্রামাণ্য বা অপ্রমাত্ব।

| মীমাংসা দর্শন-০৯ : অনুপলব্ধি প্রমাণ |

.

| মীমাংসা দর্শন-০৯ : অনুপলব্ধি প্রমাণ |
রণদীপম বসু

(৬) অনুপলব্ধি প্রমাণ :


অভাবকে অতিরিক্ত পদার্থের স্বীকৃতি দিলেও ন্যায়-বৈশেষিক ও ভাট্ট-মীমাংসক সম্প্রদায় অভাব পদার্থের জ্ঞান বা উপলব্ধির ব্যাপারে একমত নন। ভাট্ট-মীমাংসক ও অদ্বৈতবেদান্ত দর্শনের মতে অনুপলব্ধি হলো স্বতন্ত্র প্রমাণ। এই মতে অনুপলব্ধি প্রমাণ স্বীকার না করলে অভাবের জ্ঞান ব্যাখ্যা করা যায় না। অর্থাৎ অভাব পদার্থের গ্রাহক প্রমাণরূপে অনুপলব্ধি প্রমাণ অবশ্যই স্বীকার করা প্রয়োজন।

| মীমাংসা দর্শন-০৮ : অর্থাপত্তি প্রমাণ |

.

| মীমাংসা দর্শন-০৮ : অর্থাপত্তি প্রমাণ |
রণদীপম বসু

(৫) অর্থাপত্তি প্রমাণ :


মীমাংসাদর্শনে অর্থাপত্তি একটি স্বতন্ত্র প্রমা ও প্রমাণ হিসেবে স্বীকৃত। যা স্বীকার না করলে কোনো একটি অপ্রত্যক্ষ বিষয়কে ব্যাখ্যা করা যায় না তার স্বীকৃতিকে অর্থাপত্তি বলে। কোনো বিষয় যখন জ্ঞাত কোনো কারণ দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না, তখন সেই বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করতে হলে অজ্ঞাত কারণকে কল্পনা করা হয়। এই অজ্ঞাত কারণের কল্পনাই হলো অর্থাপত্তি।

| মীমাংসা দর্শন-০৭ : শব্দ প্রমাণ |

.

| মীমাংসা দর্শন-০৭ : শব্দ প্রমাণ |
রণদীপম বসু

(৪) শব্দ প্রমান :

মীমাংসাদর্শনের মূল উদ্দেশ্য হলো বৈদিক ক্রিয়াকান্ডের যাথার্থ্য ও উপযোগিতা ব্যাখ্যা করা। এবং বেদের প্রামাণ্য প্রতিষ্ঠা হলেই তা সম্ভব। সে কারণে মীমাংসকরা স্বীকৃত অন্যান্য প্রমানের চাইতে শব্দ-প্রমানের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। বেদে যাগযজ্ঞাদি কর্মের বিধান বহুল পরিমাণে বর্তমান। মীমাংসকদের মতে এই কর্মের বিধানই বেদবাক্যের প্রকৃত তাৎপর্য। বেদে যদিও সিদ্ধার্থ বাক্যও রয়েছে, কিন্তু সেগুলিরও উদ্দেশ্য হলো ঐ সকল বাক্য দ্বারা প্রকাশিত তত্ত্বগুলির অস্তিত্ব ও স্বরূপ ব্যাখ্যা করে মানুষকে কর্মে প্রণোদিত করা। 

| মীমাংসা দর্শন-০৬ : উপমান প্রমাণ |

.
| মীমাংসা দর্শন-০৬ : উপমান প্রমাণ |
রণদীপম বসু

(৩) উপমান প্রমাণ :
 
মীমাংসকরা উপমানকে একটি স্বতন্ত্র প্রমাণরূপে মনে করেন। তাদের মতে উপমানকে প্রত্যক্ষ করা যায় না। পূর্বে দেখা কোনো বস্তুর সঙ্গে বর্তমান প্রত্যক্ষীভূত কোনো বস্তুর সাদৃশ্য লক্ষ্য করে যখন সিদ্ধান্ত করা হয় যে পূর্বে দেখা ও বর্তমানে স্মৃত বস্তুটি বর্তমানে প্রত্যক্ষীভূত বস্তুর সাদৃশ, তখন সেই জ্ঞানের প্রণালীকে উপমান বলে। বলা বাহুল্য, সকল ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায় উপমানকে পৃথক প্রমাণরূপে স্বীকার করেন নি। চার্বাক, বৌদ্ধ, জৈন, বৈশেষিক ও সাংখ্য সম্প্রদায় উপমানকে পৃথক প্রমাণের মর্যাদা দেননি। মীমাংসা, বেদান্ত ও ন্যায় সম্প্রদায় উপমানকে স্বতন্ত্র প্রমাণের মর্যাদা দিলেও উপমানের স্বরূপ বিষয়ে তাঁদের মধ্যে বিশেষ করে ন্যায় ও মীমাংসা সম্প্রদায়ের মধ্যে মতপার্থক্য রয়েছে।

| মীমাংসা দর্শন-০৫ : অনুমান প্রমাণ |

.
| মীমাংসা দর্শন-০৫ : অনুমান প্রমাণ |
রণদীপম বসু

(২) অনুমান প্রমাণ :
 
‘অনুমান’ শব্দের অর্থ যার দ্বারা পশ্চাৎ জ্ঞান হয়। যেমন, পর্বতে ধূম প্রত্যক্ষ করে পশ্চাতে বহ্নির অস্তিত্বের অনুমান হয়। ‘অনু’ শব্দের অর্থ পশ্চাৎ, আর ‘মান’ শব্দের অর্থ জ্ঞান বা প্রমা। সাধারণ অর্থে অনুমান হলো সেই জ্ঞান যা অন্য জ্ঞানকে অনুসরণ করে। কোন পর্বতে ধূম প্রত্যক্ষ করে যদি বলা হয় যে, ঐ পর্বতে অগ্নি আছে, তবে এই অগ্নির জ্ঞান অনুমানলব্ধ জ্ঞান।

| মীমাংসা দর্শন-০৪ : প্রত্যক্ষ প্রমাণ |

.
| মীমাংসা দর্শন-০৪ : প্রত্যক্ষ প্রমাণ |
রণদীপম বসু

(১) প্রত্যক্ষ প্রমাণ :

প্রত্যক্ষের প্রাধান্য স্বীকার করে নিয়ে প্রায় সকল ভারতীয় দর্শন সম্প্রদায়ই প্রত্যক্ষকে পরা-প্রমাণ বা প্রমাণ-জ্যেষ্ঠ বলে অভিহিত করেছেন। মীমাংসকদের মতে বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সন্নিকর্ষই প্রত্যক্ষ জ্ঞান।

| মীমাংসা দর্শন-০৩ : মীমাংসা জ্ঞানতত্ত্ব- প্রমাণ |

.
| মীমাংসা দর্শন-০৩ : মীমাংসা জ্ঞানতত্ত্ব- প্রমাণ |
রণদীপম বসু

৩.০ : মীমাংসা জ্ঞানতত্ত্ব
 
মীমাংসা দার্শনিকেরা মূলত বেদের প্রামাণ্য প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যেই জ্ঞানের স্বরূপ, যথার্থ ও অযথার্থ জ্ঞানের পার্থক্য নির্ণয়, যথার্থ জ্ঞান লাভের উপায় এবং এতৎসংশ্লিষ্ট অন্যান্য সমস্যা সম্পর্কে আলোচনা করেন। মীমাংসা দর্শন মতে, সমস্ত বস্তুই হয় প্রমাণ অথবা প্রমেয়ের অন্তর্গত। এই মতে, প্রমাণ হলো প্রমা বা যথার্থ জ্ঞানের করণ বা উপায়, আর প্রমেয় হলো যথার্থ জ্ঞানের বিষয়।

| মীমাংসা দর্শন-০২ : মীমাংসা-সাহিত্য |

.
| মীমাংসা দর্শন-০২ : মীমাংসা-সাহিত্য |
রণদীপম বসু

২.০ : মীমাংসা-সাহিত্য
 
মীমাংসা-দর্শনের প্রাচীনতম এবং মূল গ্রন্থ হলো জৈমিনির ‘মীমাংসাসূত্র’। ভারতীয় দর্শনের সূত্রগ্রন্থ হিসেবে এটিকেই সর্বপ্রাচীন হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যদিও তার রচনাকাল সম্বন্ধে সুনিশ্চিত হওয়া যায় না। বিভিন্ন বিদ্বান-গবেষকদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী খ্রিস্টপূর্ব ২০০ থেকে খ্রিস্টীয় ২০০-এর মধ্যে হওয়াই সম্ভব। তবে আধুনিক বিদ্বানমহলে মীমাংসাসূত্র’র রচনাকাল খ্রিস্টীয় ২০০-র কিছু পূর্ববর্তী বলে বিবেচিত হয়। জৈমিনির রচনা বলেই মীমাংসাসূত্রকে ‘জৈমিনিসূত্র’ও বলা হয়ে থাকে।

| মীমাংসা দর্শন-০১ : ভূমিকা |

.
| মীমাংসা দর্শন-০১ : ভূমিকা |
রণদীপম বসু

১.০ : ভূমিকা
 
ভারতীয় দর্শনে যে ছয়টি সম্প্রদায় বেদের প্রামাণ্য স্বীকার করেন, তাঁদের মধ্যে দুটি সম্প্রদায় নিঃসংশয়ে বৈদিক বা বেদমূলক। এদের একটি হলো পূর্ব-মীমাংসা বা সংক্ষেপে মীমাংসা, অন্যটি উত্তর-মীমাংসা বা বেদান্ত।

| ভারতীয় ষড়দর্শন-০৫ : পূর্ব-মীমাংসা দর্শন |

. 
| ভারতীয় ষড়দর্শন-০৫ : পূর্ব-মীমাংসা দর্শন |
রণদীপম বসু

মীমাংসা দর্শন-সূচি (Mimamsa Philosophy)